পুনমূষিক পৰ্ব
বাড়ি ঢুকতেই মেয়েরা এসে জড়িয়ে ধরল।
—‘মা, তুমি কুম্ভমেলায় গিয়েছিল বুঝি? কি মজা! পোস্টকার্ড পেয়েছি তোমার। দিম্মা এদিকে কী ভীষণ ভাবনা করছেন। তুমি নাকি রেলের অ্যাকসিডেন্টে পড়েছিলে? দিম্মা কেবলই তাই ভাবছেন।’
ইতিমধ্যে একটা ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনা ঘটে গেছে ঐ ১৮ই জানুয়ারি তারিখেই। কুম্ভের যাত্রীদের নিয়ে মোগলসরাই থেকে ট্রেনটি এলাহাবাদের পথে যাচ্ছিল। বহু যাত্রীর প্রাণহানি হয়েছে। মা কাগজে খবরটা পড়েছেন এবং ঐ দিনেই আমার পোস্টকার্ডে জেনেছেন যে ঐ তারিখেই আমি কাশীতে পৌঁছে এলাহাবাদ রওনা হচ্ছি।
—’কিছু ভেবো না মা, যেমন করে হোক, আজ ঠিক এলাহাবাদে পৌঁছে যাব’—পড়ে মার মাথায় হয়েছে বজ্রপাত! অস্থির হয়ে উঠে নানাভাবে মা চেষ্টা করেছেন তাঁর লোপাট হয়ে যাওয়া মহার্ঘ কন্যারত্নের সন্ধান করতে। সফল হননি। এমতাবস্থায় হাসি-হাসি মুখে আহ্লাদে গদগদচিত্তে অক্ষত শরীরে আমাকে ফিরতে দেখেই মা তো ক্ষেপে রাঙা টুকটুকে!
—’হাঁরে তোর কি কোনও একটা কাণ্ডজ্ঞান নেই?’—ওপনিং সেনটেন্স শুনেই বুঝেছি কিসে পা দিলুম। আমাদের রাঁধুনি প্রফুল্ল যখনই দেশে যায়, যেদিন তার ফেরবার কথা, তার বহুদিন পরে ফেরে। তখন মা যে স্পীচটা দেন, এটা তারই আরম্ভ। বাকিটা আমার মুখস্থ। তাই আত্মরক্ষার প্রণালীটাও আমার মুখস্থ। ঠিক প্রফুল্লর মতো দুঃখী দুঃখী মুখ করে সিঁড়ির থামটাতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আঙুলে নখ খুঁটতে থাকি। নির্বাক।
-’ঠিক যেটা বারণ করা হয়েছে, সেইটিই করা চাই। নিজের তো হয়েছে দুটি সন্তান,—এবার বুঝবে মজা! ওরা এইবার বড় হয়ে উঠুক না। ছি ছি—ছি ছি—
না। এটা অন্য স্পীচ। এটা আমার না-খেয়ে কলেজে চলে যাওয়ার স্পীচটাই মনে হচ্ছে।-উঁহু। তাও না। শেষ পর্যন্ত মা একটা আনকোরা নবীন স্পীচ দেন। কুম্ভ স্পেশাল।
আমার মাথাটা নাকি একেবারেই খারাপ। ‘কিছু’ যে অমঙ্গল হয়নি, সেটাই ‘অঘটন’। ভয়ংকর ধরনের দুর্ঘটনা ঘটাটাই নাকি স্বাভাবিক ছিল। এই দুশ্চরিত্র ভূভারতে সেইটেই সহজ স্বাভাবিক, উচিত ব্যাপার হত। এই যে আমি টোটো করে একা একা ‘বিশ্বব্রহ্মাণ্ড’ ঘুরে এলুম, কেবল মানুষের কাছে আদর-আহ্লাদ, যত্নআত্তি, স্নেহ-ভালবাসা পেয়ে,–সেইটে তো একেবারেই অমানুষিক অঘটন মাত্র। কোটিকে গোটিক হয়।
আমি মাকে সান্ত্বনা দিতে তখন বলি,—
–’মা তুমি প্রস্তুত থেকো কুম্ভে গিয়ে আমরা কিন্তু দু’জন বাবা’ আর একটি মেসোমশাই হয়েছেন।’ অগুণতি দাদা এবং ভাইদের কাহিনিটা বাদ দিয়েই বলি।
-’এবং চমৎকার একটা ছেলেও হয়েছে আমার।’ মা থমকে যান।
-‘কী বললি? দু’জন…কী? কার আবার ছেলে হল?’
—’ছেলে হয়েছে আমার। আর দুজন বাবা হয়েছেন, সেও আমার। তাঁরা কিন্তু আসতেও পারেন এ বাড়িতে কখনও মা। তুমি সাবধানে থেকো। একজন আবার মিলিটারি।’
–’দূর ছাই, যে অসভ্য মেয়ে হয়েছে। মুখে ইয়ার্কি ছাড়া কথা নেই। কার সঙ্গে কী বলছিস সে-জ্ঞানটা আর কবে হবে।’
—’ঠিকই বলছি। দুজন বাবা হয়েছেন, এটা প্রথমে মাকেই তো বলার কথা?’
-হ্যাঁরে খুকু, তোর মুখে কিছুই আটকায় না? অ্যা!… মেলা বাজে বকিসনি! বলি বয়সটা হবে কবে?’
–’যাবার পথে একজন বাবা—নাম শার্দূল সিং, জয়পুরে থাকেন। ফেরার পথে ট্রেনে আর একজন বাবা—নাম পুরুষোত্তমলাল পোদ্দার, আমহার্স্ট স্ট্রিটে মারোয়াড়ি হাসপাতালের সেক্রেটারি। বলেছেন সবসময় যেকোনও রুগী তাঁর কাছে পাঠাতে পারি! আছে কোনও রুগী তোমার হাতে? দাও পাঠিয়ে দিচ্ছি আমার বাবার হাসপাতালে।’
—’যাচ্ছেতাই কথা সব।-আর ছেলে না কি যে হয়েছে? কার যেন।’
-’কার আবার, বলছি তো আমার। কাশীতে আমার একটি ছেলে হয়েছে। পুত্রসন্তান। ব্রাহ্মণসন্তান অবশ্য। তবে পুত্ররত্ন দেবকুলাদপি—এই মহা শিক্ষা মহাভারতের রাণীরা সব্বাই দেখিয়ে গেছেন। আমার ছেলে বাঁকুড়ায় কলেজে পড়ে, খুব চমৎকার ছেলে মা। দুবেলা জপ করে আহ্নিক করে অথচ বাচ্চা ছেলে। তার মধ্যে কি যে গভীর সরল বিশ্বাস, আমি পুণ্যাত্মা বলতে যা বুঝি, সে ঠিক তাই। তোমার নাতির দুঃখ ঘুচল। এবারে মা আমি আর সমীর মিলে ঠিক করেছি একটা হাসাপাতাল খুলব, গরীবদের জন্যে। গঙ্গার ধারে জমি কিনে। প্রাকৃতিক চিকিৎসায় খোলা হাওয়ায় সেরে উঠবে সব ধরনের রোগীরা, বেশি বেশি ওষুধে নয়, কেবল সেবায় আর ভক্তিতে। আরেকদিন বলব তোমায় আমাদের সেসব ভবিষ্যৎ প্ল্যান।’
-’বেশ, এটা ভাল কথা। ধর্মভীরু ছেলে পাওয়া ভাল। তোদের হাসাপাতাল খোলার আইডিয়াটাও খুব ভাল। যাক। আর কিছু?’
–’আরও অনেক কিছু! অনেক কিছু! সবার চেয়ে বড়ো কথা, মা,’ মায়ের খাটে চিৎপটাং হয়ে পড়ে মার তাকিয়াটা দখল করে নিয়ে ঘোষণা করি, ‘আমি প্রেমে পড়েছি!’
—’এ্যাঁ?’…মার বাকরোধ হয়েছে।
—’ওই নিমতলা কি ক্যাওড়াতলায় আমি কক্ষণো মরব না। বাঁচার জন্যে কলকাতা, কিন্তু মরতে হলে কাশীতে। কাশীর গঙ্গার প্রেমে পড়েছি মা। আমি সারাটা জীবন ওখানে বসে চেয়ে থাকতে পারি গঙ্গার দিকে। মাগো—কি জিনিসই দেখলুম!
-’তাই বল্! কাশীর গঙ্গা। এই প্রথম দেখলি কিনা। ওই দুর্দিন, কি চারদিন। তার পরেই আশা মিটে যাবে। কাশী তো কেবল গঙ্গাই নয় রে।’—মা বলেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
—’না মা কখনও মিটবে না। ওঃ কী নদী! ওপারটাতে কিছু নেই কেবল অন্তহীন আকাশ, ঠিক যেন মর্তের শেষ সীমা। বৈতরণী বলতে যে ছবিটা মনে ভেসে উঠত সেইটেই দেখে এলুম মা। হরিদ্বারের সেই নীলগঙ্গার চেয়েও বেশি ভালো। কী বিস্তার!
‘মা, চলো না, আমরা কাশীতে চলে যাই। গঙ্গার ধারে থাকব।’ এবারে মা হেসে ফেলেন। ‘দূর পাগল। কাশীতে তুই থাকতে পারবি না। তার চেয়ে ওই গঙ্গাটকে বুকের মধ্যে পুরে ফ্যাল। যেখানে যাবি, সঙ্গে যাবে। একবার কাছে এসেছে যখন, আর ছেড়ে দিসনে। স্রোতটা বইতে দে—কাশীর গঙ্গা উত্তরবাহিনী জানিস তো-তোর যেমনি উল্টো স্বভাব, তারও ঠিক তেমনি। দুজনে তাই মিলেছে ভালো। গঙ্গাটাকে বুকের মধ্যে দিয়ে বইয়ে দে আর প্রয়াগসঙ্গমটাকে বুকের মধ্যিখানে ধরে রেখে দে। অমৃতকুম্ভ একবার হাতে এলে আমরা নিজেরা ছুঁড়ে না ফেললে কেউ কেড়ে নিতে পারে না। তুই এইটে মনে রাখবি।–কুম্ভে গেলেই তো আর অমৃতকুম্ভের খোঁজ সকলের মেলে না রে। ভগবানের অসীম দয়া—তোর কপালে যখন মিলেই গেছে, ওটা যেন ভেঙে ফেলিসনে।’
ইতি
মহাকুম্ভযোগকথা অমৃত সমান
দীনা নবনীতা কহে শুনে পুণ্যবান।।
Apurbo
সত্যি অসাধারণ