গাছের মা – কিন্নর রায়
শামিম ৯ম শ্রেণির ছাত্র
চিকুর ,,
তিলকা ,,
টুপুর ৮ম শ্রেণির ছাত্রী
মউ ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী
বুধনি ৫ম শ্রেণির ছাত্রী
প্রজাপতি মূর্তি পাথরে তৈরি
বজ্র কালো ঘোড়া
গাজি কালো ঘোড়ার আর এক নাম
উলগুলান কালো ঘোড়ার অন্য নাম
হেডমাস্টার
প্রথম দৃশ্য
[ পরদা উঠলেই হালকা আবছা আলোর ভেতর থেকে শোনা যাবে একটি কণ্ঠ-
সে এক বিশাল দিঘি!
সেই দিঘির জলে মিশে থাকে আকাশের নানা রঙের ছায়া। বর্ষায় ঘন কালো মেঘ- মোড়া আকাশ। সঙ্গে গুড়ুমগাড়াম বাজের ডাক। আকাশ ছেঁড়া বিদ্যুৎ চমকানি। চড়বড় চড়বড় বৃষ্টির ফোঁটা। তারপর শরতে সেই আকাশই নীল আয়না। আকাশের গায়ে গায়ে ভেসে-বেড়ানো বক-পাখা রঙের মেঘ। তার সঙ্গে সোনা রঙের বাহারি রোদ্দুর। মনে হয় আকাশের গা থেকে নেমে আসছে সোনার সুতোয় বোনা ঝালর। গরমে, শীতে, বসন্তে এই আকাশের রংই কেমন যেন বদলে বদলে যায়। বসন্তে তার গায়ে গোলাপি আভা। শীতের নীল, শরতের নীল আর গরমের নীল রঙেও অনেক ফারাক। এমনকী হেমন্তেও যে নীলটুকু তাও অন্য সময়ের চাইতে আলাদা।
(শ্রোতারা শুনতে পায় না-দেখা কণ্ঠস্বর বলে যাচ্ছে) এই যে আকাশের রং বদলে যাওয়া, তা জানে দিঘির পাড়ে-দাঁড়ানো বট-অশ্বত্থের জোড়াটি। কে জানে কত শো বছর আগে থেকে তারা শিকড় চারিয়েছে দিঘির পাড়ের মাটিতে। সেই বিশাল গাছেদের ছায়া ছড়ায় দিঘির জলেও। অনেকটা ঝাপড়াল গাছের মাথায় পাখিদের ঘরবাড়ি। তাদের আন্ডা বাচ্চা, কিচিরমিচির। সেই সব পাখিরা সকাল হওয়ার আগেই জেগে ওঠে। আর সন্ধে নামার আগেই ফিরে আসে বাসায়।
দিঘির পাড়ে-পুব-দক্ষিণ কোণে আছে এক দাঁড়ানো মূর্তি। পাথরে তৈরি এই বিগ্রহের দু-হাত। দু-পা। একটাই মাথা। দু-চোখ বোজা মুখটিতে রাজ্যের প্রসন্নতা। ক্ষমা। দু-হাতের মুদ্রায় বরাভয়। দিঘির থেকে একটু দূরে যে মানুষজনের ঘরবাড়ি, সেখানকার বউ-মেয়েরা এই মূর্তিতে ফুল দেয়। চন্দন লাগায়। মাথা ঠোকে। উপোস করে ধূপ, পিদিম জ্বালায়। সেইসব বউ-মেয়েদের মুখে মুখে ইনি নারান-ঠাকুর। নারায়ণ। ভালো করে শুদ্ধ ভাষায় যাকে কিনা বলা হয় বিষ্ণু।
দিঘির পাড় দিয়ে একটি রাস্তা সোজা চলে গিয়েছে। এখন সেই রাস্তায় টাটা সুমো, আর্মাডা জিপ, মারুতি ভ্যান, অ্যামবাসাডর-সবই যায়। গাড়ি গেলে তার চাকায় চাকায় ধুলোর মেঘ জমে।
এই পথ চলে গেছে আরও পুবে-বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে। (অদৃশ্য কণ্ঠ বলে যেতে থাকে)-লোকে বলে, এই রাস্তা দিয়ে চৈতন্যদেব হেঁটে গেছিলেন। তা হবে পাঁচশো বছরের এদিকে-ওদিকে। শ্রীচৈতন্য হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছেন। মাথার ওপর দু-হাত তোলা। উর্ধ্ববাহু মানুষটির দু-চোখে জল-দিঘির মনে পড়ে। মনে পড়ে যায় প্রাচীন বট-অশ্বত্থের। শ্রীচৈতন্যর এই চলে যাওয়ার ছবিটি ভালো মতো দেখতে পায় সেই চোখ বোজা পাথরমূর্তি। তার মনে ভেসে আসে শ্রীখোলের শব্দ। হরি হরি নাম। সেই শব্দে এই পাথরের মূর্তিও সামান্য সামান্য কেঁপে ওঠে।
দিঘির পাড়ে নানান ঝোপঝাড়। ছোটো-বড়ো আরও গাছ। পুরোনো প্রাসাদের ভগ্নস্তূপ। ভাঙা ইট। সাপখোপের ভয়। তবু সেই ঝোপের ধারে প্রায় রোজই খেলতে আসে টুপুর, চিকুর, শামিম, মউ। আর আসে তিলকা টুডু, বুধনি সোরেন।
টুপুর ক্লাস এইট, চিকুর নাইন, শামিমও তাই। মউ ক্লাস সিক্স। আবার তিলকা নাইনে ওঠার পর এ বছরই পড়া ছেড়ে দিল। উপায় নেই। সাপের কামড়ে বাবা হঠাৎ মরে গেলে যেমন হয়। বুধনি সোরেন পড়ে ফাইবে। বুধনি আর টুপুরের স্কুল এক। মউও সেই স্কুলেই। শামিম আর চিকুর এক স্কুলের ছাত্র।
কিছুক্ষণ আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। তাই দিঘির পাড়ের ঘাস, বট, অশ্বত্থ, অন্য গাছেরা বেশ ভিজে ভিজে। বৃষ্টি হওয়ার পর পরই আকাশের গা থেকে রোদের বড়ো একখানা সোনালি কার্পেট নেমে এসেছে দিঘির গায়ে। বনফুলের মাথায়। সবুজ ঝোপ, জংলা গাছেদের গায়ে গায়ে।
আজ রবিবার। ছুটির দিন। দিঘির পাড়ে টুপুর আর চিকুর ]
টুপুর। কী রোদ রে বাবা! ভালো করে তাকানো যায় না আকাশের দিকে। কী রে দাদা, তাই না?
চিকুর। খুব রোদ্দুর। তা রোদ্দুর তো এখন একটু হবেই। ভাদ্র মাস পড়ে গেছে। আগস্ট শেষ হয়ে এল। কদিন বাদেই পরীক্ষা। উফ, ভালো লাগে না আর। খালি পড়া আর পড়া।
টুপুর। তুই আবার এত বাংলা মাসের খবর কবে থেকে রাখছিস রে দাদা! আগে তো রাখতিস না।
চিকুর। ভাদ্র মাসটা মনে থাকে তালের জন্যে। তালের বড়া করল না মা, কদিন আগে। আমরা সবাই খেলাম। তুইও তো খেলি। মউ এল। শামিমও। শামিমের বোন সাবিনা। তিলকা, বুধনি-সবাই। অত তালের পিঠে মা একা একা গড়ল, ভাজল। সঙ্গে তালের ক্ষীর। তাল গুলে দিয়েছিল অবশ্য ছোটোকাকিমা।
টুপুর। সেটাও খুব মেহনতের কাজ।
চিকুর। নিশ্চয়ই।
টুপুর। শুধু তো আঁটি থেকে গায়ের জোরে তালের মাড় বের করা নয়, সেই তালের গোলাকে পরিষ্কার ন্যাকড়ায় ঝুলিয়ে রাখা, যাতে তালের মাড় থেকে তেতো বেরিয়ে নীচে পড়ে যায়। তাহলে সুন্দর হবে তালের বড়া, তাল ক্ষীর।
চিকুর। তালের আঁটিগুলো উঠোনের এক কোণে জড়ো করা আছে।
টুপুর। ভালোই তো। সেই আঁটিদের গা থেকে গ্যাঁজ বেরুলে ফোঁপর হবে। সেই ফোঁপর লাগে লক্ষ্মী পুজোয়।
চিকুর। তাল ফোঁপর এমনিও খেতে বেশ।
টুপুর। কাটারি দিয়ে ফোঁপর কাটতে যা কষ্ট হয়। কী শক্ত! অনেকবার জোরে জোরে ঠুকতে হয়। হাতে বড্ড লাগে।
চিকুর। ছাড় ওসব কথা। আজ কেন এলাম আমরা রবিবারের সকালে দিঘির পাড়ে?
টুপুর। সে তো তুই জানিস। আর জানে শামিমদা। তোরাই তো আসতে বললি।
চিকুর। (চিন্তিত মুখে) হ্যাঁ, আসলে ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের ভাবা দরকার।
টুপুর। সবাইকে ভাবতে হবে?
চিকুর। নিশ্চয়ই।
টুপুর। তুই কী রে দাদা! সামনে পরীক্ষা কত কত পড়া বাকি। এর মধ্যে আবার অন্য ভাবনা! এত ভাবাভাবি মাথার ভেতর এক সঙ্গে রাখব কীভাবে? বরং তুই আর শামিমদা ভাব। আমরা সঙ্গে আছি।
চিকুর। তা আবার হয় নাকি। এ ভাবনা সবাইকেই ভাবতে হবে একসঙ্গে। তারপর ঠিক করতে হবে এরপর কোন কাজটা করা দরকার।
[ মউয়ের প্রবেশ ]
মউ। আমিও সঙ্গে আছি তোমাদের।
টুপুর। কে রে, মউ! তুই কখন এলি?
মউ। এই তো চলে এলাম।
টুপুর। কিন্তু তুই বলছিস, সঙ্গে আছিস আমাদের! কী ব্যাপার, কী হতে যাচ্ছে, কিছুই শুনলি না। না শুনেই বলে দিলি সঙ্গে আছি!
মউ। ওরকম করে বলছ কেন? শামিমদা, চিকুরদা, তুমি, তিলকাদারা যা করো, তার সঙ্গে সব সময়ই তো আমি থাকি। তোমরা তো কখনো অন্যায় কিছু করো না। আমি নয় ছোটো। তোমাদের মতো অত জোরদার সব কাজ পারি না। কিন্তু সঙ্গে তো থাকতে পারি। যতটা পারব সাহায্য করব তোমাদের।
চিকুর। নিশ্চয়ই সঙ্গে থাকতে পারিস মউ। একশো বার পারিস। তুই যেমন আমাদের সঙ্গে সব ব্যাপারে আগে ছিলি। এখনও থাকবি। ওই তো শামিম এসে গেছে। আয় শামিম, আয়।
[ মউ চিকুরের কথা শুনে চুপ করে তাকিয়ে থাকে দিঘির দিকে। তার সারা মুখে খুশির আলো। দু-চোখে চিকচিকে জল। শামিমের প্রবেশ ]
শামিম। তিলকাদা আর বুধনি এসে গেলেই আমাদের কথা শুরু হবে।
[ চিকুর দেখতে পায় শামিমের ফরসা মুখ রোদের আঁচে কেমন যেন একটু লালচে মতো। মাথা ভরতি একটু তামাটে ঘেঁষা চুল। দু-চোখের মণিতে হালকা হালকা নীল আভা। বেশ লম্বা, হাড় হাড় চেহারা। চিকুর যেমন ফুল প্যান্ট আর বুক কাটা পুরো হাতা সার্ট পরে এসেছে, শামিমও তেমনি। শুধু শামিমের সার্টটি হাফ হাতা ]
চিকুর। তুই কিছু ভাবলি শামিম?
শামিম। কী ভাবব?
চিকুর। যার জন্যে আজ আমাদের এখানে আসা।
[ তিলকা আর বুধনির প্রবেশ ]
শামিম। ওই তো তিলকাদা, আরে, সঙ্গে বুধনিও এসে গেছে দেখছি!
[ তিলকার পরনে ফুল প্যান্ট। সেই প্যান্টটি বেশ পুরোনো। গায়ের বুক কাটা পুরো হাতা সার্টটিও অনেকটাই প্রাচীন। পায়ের হাওয়াই চটির সোল ক্ষয়ে গিয়ে পাতলা। তবে তার নীল স্ট্র্যাপ দুটি নতুন। তিলকার মাথায় লাল গামছার ফেট্টি। হাতে একটি বাঁশের মোটা লাঠি। তার জামার বড়ো বুক পকেটে একটা বাঁশি গোঁজা ]
চিকুর। তিলকাদা, একটু দেরি হয়ে গেল, ঘরে কাজ ছিল কি?
তিলকা। তা তো ছিলই। এদিকে বুধনিদের একটা বড়ো ছাগল হারিয়ে গিয়েছিল কাল রাতে। সেই ধাড়ি ছাগল খুঁজতে খুঁজতেই একটু দেরি।
বুধনি। তিলকাদাকে বললাম জান গুরুর কাছে যাই। সে গুনেগেঁথে ছাগল কোথায় বলে দেবে। তা তিলকাদা গেলে তো। কথা শোনে নাকি!
চিকুর। পেলি ছাগল?
তিলকা। (এক গাল হেসে) হ্যাঁ, পেলাম তো।
[ চিকুর লক্ষ করে হাসলে তিলকার কালো মুখটা আরও সুন্দর হয়ে ওঠে। এখন রোদ লেগে মুখখানা চকচক করছে ঘামে। মনে হচ্ছে কেউ যেন তেল মাখিয়ে দিয়েছে যত্ন করে। তিলকার মাথা ভরতি কোঁকড়া কালো চুল-কিন্তু এখন সেখানে লাল গামছা দিয়ে ফেট্টি বাঁধা, তাই সেই কালো চুল তেমন করে নজরে পড়ছে না ]
চিকুর। তিলকাদা কোথায় পেলে বুধনিদের ধাড়ি ছাগল?
তিলকা। আর কোথায়! ভাঙা গড়ের ভিটের ওপর। খুব ভয় পেয়ে গেছিল। এক কোণে সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে। ডাকছিল না পর্যন্ত।
চিকুর। ওখানে তো শেয়াল আছে শুনেছি। সাপ, তক্ষক, বেজি। ভাম, সড়েলও আছে। আর বোধ হয় বনবেড়াল।
তিলকা। আছে তো। থাকলে কী হবে। আমরা সবাই হইহই করে ছাগলটাকে প্রায় শেষ রাতে খুঁজে পেলাম। আমাদের সবার হাতে হাতে তখন লাঠি, মশাল, তির-ধনুক। ঘরে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হল। তাই শেষ রাতে একটু ঘুমিয়ে গিয়ে উঠতে দেরি।
শামিম। ঠিক আছে। ঠিক আছে। কিন্তু আমরা এখানে এসেছি যে জন্য, সেটা বলা দরকার।
চিকুর। তুই বল। তুই-ই বল শামিম। (বলেই চিকুর তাকাল শামিমের দিকে)
শামিম। (গলা খাকারি দিয়ে) আসলে আজ আমরা এখানে এসেছি একটা বিশেষ ব্যাপারে কথা বলার জন্যে। বিষয়টি হল, আমাদের স্কুলের জমিতে বড়ো বড়ো পাঁচটা খুব পুরোনো গাছ আছে। ছোটো গাছও আছে অনেক। সেসব অবশ্য অন্য প্রসঙ্গ। এইসব গাছপালার পাশেই আমাদের নিজেদের খেলার মাঠ। আমরা শুনেছি বড়ো গাছগুলোকে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
মউ। গাছ বিক্রি! কী আশ্চর্য! কেন? ওই পাঁচটা গাছকে তো আমরা আদর করে পঞ্চপাণ্ডব বলি।
টুপুর। আমি তো কিছুই জানি না এ ব্যাপারে! গাছ বিক্রি হয়ে গেল। তাও কিনা আমাদের পঞ্চপাণ্ডব। ওদের ঘিরে আমাদের কত খেলাধুলো, সময় কাটানো।
চিকুর। কথার মধ্যে কথা বলিস না তো। শামিমকে বলতে দে।
শামিম। গাছ বিক্রি করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ । ম্যানেজিং কমিটি। সমস্ত ব্যাপারটা হেডমাস্টারমশাই স্পষ্ট করে জানতেন না। পরে তিনি সব শুনেছেন। তিনিও চান না এই সব গাছ কেটে স্কুল কমিটির ফান্ড বাড়ানো হোক। তিনি আমাদের সঙ্গে আছেন। আছেন অন্য মাস্টারমশাইরাও। এখন যেভাবেই হোক আমাদের বাঁচাতে হবে পঞ্চপাণ্ডবদের।
টুপুর। এত সব তুমি জানলে কী করে শামিমদা?
তিলকা। গাছ কাটা খুব অন্যায়। গাছ আমাদের মা।
বুধনি। গাছ থেকে আমরা কত কী পাই। ছায়া। শুকনো ডাল-পাতার জ্বালানি। গাছের ডালে কত পাখি। কী সুন্দর তাদের ডাক।
মউ। গাছ আমাদের অক্সিজেন দেয়।
টুপুর। শুষে নেয় খারাপ কার্বন-ডাইঅক্সাইড। গাছ আমাদের বন্ধু।
শামিম। খবর আমি পেয়েছি নানা জায়গা থেকে। সেসব কথা এখন থাক। আর সেইজন্যেই এভাবে এক সঙ্গে বসে কথা বলা। আমাদের ঠিক করতে হবে আমরা কী করব।
[ তারা সবাই সেই বিশাল দিঘির পাড়ে বট-অশ্বত্থের ছায়ায় বসে পড়ে।
ঠিক তখনই একটা ডানা-পোড়া প্রজাপতি- উঃ আঃ উঃ আঃ, গেলুম মলুম- করতে করতে উড়ে এসে বসে দিঘির পুব-দক্ষিণ কোণে রাখা সেই দু-চোখ বোজা, দু-হাত দু-পায়ের পাথর মূর্তির বুকে ]
প্রজাপতি। (ডানা ছড়িয়ে দিতে দিতে বলে,) উফ বড্ড কষ্ট। জ্বলে গেল। পুড়ে গেল।
[ মূর্তি চুপ করে থাকে ]
প্রজাপতি। আমি আসছি হিরোশিমা থেকে। সেই কত বছর আগে হিরোশিমা, নাগাসাকিতে বোমা পড়েছিল আকাশ থেকে। সেই আঁচে আমার রংবাহারি সুন্দর পাখা ঝলসে গেল। তুমি আমায় একটু আশ্রয় দাও।
[ মূর্তি চুপ। প্রজাপতি তার দুই ডানা ছড়িয়ে বসল মূর্তির বুকে। প্রজাপতির ডানায় হলুদের ওপর কালো অক্ষরে বড়ো বড়ো করে লেখা-হিরোশিমা, নাগাসাকি ]
প্রজাপতি। আঃ, কী আরাম। কী শান্তি। সমস্ত শরীরে কে যেন হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
[ শামিম, চিকুর, টুপুর, তিলকা, মউ, বুধনি খুব ফিসফাস ফিসফাস করে কথা বলে ]
প্রজাপতি। কত বছর হয়ে গেল। তবু সারা গায়ে কী জ্বলুনি! উফ! কী ভয়ানক যন্ত্রণা। বড্ড জ্বলে। শুতে-বসতে পারি না।
[ এবার মূর্তির ঠোঁট নড়ে ওঠে ]
মূর্তি। যতদিন যুদ্ধ থাকবে, লোভ, হিংসে, হানাহানি-ততদিন বার বার এমন হবে। তোমার পাখা পুড়বে। রং জ্বলে যাবে।
প্রজাপতি। আর তুমি? তোমার কী হবে?
মূর্তি। আমার যন্ত্রণা তো থাকবেই। কিন্তু তা ভেতরে ভেতরে। ছিলাম বুদ্ধ। হয়েছি বিষ্ণু। নিজে ছিলাম মূর্তি পুজোর বিরোধী, কিন্তু আমার মূর্তি গড়ে এক সময় ঘরে ঘরে আরাধনা শুরু হল। আচার সর্বস্বতা চৌপাট করে দিল আমার তৈরি করা অনুশাসন।
প্রজাপতি। তোমার বুকে বড়ো শান্তি। আনন্দ। পরমাণু বোমার পোড়া যন্ত্রণা কমে আসছে।
মূর্তি। কিন্তু শুধু এতেই হবে না।
প্রজাপতি। তাহলে? আরও কী চাই?
মূর্তি। তিষ্ঠ। অপেক্ষা করো। জানতে পারবে।
[ শামিম, টুপুর, মউ, তিলকা, চিকুর, বুধনিদের চাপা গলায় কথা বলার সভা ভেঙে গেছে। সবাই উঠে দাঁড়ায় মাটির ওপর ]
শামিম। তাহলে ওই কথাই রইল।
চিকুর। হ্যাঁ, তাই তো ঠিক হল। কী, তুমি কী বলো তিলকাদা?
তিলকা। আমি আছি তোমাদের সঙ্গে।
বুধনি। আমিও আছি।
মউ। আমিও।
[ পরদা পড়ে যাবে ]
দ্বিতীয় দৃশ্য
[ পরদা উঠলে দেখা যায় একলা খাটের ওপর চিকুর ঘুমিয়ে। খালি গা। পরনে পাজামা। ঘরে কোনো আলো নেই। বাইরে থেকে খানিকটা জ্যোৎস্না এসে পড়েছে চিকুরের মুখে।
চিকুর ঘুমের মধ্যে রক্ত-মাখা একটি ঘোড়া দেখতে পায়। ঘোড়ার রং কালো। তার কালো কেশর উড়ছে হাওয়ায়। মুখের দু-কষে সাদা ফেনা। দু-চোখ ঘুরছে। ফেটে বেরিয়ে আসবে যেন। ঘোড়াটির সারা শরীর থেকে গড়িয়ে নামছে রক্তের ধারা ]
চিকুর। তুমি কে?
[ কালো ঘোড়া জানায়, আমার নাম বজ্র- ]
চিকুর। কোথা থেকে আসছ তুমি?
বজ্র। কলিঙ্গের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে।
চিকুর। কেন, কলিঙ্গ কেন?
বজ্র। সেখানে খুব যুদ্ধ হচ্ছে। মহারাজ অশোক আর কলিঙ্গরাজের সঙ্গে, রক্তের নদী বইছে যুদ্ধক্ষেত্রে। নিহত হয়েছে সহস্র সহস্র মানুষ। আরও হবে।
চিকুর। তুমি এখন যাও। আমার ভয় করছে।
[ চিত হয়ে শোওয়া চিকুর পাশ ফিরতেই বজ্র মিলিয়ে গেল খপ খপ খপ খপ খুরের শব্দ তুলে। চিকুর দেখতে পেল মূর্তির বুক থেকে উঠে প্রজাপতিটি তার পোড়া ডানা নাড়াতে নাড়াতে সেই কালো ঘোড়ার পেছন পেছন অদৃশ্য হয়ে গেল।
ঠিক তখনই নিজের ঘরে শুয়ে একইরকম কালো ঘোড়াকে ঘুমের ভেতর দেখতে পেল শামিম ]
শামিম। তুমি কে?
কালো ঘোড়া। আমার নাম গাজি।
শামিম। তুমি এখানে কেন?
গাজি। মুহম্মদ ঘোরি আর পৃথ্বীরাজ চৌহানের মধ্যে লড়াই হচ্ছে। ভয়ংকর তলোয়ারবাজি, তির-ধনুক, ভল্ল, কুঠার। রক্তের গন্ধে আমার বমি আসছে।
শামিম। কিন্তু তোমার গায়েও তো খুন। এত খুন বইছে যে, এভাবে বেশিক্ষণ চললে তুমি মারা যাবে।
গাজি। মরে গেলে তো চলবে না। আমায় যেতে হবে বহু পথ। অনেক রাস্তা বাকি।
শামিম। তাহলে তুমি এখানে কেন?
গাজি। যুদ্ধের কষ্ট জানাতে। যতদিন না যুদ্ধ থামবে, ততদিন কষ্ট।
শামিম। তুমি যাও। আমি ভয় পাচ্ছি।
[ বলতে বলতে শামিম পাশ ফিরল। ঘোড়াটি মিলিয়ে গেল। তিলকাও তখনই তার বাড়িতে সস্তার চারপাইয়ে সেই কালো ঘোড়াটিকেই দেখতে পেল। তিলকা টুডুর বিছানার সামনে পা ঠুকল সেই ঘোড়া। একবার। দুবার। তিন বার। চমকে উঠে তিলকা ]
তিলকা। তোমার নাম কী?
উলগুলান। আমার নাম উলগুলান।
তিলকা। তোমার গায়ে এত রক্ত, ঘাম কেন? কেনই বা মুখের কষে ফেনা? তোমার দু-চোখে কেন এত ভয়?
উলগুলান। খুব যুদ্ধ চলছে। ভগনাডিহির মাঠে হুলের ডাক, গিরা নিয়ে হাজির হয়েছে সবাই। বিদেশি সাহেব খ্যাদাবে। তোপ বন্দুকের গোলাগুলির সামনে লাঠি সড়কি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়িয়েছে মাঝিরা। সাদা চামড়ার সায়েব, আর তাদের তাঁবেদার দিকুদের তাড়াতে হবে এই দেশ থেকে।
তিলকা। (জড়ানো গলায়) তুমি এখন যাও উলগুলান। এখান থেকে চলে যাও। আমার বড়ো ডর লাগছে। বড্ড ডর।
[ উলগুলান তার কালো কেশর উড়িয়ে ঘাড় সামান্য বাঁকিয়ে, লেজের বালামচি দুলিয়ে মিলিয়ে যেতে থাকে কোন দূর অন্ধকারে। তার ফুলে ওঠা কেশরের খুব কাছে একটা প্রজাপতির রঙিন ডানা নিজের মতো নড়ে ওঠে। আর ঘুমের ভেতর মউ, টুপুর, বুধনিরা দেখতে থাকে স্কুল মাঠের পাশে দাঁড়ানো পঞ্চপাণ্ডব হাওয়ায় ডাল-পাতা-কাণ্ড নাড়িয়ে নাড়িয়ে তাদের ডাকছে।
মউ, টুপুর, বুধনিরা ঘুমের ভেতর সেই গাছেদের দিকে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলে ওঠে, যাচ্ছি। আমরা যাচ্ছি পঞ্চপাণ্ডব দাদারা। তোমাদের কোনো ভয় নেই ]
[ পরদা নামে ]
তৃতীয় দৃশ্য
[ পরদা উঠলে শোনা যাবে অদৃশ্য কণ্ঠ-এখন সকাল দশটা। আকাশে ভাদ্রের চড়া রোদ্দুর। সমস্ত আকাশ আশ্চর্য নীল। তাতে এক-আধ টুকরো জলভারহীন সাদা মেঘ।
স্কুলের পাশে মাঠের ওপর পাঁচটা গাছ-পঞ্চপাণ্ডব মাথা উচুঁ করে টান টান দাঁড়িয়ে। আর তাদের দু-হাতের বেড়ে জড়িয়ে ধরে রেখেছে টুপুর, বুধনি, মউ, শামিম, চিকুর। প্রত্যেকে এক-একটা গাছ জড়িয়ে ধরেছে দু-হাতের ফাঁদের ভেতর। তিলকা দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরে। তার ডান হাতে বাঁশের তাগড়া লাঠি। সার্টের বুক পকেটে বাঁশি। মাথার লাল গামছায় ভাদ্রের রোদ্দুর আটকে আছে। পঞ্চপাণ্ডবের এক পাণ্ডবকে দু-হাতের টানে বুকের আরও কাছে টেনে আনতে আনতে চিকুর বলে- ]
চিকুর। কেউ যদি গাছ কাটতে আসে আমাকে আগে কাটতে হবে।
শামিম। আমাকে না মেরে গাছ কাটা যাবে না।
মউ। এই গাছ কাটতে হলে আমাকে মারতে হবে আগে।
বুধনি। আমাকে আগে মারো। তারপর গাছ কাটো।
টুপুর। নিজে মরি মরব। কিন্তু পঞ্চপাণ্ডবদের কারো গায়ে হাত ছোঁয়াতে দেব না।
[ একটু একটু করে তাদের চারপাশে ভিড় বাড়ে। তিলকা তার তেল-জলে পাকানো লাঠিটি কাঁধে ফেলে গম্ভীর মুখে পায়চারি করে। মাঝে মাঝে সার্টের হাতায় মুখ, গালের ঘাম মুছে নেয়। মাথায় বাঁধা গামছার ফেট্টির লেজ দিয়ে গলার ঘাম থুপে নেয়।
পঞ্চপাণ্ডব নামের পাঁচটি গাছ জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে টুপুর, শামিম, মউ, বুধনি, চিকুর। তাদের ওপর রোদ গড়িয়ে পড়ে। খোঁচা দেয়। ঘাম নামে। সকাল গড়িয়ে দুপুর। ভিড় বাড়ে পঞ্চপাণ্ডবদের ঘিরে। ওরা পাঁচজন পঞ্চপাণ্ডবদের-পাঁচটি গাছ জড়িয়ে ধরে গায়- আমি মারের সাগর পাড়ি দেব গো’ বিষম ঝড়ের বায়ে…’ অন্যরা ওদের সঙ্গে গলা মেলায়।
হেডমাস্টারমশাই নিজে এগিয়ে আসেন স্কুল ছেড়ে। সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি। পায়ে ফিতে বাঁধা কালো ব্যাক বেল্ট পাঞ্জাবির হাতার বোতাম কবজির কাছে বন্ধ। মাথায় কাঁচা-পাকা ঢেউ খেলানো চুল। দাড়ি-গোঁফ কামানো গোল মুখ। চোখে কালো ফ্রেমের ভারী চশমা।
হেড স্যারের সঙ্গে সঙ্গে স্কুলের ছাত্ররাও এসেছে। ক্রমশ ভিড় বাড়ছে ছাত্রদের। পাশের গার্লস স্কুল থেকে এসেছে নানা বয়েসের মেয়েরা। ভিড় করছে ছাত্রীরা। সঙ্গে স্থানীয় মানুষ। অন্য মাস্টারমশাই, দিদিমণিরাও। গান চলতে থাকে-‘…মারের সাগর পাড়ি দেব গো…’
ভিড়ের মধ্যে থেকে কে যেন বলে উঠল-গাছ কাটা চলবে না। সঙ্গে সঙ্গে সমবেত কণ্ঠের জবাব পাওয়া গেল-চলবে না। চলবে না। আবার শোনা গেল- একটি গাছ একটি প্রাণ। সবাই গলা মেলাল-একটি প্রাণ। একটি প্রাণ। অন্যায়ভাবে বৃক্ষ নিধন বন্ধ করো। সঙ্গে সঙ্গে সমবেত কণ্ঠে-বন্ধ করো। বন্ধ করো ]
হেডমাস্টার। সাইলেন্স। সাইলেন্স। গোলমাল নয়। কোনো গোলমাল নয়।
[ হেডমাস্টারমশাইয়ের কথা শুনে গোলমালের শব্দ কেমন যেন ধীরে ধীরে থেমে আসে ]
হেডমাস্টার। আমি অভিভূত। আমার ছাত্ররা-শুধু আমার ছাত্ররাই নয়, পাশের গার্লস স্কুলের ছাত্রীরাও কেউ কেউ এগিয়ে এসেছে পঞ্চপাণ্ডবদের বাঁচাতে। আমাদের স্কুল কম্পাউন্ডের ভেতর এই পাঁচটি গাছ, তাদের সবাই আদর করে নাম দিয়েছে পঞ্চপাণ্ডব। আশপাশে আরও অনেক গাছ আছে। তাদেরও আমরা ভালোবাসি। পঞ্চপাণ্ডবদের ঘিরে আমাদের অনেক স্মৃতি। তাদের ছায়ায় কতবার স্কুলের ছাত্রদের বনভোজন হয়েছে। উনুন অবশ্য তৈরি হয়েছিল দূরে। যাতে গাছেদের গায়ে না আগুনের আঁচ লাগে। তারপর এই গাছের চারদিকে টিফিনে ছাত্রদের কত খেলাধুলো। এমনকী কোনো কোনো দিন ছুটির পরও। এখন যারা ছাত্র-তাদের দাদা, কাকারাও কেউ কেউ এইসব গাছ ঘিরে খেলাধুলো করেছেন। তাদেরও আছে অনেক স্মৃতি এইসব গাছেদের নিয়ে। (চোখের চশমা খুলে ফেললেন) গাছ আমাদের মা। পৃথিবী আমাদের মা। সেই মা-কে রক্ষা করা আমাদের সবার কর্তব্য। দায়িত্বও বটে। এই দায়িত্ব সামাজিক দায়িত্ব। আর আজ আমার ছাত্ররা দু-হাতে গাছ জড়িয়ে রেখে নিজেরাই গাছ হয়ে গেছে। গাছেদের মা। শুধু আমার স্কুলের ছাত্ররাই নয়, গার্লস স্কুলের ছাত্রীরাও আছে। আমি কথা দিচ্ছি, কোনোভাবেই কুড়ুলের কোপ পড়বে না পঞ্চপাণ্ডবের গায়ে। এমনকী অন্য সব গাছেও কুড়ুল-করাত ঠেকাবে না কেউ। অন্তত যতদিন আমি আছি।
[ ঘিরে আসা ভিড় হেড মাস্টারমশাইয়ের এই কথা শুনে হইহই করে ওঠে ]
সাইলেন্স। সাইলেন্স প্লিজ। চুপ করুন আপনারা। সবাই চুপ করো। আমি আমার স্কুলের ছাত্র শামিম রেজা আর পুষ্পক মুখোপাধ্যায় অনুরোধ করব তারা যেন গাছ জড়িয়ে দাঁড়ানোর এই ব্রত থেকে আপাতত সরে আসে। সঙ্গের ছাত্রীদেরও অনুরোধ জানাব গাছ ছেড়ে দিয়ে সরে আসতে। আমি সবার সামনে কথা দিচ্ছি, গাছ কাটা হবে না। আর এরপরও যদি সেরকম কোনো দুঃখজনক পরিস্থিতি সামনে আসে, তখন আমি আবারও কথা দিচ্ছি এদের সঙ্গে আমি নিজে থাকব। নিজে অনশনে বসব পঞ্চপাণ্ডবের নীচে। এভাবেই জড়িয়ে ধরব গাছেদের দু-হাতে।
[ বলতে বলতে চোখের চশমা জায়গামতো রাখলেন হেডস্যার। ফটাফট হাততালি পড়ল। সবাই শুনতে পেল পঞ্চপাণ্ডবের একটি গাছ যেন মাথা নেড়ে নেড়ে খুব আস্তে আস্তে বলছে, এখনই যেয়ো না তোমরা। আর একটুখানি থাকো। আরও খানিকক্ষণ। খুব ভালো লাগছে। বড়ো ভালো লাগছে। ধীরে ধীরে পরদা নামবে ]