একটা মেয়ে একা – কার্তিক ঘোষ
পরেশ রায় পারুলতলি গাঁয়ের বাসিন্দা, অসচ্ছল অবস্থা। বয়স ৫০
নগেন দত্ত পারুলতলির অবস্থাপন্ন ব্যবসায়ী। বয়স ৪০
বৃন্দাবন খেয়াঘাটের মাঝি। বয়স ৫০
বলাই জনৈক পাগল। বয়স ৩৫
শেখর স্থানীয় থানার দারোগা। বয়স ৩৫
কানা ছোট্টু নগেন দত্তর দুষ্কর্মের সহচর। বয়স ৩০
বিশে পাড়ার ছেলে। ডানপিটে ধরনের। বয়স ১৬
নিতাই পাড়ার ছেলে, ভালোমানুষ দেখতে। বয়স ১৫
টুকু নগেন দত্তর ভাগনে। বয়স ১২
পুনু পরেশ রায়ের মেজো মেয়ে। বয়স ১৪
মা পুনুর মা। বয়স ৪০
মুংরি বৃন্দাবন মাঝির মেয়ে। বয়স ১৩
বেচার মা জনৈকা বিধবা। বয়স ৪০
ইতা পুনুর ছোটো বোন। বয়স ১২
এ ছাড়া দুটি পনেরো বছরের ছেলে, দুটি লোক এবং একজন কনস্টেবল।
প্রথম দৃশ্য
স্থান আম বাগান। সময় বিকালবেলা।
[ বাঁ দিক থেকে ঢোকে পুনু। কাঁধে বইয়ের ব্যাগ। বোঝা যায় সে স্কুল থেকে ফিরছে। মুখ খুব গম্ভীর। গাছ পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল, কী মনে করে পিছিয়ে আসে। ব্যাগটা ধপাস করে ফেলে দেয় গাছের গোড়ায়। নিজেও বসে পড়ে গোমড়া মুখে।
ডান দিক দিয়ে ঢোকে মুংরি। হাতে ছোট্ট পুঁটলিতে চিঁড়ে বাঁধা। প্রায় ছুটতে ছুটতে যাচ্ছিল, পুনুর দিকে চোখ পড়তে থমকে দাঁড়ায় ]
মুংরি । ওমা, পুনুদি! এখেনে একলাটি যে!
পুনু । আমার খুশি!
মুংরি । খুশি কী গো! ইস্কুল থেকে বাড়ি ফিরবে তো?
পুনু । যখন ইচ্ছে হবে তখন ফিরব, এখন কী!
মুংরি । এখন কী মানে? (মুংরি হেসে ফেলে) বাবা দেখছি ঠিকই বলে।
পুনু । (তড়াক করে লাফিয়ে উঠে পড়ে পুনু) কী! কী বলে শুনি বিন্দেকাকা! বল-কী বলে কী আমাকে?
মুংরি । ওরেব্বাপরে-রাগ করছ কেন? বাবা বলে, ও বেটি হচ্ছে রায়বাড়ির পাগলি!
পুনু । কী বললি, আমি পাগলি! দাঁড়া, আজই যদি না আমি বিন্দেকাকাকে গিয়ে বলি- বিন্ধেশ্বরী ইস্কুলে ক্লাস এইটে পড়ি-আমি কিনা হলুম পাগলি।
মুংরি । পাগলিই তো-নইলে আমার মতো একটা মুখ্যু মেয়েকে তুমি এত ভালোবাস- যখন-তখন চলে আস আমাদের বাড়ি-
পুনু । বেশ করি, যা!
মুংরি । জানো পুনুদি! কেউ তো আমাদের দেখতে পারে না-আমার মা সেই কবে মরে গেছে-বাবা খেয়াঘাটের মাঝি-আমার মতো মেয়েকে তুমি-
পুনু । কীসব বকছিস আবোল-তাবোল, তুই তো আমার বন্ধু! বন্ধুর বাড়িতে লোকে যায় না বুঝি!
মুংরি । ইস! কত্ত যেন সব আসছে আমার কাছে। কেন, এই পারুলতলি গাঁয়ে কেউ বুঝি আমাকে চেনে না? চাঁপা, কালী, লক্ষ্মী-একবার কেউ মাড়ায় ওদিকে?
পুনু । ওরা কেউ যায় না? দাঁড়া, আচ্ছা করে বকে দেব ওদের!
মুংরি । কিছু করতে হবে না তোমাকে। আমার শুধু এই একটা বন্ধু হলেই চলবে।
পুনু । আমারও তাই! ওরা সবাই আমার বন্ধু তো-কিন্তু দেখ, তুই যেমন আমার সব কথা বুঝতে পারিস, ওরা কী সেসব বোঝে!
মুংরি । কী কথা?
পুনু । এই ধর, আমাদের পারুলতলি গাঁ-কী ভালো! ইস্কুলের জানলা দিয়ে যখন আমি চেয়ে থাকি, দেখি-মাদার গাছে কাঠবেড়ালি ছুটে বেড়ায়-ছোট্ট ছাগলছানা ডিগবাজি খায়-টিয়ে পাখির ঝাঁক এসে বসে শিরীষ গাছে-পড়ায় কী আর মন বসে তখন, বল? ওদের এসব কথা বললে ওরা ফিক ফিক করে হাসে।
মুংরি । ধ্যুত! ওরা তো কানা!
পুনু । এই দেখ-পুজো এসে গেল-আকাশে কত রকমের মেঘ! কোনোটা সিংহ, কোনোটা মন্দির-
মুংরি । ঠিক বলেছ গো! আমারও মনে হয় যেন রাম-রাবণের যুদ্ধ হচ্ছে-
পুনু । মনে হয় না? আর আমাদের হাঁসপুকুরে যখন ওই মেঘের ছায়া পড়ে-ঠিক যেন বিনি পয়সার বায়োস্কোপ! বাবাকে সেদিন বললাম, বাবাও হেসে উঠল-
মুংরি । তাই বুঝি তোমার মন খারাপ?
পুনু । দূর, সে তো পরশুদিনের কথা! মন তো খারাপ হল আজ ইস্কুলে!
মুংরি । কেন?
পুনু । লাস্ট পিরিয়ডে ছিল অঙ্কের ক্লাস। তা, অঙ্ক তো আমার ভালোই লাগে। বোর্ডে দিদিমণি কী অঙ্ক করাচ্ছিলেন, কিছুই দেখিনি। জানলা দিয়ে এমন মিষ্টি মিষ্টি নেবু ফুলের গন্ধ আসছিল-আমার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল আর দিদির কথা মনে পড়ছিল-বললাম সেকথা দিদিমণিকে, কিচ্ছু শুনলেন না-এমন মুখ করলেন-
[ মুংরি হঠাৎ জড়িয়ে ধরে পুনুকে ]
মুংরি । ইস, কত ভালো ছিল তোমার দিদিটা!
পুনু । মনে আছে তোর?
মুংরি । মনে থাকবে না! কত আচার চুরি করে খাইয়েছে আমাকে-আম জাম লিচু, যখন যা পেয়েছে-
পুনু । মার কাছে কত মারও খেয়েছে সেই জন্যে! আমি তো খুব বেয়াড়া ছিলুম ছোটোবেলায়-আমাকে ভোলাবার জন্যে বলাই পাগলার ভয় দেখাত-সেই জন্যেও মা ওকে কত-
[ উলটোদিক থেকে ঢোকে বেচার মা। চোখ পড়তেই অবাক হয় ]
বেচার মা। ও মা! এখনও বসে রয়েছ এখানে! ছুটির পর বাড়ি যাওনি দিদিমণি?
পুনু । যাচ্ছি! কিন্তু তুমি কোথায় যাচ্ছ?
বেচার মা । শোনো কতা! চরকির মতো এবাড়ি সেবাড়ি ঘুরে না বেড়ালে আমার চলে! যাচ্চি চাঁপাদের বাড়ি গোবর দিতে।
পুনু । সে তো যাও সন্ধেবেলা!
বেচার মা । না গো দিদি-চাঁপার মায়ের বায়নাক্কা তো আর কম না! গোবর দে হয়তো খানিক জিরুচ্চি, বলে, ধানটা এটটু নেড়ে দাও-এটা করো, ওটা করো-
মুংরি । তুমি করো কেন ওসব! বললেই পারো করব না!
বেচার মা । না না-ছোটো মুখে বড়ো কতা কি বলতে পারি মা!
মুংরি । তাই বলে মুখ বুজে তুমি সব-
বেচার মা । মুখ বুজে কি আর এমনি থাকি রে মা? ওই ছেলেটার মুখ চেয়ে! বাপ-মরা ছেলে আমার বেচা-বাপ কত আদর করত। যদুমাস্টারকে তাই তো বললাম-কাজ করি তো মাস্টারের বাড়ি-বললাম ছেলেটাকে এটটু দ্যাকো আপনারা-যেদি ন্যাকাপড়া কিচু শিখতে পারে-
পুনু । বাঃ, সত্যবাবু পড়ান বুঝি ওকে?
বেচার মা । তা পড়ায়। রোজ এটটু এটটু দেখে। বলে, বেচার নাকি আমার মাতা ভালো। আমায় বলে, ভালো করে পড়াও-বড়ো ইস্কুলে যাবে-কলেজে যাবে-তোমার দুকখু ও ঘোচাবে।
পুনু । বা বা-খুব ভালো হয় তাহলে।
বেচার মা। কী জানি দিদিমণি, সে কি আর আমার অদেষ্টে আছে!
মুংরি। কেন, থাকবে না কেন?
বেচার মা। ওই যে গো-চাঁপার মা! তার তো খুব চোখ আমার বেচার ওপর।
মুংরি। সে আবার কী?
বেচার মা। দু-বেলা কানে মন্তর পড়ছে-ব্যাটাটাকে দিয়ে দে আমাদের ঘরে-তাইলে আমি আর দুটো গাই কিনি। খাবেদাবে, দিব্যি থাকবে-তোর কোনো ভাবনা নেই!
পুনু। না না বেচার মা-তুমি, কক্ষনো রাজি হয়ো না।
বেচার মা। সে তো হবই না গো-সেই জন্যি তো এটটু বেশি করে কাজকম্মো করে ওকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করি। যাই গো দিদি-কতায় কতায় আবার দেরি হয়ে যাবে।
[বেচার মা চলে যায়
মুংরি। ইস, আমারও দেরি হয়ে গেল গো-চলি।
পুনু। তোর আবার কীসের দেরি?
মুংরি। এই যে-(কোঁচড়ে বাঁধা পুঁটলি দেখায়) দেখছ না! হাটবার তো আজ-ঘাটে ভিড়! বাবা তো খেতে আসেনি!
[ মুংরি চলে যায়। পুনু বইয়ের ব্যাগ তুলে নেয়। ঠিক সেই সময় মঞ্চে ঢোকে বিশে ও নিতাই ]
বিশে। একী রে! আমবাগানে তুই আবার কী করছিস?
পুনু। তোরা কী করছিস? ইস্কুলে যাসনি?
বিশে। কী বলেরে নিতাই-আমরা নাকি ইস্কুলে যাইনি!
পুনু। তুই যাসনি সেটা জানি-নইলে আর গুন্ডামি করবি কখন। ক্লাস সেভেনেই তো পড়ে আছিস এবছর! কিন্তু নিতাই তো ক্লাসে সেকেন্ড হয়-ওর আবার তোর সঙ্গে ইস্কুল পালাবার অভ্যেস হল কেন?
বিশে। চুপ কর, বাজে বকিস না!
পুনু। সত্যি কথা বললেই রাগ হয়! ফেলটা করতে গেলি কেন শুনি!
বিশে। এঃ, এ তো আর তোদের বিন্ধেশ্বরী ইস্কুল নয়। বালিপুর হাইস্কুল-মাস্টাররা কী কড়া তা জানিস!
পুনু। জানি, জানি, কালই তো সত্যমাস্টার বলছিলেন বাবাকে-বিশেটা একেবারে বয়ে গেল-ওকে আর পাশ করতে হবে না এজন্মে।
নিতাই। না, হবে না! সত্যমাস্টার সব জানে!
পুনু। তুই রাগ করছিস কেন, মাস্টারমশাই তো নিতাই বলতে একেবারে অজ্ঞান! বলেন, নিতাইটা যে কেন ফার্স্ট হতে পারছে না-
নিতাই। থাক থাক, তোকে আর বন্ধুবিচ্ছেদ করাতে হবে না।
বিশে। হ্যাঁ, আমরা যেমন বন্ধু ছিলাম, তেমনি থাকব বরাবর।
পুনু। থাক না, বারণ করেছে কে! শুধু বন্ধুর মতো একটু বই-টই খুলে দেখিস, তাহলেই হবে।
বিশে। তোরা থাক না বই মুখে করে। আমরা ছেলে, বুঝেছিস! আমরা বিষ্টিতে ভিজব-বল খেলব-কাদা মেখে বাড়ি ফিরব-
পুনু। বছর বছর ফেল মারব-
নিতাই। বাজে বকিস না তো। মেয়েরা তো সব মুখস্থবিদ্যে ফলায়!
বিশে। যা বলেছিস! ঘ্যানঘ্যান করে দিনরাত্তির খালি পড়ে আর গাধার মতো মুখস্থ লেখে।
পুনু। বেশ করি। যা! তোরা যে টুকলি করিস, তার বেলা!
বিশে। টুকলি করি? দেখছিস নিতাই, আমরা নাকি-
নিতাই। বলতে দে না যা খুশি-মেয়েরা তো ওইরকমই! কড়া করে কিছু বলতে গেলেই আবার কাঁদতে শুরু করবে-
পুনু। হ্যাঁ, কাঁদতে শুরু করবে! তুই ভারী জানিস!
বিশে। কেন জানব না! আমার ছোড়দিকে দেখছি না! নাকে কান্না লেগেই আছে!
পুনু। সবাই তোর ছোড়দি নয়।
নিতাই। মোটকথা তোদের মাথা নেই-মুখস্থবিদ্যে লিখিস।
পুনু। বটে! তোরা ঠিক বিদ্যে শিখেছিস তো-(কোমরে দুটো হাত রেখে দিদিমণির ভঙ্গিতে) তুই তো ক্লাসের সেকেন্ড বয়, বল দেখি এই ট্রানস্লেশনটা, কেমন ইংরিজি জানিস দেখি-
[ নিতাইকে একটু নার্ভাস দেখায়, বিশে সেটা খেয়াল করে তাড়াতাড়ি বলে ওঠে ]
বিশে। আরে দাঁড়া দাঁড়া, খুব তো লাগতে এসেছিস ছেলেদের সঙ্গে, পারবি এই আম গাছটায় উঠতে-পারবি? তাহলে বুঝব হিম্মত।
পুনু। এই টুসি আম গাছটা? ধুস! কী তক্ক?
নিতাই। উঠবি তুই? বেশ- (পকেট থেকে একটা চকচকে আমকাটা ছুরি বার করে) এইটা! এক্কেবারে নতুন-নগদ চার টাকা দিয়ে কেনা।
পুনু। দিয়ে দিবি? ঠিক তো?
নিতাই। এক্কেবারে।
[ তক্ষুনি বইয়ের ব্যাগ মাটিতে ফেলে দেয় পুনু। সাপের মতো দুটো বেণী দুলছিল পিঠে, সেটা মাথার ওপর তুলে বেঁধে ফেলল। তারপর গাছটাকে ভালো করে জরিপ করল ]
পুনি। দূর! এতে আম কোথায়! দাঁড়া, ওদিকের ওই সিদুঁরে আম গাছটায় উঠছি।
[ পুনু বাঁদিকে বেরিয়ে যায়। বিশে ও নিতাই এমন করে তাকায়, ওপরে দেখে ও ভাবভঙ্গি করে যাতে বোঝা যায় পুনু উঠছে, ডালে বসেছে, আম পাড়ছে ]
পুনু। (মঞ্চের আড়াল থেকে) এই নে-ধর।
[ সঙ্গে সঙ্গে সিঁদুরে আম পড়তে আরম্ভ করে একটা, দুটো, তিনটে। বিশে তাড়াতাড়ি কুড়োতে শুরু করে, নিতাই হতাশ হয়ে আম গাছের তলাতেই বসে পড়ে ]
বিশে। কীরে, কী হল-আম খাবি না?
নিতাই। ধ্যুৎ! আমার নতুন ছুরিটা-
[ পুনু ঢোকে। জামা পরিষ্কার করার ভঙ্গি করে ]
পুনু। কীরে, হয়েছে তো?
[ নিতাই কথা না বলে ছুরিটা এগিয়ে দেয় পুনুর দিকে। পুনু সেটা নেয়, কয়েকবার তার ধার পরীক্ষা করে। তারপর সেটা বাড়িয়ে ধরে নিতাইয়ের দিকে ]
নে, এবারকার মতো ছেড়ে দিলুম তোকে।
নিতাই। থাক, থাক, দাতা-কর্ণ একেবারে।
[ পুনু হেসে ওঠে। ছুরিটা ছুঁড়ে দেয় নিতাইয়ের পায়ের কাছে। নিতাই সেটা তুলবে কি তুলবে না ভাবছে, বিশে তাড়াতাড়ি সেটা তুলে নিয়ে নিতাইকে দেয়। নিতাই ইতস্তত করে ]
পুনু। নে না! ভীষণ বোকা তুই! আমি তো ঠাট্টা করছিলাম-
নিতাই। (তুলে নিতে নিতে) হ্যাঁ রে, তুই ঠিকই বলেছিস-আমি খুব বোকা। আর সব ঠিকঠাকই বুঝি, পাটীগণিতটা কিছুতেই ঢোকে না আমার মাথায়। সেইজন্যেই তো ফার্স্ট হতে পারি না।
পুনু। ধুস! পাটীগণিতে ভয় তোর-(কথা বলতে বলতেই কপালের কাচপোকার টিপ খুলে হাতের তেলো দিয়ে মুখ মুছে আবার টিপটা লাগিয়ে দেয়।) জলের মতো সোজা। আসিস তুই বাড়িতে-দু-দিনে পাকা করে দেব।
নিতাই। সত্যি! আমি পারব?
পুনু। এসেই দেখ না কদিন! (বইয়ের ব্যাগ তোলে)
বিশে। আর আমি?
পুনু। (হাসি মুখে) কী তুই?
বিশে। আমার বুঝি মাথায় ঢুকবে না?
পুনু। বাবা, ভূতের মুখে রামনাম যে রে!
বিশে। তার মানে তুই শেখাবি না! ঠিক আছে-
পুনু। ওরেব্বাবা রাগ হয়ে গেল! ঠিক আছে, তুইও আসিস। (এগোতে এগোতে) চলি রে- [ পুনু চলে যায়
[ ওরা দুই বন্ধু তাকিয়ে থাকে এই অবস্থাতেই পরদা পড়ে বা মঞ্চ অন্ধকার হয় ]
দ্বিতীয় দৃশ্য
স্থান পুনুর বাড়ির উঠোন। ছোটো দাওয়া। ডানদিকে তুলসীমঞ্চ। সময় বিকাল
[ পুনু মাকে ডাকতে ডাকতে মঞ্চে ঢোকে, ওর কাঁধে বইয়ের ব্যাগ, কিন্তু জামাটা আগের মতো নয়। অর্থাৎ একই দিনের ঘটনা নয়, সেটা বোঝাতে হবে ]
পুনু। মা-ওমা-মা-ধুত্তেরি ছাই, খিধে পেয়েছে-গেল কোথায় মা! এই ইতা-ইতা-
[ পুনুর মা ঢোকে। কোঁচড়ে অনেকটা মুড়ি বাঁধা ]
মা। কী রে, কী হল কী-বাড়ি যে একেবারে মাথায় করছিস!
পুনু। করব না! সকালবেলা তো কিচ্ছু না খেয়ে ইস্কুল গেলাম-কোথায় খাবারদাবার সব সাজিয়ে রাখবে-
মা। সেইজন্যেই তো বেরিয়েছিলাম রে-এক পালি মুড়ি নিয়ে এলাম চাষি-বউয়ের কাছ থেকে। নে, হাত-পা ধো-আমি এক্ষুনি মেখে দিচ্ছি তেল-পেঁয়াজ দিয়ে।
[ মা চলে যাচ্ছিল, পুনু হঠাৎ কী একটা লক্ষ করে মায়ের সামনে এসে দাঁড়ায় ]
কী হল আবার?
পুনু। মা, তোমার নাকছাবিটা কোথায়?
মা। ওমা, তাই বল! আমি ভাবি না জানি কী-(যেতে উদ্যত)
এর মধ্যে পরেশ রায় ঢোকে।
পুনু। বাজে কথা ছাড়ো। নাকছাবিটা কই? তোমার সেই বেলকুঁড়ি দুলের মতো এটাও কি পুকুরের জলে পড়ে গেল নাকি?
মা। না, মানে-বাবাকে কিছু বলিস না-আমি তোকে পরে সব বুঝিয়ে বলব।
পুনু। কিচ্ছু বোঝাতে হবে না মা, আমি সব বুঝি। তাতা কেন একটা নতুন প্যান্ট পায় না-ইতার ইস্কুলে যাবার ব্যাগ কেন কিনে দাও না তুমি-কেন এখন আমাদের বাড়িতে রোজ ভাত রান্না হয় না-
মা। পুনু, পুনু-
পুনু। হ্যাঁ মা, আমি সব বুঝতে পারি। কেন বাবা আর সেই আগের মতো কলকাতায় থাকে না-হপ্তায় হপ্তায় বাড়ি আসে না-কেন আগেকার মতো সেইসব ভালো ভালো জিনিসপত্র আমাদের জন্যে আর কেনা হয় না-
মা। চুপ কর-চুপ কর মা, আমি আর শুনতে পারছি না।
পুনু। আমাকে চুপ করিয়ে তুমি করবে কী মা! কী সুন্দর তিনটে তাল গাছ ছিল আমাদের-কী মস্ত বড়ো একটা তেঁতুল গাছ ছিল-সব বিক্রি হয়ে গেছে আমি জানি। থাকার মধ্যে এখন ওই ধবলী গাই, তিনটে হাঁস, হাঁসপুকুর, আর ওই পেঁয়াজবাড়ি। দশ কাঠার আলুর জমিটাও বাবা দিয়ে দেবে, আমি শুনে এসেছি মা।
[ মা অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে ]
আচ্ছা! ঠিক করে বলো তো-বাবার কলকাতার চাকরিটা আর নেই, তাই না মা?
[ পুনুর মা কোনো কথা বলে না, চলে যায় দরজার পাল্লা ফাঁক করে মঞ্চের বাইরে। পুনু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ওর দু-চোখ জলে ভরে ওঠে। এগিয়ে যায় তুলসীমঞ্চের দিকে। হাঁটু গেড়ে বসে হাত জোড় করে ]
পুনু। (স্বগত) ঠাকুর, বাবা তো একটা ছোট্ট চাকরি করত-সেটা খেয়ে কী লাভ হল তোমার শুনি! ভাবছ আমি ছোটো বলে চিরকাল ছোট্টই থাকব! ইস্কুলেই পড়ে থাকব চিরকাল! কক্ষনো না-এই তোমার সামনে আমি প্রতিজ্ঞা করলুম-আমিও একদিন বড়ো হব, যোগ্য হব। চাকরি নিয়ে আমিও বাবার মতো কলকাতায় যাব একদিন। সেদিন এই অপমানের শোধ তুলব তুমি দেখে নিয়ো-দেখে নিয়ো তুমি-
[ কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলে পুনু। এর মধ্যে পরেশ রায় ঢোকে। হাতে একটা বড়োসড়ো প্যাকেট ও বগলে ছাতা ]
পরেশ। (পুনুকে দেখে) আরে! একী রে! তোর চোখে জল! কাঁদছিস কেন রে-
[ পরেশ হাতের বোঝা দাওয়ায় রাখে। পুনু চোখের জল মুছে সামলায় নিজেকে ]
হ্যাঁ রে, কী হয়েছে রে? অ্যাঁ!
পুনু। কিছু না- (চোখের জল মুছে মুখে হাসি আনে। তারপর একেবারে আচমকাই বলে-) তোমার চাকরিটা আর নেই বাবা, না?
[ পরেশ থতমত খেয়ে যায়। ঢোক গেলে, চোখ সরিয়ে নেয়। কী বলবে, কী করবে নিজেই যেন বুঝতে পারে না ভালো ]
ওরকম করছ কেন বাবা? চাকরিটা গেছে তোমার ভালোই হয়েছে। ছোটো চাকরির আবার মায়া! শোনো না, ও বাবা-(জোর করে বাবার মুখ তার দিকে ফেরায় পুনু) আমাদের তো কত কাজ বাবা-পেঁয়াজবাড়িতে তুমি কি আর একা জল দিতে পারো! আমরা দুজনে মিলে দোব।
পরেশ। আর ইস্কুল!
পুনু। ইস্কুল থেকে ফিরে! আরেকটা কথা বলব বাবা, তুমি রাগ করবে না বলো!
পরেশ। কথাটা কী বলবি তো!
পুনু। লক্ষ্মীকে তুমি চেনো তো-আমার বন্ধু গো!
পরেশ। বল না তুই-মহাদেব ঘোষের মেয়ে-
পুনু। হ্যাঁ-ও না কী সুন্দর দুধ দুইতে শিখে গেছে। আমিও শিখব বাবা, তুমি শুধু একটু মাকে বলে দাও।
পরেশ। না না না-ছিঃ!
পুনু। কেন বাবা, এতো আমাদের নিজেদেরই কাজ!
পরেশ। তা হোক, তুই কেন দুধ দুইতে যাবি! পড়াশোনা কর-এত ভালো মাথা তোর-সক্কলে বলে! ভালো করে পড়াশোনা কর মা!
পুনু। সে তো করছিই বাবা।
পরেশ। হুঁ, তাই কর। পাশ করে তুই আরও পড়বি-কলেজে যাবি-আমার মুখ উজ্জ্বল করবি। সবাই আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলবে-ওই যে, পুনুর বাপ যাচ্ছে। পারবি না? তুই পারবি না পুনু?
পুনু। (হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়ায়। কোমরে হাত রেখে শপথের ভঙ্গিতে) পারব বাবা-আমি পারবই! তুমি দেখে নিয়ো।
[ পরেশ তাকে বুকে টেনে নেয়, চুলে হাত বোলায় ]
বাবা, মায়ের নাকছাবিটাও তুমি বাঁধা দিয়ে এলে!
পরেশ। না, মানে-
পুনু। আমি জানি বাবা। মায়ের দুল দুটোও হারিয়ে যায়নি-বাঁধা পড়েছে। কিন্তু দিলে কার কাছে বাবা?
পরেশ। ওই মানে, তোদের নগেনকাকার কাছেই-
পুনু। নগেনকাকার কাছে!-তোমার কি বুদ্ধি নেই?
পরেশ। কেন, নগেনকাকা তো-
পুনু। ডাকাত-ডাকাত! দিদির দু-ভরির দুটো রুপোর মল ছাড়াতে গিয়ে কী হেনস্থা হয়েছিলে তোমার মনে নেই?. দিলে তো না-ই, সেই সঙ্গে এক গাদা নোংরা কথা- আমরা লোভী, আমরা মিথ্যুক-আমরা বানিয়ে কথা বলছি-ওর কাছ থেকে বাগাবার জন্যে নাকি তুমি-
পরেশ। থাক, থাক, যা হয়ে গেছে তা নিয়ে আবার-
পুনু। হয়ে আর গেল কোথায় বাবা! আবার তো সেই ডাকাতের খপ্পরে তুমি-
পরেশ। না না, শোন-লোকটা কিন্তু আসলে তত খারাপ নয়। মানে টাকাপয়সাওয়ালা লোক তো! পাঁচজনে পাঁচরকম বলে-
পুনু। হুঁ-ব্যাপারটা তো সুবিধের মনে হচ্ছে না! আবার বুঝি মেলামেশা শুরু করেছ?
পরেশ। পরেশদা পরেশদা করে-সুখদুঃখের কথা বলে-মানে বউটা মরে যাবার পর বুঝতেই তো পারছিস বাড়ির অবস্থা!
পুনু। বাবা! তুমি কি নগেনকাকার সঙ্গেই বেরিয়েছিলে এখন?
পরেশ। হ্যাঁ, মানে বললে বালিপুরের বাজারে যাবে-
পুনু। বাজার! হঠাৎ?
পরেশ। ওই কাপড়চোপড় কিনবে কয়েকখানা! তা পুজো এসে গেছে, আমায় বললে, পরেশদা চলো না-তোমারও তো কেনাকাটা আছে-
পুনু। তুমি অমনি চলে গেলে!
পরেশ। আরে শোন না, আমিও যাব না, ও-ও ছাড়বে না-শেষে বললে, ছেলেমেয়েগুলো তো কোনো দোষ করেনি দাদা, তাদের জন্যে অন্তত কেনো! তা সেই শুনে আমি-
পুনু। তুমি কিনলে আমাদের জামা?
পরেশ। কী করি বল-অত বড়ো মানুষটা-বলছে অমন করে-
পুনু। টাকা পেলে কোথায়?
পরেশ। ও-ই দিলে-মানে, ধার আর কি! পরে সুবিধে মতন ওটা একসময়-
[ কথা শোনার মধ্যেই পুনুর চোখ পড়ে জামাকাপড়ের বান্ডিলের দিকে। দৌড়ে যায়। প্যাকেট খুলে দুটো ছোটো-বড়ো ফ্রক আর একটা সার্ট বার করে। ঘেন্নায় মুখ বিবর্ণ হয়ে যায় ]
পুনু। ছি ছি বাবা-ছিঃ! জেনেশুনে ওই শয়তানটার ফাঁদে তুমি পা দিলে! ওর মতলব তুমি বোঝো না! আসলে তোমাকে বোকা সরল মানুষ পেয়ে-
নগেন। (মঞ্চের বাইরে থেকে চেঁচিয়ে) পরেশদা-পরেশদা আছ নাকি-
পরেশ। এই চুপ চুপ! এখন কিছু বলিসনি লক্ষ্মীটি-(গলা তুলে) আরে নগেন-এসো এসো-
[ নগেন দত্ত ঢোকে। তাকায় পুনুর দিকে ]
নগেন। কী পরেশদা, জামা-টামা সব পছন্দ হয়েছে তো, নাকি-
পরেশ। খুব পছন্দ, খুব পছন্দ! যাও যাও, ঘরে গিয়ে বসো-
নগেন। থাক না, এখানেই তো বেশ ফুরফুরে হাওয়া-
পরেশ। পুনু, যা তো মা, মোড়াটা নিয়ে আয় তো ঘর থেকে-(গলা তুলে) শুনছ-নগেন এয়েছে। একটু চা-পান দাও ওকে-
[ ঘরের ভিতরে যায়। পুনু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। নগেন গুটিগুটি এগোয় ওর দিকে। মুখে হাসি ]
নগেন। কী, পুনু-জামা ঠিক আছে?
[ পুনু সোজা এগিয়ে আসে নগেনের দিকে। কটমট করে চায়, যেন ভস্ম করে ফেলবে। হঠাৎই পেছনে ফিরে বেরিয়ে যায়। সেকেন্ড দুয়েক পরে একটা মোড়া নিয়ে এসে সেটা নগেনের সামনে নামিয়ে রেখে দুম দুম করে অদৃশ্য হয়ে যায়। নগেন দত্তের মুখে বোকা বদমাইশের নীরব হাসি ]
[ মঞ্চ অন্ধকার হয় বা পরদা পড়ে ]
তৃতীয় দৃশ্য
স্থান জনার্দন মন্দির। সময় সকাল
[ পুনু ঢোকে, গায়ে ফ্রকের ওপর সোয়েটার। পেছনে কিছু একটা শোনে, ফিরে তাকিয়েই ভুরু কুঁচকে ওঠে। তাড়াতাড়ি মন্দিরের পেছনে গিয়ে লুকোয়।
পরেশ ঢোকে গুনগুন করে গানের কলি মুখে নিয়ে। তার গায়ে একটা ময়লা সস্তা চাদর ]
নগেন। (নেপথ্যে) পরেশদা-দাঁড়ান-
[ পরেশ দাঁড়িয়ে পড়ে। নগেন দত্ত ঢোকে ]
দরকার আছে পরেশদা-ভালো কথা, পুনু পাশ করেছে তো?
পরেশ। পাশ মানে? রীতিমতো সেকেন্ড হয়েছে। তা তুমি কী করে মনে রাখলে বলো দিকি! মানে এত ঝঞ্ঝাট চলছে-
নগেন। নিজেদের লোক বলে কথা-কেলাস নাইন হল তো?
পরেশ। অ্যাঁ! হ্যাঁ হ্যাঁ, নাইনই হল বোধ হয়। বাবা, পুনুটা যে কখন এত বড়ো হয়ে গেল-
নগেন। না না, আমাদের কাছে যে পুনু সেই পুনুই আছে। তা, এবারে তো বইপত্তর কিনতে হবে-
পরেশ। সে হবেখন ধীরেসুস্থে-
নগেন। বিলক্ষণ! ধীরেসুস্থে কী কথা! উচুঁ ক্লাস-সামলাতে হবে তো! আপনি লিস্টিটা শুধু আমায় ধরিয়ে দেবেন। যাক গে, খবর শুনেছেন তো ইদিকের?
পরেশ। খবর তো এখন একটাই, পঞ্চায়েত ইলেকশন! ছেলেপুলেরা তো তোমার জন্যে খুব খাটছে শুনছি-একবার যদি অঞ্চলপ্রধানটা হতে পার-
নগেন। আপনাদের আশীর্বাদ। যাক গে, কাজের কথাটা বলি আগে শুনুন, রেশন দোকানটা তো হাতে পেয়ে গেলাম।
পরেশ। কী বলছ! শেতল হালদার ছেড়ে দিলে?
নগেন। ছেড়ে কি আর কেউ দেয় আজকাল পরেশদা! ওর ডিলারশিপটা ক্যানসেল করিয়ে দিলাম-অবশ্যি মোটা টাকা খরচা করতে হল তার জন্যে। সে যায় যাক, ডিলারশিপটা তো পেয়ে গেলাম!
পরেশ। খুব ভালো, খুব ভালো! তুমি ডিলারশিপ পেলে আমারও নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা হবে, কী বলো!
নগেন। হবে বলছেন কী পরেশদা, হয়ে গেছে!
পরেশ। অ্যাঁ! হয়ে গেছে?
নগেন। হয়ে গেছে। সেই খবরটা দিতেই তো ছুটে আসছি আপনার পেছন পেছন।
পরেশ। বলো কী হে-তাহলে তোমার রেশন দোকানে চাকরি আমার একটা হচ্ছে?
নগেন। হচ্ছে। যেদিন যাবেন সেদিন থেকেই। তবে মাইনেটা দাদা এখন কিন্তু মানে ওই-(হাতের আঙুলের ইঙ্গিত করে) একই থাকবে।
পরেশ। তিনশো! (একটু যেন হতাশ)
নগেন। হ্যাঁ দাদা, এখন ওইটাই ঠিক থাক। মানে, আপনি তো আমার ঘরের লোক! পরে অসুবিধে কিছু বুঝলে-
পরেশ। ঠিক আছে-এই যে একটা ব্যবস্থা তুমি করে দিলে এর জন্যেই আমি তোমার কাছে চিরঋণী হয়ে থাকলাম।
নগেন। ছাড়ুন তো ওসব, চলুন-বাড়ি যাবেন তো?
পরেশ। হ্যাঁ হ্যাঁ, চলো। এমন খবরটা দিলে, এক কাপ চা অন্তত না খাওয়ালে তোমাকে-চলো চলো-
[ পরেশ ও নগেন চলে যায়। ভুরু কুঁচকে বেরিয়ে আসে পুনু মন্দিরের পেছন থেকে ]
পুনু। (স্বগত) হুঁ-বাবাকে হাত করার চেষ্টা করছ। করো।! পৃথিবীর সবাই তোমাকে বিশ্বাস করে করুক, আমি করব না। তুমি কত বড়ো শয়তান আমি জানি। লোকের সর্বনাশ করার জন্যে তুমি ছোঁকছেঁাক করছ। ঠিক আছে, আমিও তক্কে তক্কে আছি-দিদির দু-ভরি রুপোর মল তুমি গাপ করেছ, সুদে আসলে এর শোধ নেব একদিন, তবে আমার নাম- (হঠাৎ সচকিত হয়ে) আরে! এ আবার কী?
[ দূর থেকে ‘ভোট দিন! ভোট দিন’ এই সম্মিলিত ধ্বনি কাছে আসে। পুনু বেগতিক দেখে আবার সরে আসে মন্দিরের পেছনে। একটু পরেই দলটা ঢোকে। প্রথমেই একটা ফেস্টুন, তাতে লেখা ‘আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে নির্দল প্রার্থী নগেন দত্তকে কলসি চিহ্নে ভোট দিয়া জয়যুক্ত করুন।’ দলে প্রথমে দুটি বয়স্ক মানুষ- তারপর বিশে, নিতাই, দুটি পনেরো বছরের ছেলে এবং সবশেষে টুকু, হাতে গুলতি। ওরা স্লোগান দিতে দিতে চলে যাচ্ছে ]
সমবেত। ভোট দিন! ভোট দিন! কলসি চিহ্নে ভোট দিন। পঞ্চায়েতের নির্বাচনে নগেন্দ্রনাথ দত্তকে দলে দলে ভোট দিন। ভোট দিন! ভোট দিন-
[ দলটা যখন প্রায় বেরিয়ে গেছে, পুনু চট করে মন্দিরের পেছন থেকে বেরিয়ে এসে টুকুর হাতটা টেনে ধরে। দল বেরিয়ে যায় ]
টুকু। এই মেয়েটা-আমাকে টানছ কেন?
পুনু। ইস, এইটুকু ছেলের কী কথা! অত চ্যাঁচাচ্ছিলে কেন?
টুকু। মামা যে বলল চ্যাঁচাতে!
পুনু। মামা আবার কে তোমার?
টুকু। (হাত দিয়ে দূরে দেখাবার চেষ্টা করে) ওই যে-উই-দেখতে পাচ্ছ-মস্ত পুকুর-তার পাশে এইসা পাকা বাড়ি-
পুনু। ওটা তো নগেন দত্তর বাড়ি!
টুকু। চেনো তুমি? ওটাই আমার মামার বাড়ি।
পুনু। ইস, ওই বিচ্ছিরি লোকটা তোমার মামা?
টুকু। এই, বলবে না-জানো আমার বাবা নেই!
[ পুনুর মুখটা একটু বিষণ্ণ হয়ে যায়, টুকুর কথা শুনে। কিছুক্ষণ কথা বলতে পারে না ]
তোমার বাবা আছে?
[ পুনু ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলতে যায়, তার আগেই- ]
একটা কাঠবেড়ালির বাচ্চাকে এইসা মার মেরেছি না আমি-বাড়িতে গিয়ে ঠিক মরে যাবে। হাতের টিপ দেখবে আমার?
পুনু। কাকে মারবে আবার?
টুকু। কাকে (খোঁজে, তারপর দূরে আঙুল দেখিয়ে) ওই যে-ছাগলছানাকে।
পুনু। না, মেরো না-মারতে নেই।
টুকু। কেন?
পুনু। বাঃ, ওর মা আছে না! ধরো তোমাকে যদি কেউ মারে, তোমার মার কষ্ট হবে না বুঝি?
[ টুকু গম্ভীরভাবে কথাটাকে বুঝবার চেষ্টা করে। তারপর হঠাৎ গুলতিটা ছুঁড়ে পুনুর পায়ের কাছে ফেলে দেয় ]
পুনু। এটা আবার কী হল?
টুকু। গুলতিটা ফেলে দিলাম।
পুনু। সে তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু ফেলে দিলে কেন?
টুকু। নাঃ, আর আমি মারব না কাউকে।
[ পুনু টুকুর কথা বলার ভঙ্গিতে খিলখিল করে হেসে ওঠে। টুকুকে কাছে টেনে ওর উসকোখুসকো চুলে বিলি কাটে ]
পুনু। খুব মজার ছেলে তো তুমি! যাবে আমাদের বাড়ি?
টুকু। কোথায় বাড়ি তোমাদের?
পুনু। ওই তো, কাছেই। একটা বাতাবিনেবু গাছ, তারপরে পুকুর, তারপরেই দুটো মাটির ঘর।
টুকু। উরেব্বাস! মাটির ঘরে আমি যাই না।
পুনু। ওমা! কেন?
টুকু। মা বলেছে ওখানে সাপ থাকে। সাপকে ভয় করে না তোমার?
পুনু। করে বই কী, ভীষণ ভয় করে।
টুকু। (চট করে গুলতিটা তুলে নিয়ে) তাহলে তুমি রেখে দাও এটা, সাপ দেখলেই এক টিপে-ফটাস!
[ পুনু হেসে ফেলে। টুকুর হাত ধরে টানে ওকে মন্দিরের দিকে ]
পুনু। এসো, এই মন্দিরের সামনে বসে গল্প করি দুজনে। গল্প শুনতে ভালো লাগে না তোমার?
টুকু। গল্প- কীসের গল্প?
পুনু। যা খুশি তোমার-রাজার গল্প, বাঘের গল্প, দৈত্যের গল্প, ভূতের গল্প-
টুকু। দূর, ওসব গল্প আমার ভালো লাগে না।
পুনু। ওমা! তাহলে আবার কীসের গল্প?
টুকু। কেন, আজ আমি শুনব তোমার গল্প, কাল তুমি শুনবে আমার গল্প।
পুনু। (হাসতে আরম্ভ করে, হাসতে হাসতেই-) দারুণ মজার কথা বলো তো তুমি!
টুকু। ধুস! অমন করে হাসছ কেন তুমি?
পুনু। বাঃ, হাসব না? তুমি কিনা আমার গল্প শুনবে?
টুকু। কেন, তোমার বুঝি কোনো গল্প নেই?
পুনু। তোমার আছে বুঝি?
টুকু। (গম্ভীর হয়ে যায়। অন্যদিকে তাকায়) জানো, নগেন দত্ত কিন্তু আমার সত্যিকারের মামা নয়।
পুনু। মানে?
টুকু। কেউ নয় আমার। মা বলেছে আমার কেউ নেই।
পুনু। ওমা, তাহলে যে বললে-
টুকু। শোনো না-আমরা বেলেঘাটায় থাকতুম। ডাকাতরা না মেরে ফেলেছে আমার বাবাকে-
পুনু। ইস, তাই বুঝি?
টুকু। হ্যাঁ, এই তো ক-মাস আগে। কেন মেরেছে আমি কিছু জানি না, মা-ও কিছু বলেনি আমাকে। এই লোকটা হঠাৎ গিয়ে বললে, আমি তোর মামা হই-চ আমাদের দেশে-ওখানে গিয়েই পড়াশোনা করবি।
পুনু। তোমার মা রাজি হল আসতে?
টুকু। রাজি আবার কী! কেউ কি আছে আমাদের? আসতেই হল।
পুনু। পড়াশোনা করো তো এখানে?
টুকু। ছাই করি! কে পড়াচ্ছে এখানে! (একটু চুপ করে থাকে, তারপর কান্না চাপা গলায় বলে) জানো, আমার মাকে সারাদিন ঝিয়ের কাজ করতে হয় ওদের বাড়িতে। কত দেরি হয় শুতে- তাও আমি শুয়েই থাকি শুয়েই থাকি – ঘুমিয়েই পড়ি আদ্ধেক দিন- মা আর আসে না। আমাকে না ওরা পড়তেও দেয় না, খেলতেও দেয় না, খেতেও ডাকে না। শুধু আমাকে দেখিয়ে বাড়ির অন্যসব লোকজন ফিসফিস করে কীসব বলে। শোনো- তুমি আমাকে ভালোবাসবে তো? বলো না-
[ ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে টুকু। নিজের হাঁটুতে মুখ গুঁজে দেয়। পুনু ওর গায়ে মাথায় হাত বুলোতে থাকে ]
পুনু। আরে এই-বোকা ছেলে কোথাকার। কাঁদছ কেন? ওঠো ওঠো- চলো, আমাদের বাড়ি চলো! সবাই ভালোবাসবে তোমাকে-চলো না-
[ পুনু ওকে কোনোরকমে ধরে তোলে। টুকুর ফোঁপানি বন্ধ হয়নি তখনও ]
পুনু। দেখেছ কাণ্ড! এতক্ষণ গল্প করছি-তোমার নামটাই জানা হয়নি এখনও।
টুকু। আমার নাম টুকু। তোমার?
পুনু। আমার নাম প্রণতি। তুমি আমায় পুনুদি বলবে, কেমন। চলো দেখি কে আগে যেতে পারে! রেডি এক, দুই, তিন- [ দুজনেই একসঙ্গে ছুটে বেরিয়ে যায়
[ মঞ্চ অন্ধকার হয় বা পরদা পড়ে ]
চতুর্থ দৃশ্য
স্থান পুনুদের বাড়ি। সময় সন্ধে
[ পুনুর মা সন্ধ্যাপ্রদীপ দিচ্ছে তুলসীমঞ্চের ওপর। প্রদীপ রেখে নমস্কার করে। পরেশ ঢোকে। গায়ে ওর শীতের চাদর। ঠাকুর নমস্কার করে মুখ তোলে পুনুর মা ]
মা। ওমা, তাতা-ইতাকে নিয়ে এলে না?
পরেশ। পুজো শেষ হলে দত্তদের বাড়ির বড়ো ছেলে দিয়ে যাবে বলেছে। পুনু এসেছে?
মা। পড়তে বসেছে। (গলা তুলে) পুনু-
পরেশ। না না, ডাকছ কেন? (দাওয়ায় বসতে বসতে) একটা ভারী খারাপ খবর শুনলাম! বলাই পাগলা বোধ হয় আর বাঁচবে না!
মা। বলাই আবার এসেছে বুঝি?
পরেশ। জনার্দন মন্দিরের দাওয়ায় এসে উঠেছে। হাত-পা একেবারে ফুলে গেছে- যা অবস্থা, দেখলে সত্যি মায়া হয়! কী মানুষের কী পরিণতি!
[ দরজা ঠেলে পুনু ঢোকে ]
পুনু। কার কথা বলছ বাবা?
মা। বলাই পাগলা রে! তুই দেখেছিস কখনো?
পুনু। ওই একবার না দুবার! উঃ, যা ভয় পেতাম না আগে-দিদি আমাকে দিয়ে কিছু করাতে হলেই ওই বলাই পাগলার ভয় দেখাত।
পরেশ। ওরকম কিন্তু ছিল না ছেলেটা-বুঝলি! ভালো ঘরের ছেলে-মধুপণ্ডিত ওর বাপ, আমাদের পাড়ার পাঠশালায় পড়াত। অবস্থা-টবস্থাও ছিল বেশ ভালো। ওই জনার্দনের মন্দির-বকুলতলার মাঠ-বড়োপুকুর-শিবমন্দির-সবই ছিল ওদের সম্পত্তি।
মা। ব্যাস, বাপ-মেয়েতে এখন বসে পড়লেন গপ্পো করতে। আমি যাই! কত দিন বলে বলে দুটো চাল গুঁড়োতে পেরেছি-ওবছর তো করতেই পারিনি, ভগবানের দয়ায় এবার তবু জোগাড় হয়েছে। দুটো পিঠে করে দেব তোদের আজ।
[ দরজা দিয়ে মঞ্চের বাইরে চলে যায়
পুনু। এত সব ছিল ওদের তো গরিব হয়ে গেল কী করে?
পরেশ। আর কী বলি বল-ওই তোদের নগেনকাকা! সব সম্পত্তি ওর কাছে বেচে খেয়েছে মধুপণ্ডিত।
পুনু। ইস, কত পাপ যে করেছে না বাবা, ওই লোকটা-শেষ নেই তার! একটা পাঠশালার পণ্ডিতকে ঠকিয়ে-ছি ছি ছি!
পরেশ। শুধু কি তাই রে! লোকটার ধর্মাধর্ম জ্ঞানও নেই। মধুপণ্ডিতের অনেক দেবোত্তর সম্পত্তি ছিল-তাও সব পেটে ঢুকেছে নগেনের। অথচ একটু দেবসেবা দিতে বললেই মুখ ভার।
পুনু। দূর, দূর, ছাড়ো তো ওর কথা-বলাই পাগলা পাগল হল কী করে সেই কথা বলো।
পরেশ। কী করে জানব বল! এমনিতে তো বেশ ভালোই ছিল ছেলেটা। পড়াশোনাতেও ভালো-মায়াদয়া ছিল শরীরে-গুরুজনদের ভক্তি-টক্তিও করত-ওই মা-টা মরে গেল তো পরীক্ষার ঠিক আগে। পরীক্ষাটা আর দেওয়া হল না। সেই একটা শক পেয়েছে মনে হয়। তারপর অবশ্যি মিলিটারি না কীসে একটা চাকরিও পেয়েছিল-সে অবশ্যি ওই কটা মাসের জন্যে! ফিরে এল যখন, একেবারে বদ্ধ উন্মাদ।
পুনু। তখন ডাক্তার-টাক্তার কিছু-
পরেশ। দূর কে করছে! (উঠে পড়ে) মা নেই-বাপটাও মরেছে-কে ওর জন্যে মাথা ঘামাচ্ছে বল-
পুনু। (উঠতে উঠতে) উঠে পড়লে যে?
পরেশ। হাত-মুখটা একটু ধুয়ে আসি পুকুর থেকে। যা তুইও ভেতরে যা-হিম পড়ছে, আর বেশিক্ষণ বাইরে থাকিসনি।
[ পরেশ ডান দিকে চলে যায়
পুনু। (স্বগত) ওঃ, এই শয়তানটাকে কেউ কিছু করতে পারে না! কত লোককে কষ্ট দিয়েছে-কত লোকের সব কিছু কেড়ে নিয়েছে, তবু-
বিশে। (নেপথ্যে) পরেশ জ্যাঠা-পরেশ জ্যাঠা-
[ ডান দিক দিয়ে ঢুকে পড়ে বিশে ]
এই, পরেশ জ্যাঠা আছে নাকি রে?
পুনু। কেন রে, কী হয়েছে?
বিশে। না, বাড়িতে সত্যনারাণ হবে, তাই বলতে এসেছি। বলে দিস তুই জ্যাঠাকে- [ যেতে উদ্যত ]
পুনু। এই বিশে, শোন-
[ বিশে ঘুরে আসে ]
তুই বলাই পাগলাকে দেখেছিস?
বিশে। দূর! ওর কাছে কে যাবে! কেন রে, এসেছে নাকি আবার?
পুনু। বাবা তো তাই বলল। যাবি দেখতে?
বিশে। কী বলছিস, এই সন্ধেবেলা?
পুনু। দূর বোকা, এখন কে যেতে বলেছে! সকালে যাবি?
বিশে। যেতে তো ইচ্ছে করে খুব, কিন্তু কামড়ে-টামড়ে যদি দেয়- কি ধর যদি তাড়া করে-
পুনু। ওঃ! খুব বীরপুরুষ তুই! আমি সঙ্গে থাকলেও ভয় করবে?
বিশে। ধুস! তা বলিনি-ভয় আবার কী-দুজনে থাকলে আবার-
পুনু। থাক থাক, খুব হয়েছে। আসিস তাহলে কাল সকালে, হ্যাঁ? একেবারে ভোরবেলা কিন্তু। পরে আবার কে বারণ-টারন করবে! মা পিঠে ভাজছে, আমি কখানা পিঠে নিয়ে নেব বলাইদার জন্যে।
বিশে। দূর! পাগল আবার পিঠে খায়!
পুনু। দেখি না খায় কি না! (বিশে চলে যাচ্ছে দেখে) সক্কালবেলা কিন্তু- [বিশে চলে যায়
[ পুনু অন্যমনস্কের মতো তাকিয়ে আছে। পরদা পড়ে বা মঞ্চ অন্ধকার হয় ]
পঞ্চম দৃশ্য
স্থান জনার্দন মন্দির। সময় সকাল
[ মন্দিরের সামনে হেলান দিয়ে বসে আছে বলাই পাগলা। খোঁচা খোঁচা দাড়ি-গোঁফ। লম্বা লম্বা চুল-রুক্ষ, তেল পড়েনি দীর্ঘকাল। খালি গা, ধুলোয় মলিন। জীর্ণ বহু পুরোনো প্যান্ট। পায়ে একটা ঘা। বলাই বিড়বিড় করে আপন মনে কী বকছে আর মাঝে মাঝে হাসছে।
বিশে ও পুনু ঢুকে পড়ে আস্তে আস্তে। বিশের গায়ে সোয়েটার, পুনুর গায়ে চাদর। পুনুর হাতে পদ্ম পাতায় মোড়া পিঠে। পুনু এগিয়ে যায়, কিন্তু বিশেকে দেখে বোঝা যায় খুব ভয় পেয়েছে। অতি সন্তর্পণে একটু একটু করে এগোয় ]
বলাই। যা-যা-যুদ্ধ করব! আমি কি পাগল! এই-পালা! যাঃ!
পুনু। ও কী বলাইদা, তাড়িয়ে দিচ্ছ? আমি এতদূর থেকে তোমার কাছে এলুম-
[ বলাই থমকে যায়। পুনু একেবারে মুখের সামনে গিয়ে বসে। পেছন থেকে বিশে অঙ্গভঙ্গি করে, ওকে ইঙ্গিত করে চলে আসতে। পুনু গ্রাহ্যই করে না। বলাইয়ের বকবকানি বন্ধ হয়ে যায়। চুপ করে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে পুনুর দিকে ]
বিশে। (চাপা গলায়) চলে আয়-কামড়ে দেবে!
[ পুনু বা বলাই কেউই একথা শুনতে পায় না। বলাই ওইভাবেই তাকিয়ে থাকে পুনুর দিকে। হঠাৎ ওর চোখ ঠেলে কান্না বেরিয়ে আসে, জল গড়িয়ে পড়ে গাল দিয়ে ]
পুনু। একী! বলাইদা! তুমি কাঁদছ কেন? ও বলাইদা-
[ বলাই কথা বলে না, নীরবে কেঁদেই চলে ]
বলাইদা! বলো না কী হয়েছে! তোমার কি শীত করছে?
[ পুনু চট করে নিজের গায়ের চাদরটা বলাইয়ের গায়ে চাপিয়ে দেয়। হতভম্ব হয়ে যায় বলাই। তারপরই নীরবতা ভেঙে হঠাৎ বাচ্চা ছেলের মতো হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে সে।
বিশে সন্তর্পণে আস্তে আস্তে পুনুর দিকে এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে একটা টান মারে। পুনু ছাড়িয়ে নেয় হাত, অন্য কোনোদিকে খেয়াল নেই এখন ওর। গভীর মমতায় চেয়ে থাকে বলাইয়ের দিকে ]
পুনু। কাঁদছ কেন-ও বলাইদা-বলো না, কেন কাঁদছ? তোমার খিদে পেয়েছে?
[ বলাই দু-দিকে মাথা ঝাঁকায়, অর্থাৎ পায়নি ]
এই তো তুমি কী সুন্দর আমাদের মতো হয়ে গেছ। সবাই তোমায় পাগল বলে কেন গো বলাইদা? (মাথা ঘোরায় বিশের দিকে) দেখছিস বিশে, বলাইদা মোটেই পাগল নয়।
বিশে। (ফিসফিস করে) দেখেছি। তুই পালিয়ে আয়।
পুনু। (পুনু ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে মাথা ঘুরিয়ে নেয়); তোমার জন্যে আমি পিঠে নিয়ে এসেছি।
[ পুনু পদ্মপাতায় মোড়া খাবারটা দেয়, বলাই সুস্থ মানুষের মতোই খাবার নেয়। পাশে রেখে দেয় ]
বলাই। শোনো-তোমাকে বলছি-
পুনু। (আগ্রহ ভরে) হ্যাঁ হ্যাঁ, বলো বলো-
বলাই। তোমার মুখটা না-ঠিক-ঠিক আমার মায়ের মতো! ঠিক ওই টানা টানা চোখ-
[ পুনুর দু-চোখ জলে ভরে ওঠে। বিশেরও ততক্ষণে ভয় কেটেছে, পায়ে পায়ে এগিয়ে এসেছে সামনে ]
পুনু। দেখছিস বিশে, কে বলে বলাইদা পাগল!
বিশে। তাইতো দেখছি রে!
পুনু। বলাইদা, ও বলাইদা, একটু খাও না! খাবে? পিঠে!
[ বলাই আর একটু সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করে। সোজা হতে ওর কষ্ট হচ্ছে মনে হয়। চাদর দিয়ে ওর চোখের জল মুছিয়ে দেয় পুনু। বলাই এখন কথা বলবে বেশ টেনে টেনে, যেন কষ্ট হচ্ছে কথা বলতে-দমের ঘাটতি পড়ছে ]
বলাই। তোমার-শাড়ি নেই? শাড়ি! সেই চওড়া লালপেড়ে শাড়ি! নেই?
পুনু। কেন? শাড়ি কী হবে?
বলাই। একবার-শুধু একটিবার তুমি পরে আসবে-তারপর, তারপর-(কাশির দমক আসে, একটু পরে সামলে নিয়ে) আমি দেখব-একবার শুধু দেখব-একবার-(আবার কাশির দমক) লালশাড়ি না হলে মাকে আমার মানায়? (আবার কাশতে শুরু করে। এবার কাশতে কাশতে অবসন্ন হয়ে নেতিয়ে পড়ে, শুয়ে পড়ে)
পুনু। এই বিশে, একবারটি বাড়ি যেতে পারবি?
বিশে। কেন?
পুনু। মার একটা পুরোনো লালপেড়ে শাড়ি আছে-সেটা নিয়ে আয় না চট করে! বলবি সেজো মাসি যেটা দিয়েছিল পুজোয়-
বিশে। যদি আমায় না দেয়?
পুনু। তুই যা না একবার! শিগগির কিন্তু-
[ বিশে চলে যায়। পুনু বলাইয়ের কাছে আসে ]
বলাইদা, ও বলাইদা-বলাইদা! (স্বগত) ঘুমিয়ে পড়েছে! ডেকে কাজ নেই। (ঘাড় ঘুরিয়ে চারদিক দেখে) ইস, কী নোংরা জায়গাটা-
[ বিশে আসার আগে পর্যন্ত পুনু ওই জায়গাটা পরিষ্কারের কাজে লেগে থাকবে। আগে বলাইয়ের চোখের কোনটা মুছিয়ে দেয়। তারপর খাবারটা সরিয়ে একটু দূরে রেখে জায়গাটা পরিষ্কার করে বেশ খানিকক্ষণ ধরে। এর মধ্যেই বিশে শাড়ি নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ঢোকে ]
বিশে। এই নে! (শাড়ি এগিয়ে দেয়) জ্যেঠিমা খুব রেগে গেছে তুই এখেনে এসেছিস শুনে।
পুনু। ধুৎ! তুই বলতে গেলি কেন?
বিশে। না, বলবে না! জেরার মুখে পড়লে বুঝতিস! জেঠুও চ্যাঁচামেচি করছে। বাড়িতে আবার নগেনকাকাও রয়েছে দেখলাম।
পুনু। থাকুক। দে-
[ পুনু কাপড় নিয়ে উইংসের বাইরে চলে যায়। ভালো হয় মন্দিরের পেছনে চলে গিয়ে কাপড়টা পরার ব্যবস্থা থাকলে। বিশে বলাইয়ের চারদিকে উঁকি ঝুঁকি মারে। সন্দেহ হয়। পাশে বসে পড়ে ]
বিশে। বলাইদা-ও বলাইদা! বলাইদা! (বিশের সন্দেহ ঘনীভূত হয়। গায়ে ধাক্কা দেয় আস্তে আস্তে। কয়েকবার পরে জোরে ধাক্কা মারে। দেহটা অদ্ভুতভাবে কাত হয়ে পড়ে। আঁতকে পিছিয়ে আসে বিশে। অদ্ভুত গলায় ডাকে-) পুনু-
[ পুনু হন্তদন্ত হয়ে শাড়ি পরে চলে আসে ]
পুনু। কীরে! কী হয়েছে কী?
[ বিশে কথা বলতে পারে না। আঙুল দিয়ে বলাইকে দেখায় ]
কী হয়েছে বলাইদার? অ্যাঁ! কীরে! কথা বলছিস না কেন! বলাইদা-
বিশে। বলাইদা মরে গিয়েছে!
পুনু। অ্যাঁ!!
[ পুনু ধপ করে বসে পড়ে ওখানে। বলাইয়ের মাথা, মুখ-চোখে হাত বুলোয়। কাঁদতে থাকে ফুঁপিয়ে ]
পুনু। বলাইদা, ও বলাইদা-আমি তো লালপেড়ে শাড়ি পরেছি। ও বলাইদা, একবার দেখো তুমি-একটিবার দেখো! বলাইদা গো, দেখো না-
[ সবেগে ঢুকে পড়ে পরেশ ও নগেন ]
পরেশ। এই তো-এই তো পুনু। পুনু-
[ পুনুর কোনো সাড় নেই, সাড়াও দেয় না। বিশে সচকিত ]
নগেন। উঁ! কী গন্ধ রে বাবা! কী হয়েছে রে বিশে?
বিশে। বলাইদা মরে গিয়েছে।
নগেন। অ্যাঁ! ছ্যা ছ্যা ছ্যা-সেই মড়া ঘাঁটছে পুনু! বামুনের মেয়ে হয়ে! ও পরেশদা, এ কীসব কাণ্ডকারখানা শুরু করেছে গো তোমার মেয়ে!
পরেশ। করাচ্ছি! কায়দা করে আবার শাড়ি পরা হয়েছে! ছি ছি ছি-মাথা হেঁট করে দিলি তুই আমার-ছিঃ!
[ পুনু সামনে ফেরে। উঠে দাঁড়ায় আশ্চর্য শান্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে আসে সবার সামনে ]
পুনু। একটু আস্তে কথা বলো বাবা! একজন লোক এখানে মারা গিয়েছেন।
নগেন। উঁ! মারা গিয়েছে! মারা গিয়েছে না হাড় জুড়িয়েছে। একটা বদ্ধ পাগল! আর তারই জন্যে তুমি-
পুনু। থামুন! আপনার সঙ্গে কথা বলতে আমার ঘেন্না করে। বাবা, তুমি-
পরেশ। চুপ কর! কাকার সঙ্গে কথা বলতে ঘেন্না করে! তোর সঙ্গে কথা বলতেও আমাদের ঘেন্না করে। ভালো করে শুনে রাখ, আর কোনোদিন তুই মুখ দেখাবি না আমাদের- এক্ষুনি বেরিয়ে যা তুই আমার সামনে থেকে! যা-
পুনু। তার মানে, আমি হেরে গেলুম বাবা! ঠিক আছে, তাই হবে। যদি কোনোদিন জিতি, সেদিনই ফিরে আসব।
পরেশ। হ্যাঁ, তাই আসিস! এখন দূর হয়ে যা তুই-
পুনু। না বাবা, আর একটা কাজ আমার বাকি আছে এখনও, সেটা শেষ না করে তো আমি যেতে পারব না। এঁর একটা সৎকার তো করতে হবে!
নগেন। কী! সৎকার! আরে ওর কুট হয়েছে-ওর আবার সৎকার কী! বেনো ডোমকে একশোটা টাকা দেব-বেঁধেছেঁদে পুঁতে দিয়ে আসবে নদীর ঘাটে। কী বলো পরেশদা?
পরেশ। ব্যাস ব্যাস, আবার কী?
পুনু। তুমিও তাই বলছ বাবা! মধুপণ্ডিতের ছেলের সৎকার হবে না?
পরেশ। শুনলি তো নগেন, কী বলল?
পুনু। ওসব কথা তুমি শোনো বাবা। (অত্যন্ত দৃঢ় স্বরে) বিশে, যা তো পাড়ার সকলের কাছে-প্রত্যেকের কাছে চাঁদা তুলবি। সেই টাকায় দাহ করব আমরা। দরকার হলে মন্দিরের পেছনের নিম গাছটা কাটাব। যা তুই-
[ বিশে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে যায়
নগেন। অ্যাঁ! আমার নিম গাছ কাটা হবে! আমি অঞ্চলপ্রধান-আমার কথা অমান্যি? ঠিক আছে, চলে আসুন পরেশদা-এসব পাগলামি কী করে আটকাতে হয়, খুব ভালো করেই জানা আছে আমার, আসুন- ভালো কথার মেয়ে ও নয়, এবার খারাপটা যে কী হতে পারে সেটাও একটু ওর বোঝা দরকার। চলে আসুন-
[ পরেশকে প্রায় টানতে টানতে নিয়ে বেরিয়ে যায় নগেন। অচঞ্চল দাঁড়িয়ে থাকে পুনু। এতরকম ঘটনা ঘটে যায়, অথচ ও একটুও নড়ে না সিদ্ধান্ত থেকে ]
পুনু। পারবে না, তোমরা পারবে না-কেউ টলাতে পারবে না আমাকে-আমি যে একটা ভালো কাজ করছি বাবা-সবাই মিলে আমরাই দাহ করব বলাইদার।
[ মঞ্চ অন্ধকার হয় বা পরদা পড়ে ]
ষষ্ঠ দৃশ্য
স্থান মুংরির কুঁড়ে। সময় ভোরবেলা
[ পুনু দাওয়ায় শুয়ে, কম্বল চাপা। পাশে মুংরি। ঘুম ভাঙে ওর। ধড়মড় করে উঠে বসে, তখন দেখা যায়, সেই লাল শাড়ি পরে আছে ]
মুংরি। না না পুনুদি, উঠো না-শুয়ে পড়ো। তোমার যে জ্বর হয়েছে-গা একেবারে পুড়ে যাচ্ছে-
পুনু। আমি, এখানে-মানে-
মুংরি। ওমা, তোমার মনে পড়ছে না বুঝি! ওই অত রাত্তিরে কাল একা একা একেবারে দুগগা ঠাকুরের মতো এসে দাঁড়ালে-হ্যাঁগো, আমাদের বাড়ির সামনে! আমার নাম ধরে ডাকলে-
পুনু। আমি?
মুংরি। হ্যাঁ গো, তুমি! আমি তো প্রথমে চিনতেই পারিনি তোমায়-বাপরে তোমার তখন কী চেহারা গো!
পুনু। কেন? কী করেছিলাম আমি! কী হয়েছে বল তো-
[ বৃন্দাবন ঢোকে হাসিমুখে ]
বৃন্দাবন। ও আবার কী বলবে পুন্যিদিদি, কী করে যে ওসব করলে সেকথা ভেবে আমারই তো চোখ কপালে ওঠার জোগাড়! গাঁয়ে যে একেবারে হইচই ফেলে দিয়েছ! অঞ্চলপ্রধান তো একেবারে ছটফটিয়ে মোল-
পুনু। কেন?
বৃন্দাবন। হবেনি! স্বয়ং গোখরো সাপের ল্যাজে পা! অঞ্চলপ্রধান বলে কথা-সে বললে বলাই দাদাঠাকুরের সৎকার হবেনি, আর তুমি কিনা-
[ পুনু অবাক চোখে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে ]
বৃন্দাবন। তোমার কিচ্ছুটি মনে পড়ছে না?
মুংরি। সে কী গো পুনুদি, বাবা তো রাত থাকতে বেরিয়েছিল-কোথায় কী হচ্ছে দেখবার জন্যে। তা তোমার জন্যে তো এখন জোর তল্লাসি চলছে গো!
পুনু। কেন? আর কী করেছি আমি?
বৃন্দাবন। আরে ওই করাতেই বলে যা তা কাণ্ড! দাঠাকুরের দেহ আগলে বসে ছিলে-তোমার চ্যালাচামুন্ডোরা টাকা-পয়সা তুলে আনল-সে আরও কত! তখন তুমি হুকুম দিলে, জনাদ্দন মন্দিরের নিম গাছ কেটে ফেল! নগেন দত্ত বারণ করবে কী, তোমার সে মুত্তি দেখে ভয়ে একেবারে কেঁচো গো, পুন্যিদিদি। আরে সেই কাঠেই তো দাহ হলেন দাদাঠাকুর।
পুনু। হ্যাঁ হ্যাঁ, এবার মনে পড়েছে। সকলে মিলে শ্মশানে গেলাম-অনেক লোক-তারপর আমিই তো আগুন ছোঁয়ালাম প্রথমে-
বৃন্দাবন। আহা হা হা পুন্যিদিদি-নিজের চোখে একটু দেখতে পেলাম না-সবাই বলছে সে এক দারুণ দিশশো! তুমি যেন সাক্ষাৎ দেবী-
[ ডানদিক দিয়ে দৌড়ে আসে টুকু। রীতিমতো হাঁপাচ্ছে ]
পুনু। একী রে! তুই কোত্থেকে? আয় আয়-
[ টুকু এসে দাওয়ায় উঠে বসে ]
মুংরি। কে রে তুই?
পুনু। (ওকে কাছে টেনে নেয়) ও টুকু। আমার ছোট্ট ভাই। কী হয়েছে রে টুকু?
টুকু। (দম নিতে নিতে) মামা-ধরতে আসছে তোমায়-পুলিশ নিয়ে।
মুংরি। মামা আবার কে?
পুনু। নগেনকাকা রে! হ্যাঁ রে টুকু, ওরা কী করে খবর পেলে রে আমি এখানে আছি?
টুকু। সে আমি কী জানি! মামা আর দারোগা তোমায় ধরতে আসছে-খবর পেয়েই আমি ছুট।
মুংরি। তাহলে! কী হবে বাবা?
বৃন্দাবন। আরে বেন্দামাঝি থাকতে পুলিশের ভয়! জোয়ার এসেছে এখন নদীতে-একেবারে ঝপ করে বৈঠা মারব, আর খপ খপ করে পগার পার-
পুনু। না বেন্দাকাকা, তা হয় না।
বৃন্দাবন। হয় না! কেন?
পুনু। পুলিশের চোখকে কি ফাঁকি দেওয়া যায়! কতক্ষণ লড়াই করবে তুমি ওদের সঙ্গে?
টুকু। আমিও লড়াই করতে পারি পুনুদি, আমার গুলতি আছে।
টুকু। (একেবারে টেনে নেয় বুকে) দূর পাগলা! মিছিমিছি লড়াই করতে যাব কেন, পুলিশ কি আমার শত্রু?
মুংরি। বাঃ, তা নইলে তোমায় ধরতে আসছে কেন?
পুনু। ভয় পেয়ে পালালে তো আরও বেশি করে ধরতে চাইবে। আমরা কি ভীতু নাকি, বল টুকু, যে পালাব! কী করেছি কী আমি?
বৃন্দাবন। ঠিক কথা! কী করেছে কী আমার মেয়ে। সেই কথাটাই শুধোতে হবে দারোগাবাবুকে-
[ বৃন্দাবনের কথা শেষ হবার আগেই নেপথ্যে জিপ গাড়ি থামার শব্দ। শব্দ শুনেই চমকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় টুকু। নেমে পড়ে মেঝেতে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঢোকে নগেন দত্ত ও দারোগা শেখর চাটুজ্যে। নগেনের প্রথমেই চোখ পড়ে টুকুর ওপর ]
নগেন। আরে এই ছোঁড়া! তুই এখানে কী করছিস! যা যা-চলে যা-
শেখর। আপনি কি ওকেই ধরতে এখানে-
নগেন। না না না-ওই যে লালপেড়ে শাড়ি পরে-আর ওই হচ্ছে বেন্দামাঝি, সারারাত একটা কালপ্রিটকে আশ্রয় দিয়ে-হারামজাদা, পাজি, বদমাস-
পুনু। (উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে পুনু। নীচে আসতে আসতে-) নগেনকাকা! মুখ খারাপ করবেন না এখানে- (দারোগার দিকে এগিয়ে যায়।) আপনি কি আমাকে খুঁজছেন স্যার?
শেখর। তুমিই কি পুনু?
পুনু। হ্যাঁ স্যার, আমার নামই প্রণতি রায়, পরেশ রায় আমার বাবা।
শেখর। কোন ক্লাসে পড়ো তুমি?
পুনু। নাইনে উঠেছি এবার।
শেখর। শোনো, তোমাকে একবার যেতে হবে আমার সঙ্গে। তোমার নামে এঁর একটা অভিযোগ আছে। অবশ্য সেটা ঠিক কি না আমি বুঝতে পারছি না, তোমার মতো একটা বাচ্চা মেয়ে-
নগেন। বিচ্ছু মেয়ে স্যার-বিচ্ছু মেয়ে-ওর কথায় আপনি-
শেখর. আঃ! আমায় কথা বলতে দিন। পুনু, কিছু বলবে?
পুনু। উনি ঠিকই বলেছেন স্যার, নিম গাছটা আমিই কাটতে বলেছিলুম কাল। আমি না বললে তারা কাটত না।
নগেন। অ্যাই-দেখলেন স্যার! ওটাই পালের গোদা! বলেছিলুম কিনা-অ্যাঁ!
শেখর। দয়া করে চুপ করবেন একটু? যান, আপনি একটু বাইরে যান তো-
নগেন। আমি! মানে-আমি গেলে-
শেখর। আমি তো থাকলাম। ওকে আমি নিরিবিলিতে দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।
নগেন। ও! ঠিক আছে! আরে এই ছোঁড়া-তুই এখনও যাসনি?
টুকু। না, আমি এখন যাব না।
নগেন। যাবি না! ঠিক আছে, চল বাড়িতে! পিটিয়ে যদি তোর- [ নগেন চলে যায়
শেখর। ঠিক আছে খোকন, তুমি তাহলে ওদের নিয়ে ভেতরেই যাও।
টুকু। আমি খোকন নই, আমার নাম টুকু।
শেখর। (হেসে) বেশ বেশ-তা টুকুবাবু, তোমার এই দিদিকে যে আমি চুপিচুপি কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করব।
মুংরি। চল রে টুকু-এসো বাবা।
[ মুংরি, টুকু, বৃন্দাবন দাওয়ায় উঠে চলে যায়
শেখর। ব্যাস, এইবার বলো তুমি কী বলবে। আমার মনে হচ্ছে, মিথ্যে কথা-টথা তুমি বিশেষ বলতে পারবে না।
পুনু। সবচেয়ে সত্যি কথাটা বলব স্যার আগে? আমার না ভীষণ খিদে পেয়েছে।
শেখর। অ্যাঁ! [ সজোরে হেসে ওঠে হঠাৎ ] চমৎকার। পুলিশ-অফিসার শেখর চাটুজ্যে তোমার মতোই একটা মেয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিল অ্যাদ্দিন।
পুনু। আপনি! কেন স্যার?
শেখর। মানে পুলিশের হাতে ধরা পড়েও যার খিদে-তেষ্টা থাকে। ঠিক আছে, বাড়ি গিয়ে আগে খেয়ে নাও-
পুনু। না স্যার, বাড়ি আমি যেতে পারব না।
শেখর। অভিমান হয়েছে বুঝি? (পুনু মাথা নিচু করে, নিরুত্তর থাকে) যাকগে, সেকথা পরে হবে-তোমার কী বলার আছে তাই বলো।
পুনু। আপনি-আপনি বিশ্বাস করুন স্যার-যে লোকটা আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছে সে লোকটা কিন্তু-
শেখর। জানি জানি। এখানকার দারোগা হয়ে আমি নগেন দত্তকে চিনব না! কিন্তু হাতেনাতে প্রমাণ না পেলে পুলিশ কী করতে পারে বলো?
পুনু। কিন্তু নগেন দত্ত মানুষটা যে আস্ত শয়তান স্যার। পুলিশ ইচ্ছে করলে একটা শয়তানকে শায়েস্তা করতে পারে না?
শেখর। (নীরবে হাসে) পুনু-তুমি বাচ্চা মেয়ে-অনেক কথাই জানো না। এইসব নগেন দত্তদের ক্ষমতা পুলিশের চেয়ে কম নয়।
পুনু। (গম্ভীর হয়ে) ও! তাহলে আমাকেই ধরে নিয়ে চলুন-আমি ওঁর গাছ কেটেছি। দারুণ অন্যায় কাজ করেছি।
শেখর। ওরকম করে বলতে নেই-ছিঃ! কাজটা যে তুমি ভালোই করেছ সে তো সবাই স্বীকার করবে, কিন্তু আইনের চোখে তো তুমি অপরাধী। আর অপরাধীকে ধরতে পুলিশ বাধ্য, ঠিক কি না?
পুনু। সেইজন্যেই তো বললাম, আপনি নিয়ে চলুন আমাকে। তবে এও জেনে রাখুন, একদিন না একদিন ওই শয়তানটাকে আমি হাতেনাতে ধরিয়ে দেব আপনার কাছে-দেবই! এ আমার প্রতিজ্ঞা।
শেখর। বাপরে! এত বড়ো প্রতিজ্ঞা করে ফেললে? তাহলে তো আমাকেও কিছু একটা করতে হয়!
পুনু। আপনি তো বললেন আপনি ওঁর কিছুই করতে পারবেন না!
শেখর। না না, ওর নয়,-তোমার! থানায় না নিয়ে গিয়ে বরং আমি তোমাকে আমার বাড়িতেই নিয়ে যাই।
পুনু। সেকী! কেন?
শেখর। আধঘণ্টা তোমায় জেরা করেই ছেড়ে দেব-মানে তোমার যখন এত খিদে পেয়েছে, তোমার জন্যে বউদিকে আধঘণ্টা সময় তো দিতেই হবে!
[ ব্যাপারটা পুনু একেবারেই আশা করতে পারেনি। মুখচোখ সহসা প্রফুল্ল হয়ে ওঠে ]
পুনু। উঃ, কী ভালো যে হবে স্যার! একটু ভালো করে খাইয়ে দেবেন-কাল সকাল থেকে কিচ্ছু খাওয়া হয়নি।
শেখর। ও কে। তবে এতসব ব্যাপার কেউ যেন টের না পায়-মানে ওই নগেন দত্ত তো নয়ই। এসো তাহলে-আমি জিপে গিয়ে বসছি।
[ শেখর চলে যায়। একেবারে সঙ্গে সঙ্গে বৃন্দাবন, মুংরি, টুকু ঢোকে। উত্তেজনায় রুদ্ধশ্বাস ]
মুংরি। কী হল পুনুদি?
টুকু। তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে?
বৃন্দাবন। আমরা পায়ে ধরলেও ছাড়বে না?
পুনু। আঃ, শোনো না-আমার জন্যে চিন্তা নেই। তোমরা একটু আমার বাবা-মার খবর নিয়ো মাঝে মাঝে।
বৃন্দাবন। সেকী পুন্যিদিদি! তুমি কি তাহলে ওই গারদখানায়-
পুনু। আরে না না, সেখানে নয়-কিন্তু আমি এখন বাড়ি যেতে পারব না।
মুংরি। বা রে, কেন?
পুনু। একটা দারুণ কাজ বাকি আছে রে মুংরি। যদি জিতি তাহলেই ফিরতে পারব।
টুকু। আমাকেও সঙ্গে নাও তাহলে-আমার গুলতি আছে।
পুনু। ঠিক আছে, দরকার হলেই তোকে এসে আমি ডেকে নিয়ে যাব। কেমন!
মুংরি। ঠিক করে বলো পুনুদি-তুমি আসবে তো আবার?
পুনু। আসব, আসব, আসব। এই তিন সত্যি। চলি এবার?
[ পুনু ডান দিকে যায়, ওরাও সব যায়। পুনু বেরিয়ে যাবার আগে- ]
বৃন্দাবন। আমরা কিন্তু তোমার পথ চেয়ে বসে থাকব গো পুন্যিদিদি [পুনু চলে যায়
[ মঞ্চ অন্ধকার হয় বা পরদা পড়ে ]
সপ্তম দৃশ্য
স্থান পুনুদের বাড়ি। সময় সন্ধ্যা
[ তুলসীমঞ্চে প্রদীপ জ্বলছে। পুনুর মা সামনে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ]
মা। (স্বগত) আজ তিন মাসের ওপর মেয়েটা ঘরছাড়া, ঠাকুর। মেয়েটাকে তুমি ফিরিয়ে দাও। বড়ো সাধাসিধে মেয়ে আমার-ভালো ছাড়া মন্দ কাজ কখনো করেনি জীবনে-ওর কপালে আর দুঃখ দিয়ো না ঠাকুর। পাপ যদি কিছু করে থাকি সে তো করেছি আমরা-ও তো কোনো অন্যায় করেনি! ঠাকুর, মুখ তুলে চাও ঠাকুর-
[ ইতা ও পরেশ ঢোকে ]
পরেশ। এই ইতা-বারণ কর, মাকে কাঁদতে বারণ কর-
[ ইতা মায়ের দিকে এগিয়ে যায়, পুনুর মা উঠে পড়ে। প্রদীপ তুলে নিয়ে দরজা দিয়ে চলে যায়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উলটোদিক দিয়ে ঢোকে টুকু ]
টুকু। ইতাদি জানো তো মেলায় আজ খেলা দেখে এলাম। বাঁদর নাচ!
ইতা। তাই বুঝি!
টুকু। দারুণ খেলা দেখায় লোকটা! বাঁদরটাও খুব ভালো। আলাপ করতে পারতুম, কিন্তু লোকটা মুছুরমান বলে আর কাছে গেলুম না।
পরেশ। ধুস! মুসলমান তো তোর কী!
টুকু। (গম্ভীরভাবে) মামিমা বারণ করেছে। মেলায় কী সুন্দর ম্যাজিক এসেছে জেঠু-সেটা আরও ভালো! টুপির মধ্যে একটা রুমাল নাকি ডিম হয়ে যায়। বেড়ালছানা বাকসোর মধ্যে ঢুকলেই হয়ে যায় হাঁস।
ইতা। এমন করে বলছিস যেন দেখেছিস!
টুকু। দেখব কী করে! আমার কি অত পয়সা আছে নাকি! চলো না জেঠু, সবাই মিলে একদিন দেখে আসি!
পরেশ। যাবি! কি রে, ইতা-
ইতা। না বাবা, থাক। মেজদি ফিরে না এলে আর কিছু ভালো লাগে না।
টুকু। পুনুদি ফিরে আসবেই, তুমি দেখো।
ইতা। ইস তোর কথাই যেন সত্যি হয় রে।
টুকু। হবেই তো! আমাকে যে পুনুদি কথা দিয়ে গিয়েছিল! তাই তো আমি রোজ একা একা খেয়াঘাটে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। আমি তো লিখতে পারি-নদীর ধারে বট গাছটার গায়ে লিখে রেখেছি-পুনুদি, অনেক পাখির পালক কুড়িয়ে রেখেছি তোমার জন্যে। তুমি ফিরে এসো, পুলিশ তোমাকে আর ধরবে না। হ্যাঁ গো জেঠু!
পরেশ। ওতে কি আর কিছু হবে রে! খবরের কাগজে দু-দুটো বিজ্ঞাপন দেওয়া হল-ইতার পিসি আর পিসেমশাই কলকাতায় এত খোঁজখবর নিল-এত করেও যখন কিছু হল না-
[ হঠাৎ ঢোকে মা। হাতে একটা পোস্টকার্ড ]
মা। দেখো তো কার চিঠি! দরকারি চিঠি না হলে তো কেশব ঠাকুরপো এই অবেলায় দিতে আসে না-
পরেশ। দরকারি চিঠি আর কী আসবে! দেখ তো ইতা-
[ ইতা গিয়ে মায়ের হাত থেকে চিঠি নেয়। এক পলক চোখ বুলিয়েই লাফিয়ে ওঠে ]
ইতা। বাবা! মেজদি!
পরেশ। অ্যাঁ! সে কীরে!
মা। কী বলছিস কী!-ইতা!
টুকু। পড়ো না, ও ইতাদি!
পরেশ। দে দে, আমাকে দে-
ইতা। না না, আমি পড়ি-
[ দুজনে মিলে চিঠি নিয়ে কাড়াকাড়ি করে। মা ধৈর্য রাখতে পারে না ]
মা। আঃ, পড়ো না যে হোক তাড়াতাড়ি!
পরেশ। দেখি দেখি- (চিঠিটা নেয়) কী লিখেছে! আঃ, চোখটা আবার জলে এমন ঝাপসা হয়ে যায় কেন-পড়তে পারছি না-
ইতা। দাও তো আমায়-(নিয়ে নেয় চিঠিটা)
মা। হ্যাঁরে, কোত্থেকে লিখেছে-কবে লিখেছে? দেখ না ভালো করে!
ইতা। কলকাতার স্ট্যাম্প, না বাবা? (চিঠি আবার দেয়)
পরেশ। (কোঁচার খুঁটে চোখ মুছে) হ্যাঁ, তাই তো! কিন্তু ঠিকানা তো কিছু নেই!
টুকু। আঃ, চিঠিটা পড়ো না জেঠু!
পরেশ। হ্যাঁ হ্যাঁ, পড়ি-
শ্রীচরণেষু মা ও বাবা, আমি ভালো আছি। আমার জন্যে চিন্তা কোরো না। আমাদের ইস্কুলে ইংরেজির যে দিদিমণি আমায় খুব ভালোবাসতেন-চাকরি ছেড়ে চলে এলেন-তারই বাড়িতে আছি আমি এখন-
[ মা হাতজোড় করে ঠাকুরের উদ্দেশে প্রণাম করে ]
ইতা আর ভাই যেন রোজ ইস্কুলে যায়, দেখো। আমি এখন ফিরব না। যদি কোনো দিন জিততে পারি সেদিনই ফিরব। তোমরা আমার প্রণাম নিয়ো। ওদের ভালোবাসা দিয়ো। মুংরি ভালো আছে তো? টুকুকে বোলো, আমি রোজ ওর কথা মনে করি। ইতি- তোমাদের পুনু।
মা। দোহাই ঠাকুর, মুখ তুলে চেয়েছ এতদিনে।
ইতা। (চিঠিটা নিয়ে) দেখো মা চিঠিটা শুঁকে! মেজদির চুলের গন্ধ-(গন্ধ শুঁকে) আঃ। দেখলি টুকু, মেজদি কত ভালো! তোর কথাও লিখেছে!
টুকু। লিখবেই তো! আমিও তো রোজ বসে থাকি ওর জন্যে। যাক গে জেঠু, মন তো ভালো হয়েছে এখন-কাল তাহলে আমরা মেলায় যাব!
ইতা। ম্যাজিক নয় কিন্তু, ওটা তোলা থাক মেজদির জন্যে।
টুকু। ঠিক আছে, বাঁদর নাচই যাই। কি জেঠু, যাবে তো?
মা। হ্যাঁ রে হ্যাঁ, নিশ্চয়ই যাব! আঃ! মেয়েটা বেঁচে আছে-এতেই আমি নিশ্চিন্তি। তোরা সবাই মিলে যাবি কাল মেলা দেখতে।
টুকু। আমি তাহলে আসছি-(টুকু হাঁটতে থাকে)
পরেশ। ওকীরে, চললি কোথায়?
টুকু। বাঃ, বাঁদরওয়ালার সঙ্গে একটু আলাপ করে রাখতে হবে না?
পরেশ। পাবি কোথায় তাকে এখন! সন্ধে হয়ে গিয়েছে তো!
টুকু। পাব পাব-সে এখন মামিমার কাছে ঘুরঘুর করছে-দেখে এসেছি।
ইতা। তাই নাকি?
টুকু। হ্যাঁ। মামিমা এক কাঁসি মুড়ি আর এক থাবা গুড় দিয়েছে। ও এখন যাচ্ছে না হুট করে-ওর কায়দা আমি বুঝতে পেরেছি-রাত্তিরে কোথাও থাকতে হবে তো, তাই মতলব কষছে কিছু একটা!
পরেশ। বাবা, কী পাকা রে তুই-
টুকু। (যেতে যেতে) তাইতো পাকা খবর আনতে যাচ্ছি জেঠু-
[ সকলে হো হো করে হেসে ওঠে। টুকু চলে যায়
[ অন্ধকার হয়ে যায় বা পরদা নেমে আসে ]
অষ্টম দৃশ্য
স্থান জনার্দন মন্দির। সময় রাত আটটা
[ মন্দিরের সামনে একটু ছড়িয়ে বসে আছে ইয়াসিন। কাঁচা দাড়িগেঁাফের জঙ্গল মুখে। মাথায় মুসলমানি টুপি। সামনে একটা বিরাট ঝোলা। একটু দূরে একটা সস্তা ট্র্যানজিস্টর রেডিয়ো, তাতে একটা পুরোনো হিন্দি গানের সুর বাজছিল। ইয়াসিন মাথা নেড়ে নেড়ে শুনছে। একটু পরে ক্লান্তিতে আড়ামোড়া ভাঙে। তখনই নগেন দত্ত ঢোকে, তার পেছন পেছন টুকু। ওদের দেখেই ইয়াসিন হাত বাড়িয়ে রেডিয়ো বন্ধ করে, উঠে দাঁড়ায় ]
নগেন। আরে! তুই আবার এখানে কেন! পালা!
টুকু। এখুনি চলে যাচ্ছি মামা! একটু দেখি না বাঁদরওলাকে।
নগেন। বাঁদরওলাকেও দেখতে হবে! পাজি নচ্ছার কোথাকার!
ইয়াসিন। থাক না হুজুর, থাক-বাচ্চালোগ-
নগেন। বিচ্ছু! যাক গে, বলো ইয়াসিন-সব ঠিক আছে তো? থাকতে পারবে এখানে?
ইয়াসিন। জি হুজুর।
নগেন। বাঁদর কোথায় তোমার?
ইয়াসিন। পিছে হুজুর। নিদ গিয়েছে মালুম।
নগেন। দেখো, ওটা যেন আবার ঝুটঝামেলা না বাধায়।
ইয়াসিন। না হুজুর, ঝামেলা করবে কেন? ও তো আমার পোষা!
নগেন। না, মানে মন্দির বলে কথা তো! তুমিও ভেতরে ঢুকবে না-পেছনে বিরাট চাতাল, ওখানেই কদিন ঘুমোবে। তবে শুধু রাতটুকু কিন্তু, মনে থাকবে তো?
ইয়াসিন। জি হুজুর।
নগেন। শুধু অঞ্চলপ্রধান বলেই ব্যবস্থাটা করতে পারলাম, না হলে কিন্তু-
ইয়াসিন। আল্লা আপনার দোয়া করবে হুজুর। আপনার মেহেরবানি ইয়াসিন কখনো ভুলবে না।
নগেন। ঠিক আছে, চলি তাহলে-এই, আয় না রে ছোঁড়া!
টুকু। তুমি চলো মামা, আমি একদৌড়ে তোমাকে ধরে ফেলব।
[ নগেন চলে যায়। ইয়াসিন বসে। ঝুলি হাঁটকে শাঁকালু বার করে সেটা টুকুকে দেখিয়ে- ]
ইয়াসিন। কি, শাঁকালু খাবে?
টুকু। (হেসে ফেলে) তুমিও শাঁকালু খাও?
ইয়াসিন। হাঁ! এতে হাসির কী হল?
টুকু। তোমার বাঁদরকেও তো এই শাঁকালু খাওয়াও-আমি দেখেছি।
ইয়াসিন। খাও খোকা-ভালো লাগবে।
টুকু। না, আমি খাব না। আমার নাম কিন্তু খোকা নয়, টুকু।
ইয়াসিন। আচ্ছা-! তো সন্ধেবেলা নদীর ধারে তুমিই দাঁড়িয়েছিলে, তাই না?
টুকু। তুমি দেখেছ? আমি রোজ দাঁড়াই ওখানে। পুনুদির জন্যে।
ইয়াসিন। কে?
টুকু। আমার পুনুদি। আমার তো বাবা নেই, মা রোজ লুকিয়ে কাঁদে-শুধু পুনুদি আমাকে খুব ভালোবাসে।
ইয়াসিন। কোথায় তোমার পুনুদি?
টুকু। এখানে নেই, কিন্তু আসবে। ওই নদী পেরিয়ে আসবে-সেইজন্যেই তো আমি বসে থাকি।
[ ইয়াসিন একটু যেন অন্যমনস্ক হয়ে যায়। ঝুলি থেকে একটা কলাইকরা মগ বার করে। সেটা এগিয়ে দেয় ]
ইয়াসিন। একটু জল আনতে পার টুকু?
টুকু। কেন পারব না? (হাত বাড়িয়ে মগ নেয়) সবই তো আমার চেনা-
[ বেরিয়ে যায় টুকু মগ নিয়ে
[ ইয়াসিন ঝুলিতে আরও কীসব খুঁজছে। টুকু জল নিয়ে ঢুকে ইয়াসিনের সামনে মগটা নামিয়ে দেয়। ইয়াসিন সেটা নিয়ে ঢক ঢক করে খেয়ে ফেলে ]
ইয়াসিন। লক্ষ্মী ছেলে। ভীষণ তেষ্টা পেয়েছিল।
টুকু। আমি এখন যাই-নইলে মামা ধরে পেটাবে। পরে আসব আমি।
ইয়াসিন। সেকী! রাত্তিরে? ভয় করবে না তোমার?
টুকু। ধুস! ঘুটঘুটে অন্ধকারেই আমি বেরোই-এখন তো চাঁদনি রাত! (তখনও ইয়াসিন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে দেখে) আমার সঙ্গে গুলতি আছে তো? (হেসে ওঠে ইয়াসিন)
[ টুকু চলে যায়। ইয়াসিনকে একটু অন্যমনস্ক দেখায়। পেছনে চলে যায়। মঞ্চের আলো আস্তে আস্তে কমতে থাকে। পেছনের পরদায় চাঁদ ওঠার একটা আভাস।
নগেন ও কানা ছোট্টু ঢোকে। ছোট্টুকে নগেন কলার ধরে টানতে টানতে ওখানে নিয়ে আসে। ছেড়ে দিয়ে একবার পেছনটা এক পলক দেখে নেয়। নগেন ও ছোট্টুর কথার মাঝে একবার ইয়াসিনকে ওদের অলক্ষ্যে উঁকি মারতে দেখা যাবে ]
নগেন। বল শালা, বল কী বলবি এবার! ব্যাটা বাড়ির মধ্যেই চ্যাঁচামেচি শুরু করেছে!
ছোট্টু। বলব আবার কী, মাল ছাড়ো!
নগেন। আবার টাকা? অ্যাঁ! টাকার গাছ পুঁতেছি আমি? রোজ এমনি টাকা টাকা করে তড়পাবি তো ব্যাটা তোকে-
ছোট্টু। বাঃ! আমার হক্কের টাকা আমি চাইব না? তোমার এখন আঙুল ফুলে কলাগাছ বলে কি তুমি যা খুশি তাই করবে নাকি?
নগেন। অ্যাই-চ্যাঁচাবি না! চোপ! বেশি চ্যাঁচলে-
ছোট্টু। কী করবে কী, অ্যাঁ! কী করবে? বলো-
নগেন। সে তুই তখনই বুঝবি। নগেন দত্তকে যদি এখনও না চিনে থাকিস-
ছোট্টু। তুমিও এখনও কানা ছোট্টুকে চেনোনি গুরু। হিস্যার টাকা বুঝে না পেলে আমি আমার বাপকেও ছেড়ে কথা বলি না, তা তুমি তো কোন ছার!
নগেন। ও বাবা, তাই নাকি রে?
ছোট্টু। হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই।
নগেন। তবে রে ব্যাটা শয়তান-
ছোট্টু। যাও যাও, ভয় দেখিয়ো না! কানা ছোট্টুকে-(পকেটে কী যেন খোঁজে, পায় না)
নগেন। কীরে ব্যাটা, মুখটা চুপসে গেল কেন? বল বল-
ছোট্টু। আমার পিস্তল! কোথায় রেখেছ তুমি আমার পিস্তল?
নগেন। (সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে পিস্তল বার করে) এই যে! এইখানে রয়েছে চাঁদ। হিস্যার টাকা নেবে! তোমার ন্যায্য বখরা? এই নাও, মিটিয়ে দিচ্ছি-
[ গুলি করে। আর্তনাদ করে বুকে হাত দিয়ে পড়ে যায় কানা ছোট্টু। গোঙাতে থাকে, তারপর তাও বন্ধ হয়ে যায়। নগেন চট করে পিস্তল পকেটে পুরে মন্দিরের পেছনটা একবার দেখে আসে। নিশ্চিন্ত হয়। ফিরে আসে ছোট্টুর কাছে ]
ওঃ! ব্যাটা বড়ো বাড় বেড়েছিল। এবার বডির একটা ব্যবস্থা করতে হবে। রাত এখনও অনেক আছে। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে লাশটা নদীতে ভাসিয়ে দিতে পারলেই-যাক গে, দুটো লোক তো জোগাড় করা যাক আগে-
[ নগেন চলে যায় ডান দিকে। ইয়াসিন প্রায় ছিটকে বেরিয়ে আসে বাইরে ]
ইয়াসিন। ইয়া আল্লা! এখন আমি কী করি! এই রাত্তির বেলা-
[ ডান দিক থেকেই চোখ রগড়াতে রগড়াতে টুকু ঢোকে ]
ইয়াসিন। এই টুকু-টুকু!
[ টুকু ইয়াসিনের ডাক শুনে এগোতে যাচ্ছিল, হঠাৎ কানা ছোট্টুকে পড়ে থাকতে দেখেই মারে এক লাফ ]
টুকু। আরেব্বাস! এ লোকটার কী হল?
ইয়াসিন। ওসব কথা পরে হবে, তুমি এখানকার থানাটা চেনো?
টুকু। থানা? হুঁ!
ইয়াসিন। আমাকে নিয়ে চলো শিগগির! এক্ষুনি!
টুকু। কিন্তু এই রাত্তিরে-
ইয়াসিন। (ওর হাত ধরে টেনে) আঃ, চলো না-
[ টুকুকে বাঁ দিক দিয়ে নিয়ে বেরিয়ে যায়। তারপরেই নগেন ঢোকে সেই ভোটের দলের দুজনকে নিয়ে। একজনের হাতে একটা বিরাট চটের বস্তা ]
নগেন। নে নে, হাত লাগা-
[ ওরা দুজন মিলে টানতে টানতে ছোট্টুর দেহ ডান দিকে বার করে নিয়ে যায়। নগেন ওদিকে তাকায়, আর উত্তেজনায় ছটফট করে। আবার দুজন ফিরে আসে ]
কী রে! হল না এখনও? তোরা না একেবারে-একটা ডেডবডি থলিতে বাঁধতে হিমশিম খেয়ে গেলি! যা, যা, মালটা চটপট নদীতে ফেলে দিয়ে আয়-
একজন। হুজুর, দু-চারটে টাকা হাতে না পেলে-
নগেন। আ! টাকা! টাকা নিবি, তাই না?
অন্যজন। আজ্ঞে একটু আগাম না পেলে-
নগেন। থাম! বেশি বাড়াবাড়ি করিস না! বাড়াবাড়ির ফলটা তো নিজের চোখেই দেখলি! নগেন দত্তর কথার খেলাপ হয় না! কাম ফতে হলেই হাতে হাতে টাকা। যা যা- (লোকদুটো তখনও ইতস্তত করছে দেখে তীব্র চিৎকার) যা!!
[ প্রায় সঙ্গে সঙ্গে জিপের শব্দ। চমকে ফিরে তাকায় নগেন। লোকদুটো পালাতে যাচ্ছিল, শেখর ঢোকে উদ্যত রিভলভার নিয়ে। তার সঙ্গে একটা কনস্টেবল, ইয়াসিন ও টুকু ]
শেখর। ব্যস ব্যস, আর পালাতে হবে না! রামদীন ওই দেখো ডেডবডি-(হাত দিয়ে, দূরে দেখায়) এখনও সরাতে পারেনি। যাও এদের জিপে তুলে দাও-মোহন আর সুন্দরকে বলো এদের ব্যবস্থা করতে। আর এর জন্যে একটা হাতকড়ি-(লোকদুটোর দিকে তাকিয়ে) এই, যাও!
[ ভীত লোকদুটোকে কনস্টেবল প্রায় তাড়িয়ে নিয়ে যায়। শেখরের কথার মধ্যেই কনস্টেবল হাতকড়ি নিয়ে ফিরে আসে ]
তারপর, দত্তমশাই-এবার যে কাজটা একেবারে কাঁচা হয়ে গেল! একেবারে যে হাতেনাতে ধরা পড়ে গেলেন!
(কনস্টেবলকে দেখে) এই যে রামদীন, আর দেরি কেন! গয়না পরিয়ে দাও হাতে-
[ কনস্টেবল হাতকড়ি লাগিয়ে দেয় নগেন দত্তর হাতে ]
যাও, তুমি ডেডবডি পাহারা দাও, আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেব-
[ কনস্টেবল ডান দিকে চলে যায়
না, দত্তমশাই, কাজটা আপনি ঠিক কাঁচা করেননি-এবারও হয়তো চোখে ধুলোই দিতেন। কিন্তু ওই ইয়াসিন!
নগেন। ইয়াসিন?
শেখর। হ্যাঁ! ইয়াসিন সাহায্য না করলে আমি ধরতে পারতাম আপনাকে?
নগেন। ব্যাটা বেইমান-বদমাস কোথাকার? তোকে আমি আশ্রয় দিলাম আর তুই কিনা আমাকে-
শেখর। এই দেখুন! ওকে কেন মিছিমিছি-
নগেন। মিছিমিছি! ব্যাটা ছোটোলোক, চামার! দেখে নেব তোমাকে আমি-বুঝলে? নগেন দত্তকে তুমি চেনো না-যদি চিনতে-
ইয়াসিন। না না নগেনকাকা, আপনাকে আমি খুব ভালো করেই চিনি। এক্কেবারে ছোটোবেলা থেকে-
[ টুকু চমকে ওঠে। নগেনও কম চমকায় না। ইয়াসিন টুপি গোঁফদাঁড়ি খুলে ফেলে। সবশেষে আলখাল্লা খুলতেই বেরিয়ে পড়ে সেই লালপাড় শাড়ি পরা পুনু ]
টুকু। পুনুদি! (এসে জড়িয়ে ধরে পুনুকে) পুনুদি গো-তুমি এসেছ- (হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে)
পুনু। এই-কাঁদছিস কেন? এই বোকা ছেলে-আমি তো এসেছি-(পুনুও কান্না সামলাতে পারে না)
শেখর। চমৎকার! সত্যি তুমি তাক লাগালে পুনু! কনগ্র্যাচুলেশনস।
[ শেখর ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। পুনু হাত না ধরে নিচু হয়ে প্রণাম করে ]
পুনু। এবার স্যার আপনাকে বাড়িতে নিয়ে যাব-আমি জিতে গেছি! এখন আর আমাকে কেউ বকবে না। আসবেন তো স্যার আমাদের বাড়ি? না হলে বলুন, আমি নিজে গিয়ে আপনাকে-
শেখর। না না, আজ নয়। তবে আমি কথা দিচ্ছি, সামনের ভাইফেঁাটার দিনটা আমি ছুটি নেব-হ্যাঁ, শুধু তোমার জন্যে। গোটা দিনটা আমি কাটাব তোমাদের সঙ্গে-দেখব তুমি কত যত্ন করতে পার সেদিন। নিন, চলুন এবার দত্তমশাই-
পুনু। আপনি কিন্তু কথা দিয়েছেন! মনে থাকবে তো স্যার?
শেখর। (শেখর এবার কাছে এগিয়ে আসে।) নাঃ, তোমাকে বুদ্ধিমতী ভাবাটাই দেখছি আমার ভুল হয়েছে।
পুনু। কেন?
শেখর। (এগিয়ে গিয়ে পুনুর কাঁধে হাত দেয়) ভাইকে কি কেউ স্যার বলে?
টুকু। ঠিক ঠিক। পুনুদি, আর কোনোদিন যদি শেখরদাকে স্যার বলেছ-
[ নগেন দত্ত বাদে সবাই হেসে ওঠে। শেখর নগেনকে নিয়ে ডান দিকে যায়, টুকু ও পুনু দাঁড়িয়ে দেখে। পরদা নেমে আসে ]