রবীন্দ্রজয়ন্তী – স্বপ্নময় চক্রবর্তী

রবীন্দ্রজয়ন্তী – স্বপ্নময় চক্রবর্তী

পল্লব ১২শ শ্রেণিতে পড়ে। বয়স ১৮

গোলোকপতি প্রমোটার। বয়স ৪৫-৫০

পাপুন ৪র্থ -৫ম শ্রেণিতে পড়ে। বয়স ১০-১১

ধ্রুব ,,

ছোটন ,,

শ্রাবণী একটি মেয়ে। বয়স ১০-১২

ঝালর একটি মেয়ে। বয়স ৫-৬

সন্টু স্কুলে পড়ে না। বয়স ১২

আলোর মা ,,

প্রথম দৃশ্য

[ পরদা পড়ে আছে। পরদার ভিতর থেকে মাইক ঠিক করার আওয়াজ আসছে। হারমোনিয়ামের প্যা-পু, তবলা বাঁধবার তেরে কেটে তাক, ঠুক ঠুক, হ্যালো মাইক টেস্টিং ওয়ান টু থ্রি ফোর, বাচ্চাদের কলরব।

মাইকে একটা গলা শোনা যায়। গলাটা পল্লবের ]

পল্লব। আমাদের রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠান এক্ষুনি শুরু হবে। আপনারা যারা এখানে এসে পৌঁছোননি, এক্ষুনি চলে আসুন। বাচ্চারা গোলমাল কোরো না। তোমরা গোলমাল করলে আমরা অনুষ্ঠান শুরু করতে পারব না। অ্যাই পাপুন, কী হচ্ছে, কথা বলছ কেন? গুঞ্জন, তুমি আর গুঞ্জন কোরো না। ছোটোরা সব চেয়ার ছেড়ে দাও, চেয়ারে বড়োদের বসতে দাও। আমাদের সভাপতিমশাই এসে গেছেন, বাচ্চারা হাততালি দাও। আমরা শুরু করছি আমাদের রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠান।

[ হাততালির শব্দের মধ্যে পরদা খুলতে থাকে। পরদা খুললে দেখা যায় একটা ছোটোখাটো মঞ্চ, মঞ্চে একটা ঢাকা-দেওয়া টেবিল, চেয়ার, কোণায় রবীন্দ্রনাথের একটা ছোটো মূর্তি, মালা দেওয়া, ধূপকাঠি জ্বলছে; পল্লব সভাপতিমশাইকে ধরে ধরে মঞ্চের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সভাপতিমশাই মাঝবয়সি, গোলগাল গড়ন, মঞ্চে উঠে সহাস্য বদনে বললেন, নমস্কার।

পল্লব মাইকের সামনে দাঁড়ায়। কবিতার লাইন লেখা পাঞ্জাবি গায়ে ]

পল্লব। আমাদের পরম সৌভাগ্য যে, মাননীয় প্রমোটার শ্রীযুক্ত গোলোকপতি গোলদার আজকের এই অনুষ্ঠানে সভাপতি হতে রাজি হয়েছেন, সেইজন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তিনি অত্যন্ত ব্যস্ত লোক, আরও দু-জায়গায় সভাপতি হতে হবে, তাই আমরা এখুনি সভাপতি বরণ করে নিচ্ছি, তারপরই তিনি ভাষণ দেবেন। প্রথম সভাপতি বরণ। সভাপতিকে বরণ করছে ছোট্ট মেয়ে ঝালর। এই ঝালর, এদিকে আয়।

[ একটা ছোট্ট মেয়ে শাড়ি পরেছে, খুব সেজেছে, লিপস্টিক ধেবড়ে গেছে, একটা মালা হাতে করে আসে। সভাপতি গোলোকপতির গলায় পরাতে চায় ]

গোলোকপতি। গলায় দিয়ো না, বড্ড সুড়সুড়ি লাগে। হাতে দাও।

[ মেয়েটি কোনোরকমে মালাটা দিয়েই পালিয়ে আসে ]

পল্লব। কী হল, হাততালি কোথায়?

[ বাচ্চারা সবাই হাততালি দেয় ]

পল্লব। এবার সভাপতির ভাষণ।

গোলোকপতি। আমি তোমাদের অনুষ্ঠানে সভাপতি হতে পেরে খুব আনন্দিত। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কী আর বলব, সবই তো রচনা বইতে লেখাই আছে। তবুও সভাপতিকে কিছু বলতেই হয়। (পকেট থেকে একতাড়া কাগজ বার করে) আমি লিখিত ভাষণ পাঠ করব। রবীন্দ্রনাথের জন্ম হয় জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে। ১৮৬১ সালে। পিতার নাম ছিল দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছোটোবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথের হেভি প্রতিভা ছিল। রবীন্দ্রনাথ খুব আমসত্ব খেতে ভালোবাসতেন। তাইতো কবি লিখেছিলেন-

আমসত্ব দুধে ফেলি

তাহাতে কদলী দলি

সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে-

হাপুশ হুপুশ শব্দ

চারিদিক নিঃশব্দ

পিঁপড়া কাঁদিয়া যায় পাতে।…

পাপুন। (দর্শকদের মধ্যে বসা পাপুন ধ্রুবকে ঠেলা দিল) এই মরেচে। সভাপতি যে আমার কবিতাটা বলে দিল…

ধ্রুব। যদি আমারটাও বলে দেয়, দামোদর শেঠ…

পাপুন। আমার অবিশ্যি আরেকটা কবিতা করা আছে …

পল্লব। (মঞ্চের কোণে দাঁড়িয়ে ধ্রুব-পাপুনদের দিকে তাকিয়ে মুখ ঝামটা দেয়) এ্যাই বাচ্চারা কী হচ্ছে! গোলমাল করছ কেন?

[ যখন এইসব হচ্ছে, তখন গোলোকপতি বক্তৃতা দিয়ে চলেছেন। কিন্তু গোলোকপতির কথা শোনা যাচ্ছে না। তিনি বক্তৃতার মুকাভিনয় করছিলেন। এবার আবার গোলোকপতির কথা শোনা যাচ্ছে। সন্টু নামে : একটি ছেলে, ওর মা বাড়িতে ঝি-এর কাজ করে, সে কিন্তু মন দিয়ে শুনছে ]

গোলোকপতি। তারপর রবীন্দ্রনাথ বড়ো হলেন। বড়ো হয়ে অনেক বড়ো বড়ো কাজ করলেন। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে গর্জে উঠলেন। -বাংলার মাটি বাংলার জল- রচনা করলেন। ব্রিটিশ সরকার ১৯২৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালাল (পাতা উলটিয়ে) এতে রবীন্দ্রনাথ বড়োই আনন্দিত হন। সেই আনন্দের প্রকাশ দেখা যায় তাঁর বিভিন্ন গানে। যেমন -তা-তা-থই-থই তা-তা-থই-থই-। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রকৃতির কবি সৌন্দর্যের কবি…

[ সভায় গুঞ্জন ওঠে। ধ্রুব পাপুনের দিকে তাকায়, পাপুন গুঞ্জনের দিকে। ওরা তো ৪র্থ-৫ম শ্রেণিতে পড়ে, জালিয়ানওয়ালাবাগ এখনও পড়েনি। তবুও ওদের মনে হয় কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে। হঠাৎ ধ্রুব মাথা নাড়ায়। প্রতিবাদের ]

ধ্রুব। না-না-না।

শ্রাবণী। (স্কুলের পড়া মুখস্থ বলার ঢং-এ) জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত ব্যথিত হন এবং প্রতিবাদস্বরূপ নাইট উপাধি ত্যাগ করেন।

পল্লব। বাচ্চারা গোলমাল কোরো না।

গোলোকপতি। (শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে) তুমি কিছু বলছ?

শ্রাবণী। (একইরকমভাবে) জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত ব্যথিত হন এবং …

গোলোকপতি। সরি সরি সরি সরি। আমার বোধ হয়… (পাণ্ডুলিপিটা পরীক্ষা করে) পেজ নম্বার ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল। তিনের পাতার পর পাঁচের পাতা পড়ে দিইচি। হে-হে-হে সিলি মিসটেক। আমি তাহলে আবার প্রথম থেকে পড়চি, অ্যাঁ!

[ গোলোকপতি বক্তৃতা দিতে থাকে। কী বলছে দর্শকরা শুনতে পাচ্ছে না। দর্শকরা দেখতে পাচ্ছে উত্তেজিত গোলোকপতির হাত-নাড়া, মুখ এবং গ্রীবার আলোড়ন। দর্শকদের মধ্যে ছোটোদের দু-একজন ঘুমিয়ে পড়েছে। কয়েকজন নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলতে শুরু করেছে ]

ধ্রুব। এটা হলেই আমি কবিতা বলতে উঠব, -দামোদর শেঠ-।

পাপুন। নারে, তোর আগে আমি।

শ্রাবণী। আমি বলব সবার ফাস্টে। কুমোরপাড়ার গোরুর গাড়ি বোঝাই করা কলসি হাঁড়ি। গাড়ি চালায় ভাগনে মদন সঙ্গে যে যায় বংশীবদন।

[ সন্টু একটু তফাত রেখে বসেছিল। ও শ্রাবণীর ভুল কবিতা শুনে উসখুস করে উঠল ]

সন্টু। গাড়ি চালায় বংশীবদন সঙ্গে যে যায় ভাগনে মদন।

শ্রাবনী। সরি। সরি।

পাপুন। তুই কী করে জানলি সন্টু?

সন্টু। ফোর অবদি পড়েছিলাম তো।

পাপুন। এখন পড়িস না?

সন্টু। কাজ করি যে।

পাপুন। তুই কবিতা বলার জন্য নাম দিলি না কেন?

সন্টু। আমাকে নেবে?

[ গোলমাল শুনে সভাপতি হঠাৎ থেমে যান। চোখ গোলগোল করে সামনের দিকে তাকান। পল্লব ছুটে এল ]

পল্লব। অ্যাই গোলমাল করছিস কেন? মন দিয়ে সভাপতির ভাষণ শোন।

[ আবার ভাষণ চলতে থাকে। দু-একজন চোখ বোজে। সন্টু কিন্তু গালে হাত দিয়ে শুনছে। উত্তেজিত সভাপতি হাত-পা নাড়ে। হাত-পা নাড়াবার সময় রবীন্দ্রনাথের ছবিটা পড়ে যায়। তখন কয়েকজনের ঝিমুনি ভেঙে যায়। ধ্রুব উঠে গুটিগুটি পল্লবের কাছে যায়। পল্লব তখন মঞ্চের বাইরে ]

পল্লব। কী চাই?

ধ্রুব। আমি দামোদর শেঠ…

পল্লব। সময় হলেই ডাকব। তুই এখন চামেকাটা দামোদর হয়ে বসে থাক।

[ ধ্রুব আবার দর্শকদের মধ্যে চলে আসে। সভাপতির ভাষণ চলতেই থাকে। একটু পরে সভাপতির ভাষণ শেষ হয় ]

গোলোকপতি। আর কিছু বলব না। আরও অনেক অনুষ্ঠান আছে। আমার সংক্ষিপ্ত ভাষণ এখানেই শেষ করছি।

[ পল্লব হাততালি দেবার জন্য ইশারা করে। সবাই হাততালি দেয় ]

পল্লব। সবাই ধৈর্য ধরে সভাপতির ভাষণ শুনেছেন বলে সভাপতির পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এবার নাচ হবে। নৃত্য পরিবেশন করবেন পৃথুলা রায়। এখন কিছুক্ষণের জন্য বিরতি।

[ পরদা পড়ে ]

দ্বিতীয় দৃশ্য

[ পরদা উঠলে দেখা যায় পল্লবকে ঘিরে ছোটোরা সব বসেছে। একটা মিটিং হচ্ছে ]

ধ্রুব। দামোদর শেঠ করতে দিলে না আমায়। তুমি বললে চামেকাটা মজুমদার হয়ে বসে থাকতে। আমি বসে রইলাম। ডাকলে না।

পাপুন। আমাকেও ডাকেনি।

পল্লব। কী করব বল। সভাপতির ভাষণটা বড়ো হয়ে গেল, তা ছাড়া মাইকটা বিগড়োল, নাচের সময় আলোক সম্পাতের রঙিন কাগজ ছিঁড়ে গেল, পৃথুলা রায়ের পা মচকে গেল। এরকম কত কী হল, টাইম চলে গেল। সামনের বার তোরা ভালো করে করবি।

ছোটন। তো এরকম সভাপতি এনেছ কেন? হোয়াই? এত বড়ো ভাষণ দেয়, কিচ্ছু বুঝি না।

পল্লব। তো কী করব বল। উনি কত টাকা চাঁদা দিয়েছেন জানিস? ওই চাঁদাটা না পেলে লুচি আলুর দম বোঁদের প্যাকেট দিতে পারতাম?

ছোটন। আমরা কি বোঁদে খেতে চেয়েছিলাম? আমরা তো কবিতা বলতে চেয়েছি, গান গাইতে চেয়েছি।

পল্লব। ম্যালা বকিসনি তো, দর্শকদের সব জানা আছে। আমাদের দর্শকদের মধ্যে অর্ধেক ছিল বাড়ির কাজের লোক। প্যাকেট না হলে বাবুদের ঘরে বসে সবাই টিভি দেখত। ফাংশন করব-দর্শক পাব কোথায়? তোরা তো সবাই এখন ইংলিশ মিডিয়াম। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-সত্যেন দত্ত কিচ্ছু জানবিনা। কুমুদরঞ্জন মল্লিকের নাম শুনেছিস?

[ ছোটন হাত তোলে ]

ধ্রুব। আমি ইংলিশ মিডিয়াম না।

পাপুন। আমিও না।

ছোটন। আমি ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ি, বাট বাংলাও পড়ি। কুমুদরঞ্জন মল্লিক হচ্ছেন একজন গ্রেট বেংগলি পোয়েট। বাড়ি আমার ভাঙন-ধরা অজয় নদীর বাঁকে-জল যেখানে সোহাগ ভরে স্থলকে ঘিরে রাখে…

পল্লব। গ্রেট। তোর মতো সব ইংলিশ মিডিয়ামওয়ালারা যদি বাংলাটা ঠিক করে পড়ত, তাহলে আমাদের অবস্থাটা পালটে যেত। তবে ছোটন, বাংলা কথার মধ্যে ইংরিজি বলার অভ্যেসটা ছাড়।

ছোটন। আই এ্যাম সরি।

পল্লব। ওকে! ও-ও-কে। আমি এবার যাই। কাজ আছে।

পাপুন। আমরা আবার রবীন্দ্রজয়ন্তী করব।

ছোটন। হ্যাঁ, বোঁদে-আলুরদম ছাড়াই।

ধ্রুব। হ্যাঁ। বেশ হয় তাহলে। আমরাই কার্ড লিখব। ঘোষণা করব।

ছোটন। মাইকে…

পাপুন। মাইক কোথায় পাব? পাউডারের কৌটো কেটে মাইক বানিয়ে নেব।

ধ্রুব। আর সিন?

ছোটন। ধুর বুদ্ধু, সিন না ওটা স্ক্রিন, ওটা মায়ের শাড়ি দিয়ে হয়ে যাবে।

ধ্রুব। সভাপতি?

পাপুন। সে না হয় আমিই হয়ে যাব।

ধ্রুব। তাই আবার হয় নাকি! ছোটোরা কখনো সভাপতি হয়?

পাপুন। কেন হবে না? হলেই হল। দেখিস কেমন বক্তৃতা দেব।

ছোটন। তাহলে প্রধান অতিথিটা….

পাপুন। এ নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। প্রধান অতিথি হচ্ছে ধ্রুব।

ছোটন। কেন? ধ্রুব কেন?

পাপুন। ওতো এমনিতেই অতিথি। রামকৃষ্ণ মিশনে পড়ছে, হোস্টেলে থাকছে। গরমের ছুটিতে কদিনের জন্য এসেছে বাড়িতে।

ছোটন। ও হবে প্রধান অতিথি? ওর জি. কে. কত কম। আমার ড্যাডি ওকে জিজ্ঞাসা করেছিল, বল তো মাছ কোথায় থাকে? ও বলেছিল ঝোলে।

ধ্রুব। আমি তো তখন ওয়ানে পড়তাম। ওয়ানের কথা ছাড়ো।

ছোটন। বাঃ, তোরা সব হয়ে গেলি। তাহলে আমি কী হব?

পাপুন। তুই তাহলে ঘোষক হ। ঘোষক তো খালিই আছে। পল্লবদা তো ঘোষকই হয়েছিল। ঘোষকই তো আসল।

ছোটন। ঘোষক মানে কমপেয়ারিং করতে কোনো আপত্তি ছিল না, যদি সত্যিকারের মাইক থাকত। পাউডারের কৌটোর মাইকে ঘোষক? আমার ওপর এই অবিচার? হে রবীন্দ্রনাথ, ইহারা জানে না ইহারা কী করিতেছে। তুমি ইহাদিগকে ক্ষমা করিয়ো।

পাপুন। আচ্ছা, এক কাজ করছি। কবিতা আবৃত্তির প্রাইজটা তুই পাবি।

ছোটন। গট আপ গেম?

পাপুন। হ্যাঁ। গট আপ। ধ্রুব, তোর আপত্তি নেই তো?

ধ্রুব। ঠিক আছে, পুরস্কারটা ছোটনকেই দেওয়া হোক।

ছোটন। জানি না, যাঃ।

তৃতীয় দৃশ্য

[ সন্টু ঝাড়ু দিচ্ছে। রবীন্দ্রজয়ন্তীর তোড়জোড়। ধ্রুব, পাপুন, ছোটন, সবাই রয়েছে ]

সন্টু। ঝাড়ু দেওয়া হয়ে গেছে। যা ময়লা ছাতে। ঝাড়ুটাড়ু তো পড়েনি কত কাল। আর কী কাজ করতে হবে বলো।

ধ্রুব। নীচ থেকে চেয়ারগুলো আনতে হবে যে…

সন্টু। এক্ষুনি নিয়ে আসছি।

[ সন্টু চলে যায়

ধ্রুব। সন্টুকে একটা কবিতা বলতে দিলে ভালো হয়। ওর কিন্তু অনেক কবিতা মুখস্থ। থ্রি-ফোরে যা পড়েছে, ভোলেনি।

[ সন্টু চেয়ার নিয়ে আসে ]

সন্টু। তোমাদের মায়েরা বলছিল আবার ঠিকমতো পৌঁছে দিয়ে যাস। আমি বললাম সে তোমাদের চিন্তা করতে হবেনি।

[ সন্টু চেয়ারগুলো রাখে। মেঝের দিকে তাকায় ]

সন্টু। জলের ছিটে দিয়ে আর একবার ঝাড়ু মেরে দিলে হয়। এখানে বালি কিচমিচ করছে। (ঝাড়ুটা তুলে নেয়) আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে। নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী শর্তে।

[ শ্রাবণী ঢোকে ]

শ্রাবণী। এই নে লুচি আর হালুয়া। তোরা সকাল থেকে খাটাখাটনি করছিস বলে মা পাঠিয়ে দিল। সবাই খেয়ে নে। অ্যাই সন্টু, আমার গানটা বেশ গেয়ে দিচ্ছিস।

সন্টু। তোমার গান নাকি? ইঃ, এটা তো রবীন্দ্রনাথের গান।

শ্রাবণী। কিন্তু এটা তো, আমি গাইব।

সন্টু। তা গাও না, কে মানা করেছে। গাইলে গান ক্ষয়ে যাবে নাকি?

ছোটন। ঠিকই তো, রবীন্দ্রনাথ সবার।

পাপুন। তোর গলাটা বেশ ভালো তো সন্টু, শিখলি কোথায়?

সন্টু। ওই দিদিমণির কাছে।

শ্রাবণী। ওমা! আমি আবার তোকে গান শেখালাম কবে?

সন্টু। হারমনি কাছে রেখে আমাকে বসিয়ে শেখাওনি, কিন্তু বলতে গেলে তুমিই শিখিয়েছ। তুমি যখন গান গাও, আমি বাসন মাজতে মাজতে শুনি।

ধ্রুব। তোকে বাসন মাজতে হয় কেনরে সন্তু, তোর মা নেই?

সন্টু। আমার মার জ্বর হলে আসতে পারে না তো, না এলে তোমাদের মায়েরা বকাবকি করে। তাই আমাকে পাঠিয়ে দেয়। তাইতেই তো তোমাদের গান শিখি, তোমাদের টি.ভি. দেখি, তোমাদের ফেলে দেওয়া খাবার দেখি। কত নষ্ট করো। পেলেটের মধ্যে পড়ে থাকে কত খাবার। ঝাড়ু দেবার সময় তোমাদের ছেঁড়া পাতা দেখি। কত পাতা নষ্ট কর তোমরা। কত সাদা সাদা কাগজ ঝাড়ু মেরে ফেলে দিই। একদিন একটা কবিতা পেয়েছিলাম- পূজার সাজ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

শ্রাবণী। ওটাতো আমার আগের ইস্কুলে ছিল। বেংগলি মিডিয়াম ছেড়ে ইংলিশ মিডিয়ামে ভরতি হলাম তো, ওই বইটা লাগল না।

সন্টু। ঘর মোছার জন্য যে গেঞ্জিটা দিয়েছে তোমার মা, আমার বাবার তত ভালো গেঞ্জি নেই।

ধ্রুব। তোর বাবা কী করে?

সন্টু। করত। বার্লিকলে কাজ করত। এখন কারখানা বন্ধ। ঘরে বসে থাকে। কোনো কোনো দিন ফুলুরি ভাজে।

ধ্রুব। তোর দাদা নেই?

সন্টু। আমার দাদার নাম ঝন্টু। মোটর গ্যারেজে কাজ করত। এ্যাকসিডেন হয়ে একটা আঙুল চিমসে গেছে। কেটে বাদ। এখন গাড়ি ধোয়।

ধ্রুব। আর কে আছে তোদের সংসারে?

সন্টু। বুড়ি ঠাকুরমা আছে। চোখে দেখে না। বকিয়ো না তো। অনেক কাজ।

[ ছোটন আর ধ্রুব কী যেন পরামর্শ করে ]

ছোটন। সন্টু, তুই অনেক খেটেছিস রে। তোকে কী দিই বল তো? এই নে দুটো বাবল গাম।

সন্টু। কী হবে আমার বাবল গামের ফটাস?

পাপুন। তবে এইনে ছটা পেপসির ছিপি। দোকানে দিলে স্ক্র্যাচকার্ড পাবি। অনেক অফার আছে। ওয়াক ম্যান, সেল ফোন, সি ডি প্লেয়ার…।

সন্টু। ওসব আমার কোন কাজে লাগবে? খাব, নাকি মাথায় দেব!

ধ্রুব। তা হলে স্টিকার নিবি? থ্রি ডাইমেনশনাল হলোগ্রাম।

সন্টু। উলটোপালটা কথা বলনি তো, আমাকে কাজ করতে দাও।

ধ্রুব। তাহলে কী দিই বল তো! আমাদের কাছে তো টাকা নেই এখন। মার কাছ থেকে চেয়ে এনে দিই, কিছু তো নিবি। আমাদের জন্য এত কাজ করলি।

সন্টু। তোমরা ইস্কুলে পড়া ছেলে, কী যে ভুলভাল বকো বুঝি না। এত আমাদের আমাদের করছ কেন? রবীন্দ্রনাথ কি শুধু তোমাদের নাকি? আমারও নয়? আমার বইয়েও তো তেনার কবিতা ছিল। নেহাত এখন পড়ছি না তাই। আমি তো এতক্ষণ রবীন্দ্রনাথের কাজই করলাম। তো কিছু দিতে চাইছ যখন, একটা জিনিস দেবে?

ছোটন, ধ্রুব। কী বল?

সন্টু। আমাকে একটা কবিতা বলতে দেবে?

ছোটন। সিওর সিওর।

ধ্রুব। নিশ্চই নিশ্চই।

চতুর্থ দৃশ্য

[ একটা মোটামুটি রকমের মঞ্চ। টেবিলে চাদর পাতা, রবীন্দ্রনাথের একটা ছবি। পাপুন, ছোটন, ধ্রুব, সবাই ভালো পোশাক পরেছে। ছোটনের হাতে একটা পাউডারের কৌটো ]

ছোটন। এবার আমাদের নিজেদের রবীন্দ্রজয়ন্তী স্টার্ট হচ্ছে। ফার্স্টেই সভাপতি বানানো হচ্ছে। সভাপতি হবে পাপুন।

[ দর্শকদের মধ্য থেকে একজন মহিলা উঠে দাঁড়ালেন ]

মহিলা। অ্যাই ছোটন, পাপুনের ভালো নামটা বল।

ছোটন। (জিভ কামড়ে) সরি। সভাপতি হচ্ছেন শ্রী ঋজুরেখা বসু। আজলা, তুমি সভাপতি বরণ করো।

[ ছোট্টমেয়ে আজলা একটা ট্রে নিয়ে আসে। ট্রে থেকে মালা নিয়ে পাপুনের গলায় পরিয়ে দেয়। হাততালির শব্দ ]

ছোটন। এবার সভাপতিরা যা করেন, পাপুন তাই করবেন।

পাপুন। আমাকে সভাপতি করা হয়েছে বলে আমি খুব আনন্দিত। যদিও আমি যোগ্য নই, সেজন্য দুঃখিত। রবীন্দ্রনাথ ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন আর ১৯৪১ সালে পরোলোক গমন করেন। এর মধ্যে যা যা করেছেন তা বলতে গেলে অনেক সময় লাগবে, তা ছাড়া রচনাটা মুখস্থ হয়নি। আমি আমার বক্তৃতা আর দীর্ঘ করতে চাই না। আমার বক্তব্য এখানেই শেষ করলাম।

[ হাততালি ]

ছোটন। এবার প্রধান অতিথি বানানো হচ্ছে। প্রধান অতিথি হচ্ছেন শ্রী ধ্রুব চক্রবর্তী।

[ আজলা মালা নিয়ে আসে। পরাতে গিয়ে মালা ছিঁড়ে যায় ]

আজলা। ভ্যা এ্যা- এ্যা…

[ দর্শকদের ভিতর থেকে আজলার মা দাঁড়ায় ]

আজলার মা। আমার মেয়ের কী দোষ। মাথা বড়ো মালা ছোটো।

ছোটন। ও কে। নো প্রবলেম। এবার আমাদের আসল ফাংশন শুরু হচ্ছে। প্রথমেই আবৃত্তি করে শোনাবেন আমি। শ্রী সৌম্যকান্তি মিত্র।

[ দর্শকদের মধ্য থেকে পল্লব দাঁড়িয়ে যায় ]

পল্লব। আগেই তড়িঘড়ি করে আবৃত্তি? প্রধান অতিথির বক্তৃতাটা কী হল?

ছোটন। সরি সরি। এখন প্রধান অতিথি শ্রী ধ্রুব চক্রবর্তী কী বলে… ভাষণ দেবেন।

[ ধ্রুব পকেট হাতড়াতে থাকে। দর্শকদের মধ্য থেকে একজন উঠে দাঁড়ায়। ধ্রুবর মা ]

ধ্রুবর মা। একদম কিচ্ছু মনে থাকে না তোর। এত কষ্ট করে লিখে দিলুম।

ধ্রুব। ঠিক আছে। ঘাবড়িয়ো না। আমি আমার রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজদের কায়দায় বলে দিচ্ছি। (চোখ বুজে হাতে একটা আশীর্বাদের মুদ্রা তৈরি করে) তোমরা এই মহতী উৎসবের আয়োজন করেছ বলে আমরা খুব প্রীত হয়েছি। প্রার্থনা করি তোমরা সুখে থাকো। আনন্দে থাকো। ওঁ শান্তি।

[ হাততালি ]

ছোটন। এবার আবৃত্তি পরিবেশন করবেন শ্রী সৌম্যকান্তি মিত্র। (ছোটন আবৃত্তি শুরু করে।)

ফাল্গুনে বিকশিত কাঞ্চন ফুল-

(এবার আবৃত্তি শেষ হলে কাগজ দেখে বলে) এবার নৃত্যানুষ্ঠান পরিবেশনায় শ্রাবণী পাল।

[ শ্রাবণীর নাচের সঙ্গে ক্যাসেট বেজে ওঠে- পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে…

দর্শকদের মধ্য থেকে ছোটনের মা বলে ওঠে, এই বৈশাখের পচা গরমে পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে।

প্রথম সারি থেকে শ্রাবণীর মা দাঁড়িয়ে বলে, যখন বৈশাখের গরমে ছোটন ফাল্গুনে বিকশিত কাঞ্চন ফুল করল? ]

ছোটন। বড়োরা গোলমাল করবেন না। গোলমাল করলে আমাদের পক্ষে অনুষ্ঠান চালাতে অসুবিধে হচ্ছে। ফ্ল্যাটের পুরোনো ঝগড়া এখানে নয়…। (নাচ শেষ হলে ছোটন বলে) এবার আবৃত্তি করে শোনাবেন আমাদের সবার পরিচিত সন্টু। অ্যাই সন্টু, তোর পুরো নামটা কি?

সন্টু। (মঞ্চের বাইরে থেকে) ইস্কুলের খাতায় ছিল সনৎ মণ্ডল।

ছোটন। সনৎ মণ্ডল, তুমি এসে আবৃত্তি শুরু করো।

[ দর্শকদের মধ্য থেকে কেউ কেউ বলে ওমা! সন্টুও … ]

সন্টু। প্রণাম হই।

কবিতার নাম পূজার সাজ-

আশ্বিনের মাঝামাঝি উঠিল বাজনা বাজি-

পূজার সময় এল কাছে

মন্টু সন্টু দুই ভাই ছুটাছুটি করে তাই-

আনন্দে দু-হাত তুলে নাচে।

[ দর্শকদের মধ্য থেকে পাপুনের মা উঠে দাঁড়ায় ]

পাপুনের মা। অ্যাই সন্টু। কী হচ্ছে। ওটা মন্টু সন্টু নয়, মধু বিধু হবে।

সন্টু। (ভ্রূক্ষেপ না করে)

পিতা বসি ছিল দ্বারে দুজনে শুধাল তারে

কী পোশাক আনিয়াছ কিনে?

পিতা কহে আছে আছে তোদের মায়ের কাছে

দেখিতে পাইবি ঠিক দিনে।

সবুর সহে না আর জননীরে বারবার

কহে, মাগো ধরি তোর পায়ে

বাবা আমাদের তরে কী কিনে এনেছে ঘরে

একবার দে না মা দেখায়ে।

ব্যস্ত দেখি হাসিয়া মা দুখানি সিন্থেটিক জামা

দেখাইল করিয়া আদর।

সন্টু কহে আর নেই? মা কহিল আছে এই-

হাফ প্যান্ট মোটা খদ্দর।

রাগিয়া আগুন ছেলে ওই জামা ধুলায় ফেলে

কাঁদিয়া কহিল, চাহি না মা

ফ্ল্যাট বাড়ির সব ছেলে কতরকম জিনস পেলে

ঋত্বিক রোশন মার্কা জামা-

[ দর্শকদের মধ্যে গুঞ্জন ]

মা কহিল, সন্টু ছি ছি কেন কাঁদ মিছামিছি

গরিব যে তোমাদের বাপ

বার্লিকল লক আউট আছে কতদিন উপোস গেছে

পেয়েছেন কত দুঃখ তাপ।

পল্লব। অ্যাই। কী হচ্ছেটা কী। কার কবিতা পড়ছিস!

সন্টু। রবীন্দ্রনাথ আর আমার মেশানো।

জনৈক। ছিঃ। রবীন্দ্রনাথের কবিতা বিকৃত হচ্ছে?

জনৈক। ওকে ধরে নামিয়ে দাও।

পল্লব। এই যে সভাপতিমশাই। থামিয়ে দিন।

জনৈক। থামিয়ে দিন থামিয়ে দিন।

পাপুন। আমাদের অনুষ্ঠান এখানেই শেষ হল।

[ পরদা পড়ে যায়। কিন্তু পরদার বাইরে তখন ধ্রুব, ছোটন, পাপুন আর সন্টু চলে এসেছে। সন্টু রাগ রাগ মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে ]

ছোটন। তোর কবিতাটাই বেস্ট হয়েছে রে সন্টু। কবিতার জন্য প্রাইজটা আমারই পাবার কথা ছিল। ওটা গট আপ প্রাইজ। ওটা আর আমি নিচ্ছি না রে। তুই নে।

সন্টু। আমি কেন নেব। আমাকে তো বলতেই দিলে না।

পাপুন। সরি সন্টু। আমার অন্যায় হয়ে গেছে। আমি ঠিকমতো সভাপতি হতে পারিনি। তোর কবিতাটাই সবচেয়ে ভালো হয়েছে। আমি সভাপতি। দেখ গলায় এখনও ফুলের মালা। তুই প্রাইজটা নে।

ধ্রুব। আমি প্রধান অতিথি। আমিও বলছি তোর কবিতাটাই সবচেয়ে ভালো, প্রাইজটা নে।

[ ধ্রুব প্রাইজটা দেয় ]

সন্টু। (বইটা দেখে) এই বই নিয়ে আমি কী করব। কীসব টিনটিন, আরচি…

ছোটন। হ্যাঁ, হ্যাঁ… কমিকস…

সন্টু। এসব আমার ভালো লাগে না। এসব আমি বুঝি না। এসব তোমাদের জন্য।

ধ্রুব। তাহলে কী পুরস্কার চাস তুই বল…

সন্টু। যা চাইব দেবে?

ছোটন। সিওর সিওর।

সন্টু। আমাকে একটু পড়িয়ে শুনিয়ে মানুষ করে দাও না। যেন তোমাদের ওই আরচি, টিনটিন বুঝতে পারি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতাও ঠিকমতো বুঝতে পারি। ইংরিজি সাইনবোর্ড পড়তে ইচ্ছা যায় ছোটনদাদা, চিঠির ঠিকানা লিখতে ইচ্ছা যায়। পড়াবে?

ছোটন। রোজ পড়াব। পালা করে। এই ছাতে। আসবি তুই?

ধ্রুব। ইশ। আমি কী করব তাহলে? আমাকে তো হোস্টেলে ফিরে যেতে হবে।

সন্টু। সেই হোস্টেলেও দেখবে আরেকটা কোনো সন্টু আছে। পড়া ফেলে কাজ করে।

পাপুন। তাহলে কাল থেকেই। রোজ বিকেলে।

ছোটন। আমাদের রোজই রবীন্দ্রজয়ন্তী হবে। রোজ।

[ সন্টুকে মাঝখানে রেখে ওরা তিনজন দাঁড়িয়ে থাকে ]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *