সবুজ পৃথিবী – শচীন দাশ

সবুজ পৃথিবী – শচীন দাশ

সাহেব একজন পরিবেশবিদ ও বৃক্ষপ্রেমিক

বৃদ্ধ অশ্বত্থ বাগানের গাছ

বট ,,

কৃষ্ণচূড়া ,,

নিম ,,

পাকুড় ,,

আম ,,

জাম ,,

পেয়ারা ,,

চারা বট ,,

অন্যান্য ,,

প্রথম দৃশ্য

[ সকাল। শহরের বাইরে একটা বড়ো বাগান। বাগানে নানা ধরনের ছোটো-বড়ো গাছ। কৃষ্ণচূড়া, পাকুড়, বট, অশ্বত্থ, নিম থেকে আম, জাম, পেয়ারা ও সফেদা পর্যন্ত কতই সব গালভরা নাম।

আশেপাশে ফুলের গাছও আছে। তারই ডালে ডালে পাখি ডাকছে। প্রজাপতি উড়ছে।

পরদা উঠতেই দেখা যাবে বাগানে একজন লোক দাঁড়িয়ে। লোকটির মাথায় টুপি। পরনে হাফ-প্যান্ট। পিঠে রুকস্যাক ও হাতে একটা লম্বা ঘাস কাটার কাঁচি। লোকটি একমনে তাকিয়ে একটা গাছ দেখছে। দেখতে দেখতেই লোকটি এবারে মুখ ফেরাল। তারপর কাঁচি দিয়ে যেন কিছু কাটছে এমন শব্দ করতে করতে ও মাথা নাড়তে নাড়তে আশেপাশের গাছগুলোর দিকে অদ্ভুতভাবে তাকাতে তাকাতে বাগানের আরও ভেতরে ঢুকে গেল সে।

লোকটি চলে যেতেই বাগানে দাঁড়ানো গাছগুলোর কথোপকথন শোনা যাবে ]

কৃষ্ণচূড়া। কী ব্যাপার বলো তো পাকুড়দা! সাহেব যে আমাদের চিনতেই পারল না-

পাকুড়। (অবাক হয়ে) তাই তো দেখছি। বিলেত থেকে ফিরে এসে সাহেব এমন পালটে গেল কী করে? অথচ তোর সামনে গিয়ে যখন দাঁড়াল না কৃষ্ণচূড়া, আমি ভাবলাম এবার বোধ হয় তোর সঙ্গে গল্প জুড়ে দেবে-

কৃষ্ণচূড়া। হ্যাঁ, গল্প না আরও কিছু! এমন ড্যাবড্যাব করে তাকাচ্ছিল যে, মনে হচ্ছিল এই বুঝি আমাকে গিলে খাবে-

বট। (একটু হেসে) ধুস! তোকে গিলবে কী করে! তোকে গেলার মতো পেট আছে নাকি সাহেবের?

কৃষ্ণচূড়া। না না ঠাট্টা নয় বট। সাহেব আমাদের একদম পালটে গেছে।

পাকুড়। সত্যি কী ছিল, কী হয়ে গেল মানুষটা। আগে বাগানে ঢুকে আমাদের সঙ্গে কত কথা…কত ঠাট্টা ইয়ার্কি…

কৃষ্ণচূড়া। কেন, গান শোনাত না আমাদের-

জাম। হ্যাঁ। গাদা গাদা ক্যাসেট নিয়ে এসে টেপরেকর্ডারে চালিয়ে দিত-

আম। আর গল্প! কতরকম যে গল্প করত-

পেয়ারা। শুধু গল্প কেন, আমাকে ভ্যাঙাত না বুঝি… বলত না বুঝি

পেয়ারা দোহারা

পাতাহীন চেহারা।

বলত। বলেই আবার আমার গোড়ায় কোথা থেকে মাটি এনে দিত। গোবর সারও এনে ফেলত ঝপাঝপ! বলতও তারপর, নে নে খা। খা তো ভালো করে। এমন রোগা-প্যাংলা হয়ে থাকলে চলবে-

পাকুড়। তবে! তবেই বোঝ কেমন ছিল মানুষটা… অথচ কী যে হয়ে গেল-

বট। কী আবার হবে! মানুষেরা শুনেছি মাঝে মাঝেই পালটায়। সেরকমই হয়তো বদলে গেছে আমাদের সাহেব!

কৃষ্ণচূড়া। তাই বলে চিনবে না একবারে-

আম। না না, কিছু একটা হয়েছে সাহেবের।

বট। (অবাক হয়ে) কী আবার হবে-!

পাকুড়। সেটাই তো আমাদের প্রশ্ন!

[ এই সময় নেপথ্যে একটা গলার আওয়াজ শোনা যায়ঃ ‘…ষড়যন্ত্র গভীর ষড়যন্ত্র-!’ বলতে বলতে মঞ্চে বুড়ো অশ্বত্থের প্রবেশ। আম, জাম, কৃষ্ণচূড়া ও পাকুড়েরা চমকে সেদিকে তাকায় ]

পাকুড়। (অবাক হয়ে) কীসের ষড়যন্ত্র অশ্বত্থখুড়ো?

অশ্বত্থ। আর কীসের! তোমার ওই সাহেবের কথাই বলছি।

পাকুড়। কী করেছে সাহেব!

অশ্বত্থ। চক্রান্ত করছে! চক্রান্ত-

কৃষ্ণচূড়া। (ভাবতে ভাবতে) চক্রান্ত!

অশ্বত্থ। (চোখ নাচিয়ে) হ্যাঁ। সাহেব বিলেত থেকে ‘বনসাই’ শিখে এসেছে। এখন তোমাদের বাচ্চাদের ধরে ধরে বনসাই করতে চায়-

কৃষ্ণচূড়া। (অবাক হয়ে) বনসাই! সে আবার কী?

অশ্বত্থ। সেকী! বনসাইয়ের কথা শোনোনি? সারা পৃথিবী এ নিয়ে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। বাড়ির গিন্নিরাও অবসর সময়ে বসে বনসাই করছে-

পাকুড়। (অধৈর্য হয়ে) আহা। ব্যাপারটা কী, বলবে তো-

অশ্বত্থ। বলছি বলছি। ব্যাপার হল, লম্বা একটা গাছকে নানান কৌশলে ছোটো করে রাখা। এই তুমিই ধরো না পাকুড়, পঁচিশ-তিরিশ ফুট লম্বা হয়ে এই যে তুমি দাঁড়িয়ে আছ- ইচ্ছে করলে ওরা তোমার চারা নিয়ে তাকে বেঁটে বামুন করে রাখতে পারে।

জাম। তার মানে সে আর বড়ো হবে না?

অশ্বত্থ। বয়সে বাড়বে। কিন্তু লম্বা আর হবে না-

পাকুড়। উফ-কী সাংঘাতিক!

অশ্বত্থ। সাংঘাতিক মানে… যাও না, যাও, সাহেবের বাড়ি গিয়ে দেখো, চিনেমাটির টবে কোত্থেকে একটা বটগাছের বনসাই নিয়ে এসেছে সাহেব। গাছটার বয়স কত জানো?

কৃষ্ণচূড়া। কত!

অশ্বত্থ। তিরিশ বছর। অথচ লম্বায় সে দু-ফুট-

কৃষ্ণচূড়া। (চমকে) তাই নাকি!

অশ্বত্থ। ঠিক তাই। আর সেজন্যই তো বলছি, সাহেব আমাদের সঙ্গে চক্রান্ত করছে। কী ভাবছে জানো, এই বাগানের সব চারাগুলোকে ধরে নিয়ে বনসাই করে রাখবে-

আম। নাহ, না না। এ হতে দেব না। সাহেবকে তা করতে দেব না-

অশ্বত্থ। আমিও তো তাই বলি। তা ছাড়া, কী অধিকার আছে বলো তো ওই সাহেবের-যে আমাদের শিশুচারাগুলোকে সব বেঁটে বামুন করে রাখবে-

জাম। না নেই। কোনো অধিকারই নেই-। কিন্তু কী করা যায় বলো তো অশ্বত্থখুড়ো-

অশ্বত্থ। (ভাবতে ভাবতে) দাঁড়াও- দাঁড়াও- ভাবি একটু।

[ অশ্বত্থ চুপ করে দাঁড়িয়ে কিছু ভাবতে থাকে। এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে মঞ্চে প্রবেশ করে যুবক নিম ]

নিম। (শশব্যস্তে) চুপ চুপ। সাহেব আসছে-

কৃষ্ণচূড়া। (চমকে) কই কোথায়-!

নিম। (আঙুল তুলে দেখিয়ে) ওই তো জঙ্গলের পথ ধরে আসছে-

পাকুড়। এই চুপ। সবাই চুপ। কেউ কোনো কথা বলবে না। সাহেব চলে গেলে তারপর ঠিক করব, কী করতে হবে আমাদের-

পেয়ারা। কিন্তু-

কৃষ্ণচূড়া। (মুখে আঙুল তুলে) ইস-স-চুপ চুপ-ওই আসছে-

[ আম-জাম-নিম-পাকুড়েরা সব নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে। নেপথ্যে একটা জুতোর শব্দ শোনা যায় ]

দ্বিতীয় দৃশ্য

[ মঞ্চসজ্জা একইরকম। বাগানে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে গাছেরা। এই সময় সাহেব ঢোকে বাগানে।

সাহেবের এক হাতে একটা কাঁচি। অন্যহাতের মুঠোয় একটা চারা গাছ। বোঝা যায়, এইমাত্র বাগানের ভেতর থেকে চারাটা সে তুলে এনেছে। কিন্তু হাতের মুঠোয় হাসফাঁস করছে চারাটা ]

চারা। সাহেবদাদু-ও সাহেবদাদু-

[ সাহেব মঞ্চের মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। দাঁড়িয়েই সে চারাটা তুলে ধরে চোখের সামনে ]

সাহেব। কী হল চেল্লাচ্ছিস কেন, অ্যাঁ-

চারা। একটু জল খাব-

সাহেব। (চোখ নাচিয়ে হেসে) জল! হ্যাঁ হ্যাঁ, খাবি- সব খাবি- কিন্তু আমার ওখানে গিয়ে-

চারা। (অসহায় গলায়) কিন্তু আমি যে আর পারছি না-

সাহেব। পারবি- পারবি। সব পারবি। শুধু ওই লম্বাটাই যা হতে পারবি না। হি হি… (সাহেব হাসতে থাকে। একসময় আবার হাসি থামে তার।) এখন থেকে সবাই তোরা এইটুকু হয়ে যাবি। সব কটা বেঁটে বামুন। হাঃ হাঃ হাঃ (অট্টহাসি) কী মজা না! অমন লম্বা লম্বা ঝাঁকড়া গাছগুলো সব্বাই বেঁটে- বাঁটকুল- বাঁটুল- পলাশ বাঁটুল, শিমুল বাঁটুল, অশ্বত্থ বাঁটুল, পাকুড় বাঁটুল, কৃষ্ণচূড়া বাঁটুল- এমনকী এই যে তুই- বটের বাচ্চা বট… তুই ও বাঁটুল- আর বাড়বি না- বাড়তে দেব না আমি- হাঃ হাঃ হাঃ-(অট্টহাসি)

[ চারাটার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে সাহেব বাগান ছেড়ে বেরিয়ে যায়

[ সাহেব চলে যেতেই উইংসের দু-দিক দিয়ে উত্তেজিত হয়ে মঞ্চে ঢোকে আম-জাম-বট-অশ্বত্থ-পাকুড়-পেয়ারা-নিমেরা। ঢুকেই ওরা গোল হয়ে দাঁড়ায়। তারপরেই চেঁচিয়ে ওঠে ]

অশ্বত্থ। দেখো, দেখলে তো তোমরা- নিজের চোখে দেখলে তো-

বট। (উত্তেজিত হয়ে) দেখলাম মানে-! এ তো সাংঘাতিক ব্যাপার। আমাদের শেষ করে দেবার মতলব।

অশ্বত্থ। তবে! তুমি তো প্রথমে বিশ্বাসই করতে চাইছিলে না বট-

বট। (খানিকটা অসহায়) এখন কী হবে অশ্বত্থখুড়ো! ওই বাচ্চাটা যদি মরে যায়?

অশ্বত্থ। না না মরবে না। মারবে না ওকে সাহেব- তবে বেঁটে করে দেবে-

[ এই সময়ই বাইরে একটা চিৎকার শোনা যায় ‘খুড়ো… ও খুড়ো…’ এবং চিৎকার করতে করতেই একটু পরে মঞ্চে ঢোকে কৃষ্ণচূড়া। অশ্বত্থখুড়োর সামনে এসেই দাঁড়িয়ে পড়ে। কৃষ্ণচূড়ার সারা মুখে উত্তেজনা ]

কৃষ্ণচূড়া। এই যে খুড়ো, বটের শিশুটাকে বোধ হয় এতক্ষণে মেরেই ফেলল। কিছু একটা করো-

অশ্বত্থ। করব-করব। দাঁড়া, মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে-

পাকুড়। কী বুদ্ধি খুড়ো!

অশ্বত্থ। বলছি দাঁড়াও। আগে সবাইকে ডাকো এখানে-

বট। (সামান্য ভয় পেয়ে) না না খুড়ো, এখন ডাকার দরকার নেই-কে কোত্থেকে সাহেবের কানে তুলে দেবে কথাটা-তার চেয়ে আমাদের বলো আগে- কী রে কৃষ্ণ, ঠিক বলেছি তো-? কী নিম বল না! কই রে আম-জাম তোরা বল কিছু?

জাম। বট ঠিকই বলেছে খুড়ো। তুমি আগে আমাদের বলো তারপর আমরা না হয় সবাইকে বলব আস্তে আস্তে। কী বল পাকুড়?

পাকুড়। হ্যাঁ খুড়ো, আমারও তাই মত-

অশ্বত্থ। বেশ। তবে শোনো তাহলে। পাখিদের বলো কাল থেকে তারা যেন আর এ বাগানে না ঢোকে-

পাকুড়। (অবাক চোখে) পাখিদের আসতে বারণ করব?

অশ্বত্থ। (মাথা নেড়ে) হ্যাঁ। শুধু পাখি নয়, মৌমাছিদেরও বলবে- প্রজাপতিদেরও জানাবে-

কৃষ্ণচূড়া। (অবাক হয়ে) ওদেরও জানাব?

অশ্বত্থ। (চারপাশে তাকিয়ে) হ্যাঁ। শুধু ওদেরই নয়, কাঠবেড়ালিদেরও জানাবে। আর বাতাসকেও বলবে-

নিম। বাতাসকেও!

অশ্বত্থ। (নিচু গলায়) বাতাসকেও-

বট। (চঞ্চল চোখে) কী বলব?

অশ্বত্থ। বলবে সে যেন আর এই বাগানে না ঢোকে কদিন। কেবল বাতাসই নয় আরও একজনকে বলতে হবে তোমাদের-

আম। কে অশত্থখুড়ো!

অশ্বত্থ। (একটু থেমে) সূর্য।

কৃষ্ণচূড়া। পাকুড়ের সঙ্গে সমস্বরে বিস্ময় প্রকাশ করে সূর্য-!

অশ্বত্থ। (ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে) হ্যাঁ। কেন, পারবে না বলতে?

কৃষ্ণচূড়া। (সামান্য চিন্তিত) না পারব না কেন, তবে-!

অশ্বত্থ। তাহলে আর তবে কী?

কৃষ্ণচূড়া। আমরা যে তাহলে রোদের অভাবে মরে যাব অশথখুড়ো। বাচ্চাগুলোও যে হাসফাঁস করবে-

পাকুড়। তা ছাড়া তোমারও তো হাঁপানিটা বাড়বে-

অশ্বত্থ। (মাথা নেড়ে) আরে দু-দিনে কেউ মরে যায় না। হয়তো একটু দুর্বল হয়ে পড়বি। কিন্তু শত্রুর সঙ্গে মোকাবিলা করতে গেলে এটুকু ত্যাগস্বীকার তো করতেই হবে-

বট। (উত্তেজিত হয়ে) না না করব, করব খুড়ো। আমরা আজই সবার সঙ্গে কথা বলছি-

অশ্বত্থ। হ্যাঁ, বলে বোঝাও আমাদের বিপদের কথা-

পাকুড়। কিন্তু কদিনের জন্য বলব খুড়ো?

অশ্বত্থ। (ধৈর্য হারিয়ে) আরে দু-দিন- দু-দিন-

পাকুড়। বেশ তাহলে আজই আমরা বেরিয়ে পড়ছি খুড়ো-

অশ্বত্থ। হ্যাঁ হ্যাঁ। আজই যাও। সবার কাছে অ্যাপিল করো-

পেয়ারা। তুমি যাবে না খুড়ো?

অশ্বত্থ। (আস্তে মাথা নেড়ে) না রে-শরীরটা ভালো নেই। হাঁপের টানটা বেড়েছে। হাঁটতেও পারি না আর আগের মতো-

পেয়ারা। তাহলে!

অশ্বত্থ। না না, তোরা যা না, যা। আমি না হয় এখানে দু-মিনিট জিরিয়ে নিই-

পাকুড়। তুমি তাহলে এখানেই থাকো খুড়ো। আমরা ঘুরে এসে রিপোর্ট দিচ্ছি তোমাকে-

অশ্বত্থ। হ্যাঁ হ্যাঁ আমি বসছি। বসছি এখানে-

[ আম-জাম-পেয়ারা-বট-পাকুড়-নিম-কৃষ্ণচূড়ারা বেরিয়ে যায়। অশ্বত্থ আস্তে আস্তে বসে পড়ে মঞ্চেরই মাঝমাঝি। বসে বিড়বিড় করতে থাকে ]

তৃতীয় দৃশ্য

[ মঞ্চে বাগানের দৃশ্য। কিন্তু বাগানে অন্ধকার ছেয়ে আছে। এমন অন্ধকার যে গাছগুলো ভালো চোখে পড়ে না।

পরদা সরতেই দেখা যাবে মঞ্চে সাহেব দাঁড়িয়ে। চারপাশে তাকিয়ে অবাক চোখে নিজের মনেই বলছে ]

সাহেব। (স্বগতোক্তি) কী ব্যাপার! বাগানে এমন অন্ধকার কেন! অথচ বাইরে তো এখন রোদ আছে আর রোদের তেজও প্রখর-! তা ছাড়া কোনো শব্দ নেই। পাখিদের ডাক-টাকও কানে আসছে না। ভেতরে কোথাও একটু হাওয়া নেই! আর ওই যে কাঠবেড়ালিগুলো-ফুড়ুত-ফারুত করে যারা এপাশে-ওপাশে ছোটে, তাদেরও কোথাও চোখে পড়ছে না, তা বাদে মৌমাছির দল-গেল কোথায়-আরে প্রজাপতিও নেই দেখছি- আর এত অন্ধকারই বা এল কোথা থেকে-(সাহেব মঞ্চের চারপাশে বাগানের দৃশ্যের ভেতরেই ঘোরাঘুরি করে। এরপর আবারও বলতে থাকে।) আরে হলটা কী! বাগানের ভেতরেও তো দেখছি আরও অন্ধকার। পাখি নেই! মৌমাছি নেই, প্রজাপতি নেই, কাঠবেড়ালি নেই, বাতাসও স্তব্ধ। রোদও ঢোকেনি একটুও অথচ ঘন বর্ষাতেও তো এমন হয় না-আলো কম হলেও দেখা যায় সব কিছু-বাতাসও থাকে-পাখিও ডাকে-(বলতে বলতে সাহেব এবার মঞ্চের একেবারে সামনে চলে আসবে। আপন মনেই বলতে থাকবে সামনের দিকে আঙুল তুলে।) ওই তো ওদিকে কত রোদ-পাখিরা উড়ছে-একটা ঘুড়ি, ভোকাট্টা হয়ে ভেসে যাচ্ছে হাওয়ায়! হ্যাঁ, ওই তো-ওই তো যাচ্ছে ভেসে, তাহলে এই বাগানের মাথায় রোদ নেই কেন, বাগানে পাখি নেই কেন, বাতাস কেন বইছে না-(মঞ্চের সামনে থেকে সাহেব আবার বাগানের ভেতরে গিয়ে দাঁড়ায়) আচ্ছা। দেখি তো একটু ভেতরে ঢুকে-

[ পায়ে পায়ে সাহেব ভেতরে ঢুকে মঞ্চ থেকে বেরিয়ে যায়। সাহেব বেরোতেই অন্ধকারে বটের গলা ভেসে আসে ]

বট। ধরেছে-ধরেছে-তোমার দাওয়াই কাজে লেগেছে অশত্থখুড়ো-

[ অন্ধকারেই বুড়ো অশ্বত্থ ও অন্যান্যদের কথাবার্তা শোনা যায় ]

অশ্বত্থ। আহ আস্তে। আস্তে বল বট। সাহেবের কানে যেতে পারে-

কৃষ্ণচূড়া। না না সাহেব নেই এখন এখানে।

অশ্বত্থ। না থাকলেও আবার ও এখুনি এসে পড়বে। যা কলে ফেলেছি না সাহেবকে-(খুকখুক করে কাশতে থাকে অশ্বত্থ)

পাকুড়। তোমার কাশিটা দেখি বেড়েছে খুড়ো।

অশ্বত্থ। হ্যাঁ, ভালো নেই রে শরীরটা। কী জানি এবার কবে যেতে হয়। মাটি থেকে সেভাবে তো এখন আর জল টানতে পারি না-

নিম। [ হঠাৎ ফিসফিস করে বলে ওঠে ] এই চুপ চুপ, সাহেব আসছে-

পাকুড়। আসছে! তুমি দেখেছ নিম?

নিম। হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই তো-

[ সবাই ওরা চুপ করে যায়। আপন মনে বকতে বকতে সাহেব আবার মঞ্চে ঢোকে ]

সাহেব। (স্বগতোক্তি) আশ্চর্য! চল্লিশ বছর ধরে এই বাগানে আসছি। এমন ভূতুড়ে কাণ্ড কিন্তু কোনোদিন দেখিনি! আলো নেই, হাওয়া নেই, পাখি নেই। আর গাছগুলোও তো মড়ার মতো পড়ে আছে দেখছি-(সাহেব অন্ধকারে গাছগুলোর দিকে তাকায়) কই অশ্বত্থখুড়ো, কোথায় তুমি? পাকুড় কোথায়? কোথায় কৃষ্ণচূড়া? নাহ কথাও তো বলছে না কেউ- কী হল কী-!

[ সাহেব মঞ্চের মাঝামাঝি এসে কী ভাবে। তারপর মাথা নাড়তে নাড়তেই একসময় বেরিয়ে যায়। যেতে যেতেই বলে- ]

নাহ কিছু একটা হয়েছে… দেখি কী করা যায়-

[ সাহেব বেরিয়ে যায়। অন্ধকারে আবার অশ্বত্থের কাশির আওয়াজ পাওয়া যায় ]

অশ্বত্থ। শুনলে তো সবাই?

পাকুড়। হ্যাঁ খুড়ো। সবই শুনেছি-

অশ্বত্থ। এখন আর একটু ধৈর্য ধরো-(খুকখুক করে একটু সময় কাশি অশ্বত্থের)

কৃষ্ণচূড়া। ও খুড়ো একটু জল খাবে!

অশ্বত্থ। (কাশতে কাশতে) জল কোথায় পাবি?

কৃষ্ণচূড়া। কেন পান্থপাদপ গাছ আছে না দুজন বাগানে। ওরা শরীরে জল ধরে রাখে-

অশ্বত্থ। (কাশি) চল-

[ একটু চুপচাপ। শুধু মঞ্চে একটা মৃদু কাশির আওয়াজ। একটু কাশির আওয়াজটা কমে। শোনা যায় যেন ঢকঢক করে জল খাচ্ছে ]

চতুর্থ দৃশ্য

[ একই মঞ্চ দৃশ্য। সাহেব ঢুকে বাগানে অন্ধকারেই একটা গাছের তলায় টেপরেকর্ডার বসিয়ে ক্যাসেট বাজিয়ে দিয়েছে। গানটা খানিকক্ষণ হয়। এরপর গানের সুরটা কমে আসবে। গানের গলাও নিচু স্বরে শোনা যাবে। সাহেব এগিয়ে আসবে আস্তে আস্তে। মঞ্চের খানিকটা সামনে। তারপর একটা গাছের দিকে তাকিয়ে বলবে- ]

সাহেব। (স্বগতোক্তি) কী হল পাকুড়, তোমরা সব বোবা হয়ে গেলে যে-আগে গান শুনলে নাচতে গাইতে! কী হল বলো তো! ও হো, গানটা বোধ হয় ভালো লাগছে না-না? আচ্ছা আচ্ছা, সরোদ দিচ্ছি-আমজাদ আলি-চলবে তো?

[ সাহেব পেছনে ফেরে। জামগাছের তলায় টেপরেকর্ডারের কাছে গিয়ে ক্যাসেটটা বদলে দেয়। গানের বদলে এবার বাজনা শোনা যায়। একসময় সাহেব চেঁচিয়ে ওঠে ]

সাহেব। শোনো শোনো- বাজনাটা শোনো একবার। কই কৃষ্ণচূড়া-কই পাকুড়, বট কোথায়? কই গো আম-জাম-নিম! আশ্চর্য, তোমাদের মুখে রা নেই কেন? কী হল অশথখুড়ো তুমিও তো কিছু বলছ না দেখছি-

[ অন্ধকারে সাহেব চারপাশে তাকায়। আর ওই তখনই সাহেবের মাথায় টুপির ওপরে কিছু একটা টুপ করে পড়ে। সাহেব চমকে যায়। তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে টেপটা বন্ধ করেই চারপাশে তাকায় ]

সাহেব। (চমকে) কে-!

অশ্বত্থ। (অন্ধকারেই গলা ভেসে আসে) আমি-

সাহেব। (স্বস্তি নিয়ে) ও অশথখুড়ো? (একটু হেসে) কী ব্যাপার, তোমরা কেউ কথা বলছ না আমার সঙ্গে!

অশ্বত্থ। কেন বলব! তুমি আমাদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করবে আর আমরা তোমার সঙ্গে কথা বলব-!

সাহেব। (অবাক) ষড়যন্ত্র! আমি আবার কী ষড়যন্ত্র করলাম তোমাদের সঙ্গে? আমি তো তোমাদের ভালোবাসি-

অশ্বত্থ। ভালোবাসতে। এখন আর বাসো না। না হলে আমাদের বাচ্চাগুলোকে ধরে ধরে তুমি বেঁটে বামুন করে রাখছ-আমাদের স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে তুমি নষ্ট করে দিচ্ছ-

সাহেব। (হেসে) ও এই কথা! এ জন্য তোমরা এমন নীরব। কিন্তু এ তো তোমাদের ভালোর জন্যই করছি-

অশ্বত্থ। ভালোর জন্য!

সাহেব। নিশ্চয়ই। পৃথিবীতে খুব শিগগিরই এমন দিন আসবে, যখন শহরের মানুষ আর তোমাদের দেখতে পাবে না শহর জুড়ে, তখন শুধু বাড়ি আর বাড়ি। প্রকৃতি দেখতে মানুষকে ছুটতে হবে দেড়-দুশো কিলোমিটার দূরে। তাও তোমাদের ঠিকমতো পাওয়া যাবে কি না কে জানে, তাই মানুষ যাতে ড্রইংরুমে বসেই দেখতে পায় সেজন্যই তোমাদের ছোটো করতে চাইছি। না হলে তো তোমরা হারিয়ে যাবে-

অশ্বত্থ। না সাহেব, আমরা হারাব না। আমরা হারাতে পারি না। আমরাই পৃথিবীর প্রথম প্রাণ। কোটি কোটি বছর ধরে বেঁচে আছি, তোমরা আমাদের ধ্বংস না করে ফেললে আমরা থাকবই-তোমাদেরও বাঁচিয়ে রাখব।

সাহেব। (ভুরু কুঁচকে) আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে!

অশ্বত্থ। নিশ্চয়ই। তোমরা যে প্রতিদিন গ্যালন গ্যালন বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়াচ্ছ সেগুলি আমরাই তো গিলে নিচ্ছি। না হলে কি এখনও বেঁচে থাকতে তোমরা!

[ সাহেব চুপ করে থাকে। অশ্বত্থ আবারও বলে যায় ]

অশ্বত্থ। এখন আমাদের ছোটো করে রাখলে দূষণের হাত থেকে তোমাদের বাঁচাবে কে! সেটা ভেবে দেখেছ- (একটু থেমে) আচ্ছা সাহেব, তোমার নাতিটার বয়স কত?

সাহেব। (কী ভেবে) কেন এই মার্চে এবার চারে পড়বে।

অশ্বত্থ। তবে আর কী, দাও না একটা ইনজেকশান ঢুকিয়ে ছেলেটার শরীরে, ছেলেটা একটা বাঁটকুল বামুন হয়ে যাক-

সাহেব। (ভয়ে) না না, না। এ কী বলছ তুমি অশথখুড়ো!

অশ্বত্থ। কেন, খারাপ তো বলিনি-

[ অশ্বত্থের কথা বলার মাঝেই এবার পাকুড়, বট, কৃষ্ণচূড়া, আম, জাম ও নিমেরা পরপর বলে ওঠে ]

পাকুড়। হ্যাঁ দাও না একটা ইনজেকশান ঢুকিয়ে সাহেব-

বট। তোমার নাতিটাকে বাঁটকুল করে দাও না সাহেব-

কৃষ্ণচূড়া। হ্যাঁ তাই দাও সাহেব-

নিম। নাতি তোমার বাঁটুল!

আম। নাতি তোমার বাঁটকুল!

সাহেব। (আতঙ্কে) নাহ। না না। না না…

[ প্রায় পাগলের মতো দৌড়ে সাহেব বেরিয়ে যায় মঞ্চ থেকে। মঞ্চে হো হো করে হাসি ওঠে ]

পঞ্চম দৃশ্য

[ মঞ্চসজ্জা একইরকম। বাগানের দৃশ্য। তবে এখন আর অন্ধকার নেই সেখানে। পাখিরাও ডাকছে। বাতাসও বইছে। মৌমাছি ও প্রজাপতিরা উড়ছে। কাঠবেড়ালি ছুটছে।

পরদা উঠতেই দেখা যাবে পেয়ারা কিছু বলছে বট-অশ্বত্থ-কৃষ্ণচূড়াকে ]

পেয়ারা। (উত্তেজিত হয়ে) হ্যাঁ খুড়ো, এই দেখে এলাম আমি- সাহেব তার বনসাই করার পটগুলো সব ছুঁড়ে ছুঁড়ে ভেঙে ফেলছে-

বট। তাই নাকি!

কৃষ্ণচূড়া। আর যে চারাগুলো বামুন করার জন্য তুলে নিয়ে গিয়েছিল-

পেয়ারা। না না সেগুলোকে আবার বাগানেই নাকি লাগিয়ে দেবে-

বট। (আনন্দে) যাক বাবা, বিপদ কাটল তাহলে-

কৃষ্ণচূড়া। কাটল মানে- অশথখুড়ো বুদ্ধিটা না খাটালে কি আর কাটত-!

[ নেপথ্যে শোনা যায় একটা গিটারের মধুর আওয়াজ। তারপরেই মঞ্চে ঢোকে সাহেব। কাঁধে একটা হাওয়াইয়ান গিটার। মৃদুস্বরে বাজাচ্ছে সে। গানও গাইছে সেই সঙ্গে। বুড়ো অশ্বত্থ বলে ওঠে- ]

অশ্বত্থ। (হেসে) এই যে সাহেব-এসো এসো-এই তো আবার আগের মতোই তোমাকে পেয়েছি আমরা-

সাহেব। (হাসি) হ্যাঁ খুড়ো, আমিও তো আবার আগের মতো ফিরে পেয়েছি তোমাদের-নাও, নাচো খুড়ো- নাচো-নাচো-

অশ্বত্থ। (প্রসন্ন মনে) আরে ধুর! সে বয়স কি আছে আমার! বুকে হাঁপ, পায়ে বাত, নাচো তোমরা নাচো। কই বট, কই পাকুড়-কৃষ্ণচূড়া-আম-জাম-নিম, সাহেব নাচছে, নাচো তোমরা, আনন্দে নাচো-

[ সাহেব নাচতে থাকে। নাচের সঙ্গে সাহেবের মুখে একটি দূষণবিরোধী গানও থাকে। সেই সঙ্গে সাহেবকে ঘিরে নাচে আম-জাম-নিম-বট-কৃষ্ণচূড়ার দল। বাচ্চা বুড়ো সবাই মিলে। আর এই দৃশ্যের উপরেই যবনিকা নেমে আসে ]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *