সে সব দিন আর ফিরবে না – সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়
তাঁর চেয়ে বয়সে অনেক ছোট হলেও মান্না দে আমাকে বলতেন— সন্ধ্যাদি৷ আমি প্রথম দিকে তাঁকে মান্নাবাবু বললেও, পরে দাদা বলেই ডেকে এসেছি৷ তাঁর সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি৷ সব স্মৃতিই গানের, সুরের৷ তবে, তালের স্মৃতি বেশ জোরালো৷ এর কারণ হলেন একজন মানুষ— তবলার জাদুকর রাধাকান্ত নন্দী৷ আমাদের দু’জনের সঙ্গেই অনুষ্ঠানে তবলা বাজাতেন রাধাকান্তবাবু৷ উনি যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন আমার সঙ্গে বাজিয়েছেন৷ আবার মান্নাদার সঙ্গেও৷ এটা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে, কী করে আমাদের মতো দু’জন ব্যস্ত শিল্পীর সঙ্গেই রাধাকান্তবাবু তবলা বাজাতেন? আসলে, তখন বহু আগেই আমাদের ফাংশনের দিন ঠিক হত৷ ফলে মান্নাদার তারিখ আর আমার ফাংশনের তারিখ আমরা পরস্পরেই জানতাম৷ তাই রাধাকান্তবাবুর অসুবিধে হত না আমাদের সঙ্গে বাজাতে৷ একই ফাংশনে যদি আমাদের দু’জনের গান থাকত, তা হলে তো অসুবিধের কোনও কারণই থাকত না৷ দু’জনের সঙ্গেই উনি বাজাতেন৷ একবার মনে আছে, একই দিনে, সকালবেলায়, আমাদের দু’জনের দুটো আলাদা অনুষ্ঠান ছিল৷ আমার অনুষ্ঠান আকাদেমি অফ ফাইন আর্টসে, আর মান্নাদার রবীন্দ্রসদনে৷ তখন আমরা দু’জনে সময়টা ভাগাভাগি করে নিলাম৷ আমি আকাদেমিতে গাইলাম শুরুর দিকে, রবীন্দ্রসদনে মান্নাদা শেষের দিকে৷ ফলে আমার সঙ্গে আকাদেমিতে বাজিয়ে রাধাকান্তবাবু রবীন্দ্রসদনে গিয়ে মান্নাদার সঙ্গে বাজালেন৷ রাধাকান্তবাবুকে মাঝখানে রেখে সে একটা সুন্দর বোঝাপড়ার যুগ ছিল আমাদের৷
মান্নাদার সঙ্গে সিনেমায় প্রথম ডুয়েট গেয়েছিলাম ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ ছবিতে৷ তারপর তো আরও অনেক ছবিতে একসঙ্গে গেয়েছি৷ ‘চিরদিনের’, ‘জীবনমৃত্যু’ ইত্যাদি৷ অনিল বাগচীর অসাধারণ সুরে অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির সব গানই জনপ্রিয় হয়েছিল৷ অসাধারণ গেয়েছিলেন মান্না দে৷ ইন্ডিয়া ফিল্ম ল্যাবরেটরিতে ‘চম্পা চামেলি’ গানটা মান্নাদার সঙ্গে ডুয়েট রেকর্ডিংয়ের স্মৃতি বেশ স্পষ্ট হয়ে আছে এখনও৷ অনিলদা অসাধারণ মিউজিক ডিরেক্টর৷ অনিলদা এই গানটা তোলার সময় বার বারই কিছু না কিছু সুর পাল্টাচ্ছিলেন৷ মান্নাদা শর্টহ্যান্ডে সুরের নোটেশন করে নিচ্ছিলেন৷ কিন্তু বারবার সুর পাল্টানো চলছিলই অনিলদার৷ এক সময় মান্নাবাবু আমাকে বললেন, কী করি বলুন তো সন্ধ্যাদি৷ আমি বললাম, দাদা, এখন অনিলদা যা পাল্টালেন, সেটা একটু গেয়ে দিন৷ ফাইনাল রেকর্ডিংয়ের সময় প্রথমে শর্টহ্যান্ডে যা সুর আপনি নোট করেছেন, সেটাই গাইবেন৷ মান্নাদা তাই করলেন৷ রেকর্ডিং শেষে শুধু অনিলদা যখন জিজ্ঞেস করলেন, যেটা শেষে বলেছিলাম, সেটাই আছে তো? মান্নাবাবু ঘাড় নেড়ে সায় দিয়েছিলেন৷ অনিলদার করা সেই সুরও যে কত অসাধারণ, তা তো ধরাই আছে ‘চম্পা চামেলি’ গানে৷ নচিকেতা ঘোষের সুরে মান্নাদা ও আমি ডুয়েট গেয়েছিলাম ‘চিরদিনের’ ছবির জন্যে৷ আমায় চিরদিনের সেই গান বলে দাও— গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের যেমন লেখা, তেমন সুর নচিকেতা ঘোষের৷ আমাদের ডুয়েট গানটা ছিল উত্তমকুমার আর সুপ্রিয়ার লিপে৷ এ ছবিতে মান্নাবাবুর অসাধারণ আরও সব গান ছিল: ‘মানুষ খুন হলে পরে’, ‘ফুল পাখি বন্ধু আমার ছিল’, ‘লাল নীল সবুজের মেলা বসেছে’৷ ‘চিরদিনের’ গান যে হিট করবেই, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না নচিদার৷ তাই-ই হয়েছিল৷ নচিদার সুরে ‘স্ত্রী’, ‘নিশিপদ্ম’ থেকে ‘সন্ন্যাসী রাজা’, বহু ছবিতে মান্নাবাবুর গাওয়া গান দারুণ জনপ্রিয় হয়েছে৷ আমার স্বামী শ্যামল গুপ্তর লেখা গানও গেয়েছেন মান্নাবাবু৷ আমাদের বিয়ে হয়েছিল ১৯৬৬ সালে৷ তারও ন’বছর আগে ১৯৫৭ সালে শ্যামলবাবুর লেখা একটা গান রেকর্ড করেছিলেন মান্নাদা৷ গানের শুরুটা ছিল ‘আমি আজ আকাশের মতো একেলা’৷ শুনেছি, তখনও মান্নাদার সঙ্গে শ্যামলবাবুর পরিচয় ছিল না৷ গ্রামোফোন কোম্পানিতে শ্যামলবাবুর পাঠানো গান থেকে বেছে এই গানটা মান্নাদাকে গাইতে দেওয়া হয়েছিল৷ রেকর্ডিং হয়েছিল বোম্বেতে মানে এখনকার মুম্বইতে৷ তার পর শ্যামলবাবুর আরও গান গেয়েছেন মান্নাদা৷ সে সব দারুণ জনপ্রিয়ও হয়েছে৷ যেমন, ‘আমি নিরালায় বসে’, কিংবা ‘ও আমার মন যমুনার’ ইত্যাদি৷ মান্নাদার কথা বলতে গিয়ে যাঁদের কথা বললাম, তাঁদের কেউ-ই তো আজ আর নেই৷ মান্নাদাও চলে গেলেন৷ খুবই শূন্যতা অনুভব করছি৷ মন খুবই বিষণ্ণ৷ শুধু মনে পড়ছে, মান্নাদার জন্যে শ্যামলবাবুর লেখা প্রথম গানটাই৷ ‘আমি আজ আকাশের মতো একেলা’৷
তবে, মান্নাবাবু একলা নন৷ তাঁর সঙ্গে আছেন তাঁর গানের অনুরাগী অসংখ্য শ্রোতা৷ চিরদিনই তাঁরা মান্নাবাবুর সঙ্গে থাকবেন৷ ভারতের লক্ষ লক্ষ সঙ্গীতপ্রেমীর হৃদয়ে থাকবেন তিনি৷ অসাধারণ শিল্পী, অসাধারণ মানুষ৷ কত স্মৃতি তাঁর সঙ্গে, কত সুরের যাত্রা৷ সে সব দিন আর ফিরবে না৷ আজ বিষণ্ণ হৃদয়ে তাঁকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম৷