চমচমকুমার – মনোজ মিত্র

চমচমকুমার – মনোজ মিত্র

রাজা অমৃতকুম্ভ

মহারানি লেডিকেনি

মন্ত্রী ক্ষীরমোহন

সেনাপতি কালোজাম

কবি জলভরা তালশাঁস

পুরোহিত রসমালাই

রাজশ্যালক মালপো

রাজভৃত্য মুড়কি

পরিচারক বাতাসা

গজাবুড়ো

চমচমকুমার

[ ডুগডুগি বাজাতে বাজাতে পর্দার সামনে এল গজাবুড়ো-সঙ্গে চমচম- মানে বাঁদরটা। শেকলে বাঁধা। চমচমের পোশাক-টোশাকে ভারী ছটা, লেজটাও বেশ বাহারি ]

গজা। (দর্শকদের দেখিয়ে) ওই দেখো চমচম, কত লোক তোমায় দেখছে। সবাইকে হ্যালো করো… বলো, হ্যাল্লো-ও-ও…

চমচম। হ্যাপ্পো-ও-ও…

গজা। হ্যাপ্পো না… হ্যাল্লো… হ্যা-ল্লো… গুডমর্নিং…

চমচম। হ্যাপ্পো… হ্যাপ্পো.. হুপহপিং…

গজা। (হেসে, দর্শকদের) পারে না… হ আর প ছাড়া বাংলা-ইংরেজি এক বর্ণও উচ্চারণ করতে পারে না। যা বলবে, সব ওই হ আর প দিয়ে। এই যেমন, আমি হলাম গজাবুড়ো, চমচম ডাকে …

চমচম। হপাহুপো…

গজা। বোঝো গজাবুড়ো হলো হ-পা-হু-পো! (চমচমের গায়ে হাত বুলিয়ে) বাপা চমচম, একটু নাচু দেখাও বাপধন, তোমার সেই ব্রেকডানস…

[ সঙ্গে সঙ্গে নাচ ধরে চমচম। কোমরে শেকল, নাচটা ঠিক খুলছে না। শৃঙ্খলমুক্ত হতে টানাটানি করে চমচম ]

গজা। অ্যাই, অ্যাই! না, ওইটি হবে না। শেকল খোলা যাবে না বাপ চমচম…

চমচম। হপাহুপো, হপাহুপো, হাপ! হাপ!

গজা। ও যতই বলো গজাবুড়ো ছাড় ছাড়… হুঁ হুঁ বাবা, গজাবুড়ো তোমায় চেনে না? ছুটে গিয়ে কার চেয়ারে বসে পড়বে… তারপর তার সর্বনাশ হোক…

চমচম। (চোখ রাঙিয়ে) হপাহুপো, হাপপো পা, হাপপো পা!

গজা। হাপপো পা মানে নাচব না। তা নেচো না! তা বলে আর কাউকে মরতে দেব না অকালে!

[ চমচম গজাকে খিঁচুনি দেয় ]

ও দাঁতমুখ খিঁচিয়ে কোনো লাভ হবে না। রাজামশায়ের হুকুম, যাবজ্জীবন তোমাকে বেঁধে রাখতে হবে। (দর্শকদের উদ্দেশে) চিনে রাখো গো বাবুমশায়রা, মিষ্টিপুরের সৃষ্টিছাড়া বাঁদরটাকে ভালো করে চিনে রাখো তোমরা…

[ চমচম ছুটে এসে গজাবুড়োর গালে ঠাস করে এক থাপ্পড় কশায় ]

গজা। অ্যাই, বাঁদরামি হচ্ছে? তোর জন্যে মিষ্টিপুর দেশের কত গন্যিমান্যি মনিষ্যি অকালে পটোল তুলেছে, দেব, বাবুদের বলে দেব বাঁদর?

[ চমচম গজাবুড়োর দাড়ি খামচে ধরে ]

গজা। ছাড় ছাড় বুঝেছি… বাঁদর না, আর বাঁদর বলব না। ভুল হয়ে গেছে বাবা চমচম… চমচমকুমার, নাও, কলা খাও…

[ গজাবুড়ো ঝুলি থেকে কলা দেয়। চমচম শান্ত হয়, দাড়ি ছেড়ে কলা ছাড়িয়ে খেতে বসে ]

গজা। (দর্শককে) দেখছ তো মশাইরা, বাঁদরকে বাঁদর বলা যাবে না!

চমচম। (চোখ পাকিয়ে) হুপ! হুপ!

গজা। থুড়ি! থুড়ি! মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। আর হবে না। চমচমের সব ভালো গো মশাইরা… মজার মজার খেলা জানে, মাথায় বুদ্ধি ধরে… একটাই বিপদ… একনম্বর অপয়া! ওই যে বললাম, কারো খালি সিটে বসল কি তার হয়ে গেল! আচ্ছা একটু গুছিয়ে বলি… ধরো, মশাইরা যে যার চেয়ারে বসে আছ। ধরো, তোমাদের কারুর ইচ্ছে হল, যাই একটু বাইরে গিয়ে সিগারেট ফুঁকে আসি! ধরো গেলে তাই… আর সেই ফাঁকে চমচম গিয়ে বসে পড়ল তোমার খালি সিটে! ব্যস আর দেখতে হবে না, আগামী বুধবারেই তুমি ফিনিস!

চমচম। (কলা খেতে খেতে) হ্রু-হ্রু!

গজা। ওই শোনো, নিজেই বলছে ট্রু-ট্রু! (চাপা গলায়) কত বলব ওর সব্বোনাশা কীর্তির কথা! আমাদের মিষ্টিপুর ইসকুলের হেডস্যার… প্রায়ই ইসকুলে হাজিরা দিতে পারে না… কী করে পারবে, প্রাইভেট টুইশানির ব্যাচ সামলাবে, না ইসকুল করবে… হেডস্যারের চেয়ারটা তাই প্রায়ই খালি পড়ে থাকে… এদিকে চমচমকুমার করল কী, কোন ফাঁকে একদিন ইসকুলে ঢুকে পড়ে বসল গিয়ে সেই খালি চেয়ারে! তারপর কী হল? পরের বুধবারেই হেডস্যারের বউয়ের কপালে সিঁদুর পরা ঘুচে গেল!

চমচম। হাউ হাইপ! হাউ হাইপ!

গজা। চুপ! হাউ হাইপ! অপয়াটার কথা শোনো, হেডস্যারকে সগ্গে পাঠিয়ে বলে কিনা হাউ নাইচ! একটু লজ্জা নেই! …শুধু কি হেডস্যার, বড়ো আদালতের জজসাহেব, হাসপাতালের ডাক্তারবাবু… গাদা গাদা মানী লোককে সাবাড় করেছে ব্যাটা! আবার হাসছে দেখো! বলো মশাইরা, প্রাইভেট প্র্যাকটিশ বন্ধ করে ডাক্তারবাবু কখন সরকারি হাসপাতালের চেয়ার সামলায়! বাঁদরটা তা বুঝবে!

চমচম। হপাহুপো!

গজা। না, থুড়ি, বাঁদর না, চমচমকুমার! তোমার কলা খাওয়া হল?

চলো, রাজবাড়িতে যাই। মহারাজের জন্মদিনে সেখানে আজ মোচ্ছব হচ্ছে! চলো, নাচু দেখাবে, দেদার মন্ডামেঠাই রাবড়ি খাব আমরা!

[ গজাবুড়ো হাঁটা শুরু করে। পা পড়ে চমচমের কলার খোসার ওপর। গজাবুড়ো পা হড়কে পড়ে যায় ]

গজা। বাবারে… গেছিরে… গেছি গেছি! রাস্তার ওপর কলার খোসা ফেলে রেখেছিস কেন রে বাঁদর?

[ গজাবুড়োর মুঠি থেকে শেকল ছিটকে গেছে। চমচম শেকলটা টেনে নিয়ে আনন্দে লাফায় ]

চমচম। হ্রি! হ্রি!

গজা। ফ্রি! অ্যাঁ! তাইতো বাঁদরটা যে ফ্রি হয়ে গেল!

চমচম। হ্রি! হ্রি! হপাহুপো… হাই হাই…

[ চমচম হাত নেড়ে ছুটে বেরিয়ে গেল

গজা। না, না, বাই বাই না। চমচম…ও বাপ চমচমকুমার, রাবড়ি খাবে না? [ দর্শককে ] সাবধান… কেউ চেয়ার ছেড়ে উঠবে না! খালি চেয়ার দেখলেই বসে পড়তে পারে! এঁটে বসে থাকো মশাইরা। চমচম… চমচম.. ওঃ! কার যে প্রাণ নেবে আজ সব্বোনেশে বাঁদরটা…

[ গজাবুড়ো চমচমকে ধরতে বেরিয়ে গেল। এবার পরদা খুলে গেল। মিষ্টিপুর দেশের রাজসভা। দুই রাজভৃত্য মুড়কি ও বাতাসা বাজনা বাজাতে বাজাতে ঢুকল ]

মুড়কি। জয় মিষ্টিপুরের জয়!

বাতাসা। জয় মিষ্টিপুরের মহারাজা অমৃতকুম্ভের জয়।

মুড়কি। …মিষ্টিপুরে আজ মহাফুর্তি…

বাতাসা। মহারাজের শতবর্ষপূর্তি…

মুড়কি। চল এসো.. যে যেখানে আছ.. কচিকাচারা বুড়োবুড়িরা কেউ করো না লেট…

বাতাসা। মেঠাই খেয়ে যাও… আর-এস-ভি-পি.. যাকে বলে রসগোল্লা সন্দেশ ভরপেট…

মুড়কি। ভাইসব মহারাজ অদ্য পা দিলেন একশো একে…

বাতাসা। একশো একটা ঠাসা প্রোগ্রাম, শোনো শুরু থেকে…

মুড়কি। প্রথমে ফুলচন্দনে অমৃতবরণ…

বাতাসা। প্রদীপ প্রজ্বলনে মন্ত্রী ক্ষীরমোহন…

মুড়কি। মাল্যদানে মালপো… রাজার শালা… পঞ্চমবারে মাধ্যমিক পাশ…

বাতাসা। মুখে মুখে পদ্য ছড়াবেন রাজকবি জলভরা তালশাঁস…

মুড়কি। নৃত্যগীতে কে? …কে? কে? কুইন লেডিকেনি…

বাতাসা। মিষ্টিপুরের চোদ্দো বছরের মহারানি…

মুড়কি। বাজা বাজা… জোরসে বাজা… মুড়কি বাতাসার বাজনা শুনে রাজসভায় আসছেন রাজা…

[ মুড়কি ও বাতাসা নেচে নেচে বাজায়। হঠাৎ রাজসভায় ঢুকে পড়ে চমচম ]

বাতাসা। মুড়কিরে ওই দ্যাখ… সেই গজাবুড়োর বাঁদরটা… চমচম…

মুড়কি। তাড়া তাড়া ধর ধর…

বাতাসা ও মুড়কি। হেই! হেই!

[ মুড়কি ও বাতাসা তেড়ে যায়। কিন্তু চমচমকে ধরা সোজা না। বাঁদুরে লম্ভঝম্ভ শুরু করে দেয়। বাতাসা চমচমের লেজ টেনে ধরে। চমচম তার গালে চড় হাঁকিয়ে চড়ে বসে সিংহাসনে ]

মুড়কি। (আঁতকে ওঠে) সিংহাসনে বসেছে! বাতাসারে রাজামশাইয়ের হয়ে গেল!

বাতাসা। কী হয়ে গেল মুড়কি ভাই?

মুড়কি। ওরে ইসকুলের হেডস্যারের যা হল… হাসপাতালের ডাক্তার সাহেবের যা হল… অফিসটাইমে খালি চেয়ারে বসলে যা হয়…

বাতাসা। আরে সে তো অফিসের চেয়ার! রাজসভা কি অফিস নাকি?

মুড়কি। অফিসই তো… রাজসভা রাজার অফিস! সকাল দশটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত রাজামশায়ের অফিসটাইম! এখন বারোটা বাজে… চেয়ার ফাঁকা! চমচম রাজামশায়ের খালি চেয়ারে বসেছে রে!

বাতাসা। অ্যাঁ! বুধবারেই রাজামশাই ফিনিশ!

চমচম। হ্রু… হ্রু…

বাতাসা। আয় তো বাঁদরটাকে ঠ্যাঙাই…

মুড়কি। আর ঠ্যাঙালেও যা, না ঠ্যাঙালেও তাই! রাজামশাই আর নাই! ও রাজামশাইগো…

[ মুড়কি কাঁদতে কাঁদতে ছুটে বেরিয়ে যায়। সিংহাসনখানা বেশ পছন্দ হয়েছে চমচমের। পা তুলে আরাম করে বসে ]

চমচম। হাউ হাইপ! হাউ হাইপ!

[ ঘন্টা বাজাতে বাজাতে ফুলচন্দনের মালা হাতে রাজপুরোহিত রসমালাই মন্ত্র পড়তে পড়তে ঢোকে। মন্ত্রপাঠ করছে তাই চোখ বন্ধ ]

রসমালাই। ওঁ হ্রীং হ্রীং হ্রীং… আং হুং ক্রীং ক্রীং… মহারাজের শততম জন্মদিন…

[ সিংহাসনে বসা চমচমের গায়ে ফুল ছড়াতে ছড়াতে ]

হ্যাপি বার্থডে, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ মাই লর্ড,

লেট আস প্রে টু হরি আল্লা গড,

ইয়ে দিল মাঙ্গে মোর

হানড্রেড ইয়ারস মোর…

[ রসমালাই-এর টিকি খামচে ধরে চমচম ]

রসমালাই। উরিরি… প্রভু, কী অপরাধ করলাম? বেলা বারোটার মহালগ্নে বরণ করতে এলাম… উরি, আর টানবেন না, আমি আপনার চির অনুগত পুরুত রসমালাই…

চমচম। (টিকি টানতে টানতে) হপহাপাই… হি-হি হপহাপাই…

রসমালাই। হপহাপাই কী বলছেন প্রভু, আমি রসমালাই…

বাতাসা। ঠাকুরমশাই, চোখ মেলে দেখুন…

রসমালাই। কে? বাতাসা নাকি? জানিসনে, চোখ বন্ধ করে মন্তর পড়তে হয়। এখনও মন্তর শেষ হয়নি। ছাড়ুন প্রভু, মন্তরে ভুল হয়ে থাকলে পা ধরছি…

[ চমচমের পা ধরে ]

একী! গরমকালে ভরদুপুরে পশমের মোজা পরেছেন কেন? পাগলেরও এত গণ্ডগোল হয় না প্রভু…

[ রসমালাই চোখ খুলে চমকে ওঠে ]

কেরে!

বাতাসা। চমচম!

রসমালাই। ব্যোম ব্যম পটকা বোম… মাই গড, এ যে জ্যান্ত যম!

[ রসমালাই লাট্টুর মতো পাক খেতে খেতে ঢলে পড়ে বাতাসার ঘাড়ে। দুজনে ভূতলশায়ী হয়। মহারাজ অমৃতকুম্ভকে নিয়ে মুড়কি ঢোকে ]

মুড়কি। (সিংহাসনে চমচমকে দেখিয়ে) ওই… ওই দেখুন মহারাজ… এখনও বসে রয়েছে।

[ আতঙ্কে বৃদ্ধ মহারাজের চোয়াল গেছে ঝুলে, চোখ ঠিকরে রেরুচ্ছে। লাঠি ভর দিয়ে সিংহাসনের কাছে যায়। মহারাজ ভালো করে চমচমকে দেখে- ]

অমৃত। ওঃ!

মুড়কি। প্রভু…

অমৃত। ওঃ! ওহোহো… আজ কী বার?

মুড়কি। প্রভু… মঙ্গল!

অমৃত। খাটে তোল… রাত পোহালেই বুধবার… খাটে তোল! খাটে তোল! কী করলি বাপ চমচম…

মুড়কি। বাপ কাকে বলছেন? অপয়া!

অমৃত। আমি তো গয়া! ওঃ সবে মাত্তর একশো পূর্ণ করলাম… ভাবছিলাম এবার একটু গুছিয়ে রাজত্ব করব। চব্বিশঘণ্টাও টাইম দিলিনে বাপধন।

চমচম। হাউ হাইপ! হাউ হাইপ!

অমৃত। ওঃ! আমার এত মিনিস্টার অ্যামবাসাডর গভর্নর অফিসার ইঞ্জিনিয়ার কনট্র্যাকটর… সবার চেয়ারই অর্ধেক সময় খালি পড়ে থাকে… সব্বাইকে ছেড়ে আমার পেছনেই লাগলি!

[ অমৃতকুম্ভ হাপুস নয়নে কাঁদে। মুড়কি বাতাসাও কাঁদে ]

অমৃত। ওরে রানি কোথায়? আমার লেডিকেনি?

মুড়কি। আজ্ঞে রানিমা কুঞ্জবনে এক্কাদোক্কা খেলছেন!

অমৃত। খেলুক, খেলুক! ঘণ্টা কয়েক খেলে নিক! ওঃ আর কতক্ষণই বা খেলবে! ওকে এসব কিছু বলিস না! ওঃ! কাল থেকে গয়না পরতে পারবে না, মাছ মাংস খেতে পারবে না… ভাবতে পেরেছিলি, এত তাড়াতাড়ি আমায় পাততাড়ি গোটাতে হবে রে মুড়কি বাতাসা…

[ রসমালাই ভূমিশয্যা থেকে উঠে বসে গায়ের ধুলো ঝাড়ে ]

রসমালাই। যাকগে, দুঃখু করার কিছু নেই। কম দিন তো বেঁচে গেলেন না! টু টেল ইউ ফ্র্যাঙ্কলি, আপনার মরার বয়েস অনেক দিন আগেই পেরিয়ে গেছে মহারাজ…

অমৃত। পেরিয়ে গেছে! তা পেরিয়েই যখন গেছে, নতুন করে মরার কথা উঠছে কেন রসমালাই? ওঃ দেশের কতো ডেভলেপমেন্ট ভেবে রেখেছি…

রসমালাই। আর ভাবতে হবে না, এখন পরলোকের কথা ভাবুন। হাতে আছে মাত্তর ঘণ্টা কয়। কাল আপনার সৎকারের কী ব্যবস্থা হবে বলুন। আপনার কী ইচ্ছে, কাঠ না ইলেকট্রিক চুল্লি? আমার দক্ষিণেটা কি অ্যাডভানস করে দেবেন? যাবার বেলায় আমার মতো পবিত্র পুরোহিতকে যথেষ্ট দানধ্যান করে যান। বাইদি বাই, রাজত্বিটা কাকে দিয়ে যাবেন ভাবছেন?

অমৃত। কারো সব্বোনাশ, কারো ফাগুনমাস! ওঃ রসমালাই…

চমচম। (হি হি করে হাসে) হাপুপ হাপ!

মুড়কি, বাতাসা। (চমচমকে) চো-ও-প!

চমচম। (পালটা ধমক দেয়) হো-ও-প!

[ হেনকালে সভাঘরে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে গজাবুড়ো চমচমের শেকলটা ধরে তাকে টেনে নামিয়ে নিয়ে পালাবার চেষ্টা করে। ]

মুড়কি, বাতাসা। ওই তো… গজাবুড়ো… গজাবুড়ো…

অমৃত। পাকড়ো… পাকড়ো…

[ বাতাসা মুড়কি ছুটে গিয়ে গজাবুড়ো আর চমচমকে ধরে নিয়ে আসে অমৃতকুম্ভের সামনে ]

অমৃত। ওঃ! গজা…

গজা। এবারটা মাপ করে দাও গো প্রভু… আর হবে না!

রসমালাই। আর হলেও বা কি, না হলেও বাকি! প্রভুর তো যা হবার হয়ে গেল!

অমৃত। তুই মুচলেকা দিয়েছিলি, কক্ষনো শেকল হাতছাড়া করবিনে! দিসনি?

গজা। আজ্ঞে মুচলেকা দিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু কলার খোসা যে মুচলেকা দেয় না প্রভু-

অমৃত। কলার খোসা দেখাচ্ছিস! ওঃ! তোদের দুটোর খোসা ছাড়িয়ে নেব আজ! মুড়কি বাতাসা… মেরে ধুলো উড়িয়ে দে তো!

গজা। মারলে মারো- কিন্তু দোষ তো তোমারই! সিংহাসনটাই বা খালি রেখেছিলে কেন এত বেলা পর্যন্ত? দশটায় রাজসভার কাজ শুরু হবার কথা, এখন কটা বাজে খেয়াল আছে?

চমচম। হ্রু! হ্রু!

অমৃত। দশটা! ওঃ! দশটায় কাজ শুরু করব আমি!

গজা। যার যা কাজ তা না করলে, চমচম তার কাজ করে যাবে, হুঁ! চেয়ার খালি থাকলেই বসে পড়বে!

মুড়কি। চুপ! মহারাজ পড়েছেন একশো একে…

বাতাসা। দেহ গেছে এঁকেবেঁকে…

মুড়কি। মাথার চুল চোখের ছানি সব যাঁর গেছে পেকে…

বাতাসা। চলেন ফেরেন লাঠি ঠুকে… হাঁপি ধরে থেকে থেকে …

অমৃত। কর্মসংস্কৃতি শেখাতে এলি তাকে! ধর তো গজাটাকে-

রসমালাই। আর চেঁচামেচি করে লাভ কী প্রভু? টাইম ইজ ভেরি সর্ট! কাল বুধবারে আপনি যাচ্ছেন ধরে নিয়ে তাড়াতাড়ি রাজ্যপাটের বিলিবন্দোবস্ত করে দিন মাই লর্ড! কিং ইজ ডেড, লং লিভ দি কিং! কুইক মাই লর্ড কুইক!

অমৃত। ওঃ! এই ইংলিশ মিডিয়মে পড়া পুরুতটাকে দূর করে দে সামনে থেকে। এ তো দেখছি আমি মরে গেলে বাঁচে!

গজা। রেজিগনেশন দিলে কিন্তু বেঁচে যাবে গো রাজা!

রসমালাই। কী হয়েছে?

গজা। হ্যাঁগো, হেডস্যারও মরত না, যদি চমচম চেয়ারে বসার পর হেডস্যার বুদ্ধি করে অন্য কাউকে চেয়ারটা ছেড়ে দিত! মোটকথা, বুধবারে চেয়ার যার, সব্বোনাশ তার!

[ অমৃতকুম্ভ সোজা হয়ে বসে ]

অমৃত। কানের কাছে এসে বেশ বুঝিয়ে বল তো গজা, কী বল তে চাইছিস…

গজা। প্রভু, এখুনি যদি রাজাগিরি ছেড়ে দিয়ে অন্য কাউকে রাজা বানিয়ে সিংহাসনে বসিয়ে দিতে পারো, তুমি বেঁচে গেলে, বুধবারে ফুটবে সেই!

চমচম। হুপপে হেই! হ্রু! হ্রু…

অমৃত। বটে! বটে! এই তো একটা পথ পাওয়া গেছেরে মুড়কি বাতাসা…এখুনি কাউকে রাজত্ব ছেড়ে দেব, কাল বুধবারে সে ফুটে গেলে, বেষ্পতিবারে আবার আমি সিংহাসনে চড়ে বসব!

রসমালাই। (বিরস মুখে) এত ঝঞ্ঝাটে যাচ্ছেন কেন প্রভু? এ ফালতু সিংহাসনের মায়া ছেড়ে যান না চলে কিংডম অব হেভেনস… সেখানে আপনার জন্যে খালি পড়ে আছে থ্রোন অফ হরি আল্লা গড!…

অমৃত। চোপ!

চমচম। হো-ও-প!

অমৃত। কিন্তু কাকে বসাই সিংহাসনে! কাকে…

গজা। যাই করো রাজা, কথাটা যেন পাঁচ কান না হয়। জানাজানি হয়ে গেলে আর কিন্তু কেউ রাজা হতে চাইবে না!

চমচম। হপ হিপ্রেপ!

অমৃত। কী বলছে!

গজা। টপ সিক্রেট!

অমৃত। হ্যাঁ টপ সিক্রেট! মুড়কি বাতাসা, টপ সিক্রেট!

চমচম। হপাহুপো…

[ চমচম গজাবুড়োর কানে বিড়বিড় করে ]

অমৃত। কী! কী! আবার কী বলছে…

গজা। বলছে, বাইরের কাউকে না… যাকেই বসাও সে যেন তোমার হাতের লোক হয়। বাইরের লোক রাজা হয়ে মরলে তোমার সুবিধে হবে না। তার ছেলেপুলে সিংহাসনের দাবিদার হয়ে বসবে!

অমৃত। ঠিক! ঠিক! ওঃ কী বুদ্ধি তোর চমচমের… আমার পাকা মাথাতেও এটা আসেনি!

চমচম। হপাহুপো, হাপপি!

অমৃত। হাপপি? হাপপি কী?

গজা। রাবড়ি! বলছে এত বুদ্ধি দিলাম, রাবড়ি খাব না?

অমৃত। খাবি, খাবি। দেব, সব দেব! আগে বল তো, নিজের লোক কাকে যমের বাড়ি পাঠাই চমচমকুমার-

রসমালাই। মহারাজ, আমি থাকতে আপনি কিনা ওই বাঁদরটার কাছে পরামর্শ চাইছেন। দিস ইজ টু মাচ! আমি বলছি এমন কাউকে বাছুন যে মরে গেলে আপনার কোনো দুঃখু হবে না!

অমৃত। তাহলে তুমি!

রসমালাই। হোয়াই? ইউ মীন মি?

অমৃত। হুঁ, তুমি আমার হাতের লোক। তা ছাড়া তুমি মরে গেলে আমার কোনো দুঃখু হবে না।

রসমালাই। (ডুকরে কেঁদে ওঠে) ও মাই লর্ড!

মুড়কি। কাঁদছেন কেন ঠাকুরমশাই, নিজেই তো দানসামগ্রী চাইছিলেন… রাজত্বির চেয়ে বড়ো সামগ্রী আর কী আছে?

রসমালাই। এত বড়ো কে চেয়েছে? সে তো কত লোক কত কী চায়, তা বলে সবাইকে কি সব কিছু দিতে হয়? মহারাজ, ফোরটিন ফাদার কেউ কখনো রাজত্বি করেনি… কী করে রাজত্বি চালাতে হয় জানিনে!

বাতাসা। বেশিক্ষণ চালাতে হবে না-চব্বিশঘণ্টাও নেই ঠাকুরমশাই…

অমৃত। ওরে ধরাধরি করে ওকে সিংহাসনে বসিয়ে দে… কুইক! কুইক!

[ মুড়কি ও বাতাসা রসমালাইকে ধরতে যায় ]

রসমালাই। দাঁড়া, কাপড়টা রাজামশায়ের মতো আঁটো করে পরে নি…

[ রসমালাই কাছা খুলে চোঁ চা দৌ৺ড় লাগায়

অমৃত। পাকড়ো… পাকড়ো… জলদি পাকড়ো…

[ মুড়কি ও বাতাসা রসমালাইকে ধরতে বেরিয়ে যায়

চমচম। (অমৃতকে) হাপা, হাপপি! হাপপি!

অমৃত। (খিঁচিয়ে) হবে হবেরে বাবা রাবড়ি হবে। আগে সিংহাসনটা কাউকে গছাই! ঘণ্টা খানেক ঘুরে আয় তোরা।

চমচম। ওপে! ওপ্পে…

অমৃত। ওঃ! এ কী ভাষা! কী বলছে?

গজা। বলছে ও-কে! ও-ক্কে! তাহলে একপাক ঘুরেই আসছি আমরা রাজা! [ গজাবুড়ো ও চমচম বেরিয়ে গেল

অমৃত। কে! কে নিবি সিংহাসন। আয়, চলে আয় (কাঁদতে কাঁদতে গানই গেয়ে ওঠে) কে নিবি ও ভাই, কে নিবি… এ সুযোগ আর পাবিনে… বল ভাই কী দাম নিবি…

[ অমৃতকুম্ভ দেখল রসমালাইয়ের ঘণ্টা পড়ে রয়েছে। সেটা কুড়িয়ে পাগলের মতো বাজাতে লাগল- ]

আ যা… আ যা… কৌন বনেগা ক্রোড়পতি… থুড়ি নরপতি… জলদি আযা

[ গাঁদা ফুলের মালা হাতে রাজার শালা ছোকরা মালপো ঢোকে ]

মালপো। বুড়োটা ক্ষেপে গেল নাকি! জামাইরাজা, ঘণ্টা বাজাচ্ছ কেন?

অমৃত। মালপো বাবু… শালাবাবু, আমার ঘণ্টা পড়ে গেছে তাই ঘণ্টা বাজাচ্ছি! আমার রাজত্বের আজ শেষ দিন…

মালপো। আর চুপকি দিয়ো না। সেই কবে থেকে বলছ শেষদিন শেষদিন… তোমার ক্যালেন্ডারে শেষ দিন বলে কিছু আছে? নাও জন্মদিনের মালাটা পরো…

[ রাজার গলায় মালা পরায় মালপো ]

অমৃত। দাও, মালা দাও মালপোবাবু, যদিও তুমি আমার নাতির বয়েসি, তবু তুমি আমার বড়োশালা, গুরুজন! তোমার শুভেচ্ছা বিনা এ যাত্রা রক্ষে পাব না।

মালপো। দ্যাখো জামাইরাজা, তুমি আমার ভগ্নীপতি হলেও সাফসাফ বলছি, তুমি রক্ষে পাও আমি চাইনে।

অমৃত। চাও না?

মালপো। কেন চাইতে যাব? কথা রয়েছে তুমি টেঁসে গেলে আমি সিংহাসনে বসে পড়ব। কই টাঁসছ? দিব্যি ব্যাটিং করে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে দিলে! আর কত মালা গলায় ঝোলাবে! ছাড়ো, ন লক্ষ নিরানব্বই হাজার নশো নিরানব্বই পাত্তি ছাড়ো দেখি।

অমৃত। একটাকা কম দশলাখ। দেব, যে যা চাইবে সব দিয়ে দেব আজ। কিন্তু হঠাৎ এত টাকা কী হবে মালপোবাবু?

মালপো। হবে কী, হয়ে গেছে। জন্মদিনে মালা পরালাম, মালার মাল্লু ছাড়বে না?

অমৃত। আমার জন্মদিনে গলায় মালা পরাবে, তার দামও আমায় দিতে হবে! ওঃ! এই একটা বাসি গ্যাঁদার মালার জন্যে দশলাখ!

মালপো। বাজারের খোঁজ রাখো? তোমার শতবর্ষে মালা কেনার হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে!। ফুলের বাজার হেভি চড়ে গেছে। তোমার এক একটা জন্মদিন পালনে যেভাবে মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে… এরপর দ্রব্যমূল্য ওই আকাশে গিয়ে ঠেকবে…

[ সেনাপতি কালোজাম প্যারেড করে ঢুকে স্যালুট ঠোকে ]

অমৃত। সেনাপতি কালোজাম! এই পচা গ্যাঁদার মালাটির দাম কত হতে পারে?

কালোজাম। দশ পয়সা।

অমৃত। খুব বেশি হলে?

কালোজাম। খুব বেশি হলে… দশ পয়সা।

অমৃত। ধরো কোনো কারণে যদি বাজার আগুন হয়…?

কালোজাম। বাজার আগুন হলে.. দশ পয়সা!

অমৃত। ভেবে বলো কালোজাম, কোনো দেশে কোনো কালে এর দাম দশলাখ হতে পারে…

কালোজাম। (তরবারি বার করে গর্জে ওঠে) কোন খচ্চর বলে? কচুকাটা করব!

মালপো। এই যে সেনাপতি কেলেজাম, আমি বলেছি, কচুকাটা করবে না?

[ কালোজাম মাথা নেড়ে তরবারি খাপে ঢুকিয়ে দেয় ]

ছাড়ো, মাল্লু ছাড়ো…

অমৃত। যেভাবে দিনকে দিন তুমি আমার রাজকোষ ধসাচ্ছ, এরপর তোমাকেই কিন্তু আমি সিংহাসনে বসিয়ে দিতে পারি মালপো…

মালপো। দাও না বসিয়ে। বসব বলে হাত পা ধুয়ে বসে আছি! আর কদ্দিন ঝোলাবে?

অমৃত। বসালে ঠেলা বুঝবে! কিন্তু বসাব না! হাজার হোক তুমি রানি লেডিকেনির দাদা! আমার বড়কুটুম। যাও, তোমায় নির্বাসন দিলাম। সেনাপতি কালোজাম, ওকে এখুনি মিষ্টিপুরের বাইরে রেখে এসো…

কালোজাম। (গর্জে ওঠে) চল তোকে বাইরে নিয়ে গিয়ে কচুকাটা করে রেখে আসি!

মালপো। অপমান! চাকরবাকর দিয়ে অপমান! ঠিক আছে, এখুনি আমার বোনকে নিয়ে যাচ্চি! (চেঁচিয়ে) লেডিকেনি, লেডিকেনি চলে আয় বোনটি… এই দ্যাখ জামাইরাজা আমাদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে…

অমৃত। না, না, মালপোবাবু, ছিঃ সত্যি সত্যি তা কি আমি পারি? শ্বশুরের পো মালপো বলে কথা! ছেলেপুলে নেই, তুমি আমার উত্তরাধিকারী! যাও, সিংহাসনে চড়ে বসো!

মালপো। ইয়ার্কি দিয়ো না জামাইরাজা, সত্যি সত্যি চড়ে বসব কিন্তু…

অমৃত। বসো না! তুমি বসলে দেশও বাঁচে, দেশের রাজাও বাঁচে! না, না, এ সুযোগ আমি ছাড়ব না! সেনাপতি কালোজাম, গার্ড অব অনার দিয়ে রাজা মালপোকে সিংহাসনে তোলো…

[ কালোজাম বিউগিল বাজিয়ে মালপোর সামনে প্যারেড করতে শুরু করে। মন্ত্রী ক্ষীরমোহন ফুলের তোড়া হাতে হন্তদন্ত হয়ে ঢোকে ]

ক্ষীরমোহন। একী! এসব কী হচ্ছে মহারাজ!

অমৃত। আমি না… ওই যে তোমাদের নতুন মহারাজ মন্ত্রী ক্ষীরমোহন! মহারাজ মালপোর আজ অভিষেক। দাও দাও উলু দাও সেনাপতি কালোজাম… (বিউগিল ছেড়ে উলু দেয় কালোজাম)

ক্ষীরমোহন। কখন ঠিক হল এসব-? সিংহাসন ছেড়ে দেবেন, আমি তো কিছুই জানি না।

অমৃত। কখন জানাব? শিয়রে শমন, সময় কোথায়? আর অনেক দিন তো রাজত্ব করলাম ক্ষীরমোহন… আসুক না শাসনকার্যে নতুন ব্লাড!

ক্ষীরমোহন। মহারাজ আমার মতো পোড় খাওয়া রাজনীতিককে ভুলে গিয়ে এমন একজনের হাতে দেশটা তুলে দিচ্ছেন, পাঁচ বারে যে মাধ্যমিক পাশ! তাও হত না… যদি না আপনি স্পেশাল রিভিউ বোর্ড বসিয়ে ঢেলে নম্বর দিয়ে…

মালপো। মেরে চামড়া গুটিয়ে দেব তোমার…

ক্ষীরমোহন। শুনছেন! এইসব রাজার ভাষা!

কালোজাম। (মালপোকে) ফের অসভ্য কথা বললে কচুকাটা করে দেব!

অমৃত। ওঃ! বলুক না, কতক্ষণ বলবে!

মালপো। ভাষা শেখাচ্ছে, ভাষা! মিষ্টিপুরের মাস্তানদের চেনো? পা-কাটা পান্তুয়া আর জি-কাটা জিলিপি! আনছি ডেকে! দেখি, কোন ব্যাটা আমার রাজত্বে বাগড়া মারে!

[ মালপো ছুটে বেরিয়ে যায়

অমৃত। মালপোবাবু, শোনো… ওঃ যাহোক একজনকে ফিট করেছিলাম, দুজনে মিলে দিলে ভেস্তে! এদিকে সময় নেই! সুয্যি ডোবার আগে যাকে হোক একজনকে সিংহাসনে বসাতেই হবে!

ক্ষীরমোহন। বসাতেই হবে? তবে আমায় বসাচ্ছেন না কেন প্রভু! শক্ত হাতে দেশ শাসন করব! পাঁচমিনিটের মধ্যে মালপোর মাস্তানরাজ খতম করব।

অমৃত। পাঁচ মিনিটের মধ্যে করবে? সে তো আমার পক্ষে খুব ভালো হয়। বেষ্পতিবারে সব ঠান্ডা! যাও, উঠে বসো। কালোজাম, উলু উলু…

[ কালোজাম উলু দেয়। কবি জলভরা তালশাঁস ছুটে আসে ]

জলভরা। শাসন দমন নহে, মেলাতে পারো ছন্দ?

কবিই কেবল জানে ঘোচাতে যত দ্বন্দ্ব।

-প্রভু, আমাকে একবার বসিয়ে দেখুন… আজ কবি ছাড়া কেউ এদেশ রক্ষে করতে পারবে না!

ক্ষীরমোহন। কী ব্যাপার! কবিতা লেখা ছেড়ে রাজা হতে চাও নাকি কবি জলভরা তালশাঁস? দেশ চালানোর ক্ষ্যামতা আছে তোমার…

জলভরা। হা-হা-হা কবির অসাধ্য কী, ওগো মন্ত্রীভায়া,

কল্পনায় গড়ি দিব স্বপ্নের ইউটোপিয়া!

ক্ষীরমোহন। গুষ্টির পিণ্ডি! তোমার যে সিংহাসনে নজর আছে, আগে জানতাম না!

জলভরা। (সিংহাসনের দিকে তাকিয়ে)

সিংহাসন অনুক্ষণ মনে মোর পড়ে তব কথা

কখনো দেখি মুদ্রিত নয়নে একাকিনী

তুমি সতী কান্দিতেছ মোর নাম স্মরি…

তোমা লাগি ওগো জাগরণে যায় বিভাবরী!

ক্ষীরমোহন। অ্যাই অ্যাই! কার লেখা? প্রত্যেকটা লাইন আমার আগে শোনা! কোথা কোথা থেকে টুকলি করলে?

জলভরা। মন্ত্রীমশাই বুঝিবেন কি তা…

এরে কয় মশলা কবিতা!

কালোজাম। [ তরোয়াল উঁচিয়ে ধেয়ে যায় কবির দিকে ] কচুকাটা করব!

অমৃত। দাঁড়াও দাঁড়াও কাটাকাটি করে লাভ নেই। এই দুজনের একজনকে সিংহাসনে বসালে আমার কাজ মিটে যায়… দুজনের কাকে বসাই…?

ক্ষীরমোহন। আমায় প্রভু…

জলভরা। প্রভু মোরে কেন নয়?

অমৃত। তাইতো কেন নয়? কালোজাম, টস করো…

কালোজাম। টস করে সিংহাসন!

অমৃত। শিগগির করো!

কালোজাম। হেড- কবি জলভরা তালশাঁস, টেল- মন্ত্রী ক্ষীরমোহন!

[ কালোজাম তরোয়ালটা ঘুরিয়ে শূন্যে ছুঁড়ে দেয়। সেটা ঝনঝন করে পড়তেই সবাই ছুটে যায় ]

কালোজাম। (তরোয়াল দেখে) টেল!

ক্ষীরমোহন। (আনন্দে লাফায়) হুররে! হুররে!

জলভরা। তরোয়ালের কোনটা হেড, কোনটা টেল…

কেমন করে ঠিক হল কে পাশ কে ফেল!

ক্ষীরমোহন। যা হবার হয়ে গেছে! আর কিছু হবে না। যাও সরে যাও। জানতাম, সিংহাসন আমার দখলেই আসবে। রাজা হব, আমার কোষ্ঠীতে রয়েছে রাজা হব, হবই!

অমৃত। কোষ্ঠীতে রয়েছে! তা রাজা হয়ে কদ্দিন চালাবে তাও নিশ্চয় রয়েছে!

ক্ষীরমোহন। নিশ্চয়! আমি চল্লিশ বছর চালাব… তারপর আমার পরের চোদ্দোপুরুষ…

অমৃত। তার আগে কাল বুধবারটা তো পার করো…

ক্ষীরমোহন। হে-হে, আমার কোষ্ঠীর ফাঁড়ার কথাটা বলছেন তো?

অমৃত। বলো, কোষ্ঠীতে ফাঁড়া রয়েছে কি না বলো…

ক্ষীরমোহন। সে তো আছেই। রাজ্যলাভের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যুযোগ।

অমৃত। তবে? তবে? তবে?

ক্ষীরমোহন। তবে এই যে!

[ জামার নীচে থেকে একতোড়া মাদুলি টেনে বার করে ক্ষীরমোহন তোড়াটা নাচায় ]

এই যে! এই যে!

অমৃত। ওঃ! এ তো মাদুলি!

ক্ষীরমোহন। তবে? মন্দির মসজিদ মঠ চার্চ হরদুয়ার গুরুদোয়ার… সব দুয়োরের মাটি ভরে কোষ্ঠীর সব ফাঁড়া কাটিয়ে রেখেছি! আমার পরমায়ু আপনার চার-ডবল অমৃতকুম্ভজি!

অমৃত। অ্যাঁ!

জলভরা। ওগো এ তো নয় কেবল মা-দুলি

এ যে বাবা-দুলি, কাকাজ্যাঠা-দুলি

টানা চোদ্দোপুরুষের ঠাকুরমার ঝুলি!

ক্ষীরমোহন। এর মধ্যে সব পাবেন অমৃতকুম্ভজি… যেমন আছে আমার পরমায়ু… তেমনি আছে আপনার নিধনকবচ! এইটায় আপনার ঠ্যাংভাঙা, এইটায় আপনার মাথায় বাজপড়া… এইটায় আপনার কানে পোকামাকড় ঢোকা… মোট কথা আর কোনোদিনও যাতে আমার সিংহাসন কেড়ে নিতে না পারেন…

[ অমৃতকুম্ভ স্তম্ভিত। বুক চেপে বসে পড়ে। বাইরে হট্টগোল। মুড়কি ও বাতাসা দুজনে মিলে রসমালাইকে ঘাড়ে নিয়ে ঢোকে ]

মুড়কি ও বাতাসা। প্রভু, এই যে, পাকড়ে ফেলেছি…

রসমালাই। (পরিত্রাহি চেঁচাচ্ছে) আমি রাজা হব না… অন হরি আল্লা গড, রাজা হব না…

ক্ষীরমোহন। তোমাকে হতে হবে না! হব আমি! নামো, আমাকে বরণ করে সিংহাসনে বসিয়ে দাও ঠাকুর রসমালাই…

রসমালাই। ওঃ! বেঁচে গেলাম! ইফ হরি সেভস ইউ, হু ক্যান কিল ইউ? আসুন ক্ষীরমোহনজি…

অমৃত। না! ও বসবে না! ওকে রাজা হতে দেব না।

ক্ষীরমোহন। সে কী! সবাই দেখেছে, আমি টসে জিতেছি!

অমৃত। চোপ! ফাঁড়া কাটিয়ে রেখেছে! চোদ্দপুরুষ ধরে চালাবে! কাউকে সিংহাসনের কাছে ভিড়তে দেবে না! আমার ঠ্যাংভাঙার কবচ পরে আমার সামনে ঘুরছে! বেরোও তুমি… তোমাকে দিচ্ছিনে… নে ছিঁড়ে নে কবচগুলো!

ক্ষীরমোহন। আমি কিন্তু বিদ্রোহ করব!

কালোজাম। (তরোয়াল উঁচিয়ে তেড়ে যায় মন্ত্রীর দিকে) কচুকাটা করব!

ক্ষীরমোহন। অ্যাই… অ্যাই…

জলভরা। (আনন্দে) বাজা তোরা মাদল বাজা…

আমার ভাগ্যে রাজা সাজা…

[ জলভরা সিংহাসনে বসতে যায়। ক্ষীরমোহন তাকে জাপটে ধরে ]

ক্ষীরমোহন। চালাকি! টসে হেরো-পার্টি সিংহাসনে বসবে! কভি নেহি! আমি বেঁচে থাকতে সিংহাসনের কাছে ঘেঁষতে দেব না।

[ জলভরা তালশাঁসকে হিড়হিড় করে বাইরে টেনে নিয়ে চলেছে ক্ষীরমোহন ]

জলভরা। (যেতে যেতে সিংহাসনের দিকে ঘুরে) বল রে বল সিংহাসন, আর করিসনে ছল…

কার কাছে তুই যেতে চাস, এবার সত্যি করে বল…

[ ক্ষীরমোহন ও জলভরা বেরিয়ে গেল

অমৃত। ওঃ! রসমালাই, দ্যাখো তো কালোজামটার গায়ে মাদুলি কবচ আছে কি না!

কালোজাম। মাদুলি কবচে বিশ্বাস নেই! আছে তরোয়াল! কচুকাটা করব।

অমৃত। খুব ভালো! তালপাতার সেপাই, মানে সেনাপতি হলে কী হয়- তেজ খুব! যে তোমাকে বাধা দেবে, তরোয়াল চালাবে! যাও তোমাকে দিলাম সিংহাসন!

কালোজাম। আমি রাজা হব! রাজা!

অমৃত। মিলিটারি ছাড়া দেশ কে বাঁচাবে, তাই না রসমালাই? দাঁড়িয়ে রইলে কেন, তেলসিঁদুর মাখাও। চল মুড়কি বাতাসা, তাড়াতাড়ি মুকুটটা নিয়ে আসি! সিঁদুর মাখিয়ে হাঁড়িকাঠে তোলার আগে মাথায় মুকুটটা…

মুড়কি। হাঁড়িকাঠ কী বলছেন প্রভু, বলুন সিংহাসন!

অমৃত। অ্যাঁ? হ্যাঁ… হ্রু হ্রু…

বাতাসা। হ্রু হ্রু করবেন না প্রভু… সন্দ করবে। ঠিক করে কথা বলুন…

অমৃত। ও-পে… ও-প্পে…

[ মুড়কি বাতাসার কাঁধে ভর দিয়ে অমৃতকুম্ভ বেরিয়ে গেল

কালোজাম। (রসমালাইয়ের কাঁধে চাপড় মেরে) তেলসিঁদুর মাখাও!

[ রসমালাই ঘুরে কালোজামকে ভালো করে দেখে ]

রসমালাই। অ্যাট লাস্ট ইউ! গুড গড! কেন বসছ? কী করবে রাজা হয়ে?

কালোজাম। একধার থেকে ধরব আর একধার দিয়ে কচুকাটা করব! দেশটা গোল্লায় গেছে! তুমিও গেছ ঠাকুর! তোমাকেও ছাড়ব না! কচুকাটা করব!

রসমালাই। ধন্য আশা কুহকিনী! বাড়িতে কে কে আছে শুনি!

কালোজাম। ফাদার মাদার ব্রাদার সিস্টার… ওয়াইফ অ্যান্ড থ্রি লিটল ডটারস- হালুয়া গুজিয়া অ্যান্ড সরপুরিয়া।

রসমালাই। ইস! মেয়েদের ম্যারেজের জন্যে গুছিয়ে রেখেছ তো?

কালোজাম। এর মধ্যে ম্যারেজ কী! হালুয়া ক্লাস ফাইভ, গুজিয়া কেজি ওয়ান, সরপুরিয়ার বয়েস চোদ্দো দিন!

রসমালাই। সবে চোদ্দো! ইস! শিশুরা ভেসে গেল সদ্য সদ্য!

কালোজাম। (গর্জন ছাড়ে) তেল মাখাও!

রসমালাই। আর তেল! ওরে পাগল, রাত পোহালে গো টু হেল! মিষ্টিপুরের হেডস্যারের মতো… ডাক্তারসাহেবের মতো.. ওই আসনে বসলেই শুরু হবে চমচমকা খেল! [ বাইরে তাকিয়ে ] বিশ্বাস না হয়, ওই দ্যাখো…

[ চমচমকে নিয়ে গজাবুড়ো ঢোকে ]

গজা। কইগো ঠাকুর, আমাদের রাবড়ি দাও!

রসমালাই। এই যে তেলসিঁদুর মাখাচ্ছি। ইনি সিংহাসনে বসলেই রাবড়ি পাবে!

গজা। সেনাপতি বসতে রাজি?

রসমালাই। হবে না! মিলিটারি লোক, মরতে ভয় পায় নাকি? চমচমের এঁটো করা সিংহাসনে বসে নিজে মরে সেনাপতি নিজের কচি কচি মেয়েদের কাঁদিয়ে রাজাকে বাঁচাবে। (কালোজামকে) যাও, সিংহাসনে ওঠো…

[ কালোজাম হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চমচম তার সামনে আসে ]

চমচম। হোপ… হিংপাহপে হোপ…

রসমালাই। বোধ হয় বলছে, সিংহাসনে ওঠ।

কালোজাম। বাবাগো!

চমচম। হোপ… হিংপাহপে হোপ!

[ কালোজাম ছুটে পালাতে যায়- চমচম তার পথ আটকে বলতেই থাকে হিংপাহপে হোপ। হুটোপাটি চলছে। মালপো ক্ষীরমোহন ও জলভরা তালশাঁস ঢোকে ]

মালপো। আরে, চমচমটা এখানে ঢুকেছে!

[ চমচম কালোজামকে ছেড়ে নবাগতদের তাড়া করে ]

চমচম। হিংপাহপে হোপ! (বলতে বলতে চমচম সিংহাসনে উঠে ওদের দেখাতে থাকে কেমন করে বসতে হবে)

ক্ষীরমোহন। এহেহে অপয়াটা সিংহাসনে বসল!

রসমালাই। এটা দ্বিতীয় বার!

ক্ষীরমোহন। আগেও বসেছে!

রসমালাই। নাহলে কি এমনি এমনি সিংহাসন ছাড়ছেন মহারাজ?

ক্ষীরমোহন। তাই সিংহাসনটা আমাদের ঘাড়ে চাপাতে চান!

মালপো। ওরে ফাদার, জামাইরাজা কী ডেঞ্জারাস! আমাকে মেরে ফেলার তাল করেছিল! ওঃ! ভাগ্যিস বসিনি!

চমচম। হিংপাহপে হোপ! হিংপাহপে হোপ…

জলভরা। (নিজের কান ধরে) কী করিতেছিলি হায় রে পামর

মিষ্টিপুর গদিলোভে একটু হলে

যাচ্ছিল চলে কালসিন্ধু জলতলে

জীবন যৌবন স্থাবর অস্থাবর।

ক্ষীরমোহন। ফের টুকলি!

কালোজাম। ফের মশলা! ফের যদি বড়ো কবিদের লাইন চুরি করেছ, সত্যিসত্যি কচুকাটা করব!

চমচম। হিংপাহপে হোপ!

[ সিংহাসন থেকে নেমে চমচম ক্রমাগত ক্ষীরমোহন, কালোজাম, জলভরাকে উত্যক্ত করে তাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল। চমচমকে ধরতে বেরিয়ে গেল গজাবুড়ো। রাজসভায় রয়েছে কেবল রসমালাই। মুড়কি ও বাতাসাকে নিয়ে অমৃতকুম্ভ মুকুট হাতে ঢোকে এবং পেছন থেকে রসমালাইয়ের ঘাড় টিপে ধরে ]

অমৃত। বলে দিলে?

রসমালাই। আপন হরি আল্লা গড, আর চেপে রাখা গেল না মাই লর্ড! চোদ্দো দিনের দুধের বাচ্চা পিতৃহারা হবে! আর সহ্য করতে পারলাম না মাই লর্ড!

[ রসমালাই বেরিয়ে গেল

অমৃত। এখন একশো এক বছরের লোকটার কী হবে? মুড়কি বাতাসা… চারদিকে জানাজানি হয়ে গেল! আর রাজা হবার লোক পাওয়া যাবে না…

বাতাসা। (দর্শকদের দিকে এগিয়ে) ও ভাই, যারা জন্মদিনের মোচ্ছব দেখতে এলে, এসো না একদিনের জন্যে রাজা হয়ে মহারাজের জীবনটা বাঁচাও। এই ধাক্কাটা সামলে দাও-এরপর থেকে মহারাজ রোজ দশটা-পাঁচটা আপিস করবেন… এসো না ভাই, কি তোমাদের একটুও দয়া নেই, একজনেরও? ওঃ! কী নিষ্ঠুর তোমরা!

[ বাতাসা কাঁদছে ]

অমৃত। কাঁদিসনে। যা, তুই বোস বাতাসা।

[ বাতাসার কান্না বন্ধ হয় ]

তুই তো নিষ্ঠুর নোস! প্রভুভক্ত বাতাসা, তুই আমার শেষ ভরসা!

[ বাতাসা জ্ঞান হারিয়ে কাটা কলাগাছের মতো লুটিয়ে পড়ে ]

মুড়কি। বাতাসা! বাতাসা! (বাতাসাকে ঝাঁকুনি দিয়ে) যাঃ, বাতাসা মনে হচ্ছে মরে গেছে প্রভু-

অমৃত। মরে গেল! দে, ব্যাটাকে টেনে বাইরে ফেলে দে…

[ মুড়কি বাতাসাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে বাইরে ]

মুড়কি। (যেতে যেতে) বাতাসাটা মহা ন্যাকা! আরে সেই যখন মরলি, রাজামশাইকে বাঁচিয়ে কাল মরলে ভালো হত না? আরে একদিনের রাজা হলেও, রাজা তো! সারা জীবন সিংহাসন মোছামুছি করলি, একদিন বসতিস মাথায় মুকুট পরে। মিষ্টিপুরের ইতিহাসে বড়ো বড়ো করে তোর নাম লেখা থাকত রে হতভাগা!

অমৃত। তুই বসলে তোরও থাকবে। নে মুকুটটা পরে নে বাবা মুড়কি…

মুড়কি। আমি…?

[ মুড়কি মূর্ছিত হয়ে লুটিয়ে পড়ল বাতাসারই ঘাড়ে। আর তক্ষুনি বাতাসা লাফ দিয়ে উঠে মুড়কিকে টেনে নিয়ে বাইরে চলে গেল ]

অমৃত। মুড়কি রে বাতাসা রে তোরাও নিলিনে সিংহাসন! কেউ আমায় বাঁচাবে না! ওহোহো….

[ অমৃতকুম্ভ কাঁদছে। মিষ্টিপুরের মহারানি লেডিকেনির এক্কাদোক্কা খেলার ছন্দে প্রবেশ ]

লেডিকেনি। এ মা, মহারাজ কাঁদছেন কেন?

অমৃত। (কাঁদতে কাঁদতে) ওগো, দিতে চাই, নিতে কেহ নাই! লেডিকেনি মহারানি কেউ আমার সিংহাসন নিচ্ছে না।

লেডিকেনি। সেকী! সিংহাসনে বসার লোক পাচ্ছেন না? আমি বসব! আমি বসব!

অমৃত। না-না-না… অপয়া সিংহাসন… না, না, না- বসতে নেই!

লেডিকেনি। বসব, সিংহাসনে বসব। কত বসতে চেয়েছি! কেউ আমায় বসতে দেয় না! এক্ষুনি বসছি-

অমৃত। ওগো না না। গজাবুড়োর সেই চমচম বসে গেছে ওর ওপর। তুমি যে মারা পড়বে। ওরে কে কোথায় আছিস… আমার মহারানিকে ঠেকা-বাতাসা মুড়কি…

[ বাতাসা মুড়কি ছুটে আসে ]

লেডিকেনি। না, কেউ ধরবে না। আমি বসব সিংহাসনে। এই তো বসলাম!

[ লেডিকেনি সিংহাসনে বসে ]

অমৃত। (মাথা চাপড়ে) যাঃ বুধবারে চলে গেল! বেষ্পতিবারে রাজা হয়েও আমার যে ভীষণ মন কেমন করবে লেডিকেনি।

লেডিকেনি। মন কেমন করলে ললিপপ খাবেন!

[ মালপো, ক্ষীরমোহন, কালোজাম, রসমালাই, জলভরা তালশাঁস-একে একে ঢুকছে। লেডিকেনি সিংহাসনে বসে হাসে, পা দোলায়। আস্তে আস্তে গম্ভীর হয়ে ওঠে বালিকা ]

লেডিকেনি। আমি এদেশের রানি। সারা দেশ আমার! সবার ওপরে আমি। আমি যা বলব, সবাইকে শুনতে হবে!

সকলে। যো হুকুম মহারানি!

লেডিকেনি। কাল পৃথিবীতে আমি থাকব না। তার আগে কাজ করতে চাই আমি… একটুখানি সময়ের মধ্যে করে যেতে হবে অনেক কাজ। সবাই হাত জোড় করো…

[ সবাই হাত জোড় করে ]

লেডিকেনি। মুড়কিদা, বাতাসাদা, তোমরা আমার দু-পাশে এসে দাঁড়াও! [ মুড়কি ও বাতাসা সিংহাসনের দু-পাশে দাঁড়াল। ] তোমরা একজন আমার মন্ত্রী, একজন আমার সেনাপতি! কী, পারবে তো?

[ মুড়কি ও বাতাসা ঘাড় নাড়ে। লেডিকেনি ক্ষীরমোহন মালপো কালোজামের দিকে ঘোরে ]

তোমাদের চাকরি গেল! এই ফাঁকিবাজ ঘুঘু চামচিকে অকাজের গোঁসাইদের একটা করে কান কেটে দেওয়া হবে। ওই মশলা কবি আর ওই হরিআল্লাগডেরও তাই হবে- যাতে দেশের লোক দেখামাত্তর এদের চিনতে পারে। …আমার দাদাটিকেও ছাড়বে না।

মালপো। বোনটি!

লেডিকেনি। দাদাটি বাঁদরের চেয়ে বাঁদর। দু-কান কাটা হবে।

[ মুড়কি ও বাতাসা কান কাটতে এগোয় ]

এখন না! আমি যখন থাকব না, তখন কাটবে। রক্ত সহ্য করতে পারিনে। বেষ্পতিবারে কাটবে, হুঁ?

বাতাসা। ভূতপূর্ব রাজা অমৃতকুম্ভজির কী বিচার হবে?

লেডিকেনি। একশো একে পড়েছেন, তবু সিংহাসন ছাড়বেন না। হুঁ, সবচেয়ে বেশি দোষ… বেশি সাজা!

অমৃত। মহারানি…

মুড়কি। তবে কিনা মহারানি, বুড়ো বয়েসে মানুষ আবার বাচ্চা হয়ে যায়! উনি তাই হয়েছেন! ওনার এখন দ্বিতীয় শৈশব চলছে। শিশুকে কি সাজা দেওয়া ঠিক হবে?

লেডিকেনি। (মুচকি হেসে) হুঁ, শিশু! না, শিশুকে সাজা না, পুরস্কার! আমার রাজ্যে শিশুর জন্যে হাজার খেলা… মজার খেলা! যতদিন বেঁচে থাকবেন, রোজ সকালবেলা উনি কুঞ্জবনে এক হাজার বার এক্কাদোক্কা খেলবেন আর ললিপপ খাবেন-

অমৃত। এক্কাদোক্কা! এক হাজার বার! পারব না… ওঃ ওঃ…

[ অমৃতকুম্ভ কেঁদে ওঠে। গজাবুড়ো ঢোকে। সঙ্গে শেকলে বাঁধা চমচম ]

লেডিকেনি। এই যে গজাবুড়ো- আমি যখন থাকব না, তুমি ঠিক করে দেবে কে হবে দেশের রাজা। আর তোমার চমচমকে আর শেকলে বেঁধে রাখবে না কিন্তু… ছেড়ে রাখবে! কাজের চেয়ার খালি দেখতে পেলেই সে যেন বসে পড়ে। কাজ! কাজ চাই আমার দেশে! যতক্ষণ বেঁচে আছি আমাকেও কাজ করে যেতে হবে! ওঃ, হাতে যে কত কাজ…

[ গজাবুড়ো চমচমের শেকল খুলে দেয় ]

গজা। রানি তোকে মুক্তি দিয়েছেন রে চমচম। নে, রানিকে হ্যালো কর… বল হ্যাল্লো… গুড মর্নিং…

চমচম। (মানুষের গলায়) হ্যাল্লো.. হ্যাল্লো… গুড মর্নিং!

গজা। এ কী! পরিষ্কার বলল! চমচম, তুই তো হ আর প ছাড়া একবর্ণও উচ্চারণ করতে পারিস না!

চমচম। পারি! পারি! তোমাদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে বর্ণমালা সব শিখে ফেলেছি! (হাত জোড় করে) মাই ডিয়ার কুইন, উইস ইউ অল সাকসেস! তোমার কাজের যা আগ্রহ দেখছি, তুমি বসতেই সিংহাসন আর অপয়া নেই! কাজের মানুষের ছোঁয়ায় সিংহাসনের সব পাপ ছুটে গেছে! তুমি আর মরবে না!

গজা। কী বলছিস, বুধবারে রানি মরবে না?

চমচম। সে আমি তক্ষুনি আবার বাঁচিয়ে দেব।

গজা। মানে? মরা মানুষ বাঁচিয়ে দিতে পারিস? তাই আবার পারে কেউ?

চমচম। আলবাত পারি! শোনো গজাবুড়ো, আমার ঠাকুর্দার ঠাকুর্দা… তার ঠাকুর্দা.. সে অনেক কাল আগে, পুরাকালে, গন্ধমাদন পর্বতের বিশল্যকরণী লতা এনে মরা মানুষ বাঁচিয়েছিল, মনে নেই? মহারানি, দার্জিলিং পাহাড়ে সেই বিশল্যকরণী লতা আছে। মহারানি, আমি এখুনি দার্জিলিং যাচ্ছি, বিশল্যকরণী এনে তোমায় বাঁচিয়ে রাখব!

লেডিকেনি। চমচমটা মহাপাজি! দার্জিলিং পরে যাবি। এখন একটা নাচ দেখা না চমচম!

[ চমচম ঘুঙুর বাজিয়ে নাচতে শুরু করে ]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *