ভাষণদাদা – শৈবাল মিত্র

ভাষণদাদা – শৈবাল মিত্র

বঙ্কিম বটব্যাল শিক্ষাবিদ। বয়স ৫৫-৬০

রাম

রাখাল

ভুবন বয়স ১৭-২০

সুবোধ

মিমি বঙ্কিমবাবুর নাতনি। বয়স ১৪-১৫

প্রথম দৃশ্য

[ বঙ্কিম বটব্যালের বসার ঘর। রাম, রাখাল, সুবোধ, ভুবন বসে আছে। সময় সকাল দশটা ]

রাম। বঙ্কিমবাবুর সঙ্গে কাজের কথাটা সুবোধ বলবে। আমরা শুধু সায় দিয়ে যাব।

রাখাল। ঠিক তাই। আমরা শুধু -ইয়েস স্যার- -হ্যাঁ স্যার- করে যাব।

রাম। ভয় হচ্ছে ভুবনকে নিয়ে। মুখ ফসকে কী বলে ফেলবে, কে জানে!

ভুবন। কেন রে? আমি কি ছাগল?

সুবোধ। (মুখে আঙুল দিয়ে) চুপ! চুপ! স্যার আসছেন।

[ দরজায় পরদা ঝুলছে। বাড়ির ভেতর থেকে চটির চটাপট আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সকলে নড়েচড়ে বসল। ধুতি পাঞ্জাবি পরা, বঙ্কিম ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসল ]

বঙ্কিম। (চার তরুণের দিয়ে তাকিয়ে) তোমরা?

সুবোধ। আজ্ঞে, আপনার কাছে একটু এলাম।

বঙ্কিম। সে তো দেখতে পাচ্ছি। থাক কোথায়?

সুবোধ। আজ্ঞে, এই পাড়াতেই।

বঙ্কিম। করো কী?

সুবোধ। আজ্ঞে কলেজে পড়ি।

বঙ্কিম। সবাই কলেজের ছাত্র?

[ রাম, রাখাল মুখ চাওয়াচায়ি করে। সুবোধ নখ খুঁটছে ]

রাখাল। না, সবাই নয়। সুবোধ আর আমি কলেজে পড়ি।

বঙ্কিম। সুবোধ কে?

[ রাখাল আঙুল তুলে দেখায় ]

বঙ্কিম। (রাম আর ভুবনের দিকে তাকিয়ে) তোমার নাম কী?

রাম। আমি রাম, আর ও ভুবন।

বঙ্কিম। (রামকে) তোমরা কী করো?

রাম। (আমতা আমতা করে) আমি ট্রেনিং-এ আছি।

বঙ্কিম। কীসের ট্রেনিং?

রাম। ধৈর্য পরীক্ষার।

বঙ্কিম। ভারী অদ্ভুত তো! আগে শুনিনি তো, একটু বলো দেখি।

রাম। গোলমাল না করে এক জায়গায় বসে থাকতে হয়।

বঙ্কিম। শুধু বসে থাকতে হয়?

রাম। হ্যাঁ স্যার।

বঙ্কিম। কতদিন বসে থাকতে হবে?

রাম। চিঠিটা আসা পর্যন্ত!

বঙ্কিম। কীসের চিঠি?

রাম। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার, চাকরির নিয়োগপত্র স্যার।

বঙ্কিম। বুঝলাম। কোথায় বসে থাকতে হয় তোমাকে? মানে, ধৈর্যশীল করার ট্রেনিং সেন্টারটা কোথায়? ঠিকানা কী?

রাম। খালপাড়ের রাস্তায়, পচাদার চা দোকানের পাশে যে রক রয়েছে সেখানে। সকাল দশটায় বসি, বাড়ি ফিরতে রাত দশটা হয়। দুপুরে দু-ঘণ্টা ছুটি। বাড়ি থেকে নাওয়া-খাওয়া করে আসি। বলতে পারেন, বারো ঘণ্টা ডিউটি।

বঙ্কিম। তার মানে রকবাজি করো।

রাম। ঠিক রকবাজি নয় স্যার! বলতে পারেন, রকপালিশ করি, সেই সঙ্গে পাড়ার ভালো-মন্দের ওপর নজর রাখি। দরকারে পাড়ার জ্যাঠা-কাকারা আমাদের কাছে ছুটে আসে। সাহায্য চায়। আমরা সাহায্য করি।

ভুবন। শুধু সাহায্য! কত ছক্কাপাঞ্জা যে করতে হয়!

বঙ্কিম। তোমাদের নেতা কে?

ভুবন। পচাদা।

বঙ্কিম। চাওয়ালা?

ভুবন। হ্যাঁ স্যার। পচাদা ভারী সৎ, চায়ে ভেজাল দেয় না। এক কাপ চায়ে ঠিক এক কাপ জল মেশায়। ডবল হাফ চা চাইলে নিয়মমতো আধকাপ জল দেয়। ঠকানোর কোনো সিন নেই!

[ বঙ্কিম কয়েক সেকেন্ড ভুবনের দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ ঘুরিয়ে নেয় ]

বঙ্কিম। (সুবোধকে) তা আমার কাছে কেন?

সুবোধ। সামনে মাসের সতেরো তারিখে, শুক্রবার, আমাদের পাড়ার লাইব্রেরি, ভূপেন্দ্র স্মৃতি পাঠাগারের অনুষ্ঠানে আপনাকে প্রধান অতিথি হিসেবে আমরা পেতে চাই স্যার। অনুষ্ঠান বিকেল পাঁচটায় শুরু হবে। দয়া করে -না- বলবেন না স্যার।

বঙ্কিম। উপলক্ষটা কী?

সুবোধ। পুরস্কার বিতরণ স্যার।

বঙ্কিম। কারা পুরস্কার পাবে?

সুবোধ। মাধ্যমিক আর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষাতে এলাকায় যারা ভালো রেজাল্ট করেছে, তাদের পুরস্কার দেওয়া হবে।

বঙ্কিম। বেশ। তা আমাকে ডাকছ কেন?

সুবোধ। এ পাড়ায় আপনার মতো পণ্ডিত মানুষ কজন আছে স্যার! দেশের লোক এক ডাকে আপনাকে চেনে।

রাখাল। আপনার নাম শুনলে আমাদের বাবা-কাকারাও শ্রদ্ধায় মাথা হেঁট করে।

বঙ্কিম। তাই নাকি?

রাম। আঠারো আনা সত্যি স্যার।

বঙ্কিম। কী করতে হবে আমাকে?

সুবোধ। একটা ভাষণ দিতে হবে।

রাখাল। আর পুরস্কারগুলো ছেলে-মেয়েদের হাতে তুলে দিতে হবে।

বঙ্কিম। কতজনকে পুরস্কার দেবে?

সুবোধ। পঁচিশজনকে স্যার।

বঙ্কিম। না বাপু, একটানা দাঁড়িয়ে পঁচিশজনকে পুরস্কার দেওয়ার মতো হাঁটুর জোর আমার নেই। গেঁটে বাতে ভুগছি অনেকদিন। তা ছাড়া সামনে মাসের সতেরো তারিখ সন্ধেতে আরও গুচ্ছের সভা আছে। পাঁচ মিনিটের জন্যেও একবার করে যেতে হবে। দাঁড়াও, দেখাই। (ড্রয়ার খুলে ডাইরি বার করে, পাতা উলটে দেখে) না, এটাতে নেই। (হাঁক পাড়ে) মিমি, অ্যাই মিমি।

. . . কলম হাতে নিয়ে দাদুর পাশে মিমি দাঁড়িয়ে আছে।

[ দরজার পরদার ওপাশ থেকে কিশোরী গলা সাড়া দেয়, -কী দাদু- ]

বঙ্কিম। আমার সভাসমিতির ডাইরিটা নিয়ে আয়।

[ বাড়ির ভেতর থেকে মিমি–যাচ্ছি।- ভুবন, রাম, রাখাল, নড়েচড়ে বসে ]

বঙ্কিম। পঁচিশটা প্রাইজ আমি দিতে পারব না।

সুবোধ। স্যার, প্রথম পাঁচটা দিয়ে আপনি চলে যাবেন। বাকিগুলো মঞ্চে আর যারা থাকবেন, তারা দেবেন।

বঙ্কিম। ভাষণ দিতে হবে নাকি আমাকে?

সুবোধ। তা তো হবেই স্যার। আপনার ভাষণ শুনতেই তো সকলে আসবে।

বঙ্কিম। কতক্ষণ বলতে হবে?

সুবোধ। সাত মিনিট। দশ মিনিটও বলতে পারেন।

বঙ্কিম। দশ মিনিট বলব।

সুবোধ। আপনার যেমন খুশি। (এক মুহূর্ত থেমে) আপনার নাম দিয়ে কার্ড ছাপতে দিতে পারি স্যার?

বঙ্কিম। দাও।

[ মিমি ডাইরি নিয়ে ঘরে ঢুকল। তার সপ্রতিভ, চোখা চেহারা ]

বঙ্কিম। সামনের মাসের সতেরো তারিখে, বিকেলে আমার কী কী প্রোগ্রাম আছে, পড়ো তো।

মিমি। (ডাইরির পাতা খুলে) ক্ষেত্রনাথের বিয়ে, হরিবাবুর মায়ের শ্রাদ্ধ, অনন্তর ছেলের মুখেভাত, বিধান সরকারের কবিতা পাঠের আসর, পরিবেশ দূষণ রোধে বিকেল পাঁচটায় পদযাত্রা, তারপর টপ্পাগানের আসর, তারপর-

বঙ্কিম। ঠিক আছে, ঠিক আছে, এদের অনুষ্ঠানটাও ডাইরিতে সতেরো তারিখের পাতায় লিখে নাও।

মিমি। দাদু, আরও আছে। সব অনুষ্ঠান পড়া হয়নি।

বঙ্কিম। দরকার নেই।

মিমি। (খোলা ডাইরি, কলম হাতে নিয়ে দাদুর পাশে দাঁড়িয়ে) কী লিখব দাদু?

বঙ্কিম। পাড়ার লাইব্রেরিতে সন্ধে ছটায় অনুষ্ঠান।

সুবোধ। ছটায় নয় স্যার, পাঁচটায়।

রাখাল। লাইব্রেরির নাম, ভূপেন্দ্র স্মৃতি পাঠাগার।

বঙ্কিম। (মিমিকে) ওরা যা বলছে, লেখো। লাইব্রেরির নাম, সময়।

মিমি। (ডাইরি লিখতে লিখতে) সতেরো তারিখ শুক্রবার বিকেল পাঁচটায় বালিগঞ্জ লেক থেকে দূষণবিরোধী যে পদযাত্রা বেরোচ্ছে, সেখানেও তো ভাষণ দিতে হবে তোমাকে।

বঙ্কিম। তাতে কী? কোনো অসুবিধে হবে না।

মিমি। সেদিনই বিকেল সাড়ে পাঁচটায় বিধান সরকারের নবতম কাব্যগ্রন্থ তো তোমার প্রকাশ করার কথা। বিধান সরকারের কবিতা নিয়ে ভাষণ দিতে হবে তোমাকে।

বঙ্কিম। দেব।

মিমি। অনুষ্ঠানটা কোথায় হবে জানো?

বঙ্কিম। খুব জানি। দক্ষিণেশ্বরে। বিধান সরকারের বাড়ির ছাতে।

মিমি। সন্ধে ছটায় ক্ষেত্রকাকার বিয়েতে বরযাত্রী যেতে হবে তোমাকে। দুটোর মধ্যে ক্ষেত্রকাকার বাড়িতে তোমার পৌঁছোনোর কথা।

বঙ্কিম। ঠিক পৌঁছে যাব।

মিমি। ক্যানিং-এ হরিবাবুর মায়ের শ্রাদ্ধবাসরে গিয়ে, দুপুরের মধ্যে সেখান থেকে ফিরতে পারবে?

বঙ্কিম। খুব পারব। ওসব নিয়ে তোকে মাথা ঘামাতে হবে না। (মিমি গম্ভীর হয়ে যায়। সুবোধকে) -হ্যাঁ। ওই কথাই রইল। দশ মিনিট বলব আমি।

সুবোধ। যথেষ্ট। আপনার দশ মিনিট।

রাখাল। তাতেই সকলে ফ্ল্যাট হয়ে যাবে।

বঙ্কিম। কী বিষয়ে তোমরা শুনতে চাও?

সুবোধ। আপনি যা ভালো মনে করেন।

বঙ্কিম। ভাষণের একটা নিয়ম আছে। প্রথমে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বলতে হয়।

সুবোধ। বলবেন স্যার, নিশ্চয় বলবেন।

বঙ্কিম। আচ্ছা, আমি যদি এভাবে শুরু করি- (এক মুহূর্ত নীরবতা)

সুবোধ। করুন স্যার।

বঙ্কিম। বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা, কে তারে আশা দেবে, কে তারে ভরসা দেবে, কে বলবে, ওঠো মা, জাগো।

[ সকলে হাততালি দেয় ]

সুবোধ। দারুণ!

রাখাল। ফ্যানটেনিয়াস এ্যান্ডিভোরাস!

রাম। মার কাটারি, ধর ছুরি।

সুবোধ। থামলেন কেন স্যার? বলুন।

বঙ্কিম। (মুচকি হেসে) দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে দু-চার কথা বলে, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ছুঁয়ে তারপর সমাজগঠনে ছাত্রদের ভূমিকায় চলে যাব। খুব বেশি টানব না। প্রাইজ নিতে যারা আসে, তারা ভাষণ শোনে না। প্রাইজটা হাতে পাওয়ার জন্যে হাপিত্যেশ করে বসে থাকে, আমি এসব জানি।

সুবোধ। স্যার, যদি কিছু মনে না করেন, আমাদের অনুষ্ঠান কিন্তু একদম আলাদা। সবাই মন দিয়ে ভাষণ শোনে। পুরস্কৃতরাও পুরস্কার নেওয়ার চেয়ে বেশি করে ভাষণ শুনতে চায়।

বঙ্কিম। অবাক কাণ্ড তো!

সুবোধ। হ্যাঁ স্যার!

বঙ্কিম। তাহলে দশের বদলে পনেরো মিনিট বলতে পারি। পারি কি না?

সুবোধ। অনায়াসে।

মিমি। পরিবেশ দূষণ বিরোধী পদযাত্রার কী হবে? বিধান সরকারের কাব্যগ্রন্থের প্রকাশ যে আটকে থাকবে।

বঙ্কিম। কিচ্ছু আটকে থাকবে না। পৃথিবীতে কারো জন্যে কিছু থেমে থাকে না। হ্যাঁ, যা বলছিলাম, জাতিগঠনে ছাত্রদের ভূমিকা নিয়ে অনেক কথা বলার আছে। তরুণরাই তো সব। তারা হল সকাল আটটা-নটার সূর্যের মতো। তাদের এমন কথা শোনাতে হবে যা তারা কখনো শোনেনি, কখনো শুনবে কি না সন্দেহ। একটু বাড়তি সময় পেলে সেকথা আমি শোনাব।

সুবোধ। শোনাবেন স্যার, অবশ্যই শোনাবেন।

রাখাল। কেস জমে যাবে। যাকে বলে, খেপচুরিয়াস মাইলোপিথোরাস হয়ে উঠবে গোটা অনুষ্ঠান।

রাম। দুর্দান্ত কাণ্ড হবে।

বঙ্কিম। আমার ভাষণ শোনার জন্যে তোমাদের আগ্রহ দেখে ভারী খুশি হলাম। (গলা নামিয়ে) তবে শুধু ছাত্রদের দায়দায়িত্বের কথা বলে আমি থামব না। অভিভাবকদের দায়িত্বের কথাও বলতে হবে আমাকে। ছেলেমেয়েদের বকে যাওয়ার পেছনে অভিভাবকদের দোষত্রুটি কম নেই। খোলাখুলি এসব কথা বলার সময় হয়েছে। কাউকে আমি ছাড়ব না।

রাখাল। সাংঘাতিক কাণ্ড হবে স্যার। হইচই পড়ে যাবে।

বঙ্কিম। হুস। এসব বলতে গেলে আরও পাঁচ মিনিট দরকার। পনেরোর বদলে কুড়ি মিনিট লাগবে। হ্যাঁ কুড়ি মিনিট। কুড়ি মিনিটে হয়ে যাবে।

রাখাল। তা হোক। কুড়ি মিনিটই আপনি পাবেন। কুড়ি মিনিট চোখের পলকে কেটে যাবে। উফ, আমি ভাবতে পারছি না, তারপর কী ঘটবে!

মিমি। দাদু, আর বাড়িয়ো না। পরিবেশদূষণ বিরোধী পদযাত্রার কী হবে? বিধান সরকারের কবিতার বই প্রকাশ? ক্ষেত্রকাকার বিয়েতে বরযাত্রী? কে যাবে?

বঙ্কিম। আমি যাব। সব জায়গাতে আমি যাব। দরকার হলে রাত বারোটায় পৌঁছোব।

রাখাল। সাবাস স্যার। একদম বাঘের মতো কথা বলেছেন।

বঙ্কিম। এ কী শুনছ! মঞ্চে দাঁড়িয়ে যখন ভাষণ দেব- যাক শোনো, আরও পাঁচ মিনিট বেশি সময় চাই। কুড়ি মিনিটের বদলে শেষ করতে পঁচিশ মিনিট নেব।

সুবোধ। তাই হবে স্যার!

রাখাল। হতেই হবে। আপনার ভাষণে সভায় ধুন্ধুমার লেগে যাবে।

বঙ্কিম। বলছ?

রাম। কালীর দিব্যি বলছি।

[ রামের কাঁধে হাতের চাপ দিয়ে তাকে সুবোধ থামায় ]

বঙ্কিম। স্পষ্ট ভাষায় বলব, হে ভারত, ভুলিয়ো না তোমার শিরদাঁড়া তরুণ সম্প্রদায়। হ্যাটকোট পরা তরুণ, নগ্ন তরুণ, ভদ্র তরুণ, কাদাখোঁচা তরুণ, সকলে তোমার সম্পদ। দেশের ভবিষ্যৎ বলতে তরুণরা ছাড়া কেউ নেই।

রাখাল। ব্রাভো, বুঝতে পারছি, আপনি সেদিনের অনুষ্ঠানে স্বামী বিবেকানন্দ, নেতাজি সুভাষচন্দ্রের মতো মাতিয়ে দেবেন শ্রোতাদের।

বঙ্কিম। ঠিক তাই। আরও পাঁচ মিনিট বেশি সময় লাগবে আমার।

রাম। পাঁচ মিনিট কেন স্যার, দশ মিনিট পাবেন।

বঙ্কিম। তাহলে কত সময় ভাষণের জন্যে বরাদ্দ হল?

সুবোধ। পঁয়ত্রিশ মিনিট স্যার।

বঙ্কিম। যথেষ্ট।

মিমি। পরিবেশ পদযাত্রা কী হবে? কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ কে করবে? ক্ষেত্রকাকার বিয়েতে বরযাত্রী যাওয়া তো লাটে উঠবে। ক্যানিং-এ হরিবাবুর মায়ের শ্রাদ্ধের যে স্মরণসভা হবে, সেখানেও তোমার ভাষণ দেওয়ার কথা। হাওড়ায় অনন্ত সেনের ছেলের মুখেভাত অনুষ্ঠানের শিশুকে মানুষ করা নিয়ে নাতিদীর্ঘ ভাষণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছ তুমি। মুখেভাত অনুষ্ঠানও হবে সতেরো তারিখ দুপুরে। সব দিক তুমি সামলাবে কী করে? তারপরেও আছে টপ্পা গানের আসর।

বঙ্কিম। ঠিক সামলাব।

রাম। আমরা সামলে দেব।

বঙ্কিম। তার মানে?

রাখাল। রামের কথায় কান দেবেন না স্যার। ওর কথার কোনো মানে নেই। ও হল একটা ফ্লোকসিনেটসি-নিহিলিপিলিফিকেশন।

বঙ্কিম। কথাটার মানে?

রাখাল। লবডঙ্কা। রাম একটা লবডঙ্কা।

বঙ্কিম। বিবেকানন্দ, নেতাজির নাম যখন উঠল, তখন তাঁদের দু-একটা বাণী আমি ভাষণে না ঢোকালে, সেটা অন্যায় হবে। তোমরা কী বলো?

রাখাল। হক কথা স্যার।

বঙ্কিম। দুজনের দুটো করে চারটে বাণী, আমার ভাষণের মধ্যে আমি গুঁজে দেব।

রাখাল। চমৎকার হবে।

বঙ্কিম। তাহলে আর পাঁচ মিনিট সময় আমার দরকার।

রাখাল। কোনো অসুবিধে নেই।

বঙ্কিম। ব্যস, আর চিন্তা নেই। আমার ভাষণ দাঁড়িয়ে যাবে।

ভুবন। আমরা শুয়ে পড়ব।

বঙ্কিম। কী বললে?

ভুবন। ভাষণ দাঁড়িয়ে গেলেও পাবলিক ফ্ল্যাট হয়ে যাবে।

মিমি। শুনুন, আমার দাদুকে আপনি অপমান করতে পারেন না।

রাখাল। ভুবনের মাথায় ছিট আছে।

সুবোধ। ভুবন, তুই থাম।

ভুবন। তোদের পাঁয়তাড়া আর সহ্য হচ্ছে না।

বঙ্কিম। ছিঃ, ঝগড়া করতে নেই।

ভুবন। স্যার একটা প্রশ্ন করতে পারি?

রাখাল। চুপ, চুপ!

বঙ্কিম। প্রশ্ন থাকলে ওকে করতে দাও। (ভুবনকে) বলো, কী তোমার প্রশ্ন?

ভুবন। মশাই, আমার মুখটা ভালো নয়। দু-একটা বাজে কথা যদি মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়, গায়ে মাখবেন না। প্রশ্নটা হল, চল্লিশ মিনিট ধরে আপনার ভাষণ শুনে আমার কী জমা হবে?

বঙ্কিম। অ্যাই, অ্যাতক্ষণে আসল প্রশ্নটা করেছ? (এক সেকেন্ড থেমে) কথাটার মানে তো বুঝলাম না।

ভুবন। জমা মানে বুঝলেন না। আপনি তো… (ভুবনকে কথা শেষ করতে দেয় না রাখাল)

রাখাল। জমা মানে লাভ। ভুবন জানতে চায়, আপনার ভাষণ শুনে তার কী লাভ হবে?

বঙ্কিম। আমারও তাই মনে হয়েছিল। এক্কেবারে ন্যায্য প্রশ্ন করেছে ও। আমাকে যদি আরও পাঁচ মিনিট সময় দেওয়া হয়, ভাষণের মধ্যে ভাষণ শোনার উপকারিতা নিয়ে দু-চার কথা বলে দেব। ভাষণ শেষ করতে আমার লাগবে পঁয়তাল্লিশ মিনিট, খুব বেশি পঞ্চাশ মিনিট।

ভুবন। আপনার ওপর তাহলে পটকা পড়বে।

বঙ্কিম। পটকা! পটকা কেন?

ভুবন। পচাদার ভাই ধসাদা, ভূপেন স্মৃতি পাঠাগারের সে পৃষ্ঠপোষক, পাঁচ মিনিটের বেশি ভাষণ সে সহ্য করতে পারে না। সে টাকা জোগাড় করে আনলে তবেই লাইব্রেরি চলে। আপনার কাছে আমরা আসার সময়ে লাইব্রেরির মাতব্বররা পইপই করে সময়ের কথাটা সুবোধ আর রাখালকে বলে দিয়েছিল। কিছুতেই সাত মিনিটের বেশি সময় যে দেওয়া যাবে না, মাথায় রাখতে বলেছিল। কিন্তু এখন সময় নিয়ে এরা যা শুরু করেছে এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি তাই।

রাখাল। বাজে বকবি না ভুবন।

ভুবন। এই চোখ তুলে কথা বলিসনি।

সুবোধ। আমি চললাম।

[ সুবোধ বেরিয়ে গেল

বঙ্কিম। তোমাদের সভায় আমি যাব না।

ভুবন। যেতে আপনাকে হবেই। ভাষণ দিতে হবে পাঁচ মিনিটের।

বঙ্কিম। না না পঞ্চাশ মিনিটের। একঘণ্টাও হতে পারে।

ভুবন। (রাম ও রাখালের সঙ্গে সমস্বরে) না, পাঁচ মিনিটের।

বঙ্কিম। অসম্ভব। ফ্লো এসে গেলে থামতে পারি না। মাইক ধরাবে তোমরা, কখন ছাড়ব সে আমি বলব।

ভুবন। ফ্লোর নিকুচি করেছে। আমরা যাচ্ছি। বাজারে প্রধান অতিথির অভাব নেই। অনেক ভাষণদাদা আছে।

[ ভুবন, রাম, রাখাল বেরিয়ে গেল

বঙ্কিম। দাঁড়াও, দাঁড়াও, ভাষণ শুনবে না? দাঁড়াও-

মিমি। যাক বাবা, বাঁচা গেছে!

বঙ্কিম। (হেসে) আর আসবে না। ভাষণের নাম শুনলে ওরা এখন থেকে ডরাবে। এদের হাত থেকে মুক্তি পাবার ভালো উপায় বার করিনি দিদি! ডায়েরির অ্যাপয়েন্টমেন্টগুলো তো সব মিথ্যে!

মিমি। তাই! কিন্তু গত সপ্তাহেই তো সাহিত্যসভা, পরিবেশদুষণ সচেতনতা সভা, আরও কী কী অনুষ্ঠানে ভাষণ দিয়ে এলে। দাদু, প্লিজ, অসুস্থ শরীরে তুমি এভাবে সভাসমিতিতে যেয়ো না। তোমাকে নিয়ে ওরা মজা করছিল। ভাষণদাদা বলছিল তোমাকে। কান্না পাচ্ছিল আমার।

বঙ্কিম। ঠিক আছে, ঠিক আছে দিদি, আর কোথাও ভাষণ দিতে যাব না। আসলে কী জানিস দিদি, পুরোনো অভ্যাস। ছাড়তে সময় লাগে- old habits die hard. তবে আজকাল মাঝে মাঝে ভাবি -ভাষণ দিয়ে সত্যিই কি কিছু হয়?

মিমি। ওরেব্বাবা, তুমি তো দেখছি দার্শনিক হয়ে যাচ্ছ। তাও ভালো। ভাষণদাদার চেয়ে দার্শনিকদাদা শুনতে ভালো লাগবে। তুমি এখন থেকে ভাবো দাদু। ভাবতে থাকো। একদিন ওটাও অভ্যাস হয়ে যাবে।

[ ধীরে ধীরে পরদা নেমে আসে ]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *