সময়ের প্রেক্ষিতে মান্না দে-র প্রাসঙ্গিকতা – অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

সময়ের প্রেক্ষিতে মান্না দে-র প্রাসঙ্গিকতা – অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

মান্না দে চলে গেলেন৷ ভারতবাসী, বাঙালি, সঙ্গীত প্রেমিক প্রভৃতি সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষেরা শোকসন্তপ্ত— বেদনাহত৷ আমায় যদি প্রশ্ন করেন কেউ, আপনার কি মনে হয়? আপনি কি মনে করেন না, সঙ্গীতের এক বিরাট রাজপ্রাসাদ ভেঙে পড়ল? আমি বলব, কেন? সেই মহলটি কি বালির চরে নির্মিত ছিল? সেই বিরাট অট্টালিকাটি তৈরি হয়েছিল pretested শক্তপোক্ত মৃত্তিকার ওপর৷ যার ভিত অনেক গভীর থেকে বলিষ্ঠ বিম সহযোগে কংক্রিট ভিত্তির ওপর স্থাপিত ছিল৷ এ প্রাসাদ ইতিহাসের সাক্ষী আর সেভাবেই দীর্ঘদিন কালের মহান স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে এই ইমারত৷ এ আমার ধারণা বা বিশ্বাস শুধু নয় আগামী ইতিহাসের পাতা খুলে মানুষ মিলিয়ে নেবেন৷

তাই সময়ের সঙ্কটে দাঁড়িয়ে ঠিক এই মুহূর্তে আমাদের শোক করার সময় নয়৷ কেবল উচ্ছ্বাসে গা ভাসিয়ে দেওয়ারও লহমা নয়৷ সংস্কৃতি সঙ্গীতের সনাতন ধারা যখন আন্তর্জাতিকতার নামে বিশ্বায়নের বাজারের পণ্যকৃষ্টির আক্রমণে আক্রান্ত তখন দায়বদ্ধ বিদগ্ধজনের থেমে থাকার একেবারে সুযোগ নেই৷ মান্নাদা চলে গেলেন— তাঁর ভাণ্ডারের দরজা খুলে দিয়ে গেলেন বিলাসিতায় গা ভাসানোর জন্যে নয়— তাঁর সঙ্গীত বৈভব দিয়ে সঙ্গীত তথা সমাজ মহলকে কল্যাণঋদ্ধ সেবা করার প্রেরণা জুগিয়ে৷ বিকৃত সমাজ রুচিকে, বিপন্ন, বিষণ্ণ জনসাধারণের মধ্যে স্বাস্থ্যকর শিল্প পরিচর্যায় আনন্দময় জীবনের পরিবেশে বয়ে নিয়ে যাওয়ার সাধনায় লিপ্ত হওয়ার জন্যে৷ কিছু লেখা এর মধ্যে আমি লিখেছি, সেগুলোই সাজিয়ে দিলাম৷ যা থেকে একটা ভাবনা উঠে আসতে পারে৷

”না না যেও না
ও শেষ পাতাগো শাখায় তুমি থাকো
ছিলে তুমি ছিলাম আমি চিহ্নটি তার রাখো৷”

শ্রাবণের বিষণ্ণ সন্ধ্যার মতো মন বিমর্ষ— ভিজে পাতার মতো চোখের পাতা সিক্ত— অন্ধকার বারান্দায় বসে মোবাইলে গানটি শুনছি, হৃদয়টাকে আর্দ্র করে দিচ্ছে৷ অনুভবটা স্যাঁতসেঁতে৷ দৃষ্টিতে পুবের হাওয়ায় ভাসা মেঘ মেদুর ছায়ার মায়া আর অন্তরে উত্তরে হাওয়ার কঠিন শাসন৷ গান শুনছি, মন কাঁদছে—

”উত্তরবায় করুক শাসন
যাক ঘুচে যাক সবুজ আসন
শেষ বেলাকার অশেষ নিয়ে
স্মৃতির ছবি আঁকো৷
না যেওনা শেষ পাতাগো শাখায় তুমি থাকো৷”

কত স্মৃতি, কত গীতি৷ শুধু কি স্মৃতি৷ কত বিস্ময়৷ কত সুচারু সাঙ্গীতিক আশ্রয়, কত রাগ ও অনুরাগের সহবাস, কত ‘ধ্রুপদী, জ্ঞানী পর্বত থেকে বয়ে আসা পদাবলির বৈষ্ণবীয় প্রস্রবণের প্রবাহ৷ সম্মানীয় পিতৃব্য সর্বজন প্রণম্য শ্রদ্ধেয় কৃষ্ণচন্দ্র দে সমুদ্র গর্জনে গাইলেন,

‘ওই মহাসিন্ধুর ওপার হতে

কি সঙ্গীত ভেসে আসে৷’ ওই একই গান গেয়ে কাকাকে বিনম্র প্রণাম জানালেন সুযোগ্য ভাইপো আমাদের প্রাণের শিল্পী৷ কাছের মানুষ৷ মান্না দে৷ মনে হল বেদমন্ত্রের মন্দ্রিত ধ্বনিকে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাতে সম্মান জানালেন দীন ঋত্বিক, কণ্ঠের সুরে, বৈষ্ণব পদাবলির সুললিত আত্ম নিবেদনে৷ বলা যাবে না কেয়া বাত৷ বলা যেতে পারে আ-হা৷ তারচে কিছু না বলা আরও ভাল৷ উচ্ছিষ্ট উচ্চারণে বাক্য দূষিত না করে, আত্মমগ্ন অনুভবে ভাল লাগা৷ সম্ভোগ করাই শ্রেয়৷ এই ঐশী উপলব্ধি উষ্ণবোধ-দীপ্ত নয়৷ শীতলতায় স্নিগ্ধ, অচঞ্চলতায় প্রশান্ত কে সি দে যেন পর্বত চূড়ায় অবস্থিত গুহাবাসী এক সাগ্নিক ঋষি৷ জ্ঞানী প্রাজ্ঞ আর মান্না দে যেন প্রেম বিগলিত ভক্ত বৈষ্ণব৷ একই গান অথচ দুজনের কি ভিন্ন অভিব্যক্তি৷ অতীন্দ্রিয় রসবোধ না থাকলে এই অভিদ্যোতনা অসম্ভব৷

ছবি আঁকতে গেলে একটা ক্যানভাসের ওপর আঁকতে হয়৷ মান্নাদার ছবি যদি আঁকতে চাই সেই ক্যানভাসটা জানা দরকার৷ যা যুগোত্তীর্ণ, তাই classical৷ চিরদিন যা বেঁচে থাকে৷ যে শিল্পী, সে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিখে এসে সেই শাস্ত্রীয় প্রভাবটাকে নতুন নতুন রূপে ফুটিয়ে তোলেন তাঁর নব শিল্পকলায়৷ এদিক থেকে দেখতে গেলে, আমাদের দেশে রবীন্দ্রনাথই আধুনিক সঙ্গীতের জনক৷ Classical Music-কে নানান আঙ্গিকে ব্যবহার করে, তিনি তৈরি করেছেন কত অবিস্মরণীয় গান৷ আজ খুব দুঃসময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি আমরা৷ এই যে globalised culture-এর প্রভাব আমাদের দেশে, তার উদ্দেশ্য বোধহয় আমাদের ঐতিহ্যকে শেষ করে দেওয়া৷ ইউরোপিয়ান বা ওয়েস্টার্ন যে Classical Music এবং ভারতীয় যে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত তার মেলবন্ধন করে গেছেন রবীন্দ্রনাথ৷ পরবর্তীকালে আধুনিক গানে তার প্রভাব আমরা পেয়েছি৷ যে গান জীবনের সঙ্গে একদিন মিশেছিল, মানুষের মধ্যে ভালবাসার সম্পর্ককে সুষমামণ্ডিত করেছিল, Classical Music তারই ধারা ও ঐতিহ্যকে বহন করতে পারত৷ Globalised Music সেখানেই করেছে আঘাত৷ একে ঠিক ইউরোপিয়ান মিউজিক বলা যায় না৷ এ অন্যরকম কিছু, যা জীবনকে বিপন্ন করে, সমৃদ্ধ করে না৷ এমন দুঃসময়ে এমন কেউ কেউ আছেন, যারা মূল্যবোধহীন জীবন থেকে বাঁচার চেষ্টা করেছেন৷ তেমন এক মহান শিল্পী মান্না দে, তাঁর সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে সেই ক্যানভাসের প্রসঙ্গ আসবেই৷ সেই ক্যানভাসটাকে না জানলে মান্না দে-র মানকেও বোধহয় সঠিকভাবে বোঝা যায় না৷ মান্না দে-র গানকে বুঝতে গেলে বোধহয় এই পটভূমিকাটা জানারও প্রয়োজন আছে৷ নইলে তাঁর গানের যে ঐতিহ্য, যে প্রকাশ, তা অনুভব করা যায় না৷ তিনি devalued culture থেকে সঙ্গীতকে বাঁচাবার চেষ্টা করেছেন৷ শাস্ত্রীয় সঙ্গীত তো সমস্ত যুগকে পুষ্টি জোগায়৷ এই Heritage Music-কে মান্না দে সঠিকভাবে শিখেছেন ও প্রয়োগ করেছেন যুগোপযোগী আধুনিক জীবনে৷ প্রকৃত সঙ্গীতকে কীভাবে আধুনিকতার মোড়কে পরিবেশন করে সমৃদ্ধ করা যায়, গানে গানে তিনি তার প্রমাণ রেখেছেন৷ সঙ্গীত গুরু কৃষ্ণচন্দ্র দে-র কাছে ধ্রুপদ শিখেছেন তিনি৷ অতি যত্ন করে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিক্ষা করেছেন কত গুণী গুরুদের কাছে, তবু তিনি অনায়াসে গাইতে পারেন— ‘জীবনে কি পাবো না’ অথবা ‘পৃথিবী তাকিয়ে দ্যাখো’৷ কত সঙ্গীত শিক্ষিত আধুনিক মনের মানুষ দেখুন মান্না দে৷ আমার সুরে ‘কে তুমি শুধুই ডাকো’ গানের যে চলন, শুরুতে যে সরগম আছে গানের রাগের সঙ্গে তার মিল নেই৷ একটা অনিয়মের সৌন্দর্য প্রয়োগ করতে চেয়েছিলাম৷ মান্না দে প্রকৃত যোদ্ধা, প্রখর তাঁর রসবোধ, কোনও Prejudice না রেখে এই গানটি তিনি যে কী অসাধারণ গেয়েছিলেন, সবাই জানেন৷ কিন্তু একবারও তাঁর Puritan মন নিয়ে বলেননি, ও মশাই, এটা কী করলেন৷ গানটির রূপে অন্য রাগের প্রভাব আর এই শুরুর সরগম একেবারে অন্য রাগ৷ এটা কী করে হয়? আসলে তিনি তো জীবন পথিক তাই তাঁর চিন্তায় রবীন্দ্রভাষার প্রতিফলন৷ রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘হিন্দুস্থানি সঙ্গীত ভাল ক’রে শিখলে তা থেকে আমরা লাভ না করে পারব না৷ তবে এ লাভটা হবে তখনই যখন আমরা তাদের দানটা যথার্থ আত্মসাৎ করে তাকে আপন রূপ দিতে পারব৷ তর্জমা করে বা ধার করে সত্যিকার সৃষ্টি হয় না; সাহিত্যেও নয়, সঙ্গীতেও নয়৷… মানুষের মধ্যেই মিশেল আছে, বনমানুষের মধ্যে মিশেল নেই৷’ এ সত্য মান্না দে মেনেছেন তাঁর কর্মকাণ্ডে৷

জীবন বোধ ও সঙ্গীত বোধির সমন্বয় বা বলা যায় সহবাসই মান্নাদার শিল্পী জীবনের প্রসবের উপাদান৷ আর তাঁর শিল্পী সত্তার একশো ভাগ প্রকাশের ঐশ্বর্য ও উৎকর্ষের ইন্ধন তাঁর অনলস অবিচ্ছেদ্য সত্যনিষ্ঠ সঙ্গীত সাধনা৷ যার বীজ কেবল সঙ্গীতের অবদান নয়— তাঁর সামগ্রিক শিক্ষার নির্যাস৷ ওস্তাদী বা পণ্ডিতির বেড়ার মধ্যে বাস করে তাঁর সঙ্গীত সজীব হয়ে ওঠেনি৷ তাঁর সঙ্গীত জীবন গড়ে উঠেছে নান্দনিক অনুভবে, প্রগতিশীলতায় ও সুস্বাস্থ্যকর মিশ্রণের অপূর্বতায়৷ তাঁর গায়নে রস বিভ্রাট ছিল না৷ পাকা রসুইয়ের মতো বিভিন্ন মশলা মিশিয়ে তাঁর ব্যঞ্জন৷ মান্নাদার সাঙ্গীতিক বোধ ও অভিদ্যোতনা রক্ষণশীলতার কারাগারে রুদ্ধ নয় আবার প্রগতিশীলতার লাগাম ছাড়া উচ্ছৃঙ্খলতাও নয়৷ অভিপ্রেত সৌন্দর্য বোধে সুষমামণ্ডিত প্রাণের সাঙ্গীতিক অভিব্যক্তি৷ যা সম্ভ্রান্ত, অভিজাত অথচ জনমনোরঞ্জনকারী৷

গান শুনছি:�

সবে যখন আকাশ জুড়ে মেঘ জমেছে

ঝড় ওঠেনি বাতাসটাতে ঘোর লেগেছে

ও কেন তখন, উড়িয়ে আঁচল

খোলা চুলে বাইরে এল৷

দেখে তো আমি মুগ্ধ হবই

আমি তো মানুষ৷

Fantastic lyric, Fantastic tune, Fantastic treatment৷ ভাবতে পারি না এই গীতি কবিতাটি পেয়ে এমন সুর করা যায়, এমন গাওয়া যায়৷ গানটির বন্দিশে একতাল খেয়ালের চলন বলন, গতি প্রকৃতি, স্বর বিস্তার, লয় তালের বোধ কাঁপানো Punctuation সহজিয়া লোকায়ত ভাষায় যেমন লোকগীতির শব্দসম্পদের বুননে, জীবন দর্শনে লোককাব্য বোধের মধ্যে চিরায়ত দর্শনের অভিব্যক্তিকে প্রকাশ করে তেমনি এই গানটির বাণী, সুরের বুনন৷ সব মিলিয়ে একটা সুরের জাদুকরী এক অনবদ্য নাট্যমুহূর্তের বিরল প্রকাশ৷ ব্যুৎপত্তিতে সহজিয়া সাবলীল অথচ এই ভাষাকে বোধিদীপ্ত করে, রসামৃতের আস্বাদনকে পুষ্ট করেছে অনির্বচনীয় ভাবে৷ এই ধরনের সৃষ্টি ও তার প্রয়োগ, প্রকাশ বাংলা গানে বিরল৷ পরিবারে আত্মীয় বিয়োগ হলে ক্রন্দনধ্বনি উঠবে, এ তো স্বাভাবিক৷ শোকাহত, মর্মাহত হবে সংসারের কুশীলব, এও তো স্বাভাবিক৷ তবু কর্তব্য বড় কঠিন, কাউকে কাউকে সজাগ থাকতেই হয়৷ সমস্ত বিপর্যয়ের মধ্যে তাদের স্থিতধী ও সতর্ক হতে হয়, সমস্ত ব্যবস্থাকে সচল রাখতে৷ মান্না দে-কে বড় কাছ থেকে, আপন করে পেয়েছিলাম৷ তিনিও আমার প্রতি অসম্ভব আন্তরিক ছিলেন৷ কেবল তাই নয়— পরম অগ্রজ হয়েও অকিঞ্চন অনুজের প্রতিও তিনি তাঁর স্নেহ, ভালবাসাকে অদ্ভুত এক শ্রদ্ধার রসায়নে সমৃদ্ধ করেছিলেন৷ আমার মতো নগণ্যের প্রতি তাঁর এই সংবেদন আমার কাছে ঈশ্বরের করুণার মতো৷ তাই আমি বাংলা সঙ্গীত পরিবারের অন্যতম এক প্রবীণ কুশীলব হয়ে দুঃখাহত হয়েও বসে থাকতে পারছি না৷ বক্ষ যন্ত্রণা বহন করে সমস্ত সুস্থ সঙ্গীত শিল্পীর চরণ ধরে আবেদন করছি, আপনারা মান্নাদার গান নিয়ে, এই মুহূর্তে শুরু করুন স্ব-নিষ্ঠ গবেষণা এবং তা কমিউন প্রথায়, পরস্পর বিনিময়ের ঐশ্বর্যপূর্ণ ambience-এ৷ আজ বাংলার সঙ্গীত বিপন্ন৷ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকতার সংস্কৃতিকে পায়ে মাড়িয়ে বিশ্বায়নের সংস্কৃতির ফেরিওয়ালারা বেরিয়ে পড়েছে দাপটে যাতে ঐতিহ্যকে কবর দেওয়া যায়৷ ইতিহাস অবশ্য স্বাক্ষর রেখেছে ঐতিহ্য সনাতন— পুরাতন নয়৷ তাই তাকে শ্মশানে বা কবরে পাঠানো যায় না৷ তবু বাঁচা ও বাঁচানোর একটা সংগ্রাম আছে৷ আছে একটা সাধনা, তা থেকে দায়বদ্ধ মানুষ সরে দাঁড়াতে পারে না৷ কাণ্ডজ্ঞানহীন গৃহকর্তার মতো হয়ে একটা পরিবারকে যেমন ভাসানো যায় না, তেমনি স্বার্থপরতায় বন্দী হয়ে একার জীবন নিয়ে একজন সঙ্গীত শিল্পীও তার আত্মবোধ ও নিরাপত্তাকে রক্ষা করতে পারে না৷ এই সময়ে বাংলা সঙ্গীতের মন্দিরে অভাব হয়েছে গঙ্গাজলের৷ বেল, তুলসী চন্দন ও ফুলের৷ ইঁদুরে কাটছে পূজার আসন৷ শঙ্খধ্বনি স্তব্ধ৷ ব্যবস্থা প্রয়োজন৷ আর সেই ব্যবস্থার আয়োজনে মূল উপাদান যেটা হতে পারে তার অন্যতম প্রধান মান্না দে-র সাঙ্গীতিক কর্মকাণ্ডের গতি, প্রকৃতি৷ প্রয়োগ নিয়ে খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করা, গবেষণা করা৷ কারণ, শিল্পী হিসেবে তিনি প্রগতির দুয়ার, উন্মুক্ত চিত্তে, উন্মুক্ত রেখেই, ঐতিহ্যকে রক্ষণশীলতার কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে, চিরায়তর চলমানতায় এত সুভাবিত, সুপ্রয়োগ করেছেন, যা অভাবনীয়৷ সর্বজন শ্রদ্ধেয় কৃষ্ণচন্দ্র দে-র মতো ধ্রুপদীয়া, কীর্তনীয়ার ঐশী দরবারের সদস্য হয়েও আধুনিকতার সুরম্য প্রাসাদ গড়ার কারিগর হিসেবে মান্না দে-র নাম স্বর্ণাক্ষরে সেই মহলের দেওয়ালে খোদিত থাকবে৷ ভাবতে হবে না? শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পণ্ডিত বা ওস্তাদের তকমা ত্যাগ করে নান্দনিক বোধ নিয়ে এই মহান শিল্পী কীভাবে ‘আমায় একটু জায়গা দাও, মায়ের মন্দিরে বসি’-র থেকে ‘আও টুইস্ট করে’ বা ‘এই ভাই জারা দেখকে চলো’ পর্যন্ত পাড়ি দিলেন৷ একই সুরকারের সৃষ্টি ‘জীবনে কী পাবো না’ থেকে ‘ওগো শেষ বিচারের আশায়’ পর্যন্ত সাঁতার দিলেন৷ কীভাবে ‘এই দুনিয়ায় ভাই’-এর মাতালের দর্শন বুকে করে একই শিল্পী প্রাণ ঢেলে উচ্চারণ করতে পারলেন৷

‘জিন্দেগি ক্যায়সি হ্যায় পহেলি হায়

কভি তো হাসায়ে, কভি এ ভুলায়৷’

মান্না দে বিস্ময়৷ মান্না দে অবিস্মরণীয়৷ মান্না দে অমুক, মান্না দে তমুক৷ এ সব গালভরা উচ্চারণের বিশেষণে বিভূষিত করে ‘গা ছাড়া’ ভাবে দায় এড়ানো চলবে না৷ অত্যন্ত দায়বদ্ধ ভাবে অগ্রজ শিল্পীদের দায়িত্ব নিয়ে তাঁর সঙ্গীত পরিবেশন নিয়ে গবেষণা করে অনুজদের সমৃদ্ধ করতে হবে৷ মান্না দে-র সঙ্গীতকে সঙ্গীত শিক্ষার আর্কাইভে অভিপ্রেত মূল্যবোধে ও সত্য বোধে সমৃদ্ধ করে রক্ষণ ও চলন প্রক্রিয়াকে বাস্তবায়িত করতে হবে৷

মান্না দে গীত প্রতিটি গানের সঙ্গেই একটা প্রয়োগ বিশ্লেষণের জায়গা আছে ঠিকই যেটা আবিষ্কার করা একার কাজ না৷ (যদিও কাজটা মান্নাদার একারই করা)৷ কারণ এই কাজের ইতিহাস লম্বা৷ আমি কয়েকটি, বা বলা যায় দু-চারটি গানের মধ্যে দিয়ে কীভাবে গবেষণা করতে হবে তার দু-একটা রাস্তা ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারি৷

যেমন বলি, কাবুলিওয়ালা ছবির গান ‘য্যা মেরে প্যারে বতন’ গানটি৷ বোধের পটভূমিকাটা ভাবা যাক৷

আমাদের সমাজে প্রতিটি সম্পর্কের বোধ গড়ে ওঠে সামাজিক, সাংসারিক কর্মের প্রেক্ষিতে৷ স্বামী, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, শ্বশুর, শাশুড়ি, পিতা, মাতা, ভাই, বন্ধু, পরিজন আত্মীয়, প্রতিবেশী, দেশবাসী সবার সঙ্গেই সবার বিনিময় একটা বিশেষ জীবন প্রণালীকে ঘিরে৷ সেই অর্থে কাবুল বাসিন্দাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক, অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতার বিপন্ন, বিষণ্ণ জীবনের এমন পটভূমিকায় গড়ে ওঠে যে কাবুল বাসিন্দাদের বোধের কমনীয়তার দিক আমাদের আদৌ হৃদয়সম্পৃক্ত বোধ স্বাস্থ্যকর নয়৷ অথচ রবীন্দ্রনাথের কাবুলিওয়ালা গল্পের মধ্যে এক দুরন্ত শক্তিশালী, যে কখনও হিংস্রও বটে, তার মধ্যের সংবেদনশীলতা, স্নেহ, মায়া, ভালবাসার হৃদয়কে রবীন্দ্রনাথ কী সুন্দরভাবে আবিষ্কার করেছেন৷ এখানে রবীন্দ্রনাথের সেই বোধকে বিস্তৃত করেছেন হিন্দি কাবুলিওয়ালার চিত্র পরিচালক শ্রদ্ধেয় বিমল রায় কাবুলিওয়ালার দেশে ফিরে যাওয়ার দৃশ্যে ওই গানের সংযোজনা করে৷ যে কাবুলিওয়ালা হিংস্রতার দায়ে হাজতবাস করল, সেই কাবুলিওয়ালাই মিনিকে ভালবাসে তার স্ব-কন্যার অনুভবে পিতৃত্ব বোধে৷ সেই কাবুলিওয়ালা যার হৃদয় আছে৷ স্বদেশ প্রেম আছে৷ স্বামীত্ব আছে৷ আছে ভাইবোন, পরিজন প্রভৃতি সবাই৷ সে যখন ফিরে যাচ্ছে তার স্বদেশে, দীর্ঘ একাকিত্বের সময় কাটিয়ে, আপন জনেদের নিকট— তখন তার মনে আনন্দ বোধ যেমন তেমনি শূন্যতায় বিষণ্ণ বোধ৷ দীর্ঘ বিরহের দীর্ঘশ্বাস৷ মনুষ্যত্বের এই যে চিরায়ত লাবণ্যময় বোধ বিভূতি তা যদি ওই অপূর্ব সুরের জাদুকরীর মধ্যে দিয়ে মান্না দে-র কণ্ঠমাধুর্যে বিষাদের মহত্তম নির্যাস না হয়ে ঝরে পড়ত, ওই বেদনার গান কালজয়ী হয়ে গণদেবতার বুকের বেদনা হয়ে উঠতে পারত না৷ হিন্দি অঞ্চলে প্রায়শই একটা ভাষা শোনা যায়, ‘÷হান কলাকার’৷ এই গান শুনে হাত জোড় করে মাথা নিচু করে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে সেই মহান শিল্পীর মহীরুহ অস্তিত্বের বিগ্রহের সম্মুখে৷

এ প্রসঙ্গে একটা কথা মনে আসছে যেটার বিষয়টা প্রত্যক্ষভাবে মান্না দে না হলেও পরোক্ষভাবে মান্না দে-র প্রয়োগ প্রণালী, চিন্তা ভাবনার সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ আজকের যুগটার সব থেকে অসুস্থ মানসিকতা পূর্বসূরি ও উত্তরসূরি দুই প্রজন্মের মধ্যে সম্পর্কের ও বোধের মিশেলটা ছানার জলের ভাব, তাকে ক্ষীর করতে না পারা৷ সম্পর্কের দুধ যেন টকে যাচ্ছে— সে ক্ষেত্রে মান্না দে-র শিল্পী ও সুরস্রষ্টা প্রকাশই সার্থক দাওয়াই৷ একটু পরিষ্কার করে বলি— রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘সঙ্গীতের উদ্দেশ্যই ভাব প্রকাশ করা৷’ আবার প্রখ্যাত সঙ্গীত চিন্তাবিদ শ্রদ্ধেয় রাজেশ্বর মিত্র লিখছেন, কবি জয়দেব ‘গীতগোবিন্দ’ রচনার সময়েই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পরিকাঠামো ভাঙবার চেষ্টা করেছেন কেবল ভাবের প্রয়োজনে৷ অর্থাৎ শাস্ত্রীয় সঙ্গীত হচ্ছে ঐতিহ্য, কিন্তু শাস্ত্রীয় সঙ্গীত তো classical, আর classical তো যুগবদ্ধ বা সময়বদ্ধ হতে পারে না— তার থাকবে অনাদি চলমানতা৷ রবীন্দ্রনাথও বলছেন, ‘সঙ্গীতে এতখানি প্রাণ থাকা চাই৷ যাহাতে সে সমাজের বয়সের সহিত বাড়িতে থাকে, সমাজের পরিবর্তনের সহিত পরিবর্তিত হইতে থাকে৷ সমাজের ওপর নিজের প্রভাব বিস্তার করিতে পারে ও তাহার উপর সমাজের প্রভাব প্রযুক্ত হয়৷’ অর্থাৎ classical গানের চলমানতা ও সমাজের যুগের পটপরিবর্তনের একটা সামঞ্জস্য আছে৷ তাই নব নব নির্মাণ ও প্রকাশের মধ্যে এই ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সমন্বয় ঘটানো চাই— যার model দৃষ্টান্ত মান্না দে-র সমগ্র সঙ্গীত জীবন৷ আরও একটু কথা লিখতে হবে ২০১৩ সালের সাংস্কৃতিক বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে, ইউরোপীয় Symphony-র যে সুস্থতা, তা আজ যেভাবে বিপন্ন, নববিশ্বায়নের অবদান cacophony-র আক্রমণে এবং তার থেকে বাঁচবার জন্যে সুস্থ সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী মানুষের যে রক্ষণশীল প্রক্রিয়া— দুটো দুভাবে সঙ্গীতের জীবনকেন্দ্রিক দায়বদ্ধতাকে সর্বনাশের পথে নিয়ে যাচ্ছে৷ অসুস্থ সঙ্গীত সমাজকে অসুস্থ করছে, সঙ্গীতকে শ্মশানে পাঠাচ্ছে— আর ঐতিহ্যবাহীরা রক্ষণশীলভাবে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ব্যাকরণ নিয়ে ওস্তাদি ও পণ্ডিততত্ত্বকে প্রাধান্য দিয়ে সঙ্গীতের নন্দনবোধকে ধ্বংস করছে৷ আজকের এই দুর্দিনে মান্না দে-র সাঙ্গীতিক কর্মকাণ্ড তাই দিকদর্শী— তাই বর্তমানে মান্না দে-র গাওয়া ও সৃষ্ট সঙ্গীতকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করে গবেষণা আশু প্রয়োজন৷

এ বিষয়ে মান্না দে-র এক জন্মদিনে প্রকাশিত একটি স্মারকগ্রন্থে একটি ব্যঙ্গাত্মক ছোট্ট লেখা দিয়েছিলাম যা এখানে সংযোজিত করলাম৷ এতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনুরাগী ও অনুগামীরা কিছুটা ধারণা করতে পারবেন যে, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে কতটা রস আছে৷ বড় দুঃখ হয়— পৃথিবীর সব থেকে Romantic Music Indian classical৷ আর তার রস বাদ দিয়ে কেবল রাগারাগি চলছে আর অনুরাগ মমতাজের মতো শাজাহানের নবাবি সৌধ জৌলুসের নিচে অন্ধ কারাগারে কাঁদছে৷ তাজমহলের সৌন্দর্য দীপ্তি সম্রাটকে বাহবা দিচ্ছে আর প্রেমহীনতায় পর্যটকের তৃপ্তি মেটাচ্ছে৷ আমাদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতজ্ঞদের অধিকাংশই জ্ঞানী ওস্তাদ বা পণ্ডিত বেশি, কেউ প্রেমরসিক শিল্পী হতে চায় না৷ অনেক বেদনা নিয়ে তাই আমি এই রচনাটির শিরোনাম দিয়েছিলাম— রাগাতঙ্ক৷

আমরা জলাতঙ্ক রোগের নাম শুনেছি কিন্তু আমরা চিকিৎসক নই৷ তাই তার ওষুধের নাম জানি না— যাঁরা জানেন তাঁরা সবাই চিকিৎসক৷ আমরা সুরের চিকিৎসক৷ ইদানীং একটি রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে আমাদের সঙ্গীত সমাজে৷ রোগটির নাম রাগাতঙ্ক৷ জলাতঙ্ক রোগী জলকে ভয় পায় আর রাগাতঙ্ক গায়ক গায়িকা রাগকে হারানোর ভয় পায়৷ তাদের ভয়, এই বুঝি অনুরাগ এসে রাগকে বিভ্রান্ত করে৷ এই বুঝি অনুরাগের ছোঁওয়া ইমনের পর্দায় ইমনের সার্কাস ছেড়ে অভিমানে বলে ওঠে ‘ডেকো না আমারে ডেকো না’৷ অনেক গায়ক গায়িকা তাই জীবনের আন্তরিক কথা সঙ্গীতে বলতে গিয়েও ভুলে যায় না বাঁ হাতটাকে নাড়িয়ে নাড়িয়ে রাগ রাগিণীর অস্তিত্বকে সচল রাখতে৷ তাদের সকল সময় ভয় শিল্প নন্দন তত্ত্ব এই বুঝি উড়িয়ে দিল ওস্তাদি বা পাণ্ডিত্যের শিরোপা৷ ঠিক আধুনিক কবিরা যেমন তাদের সব সময় ভয়— এই বুঝি তাদের বিদ্যাবান রূপ সহজগ্রাহ্য হয়ে তাদের মান নিম্নমুখী করে৷ আসলে এটাই একটা রোগ৷ ঐতিহ্য কখনও চলমানতায় অবিশ্বাসী হয় না৷ ঐতিহ্যের সার্থকতাই সময়ের গতিশীলতার গর্ভে৷ রবীন্দ্রনাথের ভাবধারায়, তাজমহলের থেকে সৌন্দর্যের প্রেরণা নেবে— কিন্তু নিজের প্রেমিকাকে নিজের মতো করে সাজাবে৷ রবীন্দ্রনাথের গানের ভুঁড়ি ফাঁসিয়ে পেট থেকে রাগ রাগিণীকে বের করে আনতে হবে, কিশোর কুমারের স্থিতধী পর্দাকে সার্কাসের ট্রাপিজের রূপকল্পে সাজাতে হবে, এ সব চেতনার কথা নয়৷ তাই এই রাগাতঙ্কের জন্যে আমি চিকিৎসক হিসেবে একটি ওষুধই নির্বাচন করে থাকি, যে ওষুধটার নাম ‘মান্না দে’৷ পুছো না ক্যায়সে, বাজে গো বীণার মধ্যে যে অনুভব ঝঙ্কৃত তা শুধু রাগ না একটা অনুভবকেই পুষ্টি জোগায়৷ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ romantic music৷ রবীন্দ্রনাথ বেহাগকে নিয়ে কেঁদেছেন৷ হেসেছেন৷ গান গেয়েছেন৷ ভালবেসেছেন৷ দেশসেবা করেছেন৷ দুঃখীর বুকে সান্ত্বনার প্রলেপ দিয়েছেন৷ প্রেমিকের অন্তরে চিরদিনের জন্যে গেঁথে দিয়েছেন প্রেমিকার ছবি, যাতে প্রেমিক গাইতে পারে ‘তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম’৷ এই বোধ, এই শিক্ষায় এক শিল্পী যদি নিজেকে বোধিযুক্ত করতে চান, কেবল মান্নাদার গান গাওয়া নিয়ে গবেষণা করুন৷ ভাবুন কী করে একই শিল্পী বাঁ হাত না নাড়িয়ে গেয়েছেন ‘তালাশ’, আবার একদিন রাত্রে-তে ‘মাতালের গান’৷ কাবুলিওয়ালার ‘পস্তু গান’৷ আবার পপঘেঁষা, ‘জীবনে কি পাবো না’৷ স্যাটায়ার গানে তিনি সমস্ত পূর্বসূরিকে শুইয়ে দিয়েছেন অথচ তিনি ধ্রুপদ থেকে উঠে আসা শিল্পী৷ কৃষ্ণচন্দ্র দে-র মতো সাঙ্গীতিক প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসা ওস্তাদি ও পাণ্ডিত্যে সুদক্ষ কণ্ঠশিল্পী কীরকম ১০০% নান্দনিক তা বুঝতে হয় মান্না দে-র গান শুনে৷ লিখতে লিখতে Emotional হয়ে যাচ্ছি৷ তাঁর সঙ্গে কাজ করতে করতে কতবার যে তাঁর ছাত্র হয়ে গেছি, তার ঠিক নেই৷ আমার পূর্বজন্মের বহু সৌভাগ্য যে আমি মান্নাদার এত কাছে আসতে পেরেছি৷ আমি ধন্য৷ আমি কৃতজ্ঞ৷ বুকের আন্তরিক প্রণাম দিয়ে আমি তাঁর শ্রেষ্ঠত্বকে পূজা করি৷

আমি কিছুদিন ধরে একটা কথা বলে আসছি বর্তমান সময়ের সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের বিপদ মুহূর্তে মান্না দে-র সঙ্গীত জীবন একটা model৷ কারণ তিনি সুচারু কারুকাজের নান্দনিক বুননের মারফত যে ছবি এঁকে গেছেন বা রক্ষণশীলতার কারাগার থেকে মুক্ত ঐতিহ্য সঙ্গীতের সহজ, স্বচ্ছ বিচরণ, চলমানতার দীপ্তিতে উদ্ভাসিত কিন্তু প্রগতির নামে উচ্ছৃঙ্খলতার অস্বাস্থ্যকর অভিদ্যোতনায় সামাজিক ক্ষত সৃষ্টি করা নয়৷ সব থেকে উৎকর্ষের উজ্জ্বলতা প্রতিটি প্রকাশ স্বকীয়তায় ও সত্য বোধে নিষ্ঠ সংস্কৃতি৷ বিশেষ করে ছায়াছবির গানে দৃশ্যকে সজীবতায় জীবন্ত করে তোলা৷ বড় একা লাগে বিষণ্ণ নির্জনতার রাতের আঁধার, কাহারবা নয় দাদরা বাজাও-এর মতো মহফিলের রাতের আঁধার, আজ রাতে আর যাত্রা শুনতে যাব না-র রাতের আঁধার দৃশ্যানুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন বোধের ও রসের প্রয়োগ প্রণালী কিন্তু তা শিল্পীর একেবারে নিজস্ব দক্ষতায় ও মহিমায় বিচিত্র হয়ে উঠেছে৷ ব্যক্তি জীবনের সামগ্রিক শিক্ষা, সঠিক সংস্কৃতি বোধে সর্বত্র প্রাণবন্ত ও অভিব্যক্তিতে অভিপ্রেত হয়েছে৷ কিশোরবাবুর সঙ্গে গানে গানে যখন দুজনের দোস্তি (শোলে) তখন তার আন্তরিকতা যেমন ছবির শেষ দৃশ্য পর্যন্ত বোধকে স্থিতধী বন্ধুত্বে ধরে রাখল আবার পড়োশনে চতুরানন গানে লড়াইটাও জমিয়ে করলেন৷ কেবল তাই নয়— ওই feel-কে যথাযথ করতে তাঁর সাঙ্গীতিক skill-কে যোগ্য কারিগরের মতো একেবারে মাখো মাখো করে তাঁর শিক্ষাকে ওস্তাদির বেড়া ভেঙে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন৷ মান্নাদার সাহিত্য বোধ, কাব্যানুভূতি ছিল অত্যন্ত সূক্ষ্ম৷ আজকের দুর্দিনে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে সুরক্ষা দিতে হলে ঐতিহ্য ও প্রগতির মধ্যে যে নান্দনিক প্রয়োগের দ্বারা যে বোধনিষ্ঠ সৃষ্টি ও প্রকাশের প্রয়োজন তা মান্না দে-র মতো ১০০% ভাগ নিপুণ শিল্পী বিরল৷ একদল ঐতিহ্য মাড়িয়ে চলাই প্রগতি মনে করে আর একদল ঐহিত্যকে সিন্দুকে পুরে রাখতে চায়৷ এই দুই দলের অভিঘাতে সঙ্গীতেই আত্মবিরোধ ঘটছে আর এর ফসল লুটছে কিছু বিপথগামী জীবন দর্শনের সংস্কৃতির প্রবক্তা— যারা প্রগতির মুখোশ পরে ঐতিহ্যের সর্বনাশী মুখ দেখাচ্ছে৷ আর মান্না দে-ই পূর্ণ দক্ষ সেই দিশারি যিনি ঐতিহ্যের শক্তপোক্ত ভিতের ওপরই তাঁর সাঙ্গীতিক প্রাসাদ গড়ে ভারতীয় কৃষ্টির কল্যাণময় পতাকাকে উচ্চে তুলে ধরেছেন অথচ সময়কে সুস্থ বোধের চলমানতার পথ দেখিয়েছেন৷

শেষের কবিতা গ্রন্থে, লাবণ্যকে ভালবেসে অমিত শিলং পাহাড়ে আটকে যাওয়াতে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘শিলং পাহাড়টা অমিতকে রসিয়ে নিয়েছে৷’ আমি শব্দটির সাহায্য নিয়েই বলছি, সঙ্গীত, মান্না দে-কে রসিয়ে নিয়েছে৷ এই শুনছি ‘লাগা চুনারি মে দাগ’ তারপরই শুনছি, ‘আও টুইস্ট করে’৷ এই শুনছি ‘বড় একা লাগে’ তারপরই শুনছি, ‘কাহারবা নয় দাদরা বাজাও’৷ এই শুনছি ‘ওগো শেষ বিচারের আশায়’, পরে শুনছি, ‘কুড়ুল করাত নিয়ে পোড়া বরাত নিয়ে, জঙ্গলে জঙ্গলে কাটি কাঠ’৷ তাঁর নিজের গানের বাণী দিয়েই তাঁকে প্রকাশ করতে ইচ্ছে করছে,— ‘মেজাজটাই আসল রাজা’৷ তিলোত্তমা ছবিতে, ‘গোলাপের অলি আছে’ গান রেকর্ডিং হচ্ছে, rehearsal পাকা— বললাম, মান্নাদা এবার রেকর্ড করি৷ উত্তর— দাঁড়ান মশাই— এখন দেরি আছে— গানটা ভাল করে গাইতে দিন৷ রাধুবাবু (রাধাকান্ত নন্দী) বাজান বলেই তবলার বাণী উচ্চারণ করতে করতে ঝোঁক দিয়েই শুরু করলেন, ‘গোলাপের অলি আছে’৷ — একটানা গেয়ে গেলেন ‘কেউ নেই আমার’ পর্যন্ত৷ Orchestration ছিল দৃশ্য অনুযায়ী সাদামাঠা কিন্তু সেদিন রাজার মেজাজ সামলাতে নির্দিষ্ট সময় অতিক্রম করে Overtime হয়ে গেল৷ কিন্তু প্রণাম পেলেন আমার সেই সম্রাট মানুষটি, যাঁর নিজেরই অন্য গানের উচ্চারণ ‘মেজাজটাই আসল রাজা, আমি রাজা নই৷’

প্রয়োগশিল্পের উৎকর্ষ পরিমাপ করার কোনও এককের যন্ত্র নেই৷ হৃদয়ের মিটার, বোধের স্পন্দন, কয়েক ফোঁটা অশ্রুই প্রয়োগশিল্পের সার্থকতাকে মর্মস্পর্শী করতে পারে৷ ‘সুন্দরী গো দোহাই দোহাই মান করো না’ গানটির দ্বিতীয় লাইনে ‘না বলো না’ প্রকাশের অভিব্যক্তি ও ‘না না যেও না, ও শেষ পাতা গো’ গানটির ‘চিহ্নটি তার রাখো’-র পর যখন ‘না যেও না’ ফিরে আসছে, তার প্রকাশ একই কণ্ঠস্বরের ভিন্ন অভিদ্যোতনা হয়, তখন ভাবি এও কি সম্ভব? হ্যাঁ, সম্ভব, নিশ্চয় সম্ভব৷ যখন সেই আবেদন, অন্য মনে সঞ্চারিত করার গায়কি, অনির্বচনীয় বিশেষণে বিভূষিত শিল্পী, আমার জীবনের প্রণাম-বিগ্রহ মান্না দে হন৷ পাণ্ডিত্যের কারাগার থেকে রসদ সংগ্রহ করে নন্দন-সুষমার আবেগ সৃষ্টি করা সেই মহান জাদুকর, কারিগর মান্না দে হন৷

রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘কমলহীরের পাথরকেই বলে বিদ্যে আর ওর থেকে যে আলো ঠিকরে পড়ে তাকেই বলে কালচার৷’ এই সাঙ্গীতিক বিদ্যাকে সংস্কৃতি বোধের রসসমুদ্রে স্নাত করে যে মাধুরী, যে সুধা মান্নাদা আকণ্ঠ পান করিয়েছেন বিশ্বজনকে তা বচনীয় নয়— তা উচ্চারণে উচ্ছিষ্ট করা যায় না৷ এ শুধু ‘হৃদয়ে হৃদয় দিয়ে অনুভবে’র বিষয়— অনুক্ত সম্পদ৷ অতীন্দ্রিয় রসবোধ না থাকলে এই বিদগ্ধ অভিদ্যোতনা অসম্ভব৷ আর যথার্থ রসবোধ থাকার কারণেই, রস বিভ্রাটের বিচ্যুতি মান্নাদার গায়নকে দূষিত করতে পারেনি৷ যে গান যেমন, সে গান তেমনই পরিবেশন৷ তাঁর ব্যক্তিজীবনেও এই রসবোধ বিধৃত৷ আমায় একদিন বললেন, ‘ও ময়াই (উনি মশাইটা এইভাবে উচ্চারণ করেন) বাজারে গিয়ে দেখি ভীষণ ভাল পমফ্রেট মাছ৷ বেশ কিছু কিনে নিয়ে এলাম৷ বাড়িতে এনে নিজেই কাটাকুটি করে, শসা, টমেটো সহযোগে পুর তৈরি করে একটি মাছের দুটি টুকরোর মধ্যে পুরটা দিয়ে, সুতো দিয়ে বেঁধে ফ্রিজে ঢুকিয়ে দিলাম, দু’ঘণ্টা বাদে ফ্রিজ থেকে বের করে, ভাল সর্ষের তেলে একটা করে ভেজে দিচ্ছে আর আমি খেয়ে যাচ্ছি’— একটু চুপ থেকে মুচকি মুচকি হাসি হেসে বললেন, ‘সেদিন আর নো রাইস’৷ বুঝুন রসবোধ! একটি স্বাদের সঙ্গে অন্যটি মেশাবেন না৷ একবার একটা ছবির গান তোলাতে গিয়েছি, আমাদের কাজ সমাপ্ত৷ কিন্তু প্রবল বর্ষণে রাস্তায় জল দাঁড়িয়ে গেছে৷ আমাদের আড্ডা জমে গেল, বিনিময় চলছে জোরকদমে৷ হঠাৎ বললেন, ‘ও ময়াই, আপনি তো খুব ট্রিকি নোটস ব্যবহার পছন্দ করেন, দেখুন তো বারোটা গজলের একটা এল পি করছি, কেমন লাগে?’ যত শুনছি মনে হচ্ছে এখানটা এরকম করলে বেশ হত— ওখানটা ওরকম করলে ভাল হত— কিন্তু যখন বারোটা গান সমাপ্ত হল, মনে হল পায়ে পড়ে যাই৷ কী অসাধারণ শিক্ষা ও তার প্রয়োগে পরিমিতি বোধ— একটা রসের সঙ্গে অন্য রসের মিশ্রণে তার আবেগকে বিবেকবিহীন কখনও হতে দেন না৷ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘Art-এ থামবার জায়গাটা অত্যন্ত জরুরি— Art is never an exhibition but a revelation. অর্থাৎ শিল্প প্রদর্শনী নয়, প্রকাশ৷ অনেক জ্ঞান, অনেক পাণ্ডিত্য, অনেক ওস্তাদির শিক্ষায় সমৃদ্ধ হয়েও নন্দনবোধে দীক্ষিত মান্নাদা জানতেন, কোন গানে কোথায় কতটা দিতে হবে আর কোথায় থামতে হবে৷ তিনি জানতেন গানে গানে ছবি আঁকতে৷ তাঁর কোনও পরিবেশনই তাই আরোপিত নয়, আকাঙ্ক্ষিত৷ তাঁর অ্যাকাডেমিক শিক্ষা, সাঙ্গীতিক দীক্ষা ও সংস্কৃতির নন্দনবোধ মিলেমিশে পূর্ণতা পেয়েছে৷ Fantastic equation of emotional laws and versatile skill.

মান্নাদা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিখে আধুনিক গানে এসেছেন৷ অথচ তাঁর উচ্চারণে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন যে কোনও সঙ্গীতে বাণীর প্রকাশ কতটা লাবণ্যময় হওয়া উচিত৷ অনেক ওস্তাদ বা পণ্ডিতেরা তাদের ব্যাকরণ-সর্বস্বতা দিয়ে সেই উচ্চারণকে চিবিয়ে কামড়ে শেষ করে দেয়— তাতে তারা আর শিল্পী পর্যায়ে উঠতে পারে না৷ আমির খাঁ-র মতো শিল্পীরা ‘ক্যায়সে কাটে রজনী’ বা ‘পিয়া কি নজরিয়া’ বলতে গিয়ে ভাষার যে বিষয় তার সংবেদনশীলতাকে ব্যাহত করেন না৷ আমাদের বাংলার অজয় চক্রবর্তী যেমন কী বাংলা, কী হিন্দি, কী সংস্কৃত এমন উচ্চারণ করেন যেন কণ্ঠ থেকে শব্দটা মুক্তো হয়ে ঝরছে৷ আধুনিক সঙ্গীতের জগতে হেমন্তদা, মান্নাদার উচ্চারণ তেমনি জ্বলজ্বলে নক্ষত্র৷ মান্নাদা ভারী কণ্ঠের শিল্পী নন, তবু গানের কথাগুলো কত মমতা দিয়ে উচ্চারণ করে গানটির সমগ্র বিষয়বস্তুকে কত আন্তরিক করে তোলেন৷ তাঁকে সঙ্গীত পরিচালকরা intimate romantic song বেশি গাওয়াননি— এটা সঙ্গীত পরিচালকদের দৈন্য বলব, কারণ গাওয়ালে তিনি কোথায় পৌঁছে দিতে পারেন তা বোঝাতে দুটি গানের উল্লেখ করব৷ একটি অনুভব (হিন্দি) ছবিতে ‘ফির কহী কোই’ আর বাংলা শঙ্খবেলা ছবিতে ‘কে প্রথম কাছে এসেছে, কে প্রথম ভাল বেসেছে’৷ আমার মন যখন খারাপ থাকে, তখন আমার যদি হিন্দি গান শুনতে হয়, তার জন্যে কিছু হিন্দি গান এক জায়গায় সঙ্কলিত করে রেখেছি, যেখানে তালাত মামুদের ‘জ্বলতে হায় জিসকে লিয়ে’, মান্নাদার ‘ফির কহী কোই’ গানগুলো আছে, যেগুলো শুনে আমি কাঁদি৷ ভারী কণ্ঠের ব্যাপ্তি voice-কে যতটা modulation span দিতে পারে, ছোট আওয়াজ তা পারে না, তবু নিষ্ঠা, সাধনা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, কাব্য সাহিত্য বোধ জাতশিল্পীর বোধ ওই স্তিমিত পরিধির মধ্যে modulation-এর কোন চূড়ান্ত পর্যায় নিতে পারে তা প্রমাণ পাওয়া যায় পাশাপাশি মান্নাদা গীত কিছু গানকে শুনলে৷ ‘আমায় একটু জায়গা দাও’, ‘ফির কহী’, ‘য্যা মেরে প্যারে বতন’, ‘আও টুইস্ট করে’৷ তালাশ৷ ‘কে প্রথম কাছে এসেছে’, ‘গোলাপের অলি আছে’, মধুমতির ‘দৈয়ারে দৈয়ারে’, ‘এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয়’— কী বিস্ময়কর modulation of voice৷ বসন্ত বিলাপ, ছদ্মবেশীর গান তো fantastic৷

মহঃ রফি ভারতবর্ষের সঙ্গীত জগতের গিনি সোনার অলঙ্কার তথাপি একদিন রাত্রের এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয় গানটির মধ্যে মাতালের যে স্বাভাবিক অভিব্যক্তি তা কিন্তু আমি জাগতে রহোর ‘জিন্দেগি খোয়াব’-এ পাইনি৷ আমি ক্ষমা চেয়েই বলছি, মান্নাদার কণ্ঠে মাতালকে মদ খাওয়া মাতাল মনে হয়েছে যেখানে রফি সাহেবের গানে মনে হয়েছে না খেয়ে মাতালের অভিনয় করছে৷ লিখে লিখে এত বড় মাপের শিল্পীর উৎকর্ষকে প্রকাশ করা যায় না৷ যিনি মান্নাদার ভক্ত, বাংলা, হিন্দি বা ভারতীয় যে-কোনও ভাষায় আধুনিক সঙ্গীতের পূজারী, যাঁর অনুসন্ধানের প্রেরণা আছে, গবেষণার মন আছে তাঁরা মান্নাদার গান শুনুন৷ নিজে আবিষ্কার করুন তাঁর অবদান— বিমোহিত হবেন৷ বর্তমানে নানা ভাবে বিভিন্ন মানুষ সংগ্রহশালা গড়ে তুলছেন, তাঁদের সন্ধান করে বাংলা তথা ভারতীয় সঙ্গীতের উজ্জ্বল নক্ষত্রদের কাজ নিয়ে গবেষণা করুন— নিজেও তখন ইতিহাসের একজন সাক্ষী হতে পারবেন৷

চৈতন্যদেব বলেছেন, রবীন্দ্রনাথও ‘শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থে লিখেছেন, প্রেমই মানুষের মুক্তি৷ সেই প্রেমের বিচিত্র রস-বিন্যাসই মান্নাদার সমস্ত গানে নানা বিভূতিতে বিভূষিত৷ ‘কাবুলিওয়ালা’ ছবিতে ‘য্যা মেরে প্যারে বতন’ শুনলে বোঝা যায় ঘরমুখী মানুষের দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতার কান্না ও পস্তু গানের দেশজ প্রেম দুইই কেমন তাঁর ললিত কণ্ঠে মিশে এক বোধে পরিপূর্ণতা লাভ করেছে৷ শ্রবণ ও মননকে সহবাস করিয়েছে৷ সলিলদাও এক ভিন্ন হৃদয়-দর্শন দিয়ে মান্নাদাকে আবিষ্কার করেছিলেন৷ তাঁর প্রথম হিন্দি ছবি ‘দো বিঘা জমিন’-এ ‘ও ভাইরে মৌসম বিতা যায়’ গানে জমিহারা কৃষকের শহরমুখী জীবনে প্রবেশের যে বেদনা তাকে রূপায়িত করার জন্যে নির্বাচন করেন মান্নাদাকে৷ আবার রাজ কাপুরের ছবি ‘একদিন রাত্রে’-তে, যেখানে রাজ কাপুরের পছন্দের শিল্পী মুকেশজি বা মাতালের গানে বম্বে জগতের মহম্মদ রফি অবশ্যম্ভাবী শিল্পী নির্বাচিত হওয়ার কথা, সেখানে মাতালের মুখে গিমিক-নির্ভর গানে সঠিক শিল্পীর অভিব্যক্তি ব্যবহার করার জন্যে নির্বাচন করলেন মান্নাদাকে৷ অভিজাত অস্তিত্বের অধিকারী সর্বজন শ্রদ্ধেয় নট ছবি বিশ্বাসের মুখে জীবন দর্শনের বাণী প্রকাশিত হবে সেই ভাবনায় ভাবিত হয়েই সলিলদার চিন্তা— কী অন্তর্দৃষ্টি ! ওই চিন্তা ইতিহাস হয়ে গেল৷ সেই থেকে বাংলা ছবিতে মাতালের মুখে গান বা গিমিক-নির্ভর সঙ্গীতে মান্নাদাই প্রতীকী শিল্পী হয়ে বাংলা চলচ্চিত্র জগৎ মাতিয়ে দিলেন৷ দীনেন গুপ্তের শেষ ছবি ‘ঋণমুক্তি’-তে আমি মান্নাদার একটা গান করলাম মাতালের মুখে৷ গানটা রেকর্ডের পর দীনেনবাবু মলিন মুখে বললেন, ‘অভিজিৎবাবু, এই শিল্পী চলে গেলে আর এই ধরনের গান ছবিতে রাখা যাবে না৷’ আবার অন্য দিকে সলিলদা ‘বাজে গো বীণা’, ‘কাটি কাঠ’ও গাওয়ালেন ‘মর্জিনা আবদাল্লা’-তে৷ ‘আনন্দ’ ছবিতে মুকেশজি গাইছেন রাজেশ খান্নার মুখে, কিন্তু যেই জীবন দর্শনের গভীর বাণী সংযুক্ত গান এল— ‘জিন্দেগি ক্যাইসী হ্যায়’ তখনই ডাকলেন মান্না দে-কে৷ মধুমতিতে ‘ও বিছুয়া’ গানে মান্নাদার rendering অভাবনীয়৷ মান্নাদা যে শিল্পী হিসেবে বিচিত্রগামী, তা সলিলদার অনুভবে বহু পূর্বেই ধরা পড়েছে৷ এই বিষয়ে আমি সুধীনদাকেও প্রভূত সাধুবাদ জানাই৷ ‘ডাকহরকরা’ ছবিতে সুধীনদা যখন মান্নাদাকে নির্বাচন করেন তখন মান্নাদা সেভাবে বাংলা গানে প্রবেশই করেননি৷ এমনকী হিন্দির জগতে সেভাবে identified tone-এর singer-ও নয় কেবল দক্ষ ও যোগ্য গায়ক৷ অথচ তাঁর কণ্ঠস্বরে ও অভিব্যক্তিতে ‘ওগো তোমার শেষ বিচারের আশায়’ শুনে যে মানুষ চোখের জলে ভাসবে এ কথা সুধীনদা বুঝেছিলেন৷ সুধীনদা মান্নাদাকে নানান আঙ্গিকে ব্যবহার করেছেন৷ কখনও ‘জীবনে কি পাবো না’ বা ‘হয়ত তোমার জন্য’, আবার শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পরিকাঠামোয় ‘বসন্ত বিলাপ’-এর ‘আগুন’ গানটিতে কী অসাধারণভাবে খেয়াল বন্দিশ ও পাশ্চাত্য বিট-এর মিশ্রণে গিমিককে ব্যবহার করে সার্থক রূপ দিয়েছিলেন সুধীনদা৷ ছদ্মবেশীর গান তো সংলাপ হয়ে ফুটে উঠেছে৷ নচিদাও বিচিত্রভাবে তাঁকে ব্যবহার করেছেন৷ এটা সম্ভব হয়েছিল শিল্পী মান্না দে বলেই৷ একটা গল্প মনে পড়ল৷

‘শ্রদ্ধাবান লভতে জ্ঞানম’— শ্রদ্ধা ছাড়া কোনও বোধই পুষ্ট হয় না৷ সমস্ত শ্রদ্ধাই বিষয়ের পদতলে শ্রদ্ধাশীল না হলে বিষয়টি আয়ত্তাধীন হয় না— বোধ বোধিতে উত্তরিত হয় না৷ মান্না দে ছোট বড় নির্বিশেষে গুণ ও গুণীর প্রতি শ্রদ্ধাবনত অভিব্যক্তি দিয়ে আত্মবোধকে স্নাত করেছেন৷ আমরা যাঁরা তাঁর অনুজ আমাদের কাজকেও শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করেছেন৷ অনুষ্ঠানে ‘গোলাপের অলি আছে’ গাইতে গাইতে শ্রদ্ধার সঙ্গে রাধাকান্তবাবুকে বাজাবার জায়গা করে দিতেন, যাতে রাধাকান্তবাবু তাঁর দক্ষতা প্রকাশ করতে পারেন৷ তবলার একক সুযোগ শেষ হতেই জনসমক্ষে বলে উঠলেন, ওঃ রাধুবাবু অভিজিৎবাবু কী সুন্দর Composition করেছেন— সংলাপটি বলেই শুরু হল আবার গান৷ এই আত্মতৃপ্ত প্রকাশ সমস্ত সময় তাঁর বোধের অন্তরঙ্গ সঙ্গী৷

ঘটনাটা মান্নাদার মুখেই শুনেছি৷ দাদার-এ, উত্তমবাবুর সঙ্গে পথে দেখা মান্নাদার৷ উত্তমবাবুর হাতে একটা টেপরেকর্ডার৷ মান্নাদাকে দেখে দাঁড়িয়ে গিয়ে বললেন, ‘এমন গান গেয়েছেন যে হাতে টেপ নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে আর mobile rehearsal চালাচ্ছি৷ মান্নাদার কাছে জেনে নেওয়া হয়নি কোন গানটা নিয়ে এমন প্রক্রিয়ার গুরুত্ব৷ তবে সংলাপ বিনিময় শুনে আমার বারবার মনে হয়, এই গায়ন মুনশিয়ানার প্রকাশ সন্ন্যাসী রাজার ওই গানকে কেন্দ্র করেও হওয়া সম্ভব৷ কাহারবা না দাদরা বাজাও৷ সঙ্গীত চিত্রায়নে উত্তমবাবুর ঠোঁট নাড়ানোর বাহাদুরি সর্বজনস্বীকৃত৷ তা এত যথাযথ যে তার অভিব্যক্তিতে মনেই হবে না যে শিল্পী play back-এ lip movement করছেন৷ আর ওই কাহারবা না দাদরা বাজাও-তে এমন অভিনয় করেছেন মান্নাদা যে উত্তমবাবুর মতো অভিনেতাকেও ভাবতে হয়েছে সাঙ্গীতিক নাটকীয়তাকে চরিত্রাভিনয়ের সঙ্গে কীভাবে যথাযথ করে সমবোধে গ্রথিত করা যায়৷ মান্নাদা সঙ্গীতে নাটক৷ গিমিকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে দিকপাল৷ গানের মধ্যে তাঁর অভিনয়গুলো অসম্ভব সহজাত ও স্বভাব সম্পৃক্ত ভাবে সার্থক ও প্রাণবন্ত৷ আমার বিস্ময় লাগে এই ভেবে যে এক খানদানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মহল ও উচ্চ মার্গের কীর্তন দরবার থেকে বেরিয়ে এসে রক্ষণশীলতার সমস্ত মানসিক বিকারের খোলস ছেড়ে অথচ ঐতিহ্যকে যোগ্য মর্যাদা দিয়ে কীভাবে সময়ের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে রবীন্দ্রনাথের সেই বাণীকে সত্য করেছেন তিনি৷ রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘সঙ্গীতে, এতখানি প্রাণ থাকা চাই, যাহাতে সে সমাজের বয়সের সহিত বাড়িতে থাকে, সমাজের পরিবর্তনের সহিত পরিবর্তিত হইতে থাকে, সমাজের ওপর নিজের প্রভাব বিস্তৃত করিতে পারে ও তাহার ওপর সমাজের প্রভাব প্রযুক্ত হয়৷’ প্রণাম জানাই নচিদাকে৷ আমার প্রিয় সুরকার৷ আমার সুরের ওই গান, তিলোত্তমা ছবির, ‘গোলাপের অলি আছে’— গানটি গাইবার বিকল্প কোনও শিল্পী কি খুঁজে পাওয়া যেত? বেশি যন্ত্র নিয়ে recording-এ সময় বেশি লাগে, Overtime হয়ে যায়৷ কিন্তু এই গানটি recording-টা কম যন্ত্র নিয়ে করা সত্ত্বেও Overtime হল প্রায় ২ ঘণ্টা৷ কারণটা বলি—

গানটি আমি তৈরির সময় ‘সা’ ভেবেছি B Flat-কে কিন্তু গানটি আমার শুরু ধা থেকে৷ স্বাভাবিকভাবেই open chord B Flat না— G minor৷ আমি B Flat Scale ভাবছি— অলকনাথ দে ‘সা’ করলেন ‘D’-কে৷ কিন্তু মান্নাদা মনকে গেঁথে নিলেন ‘G’-কে ‘সা’ করে, তারপর গানের ভঙ্গিকে একবারে ভৈরবী মিশ্রিত কাওয়ালি অঙ্গে নিয়ে গিয়ে গাইতে থাকলেন৷ আর যতই বলছি, মান্নাদা এবার record করি— উনি বলছেন, দাঁড়ান মশায় আমায় একটু ভাল করে গাইতে দিন৷ তবলাবাদক রাধাকান্ত নন্দী ও তিনি দুজনে মিলে মেতে গেলেন এমনভাবে যেন গানটিতে আমার আর কোনও ভূমিকা নেই৷ তখনকার শিল্পীদের গান দিলে তারা সেটা নিজের করে নিতেন৷ মান্নাদা এই গোলাপের অলি আছে গানটি recording করার সময় এবং পরেও নানা অনুষ্ঠানে গাইবার সময় বুঝিয়ে দিয়েছেন, গানকে কী করে রবীন্দ্রভাষায় যাকে বলে ‘রসিয়ে নেওয়া’, সেই রসিয়েই তিনি নিলেন৷ ‘রাগপ্রধান গান ও কাওয়ালি’ গানকে বাংলা গানের নির্মাণে ও গায়নে তিনি মুক্তি দিয়েছেন মূল বাংলা গানের ধারার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার দক্ষতায়৷ He is great কিন্তু তিনি কালের কাছে, বাংলা গানের ইতিহাসের কাছে কী অমূল্য উপহার দিয়ে গেছেন তা যদি সঙ্গীত সমাজ ও শ্রোতারা অনুধাবন করতে না পারেন তবে সঙ্গীত থেকে জীবন যে রস গ্রহণ করতে পারে, এ বোধ থেকে তাঁরা নিজেরাও বঞ্চিত হবেনই৷ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘সঙ্গীতের উদ্দেশ্যই ভাব প্রকাশ করা৷’ তাঁর এই উচ্চারণকে ভাব সম্প্রসারণ করে আমি বোধ করেছি any art is for communication from one soul to another বা আরও নিবিড় ও গভীরভাবে বলা যায় from one impulse to another impulse৷ এই communication fail করলেই সমস্ত সৃষ্টিটাই বিফল৷ শিল্প নির্মাণের মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হল৷ একটি ঘটনার উল্লেখ করছি যা এই সঙ্গীত বিষয়ক রচনায় ও ব্যঞ্জনায় অতি প্রাসঙ্গিক বলে আমি বিবেচনা করছি৷ কোনও এক সময়ে যাত্রা জগতের নটসম্রাট শ্রদ্ধেয় স্বপনকুমারের সঙ্গে কিছু কাজ করার সুযোগ এসেছিল এবং সেই সুবাদে একদিন তাঁর শয়নকক্ষে আমার যাওয়ার প্রয়োজন হয়েছিল তাঁর ডাকে— গিয়ে দেখলাম তাঁর ঘরে bed Level-এ ঘরের তিনভাগ দেওয়াল জুড়ে আয়না বসানো৷ তিনি যখন শুয়ে থাকেন তখন একা একা ঘরে শুয়ে শুয়ে মাইম অভ্যাস করেন৷ আমি স্তম্ভিত৷ শিল্পকে সত্য করে তোলার কী অসাধারণ এক সাধন-প্রক্রিয়া৷ যে শিল্পী তার নিজস্ব শিল্প মাধ্যমের ব্যাকরণকে ব্যবহার করে বিশেষ ভাব, জীবনের নন্দনরূপ, বোধের সত্য আনন্দ তত্ত্বকে প্রকাশ করতে পারেন সেই শিল্পীই যথার্থ শিল্পী৷ জ্ঞান তত্ত্ব, পাণ্ডিত্য তত্ত্ব, ওস্তাদি তত্ত্ব বা অশিক্ষা তত্ত্ব দিয়ে শিল্পকে রূপ দেওয়া যায় না৷ রবীন্দ্রনাথ সঙ্গীতের যাবতীয় রস সমৃদ্ধিকে আত্মীকরণ করে যে রূপ দিয়েছেন সঙ্গীতে— তাকে রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া অন্য কিছু বলে সংজ্ঞায়িত করা যাবে না৷ একেবারে মৌলিক৷ সেই অর্থে এবং উপরোক্ত চিন্তা ও বোধের আলোতে আমি মান্না দে গীত, সুরারোপিত সঙ্গীতকে ‘মান্না সঙ্গীত’ বলে আখ্যায়িত করব৷ কেবল গায়ন শিল্পকে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন তা নয়, নির্মাণকেও তিনি কোনও কোনও ক্ষেত্রে স্বকীয় রূপ দিয়েছেন৷ যেমন রাগ ব্যবহার করেও রাগপ্রধানের নিজস্ব style-কে প্রয়োগ করেও তা রাগপ্রধান নয়— আবার সেই বিচারে কাওয়ালিও কাওয়ালি নয়৷ তাঁর বোধ, শিক্ষা, সংস্কৃতি প্রভৃতি যাবতীয় প্রয়োজনীয় গুণের রসে জারিত কণ্ঠ মাধুর্য ও সুর বৈচিত্র্য যা উপহার দিয়েছে বাংলা সঙ্গীতের ধারাকে, তাতে ইতিহাসের পাতায় তাঁর নামটি স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকতে বাধ্য— এটা কালেরই স্বীকৃতি— যা সমস্ত পুরস্কারের ঊর্ধ্বে৷ আমার এই রকমবোধ নিয়েই সেদিন মান্নাদার শিল্পকাণ্ডের সংগ্রাহক শ্রীগৌতম রায়ের মোবাইলে মান্নাদার দুটি গুজরাটি গান শুনলাম৷ কী অসাধারণ dedication, attachment সেই rendering-এ৷ এত আন্তরিক, এত সুর ইন্দ্রজালে পরিপূর্ণ, গুজরাটি ভাষা না বুঝলেও শিল্পের প্রাথমিক শর্ত communication তার যেন এক জীবন্ত স্বমহিমা প্রকাশ৷ প্রথমেই বলছি প্রয়োগ শিল্প লিখে বোঝানো যায় না কারণ লেখায় যা জ্ঞানতত্ত্ব তা হৃদয়ের আঙিনায় নিয়ে বিচার না করলে, কেবল জ্ঞান নিয়ে রসের সঞ্চালন করা যায় না৷ আজ এই কারণে ধর্মও বিপন্ন৷ Religion is not ritual but spiritual৷ সাঙ্গীতিক rituals-এ ওস্তাদি বা পণ্ডিতি করা যায়— সঙ্গীতকে শিল্প করতে গেলে সঙ্গীতে rituals পালন করে অনুভূতিকে সুরের তরীতে ভাসিয়ে সাঙ্গীতিক spiritual-এ উত্তরিত করতে হয়— যেখানে মান্নাদা ১০০% spiritual আর মান্না কণ্ঠী শিল্পীরা rituals-এর অনুগামী৷ মান্নাদাকে একদিন ফোনে বলেছিলাম— মান্নাদা আপনার ভক্ত ও অনুগামীরা মান্নাদের ওস্তাদি বা পণ্ডিতি বেছে নিয়েছে কিন্তু তাকে ছাপিয়ে যে রস অবগাহন করা শিল্পী মান্না দে— তার সন্ধান পায়নি৷ মান্নাদা হেসেছিলেন৷ আসলে সেটার জন্যে যে শিক্ষা ও তৎসম্পৃক্ত সংস্কৃতির সাধনা, জীবন সাধনা দরকার সেটা তারা করেনি৷

ভারতবর্ষের বহুরকম ভাষায় মান্নাদা গান গেয়েছেন এবং প্রতিটি ভাষার উচ্চারণ সম্পর্কে তাঁর সজাগ-নিষ্ঠ পরিবেশন বিস্ময়কর৷ শ্রুতিমধুর৷ বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীরা গানটা সঠিকভাবে পাঠ বা আবৃত্তি করে না— কিন্তু হেমন্তদা, মান্নাদা এঁরা উচ্চারণ সম্পর্কে একটা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন৷ স্বরক্ষেপণের মতো বাণীক্ষেপণ তাঁদের যেমন সুললিত মাধুর্যময়, তেমন হৃদয়গ্রাহী৷

শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সাগরে যাঁরা ডুব দিয়েছেন অতল পর্যন্ত তাঁরাই খুঁজে পেয়েছেন রতনমণি৷ তাঁরাই সঙ্গীত ধ্বনিতে ধনী হয়েছেন৷ উদ্ভাসিত হয়েছেন মণিমুক্তার দিব্য জ্যোতির জৌলুসে৷ তাঁরাই বুঝেছেন সেই সমুদ্রের ওপরে অজস্র ঢেউ আর অতলান্তিকে রত্নরাজির ছড়াছড়ি৷ নদী শুকোয় সাগর তো শুকোয় না৷ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এই সত্য মান্নাদার অন্তরে বোধেবোধ হয়ে অমৃতরস হয়ে গেছিল, তাই তাঁর সাঙ্গীতিক বৈচিত্র্যময়, বর্ণময় অভিপ্রকাশ নন্দনঋদ্ধ মননকে অভিজাত অথচ নৈসর্গিক চলমানতার অনুভবে সমৃদ্ধ করেছে দীর্ঘ সময় ধরে৷ কিন্তু এই কাজে তাঁর প্রয়োগ কৌশলের চাবিকাঠি কোন বোধের সিন্দুকে রক্ষিত ছিল সেটাই অনুধাবনীয়৷ আমি যেমন বুঝেছি আমি আমার মতো করেই সেটা বলার চেষ্টা করেছি৷

(১) রবীন্দ্র জন্ম শতবার্ষিকীতে তাঁর ‘বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা’ গানটির হিন্দি আমি শুনি রেডিওতে, আমি ব্রাহ্ম পরিবারে জন্মাবার সুবাদে ব্রহ্ম সঙ্গীতের সুর আমার রক্তে স্পন্দিত বরাবরই৷ আর সুবিনয় রায়, রমেশ বন্দ্যোপাধ্যায় ও আমার মেজ জ্যাঠা নিরুপম বন্দ্যোপাধ্যায়দের কণ্ঠে শ্রবণ করে করে এ সব গানের এক ভিন্ন অনুভূতি আমার মনে সদা অনুরণিত৷ মান্নাদাও সেদিন তাঁর গানে আমার গায়ে কাঁটার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন৷ অশ্রুকে স্বতঃস্ফূর্ত করিয়েছিলেন সেই গানে৷

(২) একটি নারীকে ভালবাসলে তার দেহস্পর্শ রক্তে নাড়া দেয় কিন্তু আঁচলটা যদি শুধু গায়ে লাগে তবে অতীন্দ্রিয় অনুভবে শরীর রোমাঞ্চিত হয়৷ এই অনুভূতি আমার পাকা হয়েছে যখন মান্নাদার গাওয়া ‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়’ গানটির মধ্যে মান্নাদার স্পর্শস্বর লাগানো শুনি৷ এই গানে বেশ কিছু স্পর্শস্বর আছে যা স্বরক্ষেপণের দক্ষতায় অসম্ভব পারদর্শী না হলে গাওয়া সম্ভব না৷ আবার, রবীন্দ্র অনুভবের আবেশের মধ্যে থেকেই সেই প্রেমানুভূতির বিরহকে হৃদয়গ্রাহ্য করতে হবে৷ শক্ত ব্যাপার৷ আমার মনে হয়েছিল এবং এখনও বিশ্বাস করি ভারতবর্ষে দ্বিতীয় কোনও শিল্পী নেই, শিক্ষায় দীক্ষায় ভাবাবেগে গানটিকে ওই মাত্রায় পৌঁছে দিতে পারবে৷

(৩) বোম্বের কোনও এক দিকপাল সঙ্গীত পরিচালক রবীন্দ্রনাথের গান সম্পর্কে অবমূল্যায়ন করেছিলেন৷ মান্নাদা তাঁকে বাড়িতে ডেকে এনে একঘণ্টা রবীন্দ্রনাথের গান শুনিয়ে তাঁর মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন৷ এবং সবশেষে ‘ওগো স্বপ্ন স্বরূপিণী’ যখন শোনালেন সেই সঙ্গীত পরিচালক প্রায় টলতে টলতে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন৷ এই সব সওয়াল নিয়ে যখন মান্নাদাকে গণ আদালতে পেশ করলাম তখন তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি রবিঠাকুরের গান কিছু গেয়েছি৷ ওঁর বাণী পাঠ করলেই তো সঙ্গীত৷ কিন্তু আমি দেখেছি আমার থেকে এই গান অনেকেই বেশি ভাল গায়, বিশেষ করে হেমন্তবাবু৷ তাঁর কণ্ঠের তো তুলনা হয় না৷’ তখনও ফালকে পুরস্কার পাননি৷ কিন্তু পদ্মভূষণপ্রাপ্ত ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কলাকার হিসেবে আদৃত তবু পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে এই স্বীকৃতি দিতে তাঁর কোনও দ্বিধা হয়নি৷ আসলে তিনি আজন্ম শিল্প পূজারী৷ সলিলদা চলে যাওয়ার পর মিডিয়াকে বললেন, আমার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার লোকটাই চলে গেল৷ ভাললাগা না লাগাটা তাঁর আন্তরিক আবেগ থেকে প্রকাশ হয়েছে upto last৷ মান্না দে-র অনুরাগী ও অনুসারীদের চরণ ধরে আবেদন করছি, ভাই বোন বন্ধুরা, প্রিয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সাধকেরা, দয়া করে মান্না দে-কে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের খাঁচায় আবদ্ধ করবেন না তাঁকে নন্দন কাননের উদাস প্রেমিকের মতো অমর করে রাখবার তপস্যায় নিজেদের মননকে নিয়োজিত করুন৷ মনে রাখবেন, আধুনিক জীবনের পরিচর্যার একটি সম্মেলক অঙ্গন সেই কফি হাউসের আড্ডার সত্য চিত্র অঙ্কনে সুপর্ণ গৌরীদার সময়োচিত কল্পনার নিষ্ঠ অভিদ্যোতনা মান্না দে-ই ঐশ্বর্যায়ন করেছেন৷

এত বড় জীবন, এত বড় শিল্পী— ভারতের যাবতীয় আঞ্চলিক ভাষায় সঙ্গীত পরিবেশক— মান্না দে-কে নিয়ে আন্তরিক গবেষণা আজকের এই অবক্ষয়ী সমাজ ও সাংস্কৃতিক পটভূমিকায় অত্যন্ত জরুরি৷ সমস্ত সমাজব্যবস্থা আর্থ সামাজিক সম্পর্কগুলো এত দ্রুত ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে, সেখানে অসুস্থ মন, বোধগুলোকে রক্ষা করতে সুস্থ সংস্কৃতির জাবর কাটা এক অত্যাবশ্যক চিকিৎসা৷ তাই মান্না দে-র মতো অস্তিত্বকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসন্ধান করে অনুশীলনের অঙ্গনে নিয়ে আসতেই হবে৷ মানুষ মানুষে সেতু বন্ধনের প্রধান রজ্জু-সঙ্গীত— সেই সঙ্গীত ঈশ্বরীয় হয়ে উঠেছে যে সব মহান শিল্পীস্রষ্টার অবদানে, তাঁদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মান্না দে৷

রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে আধুনিক সঙ্গীত ও সঙ্গীতকার, কলাকার নিয়ে প্রামাণিক গবেষণা হচ্ছে না, হয়নি৷ কারও দায়বদ্ধতা নেই এ বিষয়ে, অথচ এটা অত্যন্ত জরুরি৷ ঐতিহ্যের হাত ধরেই যথার্থ প্রগতি সম্ভব, তাই ঐতিহ্যের ঐশ্বর্য ও প্রগতির উৎকর্ষকে গাঁটছড়া বেঁধে এগোতে হবে৷ মান্নাদা আধুনিক বাংলা গানে তার যোগ্যতম প্রতীক৷ সত্যিকারের রোল মডেল৷ রাগরাগিণী গুলে খেয়েছেন অথচ রাগাতঙ্ক রোগে ভোগেননি৷ তাল লয় গুলে খেয়েছেন, তাকে হজম করেছেন, কিন্তু সাঙ্গীতিক-মাতাল হননি৷ ওস্তাদি গান শিখেছেন কিন্তু ওস্তাদ বা পণ্ডিত হননি, হয়েছেন নন্দনবোধের রসসমৃদ্ধ শিল্পী৷ রবীন্দ্রনাথের অভিমত, আমাদের পনেরো আনা গানই তো হিন্দুস্থানি গান থেকে কিন্তু তাকে নিজের করে নিতে হবে নন্দনবোধ দিয়ে৷ বলেছেন, তাজমহল থেকে আমরা সৌন্দর্যবোধের প্রেরণা নেব কিন্তু বাড়িতে গম্বুজ লাগাব না৷ মান্নাদা কাবুলিওয়ালার পস্তু গানে, গানের সামগ্রিক বেদনাকে প্রকাশ করেছেন৷ কিন্তু পস্তু গানে তাঁর ওস্তাদি শিক্ষার পাণ্ডিত্যের গম্বুজ বেঁধে ভারাক্রান্ত করেননি৷ ফালকে পুরস্কার দিয়েও তাঁর ঐতিহাসিক মূল্যকে মূল্যায়ন করা যায় না৷ তবু ভাল লাগে, তবু আনন্দ পেয়েছি লোকে তাঁকে ধরতে না পারলেও চিনতে পেরেছে বলে৷ তবে রবীন্দ্রনাথ আমাদের সব অপরিপূর্ণতার পক্ষে ভাষা সাজিয়ে দিয়েছেন, তাই আমি বলব তাঁর ভাষায়—

বোঝা যায় আধখানি কথা
আধোখানি মন
সমস্ত কে বুঝেছে কখন?

তাঁকে কিছুটা বোঝা গেছে— দিন যাবে মানুষ তথা বিদগ্ধ শ্রোতারা তাঁকে আরও বেশি করে বুঝবে৷ অনন্তকে চিনতে চিনতে, বুঝতে বুঝতে চলতে হয় অনন্তকে ধরা যায় না৷ ছোঁয়া যায় না৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *