স্বর্গারোহণ পর্ব
প্ৰথম সর্গ
পদ্মাবতীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সোজা এয়ারপোর্ট। বিকেলের প্লেনে ছুটব হায়দ্রাবাদ। ওখানে গিয়ে ধরতে হবে দিল্লির সান্ধ্য জাহাজ। রাত সাড়ে দশটায় দিল্লি। কাল ভোরবেলা কাশীর প্লেন। হায়দ্রাবাদ এয়ারপোর্টে শ্রীদামোদর ও চন্দ্রশেখর তো উপস্থিত ছিলেনই। তাছাড়াও ছিলেন মামার বন্ধু বিজনবাবু, আর ইন্দুর বন্ধু সতীশ গুপ্তাজি। আমার কুম্ভযাত্রার সংবাদে তাঁরা দুজনেই যারপরনাই উদ্বিগ্ন, বিমর্ষ হয়ে পড়লেন ও সঙ্গে সঙ্গেই দুজনে দুটি চিঠি দিলেন—একজন দিলেন এলাহাবাদের মিলিটারী হাসপাতালের সার্জন কর্নেল সিন্হাকে, অন্যজন দিলেন—বারাণসী অঞ্চলের ডিভিশনাল কমিশনার শ্রীমিট্রালকে। ব্যাস্ আর ভাবনা নেই, ওঁরা বললেন, দে উইল টেক গুড কেয়ার অফ য়ু। আমি সবিনয়ে চিঠি দুটি নিলুম। হায়দ্রাবাদের টিক্কুও দুটি ঠিকানা দিয়েছেন। বেশ সশস্ত্র বোধ হল নিজেকে। এতগুলি সম্ভাব্য অভিভাবক, এ ছাড়াও একটা জরুরি চিঠি পেয়েছি, পি. বি. আই.-এর এক কর্তাব্যক্তির কাছে। এখন মুশকিল হচ্ছে যোগাযোগটা করব কার সঙ্গে, আমি মোটেই চয়েস থাকা পছন্দ করি না। চয়েস থাকলে ডিসিশন নেবার প্রশ্ন, বাছাবাছির ঝামেলা। তার চেয়ে একটাও না থাকা ঢের ভালো। অতএব সর্বোত্তম পন্থা হবে আমার পক্ষে কারুর সঙ্গেই যোগাযোগ না করা।
ওদিকে আসল খবরই মন্দ। দিল্লী থেকে বারাণসী যাবার বুকিং এখনও কনফার্মড, হয়নি। রিকোয়েস্ট গেছে ১৪ তারিখেই। এখনও খবর আসেনি! তবে সবাই বললেন, ভাবনা নেই ও ঠিক হয়ে যাবে। মস্ত বড়ো জেট প্লেন। বহু সীট খালি থাকে।
ঘণ্টা তিনেক বাদে, উদ্বিগ্ন চিত্তে ১২০০ মাইল পেরিয়ে, দিল্লিতে নামলুম। খবর নিতে গিয়ে শুনি আমার নামে কদাপি কোনো রিকোয়েস্ট আসেনি মোটেই। সীট তো দূরের কথা আমি কোনো ওয়েটিং লিস্টেও নেই। কাল কেন, ২০ এর আগে বারাণসীর কোনো প্লেনেই একটাও সীট নেই! সব ভর্তি। শুনে আমি পপাত ধরণীতলে। আঃ! তাহলে অযথা আমি দিল্লিতে এলুম কেন? মধ্যপথে কে স্ট্র্যান্ডেড হতে চায়? এই সুদূরে? এখন দিল্লি থেকে এলাহাবাদ যাই কী উপায়ে? ট্রেন? বেশ ট্রেনেই যাব। অনেক স্পেশাল ট্রেন দিচ্ছে কুম্ভে, শুনেছি। কিন্তু তাতে কি ঠিক সময়ে, অর্থাৎ মৌনী অমাবস্যার লগ্ন থাকতেই পৌঁছুতে পারব? মৌনী অমাবস্যা নাকি মঙ্গলবার মধ্যরাত্রে। অদ্য সোম রজনী। অর্থাৎ প্রধান স্নান কালই মধ্যরাত্রের পরে। ওটাই তো দেখতে চাই। ওই মহাস্নানে যোগ দিতে চাই।
অগত্যা স্টেশন সুপারিনটেনডেন্টের ঘরে গিয়ে হানা দিই। মরিয়া। ‘দয়া করে যদি আমার নামটা ওয়েটিং লিস্টে তুলে নেন কাল ভোরে ছ’টার বোয়িং ফ্লাইটেও, ছ’টা পঞ্চান্নর ফকার ফ্রেন্ডশিপেও?’—প্রায় সাহেবী চেহারার পাঞ্জাবী অফিসার ভুরু তুললেন—‘দুটোতেই? দুঃখিত, দুটোতে হবে না। একটা ঠিক করুন।’ আবার চয়েস?
–‘নহী জি! নহী ভাইসাব! প্লিজ সার! কাইলি, মেহেরবানি, দুটোতেই রাখুন আমাকে! ভয়ানক আর্জেন্ট। আমাকে যেতেই হবে যে?’ শেষ পর্যন্ত ভুরু নামল: নাম উঠল দুটোতেই। এক তালিকায় আমি তেত্রিশ নম্বর, অন্যটায় পঞ্চদশ। অর্থাৎ কোনো ফ্লাইটেই ঠাই নেই। রাত সাড়ে বারোটার পরে মন খারাপ করে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠে বসি। কি ভাগ্যি ঠিক সময়ে রাজাগোপালের টেলিফোনে খবর পেয়েছে মামাবাড়ির ভীম ড্রাইভার। ভাগ্যিস ভীম ছিল। ঢের রাত হয়ে গেছে। ‘মামাবাড়ির আদর’ বস্তুটা আমার মতো করে কেউ চেনেনি। মামাবড়ির বাঘা গ্রেটডেন সিজার পর্যন্ত আমাকে মামাবাড়ির আহ্লাদ সাপ্লাই করে। পালামে নেমেই দেখেছিলুম এয়ারপোর্টে শ্রীমতী মায়া রায় এবং শ্রীনীতীশ সেনগুপ্ত প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে। না, এঁরা ঠিক আমাকে রিসিভ করতে আসেননি অবশ্য। সিদ্ধার্থ রায়ের প্রত্যুদ্গমনে উৎসুক হয়ে এঁরা সমাগত। কলকাতার প্লেন আসছে মুখ্যমন্ত্রীকে পিঠে নিয়ে। তাইতো! আমার প্লেনে ঠিক সামনের সিটেই শ্রীভেঙ্গলরাও দিল্লি এলেন বটে, তিনি অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রী। কাল তবে একটা কিছু মিটিং-টিটিং আছে বোধহয় মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে। [দুদিন পরেই বোঝা গেল ১৭ই রাত্রে দিল্লিতে মুখ্যমন্ত্রীদের আগমন কেন ঘটেছিল, পরদিন ১৮ই কিসের মীটিং ছিল তাঁদের। ১৯শেই ঘটলো লোকসভার নির্বাচনের ঐতিহাসিক ঘোষণা।] নীতীশ আমাদের প্রেসিডেন্সি কলেজের বন্ধু। হঠাৎ দেখা হতে খুব খুশি হল, আমারও খুব ভালো লাগল। সুন্দর রবীন্দ্র-সংগীত গাইতে পারত নীতীশ—তার মধ্যে একটি কবিপ্রকৃতি লুকিয়ে আছে। একবার লন্ডন থেকে কেম্ব্রিজে আমাদের বাড়িতে আসতে গিয়ে রাস্তার শোভা নিরীক্ষণ করতে করতে নীতীশ পথ ভুলে সোজা নরিচে চলে গিয়েছিল। সেখানে নেমে স্টেশন থেকে কেম্ব্রিজে ফোন করে বলে—’এবার কী হবে?’ সেই নীতীশ।
হায় হায় তখনই কেন নীতীশকে বললুম না? ভি. আই. পি. কোটায় একটা সিট হয়তো বা যোগাড় করে দিত। এখন রাত্তির সাড়ে বারোটা, কাকেই বা পাব, কোথায় বা যাব। কাল প্রথম প্লেন ছটায়,-রিপোর্টিং টাইম পাঁচটা। তার অগে কোনও রকমেই দড়ি-টানাটানি করা যাবে না। মহামান্য দড়িরা সবাই নিদ্রামগ্ন থাকবেন। দিল্লিতে বহুদিন বাস করেছি—একদম চেনাশুনো নেই তা নয়, কিন্তু সময়টা যে বড়োই বেয়াড়া, কী করি? হঠাৎ মনে পড়ল সুনীলদার কথা। অমনি গাড়িটা নিয়ে সোজা উপস্থিত হলুম আমার দাদাভাইয়ের বন্ধু সুনীল ভট্টাচার্যের বাড়িতে। ঘুমন্ত পাড়া! নিস্তব্ধ ঘুমন্ত বাড়ি। ভীম আর আমি বেপরোয়া। পাঁচিল ডিঙিয়ে ভিতরে ঢুকে খুবসে পুলিশী হামলা জুড়ে দিলুম। আমি সদরে, ভীম খিড়কির চার্জে! বৌদি ঘুম চোখে উঠে ভয়টয় পেয়ে এক ইঞ্চি দোর খুললেন—আমাকে দেখে তাঁর চক্ষুস্থির। এই না হলে ননদিনী রায়বাঘিনী? মাঝ রাত্তিরে উৎপাত করে ভালোবাসা আদায়! কী উপদ্রব! কিন্তু এষা বৌদি অন্য জাতের বৌদি। অম্লানবদনে উঠে এসে আড্ডা জমালেন–কিছু তো বললেনই না, উল্টে সংক্রান্তি উপলক্ষে এক জামবাটি নলেন গুড়ের পায়েস জোর করে খাওয়ালেন। সুনীলদার বন্ধু নটরাজন আছেন পালামে রিজার্ভেশনে, তাই কাল সুনীলদাকে ধরে নিয়ে যাব পাঁচটার সময়ে। আমার দৃঢ়বিশ্বাস আমাদের সুনীলদা সর্বশক্তিমান। আড্ডা মেরে দেড়টা নাগাদ ফিরলুম। তারপর এলার্ম লাগিয়ে ঘুম। ভোর রাত্রে উঠে তল্পিতল্পা গুটিয়ে দে দৌড়। সুনীলদার বাড়িতে গিয়ে হায়রে, আবারও সেই দুর্ধর্ষ কাণ্ড। সুনীলদার ঘুম আর ভাঙে না। ধাপ্পড় ধাঁই করে ধাক্কিয়ে দরজা তো খোলানো হল। লজ্জিত ঘুমন্ত সুনীলদাকে কোনওরকমে গ্রেপ্তার করে গাড়িতে পুরে নিয়েই ছুছু—পালাম—সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে! না, ছ’টার বোয়িং-এ আর হল না। কেবল খাজুরাহোমুখী শিল্পকাতর মার্কিনী ভ্রমণার্থীতেই তিনি পরিপূর্ণ। তাছাড়া বাকি সবকটা সীটও ভরা। তেত্রিশজনের ওয়েটিং লিস্টের একজনেরও ঠাঁই হবে না! এবার বারাণসীর ফকার ফ্রেন্ডশিপের দিকে ভিড়ি। নাঃ। ওতেও হবে না। ভদ্রলোক অনায়াসে মাথাটি নেড়ে চলে গেলেন, ‘তাঁর চেয়ে বরং লক্ষ্ণৌ যান’ বলে। সত্যি এঁদের আচরণ দেখে মনে হয় যন্ত্রমানব দিয়ে কাজ চালানোয় বরং আরেকটু দয়া মায়া থাকার চান্স আছে। অনেকক্ষণ ধরে কাতর অনুনয় বিনয় করে ব্যর্থ হয়ে শান্ত মানুষ সুনীলদা এবার চটে উঠে বললেন—’তাহলে তো আমার বন্ধু নটরাজনকে বলতে হয়’–অমনি ষষ্ঠেন্দ্রিয় দিয়ে বুঝতে পারলুম নিঃশব্দে কোথায় কী একটা অঘটন ঘটল। কেসটি পুরোপুরিই ফেঁসে গেল। নটরাজনের নামে কর্তব্যরত অফিসারের নির্বাক মুখে যে সূক্ষ্ম ভাবের উন্মেষ হল, তাতে দর্শকের হৃদয়ে আর যাই হোক ভরসা জন্মায় না। শান্তকণ্ঠে তিনি বললেন ‘বেশতো তবে যান মিষ্টার নটরাজনের কাছে। তাঁর ডিউটি সাড়ে দশটায়।’ …এখন ভোর সাড়ে পাঁচটা। আমার প্লেন ছ’টা পঞ্চান্নতে—এটি ছাড়া আর প্লেন নেই কালকের আগে। আমি হঠাৎ মরিয়া হয়ে বলে উঠলুম—’অ মশাই, নটরাজন জাহান্নামে যান, তাঁকে আমি চিনি না। এখানে আপনিই সর্বেসর্বা, আপনিই আমার হুজুর-মা-বাপ, উদ্ধারকর্তা, সেভিয়ার—দয়া করে আমাকে রক্ষা করুন। সীটটা দিয়ে দিন ভাই, পুণ্য করতে কুম্ভে যাচ্ছি। আজকের ফ্লাইট মিস করলেই একশো চুয়াল্লিশ বছরের মতো ফ্লাইট মিস হয়ে যাবে কিন্তু! তখন দায়ী হবেন আপনি।’—’গোইং অ্যালোন? টু কুম্ভ়্?’ এক মুহূর্ত স্থির চোখে তাকালেন।
—
–’একা নয় তো কি? পাপ-পুণ্য কি দল বেঁধে ভাগাভাগি হয়? এই দেখুন আমার টিকিট? আমি সেই তিরুপতি থেকে এখানে ছুটে এসেছি—কি জন্যে? কেবল এই আজ এলাহাবাদে যাব বলে। আপনি একটু ইচ্ছে করলেই হয়ে যাবে। ভি. আই. পি. সীট-টিট্ অনেক কিছু ফাঁক ফোকর থাকে। আমি জানি, আপনার হাতেই সব।’ ভদ্রলোক উত্তর না দিয়ে কী সব লিখতে লাগলেন। অন্য মনে।
আমার কথাটা যে অভ্রান্ত, তার প্রমাণস্বরূপ মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই আমার সীট্ জুটে গেল। সেই সঙ্গে আরও তিনজন যাত্রীর। আমি আহ্লাদে আত্মহারা হয়ে পড়লুম, এবং ধন্যবাদ দিতে গিয়ে ভদ্রলোকের নিরপরাধ হাত দু’খানা বোধ হয় মুচড়ে ভেঙেই ফেললুম জন্মের শোধ। পরোপকারের মাশুল। আমাদের যে চারজনের সীট মিলল তার মধ্যে দু’জনকে মনে হল ব্যবসাদার আর একটি খুব শীর্ণ, জরাজীর্ণ মানুষ ছিলেন। তাঁর মাথা ঢেকে হলদে রঙের বাঁদুরে টুপি, তারই ফাঁকে ফাঁকে খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ি গোঁফ ক’দিন কামানো হয়নি, বাইফোকাল সোনালি ফ্রেমের চশমার পিছনে শান্ত ঘোলাটে চোখ, পরনে মলিন মিলিটারি রিজেকশনের মাল, খাকি সোয়েটার, খাকি কোট, পায়ে খয়েরি কেডসের ফুটো দিয়ে কালো মোজাপরা আঙুল দেখা যাচ্ছে। কী করে এই বুড়ো মানুষটি এত দাম দিয়ে প্লেনের টিকিট কিনতে পারলেন? ইনি নির্ঘাত কুন্তপার্টি! সর্বঅঙ্গে লেখা আছে—অয়মহং কুম্ভযাত্রী ভো! এই প্লেনটা লক্ষ্ণৌ হয়ে, কাশী ঘুরে একদম কলকাতা পর্যন্ত যাচ্ছে।—ইনি কাশী, সন্দেহ নেই। হয়তো পুত্র এয়ারলাইনসে কাজ করে। এয়ারলাইনসেও কি পাস পায়? কি জানি!—সুনীলদা এবার হাস্যবদনে আমাকে নিয়ে চা-কফি অভিমুখে ধাবিত হলেন। গাড়িতে বসে বসেই জুতো মোজাটা কোনোরকমে পায়ে গলিয়েছেন, কিন্তু গাড়িতে বসে বসে চা-টি তো গলায় গলেনি! গলা শুকিয়ে সাহারা। প্লেনে চড়ে বসে বলি, জয় বাবা বিশ্বনাথ! কুন্তে পৌঁছে দিও ঠাকুর। তিরুপতিনাথ তো দিল্লী আনলেন। আর দিল্লীপতি সরকার ঠাকুরের কৃপায় কাশী অবধি যাচ্ছি! এবারে কিন্তু বাবা বিশ্বনাথ রিলে-রেসে তোমার টার্ন। এবার তোমার করুণা! আমি তো বেটনমাত্র, রিলেখেলা তোমাদেরই! তারপর ব্রিফকেস থেকে পোস্টকার্ড বের করে মাকে চিঠি লিখি : ‘কুম্ভমেলাতে যাচ্ছি মা। লক্ষ্মীটি রাগ করো না, একটুও ভয় পেয়ো না, সঙ্গী বহু জুটেছে।’ (কথাটা মিথ্যে নয়। সঙ্গী এক কোটি।)—’কাশীতে যখন পৌঁছুচ্ছি আর ভাবনা নেই। ওখান থেকে বাসে, ট্রেনে, ট্যাক্সিতে, যে করে হোক ঠিক কুন্তে পৌঁছে যাবই। মৌনী অমাবস্যার স্নানের লগ্নে।—লেখা শেষ করে সুন্দরী আকাশদেবীকে ডেকে বলি—’ভাই, তুমি তো কলকাতায় যাচ্ছ, আমার চিঠিটা দমদমে নেমে ডাকে ফেলে দেবে?’ আকাশদেবী বরদা হলেন….’তথাস্তু! কিন্তু তুমি কলকাতায় না গিয়ে কোথায় যাবে?’ আমাকে বোধ হয় দেখলেই কলকাতা পার্টি বলে চেনা যায়। মার্কামারা বঙ্গবালা।-’আমি? আমি তো কুন্তে যাচ্ছি।’
—‘কুম্ভে? হঠাৎ? ট্যুরিস্ট হয়ে? নাকি স্নানে?’
–’বা রে বা, কুম্ভে যাব, স্নান করব না? তাই হয়? স্নান করতেই যাচ্ছি।’
এবার মেয়েটি একগাল হেসে বলে—‘সত্যি? কী আশ্চর্য! আমি তো ভাবতেই পারিনি—আচ্ছা আমার একটা রিকোয়েস্ট রাখবে?’
—’কী বলো? পারলে রাখব নিশ্চয়।’
-’আমার নামে কুম্ভে একটা পুজো দেবে?’
এবারে আমারই—’কী আশ্চর্য, আমি তো ভাবতেই পারিনি’র পালা। এই দিব্যি পাক্কা মেমসাহেবটি পুজো দিতে চায়?
—’নিশ্চয়ই দেব। তোমার নাম কী?’
—’গুরদীপ কউর।’
দেখতে এবং শুনতে পুরোপুরি ফিরিঙ্গি গুরদীপ ছুটে চলে গিয়ে কোত্থেকে একটা পাঁচটাকার নোট নিয়ে ফিরে এল। সেটা আমার মুঠোয় গুঁজে দিয়ে বললেন—‘হাউ লাকি য়ু আর। আই উইশ আই কুড গো উইথ ইউ।’ আমি তো ওদিকে ভাবছি গুরুদীপ নিজেই কত ভাগ্যবতী। কত অনায়াসেই অচেনা অজানা একজনের হাতে সে টাকা গুঁজে দেয়, পরমাত্মীয়ের কাজটা সেরে দেবার জন্যে। আমি তার মঙ্গলকামনা করে পুজো দেবার কে? তা ছাড়া আসল কথা তীর্থে-টির্থে ‘পুজো’ কেমন করে ‘দিতে’ হয়, তাই তো আমি জানি না। দিব্যি ইংরিজি করে গুদীপ বলে দিলে—উইল য়ু গিভ আ পূজা ফর মি? আমি স্মার্টলি বললুম—শিওর! হোয়াই নট? অথচ জীবনে নিজের স্বামী সন্তানের জন্যেও কখনো কোথাও পুজো দিইনি আমি। রিফ্লেক্স অ্যাকশনে টাকাটা ইতিমধ্যে ব্যাগে পুরে ফেলেছি। ঠিক আছে, থাকুক। আরও তো কত লোক থাকবে, কেউ না কেউ জানবে। পাণ্ডা-টাণ্ডা তো থাকবেই। আমার মায়ের চিঠি গুরদীপ নিয়ে গেল। আজ আঠারোই। আজ ডাকে দিলে মা কালই পাবেন। মা তো ভাবছেন আমি আজকালের মধ্যেই ঘরে ফিরব।
কলকাতার মেয়ে, প্রয়াগধামে যাচ্ছি। কিন্তু পথটি বড়ো সরল হল না। কলকাতা—হায়দ্রাবাদ-তিরুপতি—হায়দ্রাবাদ-দিল্লী-(লক্ষ্ণৌ)-বেনারস এখন পর্যন্ত এতটা হয়েছে। এবার এলাহাবাদটা হলে হয় শেষ অবধি। কলেরার সার্টিফিকেটটা আছে তো? ইঞ্জেকশনের দৌলতে বাঁহাতে যে কোনো ‘বিশ্বশ্রী’র ঈর্ষার যোগ্য গুলি হয়েছে আমার। কিন্তু গুলি দেখালে তো হবে না ‘পড়ছি, চাই। এই সেই ‘পড়ছি’। আমার মনিব্যাগে কেবলই ‘পড়ছি’ ভর্তি,, টিক্কুর চিঠি, গুপ্তাজীর চিঠি, বিজনবাবুর চিঠি-আমি যেন ডাকহরকরা। পরিচয়পত্রের বহুল ছড়াছড়ি। প্রেমের ফাঁদ পাতা সবখানে—ইংলিশ ইন্স্টিটুট থেকে মিলিটারি হসপিটাল পর্যন্ত। সবগুলোই সযত্নে রেখেছি। কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে?
বেনারস নামার আগে অনেক চেষ্টা করলুম নিচে কাস্তে আকৃতির গঙ্গাটা আকাশ থেকে দেখতে—ট্রেন থেকে যা দেখেছি আগে অনেকবার। কিন্তু আকাশ থেকে গঙ্গা দেখা গেল না।—নেমে দাঁড়িয়ে আছি, মাল নামেনি এখনও। ওপাশে দেখতে পেলুম সেই বৃদ্ধটি। ঠিকই ধরেছি, কুম্ভ-পার্টি। এমন সময়ে দেখি এক সর্দারজীর সামনে লাইন বেঁধে লোকেরা কি যে কুপন কিনছে। কিসের কুপন? কুম্ভে যাবার কিছু নয়তো?—না না। সিটি অফিসে যাবার বাসের টিকিট। পাঁচটাকা। ‘কুম্ভের সব কনেকশন, বাস, ট্রেন, ট্যাক্সি—সব কিছু খবর ওখানেই পাবেন।’ হিন্দীতে আমি এবারে ওই অন্যমনস্ক বৃদ্ধকে প্রশ্ন করি :—’আপনি কি বাসে করে শহরে যাবেন?’ তিনি বললেন—‘হ্যাঁ।’—’তাহলে কি আপনার টিকিটটাও কেটে দেব?’ উদাসভাবে বৃদ্ধ বললেন—’দিজিয়ে। শুক্রিয়া।’ টিকিট কিনে এনে তাঁর কাছে পাঁচটাকা চাইব কিনা বুঝতে পারলুম না। চাইতে হল না, উনি নিজেই পাঁচটা টাকা এগিয়ে দিলেন। আমি তখন ওঁর মালের রসিদটা চাইলুম, মাল নামলে খালাস করে এনে দেব। উনি নীরবে রসিদটা বাড়িয়ে দেন, মিষ্টি হাসি সমেত। মাল এলে দেখি ওঁরটা বেডিং; একটি ছোটো মিলিটারি কিটব্যাগ ওঁর হাতেই ছিল। ওঁর মাল, আমার মাল দুটোই টেনে হিঁচড়ে বাসের ভেতরে তুললুম আমি। উনি কিন্তু হাঁ হাঁ করে ‘মুঝে দিজিয়ে, মুঝে দিজিয়ে’ করে এসেছিলেন। তারপর দুজনে উঠে বসলুম বাসে। গল্প শুরু করলুম।
—‘বাবুজি কি কুম্ভে যাচ্ছেন?’
—‘জী হাঁ।’
—’এমনি একলাটি?’
-’না না, ওখানে আমার মেয়ে জামাই আছে।’
-’ বেনারস থেকে কী উপায়ে যাবেন ঠিক আছে?’
–’দেখি কী করি! শুনেছি অনেক স্পেশাল ট্রেন দিয়েছে। তা ছাড়া বাস আছে, ট্যাক্সিও যায়।’
-’ট্যাক্সি ভাড়া কত হবে কোনো ধারণা আছে?’
‘শুনেছি শেয়ারে পনেরো টাকা করে, আর পুরোটা নিলে আশি। তবে এখন নিশ্চয় আরও বাড়িয়েছে।’
-’কত আর বাড়বে? ডবল?’
—’ঐ রকমই হবে আর কি। দেখি তো গিয়ে।’
হঠাৎ পথে একটি বিরাট সাদা বাংলো পড়ল। মস্ত হাতাওয়ালা বাড়ি, গেটের থামে বড়ো বড়ো অক্ষরে নাম লেখা—‘ডিভিশনাল কমিশনার, শ্রী-জে. পি. মিট্রাল।’
–’আরে আরে এর সঙ্গেই তো আমার দেখা করবার কথা বেনারসে।’
-’কি কাণ্ড! গাড়ি থামিয়ে নেমে যান?’
—’নাঃ। আগে ফোন করে দেখি। আমার বন্ধু তো নন, বন্ধুর বন্ধু। উনি সব ব্যবস্থা করে দিতে পারেন কুম্ভে যাবার।‘
—’বাঃ তবে তো আপনার ভাবনা নেই।’
-’নাঃ তা নেই। তা আমি যে ভাবেই যাই না কেন, বাবুজী আপনাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যাব। আপ কুছ ফিকির মত্ কীজিয়ে।’ বৃদ্ধ একগাল হাসলেন।
বেনারসে পৌঁছে ফোন করে শুনি শ্রীমিট্রাল হঠাৎ মোগলসরাই চলে গেছেন। পরে বুঝেছি, কেন গিয়েছিলেন। সেই ১৮ই তারিখে মোগলসরাইতে কুত্তগামী এক ট্রেনের নিদারুণ দুর্ঘটনা হয়। সে কথা আমি পরে শুনেছি। ফিরতি পথে। যিনি মিট্রালের হয়ে ফোন ধরেছিলেন তাঁকেই আমার প্রয়োজনটি জানালুম, সতীশ গুপ্তার রেফারেন্স দিয়ে। আমি কুম্ভে যাবার ব্যবস্থা চাই। তিনি বললেন-’আপনি টি. ও. র কাছে চলে যান, আমি তাঁকে ফোন করে দিচ্ছি। তিনি সব বন্দোবস্ত করে দেবেন।’ এইরে! টি. ও. আবার কি? ও. টি. মানে তো অপারেশান থিয়েটার। টি. ও. মানে কি থিয়েট্রিকাল অপারেশন? বিনীত প্রশ্ন করি—
—’টি. ও. কাকে বলে?’
—’ট্যুরিস্ট অফিসার! কি আশ্চর্য, তাও জানেন না? আপনার সঙ্গে কে আছেন, তাঁদের কাউকে দিন, আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি।’
–’আর কেউ তো নেই।’
-’অ্যা? কেউ নেই? একা? কি মুশকিল। আপনি এক্ষুনি চলে যান টি. ও. মিস্টার চক্রবর্তীর কাছে। ট্যুরিস্ট ব্যুরোতে। আমি ফোন করে দিচ্ছি। আপনার নাম?’ বললুম। তাঁর নামটা আর জানা হল না।
বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে মাল পাহারা দিচ্ছিলেন। রিকশাওলারা ছেঁকে ধরেছে। ট্রেন, বাস, ট্যাক্সি, সর্বত্রই তারা নিয়ে যাবে। তবে প্রয়াগ পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারবে না, এই যা। বাসের চেহারা যা দেখলুম, বোঝা গেল ওতে যেতে পারব না। বমি হবেই। রিকেটি, রংচটা, ঝড়ঝড়ে মাল আর মানুষের ভিড়ে হেলে পড়ছে। বৃদ্ধও আমার সঙ্গে একমত হলেন। বললেন, ‘তবে ট্রেনেই যাওয়া যাক।’—’ট্রেন?’ রিকশাওলাদের সমবেত বিদ্রূপহাস্য শোনা গেল। ‘ট্রেনে উঠতে পারলে তো। টেক্সি লিজিয়ে, টেক্সি।’ তৎক্ষণাৎ জাদুবলে কোথা থেকে এক ট্যাক্সি এসে ঢুকল বাস স্ট্যান্ডের কমপাউন্ডে। হ্যাঁ হ্যাঁ করে ছুটল রিকশাওলারা। ‘—কুম্ভ্? তিনসও রূপাইয়া।’ আমি এবার একটু উদ্বেগের সঙ্গে বৃদ্ধের ছেঁড়া কেডসের দিকে দৃষ্টিপাত করি। উঁকি মারছে কালো মোজা পরা বুড়ো আঙুল। তারপর আমতা আমতা করে বলি—’বাবুজী আমরা একটুখানি অপেক্ষা করি? আমি ডবল ভাড়া, অর্থাৎ একশো ষাট অবধি রাজী, কিন্তু তিনশো, ঠিক পারব না। আরও কয়েকজন সঙ্গী পেলে বরং শেয়ার করে যাব। আপনি কী বলেন?’—রিকশাওলারাই জবাব দেয়—’টেক্সি মিলেগা তব্ তো জাইয়েগা? টেক্সি মিলতা হী নহী।’ কী মুশকিল। এই বৃদ্ধের কাছে তো টাকা চাইবার প্রশ্ন নেই। অথচ তিনশো দিলে ফেরার টাকা কম পড়বে। ফেরার টিকিট তো কাটা হয়নি। এমন সময়ে কানের কাছে একটি খাস বিলিতি গলার মৃদু ইংরিজি শুনতে পেলুম-’আর ভিড় বাড়িয়ে কাজ নেই, আমার মনে হয় এইটেই নিয়ে নেওয়া উচিত হবে।’—হ্যাঁ। তিনিই সেই ফুটো কেডস, মাংকি-ক্যাপ। মুখে মিষ্টি হাসি। বৃদ্ধস্য বাক্যং শ্রুত্বা আমি তো বাক্যহারা অভবম। ইনি ইংরিজি জানেন না ভেবে কত কষ্টে ভদ্রস্থ হিন্দীতে বাতচিত চালাচ্ছি এতক্ষণ!—’টাকার জন্যে ভাববেন না, ঈশ্বর আমাকে অনেক দিয়েছেন। আপনি ঐ আশি টাকাই দিন, বাকিটা আমার।’ যদি এখন পুষ্পকরথ নিয়ে অপ্সরাকুল আমার সামনে আবির্ভূত হতেন, তাতেও এত আশ্চর্য হতুম না। এই খোঁচা-দাড়ি তাহলে কেবলই কৃপণতা? কিন্তু কার্পণ্যের লক্ষণ তো এই প্রস্তাবে নেই? তবে, পরে বুঝেছি, উনি অন্য জগতের বাসিন্দা—সন্তপ্রকৃতির মানুষ। আপন বহিরঙ্গের প্রতি তাঁর মমতা নেই, বরং নির্মমতা আছে। আশি থেকে দরাদরি করে একশো পর্যন্ত নামলেন, তার পরেই ডীল ক্লোজ করে দিলেন, আমাকে কিছুতেই আধাআধি দিতে দিলেন না। বারবার বললেন-’বেটি, তুমি তো আমার কন্যার বয়সী, তোমার কাছে আমার কিছুই নেওয়া উচিত নয়। তবে পুণ্যক্ষেত্রে সর্বদা কিছুটা নিজে খরচ করা নিয়ম, তাতে তোমার তৃপ্তি হবে। কিন্তু ওয়ান-থার্ডের বেশি আমি কিছুতেই নেব না।’ এবার মালপত্র সমেত ট্যাক্সিতে চড়ে বসা হল। বৃদ্ধ বাবুজী ট্যাক্সিওলার সঙ্গে সামনে বসলেন—তাঁর নাকি পিছনে বসতে অসুবিধা হয়। আমি পুরো গাড়ি দখল করে হাত পা ছড়িয়ে বসে নির্দেশ দিই—’ট্যুরিস্ট অফিস! টি. ও.-র কাছে।’
চক্রবর্তীমশাই টেলিফোনটি পেয়ে গেছেন মনে হল, তা ছাড়া, একটি দৈনিক পত্রিকার কল্যাণে আমার কিছু খুচরো লেখাও তাঁর নজরে পড়েছে। ভদ্রলোক সত্যিই অতি ভদ্র, এবং যথেষ্ট কর্মকুশলী। হাসিমুখে একশো লোকের ন্যায়-অন্যায় একশোখানা আবদার শুনছেন, মাথা ঠান্ডা রেখে এক্স সামাল দিচ্ছেন। এই আসছেন ট্যুরিস্ট মেম, উল্কখুষ্ক চুল, পরনে হাফপ্যান্ট আর তিনটে ক্যামেরা—’হ্যালো ম্যাডাম, আই ওয়াজ জাস্ট থিংকিং অফ্ য়ু’…..এই আসছেন তীর্থযাত্রী বাবু, সঙ্গে আধ ডজন কেটের কাপড় পরা আলোয়ান জড়ানো ন্যাড়ামাথা বৃদ্ধা—‘এই যে দত্তমশাই, সবকিছু ব্যবস্থা হয়ে গেছে, শুনুন, …আমাকেও উনি পরমাত্মীয়ের মতো যত্ন করে ব্যবস্থাপত্র লিখে দিলেন। একটা নয়, তিনটে। পি. বি. আই. এর চতুর্বেদীর কাছে, কুম্ভের ট্যুরিস্ট অফিসের শ্রী ডি. কে. বর্মণ এবং তাঁর সহকারী শ্রীকরমপল সিং-এর কাছেও। বললেন—’কিছু ভাবনা নেই। একজায়গায় না হয় আরেক জায়গায় হবে। এঁরা তিনজনেই খুব দক্ষ লোক, সাহায্যে পটু, যাবতীয় সুব্যবস্থা হয়ে যাবে। আপনি একা মানুষ, শোবার প্রবলেম হবে না। প্রেসের ওখানে সব সময়ে একটা লোকের ব্যবস্থা থাকে, নিজের কোনো স্পেশাল ঝামেলা যদি না থাকে, দে উইল টেক গুড কেয়ার অফ য়ু। ট্যুরিস্ট ব্যুরোর ওখানে পাকা বাথরুম, পাকা ঘরটর আছে, ঠিক গভর্নরের ক্যাম্পের পাশেই। প্রেসও ওই একই জায়গায়। চমৎকার কটেজ আছে সব, বসার ঘরে টিভি আছে, সোফাকৌচ আছে। ঘর না পেলেও ভাবনা নেই, কম্বলমুড়ি দিয়ে কৌচে লম্বা হয়ে পড়বেন। পরশু রাতেই তো আমি ওখানে ছিলাম, ঐভাবে শুয়েছি তোফা আরামে।’ ট্যাক্সিওয়ালাকে ডেকে এনে বললেন—’এই যে লান্নন সিং, এই মেমসাবকে খুব যত্ন করে নিয়ে যাবে। ঝুঁসির দিকে নয়, এঁকে নৈনির কাছে নামাবে। সেখান থেকে গঙ্গাদ্বীপে ট্যুরিস্ট ব্যুরোতে যেতে খুব অল্পই হাঁটতে হবে, দু’কিলোমিটার মতন। কিন্তু মালপত্তর তো উনি বইতে পারবেন না, একটা ব্যবস্থা করে দিও।’ কিন্তু আমার ললাটের লিখনই আলাদা। লাল্গন সিং পকেট থেকে ভাঁজ করা সেদিনের হিন্দী খবরের কাগজটি বের করে তখুনি দেখিয়ে দিলে নোটিশ বেরিয়েছে, নৈনির রাস্তা বন্ধ একমাত্র ঝুঁসির পথই সেদিন খোলা।—’আব্ ক্যা করেঙ্গে?’—দেখে শুনে চক্রবর্তী সাহেবের মুখের অলিম্পিক শিখার মতো অনির্বাণ হাসিটিও দপ করে নিভে গেল।—’তাহলে মালের কী হবে। হাঁটলেন না হয়… কিন্তু মাল? অতটা পথ! ঝুঁসি থেকে মানে…লাল্লন সিং খবরদার তুমি ওঁকে মালসুদ্ধ, একলা একলা ছেড়ে দিও না—অনেক টাকা নিচ্ছো মনে রেখ—আমি কিন্তু পরে খোঁজ নেব তুমি কি ব্যবস্থা করেছিলে। মাল বয়ে ঝুঁসি থেকে ট্যুরিস্ট লজে যাওয়া এঁর পক্ষে অসম্ভব।’ লান্নন সিং হেসে এক সেলাম ঠুকে দেয়—’আরে সাব—লাল্লনকো তো আপ জানতে হেঁ! কুছ ফিকর মত কীজিয়ে, সব ঠিক হো জায়েগা। কুলি নহী মিলেগা তো লালন হ্যায়।’ চক্রবর্তী ঝুঁকে হাত বাড়ান—‘ঠিক তো?’ টেবিলের ওপরে লাল্গন হাত মেলায়—’ঠিক বাত।’ চক্রবর্তী হেসে বলেন—’চলে যান, ভাবনা নেই। ফিরে এসে একটা খবর দেবেন স্নান কেমন হল!’
আমি কৃতজ্ঞতায় দুমড়ে যাচ্ছি দেখে চক্রবর্তী হা-হা হেসে বললেন—’আরে দিদি এই তো আমার কাজ, এ জন্যে আমি মাইনে পাই—এতে ধন্যবাদের কি আছে?’
অথচ আমি জানি বেতনের বিনিময়ে কর্তব্যকর্ম বলে আর কিছু বাকি নেই। অন্তত এ দেশে। এখন যেখানে যেটুকু পাই সবটাই আমি কৃপা বলে মেনে নিই, প্রাপ্য বলে নয়। অধিকার বা দাবি এসব শব্দ এখন স্লোগান মাত্র, প্রাত্যহিক জীবনে আছে কেবল আসি যাই মাইনে পাই। কাজ চাইলে ওপর-টাইম চাই। এই তো আমাদের কাজের ধারা। আমি জীবনের সব পাওয়াটাকেই ইদানীং ধরে নিই উপরি পাওনা। ওপর-টাইম। রাইট নয়, সবই প্রিভিলেজ।
দ্বিতীয় সৰ্গ
লাল্লন পথে তুলে নিলে লতিফকে। তাদের পাশে সেই বৃদ্ধ—যাঁকে আমি বাবা বলে ডেকেছি। পিছনে আমিই একচ্ছত্র রাজত্ব করছি। গাড়ি চলল। বৃদ্ধ বললেন, ‘আপনি কোথায় উঠবেন?’ প্রশ্নটা সুবিধের নয় দেখে আমি কথা ঘুরিয়ে নিয়ে বলি—‘আপনি?’-’আমি তো উঠব আনন্দময়ী মায়ের আশ্রমে। আমার মেয়ে জামাই সেখানে আছে। আপনি?’—আবার ‘আপনি’। দূর ছাই।—’আমার কোন ঠিক নেই। ‘
‘ঠিক নেই? সে কি? গঙ্গাদ্বীপে, না এলাহাবাদে থাকবেন সেটা ভেবেছেন?’ ‘নিশ্চয়ই। গঙ্গাদ্বীপে অবশ্যই।’—’কিন্তু এই ভিড়ে…’–’আপনি ভাবছেন কেন? আমি তো একটুও ভাবছি না। এই তো মিস্টার চক্রবর্তী তিনচারজনকে ইনট্রোডাকশন দিয়ে দিলেন পি. বি. আই.-তে, ট্যুরিস্ট ব্যুরোতে। কোথাও না কোথাও ঠাঁই মিলে যাবেই। লক্ষ লক্ষ লোক সেখানে রয়েছে, বনবাসে তো যাচ্ছি না।’ বৃদ্ধ তবু গাঁইগুই করেন—’তাবলে অত ভিড়ে একজন লেডি হয়ে অল বাই য়োরসেল্ফ’…তখন আমাকে মরিয়া হয়ে বলতেই হল—’প্রথমত আমি মোটেই লেডি লাইক নই—দ্বিতীয়ত, বাবা, এইতো আপনিই আছেন। আমার ভাবনা কী? একা তো নই।’ বাবার মুখের জ্যোতি একথায় দপ করে নিভে যাবে ভেবেছিলুম কিন্তু নিভল না। শান্তস্বরে তিনি বললেন—’হ্যাঁ। আমি আছি বইকি! ঈশ্বর তোমাকে জুটিয়ে দিয়েছেন আমার একাকিত্বের উদ্বেগ মোচন করতে। কিন্তু আমি তো বৃদ্ধ হয়েছি, আমি কি তোমার জন্য ব্যবস্থা করতে পারব?’ অগত্যা আমি বলি—’বাবা, বিশ্বাস করুন আমি অতি গেছো মেয়ে। আমিই আপনাকে দেখব শুনব। আনন্দময়ীর কাছে না পৌঁছে যাওয়া অবধি আপনি আমার দায়িত্বে। আর আমাকে দেখাশুনোর কাজটা ঈশ্বরই করেন। আপনি বৃথা ভার বোধ করবেন না।’—বৃদ্ধ বললেন—’দীক্ষিত হলে আমার মত গুরুর আশ্রমেই থাকতে পেতে।’ সে কথার জের না টেনে আমি বলি—’আপনার দেশ কোথায়?’ বৃদ্ধ বলেন—’জয়পুর। আমি জয়পুর থেকেই আসছি। তুমি?’
-’কলকাতা। অবশ্য এখন কলকাতা থেকে আসছি না।’
-’কলকাতা? আমি ওখানেই দু’একজনকে চিনতাম। জেনারেল জে. এন. চৌধুরীকে চেনো?’
—’আমি ওঁকে চোখে দেখেছি, এই পর্যন্ত। চিনি না।’
–’আমাদের স্কুলে পড়ত। তা ছাড়া ব্যানার্জি, রাঘবেন্দ্র, সেও আমাদের স্কুলে পড়েছে। চেনো তাঁকে? অবশ্য এঁরা দু’জনই আমার জুনিয়র।’
—’তাঁকেও দেখেছি। পরিচয় নেই। আমার বাবা মা চেনেন। আপনার নাম?’
—’শার্দূল সিং। ওঁদের সঙ্গে দেখা হয়? কেমন আছে রাঘবেন্দ্র?’
—’ভালোই আছেন, যতদূর জানি।’ আমি যখন ওঁকে দেখেছি, রাঘবেন্দ্রবাবুকে মোটেই বৃদ্ধ বা অসুস্থ দেখায়নি। দিল্লীতে বছর পাঁচ ছয় আগে জেনারেল চৌধুরীকেও না। ওঁদের দুজনের মধ্যেই যৌবনদৃপ্ত প্রৌঢ়তা বজায় রয়েছে—অথচ শার্দূল সিংহ এমন বৃদ্ধ হলেন কি করে? প্রশ্নটা অবশ্যই করিনি।–এসব প্রশ্ন কেউ করে না। এর সম্ভবত কোনো উত্তরও হয় না। শার্দূল সিংহের হাসিটি সত্যি ভুবনমোহন—শিশুসুলভ সারল্য ও সৎ অন্তঃকরণের একটা সহজ প্রকাশ আছে তাঁর মধ্যে। ক্রমশ বুঝলাম তিনি সংসারে থেকেও প্রায় সন্ন্যাসী। তাই এই খোঁচা খোঁচা দাড়ি, এই ফুটোফাটা পোশাক—হাতের কিটব্যাগে মনে হল পুজো-আহ্নিকের সরঞ্জাম আছে।—’আপনাকে মিলিটারি মানুষ ভাবতেই পারছি না বাবা।’-’এককালে আমি বেজায় রাগী, জেদী, আর নিষ্ঠুর প্রকৃতির ছিলাম। সবাই ‘শার্দূল সিং’ বললে ভয় পেত।’
-’বাঃ!—সত্যি, মাই ডিয়ার গার্ল, বিশ্বাস কর।’
-’কী করে বিশ্বাস করব?’ হাহা করে হেসে উঠে বৃদ্ধ বললেন—তা যা বলেছ। আমার নিজেরও ঠিক বিশ্বাস হয় না। আনন্দময়ী মা যে আমাকে পথ বাতলে দিয়েছেন। আই অ্যাম আ চেঞ্জড ম্যান টু-ডে।’
-‘কী করে এমন হল? বাবা?’
–’ সে এক লম্বা গল্প। তোমার কি শুনতে ভালো লাগবে?’
—’লাগবে লাগবে, বলুন।’
—’সে সব ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ব্যাপার। ওসব সিরিয়াস কথা থাক। জেনারেল মানেকশ’ও আমাদের স্কুলে ছিলেন, ওঁকেও তো জানো।’
-’আপনার বয়স মোটেই আমার তিনগুণ নয় বাবা, দুগুণ হতে পারে
—‘ওই হল। তুমি কবে জন্মেছ?’ সালটা বললুম।
–’অ্যাঁ। আমার ছোটো ছেলেও তো ঐ বছরেই জন্মেছে। সে এঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়াচ্ছে।’
—’আমিও তো! অবশ্য এখন ওটা বিশ্ববিদ্যালয়। এবং আমি কিছুই এঞ্জিনিয়ারিং জানি না।’
—’বা, বা। তবে তো তুমি আমার ছোটো মেয়ে।’
–’তা তো বটেই। বাবা বলে ডেকেছি যখন। এবার আপনার ধর্মজীবনের অভিজ্ঞতার কথা বলুন। মেয়ের কাছে বলবেন না? ‘
-’হবে হবে, অল ইন গুড টাইম।’
রাস্তায় অনেক গাড়ি, ভিড়ে ও মালে একটেরে হয়ে বেঁকে যাওয়া বহু দুঃখী দুঃখী বাস, কোনোটা আসছে পাটনা থেকে, কোনোটি আগ্রা, কোনোটা বারাণসী, কোনোটা মোগলসরাই। একটা কলকাতার মিনিবাস দেখলুম, পশ্চিমবঙ্গের যাত্রী নিয়ে আসছে। বাসের কপালে বাংলায় ‘জয়গুরু’ লেখা দেখেই হঠাৎ খুব আহ্লাদ হল। বাংলায় নাম লেখা আরও অনেক বাস চোখে পড়ল পথে। দক্ষিণ থেকে আসছে এমন কোনো বাস অন্তত আমার চোখে পড়েনি। কুম্ভমেলা প্রধানত উত্তর ভারতীয় মিলন-মেলা বলেই বোধ হল।
আমাদের একটা টেনডেন্সি আছে অবশ্য, ব্যাপকভাবে উত্তরভারতীয় হলেই তাকে ‘সর্বভারতীয়’ আখ্যা দিয়ে ফেলা। দক্ষিণের মানুষও কুম্ভমাহাত্ম্যে বিশ্বাসী, কিন্তু সেখান থেকে ঠিক এমনিভাবে জাতীয় এক্সোডাস হয়নি মনে হয় কুম্ভমেলার উদ্দেশে। একটা কারণ নিশ্চয় ভৌগোলিক দূরত্ব। আরও কি একটা কারণ থাকতে পারে? উত্তর-দক্ষিণের সাংস্কৃতিক দূরত্ব? দক্ষিণের মন্দিরে পাণ্ডাহীন ভিখিরিহীন নিরুপদ্রব শান্তিময়তা এবং আবর্জনাশূন্য নাগরিক পরিচ্ছন্নতা যে ভক্তির আবহাওয়া তৈরি করে দেয়, তা কি উত্তরের তীর্থে এসে ধাক্কা খেয়ে ফিরে যায়?
বেলা গড়াচ্ছে। হঠাৎ মনে পড়ল সকাল থেকে খিদে তেষ্টা ভুলে কেবল স্বর্গারোহণের ব্যবস্থায় মত্ত হয়ে আছি। সেই কোন্ রাত থাকতে দিল্লীতে ঘুম ভেঙেছিল—তারপর থেকেই ছুটছি।
গতকালই তো আমি তিরুপতিতে ছিলাম। গতকাল? হ্যাঁ কালই তো! কী আশ্চর্য ভাবে, কত দ্রুত সময় কেটে যাচ্ছে এই দুদিন ধরে। আজ মাত্র আঠারোই। দুপুরের মধ্যে প্রয়াগসঙ্গমে পৌঁছে একটা বাসস্থানের ঠিক করে নিতে হবে। মধ্যরাত্রে স্নান শুরু। চক্রবর্তী যেমন বলে দিয়েছেন তাতে বাসস্থানের কোনো ভাবনা নেই। শুনেছি নাকি পশ্চিমী কায়দায় পাকা কলজলের ব্যবস্থা পর্যন্ত রয়েছে ট্যুরিস্ট ব্যুরোর ওদিকে, সাহেবদের কথা ভেবে। অবশ্যই তা হায়দ্রাবাদী রাজকীয় আতিথ্যের মতো হবে না। কিন্তু কুম্ভমেলার তুলনায় রাজকীয়ই। শীর্ষেন্দুর লেখায় পড়েই এসেছি, এবারের ব্যবস্থা নাকি খুব ভালো। সাহেব-মেমে ছয়লাপ। মনে হবে বিলেতে এসেছি।
শার্দূল সিংকে বলি—’বাবা আপনি লাঞ্চ খাবেন কখন?’—উনি বললেন—’আমি তো একবেলা খাই। সকালে ব্রেকফাস্ট করেছি আবার রাত্রে খাব।’ কিন্তু আমি যে পথে বেরুলে ঘণ্টায়-ঘণ্টায় খাই-খাই? একেই ব্রেকফাস্ট করিনি, আমি বাপু লাঞ্চ খাবই। খাবারের কথা যেই না মনে পড়া, অমনি পেট চোঁচো। কী করি এখন? উনি যদি থামতে না চান? হঠাৎ খেয়াল হল-এই তো, সমাধান সামনেই।
—’ভাই লান্নন সিং? তোমরা লাঞ্চ খাবে না?’
–’হ্যাঁ মেমসাব, গোপীগঞ্জে খাব।’
—’ওখানে কি পাঞ্জাবীদের ‘ধাবা’ আছে?’
—’জি হুজুর। আছে।’
-’হুজুর হুজুর করো না তো। শোনো, তোমরা একটা বেশ পরিষ্কার জায়গা দেখে থামো, আমিও খেয়ে নেব।’
‘ওখানে? সে আপনি পারবেন না মেমসাব। ঈশ আগে বললেন না? বরং বানারসেই কোনো ভালো হোটেলে—‘
-’খুব পারব। আমার পাঞ্জাবী তড়কা-রুটি খেতে খুবই ভালো লাগে লান্নন সিং।’ এবারে হেসে ফেলল লতিফ-লালন দুজনেই!
–’ঠিক আছে মেমসাব।’
-’মেমসাব-মেমসাব করছ কেন? আমি কি মেম?’
-’তবে কী বলব?’
-’কেন, দিদি বলতে পার না?’
-’যো হুকুম, দিদি।’ কিন্তু লতিফের চোখে প্রশ্ন। লান্নন এবার লতিফকে বললে, দিদি মানে বেহেনজী। দিদি বাংলা কথা। লতিফের মুখে নিশ্চিন্ত হাসি। এবার আমার খেয়াল হল সত্যি তো দিদি বুঝি ‘সর্বভারতীয়’ নয়? ‘দাদা’ মানে যেমন ঠাকুর দাদা বা দাদামশাই, দিদি মানে হয়তো দিদিমা। কে জানে? তা হোক, একই হল।
–’লাল্লন সিং, তুমি বাংলা জানলে কি করে?’
-’কাশীতে তো বঙ্গাল-কে আদমি একদম ভরতি। লতিফ ঠিক কাশীর নয়, তাই বাংলাটা এখনও শেখেনি। তাছাড়া আমি তো বঙ্গালমে কতবার গেছি।’
—’কোথায় গেছ?’
-’তার্কেস্সুয়র মে বাবা কো পাস।’
-’বাবার কাছে? তারকেশ্বরে? কেন, তোমরা তো বাবার কাছেই আছ, বিশ্বনাথের কোলে।’
—‘না না, ওই যে মানসিকের জন্যে জল নিয়ে যেতে হয় বাঁকে করে–হেঁটে গিয়ে ট্রেনে চাপি। বর্ধমানে নেমে আবার হাঁটি। আমি প্রায়ই কনট্রাক্ট নিই। ওখানেই আমার বড়ি বেহেন আছে কিনা ব্যান্ডেলে।’
–’লাল্লন সিং, তোমার মতো নামের একজন খুব বিখ্যাত বাঙালী ছিলেন, জানো? তাঁর নাম লান্নন নয় লালন। ফকির। তিনি গান বাঁধতেন। খুব সুন্দর গান। ফকির তো বোঝ?’
—‘জরুর। ফকির বুঝব না? কত ফকির আছে বানারসে। আমার নামও তো লা-লন। ল-আ, ল, ন। কিন্তু মুখে বলি লাল্লন। উও ফকিরকো কোঈ গানা আপ জানতে হেঁ ক্যা?’
-’আমি জানি, কিন্তু গাইতে পারি না যে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলে বাংলায় একজন খুব বড়ো কবি ছিলেন, লান্নন, তিনি লালন ফকিরের গান শুনতে খুব ভালবাসতেন। তুমি রবীন্দ্রনাথের নাম শুনেছ?’ লালন মাথা নাড়ে। শোনেনি। লতিফ নীরব। শার্দূল সিং বলেন—
টেগোর রাজপুতানা নিয়ে অনেক কবিতা লিখে গিয়েছেন আমি শুনেছি। তিনি রাজপুতদের খুব ভালোবাসতেন। তাঁকে জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করেছিল রাজপুতদের জাতীয় চেতনা। অবশ্য আমি টেগোরের যা লেখা পড়েছি সে সমস্তই মিস্টিক কবিতা স্পিরিচুয়াল পোয়েমস। দে আর লাইক হিস্। চমৎকার।’
—’আপনি কি রাজপুত?’ আবার একমুখ ক্ষত্রিয়দুর্লভ বিনয়ে পরম বৈষ্ণব হাসি ছড়িয়ে শার্দূল সিংহ নিচুস্বরে বললেন—’অফ কোর্স! লান্নন কী ভাগ্যি আর লালন ফকিরের গানের প্রসঙ্গ তুলল না। তুললে ‘আরশিনগরে পড়শি বসত করে’ ব্যাপারটার ব্যাখ্যা করতে বড্ডই কষ্ট হত। একেই তো এই কুকর্ম করেই খাই! চাকরি-বাকরির প্রসঙ্গে মন একটু দমে যায়ই। তাই মন উৎফুল্ল করতে আবার গল্প শুনতে চাইলুম।
—’বাবা, কই বললেন না, আনন্দময়ীর প্রসঙ্গে আপনার কি আশ্চর্য অভিজ্ঞতা হয়েছিল?’
–’তুমি দেখছি না-শুনেই ছাড়বে না। আমি কাউকে বলতে চাই না কারণ পীপ্ ওন্ট বিলীভ্ ইট। বলবে হ্যালুসিনেশন।’
—’আমি বিশ্বাস করব। আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি। অবশ্য গুরুরা অঘটন ঘটাতে পারেন কিনা জানি না, কিন্তু ঈশ্বর নিশ্চয় পারেন!
-’ব্যাপারটা তেমন কিছু নয়, আমার চোখের দোষও হতে পারে। তবে আমার জীবনের ধারা বদলে দিয়েছে।—আমরা গাড়ি নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছিলাম দিল্লী, আগ্রা, মথুরা, বৃন্দাবন বৃন্দাবনে গিয়ে আমার বোন বললে, আনন্দময়ীর আশ্রমে যাবে। সে ওঁর শিষ্য। বেশ তো চলো। গেলাম, মায়ের সঙ্গে পরিচয় হল যৎসামান্য—অর্থাৎ প্রণাম। তাঁদের নতুন মন্দির উদ্বোধন হচ্ছে সেখানে, নিতাই-গৌরের মন্দির। আমাদের সামনের সারিতে বসতে দেওয়া হয়েছে। দেখি মন্দিরের সামনে মা আনন্দময়ী দুহাত তুলে নিতাই সেজে নাচছেন। আমার কি জানি বাপু পছন্দ হল না। আমি বললাম আমার স্ত্রীকে ‘হাউ অড্!’—স্ত্রী বললেন—’কেন?’ আমি বললাম—’মা আনন্দময়ীর কি ওরকম করাটা উচিত?’ স্ত্রী অবাক হয়ে বললেন—‘কেন উনি আবার কী করলেন? একটু বিশ্রাম করতে গেছেন বোধ হয়।’ এবার আমি হকচকিয়ে গিয়ে বোনকে বললুম—’সামনে কী দেখছ?’ বোন বললে-’কেন, নিতাই-গৌর? চিনতে পারছ না? নিত্যানন্দ আর গৌরাঙ্গ?’ আমি ভয় পেয়ে এবারে একদম চুপ করে গেলুম। চোখের সামনে তখনও দেখছি একটিই দৃশ্য, লালপাড় সাদা শাড়ি পরা, ভাববিহ্বলা মা আনন্দময়ী, দুই হাত তুলে, এলোচুলে, নিমাইয়ের ভঙ্গিতে নৃত্য করছেন। হঠাৎ সবই গুঞ্জন করে উঠল ‘মা! মা!’ তখন চকিতে দেখলুম সামনে মা নেই, সেই জায়গায় মস্ত দুটি গৌর-নিতাইয়ের মূর্তি। একপাশ থেকে মা সদ্য হেঁটে প্রবেশ করছেন, শ্রদ্ধাভরে সকলে উঠে দাঁড়াচ্ছে। আমার মাথা ঘুরতে লাগল। আমি দাঁড়াতে পারলুম না। তার পরেই আমি দীক্ষা নিয়েছি মায়ের কাছে। আফটার দ্যাট ভিশন আই অ্যাম আ চেঞ্জড্ ম্যান।’
শার্দূল সিংহের কথার উত্তর দেবার কিছু ছিল না। স্বর্গেমর্তে অনেক কিছুই রয়েছে, হোরেশিও, যা তোমার পরিধির বাইরে। আমি নিজেকে যুক্তিবাদী ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষ বলে মনে করতে চাই। জগতে এই যুক্তি, বিশ্বাস, আর মনুষ্যত্ব হাতে-হাতে ধরে থাকে পরস্পরকে। আমি ঈশ্বরের করুণাকাঙাল—তা বলে মিরাকে বিশ্বাস করি না। ভেলকি আর করুণা এক নয়, তুলনীয় নয়। আমার বাবা কখনও ধর্মের ভেলকিতে বিশ্বাস করেননি। মা-ও তথৈবচ। মা আবার সেকেলে বেহ্ম-টাইপের আছেন খানিকটা। দুজনেই ঘোরতর মিরাক্ল-বিরোধী। এই তো গেল বাপের বাড়ি। ওদিকে স্বামী তো গোঁড়া অবিশ্বাসী। তাঁর নাস্তিকতায় ভক্তি আমার আস্তিক্যের চেয়েও জোরালো। তাঁর কাছেও দীর্ঘকাল ঘোর ট্রেনিং পেয়েছি। সে কি ভোলা যায়? ফলং-মিরাকে বিশ্বাস করার শক্তি আমার ভেতরে নেই। তবে মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা নিশ্চয় হতে পারে মিরাক্ল জাতীয় অঘটনের। যা যুক্তিগ্রাহ্য। এমনি একটি অঘটন তো ঘটেছিল আমারই চোখের সামনে। নিজের বাড়িতে। শার্দুল সিংহের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাটি তাঁর কাছে এত মূল্যবান যে তার পাশে আমার যুক্তি বুদ্ধির অবতারণা করাটা ভাল হবে না। বরং ওই ধরনের আরেকটা অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলে সুরটা থাকবে। আমাদের যা ঘটেছিল, সেটা ঠিক দৈবী ঘটনা নয়, তবে ডাঃ শৈলেন সেন সেটাকে বলেছিলেন ‘একটা মেডিক্যল মিরাক্ল।’ ওই গল্পটাই বলা ঠিক করলুম। ভাল হবে ওঁর গল্পের পাশে মানাবে। তছাড়া আমার বোনাফাইডিটাও প্রমাণিত হবে। এই ঘটনাটা পরিমল গোস্বামীও একবার উল্লেখ করেছিলেন তাঁর একটি লেখায়। আমি শার্দুল সিংহকে আমার গল্পটি বলতে শুরু করলুম।
আমার বাবার বয়স তখন একাশি, হঠাৎ করোনারি প্লাস সেরিব্রাল থ্রম্বসিসের স্ট্রোক হল। বাবার ব্লাডসুগার তখন খুবই উচ্চে, কোমা অবস্থায় অচেতন আছেন দশ-বারোদিন। বাঁদিকটা অবশ হয়ে গেছে, বাঁ হাত পা কঠিন। বাবার বাঁচার সম্ভাবনা আছে কেউ বলছেন না। নাকে অক্সিজেনের নল, হাতে গ্লুকোজ ছাড়াও আরও একটি জলীয় দ্রব্যের ছুঁচ ফোটানো। বাবার জন্যে লোহার তৈরি ফাউলার্স বেড এসেছে। এসেছেন দিনে রাতে দুজন সিনিয়ার নার্স। এবং আমি উড়ে এসেছি দিল্লী থেকে। মন সক্কলের খুব খারাপ। এমন সময় বাবার বন্ধুস্থানীয় সাধক সন্ন্যাসী শ্রীসীতারামদাস ওঙ্কারনাথ খবর পেলেন যে বাবা মৃত্যু শয্যায়। বাবার বাল্যবন্ধু ‘নিরক্ষর’এর লেখক চরণদাস ঘোষ সীতারামদাসের কলেজের সহপাঠী—সেই সূত্রে বাবার সঙ্গে তাঁর পরিচয়। বাবার অসুখ শুনে তিনি বাবাকে একদিন দেখতে এলেন। ওঙ্কারনাথ ঠাকুর সর্বদা রামনামে পরিবৃত থাকেন—তাঁকে ঘিরে একদল শিষ্য নাম সংকীর্তন করতে করতে এলেন। আমি মহাপাপী। সংকীর্তন শুনে ছুটে গিয়ে বললুম-’ঠাকুর, যদিও আমার বাবা অচৈতন্য হয়ে আছেন, তবু যদি ভেতরে ভেতরে জ্ঞান থাকে, তবে হরিনাম শুনে তো ভয়ে মারাই যাবেন। লড়াই করে বাঁচবার আত্মবিশ্বাসটা সেরে ওঠার পক্ষে খুব জরুরী বলে শুনেছি—হরিনাম শুনলে বাবা হয়তো ভাববেন ওঁর নির্ঘাত মৃত্যু ঘটেছে। তখন ভেতর থেকে মৃত্যুকে আর বাধা দেবেন না।—ওঙ্কারনাথ ঠাকুর সহাস্যে বললেন—’নাম গান নিচেই হোক তাহলে, চল্, আমি একা ওপরে যাব।’ বাবার চোখ বন্ধ। ঘরের জানালা-দরজাও বন্ধ। তখন গ্রীষ্ম। সময় সকাল বেলা এগারোটা সাড়ে এগারোটা হবে। বিদ্যুৎ বাল্ব জ্বলছে। খাণ্ডার নার্স তো ঢুকতেই দেবে না কাউকে, যেহেতু ভিজিটরস নট অ্যালাউড। আমরা নার্সকে ঘর থেকে চলে যেতে বললুম। সে গেল না। বরং আগে ভাগে বলল ‘রোগীকে প্রসাদ-টসাদ কিছু খাওয়ানো চলবে না কিন্তু, ডাক্তারবাবু না-এলে।’ সন্ন্যাসী দেখেই সে ঘাবড়ে গেছে, ভেবেছে এবার কিছু তুকতাক হবে বোধ হয়। চলবে চরণামৃত-টুত গেলানো। সীতারামদাস বাবার পাশে এসে ঝুঁকে দাঁড়ালেন। সস্নেহে তাঁর কপালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বেশ জোরে জোরে ডাকলেন-’নরেন! নরেন! বলি ব্যাপারটা কি?’—বারোদিন ধরে বন্ধ চোখের পাতা থিরথিরিয়ে কাঁপতে লাগল। মা, আমি, আমার মাসীমা এবং নার্স অবাক হয়ে দেখলুম—চোখ মেলে বাবা তাকালেন। লাল টকটকে চোখ, রক্তের মতো লাল। চোখের দৃষ্টিতে ফোকাস নেই তেমন, তবু, পাশের দিকে তাকালেন, ওঙ্কারনাথের দিকে। একমুখ হেসে ওঙ্কারনাথ বাবাকে বললেন-’বলি, আছো কেমন?’ খুব জমাটি আড্ডার ভঙ্গীতে। কী আশ্চর্য, বাবার ঠোঁট খুলল, স্বাভাবিক সুরে একটু জড়িত স্বরে বাবা বললেন—’যেমন রেখেছ। আবার কেমন?’ হেসে উঠে ওঙ্কারনাথ বললেন—’আবার ইয়ারকি করা হচ্ছে! আর নয়, এবার উঠে পড়ো দিকিনি।’ ইতিমধ্যে বাবার চোখ আবারও বুজে গেছে! বাবা আর কিছু বললেন না। সীতারামদাস আমাকে বললেন—’ভাবিসনি। আর তিন-চারদিন পরেই তোর বাবা উঠে পড়বে। নেমে চলে গেলেন তিনি, হরিনাম সংকীর্তন জোরালো হয়ে উঠল। বাবা দীক্ষিত তো ননই, যাঁকে ভক্তশিষ্য বলে তাও নন। ওঁদের দুজনের মানবিক সম্পর্কটি নেহাত হৃদ্যতার, বন্ধুতার! বড়ো মধুর! ওঙ্কারনাথ ঠাকুর তো চলে গেলেন। নার্স এদিকে একেবারে অধীর হয়ে পড়ল। বারোদিন ধরে অজ্ঞান অচৈতন্য কোমা রোগীকে এভাবে অনায়াসে ‘হিপনোটাইজ করে কথা কওয়ানো সে কখনও দেখেনি। সীতারামদাস ঠাকুর কী করে বুঝেছিলেন তা আমি জানি না, তবে সত্যিই তিন-চারদিন পরেই বাবার চৈতন্য ফিরল। শুধু তাই নয়, পনেরদিন ধরে অবশ, পঙ্গু বাঁ হাত বাঁ পা দিব্যি নড়তে লাগল। বাবা উঠে বাথরুমে গেলেন। ডাঃ শৈলেন সেন বললেন—’এটা মেডিক্যাল মিরাক্ল। কেবল মনের জোরেই উনি অসাধ্য সাধন করে ফেললেন।’ সবচেয়ে ভক্তিবিহ্বল হয়ে পড়েছিল সেই দিশী খ্রীস্টান নার্স, ব্রজাঙ্গনা যার নাম। সে তখন ঘরে না থাকলে জানি না ডাক্তারবাবু আমাদের কথা বিশ্বাস করতেন কিনা।
সীতারামদাস ওঙ্কারনাথ কিন্তু ভানুমতীর খেল দেখান বলে শুনিনি। এটাও নিশ্চয় কোনো মিরাক ছিল না—আমাদের মনে হয় বাবার সঙ্গে তিনি স্বাভাবিক কথাই বলেছিলেন। বাবার আচ্ছন্নতার তলায় তলায় যে চৈতন্য সুপ্ত ছিল, তাকেই জাগ্রত করেছিলেন তিনি। যৌগিক সাধকের পক্ষে একাজ কঠিন নয়। এর পরে বাবা আরও দু’বছর বেঁচে ছিলেন। সুস্থ ও সমর্থ শরীর নিয়ে, চারতলা-একতলা ওঠা-নামা-হাঁটা-চলা করে। জ্ঞান ফেরবার পরে এই ঘটনার কথা শুনে তিনি বললেন, হ্যাঁ তার মনে আছে সীতারাম এসেছিলেন।
লান্নন আর লতিফও আমাদের গল্প শুনেছে। লাল্গন বলল—’গুরু ভগবানেরা তো এরকম হামেশাই পারেন। বানারসে তো হরেক সন্ন্যাসী হরেকরকম জাদু কি খেল্ জানেন।’ লতিফ বেশি কথা বলে না, সে কেবল সায় দেয়। সঙ্গ করে। ইতিমধ্যে গোপীগঞ্জ এসেছে। খাবারের দোকানে গাড়ি থামল। নেমে এগিয়ে গেছে ওরা। আমি নামতেই শার্দূল সিং বললেন—‘এইবেলা আমার দ্বিপ্রাহরিক আহ্নিকপুজোটা সেরে নেব খালি গাড়িতে।’ বেশ ঠান্ডা। আমার গায়ে ভাগ্যিস আছে তিনটে সোয়েটার। মায়ের কীর্তি। মা বললেন—‘কে জানে হায়দ্রাবাদের কম-বেশি কেমন-কীরকম ঠাণ্ডা হবে? একটা হাতপুরো নে, একটা হাফ হাতা নে, আর একটা হাতকাটা নে। যেমন যেমন শীত বুঝবি তেমন তেমন পরতে পারবি। আর একটা শালও নিবি।’ খুব গাঁইগুই করেছিলুম তখন।—’কি হবে চারটে গরম জিনিসে? একটা শালই যথেষ্ট। এখন তিনটে সোয়েটারই পরে আছি দুপুরবেলায়। রাত্রে কি হবে? লান্নন বললে—‘দিদি পরোঠা ঔর মিট লিজিয়ে আপ। ঔর সাথমে মটর পনীর, টমাটর তরকা ঔর দাল।’—লিস্টিশুনে আমার বেজায় রাগ হয়ে গেল। দোকানের সঙ্গে নিশ্চয় সাঁট আছে এদের। কেন রে বাবা? এত খাব কেন? তা ছাড়া কোনো সৎ আচারের আগে ‘সংযম’ করে থাকতে হয়। যেমন বিবাহে! তিরুপতিতে কাল সারাদিন নিরামিষ খেয়েছি। এমনিতেই দিব্যি ‘সংযম’ হয়ে গিয়েছে, আজকে খামোকা মাংস খেয়ে পুণ্যিটা নষ্ট করি আর কি? আমি হাঁ হাঁ করে উঠলুম।—’সির্ফ চাপাটি ঔর তরকা। ঔর চায়। পহলে চায়, পিছু খানা ফিরভি চায়।’—’চাপাটি, তরকা?’ আর্তনাদ করে ওঠে লালন।—’ব্যস্?’ আমার খুব রাগ বেড়ে যায়।—’হ্যাঁ, হ্যাঁ, ব্যস।’ ‘ঔর কুছ নহী?’—’কুছভি নহী।’ গটগটিয়ে একটা খাটিয়াতে বসতে যাই। অমনি হাঁ হাঁ করে ছুটে আসে লতিফ।
-’জি নহী মেমসাব। ইধর তো বহুৎ খটমল হোগা। আপ উধর তকতাপর বৈঠিয়ে।’
–’ফের মেমসাব!’ ধমক শুনে লাজুক হাসে লতিফ। কিছু বলে না। সঙ্গে সঙ্গে ন্যাতা এনে তক্তপোশ মুছে সিংহাসনের মতো ঝকঝকে করে ফেলেছে দোকানের ছোকরা ভৃত্য—
-’বৈঠিয়ে জী।’ এ মজা মন্দ নয়। আরেক রকম স্টেট্ গেস্ট হয়েছি। পাঞ্জাবি রাঁধুনি মুহূর্তেই চমৎকার সুগন্ধি মশলা চা এনে দেয় গেলাসে। লতিফ ধমক দেয়—’কাপ নহী হ্যায়? কাপ দো!’
আমি হাঁ হাঁ করে বলি—আমার গেলাসই বেশি পছন্দ। বেশ বাগিয়ে ধরা যায়। গাটাও তাপে গরম হয়। সাহেবদের ওই এক পেশে হাতলওলা বাটি আমার মোটে পছন্দ নয়। ধরাও বেশ শক্ত। দু আঙুলে শক্তি চাই, ব্যালান্স চাই, মনস্কতা চাই। ভাঁড়, গেলাস, বাটি এ সব ঢের মানুষের মতো বাসন।
রুটি তৈরি ছিল না। রুটি গড়বে এখন। ইতিমধ্যে দুজন লোক এসে ঐ খটমল অলংকৃত খাটিয়াতেই আরাম করে বসল, যেখানে আমার বসতে মানা। লান্নন, লতিফ দুরের একটা খাটিয়ায় বসেছে। আমার সঙ্গে বসতে চায় না, বোঝাই যাচ্ছে। আমি প্রথমেই ভাবলুম ওদের কাছে ডাকি—তারপর মনে হল ওরা হয়তো শরাব-টরাব পিয়েগা, কে জানে বাবা? থাক—যেখানে ওরা স্বচ্ছন্দ সেইখানে বসুক। এখানে যাঁরা খাটিয়াতে এসে বসেছেন তাঁরা একদৃষ্টে আমাকে খুঁটিয়ে খুটিয়ে নজর করছেন। আমার পরনে অন্তত একপো জরি আর আধসেরটাক্ সিঙ্কের সুতোয় বোনা এক পেল্লায় কাঞ্জিভরম শাড়ি। তার চাকচিক্য দেখে আমাকে ঠিক মহীশূরের মহারাণী মনে নাও হতে পারে, কিন্তু তাঁর কৃপাধন্য মন্থরা তো বটেই। কাঁধে ফুটানি—কি থলিয়া, চোখে চশমা, হাতে ঘড়ি, গায়ে প্রথমে হাতপুরো সোয়েটার, (ভেবেছিলুম ওতেই হবে) আর ওপরে হাফহাতা সোয়েটার, তার ওপরে হাতকাটা সোয়েটার। তিনটেই ঘোর কালো রঙের এই রক্ষে! গাল যথাসাধ্য ফুলো, মুখ গম্ভীর। কারণ হাতের গরম গেলাসে আপ্রাণ ফুঁ দিচ্ছি তখন! গরম জিনিস, আমি একদম খেতে পারি না। বিলেত-টিলেতের নেমন্তন্নে ওই সুপ খাবার পরীক্ষাটায় প্রত্যেকবার ফেল করি। জুলজুল করে দেখি না-খাওয়া সুপটা নিয়ে গেল। নইলে পরের কোর্সটা দেবে কেমন করে? ফুঁ দিতে দিতে আমিও চোরা চাহনিতে তাঁদের দেখছি। চায়ের ধোঁয়ার আড়াল থেকে। তাঁদের পরনে পরিষ্কার ধুতি, পায়ের ময়লা বুট জুতোয় ফিতে বাঁধা, গায়ে খদ্দরের (একজন হলদে, অন্যজন সাদা) পাঞ্জাবি, তার ওপরে মোটা পশমী আলোয়ান জড়ানো। ফরাস রং, দুজনেরই গোঁফ আছে, একজনের আবার টিকিও আছে। ধোঁয়াওড়া দু’ গেলাস চা নিয়ে মৌজ করে বসেছেন। আর আমাকে নিরীক্ষণ করছেন। শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন হল—’আপ কিধরসে আয়ে হেঁ?’—গম্ভীর মুখে বলি—’হায়দ্রাবাদসে।’ ‘আচ্ছা, আপ হায়দ্রাবাদকে রহনেওয়ালী হেঁ!’ সাদা পাঞ্জাবী ফিসফিস করে হলদেকে কিছু বললেন। হলদে গম্ভীর মুখে জানালেন : ‘নহী নহী ইলাহাবাদকে পাশ নহি, হায়দ্রাবাদ তো বহু দূর হ্যায়। আমাদাবাদকে পাশ হোগা’ তাড়াতাড়ি আমি বলি—’না না, আমেদাবাদ তো সেই গুজরাটে, আর হায়দ্রাবাদ অন্ধ্র প্রদেশে! ঔরাঙ্গাবাদকে পাশ। দুজনই এবার গুম্ হয়ে গেলেন। এটা ভুল হল। হায়দ্রাবাদ যেখানেই থাকুক, গোপীগঞ্জের কাছে নয়। আমি ডিটেল নিয়ে মাথা ঘামিয়ে প্রায়ই গোড়াটা কাঁচিয়ে ফেলি। সামাল দিতে কথা শুরু করলুম-’আপনারা কি গোপীগঞ্জে থাকেন?’—‘জী হাঁ।’—‘চাষবাস করেন?’—‘না না বিজনেস।’ বললেন হলদে।—–’চাষও করি।’ বললেন সাদা। হলদের মাথায় দীর্ঘ টিকি।—’আপনি ব্রাহ্মণ? ‘—’জী হাঁ।’ আপনাদের গোপীগঞ্জের লোকেরা কি প্রধানত চাষী?’—‘হ্যাঁ, অবশ্য আমরা কয়েকঘর বিজনেসম্যানও আছি। গোপীগঞ্জে মস্ত মার্কিট আছে তো। বানারসকা সব কুছ চিজ ইধরমে মিলেগা। লেকিন ভাও জরাসা জেয়াদা হ্যায়।’—’ইস্কুল আছে?’—‘হ্যাঁ।’—‘হাসপাতাল?’—’হ্যাঁ, ডিস্পেন্সারি আছে। ডাক্তার আছে।’ এবার আমি আর কথা খুঁজে পেলুম না। সাদা পাঞ্জাবি কথা কন না বিশেষ। ফিসফিস করে তিনি কিছু বললেন হলদের কানে কানে। এবং হলদে মাইক হয়ে সেটা জোরে জোরে বললেন ‘আপ কাঁহা যায়েঙ্গে? কুম্ভমেলা?’—’জী হাঁ।’ ইতিমধ্যে আবার রুটি-তরকা এসে গিয়েছে। ফের এক গ্লাস চা-ও।—’আপনারা কুম্ভস্নানে যবেন না।’—’ওখানে বড্ড ভিড়। ভিড়ে যেতে আমার ভালো লাগে না।’ বললেন টিকিওলা ব্রাহ্মণ বিজনেসম্যান—‘বা, মার্কেটে বুঝি ভিড় নেই?’—‘মার্কেটের ভিড় তো সও আদমিকো, কুম্ভের ভিড় কোটি মানুষের। হলদে জামা এবার হেসে ফেললেন।—’আমরা বিজনেসম্যান, আমাদের পুণ্ আস্নান সে ক্যা হোগা?’—আমি হতবাক্ গোপীগঞ্জে এ কোন্ কালা-পাহাড়? বন্ধুকে সামলে দিয়ে এবার সাদা পাঞ্জাবিই কথা বলেন—’এত দূর দূর থেকে সবাই আসছে, আর আমরা এত কাছে থেকেও যাচ্ছি না? চলো তেওয়ারীজী এবার আমরাও ঘুরে আসি।’-তেওয়ারী বললেন—‘আপ যাইয়ে। ম্যায়-নহী যাউঙ্গা।’ মাথায় কিন্তু দিব্যি পুরুষ্টু টিকি রয়েছে। প্রসঙ্গ বদলাতেই বোধহয় তিনি বললেন—’গাড়িতে উনি কে? আপনার বাবা?’ এবার আমার মুশকিল। বাবা? -’না ঠিক বাবা নন। সহযাত্রী।’
-’হায়দ্রাবাদের?’—‘না জয়পুরের।’–আপনি জয়পুর থেকে আসছেন? এখন?’–‘না, হায়দ্রাবাদ থেকে।’
—‘তবে?’
‘বেনারসে সাক্ষাৎ হয়েছে আমাদের।’—’অ! আপনি কার সঙ্গে এসেছেন :—সেই প্রশ্ন।—’কারুর সঙ্গেই না।’—‘ একা?’ সাদা পাঞ্জাবি তাকালেন হলদের দিকে।—’একা?’—হলদে চাইলেন সাদার প্রতি। তারপর খালি গেলাস সন্তর্পণে নামিয়ে রেখে দু’জনেই হাতজোড় করে সবিনয়ে বললেন—’নমস্কার। এবার তবে আমরা আসি।’—যে মেয়ে একা একা কুম্ভমেলায় যায়, পথে জয়পুরী বৃদ্ধ বাবা যোগাড় করে ফেলে, সে মেয়ে তো মেয়ে নয়, অপ্সরা নিশ্চয়! ছোঁয়াচ এড়াতে তারা গোপীগঞ্জের স্বাস্থ্যবান হাটের দিকে দ্রুতপায়ে পালিয়ে গেলেন।
আমিও খাওয়া শেষ করে লাল্গন-লতিফের দিকে তাকিয়ে দেখি—খাটিয়া খালি। কই, গেল কোথায় তারা। ঐ যে—দূরে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। দেখে মনে হল ওদের বিলটাও আমি দিয়ে দিই বরং–ভেবে বেশ উদার ফিল করি। তৎক্ষণাৎ দোকানিকে গিয়ে বলি, ‘ড্রাইভারদের বিল আর আমার বিল—’ পাঞ্জাবী রাঁধুনি এক-দাড়ি-গোঁফ বিনয়ী হাসি হেসে বললেন—’বিল্ দেদিয়া গয়া। আপকোভি!’—’মুঝকো ভি? কৌন দিয়া?’
—’উও ড্রাইভার লোগ?’
ছুটে গেলাম—’লাল্লন? লতিফ? বিল্ কেন তোমরা দিয়ে দিয়েছো?’ দুজনেই হাতজোড় করে বললে—’কিছুই তো খেলেন না আপনি। আমরা যা যা খাওয়াতে চাইলুম তার একটাও তো খেলেন না।’—’এ চলবে না ভাই, খাবারের দাম নিতেই হবে।’—জিভ কেটে কান মলে লাল্গন বলে—’এই যে বললেন, ‘ভাই’, ভাইরা বহেনকে খাইয়ে দাম নেয় কখনও? আমার চোখে জল ভরে এল। স্টেট গেস্ট হওয়ার চেয়েও ঢের বড়ো সম্মান যে গোপীগঞ্জের রাস্তায় আমার প্রাপ্য ছিল, তা কি জানতুম? লতিফ কেবল মুচকি মুচকি হাসে।
আমার জীবনে ঈশ্বরের কৃপার সত্যিই শেষ নেই। ঠিক এই আশ্চর্য আনন্দের অভিজ্ঞতা আরও একবার ঘটেছিল। মহীশূরে গেছি সেবার বক্তৃতার ব্যাপারে—সেখান থেকে বাসে বেলুর হালিবিড ঘুরতে গিয়ে ঠিক এমনিই ভাই কুড়িয়ে পেয়েছিলুম। দুজন নয় তিনজন। সেই বাসেরই ড্রাইভার, ক্লীনার, আর গাইড। সে আরেক মস্ত গল্প! ঈশ্বর জগৎ জুড়েই মায়ার ফাঁদ পেতে রেখেছেন, ঘরে ঘরে সত্যিই ঘর গড়ে রেখেছেন; সেই ঘরই ঠিক আমাদের খুঁজে নেয়। যখন উটি-ব্যাঙ্গালোর পর্যন্ত ঘুরে ফিরে এলুম মহীশূরে, আমাদের বন্ধু অধ্যাপক দেবীপ্রসন্ন পট্রনায়কের বাড়িতে, পিছনে পিছনে এসে উপস্থিত হল আমার তিন বন্ধু, দুজনের মাথায় দুটি বিশাল উপহার, পাকা দুটো কাঁঠাল। একটি আমার মহীশূরের বন্ধুগৃহের জন্যে, অন্যটিকে কলকাতায় নিয়ে যেতেই হবে।—’বাচ্চারা খাবে’। আরেকজনের সলজ্জ হাতে নীলগিরির চা। অকস্মাৎ কালিঝুলিমাখা ক্লীনার আর ড্রাইভার-বন্ধুদের দেখে আমার অধ্যাপক বন্ধুর গৃহস্থালি থ’। ওদিকে গাইডটি আবার সাহ্মণ, শ্রীরঙ্গপত্নমের প্রধান পুরোহিতের পুত্র। সেবারে এমনিই এক চমৎকার বন্ধুত্ব হয়েছিল। নাগেশ্বর, উরস আর গোপাল।
.
গাড়ি চালাতে চালাতে এবারে লতিফ কথা বলল—‘বহেনজী, পান খায়েঙ্গে?’ হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ। পানের দোকানে গাড়ি থামল। পান এল চারটে, মিঠামসালা। বেগর জরদা। শার্দূল সিং খেলেন না। ‘নো থ্যাংকয়ু।’ আমার মুখভরতি ভায়েদের দেওয়া মিঠেপানের খিলি। জরদা নেই। কেবলই মিঠে। এদিকে রাস্তায় ভীষণ ধুলো উড়ছে—সব কাচ তুলে দিয়েছে ওরা—ঘুমঘুম পাচ্ছে একটু আমার, বেশ গরম ওম্ হয়েছে গাড়ির ভেতরে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
ঘুমিয়েই পড়েছিলুম। ঘুম ভাঙাল লাল্লন, বলছে—’দিদি ‘পড়ছি’ দিখাইয়ে।’ সামনে রাস্তা বন্ধ। যতদূর দৃষ্টি যায় লাইনকে লাইন শত শত গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছে। ট্রাফিক জ্যাম?—না। ওইখানে, অনেকদূরে, একটা চেকিং হচ্ছে। কলেরা ভ্যাক্সিনেশনের সার্টিফিকেট দেখাতে হবে। তবে কি এসে গেছি? নাঃ, ঠিক আসিনি। এখনও ঢের দূর। পথেই চেকিং হচ্ছে। এখানে ইঞ্জেকশন দেবারও ব্যবস্থা আছে। অনেকক্ষণ পরে আমাদের পালা এল। ‘পড়ছি’ দেখালুম। ছেড়ে দিলে আমাদের। পথে বার তিন-চার এভাবে ‘পড়ছি’ চেকিং এবং গাড়িরও ‘ঈশ্বর জানেন কী’–চেকিং করা হল। শেষ পর্যন্ত একটা বিশাল মাঠে স্তব্ধ গাড়ির সমুদ্রের মধ্যে এসে আমাদের গাড়িও থেমে গেল। সামনে মস্ত তোরণ বাঁধা হয়েছে। তাতে লেখা আছে—’কুম্ভমেলা’। তার মধ্যে দিয়ে যতদূর দেখা যায় কেবল মানুষের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। দোতলা মাচার ওপর থেকে পুলিশ নির্দেশ দিচ্ছে মাইকে, গাড়িদের কি করতে হবে, মানুষদেরই বা কী করতে হবে। ভাইরা নামল। আমরা নামলুম না। গঙ্গা কোথায়? যমুনাই বা কোথায়? এ তো মাঠ। জলের চিহ্ন নেই। লতিক বলে—’জল এখানে কোথায়? এ তো ঝুঁসীর কাছে এসেছি। সঙ্গম এখনও বহুদূর।’ ‘সর্বনাশ। মালের কী হবে? লালন বলে—’দাঁড়ান, দেখি কুলি পাই কিনা।’ কিছুক্ষণের মধ্যেই বোঝা গেল কুলি নেই। অনেকেই গাড়ির মধ্যে বসে আছেন। গাড়ির মাথার ওপরে মাল। ফেলেও যেতে পারছে না, টেনেও নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। দুজন বাঙালী মহিলাকে যেতে দেখে ডাকলুম। তাঁরা প্রায় কেঁদে ফেলেন আর কি। বিহার থেকে এসেছেন গাড়িতে। এতদূর এসেও স্নান হবে না? পুরুষটি চলে গেছেন ওঁদের গাড়ি পাহারায় বসিয়ে দিয়ে। আমার মাল কোথাও রেখে যাবার উপায় থাকলে ফেলে রেখেই চলে যেতুম। শার্দূল সিং দুর্বল হাতে বেডিংটি তুলে নিলেন, অন্য হাতে কিটব্যাগ। আমার এক হাতে কম্বল আর ব্রীফকেস, পেটফোলা অহংকারের ঝুলি ঝুলছে কাঁধ থেকে, তদুপরি জলের ফ্লাস্ক লগবগ করছে, অন্যহাতে ক্ষুদ্র হ’লেও জ্ঞানের বোঝায় অতীব ওজনদার সুটকেস (নবলব্ধ বইপত্র ঠাসা)–তৃতীয় একটা হাত না থাকায় শাড়ির কোঁচাটা অত্যন্ত বিনীতভাবে শ্রীচরণে লগ্ন হয়ে পড়েছে—তাকে তুলে ধরি কী করে? উদিকে আহ্লাদী শালখানি কেবলই খসে খসে পড়ছেন সঙ্গে সিল্কের শাড়ির আঁচলটা সুদ্ধ নিয়ে, হিন্দী ছবির নায়িকাদের স্টাইলে। লাজলজ্জা বুঝি আর রইল না। আঁচল গোছাতে যেতেই সুযোগ বুঝে ইদিকে কম্বলটির ভাঁজ খুলে খুলে ধুলোয় অমনি এলিয়ে পড়ছেন। এইভাবে অবিশ্বাস্য উপায়ে দু’পা যেতে-না-যেতেই চতুর্দিকে প্ৰবল ধুলো উড়তে লাগল। হাত কৈ, যে নাকে চাপা দেব? হাত কৈ, যে কোঁচাটা তুলব? হাত কৈ, যে আঁচল সামলাব? কম্বল ভাঁজ করব। শালটা জড়িয়ে নেব? দ্বিভুজ প্রাণী মাত্র, হাত বড়ই কম। সে তুলনায় বোঝা ঢের বেশী। লাজলজ্জা, মালপত্র, স্বাস্থ্যটাস্থ্য। অতএব চটিতে, কোঁচাতে শালেতে, শাড়িতে, ব্যাগেতে, বাক্সতে, জলে, কম্বলে—প্রচণ্ড এক কেলেঙ্কারি হয়ে যাকে বলে গোবর মাঠময়। নাঃ, এভাবে পিলগ্রিমের প্রোগ্রেস ইমপসিব্ল! লাল্লন দৃশ্যটি নজর করে ছুটে এসে সুটকেস-কম্বল কেড়ে নেয় হাত থেকে। ‘দিদি, জরাসা ঠাহর যাইয়ে। কুলি না পেলে কী আর করা, আমাদেরই কেউ যাবে। আসলে আজ যত তাড়াতাড়ি বানারসে ফিরতে পারব, ততগুলো ট্রিপ দিতে পারব এখানে! আজ মৌনী অমাবস্যা, হোল নাইট যাত্রী আসবে। সেইটেই মুশকিল হয়েছে। এর মধ্যেই লতিফ কোথায় চলে গেছে। তাকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। লাল্লন বললে—’মুশকিল এই যে, কুলি যদিও বা পান, আপনাদের কুলি নেওয়া উচিত নয়।’ তোরণের নিচের অনাদ্যন্ত জনস্রোতের দিকে আঙুল তুলে লাল্লন বললে—’কুলি তো মাল নিয়ে ভেগে যাবে। যাকে-তাকে মাল নিতে দেবেন না। এখানে অনেক চিটিং হয়। আপনারা একজন বুড্ঢা আর একজন ঔরৎ। ভিড়ে দৌড়ে চোট্টাকো পকড়নে কোইভি নহী সকেঙ্গে মালপত্র সমস্তই যাবে।’—এমন সময়ে লতিফ ফিরল। সঙ্গে দুটি বছর দশ বারোর ফুটফুটে ছেলে। একজনের মাথায় চাঁটি মেরে বললে–’এটার নাম লালা। আর এইটা গোঙা। এরা ঐ চায়ের দোকানের মালিকের ছেলে।’ ওর হাতের ইশারা অনুধাবন করে দেখি ছোট্ট সাদা রঙের পাকাঘর। সেখানে চা বিস্কুট বিক্রি হচ্ছে বারান্দায়—ব্ল্যাকবোর্ডে আরও অনেক স্বাদু সম্ভাবনার নাম লেখা।
-’এটা এদের বাপের বাড়ি, নিজের বাড়ি, নিজের দোকান। পালাতে পারবে না। পালালে পুলিশকে বলবেন এই দোকানের মালিকের ছেলে। ওর বাবা বলেছে একে পাঁচটাকা, ওকে দু’টাকা দিয়ে দিতে। তাই দেবেন।’
–’সেকি, ওকে মোটে দু’টাকা কেন?’
‘ও তো গোঙা।’
‘গোঙা? মানে বোবা?’–বোবা বলে মাল তো কিছু কম বইবে না। কিমাশ্চর্যম্। ওদের বাবা নিজেই এমন বললেন?
‘ঠিক তা নয়। দর কষে নামিয়েছি।’
–’আমরা দু’জনকেই পাঁচটাকা করে দেব। শুনে গোঙার ম্লান মুখ মুহূর্তে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। লালাও মিষ্টি হাসল একগাল। লতিফ তাদের পিঠ চাপড়ে বলল—ঠিকসে নিয়ে যাবি। বেইমানি করবি না।’ তারপর পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে তাতে ইংরেজি অক্ষরে নিজেদের নাম লিখে আমার হাতে দিল। ওদের ট্যুরিস্ট ট্যাক্সি আসোসিয়েশনের ঠিকানা। ক্লার্ক হোটেলের বিপরীতে। ট্যাক্সির নম্বরও লিখে দিল—U. P. L. 5233 আর বলল, লাল্লন সিংয়ের ট্যাক্সি বলবেন। ক্লার্ক হোটেলেও চেনে, ট্যুরিস্ট ব্যুরেতেও। বাবা দুশো আমি একশো, ভাড়া মিটিয়ে দিলুম। তারাও খুশি, আমরাও।
.
একটা নোটবই এগিয়ে দিল লাল্লন।-’দিদি, আপনার ঠিকানা? যদি ফিন তার্কেস্সুয়েরমে যাই এবারে কলকাতা দেখে আসব।’ ঠিকানা লিখতে লিখতে বলি—’নিশ্চয়। আমাদের বাড়িতে এসে থেকো। লতিফভাই, লাল্লুনভাই, তোমাদের দিদির নেমন্তন্ন রইল!’
বেলা তিনটে বাজে। এবারে দুটি কিশোরের সঙ্গে আমরা দু’জন অনাত্মীয় পিতাপুত্রী প্রয়াগসঙ্গমের দিকে পদব্রজে রওনা হলুম। জনসমুদ্রে মিশে যাবার অগে একবার পিছন ফিরে দেখি ঐ চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে লতিফ লাপ্পন হাত নাড়ছে।
–’চলি ভাই।’
-’ফির মিলেঙ্গে দিদি।’
তৃতীয় সৰ্গ
হাঁটছি তো হাঁটছিই।
গোড়াতেই ডানদিকে একটা পুলিশের তাঁবু দেখে আমি রাস্তা ছেড়ে নেমে গিয়ে জেনে এসেছি, যদি গবর্নরের তাঁবুর পাশে যেতে চাই তাহলে ৪নং ব্রিজ দিয়ে পার হতে হবে। চক্রবর্তী রাস্তার ছবি এঁকে দেখিয়ে দিয়েছেন গবর্নরের তাঁবুর পাশেই ট্যুরিস্ট ব্যুরো এবং প্রেস। আনন্দময়ী মায়ের তাঁবু কোথায় পুলিশ জানেন না। কিন্তু প্রেসের কাছে পৌঁছুতে পারলে আনন্দময়ী মাকে পাওয়া অসাধ্য হবে না, শুনেছি ইন্দিরা গান্ধীও তাঁর ভক্ত! আনন্দময়ীর দেওয়া মালা গলায় পরে ইন্দিরার ঢের ছবিও দেখেছি কাগজে। শার্দূল সিংয়েরও তাই অভিমত। ট্যুরিস্ট ব্যুরোকেই লক্ষ্য করে এগোতে হবে—অথবা প্রেস। কেননা এগুলো সবাই জানবে, বিশেষ একজন ধর্মগুরুর আশ্রম যদি নাওবা জানে।
মানুষ, মানুষ মানুষ। রাস্তাটা উঁচু বাঁধের মতো। দুপাশে ঢালু হয়ে নেমে গেছে মাঠ। মাঠে তাঁবু মানুষ গাছপালা। একজায়গায় দেখি পরপর বেশ কয়েকটি স্বাস্থ্যবান হাতির পায়ে শিকল পরিয়ে খোঁটায় বাঁধা রয়েছে, গাছের নিচে। এত মানুষের মধ্যে হঠাৎ কিছু হাতি দেখে কেন জানিনা খুব আহ্লাদ হল। এক সঙ্গে এত হাতি! কিন্তু কেন! এ হাতিরা এখানে কি করছে? এখানে কি সার্কাস-টার্কাস…? না শোনপুরের মেলার মতো…? লালা বললে—এদের মেলায় ঢুকতে দেওয়া হয়নি এবারে। হাতি ভেতরে নিয়ে যাওয়া বারণ। তাই যে সব সন্ন্যাসীরা হাতিতে এসেছেন তাঁরা এখানে ওখানে হাতি জমা রেখে, হেঁটে গঙ্গাদ্বীপের আখড়ায় গিয়ে আছেন।
বিদ্যুচ্চমকে মনে পড়ে গেল, আরে পূর্ণকুম্ভের বিষণ্ণ-প্রসঙ্গ, যেবার নাগাসন্ন্যাসীদের হাতির তলায় পিষ্ট হয়ে স্বর্গলাভ করেছিলেন কয়েক হাজার অসহায় পুণ্যার্থী। থাক, হাতিরা ভালোই আছে—মেলার বাইরে। এখানেই তোমাদের ঢের পুণ্য হবে, সামনের বারে হাতিজন্ম হবে না। মাহুত জন্ম হবে। এই তো প্রার্থনা? খানিক পরে দেখি, উট! মাল বইছে উটের গাড়ি এবং উট। দলে দলে পুণ্যার্থী হেঁটে চলেছেন, তাঁদেরও হাতে, বগলে মাথায় মালের বোঝা। অনেক সাধুসন্ন্যাসীও যাচ্ছেন, মোটা কম্বল নিয়ে, সুখী পুরুষ তাঁরা। লালার মাথায় আমার সুটকেস, গোঙা বাবার বেডিং ও কিটব্যাগটি বইছে। আমার ফুটানির ঝোলা, জলের বোতল, কম্বল, ব্রীফকেস, (আঁচল, শাল, কোঁচা) ইত্যাদি আমারই করস্থ আছে! কচি কচি মুখ দুখানি যেন পদ্মফুলের মতো আলো হয়ে আছে ময়লা পোশাকের ওপরে। সেই পদ্মমুখে বিস্তর ধুলো ময়লা, তারই মধ্যে ঝকঝকে দুটি হাসিভরা সরল চোখ। ওদের দিয়ে ভারী ভারী বোঝা বহন $রিয়ে তারপর কুম্ভস্নান করলে সেটা মোটেই পুণ্যস্নান হবে না। তাই বললুম—’এবারে এইসব খুচরো জিনিসগুলো লালা নাও, আমি নিচ্ছি স্যুটকেস।’ লালা আপত্তি করলে, ওগুলো তো ভারী নয়, এইটেই ভারী—’তা হোক, লালা তুমি আমার কথাটা শোন। বাবাও কিটব্যাগটি গোঙার হাত থেকে নিয়ে নিলেন। দেখেই আমার শিভালরি জেগে উঠল। বাবার হাত থেকে কিটব্যাগ আমি কেড়ে নিলুম—’বাবা, মেয়ের সামনে আপনি ব্যাগ বইবেন ওকি হতে পারে?’ বলতে না বলতে দেখি গোঙা টানাটানি করছে আমার সুটকেসটা নিয়ে। এইরকমই চলল সারা রাস্তা বদলাবদলি। আমরা সবাই মিলে সব মাল ভাগাভাগি টানাটানি করে বইতে লাগলুম। শার্দূল সিংহও কম যেতে রাজি নন—নিদেনপক্ষে কেড়েকুড়ে কম্বলটা জলপাত্রটা তো বইবেনই। তাঁর মিলিটারি ট্রেনিঙে স্ত্রীলোকের হাতে মাল দিয়ে নিজে শূন্যহাতে যাওয়া প্ৰাণ থাকতে দুঃসাধ্য। আর আমার কলকাতা ছেড়ে আসা দুটো মেয়ের কচি মুখ আমি কেবলই লালা গোঙার ধুলোময়লা মাখা মুখে দেখতে পাচ্ছি-ওদের দিয়ে সবটা ভার বওয়ানো আমার মায়ের প্রাণেও অসম্ভব। নেহাত একা সত্যই বইতে পারব না, আর ওদের মাল বওয়ার অভ্যেস আছে—তাই। আমাদের দুজনের মাল আমরা চারজনে ভাগ করে বইতে লাগলুম।
ওফ! মালের বোঝা তো নয়, এ যেন পাপের বোঝা। অথচ এসেছি তো মাত্র সঙ্গে তিনটে চেঞ্জ নিয়ে তার একটা রয়েছে পরনে। যাবতীয় গরম পোশাকও সমস্তই রয়েছে পরনে। পায়ে এক জোড়া মোজা ছিল, একসময়ে থেমে আরেকজোড়াও পরে ফেললুম তার ওপরে। পায়ে শীত করছে। হায়দ্রাবাদে-তিরুপতিতে কিছু উপহার দ্রব্য কেনা হয়েছে আর পাওয়া হয়েছে প্রচুর বইপত্র। তারই ফল এই। ঐ সরস্বতীর প্রসাদটাই মাটি করেছে। (অথচ তাঁরই কল্যাণে যে আসাটা সম্ভব হল, তা সেই কৃতঘ্ন পাপ-মনে খেয়ালই হল না তখন!) সরস্বতীর তো কাণ্ডজ্ঞান নেই, সকলেই জানে। মাঝে মাঝে উটকে সসম্ভ্রমে পথ ছেড়ে দিয়ে আমরা চলেছি। আমরা কত সহস্ৰ উদ্গ্রীব মানুষ এই একই পথে চলেছি। পথের পাশে মাঠে মাঝে মাঝে দেখছি ধুলোয় ঝুপড়ি বাঁধা, বিছানা পাতা, উনুন গড়া। রান্না হচ্ছে, খাওয়া হচ্ছে, কম্বলমুড়ি দিয়ে ধুলোয় ঘুমোচ্ছে দূরাগত, পথক্লান্ত।
.গোড়ায় আমরা অনেকক্ষণ ধরে একটা বাজারের মধ্য দিয়ে গিয়েছি। দুদিকের দোকানে কম্বল ঝুলছে পুঁতিচুমকির কাজকরা বিয়ের ওড়নাও ঝুলছে। দোকানে দোকানে চা-বিস্কুট বিক্রি হচ্ছে। আমার মনে হল ছেলেদুটোকে কিছু খাইয়ে নিলে হত। শার্দূল সিংকে বলতেই তিনি বললেন—‘নিশ্চয়ই, কিন্তু সেটা হয়তো মেলায় পৌঁছে খাওয়ানোই ভালো, পথে কখন যে সন্ধ্যে হয়ে যায়।’ এত ভিড় যে, মানুষে মানুষে গায়ে গা ঠেকে যাচ্ছে, মালে মাল বেধে যাচ্ছে, দ্রুত যাওয়াই যায় না। অবশ্য আমরা দ্রুতগামী জীব নই আপাতত একজনও! সকলেই ভারবাহী ধীরগতি জন্তু। পথে সন্ধে হয়ে গেলে খুঁজে পাব না অচেনা আস্তানা। তাই এখন না থামাই বাস্তবিক ভালো। তখন আমি ভাবলুম পথেই ওদের লজেঞ্চুস কিনে দেব—গলাটা ভিজবে। ভাবামাত্র একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। উলটোদিক থেকে নেভি ব্লু রঙের লম্বা কোট, মাথায় শেঠেদের কালো টুপি আর ধুতিপরা এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক এগিয়ে এসে লালার একটি হাত ধরে, তাতে একমুঠো সাদা ধবধবে বড়ো বড়ো চিনির বাতাসা পুরে দিলেন। আমি অমনি গোঙার হয়ে তাড়াতাড়ি হাত পেতে দাঁড়ালুম—যেহেতু গোঙার দু’হাতে বেডিংটা মাথায় ধরা আমাকেও দিলেন তিনি বাতাসা। দিয়ে বাতাসার ঠোঙা নিয়ে জনসমুদ্রে মিশে গেলেন। আমি গোঙার লাজুক লাজুক হাসিমুখে আর ছিন্ন পকেটে ভরে দিলুম ধবধবে বাতাসা। ইশ্—গোঙা’ কি একটা নাম হল?—’লালা, তোমার ভায়ের আর কোনো নাম নেই? রাম, রহিম, মুন্না, পাপ্পু, কিছু না।’ গোঙা বাতাসা খেতে খেতে মাথার ওপরে ভারি জিনিস সামলে, সন্তর্পণে চোখের মণি নেড়ে ইশারা করল, না নেই। লালা বলল, ‘গোঙাই ওর নাম। আমার যেমন লালা।’ কী নির্মম আমাদের দেশ। কী উৎকট নগ্ন আমরা। এর চেয়ে সায়েবসুবোরাও যে ঢের ভদ্দর! সেখানে এইযুগে একটা বোবা শিশুর নাম কেউ ‘বোবা’ রাখছে, এটা কিন্তু ভাবতে পারি না। আর এমনি হাসিখুশি, বুদ্ধিমান এবং শ্রবণশীল সুস্থ ছেলে, ঠিকমতো চিকিৎসা হলে, অর্থাৎ অবস্থাপন্ন ঘরে জন্মালে সে ছেলে নিশ্চয়ই কথা বলত। বোবা হওয়ার কথা ছিল না ওর।—’লালা’ খুবই আদরের নাম, লালা নন্দ-দুলালা। আর তারই ছোট ভাইটির নাম হবে কেন গোঙা? কেন?—এমন সময়ে শার্দূল সিং বললেন—’নবনীতা, লক্ষ্য করেছ কি, কুম্ভমেলায় প্রবেশ করার আগেই ভগবান তোমার ইচ্ছা পূরণ করতে শুরু করেছেন?’ তাঁর কণ্ঠস্বর চাপা উত্তেজনায় কাঁপছে।
-’কেন বলুন তো?’
-’বাঃ, তুমি যেই ইচ্ছে করলে যে বাচ্চা দুটোর মুখে কিছু খাবার তুলে দেবে, অমনি ঈশ্বর স্বয়ং সেই খাবার জুটিয়ে দিয়ে গেলেন। তোমাকে আর দাঁড়াতেও হল না, দেরিও হল না। দেখলে না?’
শার্দুল সিংহের কথায় আমার গায়ে হঠাৎ কাঁটা দিল। সত্যি তো! ঐ লোকটি কে? কেনই বা উলটোদিক থেকে উজান বেয়ে এল,—–জনতা তো এখানে একস্রোতা, সকলে একই লক্ষ্যের যাত্রী—কেনই বা এতলোক ছেড়ে আমাদের লালা-গোঙার অঞ্জলিতেই ভরে দিল সে মিষ্টান্ন?
-’লালা, তুমলোগ উও আদমিকো পহচানতে হো?’
–’কওন আদমি?’
–’জিসনে মিঠাই দিয়া।’
—’নহী তো?’
নিশ্চয় পুণ্যলোভী কোনো তীর্থযাত্রী হবেন। শিশু-ভোলানাথকে তিনি অর্ঘ দিয়ে গেলেন নিজেরই মনের তৃপ্তির জন্য। এ তাঁর পুণ্য অর্জনের এক পথ নাকি, শার্দূল সিং যা বলছেন,—তাই? স্বয়ং ঈশ্বরই আমার মনের বাঞ্ছা পূরণ করতে এগিয়ে এসেছিলেন? ইচ্ছে করছে শেষের ব্যাখ্যাটাই বিশ্বাস করতে এই আকুল ভিড়ে, এই পবিত্র ধুলোয়, এই ম্লান-হয়ে আসা সূর্যালোকে, এটাই মানায়।
তিনিই এসেছিলেন। আমার জন্যে, আমার কাছে, তিনিই এসেছিলেন। ভাবলে ক্ষতি কী? ভাবতে পারলে তো অনেক লাভ। শার্দূল সিংহের সেই মস্ত লাভটা হয়ে গেছে। সতের লক্ষ টাকার লটারি নিতে গেছেন তিনি, এখানে—এইমাত্র। ভাগ্যবান পুরুষ। আর তুমি একটা একশো টাকার কনসোলেশন প্রাইজও তুলতে পারলে না, নবনীতা? এতই তোমার জ্ঞান-বুদ্ধির পাথর বোঝা? না হয় চোখটা বুজে এক মুহূর্ত মেনেই নেবে—তোমার মধুসূদনদাদা এসেছিলেন যেই তুমি চাইলে ওরা মিষ্টি খাক, অমনি ওদের মিষ্টি খাইয়ে গেলেন তিনি নিজেই। ঈশ্বরদর্শন কি অপার্থিব, অন্যরকম কিছু? না এইরকমই?
আমি তো ভজনপূজন জপতপ কিছুই জানি না। অথচ অনেকবারই আমার বিস্মিত হৃদয়ের সামনে ঈশ্বরের করুণা ফুটে উঠেছে—যা আমার কদাচ প্রাপ্য নয়, সেই অহৈতুকী কৃপা আমাব জীবনেই উথলে পড়েছে বার বার। ঈশ্বর নিশ্চয়ই দেখিনি, কিন্তু মাঝেমধ্যে যুক্তির ঘরে চুরি করে অন্যের চোখে দেখতে দোষ কি? এই তো—পুণ্যবান শার্দূল সিংহ খুব কাছ থেকে এইমাত্র তাকে দেখলেন। দেখতে পেলেন।
বাতাসা খেতে খেতে বাচ্চারা পথ দেখিয়ে আগে আগে চলেছে। আশেপাশে সকলেই যে-যার নিজের মাল বইছেন—শুধু আমাদের বেলাতেই সহায়ক আছে। হঠাৎ খেয়াল হয়—এও তো মস্ত এক ভগবদ্ কৃপাই? এ সুবিধে তো পাওয়ার কথা ছিল না আমাদের? মনে পড়ে গেল ছেড়ে আসা প্যাকিং লটে গাড়িতে-বন্দী সেই দুই দুজন বাঙালী মহিলার আফসোস। দুদিন ধরে এখানে এসেও তাঁদের সঙ্গমে স্নান হয়নি। কারণ মালপত্তর। ফেলেও যেতে পারেননি, নিয়েও যেতে পারেননি। এবং সঙ্গের একমাত্র পুরুষটি তাঁদের এই ভিড়ের মধ্যে যেতে একলা ছাড়েন নি। তিনিই একলা অগত্যা চলে গেছেন নাইতে। আমাদের লালা-গোঙার মধ্যেই ঈশ্বরের অপার করুণা এসেছে। একবার মেঘমেদুরম্বরম্ স্টাইলে এমনই পবিত্র তীর্থরজঃ উড়ছে আকাশ ছেয়ে, নাকে রুমাল চাপতে হচ্ছে শার্দূল সিংকেও। অথচ জয়পুর ধুলোরই দেশ আমার ধুলো-ধোঁয়াতে আবার প্রবল এলার্জি। এতক্ষণে উচিত ছিল ফ্যাচ ফ্যাচ-ফ্যাচ্চো শুরু হয়ে যাওয়া। তারপরেই সোঁ-সোঁ করে ঝড়ের গর্জন উঠবে বক্ষপঞ্জরে। সঙ্গে সঙ্গে ঝরঝর ঝরবে বারিধারা, নাসা গহ্বর দিয়ে। কৈ, সে সব নৈসর্গিক দুর্লক্ষণ তো দেখা যাচ্ছে না? দেখা দিলে অবশ্য যাত্রা আজকের মতো সমাপ্ত হত আমার। ব্যাগ থেকে বেরুবে কর্টিজোনের ধন্বন্তরি বিষবড়ি—আর সঞ্জীবনী স্প্রে-সুধা। যথা-তথা বিশ্রাম নিয়ে ফুলো ল্যাজ গুটিয়ে কালই ঘটবে ‘খুকুমণির প্রত্যাবর্তন। চান্স পেলে আমার হাঁপানি এতই বেড়ে ওঠে, যে কাছাকাছি উপস্থিত সুস্থ ব্যক্তিদের পক্ষে সে দৃশ্য সহ্য করা—আমার শ্বাস-প্রশ্বাস নেবার কষ্টের চেয়েও বেশী কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। এতদ্সত্ত্বেও আমার যত্র-তত্র বিহারের উৎসাহে ভাটা পড়ে না। যদি অসুখ করে? তখন তো কষ্ট হবেই! অসুখ করতে পারে—এই ভাবনায় আগে থেকে কষ্ট পাই কেন? তাই আমি সবসময়ে ধরেই নিই অসুখ করবে না। কখনই করবে না। অসুখ নেই। দুঃখের বিষয় সদা সর্বদা এই ধরে নেওয়াটা কার্যকরী হয় না। মাঝে মাঝে অসুখই আপার-হ্যান্ড পেয়ে যায়। তা যাক। তবু বিশ্বাস হারাতে নেই। রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন না, মানুষের ওপরে বিশ্বাস হারানো পাপ? আমি সেটাকে জীবনে ধ্রুবতারার মতো মেনে চলতে চেষ্টা করি। আমি জানি, রিপু-তাড়িত, মৃত্যুশাসিত, অমানুষিক এই মানুষই আবার পারে দেবোচিত অসাধ্যসাধতে। ঠিক তেমনই, শরীরের বেলাতেও একটা সদুপদেশ তৈরি করে নিয়েছি আমি।—শরীরের ওপরে বিশ্বাস হারানো পাপ। যদিও শরীর মানুষের মতোই বিশ্বাসভঙ্গ করে, তবুও শরীরের নামই তো মহাশয়, যা সওয়াবে আলবৎ তাই সইবে। এই বিশ্বাসেই আমি চোখ বুজে চলি। প্রসিদ্ধ ‘গরীবী হঠাও’-এর মতো আমার স্লোগান হল ‘উদ্বেগ হটাও।’ যদিও জানি এই জটিল জগতে কোনোটাই সহজে হটবার নয়।—আমার মা অবশ্য আমার এই সুগভীর ফিলসফিকে শরীরের ওপর অকথ্য অত্যাচার বলে অভিহিত করেন। কিন্তু মায়েরা বড়ো একবগগা অবুঝ জাত। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি একদম ভোঁতা, অযৌক্তিক। যতই বলি—’দ্যাখো, চে গুয়েভারা অত জোর হাঁপানি নিয়ে বনে-জঙ্গলে কী যুদ্ধই না করে বেড়িয়েছেন। দ্যাখো, চারু মজুমদার ওই কার্ডিয়াক হাঁপানি এবং আরও পাঁচটা রোগসুদ্ধ দেশে কী কাণ্ডটাই বাধিয়ে গেলেন।’ মা ইম্প্রেড হন না মোটেই। এই ধুলোয় এই ঠান্ডায় এভাবে আমাকে দেখতে পেলে মা বেচারা কী করতেন আজ!
.
বাঁধানো পথ ছেড়ে ছেলেরা এক সময়ে পাশের মাঠে নেমে পড়েছে। এমনি মাঠেই বাঁধা ছিল উটের গাড়ি। যাত্রীদের শোওয়া খাওয়া ঝোপড়ি বাঁধা হচ্ছিল। পথের মাঝে একটা মস্ত ইঁদারা পেরিয়েছি, গাছতলাতে। সেটা ঘিরে অনেক গ্রাম্য যাত্রী বিশ্রাম করছেন। এই ঝুঁসীই নাকি পুরাকালে পুরুরবার রাজধানী ছিল। কে জানে, এই ইঁদারাই সেই ‘সমুদ্রকূপ’ কিনা?
দূর থেকেই দেখি পথের পাশে একজায়গায় ধবধবে সাদা পরিষ্কার কাপড় বাঁশের ফ্রেমে ঘেরা অনেকখানি জায়গা, তার গায়ে হিন্দীতে সাইনবোর্ড আঁটা ‘শৌচাগার’। তারই পাশ দিয়ে যেতে হবে ভেবে নাক বেচারী বেজায় ভয় পেয়ে গেল। কাছাকাছি গিয়ে নাক কিন্তু খুব অবাক—ব্লিচিং পাউডারের প্রাণারামকারী কড়া গন্ধ আসছে। যেটা ভাবা গেছিল, সেটা নয়। রাস্তার ধারে ধারেই চোখে পড়েছে নিচু পাইপ থেকে জল ঝরছে পরিষ্কার। সেখান থেকে পা ভরে নিয়ে যাচ্ছেন যাত্রীরা। যথেষ্ট জল, যথেষ্ট বীজাণুনাশক ওষুধের বন্দোবস্ত হয়েছে দেখছি। ওদিকে অনবরতই কলেরার টিকে চেকিং হচ্ছে।
হাঁটতে হাঁটতেই দুবার সার্টিফিকেট দেখাতে হল, গাড়িতেও দুবার দেখানো হয়েছে! এই নিয়ে চারবার। বাচ্চাদের ‘পড়ছি’ নেই। দ্বিতীয় ফাড়িতে একজন পুলিশ বললে-’আয়, দিই তোদের ইঞ্জেকশন দিয়ে।’ শুনে গোঙা হেসে ফেলল, আর লালার মুখটি ভয়ে শুকিয়ে গেল। গোঙা অতঃপর টেনে এক ছুট লাগাল তার পরেই। পুলিশটি তাড়া করল না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই হাসতে হাসতে চেঁচালো কেবল—‘ধর ব্যাটাকে, ধর ব্যাটাকে,—পাড়ো, পাড়ো–ভাগ লো ভাগ লো’–এবারে লালার ছোট্ট ধরে যেন প্রাণ এল। সে একগাল ফরসা হাসি হেসে দিল।
চতুর্থ সর্গ
চার নম্বর সেতু কাকে বলে বোঝা গেল না—সেতু চোখে দেখাই যাচ্ছে না, কেবল থিকথিক ঘন পিঁপড়ের সারির মতো মানুষের রেখা নদীর বুক জুড়ে সরীসৃপের মতো পশ্চিমমুখো এগোচ্ছে। দূরে শূন্যপথে আকাশের গায়ে দুটি সেতু ঝুলে আছে, তাদের রুপোলি শরীরে শেষ সূর্যের নরম আলো। একটি সম্পূর্ণ অন্যটি অসম্পূর্ণ। ওটি তো রেলসেতু, বোঝা গেল না অসম্পূর্ণটি কি অতীতের ভগ্নস্মৃতি, না অগঠিত ভবিষ্যৎ-স্বপ্ন? লালাও সেটা বলতে পারে না। যেখান দিয়ে হেঁটে আমরা পার হচ্ছি ঈশ্বর জানেন সেটি কোন নদী, হয় গঙ্গা না হয় যমুনা। (সরস্বতী নিশ্চয়ই নয়, যেহেতু যুক্তবেণীর তিনটির মধ্যে এইটি অদৃশ্য!) সেতুতে উঠতে যাবার আগে সামনের দিকে তাকালুম, ওপারে বালুচর সাদা সাদা তাঁবুতে ভর্তি। সেখান থেকে অজস্ৰ ধোঁয়ার সাদা ঋজুরেখা উঠছে আকাশে, শত শত প্রার্থনার মতো। আর দক্ষিণ-পশ্চিমে আরও জল, তারও পশ্চিমে আরও বালুচর, আরও তাঁবু, আরও ধোঁয়া। আর কী মানুষ!—ধোঁয়া অত কি সবই উনুনের?
শার্দূল সিং বললেন না, ধুনির। সাধুরা ধুনি জ্বালিয়েছেন তো, শীতও কমে, আলো হয়। সেই ধুনির ধোঁয়া এই সব। উনিও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে, দূরে দৃষ্টি নিবন্ধ। একটি হাতে চোখ আড়াল করা, অস্তরবির মুখোমুখি। ওঁর চোখ দিয়ে দূরে তাকিয়ে হঠাৎ একমুহূর্তর জন্য মনে হল—সামনে বিস্তৃত যুদ্ধক্ষেত্র। পশ্চিমের অস্তসূর্যের রক্ত আভায় একটা ভয়াল বিষণ্ণতা আছে, এইসব তাঁবু পড়েছে যেন কোন বিদেশী সৈন্যদলের, এই যে ধোঁয়া উঠছে, যেন তাদেরই সঙ্কেতচিহ্ন—আর এই শতসহস্র চলমান মানুষ, সবাই সৈনিক সবাই প্রস্তুত, সেনাপতি শার্দূল সিং যেন তার বিপুল সৈন্যবাহিনী পর্যবেক্ষণ করছেন, যেন মানুষ এখানে আসার আগে শেষবার প্রণয়ীকে চুম্বন করে এসেছে, সন্তানকে আদর করে এসেছে, পিতা মাতাকে প্রণাম করে এসেছে। এখন এদের হারজিৎ, ফেরা-না-ফেরা সবই অনিশ্চয়ের!
দূরের দিকে তাকালে মনটা ছড়িয়ে পড়ে। শুনেছি ত্রিশ মাইল জুড়ে কুম্ভমেলা বসেছে গঙ্গাদ্বীপে। মেলা কেন কে জানে? এখন পর্যন্ত কোনও হাটবাজার দেখিনি। ঘণ্টা দু’তিন হাঁটছি, সবে তো নদী এল, এই জল পেরুতে হবে একবার নয়, বারবার তারপর সেই কাঙ্ক্ষিত হৃদয়ভূমি, গঙ্গাদ্বীপ।
শার্দূল সিং তাঁর বাঁদুরে টুপির নিম্নাংশটা গুটিয়ে রেখেছিলেন, এবার নামিয়ে দিলেন ঘেরাটোপ, জোলো হাওয়া। আমি খুব জল ভালোবাসি। জল দেখলেই আমার ভেতরে ভেতরে একটা সাড়া জাগে। হয়ত আমার খুব পূর্বের পুরুষরা কোনও ঝর্ণার ধারে বাস করতেন, গভীর জল দেখলেই হাঁটু গেড়ে বসে ছুঁতে ইচ্ছে করে, আর অগভীর জলে নেমে পড়ি। কিন্তু এখন এমনই এক ঘোরের মধ্যে হাঁটছি—পথ থেকে সরে গিয়ে জলের কাছে নেমে যাবার কথা মনেই এল না। একসময়ে দেখি হাঁটি হাঁটি পা পা করে আমরা চারজনে সেই সেতুর ওপরে শোভাযাত্রায় মিশে গেছি। যেতে যেতে যে থমকে দাঁড়াব তার উপায় নেই। থামা চলবে না। পিছন থেকে লক্ষ মানুষের গতিময় চাপ এসে আছড়ে পড়বে। শার্দূল সিং পিছনে পড়ে গেছেন, লালা-গোঙা কোথায় এগিয়ে গিয়েছে। পিছন ফিরে ফিরে দেখতে চেষ্টা করছি, হঠাৎ কিছু দূরে একটি হাত শুন্যে উঠল—শার্দূল সিং। ঠোট নেড়ে বললেন—’গো আহেড়, আয়াম হিয়ার।’ দূরের দিকে বাচ্চা ছেলেদের চিহ্ন দেখা গেল না। বুঝতে পারছি কেন লাল্লন-লতিফ বলেছিল কুলি নেওয়া অনুচিত। এখানে কেউ যদি পালাতে চায়, আমরা তাকে ধরতে পারব না। লালারা যদি না পালায়, সেটা হবে ওদের মহানুভবতা। আমি সেতুর বাঁপাশে—একদিকে খোলা জল আছে—সেতুর ধারে অবশ্য শক্ত লোহার বেড়া, জালটাল নানারকমের পার্থিব রক্ষণাবেক্ষণ তার ফাঁক দিয়ে আসছে নদীর হাওয়া, নদীর রং, জলের গন্ধ আকাশের বিস্তার-ওপাশের দৃশ্য। সাদা সাদা তাঁবু, সন্ন্যাসীদের চলাফেরা ওই ফাঁক দিয়ে সব এগিয়ে আসছে আমার কাছে। আরেকপাশে নিরবচ্ছিন্ন মানুষের দেওয়াল, ৭-৮ মানুষ ঘন। কি আরও বেশিও হতে পারে। এক সময়ে পায়ের নিচে সেতু ফুরোল, হঠাৎ মানুষের দেওয়ালটা ভেঙে গেল, ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। পায়ের নিচে রুপোলি সাদা মিহি বালি। আমার আবার ইয়া উঁচু গোড়ালির মেমজুতুয়া পায়ে। খুলে হাতে নিলুম। এই বালিতে হাঁটতে গেলে খালি পা-ই সবচেয়ে ভালো।
সামনেই অপেক্ষা করছে দুটি ক্ষুদ্র মনুষ্যমূর্তি, মাথায় বেডিং, সুটকেস। আবার তেড়ে গিয়ে সুটকেসটা ছিনিয়ে নিলুম। অনেকক্ষণ বয়েছে। সেতুটা পার হবার সময়ে স্পিড্ খুব কমে গিয়েছিল তো। বেডিংটা বওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়, নেবার চেষ্টা করা কেবলমাত্র ন্যাকামি হবে। শার্দূল সিংও এসে পড়েছেন। এখন দিব্যি এক তাঁবুর-শহরে এসে পড়েছি দেখা যাচ্ছে। এই বোধহয় গঙ্গাদ্বীপ। কুম্ভনগর।
আমাদের একপাশে গঙ্গা। গঙ্গাই মনে হয়, জলের রং সাদা। (যমুনা তো নীল যমুনা হবার কথা!) অন্যপাশে সারি সারি তাঁবু গঙ্গার তীর থেকে ভার্টিকাল রেখায় বেরিয়ে গিয়েছে পুব থেকে পশ্চিম দিকে—তাদের ফাঁকে ফাঁকে রাস্তা। দূরে একটা খুব উঁচু প্যাগোডার মতো গড়নের দর্পিত তাঁবু দেখা যাচ্ছে। এই সামনের বিনীত তাঁবুদের গায়ে তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা। কোনো কোনো তাঁবুর গায়ে তাদের ধর্মীয় গুরুর ছাপা ছবির সারি সারি পোস্টার আঁটা। উপদেশের স্লোগান দেওয়া পোস্টার তো আছেই। বাঃ, এ তো বেড়ে মজা! গুরুদেবের শ্রীমুখের পোস্টার পড়েছে তাঁবুর দেওয়ালে। ধর্মের বক্স অফিস নিয়ে বেশ প্রতিযোগিতাও আছে মনে হচ্ছে। শিবাজীগণেশন্ আর মোক্ষমকুমারদের মধ্যে সব প্রফেশনেই যখন প্রতিযোগিতা আছে, এতেই বা থাকবে না কেন। সবকিছুতেই ভেজালও আছে; সাধুদের মধ্যে তো আছেই! যাঁরা তেমন-তেমন সন্ন্যাসী, তাঁদের নিশ্চয় এমন দশা হয় না। সত্যকার সন্ন্যাসীও নিশ্চয় এই মেলায় অনেকেই এসেছেন। পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ।
শার্দূল সমেত ছেলেদের দাঁড় করিয়ে রেখে পুলিশকে জিজ্ঞেস করতে ছুটলুম-’মশাই, গবর্ণরের তাঁবু/প্রেস তাঁবু এবং / অথবা ট্যুরিস্ট অফিস এবং/অথবা আনন্দময়ীর আশ্রম-ইত্যাদির স্থান কোথায়?’ তিনি আমার হাতে একটা হলদে বই দিয়ে বললেন—’ইমে সব কুছ হ্যায়। দেখ্ লিজিয়ে।’ এটাতে সব উত্তর লেখা আছে? ম্যাপ আছে বুঝি? হ্যাঁ এই তো ভেতরে একটা আলগা ম্যাপ। শীর্ষেন্দু লিখেছেন বটে এবারে কুম্ভ ব্যবস্থাপনা খুব ভালো—ও হরি! এ তো এলাহাবাদের ম্যাপ। গঙ্গাদ্বীপের ম্যাপ কই?—’গঙ্গাদ্বীপকা কোঈ ম্যাপ নহী।’ তবে? কী করে খুঁজে পাব ট্যুরিস্ট অফিস? এইসব তাঁবুর ফাঁকে সরু সরু যে রাস্তা হয়েছে, তাতে নামও লেখা আছে। কুম্ভনগর রীতিমতো টাউনপ্ল্যানিং করে তৈরি, বোঝাই যাচ্ছে। অথচ ম্যাপ ছাপানো হয়নি? কিমাশ্চর্যম্। গবর্নরের তাঁবু কোথায়? হাত তুলে ওই পেল্লায় উঁচু প্যাগোডাটা দেখিয়ে দিয়ে পুলিশ বললে-’উয়ো দেখিয়ে—উধার, সিধা বড়া রাস্তাসে চলা যাইয়ে।’ বাবাঃ, কায়দা তো মন্দ নয়, গবর্নরের তাঁবুই বটে, চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির।—ওপাশে, অর্থাৎ গোটা চারেক গলি পেরিয়ে গিয়ে, একঠো বড়া রাস্তাভি আছে সত্যি। সেখানে অনেক মোটরগাড়ি ও জিপ ঘোরাফেরা করছে। এইসব গাড়ি এখানে কি করে এল?—’ভি. আই. পি. গাড্ডি হ্যায়, ইস্পিসল পারমিশনসে আয়া।’ গাড়িগুলোর ভেতরে কচিমুখ, পচামুখ, পাকামুখ, ডাসামুখ—নানা আকার-প্রকারের ভি. আই. পি. বৃন্দ অধিষ্ঠিত। শোঁশোঁ করে ধুলোর কুয়াশা তৈরি করে, পথচারীদের নাক-গলা পর্যন্ত অযাচিত ভি. আই. পি. প্রসাদে পরিপূর্ণ করে দিয়ে হু হাশ তাঁরা বেরিয়ে যাচ্ছেন, কেউ কেউ আবার শূন্যগর্ভ শব্দসার।—আমি চারিদিকে চেয়ে দেখছি ক্লান্ত, মালবাহী পদাতিক তীর্থযাত্রীরা নাকেমুখে কাপড় গুঁজে সেই দাম্ভিক তীর্থরজঃকে যথাসাধ্য বাধা দিচ্ছেন।
পুলিশের কথামতো বড়ো রাস্তা বেয়ে চলতে চলতে দেখছি, পথের দু’পাশে তাঁবুতে বড়ো বড়ো সাইনবোর্ডে ধর্মীয় সংস্থাগুলির নাম ধাম পরিচয় লেখা। প্রত্যেক তাঁবুতে মাইক। ভেতর থেকে কোথাও ভেসে আসছে মাইকে রামায়ণ পাঠ, কোথাও নামসংকীর্তন, কোথাও অগ্নিগর্ভ হিন্দী বক্তৃতা, কোথাও বা শুনতে পাচ্ছি ব্যাকুল পুণ্যবিক্রির বিজ্ঞাপন–’এইবার এই তাঁবুতে অমুক বাবাজি অমুক বিষয়ে বক্তৃতা করবেন, সীট ভরে গেলে ঠাঁই পাবেন না, আসুন, আসুন, এই বেলা চলে আসুন’—পাড়াগাঁয়ে সার্কাস পার্টি এলে কিংবা মফঃস্বলে নতুন সিনেমা খুললে যেমন মাইকে বিজ্ঞাপন ঘোষিত হয়, ঠিক তেমনি। কর্মকাণ্ডের তো মজা মন্দ নয়।
সুউচ্চ প্যাগোডা তাঁবু এসে পড়ল, সত্যি বিরাট ব্যাপার। দেখি তোরণের মাথায় রঙিন নিওন বাতিতে দিব্যি চক্রটক্র ঘুরছে—কী এক সাধু সম্প্রদায়ের নামও শিয়রে জ্বলজ্বল করছে।—তবে? এর ভেতরেই কি গবর্নরের গুহ্যগৃহ? বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা? প্রভু, কে আমাকে বলিয়া দিবে সত্য কী!
অগত্যা আবার পুলিশ।—’ও পুলিশজী, গবর্নরকা তাঁবু কিধর,’ তিনি প্রথমে অদ্ভুত এক নির্বাক বিস্মিত তিরস্কারের জটিল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আমার সর্বাঙ্গ জ্বালিয়ে দিলেন। তারপর নিঃশব্দ তর্জনী নির্দেশ করলেন প্যাগোডার বিপরীতে একটি করোগেটের টিনে ঘেরা বিস্তৃত অঞ্চলের দিকে। পিছন ফিরে দেখি সেখানে থিথিক্ করছে পুলিশ। গেটের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে, পরিচ্ছন্ন উঠোনের ভিতরে বহু তাঁবু। সামনে ছোট্ট সাইন বোর্ডে সরকারি পরিচয়পত্র টাঙানো। হ্যাঁ, এটাই। এলুম তবে? আহ! শার্দূল সিংয়ের শুকনো মুখে হাসি ফুটল।
‘আচ্ছা ট্যুরিস্ট ব্যুরো, আর প্রেস অঞ্চলটা কোথায়?’–ও বাবা। সে কি হেথা? পুলিশ গালে হাত দেয়। সে সব মোটে এ-তল্লাটেই নয়! অনেক দূরে। ‘কম সে-কম ছে-সাত-মিল তো হোগা। বাঁধকো পাস। উয়ো গঙ্গাদ্বীপ মে হি হ্যায় নহী।’—বারে বাঃ? চক্রবর্তী আমাকে ছবি এঁকে স্পষ্ট দেখিয়েছেন এই গবর্নরের তাঁবু, আর তার পাশটিতে কোলঘেঁষেই ট্যুরিস্ট অফিস এবং প্রেস। সেই ছবি আমার ঝোলায় মজুত। বললেই হল ‘হ্যায় নহী!’—ও হোঃ? পুলিশ হাসে। সে তো গবর্নরের অন্য তাঁবু। গবর্নর সাহেব ওখানেই এসে ওঠেন। এখানে গবর্নর নেই—অন্যান্য সরকারী লোকেরা আছেন। এটা নামেই গবর্নরের তাঁবু। সেই অন্যখানেই ট্যুরিস্ট ব্যুরো এবং প্রেস—কিন্তু সে সব বহু দূরে। দুনম্বর, এক নম্বর, সবকটা সেতু পার হয়ে সেই বাঁধের ওপারে গেলে এই জায়গা খুঁজে পাবেন। এগিয়ে যান, সামনের পুলিশকে জিজ্ঞেস করুন। এদিকে নামে সন্ধ্যা তন্দ্রালসা, গঙ্গাদ্বীপের আকাশে ঘনিয়ে আসছে মৌনী অমাবস্যার আঁধার। শার্দূল সিং একটু চঞ্চল হয়ে পড়েছেন। তাই দেখে আমি অন্য প্রশ্ন করি—’পুলিশজি, আনন্দময়ী মাতাজির আশ্রম কোথায় জানেন?’—’কওন মাতাজি? ইধরতো বহোৎ সারে মাতাজি আয়ে হেঁ!’ দূরছাই আনন্দময়ী মায়ের নামই যে জানে না, এ অপদার্থ পুলিশকে কিছু জিজ্ঞেস করে কাজ নেই-এমনি একটা ভাব করে শার্দূল সিং গটগট করে মিলিটারি পদক্ষেপে হঠাৎ অনেকটা এগিয়ে গেলেন। এমনি সময়ে : আঃ! কাহারে হেরিলাম। একি স্বপ্ন, একি মায়া। ডানদিকে একটি চায়ের স্টল। লোকজনেরা দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে। অমনি আমার বুকের মধ্যে চা-স্পৃহ চঞ্চল চাতকটি চা-চা-চা নেচে উঠল। পা দুটি আপনি আপনি থেমেছে, যেন শকুন্তলার বল্কলে অদৃশ্য কণ্টক বিধল নাকি শিবমুগ্ধা পার্বতী? চা-চমৎকৃতা নবনীতা ন যযৌ ন তস্থৌ! নেশা বলে কথা। এতক্ষণ চলার নেশায় চলেছি। সেই বেলা তিনটে থেকে হাঁটছি তো হাঁটছিই। এখন ছটা বেজে গেছে। চায়ের কথা মনেই পড়েনি। এতক্ষণ কেবল মুখ দেখেছি। চারদিকে মুখের ভিড়ের মধ্যে একটিও চেনামুখ নেই। প্রত্যেকটি মুখের দিকে যত্ন করে চেয়ে দেখেছি যদি একটিও চেনা মুখ চোখে পড়ে যায়? কী না ঘটে এই বিচিত্র ভুবনে? সে এক অন্য তৃষ্ণায় পথ চলতে চলতে চায়ের তেষ্টা ভুলে ছিলুম। হঠাৎ সামনে চা দেখতে পেয়েই চাতকিনী। চেনা নেশার মুখ অচেনামুখের নেশা ভুলিয়ে দিয়েছে মুহূর্তেই!
কিন্তু হলে কি হবে। হা শার্দূল সিংহ! তিনি ওদিকে বালিতে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে টুকটুক করে অনেকদূর এগিয়ে গেছেন। মিলিটারি-সাধুর ডিসিপ্লিন সে বড়ো ভয়ংকর শৃঙ্খলা! তিনি চা খান না। একেই শার্দূল, তায় সিংহ, তদুপরি সাত্ত্বিক! কী কম্বিনেশন! সে বড়ো ভয়ানক জীব। আরও দাঁড়ালে এবারে হারিয়ে যাব। চা চুলোয় যাউক, নিম্নে উতলা ধরণীতল, ঘাস বিচালি, ঘাস, বিচালি, ঘাস। ফরোয়ার্ড মার্চ শুরু করে দিই। বাচ্চারাও এগিয়ে গিয়েছে। চটিজুতো আর কিটব্যাগ হাতে, পায়ে ডবল মোজা, আমি থুপথুপিয়ে ঠাণ্ডা বালিতে অনেকক্ষণ হাঁটছি। পা জমে হিম বরফ। এবার চটি জোড়া ঝেড়েঝুড়ে পায়ে দিই। এদিকে রাস্তাটা খানিকটা বাঁধান মতন, পায়ের নিচে একটা ভারসহ কাঠিন্যের আরাম অনুভব করছি। বালির অতল নরম প্রশ্রয় নেই। আহ্। জুতোয় ঢুকে বেচারা পাদুখানি যেন মায়ের কোলের উষ্ণ আরাম পেয়ে যায়। সত্যি, কত অল্পতেই শরীর আমাদের সুখী করে। মন কিন্তু অত অল্পে ভরে না। চা হল না, কেবল চলাই হল। ক্রমশ চায়ের স্টলটি পিছনে স্টিল ফোটোগ্রাফের অঙ্গ হয়ে গেল। তারপর মুছে গেল ভিড়ে, সন্ধ্যায়, আর দূরত্বে। আবার পথের নেশায় চোখ উচাটন, পা সামনে টানছে। পথের শেষ কোথায়?
শার্দুল সিং এবার নিজেই পুলিশদের জিজ্ঞেসপাতি করছেন। অন্ধকার নেমে আসছে, দুপাশের ল্যাম্পপোস্টে আলো জ্বলে উঠেছে। বিজলী বাতির ব্যবস্থা সুপ্রচুর। নাঃ, এত আলোয় মৌনী অমাবস্যা টেরও পাওয়া যাবে না।
গবর্নর-পরিত্যক্ত ‘গবর্নরের তাঁবুর কাছে ওই একটি সবেধন পুলিশই কিছু কিছু তবু খবর রাখত। বাকী পুলিশেরা প্রায় সকলেই একবাক্যে বলতে লাগল—আমরা তো এলাহাবাদের পুলিশ নই বাছা, বাইরে থেকে সদ্য এসেছি, এখানকার পথঘাট কিছুই জানি না, আমরা অন্যপাড়ার ছেলে বেপাড়ায় খেলতে এসেছি, আমরা ট্রাফিক সামলাতে পারি-রাস্তা বাতলাতে পারি না। ইতিমধ্যে মাইকের ঘোষণার আরেক চরিত্র উদ্ঘাটিত হয়েছে, সন্ন্যাসী ঘোষণার পাশাপাশি পুলিশী ঘোষণা। মাঝে মাঝেই দোতলা উঁচু মাচা বেঁধে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে, দূরদৃষ্টির সুবিধার জন্য। সেখানেও মাইক আছে। পুলিশরা প্রায়ই হেঁকে বলছেন—মুন্নিকা মা, গাঁও হর-কি-দুয়ার, জিলা দারভাংগা, বিহার। আপকো পতি জানকীলাল ইধর খড়ে হ্যায়, পুলিশ থানে পর আ জাইয়ে…নইনা দেবী, গাঁও দুধপুর বিকানের আপকো লড়কা যোধমল সিং…এসব শব্দ কানে ঢুকেও ঢুকছে না। ঘটনাগুলো শব্দমাত্র হয়ে রয়েছে। পথে একটি খোকা-সন্ন্যাসী হঠাৎ পিছু নিল। সঙ্গে সঙ্গে এসে ভীষণ জ্বালাতে লাগল–’এক রূপাইয়া দে দো বেটি, লাকড়িকো লিয়ে’—কী? নিজের গোঁফ ওঠেনি, আমাকে কিনা বেটি বলা? এই সেদিন কলকাতার রাস্তায় এক বাঙালী ট্যাক্সিওয়ালার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল, যে যার গাড়ি থেকে মুখ ঝুঁকিয়ে। ছোকরা অতি বেপরোয়া কাঁচা চালায়, আবার মুখটিও কাঁচা। আমি তাকে ‘মশায়ের কদ্দিনের লাইসেন্স?’ বলতে, সে বলল—পাঁচবছর। আপনার বুঝি এখনও হয়নি?’ আমি প্রায় নাবালক বয়েস থেকেই লাইসেন্সড্ ড্রাইভার। সগৌরবে যেই বলেছি—’পাঁচ? আমার সতেরো’–অমনি সেই ছোকরা অট্টহাস্য করে উঠল—’সতেরো বছর? সতেরো তো আপনার বয়েসই হয়নি।’ শুনে রাগে আমি বাক্যহারা কান ঝঝন হয়ে ক্ষেপে গেলুম, মিথ্যেবাদী বলা! আর সেই ফাঁকে হাস্যবদনে শাঁ করে বেরিয়ে গেল সে। এই খোকা-সন্ন্যাসির ‘বেটি’-ডাক শুনে সেই কথাটা মনে পড়ে গেল। যত পাকা বিচ্ছু ছেলে। ‘লাকড়িসে ক্যা হোগা?’ টাকা বের করে দিয়ে প্রশ্ন করি। একগাল হেসে খোকা বলে কাঠ কিনবে, ধুনি জ্বালাবে। শীত করছে। খোকা-সন্ন্যাসীর এই শীতেও গা খালি।
ভীষণ ক্লান্ত পা, পিঠ যেন আর পিঠে থাকতে চাইছে না, হাতের জিনিসের ওজন ক্রমশ বেড়েই উঠেছে, অন্ধকারে তাঁবুগুলোর রং দ্রুত পালটে যাচ্ছে, এমন সময়ে অনেক গাঁদা ফুলের মালায় সাজান সিংহাসনের পালকিতে চড়ে একজন সাধুমহারাজ পথ দিয়ে গেলেন—সঙ্গে দলে দলে শিষ্য, পতাকা-টতাকা। উড়ছে—ভিড়ের কাছে শুধিয়ে শুনলুম উনি নাকি একজন শংকরাচার্য। বাঃ, কী পুণ্য। শংকরাচার্য দর্শন। ভিড়কে আবার শুধোই—আনন্দময়ী মায়ের আশ্রম কোথায় কেউ জানেন? না। কেউ না। নিজেরা আর কথা বলছি না। না শার্দূল সিং, না আমি। শুধু হাঁটছি, থামছি, প্রশ্ন করছি, হাঁটছি। কেউ জানে না। কেউ জানে না। আমরা কোথায় যাচ্ছি কে তা জানে, অন্ধকারে দেখা যায় না ভালো? এমন সময় হারে রেরে রে রে, চলার পথ কে যেন আটকালো? চলতি মানুষেরা দাঁড়িয়ে পড়লেন, ছড়িয়ে পড়লেন। আমাদের সামনে একজন নগ্ন সাধু দু’হাত ছড়িয়ে দাঁড়ালেন। তাঁর ছড়ানো হাত ধরে দু’হাত প্রসারিত করে আরও কয়েকজন নগ্ন সাধু। কী ব্যাপার? এখন রাস্তা বন্ধ। কেন? ডানদিকের তাঁবু থেকে এখুনি একদল নাগা সন্ন্যাসী শোভাযাত্রা করে বেরুবেন, অন্য এক আখড়ায় যাবার জন্য। তাঁরা চলে না যাওয়া পর্যন্ত একটু অপেক্ষা করতে হবে। আমরা দাঁড়িয়েই রইলুম। নাগা সন্ন্যাসীর চিহ্ন নেই। গোঙা-লালার মাথা থেকে মালপত্র নামিয়ে মাটিতে রাখলুম। যেখানটায় দাঁড়িয়েছি ঠিক সেখানেই আবার খানিকটা জলকাদা জমে আছে। অথচ নড়বার উপায় নেই। ফুটপাথ অপেক্ষমান মানুষে মানুষে ঠাসা, পূর্ণ অবরুদ্ধ, যাকে বলে ‘জ্যাম-ধরা অবস্থা’। হঠাৎ জনস্রোতের মুখে পাথর চাপা পড়ল, অথচ স্রোত উথলে উঠল না, কেবল ঘন থেকে ঘনতর হয়ে জমে উঠতে লাগল পরস্পর সংলগ্ন মনুষ্য শরীর। ধৈর্যের এক আশ্চর্য পরীক্ষা দেখেছি সেদিন গঙ্গাদ্বীপে। গোঙাটা এরই মধ্যে কোথায় পালাল। লালা বলল ভয় নেই, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেছে এখুনি আসবে। ভাগ্যিস গোঙা তখনই এসে পড়ল—নইলে সে সন্ধ্যায় ওকে আর আমরা খুঁজে পেতুম কিনা কে জানে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভিড়ের চাপ অসম্ভব বেড়ে উঠল। দাঁড়িয়ে থাকতে যেন দিচ্ছে না। অথচ একবার পা পড়ে গেলে আর রক্ষে থাকবে না। যেমন করে হোক, মাটিতে পা গেঁথেও খাড়া থাকা চাইই? শার্দূল সিংহের জন্যে খুব উদ্বেগ হতে লাগল। সারাদিন অভুক্ত বৃদ্ধ এতক্ষণ হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত, তার গন্তব্যের কোনও নির্দেশ পর্যন্ত এখনও যোগাড় হয়নি। তার ওপরে এই অমানুষিক ভিড়। চাপে দম আটকে আসছে। অত শীতের মধ্যেও ভিড়ের নিষ্পেষণে ঘাম হবার মতো অবস্থা।
সামনে দিয়ে ইতিমধ্যে নাগা সাধুদের শোভাযাত্রা শুরু হয়েছে। একি! এরা তো বালক মাত্র! আপাদমস্তক সর্বাঙ্গ মুণ্ডিত, সামনে ছোট্ট কৌপীন ডুমুরপাতার মতন করে পরা, হাতে ছোটো একটা লাঠি না গাছের ডাল, ঠিক ঠাহর পেলাম না, আর একটু করে কাপড়ও, বৈষ্ণব চেহারার বালক, কিশোরের দল চলেছে। চলেছে তো চলেইছে। শেষদিকে আসতে লাগল নাগাদের অন্য এক সম্প্রদায়—এটা বয়স্কদের দল-দাড়ি গোঁফের ঝোপজঙ্গল, পূর্ণ উলঙ্গ, হাতে ত্রিশূল—অনেকের গলায় বুকে রুদ্রাক্ষের মালার সঙ্গে গাঁদাফুলের মালাও শোভা পাচ্ছে। এই নগ্ন বৈরাগ্যেও কী একটা ভীষণ রুদ্রতা আছে—মা কালীকে মনে পড়ে যায়।
পিছনে ভিড়ের চাপ বাড়ছে। সেই চাপের বিরুদ্ধে অটল থাকার জন্য পেশির যুদ্ধে দম আটকে আসছে। এরই মধ্যে আমার একটা বাড়তি যন্ত্রণা জুটেছে। ভিড়ের সুযোগে একটি নগ্ন নির্জন হাত উপরি কিছু নগদ পুণ্যের লোভে যারপরনাই উত্ত্যক্ত করছে। এত ভিড়, উপায় নেই যে পিছন ফিরে পুণ্যার্থীটিকে দেখব। উড়ে আসা আরশোলা গা থেকে ঝেড়ে ফেলার মতো নোংরা হাতটাকে বার কয়েক ঝেড়ে ফেলে দিয়েছি—কিন্তু আমার নিরুপায়, আত্মরক্ষায় অপারগ অবস্থা, এবং সম্ভবত নাগাদের নগ্নতাও তাকে ভীরুতার দুঃসাহস যোগাচ্ছে। ঐ হাতের সঙ্গে শুরু হয়েছে আমার স্নায়ুর যুদ্ধ। প্রবল রাম-চিমটি কেটেও দেখলুম ফল হল না। কী করি? বাচ্চা দুটো প্রসেশন দেখছে একমনে, পরিশ্রান্ত শার্দূল সিং তাঁর বেডিঙের ওপরে বসে পড়েছেন। চক্ষু নিমীলিত। আমি এবার খপ্ করে হাতটি চেপে ধরলুম। তারপর গলা একেবারে উঁচু না করেও স্পষ্ট শ্রোতব্যস্বরে ইংরিজি ভাষায় বললুম–’যদি এবার চেঁচিয়ে উঠি, আপনি কিন্তু খুন হয়ে যাবেন। এই ভিড় আপনাকে এখুনি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলবে।’ বলে হাতটা ছেড়ে দিলুম। ইংরিজিতে বললুম কেননা আমার কেমন মনে হল এই কুৎসিত লোভাতুরতা নির্ঘাত আমাদের ‘শিক্ষিত মধ্যবিত্ত’ লক্ষণ। মক্ড হবার ভীতি প্রদর্শনে দিব্যি কাজ হল। হাতের মালিক সংবৃত হলেন। কথাটা যথাসাধ্য গলা চেপে বললেও ভিড় এত ঘন, যে এপাশ-ওপাশের দু’চারজন শুনেছেন। ওপাশে একটি মহিলা হিন্দীতে ‘জানওয়ার’ জাতের শব্দ করলেন। সহানুভূতি পাইয়াই হৃদয় দ্রবীভূত হইল, আমি আরও সহানুভূতির প্রত্যাশী হয়ে গদ্গদচিত্তে একটা বেমওকা প্রশ্ন করে বসি—’বেহেনজী আপ আনন্দময়ী মাতাজীকো আশ্রম জানতে হেঁ? জানি অবশ্য উত্তরটা কী হবে। তবুও। আমার ভালোবাসার ভাষাই এখন এবম্বিধ হয়ে দাঁড়িয়েছে।—’ট্যুরিস্ট ব্যূরো?/কিংবা প্রেস/অথবা আনন্দময়ী?’ প্রশ্নটা শুনে শার্দূল সিং চোখ মেললেন—সে চোখে এখন হালছাড়া উদাস দৃষ্টি। উত্তরটা তাঁরও জানা।
বেহেনজী বললেন—’আনন্দময়ী মাতাজী? হাঁ, হাঁ, জরুর। ম্যায়ভি উধরহী জা রহীহুঁ।—সখি! কেবা শুনাইল শ্যামনাম! শার্দূল সিংহের দিকে দেখলুম—উনি শুনতে পাননি। আবার চোখ বুজেছেন।–অনেক সাধায়ে অনেক কাঁদায়ে দরশ মিলালি মোরে। বঁধু আর না ছাড়িব তোরে।—’বেহেনজী!’ আমি কাতর আর্তনাদ করি—’আপ হমলোগোঁকো ছোড়কে মত জাইয়েগা। হম তিন বজে-সে ছুঁড় ছুঁড় কে থক গয়ে হেঁ। আশ্রম নহী মিলা।’ একমুখ হেসে বেহেনজী বললেন—’জরুর। আপনি আমার সঙ্গে সঙ্গে আসুন। আগে নাগারা দূর হয়ে যাক।’ আমি এবার চেঁচিয়ে ডাকি—’বাবা, বাবা? উঠুন। দেখুন, ইনি আশ্রম চেনেন—ইনি ও আনন্দময়ীর কাছেই যাচ্ছেন। আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন।’ প্রায় লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন বৃদ্ধ শার্দুল। আকর্ণ-টুপি হাসি ফুটল, মৌনী অমাবস্যার অন্ধকার তাড়িয়ে দিয়ে।
–’রিয়্যালি! হাউ মার্ভেলাস! আই ওয়াজ জাস্ট বিগিনিং টু ডেস্পেয়্যার।’
-’ঈশ্বরই আপনাকে গুরুর কাছে নিয়ে যাবার জন্য পথপ্রদর্শিকা পাঠিয়ে দিয়েছেন, আপনি তো মহাপুণ্যবান বাবা। হোয়াই শুড য়ু ডেপেয়্যার?’
একমুহূর্তেই এই প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মানুষের অরণ্যে সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনীভূত হতে দেখার পরম ক্লান্তি অপনোদিত হল, মুছে গেল ভিড়ের চাপ, শার্দূল সিং হাতে কিটব্যাগটা তুলে নিলেন। এবং আমিও যথারীতি সেটি ছিনিয়ে নিলুম। কিছুক্ষণের মধ্যেই কপালজোরে নাগারাও অন্তর্হিত হলেন। কোনো এক বিশাল প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর নিদ্রাভঙ্গের মতো স্তব্ধ ভিড় এবার নড়ে উঠল। আমি শক্ত করে বেহেনজীর আঁচল চেপে ধরি। শার্দূল সিং চেঁচিয়ে ওঠেন-’সাবধান। এই সময়টাই সবচেয়ে ভয়ের।’ লালা-গোঙা যথাসাধ্য শক্ত হয়ে মাটিতে পা বিধিয়ে গতিশীল ভিড়ের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ক্রমশ ভিড় ছিটকে যায় পথে, চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েন স্থগিত তীর্থযাত্রীরা। বেহেনজী হাঁটা শুরু করেন। দূরে হঠাৎ একটা আলোর তৈরি লেখা চোখে পড়ে অন্ধকার আকাশের গায়ে বেশ অনেকটা উঁচুতে—’গঙ্গে তব প্রসাদাৎ মুক্তি।’ মনের মধ্যে একটা বাজনা বেজে উঠল যেন; এই তো প্রয়াগধাম তীর্থরাজ। কুম্ভমেলা বিষয়ে ওখানে আরও একটা আলোয় লেখা শ্লোকাংশ জ্বলছিল—যার শেষ শব্দ ‘প্রয়াগঃ’ কিন্তু আমার আর এখন সেটা মনে নেই। লেখাগুলো দেখে চোখে জল এসে গেল আমার। এসেছি? এসেছি তবে? ছুটতে ছুটতে হাঁটছি বেহেনজীর পিছনে পিছনে—খুব দ্রুত পায়ে চলেন তিনি। তাই বলে ওঁকে হারিয়ে ফেললে চলবে না কিছুতেই। পায়ের ক্লান্তি কখন ঘুচে গেছে…হাতের বোঝাগুলি যেন ভারহীন—আমাদের পায়ে—এখন যে সেই বিশ্ববীণার ছন্দটি এসে গিয়েছে—যে নাচের ছন্দে বিপুল বস্তুর ভারও হালকা হয়ে যায়—’ বুকের মধ্যে গুনগুনিয়ে উঠতে লাগল সুর—ভাঙা বেসুরো গলাকে আর বাধা দিতে পারলুম না—’তুমি যত ভার দিয়েছ সে-ভার করিয়া দিয়েছ সোজা’—কী আনন্দ কী আনন্দ কী আনন্দ…এখানে চলার জায়গাও বিস্তৃত, ভিড়ের চাপ নেই। এমন সময়ে একজন বাঙালী মহিলা, তাঁর সঙ্গে আরও প্রায় ৫-৬ জন যাত্রী হাঁপাতে হাঁপাতে এসে আমাকেই জিজ্ঞাসা করলেন—’আচ্ছা, আনন্দময়ী মায়ের তাঁবুটা…’ মনের ভেতরের মস্ত একটা হাসি আছড়ে পড়ল। হ্যাঁ এবারে স্ট্রাকচারটা সম্পূর্ণ হল বটে। ফাঁকা ডানহাতটা তাঁর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে আত্মস্থ গলায় বলি—’হ্যাঁ, আমরা ওখানেই যাচ্ছি, আমাদের সঙ্গে আসুন আপনি…।’