স্বর্গবাস পর্ব – তাঁবু

স্বর্গবাস পর্ব – তাঁবু

ভদ্রলোক অগত্যা আমাকে নিয়ে গেলেন তাঁবুতে। খুব কাছাকাছি খুব ছোটোখাটো তাঁবু পাতা। তাবুর খোঁটায় আর দড়িতেই হাঁটার জায়গাটা কণ্টকিত। তাঁবু সত্যি খুবই ক্ষুদ্র। তাতে খড় বিচালি বিছানো। ভেতরে একটি মৃদু বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বলছে। অনেকজন মহিলা বসে আছেন, দু’চারটি পুরুষ। আমাকে নিয়ে গিয়ে খুবই যত্ন করে শুতে দিলেন ভদ্রলোক। কম্বল তো পেতে দিলেনই, মাথায়ও বালিশ জাতীয় একটা কিছু (গোছানো বিছানা বোধহয় কারুর) গুঁজে দিলেন। লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লুম, আহ! কী আরাম। তক্ষুনি মনে পড়ল দিল্লীতে ইয়ুথ ফেস্টিভ্যালে গিয়ে তাঁবুতে এই খড়ের ওপরে শুয়েই আমার প্রথম হাঁপানি শুরু। আবার মনে হল, সে ছিল আলাদা ধুলো। এ ধুলো আলাদা। হুঁ হুঁ বাবা, এ হচ্ছে স্বয়ং প্রয়াগ। তালকাটোরা গার্ডেন নয়। এখানে হাঁপানি হবে না। সংস্কার মাঝে মাঝে বেশ মনের জোর দেয়। যুক্তিবাদও মাঝে মাঝে সংস্কারের মতোই আচ্ছন্ন করে ফেলে মানুষের মনকে, সেও তো দেখেছি। আমার এখন দরকার ঘোরতর মনের জোর যেন তেন প্রকারেণ; অসুখ করলে চলবে না।

চোখে আমার আলো একদম সয় না। আঁচলটা চোখের ওপর যেই টেনে দিলুম, টের পেলুম, সর্বনাশ হল। একপো জরি সকলের চোখের ওপরে ঝলমল করে উঠল। এবার জ্বলন্ত উপদেশ। যা হবার তা তো হয়েই গেছে। সমবেত গিন্নিরা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন—

–’এমন কাপড় পরে কেউ কুম্ভমেলায় আসে গা? তোমার সুতীর কাপড় ছিল না?’—’ছিল বাড়িতে। বাড়ি থেকে তো আসিনি।’

-’ৰাড়ি থেকে আসনি? তবে কোথা থেকে এলে?’

—‘হায়দ্রাবাদ।’

-’ সেখানে কী করছিলে?’

-’কাজ ছিল।’

-’কাজ? কী কাজ?’

-’বক্তৃতা।’

—’কিসের বক্তৃতা?’

—’ওই, এমনি। সাহিত্যের।’

-’কাদের সঙ্গে এসেছ?’

-‘একাই।’

-’একা মানে? একদম একা? তার মানে? সঙ্গে কে-উ নেই?’

-’সঙ্গে ভগবান আছেন।’

—দু’মিনিট নীরবতা পালন। তারপর—

—’এখানে থাকা হচ্ছে কোথায়?’

–’এই তো আপনাদের কাছেই এখন আছি।’

—’অ্যাঁ? এখেনেই থাকবে না কি রাত্তিরে?’

–’না, সারারাত্তির থাকব না। শুধু এক ঘণ্টা। বড্ড পিঠ ব্যথা করছে। তিনটে থেকে আটটা পর্যন্ত হেঁটেছি কিনা।’

—’ও বাবা—অতক্ষণ? তা এতক্ষণ কি জন্যে হাঁটছিলে? কোথায় গেছলে?’

—’যাইনি কোথাও। এলুম কুম্ভনগরে।’

–’এই মাত্তর এলে?’

-’আজ্ঞে হ্যাঁ। এইমাত্র।’

‘অত হাঁটতে হল কেন? ইস্টিশানে গাড়ি ঘোড়া ছিল না?’

—’ওদিক দিয়ে আসিনি। অন্যপথে এসেছি। ঝুসী থেকে।’

অভ্যাস মাফিক মাথার ওপর হাত দুটো তুলে শুয়ে আছি। খেয়াল করিনি, তাঁরা লক্ষ্য করছেন। বালা আছে, ঘড়ি আছে, কিন্তু শাঁখা কই? লোহা কোথায়? ওঁদের কৌতূহলের দিক বদল হয়।

–’তা, হ্যাঁ গো মেয়ে, তোমার বাপ-মার বিবেচনা কেমন ধারা? একা একা এই কুম্ভমেলায় আসতে ছেড়ে দিলে, এত বড়ো আইবুড়ো মেয়েটাকে?’

-’আইবুড়ো? ও মা! সে কি কথা! আমার বড়ো বড়ো মেয়ে রয়েছে না দু’দুটো?’

-’মেয়ে রয়েছে? বড়ো বড়ো? আমাদের সঙ্গে এসব ঠাট্টা করো না মা। তুমি হিন্দুর মেয়ে, ভক্তিমতী, তীর্থে মতি আছে, বুঝতেই পারছি। আমাদের কাছে ওসব বলতে হবে না, সত্যি কথাটা বলো।’

এবার উঠে বসি। বিশ্রাম চুলোয় যাক। এরা যে মিথ্যেবাদী বলছে?

–’আমার সত্যিই দুটো মেয়ে আছে মাসীমা, মেঘে মেঘে বেলা কম হয়নি আমার।’ এবার তাঁদের চোখ পড়ে, সিঁথেয় বটে সিঁদুর আছে।

–’অ, তাই বলো। তবে অঙ্গে এয়োতির লক্ষণ নেই কেন? শাঁখা লোহা পরনি কেন? হাত অমন ন্যাড়া কেন? ‘

–’মাঝে মাঝে তো পরি। ইচ্ছে হলে।’

-’মাঝে মাঝে? সে কি কথা! সব সময়ে স্বামীর মঙ্গল চাওনা তুমি? মাঝে মাঝে চাও কেবল? ইচ্ছে হলে?’

-’সব সময়েই নিশ্চয়ই চাই। তাঁর মঙ্গল ব্যবস্থা কি আমি গয়নাগাঁটি পরে করতে পারি?’ স্বর গম্ভীর হয় মাসীমা—

—’ওগুলো গয়না নয়। মঙ্গল চিহ্ন। অঙ্গে রাখতে হয়।’ তারপরে তাঁর আসল কথাটা খেয়াল হয়—

‘তা তোমার স্বামী যে সঙ্গে এল না বড়ো? সেই বা কেমন? অল্পবয়সী বৌকে একা একা কুম্ভমেলায় পাঠিয়েছে?’

—’তিনি এখানে নেই।’

–’কোথায় গেছে?’

-’বিলেতে।’

-’অ, তাই বলো। সে বেচারী বিলেত গেছে কাজে, আর তুমি অমনি পালিয়ে এসে একা একা তীর্থ করে বেড়াচ্ছ। তোমার শ্বশুর-শাশুড়ি নেই?’

-’শাশুড়ি আছেন।’

-’সে কিছু বলবে না?

‘কেন বলবেন? আমি তো কিছু অপকর্ম করতে আসিনি। ‘তাকে কেন সঙ্গে আনলে না? শাশুড়ি রাগ করবে না?’—’না।’

-’ধর্মে কর্মে মতি নেই বুঝি তোমার শাশুড়ির? সে কি গো?’

—’ধর্মে মতি থাকবে না কেন? কিন্তু আমি তো হায়দ্রাবাদ থেকে হঠাৎ চলে এসেছি। তিনি কি করে সঙ্গে আসবেন? তিনি তো শান্তিনিকেতনে।’

–’যত যাই বলো, একা আসাটা ঠিক হয়নি তোমার। এটা বড্ড বুকের পাটার কাজ হয়ে গেছে।’

-’কেন, আপনারা সবাই তো কত যত্ন আদর করছেন। একা এসে তো কোনও অসুবিধে হয়নি।’

-’তোমার নাম কি মেয়ে?’

-’নবনীতা।’

—’ক্ কীঈ?’

-’নবনীতা!’

এটাও নিয়ম। সর্বদা দু’বার বলতে হয়। কেন যে আমার নাম চিত্রা নয়, বা কৃষ্ণা নয়। চিরকালের দুঃখ। আমার এই বিদঘুটে নাম।

—’তুমি কী-চাকরি কর?’

—’পড়াই?’

—’ইস্কুলে?’

-’ওই রকমই বলতে পারেন। পড়াই বড়ো ছেলেমেয়েদের।’

-’থাক কোথায়?

-’বালিগঞ্জে?’

—’বাড়িতে আর কে কে আছেন।’

—‘মা।’

-’মানে শাশুড়ি? শ্বশুর নেই?’

এ তো বড়ো জ্বালা হল? বিশ্রাম দূরে থাক জেরার জবাব দিতে দিতেই জেরবার। এইভাবে কখনও ক্লান্তি দূর হয়? ঠিক করলুম উত্তর দেব না। অফেন্স ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স—অতএব আমিই এবার অফেনসিভ টেকনিক ব্যবহার করব। যেমন ভাবা তেমনি

কাজ। সঙ্গে সঙ্গে আক্রমণ :

-’আপনি কার সঙ্গে এসেছেন মাসিমা?’

-‘ছেলেই নিয়ে এসেছে বলতে পার, কিন্তু আমরা তো দল বেঁধে এসেছি।’

–’কতজন এসেছেন আপনারা?’

—’তা তিরিশ-বত্রিশজন হবে, নারে খোকা?’

-’পঁয়ত্রিশ।’ খোকা জানাল।

-’কিসে এলেন আপনারা?’

-‘খানিকটা বাসে, খানিক রেলে।’

–’কবে এখানে এসেছেন?’

–’এলাহাবাদে? সতেরোই। কুম্ভমেলায় কালই এসেছি। সাত দিন এখানে থাকব, কল্পবাসে, এই তাঁবুতে।’

–’তারপর কোথায় যাবেন?’

-’হরিদ্বার, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন, দিল্লী আগ্রা হয়ে ফিরব।’

-’ও বাবা—এ তো মস্ত ট্যুরে বেরিয়েছেন। ‘

—’হ্যাঁ বাবা। এতদূরে যখন এলুম, জগৎটাকে একটু দেখে যাই। তা, তোমার কিছু খাওয়া হয়েছে বাছা?’

—নেহাত অপ্রস্তুত অবস্থায় প্রশ্নবাণটি ছুঁড়েছেন, ট্যাকটিকসের কথা ভুলে গিয়ে উত্তর দিয়ে ফেলি :

—’এখনও হয়নি। এবারে হবে।’

-’ভাল কলা খাবে? আমাদের কাছে চিড়ে, গুড়, কলা সব আছে। তোমাকে দুটি দিই? মুখখানা তো একদম শুকিয়ে গেছে। খোকা চিড়ের পুঁটলিটা বের কর তো।’

এই মানুষের ওপর বিরক্ত হয়েছিলুম? ভেবেই লজ্জা করতে লাগল। তাই লজ্জা ঢাকতে দ্বিগুণ রূঢ় হই-’নানা, আমি এখন খাব-টাব না, আমার একদম খিদে পায়নি।’

এমন সময়ে খুব জোরে একটা বাচ্চা কেঁদে উঠল তাঁবুর এককোণে।

সঙ্গে সঙ্গে ঘরের কথোপকথন স্তব্ধ। যেন শোকের আবহাওয়া নেমে এল। আমি অবাক হয়ে উঠে বসে খুঁজি বাচ্চাটাকে। পেছন ফিরে দেখতে পাই—আরে! এরাও এতক্ষণ ছিল এইখানেই? এদের তো এতক্ষণ দেখতে পাইনি! ক্লান্তির চোটে তাঁবুতে ঢুকেই শুয়ে পড়েছি। এঁরা আমার ঠিক পিছন দিকে ও কোণে বেশ পুরু, প্রায় ফুটখানেক উঁচু গদির মত একটি সিংহাসন বানান হয়েছে,—পর পর অনেকগুলো ভোকম্বল ভাঁজ করে পেতে। তার ওপরে দুটি সুন্দরী মেয়ে জাপানি নাইলন শাড়িতে বিশিষ্ট হয়ে, রাণীর মত উদাস—বসে আছেন। দেখলেই দুটি বোন বলে বোঝা যায়। চিত্রতারকার মতো পরিপাটি সজ্জাসচেতনটি কুমারী। ইংরাজিতে যাকে বলে—প্রতিটি চুল যথাস্থানে, তাই ঘরোয়া তীর্থযাত্রিণীদের মধ্যে আমার জরির শাড়ীর চেয়েও যেন দৃষ্টিকটু তাঁর সযত্ন পারিপাট্য। অন্যটি বিবাহিতা। সিঁদুরটিপটা গড়িয়ে পড়েছে কপাল জুড়ে। নাকে হীরের নাকছাবি এই ম্লান বাতিতেও ঝক্‌ক্‌ করছে। সমস্ত মুখে বিরসতা।

দুজনের মাঝখানে একটি সুসজ্জিত পুং-শিশু! সে-ই পরিত্রাহি চেঁচাচ্ছে। কিন্তু, কিমাশ্চর্যম্? দুজনের কেউই তাকে ভোলাতে বা থামাতে চেষ্টা করছেন না। তাঁরা নিবাত নিষ্কম্প শিখা। ওদের বাচ্চা কি তবে নয় নাকি? যাব? ধরব? এবার উঠলেন একটি যুবক মেঝের খড় থেকে তিনি নীরবে কান্নাবিহ্বল শিশুটিকে কোলে নিলেন। তাঁবুর মধ্যে কোণের দিকে দাঁড়ানো যায় না। তাঁকে একদিকে ঘাড় বাঁকিয়ে থাকতে হল। তিনি বাচ্চাকে ভোলানোর সামান্য চেষ্টা করতেই শিশুটি তার আধো আধো কচি গলায় উচ্চৈস্বরে কান্নার মধ্যেই যথাসাধ্য ক্রোধ ফুটিয়ে চিৎকার করে উঠল—’বাবা পাজী—বাবা ছয়তান–বাবাকে মালবো–বাবাকে টর্চ দিয়ে দিয়ে মালবো–বাবাকে খুউব মালবো’—ঐ যুবকটিই যে তার হতভাগ্য বাবা তাতে আর সন্দেহ রইল না; কেননা, ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে কথামতন কাজও চলতে লাগল। কচি কচি হাতের কিল-ঘুষি—চড়।

বাবাটি ফিফিস্ করে মাননীয় বাচ্চাটির কাছে কিছু বিনীত বক্তব্য রাখলেন। শিশুমহাশয় তখন আরও বেশি জোরে কান্না চড়িয়ে বলতে শুরু করল–’মা কেন আমাকে তলচ্ (টর্চ) দিয়ে মালল–মা কেন ছুদু ছুদু আমাকে কেন টলচ্ দিয়ে ঠাই ঠাই এমনি এমনি অত জোরে মালল’—এইবারে চিত্রার্পিত প্রায় জননীর চাঁচাছোলা গলা শোনা গেল এবং হাতের ভারি সোনার চুড়ির গুচ্ছ ঝিকমিকিয়ে উঠল—

‘মর্ মর্—মর না তুই? মরিস না কেন?… যেমন বাপ তার তেমনি ছেলে!! এখানে কি করে থাকে মানুষ? এটি মানুষ থাকার জায়গা? এত ঘোড়ার আস্তাবল। এখানে এনে তুলবে জানলে কখনও আসতুম? কক্ষনও না। ছি ছি—ছি ছি ছি। এই খড়ের গাদায় মানুষ থাকে? এই নোংরা তেরপলের থলির মধ্যে?…এই যদি মুরোদ, তবে এনেছিলেন কেন? আমরা কালই ফিরে যাব যেমন করে হোক—‘

‘বাবা’ নামধারী অপরাধী যুবক ধৈর্যের প্রতিমূর্তি। নিশ্চল, নিশ্চুপ, পুত্রের চেঁচানি তখন বন্ধ। সে নিঃশব্দে বাপের কেশগুচ্ছ দুইহাতে ছিঁড়ছে মহানন্দে। অপর তরুণী এখনও চিত্রবৎ নির্বাক। উদাসনয়না। সারা তাঁবু জুড়ে শোকপালনের নৈঃশব্দ্য—একটি খড় উড়লেও তার শব্দ হবে।

—’গরু, গরু, গরু। এখানে গরুতে থাকে। এ কি মানুষের থাকার জায়গা? ছিঃ!…একটা ঘর পর্যন্ত যোগাড় করতে পারলে না? ছি ছি ছি। কচি বাচ্চা কেন, বুড়োদেরও তো অসুখ করে যাবে এই ধুলো-কাদা খড় বিচিলির মধ্যে থাকলে! কেন আলাদা আসা কি যেত না? এই টুকুন জায়গায় মেয়েমদ্দ একশো লোকের গাদাগাদি—ঈশ্। একটা তক্তা পর্যন্ত নেই যে বাচ্চাটা শোবে। যত্তোসব ভিখিরির দল-বাবা বার বার আসতে বারণ করেছিলেন, এই জন্যেই। এখন বুঝতে পারছি—ঘেন্না! ঘেন্না!—’

এলিজাবেথ টেলরের Who is afraid of Virginia Woolf? ছবিটা হঠাৎ মনে পড়ল। ‘মানুষ’ শব্দটিতে উনি বার বার ঝোঁক দিচ্ছিলেন—আমার কান ঝাবী করতে লাগল! ইতিমধ্যে বাচ্চাকে মাটিতে নামিয়ে রেখে তার বাবা একটি ফ্লাস্ক খুলেছেন। বোধ হয় দুধ বেরুবে। কিন্তু, না।—যুবকটি এবার নম্র গলায় স্ত্রীকেই সবিনয় আবেদন পেশ করলেন।

—’একটু কফি খাবে? দিই একটু?’

–’চাই না কফি। ফেলে দাও গে। আবার ন্যাকামো হচ্ছে?’ এমন সময়ে একটা অন্য স্বর শোনা গেল। এদিক থেকে। বছর কুড়ি-বাইশের একটি চপল ছেলে, মুখ ফসকে বলে ফেলল—

—’কফি? বাঃ, আপনাদের সঙ্গে কফি আছে বুঝি?’ সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ অভাবনীয় কাণ্ড। ইস্পাতকঠিন কণ্ঠে সেই বিনীত বাবাই বলে উঠলেন—’আছে, তবে ওটা আপনাদের জন্যে নয়।’

.

ঘরে আগের চেয়েও বেশী স্তব্ধতা নেমে এল। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসতে চায়—ছোট তাঁবুটা আরও ছোট হতে হতে ক্রমশ বুঝি আমার গলা টিপে ধরছে। নাঃ বেরিয়ে পড়তেই হবে, আর বিশ্রামে কাজ নেই। ঘুরে আসা যাক একটু। একটু খোলামেলা আকাশ বাতাস চাই। হোক বাইরে ঠাণ্ডা, এই অন্তরঙ্গ উষ্ণতায় গায়ে যে ফোস্কা পড়ছে—এ জ্বালা আমার চামড়ায় সইবে না। এখুনি পালান দরকার! উঠে দাঁড়িয়ে পথে বেরিয়ে পড়ি। কানের মধ্যে বাজছে ‘গরু, গরু! এখানে মানুষ থাকে?’

বেরিয়েই ভয়ানক ধোঁয়া। এই ধোঁয়া আর খড় মিলিয়ে কেমন যেন গোয়াল—গোয়াল একটা অনুষঙ্গ সত্যিই আছে। যাই বা কোথায়। এই তাঁবুর জঙ্গলে পথ চিনে ফেরাও তো সোজা নয়। একটু বেরিয়ে এদিকে ওদিকে চেয়ে দেখলুম যেখান দিয়ে ঢুকেছি সেখান দিয়ে দ্বিতীয় তাঁবু এইটে। সেটা লক্ষ্য করে নিয়ে সোজা উল্টোমুখে হাঁটতে থাকি। মনের ভেতরে সুর কেটে গেছে, মুখ বিস্বাদ।

একা একা হাঁটতে ভালই লাগছে—হাতে মালপত্র নেই, মোটামুটি একটা জায়গায় ফিরে আসব জানি,—আর সব চেয়ে বড় কথা এটা কুম্ভনগর। খবর নিয়েছি। পথচারীদের কাছে, সঙ্গমটা নাকি খুবই কাছে। যাই দেখে আসি। কিন্তু তার আগেই দেখি পথের ধারে খোলা  জায়গায় এক সাধুজীর জ্বলন্ত ধুম ঘিরে গুটিকতক মানুষ গোল হয়ে আগুন পোহাচ্ছেন। তাঁরা সন্ন্যাসী নন, দেহাতী যাত্রী। একজন মাত্র চেলা সাধু রয়েছেন সাধুজীর। সেই ছোট্ট তাঁবুটা রীতিমতো গরম ছিল অতগুলি মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসে। বেরিয়ে এসেই শীতের ঝাঁকুনি খেয়েছি। আগুন পোহানোর দৃশ্যটা পরম রমণীয় লাগল। হঠাৎ কী মনে হল, ধুনি ঘেঁষে বসে পড়লুম। উপস্থিত ব্যক্তিরা মুখ তুলে চাইলেন। একটু বুঝি অবাক। হয় পাগড়ি-কম্বল, নয় গায়ে-মাথায় কম্বল-মুড়ি-দেওয়া, দেহাতী পার্টি। গায়ে-মাথায় শালমুড়ি দেওয়া, আমিও তাদের মধ্যে ঢুকে দিব্যি একপাশে উবু হয়ে বসেছি। মাটিতে কম্বল বিছানো আছে। আহ। এখানে যদি একটু পিঠটা পেতে বিশ্রাম করা যেত, এই আগুনের ধারে, কম্বলের ওপর। কম্বলে অবশ্য ছারপোকা থাকতে পারে। কিন্তু এখানে চিৎপাত হওয়া যাবে না—ওটা ভাল দেখাবে না। পিঠ যতই ক্লান্ত হোক, সাধুর সামনে বসে থাকাই ভদ্রতা। ধুনির আগুন পোহাতে নিশ্চয় মেয়েদেরও বাধা নেই? তবুও একটু যেন অস্বস্তি? কেন রে বাবা? এবারে টের পাই। গাঁজার ছিলিম হাতে-হাতে ঘুরছে। সাধুজীর প্রসাদ সবাই পাচ্ছেন। দেখে আমার মনে হল আমাকেও একটু দেয় যদি তো দিক না, ক্ষতি কি? বাড়ি গিয়ে বুক ফুলিয়ে মেয়েদের কাছে গল্প করতে পারতুম, সাধুর আখড়ায় বসে গাঁজা খেয়েছি, জানিস? কিন্তু ওমা! একী? উইমেন্স ইয়ারের কথা কি সাধুরা কেউ শোনেনি? হায় হায়! ছিলিম আমার সামনে দিয়ে পাস হয়ে গেল যে। একবার নয়, বারংবার। প্রত্যেকবার। আমার ব্যাকুল মুঠোতে মোটে এলই না। সে কেবল পালিয়ে বেড়ায়, মুষ্টি এড়ায়, এত কাছে এসেও ধরা দিল না। পোড়া কপাল ছাড়া কী?

ধুতিপরা মধ্যবয়সী পাঞ্জাবী সাধুজী তাঁর শিষ্যকে কীসব বলছেন, শিষ্য একটা ছোটো পেতলের ডেকচি করে দুধ এনে ধুনিতে চড়ালে।

ও গাঁজা হল, এবারে বোধহয় আফিং-টাফিং হবে। শুনেছি আফিমের সঙ্গে লোকে খুব দুধ খায়। তা—আফিমই বা মন্দ কি? দেখা যাক। আফিমটা হয়তো আমাকেও দেবে। বিলেতে কয়েকবার সাহেবদের গাঁজার আড্ডায়, অর্থাৎ মারিহুয়ানার আখড়ায়—অর্থাৎ ‘পট-পার্টি’তে গিয়েছি। একসময়ে ছাত্রমহলে এবং লেখকমহলে ওদেশে ব্যাপারটা বেশ চালু ছিল। গিয়েছি, কৌতূহলের বশে, কিন্তু ভালো লাগেনি। পুরো ব্যাপারটার মধ্যে কেমন একটা নকলপনা আছে।

বদ্ধ ঘরে গাঁজার ধোঁয়া জমে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, উৎকট গন্ধে দম আটকে আসে, না খেলেও নিশ্বাসে প্রবেশ করে নেশার ধোঁয়া, ঘরে জোের দমে হয় পপ-রেকর্ডের ঝিনচাক্‌ বাজে, নয়তো সেতার, নয়তো হরি ওম। এদিকে ওদিকে ‘স্টোনড’ সাহেব-মেম গেঁজেলরা বসে, শুয়ে, ধ্যানস্থ, স্তব্ধ। অনেক সময়ে অন্ধকার ঘরে দেওয়ালে সাইকিডেলিক আলোর খেলা হতে দেখেছি। অন্য সময়ে ঘরে স্নান বাতি জ্বলে। কখনও বা শুদ্ধ মোমের আলো। যাতে বাইরে থেকে দেখা না যায়। পর্দা-টর্দা ভাল করে টানা থাকে। অত আব্রুর মূলে পুলিশ। গাঁজা বেআইনি। এধরনের ছাত্রদের আখড়ায় পুলিশভীতিটা সর্বদাই প্রবলভাবে কাজ করে—সেই নেশা সত্যি বলতে খুব সুখের নয়। সেই পরিবেশে বন্ধুকেও বন্ধু মনে হয় না। সেই পরিবেশই প্রত্যেককে ভয়ানক সঙ্গীহীন, ভয়ানক একলা করে দেয়।

হোস্টেলের সেই সব পট-পার্টিতে যে টানতো না সেই এলেবেলে হয়ে যেত। তখন আমার সমস্যা ছিল অন্য—-নেশাটা কীভাবে এড়ানো যায়। সিগারেটটা গাঁজা সমেত যখন হাতে আসবে, না খেয়েই অন্যের হাতে চালান করে দিতুম। যে কোনো নেশায়ই দারুণ ভয় ছিল ছাত্রবয়সে। অথচ সোজা রিফিউজ করলে সবাই খেপাবে; তাতেও ভয়! অধ্যাপক হয়ে যখন পট-পার্টিতে গেছি তখন মিষ্টি হেসে রিফিউজ করবার মতো স্বনির্ভরতা আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়ে গেছে। ‘তোমরা ওসব ছেলেমানুষী করছ করো–আমাদের কাছে ও আর নতুন কী!’—এমনধারা ভাবখানা করে অনেক ওপর থেকে করুণাঘন দৃষ্টিপাত করতে শিখে গেছি ততদিনে। কিন্তু আজকে, মধ্যরাত্রের প্রবল শীতে, কুম্ভমেলার পুণ্যতীর্থে, আমার বড়ই লোভ হতে লাগল।

কেননা এখানে পুরো ব্যাপারটাই আলাদা। না-আছে এখানে আইনভঙ্গ করায় পুলিশভীতির অন্তরটিপ্পুনি—না আছে রেকর্ডের ঝমঝমানি, না সাইকিডেলিক আলোর অত্যাচার। খোলা বাতাসে গাঁজার দুর্গন্ধও অতি সীমিত। এখানে স্নায়ুর ছুটি আছে। ওদেশে স্নায়ুকে ছুটি দেবার জন্যে এতই প্রবল তোড়জোড়, যে তাতে স্নায়ুর অবস্থা, আরও সঙ্গীন হয়ে ওঠে। এখানে এই জ্বলন্ত ধুনি, এই কম্বলজড়ানো দেহাতী স্নানার্থীরা, এই প্রায় নগ্ন শ্মশ্রুগুম্ফসজ্জিত সাধুজি আর তাঁর চেলার সঙ্গে, মৌনী অমাবস্যার গঙ্গাদ্বীপে চমৎকার মানিয়ে যাচ্ছে গাঁজার ছিলিমটা। একবার হাতে যদি আসত, আমিও আজ প্রসাদ পেয়ে দেখতুম। কিন্তু এল না। নারী বলে স্পষ্টত আমার সঙ্গে ভিন্ন আচরণ করা হল। ভারতীয় সংবিধানবিরোধী আচরণ একেবারে ডিসক্রিমিনেশন!

পেতলের ডেকচিতে দুধের মধ্যে এলাচ দারুচিনি দিয়ে চা, চিনি ফোটান হল। এবং পেতলের গোল বাটি করে আমাকে চমৎকার ধোঁয়া ওঠা, হাল্কা গোলাপি রঙের দারুচিনি দ্বীপের স্বপ্নসুরভিত এক বাটি স্বাদু পানীয় এনে এগিয়ে দিলেন, চেলা নয়, সাধুজী স্বয়ং। ‘লো বেটি জরাসা চায় তো পি লো।’ সাধুজি চা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন–ব্যাগ থেকে রুমাল বের করবার সময় নেই। শালটা দিয়েই জড়িয়ে উত্তপ্ত পেতলের বাটিটা দু’হাতে ধরে নিলুম। আহ—গরম বাটি থেকে প্রীতিময় উত্তাপ এসে আমার সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। গাঁজার্থীরাও চা খান দেখা গেল। কিন্তু বাটি মাত্র চারটি। আমাকে নিয়ে মেহমানই পাঁচজন, তাছাড়া গুরু-শিষ্য। চা খেয়ে বাটি ফেরত দিলে তবে বাকিদের চা দেওয়া হবে। আমি আবার গরম গরম কিছুই খেতে পারি না। জুড়োনোর জন্যে অপেক্ষা না করে উপায় নেই। পেতলের পাত্র তো সহজে জুড়োবে না। সাধুজী বেশি কথা বলেন না। তাঁর মেহমানেরা একেবারেই না। ঐ তাঁবু থেকে চলে এসে এই সাধুর আস্তানা একটা মস্ত রিলিফ্। এখানে কোনও প্রশ্ন কিংবা অভিযোগ নেই—কোনো মান অভিমান কলহের ব্যাপার নেই। ঘড়িতে দেখলুম একঘণ্টা অনেকক্ষণ হয়ে গিয়েছে। সর্বনাশ। আমার নবলব্ধ গার্জেনরা যদি তাঁবুতে এসে আমাকে খুঁজে না পান? মালপত্রের বোঝা চাপিয়েছি ওঁদের দলের ওপরে, সেই যে ভারত সেবাশ্রমের ছাউনির নিচে চেয়ারে গোঁফওয়ালা ‘দাদু’ বসে আছেন আমার মালপত্র আগলে। ছি ছি ছি।—সাধুজীকে প্রণাম করে, প্রণামী দেব কিনা বুঝতে পারলুম না, কাকেই বা দেব, কোথায়ই বা দেব। দিলে মেহমানীর অপমান হবে না তো? থাক বাবা, কাজ নেই—। ভাল করতে গিয়ে মন্দ না করে ফেলি। শুধু শুধুই প্রণাম করি। সাধুজী কী যে বললেন আশীর্বচন, ঠিক বুঝতে পারি না। চেলাকেও প্রণাম করতে হয় কিনা জানি না, নমস্কার ঠুকেই পলায়ন করি। মুখের মধ্যে, বুকের মধ্যে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়া সুরভিত দুধ-চায়ের উষ্ণ আরামেই সাধুজীর আশীর্বাদ মাখান।

ওঁদের তাঁবুতে গিয়ে দেখি সবাই বেরিয়ে গেছেন আর একজন আছেন পাহারাদার, আর সঙ্গে আছেন ঘুমন্ত বাচ্চা নিয়ে সেই বেচারী বাবা,—সিংহাসনে বসে। সবাই মিলে স্নানে গেছেন, এমন কি ভোটকম্বলের রাণীমায়েরাও। তাঁবু ফাঁকা, সুসান্। প্রশ্ন করে ফেলি—’এখনই সবাই স্নানে গেলেন?’

-’আজ্ঞে হ্যাঁ, সাড়ে নটা থেকেই তো অমাবস্যে পড়ে গেছে। আস্তে আস্তে সবাইকে নাইয়ে নিতে হবে তো।’

–’আপনারা যাবেন না?’

-’আমরা কয়েকজন পরে নাইবো। দুটোর পরে। এখন বুড়োদের পাঠিয়েছি আর মেয়েছেলেদের। এরা বেলাবেলি নেয়ে নিলেই ভাল, এই বেলা তেমন ভিড় হয়নি। এখনও পিছল হয়নি ঘাটের মাটি।’

–’দুটোর পরেই আসল মহাকুম্ভের লগ্নটা পড়ার কথা না?’

—‘হ্যাঁ, তবে কি জানেন, অমাবস্যেটা পড়ে গেলেই হল একপক্ষে। আসল পুণ্যি তো মনে মনে। বলুন ঠিক কিনা?—আসল কথা কি জানেন, এতসব বুড়োবুড়িদের সঙ্গে এনেছি, তাদের দায়িত্ব তো আমাদেরই। অত ভিড়ের মধ্যে, সামাল দেওয়া শক্ত হবে। তাই আগেভাগে সেরে ফেলা আর কি।’

ভালো কথা। আগে ভাগে পুণ্য সেরে ফেলা হচ্ছে। যে মহালগ্নের জন্যে এত কষ্ট করে আসা, তার আগেই। অবিশ্যি পুণ্যতো সত্যিই মনে মনে। তার জন্যে এই প্রয়াগে আসারও দরকার নেই, কুম্ভস্নানও একেবারেই অপ্রয়োজনীয়।—কথা বলতে বলতেই বন্ধুরা এসে পড়লেন। এক আশ্রয় ছেড়ে পথে বেরিয়ে পড়লুম অন্য আশ্রয়ের খোঁজে।

.

এসেছিলুম একলা। কিন্তু মাত্র ক’একটা মুহূর্ত ছাড়া সঙ্গীবিহীন সময় কাটেনি। তবু সবাই বলবে আমার সঙ্গে কেউ নেই? সঙ্গে ঈশ্বর আছেন, আছেন ঈশ্বরপ্রেরিত সঙ্গীরা। এসব সম্ভাবনা তো ভাবিনি। কিছুই ভেবেচিন্তে আসিনি—শুধু মনে করেছিলুম চলে তো যাই—যাওয়াটাই খুব জরুরী—তারপর যা হয় একটা হবে। ট্যুরিস্ট ব্যুরোতে যেতে পারিনি, কিন্তু তার বদলে এসেছি ঢের ঢের ভালো জায়গায়। আসল জায়গায়। আমি এসেছি তীর্থে।—ট্যুরে তো নয়। এই তো ভারততীর্থ,–এক কোটি লোকের সঙ্গে মিশে কবেই বা কী করতে পেরেছি আমি? এই ধুলোয় বসতে পাওয়াটুকুই আমার তীর্থবাস। গড়িয়াহাটেও তো কত ধুলোমাটি আছে। কিন্তু ধুলোয় শুয়ে পড়তে পারি কি আমি সেখানে? ধুলো অত সস্তা নয়। ধুলোয় বসতে পাওয়াও অতো সস্তা নয়। পাগলা অজিতনারায়ণই কেবল সেটা পারে। তার জন্যে ঢের মূল্য ধরে দিয়েছে সে। এ স্বয়ং মা ধরিত্রীর কোল, অতি মহার্ঘ শয্যা। ইচ্ছে করলেই ধুলোয় শয্যা পাতা যায় না। আমরা পারি না। আমরা মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, বড্ডই মাঝারি মাপের। এখানে এই কুন্তনগরের কল্যাণে কিছুটা ছড়িয়ে পড়বার ভাগ্য আমার হয়েছে, সহস্র যাত্রীর চরণধূলায় ধূসর হবার ভাগ্য। মুখ ফুটে বললে কথাটা এত বেয়াড়া রকমের ন্যাকা ন্যাকা শোনায় যে বলা যায় না, কিন্তু বুকের ভেতর যে-কথাটা কেবলই বেজে চলেছে—সেটার গলাও তো টেপা যায় না? রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন—’ওই আসনতলে মাটির পরে লুটিয়ে রবো। তোমার চরণ ধূলায় ধূলায় ধূসর হব’—তখন দিব্যি স্বাভাবিক শোনায় যেহেতু তিনি ঋষি কবি। কিন্তু আমি ওটা নিজের ভাষায় বললেই শোনাবে বেতরো, বেসুরো বানান। তার চেয়ে তাঁর ভাষাতেই বলা ভালো। আমাদের মূক মুখে তিনিই তো ভাষা যুগিয়ে দিয়ে গেছেন। হাঁটতে হাঁটতে একটা জায়গায় এসে থামি।

–’এখানে কিছু খেয়ে নেওয়া হবে।’ বলেন সঙ্গীরা। পুরি তরকারি মিঠাই বিক্রি হচ্ছে দোকানে। আমার হাতে চলে এল শালপাতার তৈরি বাটি, তাতে একগোছা পুরি, একহাতা তরকারি, দুটো অমৃতি জিলিপি। মুখে খাদ্য তুলতেই মনে পড়ে গেল লতিফ আর লান্ননের কথা। এরা এতক্ষণে সেকেণ্ড ট্রীপ নিয়ে পৌঁছে গেছে নিশ্চয় আবার ঝুঁসীতে। শার্দুল সিং রাতের খাবার পেয়েছেন তো? সকাল থেকে অভুক্ত ছিলেন একাহারী বৃদ্ধ। লালা গোঙাও ফিরে গিয়েছে এতক্ষণে তাদের সেই ছোট সাদা বাড়িতে। মালপত্র হাতে নেই, দৌড়ে দৌড়ে যেতে পারবে, যদি না আবার কোনও শোভাযাত্রায় আটকে পড়ে। খিদে-টিদেও পেয়ে গিয়েছে বেচারাদের। আবার কি কেউ বাতাসা যোগাবেন, পথিমধ্যে ওই বালকদের?

-’কি ভাবছেন? বাড়ির কথা?’

—’বাড়ি? নাঃ।’ সত্যি তো, বাড়ির কথা মনে পড়েনি। বাড়িতে এতক্ষণে গুরদীপের টেলিফোন পৌঁছে যাওয়া উচিত। নইলে মা কালকে পাবেন আমার পোস্টকার্ড, যদি গুরদীপ তা ডাকে দেয়। এবারে গুরদীপের পাঁচটাকা আমাকে কামড়াতে শুরু করল কোথায় পুজো দেব? পুজো কোথায় দেয় এখানে? আমি তো জানিও না এসব

‘একজন আমাকে পাঁচটাকা দিয়েছে তার নামে পুজো দিতে, কোথায় পুজো দিই বলুন তো?’—’কুম্ভে লোকে পুজো দেয় না। স্নান করে। মাথা কামায়। অনেকে পিণ্ড দেয়। যাঁর নামে পুজো দেবেন আপনি, তাঁর গোত্র জানেন?

-’তা তো জানি না। কিন্তু পিণ্ড তো নয়, সে তো জীবিত ব্যক্তি।’

–’এক কাজ করুন, টাকাটা আমাদের দিয়ে দিন, আমরা একটু (গলাখাঁকারি) ওদিক থেকে ঘুরে আসি, কী বলিস? বড্ড শীত! আর ওঁর নামে আমরা প্রত্যেকে একটা করে ডুব দেব? সেই ভালো।’

-’হ্যাঁ হ্যাঁ—সেই ভালো, সেই ভালো—‘ সমবেত সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়। শুনে আমি—’হেঁ–হেঁ–হেঁ’—করে হাসি। না গুরদীপের টাকা তোমাদের আমি দেব না হে ছোকরা। যদিও জানি তোমরা ভাল মানুষ। বরং ওটা ওই সাধুজীকে প্রণামী দিয়ে দিলে ভালো হত। তখন কি ছাই মনে ছিল?

–’উহুহুহু, কী ঠাণ্ডা। কী পড়ছে বলতো? বৃষ্টি নাকি? আরে—বৃষ্টিই পড়ছে যে! সব্বোনাশ! নির্ঘাত তাই। ঝিরঝির করে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। শালটা ভাল করে জড়িয়ে নিই। ছেলেরা সিগারেট ধরিয়েছে। ওদের ঢেলে দেওয়া জলে হাত ধুয়েছি। ডাস্টবিনে শালপাতাটা ফেলেছি! না, কেউই পথে এঁটো শালপাতা ফেলেন নি। সব শালপাতা ঝুড়িতে। অন্তত এই দোকানের সামনে। তিরুপতির প্রসঙ্গটা মনে পড়ে গেল। না, কুম্ভনগরও বেশ পরিচ্ছন্ন বইকি।

তখন বুঝিনি কয়েকঘণ্টা পরেই কথাটা ফিরিয়ে নিতে হবে মনের ভেতরে।

-’একটা পান হবে?’

—’নিশ্চয়ই।’ একজনের হাতে শালপাতায় মোড়া পানের খিলি প্রস্তুত।—’জর্দা?’

–ওরে বাবা। জর্দা? কী সর্বনাশ! নো স্যার। নো জর্দা। ‘ক্যুয়োড্‌ দ্য রেভেন, নেভার মোর।’ কদাচ জর্দা নয়।

সহকর্মী দেবীবাবুর ভাইয়ের বিয়েতে জর্দা খেয়েছিলুম বটে। সেই যথেষ্ট। ছাদে নেমন্তন্ন খেয়ে-দেয়ে নামতে নামতে সিঁড়িতে মিঠেপানের সঙ্গে অলস আরামে একচিমটি জর্দাও তুলে নিয়েছিলুম। প্রণবেন্দুর দেখাদেখি। নিচে নেমে রাস্তায় ক’পা চলেছি মাত্র। তারপরই শুরু হয়ে গেল কেলেংকারি। রাজপথে আমার অনিচ্ছুক বেলেল্লাপনা। দেবীবাবুরা ভাটপাড়ার ব্রাহ্মণ কিন্তু বাড়ি করেছেন সিঁথিতে।

সিঁথির মোড় পর্যন্ত পৌঁছুতে না পৌঁছুতেই জর্দার কল্যাণে আমার ‘পায়ের ভিতর পা। ফুটপাথ বদল হয় মধ্যরাতে।’ ভাগ্যিস সঙ্গে আছে তিনবন্ধু প্রণবেন্দু, অমিয়, সুবীর। তাদেরই হল মুশকিলের একশেষ। রাজপথে রণক্ষেত্র—একেবারেই বাগ মানান যাচ্ছে না আমার বল্গাছাড়ানো পা-দুটোকে। মাথার ভেতরে লোহার গোলা ভরে দিয়েছে কেউ। যার ভারে ঘাড় লটকে পড়ছে বুকে। পা দুটো শোলা দিয়ে তৈরী খেলনা। আমি কি হাঁটতে পারি?—

বিয়েবাড়ির সাজগোজ করা একটি মেয়ে বড় রাস্তায় চলতে চলতে একবার এর ঘাড়ে, আরেক বার ওর পিঠে ঢলে পড়ে ধাক্কা খাচ্ছে : পথচারীদের নয়নলোভন হৃদয়হরণ এই দৃশ্য সৃষ্টি করে, (যা আমার ধাতু-বিরুদ্ধ।) জগতের পাঁচজনকে ফ্রী আনন্দ জুগিয়ে, কোনরকমে তো একটা মিনিবাসে উঠে পড়া গেল। শ্যামবাজারের মোড়ে এসে চারজনে নামলুম। আমাকে নিয়ে ২বি বাসে তুলবে বলে পাঁচ রাস্তার মোড় পেরোতে গিয়ে বন্ধুবর্গ হাল ছেড়ে দিলে। আমি তখন ঘাড় মাথা গুঁজে পা লটকে বসে পড়েছি এক দুর্দান্ত অশ্বারোহী যোদ্ধা-যুবকের পদমূলে।—ওইখানেই অগত্যা আমাকে ফেলে রেখে সঙ্গীরা গেল ট্যাক্সির খোঁজে।—ট্যাক্সিতে ঢুকেই আমি লম্বা। ভীষণ বমি পাচ্ছে। বাড়িতে নামার পরে আমার মাকে ডেকে আনল। নেহাত মা জানেন তাঁর অকর্মণ্য মেয়েটিকে ভাল মতোই, তাই উলটোপালটা বুঝলেন না। কাজের লোকজনেরা পর্যন্ত হেসেই আকুল। ছিঃ ছিঃ দিদিমণির জর্দা খেয়েই এই! এতটুকু সহ্য নেই শরীরে! যে-মেয়েটি আমার বাচ্চাদের দেখে, সে চটপট আমার মাথা ধুইয়ে, এক গ্লাস বরফ দেওয়া লেবুর শরবত খাইয়ে দিল। ওর বাবা মদতাড়ি খেয়ে বাড়ি এলে ওর মা নাকি এই অব্যর্থ প্রণালীতে তাঁর পরিচর্যা করেন। দিদি আজ জর্দা খেয়ে বাড়ি এসেছেন। অতএব ওটাই করা হোক। ওর গৃহ চিকিৎসায় উপকারও হয়েছিল। কিন্তু জর্দা খাবার শখটা আমার একদিনের নয় সারা জন্মের মতো মিটেছে। এই সর্বনেশে বস্তুটি অন্যেরা খায় কী করে? অল্প বয়সীদের মধ্যেও আজকাল দেখি জর্দা বেশ পপুলার হয়েছে! জর্দা ছাড়া পানও ছিল ভদ্রলোকের কাছে। তিনিই, শোনা গেল, ওদের দলের ‘খাদ্যাধ্যক্ষ’। আমার কাছে খাবারের দাম নিলেন না কিছুতেই। হিসেব গুলিয়ে যাবে তাতে নাকি। বেশ কথা? হাঁটতে হাঁটতে ভারত সেবাশ্রম এলুম। পরের খরচে তীর্থ করলে নাকি পুণ্য হয় না। কিন্তু ‘পর’ কে? আমার ‘আপনাই বা কে? নিজের বলতে আমার কী আছে?

দাদু তো দেখে হুংকার ছাড়লেন।

‘হ্যাল্লো নাতনী, হোয়াট-ইজ দিস? আমি যে তোমার কাসাবিয়াংকা হয়ে গেলুম! দি বয় স্টুড অন দি বার্নিং ডেক—বলি মালপত্তরের খোঁজ কি করতে নেই? এই কি তোমার চা খাওয়া? এ যে রাইটার্স বিল্ডিংয়ের টিফিন টাইম? টানা তিন ঘণ্টা পেরিয়ে এলে?’—ভীষণ লজ্জিত হয়ে পড়ি। সত্যিই তো। কোনো ব্যাখ্যা নেই, কোনো কৈফিয়ত নেই! কে জানে ওঁর খাওয়া হয়েছে কিনা? আমার নিরুত্তর কাঁচুমাচু মুখ দেখে দাদু হেসে উঠলেন সশব্দে।

—’ডোন্ট ওয়ারি। শোনো, সুখবর আছে। আমরা একখানা তাঁবু পেয়ে গেছি। চলো সেখানে সব মালপত্তর নিয়ে যাই। খাওয়া-দাওয়া এইবারে হবে। সেইখানে গিয়ে।’

মালপত্র কে কোনটা নিলে কে জানে। আমার কাঁধে কেবল অহংকারের ঝুলিটাই। দলের সঙ্গে হাঁটতে লাগলুম। তাঁবুটি মস্ত বড়। এ সেই পাহাড়ি বাবার আস্তানার মতো নয়। সে তাঁবু যদি পায়রার খুপরি হয়, এ তাঁবু তাহলে চিড়িয়াখানার পাখির খাঁচা। ঢুকে এককোণে দেখি আমার সুটকেসের ওপরে আমার লোটা-কম্বল-ব্রিফকেস গোছানো। সত্যি, এখানে ব্রিফকেসটা বড্ডই বেমানান। এ তাঁবুতে খড়ের ওপরে মাদুর পাতা, ওখানে মাদুর ছিল না। তার মানে তাঁবুতে তাঁবুতে কৌলিন্য ভেদ আছে। গুজব শুনলুম এতদিন দু’শো টাকায় সাতদিনের জন্য তাঁবু পাওয়া যেত, সন্ধে রাত্রে ছিল আড়াইশোতে দুদিন, এখন এঁরা পেয়েছেন বুঝি তিনশোয়। তাঁবুতে বসেই সবাই লাইন দিলেন। সামনে ঝপাঝপ্ শালপাতা পড়ল; তাতে সপাসপ পুরি, সজ্জী, ডাল, মিঠাই। আমার খাওয়া হয়ে গেছে। আর পাত্ পেতে বসা সম্ভব নয়, যদিও পক্তি ভোজনের আলাদা একটা আনন্দ আছে। কিন্তু সেটা না খেয়েও ভাগ করে নেওয়া সম্ভব। সঙ্গী ছেলেরা দিব্যি দ্বিতীয়বার মহানন্দে খেতে বসে যায়, যেন কত কাল অভুক্ত রয়েছে। চমৎকার একটি তৃপ্তিকর দৃশ্য অস্পষ্ট আলোয় ফুটে উঠল তাঁবুর মধ্যে।

এখানে আলাপ হল সেই গায়ক ভদ্রলোকের সঙ্গে, দিব্যি কোটপ্যান্ট পরে যিনি সন্ধ্যায় মাইকে লবকুশের গান গাইছিলেন। তিনি এবারে রুমালের খুটটি খুলে মেঝেয় কিছু নোটের তাড়া ঢেলে দিলেন। এবং বেশ কিছু খুচরো পয়সাও। তারপর অন্য একটি ছোকরাকে ডেকে বললেন—’ভাই একটু গুনে দাও তো। আর পারছি না। বড় টায়ার্ড লাগছে।’ টাকা গুনতেও যে কারুর টায়ার্ড লাগে, তা বোধ হয় কেবল এমনি পূর্ণকুম্ভের মেলাতেই দেখা সম্ভব! বাচ্চা ছেলেগুলোর কিন্তু মোটেই টায়ার্ড লাগল না, মহা উৎসাহে গুনে ফেলল, ঝাঁপিয়ে এসে। খুচরোতে নোটেতে মিলিয়ে হল মন্দ নয়। শ’তিনেক টাকার মতো প্যালা পড়েছে ভদ্রলোকের। ছেলেরা চেঁচিয়ে উঠল-’দাদা, ও টাকাটায় আমাদের খাওয়াবেন!’ দাদাও প্রফুল্ল বদনে বললেন—‘বেশ! বলো কবে খাবে?’

আমি আগে কীর্তনের এদিকটা তো দেখিনি। থালাতে প্যালা ফেলেইছি মাত্র। প্যালা কুড়োনোর পরের অংশটা আজ দেখা হল। ভালো। হিংসে করে লাভ নেই, যেহেতু আমি গাইতে একদমই পারি না! কিন্তু কবিতা পড়ে সামনে থালা রাখার আইডিয়াটা মাথায় চট করে একবার খেলে গেল। মন্দ কি? কবিরা যথেষ্ট আয় করতে পারবেন এই পথে—ডিলান টমাসের মতো। না, গায়ক ভদ্রলোককে হিংসে করব না। অনেক ক্লান্ত, বিনিদ্র মানুষকে ওঁর গান আজ শান্তি ও সঙ্গ দিয়েছে। এই টাকা গায়ক ভদ্রলোকের উচিত প্রাপ্তি।

পাশেই মা আনন্দময়ীর তাঁবু। স্বরূপানন্দজীর কাছে খবর নিয়ে এসে শার্দুল সিং বলেছিলেন, ভোর পাঁচটার সময়ে তিনি মায়ের সঙ্গেই স্নানে যাবেন, তখন আমাকেও সঙ্গে নিয়ে যাবেন। নিজের মালপত্র রেখে দিয়ে একটু পরেই ঘুরে এসে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে পুনরায় জানিয়েছিলেন, না, তা হবে না! মা মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে স্নানে নামেন না। অন্য স্বামীজিরা মেয়েদের নিয়ে গিয়ে রাত দুটো থেকে পাঁচটার মধ্যে স্নান সমাপন করিয়ে আসবেন। মায়ের সঙ্গে কেবল পুরুষ শিষ্যবৃন্দ অ্যালাউড। অতএব এই স্ত্রীজাতীয় শার্দূল শাবকটি যেতে পারবেন না পিতা শার্দুলের সঙ্গে। শার্দূল সিং বলেছিলেন, ‘কিন্তু আমাদের আশ্রমের মেয়েদের সঙ্গে তুমি যাতে নাইতে পার তার ব্যবস্থা আমি করে দেব।’ তারপরে তো তিনি নিজেই হাওয়া হয়ে গেলেন। নাকি আমিই? তিনি হয়তো তার খানিক পরেই হস্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছিলেন, এসে দেখলেন আমিই হাওয়া। সেও তো হতে পারে। অপরজনকে বেনিফিট অব ডাউট দেওয়া ছাড়া জগতে তৃপ্তি নেই। এঁরা অনেকে গিয়ে আনন্দময়ীকে প্রণাম করে এসেছেন। আনন্দময়ীর নামের কল্যাণেই আমি এ অঞ্চলে এসে পড়েছি, এই মানুষদের স্নেহের আঁচলে ঠাঁই পেয়েছি! একপক্ষে তাঁর কাছে আমি কৃতজ্ঞ বৈকি। এতক্ষণ ওঁরই আশেপাশে ছিলুম, অথচ মনেই পড়ল না যে একবার আনন্দময়ীকে দর্শন করে আসা উচিত। এখন খুব মন কেমন করতে লাগল এ-তাঁবুতে বসে বসে। আমি তীর্থযাত্রী বটে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তীর্থযাত্রীদের আচার-বিচার কিছুই জানি না।

অনবরত মাইকে ঘোষণা হচ্ছে—’মৌনী অমাবস্যার যোগ অনেকক্ষণ পড়ে গিয়েছে, আপনারা অযথা দেরি করবেন না, স্নানে বেরিয়ে পড়ুন। পরে ভিড় বাড়বে।’

দাদু বললেন—’সব মিছে কথা। যোগ এখনও পড়েনি। অমাবস্যাটা পড়েছে। কিন্তু এ-বছরে যে যোগটা আসল, গ্রহ-নক্ষত্রের সেই বিশেষ সংস্থান রাত দুটোয় শুরু, কাল সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত আছে। এসব বাক্য কেবল ভিড় পাতলা করার জন্য। লোক ঠকানো কথা।’

আমরা ঠিক দুটোয় বেরুব কথা হল। পঞ্চাশের জায়গায় এখন একান্নজন। দাদা এসে ঘোষণা করলেন—’মস্ত সুসংবাদ। আমাদের সঙ্গে করে স্নানে নিয়ে যাবেন স্বয়ং কানাই মহারাজ। ঠিক দুটোয় বেরুবেন। সবাই তৈরি হয়ে নিয়ো। পাংচুয়ালি।’

ভীষণ হাততালি পড়ল। চমৎকার ব্যবস্থা। কানাই মহারাজ, শুনলুম, ভারত সেবাশ্রমের সর্বভারতীয় ব্যবস্থাপনার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তিনি স্বয়ং সঙ্গে থাকলে আর অব্যবস্থার প্রশ্নই নেই।

ইতিমধ্যে এক বয়স্ক ভদ্রলোক এসেছেন তাঁবুতে, যাঁকে আগে দেখিনি। ছেলেরা তাঁকে মেসোমশাই বলে ডাকছে। তিনি আমাকে জুটতে দেখে স্বভাবতই অবাক হলেন—’এটি কে?’ আমি নাম বলতেই তিনি বললেন-’আরে তুমিই কি আগস্টে অক্সফোর্ডে গিয়েছিলে?’

এতক্ষণ যাঁরা আমাকে স্নেহভরে ঘরে জায়গা দিয়েছেন, দেখাশুনো করেছেন, তাদের কাছে ‘আমার হঠাৎ একটু লজ্জাই করল। জীবনে কখনও এর আগে ‘অক্সফোর্ড’ শব্দের সঙ্গে তেমন লজ্জার যোগাযোগ ঘটেনি। কিন্তু এই পরিবেশে—ইতিমধ্যে কিছু কিছু জেনেছি—এঁদের কে কী করেন। কার কতদূর পড়াশুনো। কেউ কারখানার শ্রমিক, কেউ ছোট দোকানদার, কেউ ইতি-উতি ব্যবসার চেষ্টা করেন, কেউ বা কেরানি। এঁদের মধ্যে হঠাৎ ওই সব লম্বাচওড়া বিজাতীয় শব্দের ভুতুড়ে আওয়াজ বড়ই বেখাপ্পা শোনাল। মনে হল কেমন যেন ঠকিয়ে ঢুকে পড়েছি এঁদের হৃদয়ের সম্প্রীতির আওতায়। আমার যেন সেটা পাওনা ছিল না। যারা এরকম কথায় কথায় অক্সফোর্ড-হার্ভার্ড ঘুরছে, তাদের এ দেশের কোথাও কোনো উষ্ণতা প্রাপ্য নয়। তারা বুঝি খাঁটি বাঙালীর ভেতর-বুকের বেড়া ডিঙোনোর অধিকারটা হারিয়ে ফেলেছে। এ যেন আমার ডুডুটামাক দুটোই খাওয়া! চোর চোর মুখ করে বলি—

–’হ্যাঁ, যেতে হয়েছিল। কিন্তু আপনি কী করে…?’

–’তুমি হাঙ্গারি না চেকোস্লোভাকিয়া কোত্থেকে যেন গিয়েছিলে অক্সফোর্ডে—ওখানে আমার মেয়ের সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল। সে তোমার সঙ্গেই যাদবপুরে পড়ায়।’

আরে? শোভার বাবা? চট করে একটা প্রণাম করে ফেলি। পৃথিবীটা কতটুকু? এর মধ্যে অশোকদার চোখের চিকিৎসক অমলবাবু, এরই মধ্যে শোভার বাবা মেসোমশাই। এই যে লক্ষ মুখের ভিড়ের মধ্যে আমি চেনামুখ খুঁজে খুঁজে হাঁটছিলুম সারা বিকেল, সে খোঁজা আমার মিথ্যে হয়নি তাহলে। তবুও লোকে বলবে, আমি একলা পথে বেরিয়ে ভুল করেছি? রিস্ক নিয়েছি? বড্ড বড় বুকের পাটা? দূর। বাড়ি থেকে দূরে আর এলুম কখন? বাড়িতেই তো আছি! একজন বাবা ছিলেন এতক্ষণ আমার পথসঙ্গী হয়ে, তিনি থেমে পড়তেই এবারে মেসোমশাইকে পেয়েছি। খুবই স্নেহপ্রবণ মানুষ। অমলবাবুর প্রশংসায় উনি দশমুখ। সত্যি অমলবাবু খুব আন্তরিক মানুষ। সত্যিই ভক্ত। মজা এই যে সাধুসঙ্গের জন্যেই তো মানুষ কুম্ভে আসে? আমার সন্ন্যাসীসঙ্গ না হোক, সাধুসঙ্গ হচ্ছে সমানেই। এতগুলি সৎ মানুষ, এতগুলি বিশ্বাসী হৃদয়, এতগুলি ভক্তপ্রাণ একসঙ্গে আমার চারিপাশে—এমন সৌভাগ্য কি আমার সহজে আবার হবে? কোনও কনফারেন্সে যখন যাই আমার তখনও মনে হয়, কতগুলি পণ্ডিতের সঙ্গ পেলুম, কত মহৎ চিন্তার উন্নত বুদ্ধির মানুষের সঙ্গে আজ দেখা হল। আমার কী সৌভাগ্য! এতটা আমার মত অভাজনের কি পাওনা ছিল? নিশ্চয়ই না। আমি কেবলই প্রাপ্যের অতিরিক্ত পাই। সুখও যেমন, দুঃখও তেমনি। খোদা আমাকে যখন যা দেন, ছপ্পড় ফোড়কে দেন।

ইদানীং জেনেছি কনফারেন্সে আসেন প্রধানত দু’রকমের লোক। একদল সরস্বতীর পূজারী, পণ্ডিত। আর একদল মজা লুটিয়ে র‍্যাকেটিয়ার। এছাড়াও তৃতীয় একটি অপ্রধান গুচ্ছ থাকে যারা আমার মতো, শিক্ষার্থী। বাগ্দেবীর রূপমুগ্ধ, সম্মোহিত, দুর্ভাগা শূদ্র। যাদের বুকের মধ্যে ইচ্ছে আছে, কিন্তু রক্তের মধ্যে জোর নেই সরস্বতীর পদপ্রান্তে পৌঁছতে পারার।

তীর্থেও নিশ্চয় তেমনিই নানারকমের যাত্রীর সমাবেশ হয়। একদল তো সাধু-সন্ন্যাসী [একদল অসাধু সন্ন্যাসীও নিশ্চয় আসেন।] আর একদল ভক্ত। আর তৃতীয় একদল, যারা ভক্ত হতে চায়। যেমন আমি। আমার ভক্তির ইচ্ছে আছে, অথচ এই ‘অথচ’টা এখনও বুকের মধ্যে বড় প্রবল। আমার দলও নিশ্চয়ই বেশ ভারী। যাঁরা এই ‘অথচ’ খোঁচাতে চান। যাঁরা সন্ন্যাসী, ভক্তের কাছে তাঁদের সঙ্গ যেমন মূল্যবান,—যাঁরা ভক্ত মানুষ, তাঁদের সঙ্গও ভক্তিলোভী ‘অথচ’দের কাছে তেমনি মূল্যবান। সন্ন্যাসী-সঙ্গ নাই পেলুম, এই যে এত ভক্তসঙ্গ পাচ্ছি, এই আমার ঢের পুণ্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *