বৈচিত্র্যে অবিস্মরণীয় শিল্পী – অলক চট্টোপাধ্যায়

বৈচিত্র্যে অবিস্মরণীয় শিল্পী – অলক চট্টোপাধ্যায়

কী করে একজন সুবিখ্যাত কৃতী মানুষ সহজ হতে পারেন তা বোধহয় বুঝিয়ে বলা যায় না৷ বরং সেটা অনায়াসে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হিসেবে স্মৃতিতে বেঁচে থাকতে পারে দীর্ঘদিন৷ ঘটনাটা ঘটেছিল একটা সাক্ষাৎকারের শেষ পর্বে৷ মান্না দে যেহেতু সাক্ষাৎকার সম্পর্কিত কথাবার্তার স্থায়ীপর্বটা পেরিয়ে যাওয়ার পরেই তাঁর সাফল্যদীপ্ত বিশাল জীবনের নানা কথা বলতেন, তাতে দুটো কাণ্ড ঘটত৷ অনভিজ্ঞ কমবয়সী শ্রোতা কেউ থাকলে (এই ক্ষেত্রে একজন ছিল) সে একেবারে স্তব্ধ হয়ে যেত৷ আর প্রশ্নকর্তা কী করে তাঁর প্রয়োজনীয় অংশটুকু বেছে নিয়ে কাজে লাগাবেন— সেই ভাবনায় চিন্তিত হয়ে পড়তেন৷ তবে জীবন যেমন৷ এই প্রয়োজনধর্মী কাজের মধ্যেই একটা অতিপ্রয়োজনীয় সত্য যেন ঝলমল করে দুলতে থাকে৷ কী করে একজন প্রায় নব্বুই বছরের কিংবদন্তি শিল্পী তাঁর নাতনির বয়সী সঙ্গীতের ছাত্রীর গান গাওয়ার প্রশংসা করে বলতে পারেন— হয়ত কোনও অনুষ্ঠানে আবার হবে তো দেখা! এখানেই বোধহয় লুকিয়ে আছে কালের শিক্ষা৷ খ্যাতি ও সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছেও সহজ, সরল ও রসিক থাকা যে একেবারেই সহজ নয়, তা তো চারপাশের পরিবেশ-পরিস্থিতিই প্রতিনিয়ত বুঝিয়ে দেয়৷

যাঁরা মান্না দে-কে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় চেনেন ও জানেন তাঁদের অভিজ্ঞতা, তাঁদের লেখা ইত্যাদিতে স্নেহশীল মানুষটার শিল্পীমনের পরিচয় পাওয়া যায়৷ একই সঙ্গে জানা যায় তাঁর জীবন নির্মাণের গল্পও৷ কঠোর শৃঙ্খলাবোধের সঙ্গে পরিবেশ-পরিস্থিতির সুবিধে যেমন পেয়েছেন, তেমন নিরলস পরিশ্রমের দিকটাও একইরকম গুরুত্বপূর্ণ ছিল৷

অনিবার্য জীবন এগিয়ে গেলে অনেকে নিজের স্মৃতিকথায় অনেক রকম রঙ চাপিয়ে দেন, কিন্তু মান্না দে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী মানুষ৷ নিজের কথা জানাবার স্টাইলে কখনও নিজেকে স্বয়ং ঈশ্বরের বরপুত্রগোছের কাহিনী শোনাননি৷ সহজ বিশ্লেষণে মনে হয়, মানুষ মান্না দে-র নিজস্ব নির্মাণ তাঁকে তা করতে দেয়নি৷ যথাসময়ে নিজের ব্যর্থতা, ত্রুটি ইত্যাদিও একইরকম সহজ ভঙ্গিতে জানিয়েছেন৷ যথার্থ সুযোগ পেতে তাঁকেও অপেক্ষা করতে হয়েছিল৷ কোনও কোনও ক্ষেত্রে অবশ্য সময়-সুযোগ এসেছিল নাটকীয়ভাবে৷

স্কুল-কলেজের বন্ধুবর্গ এবং কাঠের বেঞ্চগুলো যে সঙ্গীতপ্রতিভাদের আত্মপ্রকাশে কতদূর সহায়তা করতে পারে তা নিয়ে হয়ত কখনও কোনও কৌতুকময় গবেষণা হবে৷ পরে সকলেই হয়ত এসব কথা বেশ সহজ করে বুঝতে পারেন৷ তা সঙ্গীতাচার্য কৃষ্ণচন্দ্র দে-র সুরসিক ভ্রাতুষ্পুত্র সেই কলেজজীবনের সঙ্গীত প্রতিভা নিয়ে কী লিখেছেন?

—’…আমি কাকার মতো করে কাকার গান এবং শচীনকর্তার মতো করে শচীনকর্তার গান গেয়ে এবং সেই গান শুনিয়ে হাততালি পেতে পেতে তখন মনে মনে ভাবতে শুরু করেছি যে, ভারতবর্ষে কাকা এবং শচীনকর্তার পরেই বুঝি সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে আমার স্থান পাকা৷ গান শেখা-টেখা মোটামুটি শেষ৷ তখন আমি রীতিমতো গায়ক প্রবোধচন্দ্র দে৷’

কিন্তু শেষ পর্যন্ত রঙ্গ-রসিকতা পেরিয়ে সেই প্রবোধচন্দ্র দে কাকার কঠোর শৃঙ্খলায় বাঁধা তালিম পেয়ে ইন্টার কলেজ মিউজিক কম্পিটিশনে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ফার্স্ট হয়েছিলেন৷ প্রতিটি ক্ষেত্র বললে যেন কৃতিত্বের পরিমাণ ছোট হয়ে যাচ্ছে৷ ক্ষেত্রগুলি ছিল ধ্রুপদ, ধামার, খেয়াল, ভজন, কীর্তন, বাউল, ভাটিয়ালি, টপ্পা গজল-এ ফার্স্ট৷ আধুনিক বাংলা গান (আধুনিক গানে সেই বছর প্রথম হয়েছিলেন সত্য চৌধুরি) আর ঠুংরিতে সেকেন্ড৷ একটু অন্যমনস্ক পাঠককে সামান্য ধাক্কা দিয়ে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়— কী প্রকার যত্নশীল পরিশ্রমে এতগুলো বিষয়ে প্রথম হওয়া যায়? পরে পরপর তিন বছর চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর একটা বিশেষ প্রাপ্তিও ঘটেছিল, পেয়েছিলেন একটা রুপোর তানপুরা৷ পরে একবার অল বেঙ্গল মিউজিক কম্পিটিশন-এ অংশ নিয়ে সব বিভাগে প্রথম হওয়ার বিবরণ লিখেছেন ১৯৩৭-এ, সেখানে দ্বিতীয় হয়েছিলেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য৷ শিল্পীকে ভালবাসার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর যোগ্যতা বিচার করবেন বিশাল সংখ্যক শ্রোতৃমণ্ডলী ও বিশেষজ্ঞ হিসেবে চিহ্নিত সমালোচকরা৷ কিন্তু সেখানেও, শিল্পীর নিজের হৃদয়-দুয়ার খোলা থাকলে অন্যরকম একটা প্রাপ্তি ঘটে৷ এবং আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথা সাধারণত লেখা হয় পরিণত বয়সে৷ মান্না দে যখন তাঁর স্মৃতিকাহিনী লিখেছেন তখন তাঁর বয়স মধ্য আশিতে পৌঁছে গেছে৷ সেই আত্মকথাতেও একজন প্রকৃত গুণী শিল্পীর মতো অতুলনীয় সত্য লিখেছেন যা সঙ্গীতের ছাত্রদের কাছে চিরকাল শিক্ষা হয়ে থাকবে— ‘…আসলে আমি তো কোনওদিনই ঠিক শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী হতে চাইনি সেভাবে৷ আমি শুধু চেয়েছিলাম যে, আমি যে-ধরনের লঘু সঙ্গীত এবং আধুনিক গান গাই বা গাইব ভবিষ্যতে তা ঠিকভাবে গাইতে পারার জন্য গলার যে সাবলীলতা অত্যন্ত দরকার, সেটা আনার জন্যই শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শেখাটা আমার কাছে অত্যন্ত জরুরি৷’

প্রকৃত শিক্ষা কখনও প্রমাণের অপেক্ষায় থাকে না৷ যদি কারও তেমন কোনও সন্দেহ প্রভাবিত ভ্রুকুঞ্চন থাকে তাহলে তিনি যেন হিন্দি ও বাংলা চলচ্চিত্রে রাগ-রাগিণী নির্ভর গানগুলো শুনতে শুরু করেন৷ পাতিয়ালা ঘরানার উস্তাদ আব্দুল রহমান খাঁ ও উস্তাদ গোলাম মুস্তাফা খাঁ সাহেবের কাছে পাওয়া শিক্ষার বিচ্ছুরণ আছে গানগুলোতে৷ এ প্রসঙ্গেও একটা চিরস্মরণীয় স্মৃতিচারণা করেছেন— ‘যখন ছায়াছবির নেপথ্য-গায়ক হিসেবে আমার একটু নামডাক হয়েছে তখনও আমি লক্ষ্য করতাম যে, আমি গানের স্কেলের নিচের দিকে বেশ সুন্দর গলা খুলে গাইতে পারলেও, ওপর দিকে গলা যেন ঠিকমতো উঠছে না৷ তখন আমি ওস্তাদজির শরণাপন্ন হয়েছিলাম৷ উনি আমায় অভয় দিয়ে বলেছিলেন, এটা কোনও চিন্তার কারণই নয়৷ কিছু দিন তিনি আমায় আমি যে-স্কেলে গান করি তার পঞ্চমকে ষড়জ করে রেওয়াজ করতে বললেন৷ আমি তো বরাবর ডি-শার্প স্কেলে গান করেছি৷ ওস্তাদজির উপদেশ মতো কিছুদিন পঞ্চম ষড়জ হিসেবে রেওয়াজ করেই দেখলাম আমার গলা নিয়ে আমি ইচ্ছেমতো সুরের জগতে বিচরণ করতে পারছি— উদারা, মুদারা, তারাতে৷ তারপর থেকে যে-কোনও স্কেলে, যে-কোনও জায়গায় স্বচ্ছন্দে গলা দিতে শিখে গেলাম আমি৷’

অন্য দৃষ্টিতে দেখলে বিষয়টা বোধহয় সমাজবিজ্ঞানীদের আওতায় পড়ে৷ কী করে বা কেন একজন স্রষ্টার বিশেষ দক্ষতা যথোপযুক্ত মর্যাদায় আলোচিত হয় না, তার উত্তরও পাওয়া যায় না৷ বাংলা গানের ক্ষেত্রে সুরকার মান্না দে-র দক্ষতা-যোগ্যতা নিয়ে তেমন বিশ্লেষণ তো দূরের কথা, সেইভাবে আলোচনাই হয়নি কখনও৷ তাতে অবশ্য তাঁর কোনও ক্ষতি হয়নি, বঞ্চিত হয়েছেন সঙ্গীতের ছাত্র ও তরুণ শিল্পীরা৷

দীর্ঘ জীবন যেন নিজের স্বাভাবিক অভ্যাসেই মানুষকে অতুলনীয় অভিজ্ঞতায় ধনী করে৷ সহজ মানসিকতার মানুষ মান্না দে নিজেই এক সাক্ষাৎকারে ঘটনাটা শুনিয়েছিলেন৷ প্রবীণ ও প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীত পরিচালক অনিল বিশ্বাস একটা গান লিখে, সুরারোপ করে মান্না দে-কে গাইতে অনুরোধ করেছিলেন৷ গানটা দেখে এবং ভেবে, সবিনয়ে তাঁর অনিলদাকে বললেন, গানটা তিনি অবশ্যই গাইবেন, কিন্তু সুরটা হবে তাঁর নিজের, যদি অবশ্য অনিলদা অনুমতি দেন তবেই৷ শিল্পীমনের আর্তি বুঝতে দেরি হয়নি অভিজ্ঞ অনিল বিশ্বাসের৷ তিনি অনুমতি দিতেই মান্না দে নিজের সুরে গানটি গেয়েছিলেন৷ শিল্পী ও সুরকার মান্না দে-র জীবনের সেরা গানগুলির মধ্যে স্থান পেয়ে যাবে গানটি, হয়ত তাঁর শ্রোতৃমণ্ডলী তেমনই মনে করে এসেছেন—

‘চাঁদের আশায় নিভায়ে ছিলাম

যে দীপ আপন হাতে’ (১৯৫৮)

মনে রাখতে হবে মান্না দে তার মাত্র পাঁচ বছর আগে থেকে বাংলা গানে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন, অর্থাৎ বাংলা গানে তাঁর বেসিক রেকর্ডের প্রকাশ ঘটেছিল৷ শ্রদ্ধেয় অনিল বিশ্বাসের লেখা গান বলেই তিনি গভীরতর প্রচেষ্টায় সুরারোপে মগ্ন হয়েছিলেন— এমন ব্যাখ্যা যদি কেউ করেন, করতেই পারেন৷ কিন্তু একই সঙ্গে সুরকার মান্না দে-র আত্মবিশ্বাস ও আন্তরিক ইচ্ছের কথাটাও মনে রাখতে হবে৷

সুরগুলোই যেখানে সাক্ষী, সেখানে অন্যদের, অন্য তর্কসাথীদের ডেকে আনার কী প্রয়োজন৷ বাংলা গানের আরও কয়েকজন কৃতী সঙ্গীত ব্যক্তিত্বদের মতোই মান্না দে-ও নিজের সুরেই গান গেয়ে পথচলা শুরু করেছিলেন৷ সারা জীবনই মাঝে মাঝে শিল্পী মান্না দে-র গানে শ্রোতারা সুরকার মান্না দে-কে খুঁজে পেয়েছেন৷ কিন্তু খুব সহজ, স্বাভাবিক কারণে প্রতিষ্ঠা ও স্বীকৃতির প্রশ্নে শিল্পী-জীবনের প্রথম বছরগুলো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল৷ ১৯৫৩ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত, এই সময়ের মধ্যে প্রকাশিত মোট ১৬টি গানের মধ্যে তাঁর নিজের সুর ছিল ১২টি গানে৷ সুররসিক পাঠকবৃন্দ, সেই ১২টি গান ছিল— ‘কত দূরে আর নিয়ে যাবে বল’ (গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার), ‘হায় হায় গো রাত যায় গো’ (গৌরীপ্রসন্ন), ‘তুমি আর ডেকো না’ (গৌরীপ্রসন্ন), ‘তীর ভাঙা ঢেউ আর’ (গৌরীপ্রসন্ন), ‘চাঁদের আশায় নিভায়ে ছিলাম’ (অনিল বিশ্বাস), ‘এই কূলে আমি আর ওই কূলে তুমি’ (বঙ্কিম ঘোষ), ‘এ জীবনে যত ব্যথা পেয়েছি’ (প্রণব রায়), ‘আমি সাগরের বেলা’, (প্রণব রায়), ‘ও আমার মন যমুনার অঙ্গে অঙ্গে’ (শ্যামল গুপ্ত), ‘আমি নিরালায় বসে বেঁধেছি’ (শ্যামল গুপ্ত), ‘আমার না যদি থাকে’ (পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়) ‘জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি’ (পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়); এরপর সবিনয় প্রশ্ন, এই গানগুলোর মধ্যে কোনটা জনপ্রিয় হয়নি? কোনও একটা গানও কি অক্ষম সুরারোপের জন্য নিষ্প্রভ হয়েছিল?

বারবার নানা কৌতূহল ও প্রশ্নে জীবনের কাছেই ফিরে আসতে হয়৷ আর বৃদ্ধ জীবনমশাই মৃদু হেসে শুধু মাথা নাড়েন যেন৷ এখন যাঁরা অনিবার্যভাবে প্রবীণ, তাঁদের মনেও প্রশ্নটা উঠতে পারে৷ ১৯৫৩-তে দুটো অনবদ্য গান (কত দূরে আর/হায় হায় গো) শোনানোর পরেও কেন পরবর্তী বাংলা গানের রেকর্ডের জন্য ১৯৫৬ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া কঠিন, কেউ জানেন কি?

সুরকার মান্না দে অন্য কৃতী সুরকারদের মতোই মনে মনে সুর খুঁজে বেড়িয়েছেন৷ বিশেষ করে বাংলা গানের গায়ক হিসেবে তাঁর জীবনের প্রথম দিকে তো বটেই৷ অন্য উৎসুক, সুররসিকদের চেয়ে তাঁর নিজের বক্তব্য হয়ত আরও কাছে পৌঁছে দেবে৷

‘…বন্ধুদের গলায় শুনে শুনে যখন বিদেশি সঙ্গীতের ওপর রীতিমতো আকর্ষণ জন্মে গেল, ভালবেসে ফেললাম, তখন চেষ্টা করলাম সেইসব গানের রেকর্ডগুলো শুনতে৷ রেডিওতে এই ধরনের গান হলে শুনতে চেষ্টা করতাম৷ ফলে কিছু দিনের মধ্যেই পরিচিত হয়ে উঠলাম এই ধরনের গানের সঙ্গে গায়কদের নাম এবং তাঁদের কণ্ঠস্বরের সঙ্গে৷ পরিচিত হলাম ইংরেজি গানের প্রবাদ প্রতিম ব্যক্তিত্ব— বিং ক্রসবি, পেরি কমু ফ্রাঙ্ক সিনত্রা, জিম রিভস প্রমুখের নামের সঙ্গে৷ …জিম রিভসের একটি বিখ্যাত গান ছিল— ‘Oh Dawny Boy, Down the mountain side the summer’s gone… জিম রিভসের গায়কীটাও ছিল অসাধারণ৷ গানের মধ্যে কোথায় যেন একটা ভীষণ একাকিত্বের দুঃখ লুকিয়ে আছে— যা আমায় ভাবাত, কাঁদাত, উদাস করে দিত৷ মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম, যদি কোনওদিন সুযোগ পাই এ গানকে আমি আমার গানে নতুন করে জন্ম দেব৷’

সুরকার ও শিল্পী মান্না দে কথা রেখেছিলেন ‘শ্যামল গুপ্তের লেখা— ‘আমি আজ আকাশের মতো একেলা’ গানটিতে খুব সচেতনভাবে আমি এই সুরের প্রভাব রেখেছিলাম৷ কল্যাণ ঠাটের সুরের প্রভাব একটা অসাধারণ মাত্রা এনে দিয়েছিল সে-গানে৷’ জিম রিভস-এর একটা অন্য গানকেও কাজে লাগিয়ে মান্না দে তৈরি করেছিলেন৷ বাংলা গানের বিশ্বস্ত শ্রোতারা নিশ্চয় আজও মনে রেখেছেন সেই গানটা— ‘হায় হায় গো রাত যায় গো, দূরে তবু রবে কি৷’ মান্না দে সহজ-সরল প্রকৃতির মানুষ৷ সম্ভবত সেই কারণে সত্যের স্বাভাবিক প্রকাশ ঘটিয়েছেন৷ অভিজ্ঞ শ্রোতা মাত্রই জানেন সেই আমলে বা এই আমলেও বিস্তর সংখ্যক সুপারহিট গান নির্মিত হয়েছে৷ এই প্রশ্নে বাংলা, হিন্দি ও অন্য ভারতীয় ভাষার চলচ্চিত্রের গানের একটা বড় অংশ জড়িত৷ এবং এটা কোনও অপরাধ নয়৷ কেবল দেখতে হবে সেটা, অর্থাৎ সেই সৃষ্টিটি একেবারে অবিকল চেহারা না নেয়৷ লঘু সঙ্গীতের ক্ষেত্রে গানের সুরের চলন ছাড়া গানের কথা ও গায়কীর উৎকর্ষতাও গানটির চূড়ান্ত চেহারা নির্মাণে রীতিমতো বড় ভূমিকা নেয়৷ যদি তা না হত, তাহলে সুরকার ও গীতিকাররা একজন সত্যিকারের দক্ষ গায়ক বা গায়িকার জন্য ব্যাকুল হতেন না৷

সুরকার মান্না দে সচেতনভাবে বৈচিত্র্যের সন্ধান করেছেন৷ করারই কথা, গোটা দেশের সর্বত্র গান শুনিয়ে, অধিকাংশ ভারতীয় ভাষায় গান গেয়ে, অসংখ্য গান শুনে তাঁর অনুভব-উপলব্ধি তৈরি হয়েছিল৷ সঙ্গীতের নানা দিকের তালিমও নিশ্চয় তাঁকে সাহায্য করেছিল৷ একটা গানের সুরারোপ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন— ‘একবার ভেবেছিলাম রাগ সঙ্গীতে যে-রকম আলাপের পর সুরের বিস্তার হয়— সেটা করলে কেমন হয়? পুলকবাবুকে বলতেই একটি সুন্দর গান লিখে দিলেন— ‘কথা দাও, আবার আসবে৷’ এই গানে ‘কথা দাও’-এর ওপরে ওই রাগাশ্রয়ী গানের বিস্তারের মতো অনেকটা বিস্তারও আমি করেছিলাম৷ আমি জানি, আমার এই পরীক্ষা সফল হয়েছিল৷ আমার গানের শ্রোতাদের সেই গান খুবই পছন্দ হয়েছিল৷’ যে গানটা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে সেটা ১৯৭৩-এর গান৷ বস্তুত সুরকার মান্না দে নানা ধরনের বৈচিত্র্যময় চলনের সুর তৈরি করতে শুরু করেছিলেন অনেক আগেই৷ তাঁর নিজের গানেই শুধু নয়, অন্য শিল্পীদের জন্য তৈরি গানের সুরারোপে তাঁর শিক্ষা, অনুভব ও বৈচিত্র্যপিয়াসী মনের ছবি ধরা পড়েছে৷ ১৯৫৯-এ আশা ভোসলের জন্য সুরারোপিত দুটো গানই তাঁর নির্ভুল প্রমাণ— ‘যে গান তোমায় আমি শোনাতে চেয়েছি বারে বার (কথা: আনন্দ মুখোপাধ্যায়)/ ‘আমি খাতার পাতায় চেয়েছিলাম’ (কথা পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়)৷

সকল রসিক ও অভিজ্ঞ শ্রোতাই জানেন শিল্পী নিজেই সুরকার হলে গানটি গাওয়ার ক্ষেত্রে এক ধরনের বাড়তি সুবিধা, স্বাধীনতা থাকে৷ হয়ত বা আত্মবিশ্বাস-এর কথাও এ-প্রসঙ্গে বলা যায়৷ বাংলা গানে মান্না দে তাঁর নিজের গানের সুরকার হিসেবে চমৎকার বৈচিত্র্য হাজির করেছিলেন৷ একই সুরকার ‘এ জীবনে যত ব্যথা পেয়েছি’, ‘আমি নিরালায় বসে বেঁধেছি’, ‘জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি’ এবং ‘সেই তো আবার কাছে এলে’-র সুর করেছেন— এই বৈচিত্র্যের কথা ভাবার সঙ্গে সঙ্গে মনে রাখতে হবে গানগুলোর সুরারোপ ঘটেছে পাঁচ বছরের মধ্যেই (১৯৫৮ থেকে ১৯৬৩)৷ একইরকম ভাবে বৈচিত্র্যের প্রশ্নে আকর্ষণীয় ও বিপুলভাবে জনপ্রিয় হয়েছিল ১৯৬৯ ও ১৯৭০-এর চারটি গানই৷ (‘রঙ্গিনী কত মন, মন দিতে চায়’/’ললিতা গো ওকে আজ চলে যেতে বল’— ১৯৬৯; ‘এ তো রাগ নয়, এ যে অভিমান’/’সুন্দরী গো দোহাই দোহাই’— ১৯৭০) এখানে একটা অকিঞ্চিৎকর কৌতুকের প্রসঙ্গ এসে পড়ছে৷ গীতিকার (পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়) ও সুরকার-শিল্পীর পছন্দ ও বিবেচনায় নিশ্চয় কোনও সমস্যা হয়নি, কিন্তু এক শ্রেণীর শ্রোতৃমণ্ডলীর কাছে ‘ললিতা গো’ সামান্য বিভ্রান্তিকর মনে হয়েছিল৷ ‘সখী ললিতাকে যিনি অনুরোধ ও অনুযোগ করে বলছেন তিনি নিশ্চয় শ্রীমতী রাধিকা, তাহলে সেটা পুরুষকণ্ঠে গাওয়া যায় কী করে?’ কিন্তু প্রবল জনপ্রিয়তায় কারও বোধহয় গানের মধ্যের এই প্রশ্নটা মনে ছিল না৷

একজন পরিণত বয়সের শিল্পী তাঁর বিপুল অভিজ্ঞতা এবং সঙ্গীত সম্পর্কিত বিচার-বিবেচনা থেকে কোনও পরামর্শ দেন, তখন তার একটা বিশেষ মূল্য থাকে৷ একদা হৈমন্তী শুক্লাকে নিজেরই সুরে একটা গান শেখাচ্ছিলেন৷ সুরারোপ ও গায়নভঙ্গি প্রসঙ্গে মান্না দে বলেছিলেন— ‘বাংলা গানে বেশি কালোয়াতি করো না৷’ এখানে সমস্যার চরিত্র একটু অন্যরকম৷ যে-পাত্রে বারুদ ঠাসা, তার কাছাকাছি কোথাও আগুন নিয়ে গেলেই বিস্ফোরণের সম্ভাবনা থাকে৷ মান্না দে এবং হৈমন্তী শুক্লা দুজনেই মার্গসঙ্গীতে শিক্ষিত শিল্পী৷ সামান্য সুযোগ পেলেই তাঁদের অন্তরস্থিত যোগ্যতা-দক্ষতা মিশ্রিত কালোয়াতি বেরিয়ে পড়ারই কথা৷ নির্ভেজাল কালোয়াতি না হয়, না-ই করা হল, কিন্তু তার সামান্য ছোঁয়ায় যদি গানটার চেহারাই বদলে যায়, তাতে আপত্তির কি কোনও কারণ আছে? গায়ক মান্না দে নিজেই কাণ্ডটা ঘটিয়েছেন বলেই কথাগুলো লিখতে হল৷ তবে সেক্ষেত্রে সুরারোপের কৃতিত্ব ছিল তাঁর ছোটভাই প্রভাস দে ও রতু মুখোপাধ্যায়ের৷ এবং সেক্ষেত্রে নির্ভুল বিবেচনার সঙ্গে কয়েক চামচ বাড়তি ভালবাসা প্রাপ্য হয়ে যায় এই সুরকারদের৷ তাঁরা মান্না দে-র মতো মার্গসঙ্গীতে শিক্ষিত শিল্পীকে কাজে লাগিয়েছিলেন বলেই শ্রোতারা ‘অভিমানে চলে যেও না’ (সুরকার— রতু মুখোপাধ্যায়), ‘গহন মেঘের ছায়া ঘনায় সে আসে’ ও ‘কে তুমি তন্দ্রাহারিণী’ (সুরকার— প্রভাস দে) শুনতে পেয়েছিলেন৷ শুরুর সময়ের পরেও নিজেই নিজের গানে সুর দেওয়ার সিদ্ধান্ত না নিলে সগৌরব সুরকার মান্না দে অনেকটাই অজানা থেকে যেতেন৷ রাগাশ্রয়ী গানের ক্ষেত্রে তাঁর নিজেরই সুর করা ‘কেন ফিরে যায় বেদনায় অভিমানিনী’ গানটিও স্মরণীয় হয়ে থাকবে৷

গায়ক মান্না দে-র যোগ্যতা, জনপ্রিয়তা অর্জনের ক্ষমতা এবং বৈচিত্র্যে উজ্জ্বল নানা ধরনের গান গাইবার দক্ষতা বুঝতে শ্রোতাদের বেশি সময় লাগেনি৷ সময়ের হিসেবে চোখ রেখে বলতে গেলে সেটা ওই গত শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকেই প্রমাণিত হয়েছিল৷ এবং এই বিস্ময়ের ক্ষেত্রে বাংলা আধুনিক গান থেকে বাংলা-হিন্দি চলচ্চিত্র— সর্বত্রই তিনি স্বমহিমায় হাজির৷ শিল্পী মান্না দে বৈচিত্র্যের প্রশ্নে কাউকে তাঁর কাছাকাছিই আসতে দেননি৷ সিনেমাও যেন তাঁকে এই ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল৷ শ্রোতা ও পাঠককে সবিনয় অনুরোধ, তিনি এই তুচ্ছ রচনায় উল্লেখিত গানগুলোকে নিজের স্মৃতির অলৌকিক টানে স্মরণ করেন৷

একই মান্না দে ১৯৫৬-তে গাইছেন ‘এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয়’ (একদিন রাত্রে/সঙ্গীত পরিচালক— সলিল চৌধুরি), ১৯৫৮-তে গাইছেন— ‘মনরে আমার শুনলি না বারণ’ ও ‘ওগো তোমার শেষ বিচারের আশায়’ (ডাক হরকরা)/ সঙ্গীত পরিচালক— সুধীন দাশগুপ্ত), ১৯৫৯-এ গাইছেন— ‘এমন বন্ধু আর কে আছে’ (দীপ জ্বেলে যাই/সঙ্গীত পরিচালক— হেমন্ত মুখোপাধ্যায়), ১৯৬০-এ গাইছেন— ‘উথালি পাথালি আমার বুক’ (‘গঙ্গা’/সঙ্গীত পরিচালক— সলিল চৌধুরি), ১৯৬২-তে গাইছেন— ‘রাধা চলেছে মুখটি ফিরায়ে’ (‘সরি ম্যাডাম’/সঙ্গীত পরিচালক— বেদ পাল)৷ এই উদাহরণ তালিকা যে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে পারে তা অভিজ্ঞ শ্রোতারা বিলক্ষণ জানেন৷ এই সংক্ষিপ্ত তালিকায় যে-ক’জন সঙ্গীত পরিচালকের নাম লেখা হয়েছে, তাঁরা যে নিজেদের কাজে কতদূর কৃতী সেই সত্যই বা কতজনের কাছে অজানা তথ্য? খুব স্বাভাবিক উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতায় তাঁরা বুঝেছিলেন সেই বিশেষ বিশেষ গানগুলো মান্না দে মহাশয় ছাড়া অন্যদের দিয়ে গাওয়ানো যাবে না৷ আরও বাস্তবিক অনুভবে ঘোষণা করা উচিত, বৈচিত্র্য ও যোগ্যতায় শিল্পী মান্না দে-কে ব্যবহার করার কারণ তাঁর নিজস্ব অনুভব, উপলব্ধির ক্ষমতা ছাড়া নিবেদিতপ্রাণ গাইয়ে হওয়ার প্রবণতা৷

একেবারে শেষ বয়সে পৌঁছেও মান্না দে তাঁর অতুলনীয় সঙ্গীতপ্রেম নির্ভর চিন্তা-ভাবনাতেই নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন৷ নিজেরই গাওয়া গান সম্পর্কে খুঁতখুঁতে থাকাটাও প্রকৃত শিল্পীজনোচিত গুণ৷ ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ ছবির গানগুলো যে অবিশ্বাস্য রকমের জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল তার প্রধান কারণ সম্ভবত একেবারে প্রায়-অলৌকিক নিয়ন্ত্রণধন্য গায়কী৷ ছবিতে এই গান দুটোর (‘আমি যামিনী তুমি শশী হে’ ও ‘আমি যে জলসাঘরে’) পরিস্থিতি, উত্তমকুমারের উচ্চতম শ্রেণীর সঙ্গীতাভিনয় ইত্যাদি সবই শিল্পীর গায়নক্ষমতার পরে গুরুত্ব পাবে৷

নিজের কথা নিজেই বললে এবং সেই বক্তা যথার্থ রসিক হলে স্মৃতিও বোধহয় সাহায্য করে৷ ‘একদিন রাত্রে’ ছবির সেই বিখ্যাত গান (‘এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয়’) ছিল স্বনামধন্য ছবি বিশ্বাসের মুখে৷ এবং প্রবীণ ছবি বিশ্বাস ছিলেন মান্না দে-র কাকা অবিস্মরণীয় কৃষ্ণচন্দ্র দে-র বন্ধু৷ এ প্রসঙ্গে মান্না দে তাঁর আত্মজীবনীতে লিখছেন— ‘…আরে মানা, এটা তুমি কী করেছ? গানের মধ্যে এরকম সমস্ত বেলেল্লাপনা ঢুকিয়েছ, মাতলামি— আমি এই লিপ দেব কেমন করে? আরও একটু সহজ করে গাইতে পারলে না গানটা?’ গুণে, যোগ্যতায় বড় মানুষদেরও কত রকমের কৌতুকবোধ থাকে, যাঁরাই ‘একদিন রাত্রে’ ছবিটা দেখেছেন, তাঁরাই জানেন ছবি বিশ্বাস কেমন সঙ্গীতাভিনয় করেছিলেন৷

হিন্দি সিনেমাতেও বৈচিত্র্যময় গানে মান্না দে চিরকালই এক ধরনের বিশেষ স্বীকৃতি পেয়েছিলেন৷ পেয়েছিলেন তেমন গান গেয়েছিলেন বলেই৷ এবং এসব সত্য নতুন করে পাঠকদের কাছে জানানোরও বিশেষ প্রয়োজন নেই, শুধু তাঁদের স্মৃতি উস্কে দেওয়া ছাড়া৷

হিন্দি ছবিতে বৈচিত্র্যের উদাহরণ-তালিকা করতে গেলে তালিকাটি বোধহয় চেষ্টা করেও ছোট করা যাবে না৷ কারণ হিসেবে গানের সংখ্যা ছাড়া বহুসংখ্যক সঙ্গীত পরিচালকের কথাটাও মনে রাখতে হবে৷ সকলেই সলিল চৌধুরি নন৷ ‘বম্বে ইয়ুথ কয়ার’ গড়া ছাড়াও সলিল চৌধুরি গায়ক মান্না দে-কে নানাভাবে জানতেন৷ নিজের নানা ধরনের গানও উনি মান্না দে-কে দিয়ে গাইয়েছিলেন৷ ১৯৫৩-তে বিমল রায়ের ছবি ‘দো বিঘা জমিন’ ছবিতে যে মান্না দে গেয়েছিলেন— ‘আরে তক নাগিন নাগিন গিন রে’ সঙ্গীত পরিচালক— সলিল চৌধুরি, ১৯৬০-এ সলিল চৌধুরির সুরেই ‘পরখ’ ছবিতে গেয়েছিলেন— ‘কেয়া হাওয়া চলি’৷ ১৯৬১-তে ‘কাবুলিওয়ালা’তে গেয়েছিলেন ‘অ্যায় মেরে প্যায়ারে বতন’ (সঙ্গীত পরিচালক— সলিল চৌধুরি)৷ এবং কী করে ভোলা যাবে ‘আনন্দ’ ছবির সেই গান (জিন্দেগী ক্যায়সি হ্যায় পহেলি’)৷

হিন্দি ছবিতে রাগাশ্রয়ী গান গাইবার প্রশ্নে মান্না দে-র বিশেষ যোগ্যতার স্বীকৃতিও যেন এসেছিল বিশেষভাবে৷ এবং স্বয়ং লতা মঙ্গেশকর এ-প্রসঙ্গে ঠিক কী বলেছিলেন তা-ও বোধহয় বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে জানা প্রয়োজন—

‘Manna Dey is a very nice and good man. Plain speaking. I often visited him and we frequently ate together. I talked nonsense with him and enjoyed his company. He can sing all types of compositions, but when he records songs based on classical music, these are especially good. We sung many duets together and they have worked well. Mannada always helped me sing classical songs. Comedic songs were also his forte. His voice is deep and more mature. Unlike Rafi Sahib or Talat Sahib, who could sing for an actor of any age, Manna Dey’s singing did not sound as youthful. His voice suited Raj Kapoor and Mehmood very well. What a wonderful time it was. We all worked together then, loved each other like brother and sisters.

Page 59, ‘Lata Mangeskar …in her own voice’

– Conversations with Nasreen Munni Kabir.

মানুষের জীবনে সম্ভবত সবচেয়ে দুর্লভ স্বীকৃতি ‘ভাল মানুষ’ হওয়া৷ আর যাঁরাই ভাল মানুষ তাঁদের অধিকাংশই ওই plain speaking৷ সাধারণ সঙ্গীত রসিকদের মতো লতা মঙ্গেশকরও যদি বলেন মান্না দে সব ধরনের কম্পোজিশন গাইতে পারেন, তখন আলোচনা ও বিতর্ক— দুটোই প্রায় শেষ হয়ে যায়৷

কেবল একটা কথা, মান্না দে-র কণ্ঠ ততটা তারুণ্যদীপ ছিল না বলে লতাজি উল্লেখ করেছেন, এই কথাটা বোধহয় ততটা সত্য নয়৷ একটা ছোট্ট উদাহরণ হয়ত রসিক ও অভিজ্ঞ দর্শক-শ্রোতাদের স্মৃতিতে আলোড়ন ফেলতে পারে৷ পরিচালক হৃষিকেশ মুখার্জির ‘বাবুর্চি’ (১৯৭২)-তে বিলাওল আশ্রিত একটা গান ছিল— ‘ভোর আয়ি গয়ি আন্ধিয়ারা’৷ বস্তুত সেটা একটা অসাধারণভাবে আয়োজিত (যা বোধহয় কেবল হৃষিকেশ মুখার্জির পক্ষেই নির্মাণ করা সম্ভব ছিল) আয়োজিত সম্মেলক সঙ্গীতের দৃশ্য, সেখানে প্রধান গায়ক মান্না দে৷ এবং হিন্দি ছবির অবিস্মরণীয় সঙ্গীতপরিচালক মদনমোহন মান্না দে-র সঙ্গে গাইবার জন্য কাজে লাগিয়েছিলেন যাঁদের, তাঁদের নাম— কিশোরকুমার, লক্ষ্মীশঙ্কর, নির্মলা দেবী ও হরীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়কে৷ কায়ফি আজমির লেখা সেই গানটি পারিবারিক নাটকধর্মী ছবির একটা গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যও বটে৷ ছবিতে সেই গানটির মূল গায়ক বিস্ময়কর গুণী ভৃত্য রাজেশ খান্না৷ এবং সঙ্গীতে রীতিমতো শিক্ষিত ভৃত্যমশাই সেই ছবিতেই আরও একটা গান (একক সঙ্গীত) গেয়েছিল, সেটি রাগ ‘হেমন্ত’-নির্ভর ‘তুম বিন জীবন’, বিনীত প্রশ্ন, প্রায় তরুণ রাজেশের মুখে রাখা গানদুটো কি ততটা তারুণ্যহীন ছিল?

হিন্দি ছবিতে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতনির্ভর গান গাওয়ার ক্ষেত্রে মান্না দে-র ভূমিকা প্রকৃত অর্থেই অবিস্মরণীয়৷ প্রাণপণ চেষ্টাতেও সেই তালিকাকে ছোট করা যাবে না৷ যাঁরা হিন্দি ছবির এইসব গান শুনতে অভ্যস্ত, তাঁরাই যে-কোনও সময়ে প্রসঙ্গটা তুললেই দশ-পনেরো-কুড়িটা গানের উল্লেখ করে ফেলবেন৷ যেমন ‘ভৈরবী’ আশ্রিত— ‘লাগা চুনরি মে দাগ’ (‘দিল হি তো হ্যায়’), ফুল গেঁদোয়া না মারো (‘দুজ কা চাঁদ’), আহির ভৈরো আশ্রিত— ‘পুছো না ক্যায়সে ম্যায়নে’ (‘মেরি সুরত তেরি আঁখে’), রাগেশ্রী নির্ভর— ‘কৌন আয়া মেরা মন কে দুয়ারে’ (‘দেখ কবিরা রোয়া’), ‘ছায়ানট’-এ গাওয়া— ‘তেরে নয়না তলাশ করে’ (‘তলাশ’), দরবারি কানাড়া-য় নির্মিত— ‘ঝনক ঝনক তোরি বাজে পায়েলিয়া’ (‘মেরে হুজুর’)৷ এবং তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে৷

বৈচিত্র্যের প্রশ্নে অন্যকথায় যাওয়ার আগে সরল মানসিকতার ভাল মানুষ মান্না দে-র তাঁর সঙ্গীত পরিচালকদের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালবাসা জানানোর কথাও একটু বলা দরকার৷ শচীন দেববর্মন ও সলিল চৌধুরি ছাড়া শঙ্কর-জয়কিষানের প্রতিও অসম্ভব শ্রদ্ধাশীল ছিলেন৷ এই সঙ্গীতপরিচালক জুটির সুরে বিস্তর হিট গান গেয়েছিলেন মান্না দে৷ সঙ্গীতরসিক ও মান্না দে-বিশেষজ্ঞ রূপায়ণ ভট্টাচার্য তাঁর বইয়ে এ সম্পর্কে একটা চমৎকার তথ্য পাঠকদের উপহার দিয়েছেন, ‘সুরকার থেকে সিরিয়াসলি গায়ক হওয়ার ভাবনা শঙ্কর জয়কিষানই মান্নাকে প্রথম ঢোকান মাথায়৷ সেই সতর্কবার্তা মান্না যে কতবার নিজে বলেছেন, ‘মান্নাবাবু, গায়ক হতে চাইলে কিন্তু সুরকার হওয়া যাবে না৷ দুটো কাজ একসঙ্গে করা যাবে না৷’

তা বাঙালিদের হিন্দি ও উর্দু উচ্চারণের খ্যাতিও বহুকালের৷ রূপায়ণই ওই শঙ্কর জয়কিষানের গায়ক সম্পর্কিত পরামর্শ জানানোর পরেই জানিয়েছেন নৌশাদ-এর উক্তিও— ‘মান্নাজী কা তো ভয়েস আচ্ছা হ্যায়৷ লেকিন আলফাজ আচ্ছা নেহি হ্যায়৷’ সহজেই অনুমান করা যায়, প্রকৃত দক্ষ গাইয়ে হওয়ার জন্য প্রকৃত সঙ্গীতশিক্ষা, প্রবল ইচ্ছে থাকা ছাড়া এই ধরনের একান্ত প্রয়োজনীয় পরামর্শকেও সমান গুরুত্ব দিয়েছিলেন মান্না দে৷

গায়ক মান্না দে-র প্রমাণিত যোগ্যতা প্রসঙ্গে আরও দু একটা কথাও বোধহয় প্রাসঙ্গিক৷ তাঁর গলা জিম রিভস, ফ্র্যাঙ্কি ভন বা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো নয়৷ অন্যদিকের উদাহরণ টেনে আনলে, সেক্ষেত্রে তাঁর গলা ন্যাট কিং কোল, মেহেদি হাসান বা জর্জ বিশ্বাসের মতোও নয়৷ তাহলে? তাঁর কণ্ঠ ঠিক তাঁরই মতো৷ একাধিক সাক্ষাৎকারে সোজা-সাপটা কথা বলার মানুষ, সত্যিকারের অলরাউন্ডার গায়ক মান্না দে বলতেন— ‘কী করব! আমার তো হেমন্তবাবুর মতো কণ্ঠ ছিল না, আমাকে তো সেই জন্য একটু অন্যরকমভাবে গাইতেই হয়েছিল৷’

এখানে কণ্ঠ ও কণ্ঠের সঙ্গীত সম্পর্কে আরও দু-একটা কথা এসে যাচ্ছে৷ সতত স্মরণীয়া বেগম আখতার একদা বলেছিলেন, ‘গানা গলে সে বনতি হ্যায় থোড়ি!’ শ্রোতৃমণ্ডলীকে মজাতে গেলে সুমধুর আওয়াজ থাকা নিশ্চয়ই একটা বাড়তি সুবিধা, কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়৷ সকলেই এমন অনেক গাইয়ের কথা জানেন বা শুনেছেন যাঁরা সুকণ্ঠের অধিকারী, কিন্তু গানটা গাইতেই জানে না৷

তা অবান্তর কথা, যুক্তিহীন মন্তব্য আরও আছে৷ নায়কের গলায় সেই অর্থে রোমান্টিক প্রেমের গান নাকি মান্না দে-র গলায় তেমন খেলত না৷ মানে কী? প্রেমে তো মিলনের চেয়ে বিরহই বেশি৷ বিরহের গান তেমনভাবে গাইতে না পারলে কি মান্না দে বাংলা গানের কাছে কখনও জনপ্রিয় হতে পারতেন? বাংলা গান গাওয়ার প্রথম দশ বছরে মান্না দে মোট যতগুলো চিরমধুর বিরহের বা বিষাদের গান গেয়েছিলেন তা কি কোনওভাবে ভোলা যায়? আর হিন্দি ছবিতে মান্না দে তো বিস্তর মিলনান্তক প্রেমের গান ও মজার গান গেয়েছেন তার তালিকা তো শেষ হতেই চাইবে না৷ তালিকা শুরু হবে অবশ্যই ‘প্যায়ার হুয়া ইকরার হুয়া (শ্রী ৪২০), ‘ইয়ে রাত ভিগি ভিগি’ (চোরি চোরি) দিয়ে, আর শেষ কোথায় হবে তা লেখা কঠিন৷ মজার গান, সমবেত বা দ্বৈত কণ্ঠে আনন্দ-উচ্ছ্বাসের গানেরও তাহলে তালিকা করতে হয়৷ মজার গান বলতে যদি কারও প্রথমেই মনে পড়ে ‘এক চতুর নার’ তাহলে পরের গান হতে পারে— ‘এ ভাই জরা দেখ কে’, পাশের বন্ধু হয়ত মনে করিয়ে দেবেন— ‘কিসনে চিলমন সে মারা’ ইত্যাদি৷ বস্তুত পক্ষে যিনি একই শারীরিক অস্তিত্বে— ‘পুছো না ক্যায়সে’, ‘চলত মুসাফির’, ‘অ্যায় মেরি জোহরা জবিন’, ‘আও টুইস্ট করে’ গেয়েছেন তাঁকে কী করে ছোট একটা বন্ধনীতে বেঁধে রাখা যায়?

গান-বাজনায় শেষ কথা বলে কিছু হয় না৷ কে-ই বা বলবেন সেই কথা! তবুও যদি সাধারণ শ্রোতাদের মনের কথায়, নিজস্ব অনুভব-উপলব্ধির কোনও মূল্য থাকে, তাহলে বলতে হবে৷ পবিত্র দুঃখ, জীবনদর্শনসিক্ত অন্তরতর হাহাকার, চোখের জলের শেষকথা গানেই শুনতে হয়, তাহলে মান্না দে সেই ‘চাঁদের আশায় নিভায়ে ছিলাম’ ছুঁয়ে সেই ‘…শেষ বিচারের আশায়’ বসে থাকতে হবে৷ সঙ্গীততপস্বী কৃষ্ণচন্দ্র দে-ও যে-অনুভবে জীবনের শেষ প্রহরে সেই পাওনা-দেনার হিসেব বুঝেছিলেন, তা-ই ধ্রুব সত্য হয়ে বেঁচে আছে৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *