স্নাতকোত্তর পর্ব
ছবির মতো দৃশ্যটা এখনও দেখতে পাচ্ছি। মাঠের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে চলেছে তীর্থযাত্রীর দল। সকলেরই কাঁধে অবশ্য মাল নেই। এটা শুধু আমাদেরই দলের বৈশিষ্ট্য। ভোরের চিহ্ন নেই, যদিও বিজলী আলোর আভায় আকাশ লালচে। আমার ভিজে কাপড়ের ভারী বান্ডিলটি কোন্ শুভার্থী কখন নিয়ে নিয়েছেন, আমি মুক্ত। ভিখুর মাথায় মেসোমশায়ের কিটব্যাগ, এবং তার ওপরে বিরাট ভিজে কাপড়ের গন্ধমাদন পর্বত। ভিখু তবু নাচতে নাচতে যাচ্ছে। হাসতে হাসতে যাচ্ছে। ভগবান ওকে চোখের সামনে রেখেছেন—এ আমাদের মহা ভাগ্য। দিলীপের পিঠে রুকস্যাক, আর মাথায় আমার সুটকেস। সে মেঠো গলায় মহানন্দে হাঁকছে—’হো ই চুন্নু কো মা, তুই কাহা গইল বা? আরে ইধরি তো আ যা!’ বৌদি শুনে বললেন—’মরণ! কে না কে ছুটে আসবে এবারে। তখন ঠেলা বুঝবে!’
মাঠেও খুবই সন্তর্পণে হাঁটতে হচ্ছে—পদতলে পুণ্যস্নানের পবিত্রতা রক্ষা করা বেশ কঠিন—অনিবার প্রাতঃকৃত্যের উদারতায়। এক সময়ে তাঁবুপাড়া এসে পড়ল। বৃষ্টিতে ততক্ষণে আমাদের সবকিছু ভিজে জবজবে।—ঠিক দুটি ঘণ্টা লেগেছে স্নান সারতে। সকলের শরীরমনে তখন একটিই ইচ্ছে-শুকনো তাঁবুতে ঢুকে একটু পিঠ পেতে শুয়ে পড়া শুকনো উষ্ণ কম্বলমুড়ি দিয়ে। আর এককাপ কড়া করে আদা দিয়ে চা।
কিন্তু তাঁবুর মেঝে জলে ভাসছে। পা ডুবে গেল। ভেতরে যেন বন্যা বয়ে গিয়েছে। ওরই মধ্যে যেখানটা একটু শুকনো, সেখানেই কম্বলজড়ানো মড়ার মতন মানুষ পড়ে আছে। এভাবে বহু মনুষ্যদেহ তাঁবুর যততত্র অনাদরে শয়ান। আমাদের শোবার ঠাই নেই। এরা কারা? দলপতি দাদা এসে এক হাঁকেই তাঁবু খালি করে দিলেন। নাঃ ওরা কেউ নয়। ওরা বিনাভাড়ার জবরদখল পার্টি। বিনা প্রতিবাদে উঠে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে গেল কম্বলজড়ানো কেউ-নয়-দের-দল। এটা এত আশাতীত যে দেখে খুব কষ্ট হল আমার। তারপরেই মনে হল, ভাবনা কি—ওরা এখুনি আরেকটা খালি তাঁবুতে ঢুকে পড়তে পারবে। এখন অনেক তাঁবুই খালি। সবাই স্নানে। তাঁবু তো পুকুর। মাত্র কয়েকটা শুকনো ডাঙা আছে। আমরা যে কজন মিলে পারি এক একটা শুকনো মাদুরে ঘেঁষাঘেঁষি ঠেসাঠেসি করে বসলুম কম্বলমুড়ি দিয়ে। উহুহু কী শীত। জীবনে কখনও এত তীব্র তুহিন শীতের অনুভূতি আমার হয়নি।
.
তুহিন বরফের মধ্যে বহু গিয়েছি—নিশীথ রাতের সূর্যের দেশে গিয়ে—মেরুজ্যোতি অরোরা বোরিয়ালিস দেখে এসেছি। মাইনাস ঊনত্রিশ ফারেনহাইটে গিয়েছি উত্তর মার্কিনে—প্রচণ্ড শীতে অসাড় নাকের ভেতরে সর্দিটা জমে যেন আইসিক্ল হয়ে যাবার যো হয়েছে সেখানে। আর নাকটা যেন একটা আলগা ফল, মুখের ওপরে আলতো ঝুলছে।-টুপ্ করে খসে পড়ে গেলেও জানতে পারব না। কিন্তু সে শীতটা করেছে কেবল নাকেই। কেবল এটুকুই কিনা প্রকৃতির কাছে অনাবৃত। আর বাকী সমস্ত শরীর উষ্ণ। পায়ের আঙুলের ডগা থেকে কানের লতি পর্যন্ত বৰ্মে বর্মে আচ্ছাদিত। শীত ঢুকতেই পায়নি কোনও ছিদ্রপথে। কিন্তু এই একটি রাত্রির চণ্ডাল শীত আমি ইহজীবনে ভুলব না। আমার চামড়ার ঠিক নিচেয় যেন আরেকটা আমি তৈরি হয়েছিল। সেই অসহায়, অবাধ্য জড়পিণ্ডটা কেবলই কুঁকড়ে শিউরে শিউরে উঠছিল, আর অন্য যে কোন আরেকটা গরম জ্যান্ত কম্বলের মধ্যে ঢুকে পড়তে, উষ্ণ হতে চাইছিল। পোষা শরীরটা হঠাৎ বুনো শরীর হয়ে উঠে মন বুদ্ধিকে ঠেলে ফেলে আলাদা হয়ে যেতে চাইছিল। একটু গরম হওয়া চাইই। গরম হতেই হবে। কিন্তু না। মনবুদ্ধিকে ঠেলে আগুনে ফেলা তো অত সোজা নয়। লজ্জাকেই ঠেলা যায়নি যখন! ভিজে কাপড়ের অভিসম্পাতে রিক্ত আকিঞ্চন হৃদয়ভূমি। আর সেই প্রবল আভ্যন্তরীণ সংগ্রামের কাঁপুনি ঝাঁকিয়ে দিচ্ছিল আমার বাইরেটাকেও। দাঁতে দাঁত টিপে চোয়ালটা শক্ত করে এঁটে না রাখলে সত্যি সত্যি ঠকাঠক শব্দ হয়ে যাচ্ছে দাঁতে। আপাদমস্তক কম্বলজড়িয়ে তার ভেতরে গরমাগরম নিশ্বাস ফেলে যে যার নিজস্ব শরীরে গরম হাওয়ার ইনসুলেশন তৈরি করছি। চায়ের প্রশ্ন নেই। দোকানপাট বন্ধ
কিন্তু আমার শত্রু তো আমারই ভেতরে। সপসপে ভিজে বেশবাসের সেই দুর্দান্ত সর্বগ্রাসী কামড়, বিবেক দংশনের চেয়েও কড়া। যতই কম্বলমুড়ি দিই, যেভাবেই গুটিসুটি হই না কেন, তার অন্তঃসলিলা আলিঙ্গনের হাত থেকে তো রক্ষে নেই : শীত যেন আমাকে লৌহভীম চূর্ণ করে ফেলছে। প্রত্যেকটা স্নায়ুতে যন্ত্রণা। সর্বক্ষণ গভীর জলে তলিয়ে যাওয়ার মত যাতনাকীর্ণ তীক্ষ্ণ অনুভূতি। এই সময়ে, কম্বল নয়, আগুন চাই, আগুন। হয় জ্বলন্ত ধুনি, নয় জ্বলন্ত শরীর। এই শীতের অন্তরটিপ্পনী দমন করতে যে উত্তাপ দরকার তুচ্ছ কম্বলের তা দেবার শক্তি নেই বৃষ্টিতে চারিদিকের সব ধুনি নিভে গেছে, সব কাঠ ভিজে গেছে এখন আর খুঁজে পাব না সেই সব ধুনি জ্বালান সাধুজীদের। যেমন এই হৃদয় ছুঁড়লেও ফিরে পাব না প্রথম যৌবনের উত্তাপ। এখন সিক্ত অরণির সময়। সন্ধ্যালগ্নে আগুন পোহানোর স্মৃতিটা মনে আনার চেষ্টা করলুম, প্রণয়ের উষ্ণতা স্মরণে আনতে। হায়রে, শীতের চোটে স্মৃতিও নড়তে চায় না। পিছু না-হটে, বুদ্ধি চায় কেবলই সামনে দৌড়ুতে। কখন পালাব, এই বৃষ্টি তো সহজে থামবে না—এই ভিজে কাপড়ে আর কতক্ষণ থাকব—শরীরের ওপরে যদিও বিশ্বাস হারান পাপ, তবু এভাবে ভিজে কাপড় মুড়ে রাখলে শরীর আর কত সইবে। নিমোনিয়া না হোক, ব্রঙ্কাইটিস কি বাগ মানবে? শরীর তো আর সুষনি-কলমী নয়। এহেন অবস্থায় শুধু হরি হে, তুমিই ভরসা!
হরি ভরসা করবামাত্র মনে পড়ল আর একজোড়া তো মোজা আছে! নোংরা হয়ে যায় বলে তিন জোড়া এনেছি। লাফিয়ে উঠে টর্চ জ্বেলে সুটকেস খুলে বের করলুম গরম মোজা। তাঁবুর বিজলীবাতি বৃষ্টিতে নিবে গেছে। সব তাঁবুই এখন অন্ধকার। কেবল মাঝে মাঝে দেশলাই জ্বলছে, জ্বলছে বিড়ি সিগারেটের লাল মুখ। আচ্ছা এই খড়ের গাদার মধ্যে এদের সিগারেট ধরানোটা কি ভাল হচ্ছে? একবার ভয় হল। তারপর ঝেড়ে ফেললুম দুর্ভাবনা। জলেরও তো অভাব নেই। খড় তো ভিজে। যা হয় হোকগে। একটু আধটু আগুন লেগে গেলেও মন্দ হয় না! কে জানে, এমতাবস্থায় ‘কাশীর মহিষী করুণা’র ব্যাপারটা হয়ত অন্যভাবেও দেখা চলতে পারে! সেও মাঘমাস, এই একই অঞ্চল, নদীর ধার, হয়তো বৃষ্টিও…
পায়ে শুকনো মোজা জোড়া পরে যেন দেহে নতুন করে প্রাণ এল, এবং বুকে বিবেক এল। এলোপাতাড়ি কাঁপুনি একটু কমল। মাতৃজঠরের মতো ওম্ হল শরীরে। সেই সঙ্গে মনে পড়ল, একবার বহু বছর আগে, বাল্যকালে বাবামার সঙ্গে অস্ট্রিয়া বেড়াতে গিয়ে সাজবুর্গ শহরে ঢুকে এমনিই ভিজেছিলুম। সে কি শীত। কি কাঁপুনি। সেদিন হোটেলেই এক ডাক্তার দম্পতি উপস্থিত ছিলেন, কর্তা বাঙালী—তিনি আমাদের নিজের বাক্স খুলে ব্রান্ডি বের করে চামচে করে খাইয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর সেই যত্ন, বাবামার স্নেহের কোল, সবকিছু জড়িয়ে নিজের নিশ্চিন্ত বালিকা-বয়সের জন্যে হঠাৎ মন কেমন করে উঠল। সেটা ঝেড়ে ফেলতে, ‘একটু ব্র্যান্ডি থাকলে খুব ভালো হত’–বলতেই, অনেকগুলো সমর্থনসূচক শীতার্ত হাহুতোশ উঠল অন্ধকার তাঁবুর ভিজে বাতাস দুলিয়ে। একটু বাদেই ঘরে কড়া ব্রান্ডির গন্ধ পাওয়া গেল। কিন্তু তার উৎপত্তিস্থলটা বহু টর্চ জ্বেলেও কিছুতেই উন্মোচন করা গেল না। মন্তব্য ছোঁড়া হল নিরুপায় হয়ে। ‘এটা সত্যি খুব কিন্তু স্বার্থপরের মতো কাজ হচ্ছে’—
–’সকলেই তো ভিজেছি!’—’যেই হোন, মশাই আপনার পুণ্য কিন্তু উপে গেল!’ কিন্তু পঞ্চাশ-একান্ন চামচ ব্রান্ডি হয়তো সেই পাত্রে ছিল না, তাই তার মালিক ধরা দিলেন না। তাঁবুর অন্ধকার তাঁকে আড়াল করে রাখল, যদিও তাঁর কর্মটি আড়াল করতে পারেনি।
এমন সময়ে মেসোমশাই ফিরলেন জবজবে ভিজে। সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে একজোড়া গরম মোজা ধার দিল কেউ, কেউ দিল মাফলার, কেউ বাঁদুরে টুপি। সদ্যপ্রত্যাগত বীর-জওয়ানের মতো উৎসাহে তাঁকে স্বাগত-অভ্যর্থনা জানান হল। মেসোমশাই হারিয়ে যাননি—তাঁকে ডিট্যুর করিয়ে আরও এক ভিন্ন অঞ্চলে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল! নাক ঘুরিয়ে এসেছেন তিনি। মেসোমশাইকে একটু কাত হতে দেবার জায়গা করতে গিয়ে টের পাই তাঁবুর কিনারা দিয়ে হুহু করে জলস্রোত এসে আমার সর্বস্ব ভিজিয়ে দিয়েছে। ব্যাগ জলে ভেজা, সুটকেস বিঘৎখানেক গভীর জলের মধ্যে দ্বীপের মতো ভাসছে, পট্টর শাল ভিজে ন্যাতা। আঁচলটাও ভিজে গেছে অনেকখানি। কি ভাগ্যি কম্বলটা ভেজেনি! দিল্লিতে মামাবাড়ির বিছানা থেকে আমি তো এই কম্বলটা স্রেফ তুলে নিয়ে চলে এসেছি।
আমার প্রাণ সেই কম্বলই রক্ষা করা করেছিল সে যাত্রায়। অভুর কম্বলটি গায়ে জড়িয়েই পরদিন সকালে রওনা হলুম আঝোর বর্ষণের মধ্যে। মালপত্র নিয়ে। শাল ততক্ষণে ভিজে কাপড়ের পুঁটলিতে চালান হয়েছে। ভিখুর হাতে দুটো দশটাকার নোট সসংকোচে গুঁজে দিয়ে আমি বললুম—’ভাই, তুমি আমার সুটকেসটা না-নাও, ভিজে কাপড়টা কিন্তু নিও।’ ভিখু একগাল হেসে বলল-’তার জন্য টাকা কেন—অমনিতেই তো নিতাম দিদি!’
–’সেটা জানি বলেই তো এটা দেওয়া!’ ভিখু ঐ দলের ভৃত্য। আসলে কিন্তু সেই মালিক। তারই আছে দীনদুনিয়ার মনিব হবার মতো দিল। তার মুখের হাসি তার বুকের সুখ সকলেরই ঈর্ষার যোগ্য।
বেরুবার সময়ে সেবাশ্রমের দান-বাক্সে গুরুদীপের দেওয়া পাঁচটা টাকা রেখে এলুম। শুনলাম এঁরা গরীব তীর্থযাত্রীদের খিচুড়ি খাওয়াচ্ছেন। ওতেই তোমার ‘পুজো’ দেওয়া হবে গুরুদীপ, ওতেই ঢের পুণ্য