জাম্বো – মোহিত চট্টোপাধ্যায়

জাম্বো – মোহিত চট্টোপাধ্যায়

আনন্দবাবু মধ্যবয়সি ব্যক্তি

জাম্বো আনন্দবাবুর ছেলে। বয়স ১০

নিশি যুবক

নিশি যুবক

মাখন যুবক

রামলোচন পাহারাদার

ভজুদা কাজের লোক

প্রথম দৃশ্য

[সকাল। জায়গাটা গাছতলা। অদূরে খেলার মাঠ। গাছতলায় গাছের গোড়া ঘেঁষে অর্ধবৃত্তাকার বাঁধানো বসবার জায়গা। স্থানটি জনবিরল। এখানে মধ্যবয়সি আনন্দবাবু আর তার বছর দশের ছেলে জাম্বোর সঙ্গে প্রায় একটা যুদ্ধ চলছে। ছেলেটির কদমছাট চুল, গাবদা-গোবদা বলবান কঠিন গঠন, সাজপোশাকে হাল-ফ্যাশানের ছাপ। দুটি যুবক নিশি আর মাখন-এখানে এসে পিতা-পুত্রের লড়াইটা দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে। দুজনের পিঠে ব্যাগ, নিশির হাতে একটা মাইক ও রেকর্ডার। আনন্দবাবু ছেলের হাত ধরে টেনে ছেলেকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাইছেন, ছেলে যাবে না, আরও খেলবে- এই নিয়ে টানাটানি]

জাম্বো। ছাড়ো না! বলছি তো, আর একটু খেলে নিয়ে বাড়ি যাব!

আনন্দ। আরও খেলবে! স্কুল যাবে কখন? বাড়ি চলো!

জাম্বো। একটু পরে গেলে কী হয়েছে!

আনন্দ। একটা কথা নয়, সোজা বাড়ি চলো! দিনরাত্তির টি.ভি. দেখা, খেলে বেড়ানো-পেয়েছিস কী! সব নিজের ইচ্ছে মতো! এই বয়সেই লায়েক হয়ে উঠেছ!

জাম্বো। ওরা তো খেলছে এখনও-ছাড়ো না ড্যাডি!

আনন্দ। যেমন তুই, তেমনি তোর ওই সাকরেদগুলো! তোরা উচ্ছন্নে যেতে চলেছিস!

জাম্বো। ছাড়ো, নইলে এবার হাত ছাড়িয়ে পালাব কিন্তু।

আনন্দ। পালাবি? খুব পালোয়ান হয়েছিস! পালাবার চেষ্টা করে দেখ দেখি-হাত মুচড়ে ভেঙে দেব! পালাবে।

জাম্বো। পালাতে পারব না? পারবে? পারবে আমার সঙ্গে? তো হো যাইয়ে তৈয়ার, দেখো চমৎকার! …অব মুঝে কোই নহি রোখ সকতা!

[জাম্বো হাত ছাড়িয়ে নেবার জন্য প্রবল চেষ্টা করতে থাকে]

আনন্দ। খুব তেজ! তোর কত তেজ আজ আমি দেখব!

জাম্বো। মোগাম্বোকো পকড়না ইতনা আসান নহি হ্যায়!

আনন্দ। মোগাম্বো! তুই কত বড়ো মোগাম্বো আমি দেখছি!

[হাত ছাড়াবার প্রাণপণ চেষ্টা করে জাম্বো। একসময় হাত ছাড়িয়ে ছিটকে দূরে গিয়ে বিজয়ীর ভঙ্গিতে জাম্বো বলে]

জাম্বো। দেখা মেরা পাওয়ার! হম কিসিসে কম নহিঁ! ড্যাডি-ইউ কান্ট বিট এ জাম্বো জেট! (শূন্যে হাত তুলে) আই হ্যাভ দি পাওয়ার! গিভ মি দি ওয়ে।

[বলতে বলতে খেলার মাঠের দিকে জাম্বো ছুটে অদৃশ্য হয়। ক্লান্ত আনন্দবাবু হতাশ দৃষ্টিতে জাম্বোর গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। মাখন আর নিশি এগিয়ে আসে]

নিশি। আপনি আনন্দবাবু তো?

আনন্দ। (তাকায়) আমাকে কিছু বলছেন?

নিশি। আপনি আনন্দবাবু তো?

আনন্দ। আনন্দবাবু! কে আনন্দবাবু! আমার এ-নামটা ভুলে যেতে চাইছি মশাই। আনন্দ আমার দেখছেন কোথায়? একটি মাত্র ছেলে, সেটি গোল্লায় গেলে রইল কী! সব থেকেও আমি ডাহা ফেল হয়ে গেছি ভাই। আমার ডাক নাম ফেলু। ওই নামটিই যথার্থ। আনন্দবাবু? -সে আর নেইকো! বলুন, ফেলুবাবু।

মাখন। ফেলুবাবু?

আনন্দ। বলুন। উঃ! (গাছতলাটায় গিয়ে ক্লান্তভাবে বসেন আনন্দবাবু)

নিশি। আপনার বাড়ি গিয়েছিলাম। সেখান থেকে খবর পেয়ে এখানে এলাম।

আনন্দ। মানে, এই রণক্ষেত্রে এলেন! বাপ-ব্যাটার যুদ্ধটি কেমন দেখলেন? এখানেও আমি ফেলুবাবু! ছেলে বাজিমাত করে হিন্দি বাত কপচে উধাও! এই ছেলে নিয়ে জেরবার হয়ে গেলুম মশাই।

[নিশি মাইকটা নিয়ে আনন্দবাবুর দিকে একটু এগোয়]

নিশি। আমরা আপনার একটা সাক্ষাৎকার নেব বলে এসেছিলাম।

আনন্দ। সাক্ষাৎকার! আমার? আমি কে? ক্ষুদ্রস্য ক্ষুদ্র এই ফেলুর সাক্ষাৎকার? হাসাবেন না, ভাই। আমাদের এই পল্লির স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির একটা মিটিং রয়েছে- আমাকে এক্ষুনি যেতে হচ্ছে।

[আনন্দবাবু ওঠেন]

মাখন। আপনি তো আবার ম্যানেজিং কমিটির প্রেসিডেন্ট, যেতে তো আপনাকে হবেই।

আনন্দ। আপনারা তো এ-তল্লাটের লোক নন, কিন্তু অনেক খবরই রাখেন দেখছি।

মাখন। আপনি নিজেকে ক্ষুদ্রস্য ক্ষুদ্র বলছেন-কিন্তু ওটা আপনার বিনয়। এলাকার অনেকের মুখেই শুনেছি-বিত্তে, সম্মানে আপনার তুল্য এখানে আর কেউ নেই।

আনন্দ। বিত্ত? বাপের কাছে ছেলের চেয়ে কি বিত্ত বড়ো? মশাই, ছেলে আউট অফ কন্ট্রোল-আনম্যানেজিবল! এদিকে আমি ম্যানেজিং কমিটির প্রেসিডেন্ট! ভগবান কীভাবে আমার কান মুলে দিচ্ছে ভাবুন! আপনারা আমার সাক্ষাৎকার চাইছেন, আমি তো স্বয়ং ভগবানের কাছে একটা সাক্ষাৎকার চাইছি। হাজার প্রশ্ন জমে আছে। আচ্ছা ভাই, অনেক বকলাম,-কিছু মনে করবেন না, আসি!

[ব্যস্তভাবে আনন্দবাবু কয়েক পা এগিয়ে ফিরে আসেন]

আনন্দ। মাফ করবেন, আপনাদের পরিচয়টা নেওয়া হল না-সাক্ষাৎকারই বা কেন?

নিশি। আমরা একটা সমীক্ষা করছি। এজন্য নানা জায়গায় ঘুরতে হচ্ছে। এই শহরতলিতে আজ আপনাদের পাড়ায় এসেছি। কয়েকটা বাড়িতে গেছি, তাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছি।

আনন্দ। সমীক্ষাটা কী নিয়ে?

মাখন। আজকের এনটারটেনিং মিডিয়া নিয়ে আর কি-এই টি. ভি., সিনেমা, রেডিয়ো, ইন্টারনেট… ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের ওপর এর প্রভাব… অভিভাবকদের মতামত, এই নিয়ে কিছু প্রশ্ন রাখছি, উত্তর রেকর্ড করা হচ্ছে।

নিশি। এ পাড়ায় এসে শুনলাম, আপনার ছেলেটি-

আনন্দ। ঠিকই শুনেছেন। এতক্ষণ তো এজন্যই কপাল চাপড়াচ্ছিলাম। এই মিডিয়া ভাইরাসেই তো আমার ছেলেটি ধসে গেছে। কী ভাইরাস যে ঘরে ঘরে ঢুকে পড়ছে!

নিশি। (মাইকটা বাড়িয়ে) আপনি বলতে চান, এনটারটেনিং মিডিয়া ভাইরাস ছড়াচ্ছে?

মাখন। মিডিয়ার ভালো-মন্দ দুটো দিকই থাকে।

আনন্দ। থাকে। আমি তা মানি। আমাদের পাড়ায় অনেক ছেলে-মেয়ে আছে, মনে হয়-তারা তেমনভাবে ভাইরাসের পাল্লায় পড়েনি। কিন্তু কেউ কেউ ভাইরাসে অ্যাট্রাক্ট হচ্ছেও তো? যেমন আমার গুণধর সন্তানটি। কাগজপত্র তো পড়েন-ছোটো ছেলে-মেয়েদের ওপর এসব ভাইরাসের ক্রিয়া যে কতরকমভাবে হচ্ছে, সেসব দেখছেন নিশ্চয়ই।

নিশি। এ ব্যাপারে মিডিয়ার দায়িত্ব, সরকারের দায়িত্ব, অভিভাবকদের কর্তব্য সেসব নিয়েই চিন্তা-ভাবনা করার জন্যেই আমাদের এই সমীক্ষা। পথ একটা বেরুবে।

আনন্দ। এ রোগের মলম কবে বেরুবে জানি না! ইতিমধ্যে আমার কপাল পুড়ে তো ঘা হয়ে গেল! আমার ছেলে জাম্বো তো পারলে টি.ভি.-র বাকসোটার মধ্যে ঢুকে যেতে পারলেই মহাখুশি। দিনরাত যন্তরটা আঁকড়ে ধরে আছে-ওখান থেকেই বুলি শিখছে, মগজে মশলা ভরছে, চলন-ধরন শিখছে। যন্ত্রটাকে বিদেয় করাও অসম্ভব। দুনিয়া রসাতল করবে। একবার চেষ্টা করেছিলাম-আত্মহত্যার ছক কষেছিল ছেলে, তার কায়দাটাও নাকি সিরিয়াল দেখে শিখেছে। জাম্বোর একটি সমবয়সি সাকরেদ ফিল্মস্টার হবার জন্য মুম্বাই পালিয়েছিল। ইনিও তালে আছেন। মাকে নাকি বলে, মুম্বাই গিয়ে অ্যাক্টর হবে।

মাখন। সত্যি সত্যি কি আর পালাবে?

আনন্দ। কী জানি! এক ধরনের নেশা ভর করেছে তো? নেশার ঘোরে কে কী না করে। আর জাম্বোর নেশা কি একটা! মাঝেমধ্যেই দেখবেন বোতল নিয়ে বসেছে।

নিশি। বোতল?

আনন্দ। হ্যাঁ, যদি আমি বলি, লুকিয়ে-চুরিয়ে চলছে।

মাখন। এইটুকু বয়সে বোতল ধরেছে?

আনন্দ। মদের বোতল নয়-কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতল। চোঁ-চোঁ করে গিলছে আর ছিপিটি থলেয় পুরছে। আর বিস্কুট? বিস্কুটে তো ঘর ভরে গেল। ওইসব ছিপি, প্যাকেটে কীসব নম্বর থাকে। ঠিক নম্বরে এসে গেলে আর কথা নেই- বিস্কুট চিবিয়ে লন্ডন যাবে, ছিপি নাকি লাখপতি বানিয়ে দেবে। ঘুমের ঘোরে বিড়বিড় করে বলে-মেরা নম্বর কব আয়েগা? এই তো পুজো আসছে-ছোটো পরদার ফর্দ মিলিয়ে বায়না ধরেছে, আদিদাসের টি-সার্ট, নাইকির জুতো, রেব্যানের সানগ্লাস, গুচি না কার জিনস আর পকেটে রাখার খুশবুওয়ালা পেন। এসব আবদার চলবে না শুনলেই, ফোঁপাচ্ছে!

নিশি। না, আপনার ছেলেকে ভাইরাসে ভালোভাবেই ধরেছে, দেখছি।

আনন্দ। কিন্তু সব কিছুর ওপরে ওর ওই মুম্বাই যাবার নেশা। অ্যাক্টর হবে, অ্যাকসন হিরো হবে। কবে যে পালায় সেই ভয়ে অস্থির হয়ে থাকি। যেমনই হোক, একটিমাত্র ছেলে তো, ওটিই তো আমার বুকের পাঁজর। এত রকম স্বপ্নের ভূত ওর ঘাড়ে চেপে আছে-কোন ওঝা তা তাড়াবে! ছোটোরা আগে নিজেদের স্বপ্ন গড়ে নিত, বড়ো কিছু হবার স্বপ্ন। ওরা এখন মিডিয়া থেকে স্বপ্ন কেনে, স্বপ্ন বেছে নেয়। না, ভাই-দেরি করে ফেলেছি, মিটিংয়ে যেতে হবে। আসি।

মাখন। অনেক দরকারি কথা পেলাম আপনার কাছ থেকে, ধন্যবাদ।

আনন্দ। ধন্যবাদ।

[আনন্দবাবু দ্রুত চলে যান]

[নিশি আর মাখন গাছ তলায় গিয়ে বসে। পিঠের ব্যাগ নামায়। মাইকটা জায়গামতো রাখতে রাখতে নিশি বলে]

নিশি। মাখন?

মাখন। বল।

নিশি। কেমন বুঝছিস?

মাখন। আনন্দবাবু বড্ড ভেঙে পড়েছেন।

নিশি। তোর মাথায় কী রে মাখন? আমি কি ওইসব নিয়ে ভাবছি? সমীক্ষার ভাঁওতাটা বেশ কাজ দিয়েছে, কী বল?

মাখন। হ্যাঁ। খবরাখবর পেতে খুব সুবিধে হয়েছে। এ তল্লাটে আমরা অচেনা লোক-কেউ সন্দেহের চোখেও দেখছে না। মাথা খাটিয়ে প্ল্যানটা বেশ বের করেছি।

নিশি। তাহলে আমার প্ল্যানটার তারিফ করছিস? ফেলুবাবু পার্টিটি শাঁসালো। তার ওপর ওই যে বললেন না-ছেলেটি ওর বুকের পাঁজর, তাই মনে হচ্ছে ওর ট্যাঁক থেকে এক লাখ টাকা খসানো খুব শক্ত কাজ হবে না।

মাখন। ওই তো ছেলে-তবু ছেলের ব্যাপারে খুবই নরম। ও টাকা দিয়ে দেবে।

নিশি। ভাবছি দু-লাখ চাইব কি না?

মাখন। গাছে কাঁঠাল, গোঁফে তেল। যেন, ছেলেটাকে কিডন্যাপ করে ফেলেছিস!

নিশি। আরে তুড়ি বাজিয়ে ‘কেস’ হাসিল করে ফেলব। ছেলেটা কী করছে দেখ।

মাখন। (একটু এগিয়ে দূরে তাকায়) খেলছে।

নিশি। এ পথেই ওকে ফিরতে হবে।

মাখন। সঙ্গে যদি বন্ধু-টন্ধু কেউ থাকে?

নিশি। থাকতেই পারে।

মাখন। তখন?

নিশি। ঘাড়ের উপর এই মাথাটি আছে কী জন্য? এটি খাটাব। যে জাল ফেলতে জানে, সে জাল টেনে তুলতেও জানে। মাছ ঠিক আমি ডাঙায় তুলে ছাড়ব। দেখে নিস। তবে মাথায় খালি একটা ভাবনা ঘুরছে-এক লাখের বদলে দু-লাখ চাইব কি না? লোকে বলছিল না, লাখ টাকা ফেলুর হাতের ময়লা।

মাখন। লোভ বাড়াস না, নিশি।

নিশি। বলছিস?

মাখন। প্রথম কাজ আমাদের, বলতে পারিস হাতে খড়ি। গোড়ায় যখন এক লাখ ভেবেছি, তাই থাক।

নিশি। তুই যখন বলছিস, তাই হবে। হ্যাঁ, লোভ বাড়াব না। লাখ খানেক টাকা আমাদের মতো বেকার ছেলের কাছে কম কী? দুজনে ওই ক্যাপিটাল নিয়ে ছোটোখাটো একটা বিজনেস স্টার্ট করে দেব, দিনরাত খাটব-এক সময় ঠিক দাঁড়িয়ে যাব।

মাখন। কিন্তু অসৎ পথের অর্থ-ফল দেবে?

নিশি। ওসব ফালতু কথা বলবি না তো! আর কোনো বাঁচার পথ আছে তোর? ধম্মকথার কাঁথায় আগুন! ওই ফেলুর এক লাখ টাকা খসলে সে না খেয়ে মরবে? আমরা তো মরতে বসেছি। ওর কাছে এই কটা টাকা কিচ্ছু না। তা ছাড়া ওর ছেলের ওপরও আমরা কোনো টরচার করব না-বিবেক-বুদ্ধি তো পুরোপুরি জলাঞ্জলি দেবার ছেলে নই আমরা।

[মাখন ব্যাগ থেকে বের করে একটা ওষুধ খায়]

নিশি। কী হল-ওষুধ খাচ্ছিস?

মাখন। আজ পূর্ণিমা তো।

নিশি। পূর্ণিমা? তাতে কী হয়েছে?

মাখন। পূর্ণিমা-অমাবস্যায় আমার ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমাটা একটু বেগ দেয়।

নিশি। দিচ্ছে?

মাখন। দেয়নি। প্রিকশন আর কি।

নিশি। না, টাকাটা পেয়েই আগে তোর একটা ভালো ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করব। শোন, ফেলুর কাছে দেড় লাখ চাইব। তোর ট্রিটমেন্টটা ওর টাকায় হবে। ছেলের আবদারের পিছনে যে অত টাকা নর্দমায় ঢালছে, তার টাকার কিছুটা সদ্ব্যয় হোক। তাহলে এক লাখ আর তোর চিকিৎসা বাবদ বাড়তি পঞ্চাশ হাজার চাইছি।

মাখন। পঞ্চাশ হাজার টাকার চিকিৎসা! আমার জন্যে? এ চিকিৎসা আমাকে মানায়? তুই বাড়তি এক নে। ওতেই যা চিকিৎসা হয়, হবে।

নিশি। এক হাজার?

মাখন। হ্যাঁ।

নিশি। তুই কী রে মাখন! না পেয়ে পেয়ে তোর চাওয়াটাই এইটুকু হয়ে গেছে। রাবিশ! তা ছাড়া আজকাল একটা কিডন্যাপিং কেসে র্যানসমের রেট কত জানিস? পঞ্চাশ লাখ দিয়ে শুরু হয়, ফেলুর কপাল ভালো, আমরা এক-দেড় চাইছি। যাস্ট, এই বেকার জীবনটা থেকে কোনোমতে একটু বাঁচার চেষ্টায়। অতি লোভে একগাদা টাকা চেয়ে লোকটাকে পথে বসাতেও চাইছি না।

[মাখন পকেট থেকে একটা ছোটো কৌটো বের করে। কৌটোর ভিতর একটা শুকনো জবা ফুল। নিশি লক্ষ করে ব্যাপারটা। মাখন ফুলটা নিজের মাথায় ঠেকিয়ে নিশির কাছে আসে। নিশি বিরক্ত]

মাখন। নে, এটা মাথায় ঠেকা। মায়ের প্রসাদি ফুল।

নিশি। জ্বালাসনে তো! ওসবে আমার ভক্তি নেই!

মাখন। আমাদের প্রথম কাজ!

নিশি। তুই তো মাথায় ঠেকিয়েছিস, ব্যস-ওতেই যা হবার হবে। এবার ছেলেটাকে তুলতে পারলেই প্ল্যানমতো কাজটা এগোয়। ব্যাটা এখনও খেলছে?

[মাখন মাঠের দিকে তাকায়, কেমন চিন্তিত মাখন]

মাখন। নিশি!

নিশি। কী রে?

মাখন। মাঠ ফাঁকা, কাউকে দেখছি না।

মাখন। এদিক-ওদিক কোথাও গেছে। আরে ওর বাড়ি ফেরার তো এটাই পথ-বাছাধনকে ফিরতে তো হবে। ধৈর্য হারালে চলবে কেন? লক্ষ করেছিস-এ জায়গাটা বেশ নিরিবিলি। একজনও কেউ এতক্ষণ এখান থেকে পাস করল না।

মাখন। ফুলটা মাথায় ঠেকালে ভালো করতিস।

নিশি। ধ্যাত! ওরে ছাগল, ফুল ঠেকিয়ে কী হবে? ভগবান এসব কাজে তোকে হেল্প করবে? তাহলে ভগবান আর ভগবান থাকে? বল থাকে? (মাখন চুপ) ভগবান অ্যান্টি-সোসাল অ্যাক্টিভিটিজকে মদত দেবে? ওই ফুল মাথায় ঠেকিয়ে তুই ভুল করেছিস। তোর এর জন্য কী পেনাল্টি হয় দেখ। কিডন্যাপিংয়ের অপকম্মে কেউ ভগবানকে পার্টনার করে?

মাখন। এসব কথা আগে সমঝে দিবি তো! এখন কী হবে? আমি তো ফুল কপালে ঠেকিয়ে ফেলেছি।

নিশি। ফোনটা দে। নন্তুর সঙ্গে একটু কথা বলি। বেচারা একা-একা বসে আছে।

[মাখন ব্যাগ থেকে সেল ফোনটা নিশিকে দেয়। নিশি ডায়াল ডাকে]

নিশি। (ফোনে) হ্যালো,…নন্তু, শোন-গাড়িটা এই মাঠের ধারের রাস্তাটার কাছে এনে রাখ… হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঝোপটার কাছাকাছি। ফাঁকা মতো আছে না, জায়গাটা? …আরে, এ মাথাটা অত কাঁচা নয়, সব কিছু আগেভাগে সার্ভে করে, প্ল্যানটা ছকে নিয়ে স্টেপ বাই স্টেপ পা ফেলছি। …হ্যাঁরে, কেস ভেরি ভেরি হোপফুল। একটু বাদেই ছেলেটাকে তুলে ফেলব। …চা খাবি? কাছে দোকান আছে? …বুঝতে পারছি, একা-একা বোরড হচ্ছিস খুব। তবে চটপট চা-টা খেয়েই গাড়ির কাছে চলে আসিস। …আচ্ছা…আচ্ছা…ওকে। …ক্যাশ টাকা? আমার সঙ্গে হাজার খানেক আছে। তোর কাছে যা আছে, তা মিলিয়ে …পরে দরকার হলে দেখা যাবেখন। (হাসে) মাখনটার কথা আর বলিস না…প্রসাদি ফুল মাথায় ঠেকাচ্ছে, আর অ্যাজমার ওষুধ খাচ্ছে… (হাসে) হেপোরোগীকে কিডন্যাপিংয়ের পার্টনার করেছি, সব না গুবলেট হয়ে যায়। ঠিক আছে… হ্যাঁ, রাখছি… চা খেয়ে ঝটপট গাড়ির কাছে চলে আসিস। আর মাখনের সঙ্গে কথা বলতে হবে না। রাখছি-

[ফোনটা মাখনকে ফেরত না দিয়ে নিশি তার পকেটে রাখে। মাখন তার মুখ হাঁ করে ইনহেলার থেরাপির যন্ত্রটা পাম্প করে]

নিশি। কী হল?

মাখন। নিশ্বাসটা…

নিশি। বল না!

মাখন। নারে, তেমন কিছু না- প্রিকশন নিয়ে রাখলাম।

নিশি। তুই দেখছি ডোবাবি। একটার পর একটা প্রিকশন চলছে। নার্ভাস লাগছে? ঝেড়ে কাশ না!

মাখন। আমি ঠিক আছি।

নিশি। তাই থাক ভাই। তীরে এসে তরি ডোবাস না!

মাখন। ছেলেটা বেয়াড়া টাইপের, ট্যাকল করা কিন্তু সোজা হবে না!

নিশি। আমাকে ফেলুবাবু পেয়েছিস? একবার ধরলে কচ্ছপের কামড়। একটু বেগড়বাই করলে এমন কোঁতকা দেব, টাইট হয়ে যাবে!

মাখন। চ্যাঁচায় যদি?

নিশি। সে আমার ভাবা আছে। চ্যাঁচাবার সুযোগই দেব না। আমি একথা-সেকথায় জাম্বোকে ভুলিয়ে রাখব। এক সময় একটা তুড়ি বাজাব। ওটা সিগন্যাল। তুই ওর পিছনে চলে যাবি।

মাখন। (নার্ভাস গলায়) আমি?

নিশি। (শক্ত গলায়) হ্যাঁ, তুই। তুই পিছন থেকে যাস্ট ওর মুখটা চেপে ধরবি। আমি সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে ওকে পাকড়ে ফেলব। এর বেশি তোকে কিছু করতে হবে না। তারপর চ্যাংদোলা করে ওকে গাড়িতে তুলব।

মাখন। ওর গায়ে জোর আছে, ওর মুখ চাপা দিয়ে কতক্ষণ রাখতে পারব কে জানে?

নিশি। কতক্ষণ আবার রাখবি? আমি তো তৎক্ষণাৎ গিয়ে ওর মুখের মধ্যে রুমাল গুঁজে দেব।

মাখন। আমাদের সঙ্গে ক্লোরোফর্ম রাখা উচিত ছিল। একটু দুবলা আছি তো-তেমন গায়ের জোর ফলাতে হত না।

নিশি। ওসব এখন ভেবে লাভ নেই। তোর নার্ভাস লাগছে কি না বল?

মাখন। কোনোদিন এসব করিনি তো।

নিশি। আমিই কি করেছি?

মাখন। প্রথম কাজ-একেবারে আনাড়ি আমরা, তা ছাড়া দুজনেই ব্রাহ্মণের ছেলে হয়ে-

নিশি। ব্রাহ্মণের ছেলে বলে কী? তোর এতরকম ভ্যানতাড়া তাহলে একাজে রাজি হলি কেন? ব্রাহ্মণের ছেলে! পৈতের জোরে অ্যাজমা ছাড়া তো জীবনে কিছু পাওনি! একটা দিন পৈতে চুষে দেখো না, পেট ভরে কি না?

মাখন। রাগ করছিস কেন? আমি তো একাজ পারব না বলিনি। কী প্রবলেম রয়েছে, তাই বলছিলাম।

নিশি। এসব কাজে প্রবলেম থাকবেই, তা সলভ করতে হবে-মনের জোরে, বুদ্ধি খাটিয়ে সলভ করতে হবে।

মাখন। বটেই তো।

নিশি। (ভেংচে) বটেই তো! ন্যাকা! ন্যাদোস একটি! (মাঠের দিকে চোখ পড়ে) জাম্বো আসছে! গেট রেডি।

মাখন। (সেদিকে তাকিয়ে) একাই আসছে। সুবিধে হল।

নিশি। কায়দা করে আটকাতে হবে ওকে। মনে আছে তো? তুড়ি বাজালে ওর পিছনে চলে যাবি, তারপর মুখটা চেপে ধরবি।

মাখন। সব মাথায় আছে।

[জাম্বো আসে। ওদের দেখে দাঁড়ায়]

নিশি। জাম্বো, বাড়ি চললে?

জাম্বো। বন্ধুরা চলে গেল যে, একা একা কী খেলব!

নিশি। তার মানে, আরও খেলতে মন চাইছিল?

জাম্বো। হ্যাঁ গো-দিল মাঙ্গে মোর… ড্যাডির সঙ্গে আমার ফাইট হচ্ছিল এখানে, তখন তোমাদের দেখেছি। এতক্ষণ কী করছ এখানে?

নিশি। একটা কাজে বেরিয়েছিলাম… অনেক ঘুরতে হয়েছে, একটু রেস্ট করছি। কী খেলছিলে তোমরা?

জাম্বো। হি-ম্যান খেলছিলাম। হিম্যান কে জানো?

নিশি। হি-ম্যানকে কে না জানে? হি-ম্যান, সুপারম্যান-

জাম্বো। অ্যাকোয়া ম্যান, এক্সম্যান, আয়রনম্যান, চেঞ্জিংম্যান, স্পাইডারম্যান, ব্যাটম্যান-

মাখন। সেলসম্যান।

জাম্বো। (হেসে উঠে) সেলসম্যান তো আলাদা! এ কিচ্ছু জানে না।

মাখন। জানি-মজা করে বলেছি। স্কেলেটরের সঙ্গে হি-ম্যানের ফাইট হয়, কি তাই না?

জাম্বো। (মাখনকে) জানে।

মাখন। হি-ম্যান তো আমার হিরো।

জাম্বো। আমার হিরো ব্যাটম্যান। মঁ্যয় হুঁ রাতকা রাখোয়ালা ব্যাটম্যান। কখনো আবার হি-ম্যান হয়ে যাই, সুপারম্যানও হই।

[নিশি তুড়ি বাজিয়ে ‘সিগন্যাল’ দেয়। মাখনের মুখে নার্ভাস ভাব ফুটে ওঠে। ইনহেলার থেরাপির যন্ত্রটা বের করে হাঁ-করে স্প্রে করে। জাম্বো লক্ষ করে]

জাম্বো। ও কী খাচ্ছে?

নিশি। একটা ওষুধ, ওটা খেলেই ওর তাকত বেড়ে যায়-পালোয়ান হয়ে ওঠে।

জাম্বো। আচ্ছা! তুমি কার্টুন নেটওয়ার্কে পপাই শো দেখেছ?

নিশি। না।

জাম্বো। পপাই হচ্ছে একজন সেলর-জাহাজের নাবিক। মাথায় হ্যাট, মুখে পাইপ। সরু ডিগডিগে। সেও একটা জিনিস খেলেই পালোয়ান হয়ে ওঠে। যেই না সে স্পিনিচ খেল অমনি ওই ডিগডিগে চেহারাটা একটা চক্কর খেয়ে গুলি ফুলিয়ে মহা শক্তিমান হয়ে ওঠে। ওঃ, তারপর শুরু হয়ে যায় ওর রাইভাল ব্লুটোর সঙ্গে ফাইট!

নিশি। ওই ওষুধ খেয়ে ওরও শক্তি বেড়ে যাবে। তবে গুলি অত ফুলবে না। ও চক্কর খায় না, তবে পায়চারি করে। ওতে শক্তি আরও বাড়ে। মাখন, পায়চারি করে যা, মনে জোর আন-তোর চোখমুখ আমার ভালো ঠেকছে না। বি স্ট্রং!

[মাখন পায়চারি করতে থাকে। জাম্বো ওকে লক্ষ করে। জাম্বোর পিছনে গেলে জাম্বোও ঘুরে তাকায়। ওর অজান্তে মুখ চেপে ধরার সুবিধে পায় না মাখন। নিশি তাই বলে]

নিশি। ওকে দেখছ কী? ও এখন দশ মিনিট এরকম হাঁটবে। তারপর জোর বাড়বে।

জাম্বো। জোর বাড়িয়ে কী করবে?

নিশি। মেজাজে হাঁটবে, চলবে- দুশমন এলে রুখবে। অবশ্য, এখানে আর দুশমন কোথায়! তবে রুস্তমের চালে চলতে ওর ভালো লাগে।

[এই কথার ফাঁকে মাখন জাম্বোর পিছনে দাঁড়িয়ে দু-হাত বাড়িয়ে ওর মুখ চেপে ধরার চেষ্টা করতেই মাখনের হাতের আঙুল জাম্বোর কানে লেগে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়িয়ে জাম্বো শক্ত বুট দিয়ে মাখনের পায়ের পাতাটা প্রায় থেঁতলে দিয়ে বিদ্যুৎবেগে পেটে ঘুসি মেরে বলে ওঠে- ‘ঢিসুম!’ মাখন আর্তনাদ করে বসে পড়ে। নিশি এগিয়ে যায়]

মাখন। ওঃ, মাগো!

নিশি। ওকে মারলে কেন?

জাম্বে। আমার পেছনে গিয়ে কানে হাত দিল কেন? মেরা কান পাকড়ায়া কিঁউ?

মাখন। (মুখে যন্ত্রণা) এই, কে তোর কান পাকড়েছে রে? কানে একটু হাতটা লেগেছে! বেয়াদব, উজবুক! পা-টা থেঁতলে গেছে…আর পেটে কী জোর মারলে। দানব একটা। নচ্ছার, বিটকেল কোথাকার!

জাম্বো। জবান সামালকে … গালি মত দো!

মাখন। এঃ, গালি দেবে না, তোকে পুজো করবে! তোর কী দশা করি দেখ!

নিশি। মাখন, ভুলে যা। সব গুবলেট করে দিচ্ছিস! সব দিক ভেবে মানিয়ে নে। সহ্য কর!

মাখন। উঃ, ঘুসি খেয়ে দম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল প্রায়। নিশি, দু-লাখ চাইবি।

নিশি। থাম না। বুঝেশুনে কথা বল। না ভেবেচিন্তে, যা মনে আসছে বলে যাচ্ছিস। (জাম্বোকে নরম গলায়) তোমার চেয়ে বয়সে কত বড়ো, ওকে অমন করে মারলে? এটা ঠিক করনি কিন্তু।

জাম্বো। কানে হাত দিলে আমি কাউকে ছাড়ি না। তাও মোটে একখানা ঢিসুম ঝেড়েছি।

নিশি। যাকগে, যা হবার হয়ে গেছে। তোমাদের পাড়ায় এসেছি। এক্ষুনি চলে যাব। ঝগড়া-মারপিট ঠিক নয়। এসো জাম্বো, ভাব হয়ে যাক দুজনে। মাখন, যা বলছি তা শুনবি। দুজনে হাত মিলাও। হাত বাড়া, মাখন।

[মুখ গোঁজ করে মাখন হাত বাড়ায়। জাম্বো আর মাখন হাত মিলায়]

নিশি। তুমি একটু মারকুটে আছ। আসলে তুমি হি-ম্যান, সুপারম্যান এইসব খেলা করো তো-

মাখন। সুপারম্যান? এ হচ্ছে হনুম্যান।

জাম্বো। ফের হনুমান বলছে!

নিশি। হনুমান বলেনি, হনুম্যান বলেছে। হনুম্যানরা খারাপ কিছু না। এদের কথা বড়ো হলে তুমি জানতে পারবে… ভারী বুদ্ধিমান, যেমন চেহারা তেমনি স্বভাব, সাহসও তেমনি। কথাটা ও তোমাকে তারিফ করেই বলেছে। হ্যাঁ, যা বলছিলাম, তুমি তো ব্যাটম্যান, এক্সম্যান-কতরকম হতে চাও। চাও তো? কিন্তু এতরকম তো হওয়া যায় না। যায়?

জাম্বো। না।

নিশি। তাহলে আসলে তুমি কী হতে চাও?

জাম্বো। সত্যি সত্যি কী হতে চাই?

নিশি। হ্যাঁ।

জাম্বো। মুম্বাই ফিল্মকা হিরো। নাচুংগা, গাউংগা, অ্যাক্টর বনুংগা, অউর ক্যা? এ হি মেরা পিয়াস, বাকি সব বাকোয়াস। মুম্বাই ম্যঁয় একদিন জরুর যাউংগা।

নিশি। আমরা তো মুম্বইয়েই থাকি।

জাম্বো। (চোখ জ্বলে ওঠে) সচ?

নিশি। বিলকুল সচ।

জাম্বো। সব ফিল্মি হিরোদের নিজের চোখে দেখেছ?

নিশি। (হাসে) দেখব কী? আমরা তো ফিল্ম বানাই। ওদের সঙ্গেই তো হামারা দিন গুজরতা।

জাম্বো। কিতনা লাকি হো তুম!

নিশি। আমরা দুই দোস্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট ডাইরেক্টর আছি। ইধার লোকেশন ঢুঁন্ডনেকে লিয়ে আয়ে হ্যাঁয়।

জাম্বো। (অভিভূত) আচ্ছা!

মাখন। পিকচারের নাম ‘বাহাদুর বজরং’।

জাম্বো। বাহাদুর বজরং! ক্যা টাইটেল হ্যায়! মজা আ জায়েগা! মুঝকো এক চান্স দিলাও, মঁ্যয় চক্কাস অ্যাকটিং করুঙ্গা, জবরদস্ত ফাইট ভি করুঙ্গা। ডান্সমে ভি ‘এ’ ক্লাশ হুঁ। থোরা কুছ ‘বুগিউগি’ দিখাঁউ?

নিশি। আমরা দেখলে কী হবে? সে দেখবে ফিল্মের ডাইরেক্টর। আমাদের উনি পাঠিয়েছেন একটা জঙ্গল খুঁজতে-সেখানে দু-চার দিন শুটিং হবে।

জাম্বো। এই মাঠের ওধারে একটা বিরাট জঙ্গল আছে।

মাখন। সেই শুনেই তো এসেছি।

নিশি। তবে কেবল জঙ্গল থাকলেই তো হবে না। গাছে গাছে হনুমান থাকতে হবে।

জাম্বো। আমাকে একটা ন্যাজ লাগিয়ে সাজিয়ে নাও-এইসা তো পিকচারমেঁ হোতা হ্যায়।

নিশি। হোতা হ্যায়, লেকিন…

মাখন। রোলটায় তোমাকে মানাবে! তবে অনেক হনুমান চাই।

জাম্বো। আমার অনেক দোস্ত আছে-সাজিয়ে নেবে?

মাখন। তাতে অনেক খরচ,-ডাইরেক্টর আসলি হনুমান চাইছে।

নিশি। তবে তোমার মতো অনেক ছেলেকে এই পিকচারে দরকার হবে। ডাইরেক্টর তোমার কেরামতি দেখে খুশি হলে, তোমার পিয়াস মিটে যেতে পারে। কিন্তু ডাইরেক্টর তো মুম্বাইতে।

জাম্বো। মুম্বাই চলে যাব।

[এসময় নেপথ্য থেকে ডাক]

ভজুদা। (নেপথ্য) জাম্বো-

জাম্বো। এই সেরেছে, ভজুদা আসছে। আর সময় পেল না।

নিশি। ভজুদা কে?

জাম্বো। ড্যাডির হাত-পা দাবায়। আমাকে স্কুল যেতে ডাকতে এসেছে। ভুজুং দিতে হচ্ছে!

[বলেই হাতের চেটো দিয়ে একটা চোখ রগড়াতে থাকে। জবরদস্ত চেহারার ভজুদা আসে। জাম্বো চোখ থেকে হাত সরিয়ে সেই চোখটা বুজে থাকে। ভারী গম্ভীর গলায় ভজুদা বলে]

ভজুদা। মা বলে পাঠালেন, ইস্কুল যাবে চলো।

জাম্বো। কী করে যাব স্কুলে?

ভজুদা। কেন, না যাবার কী হল?

জাম্বো। এই দেখোনা- (ডান-চোখ-বোজা মুখটা ভজুদার দিকে তুলে ধরে জাম্বো।) এক চোখ বুজে স্কুলে যাওয়া যায়?

ভজুদা। চোখে কী হয়েছে?

জাম্বো। কী পড়েছে যেন চোখে, পোকার কামড়ও হতে পারে। চোখটা খুললে হাওয়া লাগলেই জ্বালা করছে। দেখো-

[চোখটা খোলে জাম্বো। ভজুদা দেখে]

ভজুদা। ইস, খুবই লাল হয়েছে।

জাম্বো। তুমি যাও, আমি ডাক্তারকাকুকে চোখটা দেখিয়ে ওষুধ নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি।

ভজুদা। ডাক্তারখানায় একা যাবে, আমি যাচ্ছি সঙ্গে।

জাম্বো। আমার বন্ধু, পিকলু আসবে বলেছে। ও আমার সঙ্গে যাবে। তাই ওর জন্য ওয়েট করছি। তুমি চলে যাও।

ভজুদা। আমিও থাকি না হয়।

জাম্বো। বলছি যাও। আমার কথা না শুনলে, জানোই তো-

ভজুদা। বেশ যাচ্ছি।

[ভজুদা চলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে চোখ খোলে জাম্বো]

জাম্বো। তখন চোখ রগড়ে নিলুম। বেশ লাল হয়েছে না! ভজুদার সঙ্গে চিটিংবাজি করা সোজা। একবার ওর আঙুল কামড়ে দিয়েছিলাম, তারপর থেকে যা বলি শোনে।

মাখন। যা দেখছি, তুমি একটি রত্ন!

নিশি। এই বয়সেই মাথাটি তোমার খেলে বেশ। মুম্বাই গেলে তুমি তো কামাল করে দেবে।

জাম্বো। জরুর, ম্যঁয় সব সে এক কদম আগে হি রহুংগা। অ্যাক্টর বনুংগা নামওয়ালা। তোমাদের সঙ্গে আমাকে মুম্বাই নিয়ে চলো না?

নিশি। বাবাকে বলো, তার মত নাও।

জাম্বো। ড্যাডি ছাড়বে না। ড্যাডি মুঝে নেহি সমঝতা। তোমরা আমাকে নিয়ে চলো। তোমাদের সঙ্গে লুকিয়ে চলে যাব। তোমাদের সঙ্গে থাকব।

মাখন। ফোকটে মুম্বাই থাকবে?

নিশি। ওখানে থাকার খরচা তো আছে-থাকতেও তো হবে কম দিন না।

জাম্বো। সে ঠিক কথা। (কী ভাবে। হঠাৎ লাফিয়ে ওঠে) আইডিয়া! আইডিয়া আ গিয়া। তুমনে ‘রুখ যা বেওকুফ’ পিকচার দেখা?

মাখন। কী পিকচার?

জাম্বো। ‘রুখ যা বেওকুফ’।

মাখন। দেখিনি।

জাম্বো। আঃ, ক্যা চক্কাশ পিকচার! ওই পিকচার থেকে আইডিয়া এসে গেল। তুমলোগ মুঝে কিডন্যাপ করো। দো-চার লাখ আপসে ড্যাডিসে মিল জায়গা।

নিশি। কিডন্যাপ করব, তোমাকে?

জাম্বো। হ্যাঁ।

নিশি। মাখন, শুনছিস?

মাখন। কেবল আমি মাথায় ফুল ঠেকিয়েছি, তাতেই এই। দুজনে ঠেকালে কী হত ভাব।

নিশি। কিডন্যাপ করব বলছ?

জাম্বো। হ্যাঁ।

মাখন। তারপর পুলিশ ধরলে?

জাম্বো। পুলিশ নাগালই পাবে না, মুম্বাই চলে যাব তো!

নিশি। ধরো কিডন্যাপ করলাম। তোমার ড্যাডির কাছ থেকে টাকাও পেলাম। তারপর তোমাকে তো ড্যাডির কাছে ছেড়ে দিতে হবে। তোমাকে ফেরত না দিলে টাকা দেবে কেন?

জাম্বো। চিটিং করতে পারবে না ড্যাডিকে? ‘রুখ যা বেওকুফ’ পিকচারে অ্যায়সা চিটিং থা। সে আমি সমঝে দেব। কামপে মত ডরো ভাই।

মাখন। আর ভাবিস না নিশি, ছেলেটা এত করে চাইছে যখন গাড়িতে তুলে নে। গায়ের জোরের দরকার হচ্ছে না। তুলে নে।

[সেল ফোন বেজে ওঠে। পকেট থেকে ফোন তুলে কানে নেয় নিশি]

নিশি। হ্যালো, হ্যাঁ বল-সে কী! গাড়ির চাকার হাওয়া নেই। কেউ বদমায়েসি করে খুলে রেখেছে? চার চাকাতেই হাওয়া নেই! কেন যে চা খেতে গেলি! ঠিক আছে, সব কথা বলা যাচ্ছে না। সব ও কে। তুই দেখ চাকায় কীভাবে হাওয়া দেবার ব্যবস্থা করা যায়। একটু বাদে ফোনে বাকি কথা তোকে জানাব। রাখছি।

জাম্বো। ঝোপের ধারে তোমাদের গাড়ি ছিল?

মাখন। হ্যাঁ।

জাম্বো। ওর চাক্কার হাওয়া তো আমরা তখন খেলার মাঠ থেকে বাদাম কিনতে গিয়ে খুলে দিয়েছি।

নিশি। খুব করেছ! এখন তোমাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাব কী করে?

জাম্বো। কুছ পরোয়া নেই। হো জায়গা।

নিশি। কী হো জায়গা?

জাম্বো। গাড়ির কোনো দরকার নেই।

মাখন। দরকার নেই? তোমাকে সঙ্গে নিয়ে হেঁটে যাব? লোকের নজরে পড়বে না? তারপর পাঁচ পাবলিকের ঠ্যাঙানি খেয়ে মরি আর কি!

জাম্বো। এমন জায়গায় যাব কেউ দেখতেও পাবে না, গাড়িও চাই না।

নিশি। সে কোথায়?

জাম্বো। ওই মাঠের ওধারে যে জঙ্গলটা-

নিশি। হ্যাঁ-

জাম্বো। ওটা পেল্লাই জঙ্গল। ভয়ে ভিতরে কেউ ঢোকেই না। ওই জঙ্গলের মধ্যে একটা ভাঙা বাড়ি আছে। ওইখানে গিয়ে আমরা লুকিয়ে থাকব। আগে ওটা মন্দির ছিল। এখন ভূতের বাড়ি, কেউ যায় না।

নিশি। আইডিয়াটা মন্দ না। কী বলিস মাখন?

মাখন। চল ঠাকুরের নাম করে। তারপর ভেবেচিন্তে গাড়ি ঠিক হলে-

নিশি। তবে চলো। (জাম্বোকে) পথ দেখিয়ে নিয়ে চলো।

জাম্বো। শেষ পর্যন্ত ড্যাডির হাতে আমাকে তুলে দেবে না কিন্তু!

নিশি। তা দিই?

জাম্বো। মেরে সাথ বেইমানি নেহি চলেগা।

নিশি। বিলকুল নহি।

জাম্বো। ড্যাডির কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে চুক্কি দিয়ে পালিয়ে আসবে। তারপর একদম মুম্বাই।

মাখন। আলবত।

জাম্বো। কীসে করে মুম্বাই যাব?

মাখন। প্লেনে।

জাম্বো। প্লেনে? বহত মজা আয়েগা! (মাখনের থুতনি নাড়ার মাইম করে) এ হি হ্যায় রাইট চয়েস, বেবি-আহা! (মাখনের হাত ধরে) চল মেরে সাথ!

[ওরা এগোয়। মঞ্চ অন্ধকার হয়]

দ্বিতীয় দৃশ্য

[মঞ্চে আলো আসে। জীর্ণ, বিদ্ধস্ত একটি কোঠাঘর। আসন্ন সন্ধ্যা। তাই জঙ্গলের ভিতরের এই ঘরের আলো নিস্তেজ। এই পরিবেশে পরদা উঠতেই দেখব জাম্বো মাখনকে মেঝেয় ফেলে বুকে হাঁটু চেপে বসে তার দু-কাঁধ ধরে বাঁকছে]

জাম্বো। ইসবার নহি বাঁচো গে! মুনিয়া, তেরা জান আভি মেরা মুঠিমে। সমঝা!

মাখন। নিশি… নিশিরে… বাঁচা…আমাকে মেরে ফেলছে… বাঁচা… নিশি… মরে গেলুমরে…

[ত্রস্তভাবে নিশি ঢোকে। তার মাথায় একটা ন্যাকড়ার ব্যান্ডেজ। কপালের ধারটায় ব্যান্ডেজে হালকা রক্তের ছোপ। দৃশ্যটা দেখেই জাম্বোকে নিশি ছাড়িয়ে নেয়, ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলে]

নিশি। হচ্ছে কী! খেপে গেছ দেখছি! গলা টিপে তো ওকে প্রায় মেরে ফেলেছিলে!

জাম্বো। গলা টিপেছি নাকি? ওর কাঁধ ঝাঁকাচ্ছিলাম।

নিশি। তাই বা করবে কেন? কী? শুরু করেছ কী?

মাখন। (হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে বসে মাখন বলে-) শুধু কাঁধ ঝাঁকাচ্ছিলে! বুকের ওপর হাঁটু চেপে বসেছিল কে? দম নিতে পারছিলাম না!

জাম্বো। শুধুমুধু আমাকে গাল দিলে কেন? চুল ধরে ঝাঁকালে কেন? আমি ছেড়ে দেব? মামদোবাজি!

মাখন। শুধুমুধু? তুই আমার ইনহেলার থেরাপির যন্ত্রটা মাটিতে ছুঁড়ে ফেললি কেন? ওটা ছাড়া আমার চলে না। সেটাকে ড্যামেজ করলি!

জাম্বো। যন্ত্রটা আমার হাত থেকে কেড়ে নিতে চাইলে কেন?

মাখন। কেড়ে নেব না? বুঝলি নিশি, দেখি আমার যন্ত্রটা নিয়ে এই খুদে বিচ্ছুটা একটা ঘেয়ো কুকুরকে হাঁ করিয়ে সেটার মুখে পাম্প করে যাচ্ছে! কেড়ে নিয়ে ওর দু-গালে ঠাস ঠাস করে চড় কষাইনি এই ওর ভাগ্যি! হতচ্ছাড়া, বদমাস।

জাম্বো। ফের গাল দিচ্ছ! গন্দে নালিকে কিড়ে, তুঝকো বোটি বোটি করকে কুত্তেকো খিলাউংগা! কামিনে-

[বলেই মেঝে থেকে একটা ভাঙা ইট তুলে মাখনের দিকে ছোঁড়ে- গায়ে লাগে না। মাখন আঁতকে সরে যায়। নিশি তর্জন করে ওঠে]

নিশি। জাম্বো! আরম্ভ করেছ কী? সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ! ওই ইট ওর গায়ে লাগলে?

জাম্বো। লাগবে কী করে, আমি ওকে টিপ করে মেরেছি? টিপ করে মারলে বলতে! টিপ করে মারলে ওর রক্ষে ছিল!

মাখন। ছেলেটার কথা শুনলে হাড় পিত্তি জ্বলে কি না বল? বেকায়দায় আছি বলে, নইলে বাছাধনকে টের পাইয়ে দিতাম! এমন টেঁটিয়া ছেলেকে পাঁকে পুঁতে রাখলে তবে শান্তি হয়।

জাম্বো। শুনলে? নিজের দোস্ত বলে ওর দোষ দেখছ না। ওকে ডাঁটো।

নিশি। কী ডাটব! নিজে কী করছ, তাই ভাবো? আমাকে নিয়ে বুলফাইট খেলতে গিয়ে পেটে ঢুঁ মেরে খানায় ফেলেছ! কপাল কেটে গেছে, হাত-পা ছড়ে গেছে-কিচ্ছুটি বলিনি। আমার একপাটি বুট জুতো নিয়ে কুকুর তাড়া করে জঙ্গলে ছুঁড়ে তা হারিয়েছ, টর্চটাকে স্টেনগান বানিয়ে ফাইটের খেল দেখাতে গিয়ে তার বারোটা বাজিয়েছ, মাখনের ওপর অকথ্য হামলা চালাচ্ছ-তোমাকে কত সহ্য করব?

মাখন। সন্ধে হয়ে আসছে। রাত হোক, ওর হচ্ছে! ভাঙাচোরা একটা ভূতের বাড়িতে আছি। একটা মোমবাতিও সঙ্গে নেই। টর্চটা ছিল, সেটা গেছে। অন্ধকারে ভূত কিলবিল করবে। তুই কত বড়ো মস্তান তখন দেখব!

জাম্বো। ওই দেখো, ভয় দেখাচ্ছে!

নিশি। তোমার ভয় তাহলে আছে?

জাম্বো। ম্যঁয় ভূতসে ডরতা। ম্যঁয় ডরপুক নহি…সির্ফ ভূতসে…

মাখন। ওরে তোর হিন্দি বাত বন্ধ করবি?

জাম্বো। তোমার কথায়? মুম্বাইতে হিন্দি চলে। ইসিলিয়ে ম্যঁয়-

নিশি। রাত হোক, মুম্বাই যাবে না স্বর্গে যাবে তখন বুঝবে! ভূত না হোক, এরকম জঙ্গলে তো সাপের রাজত্ব। অন্ধকারে তো কিচ্ছু নজরে আসবে না। কেউ কি বেঁচে ফিরতে পারব?

জাম্বো। আমি দুখানা সাপ দেখেছি। একটা ফণা তুলেছিল।

নিশি। বীরত্বে তো কম যাও না! আমাদের ওপর গায়ের জোর না ফলিয়ে চারদিকের সাপ-বিছেগুলো মারতে পারনি?

মাখন। ওর বুদ্ধিতে নেচে কেন যে এখানে এলাম!

নিশি। তখন আর যাব কোথায়? তা ছাড়া জায়গাটা তো আমাদের কাজের পক্ষে আইডিয়াল। ঝোলালো ওনার ড্যাডি! ফেলুবাবু সেই দুপুরে বলল, অত ক্যাশ টাকা ঘরে নেই। জোগাড়ে বেরুচ্ছি। এরপর তো দেখলি তিন তিন বার ফোন করলাম। ফেলুবাবু বাড়ি ফেরেননি।

মাখন। থানায় যায়নি তো?

নিশি। সে সাহস হবে না।

মাখন। এখন একবার ফোন করে দেখ।

[নিশি ফোনটা বার করে। ডায়াল করে]

নিশি। হ্যালো। তাহলে ফিরেছেন? ফিরেই ফোন করেননি কেন?… শুনুন অত ধৈর্য আমাদের নেই। বড়ো জোর আর এক ঘণ্টা সময় আপনাকে দিতে পারি। মাঠের ধারের তেঁতুল তলায় টাকা নিয়ে একা আসবেন। টাকা নেব তার বিশ মিনিটের মধ্যে ছেলে আপনার ঘরে ফিরবে। …হ্যাঁ বলুন-

[জাম্বো নিশির চিবুকটা নিজের দিকে ফেরায়। ফিসফিসিয়ে বলে]

জাম্বো। ঘরে ফিরব না তো! মুম্বাই যাব যে!

[নিশি হাতের ভঙ্গিতে আশ্বস্ত করে]

জাম্বো। সমঝা, ড্যাডিকে চুক্কি দিচ্ছ তো?

[নিশি মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ জানায়]

জাম্বো। ঠিক হ্যায়।

নিশি। (ফোনে) কী বলছেন, কাল দুপুরের আগে পারছেন না? অসম্ভব, ততক্ষণ আমরা বাঁচব না..মানে আপনার ছেলেকে আমরা বাঁচিয়ে রাখতে পারব না।

[জাম্বো আবার নিশির দৃষ্টি আকর্ষণ করে তার হাতে আলতো টোকা দিয়ে। নিচু গলায় বলে]

জাম্বো। ম্যঁয় থোড়া কুছ ড্রামা কঁরু? (বলেই ফোনের কাছে মুখ নিয়ে ভয়ার্ত কান্না জড়িয়ে বলতে থাকে-) ড্যাডি-ড্যাডি…মাম্মি… জলদিসে রুপেয়া দিয়ে দাও, ড্যাডি! …আমার বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে রেখেছে…বাঁচাও ড্যাডি… বলছে, টাকা না পেলে জান নেবে, তোমাদের কাছে নিয়ে নাও মাম্মি… এরা বহত খতরনক… কোথায় আছি? (নিজেই নিজের মুখ চেপে) মুখ চেপে ধরেছে… ড্যাডি… মাম্মি… কথা বলতে দিচ্ছে না-(ফোনের কাছ থেকে সরে গিয়ে চোখ মটকে বলে-) অ্যাক্টিং দেখা মেরা?

[ওরা হতবাক। ফোনে নিশি বলে]

নিশি। তাহলে কখন টাকা পাচ্ছি? …হ্যাঁ বলুন, কাল সকালে? …ছেলের কান্না শুনে কাল দুপুরটা সকাল হয়ে গেল? সকাল ছাড়া পারছেন না? সকালে আপনার হাতে টাকা আসছে? ঠিক আছে …ওটাই ফাইনাল! কথার একটু নড়চড় হলে আপনাকে কিছুই দিতে হবে না-আমরাই আপনাকে দেব, আপনার ছেলের ডেড বডি। (ফোনটা বন্ধ করে) কাল সকালে কে একজন ওকে টাকা দিয়ে যাবে। আজকে শত চেষ্টাতেও জোগাড় করতে পারেনি। বলে দিল, পুলিশকে কিছু জানায়নি। অগত্যা সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হচ্ছে।

মাখন। এ ছাড়া উপায়ই বা কী!

নিশি। (জাম্বোকে) বড়িয়া খেল দেখিয়েছ!

জাম্বো। ‘রুখ যা বেওকুফ’ পিকচারে লাডলি বলে ছেলেটা এইরকম ড্রামা করেছিল।

নিশি। সেটা লাগিয়ে দিলে? জব্বর লাগিয়েছ!

মাখন। ‘রুখ যা বেওকুফ’ ছবির দেখছি জবাব নেই। একবার দেখে নিতে হচ্ছে।

[ইতিমধ্যে ঘরে অন্ধকার বেড়ে গেছে]

নিশি। দেখার কী সুযোগ পাবি? ঘর কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে দেখছিস? না আছে আলো, না শোওয়া-বসার জায়গা। খাওয়াদাওয়ার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম- একটু জল তো খেতে হবে!

মাখন। এক বোতল জল ছিল-তা তো এই জাম্বো জেটের ফুয়েল হয়ে গেছে। একাই সাবাড় করেছে। আমি তবু দু-এক ঢোক খেয়েছি, তুই তো গলা শুকিয়েই আছিস।

নিশি। এখান থেকে বেরোনো তো ঠিক হবে না-নয়তো জোগাড় করে নেওয়া যেত।

জাম্বো। পেটপূজাকে লিয়ে থোড়াসা-

মাখন। (চটে) থোড়াসা কী? পেটপূজাকে লিয়ে গাজরকা হালুয়া, আলুকা পরাঠা, না চাইনিজ চিজ, কী চাও? নিজের আঙুলটা মুখে পুরে চুষতে থাকো! যে খাবারদাবার সঙ্গে ছিল তার বারো আনা তো তোমাকেই নৈবেদ্য সাজিয়ে ভোগ দেওয়া হয়েছে! তা ছাড়া এই জঙ্গলের পেয়ারা গাছ থেকে কম করে গোটা দশেক কাঁচা পেয়ারা চিবিয়েছ! এর ওপর আর খাইখাই কোরো না! গনেশ ঠাকুরের মতো একটি উদর নিয়ে জন্মালে অনেক ঝামেলা পোয়াতে হয়।

নিশি। থাম না, মাখন।

জাম্বো। (নিশিকে) তুমি ভালো লোক। লেকিন তোমার এই পার্টনারটা খুবই ঘাটিয়া আছে!

মাখন। থাম থাম-তুই জব্দ রাত্তিরে। ভূতের বাড়ি এটা। ভয়ে চোখ বুজতে পারবি? চোখ মেলেও থাকতে পারবি না। তোর কী অবস্থা হয় দেখ।

জাম্বো। ভয় দেখাচ্ছ কিন্তু। রাত্তির বলে কিছু বলছি না!

নিশি। বাইরের অবস্থাটা একবার দেখে আসি।

[নিশি চলে যায়]

মাখন। ম্যয় হুঁ ব্যাটম্যান-রাতকা রাখোয়ালা! এবার রাত্তিরে তোর কত বাহাদুরি আছে দেখা!

জাম্বো। কাল সকাল হোক। ইসকা বদলা জরুর লুংগা! শেষ করে দেব! সুবহ আনে দো!

মাখন। সুবহ পর্যন্ত আগে বেঁচে থাকবি, তবে তো?

[দ্রুত নিশি আসে। চোখে বিস্ময়]

নিশি। মাখন, এই দরজার কাছটায় একবার আয়!

[মাখন ব্যস্তভাবে দরজার কাছে যায়। জাম্বো মাখনের পিছে পিছে যায়-ধীরে, একটু ভয়-ভাব নিয়ে]

নিশি। ওই গাছটার দিকে তাকা।

মাখন। কোন গাছটা?

নিশি। ওই যে, বাঁ দিকের বড়ো গাছটা। নিচু ডালটার দিকে তাকা।

মাখন। দড়িতে একটা হাঁড়ি ঝোলানো রয়েছে না?

নিশি। হ্যাঁ। এটা আগে ছিল?

মাখন। না।

নিশি। তাহলে?

জাম্বো। সত্যনাশ!

মাখন। কী সত্যনাশ?

জাম্বো। শুরু হো গ্যয়া। ভূত কা খেল-শুরু হয়ে গেল! (জাম্বো নিশির কোমর জড়িয়ে ধরে)

নিশি। ভয় কীসের? এতগুলো লোক আছি!

মাখন। (হঠাৎ কী চোখে পড়ে) ওধারের ওই গাছের ডালটা দেখ নিশি!

[নিশি তাকায় সেদিকে]

মাখন। দেখেছিস?

নিশি। হ্যাঁ, ওখানেও কী যেন ঝুলছে।

মাখন। মনে হচ্ছে, গলায় দড়ি দিয়ে কেউ ঝুলছে! দেখ তো ভালো করে-

[জাম্বো দু-চোখ ঢাকে]

নিশি। না রে, মনে হচ্ছে রোল করে গোটানো মাদুর টাইপের কিছু হবে। আর ওপাশে ছোটোমতো অন্য কী একটা ঝুলছে তা নজরে আসছে না।

জাম্বো। দরজার কাছ থেকে ভেতরে চলো না!

মাখন। তুই যা না!

জাম্বো। একলা যাব না।

নিশি। চল, ভিতরে চল। আশ্চর্য! এসব এল কোত্থেকে?

মাখন। সত্যি সত্যি ভূতুড়ে কাণ্ড রে।

[ওরা ভিতরে চলে এসেছে]

নিশি। দিনে সারা জঙ্গলের কোথাও কোনো লোকজনের হদিশই পায়নি। এসব রাখল কে? শেষ অবধি কি ভূতে বিশ্বাস করতে হবে?

মাখন। ভয় দেখাবার জন্য কেউ এসব করছে না তো?

নিশি। কী জানি। কিন্তু কেন ভয় দেখাবে?

মাখন। এটা হয়তো কারুর আস্তানা। আমরা সেটা দখল করে আছি-

নিশি। এখানে কেউ আস্তানা করে?

মাখন। কোনো বাজে ধরনের লোক!

নিশি। তাহলে সে এসে তো আমাদের শাসাবে। তাড়িয়ে দেবে বা হামলা করবে।

মাখন। তাহলে ব্যাপারটা কী?

[দরজার কাছে কিছু একটা রাখার শব্দ শুনে ওরা তিনজন সন্ত্রস্তভাবে তাকায়। দেখে ছোটো একটি মাটির কলসি অলক্ষ্যে রাখা হয়েছে। ওদের বিস্ময় আরও বাড়ে]

মাখন। আবার কলসি এল রে নিশি!

নিশি। এবার গাছে নয়, একেবারে ঘরে এসে হাজির।

জাম্বো। ভয় করছে, খুব ভয় করছে আমার!

মাখন। চোখ বুজে কানে আঙুল দিয়ে থাক।

[জাম্বো তাই করে। হঠাৎ রোলকরা মাদুরটা দরজা দিয়ে ঘরের মেঝের ওপর এসে পড়ে। তারপর এক বান্ডিল মোম]

একটি বয়স্ক মূর্তি দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়।

জাম্বো। আউর কুছ হুয়া? আওয়াজ পেলাম একটা?

মাখন। চুপ করে বোস।

নিশি। এটা তো মোমের বান্ডিল। শোবার জন্য মাদুর, রাতে আলো জ্বালবার জন্য মোম-কলসিতে মনে হচ্ছে খাবার জল আছে। যা-যা আসছে, সবই আমাদের খুবই দরকারের জিনিস। কিন্তু কে এসব করছে? কেন?

মাখন। আড়ালে থেকেই বা করছে কেন? আমাদের ওপর দরদের কারণটাই বা কী? ভাবিয়ে তুলল।

[জাম্বো একবার চোখ খুলে মাদুর ইত্যাদি দেখে আবার চোখ বোজে। এসময় বাঁ হাতে দড়িতে হাঁড়ি ঝুলিয়ে ডান হাত পিছনে রেখে খালি গায়ে পাঁজরা বের করা, উঁচিয়ে ধুতি-পরা রহস্যময় চোখ-মুখের একটি বয়স্ক মূর্তি দরজার কাছের আলো-আঁধারিতে এসে দাঁড়ায়]

লোকটি। আমায় দেখে মুচ্ছো যেয়ো না কিন্তু। মুচ্ছো যাবে না তো?

[নিশি আর মাখন মাথা নাড়ে]

লোকটি। চোখ যে ছানাবড়া হয়ে আছে তোমাদের? এই হাঁড়িতেও ছানাবড়া আছে। টাটকা। খেতে খুব সরেস। রাতে খাবে, কেমন? খাবে তো?

[ওরা ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ’ জানায়। লোকটি হাঁড়ি নামিয়ে রাখে]

লোকটি। কষ্টমষ্ট করে ওই মাদুরেই তিনজন ঘুমিয়ে নিয়ো।

[ওরা ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ’ জানায়]

লোকটি। মোম রইল-জ্বালবে। কলসিতে খাবার জল, খাবে। কলসির মুখে মাটির গেলাস বসানো আছে।

[ওরা ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ’ জানায়]

লোকটি। ভাবছ, তোমাদের জন্য এত সব করছি কেন? এই ভাঙা বাড়িতে সাপ-খোপ ছাড়া তো কেউ আসে না। কতকাল পর মনিষ্যি অতিথি এল এখানে। সেবা তো একটু করতে হয়-অতিথি বলে কথা! (মিষ্টি গলায়) এবার আসি আমি?

[ওরা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়। জাম্বো চোখ খোলে। কান থেকে আঙুল নামায়। লোকটি আবার দরজার কাছে উদয় হতে জাম্বো আবার চোখ কান বন্ধ করে]

লোকটি। দেশলাই দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। (দেশলাই রাখে) রইল। নিভভয়ে ঘুমিয়ো, আমি ঘরের বাইরে টহল দিচ্ছি। সাপ, বিছে, ছুঁচো কিচ্ছু ঘরে আসতে পারবে না। রা, কাটছ না কেন? আমি ভূত নই। আমার নাম-রামলোচন। ‘রাম’ নামে ভূত পালায়। নিভভয়ে থাকো। (পিছনের হাত সামনে আনে, তার হাতে একটা টর্চ।) এই দেখো, আমার হাতে টচ। ভূতের হাতে টচ থাকে? ভূত টচ জ্বালে? এই দেখো জ্বালছি (জ্বালায়), আবার ফুস (নেভার) , আবার জ্বালছি (আলো জ্বলে), আবার ফুস।

[টর্চ নিভতেই সেই অন্ধকারে দৃশ্যটি শেষ হয়]

তৃতীয় দৃশ্য

[মঞ্চে আলো আসে। সকাল। সেই একই ভূতুড়ে ঘর। একই পরিবেশ। নিশি ফোনে ডায়াল করছিল, মাখন মাথায় হাত চেপে কাতর মুখে এসে মেঝের মাদুরে বসে। নিশি ডায়াল করা বন্ধ রেখে জিজ্ঞেস করে]

নিশি। কী রে, কী হল?

মাখন। একবার এসে দেখ তো-মাথার এখানটায় ফেটে গেছে কি না? (নিশি এসে নির্দিষ্ট জায়গাটা দেখে)

নিশি। না। তবে ফুলে আলু হয়ে উঠেছে!

মাখন। ওই ডাকাতটার কাণ্ড!

নিশি। সারারাত্তির তো ভূতের ভয়ে ভেজা বেড়ালটি হয়ে ছিল। সকাল হতেই শুরু করেছে!

মাখন। এই এত বড়ো একটা কাঁচা পেয়ারা ছুঁড়ে মেরেছে। আরেকটা মেরেছে পিঠে! ছুটে গিয়ে গাছে উঠল! গাছে চড়তে জানলে, গাছে উঠে ওটাকে নীচে ঠেলে ফেলতাম, মুখ থুবড়ে মরত!

নিশি। কেসটা গুবলেট হয়ে যাবে, নইলে হিঁচড়ে টেনে এনে শয়তানটার দু-গালে দড়াম-দড়াম করে দুই চড় মেরে দাঁত ফেলে দিতাম! বাড়াবাড়ির একটা সীমা থাকবে তো!

মাখন। ওই যে কাল ওর সঙ্গে সন্ধেবেলা একটু খিটিমিটি হয়েছিল-তখন বলছিল না, সুবামে বদলা লুংগা-সেই কথা ব্যাটা ঠিক মনে করে রেখেছিল। কী ডেঞ্জারাস টাইপ ভেবে দেখ।

নিশি। যাকগে, আপদ বিদায়ের সময় তো হয়ে এসেছে। ওর ড্যাডি এখুনি তেঁতুলতলায় টাকা নিয়ে চলে আসবে। টাকাটি নিয়েই কেটে পড়ব। নন্তুকে ফোন করেছিলাম, ও গাড়ি নিয়ে রেডি হয়ে আছে।

মাখন। ফেলুবাবু যদি দেরি করে কোনো কারণে, আমি তোকে বলে রাখছি নিশি, ওই খুদে রাস্কেলটার সঙ্গে আর আমি এক মিনিটও থাকব না। আমি বেরিয়ে গিয়ে নন্তুর গাড়িতে বসব!

নিশি। ফেলুবাবুর আজ আর দেরি হবে না! যার একমাত্র ছেলে কিডন্যাপড হয়ে আছে, তার মনটা কীরকম উতলা হয়ে থাকে বুঝিস তো। তা ছাড়া জাম্বোর মা-তাঁর মনের অবস্থাটাও ভাব। কতক্ষণে ছেলেকে পাব-এই তো সারা রাত না ঘুমিয়ে দুজনে ভেবে চলেছে। তাড়াটা তো ওদেরই বেশি। শোন, তোর মাথায় লেগেছে-তোর কিছু করতে হবে না। আমি ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছি। (গুছোতে থাকে) আমি তেঁতুলতলায় চলে যাচ্ছি। (ঘড়ি দেখে) সময় হয়ে এসেছে। তারপর এই ভূতের বাড়ি আর জাম্বো ভূতকে টা-টা জানিয়ে বিদায়।

মাখন। একটা রহস্যের কিন্তু সমাধান হল না।

নিশি। ওই রামলোচনের ব্যাপারটা তো?

মাখন। হ্যাঁ। আলো ফুটতেই বাইরে গেলাম। কাউকে দেখতে পেলাম না।

নিশি। তবে সে যা অতিথি সেবা করেছে তার চেয়ে বড়ো অতিথি সেবা আর হয় না। আমার মনে হয়, লোকটা আসলে এক ধরনের পাগল। এটাই ওর আস্তানা। সবটাই ওর পাগলামো।

[এসময় দরজার কাছে ফেলুবাবু ওরফে আনন্দবাবু এসে হাজির। তার হাতে একটি অ্যাটাচি কেস। ওরা দুই বন্ধু চমকে যায় যেন ভূত দেখল]

আনন্দ। ভেতরে আসব?

নিশি। আসুন।

মাখন। আপনার সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্টটা তো তেঁতুলতলায়-

আনন্দ। আবার কষ্ট করে অতদূর যাবেন, তাই ভাবলাম-

নিশি। আমরা এখানে, তা জানলেন কেমন করে?

আনন্দ। সে বলছি। জাম্বো কোথায়?

মাখন। বলছি।

আনন্দ। জাম্বো কুশলে আছে তো?

নিশি। আপনার সঙ্গে লেনদেনের ব্যাপারটা মিটলেই, সব কিছুর উত্তর পাবেন।

আনন্দ। তাহলে ব্যাপারটা আমরা মিটিয়ে ফেলি। আমার যা আনার তা এই অ্যাটাচি কেসে রয়েছে।

নিশি। ভালো। পুরো দু-লাখই এনেছেন তো?

আনন্দ। বলছি।

মাখন। সবতাতেই আপনার ‘বলছি’-এক্ষুনি পরিষ্কার ভাবে কিছু বলবেন তো?

আনন্দ। তাও বলছি। আমি জাম্বোকে নিতে আসিনি।

নিশি। তার মানে?

আনন্দ। তার মানে, আমি স্থির করেছি, ও দিন সাতেক আপনাদের সঙ্গে থাকবে। এখানে।

নিশি। ছেলের চিন্তায় আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?

মাখন। আবোল-তাবোল কীসব বলছেন? আপনি কি পুলিশ নিয়ে এসে আমাদের সঙ্গে রসিকতা জুড়েছেন? এর ফল ভালো হবে না। ছেলেকে এখনও আপনি হাতে পাননি।

আনন্দ। পেতে চাইছি না তো। অন্তত দিন সাতেকের জন্য। একথা তো বললাম। মশাই, ওই দুর্দান্ত ছেলে কাল বাড়িতে ছিল না তার জন্য বাড়িতে যে কী শান্তি বিরাজ করেছে আর কী শান্তিতেই না ঘুমিয়েছি। কেবল রাতে? দুপুরে, বিকেলে শুয়ে চোখ বুজলেই ঘুম। ভগবান যেন মাথায় হাত বুলিয়ে বলে যাচ্ছিলেন- ফেলুরে, এমন তৃপ্তি কত বছর ধরে তুই পাচ্ছিস না। আজ আর তোকে ‘ফেলু’ বলব না, আজ তোর নাম যথার্থই আনন্দ। এমন আহ্লাদে আর কটা দিন থাকতে চাই ভাই! না করবেন না।

নিশি। যেভাবে নিশ্চিন্তে কথা বলছেন তাতে পরিষ্কার বুঝতে পারছি, আপনি আটঘাট বেঁধে পুলিশের সাহায্য নিয়েই এসেছেন। আর তার জন্যেই মশকরা শুরু করেছেন!

আনন্দ। পুলিশের ধারেকাছে আমি যাইনি। যাবও না। মিথ্যে কথা আমি বলি না, ভাই।

নিশি। আপনার কথা বিশ্বাস করতে হবে?

আনন্দ। সবাই তো করে।

মাখন। বাপ হয়ে কিডন্যাপারদের হাত থেকে ছেলেকে ফিরিয়ে না নিয়ে, কিডন্যাপারদের কাছে তাকে ফেলে রাখবেন?

আনন্দ। (হেসে) আমার স্ত্রীও কান্নাকাটি করে ঠিক এই কথাটিই বলেছিলেন।

নিশি। যে কোনো সুস্থ মানুষই তা বলবেন।

আনন্দ। কিন্তু সব শুনে, এই অসুস্থ মানুষটির যুক্তিই তিনি হাসিমুখে গ্রহণ করেছেন।

মাখন। আপনারা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই তাহলে পাগল। আর আপনাদের গুণধর পুত্রটি আর একধরনের খ্যাপা ডাকাত।

নিশি। যাকগে আপনার দাবি মঞ্জুর। কেবল সাত দিনের জন্যই নয়-চিরকালের মতো আপনি ছেলের হাত থেকে মুক্তি পাবেন। ধরে নিন, আপনার ছেলে আর নেই।

আনন্দ। সে আছে। মহানন্দে পেয়ারা গাছে চড়ে পেয়ারা খাচ্ছে। এখানে আসতে আসতে দূর থেকে আমি দেখেছি। শুনুন-হেঁয়ালি রেখে লাভ নেই। আপনাদের মতো আনাড়ি কিডন্যাপারদের এত বড়ো গলায় বেশিক্ষণ কথা বলাও উচিত নয়। আমার বাড়ির কাজের লোক ভজু জাম্বোকে স্কুলে যাবার জন্য ডাকতে গিয়ে আপনাদের সঙ্গে জাম্বেকে গপ্প করতে দেখে। সে ফিরে গেলেও ওর ওপর নজর রাখে। আপনাদের এই আস্তানার খবর ভজুই আমাকে জানিয়েছে। তারপর রামলোচনকে আপনাদের চৌকি দেবার জন্য আমি ফিট করেছি। জাম্বোর যাতে খুব কষ্ট বা বিপদ না হয়, তার জন্য মোম, খাবারদাবার, জল সব ব্যবস্থা করেছি। রামলোচন সাপ তাড়াতে এ-ঘরের চারদিকে বোতল-বোতল কার্বলিক অ্যাসিডও ছড়িয়েছে। আরও দিন সাতেক এভাবে থাকলে জাম্বোর কষ্ট হবে ঠিকই কিন্তু এই শাস্তিটা ওকে দিয়ে আমি দেখতে চাই এর ফলে ওর কিছু শিক্ষা হয় কি না। আপনাদের অপকর্মেরও একটা শিক্ষা দেওয়া হবে। জাম্বোকে নিয়ে এখানে এভাবে দিন সাতেক আটকে থাকলে আপনাদের সবারই মঙ্গল। তাই জাম্বোকে নিয়ে দিন সাতেক থাকুন।

নিশি। আপনার এই আজব প্রস্তাবে রাজি থাকব, তা-ই কি মনে করেন?

আনন্দ। রাজি না থাকলে, আমি পুলিশের হাতে আপনাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হব। সেটা আপনাদের পক্ষে আরও বড়ো শাস্তি হবে না কি?

মাখন। ওই ছেলেকে সঙ্গে রেখে এখানে সাত দিন থাকতে হবে? সাপের কামড়ে নয়, ওই জাম্বোর হাতেই আমাকে মরতে হবে। শুনুন, টাকা আমরা চাই না। আমরা চলে যাচ্ছি।

আনন্দ। চলে যাবেন?

মাখন। কি নিশি?

নিশি। হ্যাঁ, চলেই যাব।

আনন্দ। শাস্তি এড়িয়ে?

মাখন। দয়া করে আমাদের ছেড়ে দিন।

আনন্দ। আমি নরম মানুষ, ওভাবে বলবেন না।

মাখন। আমার ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমা আছে। আপনার ছেলে আমার ইনহেলার থেরাপির যন্ত্রটা ভেঙে দিয়েছে!

আনন্দ। আমার বাড়িতেও কিছু আস্ত নেই।

নিশি। ওকে মেরেধরে শেষ করছে। ভগবান ওকে আরও শক্তিমান করুন, আমাদের মুক্তি দিন।

মাখন। হাত জোড় করে বলছি, আমাদের ছেড়ে দিন! আমি অসুস্থ।

আনন্দ। আমাকে বড্ড নরম করে তুলছেন, ভাই। এখন আমি কী করি? আচ্ছা, একটা কাজ করুন। (আনন্দবাবু অ্যাটাচি কেস খুলে একটা বিল বই আর কলম বের করেন।) এটা আমাদের স্কুলের বিল বই-পুয়োর ফান্ডের জন্য। হাজার দশেক টাকা স্কুলের পুয়োর ফান্ডে অন্যায় কাজের ফাইন হিসেবে দান করে চলে যান।

নিশি। সে কী! উলটে আমরা টাকা দেব?

আনন্দ। এর চেয়ে নরম ব্যবহার আর কী হতে পারে, আমার তো জানা নেই ভাই!

মাখন। দশ হাজার টাকা আমরা পাব কোথায়?

আনন্দ। পকেট ফাঁকা রেখে কেউ কিডন্যাপ করতে নামে? আপনারা ভাই এতটা আনাড়ি আমি মানতে পারছি না।

মাখন। সত্যি, দশ হাজার টাকা আমাদের সঙ্গে নেই, স্যার!

আনন্দ। আবার স্যার বলছেন, -ফেলুকে? ছিঃ! কত আছে?

নিশি। হাজারখানেক।

আনন্দ। মোটে?

মাখন। আজ্ঞে, তিন সত্যি। আমাদের সার্চ করে দেখুন।

আনন্দ। ছিঃ, অত নামতে পারি? ওই টাকাই বিলে লিখে সই করে দিন।

মাখন। আমি টাকা বের করে দিচ্ছি-তুই সই করে দে।

[নিশি বিলে লেখে। মাখনের হাত থেকে টাকা নিয়ে অ্যাটাচিতে রাখেন আনন্দবাবু। সই শেষে বিল বইটিও রাখেন। এসময় দৌড়ে জাম্বো ঢোকে পিছনে রামলোচন]

জাম্বো। ড্যাডি, এরা বেইমানি কিয়া। বেইমান কো নহি ছোড়ুংগা ম্যাঁয়। ম্যঁয় মুম্বাই জরুর যাউংগা। বেইমান, কামিনে-নহি ছোঁড়ুংগা ম্যঁয়। (জাম্বো মাখনের পিঠের দিকে কোমরের বেল্টটা দু-হাতে ধরে)

মাখন। নিশি।

নিশি। (ছাড়াবার চেষ্টা করে) ওকে ছাড়িয়ে দিন।

জাম্বো। নহি ছোঁড়েগা! অব মুঝে কোই নহি রুখ সেকতা!

মাখন। কী হচ্ছে! ছাড়িয়ে দিন!

আনন্দ। বড়ো শক্ত কাজ ভাই-লেট হয়ে গেল! ও এসে পড়ার আগে যদি চলে যেতে পারতেন।

মাখন। ও নখ ফোটাচ্ছে!

জাম্বো। এবার কামড়ে দেব-নহি ছোঁড়েগা। ম্যঁয় হামলা করনেকে লিয়ে বিলকুল তৈয়ার হুঁ। মুঝে মুম্বাই লে যানে হোগা।

নিশি। ওকে সামলান! আমাদের যেতে দিন। প্লিজ।

আনন্দ। মিনিট দশেকের বেশি আমি আর রামলোচন ওকে ধরে রাখতে পারব না। এর মধ্যে সরে পড়তে পারবেন?

মাখন। পারব। দৌড়ে যাব।

আনন্দ। রামলোচন, জাম্বোকে ছাড়িয়ে নিয়ে ধরে রাখ। আমিও ধরছি তোর সঙ্গে। পালান!

[আনন্দবাবু আর রামলোচন কোনোমতে জাম্বোকে ছাড়িয়ে নেয়। ওরা দৌড় দেয়। জাম্বোর এক পা আনন্দবাবু, অন্য পা রামলোচন মাটিতে বসে পাকড়ে ধরে রাখে। পা ঝটকাতে ঝটকাতে জাম্বো বলে চলে]

নিশি। ছেড়ে দাও ড্যাডি! বেইমান লোগোকে ম্যঁয় মার ডালুংগা! ছোড় মুঝে, ছোড়!

রামলোচন। পারছিনে! লাথাচ্ছে!

আনন্দ। লাথাচ্ছে তো আমাকেও। কথা দিয়েছি। দশটা মিনিট দাঁত কামড়ে ধরে রাখ রে রামলোচন।

জাম্বো। ম্যঁয় মুম্বাই যাউংগা। মুম্বই যাউংগা ড্যাডি।

আনন্দ। পা সামলা জাম্বো। লাথি ছুঁড়ছিস যে!

জাম্বো। মুম্বাই যাউংগা!

আনন্দ। বাপের বুকে লাথি মেরে কোথায় যাবি বাবা!

[জাম্বো পায়ে ঝটকা মারতে থাকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার জন্য। ওরা দুজন প্রাণপণ চেষ্টায় ওকে ধরে রাখার চেষ্টা করে। এই অবস্থার মধ্যে মঞ্চ ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে যায়]

_______________________

* ও. হেনরির একটি গল্প ঝাপসাভাবে মনে থেকে গিয়েছিল। সেই গল্পটির রূপরেখার আদল ‘জাম্বো’ নাটকে এসে পড়েছে। নাটকটির সঙ্গে ও. হেনরির সম্পর্ক এটুকুই। জাম্বো নাটকের বিষয় ও দৃষ্টিভঙ্গি, সংলাপ ও বিন্যাস, চরিত্রসৃজন সম্পূর্ণ ভিন্ন। ‘জাম্বো’ এদিক থেকে স্বতন্ত্র রচনা।

-লেখক

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *