উদ্যোগ পর্ব
‘এ্যাঁ? তুমিও কুম্ভে? কী কাণ্ড! তবে যে কাকীমা বললেন তুই হায়দ্রাবাদে সেমিনারে গেছিস, ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশন না কী সব নিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিস?’ এই দেড়দিন ফিরে অবধি অন্তত বিশবার এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। মা বেচারীকে একটু ফল্স পজিশনে ফেলা হয়ে গেছে সত্যিই! ঠিকঠাক করে তো আর যাইনি, যে বলে-কয়ে গুছিয়ে-গাছিয়ে যাব? কাঁচুমাচু গলায় বলি, ‘হ্যাঁ, ঐ হায়দ্রাবাদের সেমিনারটা থেকেই ফেরবার পথে অমনি বড্ড ইচ্ছে হল, তাই টুক করে একটু কুম্ভমেলাতে’—বলেই শেষ হয়ে গেছি! ‘ইচ্ছে হল অমনি টুক করে কুম্ভমেলায় একটু? বলি ঘরে ফেরবার সিধে পথ কি এঁটে? কবে থেকে হায়দ্রাবাদের পথে এলাহাবাদটা পড়েছে? কাকীমা এদিকে ভেবে ভেবে অস্থির…ছি ছি ছি’…দূর ছাই! কৈফিয়ত দিতে দিতে মাথা খারাপ হয়ে গেল। তাও তো এখনও কর্মস্থলে মুখপ্রদর্শন করিনি। সেখানে আরেক দফা রিপিট-প্রোগ্রাম হবে। গেছি তো গেছি। বেশ করেছি। তোমাদের তাতে কি? পাপকার্যে নিরত তো হইনি। গেছি পুণ্যকর্মেই। তাতেও এত কথা? কোথায় তীর্থ করে এলাম আমাকে যত্ন করে পা ধুইয়ে দেবার কথা, তা নয়, ফিরে অবধি আপাদমস্তক আড়ং ধোলাই চলছে। এর চেয়ে বাপু পাপটাপ করা অনেক সোজা হতো। প্রথমত, লোকে জানতেও পারত না। দ্বিতীয়ত, যদি বা জেনে ফেলত কেউ কৈফিয়ত চাইতো না, কেননা ওটা সবাই বোঝে। ওতে লোকে অবাক হয় না, ওটা মনুষ্যধর্ম, এক্সপেকটেড্ অ্যাকশন। কিন্তু হঠাৎ পুণ্য? না বলে-কয়ে? এত বড়ো আস্পর্ধা। কই ছেলেদের বেলায় তো কেউ কিছু প্রশ্ন তোলে না? এই যে পড়ি। নীললোহিতবাবু যত্র-তত্র ঘুরে বেড়ান, তাঁকে কি বাড়ির বড়োরা কেউ কিছু বলে? শুধু আমার বেলাতেই—? নেহাত মেয়ে বলেই এত কথা? রেগে-মেগে চুপ করে থাকি।-’তা হঠাৎ কুম্ভে যে? ভালো দল পেয়ে গেলি বুঝি হঠাৎ?’—দল! ‘দল পাব কোথায়?’—‘তার মানে? তুই-তুই…এ্যাঁ? বলিস কি? একা একাই…?’ বড়দার বাক্যি লোপ হয়ে গেল। আর তাই দেখে আমার ধড়ে প্রাণ সঞ্চার হল।-’নয়তো কি, দোকা পাব কোত্থেকে?’—’এই মরণ ভিড়ে, বিনা ব্যবস্থায়, এক কোটি মানুষের মধ্যে একদম একলাটি…হ্যাঁ রে খুকু, তুই কি পাগল?’ পাগল আমি কেন হব? যে বলে এককোটি মানুষের মধ্যে একদম একলাটি পাগল তো সে-ই! না, উইমেন্স লিব-টিব এদেশে অদ্যাপি দূর অস্ত! যদিও, শিক্ষিত মেয়েদের একা ভ্রমণের পক্ষে এত নিরাপদ, এত সুসভ্য সমাজ আমাদের এই গরিব দেশটির তুলনায় পৃথিবীতে আর একটাও আছে কিনা জানি না। অবিশ্যি আমার নিজের কথা দিয়ে বিচার করা হয়তো খুব ঠিক নয়, কেননা আমি সর্বত্রগামী, মুক্তকচ্ছ জীববিশেষ। সেই জন্মাবার সময় যা ‘হিন্দু ফিমেল ছিলাম, আবার মরবার পরে হব। ইতিমধ্যে আমি হিন্দুও নই, ফিমেলও নই, ধর্মভীরু ভারতীয় মাত্র। অর্থাৎ মুক্তপ্রাণী। আমাকে ডাকে হরি তো রাখে কে?
গল্পটা গোড়া থেকেই বলা যাক।
সেমিনারে-টেমিনারে বক্তৃতা দিতে যাওয়া মানেই আরেক হাতা পাপ আঁচলের কোণে বেঁধে আনা। অথচ এ ক্ষেত্রে ঘটল উল্টোটাই। কোত্থেকে কি হয়ে গেল। সেদিনটা ছিল পৌষসংক্রান্তি, ১৪ জানুয়ারি। আমাকে হায়দ্রাবাদ যেতে হবে, বিকেলে প্লেন ধরার বেদম তাড়া, তার আগে টুকিটাকি একশোটা কাজ শেষ করতে হবে, ব্যাংক, রেশন, মেয়েদের নতুন ক্লাসের বইখাতা, মার ডাক্তার ওষুধ তদুপরি একটা ডিপার্টমেন্টাল মিটিং আছে ১-৪০ এ…এবং পেপারটা যথারীতি টাইপিং অসমাপ্ত। এরই মধ্যে বেলা দশটায় গলায় কম্ফর্টার, পায়ে বুট জুতো, পরনে ধুতির ওপর কোট, এক মাঝবয়েসী ভদ্রলোক এলেন, আমার সঙ্গে—’সাহিত্য বিষয়ে আলাপ আলোচনায় সময় কাটাবার উদ্দেশ্যে।’ গ্রামাঞ্চল থেকে কষ্ট করে আমার বাড়িতে এসেছেন, আমার মহাসৌভাগ্য, কিন্তু সময় যে সত্যিই নেই? অতএব বলি ‘আজ বরং আলাপটুকুই থাকুক, আমি ফিরে এলে পরে আলোচনাটা হবে এখন আরেকদিন?’ তিনি বললেন—’যাচ্ছেন কোথায়? কুম্ভে বুঝি? হ্যাঁ, মৌনী অমাবস্যে তো এসে পড়ল। উনিশে। সেই পড়ে গেল মগজের মধ্যে টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্সের বিপুল ঘণ্টায় ঘা…ঢং ঢং করে তার প্রতিধ্বনি বাজতেই লাগল স্নায়ুতন্ত্রে। ভদ্রলোক যেন দৈববাণী করলেন। আরে? সত্যিই তো। কোথায় যাচ্ছি? কোথায় যাচ্ছি আমি? কুন্তে কেন নয়? এক যুগ পেরিয়ে যে পূর্ণকুম্ভের মহাযোগ হয় আমি তো ছুটি নিয়ে ১৭ই অবধি বাইরে থাকছিই, ১৮ই না ফিরে ২০শে ফেরা যায় না? কেন যাবে না? পথে কুম্ভ নাইবা পড়ল-পথ তো কেটে নিলেই পথ, পথ খুঁজে নিলেই পথ। মাকে বলতেই মা বললেন, ‘যাবি না কেন, যা না, তবে একা যেতে দেবো না।’ কি মুশকিল। এখন সঙ্গী পাই কোথায়? তার সময় কই? আজই যে বেরুচ্ছি তিনটের সময়ে। তখন মা বললেন আমার এক কাকাবাবুর কথা। যদি খুড়িমার কাছে এলাহাবাদে রাত্রিবাসের ব্যবস্থা হয়, তবেই আমাকে একা যেতে দেবেন। কাকাবাবু জানালেন তিনি অসহায় ঠাই নাই ঠাই নাই ছোটো সে বাড়ি ভি. আই. পি. যাত্রীতে গিয়াছে ভরি! অবশ্য আমি একটা ফরম্যাল লিখিত আবেদনপত্র পাঠিয়ে দেখতে পারি। হায় রে পিতা-পিতৃব্যের অক্ষম স্নেহ! হায় আমাদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র গৃহস্থালি। একরাত্রির জন্যও যেখানে আমরা স্নেহাস্পদ লঘুজনের ঠাঁই করে দিতে পারি না! অবশ্য আমার যে অতিদূর ভবিষ্যতেও কদাচ ভি. আই. পি. হবার সম্ভাবনা নেই, তা এতই স্পষ্ট, যে এ নিয়ে আমি কাউকে সত্যি দোষ দিতে পারি না। মা ভয় পেয়ে বললেন—‘হল না? সে কিরে? তবে দ্যাখ যদি কোনো প্রেস-ট্রেস থেকে অফিসিয়াল একটা সিকিওরিটি যোগাড় করতে পারিস।’—দেখলাম দু’চার জায়গায় ফোনটোন করে। এ সময়ে বলা মানেই শুভার্থীদের বিব্রত করা—ওসবের জন্য প্রস্তুতিপর্ব লাগে। প্রেসকার্ড কি ছেলের হাতের মোয়া? সবাই সাহায্যে প্রস্তুত, ঘোঁতঘাত অনেক বলে দিলেন, কিন্তু আমারই কেমন লজ্জা করল দ্বারস্থ হতে। যাদের সুখে-দুঃখে গিয়ে দাঁড়াই না, প্রয়োজনে কেমন করে বলি? যাগে যেতে হলে একলাই যাব। সেই তো ভালো। অবশ্য মাকে এক্ষুনি সেটা বলা চলবে না, ভয় তো পেয়েই আছেন সর্বদা! মায়েরা তো গুরুজন না, ভীরুজন।
এই সব করতে গিয়ে হুড়মুড়িয়ে সময় পালালো। সবগুলো কাজ নষ্ট হল, একে ওকে তাকে বকেয়া কাজকর্মগুলোর ভার বিলি করে দিয়ে তিনটের সময় রওনা হলুম দমদমে—সুটকেস রইল হায়দ্রাবাদের জন্য গোছানো, মন রইল কুম্ভস্নানের জন্য বদ্ধপরিকর। কিন্তু তার জন্যে যে কাপড়গামছা লাগে,. গঙ্গাদ্বীপে যে ভীষণ ঠাণ্ডা, মেলায় যে ভীষণ ধুলো-ময়লা, এসব কিছুই মনে পড়ল না। আমার মনের ভিতর তখন একটা খোলা বাতাস বইছে—অনেক দূরের বাতাসে সব বন্ধ দরজাগুলো আপনা থেকে খুলে যায়। আর অমনিতে মাথার মধ্যে খোলা—জানালাগুলো সব বুজে যায়।
ট্যাক্সি ছাড়ছে, মা তখনও বলছেন—’খুকু, পাগলামি করবি না বাবা, একে তোর অ্যালার্জির ধাত, মেলাটেলায় ভয়ংকর ধুলো (আসলে আমার দারুণ হাঁপানি, মা বলেন অ্যালার্জি) তায় এই ব্রঙ্কাইটিস থেকে উঠলি—বাঁ পাটা সিঁড়ি দিয়ে পড়ে গিয়ে মচকে ফুলে রয়েছে—প্রেসারটাও হাই—এই অল্পবয়সী মেয়ে, একলা ওই ভয়ংকর ভিড়ের ভিতর যাবার কথা চিন্তাও করো না খবরদার’ …অর্থাৎ সব বয়সের ঝুট ঝামেলা আমি একবয়সেই বাধিয়ে বসেছি। এদিকে বুড়োদের যাবতীয় রোগটোগ, বাত-হাঁপানি-প্রেসার, আবার ওদিকে যৌবন-টৌবন—বেচারী মা একা কতদিক সামলাবেন? তাঁর গুণবতী কন্যেটি যেন সেই মেঘদূতের যক্ষপুরী, যেখানে সব ঋতুর ফুল এক সঙ্গে ফুটেছে। এ কী দুর্দৈব বল দেখি!