শয়ন পর্ব – শিবের ত্রিশূল
শিবের ত্রিশূলের পুরো গল্প আরেকদিন হবে। কাশীর সেবাশ্রম সঙ্ঘে একটি দোতলার ঘর পাওয়া গেল। সেখানে জোড়া তক্তপোশে শুলুম আমরা মোট ছ’জন
অমলবাবু, তাঁর দুই দিলীপ, সমীর (সে আমার পুত্র হয়েছে) মেসোমশাই আর তাঁর পাশটিতে আমি। যার কাছে যা চাদর-টাদর ছিল, বিছিয়ে চমৎকার ঢালা ফরাস হল ঠিক বিয়েবাড়ির মতো। কম্বল প্রত্যেকেরই আছে, এমনকি আমারও। আর যার যা গরম জামা ছিল সেগুলো গুটিয়ে পুঁটলি পাকিয়ে মাথার বালিশ হল। আমার সুটকেস থেকে শুকনো পোশাকপত্র বেরুল—
‘আহ্। এখানে সভ্যজগতের সব সুবিধাই আছে। আছে শুকনো খাট, শুকনো মেঝে আর পুণ্যবারিতে সপসপে ভিজে পোশাক খুলে শুকনো পোশাক পরবার মতো বাঞ্ছিত আড়াল। আর আছে পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে বাথরুম। জয় বাবা বিশ্বনাথ!
এখানে এসে কয়েকঘণ্টা আগেকার কুম্ভনগরের অভিজ্ঞতাকে স্বপ্নই মনে হত যদি না থাকত ভারত সেবাশ্রমের বারান্দাতেও কুম্ভের যাত্রীর ক্লান্ত ভিড়। তাঁরা মাটিতে শুয়ে পড়েছেন। তাঁদের দেখেই বুঝতে পারছি স্বপ্ন নয়। কুম্ভনগর সত্য। আমি, মেসোমশাই, আর সমীর, বিছানা-টিছানা করে সবার ভিজে কাপড়গুলো টানা বারান্দায় মেলে দিলুম। অমলবাবুরাও তিনজনে বেরুলেন খাবার কিনতে। আমার ফ্লাস্কে কুম্ভের জল না থাকাতে ভালোই হল, কেবলই গরম চা ভরে আনা হতে লাগল বাইরে থেকে। বোতলটার ছ’কাপ পানি চার ঘণ্টা ঠান্ডা/গরম থাকে। অবশ্য কুম্ভের জল আমি এনেছি সঙ্গে, ভট্চাযের টিন থেকে চেয়ে। নইলে বাড়ি ফিরে মুখ দেখাব কি করে? বাতের ক্যাপসুলগুলো ঢেলে ফেলে দিয়ে তার শিশিটাতে ভরে নিয়েছি সেই পুণ্যবারি, ১৪৪ বছরের মধ্যে আর ত্রিভুবনে ও-জল মিলবে না তো!
বাজার থেকে খাবার নিয়ে যাঁরা ফিরলেন তাঁরা খবরও নিয়ে ফিরলেন। ‘সন্দেশ’ শব্দটি প্রকৃত অর্থেই সেদিন ব্যবহৃত হল (প্যাড়ার প্রসঙ্গে অবশ্য!)—জোর খবর। তবে নিশ্চিত কিনা জানা যাচ্ছে না—ওঁরা শুনে এসেছেন লোকসভা ভেঙে দিয়েছেন ইন্দিরা, ভারতবর্ষে নির্বাচন ঘোষণা করা হয়েছে।
দিনটা ১৯শে জানুয়ারি, তখন সন্ধ্যাবেলা। মৌনী অমাবস্যার পুণ্যলগ্নে ১৪৪ বছর পরের বিশেষ যোগটিতে যে ভারতবর্ষের ভাগ্যবিধাতাও অন্তরীক্ষে একটি বিশিষ্ট সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তার পূর্ণ মর্মোদ্ধার করতে বিশে মার্চ হয়ে গেল। সেই সন্ধ্যায় খবরটাকে সত্যি বলে মনে করিনি আমরা। হাতে-নাতে এতখানি পুণ্যলাভ তো চট করে বিশ্বাস করা শক্ত? খবরটা শুনে উচ্ছ্বসিত না হয়ে, আপাতত ওটাকে ‘গুজবে কান দিবেন না’‘ পলিসিতে শিকেয় তুলে রেখে, অনেক রাত পর্যন্ত কুম্ভস্নানের গল্প করতে করতে একসময় ঘর সত্যিই নির্বাক হয়ে গেল। নিশ্চিন্ত ঘুমিয়ে পড়লুম আমরা। একটা টানা বিছানায় ছয় পরিবারের ছ’জন মানুষ। গঙ্গা যমুনা সরস্বতীর দ্বিগুণ ধারা মিলিত হল সেই পুণ্যতীর্থের প্রীতিময় নির্ভরতায়।