তিরুপতি পর্ব
তিরুপতিতে নেমে দেখি ওখানকার টাউন কংগ্রেসের তেলুগুভাষী সভাপতি আই. এস. বাসু ও মন্দির অঞ্চলের মিউনিসিপ্যাল কাউন্সিলার শ্রীপার্থসারথি আমাকে নিতে এসেছেন। আমাকে দেখামাত্র তাঁরা যারপরনাই দুঃখিত হলেন, বেশ বোঝা গেল। হায়, কেন যে ঈশ্বর আমাকে এমন ব্যক্তিত্বহীন দৃশ্য দিয়েছেন! বাবার খানদানী গোঁফ জোড়াটা যদি না-ও পাই, নিদেনপক্ষে মায়ের মতো ওজনদার ব্যক্তিত্বটা তো দিতে পারতেন। ত্রিপুরায় যেবার যাই, আমার প্লেনে দিল্লীর একটি ফিটফাট ছাত্রীও যাচ্ছিল, দিব্যি মেমসাহেবী কায়দায় শাড়ি চুল মুখ নখ সব তৈরি করা। বাপরে—সে কী স্মার্ট! প্লেন থেকে নেমে হেঁটে টার্মিনাসে যেতে যেতে দেখলুম ফুলটুল নিয়ে কিছু মানুষ তার দিকে সম্মোহিত হয়ে ছুটে গেলেন। ওদিকে আমি এক শিশু কোলে বিব্রত মহিলাযাত্রীর পোঁটলা বগলে করে পেছন পেছন আসছি। এবার অবশ্য তাঁরা সহজেই আমাকে চিনলেন। কেননা তৃতীয় কোনো মহিলাযাত্রী ছিলেন না। আমার তাই এহেন দুর্ভাগ্যে দিব্যি অভ্যাস আছে!
বাসু ও পার্থসারথি বিরসবদনে আমাকে প্রথমেই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস দেখাতে নিয়ে গেলেন। পাহাড়ের কোলে সুদৃশ্য নতুন বিশ্ববিদ্যালয়টি মন্দিরের টাকায় চলে। ওপাশে শ্রীভেঙ্কটেশ্বর বয়েজস্কুল সেও মন্দির ফান্ড থেকে চলে। এঞ্জিনিয়ারিং, এগ্রিকালচার, নানা বিভাগ রয়েছে। ছাত্রদের, অধ্যাপকদের বাসস্থানের দিব্যি সুব্যবস্থা দেখলুম। উপবন গড়ে আশ্রমিক আবহাওয়া সৃষ্টির চেষ্টাও আছে, পথের দু’দিকে পাথরের বেদীতে প্রাচীন প্রস্তরমূর্তি বসানো সারিবন্দী। দেখেই কুচিন্তা মনে এল-হায়রে! সম্ভবত এগুলো উপড়ে নিয়ে অচিরেই মার্কিন টুরিস্টদের কাছে বেচা হবে। প্রত্যেকটিই যে হিন্দু দেবদেবীর মিথুনমূর্তি। বিদেশীদের বড়ো মনের মতো। গৃহস্থালির শোভাবর্ধন করবে। পরের বারে এলে কি আর এঁদের সঙ্গে দেখা হবে? হয়ত তদ্দিনে এঁরা সাগরপারের ড্রয়িং-রুমে!
এরপর শ্রীবাসুর বাড়িতে। বাসুবাবুর এখানে প্রবল প্রতিপত্তি। বিরাট বিরাট বিজনেস ম্যাগনেট তিনি। তাঁর একটি সিনেমা হাউস আছে, তারও নাম ‘আই এস’। সেখান থেকে খেয়েদেয়ে মন্দিরের পথে রওনা। সাতমাইল হেঁটে মন্দিরে ওঠবার রাস্তা আছে, তিরুমালা পাহাড়ের গা বেয়ে। অতীতে একসময়ে চোল রাজা কৃষ্ণদেব ছিলেন তিরুপতিনাথের মহাভক্ত, তিনি তিরুপতিকে প্রণাম না করে জল খেতেন না। তিনি তাই এ মন্দিরের নকলে পাহাড়ের নিচে একটি মন্দির করেছিলেন নিজের প্রাসাদের কাছেই। তাতেও তিরুপতিনাথ ভেঙ্কটেশ্বরের অবিকল মূর্তি আছে। দুই মন্দিরের মাঝখানে সারাটা পথেই একসারি ঘণ্টা বসিয়েছিলেন তিনি। পাহাড়ের চুড়োয়, মন্দিরে পুজো শুরু হবার ঘণ্টা বাজলেই সেই ঘণ্টা থেকে আর এক ঘণ্টায় তার সংকেতধ্বনি বেজে উঠত। এভাবে ঘণ্টা থেকে ঘণ্টায় ধ্বনিত হয়ে খবর পৌঁছে যেত রাজা কৃষ্ণদেবের মন্দিরে। সেখানেও তক্ষুনি পুজো শুরু করতেন রাজা স্বয়ং। এত ভক্তি সত্ত্বেও রাজা যে শুধু নিজেই যবনদের কাছে হেরে গেলেন তাই নয়, শেষ পর্যন্ত তাঁর বংশলোপ হল। কেন যে এমন হয়? আমাকে গল্পটা বলে শ্রীপার্থসারথি খুব বিমর্ষ হয়ে পড়লেন। তখন আমি বললুম কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, শ্রীঅরবিন্দ, শ্রীরামকৃষ্ণদেব এঁদেরও তো বংশলুপ্তি ঘটেছে। যাঁরা সন্ত, পুণ্যবান ব্যক্তি, তাঁদের তো পুনর্জন্ম হয় না। তাঁরা সবংশেই উদ্ধার পেয়ে যান বোধ হয়। এই ব্যাখ্যাটি পার্থসারথির মনঃপূত হল। তিনি বলতে শুরু করলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলি পড়ে তাঁর কেমন লেগেছিল, পঞ্চাশ বছর আগে। তিনি রবীন্দ্রনাথকে ঋষি বলে মনে করেন। সাধক না হলে কেউ অমন লিখতে পারে না। বাসু কথা কন কম। ড্রাইভার ছাড়া, একটি বৃদ্ধ আর একটি খোকা এই দুটি ভৃত্যও চলেছে সামনের সীটে। বাসু মাঝে মাঝে তাদের সঙ্গে কথা বলছেন তেলুগু ভাষায়। হঠাৎ বললেন—’বড্ড মুশকিল! তিরুপতিতে আজকাল বড্ডই ভি. আই. পি. সমাগম হচ্ছে। তাদের আনো, রাখো, ঘুরিয়ে দেখাও—ওঃ কী ঝামেলা।’ ইংরিজিতেই বললেন। বেশ স্পষ্ট ভাষায়। ‘আ রিয়াল নুইস্যান্স’। আমার মাথায় বাজ পড়ল। তাঁর গাড়িতেই বসে আছি। পেটে তখনও গজগজ করছে তাঁর সুন্দরী স্ত্রী কৃষ্ণবেণীর রান্না করা অপরূপ কেশর হালুয়া। বাসুর নতুন ঝকঝকে বাড়িতে তাঁর রূপসী স্ত্রীকে খুব মানায়। স্ত্রীর রন্ধনপটুত্বে স্বামী রীতিমতো গর্বিত। বিশিষ্ট অতিথিরা কে কী বলে গেছেন তাঁর হাতের রান্না খেয়ে, বাসুর তা ঠোটস্থ। যত্ন করেই তো ঠাকুরঘর শোবার ঘর সব ঘুরিয়ে দেখালেন নতুন বাড়ির। তারপর এইরকম কথা বলাটা কি ঠিক হল ওঁর? এ কেমন আতিথ্য? তারপরেও বাসু কিন্তু বলেই চললেন—’তাঁদের রিসিভ করতে করতেই প্রাণ গেল। খরচ কি কম? ট্রাকে করে গাঁ থেকে লোক বয়ে আনো, পথে পথে তোরণ বাঁধো, ওরে বাব্বা, সেকি কম পরিশ্রম? তারপর মিটিং ডাকা আছে।’ আমি তো ক্রমশই থ হয়ে যাচ্ছি। অ্যা? তোরণ? ট্রাকে করে লোক? এসবও কি হবে নাকি? আমারই জন্যে? এই রোগা আমি? কী জানি বাবা, কত অঘটনই তো ঘটে আমার কপালে, এও হতে পারে। বলাতো যায় না। এবারে যে রেটে ভি. আই. পি. ট্রিটমেন্ট জুটছে! কিন্তু একটা খটকা–অভিযোগের তালিকায় বাসু একবার একটা মীটিং ডাকার কথাও যেন বললেন না? নাঃ, তাহলে নিশ্চয়ই আমি না। আমি তো চলেই যাচ্ছি। এ নির্ঘাত রাজনীতির নেতা ব্যাটাদের বিষয় আলোচনা হচ্ছে। উদ্বেগটা ঝেড়ে ফেলে তাড়াতাড়ি আমিও মহামুরুব্বির মতো আলোচনায় যোগ দিলুম—
‘সত্যিই! খুবই ঝামেলা তো? টাউন কংগ্রেসের সভাপতিই বুঝি এসবগুলোর ব্যবস্থা-ট্যবস্থা করেন। টাকাকড়ি আপনাদের কেমন?’ এইবার ওঁর সবচেয়ে নরম জায়গায় হাত পড়ল।—‘সেইটেই হয়েছে মুশকিল! আমাদের মোটেই টাকাকড়ি নেই। এসবে প্রায়ই প্রাইভেট ফান্ড লেগে যায়।’—তিরুপতিনাথ ভারতবর্ষের সবচেয়ে ধনীদেবতা। তাঁরই শহরে কিনা কংগ্রেসের টাকা নেই? হায়রে! তবু ভালো যে বাসুবাবুর আছে। নইলে ভি. আই. পি. বেচারীদের তোরণ-টোরণগুলো আর জুটতো না হয়তো। আমি এখানে এসেছি বন্ধুর-বন্ধু হয়ে নেহাতই অরাজনৈতিক তীর্থযাত্রী হিসেবে, স্বতঃস্ফূর্ত ব্যক্তিগত আতিথ্য পাচ্ছি। ভাগ্যিস নেতা নই? আমার জন্যে যে তোরণ বাঁধতে হয়নি, ট্রাকে করে লোক আনতে হয়নি—এতেই বাসু যারপরনাই কৃতজ্ঞ মনে হচ্ছে। যতদূর বুঝলাম এমনিতে তিরুপতি দর্শনে বার বার যেতেও ওঁদের বিরক্তি নেই, বরং তৃষ্ণা আছে। প্রায় সপ্তাহেই আসেন।
.
তিরুপতি মন্দিরের সোনার চুড়ো ঝিকিয়ে উঠল দূর থেকে—এঁরা সবাই হাত জোড় করলেন। দেখাদেখি আমিও। সুন্দর জায়গা এই তিরুমালা পাহাড়—ঠিক উৎকামণ্ডের মতো। চমৎকার একটি লেক রয়েছে—তার চারিদিকে অজস্র ছোটো ছোটো কটেজ–সব যাত্রীনিবাস। বিভিন্ন ভক্তদের দেওয়া ডোনেশনের টাকায় তৈরি। প্রতি বাড়ির গায়ে দাতাদের নামের তালিকা গাঁথা আছে কালোপাথরে-কে কে কোন বাড়িতে কত টাকা ঢেলেছেন। আশ্চর্য এই ঝরঝরে, পরিচ্ছন্ন ছোট্ট তীর্থনগরী, ঠিক যেন পাশ্চাত্যের কোনো স্বাস্থ্যনিবাসে এসেছি। সত্যি, হেল্থ রিসর্ট, হলিডে রিসর্ট হিসেবে তিরুমালার মধ্যে অতল সম্ভাবনা। ওখানে চমৎকার একটি বাগান আছে, বোধহয় সেটা দক্ষিণ-পশ্চিম কোণই হবে—যেখানে একটা পাথরের রথ বসানো আছে। তার চাকাগুলো নেই, শুনলাম মাটির নিচে থেকে গিয়েছে, শহরের যেখান থেকে রথটা তুলে আনা হয়েছে সেখানেই। রথের চারিদিকে ফুলের বাগান, তার ওপাশেই পাহাড়ের সীমানা। নিচে, বহু নিচে, দেখা যাচ্ছে সবুজ উপত্যকা, ঢেউ খেলানো পাহাড়ের সারি। দূরে ওটা কী? সেই মন্দির না? মহারাজ কৃষ্ণদেবের? হ্যাঁ। ওখানেই ছিল রাজা কৃষ্ণদেবের কেল্লা। ভগ্নাবশেষ পড়ে আছে। দুর্গপ্রাচীর দেখা যায়।
এখানে টুরিস্টলজ জাতীয় একটা সরকারী অতিথিশালা আছে, সেখানে দ্বিপ্রহরের জন্য একটি ঘর নেওয়া হয়েছে। আমার বাক্স-টাক্স, ঝোলা-টোলা সেইখানে রেখে, আমরা বেরলুম মন্দির দেখতে।
মন্দিরের পথ পরিচ্ছন্ন, পাথর বাঁধানো। দক্ষিণের তীর্থস্থানের এই গুণটি আছে। পাণ্ডার অত্যাচার নেই, ভিক্ষুকের উপদ্রব নেই, ভক্তদের থুতু, পানের পিচ ইত্যাদি অবশ্যকরণীয় নোংরামিও নেই।—অর্থাৎ ভক্তির সুযোগ আছে কিছুটা।
গাড়িতে চটি রেখে, সবাই খালি পায়ে চললুম।—পথে একটি ছেলে এল তিরুপতিমাহাত্ম্য বেচতে। তাকে বললুম ফেরার পথে কিনব। একটু পরেই দেখি দীর্ঘ, সর্পিল কিউ। সেখানে যেই দাঁড়াতে গেছি—ওটা নয়, ওটা নয়। ওটা ‘সর্বদর্শনের কিউ। ‘স্পেশাল দর্শনে’র দরজা আলাদা। হা ভগবান তিরুপতি ভেঙ্কটেশ্বর! তোমার কাছে যাবার বুঝি ভিন্ন ভিন্ন পথ? যমের দুয়োরের মতো? জন্মের দ্বার যেমন একটাই—তেমনি দেবদর্শনের দ্বারও একটাই হওয়া উচিত। অবশ্য তা যদি সত্যিই হতো, তবে দেবদর্শন সেরে আজই সন্ধ্যার প্লেনে আমার হায়দ্রাবাদ হয়ে দিল্লী যাত্রাটি আর সম্ভব হত না। অতএব শত শত পূর্ববর্তী মানুষ, শিশু-নারী-বৃদ্ধকে পিছনে সর্বদর্শনের কিউবন্দী রেখে, চোরের মতো মাথা নিচু করে বাসু ও পার্থসারথির পিছু পিছু ‘স্পেশালদর্শনে’র চওড়া দরজা দিয়ে চুপি চুপি মন্দিরে ঢুকে পড়লুম। মন কিন্তু সায় দিল না।