স্বার্থপর দৈত্য – দীপেন্দ্র সেনগুপ্ত

স্বার্থপর দৈত্য – দীপেন্দ্র সেনগুপ্ত

শিউলি মেয়ে

ফুলঝুরি ,,

উঁকিঝুঁকি ,,

মেরুদণ্ড পুততুণ্ড পাড়ার লোক

বঙ্গবদন ,,

বলশালী দত্ত ,,

মোরব্বা মিত্তির ,,

দরবেশ বাঁড়ুজ্যে ,,

জমায়েত হোসেন ,,

ঠোঙা চাটুজ্যে ,,

মিস্তিরিরা ,,

প্যাঁপো ছেলে

সমুদ্র ,,

প্রান্তর ,,

গাছ ১, ২, ৩, ৪, ৫

জগঝম্প দৈত্য

ছেলে ১, ২

ঝঞ্জা

ঝড়

ঘুর্ণি

তুষার

শিশুরা

বড়োবন্ধু

ছোট্টটি

আরম্ভের আগে

[আবহ বাজতে থাকে। স্কুল ছুটির ঘণ্টার শব্দ হয়। একটি ছোটো ছেলে মঞ্চের ডান দিক থেকে ছুটে এসে মধ্যমঞ্চে একটা আলোর বৃত্তে দাঁড়ায়]

ছোটো ছেলেটি। এবার বিকেল হল,

চলো, চলো দৈত্যের বাগানে চলো-ও-ও।

[ছেলেটি মঞ্চের ডান দিকে দৌড়ে যায়। মূল পরদা সরতে থাকে। একটি বাগান দেখা যায়। গাছেরা গান গাইছে, নাচছে। ঊর্ধ্ব বাম মঞ্চেও একটা প্রাসাদের অংশ। দোতলার জানলাটা বন্ধ]

প্রথম দৃশ্য

গাছেদের নাচ ও গান

আহা ধিনতা ধিনা, ধিনতা ধিনা, ধিনতা ধিনা

ওরে খেলবি কে আয়, নাচবি কে আয় ধিনাকতিনা।

ধিনতা ধিনা-

সবুজ পাতার, সবুজ লতার বন্ধু তোরা,

আয় ছুট্টে সব অবুঝ যত পাগলা ঝোরা

এই বাগানের দিন কাটে না তোদের বিনা

ধিনতা ধিনা-

যখন বিকেল ঘনিয়ে আসে রোদ্দুরে,

যেথায় থাকিস চোখ চলে যায় তদ্দূরে।

দুলিয়ে বাতাস শুধোয় কানে, আসবি কি না?

ধিনতা ধিনা-

পেরজাপতি, মৌমাছিদের গুঞ্জনে,

উথাল-পাথাল লাগবে মাতন, ফুলবনে

তোদের বিনা রঙের তুফান, তুলব না,

আহা ধিনতা ধিনা-

[গাছেরা সরে যায় তিনটি মেয়ে বলতে বলতে আসে]

শিউলি। আঃ! উঃ!

ফুলঝুরি। কী হল রে শিউলি? অমন আ-উ করছিস?

শিউলি। এ বাগানে না এলে, না দৌড়োলে, না লাফালে আমার খিদে পায় না, ঘুম হয় না, ভাল্লাগে না। তোর? ফুলঝুরি?

ফুলঝুরি। আমার ভীষণ মাথা কটকট করে, কান চুলকোয়, পা সুড়সুড় করে রে শিউলি!

উঁকিঝুঁকি। আমার রাগগুলো সব শুঁয়োপোকার মতো সারা গায়ে গুটগুট করে উঠে প্যাঁট প্যাঁট করে কাঁটা ফোটায়।

ফুলঝুরি। বাব্বা! উঁকিঝুঁকি যেন পদ্যে কথা বলছে!

শিউলি। হ্যাঁরে, এ বাগানে এলে, আমার কেমন গানের সুরে- গানের সুরে কথা বলতে ইচ্ছে করে। চল চল! ওই দিকে যাই।

উঁকিঝুঁকি। না ভাই, হেঁটে যাব না।

ফুলঝুরি। ওমা। কীভাবে যাবি? শিউলি! উঁকিঝুঁকি কী বলে রে?

[উঁকিঝুঁকি সবার হাত ধরে গোল হয়ে দাঁড়ায়। সবার হাত দোলাতে থাকে]

উঁকিঝুঁকি। (সুর করে ঘুরতে থাকে) আমরা দুলে-দুলে-দুলে যাব-দুলে-এ-এ-!

সবাই। হ্যাঁ, হ্যাঁ, দুলে দুলে দুলে যাব, দুলে-এ-

[ঘুরতে ঘুরতে মঞ্চের ঊর্ধ্ব দক্ষিণে চলে যায়। বিপরীত দিক থেকে কটি ছেলে-প্যাঁপো, সমুদ্র, প্রান্তর একটা রবারের বল ড্রপ দিতে দিতে ঢোকে]

প্যাঁপো। ঘপাং! ঘপাং-ঘং-ঘং!

সমুদ্র। একী রে? এটা কোন সং?

প্যাঁপো। হ্যাটাপ্যাটা, হ্যাটাপ্যাটা!

প্রান্তর। আরে, এই প্যাঁপো! এ কি কথা নাকি রে কম্প?

সমুদ্র। তেড়েফুঁড়ে বেরুচ্ছে, দিয়ে যেন লম্ভ?

প্যাঁপো। হুঁ-হুঁ। হুম্বা, হুম্বা-

বাগানের মালিকের, দৈত্যের ভাষাতে,

আমি কথা যে বলুম্বা-।

সমুদ্র। অ্যাঁ? এই বাগানের দৈত্যটা?

প্রান্তর। সেই জগঝম্পটা-তাকে দেখেছেই বা কে?

প্যাঁপো। ওরে ঘটাঘট, পটাপট, সটাং সটাং

দৈত্যকে দেখলেই হবি রে পটাং।

সমুদ্র। আরে যা-যা। দৈত্যটা পালিয়েছে, বাগানটা ফেলে থপথপ পায়ে পায়ে, গেছে দূরে চলে!

প্রান্তর। হ্যাঁ, হ্যাঁ। বাগানটা আমাদের হয়ে গেল চিরকাল,

হুমহাম দুমদাম চালাব যে গোলমাল।

প্যাঁপো। জানিস রে, সমুদ্র! প্রান্তর!

ওই দৈত্যের ভয়ে বুক,

খালি করে ধুকপুক!

সমুদ্র। দেখ প্যাঁপো! বড়ো বেশি ভয় তোর-

প্রান্তর। ঠিক রে সমুদ্র। বাগানে বেড়াচ্ছি, খেলছি,

আমরা কি বাগান চোর!

সমুদ্র। নে, নে, এসে গেছে সব্বাই-

খেলবি তো, চল চল, লাগা দৌড়।

[সবাই দৌড়ে চলে যায়। সবুজ আলোয় মঞ্চ আলোকিত হয়ে ওঠে। আবহ বাজতে থাকে। তার তালে তালে গাছেরা এগিয়ে আসতে থাকে। পাতা নাড়ানোর শব্দ, ডাল দোলানোর শব্দ করে কথা বলতে থাকে]

১ গাছ। টুপটাপ! টুপটাপ! টুপটাপ!

কই রে? কই সব ধুপধাপ?

দেখছি না, দেখছি না, দেখছি না-

কথা-টথা, হাসি-টাসি শুনছি না?

নাকি, লুকোচুরি খেলছে রে চুপচাপ!

টুপটাপ! টুপটাপ! টুপটাপ!

২ গাছ। (নাচের ছন্দে এগিয়ে আসে) শনশন! শনশন! শনশন!

ওই দেখ দস্যিরা ঘুরছেই বনবন-

ওরে বাবা! ডাল ধরে ঝোলে দেখ

চোখ করে টনটন!

শনশন! শনশন! শনশন!

৩ ছোটো গাছ। (লম্বা একটি গাছের কাছে এসে) এই যে শোনো, ও বড়ো গাছদা!

গাইছে কেমন, হাসছে কেমন, জমছে কেমন নাচটা!

৪ বড়ো গাছ। (ডাল কাঁপিয়ে) হুস্বুঃ সু! হুস্বুঃ সু! হুঃস্বু সু!

ভাবছি গাচ্ছু!

ফেরে যদি জগঝম্পটা,

এসেই লম্ভঝম্পটা,

দেখায় দত্যি!

ওঠায় বাগানে থরহরি ভয় কম্পটা?

৫ গাছ। ঝির-ঝির-ঝির-! ঝিঃ-

তোরা ভয়েই মরিস, ছিঃ!

কত যে দিন, কত যে রাত, কত সকাল গেছে,

দত্যি জগঝম্পটা কি আজও বেঁচে আছে?

আরে, আসেই যদি আসুক-

প্রাসাদটার ওই টঙে চড়ে মটকা মেরে বসুক।

১ গাছ। অ্যাঁ? সে যদি বাগানে আসে?

২ গাছ। ধরো বসল ঘাসে?

৩ গাছ। ডাল ধরল?

৪ গাছ। পাতা ছিঁড়ল?

১ গাছ। ধ্যাবড়া নাকে ফুল শুঁকল?

৫ গাছ। (ভেঙিয়ে) বেশ করল!

এ বাগান তার,

গাছপালা তার,

ইচ্ছে মতো ধরল, ছিঁড়ল, শুঁকল!

অন্য গাছেরা। (সমস্বরে) কক্ষনো না, কক্ষনো না।

৫ গাছ। বাগানটা তার-।

১ গাছ। আমরা কি কেনা?

অন্য গাছেরা। (সমস্বরে) কক্ষনো না। কক্ষনো না।

২ গাছ। এই পাতা, ফুল, কুঁড়ি ও পাপড়ি

খবরদার সে ছিঁড়বে না-

অন্য গাছরা। কক্ষনো না, কক্ষনো না।

৩ গাছ। যদি সে ছোঁয়ায় কোনো গাছে হাত,

৪ গাছ। পলকের মাঝে অমনি হঠাৎ

১ গাছ। সেই ডালে আর ফুল ফুটবে না-

সবাই। কক্ষনো না, কক্ষনো না।

৫ গাছ। (হেসে) আচ্ছা বাবা, আচ্ছা-

তোরা দেখছি, প্রত্যেকটা মুখ্যুগাছের বাচ্চা।

ঠাট্টা বুঝিস? বুঝিস তোরা-

কোনটা ঝুটা, সাচ্চা?

সাতটি বছর পেরিয়ে গেছে,

সে তো মরেই ভূত হয়েছে,

এ বাগানে সে কোনোদিন আসছে না,

আর দুটি পা ফেলছে না।

সবাই। (হাততালি দিয়ে) এ বাগানে সে কোনোদিন আসছে না,

আর দুটি পা ফেলছে না।

[হঠাৎ একটি বজ্রপাতের শব্দ। গাছেরা ভয় পেয়ে দৌড়ে এক এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ে। বিউগিল বাজে। প্রাসাদ চুড়োয় একটা পতাকা ওঠে। আবার বজ্রপাতের শব্দ। চারদিক থেকে ছেলে-মেয়েরা ছুটে এসে গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। ডান দিক থেকে লাল নীল জোব্বা পরা দীর্ঘ-স্থূলদেহী জগঝম্প দৈত্য আসে। বেজায় খুশিতে থপথপ হাঁটে আর গান গায়]

জগঝম্প।

দৈত্যের গান

হাউ-হাউ-হাউ

আয়্যাম হিয়ার নাউ।

আমি সাত সাতটা বছর, জবর কাজে

ছিলাম ব্যস্ত-ব্যস্ত- ব্যস্ত- ব্যস্ত- ব্যস্ত!

তাই, ফেরার পথে আনন্দেতে, একটা কাণ্ড করেছি মস্ত।

হাউ-হাউ-হাউ,

আয়্যাম হিয়ার নাউ।

ওরে গেছিরে বুঝে, এই পৃথিবীতে, আমার লম্বা নাম রাখব,

আ-যা, আ-যা বলে বলে যাকে তাকে যুদ্ধে ডাকব।

ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন, গুন্ডা বদমাশ, ওরাং ওটাং, হিপোপটেমাস

ঘাড় মুচড়ে, খিমচে চটকে, করব তাদের পকেটস্থ।

হাউ-হাউ-হাউ,

আয়্যাম হিয়ার নাউ।

ওরে সবাই শোনরে, কীর্তি আমার আর একখানা তাজমহল,

আমার কীর্তি লেখা থাকবে সোনার জলে জ্বল-জ্বল-জ্বল!

জানিস আমি কী করেছি?

এক পাগলা হাতির হোঁতকা পায়ে, গদাম গদাম লাথি মেরেছি

তার ন্যাজ পাকড়িয়ে গোঁত্তা মেরে, করেছি তাকে কবরস্থ।

একটা কাণ্ড করেছি মস্ত-

হাউ-হাউ-হাউ-

আয়্যাম হিয়ার নাউ-!

জগঝম্প। (চারদিকে তাকিয়ে) হোম! অহোম। অহোম। এই তো আমার প্রাসাদ! এই তো আমার বাগান! এই তো আমার গাছ-পাতা-ফুল! আমার! আমার! আমার!

[‘আমার’ শব্দটির প্রতিধ্বনি হতে থাকবে]

আমি হা-হা-হা-হা করে হাসব, আমি প্রাসাদটা জুড়ে নাচব, কেন না, এটা তো আমার নিজের। আমার! আমার! আমার!

[দৈত্য হাঃ-হাঃ…-হাঃ করে হাসতে থাকে। ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েরা ভয়ে চিৎকার করে দৌড়ে পালাতে যায়]

জগঝম্প। এ্যা-ই-য়ো-!

[সবাই দৌড়ের ভঙ্গিতে নানারকমে ফ্রিজ হয়ে যায়। দৈত্যের চোখমুখ রাগে ফেটে পড়ে। সে এক-একটি ছেলের সামনে গিয়ে দেখে]

অ্যাঁ? অঁ? উঁ! হুঁঃ। বটে? আহোম। হচ্ছে! এই কারা তোরা? কেন তোরা? কী জন্যে তোরা? সব খুদে পিঁপড়েরা! ডেঁয়ো পিঁপড়ে! বিষ পিঁপড়ে! দেখবি! টিপে মারব? টিপে! টিপে! টিপে-? আস্পর্দা! আমি অ্যাবসেন্ট সেভেন ইয়ারস ওনলি, অমনি বাগানে সুরুত করে এনট্রি? নো ভয় ডর, নো পারমিশান? (চেঁচিয়ে উঠে) এটা আমার বাগান, আমার। আমার! আমার! কান খাড়া করে শোনো সব। এটা শ্রীজগঝম্প ধাড়াক্কার নিজের বানানো বাগান। এ মাটির সব ঘাস আমার। সব গাছ আমার। সব লতা-পাতা, কুঁড়ি, ফুল-পাপড়ি ফল-টল- এমনকী তার খোসা-টোসা পর্যন্ত আমার, আমার, আমার।

[এবারও ‘আমার’ শব্দটা ভীষণভাবে প্রতিধ্বনিত হয়]

কীরে, উত্তর নেই কেন? থাকিস কোথায়? বাবার কী নাম? কয় ভাই-বোন? কোন স্কুলে পড়িস? মাস্টার কে? এই শিক্ষা? না বলে পরের বাগানে, ফুল-ফল ছেঁড়া?

দুটি ছেলে। না-! আমরা তো না। (গাছেরা না! না! বলে চিৎকার করে ওঠে)

জগঝম্প। চোপ! আবার না? কীসের না? তোরা বাগানে ঢুকিসনি, না-? খেলিসনি, না? হুটোপাটি, লাফালাফি, দাপাদাপি, গড়াগড়ি-সব না-না-না-না-না-না, না-? (এদিক-ওদিক দৌড়ে দৌড়ে বলতে থাকে) ওখানে মাটি নেমে গেছে পায়ের চাপে- এই দেখ কচি কচি ঘাস চেপটে গেছে! ইস-দেখেছ! মাটিতে কেমন হাঁচোর-পাঁচোর? ঘ্যাঁচম্যাচ করা আঁচড়, আঁচড়! কীরে বিচ্চুরা, পুলিশ ডাকব? ডাকব গার্জেন! ওঃ! যা রাগ হচ্ছে! (থেমে রাগটা কতখানি, দম বন্ধ করে দেখায়) উঃ! উঁ-উঁ, উঁ-উঁ-উঁ! এক মাথা রাগ। রেগে ফেটে যাব, ফটাস!

শিউলি। সত্যি, সত্যি! দত্যিকাকু, শোনো-!

জগঝম্প। অ্যাঁ? দত্যি কাকু? আমাকে দত্যি বললি কেন?

উঁকিঝুঁকি। সবাই যে বলে দত্যি, তুমি!

জগঝম্প। সবাই বলে-? বলতে পারে। আমি পেল্লাই বলে- আমার গায়ের জোরে হাতি বাঘ সব ভয় পায় বলে-

ফুলঝুরি। ও বাবা তা-ই-?

জগঝম্প। হুঁ-হুঁ পেল্লাই। আমার পেল্লাই শরীর, পেল্লাই বাগান, পেল্লাই বাড়ি। আমি সব কিছু পেল্লাই ভালোবাসি।

শিউলি। ও ব্বাবা! পেল্লাই মাঠ ভালোবাসো?

জগঝম্প। (গোঁয়ারের মতো) হ্যাঁ-!

ফুলঝুরি। পেল্লাই আকাশ-?

জগঝম্প। নিশ্চয়ই!

উঁকিঝুঁকি। পেল্লাই পেল্লাই গাছ-?

দৈত্য। হ্যাঁ-

শিউলি। (উৎসাহে) তাহলে তো পেল্লাই পেল্লাই, মানে অনেক অনেক লোকজন, অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েদেরও ভালোবাসো-?

জগঝম্প। হ্যাঁ-অ্যাঁ-? না। খবরদার! আমাকে গুলিয়ে দেবে না। একদম গুলিয়ে দেবে না। গুলিয়ে দিলেই রাগ পড়ে যায়, ভুলিয়ে দিলেই সব ভুল হয়, আমি একচুলও রাগ কমাব না। মজা দেখাচ্ছি-

গাছেরা। (সমস্বরে বিলাপের সুরে) না। না। না।

জগঝম্প। এই! সব একঠাঁই হও, একঠাঁই!

শিউলি। আমাদের ভয় করছে।

জগঝম্প। হাঃ। হাঃ। হাঃ। এখনই কী হয়েছে। একঠাঁই! একঠাঁই।

দৈত্য ভিতরে যায়

গাছেরা। পালাও, পালাও।

[ছেলে-মেয়েরা নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলে দৌড়োতে যাবে, জগঝম্প বিরাট এক দড়ির গোছা নিয়ে আসে]

জগঝম্প। হাত তুলে একঠাঁই! … একঠাঁই- পালাবার পথ নাই।

[ছেলে-মেয়েরা দু-হাত তুলে, পিছিয়ে, পিঠে পিঠ দিয়ে বৃত্তাকারে দাঁড়ায়। দৈত্য জগঝম্প তাদের ঘুরে ঘুরে বাঁধতে থাকে। গাছেরা করুণ সুরে আ-আ-আ করতে থাকে। জগঝম্প হা-হা করে হাসে। আলো নেভে।

মূল পরদার সামনে আলো জ্বলে। বাঁ দিক থেকে ধুতি পাঞ্জাবি পরা, চশমা চোখে হাতে লাঠি নিয়ে বৃদ্ধ মেরুদণ্ড পুততুণ্ড রাগে গজগজ করতে করতে আসে]

মেরুদণ্ড। জগঝম্পের অমন বাগানে আগুন লাগুক। ওটা একটা ঢ্যাঙা জন্তু। ঢ্যাং-ঢেঙে -ঢেঙ্গু। ওটা কি মানুষ? একটা হিন্দুকুশ! একটা বিন্ধ্য, এভারেস্ট বেহ্মদত্যি। কবন্ধ ভূত। ওর প্রাসাদে বাজ পড়বে। বাগানের ঘাসে টাক পড়বে, বাগান মরুভূমি হবে। আমি তোকে ছাড়ব না। আদালতে যাব। আমি মেরুদণ্ড পুততুণ্ড। এত বড়ো আস্পর্দা! তোর বাগানে আমার নাতিকে তুই সন্ধে পর্যন্ত বেঁধে রেখেছিলি?

[ডান দিক থেকে আর এক প্রৌঢ়, ফতুয়া ধুতি পরনে এসে হাজির হয়]

এই যে বঙ্গবদন! জগঝম্পের কাণ্ডটা শুনেছ?

বঙ্গবদন। আমার ভাইপোটাকে তো কাল ওর বাগানে-

মেরুদণ্ড। অ্যাঁ? তোমার ভাইপোকেও -আমার নাতিটাকেও মানে, ওদের সব বন্ধুকেই। ওটা একটা ষণ্ড-পাষণ্ড। হিটলার। আইখম্যান। কংস। হিরণ্যকশিপু। রাক্ষস রাবণ!

বঙ্গবদন। আহা, মেরুদণ্ড খুড়ো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অমন ধুনুচি নেত্য করলেই চলবে? চলুন তল্লাটের সবাইকে জড়ো করে ওকে বুঝিয়ে দিয়ে আসি-।

মেরুদণ্ড। ঠিক বলেছ। ওই ঠোঙা চাটুজ্যে, হিম্মত হালদার, মোরব্বা মিত্তির সবাইকে নিয়ে যাব।

বঙ্গবদন। আপনি ওদেরও পাবেন, হ্যা-হ্যা বোস, দরবেশ বাঁড়ুজ্যে, বলশালী দত্ত-

মেরুদণ্ড। হ্যাঁ, ছোবল দাস, হল্লা সেন- ওরাও বেশ রগচটা আছে-

বঙ্গবদন। জমায়েত হোসেনও দারুণ কড়া লোক চলুন তো ডাকি সবাইকে-

[ওরা মঞ্চের ডাইনে বাঁয়ে দৌড়তে থাকে আর সবাইকে ডাকতে থাকে। নানা দিক থেকে সবাই এসে জড়ো হতে থাকে]

মেরুদণ্ড। ওরে উত্তাল, কসরত, ফেনা সাঁপুই-, জমায়েত হোসেন-

[সবাই কথা বলতে বলতে আসে। একসঙ্গে কথা বলে]

সবাই। চলো, চলো দৈত্যের বাগানে চলো। বুনো জগঝম্পের বাগানে চলো।

[হইহই করতে করতে সবাই ডান দিকে চলে যায়। সামনের আলো নেভে]

দ্বিতীয় দৃশ্য

[পরদা সরতে থাকে। মঞ্চের আলো জ্বলতে দেখা যায় জগঝম্প, দোতলার জানলায় বসে গড়্গড়া টানছে। দোতলা থেকে নল নেমে এসেছে। নীচে গড়্গড়াটা। গরর গরর শব্দে জগঝম্প নীচের দিকে তাকিয়ে গড়্গড়া টানছে। সবাই একতলায়, জানলার নীচে দাঁড়িয়ে]

বঙ্গবদন। তাহলে আপনি শুনলেন সব? বলুন, আপনার কী বলার আছে?

জগঝম্প। (গর্জনের স্বরে) ভোঁ-ভোঁ!

মেরুদণ্ড। কী ভিমরুলের মতো ভোঁ-ভোঁ করছেন? জেলে পাঠিয়ে ছাড়ব।

জগঝম্প। হাঃ! হাঃ! হাঃ!

মেরুদণ্ড। কেমন হাসে দেখো?

জগঝম্প। হাঃ! হাঃ! হাঃ! হাঃ!

মেরুদণ্ড। আরও জোরে হাসে, দেখো? কোন যাত্রা কোম্পানির পার্ট হচ্ছে, অ্যাঁ!

বলশালী। তাহলে জেলে ঘানি টানার ইচ্ছে হয়েছে?

জগঝম্প। -ফুঃ! (বাতাসের হু-হু শব্দ শোনা গেল)

মেরুদণ্ড। এটা কী ভাষা? ফুঃ করল, আর হু-হু করে বাতাস ছুটে এল?

জমায়েত। আমাদের কথা হচ্ছে-

জগঝম্প। আহোম।

[বজ্রপাতের শব্দ হল]

মেরুদণ্ড। দড়াম করল।

বঙ্গবদন। দড়াম করুন আর যাই করুন। জেনে রাখুন, কাজটা আপনি ভালো করেননি।

মোরব্বা। শুনে রাখুন, সুন্দর বাগান একা দেখে না, সবাই দেখে। বাগানের ফুল কারো একার জন্যে না, সবার জন্যে ফোটে।

দরবেশ। তা ছাড়া, এলাকায় খেলার মাঠ নেই, তাই-

জগঝম্প। ওই রাস্তা আছে। ব্যস!

মেরুদণ্ড। রাস্তা আছে? ব্যস? অক্স! ঘাড়ত্যাড়া অক্স একটা!

কসরত। এই মোরব্বা, ঠোঙা, দরবেশ। চলো তো সব। বুঝবে না।

ঠোঙা। যা হোক। ওয়ার্নিং দিয়ে গেলাম। আপনি একা থাকেন জানি, তবু লোক সমাজে তো থাকেন। সবাইকে অগ্রাহ্য করে টেঁকা যায় না, জেনে রাখুন।

জগঝম্প। রাখলুম।

মেরুদণ্ড। হালুম করল! এই চলো তো সব। ওই হালুম কোর্টে গিয়ে মিঁউ মিঁউ ক্যাট সাউন্ড করিয়ে ছাড়ব। স্বার্থপর। হিংসুটে, কুট কুটে! চলো।

[সবাই রাগত স্বরে কথা বলতে বলতে চলে যায়]

দৈত্য। (রাগত চোখে গড়্গড়া টানতে টানতে) এ তো বজ্জাত বিচ্চুদের, বজ্জাত গার্জেন! কী পিড়িং পিড়িং। হাত খ্যাচখেঁচে। পা ছিটকোচ্ছে। তুবড়ির মতো ফ-স করে জ্বলে উঠছে। আমি তো তেড়েমেরে নেমেই যাচ্ছিলুম- তথাপি নামিনি! (ভেঙিয়ে) হ্যাঁঃ! ‘ফুল সবার জন্যে ফোটে’- ফোটে যদি সবার বাগানে না ফুটে আমারই বাগানে ফোটে কেন? এটা কি ফুলের মামাবাড়ি! ‘সুন্দর বাগান সবাই দেখে’- তা দেখো, বাইরের রাস্তা থেকে হাঁ করে দেখো। ‘আয় চাঁদ, আয় চাঁদ’ বলে যেমন দেখে, ‘আয় বাগান’ বলে দেখো। (হঠাৎ গর্জন করে) এটা আমার বাগান। আমি স্বর্গ বানাব, নরক বানাব আমার খুশি। এই কে আছিস? আমার নো এন্ট্রি এনে বাগানে পুঁতে দে তো!

[আবহ বাজে। একজন ভৃত্য ‘নো এন্ট্রি’ স্ট্যান্ড রেখে চলে যায়। তাতে লেখা-

‘প্রবেশ নিষেধ,

আইন ভাঙলে, কঠিন বেত’]

জগঝম্প। কই মিস্তিরিরা কই? মিস্তিরি!

[লুঙি পরা, টুপি মাথায়, দাড়িওয়ালা পাঁচিল গাঁথার সরঞ্জাম হাতে নিয়ে মিস্তিরিরা ঢোকে]

মিস্তিরি। জি হুজুর- জি!

জগঝম্প। বাগান ঘিরে পাঁচিল তোলো, পাঁচিল-!

লাগাও বাগানে খিল।

[দৈত্য সরে যায়। মিস্তিরিরা হাতের যন্ত্র নিয়ে গান ধারে]

মিস্তিরিদের গান

পাঁচিল, পাঁচিল, পাঁচিল তোলো-

বাগান ঘিরে পাঁচিল তোলো।

বাতাস আলোর কণ্ঠ চেপে

মরুর ভূমি জাগিয়ে তোলো।

হেঁই সামালো- হেঁই সামালো-।

দুষ্টু যারা, মন্দ যারা,

ভেতর ভেতর, অন্ধ তারা,

মিষ্টি বাগান উপড়ে ফেলে

ফুলের চোখে জল নামাল-

হেঁই সামালো-

তোলো মালিক পাঁচিল তোলো,

মনের ভেতর গর্ত খুঁড়ে,

বাইরেটাতেই হও শাঁসালো

হেই সামালো-

[গানের সাথে সাথে পাঁচিল তোলার কাজ চলে। বাঁ দিক থেকে তিনটি ছেলে আসে। পাঁচিলটা দেখে তিনজনে ডান হাতে চোখ ঢেকে বসে। তাদের পিঠে বি-শ্রা-ম লেখা। পরদা নামে। প্রেক্ষাগৃহের আলো নেভে। দূরে হোলির গান ও চিৎকার শোনা যায়]

হোলির গান

ঝগমগ ঝগমগ হোলি হো, হোলি হো

(আজ) বসন্তে রঙে রঙে সবাইকে রাঙিয়ো

চেনামুখে রং ঢেলে, অচেনায় আঁকিয়ো।

[গান চলতে থাকে। পরদার সামনে মেরুদণ্ড পুততুণ্ড ছাতা খুলে এগোচ্ছিল, একটি ছেলে পিচকিরি বাগিয়ে তার দিকে দৌড়ে আসে। মেরুদণ্ড ফিরে ছাতাটা বারবার খুলে বুজিয়ে বাধা দিতে থাকে]

মেরুদণ্ড। অ্যা! খবদ্দার। রং দিবি না বলছি। ভালো হবে না। এই এঁচোড়ের দল। ঝিঙে, উচ্চিংড়ে, চুনোপুঁটি-

[পুততুণ্ড বাঁ দিক দিয়ে পালায়। ছেলেটি ফিরে যায়। দূরে চিৎকার ওঠে- ‘হোলি হো’ পরদা সরে]

তৃতীয় দৃশ্য

[মঞ্চের বাঁদিকে প্রাসাদের চাতালে দৈত্য বসে। তার চুলে পাক ধরেছে। সাদা পোশাক তার গায়ে]

জগঝম্প দৈত্য। হোলি হো! হুঃ। আমার বাগানের গাছগুলোকে দেখো- খটখটে কাঠ। এগুলো গাছ না, এক-একটা ঝাঁটা! যেন উলটো করে পুঁতে রেখেছে। এই বাগান! আমি শ্রী শ্রী জগঝম্প বলছি, লতায় পাতায়, সবজে হলদে লালে লালে, ফুলে ফুলে রঙে রঙে হোলি খেল।

[আবহ। গাছের আড়াল থেকে ছোটো ছোটো পোস্টার ‘না-না-না’ লেখা বেরিয়ে আসে]

নাঃ! একদম কথা শোনে না।

[লেখাগুলো সরে যায়]

এই বাগান! এটা শীতকাল না। মুখস্থ কর, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত, বসন্ত। এটুকু মুখস্থ থাকে না? You are a very bad student!

[গাছের আড়াল থেকে শোনা যায়, Yes Sir! Yes Sir! Yes Sir!]

আমার ভুল হচ্ছে নাতো? কিন্তু এক বছর তো হয়ে গেল! (উঠে পায়চারি করে) বাগানে শুধু শীতকালই থাকবে? বসন্ত কবে আসবে?

[ঝঞ্ঝা, হাতে বর্শা নিয়ে সাদা পোশাকে এসে পাশে দাঁড়ায়]

ঝঞ্ঝা। বসন্ত আসবে এ বাগানে? এই যে আমি ঝঞ্ঝা এসেছি- হি-হি-হি-হি! আরও সব আসছে, দাঁড়াও। হুড়মুড় করে আয়তো রে ঝড়!

[আলো কমে। ঝড়ের আবহ। অবিন্যস্ত খ্যাপার বেশে হাতে মুগুর নিয়ে ঝড় আসে। দৈত্যের পাশে এসে দাঁড়ায়]

ঝড়। এ-ই-তো! এ-ই-তো! এসে গে-ছি তো!

ঝড়। আয়তো রে বোন ঘূর্ণি!

[হু-হু শব্দ করে ঘূর্ণি আসে। হাতে সাদা বর্শা]

ঘূর্ণী। হু-হু-হু-হু! এই যে হু-হু! হাজির হু-হু!

আয়তো রে কালো অন্ধকারটা

কুয়াশা তুষার আন,

তছনছ করে নাচব, লাফাব

নরক বানাব বাগান।

[কুয়াশা, তুষার হাতে বর্শা নিয়ে এসে দাঁড়ায়]

তুষার। হারে-রে-রে! হারে-রে-রে!

অন্যরা। কে এলি রে? কে এলি রে?

তুষার। আমি ডাইনি তুষার, মরণ ঠান্ডা এনেছি রে!

ঝিরিঝিরি, কুচিকুচি, গুঁড়োগুঁড়ো তুষারে

ঘাস-মাটি ঢেকে দেব বরফের চাদরে!

সবাই। আহা, দিলখুশ ঠান্ডায় কুলপির মতো রে-!

জমবে রে জমবে রে, জমবে রে!

[দৈত্যকে ঘিরে ওরা ঘুরতে থাকে বল্লম উচুঁ করে। দৈত্য দু-হাত ছড়িয়ে চিৎকার করতে থাকে]

জগঝম্প। না-এসব আমি সইব না! সইব না।

[সবাই ঘুরতে থাকে আর হাসতে থাকে]

সবাই। হাঃ! হাঃ! -হাঃ!

দৈত্য। না-না-না।

সবাই। হাঃ! হাঃ! হাঃ!

[আলো নেভে]

চতুর্থ দৃশ্য

[ঝড়ের শব্দ চলতে থাকবে। দৈত্যের দোতলার জানলা খুলে গেল। দৈত্য মুখ বাড়িয়ে দেখে]

দৈত্য। হায়রে। আরও একটা বছর গেল।

ঘূর্ণি। গেলই তো! গেল-গেল-গেল-

ঘূর্ণির পাক দেখাই এখন, পয়সা ফেলো।

দৈত্য। বাগানটার এ দশা কেন?

কিছুই তো বুঝি না!

তুষার। না-না। -না-না। না-না

তুমি কিচ্ছু বোঝো না,

কতটা নিজের, কতটা পরের

জেনেও জানো না-জানো না।

দৈত্য। কে? কে ওখানে?

ঝড়। আমি রে। শ্রীযুক্ত ঝড়বাবু রে!

ডুগ ডুগ ডুগ, ডুগ ডুগ রে।

এ প্রাসাদের টালি ভাঙব, ছাদ ফাটাব

চূন খসাব, বালি ঝরাব।

দৈত্য। কতকাল যে বাগানটার এ দশা থাকবে?

ঝঞ্ঝা। থাকবে। আরও থাকবে।

এখানে সাপ থাকবে,

ছাতেতে প্যাঁচা ডাকবে,

চামচিকে আর চাম বাদুড়ে

উলটোমুখে ঝুলে থাকবে।

দেখো, এই ঝঞ্ঝা পিসি বাগানময় নেত্য করবে।

দৈত্য। ধ্যাত্তেরি!

[দৈত্য রেগে জানলা বন্ধ করে দেয়। নীচে ঝড় ঝঞ্ঝা তুষার ইত্যাদির হো-ও-ও চিৎকার করে বৃত্তাকারে এসে পরামর্শ করে। হঠাৎ ভয়ংকর শব্দ হতে থাকে। একটা দেয়ালের একাংশ দেখা যায় ভাঙা। সেদিক দিয়ে ছোটো ছেলের একটা মুখ দেখা যায়]

ঝড়। ও কী রে, ও কী?

ঝঞ্ঝা। কেন ঠকঠক ঠকঠকি?

ঝড়। (চিৎকার করে) ওরে দেয়াল ফেটেছে দেয়াল,

বাইরের ওই খোলাবাতাসের খেয়াল হয়েছে খেয়াল,

ভেতরে ঢুকবে, আলো ঢেলে দেবে,

ভাঙবে চুরবে দেয়াল।

তুষার। আঃ! আলোয় আলোয় সারা গায়ে ধরে জ্বালা।

সবাই। ওরে পালা-পালা-পালা-সময় থাকতে বোঁচকা-বুঁচকি দু-বগলে চেপে পালা।

[নেপথ্যে ‘পালা-পালা-পালা।’ আলো ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। একটি করে ছেলে-মেয়ে ভিতরে ঢুকে পড়তে থাকে। আনন্দের আবহ বাজতে থাকে। একটি ছোট্ট ছেলে কোনোক্রমে ওই গর্ত দিয়ে বাগানে ঢোকে। সঙ্গে সঙ্গে সর্বত্র আলো ঝলমল করে ওঠে। পুষ্পিত গাছগুলো আগের জায়গায় এসে দাঁড়ায়। ছোটো ছেলেটি মঞ্চের এককোণের একটা গাছের ফুলের ডাল ধরতে গিয়ে পারে না। সে একবার হতাশ হয়ে বসে পড়ে। আবার পারে না। আবার বসে। দৈত্যের জানলা খুলে যায়। দৈত্যের মুখে খুশি আর ধরে না]

দৈত্য। তবে, তবে, তবে? বসন্ত নাকি আসবে না? বাগানেতে ফুল ফুটবে না? পাখি-টাখি আর ডাকবে না? খালি হ্যা-না-না, ত্যানানা, ত্যানানা! ওই তো আমার গাছ-ভরা পাতা, পাতা-ভরা ফুল, ডালের ওপরে ডাকে বুলবুল, কুঁড়িদের সব চোখ ঢুলুঢুল। আর নাকি ওরা জাগবে না? খালি হ্যানানা-ত্যানানা-ত্যানানা! যাচ্ছি যাচ্ছি যাচ্ছি- আঃ! কতদিন পরে নির্মল বাতাসের গন্ধটা পাচ্ছি। যাচ্ছি-

[বাগানে শিশুরা গান গায়]

শিশুরা। হো-হো। এই তো! এই তো!

সব পেয়েছির, দেশ তো!

হো-হো! হো-হো!

[হঠাৎ দৈত্যকে দেখে তারা চিৎকার করে পালাতে যায়। এবার গাছেরা তাদের ডাল নাড়িয়ে বলে, ওঃ হো! যেয়ো নাকো! দৈত্য সঙ্গে সঙ্গে একটা গান ধরে]

দৈত্যের গান

দৈত্য। নো মোর, আই য়্যাম সেলফিশ নো মোর

নো মোর অ্যান্ড নো মোর জেলাস-

বিলিভ মি, আই এ্যাম চেইঞ্জড ফ্রম মাই কোর

ইউ হ্যাভ সেভড মাই সোল, ও গড!

[ছেলেরা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে শুনছিল। দৈত্য গান গাইতে গাইতে বাগানের নোটিশ বোর্ডটা সরিয়ে দেয়। উইংগসের মধ্যে থেকে একটা বিরাট হাতুড়ি এনে দেয়ালের আরও কিছুটা ভাঙে। তারা এবার এগিয়ে আসে। হাত ধরাধরি করে দৈত্যকে ঘিরে ঘুরতে থাকে]

ছেলেরা। নই আমি আর স্বার্থপর নই,

এমনকী হিংসুটে,

সত্যি সত্যি, বদলে গেছে হৃদয়টা।

তুমিই রক্ষা করলে আমায় বিধাতা।

হো-হো। হো-হো।

দৈত্য। দিস ইজ নো মোর মাই গার্ডেন

লেট ইট বি প্যারাডাইজ ফর অল

ওহ! ইটস মেন্ট ফর ফ্লাওয়ার অ্যান্ড চিলড্রেন

লেট দি গ্রান্ড ফাদার্স টুগেদার স্ট্রোল

ছেলেরা। আমার বাগান, আমার নয়তো মোটে

স্বর্গোদ্যান হয়ে উঠুক সবার-

হাসবে বাগান, ফুল শিশুদের জোটে-

পায়চারিও চলবে ঠাকুরদাদার।

দৈত্য। আই অ্যাম সেলফিশ নো মোর

বিলিভ মি, আয়্যাম চেইঞ্জড ফ্রম মাই কোর

ছেলেরা। নই আমি আর স্বার্থপর নই

সত্যি সত্যি বদলে গেছে হৃদয়টা

হো-হো। হো-হো।

[ছেলেরা গাইতে থাকবে। দৈত্য ছোট্ট শিশুটিকে ঘাড়ে তুলে, গাছের ফুল-পাতা ধরায়। ছেলেটি তার গলা জড়িয়ে চুমু খায়। গান চলতে থাকে। পরদা নেমে আসে]

[পরদার সামনে মেরুদণ্ড আসে। হাতে ছাতা]

মেরুদণ্ড। (চেঁচিয়ে) হো-হো! বঙ্গবদন! বঙ্গবদন!

বঙ্গবদন। (বিপরীত দিক দিয়ে এগিয়ে আসতে আসতে) একী? এখনও তো রোদ কটকট করছে!

মেরুদণ্ড। সে রোদ কটকট করুক, ঝনঝন করুক, খ্যাঁকখ্যাক করুক- আমার কী? চলো তো! ওই কুঁচো পুঁচকেদের হো-হো শুনলে এই পা দুখানাও কেমন গোঁ-গোঁ করে ওই বাগানের পথেই ছুটতে চায়। আহা কী বাগান, কী গাছপালা! আর কত ফুলের কী যে ম-ম করা গন্ধ-!

বঙ্গবদন। সত্যি! জগঝম্পটা দেখাল বটে। ‘খুদে বন্ধুদের বাগান’ নাম দিয়ে অত বড়ো এলাকাটাই উইল করে দিল?

মেরুদণ্ড। বঙ্গবদন! আসলে কোনো মানুষই খারাপ না। মানুষের চারপাশটা উঁচু-নিচু এবড়ো-খেবড়ো হয়ে গেলেই সেও কেমন ব্যাঁকাত্যাড়া হয়ে ওঠে। আরে চলো, চলো। ওই দেখো রোদ্দুরটা কেমন চাদর গুটিয়ে নিচ্ছে। (হাত তুলে) এই হো-হো-!

[বঙ্গবদন আর মেরুদণ্ড ডানদিকে এগোয়। পরদা সরতে থাকে]

পঞ্চম দৃশ্য

[দেখা যায় শিশুরা দৌড়োদৌড়ি করছে, খেলাধুলা করছে। দৈত্যের বেশভূষা দেখলে মনে হয় তাঁর বয়স বেড়েছে। জগঝম্প দৈত্য ঘোড়া হয়ে একটি শিশুকে পিঠে নিয়ে ঘুরছে। তার মুখে দড়ির লাগাম। হঠাৎ দৈত্য মুখ থুবড়ে পড়ে। সবাই ‘বড়োবন্ধু- বড়োবন্ধু’ করে ছুটে আসে]

সবাই। বড়োবন্ধু! বড়োবন্ধু!

১ম জন। (গায়ে কপালে হাত দিয়ে) একী! গা পুড়ে যাচ্ছে। খুব জ্বর হয়েছে তো তোমার!

দৈত্য। (সবাইকে ধরে উঠতে উঠতে) চারদিকটা বড়ো অন্ধকার লাগছে, সন্ধে কি হয়ে এল?

২য় জন। কই না তো। এখনও তো খুব বিকেল!

[সবাই ধরে তাকে প্রাসাদের সিঁড়িতে বসিয়ে দেয়]

৩য় জন। কালকে আমাদের সঙ্গে তোমার খেলা বন্ধ।

৪র্থ জন। তুমি ডাক্তার দেখাবে কিন্তু-

দৈত্য। (ম্লান হেসে) আচ্ছা! আচ্ছা! তোমাদের মধ্যে আমাদের সেই ছোটো, সবচেয়ে ছোট্ট বন্ধুটাকে আর দেখি না কেন?

১ম জন। কে?

অনেকে। খুব ছোট্ট? কে? কেমন…?

দৈত্য। সেই যে চুড়ো করে চুল বাঁধা লাল টুকটুকে পা-

[মঞ্চের বিপরীত দিকে একটা আলোর বৃত্তে চুড়ো বাঁধা ছোটো ছেলেটিকে দাঁড়িয়ে হাসতে দেখা যায়। আর কেউ তাকে দেখতে পায় না]

৩য় জন। দেখতে দেখতে আকাশটা কেমন লাল টুকটুক হল দেখো-

দৈত্য। তাহলে খুব বৃষ্টি নামবে। তাড়াতাড়ি বাড়ি যাও সব। (ওরা যেতে উদ্যত হলে) দাঁড়াও! রাজাবাবুরা আজ আর নজরানা নেবে না বুঝি?

[একটা কৌটো পাশ থেকে নিয়ে খুলে একটা কিছু একজনের হাতে দিতে থাকে]

১ম। আসি বড়োবন্ধু-।

দৈত্য। এসো।

২য়। গুড নাইট -।

দৈত্য। নাইট-।

২য়। হুঁ। হুঁ। আজ আমার ভাগ্যে চকোলেট।

৪র্থ। টা-টা। বড়োবন্ধু!

দৈত্য। তোমার আজ বিস্কুট।

৪র্থ। ভেরি গুড! ভেরি গুড! কচমচ বিস্কুট।

৫ম। (হাতে নিতে নিতে, উঁকি দিয়ে কৌটোয়) আরও একটা কেন? আর কে পাবে?

দৈত্য। (ক্লান্ত স্বরে) ওটা আমার সেই ছোট্ট বন্ধুর।

[পূর্বের স্থানে সেই চুড়ো-বাঁধা চুলের ছোট্ট ছেলেটি হাসি মুখে এসে দাঁড়ায়]

ছোট্টটি। সেই যার চুড়ো করা চুল, না?

দৈত্য। (আচ্ছন্নের দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে) হ্যাঁ-

ছোট্টটি। লাল টুকটুকে পা যার, না?

দৈত্য। হ্যাঁ। সে-ই!

ছোট্টটি। যে তোমাকে চুমু দিয়েছিল দু-গালে, তাই না?

দৈত্য। (ব্যাকুল স্বরে) ঠিক। ঠিক। তারই জন্যে- তারই জন্যে-

৬ষ্ঠ। কী হল বড়োবন্ধু? তুমি অমন বিড়বিড় করছ কেন?

দৈত্য। অ্যাঁ? না। তোমরা বাড়ি যাও। খুব ঝড় বৃষ্টি আসছে।

৭ম। হ্যাঁ। তুমি ওঠো- ঘরে গিয়ে ঢোকো….

দৈত্য। এই যাই-

[দৈত্য উপরে উঠে যেতে থাকে। ছেলেরা চলে যেতে যেতে বাই, গুডবাই, বাই বাই বলতে বলতে চলে যায়। মঞ্চে বিদ্যুৎ চমকাতে থাকে ঝড়ের শব্দ চলতে থাকে। ১৫/২০ সেকেন্ড মঞ্চ ফাঁকা। তারপর একটা বাঁশি বাজতে থাকে। মঞ্চের ঊর্ধ্ব দক্ষিণ কোণ থেকে চুড়ো বাঁধা সেই ছোট্টটি মুখে হাত দিয়ে চিৎকার করে ডাকতে থাকে]

ছোট্টটি। বড়োবন্ধু। বড়োবন্ধু! আমি এসেছি।

[প্রাসাদের জানলা খুলে যায়]

দৈত্য। কে? গোপাল? আমার নাড়ুগোপাল এলে? কতদিন খুঁজেছি তোমাকে এতদিনে আসার সময় হল? দাঁড়াও- আসছি। আমি আসছি। (সিঁড়ির গোড়ায় হাঁটু ভেঙে সে বসে পড়ে।) আমি যে চলতে পারছি না-

ছোট্টটি। এই তো আমি। আমার হাতটা ধরো-

[দৈত্য টলোমলো পায়ে যেই হাত ধরতে এগোয়, ছোট্টটি পেছোতে থাকে]

দৈত্য। (বলতে বলতে মঞ্চের মাঝখানে যায়) জানো? জানো তুমি? তোমার ছোঁয়ায় আমি সোজা হয়ে গেছি গো। তোমাকে দেখার আগে আমি জানতামই না, শিশু- ফুল- পাখি- আলো, রোদ- আকাশ-বাতাস যারা ভালোবাসে না, তারা বড়ো হতভাগা। একটু দাঁড়াও। তুমিও আমাকে ভালোবাসতে শেখালে। আমার ভেতরটা নরম করে দিলে গোপাল আমার নাড়ুগোপাল….

[ততক্ষণে মঞ্চের ঊর্ধ্ববাম অংশে শিউলি : গাছটাকে গিয়ে ছোট্টটি ধরেছে। সে গাছের আড়ালে চলে যায়। গাছের অন্য দিক দিয়ে ছোট্ট কৃষ্ণের সাজে একটি ছেলে বেরিয়ে আসে]

দৈত্য। বন্ধু, কোথায় গেলে? একী, আমার দু-চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে কেন?

[হাঁটু ভেঙেঁ বসে পড়ে। শ্রীকৃষ্ণরূপী ছেলেটি সামনে এসে দাঁড়ায়]

দৈত্য। একী? তুমি কে? তোমার পায়ে এ কীসের ক্ষত?

ছেলেটি। কিছু না, ও ভালোবাসার চিহ্ন। আড়াল থেকে একটা ব্যাধ পা-টাকে পাখি ভেবেছিল-

দৈত্য। তাহলে কে তুমি? তুমি কে-?

ছেলেটি। তোমার বড়োবন্ধু। তুমি একদিন তোমার বাগানে আমাকে খেলতে দিয়েছিলে, আজ চলো তোমাকে আর একটা সুন্দর বাগানে খেলতে নিয়ে যাই। যাবে তুমি-?

দৈত্য। যাব, যাব। আমার হাতটা একটু ধরো।

ছেলেটি। (পিছিয়ে গাছের পাশে যায়) এসো। এসো। এসো।

[দৈত্য শুয়ে এগোতে গিয়ে হাত বাড়িয়েই উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে। গাছ থেকে ফুল ঝরে পড়তে থাকে দৈত্যের গায়ে। গাছের পাশ দিয়ে কৃষ্ণ-বালকটি ও চুড়ো-বাঁধা বালকটি পর্যায়ক্রমে ঘুরে ঘুরে যায় গাছটিকে। স্কুলের ছুটির ঘণ্টা বাজে। ছেলে-মেয়েরা দৌড়ে এসে দৈত্যকে শায়িত দেখে তাকে ঘিরে হাঁটু ভেঙে বসে মাথা নিচু করে। দূর থেকে শিশু কণ্ঠে গান ভেসে আসতে থাকে-। নই আমি আর স্বার্থপর নই, এমনকী হিংসুটে- সত্যি সত্যি, বদলে গেছে হৃদয়টাই]

[পরদা]

অস্কার ওয়াইলড-এর ‘দ্য সেলফিশ জায়ান্ট’ কাহিনি অবলম্বনে

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *