স্নান পর্ব

স্নান পর্ব

দুটো বাজল। বাক্স খুলে আরও একটা জরিদার ভয়ংকর কাপড় বের করলুম, সবই হায়দ্রাবাদ লক্ষ্য করে আনা। নিজামের দেশে যা চলত, গঙ্গাদ্বীপে, কুম্ভনগরে কি তাই চলে? উপায় নেই। যা পরে আছি এইটে পরেই আমি স্নান করব সঙ্গমে। একটা কাপড়ের চেয়ে মধ্যরাত্রের এই স্নানটা ঢের বেশী দামী। তোয়ালে নিলুম, ব্যাগ টর্চ নিলুম। মেসোমশাই মনে করিয়ে দিলেন, জলপাত্রটা নিয়ে চল, সঙ্গমের জল ভরে নেবে। পাত্রে ফোটানো জল কিছু অবশিষ্ট ছিল। এতক্ষণ কুম্ভের জলটা খেতে হয়নি। ফেলে দেব? ফোটানো জল ফেলে দিয়ে সঙ্গমে জীবাণু থিকথিকে ভয়াবহ পুণ্যবারি ভরে নেব? ওটা তো খাওয়া যাবে না! মেসোমশাই বললেন,—’কুম্ভের এই পুণ্যলগ্নর জল কলকাতায় গিয়ে ছেলেমেয়েদের মাথায় দেবে, মাকে দেবে।—’ ঠিক হ্যায়। বোতল সঙ্গে চলল। ইতিমধ্যে একটা ভীষণ গোলমাল হল—দাদা এসে বললেন সব মালপত্র সঙ্গে নিয়েই স্নানে যেতে হবে। কারণ সঙ্গম থেকে হয়তো তাঁবুতে ফিরতে পারব না, পথটা ঘুরিয়ে ডিট্যুর করে সোজা শহরে পাঠিয়ে দিতে পারে। তখন মালের কী হবে? হায় মাল! হায়রে ভক্তের মাল! তোমাকে বইবার কথা ভগবানের। এখন যে যার মালের বোঝা মাথায় তোলো, আপনা হাথ জগন্নাথ—তুলে হাঁটো সবাই স্নানের ঘাটের দিকে। প্রসঙ্গত, দাদা মনে করিয়ে দিলেন—সেই ইলশেগুঁড়ি এখন দিব্যি রুই কাৎলা হয়েছে। বৃষ্টিতে ভেজা আছে কপালে। তাঁবুর জনগণ, যাকে বলে আমজনতা, মালবহন বিষয়ে গুনগুনিয়ে প্রতিবাদ করলেও, দেখলুম দলপতির নির্দেশের বিরুদ্ধে ‘সোচ্চার’ হল না, প্রায় সৈনিকসুলভ শৃঙ্খলার সঙ্গে যে-যার মাল নিয়ে উঠে পড়ল, মেসোমশাই এবং আমি ছাড়া। একটি হাসিখুশি ষোল সতেরো বছরের হিন্দুস্থানী ছেলে কোত্থেকে এসে পড়ল, ভিখু তার নাম—মেসোমশায়ের কিটব্যাগ কাম-বিছানা সেই ঘাড়ে নিয়ে নিলে। এবং আমার সুটকেসও। ভক্তের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে ভিখুই এখন ভগবানের ভূমিকায়। ব্রিফকেসটা বুদ্ধি করে সুটকেসে ভরেছি, কাগজপত্র ভিজে যাবার ভয়ে। কিন্তু লোটা-কম্বল কাঁধে আছে, এক বগলে স্নানের পুঁটলি, অন্য বগলে অহং-থলিকা, তদুপরি কোঁচা, আঁচল, শাল—তামাম দুনিয়া সঙ্গে নিয়ে আমি বেজায় জট পাকাচ্ছি। তাঁবু থেকে বেরিয়ে বৃষ্টিতে কয়েক পা যেতেই দেখা গেল কেবল অহং-থলিকা ছাড়া আমার কাছে আর কিছু নেই। স্নানের পুঁটলি পর্যন্ত উধাও। উদার এবং করুণাময় যাত্রীরা কেউ না কেউ স্বেচ্ছাসেবক হয়ে আমার ভারমোচন করে, ওগুলো নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

–তবু লোকে বলবে একা এসেছি? সঙ্গী নেই? বাইরে এসে আরও খানিকক্ষণ অপেক্ষা করার পরেই গেরুয়াপরা এক মহারাজ এসে দাঁড়ালেন, তাঁর সঙ্গে মস্ত একদল যাত্রী। যাত্রীরা রাস্তা পার হয়ে চলতে লাগল। আমিও ওঁদের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটি। এমন সময়ে দেখি ও-ফুটপাথ থেকে একটি ছেলে ছুটতে ছুটতে আসছে—’দিদি! কোথায় যাচ্ছেন? ওরা তো আমাদের গ্রুপ নয়!’ সেকি! আমি লজ্জায় মাথাটি হেট করে ফিরে এলুম।

-’আমাদের সঙ্গে তো কানাই মহারাজ যাবেন। হাতে মস্ত ত্রিশূল থাকবে।’

ভিখু তো হেসেই কুটিপাটি!—’দিদিকা সুটকেস হমকো মিল গয়া থা। ‘

একটু পরেই যাত্রা শুরু হল। উন্নতকায়, পরম কান্তিবান্ কানাই মহারাজ এসে দাঁড়ালেন। হাতে বিশাল দীর্ঘ রুপোলি ঝকঝকে ত্রিশূল। পথিকৃতেরই যোগ্য মূর্তি তাঁর। সেই ত্রিশূল শূন্যে উঁচু করে ধরে তিনি বললেন—‘এই ত্রিশূল লক্ষ্য করে করে আপনারা আসবেন। পেছিয়ে পড়বেন না যেন। যদি পড়েনও তবে আবার ত্রিশূল খুঁজে নেবেন। আমি মাঝে মাঝে থেমে দাঁড়াব।’

জয় কুম্ভ! জয় প্রয়াগরাজ! জয় গুরু! হাঁক দিয়ে উঠলেন আমাদের যাত্রীদল। পঞ্চাশজনের জায়গায় একান্নজন, স্নানযাত্রা শুরু হল।

চলতে চলতে চলতে চলতে মনে পড়ল মন্ত্রী দাদা বলে গেছেন—মাত্র মাইল দেড়েক। মাল নিয়ে চলা বলেই দূর লাগছে।

কুম্ভনগরে এসে আগে যা দেখিনি তা এবারে চোখে পড়ল। সেই ছোট ছোট তাঁবু অঞ্চলের পিছন দিয়ে যাবার সময়ে খুবই মুশকিলে পড়লুম। ঠিক রাস্তার ওপরে সারি সারি পুণ্যার্থী মধ্যরাত্রেই প্রাতঃকৃত্য সারতে বসেছেন। পথ চলা দায়। তাঁদের অবিশ্যি লাজলজ্জা নেই, বরং মহা উৎসাহে বড় বড় চোখ মেলে সরল আহ্লাদে তাঁরা আমাদের স্নানযাত্রা পর্যবেক্ষণ করছেন। স্ত্রী, পুরুষ, যুবতী, বৃদ্ধতে কোনও ফারাক নেই। রাস্তায় যাঁরা বসে আছেন, তাঁরা তবু তো দৃশ্যমান! যাঁরা এখন আর বসে নেই, কিন্তু একটু আগেই ছিলেন? তাঁদের এড়িয়ে চলাই আরও বেশি মুশকিল। একেই সকলের হাতে ভারী ভারী মালপত্র, তায় দৃষ্টি দূরে ত্রিশূলের ডগায় নিবদ্ধ। পা বেচারী যে কোথায় পড়ছে–তার ঠিক নেই কিছু। একেই ঐ শীত, তায় সমানে ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি, তবু বাঙালীর রঙ্গরসে কিছুই টান পড়েনি—শ্রীচরণের বিস্ময় নিয়ে নানান মন্তব্য বিচ্ছুরিত হচ্ছে যাত্রীদের মধ্যে। হাসিই উঠছে বিরক্তির চেয়ে বেশি করে। সন্ধ্যাবেলা যখন মোজা পরে হাঁটাছিলুম—সেই কথাটা মনে পড়ল। সে রাস্তায় এ উপদ্রবটি ছিল না, ভাগ্যিস! এখন তবু খড়ম পরে আছি। একেই বলে দেবতাদের মতো ভূমি স্পর্শ না করে হাঁটা। বামুনরা কেন যে খড়ম পরতো, এতদিনে তার গোপন সূত্রটা টের পেলুম! এইজন্যে! এখন রাস্তার চেহারাই বদলে গেছে। দু’দিকে দু’রকমের স্রোত-জনস্রোত। একদল সঙ্গমের অভিমুখে ছুটেছে, অন্যদল সঙ্গম থেকে ছুটে ছুটে ফিরছে। বৃষ্টি দুই দলকেই ছুটিয়ে ছেড়েছে। এই শীতে মেয়েদের গায়ে ভিজে কাপড় জড়ানো, ছেলেদের মধ্যে অনেকেরই পরনে গামছা। খালি পা আমাদের বাঙালী দলেও। অনেক পুরুষ-মানুষের খালি গা খালি পা। পরনে গামছা। অনেকে তার ওপরে কেবল কোটটা জড়িয়ে নিয়েছেন। মেয়েদের শাড়ি শাল দেখে ভেতরের খবর কিছুই টের পেলুম না। আর আমি যে জামাগুলো খুলব, তার তো কোনো জায়গাই পাইনি। জলে নামার আগে, ডাঙাতে শাল আর সোয়েটারগুলো খুলে রাখব জুতো-মোজার সঙ্গে। বাকী যা পরে আছি সবসুদ্ধুই নেমে পড়ব ভেবেছি। যা হবার হবে। বৌদির খালি হাত পা। মাল নেই। তিনি আগে আগে যাচ্ছেন। আমি বৌদির সঙ্গে তাল রাখতে খুব চেষ্টা করছি। বৌদি বললেন, ‘শোনো মেয়ে, আমি একটা কথা বলি। এ-শাড়িটা পাড়ে খুলে রেখে সায়া ব্লাউজ পরেই নেয়ে নিও, কিচ্ছু হবে না, এখানে কেউ কাউকে দেখবে না। পরে ওই ভিজে শাড়ির কী দশা হবে—ক’মণ ওজন হবে ভেবেছ? নেবে কিসে?’ সব বুঝেছি। কিন্তু কী আর করব? বৌদি যা বলার বলুন, আমি যা পারব তাই তো করব? মাঝে মাঝে ‘জয় কুম্ভ’ ধ্বনি ওঠে, মাঝে মাঝে ওঠে ‘মহারাজ! একটু দাঁড়ান’! মাঝে মাঝে ত্রিশূল দেখা যায় না, ত্রিশূল নেমে যায়। অস্থির হয়ে উঠি আমরা। ত্রিশূল কই? ত্রিশূল কই? ধ্বনি জোরাল হলেই দেখি ঠিকরে উঠেছে শূন্যে রুপোর ত্রিশূলের অভয়শীর্ষ। যেতে যেতে একজায়গায় হাঁটা থামল। সবাইকে একটা বাঁশে ঘেরা অঞ্চলের ভেতর ঢুকিয়ে নিয়ে কানাই মহারাজ বললেন—’এইখানে মালপত্র রাখুন। সবাই একসঙ্গে যাবেন না। অর্ধেক থাকুন মাল আগলে। ওই যে ওখানে জোর ফ্লাডলাইট’–ওদিকে তাকিয়ে দেখি ফ্লাডলাইটের নিচেই লাখো লাখো পতঙ্গের মতো মানুষের ছায়ার ছন্দহীন ছুটোছুটি।—’ওইখানে সঙ্গম। আমি ওখানেই থাকব। স্নান করে উঠে ত্রিশূলের কাছে চলে আসবেন। আর এইখানে থাকবেন আমাদের স্বামীজী—দুটে ফ্ল্যাগ হাতে।’—দুটি সবুজ রঙের পতাকা নেড়ে দেখালেন হাসিমুখে এক বৃদ্ধ স্বামীজী।-’হাম্ রহেঙ্গে য়াঁহাপর।’ চমৎকার বন্দোবস্ত। এবারে শুরু কাপড় বদল। আমি শালটা খুলে রাখি, আঁচলটা জড়িয়ে নিই। ব্যাগটা দিলীপের হাতে তুলে দিই, সেই ছেলেটি আমাদের মালপত্রের জিম্মাদার হয়ে থাকবে এখানে। ওদিকে বৌদিরা এগিয়ে গেছেন। তাড়াতাড়ি করে স্নানান্তে যেগুলো পরব, সেগুলো বগলে নিয়ে এগোই। কে যেন বলেন–’হাতে ঘড়ি কেন? ছুটে যাও, খুলে দিয়ে এস।’ ঘড়ি খুলতে আবার ফেরত দৌড়োই। ঘড়িটা দিতে গিয়ে মনে পড়ল কৈশোরে যখন সাঁতারু ছিলুম, তখন জলে নামার আগে কানে রিং হাতের আংটিও খুলে রাখতে হত। স্রোত নাকি খুলে নেয় অলংকার। সেসব বস্তু খুলে ব্যাগে পুরে দিয়েই ফের ছুটছুট। বৌদিদের ধরে ফেলেছি। আমাদের সঙ্গে অঞ্জনা বলে সাত-আট বছরের একটি বাচ্চা মেয়ে আর তার তরুণী মাও চলেছেন। অবশ্য বাবাও আছেন। ছোট্ট অঞ্জনা ভারী মিষ্টি। ওকে দেখে কেবলই নিজের মেয়েদের কথা মনে পড়ছে। কোন দুঃসাহসে ওঁরা যে এতটুকু শিশুকে এই ভিড়ে কুন্তস্নানে এনেছেন। আশ্চর্য। আমার রীতিমতো উদ্বেগই হতে থাকে ওর জন্যে।

আলোর কাছে গিয়ে কোথা দিয়ে কী যেন হয়ে গেল। ভীষণ ভিড়। ওপাশ থেকে লোকেরা উঠে আসছে স্নান সেরে, এপাশ থেকে স্নান করতে যাচ্ছে, আর পশ্চিম থেকে তৃতীয় এক বিপুল স্নানার্থী দল হুড়মুড়িয়ে এসে পড়ল। কোথায় ছিটকে গেলেন বৌদি, কোথায় অঞ্জনা আর তার মা, কোথায় আমি! বগলের পুঁটলি আর নাকের চশমাটাকে জোরে চেপে ধরেছি। এই রেঃ চশমাটা খুলে আসতে ভুলে গিয়েছি। সর্বনাশ। ভিড়ের ঠেলায় আপনা আপনি কোনদিকে যাচ্ছি কে জানে, এমন সময়ে দেখি সামনেই জল। ভিড়টাও এখানে আবার একটু পালা। কিন্তু বৌদিদের চিহ্ন দেখা গেল না। নদীজলে অনেক মানুষ। ওপারে চড়া, তার ওপারে আবার জল। আবার মানুষ। জল বেশি নয়। হাঁটু পর্যন্ত। যাক। তবু রক্ষে। এখন চশমা নিয়ে কী করি? ভাবতে না ভাবতেই মনে পড়ল, পায়ে আমার দু’জোড়া মোজা, একজোড়া হিলতোলা চটি, গায়ে তিনটে মাথা গলানো সোয়েটার। কিছুই তো খোলা হয়নি? একটা একটা করে সব এবারে খুলে নিতে হবে। ভেবেছি মাত্র—হঠাৎ ‘হর হর মহাদেও’–’গঙ্গা মাইকি জয়’—বলে এক সম্মিলিত চিৎকার, আর পিছনে হাজার লোকের ভিড়ের ধাক্কা। একমুহূর্ত পরেই দেখি—আমি জলে। কোমর পর্যন্ত জল। দুই পা জুতোসুদ্ধ, কাদায় প্রোথিত। বগলে কিন্তু পুঁটলি বাঁধা চেঞ্জটি তখনও চেপে-ধরা। যদিও তা ভিজে গেছে। নাকে চশমাও আছে। একহাতে পুঁটলিটা ধরে অন্য হাতে সন্তর্পণে কাদা থেকে একটা একটা করে পা তুলে জুতো খুলে জলে ধুয়ে হাতে নিলুম, মোজা খোলার চেষ্টার কথা ছেড়ে দিলুম। এখন জামা খুলি কী করে?

হঠাৎ দেখি গামছা পরা, খালি গা, হাতে দুটি দু’ কিলো করে শ্রীঘৃতের টিন, এক ভদ্রলোক অবাক হয়ে আমাকে বলছেন-’কী কাণ্ড? আপনি এসব জামাকাপড় পরেই নাইতে নেমেছেন? আপনি কি পাগল?’ ভাল করে তাকিয়ে দেখি, সেই খাদ্যাধ্যক্ষ ভদ্রলোক। ভারি আহ্লাদ হল। বাঃ এই তো সঙ্গী পাঠিয়ে দিয়েছেন ঈশ্বর! শার্দুল সিংয়ের নজর আমিও পেয়ে গিয়েছি এখন।

কাঁদো কাঁদো গলায় বলি—’ইচ্ছা করে কি আর? ধাক্কার চোটে জলে পড়ে গিয়েছি গরম জামা খোলবার আগেই।’

—’কী কাণ্ড! দিন আমাকে দিন জুতো আর পুঁটলি। চশমাটা খুলুন আগে, তারপরে সোয়েটারগুলো। নাকি, নাইবেন না? তার চেয়ে আমি বলি কি, মাথায় একটু জল ঠেকিয়ে উঠে পড়ুন, তাতেই খুব পুণ্য হবে।’

তা কেন? ডুব দেব বলেই না আসা। দুটো টিন, দু’পাটি জুতো, চশমা, পুঁটলি ধরে ভদ্রলোক হাঁটুজলে শান্ত হয়েই দাঁড়িয়ে রইলেন। পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর অপেক্ষায়। হাতকাটার পরে হাফহাতা, হাফহাতার পরে ফুলহাতা হিঁচড়ে টেনে খোলার অপরূপ দৃশ্য নয়নভরে নিরীক্ষণ করলেন। তারপর বললেন—’আর কী বাকী?’ আমি বললুম—’ব্যাস্। খতম।’ (অতঃ হতাশা?) সোয়েটারগুলোকে গুটিয়ে পুঁটলি করে ওঁর হাতে দিলুম। ছাতির ওপরে বড়ই ঝকমক করছে ভদ্রলোকের পৈতের গোছা। নাঃ নিজের জুতোটা বরং নিজেই ধরি। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। জুতো জোড়াটা ফেরত নিয়ে নিই। ভিজে মোজাগুলোও খুলে কাদা ধুয়ে নিংড়ে নিই। তারপর চারখণ্ড মোজা যত্ন করে গুনে গুনে কোমরে গুঁজে রেখে, বগলে দু’পাটি জুতো নিয়ে ‘জয়কুম্ভ’ বলে একটা ডুব দিয়ে ফেলি। যা থাকে কপালে। বাহির হয়েছি স্বপ্নশয়ন করিয়া হেলা, নিশীথবেলা! দে ডুব, ডুব! উরিঃ বাপরে বাপ্‌! কী ঠান্ডা! মাথা তুলেই মনে হল গুরুদীপ? গুরদীপের নামেও একটা ডুব দিতে হবে। তার আগে পুণ্য প্রয়াগধামে এসেছি যখন পিতৃপুরুষদের একটু জল দিয়ে নিই। বাবার মৌদ্‌গল্য গোত্র, শ্বশুরমশাইয়ের ধন্বন্তরী, এবং আমার প্রিয় মামীমাও মৌদ্‌গল্য—এঁদের মনে মনে স্মরণ করে, আমি নিচু হয়ে অঞ্জলি ভরে জল নিয়ে প্রথমে ‘আগচ্ছন্তু মে পিতর ইমং…’ বলতে বলতেই দেখি গঙ্গার স্রোতে ভেসে যাচ্ছে আমার একপাটি চটি জুতো, কিছু ভাববার আগেই খপ করে সেটি ধরে ফেলেছি। ধরতে ধরতে ইতিমধ্যে মুখ দিয়ে মন্ত্রটি বেরিয়ে গেল যেটা বেরুচ্ছিল, পহুত্ত অপোঞ্জলিম্।’

ছি ছি ছি ছি ছি। নবনীতা! তোমার হাতে জলের সঙ্গে ওটা কী? এ্যাঁ!! কিন্তু হে আমার পিতৃপুরুষগণ—আমি তো ইচ্ছে করে করিনি। তোমরা তো আমার দূরপর কেউ নও, তোমরা তো আমারি পিতৃপুরুষ। তোমরা আমার দোষত্রুটি নিজগুণেই মার্জনা করে নেবে। তোমাদের আহ্বান করা মাত্র, তোমরাই তো আমাকে দেখিয়ে দিলে, যে জুতোটা ভেসে যাচ্ছে? একপক্ষে তোমরাই ওটা উদ্ধার করে দিলে। হে আমার পূজনীয় পিতৃপুরুষগণ, পরমহংস যেমন নীর বাদ দিয়ে ক্ষীরটুকু গ্রহণ করেন, তোমরাও তেমনি জুতোর কলঙ্কটুকু বাদ দিয়ে, হৃদয় নিঃসৃত জলটুকুনি গ্রহণ করো।

—’ওকি হচ্ছে? জুতো হাতে করে উদকাঞ্জলি?’ এক ধমক দিলেন খাদ্যাধ্যক্ষ মশাই।—’মাথাটাথা কি একেবারেই গেছে?—দিন জুতো আমাকে? নিন ডুব দিন চট করে ডুব দিন–এক, দুই—তাঁর ধমকের চোটে আর একদুই গোনার চাপে টুপ টাপ করে আরও দুটো ডুব দিয়ে ফেলি। এবার অঞ্জলিতে আবার জল নিয়ে বলি :

—’আগচ্ছন্তু মে পিতর ইমং গৃহ্নন্তু অপোঞ্জলিম্।
আব্রহ্মভুবনাল্লোকা দেবর্ষি পিতৃ মানবাঃ।।’

তৃপ্ত হও হে আমার পূর্বপুরুষ সকল, হে পূজনীয় মাতৃপিতৃগণ! তিনভুবন জুড়ে তৃপ্ত হও তোমরা আমার ভালবাসায়।

—’ময়া দত্তেন তোয়েন তৃপ্যন্তু ভুবনত্রয়ম্।’

তারপরে গুরুদীপ কাউরের নামে আর একটি শুদ্ধচিত্তে ডুব। ব্যাস্।

–’নিন ধরুন এবার এই সবগুলো, এখন আমি জল ভরব টিনে।’ জামার পুঁটলি, জুতো, চশমা আমাকে ফেরত দিলেন তিনি।

আমি একটা চড়ায় উঠে দাঁড়িয়েছি, পায়ের গোছ ডোবানো জলে। জিনিসপত্রগুলো সামলে। চড়াতেও ভিড় বাড়ছে। খাদ্যাধ্যক্ষ যে কোথায় গেলেন। তাঁকে আর দেখতে পাচ্ছি না। ভিজে কাপড়ে ভীষণ শীত করছে। সঙ্গে শালটাও নেই যে জড়াবো, মাথায় বৃষ্টি পড়ছে। পা ডুবে আছে জলে।

শীতের কাঁপুনি ভুলতে অন্য কথা ভাবি, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লোকদের স্নান করা দেখছি আর ভাবছি এই সেই পুণ্য ত্রিবেণী—এখানে পূর্ণকুম্ভের লগ্নে স্নান করলে আর পুনর্জন্ম হয় না। এ বড়ো পুণ্যভূমি। স্বয়ং প্রজাপতি ব্রহ্মও এখানে যজ্ঞ করেছিলেন। তাই এর নাম প্রয়াগ। অমৃতকুম্ভ নিয়ে পালানোর সময়ে যে চার জায়গায় ইন্দ্র কলসি নামিয়েছিলেন, যেখানে যেখানে চলকে পড়েছিল অমৃতবারি, এই গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর সঙ্গম তার মধ্যে প্রধান। তীর্থরাজ প্রয়াগ সকল তীর্থক্ষেত্রের শ্রেষ্ঠ মিলনতীর্থ। এই যে ছুটে এসেছে এক কোটি মানুষ এদের প্রত্যেকের মনে এই মুহূর্তে একটিই আশা একটিমাত্র আকাঙ্ক্ষা, মুক্তি। সকলের মন এখন একই তারে বাঁধা। একেও যদি পুণ্যলগ্ন না বলি, তো কাকে বলব? যখন এক কোটি তন্ময় মানুষ একসঙ্গে মুক্তির প্রার্থনা করছে, একই জলে স্নান করে ধৌত হতে চাইছে? কোটি মানুষের মন যেখানে মিশে যায় সেই তো সঙ্গম। এই অমৃতের আকাঙ্ক্ষাই তো অমৃতের স্বাদ।

একসময়ে দেখি খাদ্যাধ্যক্ষ উঠে আসছেন, টিন হাতে। টিনগুলো আমাকে দিয়ে বললেন—’রাখুন, এইবারে আমি ডুব দিয়ে আসি। আপনার জন্য মশাই, আমার ভাল করে ডুবই দেওয়া হয়নি!—আচ্ছা, আপনার নামটা যেন কী? নামটা জেনে রাখা ভালো। যা ভিড়! সাংঘাতিক কাণ্ড। এত সুব্যবস্থা এবার, তাতেও এই। অন্যান্যবার কী হয় তাহলে ভেবে দেখুন!—আমার নাম ভটচায্যি।’

–’আর আমি নবনীতা।’

—’নবনীতা? বা, বা বেশ।’ দুবার নাম বলতে হয়নি দেখে আমি খুব খুশি। ইতিমধ্যে এক ফোঁটাতিলককাটা গামছাপরা পাণ্ডা এসে আমাদের পাকড়াও করল।—’চলুন বাবু, চলুন, খুব ভাল করে স্নান করিয়ে দেব’—’চাই না, চাই না’ বলে ভট্চায্যি অস্থির হয়ে উঠলেন। পাণ্ডা কিন্তু নাছোড়। আমার মাথায় হঠাৎ দুর্বুদ্ধি এল। আমি গামছাপরা ভট্চায্যির নগ্নবক্ষে শোভা-পাওয়া পুরু পৈতের পুচ্ছটির দিকে আঙুল তুলে বলি—’আরে? পাণ্ডা দিয়ে এখানে কি হবে? ইনিই তো আমার পাণ্ডা! দেখছেন না, ইনিই আমাকে স্নান করাচ্ছেন!’ পাণ্ডাজী মস্ত জিব কেটে ‘লজ্জিত হেসে আর এক মিনিটও অপেক্ষা করলেন না। আর ভট্‌ট্চায্যি?—’বাঃ! আপনার তো দেখছি দিব্যি সাফ্ মাথা! তবে কেন খামখা জুতোজামা পরে জলে নেমেছিলেন?’ বলেই চলে গেলেন জলের দিকে। এতক্ষণে মনে পড়ল আমার জলের পাত্রটি তো ব্যাগ সুটকেস-কম্বলের সঙ্গেই ফেলে এসেছি, পুণ্যপানি ভরে নেওয়া আর হল না। ভট্‌ট্চায্যি গেলেন তো গেলেনই। আর ফেরার নাম নেই। ইতিমধ্যে দলে দলে স্নানার্থী মানুষে জলের ধারটা একেবারে ঢেকে গেল। আমি কিছুতেই ভট্টচায্যিকে আর নজর করতে পারছি না। দু’টিন পুণ্যবারি আর এতগুলো পোঁটলা পুঁটলি নিয়ে হাঁটতেও পারছি না—পুণ্য সঙ্গমের চরে ক্যাসাবিয়াংকার মতো নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে—আকুল নয়নে চতুর্দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে লক্ষ লক্ষ গামছাপরা খালি গা পুণ্যবানের অরণ্যে দময়ন্তীর মতো নিবিষ্টচিত্তে আমাদের ভট্চায্যির পুণ্যমূর্তিটি খুঁজছি। কিন্তু নলকে যেভাবে দময়ন্তী চিনে নিয়েছিলেন-এখানে তো সেই অন্যান্য যোগাযোগটি নেই। আমার মন অস্থির হয়ে উঠল। হল কি ভট্চায্যিমশায়ের? …এমন সময়ে কানে এল :

—’নবনীতা! নবনীতা! আপনি কোথায়?’

‘নবনীতা!’ নিজের নামটা আমার কোনকালেই পছন্দ নয়। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে চেনা নামটি শুনতে কী ভালোই লাগল!-’এই যে আমি-ঈ! ভট্‌ট্চায্যি মশাই—ঈ!’ ভট্‌ট্চায্যি খুঁজে পেলেন আমাকে। একহাতে দড়ি বাঁধা দুটো টিন ঝুলিয়ে নিয়ে-অন্য হাতে শক্ত ক’রে আমার বাঁ কব্জিটা পাকড়ে তিনি বললেন—’ওফ্! যা ভিড় বাড়ত্যাসে—চলেন চলেন আর দেরি না।’ চরের ভিড় ঠেলে জলে নেমে, জল পার হয়ে পাড়ে উঠতে গিয়েই মুশকিল বাধল। ভট্‌ট্চায্যি আগে উঠলেন, হাত বাড়িয়ে আমার হাত থেকে জুতোজোড়াও নিয়ে নিলেন, তারপর আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়ালেন…কিন্তু দ্রুত নেমে আসা মানুষের স্রোতের চাপে তাঁর বাড়ানো হাতটি কোথায় মিলিয়ে গেল। আর তাঁকে দেখা গেল না। আমি এখনও হাঁটুজলে। এখানে পাড়টা খুবই উঁচু, বুকসমান খাড়াই। এবং অসম্ভব পিছল। আমার পক্ষে নিজের চেষ্টায় পাড়ে ওঠার প্রশ্ন নেই। অতএব পুঁটলি ও চশমা একহাতে আগলে,–অন্যহাতটা ভিক্ষে চাইবার মতন ওপরদিকে বাড়িয়ে দিই। এবং সামনেই দাঁড়ান মাথায় পাগড়ি বাঁধা বিরাট গোঁফ ঝোলান রাজস্থানী চাষী চেহারার লোকটিতে আপ্রাণ ডাকাডাকি শুরু করি-’ও ভাইসাব! মুঝে জরা উঠা লিজিয়ে না? বহোৎ উচা হ্যায়। ম্যয় অকেলি নহি সকতি হুঁ!’ খুব কড়া-পড়া আর নিশ্চিন্ত করা একটা শক্ত মুঠোর মধ্যে আমার হাতটা চলে গেল—তারপর এক হ্যাঁচকা টানে সোজা পাড়ে। ‘ভাইসাব’ সত্যি সত্যি ভালো লোক—হেট্‌ হেট্‌ করে চেঁচিয়ে ধাক্কিয়ে ভিড়ের মধ্যেই একটুখানি ফাঁক তৈরি করে ঠেলে ঠুলে আমাকে আরও খানিকটা ওপর দিকে জবরদস্তি তুলে দিলেন। নিশ্বাস নিয়ে, সামনে তাকিয়েই দেখি জ্বলজ্বল করে উঠেছে ভিড়ের মাথা ছাড়িয়ে একটা চমৎকার রুপোলী ত্রিশূলের চুড়ো। যেন স্বপ্নে দেখা কোন দেশের ইস্টিশান।

–’কানাই মহারাজ!’ ভুলেই গিয়েছি তাঁর কথা, দলের কথা। প্রায় একই সঙ্গে একটা চিৎকার কানে এল—’নবনীতা! নবনীতা!’

—’ভট্‌ট্চায্যি মশাই? এই যে, এই তো আমি!’

.

কানাই মহারাজ ঐখানেই রইলেন। আমাদের দূরে একটা বড় লাল আলোর দিকে হাত তুলে দেখিয়ে বললেন, এবার ওইখানে যেতে হবে, ওখানেই বাঁদিকে বেড়ার মধ্যে আরেকজন মহারাজ আছেন, দুহাতে দু’রঙের দুটো ফ্ল্যাগ দোলাচ্ছেন। সেখানে তাঁর চার্জে মালপত্র, এবং বাকি সবাইকে পাওয়া যাবে। পুঁটলিবাঁধা ‘চেঞ্জ’ তো ভিজে একশা। গায়েও একপো জরি ভিজে একমণ হয়েছেন। অঙ্গ যেন চলে না। ভিজে পেটিকোটে পাদুটি সপ্রেমে জড়িয়ে ধরেছে যেন শ্রীকৃষ্ণের কুঞ্জলীলা–ওদিকে ভিজে ব্লাউজ বুকে হাড় কাপানো চমক দিচ্ছে, যেন নাৎসী কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের বৈদ্যুতিক শাস্তির খেলা, আর ভিজে আঁচল সর্বাঙ্গে মহাপাপের মতো লেপ্টে আছে। উপরন্তু বৃষ্টি পড়ছে প্রাচীন চীনে শাস্তির মতো ছুঁচ ফুটিয়ে। রামকৃষ্ণদেবের কথাটাও মনে পড়ল, গঙ্গায় ডুব দেবার সময়ে পাপগুলো উড়ে গিয়ে গাছের ওপরে বসে থাকে, মাথা তুললেই ফের আমাদের অঙ্গে এসে ঢোকে। তা আমার পাপগুলো ওজনে দশগুণ বেশি ভারী হয়ে ফিরে এসেছে।

—’আপনি কী করেন ভট্টচায্যিমশাই?’

-’আমি? রেলে ফোরম্যানের কাজ করি।’ একটু অবাক না হয়ে পারি না। আমার পাতাটি তো ভালো?

–’আসবেন নিশ্চয়ই আমাদের বাড়িতে, আমার স্ত্রী, আপনার বৌদিদি, আপনাকে দেখলে খুব খুশি হবেন। আর আমার ছেলেমেয়েরাও। রেলোয়ে কোয়ার্টার্সেই থাকি। নেমে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে।’

-’আমি ওখানে গেলে নিশ্চয়ই আসব আপনার বাড়িতে। আপনার জন্যেই তো আমার স্নান হল।’

-’আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’

-’করুন?’

—’আপনি এরকম একা একা কোন্ সাহসে এলেন বলুন দেখি?’

—হায়! আবার?

–’এই তো আপনাদেরই ভরসায়।’

–’ওটা একটা কথা? ‘

-’ওটাই আসল কথা।’

—’আপনি বড় অদ্ভুত মেয়ে। আপনার কি সন্ন্যাসী হবার ইচ্ছে?’

—’সন্ন্যাসী হতে যাব কোন দুঃখে? আমার দুটি মেয়ে আছে না?’

—’এ্যাঁ? মেয়ে?’

‘বয়েস হয়েছে, বিয়ে হবে, বাচ্চা হবে, এটাই তো স্বাভাবিক।’

—’আপনার মিস্টার আপনাকে একা ছেড়ে দিলেন? এই ভিড়ে? আশ্চর্য! মিস্টার কি করেন?

—’পড়ান।’

–’কলেজে?’

—’হ্যাঁ।’

—’কোন্ কলেজে?

–’বিলেতে।’

—’ও বাবা। তা আপনিও কেন বিলেতে থাকেন না?’

—’বিলেতে থাকলে এখানে আসতুম কি করে?’

—’তা বটে। তবু মিস্টারকে ওখানে একা রেখে দেওয়াটা! তাঁকে যত্নআত্তি করারও তো একটা লোক চাই।’

–’তাঁকে যত্নআত্তি করার লোক সেখানে আছে।’

-‘এ্যাঁ?’

-’হ্যাঁ।’

এবার দুমিনিট নীরবতা পালন। তারপর :

-’ওঃ। বুঝেছি! তাই আপনার এই যৌবনে যোগিনী বেশ, এই সংসারে বিরাগ। ওঃ হোহো! ভেরি ভেরি সরি!’

-’কী মুশকিল। এতে আপনার কী দোষ? তাছাড়া সংসারে বিরাগ-টিরাগ আমার মোটেই নেই। খুবই সংসারি আমি। আপনি একদম ভুল বুঝেছেন ভট্‌ট্চায্যিমশাই।’

—’বললেই তো হল না। যেভাবে এত দামী বেনারসীটাকে আপনি জলেকাদাতে অনায়াসে নষ্ট করলেন,–মেয়েরা কাপড়চোপড়কে—’

–’তাতে আমিও খুবই দুঃখিত। কিন্তু এটা দক্ষিণী শাড়ি, কেচে ফেললেই ঠিক হয়ে যাবে।’ মাত্র এই ক’ঘণ্টায় কতজনে মিলে আমাকে নিয়ে কত ধরনেরই যে উদ্বিগ্ন হয়েছেন!–আরও একটা কুম্ভস্নানের সমান সমান পুণ্য তাঁরা অর্জন করে ফেলেছেন একটি অচেনা অনাত্মীয় মেয়ের শাড়ি ও স্বামী সংরক্ষণের আন্তরিক শুভাকাঙ্ক্ষায়। জীবনে এতখানি ইম্পর্ট্যান্স আর পাইনি আমি। ধরা ধরা গলায় ভট্টচায্যি হঠাৎ বলে ওঠেন—’দেখুন, ভগবান আছেন। একদিন আপনার দুঃখ তিনি নিশ্চয়ই ঘোচাবেন। এই পুণ্যতীর্থে দাঁড়িয়ে আমি আপনাকে বলে দিলাম! আপনি সেদিন দেখে নেবেন। আপনার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবেই।’

উত্তরে চুপ করে থাকি। কি বলব? ধন্যবাদ?

এই আমাদের দেশ। এ কেবল ভারতবর্ষেই সম্ভব। যাকে জানিনে চিনিনে তারই জন্যে বুকটা ফাটিয়ে ফেলি। যেমন প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে অন্যকে উত্ত্যক্ত করতে আমাদের জুড়ি নেই তেমনি অন্তর থেকে মধু ঢেলে অন্যের ঊষর জমিতে আবাদ করাও আমাদের চরিত্রে স্বাভাবিক। এ দুটোর কোনটাই পশ্চিমী সংস্কৃতিতে সভ্য আচরণবিধির অন্তর্গত নয়। পশ্চিম থেকে ধার করা আমাদের শহুরে সংস্কৃতিতে এগুলি গ্রাম্যতা দোষ বলেই পরিচিত। আমার মনোবাঞ্ছা যে কী, তা ভট্টচায্যি জানেন না, কিন্তু ধরে নিয়েছেন, জানেন। যেহেতু সেটা ওঁর মনোবাঞ্ছা। আমি মেমসায়েব নই, তবুও দেশের মানুষের অপার কৌতূহল ইদানীং আমাকে বড়ো কষ্ট দেয়। কিন্তু দেশের মানুষের আসল চেহারাও আমি চিনেছি এই প্রসঙ্গেই। ধুলোয় শোওয়া নির্বান্ধব মেয়েকে এরাই তুলে আনে দলের আশ্রয়ে, জলে-পড়ে-যাওয়া অজানা মেয়েকে এরা শক্ত হাতে জল থেকে ডাঙায় ওঠায়, পথক্লান্ত, নামগোত্রহীনকে এরাই আপন কম্বল পেতে জায়গা করে দেয় একটুখানি শোবার। আবার একা একা যুবতী মেয়ে কুম্ভে যাচ্ছে শুনে, চায়ের গেলাস ঠক্ করে নামিয়ে রেখে এরাই সে-তল্লাট ছেড়ে পলায়ন করে।

.

খোলা মাঠ দিয়ে প্রচণ্ড কনকনে উত্তুরে বাতাস ছুটে আসছে; বৃষ্টি বাড়ছে। গরমজামাগুলো সবক’টা টপাটপ্ গায়ে দিয়ে ফেলেছি ভিজে পোশাকের ওপরেই। শীতে জমে গিয়ে ফোড়ার মতো টাটিয়ে উঠেছে মোজাহীন পা ভিজে টুসটুসে জুতোর মধ্যে। কে বলবে আজ অমাবস্যা। এত আলো, যেন ইন্দ্রসভা। টর্চ ব্যাগেই রেখে এসেছি। নদীর পাড়েই শুধু নয়, জলেও অন্ধকার নেই। পুরো সঙ্গম অঞ্চলটি জোরাল ফ্লাডলাইটের আলোয় ঝলমল করছে। তার মধ্যে ভিজে জামাকাপড় বদলানোর যথেষ্টই অসুবিধা। মাঠেও আলো যথেষ্ট, দূর থেকে কুম্ভনগরের তাঁবুর আলোর মালা দেখা যাচ্ছে। এখান দিয়ে সহস্র মানুষ স্নান সেরে ফিরছেন—ছুটে ছুটে। সকলেই শীতে কাতর। সকলের গায়েই ভিজে কাপড়। সেদিকে তাকিয়ে নিজের শীতের কষ্ট কমছিল—তবে আমার জলে টইটম্বুর তিনসেরি ওজনের শেকল পরানো পোশাকপরিচ্ছদের চেয়ে ভট্টচায্যির মুক্ত গা নিশ্চয় ঢের আরামের।

একসময়ে দুটি ফ্ল্যাগ হাতে বৃদ্ধ স্বামিজী দিগন্তে পরিদৃশ্যমান হলেন। উল্লাসের হল্লা তুলে আমরা তাঁর দিকে ছুটে গেলুম। এবার শুকনো পোশাক পরা যাবে! কিন্তু পোশাক বদলাবো কোথায়? সর্বত্রই তো জোর আলোর খেলা। নাঃ বাঙালী মেয়ে হয়ে জন্মানোর দু’একটা অসুবিধে সত্যি সত্যিই আছে। সবখানে ইকোয়ালিটি চলে না। সুটকেস থেকে শেষ শুকনো শাড়িটি বের করে নিলুম বটে কিন্তু লজ্জাশরম বড় বালাই। কোনরকমে চোখকান বুজে এই ভিড়ের মধ্যেই মেয়েদের দলে লুকিয়ে টুকিয়ে শুকনো শাড়িটুকুনি ওপর-ওপর জড়ানো হল। কিন্তু অন্তর্নিহিত ভিজে বসনগুলি যেমনকে তেমন—হৃদিস্থিত হৃষীকেশের মতো, অন্তরঙ্গেই রয়ে গেলেন। অন্য স্নানার্থীরা বুদ্ধি করে কেমন প্লাস্টিকের থলে এনেছেন, আমার তো কিছুই আয়োজন ছিল না; অগত্যা ভিজে কাপড়ের রাশি তোয়ালে জড়িয়ে এক ধ্যাবধেড়ে পুঁটলি করে নিলুম। ওরেবাবা কী দুশমনী ওজনই হয়েছে। ওয়ার্ল্ড হেভি ওয়েট-লিফটিং চ্যাম্পিয়ানশিপের মহড়া দিতে দিতে ফিরতে হবে এবার। এটিকে বহন করা, অপরাধবোধ বয়ে বেড়ানোর চেয়েও দুরূহ হবে বলে মনে হচ্ছে।

সবাই এবার চিরুনি বের করে চুলটুল আঁচড়াচ্ছেন! আমিও দেখাদেখি একটুখানি আঁচড়াই। ব্যাপারটা সুবিধার নয়—এদিকে ভেতরের সবকিছুই জবজবে ভিজে, হিহি করে কেঁপে হাড়ে দুব্বো গজাচ্ছে, বাহার করে ওদিকে চুলের টেরি ফেরানো হচ্ছে! এবার এল যেখানে যা গয়নাগাঁটি পরবার, সেসব পরে নেবার পালা। অর্থাৎ হাতে হাতঘড়ি, নাকে চশমা, আঙুলে আংটি, কানে মাকড়ি,—একে একে ইহজাগতিক সম্পত্তিগুলির সব দখল নিয়ে নিয়েছি। না, কোনটাই খোয়া যায়নি। কেবল শালের ওপর এতক্ষণ আরও বৃষ্টি পড়েছে, ফলে সেটিও প্রায় স্নানের কাপড়চোপড়ের মতোই ভিজে ভারী হয়ে উঠেছে। এবং শীতে প্রোটেকশন দিচ্ছে না।

হঠাৎ মাটিতে কী একটা দেখতে পেয়ে অঞ্জনার মা চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘ওমা! এটা কার সোনার মাকড়ি?’ দেখে আমি উদ্বিগ্ন হয়ে বলি—’দেখুন, দেখুন—কার আবার সোনা হারাল।

—’কার আবার সোনা হারাল?’ বৌদিদি এক নজর তাকিয়েই দাবড়ে ভেংচে ওঠেন—

–’এইবার মারব একটি গাঁট্টা! ছি ছি ছি—এই ন্যাকা মেয়ে একা একা কুম্ভে এসেছে? দ্যাখ্ দিখি নিজের কানে হাত দিয়ে,কার সোনা হারিয়েছে?’ বকুনি খেয়ে তাড়াতাড়ি কানে হাত দিই কথায় কথায় এই যে ‘একা-আসার’ খোঁটা খেতে হচ্ছে আমাকে, ওইটুকুই যা একা আসার অসুবিধে। নইলে ‘একা’ আর কোথায়? শহরেই বরং আমার অনন্ত নিঃসঙ্গতা। কানে হাত দিয়েই দেখি, ওমা? সত্যিই তো এক কান খালি? শীতে-টিতে ঠিকমত করে খিলটা আঁটা হয়নি আর কি। হেঁহেঁ করে মাকড়িটা ফেরত নিতে হাতে বাড়াই। বৌদি হাতে একটা আলতো চাঁটি মারেন, নকল রাগ করে বকেন

–’বলি ও মেয়ে, চোখে দেখেও চিনতে পারলে না যে গয়নাটা নিজের? এ মেয়ের কী হবে গো!’

আমি যে চোখে দেখেও কিছুই চিনতে পারি না তা তো বৌদি জানেন না? জীবনে অনেক কিছুই আমার এই দুটো অকর্মণ্য চোখের সামনে দিয়েই প্রতিনিয়ত ঘটে যাচ্ছে, আমি যা দেখতেও পাই না, চিনতেও পারি না। জীবনে সোনা হারান আমার অভ্যেস হয়ে গেছে।—তেমনি সোনা কুড়োনোও তো সম্ভব? এই বৌদি আর অঞ্জনার মায়ের মতো দৈব ও তো জগতেই আছে? কথা ঘুরিয়ে নিয়ে বলি–

-’অঞ্জনার জলে নামতে শীতের ভয় করল না? এই ভিড়ে অতটুকু বাচ্চা—‘

—’কোথায় ভয়? মহাউৎসাহে কতগুলো যে ডুব দিলে তার ঠিক নেই।‘

সত্যি, অঞ্জনাকে বুকে নিয়ে অঞ্জনার মা যে কী করে একা একা এই ভিড়ে নিয়ে এলেন, ঈশ্বর জানেন। স্নানের সময়ে সঙ্গে বৌদিও ছিলেন না। ওর বাবাও ছিলেন না। অঞ্জনার মা একগাল হেসে বলেন,–’ওমা, আমার মেয়েটা খুব শক্ত। সেই তো ভিড় ঠেলেঠুলে জায়গা করে জলে নামালে আমাকে! টেনেও ও-ই মেয়েই তুললে!’—যাঃ বাবা! নাঃ, একেই মিরাক বলে! অঞ্জনার মায়ের হাসিটি খুব মিষ্টি, প্রাণখোলা। অঞ্জনাও মায়ের মতোই মিষ্টি মেয়ে—সে যে অত শক্তপোক্ত, তাকে দেখে তা বোঝা যায় না। কত আর বয়েস, সাত-আটের বেশি নয়। এক গোছা ঝাঁকড়া কোঁকড়া চুল এখন ভিজে মুখের চারপাশে সেঁটে আছে। মুখের হাসিটি মায়ের মতোই অনির্বাণ। আর বৌদি ঠিক যেন জগজ্জননী। মুখে সর্বদা পানদোক্তা আর হাসি ঠাসা, ঠোঁটটি হৃদয়ের রঙে টুকটুকু করছে। ইতিমধ্যে গায়ে একটা গামছা, কোমরে একটা গামছা, শীতে কাঁপতে কাঁপতে মেসোমশাই এসে উপস্থিত। ‘ও দিলীপ, আমাকে স্নান করিয়ে দাও। আমি তো ভিড়ে জলে নামতেই পারলাম না। ঘাট এমন পিছল, ভীষণ পড়ে গিয়েছি। বড্ড কোমরে লেগেছে বাবা।‘

অমলবাবু বললেন-’আমি ওষুধ দিয়ে দেব মেসোমশাই—’ দিলীপ ছুটল মেসোমশাইকে নিয়ে স্নান করতে। আমরা দাঁড়িয়ে রইলুম বৃষ্টির মধ্যে, মাল পাহারায়। গতবারের প্রহরীরা এখন স্নানে গেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই ফিরে আসেন। মালপত্তর পুনরায় ঘাড়ে ওঠে—’জয় কুম্ভ’ হাঁক দিয়ে মিছিল ফেরত রওনা হয় তাঁবুর দিকে। তীর্থযাত্রায় কৃচ্ছসাধন আবশ্যিক। সেটা এইভাবেই হয়ে গেল। ভারী ভিজে কাপড়ের পুঁটলি নিয়ে এবারে এই শীতে হাঁটতে রীতিমতো কষ্ট হচ্ছে সকলের। তাড়াহুড়োতে সঙ্গমে আমার কী ছাই জলে নামাই যে হল। এখন ভেবে দেখলে ছবিটা রীতিমত চাঞ্চল্যজনক—(১) পরনে জরিদার ভারী একটা নেমন্তন্ন বাড়িতে যাবার পোশাকী কাপড়। (২) তিনরকম সাইজের তিনটে সোয়েটার গায়ে, (৩) চোখে চশমা (৪) কোমর থেকে জলের নিচে রয়েছে পা—তাতে একজোড়া হিলতোলা জুতো, এবং (৫) দুজোড়া গরম মোজা। (৬) বগলে শুকনো কাপড়ের ভিজে পুঁটলি। পুণ্য প্রয়াগসঙ্গমে গামছা-পরা স্মার্ট স্নানার্থীদের ঠিক মধ্যিখানে কোমরজলে হতভম্ব দাঁড়িয়ে রয়েছি। বেমানান কিন্তু কৃতাৰ্থ

এই আমার অনৈসর্গিক কুম্ভস্নানের ক্লোজ-আপ ছবি।

পরের দৃশ্যটি তো আরও রোমহর্ষক, অঞ্জলিতে একপাটি চটিজুতো সমেত তর্পণের মন্ত্র উচ্চারণ করে ফেলেছি। কিন্তু অশ্রদ্ধায় অবহেলায় নয়। রীতিমত ভক্তিভরে। অন্তরের শ্রদ্ধা দিয়ে। চটিজুতোটা নেহাতই অ্যাকসিডেন্টাল। এবং ইচ্ছাবিরুদ্ধ।

মা অবশ্য এ খবরটা শুনে আমাকে মারতে উঠেছিলেন। এবং পইপই করে বারণ করেছিলেন এটা লিখতে। লোকে নাকি ভুল বুঝতে পারে। মা সম্প্রতি ঠেকে শিখেছেন, সত্যকথাও সবার কাছে বলতে নেই—সত্যের শত্রু অনেক। আবার আমাদের মতো বলহীন ব্যক্তিদের জগতে একমাত্র বন্ধুও যে ওই, সত্য। একদিন না একদিন সে ঠিকই আশ্রয় দেয়, রক্ষণাবেক্ষণ করে। বলীয়ান করে তোলে।

.

ফেরতপথে সত্যিই রাস্তা ঘুরিয়ে দেওয়া হল, মাঠের মাঝখান দিয়ে। একপক্ষে ভালই—এখন স্নানার্থীদের মিছিল আর স্নানযাত্রীদের মিছিল ভিন্ন ভিন্ন পথে চলেছে। যাতায়াতের ভিড় কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হবে এতে। যেখান দিয়ে হঠাৎ মোটা মোটা দড়ি হাতে কিছু পুলিশ এসে জোর করে আমাদের পথ বন্ধ করে দিয়ে মাঠে ঠেলে দিল, সেইখান থেকেই মেসোমশাইকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। অমলবাবু ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। তাঁর সঙ্গে দুটি তরুণ পার্শ্বচর সখা ছিল, মামু দিলীপ আর কাকু দিলীপ। তারা অনবরত সান্ত্বনা দিয়ে চলল-মেসোমশাই নারী নন, অশিক্ষিত নন, নির্বোধ নন, অথর্বও নন—পরন্তু একটা জবরদস্ত অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেল অব বেঙ্গল ছিলেন তিনি, তদুপরি তাঁর পরনে পুরোদস্তুর কোটপ্যান্ট আছে। আর কি চাই? এতটা উদ্বেগের কি আছে? মেলায় অধিকাংশ মানুষেরই একসঙ্গে এতসব গুণাবলী নেই বিশেষত কোটপ্যান্ট। কেননা স্নান সেরে ফেরার পথে পুরো পোশাক পরনে নেই কারুরই। ঊর্ধ্বাংশে শুকনো কোট, নিম্নাংশে ভিজে গামছা এখানে এই ইউনিফর্মটাই বেশি প্রচলিত দেখা যাচ্ছে।

অমলবাবু তবু বলেন, ‘আহা, একটা চোখে যে ভালো দেখেন না! আর পড়ে গিয়ে তখন যে কোমরে একটু লেগেছিল।’ মেসোমশাই কি আর সাধে—’অমলের মতো ছেলে কলিযুগে হয় না’—বলে প্রত্যেকের মনে গভীর হিংসে জন্মিয়ে দিচ্ছিলেন? কথাটা সত্যি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *