সেই অজানার খোঁজে ২.৮

অবধূত নিজের ভাগ্য কখনো দেখেন নি, কখনো যাচাই করেন নি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কখনো ভালো করে নিজের কপাল পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করেন নি। দুর্ভাগ্য মানুষকে তাড়া করে ফেরে এমন একটা কথা শোনা ছিল কিন্তু নিজের বেলায় দেখছেন এর বিপরীতটাও তার থেকে কম সত্যি নয়। একে তিনি সৌভাগ্য বলবেন কিনা জানেন না। কারণ এর সঙ্গে আত্ম-তৃপ্তির যোগ স্বাভাবিক, তা তাঁর নেই। কিন্তু কোথায় ছিলেন, আজ ভাগ্য তাঁকে কোথায় এনে দাড় করিয়েছে! নাম যশ খ্যাতি অর্থ ধাওয়া করে আসছে। কাছের লোক দূরের লোক তাঁকে দুঃখ জমা দেবার মতো একটা মানুষ ভাবছে। শক্তির আধার ভাবছে। নিজের ভাগ্য গণনা না করেও তিনি বুঝতে পারছেন কর্মের আরো প্রবল স্রোতের মুখে তিনি ভেসে চলেছেন, ভেসে যাবেন।

কিন্তু এর সঙ্গে তার নিজস্ব শক্তির যোগ কোথায়? অনেক রোগের তিনি হদিস পান, ওষুধ সম্পর্কে বিচার বিবেচনাও প্রখর, মানুষের দিকে চেয়ে কিছু লক্ষণ ধরতে পারেন, তাপ পরিতাপ সম্পর্কে একটা ধারণা হয়। কিন্তু এ-সবের সঙ্গে তাঁর নিজস্ব শক্তির যোগ কোথায়? অথচ কল্যাণীর দিকে চেয়ে মনে হয় শক্তি বলে কোথাও কিছু আছে। যা তার নেই।

সুবুর মৃত্যুর পর তিনি বড় রকমের একটা নাড়াচাড়া খেলেন। স্ত্রীর পাশে নিজেকে এমন শক্তিশূন্য আর কখনো মনে হয় নি। তাঁর এই অস্তিত্বও যেন স্ত্রীর ওপর নির্ভরশীল। বক্রেশ্বরের ভৈরবী মা মহামায়া তাঁকে যেটুকু দিয়েছেন সেটা এই মেয়ের মুখ চেয়ে। কংকালমালী ভৈরব তাঁকে দীক্ষা দিয়েছেন, তাঁর দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন তা বড় আদরের এই মেয়ের জন্য। আজ তাঁর যা কিছু তার সবই কল্যাণীর জন্য। শক্তি কি জানেন না, কিন্তু এই শক্তির বন্ধনে আটকে আছেন।

ভাইয়ের মৃত্যুর পর একটা নীরব আক্রোশ তাঁকে যেন পেয়ে বসল। শক্তির দৌড় দেখার আক্রোশ। কল্যাণীর দোষ নেই, কিন্তু ভাইয়ের এমন অস্বাভাবিক মৃত্যুর উপলক্ষ তো বটে। কল্যাণী যা বলেন তিনি তাঁর বিপরীত করেন। তাঁকে সাহায্যের জন্য ডেকে ওষুধ বানাতে বসলে বিকেল গড়ায়। এরই ফাকে-ফাঁকে কল্যাণী যা এনে দেন, বিরক্তি দেখিয়ে দিব্বি খেয়ে নেন, স্ত্রীর নিরম্বু উপোস চলছে তা যেন খেয়ালই নেই। লোক আসার বিরাম নেই। হঠাৎ তাদের সেবার নেশায় পেয়ে বসল। তাদের জন্য হারুকে নিয়ে তিন মাইল দূরের বাজার যাও, রাঁধো-বাড়ো খাওয়াও। অসময়ে লোক আসার জন্য কল্যাণীর নিজের অন্নও কতদিন তুলে ধরে দিতে হয়েছে। সব থেকে নিঃশব্দে নিষ্ঠুর তিনি রাতের নিভৃতে। যে বাসনা সুবুকে পাগল করেছিল সেই গোছেরই একটা লোভের বাসনা নিজের মধ্যে জাগিয়ে তোলেন, চোখে মুখে স্থুল আচরণে পরস্ত্রীকে ভোগের দখলে টেনে আনার উল্লাস প্রকট করে তুলতে চান। তিনি চান স্ত্রীর এই ধৈর্যের শক্তিতে ভাঙন ধরুক, সে বিদ্রোহ করে হার মানুক।

…শেষে কল্যাণী একদিন শুধু বললেন, তোমার হলো কি বলো তো? তুমি হঠাৎ এ-রকম হয়ে গেলে কেন?

—পছন্দ হচ্ছে না? অবধূত হেসে উঠেছেন।—তাহলে তোমার শক্তির অস্ত্র হাতে নাও, তোমার শিবঠাকুরকে ডেকে বলো তিনি বিহিত করুন, পারেন তো সুবুর মতো শাস্তি দিন আমাকে।

কল্যাণী হাঁ করে মুখের দিকে চেয়েছিলেন খানিক। তারপর বললেন, তুমি একটা পাগল, লোকের চিকিৎসা না করে নিজের চিকিৎসা করাও।

…যে মানুষকে দেখে এখন শত শত মানুষ রোজ মাথা নত করে, হাত জোড় করে—তাঁকে কল্যাণী অনায়াসে বলে বসল, তুমি একটা পাগল। কিন্তু এই এক কথায় অবধূতের কাঁধ থেকে যেন এক অপদেবতা বিদায় নিল। চিত্ত বিষণ্ণ তবু। নিজের ভিতরটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন। ক্রীতদাস মূর্তি। রমণীর ক্রীতদাস। সেই রমণী নিজের স্ত্রী।

শিকল ছেঁড়ার তাগিদে আবার দূরে পালানোর মন। এখানকার পসারের পরোয়া একটুও করেন না। লোকসানের হিসেব করেন না। কিন্তু একটু সূক্ষ্ম আবেগের তাড়নায় চট করে নড়তেও পারলেন না। সুবু বকুলকে বিয়ে করেছিল কিনা জানেন না। ও চলে যাবার আগে বকুলের কপালে সিঁথিতে সিঁদুর দেখেছিলেন। অবধূত বিয়ে নিয়ে মাথা ঘামান না। বকুলকে অসহায় ভ্রাতৃ-বধুই ভাবেন। তার প্রতি দরদ আর কর্তব্য তাঁকে সাময়িকভাবে আটকে ফেলল। সুবুর এক মাসের চিকিৎসায় আর অপারেশনে বকুল একেবারে নিঃস্ব। শেলাইয়ের দোকান থেকে কি-ই বা রোজগার ছিল। বকুল নিজে মুখ ফুটে কিছু বলে নি, অবধুত খোলাখুলি জিজ্ঞেস করে জেনেছেন।

তার জন্য আরো বিশেষ করে ওই সাড়ে আট বছরের মিষ্টি দুষ্টু ছেলেটার জন্য মন চিন্তাচ্ছন্ন। ওদের সম্পর্কে বিমাতার সঙ্গে পরামর্শ করতে গেছলেন। কিন্তু ওই মহিল৷ কঠিন, নিস্পৃহ। স্পষ্ট বলে দিয়েছেন তাঁর ওখানে ঠাঁই হবে না, বাড়ি তিনি মেয়ের নামে উইল করে দিয়েছেন।

কল্যাণীর পরামর্শ মতো অবধূত ওদের কোন্নগরে নিজের কাছে এনে রাখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বকুল রাজি হয় নি। সবিনয়ে বলেছে আমার জন্য ভাববেন না দাদা, ধার দেনা মিটিয়ে এই দোকান দিয়ে ছেলেটাকে নিয়ে খেয়ে থাকতে পারব…কিন্তু ছেলেটার জন্য আমার এখন থেকে অন্য ভাবনা, নবছরও বয়স হয় নি এখনো, কি দুরন্ত আর অবাধ্য ভাবতে পারবেন না, আপনি আর দিদি সব অপরাধ ক্ষমা করে ওর ওপর একটু ‘আশীর্বাদ রাখুন, আপনাদের আশীর্বাদই আমার সব থেকে সম্বল। অবধূতের ধারণা, কেন সুবুর এত বড় অঘটন ঘটল বকুল সেটা আঁচ করতে পেরেছে। ছেলেটার নাম তপন, তপু। একটু বেশি মাত্রায় দুরন্ত যে, মুখ দেখলেই বোঝা যায়। চঞ্চল দুচোখ যেন সারাক্ষণ হাসে, আর কিছু করার মতলব ভাঁজে। ওকে নিজের কাছে এনে রাখার কথা বলতে পারতেন, কিন্তু ছেলেটাকে ছেড়ে ওর মা থাকে কি করে। তাছাড়া ছেলে কোল-ছাড়া হলে এই বয়সের সুশ্রী গরিব মা-ও কলকাতা শহরে খুব নিরাপদ নয়। বকুল কালো বটে কিন্তু ভারী সুশ্রী। জোর করেই অবধূত তার ধার দেনা মিটিয়ে দিয়েছেন। আর বলেছেন ছুটি-ছাটা হলেই তপুকে নিয়ে সে যেন কোন্নগরে তাঁর ওখানে কাটিয়ে আসে।

ঈষৎ আগ্রহ-ভরা দুচোখ তুলে বকুল জিজ্ঞাসা করেছিল, দিদি বিরক্ত হবেন না…?

অবধূত হেসে জবাব দিয়েছেন, তোমাদের বরাবরকার মতো কোন্নগরে রাখার এ প্রস্তাবটা তাঁরই ছিল। বকুল বলেছে, সামনের ছুটিতে ছেলেকে নিয়ে সে কোন্নগরে গিয়ে দিদির কাছে থাকবে।

…তবে সপ্তাহে দু-তিন দিন অন্তত দোকান দেখার জন্য তাকে কলকাতায় যাতায়াত করতে হবে।

অবধূত এই কারণেই বেরিয়ে পড়তে পারেন নি।

কিন্তু ওরা আসার পর অবধূত যেন আর এক মায়ার বন্ধনে পড়ে গেলেন।— হ্যাঁ, যেমন মিষ্টি আর তেমনি দুরন্ত বটে ছেলেটা। আর দুঃসাহসও বটে। অবধূতের অনেকবার ইচ্ছে হয় ওর কপালটা ভালো করে দেখেন। চোখে পড়ে না এমন অনেক সূক্ষ্ম আঁচড়ের কারিকুরি। তাঁর বিবেচনায় এটা ভালো লক্ষণ নয়। হাতের দিকে আপনা থেকে যেটুকু নজর গেছে তাতেও খটকা লেগেছে। না, সাহস করে তিনি সজাগ চক্ষু নিয়ে ওর কপাল বা হাত দেখেন নি। দুখিনী মায়ের ছেলে, কি দেখতে কি দেখবেন ঠিক কি। এ-ক্ষেত্রে তাঁর কর্তা না সাজাই ভালো।

জেঠুর সঙ্গে তপুর খুব ভাব! জেঠু হেসে হেসে সম-বয়সীর মতো ওর সঙ্গে গল্প করে, ওর মনের কথা শোনে। জেঠুর টক-টকে লাল জামা-কাপড় ওর দারুণ ভালো লাগে। জেঠু এ-রকম জামা-কাপড় পরে কেন এ নিয়ে কৌতূহল আর প্রশ্নের অস্ত নেই। বড় মা-কেও ওর দারুণ পছন্দ। কল্যাণীকেই জিজ্ঞেস করে, তুমি এমন আগুনপানা সুন্দর হলে কি করে?

একটা ধাক্কা নীরবে সকলকেই সামলাতে হয়। এই রূপের আগুনে ওর বাপ পুড়ে মরেছে। কল্যাণী হাসি মুখেই বলেছেন, আগুন আবার সুন্দর হয় কি করে রে?

—বাঃ, আগুনের থেকে সুন্দর আর কোনো রং আছে!

অবধূতের গম্ভীর মন্তব্য, রং সুন্দর হলে কি হবে, পোড়ায় যে…? —সেই জন্যই তো আগুন আমার আরো ভালো লাগে।

এই ছেলেকে নিয়ে এরই মধ্যে অবধূত দু দুটো অঘটন থেকে বেঁচেছে। এখানে আসার দিন কতকের মধ্যে বাড়ির কাছের পুকুর দেখে তপুর সাঁতার শেখার সাধ হয়েছে। হারু সাঁতার শেখাবে কথা দিয়েও দেরি করছে দেখে তার আর ধৈর্য থাকল না। দুপুরে সকলের অলক্ষ্যে বেরিয়ে গিয়ে হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি পরা অবস্থাতেই পুকুরে নেমেছে। সাঁতার মানেই হাত-পা ছোড়া জানে। তাই করে গভীর জলে গিয়ে হাবুডুবু। উদ্বাস্তুদের কারো কারো চোখে পড়েছিল বলে রক্ষা। তাকে যখন তুলে আনা হয় আধ-মরা দশা। ছদিন লেগেছে সুস্থ হতে। তার পরেই ঘোষণা করেছে, অনেকটা নাকি শেখা হয়ে গেছে, হারু কাকা জলদি সাঁতার শিখিয়ে না দিলে আবার একলাই পুকুরে নামবে।

অবধূত নিজে নিয়ে গিয়ে ওকে সাতদিন ধরে সাঁতারে পোক্ত করে তবে নিশ্চিন্ত।

আর একদিন তার মনে হয়েছে জেঠুর বাড়ির একতলা ছাদ থেকে নিচে লাফ দিতে পারাটা সহজ ব্যাপার। তক্ষুনি সেই বীরত্ব দেখানোর ঝোঁক। শব্দ শুনেই অবধূত কল্যাণী আর বকুলের ত্রাস। তপু মাটিতে শুয়ে পড়েছে, যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত। অবধূত ওকে শ্রীরামপুরে এনে এক্সরে করে তবে হাপ ফেলেন। ফ্র্যাকচার হয় নি, তবে সাংঘাতিক ভাবে মচকে গেছে।

অবধূত নিজেই চিকিৎসা করেছেন। পায়ের গোড়ালির দিক কদিন পর্যন্ত ফুলে ঢোল। সাত দিনের মধ্যে দাঁড়াতেও পারে নি। অবধূত রক্তাক্ত মুখ করে বলেছেন, তুই এরপর আমার হাতে মার খাবি।

মিষ্টি হাসি, দুষ্টু চাউনি। তারপর জবাব।—মার খেলে আমার কিছুই হয় না, মা তো এক-একসময় মেরে মেরে শুইয়ে ফেলে।

ভিতরটা মোচর দিয়ে উঠেছিল অবধূতের। কপালটা আত্মিক মনোযোগে লক্ষ্য করবেন?…হাটা একবার দেখবেন? না, থাক।

—বলিস কি, এত দুষ্টুমি কেন করিস?

—দুষ্টুমি হয়ে যায় কি করব।…দু-তিন মাস আগে মা এমন মার মারল যে রাতে একেবারে তিন ডিগ্রী জ্বর।

—কেন, তুই কি করেছিলি?

—পাথর ছুঁড়ে একটা লোকের মাথা দু ফাঁক করে দিয়েছিলাম। মাকে সে গালাগাল কচ্ছিল আর শেলাইউলি বলেছিল।

অবধুত শুনে থ।

ওরা চলে যেতে বাড়ি যেন একেবারে ফাঁকা। কল্যাণীও ঘুরেফিরে অনেক বার বলেছেন, ছেলেটা যেন বাড়িটাকে একেবারে ভরাট করে রেখেছিল।

মাস দেড়েক পরের এক শনিবার। অবধূত জানলা দিয়ে দেখেন, লজ্জা-লজ্জা মুখ করে তপু বাঁশের গেট সরিয়ে ঢুকছে। কিন্তু পিছনে আর কাউকে দেখতে পেলেন না। তখনো ভাবলেন, ও ছুটে এসেছে, মা ওর পিছনে আসছে।

কিন্তু বাইরের বারান্দায় এসেও দেখেন ওর সঙ্গে আর কেউ নেই। —কি রে, কার সঙ্গে এলি?

—একলাই।

গলা শুনে কল্যাণীও এসে দাঁড়িয়েছেন। বলে উঠলেন, তোর মা তোকে একলা ছাড়ল?

ঠোঁট উল্টে জবাব দিল, মা জানেই না।

দুজনেরই চক্ষুস্থির। তপুর জোরালো কৈফিয়ৎ, রবিবারের পর সোম মঙ্গল বারেও তার স্কুল ছুটি। জেঠুর বাড়ি যাবার জন্য মাকে এতবার করে বলল কিন্তু মা কানেই নিল না—এদিকে সে সাঁতার ভুলে যাচ্ছে, তাই চুপিচুপি একলাই চলে এসেছে।

অবধুত হাসবেন না ওর মায়ের চিন্তায় উতলা হবেন!—তুই কলকাতা থেকে এ-পর্যন্ত চিনে একলা চলে এলি!

—সহজ তো। বাসের পয়সা আগেই যোগাড় করে রেখেছিলাম। হাওড়া স্টেশনে এসে লোককে জিজ্ঞেস করে জেনে নিলাম কোন্ গাড়ি কোন্নগরে যাবে। গাড়ি ছাড়ার আগে ট্রেনে উঠে পড়লাম। টিকিট তো নেই, এক-একটা স্টেশন এলেই নেমে পড়ি, আবার ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ি। হাওড়া থেকে কটা বা স্টেশন!

অবধূত তক্ষুনি এক ভক্তকে ডাকিয়ে এনে বকুলের কাছে চিঠি লিখে তাকে কলকাতা পাঠিয়ে দিলেন। তারপর মঙ্গলবার বিকেলে তাকে নিজে সঙ্গে করে নিয়ে এলেন। বকুলকে বললেন, ওকে মারধোর করবে না, ও আর এ-রকম করবে না বলেছে।

ছেলের তক্ষুনি প্রতিবাদ। — আমি বলেছি কয়েকটা দিন স্কুলে ছুটি পেলে মা যদি তোমার আর বড় মার কাছে নিয়ে আসে তাহলে আর এ-রকম করব না।

রাগের মুখে ওর মা পর্যন্ত হেসে ফেলেছিল।

এরপর একদিন দু দিন না হোক, একসঙ্গে চার পাঁচদিনের ছুটি পেলেই ছেলে নিয়ে বকুলকে কোন্নগর আসতে হয়। চলে গেলে তঅবধূত প্রত্যেক বারই কল্যাণীকে বলেন, এ আবার কি মায়ায় জড়িয়ে পড়ছি আমরা। জবাব না দিয়ে কল্যাণী শুধু হাসেন। অবধূত নিজের ভিতরে চোখ চালান। এই দুরন্ত মিষ্টি ছেলেকে একমাত্র বংশধর ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেন না। অনেকটাই তাঁর ভিতর জুড়ে বসে আছে। দিন যায়। একে একে বছর গড়ায়। দিনে দিনে ছেলেকে নিয়ে মায়ের দুশ্চিন্তা আর নালিশ বাড়ছেই। এ ছেলেকে নিয়ে তার এক মুহূর্ত শান্তি নেই। পাড়ার যত দুষ্টু ছেলেরাও মোড়ল। দল বেঁধে মারামারি করে। কোনো কথা শোনে না। এই ছেলে এখানে রাখা আর ঠিক নয়, তাকে বাইরের খুব কড়া কোনো হস্টেলে পাঠানো দরকার।

প্রস্তাবটা অবধূত উড়িয়ে দিতে পারেন না। কিন্তু একটু খটকা লাগে অন্য কারণে। বলেন, কিন্তু স্কুলে তো বরাবর ফার্স্ট সেকেণ্ড হচ্ছে শুনি?

বকুল ব’লে সেই জন্যেই আমার আশা দাদা, বাইরে গেলে ও হয়তো মানুষ হবে, কিন্তু এখানে থাকলে ও বয়ে যাবে।

তপুর পনেরো বছর মাত্র বয়েস তখন। অবধূতের ভিতরে আবার ওর কপাল আর হাত দেখার তাড়না। কিন্তু থাক। এখনো সাবালক হয় নি, সমস্ত চিহ্নই বদলাতে পারে। তপুকেই বলেন, তোকে আর কলকাতায় রাখব না ভাবছি, বাইরের কোনো ভালো হস্টেলে পাঠিয়ে দেব। ওর মা আর কল্যাণীর সামনেই জ্যাঠা-ভাইপোতে আলাপ।

—দাও। ভালোই হবে, একটু স্বাধীনতার মুখ দেখব।

—স্বাধীনতার মুখ দেখবি মানে, রীতিমতো কড়া হস্টেলে রাখব।

হাসি।—এমন হোস্টেল কোথায় আছে? মা-কে তো বলেই দিয়েছি, বাইরে পাঠালে সাত দিনের মধ্যে আমি হাওয়া হয়ে যাব… আর আমার কোনো পাত্তাই পাবে না তোমরা, একবার পাঠিয়ে দেখুক না—

বকুল বলে উঠেছে, তুই কি কখনো আমার দুঃখ দুশ্চিন্তা বুঝবি না?

—নাকে কেঁদো না তো, হস্টেলে থাকব না বলা সত্ত্বেও এক-কথা তুমি বার বার বলো কেন? আমি কখনো অন্যায় করি?

অবধূত হঠাৎ গর্জনই করে উঠেছেন, এই বেয়াদপ। মায়ের সঙ্গে ফের ও-রকম করে কথা বলবি তো কান ছিঁড়ে নেব!

তপু গুম।

পরে ভেবে-চিন্তে অবধূত বকুলকে বলেছেন, পাঠাবার চেষ্টা কোরো না, যে ছেলে, সত্যি মুশকিল হতে পারে।

আরো দু‘টো বছর কেটে গেল। অবধূত কখনো বেরোন, কখনো বা ঘরে স্থিতি হন।

তপুর বয়েস সত্তরো। ফার্স্ট ডিভিশনে বেশ ভালো নম্বর পেয়েই পাশ করেছে। অংক আর সায়েন্সের পেপারে লেটার পেয়েছে। এবারে ফিজিক্স অনার্সে বি. এস-সি পড়বে। অবধূতের দীর্ঘ নিঃশ্বাস পড়েছে,ওর বাপটাও রীতিমতো ভালো ছাত্র ছিল। আবার আনন্দে সেই রাতে ফিস্টও লাগিয়ে দিয়েছেন। কল্যাণীকে বলেছেন তপুকে খুব ভালো করে খাওয়াও।

কিন্তু মুখ শুকিয়ে কুল এক ফাকে যা বলল, শুনে অবধূত বেশ উতলা। সেটা সত্তর সালের সবে শুরু। নক্সালরা তৎপর হয়ে উঠেছে। বকুলের ধারণা, তপু তাদের খপ্পরে পড়ছে। পুলিশ এর মধ্যে দু‘বার তাকে থানায় নিয়ে গেছে। অবশ্য জেরার পর ছেড়েও দিয়েছে। বকুল বলল, ওর কথা ভাবলে ভয়ে আমার বুক শুকিয়ে যায় দাদা।

রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর তপুকে নিয়ে তিনি জেরায় বসেছেন।—এ-সব কি শুনছি?

—ছাড়ো তো, মায়ের বেশি-বেশি ভাবনা। আমি অন্যায় কিছু করছি না।

—থাপ্পড় খাবি তুই আমার হাতে—এক পড়াশুনা ছাড়া তোর অন্যকিছু করার দরকার কি? তুই এ-সব মুভমেন্টের কি বুঝিস?

সতেরো বছরের ছেলের মুখে অদ্ভুত হাসি।—বোঝার কি আছে বলো জেঠু—স্বাধীনতার নামে যে ভাঁওতাবাজী চলছে তা-ই বিশ্বাস করব!

—তা বলে এ-সব মারামারি কাটাকাটিতে বিশ্বাস করবি?

—তুমি নিশ্চিন্ত থাকে৷ জেঠু, ও-সবের মধ্যে আমি নেই। নক্সাল নাম নিয়ে অনেক মুখ্যু লোকও ঢুকে গেছে। দরকার ছাড়া মারামারি কাটাকাটির মধ্যে যাব কেন?

—দরকার পড়লে যাবি?

জবাবে হাসি। অবধূত অনেক কথাই এরপর বলেছেন। কিন্তু ফল হয়েছে মনে হয় নি।

তপু কলকাতায় গিয়ে ফিজিক্স অনার্স নিয়ে বি. এস-সি পড়া শুরু করল। তার পরের তিন-সাড়ে তিন বছরের খবর অবধূত আর রাখেন না। কারণ ঘরের বন্ধন ছেঁড়ার তাড়নায় এবারে তিনি যাকে বলে নিরুদ্দিষ্টই হয়েছেন। তিন বছরের ওপর দ্বার-ভাঙার কাঁকুড়ঘাটির মহাশ্মশানে কাটিয়েছেন। ফলে অনুভব করেছেন, ঘটনার সাজে ডাক পড়েছিল বলেই তিনি সেখানে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন, আর মেয়াদ ফুরোতে ফিরে আসতেও বাধ্য হয়েছেন। ঘরের বন্ধন ছেঁড়ার মানসিক তাগিদ এরপরে আর কখনো অনুভব করেন নি।

কোন্নগরে ফিরে তপুর খবর শুনে তিনি ভীষণ বিচলিত। শুধু তপুর নয়, বকুলেরও। তারও নাকি শরীর স্বাস্থ্য ভেঙে আধখানা হয়ে গেছে। জীবন যুদ্ধে এবারে সে হারই মেনেছে। জীবন্মৃত দশা।…বেশি নয়, মাস তিন-চার মাত্র আগের কথা। বি. এস-সি ফাইন্যাল পরীক্ষার পরেই তপু কোথায় ডুব দিয়েছে কেউ জানে না। পুলিশ দল-বলসহ তাকে খুঁজছে। তাদের নামে শুট-অ্যাট-ফাইট অর্থাৎ ধরতে না পারলে দেখামাত্র গুলি করার অর্ডার বেরিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মারাত্মক সব অপরাধের অভিযোগ। পুলিশ বকুলের ডেরায় এসে তছনছ করেছে, সব ভেঙেচুরে একাকার করে দিয়েছে। তাকে অনেকবার করে টেনে হিচড়ে থানায় নিয়ে গেছে, জেরার নামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে রেখে ভীষণ কষ্ট দিয়েছে। …না বকুল বিশ্বাস করে না তার ছেলে জঘন্য কোনো অপরাধ করেছে, দলের সঙ্গে ছিল বলেই অন্যদের সঙ্গে তার নামেও হুলিয়া বেরিয়েছে।

তপু ফেরার হবার তিন-চারদিন বাদে কল্যাণী ওর লেখা ছোট্ট একটা চিঠি পেয়েছিলেন। লিখেছে, বড়-মা, বাধ্য হয়েই আমাকে সরে যেতে হচ্ছে, কপালে কি আছে জানি না, মা-কে দেখো! কল্যাণী ফাঁপরে পড়েছেন। তখন পর্যন্ত তাঁর কেবল হারু ভরসা। অবশ্য পাড়া-প্রতিবেশীরাও ভরসা। বাবা নেই বলে তারাও সর্বদা মাতাজীর খোঁজ খবর নেয়। .. কল্যাণী ততদিনে মাতাজী হয়ে বসেছে। হারুকে নিয়ে কলকাতায় এসে তাঁর চক্ষুস্থির। বকুল শয্যাশায়ী। তাঁকে দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে। তারপর সব বলেছে’ কল্যাণী তাকে নিজের কাছে এনে রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বুদ্ধিমতী মেয়ে বলেই সে আসে নি। বলেছে, পুলিশ তপুর খোঁজে জাল ফেলে বসে আছে। আত্মীয়-পরিজন কোথায় কে আছে খোঁজ করছে। বকুল বলেছে কেউ কোথাও নেই, কোন্নগরে গেলে সেখানেও পুলিশের উৎপাত শুরু হবে।…তপু হঠাৎ কখনো বড় মায়ের কাছে গিয়ে উপস্থিত হবে কিনা জানে না। তাই কোন্নগরে গিয়ে তার ওখানকার আশ্রয় সে বিপন্ন করতে চায় না।

কল্যাণী আর যায় নি। বকুলও আসে নি। খুব নিঃশব্দে কল্যাণী ব্যবস্থা যা করার করেছেন। এখান থেকে লোক পাঠিয়ে, আগের থেকেও ভালো করে বকুলের দোকান সাজিয়ে দিয়েছেন।…কিছুদিন আগে তপুর বি. এস-সি পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। কল্যাণী কাগজে খবর পড়ে অবাক হয়েছেন। এত কাণ্ডের মধ্যে থেকেও ওই দস্যি ছেলে কিনা ফিজিক্সে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে!

অবধূতও এরপর কলকাতায় গিয়ে খুব সাবধানে বকুলের সঙ্গে দেখা করেছেন। এমনকি চোখে পড়ার ভয়ে রক্তাম্বর ছেড়ে সাদা পোশাকে গেছেন। বকুল তাতেও মিনতি করে বলেছে, আপনি আর নিজে আসবেন না—জানাজানি হলে সকলেরই ক্ষতি।

দিন বসে থাকে না। একে একে আরো চারটে বছর কেটে গেল। ছিয়াত্তর সালের এপ্রিল মাস সেটা। শ্মশানের ধারে রাত এগারোটা অনেক রাত্রি। অবধূত আর কল্যাণী জেগেই ছিলেন। কার্তিককে কি দরকারে কলকাতা পাঠানো হয়েছিল। বাবার সে পাকাপোক্ত চেলা এখন। দরজায় খুট খুট কড়া নাড়ার শব্দ শুনে ভাবলেন সে-ই ফিরে এসেছে। অথচ এই রাতে তার ফেরার কথা নয়।

দরজা খুলেই অবধূত চমকে দু‘পা পিছিয়ে গেলেন। অবছা অন্ধকারে কে একজন রিভলবার তাক করে আছে, তার পিছনে আরো একজন কেউ। সামনের লোকের চাপা হিস হিস গলা, টু-শব্দটি নয়! তারপরেই হি-হি হাসি।—এই রে, জেঠু তুমি! আমি ভেবেছিলাম বড়-মা দরজা খুলবে। ঘুরে তাকিয়ে বলল, এসো রিনা চটপট ঢুকে পড়ো। এগিয়েও থমকালো।বাড়িতে বাইরের কেউ নেই তো জেঠু?

তপন… তপু! তার সঙ্গে একটি মেয়ে। হাতে ছোট সুটকেশ। নীরবে বিস্ময়ে মাথা নেড়ে অবধূত দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়ালেন। রিনা নামে মেয়েটি ভিতরে পা দিতে তপুই তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করল।

ঘরে এসে দুজনেই ওরা তাঁকে আর কল্যাণীকে প্রণাম করল। কল্যাণীও অবধূতের মতোই হাঁ। তপুর চেহারা খুব বদলায় নি। তবে চুল একেবারে ছোট করে ছেটে ফেলার দরুন মুখের মিষ্টি ভাব একটু কমেছে। আর বেশ রোগা হয়েছে। মেয়েটির বয়েস একুশ-বাইশ, মোটামুটি সুশ্রী আর স্বাস্থ্যবতী। এক-নজর তাকালেই বোঝা যায় অন্তঃসত্ত্বা। এই অচেনা বাড়িতে এ-রকম দুজনের সামনে পড়ে বেশ বিব্রত কুণ্ঠিত মুখ।

কিন্তু তপুর কোনো সংকোচের বালাই নেই। মুখে সেই আগের মতোই মিটি মিটি হাসি।—একেবারে হাঁ হয়ে গেলে যে দুজনেই! এই হলো রিনা, আমার বিয়ে করা বউ। আবার হাসি।—বিয়েটা অবশ্য সিঁদুর পরিয়ে আর মালা বদল করে যে-যার ইচ্ছে মতো করেছি, তার জন্য রিনার মনে একটু খুঁতখুঁতুনি আছে, আমি ওকে বলেছি জেঠুর কাছে গেলে উনি তন্ত্র-মতে আমাদের দারুণ বিয়ে দিয়ে দেবেন’খন। যাক কথা পরে, সকাল থেকে এ-পর্যন্ত আমাদের পেটে দানা পড়ে নি, কি দেবে দাও, যা-হোক কিছু পেলেই হলো—

কল্যাণী ব্যস্ত পায়ে চলে গেলেন।

খাওয়া-দাওয়ার পর রিনাকে শুইয়ে দিয়ে এ-দিকের ঘরে এলেন। অবধূত রিভলবার আর চামড়ার পাতের কেসের মতো জিনিসটা তাঁর হাতে দিয়ে গম্ভীর মুখে বললেন, এগুলো খুব সাবধানে রেখে দিও।

কল্যাণী দেখলেন কেসের মতো জিনিসটায় গুলি। তাঁর কপালে ঘাম দেখা দেবার দাখিল। ওগুলো শাড়ির আড়াল করে বসলেন।

অবধূত বললেন, মাকে ও-ভাবে কষ্ট দিয়ে কি পেলি—মায়ের খবর রাখিস হতভাগা?

—আমি সব খবরই রাখি জেঠু, তোমার খবরও রাখি…তুমি তিন বছরের ওপর নিপাত্তা হয়ে ছিলে, এটা আমার হিসেবের মধ্যে ছিল না।

—যাক, এখন কি ব্যাপার কি অবস্থা বল। এখনো পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে?

তপু হাসল।—অন্য সব অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে এখন তো আমি আরো বড় আসামী। খুন আর অ্যাবডাকশন দুই কেসই ঝুলছে।

কল্যাণী বলে উঠলেন, তুই এ-সব করেছিস?

—নিজেকে আর রিনাকে বাঁচানোর জন্য খুন করেছি বড়মা, রিনাকে অ্যাবডাক্ট করার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ মিথ্যে—।

এর পরের ঘটনা শুনে দুজনেই স্তব্ধ।… বাড়ি ছাড়ার পর তপু তার দলবল নিয়ে শেয়াল কুকুরের মতো পালিয়ে বেড়িয়েছে। একদিন ছদিন নয়, তিন বছর। শেষের একটা বছর সঙ্গে রিনা।—লোক বুঝে ছোট-খাটো হামলা তারা করেছে, বিপাকে পড়ে কাউকে কাউকে জখম করেও পালাতে হয়েছে, কিন্তু খুন কাউকে করে নি তখন পর্যন্ত। খুন কাউকে সত্যিই করতে হয় না, ভয় দেখিয়েই অনেক কাজ হাসিল করা যায়। কিন্তু শেষের দিকে যা করত সেটা কোনো রাজনীতির ব্যাপার নয়, নিজেদের বেঁচে থাকার তাগিদেই ওটুকু করতে হতো। ইউনিটের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে, পুলিশের গুলি খেয়ে অনেক মরেছে, অনেকে ধরা পড়ে জেলে পচছে।

…রিনা কলকাতায় তাদের পাড়ার মেয়ে। ওর বাবা ছা-পোষা কেরানি। দুটো ছেলে আর এই মেয়ে। ছেলে দুটো তেমন লেখা-পড়ার সুযোগ না পেয়ে ফ্যাক্টরির কাজে ঢুকেছিল। বাপ তখন অসুস্থ, রিটায়ার করেছে। তপু যে-বছরে বি. এস-সি পরীক্ষা দেয় সে-বছরই রিনা হায়ারসেকেণ্ডারি পরীক্ষায় পাশ করেছিল। তপুর সঙ্গে আলাপ ছিল না, কিন্তু মুখ-চেনা ছিল। সেই তখন থেকেই পাড়ার জনাকয়েক আর বেপাড়ার একজন পয়সাঅলা গুণ্ডা গোছের ছেলে রিনার পিছনে লেগেছিল। তপু তাদের একবার আচ্ছা করে সামলে দিতে আর বেপাড়ার ওই পয়সাঅলা বড়লোকের গুণ্ডা মো… আচ্ছা করে ঠেঙিয়ে দিতে ওরা কিছুদিন চুপ মেরে ছিল। রিনা বাড়িতে কিছু বলে নি। বলে কি লাভ। কিন্তু তপুর প্রতি ভারী কৃতজ্ঞ ছিল। তখন একটু-একটু আলাপ ছিল। কিন্তু তার পরেই তো তপুকে গা-ঢাকা দিতে হয়।

হায়ার সেকেণ্ডারি পাশ করার পর রিনা প্রায় বছর তিনেক ছোট ছোট ছেলেমেয়ে পড়িয়ে সামান্য কিছু রোজগার করত। এই সময় একজন তাকে টাইপ শিখতে পরামর্শ দিল। কিন্তু রাত আটটার আগে রিনার ফুরসত ছিল না। প্রাইভেট টিউশনি আর বাড়িতে রান্না করে সময় পেত না। আটটা থেকে ন’টা বাড়ির আধ মাইলের মধ্যে টাইপিং স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু ওই বড়লোকের গুণ্ডা ছেলে যে এ-ভাবে ওঁত পেতে ছিল জানত না। আবার ওকে তারা উত্যক্ত করতে শুরু করেছিল। চিঠিতে হুমকি দিত। কিন্তু রিনার এ-সব গায়ে মাখলে চলবে কেন?

টাইপ-স্কুল থেকে এক বৃষ্টির রাতে ফেরার সময় ওরা তাকে জোর করেই গাড়িতে তুলে নিল। চোখের পলকেই ঘটে গেল ব্যাপারটা। রিভলবার পিঠে ঠেকিয়ে সেই বড়লোকের গুণ্ডা ছেলের দল ওকে গাড়িতে তুলে নিল। একটু-আধটু দূরে যারা ছিল ভালো করে তারা কেউ কিছু বুঝতেই পারল না। পরে জেনেছে ওই ছেলে আগে আরো দুটো মেয়ে তুলে নিয়ে পালিয়েছে। বুকে রিভলবার ঠেকিয়ে নিজেই নিজের কেরামতির কথা শুনিয়ে রিনাকে শাসিয়েছে, মুখ বুজে থাকলে প্রাণে বাঁচবে—দু-দশ দিন পরে হয়তো বাড়িতেও ফিরতে পারবে, নইলে খতম হতে হাবে?

একটু হেসে বলল, ওদেরও কি স্রাত ছ্যাখো জেঠু, ডায়মণ্ড হারবারের যে জঙ্গলে আমার ঘাঁটি তার কাছাকাছি একটা ছোট বাংলোয় রিনাকে এনে তোলা হয়েছে। আরো তো কত জায়গা আছে, রিনার বরাত ভালো না হলে ওরা ওখানেই আনবে কেন? আমাদের তখন সতর্ক প্রহরা, কে আসছে যাচ্ছে সর্ব-দিকে নজর রাখতে হয়। আমি দেখি নি, আমার দলের একজনের সন্দেহ হলো ফুর্তি করার জন্য মোটরে করে একটা মেয়েকে তুলে আনা হয়েছে, কারণ যতদূর মনে হয় রাতের অন্ধকারে জোর করেই তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে ওই বাংলোয় ঢোকানো হয়েছে।

…খবর পেয়ে দলের পাঁচজনকে নিয়ে নিঃশব্দে তপু বাংলোয় হানা দিল। ওই ছেলের দল তখন একটা ঘরে মদের বোতল খুলে বসেছে, আর ওই বড়লোকের গুণ্ডা ছেলে অন্য একটা ঘরের দরজায় রিনাকে বশে আনতে চেষ্টা করছে আর হুমকি দিচ্ছে, টু-শব্দ করলে বা কোনো রকম বাধা দিলে ওই ছেলেরা এসে তাকে ধরবে এবং সে যা করার ওদের সামনে করবে।

তপুর দলের ছেলেরা নিঃশব্দে গিয়ে তার সঙ্গীদের ওপর চড়াও হলো। রিভলবার তুলে ইশারায় একেবারে বোবা হয়ে থাকতে হুকুম করল। তারা যমদূত দেখে হকচকিয়ে গিয়ে নির্বাক।

রিভলবার হাতে তপু সশব্দে দরজা খুলল, রিনার পরনে তখন কেবল শায়া, ছেঁড়াখোঁড়া শাড়িটা মাটিতে পড়ে আছে। সেই অবস্থাতেই ধস্তাধস্তি চলছে। রিনা মরিয়া হয়ে বাঁচার শেষ চেষ্টা করছে। চমকে সেই গুণ্ডা ছেলে ছিটকে উঠে দাড়ালো, দু‘হাত দূরে রিভলবার হাতে শমন দেখে স্থির। …কিন্তু গণ্ডগোল করে ফেলল রিনা। আবার তাকে দেখে তপুও কয়েক মুহূর্তের জন্য হতচকিত। তারই মধ্যে রিনা ছুটে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে বাঁচাও বলে চেঁচিয়ে উঠল। সেই কয়েক পলকের সুযোগে ওই গুণ্ডা ছেলে পকেট থেকে রিভলবার বার করে তাক করল। রিনাকে ভয় দেখাবার জন্যেই ওটা সঙ্গে রেখেছিল বোধহয়। কিন্তু এত দিনে তপুর পিছনেও চোখ গজিয়েছে, মুহূর্তের মধ্যে তার হাতের রিভলবার গর্জে উঠল। ওই বদমায়েশের ভোগের সাধ চিরদিনের জন্য মিটে গেল। সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

গুলির শব্দে কে কাকে মারল ভেবে না পেয়ে সবাই ছুটে এলো। সেই ফাঁকে ওখানকার ফুর্তিবাজরা অন্ধকারে প্রাণের দায়ে দিশেহারার মতো ছুটে পালালো। এরপর বাধ্য হয়ে রিনাকে নিয়ে তাদেরও গা-ঢাকা দিতে হয়েছে। মাঝের একদিন বাদ দিয়ে তার পরের দিন সমস্ত কাগজের প্রথম পাতায় খবর বেরুলো, চার বছর আগের নক্সালপন্থী সমাজ বিরোধী আসামী তপন চ্যাটার্জী সদলে অতর্কিতে কলকাতার ওমুক জায়গা হানা দিয়ে রিনা রায় নামে একটি অবিবাহিতা তরুণীকে গাড়িতে তুলে নিয়ে গেছে। জানা গেল সেখানেই তার ঘাঁটি ছিল। ওই পাড়ারই একটি তরুণ দল তাদের অন্য পাড়ার এক বন্ধুর গাড়িতে সেদিকে পিকনিকের উদ্দেশে গিয়েছিল। বিপদের আঁচ পেয়ে তারা ওই গাড়ির পিছু নেয় এবং ঘাঁটির সন্ধান পায়। মেয়েটিকে জঙ্গলে একটি পরিত্যক্ত পড়ো বাংলোয় তোলা হয়েছিল পিকনিকের দলটি হানা দিয়ে মেয়েটিকে উদ্ধারের চেষ্টা করে। তপন চ্যাটার্জী গুলি চালিয়ে গাড়ির মালিক বন্ধুটিকে হত্যা করার ফলে অন্যরা পালাতে বাধ্য হয় ইত্যাদি। মৃত ছেলেটির নাম সুধীর দত্ত, বয়েস আঠাশ। এক অবস্থাপন্ন পরিবারের দ্বিতীয় এবং কনিষ্ঠ সন্তান।

…তপু রিনাকে তার বাপের কাছে যে ভাবে হোক পাঠাতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু রিনা একেবারে বেঁকে বসেছিল। সে আত্মহত্যা করবে তবু আর বাড়ি ফিরবে না। তপুকে বলেছে আমাকে বিয়ে কর, যে ভাবে রাখ আমি সেভাবেই থাকব। বাবার কাছে ফিরে গেলে ওই হায়নার দল আবার আমাকে ছিঁড়ে খাবে।

তপু হাসি মুখেই জেঠুকে বলেছে কলকাতায় থাকতেই রিনাকে তার ভালো লাগত। দূর থেকে দেখত। সামান্য আলাপ হবার পর আরো ভালো লেগেছিল। ওই গুণ্ডার দলকে কলকাতায় একবার ঢিট করার পর থেকে রিনাও তাকে শ্রদ্ধা করত।

প্রায় একটা বছর যে কি ভাবে কেটেছে ওরাই জানে। দল তো ভেঙেই গেছে। কিন্তু গোপনে সাহায্য করার মতো অবস্থাপন্ন লোক ছিল। রিনাকে নিয়ে কত জায়গায় ঘুরে ঘুরে গা-ঢাকা দিতে হয়েছে ঠিক নেই। ফলে অনেক সময়েই সাহায্য পেতে দেরি হয়েছে। তখন এক বেলা খাওয়া জোটে নি এমন সমন দিনও গেছে। নাম ভাঁড়িয়ে প্রাইভেট টিউশানি যোগাড় করে ক’দিন না যেতে ভাঁওতা দিয়ে আগাম টাকা নিয়ে সরে পড়তে হয়েছে। তপু হেসে উঠল, কিন্তু বিয়ে করলে যে আবার সাবধান হওয়া সত্ত্বেও ছেলে-পুলে আসার ঝামেলা পোহাতে হবে এ-কি আর হিসেবের মধ্যে ছিল! তাই রিস্ক নিয়ে তোমার কাছে না এসে করি কি। মায়ের কাছে রাখা যাবে না, চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে পুলিশের নজরে পড়বে। রিনার বাবার তো এই অবস্থা, তার ওপর হারানো মেয়ে ফিরেছে জানাজানি হলে সেখানেও একই বিপদ। আপাতত সব দায় তোমার ওপর চাপিয়ে দিয়ে আমি সরে পড়ব…কিন্তু আমি বড় ক্লান্ত জেঠু, অন্তত পাঁচ সাত দিনের বিশ্রাম দরকার, ক’টা দিন সকলের চোখ থেকে আমাকে আগলে রাখতে পারবে না?

সমস্ত রাত অবধূত ছটফট করেছেন আর পায়চারি করেছেন। বিছানায় গা পর্যন্ত দিতে পারেন নি। পরদিন সকালে চা খেতে খেতে তপুকে বলেছেন, এখানে তোর লুকিয়ে থাকার কোনোরকম চেষ্টা করারই দরকার নেই। এখানে তোকে চেনে একমাত্র হারু তাকে সমঝে দিলে সে মুখ সেলাই করে থাকবে। আর কার্তিক নামে একটি ছেলে থাকে, সে জানবে তুই আমার নিকট আত্মীয়, মধ্যপ্রদেশে থাকিস, দরকারী কাজে বিদেশে চলে যেতে হচ্ছে বলে এখানে বউ রেখে যাচ্ছিস।

…বাড়ির মধ্যে লুকিয়ে চুরিয়ে থাকলেই বরং লোকের সন্দেহ হবে। এটাই ভালো পরামর্শ মনে হলো তপুরও। কিন্তু ও ভেবে পাচ্ছিল না, জেঠু কথা যখন বলছিল, ওর মুখের ওপর তার দৃষ্টিটা এমন স্থির আর তীক্ষ্ণ কেন? মুখ কপাল সব যেন ফালা ফালা করে দেখার চেষ্টা। জিজ্ঞেস করেছিল, কি হলো …?

—বোস আসছি। উঠে হাত-দেখার বড় ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা নিয়ে এলেন।

কিন্তু হাত নয়, একাগ্র মনোযোগে ওটা কপালের কাছে এনে আগে কপাল দেখতে লাগলেন। দেখছেন তো দেখছেনই। শুধু কপাল কেন, নাক, কান, কানের পিছন এমন কি গলা পর্যন্ত। সামনে বসে রিনাও হাঁ করে দেখছে …জ্যাঠশ্বশুরের কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমছে, দুচোখ অস্বাভাবিক রকমের তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে।

কপাল-মুখ দেখার পর তেমনি মনযোগ দিয়ে হাত দেখতে লাগলেন। এক বার জিজ্ঞেস করলেন, তোর ঠিক বয়েস এখন কত?

—একেবারে ঠিক তো বলতে পারব না, চব্বিশ চলছে। হেসে উঠল, কিন্তু জেঠু রাগ কোর না—এসব আমি কিছুই বিশ্বাস করি না অবধূতের পাথর মূর্তি।—তোর বিশ্বাসের দরকার নেই, আমি নিজের বিশ্বাসের কিছু খুঁজছি। এই দেখার ঝোঁকে এক ঘণ্টারও বেশি কেটে গেল। অবধূত তার পরেও গম্ভীর। কেবল পায়চারি করছেন। কপালে ঘাম। মাঝে মাঝে আরো দুই একবার তপুর সামনে এসে দাড়িয়েছেন। চাউনি তেমনি তীক্ষ্ণ, তীব্র। তপু ধরেই নিল, শিগগীর তার ফাঁড়া-টাড়া অর্থাৎ ধরা পড়ার সম্ভাবনা আছে কিনা জেঠু তাই দেখছে। হয়তো তার বিবে চনায় ভালো দেখছে না বলেই এত উতলা এমন গম্ভীর। কিন্তু তপু বেপরোয়া, জীবন-মৃত্যুর মাঝখানেই তো কবে থেকে দাঁড়িয়ে আছে। কেবল কল্যাণী বুঝছেন। এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করেছেন, কেমন দেখছ? —পরিষ্কার। আগে সাহস করে সেভাবে দেখি নি কখনো, কিন্তু এখন মনে হয় আগের থেকেও ঢের বেশি পরিষ্কার। কিছু সময়ের জন্য ঝামেলা তারপর সব পরিষ্কার, দীর্ঘ আয়ু… কেবল একটু শোকের চিহ্ন আছে, সেও ওর নিজের বা রিনার শরীরগত কিছু নয়। কোনো নিকট জনের কিছু হতে পারে।

ইতি মধ্যে এক ফাঁকে তিনি রিনার হাত আর কপালও যত্ন করে দেখেছেন।

কল্যাণী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোমার নিজের দেখা আর বিশ্বাস নিশ্চয় ঠিক, শিবঠাকুর নিশ্চয় আর আমাদের বা বকুলকে কোনো বড় দুঃখের মধ্যে ফেলবেন না।

পেটো কার্তিক এসে দেখল এবং জানলো বাবার বাড়িতে আত্মীয় অতিথি এসেছে, তাকে ক’দিন রাতে বোসেদের বাড়িতে থাকতে হবে। স্ত্রী নিয়ে বাইরের ভক্তরা কেউ ছ’পাঁচ দিন বাবার কাছে গেলেও তাকে রাতে বোসেদের বাড়িতে আস্তানা নিতে হয়। কিন্তু সে-জন্য নয় কার্তিক হতভম্ব আর উতলা বাবার মধ্যে একটা চাপা অস্থিরতা আর উত্তেজনা দেখে। আধফর্সা মুখ সর্বদা লাল, কোনো কাজে মন দিচ্ছেন না, কেবল ভাবছেন আর পায়চারি করছেন।

শনি মঙ্গলবার নয়, পর পর তিন রাত তিনি শ্মশানে কাটিয়েছেন। তাঁকে দেখে মনে হয়েছে জীবনে তিনি এমন সমস্যার মধ্যে কখনো পড়েন নি। কেবল পায়চারি করেন আর ভাবেন! সন্ধ্যার পরেই শ্মশানে চলে যান। ঘাবড়ে গিয়ে কার্তিক মাতাজীকেই জিজ্ঞেস করেছে, মা বাবার হঠাৎ হলে। কি—অসুখে পড়ে যাবেন যে!

মাতাজীও ভীষণ গম্ভীর। দু‘কথায় জবাব দিয়েছেন, জানি না!

তপুও একটু অবাক হয়ে বলেছে, জেঠু যে আজকাল দেখি প্রায় শ্মশানচারী হয়ে পড়েছে—তিন বছরের ওপর বাইরে কাটিয়ে আসার পর থেকেই এ-রকম হয়েছে বুঝি?

কল্যাণী জবাব দেন নি।

সেই রাতে অবধূত রিনাকে নিজের ঘরে ডেকে পাঠালেন। সে আসতে হাসি মুখেই বললেন, বোস।

রিনা কাছে বসে জিজ্ঞেস করল, আজ আপনার শ্মশান যাওয়া নেই?

—না, আজ আর না।… আমার শ্মশান যাওয়া নিয়ে তপু কিছু বলে-টলে নাকি?

—বলে এ-রকম করলে শরীর ভেঙে যাবে, বড় মা‘র বাধা দেওয়া উচিত। …আপনাকে যত ভালোবাসে আর শ্রদ্ধা করে পৃথিবীতে এমন আর কাউকে না।

অবধূতের গলার স্বরে কৌতুক।—কি রকম?

রিনা হেসে জবাব দিল, বলে দেবতা-টেবতা জানিও না বিশ্বাসও করি না, নরদেবতায় বিশ্বাস করি—আমার কাছে জেঠু সেই দেবতা। অবধুত হেসে উঠলেন, শুনে তোমার কি মনে হলো?

—আমারও তাই বিশ্বাস করতে ভালো লাগল।

সেই রাতেই অবধূত বেশ একটা মজার অনুষ্ঠান করলেন। নিজে বসে তপু আর রিনার আনুষ্ঠানিক বিয়ে দিলেন। বললেন, বিয়ের খাওয়া কাল দুপুরে।

এক কল্যাণী ছাড়া আর কেউ জানেন না, শেষ রাতে উঠে অবধূত নিঃশব্দে বাড়ি ছেড়ে বেরুলেন। যাতায়াতের ট্যাক্সি ভাড়া করাই ছিল, ট্যাক্সি যেখানে অপেক্ষা করার কথা সেখানেই অপেক্ষা করছে। সকাল পাঁচটার মধ্যে তিনি এসে দরজার কড়া নেড়ে বকুলের ঘুম ভাঙালেন।—এই সময়ে বকুল তাঁকে দেখে বিষম চমকে উঠেছিল। অবধূত ভিতরে এসে বসলেন না, কেলল বললেন কোনো ভয় নেই, তপু এসেছে, আমার কাছে আছে আজই চলে যাবে, তুমি খেয়ে দেয়ে বেলা একটা দেড়টার মধ্যে চুপচাপ কোন্নগরে আমার বাড়ি চলে যাবে—এখন আর কোনো কথা নয়, আমাকে একটা দরকারে কাজে এক্ষুনি এক জায়গায় যেতে হবে। বকুল বিমূঢ়ের মতো দাড়িয়ে। অবধূত বেরিয়ে এসে আবার ট্যাক্সিতে উঠলেন। সেখান থেকে সোজা পার্ক স্ট্রীটে তাঁর এক জাঁদরেল পুলিশ অফিসারের কোয়ার্টার্স-এ। তার বদ্ধ পাগল মেয়েকে তিনি ভালো করেছিলেন। সেই থেকে ওই পরিবারটি তাঁর বিশেষ ভক্ত এবং অনুগত। তাঁকেও ঘুম ভাঙিয়ে তোলা হলো। অবধূত তাঁর সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টা কথা বলে ভোর সাড়ে ছ’টার মধ্যে আবার ট্যাক্সিতে।

সাড়ে আটটার মধ্যে একরাশ বাজার করে আবার কোন্নগরে নিজের বাড়িতে। তপু আর রিনা ভাবল জেঠু এই বাজার করতেই সকাল সকাল বেরিয়েছিল। পেটো কার্তিকও তাই ভেবেছে।

খুব ফুর্তির মধ্যেই দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষ হলো। খানিক বাদেই তপু আর রিনা—হতবাক। কলকাতা থেকে বকুল-মা এসে হাজির। তপু আকাশ থেকে পড়ল, মা তুমি এখানে, এ কি কাণ্ড। বকুলও তেমনি অবাক। হকচকিয়ে গিয়ে বলল, কেন, দাদা যে সকালে নিজে গিয়ে তুই এসেছিস বলে আমাকে আসার কথা বলে এলেন।

অবধূত হেসে তাদের নিরস্ত করলেন, এ-সব নিয়ে পোস্টমর্টেমের দরকার নেই—বকু, এই তোমার ছেলের বউ রিনা, দ্যাখ কি মিষ্টি মেয়ে?

বকুল আবারও বিমূঢ়।

বিকেল চারটের মধ্যে শুধু বাড়ির লোক কেন, পাড়াসুদ্ধ, হতচকিত।

অবধূতের বাড়ি পুলিশে ঘেরাও করেছে। রিভলভার উচিয়ে পাঁচজন পদস্থ কর্মচারী এসে তপুকে হাত কড়া পরিয়ে গ্রেপ্তার করল। আর সকলেই হতভম্বের মতো দেখল, তাদেরও যে ওপরওলা তিনি অবধূতের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন।

নির্বাক নিস্পন্দ সকলে। বকুল আর রিনা থর-থর করে কাঁপছে। তারা বিবর্ণ পাংশু। তপুই সকলের আগে ব্যাপার বুঝেছে। দুচোখে গলগল করে ঘৃণা ঠিকরোচ্ছে। পৃথিবীর আর যে-কেউ এমন বিশ্বাসঘাতকতা করলে এত বজ্রাহত হতো না, এত ঘৃণা করত না। সেই ঘৃণার আগুন শুধু চোখে নয়, গলা দিয়েও ঠিকরোচ্ছে। — তুমি? তুমি? তুমি এ-কাজ করেছ তাহলে? এই জন্যেই ভোর না হতে তোমার কলকাতায় ছোটা দরকার হয়েছিল? আমার মা-কেও এমন দৃশ্য দেখাবার লোভ সামলাতে পার নি? তাকে তুলে নিয়ে যাবার আগে আরো বলেছে। বলেছে, কাউকে হত্যা করার জন্য আমি কখনো অস্ত্র হাতে তুলি নি, কেবল দুজনের প্রাণ বাঁচাতে একটা খুন করেছি—কিন্তু জেনে রেখে দাও যদি আমার ফাঁসি না হয় আর যদি আমি কখনো ফিরি আর তোমার ঈশ্বর যদি ততদিন বাঁচিয়ে রাখে— খুব ঠাণ্ডা মাথায় আমি আর একটা হত্যা করব…সেদিন কোন্ ইষ্ট তোমাকে রক্ষা করতে পারে আমি দেখব।

তপুকে নিয়ে ওরা চলে গেল।

ধুপ করে একটা শব্দ হতে সকলে সচকিত হয়ে দেখে রিনা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে। অবধূতই আগে ছুটে এসে তাকে তুলে ধরতে গিয়ে বাধা পেলেন। বিকৃত গলায় বকুল বলে উঠল, ও যেমন আছে থাক, আপনি আগে বলুন তপু এ কি বলে গেল— যা বলে গেল তা ঠিক কিনা?

বজ্র-গম্ভীর ধমকের সুরে অবধূত বলে উঠলেন, সেটা জানতে বুঝতে হলে একটু অপেক্ষা করতে হবে—আমি কেন কি করেছি এই স্নায়ু নিয়ে বোঝা তোমার পক্ষেও সম্ভব নয়। পেটো কার্তিকের দিকে তাকিয়ে হুংকার ছাড়লেন, দাঁড়িয়ে দেখছিস কি, জল নিয়ে আয়!

ওই মুখের দিকে চেয়ে বকুল বিহ্বল বিভ্রান্ত। বাবার এই মূর্তি কার্তিকও কখনো দেখে নি। সে উর্ধ্ব শ্বাসে জল আনতে ছুটল।

রিনা ঠাকুরঘরে শুয়ে আছে, কল্যাণীর কোলে তার মাথা। জলের ঝাপটায় জ্ঞান ফিরতে অবধূতের ইশারায় কল্যাণী তাকে এ-ঘরে নিয়ে এসেছে। তার বিমুঢ় বৃষ্টি। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে সে কেবল ভয়ংকর রকমের দুঃস্বপ্ন দেখে উঠেছে একটা।

অবধূত শোবার ঘরে গেছলেন, একটু বাদে ফিরে এলেন। থমথমে মুখ, ঘরে পাড়ার দু‘একজন মহিলা ছিল। তাঁদের বললেন, আপনারা এখন বাইরে যান মা, আমার এ-ঘরে একটু কাজ আছে। তাঁরা তক্ষুনি চলে গেলেন। অবধূত পেটো কাতিক আর হারুকেও চলে যেতে বললেন। তারপর দু‘হাত কোমরে তুলে ঝুঁকে রিনার দিকে তাকালেন। খুব কোমল গলায় বললেন, একটু ভালো বোধ করছিস তো মা…? তোর বড় মায়ের ঠাকুরঘরে দাড়িয়ে বলছি, আমি কি এমন কিছু করতে পারি যাতে তপুর—আমাদের একমাত্র বংশধরের এতটুকু ক্ষতি হয়—এর পরের ম্যাজিক তোকে আর তোর শাশুড়িকে যদি আমি না দেখাতে পারি, তাহলে এই দ্যাখ, এটা চিনিস?

রিনার মুখে কথা নেই। চিনেছে। তপুর সেই রিভলবার। বকুল বিস্ফারিত নেত্রে চেয়ে আছে। তার দিকে চেয়ে অবধূত বললেন, এটা তোমার ছেলের, তপু আমাকে রাখতে দিয়েছিল, গুলিও আছে।…শোনো বকুল, রিনা শোন্—আমি যা করেছি সেটাই যদি তপুর বাঁচার একমাত্র পথ না হয়, খুব শিগগীরই সমস্ত অপরাধের দাগ ধুয়ে মুছে ফেলে সুস্থ জীবনের পথ ধরে তোমাদের কাছে ফিরে না আসে তাহলে এই ঘরে দাড়িয়ে আমার মহাগুরুর নাম নিয়ে শপথ করছি— আমার জীবনের সমস্ত শিক্ষা ভুল জেনে তপুর দেওয়া এই জিনিস দিয়েই আমি আমার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করব। তীব্র চোখে কল্যাণীর দিকে তাকালেন, তুমি কি বলো? ওদের শুনিয়ে দাও—আমার এ শপথ তুমিও মেনে নেবে কি নেবে না? কল্যাণী স্থির চোখে তাঁর দিকে তাকালেন। বললেন, মেনে না নিতে বাধা কোথায়, তুমিও জানো আমিও জানি এ-শপথ রক্ষা করার দরকার হবে না। গুরুর আদেশ যা পেয়েছ তা মিথ্যা হতে পারে না।

রিনা আস্তে আস্তে উঠে বসল। সে বা বকুল কেউ কিছু বুঝছে না। এই দু‘জনের মুখের দিকে চেয়ে বুকের তলায় কি যেন একটু আশার মতো উকিঝুকি দিচ্ছে।

অবধূত নিজেও আস্তে আস্তে তাদের সামনে মেঝেতে বসলেন। বললেন আমি যা করেছি তা না করলে শেয়াল কুকুরের মতো তপুকে যারা তাড়া করে বেড়াচ্ছে, তাদের কারো গুলিতে খুব শিগগীরই তার মৃত মুখ আমাদের দেখতে হতো, মা হয়ে তোমাকে বা জ্যাঠা হয়ে আমাকে তার মুখাগ্নি করতে হতো।

গলা দিয়ে অস্ফুট একটা আর্ত শব্দ বার করে বকুল শিউরে উঠল।

অবধূত বলে গেলেন, ওই রিনাকে জিজ্ঞেস করে। কি যন্ত্রণা আর উদ্‌বেগ নিয়ে আমি তপুর আর ওর কপাল দেখেছি আর হাত দেখেছি। কেউ যেন তপুর সমূহ একটা ফাড়া আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। প্রাণঘাতী ফাড়া, কিন্তু আবার সেটা পরিষ্কার হয়ে যাবার লক্ষণও স্পষ্ট। তারপর সুস্থ সুন্দর লম্বা স্বাভাবিক জীবন। রিনার হাত বা কপালেও কোনোরকম বৈধব্যের বা দীর্ঘদিন স্বামীর কারণে দুর্ভোগের চিহ্ন নেই। যা আছে সেটা সাময়িক, বড় জোর পাঁচ ছ’বছরের। একটু বাদেই বুঝলাম, কি হলে বা কি করলে এমন একটা ফাড়া কেটে যেতে পারে। ও ধরা দিলে পুলিশের হাতে গুলি খেয়ে মরার ভয় নেই। আর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও ওর হতে পারে না, তাহলে সুস্থ সুন্দর লম্বা স্বাভাবিক জীবন যাপনের এমনসব স্পষ্ট চিহ্ন থাকত না।

ক’টা দিন আমার কি যে সংকট গেছে তোমরা জানো না। যদি আমার বিচারে ভুল হয় তাহলে সর্বনাশ, আর ভুলের ভয়ে যদি চুপ করে বসে থাকি তাহলে আরো সর্বনাশ। তপু রিনা দুজনেই জানে তিন-তিনটে রাত এরপর আমি শ্মশানে কাটিয়েছি। আমার মহাভৈরবগুরুর কাছে ভৈরবী মায়ের কাছে আকুল হয়ে প্রার্থনা করেছি, আমার মন স্থির করে দাও, আমার দৃষ্টি আরো মুক্ত করে দাও—আমার সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাটিয়ে আমাকে শুধু সত্য দেখার শক্তি দাও। তাই তাঁরা দিয়েছেন। নিজের ভিতরে থেকেই গুরুর গলা কানে এসেছে, হতভাগা দেরি করছিস কেন —আয়ু আছে তবু ছেলেটা বেঘোরে মরবে! ও ছেলে নিষ্পাপ ওর ক্ষতি কে করবে কেবল কল্যাণীকে সব বলেছি। সে-ও আমার সঙ্গে একমত। বলেছে ভুল হতে পারে না, তুমি যা করার করো।

…কাল রাতে ওদের আমি নিজের মনের মতো করে বিয়ে দিয়েছি। রাত থাকতে উঠে ট্যাক্সি নিয়ে তোমার কাছে চলে গেছি। সেখান থেকে আমার ভক্ত এই মস্ত পুলিশ অফিসারের কাছে গেছি। তাঁকে কেবল একটু অনুরোধ করেছি, লক-আপে তপুর ওপর যাতে কোনো রকম অত্যাচার না হয় সে দায়িত্ব তাঁকে নিতে হবে। সব শোনার পর তাঁরও মনে আশঙ্কা। জিজ্ঞেস করেছেন, ফাঁসী না হোক, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে না আপনি ঠিক জানেন?

বলেছি ঠিক জানি।

এর পরের অধ্যায় কিছুটা গতানুগতিক। অবধূত একদিনের জন্যও কোর্টে যান নি। আসামী তপন চ্যাটার্জীকে বুঝতেও ছ্যান নি, তার হয়ে সওয়াল করার জন্য এমন একজন নামজাদা উকিল কে দিলে—কে এমন জলের মতো টাকা খরচ করছে। নিজের উক্লিকেই সে এ-কথা জিজ্ঞেস করেছিল। উনি বলেছেন, তপুরই একজন মস্ত বড়লোক বন্ধুর বাবা — নাম বলতে বাধা আছে। তপু অবিশ্বাস করে নি, আঁচও করেছে কে হতে পারে, এ-রকম একজন বিরাট অবস্থাপন্ন বন্ধু তার আছে—মা তাকে জানে মায়ের চেষ্টাতেই এটা সম্ভব হয়েছে।

তার বিরুদ্ধে খুনের কোনো অভিযোগই শেষ পর্যন্ত টেকে নি। বাপের বাড়ির পাড়ার যে ছেলেরা মৃত গুণ্ডা সুধীর দত্তর দল থেকে রিনাকে অপহরণ করেছিল, পুলিশ তাদের ওপর চড়াও হয়ে কোর্টে টেনে এনেছে। রিনা তাদের সনাক্ত করেছে। অবধূতের পুলিশ অফিসারের দাপটে তাদের হৃৎকম্প। কোর্টে তারা অপরাধ স্বীকার করেছে। জেরায় পড়ে সুধীর দত্ত আরো কিছু কুকার্য ফাঁস করে দিয়েছে। তপুর উকিল এটাও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পেরেছেন যে আত্মরক্ষা আর রিনাকে রক্ষা করার জন্যই তপন চ্যাটার্জী সুধীর দত্তকে গুলি করতে বাধ্য হয়েছিল। রিনা শাস্ত মুখে সুন্দর সাক্ষী দিয়েছে।

তপন চ্যাটার্জী শেষ পর্যন্ত খুনের দায় থেকে রক্ষা পেল বটে। আর পুলিশের ভক্ত অফিসারটির চেষ্টায় নক্সালের ছাপটাও উবে গেল। সমাজবিরোধীর কার্যকলাপ আর লুঠতরাজের অভিযোগ খণ্ডন করা গেল না। বিচারের দায়ে তার পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হলো।

তাকে ভ্যানে তোলার সময় ব্যাকুল মুখে যতটা সম্ভব ভিড় ঠেলে সামনে গেছল। তপু চেঁচিয়ে বলেছে, মা জেঠুকে এবার তৈরি থাকতে বোলো। মা আর রিনার প্রতিক্রিয়া বোঝার আগেই পুলিশ তাকে ভ্যানে টেনে তুলেছে।

বকুল এরপর অনেকবার অনুনয় করে বলেছে, দাদা, তপুর সঙ্গে আমার একবার দেখা করার ব্যবস্থা করে দিন, সব বলে তো ওর ভুল ভাঙাতে হবে।

অবধূত হাসি মুখে তাকে নিরস্ত করেছেন।—কিচ্ছু দরকার নেই, সময়ে সব হবে। পাঁচ বছরের জন্য আমার ওপর তোমরা ওকে জ্বলতে দাও, আখেরে তাতে দু‘তরফেরই লাভ বই লোকসান হবে না।

বকুল আর রিনা তাঁর এ-কথা আদেশ বলেই মেনে নিয়েছে।

অবধূত শাশুড়ী-বউয়ের থাকার জন্য সেই বড় পুলিশ অফিসার ভক্তর মারফৎ ভালো একটা ফ্ল্যাটও যোগাড় করেছেন। রিনার সন্তান কোন্ নার্সিং হোমে হবে, কোন্ ডাক্তার দেখবে সে সব ব্যবস্থাও তিনি নিজে করেছেন। তাঁর কথায় বকুল জলের দরে তার শেলাইয়ের দোকান বিক্রি করে দিয়েছে। অবিশ্বাসের আর ঠাঁই কোথায়? দাদা বলেছেন, জেল থেকে বেরুলেই তপুকে হরিদ্বার আর দেরাদুনে গিয়ে সকলকে নিয়ে পাকাপাকি ভাবে থাকতে হবে—তপুর জন্য সেখানে একটা ভালো কাজ তিনি ঠিক করেই রেখেছেন। না কলকাতায় বা কোথাও কোনো রকম রাজনীতির হাওয়ার মধ্যে তপুকে তিনি আর রাখবেন না। আপাতত সব খরচ তাঁর।

…তপুর জন্য উনি হরিদ্বার আর দেরাদুনে ভালো কাজ ঠিক করেছেন তা-ও বক্রেশ্বরে মহাভৈরব বাবার ডেরায় বসেই শুনেছি। আজ নয়, বহু বছর আগেই, তপুর যখন মাত্র ষোলে। সতেরো বছর বয়েস—তখন থেকেই এ সংকল্প তাঁর মাথায় ছিল। তপু ওই বয়সে নক্সালদের সঙ্গে আর আরো কাদের সঙ্গে মিশছে শোনার পর থেকেই তাঁর দুশ্চিন্তা। তখনই ঠিক করেছিলেন ওকে কলকাতায় রাখবেন না। কিন্তু তখনো প্ল্যান কিছু ঠিক হয়নি। সেই সময় হরিদ্বারের ভক্ত পুরুষোত্তম ত্রিপাঠী—বাবার দয়ায় যার সেখানে এখন তিন-তিনটে হোটেল—সে দেখা করতে এসেছিল। কথায় কথায় ভাইপোর কথা শুনে সেই সোৎসাহে প্রস্তাব দিয়েছিল, তার হাতে ছেড়ে দিলে ওই ভাইপোর দায়িত্ব সে নেবে। পাঁচ-সাত বছর শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়ে সব কটা হোটেলের জন্য একজন জেনারেল ম্যানেজার পোস্ট করে তাকে বসিয়ে দেবে। বাবার ভাইপোকে পেলে সে বর্তে যাবে। …

তপুর বিচারের রায় বেরুবার পর পূর্ব কথা স্মরণ করিয়ে অবধূত তাকে একটা চিঠি লিখেছিলেন। চিঠি পেয়েই সে সানন্দে জবাব দিয়েছে, আগের ব্যবস্থা তো ঠিক আগেই। এখন সে দেরাদুনেও একটা আধুনিক হোটেল করার কথা ভাবছে। বাবার ভাইপোকে পেলে সে নির্দ্বিধায় সেটা করবে আর সব কটা হোটেলের জেনারেল ম্যানেজারের পদে তাকে বসিয়ে দেওয়া ছাড়াও দেরাদুন হোটেলের চার আনার লাভের অংশও লিখে দেবে। বাবা সত্বর ভাইপোকে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন, বিশ্বস্ত আপনারজনের তার বড় অভাব। ফলে ভাইপোর সম্পর্কে অবধূত তাকে আবার বিস্তারিত লিখেছেন। তার উত্তরে পুরুষোত্তম ত্রিপাঠী জানিয়েছে, বাবার ইচ্ছেই তাঁর কাছে আদেশ—সে অপেক্ষা করবে।

একটু হেসে অবধূত বলেছিলেন, মানুষের মন কোথায় নামে আবার কত ওপরেও ওঠে দেখুন।…মাস ছয় আগে পুরুষোত্তম হরিদ্বার থেকে কোম্নগরে এসে হাজির। ভাইপোকে নেবার তাগিদ আমার থেকে তার বেশি।

তার সব ব্যবস্থা পাকা, দেরাদুনে জমি কিনে আধুনিক হোটেলের বাড়ির কাজও শুরু হয়ে গেছে—আমার ভাইপোর অপেক্ষায় এখন সে উন্মুখ হয়ে আছে।…আমি ঠাট্টা করে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কত মাইনে দেবে? তাইতেই ঘাবড়ে গিয়ে আমতা-আমতা করে চলেছে, ভেবেছিলাম শুরুতে মাসে তিন হাজার টাকা করে দেব, আর বছরে নতুন হোটেলের চার আনা অংশ…তবে বাবা যদি আরো বাড়াতে বলেন, আমি সেটাই ঠিক ধরে নেব। আমিই উল্টে লজ্জা পেয়েছি, তুমি যা ভেবেছ সেটা ঠিকের থেকেও অনেক বেশি।

…রিনার একটি মেয়ে হয়েছে। এখন সাড়ে চার বছর বয়েস। বেশ ফুটফুটে মেয়ে শুনলাম।

এরপর কেবল সেই দিনটির প্রতীক্ষা সকলের। তপুর জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রতীক্ষা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *