স্বর্গবাস পর্ব – পথ

স্বর্গবাস পর্ব – পথ

আরও খানিক হেঁটে গিয়ে, শুনতে পাই মাইকে কীর্তন গাইছে একটি মধুর ভরাট স্বর—’দেখে এলাম তারে সখি…’ আমরি বাংলা ভাষা! মাত্র ক’টা দিনই তো মোটে? কদিন আছি আমি কলকাতার বাইরে? মোটে চারদিন। অথচ মনে হচ্ছে যেন বৎসরাধিক কাল গত। বাংলা কীর্তনে মনপ্রাণ পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। সামনেই ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ। সেখানেই গানটি হচ্ছে। তার ঠিক পাশেই আনন্দময়ীর আশ্রম। পৌঁছেই শার্দূল সিং ব্যস্ত হয়ে পড়লেন স্বরূপানন্দজীর খোঁজে। ইতিমধ্যে ব্যাগ থেকে একটি ক্যাডবেরি চকোলেট বার, যা হায়দ্রাবাদ এয়ারপোর্টে চন্দ্রশেখর আমাকে উপহার দিয়েছিল, বের করে আমি দু’ ভাগ করে বাচ্চা দুটোর হাতে দিলুম। তারপর তাদের চোখেমুখে যে আশাতীত আহ্লাদটি তখন দেখেছি, তাতেই পূর্ণকুন্ত, অমৃতকুম্ভের স্বাদ আমি পেয়ে গিয়েছি। চকোলেটের কাগজ আর রাংতাটাও তারা আমার কাছ থেকে চেয়ে নিলে। লজ্জায় মনটা ছোটো হয়ে গেল, এই আমার দেশ! সুখী-দুঃখীতে কতটা বিপুল ফারাক আছে বলেই না দুটো গরীব বাচ্চাকে মোটে আধখানা করে চকোলেট খাইয়ে আমি পুণ্যার্জনের দিব্য আনন্দ উপভোগ করছি? অহো, কী পুণ্যাত্মা কী দরিদ্রদরদী ব্যক্তি!

দারিদ্রের সুযোগ নেওয়া এখানে পুরোদমে আইনসিদ্ধভাবে চলে বলেই না আজ আমি পৌঁছেছি গঙ্গাদ্বীপে? চাইল্ড লেবার এক্সপ্লয়েট করে? ওরা না থাকলে আমার আসা হতো?

মনে পড়ল এক বন্ধুর কথা, যিনি সম্প্রতি বিলেত থেকে ফিরে বম্বেতে এয়ার লাইন্সের দামী হোটেলে রাত্রিবাস করতে গিয়ে আঁতকে উঠেছিলেন এটা আবিষ্কার করে, যে চৌদ্দ পনেরো বছর বয়সের অপাপবিদ্ধ মুখের হোটেলবয়গুলির প্রত্যেকেই আড়কাঠি। সবরকম পাপ-কাজে পারদর্শী। বে-আইনী মদ চাই? গণিকা চাই? স্মাগলার চাই? সব আছে তাদের কাছে। এই তো আমার দেশ! এর গরীবী কি সহজে হটবে? গরীবী ঢুকে পড়েছে আমাদের মজ্জার ভেতরে, ঘুণ ধরিয়েছে হাড়ে।

লালা বলল, রাত অনেক হয়েছে, সাড়ে সাতটা আটটা বাজে, ঝুঁসীতে আমরা কখন ফিরব? অনেক রাত্রি বেড়ে যাবে যে? সত্যই তো। আমি তো এখনও ট্যুরিস্ট ব্যুরোর খোঁজ পেলুম না। ঠিক আছে। ওদের তো ছেড়ে দিই। তারপর যা হবার তা হবে। দু’জনের হাতে দুটো দশটাকার নোট দিতে অবাক হয়ে দুই ভাই পরস্পরের হাতের দিকে তাকাল তারপরেই গোঙা তার নোটটি আমার দিকে এগিয়ে দিল। লালা বলল—’এ দোনোই দস দস রূপাইয়াকা নোট হ্যায়। পাঁচ পাঁচ দিজিয়ে।’ তখন তাদের গাল টিপে দিয়ে যেই আমি বলেছি ‘দুটোই তোমাদের দু’জনের’—অমনি গোঙা হঠাৎ খাস মিলিটারি কায়দায় পায়ে পা ঠুকে আমাকে একটা শ্যালুট ছুঁড়ে দিলে, একগাল হাসি সমেত। ও বাবা, ছেলের আবার রঙ্গরসিকতার জ্ঞানও টনটনে। সেই দৃশ্য দেখে লালা গোঙার পিঠে একটা তিরস্কারের হালকা ঠোকর মারল, আর অতিভদ্র লৌকিক কায়দায় আমাকে একটি সভা-শোভন সেলাম করেই, গোঙার হাত ধরে ছুট লাগাল। আবার অতটা পথ। এখন ওরা কত-দূর ছুটবে!

আমি বুঝতে পারলুম না আশ্রমের ভেতরে ঢুকবো, না ঢুকবো না। শার্দূল সিং ইতিমধ্যে এসে তাঁর মালপত্র নিয়ে ভেতরে গেছেন, তাঁর ঘর-খাটিয়া জুটে গেছে। জামাই মেয়ে ব্যবস্থা করে রেখেছে তাঁর। এবার গেছেন আমার জন্য খোঁজ করতে। আমি বসে পড়লুম বাইরে, রাস্তার ধারে, একেবারে ধুলোর ওপরে। শরীরে আর দাঁড়াবার শক্তি নেই। সুটকেসটাতে বসার উপায় নেই। তার ডালাটা নরম তলতলে চামড়ার। ছিঁড়ে যাবে। অপেক্ষা অনেকক্ষণ হল। শার্দূল সিং ফিরলেন না আর। ইতিমধ্যে একজন চেনা বাঙালী মন্ত্রী ভি. আই. পি. গাড়ি থেকে নেমে আশ্রমে ঢুকলেন। সঙ্গে পরমাসুন্দরী স্ত্রী। যেহেতু বহুদিনের পারিবারিক আত্মীয়তা, আমি নিজের অজান্তেই চেঁচিয়ে উঠলুম—’অমুক বৌদি।’ বৌদি থমকে দাঁড়িয়ে চারিদিকে চাইলেন, কিন্তু ধুলোয় বসে-থাকা আমাকে দেখা গেল না; ওঁদের চারিপাশে উৎসুক জনতার ভিড় জমে উঠে দৃষ্টির আড়াল গড়ে দিল। তাঁরা ভেতরে ঢুকে গেলেন। এবার আমি সুটকেসের ওপরেই মাথা নামিয়ে একটু শোবার মতো চেষ্টা করি। কী অসীম ক্লান্তি। তীর্থস্থানের এমনই মজা, রাস্তার ওপরে শুতে কোনো অসুবিধাই হয় না, অন্তত আমার তো নয়। খানিক বাদে মাথা তুলে আশ্রমের দিয়ে চেয়ে শার্দূল সিংকে খুঁজছি, দেখি মন্ত্রীমশাই সস্ত্রীক বেরিয়ে আসছেন। এবার বৌদি আমাকে যাতে দেখতে পান আমি তাই উঠে দাঁড়ালুম। বৌদিও নিজেই ছুটে এগিয়ে এলেন, খুশী গলায় বললেন—’তাই বলি আমার ডাকনাম ধরে ওখানে কে ডাকবে!’ তারপর সেই অবধারিত প্রশ্নগুলি এসে পড়ল—কবে এলে, কোথায় উঠছ, কাদের সঙ্গে এসেছ। উত্তরগুলো শুনেই বৌদি আঁতকে উঠলেন।

—’সে কি? এক্ষুনি এলে? আজকের এই সাংঘাতিক ভিড়ে? ওঠবার ব্যবস্থা না করেই? কী সর্বনাশ। অ্যা? ছি ছি ছি একা একা মেয়েমানুষ হয়ে কখনও কুম্ভে আসে কেউ? তুমি কি পাগল? চলো চলো দেখি ওঁকে বলে তোমার কী ব্যবস্থা করা যায়।’

ব্যস্ত হয়ে বৌদি স্বামীর কাছে ছুটলেন, আমার হাতটি নিজের হাতে শক্ত করে ধরে। গাড়ির কাছে গিয়ে আমি হাত ছাড়িয়ে নিই—বুঝতেই তো পারছি এ যাত্রায় আমার ভি. আই. পি. ট্রিপ কপালে নাচছে। নইলে এই ভিড়ে এত আকুল হয়ে চেনামুখ খোঁজার ফলে হবি তো হ’ মন্ত্রীমশায়ের সঙ্গে দেখা? আমার স্থানে অস্থানে ভি. আই. পি. হওয়া ঠেকাবে কে?

কিন্তু বৌদির কাছে সব শুনে মন্ত্রীদাদা যে খুব আশ্বাস দিলেন তাতো মনে হচ্ছে না? বরং বৌদির ক্রমশ নিষ্প্রভ হয়ে আসা করুণ মুখচ্ছবি একটা মোগলাই ধমকেরই আভাস দিচ্ছে (আনুমানিক অ্যা? ফের তুমি এসব বাজে ঝামেলা জোটাতে গেছ? আমি বাপু কিছু করতে পারব না, এই বলে দিলুম—গোছের সায়ার্ডিং সম্ভবত) ব্যাপারটা আন্দাজে সমঝে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে এক মুহূর্তও লাগল না। গলা উঁচু করে, গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ঘোষণা করি—’বৌদি আমার থাকার কোনোই ভাবনা নেই, ট্যুরিস্ট ব্যুরোতে ডি. কে. বর্মণের কাছে আর পি. বি. আইতে চতুর্বেদীর কাছে চিঠি আছে।’ বৌদির মুখে আবার আলো জ্বলে উঠল।’তবু? সেইখানেই তো যাচ্ছি আমরা। চলো চলো তোমাকে প্রেসের ওখানে নামিয়ে দিই।’ দাদাও একবাক্যে এই প্রস্তাবে রাজী হন। এবারে আমিই প্রশ্ন করি—’কত দূর হবে প্রেসের অঞ্চলটা, সঙ্গম থেকে? রাত্রি দুটোয় লগ্ন পড়বে, তখন স্নান করতে আসা যাবে তো? সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রীর সহচর অমাত্যটি সোৎসাহে জানালেন ‘সঙ্গম? বারো মাইল দূর।’ আমার মাথায় বাজ পড়ল। বা-রো-মা-ই-ল? এই ক্লান্ত পায়ে অতটা আর পারব না হাঁটতে। ‘আর এখান থেকে সঙ্গম কতদূর?’ এবার মন্ত্রীমশাই বলেন—’মাইল দেড়েক হবে বড়ো জোর।’—। সিদ্ধান্ত পাকা। ‘আপনারা তবে আজ আসুন ভাই বৌদি—আমি আর যাব না। আমি আজ সঙ্গমে স্নান করতে চাই, মধ্যরাত্রে।’—সুতরাং দাদা বৌদি হাত নেড়ে ধুলো উড়িয়ে ভুশ্ করে মিলিয়ে গেলেন।

আমার এতক্ষণে মনে পড়ল—আমার ব্রিফকেস, সুটকেস, জলের ফ্লাস্ক অর্থাৎ লোটা, কম্বল সবই পড়ে আছে অরক্ষিত অবস্থায় রাস্তায় ধারে। গিয়ে দেখি যথার্থই আছে সব। কেউ ছোঁয়নি। যাক। পুণ্যক্ষেত্র বলে কথা! এবারে পিঠটা পেতে এই ধুলোমাটিতেই একটু শুতে হবে। কম্বলটা বিছিয়ে নেবার ব্যবস্থা করা দরকার। আনন্দময়ী মায়ের আশ্রমে ঢুকেই একটা ছাউনি মতো আছে, সেখানে অনেক গ্রাম্য মানুষকে ধুলোয় কম্বল পেতে শুয়ে থাকতে দেখেছি। আমিও ঐখানেই চলে যাই। কিন্তু না, জায়গা নেই। ভেতরে ঢুকতে পারি না। দোরের কাছেই একটু জায়গায় মালপত্র রেখে, কম্বলটা পেতে, শুয়ে পড়ি! বড্ড ধুলো সত্যি। কিন্তু যে-সে ধুলো তো নয়, তীর্থরেণু। কত সাধুসন্ত কত পুণ্যার্থীর পদরজঃকণা। এতে নিশ্চয়ই আমার অ্যালার্জি নেই। এতই কি পাপী আমি, যে what dust-book-dust-pollendust—এর মতোই তীর্থরেণুতেও অ্যালার্জি থাকবে? কক্ষনো নয়। হাঁপানি হবে না আমার। উড়ুক যত খুশি ধুলো। সত্যিই কিন্তু শুয়ে পড়েছি এবার। আঃ! জয় কুম্ভ!

.

জানি না কটা মুহূর্ত শুয়েছিলাম—হেনকালে তিনটি দীর্ঘ ছায়ামূর্তি নিঃশব্দে পাশে এসে দাঁড়ায়। পরনে কালো কালো ওভারকোট, দু’জনের মুখে-মাথায় বাঁদুরে টুপি ঢাকা, একজনের মাথাগলায় চেককাটা মাফলার জড়ানো। প্রত্যেকেরই হাত দুটি পকেটে। হাত পকেটে কেন? পকেটে কি রিভলবার আছে? কী আছে পকেটে?

১নং–’আপনি তো বাঙালী?’-আমি চমকে উঠি।

–’কেন বলুন তো?’

২নং—’অমুকবাবু মন্ত্রীর সঙ্গে বাংলায় কথা বলছিলেন দেখলাম-আপনিই তো?’

-’আজ্ঞে হ্যাঁ।’ কী সর্বনাশ! কারা এরা? জেরা করছে কেন? আমি কি কোনো দোষ করে ফেলেছি? এরা কি গুণ্ডা? এরা কি পুলিশ? এরা কি গোয়েন্দা? এরা কারা? ভয়ে পেটের মধ্যে হাত পা সেঁধিয়ে গেছে! কি জানি বাবা কী অন্যায় করলুম আবার। এভাবে মন্ত্রীর সঙ্গে কি কথা কইতে নেই? নাকি এটা ট্রেসপাসিং? আমি যেহেতু আনন্দময়ীর শিষ্যা নই, ওঁর ছাউনিতে ঢোকা বোধ হয় উচিত হয়নি আমার। তাড়াতাড়ি উঠে পড়ি। এখন যাই কোথায় মালপত্তর নিয়ে? কুতঃ? কুত্ৰ?

১নং—-’আপনি ওঁদের সঙ্গে গেলেন না কেন? ওঁরা তো ডাকলেন।’

–’আমি স্নান করতে চাই। প্রেসের ওখান থেকে সঙ্গম বহুদূর। তাই যাইনি।’

২নং—’আপনি এভাবে ধুলোয় শোবেন না দিদি, উঠুন। এ্যাতো ভালো শাড়ি পরে কেউ কুম্ভের মেলাতে আসে? একেবারে শেষ হয়ে গ্যালো যে। ছি ছি।’

—(সত্যি তো—এত ভালো কাপড় আমার মাত্র দু’একটাই আছে।)—’নাঃ। ঠিক আছে।’—’আমাদের সঙ্গে চলুন।’

–’আপনারা কোথায় উঠেছেন!’

১নং—’আমরাও অবিশ্যি কোনও জায়গা পাইনি, তবে চেয়ারে বসার জায়গা দিতে পারি আপনাকে। তা ছাড়া মাথার উপরে ছাউনি পাবেন।’

–’ছাউনি তো আছে আমার মাথায়।’

২নং—’কোতায় আচে? আপনি নিজে তো বাইরে।’

—মাথার ওপরে চেয়ে দেখি, আরে, তাইতো, ছিছি, আকাশ যে। একেবারেই ভিতরে ঢুকতে পারিনি? অথচ মালগুলো রয়েছে ছাউনির মধ্যে দিব্যি। কেবল নিজেই আমি রয়ে গিয়েছি বাইরে। এ যেন ক্ষান্তবুড়ির দিদিশাশুড়ির বাড়ির গল্প হল। টাকাগুলো বাইরে রেখে যাঁরা নিজেরা থাকেন সিন্দুকে। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বলি—’মশাইরা আমাকে যেখানে ছাউনির তলায় বসাবেন, সেটা কি অনেক দূরে?’ তাঁরা বললেন—’মোটেই না, এই ঠিক পাশের তাঁবুতে।’ তারপরে আর একজন আমাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন—‘আমাদের সঙ্গে মেয়েছেলেরাও রয়েচে দিদিভাই! সুধু মৃদু ভয় পাবেন না যেন। আপনি বাঙালী মেয়েছেলে হয়ে এমনি এগলাটি এই ভিড়ভাট্টার মদ্দে—-তাই।—আমাদের যেন ভুল বুইবেন না।’

—মোটেও ভুল বুঝিনি। মোটেই ভয় পাইনি। আমার ভয়টা কাকে? গেলে তো যাবে কটা কাপড়, কখানা বই। যাক না। আমার সংসার-জ্ঞান হয়েছে বৈকি। আমি তো জানি, সবই যায়। একদিন কিছুই ছিল না একদিন কিছুই থাকবে না। ভয়টা কিসের? ভয় করলে আর আমি আসি এখানে? ভয়ের দিকটাতে নজর দিই না, আমি চোখ মেলে থাকি ভালোবাসার দিকটাতে। এই তো তোমরা তিনজন হৃদয়বান বাঙালী ছেলে, মানুষের সহজ শুভার্থী তোমরা, তোমাদের কাছে এখনই আমি কৃতজ্ঞ। অজ্ঞাতকুলশীল একজন পথবাসী মানুষ, তার মাথায় শিশির না পড়ুক, কাপড়ে ধুলো না লাগুক, এটুকু যে চেয়েছ তোমরা, এজন্যেই আমি আন্তরিক কৃতজ্ঞ। মানুষের জন্যে এটুকু চাইবার মতো মানুষও যে জগতে আমাদের থাকে না। তোমাদের হৃদয়ের অমৃতকুম্ভ চিরকাল পূর্ণ থাকুক, তার পুণ্যধারায় স্নান করুক আমার মতো হাজার জন ভাগ্যবান স্নানার্থী।

তিনজনের হাতে হাতে উঠে গেছে আমার সুটকেস, ব্রিফকেস, লোটাকম্বল, ফুটুনি-ঝোলা। চললুম পাশের তাঁবুর দিকে। সেখান থেকে মাইকে সজোরে গান আসছে—দিব্যি কথকতা করে লবকুশের গাথা গাইছেন একজন বাঙালি গায়ক। সুন্দর গলা। ঢুকে কোটপ্যান্ট মাফলার পরা গায়ককে দেখাও গেল মঞ্চে। মঞ্চের সামনে অজস্র মানুষভর্তি চেয়ার। একজায়গায় গিয়ে সব মালপত্র নামিয়ে দিলে ছেলেরা।—’অ দাদু, দাদু, এই দেখুন আপনার আরেক নাতনী। এঁর মালপত্তরগুলো আপনি ভালো করে রাখুন। খোকন ভাই একটু উঠে দাঁড়াও, এই দিদি খুব টায়ার্ড, আরেকটু হলেই রাস্তায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ছিলেন। এঁকে আগে একটু বসতে দে।’—মুহূর্তেই যেন পাড়ার পুজো প্যান্ডেলের আবহাওয়ায় এসে পড়েছি। দাদু বললেন—’আও নাতনী আ যাও, ওয়েলকম টু আওয়ার হোমলেস হোম—মালপত্তর কই? আরে বেটা বৈঠ যাও। রাত দুটো পর্যন্ত বসে বসেই ঘুম মারো ঘুম—আর আমি ততক্ষণে এদের কোনো আখড়ায় ঢুকে লুকিয়ে লুকিয়ে দম্ মারো দম্ করে আসি অ্যা? হা হা হা।’

—ছেলেগুলি বলল—’এখন দম্ মারবেন না দাদু, মালপত্তরগুলো সামলে থাকুন। আমরা একটু চা খেতে যাচ্ছি।’ বলে চলে গেল তারা। একটু পরেই আমার খেয়াল হল—কী যেন বলল—চা? ওরা চা খেতে গেল না? অমনি আমি লাফিয়ে উঠি। ‘দাদু আমিও যে বিকেলে চা খাইনি—সেই বেলা তিনটে থেকে হাঁটছি।’

—’অ্যা? বেলা তিনটে? সে কি রে? এখন তো ন’টা বাজে। এতক্ষণ তুই হেঁটেচিস কি-রে? কলকাতা থেকে স্ট্রেট পায়ে হেঁটেই এলি বুঝি? যা, যা, আমি বাক্সটা দেখছি, তুই শিগির চা খেয়ে আয়।’—আমি দুড়দাড় করে উঠে পড়ি। ‘তুই’ সম্বোধনে ফের শুকনো চোখে জল এসে যায়। বৃদ্ধ ভদ্রলোকের মস্ত সাদা পাকানো গোঁফ। আমার বাবার গোঁফের কথা মনে পড়ে যায়। স্বভাবটাও এঁর তেমনই জমজমাট। এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক বলেন—’আপনি কোত্থেকে আসছেন?’

-’আপাতত হায়দ্রাবাদ থেকে’—আমি চাই না কলকাতা, ‘ভালো-বাসা’-বাড়ি—যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় যাবতীয় কুলুজি এখন ঘাঁটাঘাঁটি হোক। ঐ ছেলেরা তো কিছুই জানতে চায়নি। মনে হল হঠাৎ ‘হায়দ্রাবাদ’ শুনলে হয়তো ইনি চুপ করে যাবেন। এবং গেলেন-ও। দাদুর কাছে মালপত্র রেখে আমি তো বেরোলুম—চায়ের খোঁজে। এমন সময়ে আরেকটি ছোকরা এসে আমাকে একটু গোপন গোপন স্টাইলে, বেশ ঘনিষ্ঠ সুরে বললে-’অম্বিকা সোনি কি এখনও হায়দ্রাবাদে?’

—‘আজ্ঞে?’

-’মানে, কদিন আগেই তো সঞ্জয় গান্ধী হায়দ্রাবাদ গিয়েছিলেন, দারুণ ক্রাউড় হয়েছিল, ওখানে ওঁর ভয়ানক হোল্ড। তাই বলছি অম্বিকা সোনি কি এখনও হায়দ্রাবাদে?’

শুনে আমি ধম্‌কে উঠি—

-’সে আমি কেমন করে জানব মশাই? আমি কি রাজনীতির লোক? আমি ওসব জানিটানি না কে কোথায় থাকে।’

-’রাজনীতির লোক নন? তবে যে ওরা বলল অমুক মন্ত্রীর সঙ্গে খুব দহরম-মহরম আছে আপনার!’

হায় রে! দহরম-মহরম! তাহলে কি সেজন্যেই আমার প্রতি এই কৃপাদৃষ্টি? নির্ঘাত তাই।

–’দেখুন, দহরম-মহরম নয়, ওঁরা আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয়।’

—’ওই একই হল। তা শুনলাম আপনি নাকি অমুক মন্ত্রীর ইনভিটেশন রিফিউজ করেছেন ‘আমার এই ধুলোই ভালো বলে? সত্যই দারুণ মনের জোর আপনার—তাই ভাবলুম আপনি নিশ্চয় যুব কং–’

‘না মশাই না। রিফিউজ করব কেন, ইনভিটেশন কোথায়? একটা লিফ্ট দিচ্ছিলেন ট্যুরিস্ট ব্যুরোয়। সেটা নিইনি, সঙ্গম থেকে বহু মাইল দূর হয়ে যায় বলে। এটা কোনো ব্যাপারই নয় মশাই। ওসব ছাড়ুন, তার চেয়ে বলুন দিকি চায়ের দোকানটা কোথায়? ‘

-’চলুন, চলুন দিদি, নিয়ে যাচ্ছি। স্যরি। কিছু যেন মনে করবেন না। ভুল হয়ে গেছিল।‘

.

ফের অনেকখানি হেঁটে চৌমাথায় এলুম। সেখানে দোকানে দোকানে বারকোশের ওপরে মণ্ডা মিঠাই, লাড্ডু পুরির পাহাড়, পাঁপড় ভাজারও। ঘিয়ের গন্ধ ম-ম করছে বাতাসে। তারই পেছনে একটি টুলে বসা একটি রাগী চেহারার লোকের সামনে মাটিতে এক ঝোড়া মাটির ভাঁড় এবং উনুনে কেটলি। এবং সামনে গিজগিজ করছে শীতার্ত তৃষ্ণার্ত মানুষ, সে চা দিচ্ছে, আটআনা করে ভাঁড়। যথেষ্ট ছোটও। দুর্ভাড় না খেলে তেষ্টা মেটে না, কিন্তু দু’ভাঁড় পাওয়া সোজা নয়। র‍্যাশনিং আছে, কিউ আছে, আর গালাগাল আছে। আট আনা পয়সা হাতে দিলে, সে খালি ভাঁড়াটাই শুধু আপনাকে দেবে, তারপর ভাঁড়টা পেতে দাঁড়ালে আরেকজন সেই ভাঁড়ে চা ফ্রী ঢেলে দেবে। তার জন্য আর পয়সা লাগবে না। কিন্তু চা-ওলার কী মেজাজ! একটি ভদ্রলোক আট আনা টেবিলে রেখে নিচু হয়ে যেই ভাঁড়টি হাতে তুলে নিয়েছেন, অমনি সে খপ্ করে তাঁর হাতটি ধরে ভাঁড়টি কেড়ে নিয়ে যাচ্ছেতাই একটি গাল দিল। সে আধুলিটাকে দেখতে পায় নি। চোখে আঙুল দিয়ে জলজ্যান্ত সুগোল আধুলিটা দেখিয়ে দেবার পরে সে হাত ছাড়ল এবং ভাঁড় তুলে দিল বটে কিন্তু দুঃখ প্রকাশের ধার দিয়েও গেল না। অথচ ওর কাছেই চা খেতে হবে। কাছাকাছি সে-ই একমেবাদ্বিতীয়ম্ চা-ওলা। অন্য চা-ওলা খুঁজতে আবার এক মাইল কে হাঁটবে? বিনয়ী না হয়ে উপায় নেই। স্বার্থ দদাতি বিনয়ম।

চা খেতে খেতে আলাপ হল একটি ‘দাদা’ এবং একজন ‘বৌদির সঙ্গে। যে-ছেলেরা আমাকে ‘পথের ধূলা হইতে কুড়াইয়া’ ছাউনির তলায় এনেছে, সেই ছেলেদের দলপতি এই দাদা। ছেলেরা তাঁর মত নিয়ে নিয়েছে, অবলা এই নারীটিকে তিনি দলভুক্ত করতে রাজী হয়েছেন। জনাপঞ্চাশেক মিলে দল বেঁধে এসেছেন কয়েকটি মোটরগাড়ি করে, সোজা পশ্চিমবাংলা থেকে। যাঁহা পঞ্চাশ তাঁহা একান্ন! আর আলাপ হল একজন চক্ষু চিকিৎসকের সঙ্গে, যিনি আমাদের এক বন্ধুর (অশোক রুদ্র) চোখের রেটিনায় অস্ত্রোপচার করেছেন। যেমন তাঁকে নামে চিনি, দেখা গেল অমলবাবুও তেমনি আমাকে লেখায় চেনেন। আমাকে লেখায় চেনেন এমন তীক্ষ্ণ স্মৃতিশক্তির মানুষ তো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে বিরল, তাই কোথাও একজন ‘পাঠক দেখতে পেলে ধন্য হয়ে যাই—আর তাকে ভুলি না। চা-পর্ব মিটিয়ে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এগোই। এঁরা এখন যাবেন ঘুরতে। ওরে বাবা! আবার ঘোরা! আমি বলি—আমি ওই ছাউনির নিচেই কম্বল জড়িয়ে মাটিতে লম্বা হব। পিঠটা যেন ভেঙে পড়ছে। এক ঘণ্টা আমাকে শুতেই হবে। যেখানে হোক। মধ্যরাত্রে স্নান করা এখনও বাকী। অমলবাবু বললেন, ভাবনা নেই, একটু শোবার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। দল বেঁধে বেশ কিছু দূর হেঁটে যাবার পরে, এবার একগুচ্ছ ছোটো ছোটো তাঁবুর পিছনদিকে এসে পড়লুম। নানাবিধ সাধু-সন্ন্যাসীর আশ্রম সেখানে, পাহাড়িবাবা, কাঠিয়া-বাবা, কত নাম। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ে একে একে এঁরা বাঁশের বেড়াটি ডিঙোলেন। এটা অবশ্যই এই তাঁবু অঞ্চলের চত্বরে ঢোকার সদর রাস্তা নয়। ওপার থেকে আমার দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করছেন দেখে আমিও চট করে বাঁশের বেড়াটি ডিঙিয়ে ফেললুম—এসব তুচ্ছ বিষয়ে যে আমাকে নিয়ে ওঁদের চিন্তার কোনোই কারণ নেই সেটা বোঝাতে। নিশ্চিত হয়ে তাঁরা এবার ডাকাডাকি শুরু করলেন একটি নাম ধরে। রাত্রি তো অমাবস্যার, শীত প্রচণ্ড, কুয়াশাও আছে, ধুনির ধোঁয়ায় সারা অঞ্চলটি ঘোর আচ্ছন্ন। হাঁকডাক শুনে এক ভদ্রলোক সেই ধূমজাল ফুঁড়ে যাদুবলে উদ্‌গত হলেন। ভদ্রলোক বাঙালী। তাঁর হাতে আমাকে সমর্পণ করে বলা হল—’এঁকে একঘণ্টা শুতে ঠাঁই দাও তোমাদের তাঁবুতে। ইনি অত্যন্ত ক্লান্ত। প্রমিস করছি উটের মতো অঘটন ঘটবে না।’

-’কিন্তু আমাদের তাঁবু যে খুবই ছোটো এবং ভর্তি।’

-’এক ঘণ্টা পরেই আমরা এসে এঁকে তুলে নিয়ে যাব। কথা দিচ্ছি এ ব্যক্তি সারারাত জাঁকিয়ে থাকবে না তাঁবু জুড়ে। ডোন্ট ওয়ারি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *