সেই অজানার খোঁজে ১.৫

মনে মনে আর না ফেরার সংকল্প নিয়ে কালীকিংকর ঘর ছেড়েছিলেন এখন থেকে আরো আট বছর আগে। ফিরতেই যদি হয়, একই মানুষ ফিরবে না-ফেরা না ফেরা সমান এমন মানুষই ফিরবে। কারো ওপর রাগ অভিমান বা অভিযোগ ছিল না। নিজের কাছে নিজেই তিনি সব থেকে বড় বিঘ্ন। এই বয়সেও ভোগ তাঁকে টানে, প্রবৃত্তির আকর্ষণ অমোঘ হয়ে ওঠে। দেশে দেশে তাঁর ভক্ত সংখ্যা অনেক। এত ভক্ত জুটিয়ে দিয়ে কেউ যেন আড়াল থেকে মজা দেখছে। তাদের কাছে বড় হয়ে ওঠার লোভ মনের তলায় বাসা বেঁধেছে বই কি। এই সব বন্ধন তাঁকে ছিঁড়তে হবে, শিকল ছিড়ে বেরুতে না পারা পর্যন্ত মুক্তি নেই। সেই মুক্তির রূপ কেমন জানেন না। ভোগ প্রবৃত্তি লোকমান্য সব একদিকে ফেলে রেখে ঝাড়া হাতে-পায়ে শুধু বেরিয়ে পড়ার তাগিদ।

কোথায় যাচ্ছেন কত দিনের জন্য যাচ্ছেন কল্যাণীকে বলেননি। কল্যাণীও কিছু জিগ্যেস করেননি। এটাই তাঁর রীতি। তবু এবারে বোধহয় মনে একটু খটকা লেগেছিল। মুখের দিকে চেয়ে থেকে জিগ্যেস করেছিলেন কি আশায় যাচ্ছ কি পেতে চাও?

—আশার শেষ করতে। পেতে চাই না, ছাড়তে চাই।

আবার জিগ্যেস করলেন, কি ছাড়তে চাও?

পরিহাসের মতো করে সব থেকে বড় সত্যি কথাটাই বললেন। হ্যাঁ, ভিতরে ভিতরে এই বন্ধনের শিকলটাই ছেড়ার বেশি তাড়া। এই একজন যেন তাঁর জীবনে স্থির জলাশয় একখানা। ভোগের আর প্রবৃত্তির তাড়নায় তাঁর বুকে আলোড়ন তুললে ঢেউ ওঠে, তরঙ্গ ছড়ায়। তারপর আবার যেমন স্থির শান্ত—তেমনি। হেসে জবাব দিলেন, সব থেকে আগে তোমাকে।

হাসলেন কল্যাণীও।—পালিয়ে গিয়ে পালানোই হয়, ছাড়া হয় নাকি? ঐশ্বর্যের মধ্যে থেকেই ঐশ্বর্য ছাড়তে হয়, পালালে সেটা তোমাকে আরো বেশি টানবে।

মনে দাগ ফেলার মতোই কথা। এমন ছাড়ার মর্ম অবধূতও জানেন। কিন্তু বিবাহিত জীবনের প্রায় চব্বিশটা বছর কেটে গেছে, ভোগের মধ্যে থেকেও নিবৃত্তির শক্তি তিনি অর্জন করতে পারেননি। চোখের বার মনের বার-এও তো একটা কথা। তিনি বেরিয়েই পড়লেন।

বিহারের দিকে কেন রওনা হলেন তার স্পষ্ট কোনো কারণ নেই। কেবল মনে হয়েছে ও-দিকটাতেই খুব কম যাওয়া হয়েছে। চেনামুখের উৎপাত ওখানেই সব থেকে কম হবে। ট্রেনের জন-সাধারণের কামরায় গাদাগাদি ভিড়। টিকিট কেটেছেন, রিজারভেশনের বালাই নেই। এতো লোকের মধ্যে একেবারে বিচ্ছিন্ন থেকেই চললেন তিনি। এই বেরুনোর প্রস্তুতি অনেক দিন ধরেই চলছিল। ছ’মাস আগে থেকে চুল-দাড়ি কাটেননি, মাথায়ও তেলের ছোঁয়া পড়েনি। দিব্বি শনের মতো চুলদাড়ি জটাজ ট গজিয়েছে। পরনের বা গায়ের রক্তাম্বরও নজর কাড়ার মতো ঝকঝকে সিল্কের নয়। বরং মলিন। কাঁধের মস্ত গেরুয়া ঝোলায় আরো দু’ প্রস্থ জামাকাপড় সুযোগ-সুবিধে পেলে এ-ও ত্যাগ করার ইচ্ছে আছে। ঝোলাতে কিছু টাকা অবশ্য আছে কিন্তু খুব বেশি নয়। সঙ্গে একটা চিমটে আর ত্রিশূল। সব মিলিয়ে কারো চোখ প্রসন্ন হবার মতো মূর্তি নয়, উল্টে হয়তো বিমুগ্ধ হবার মতো। টিকিট চেকার তো ভিড়ের মধ্যে উঠে তাঁকেই প্রথম অব্যর্থ শিকার ভেবে হামলার মূর্তি ধরেছিল।—এই! উত্তর যাও! অর্থাৎ এ-রকম ভণ্ড সাধু তার অনেক দেখা আছে।

—কাঁহে জী?

—টিকিট হ্যায়?

ঝোলা থেকে টিকিট বার করে দেখালেন। ভালো করে সেটা পরখ করে ফেরত দিতে অবধূত করুণা প্রার্থীর মতো জিগ্যেস করলেন, উত্তরনে পড়েগা সাব?

—নহি, ঠয়ের যাও।

পরদিন সমস্তিপুর ছাড়িয়ে ট্রেন দ্বারভাঙায় আসতে কি ভেবে নেমে পড়লেন। ঘটনার আসরে বিশেষ কিছু ভূমিকা আছে বলেই নেমেছেন এমন চিন্ত৷ কোনো কল্পনার মধ্যেও নেই। নিজের ইচ্ছে আর নিজের খেয়ালটুকুই সব ভেবেছেন।

প্রায় ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর যেখানে এলেন তার নাম কাঁকুরঘাটি। বেশ বর্ধিষ্ণু গ্রাম। বিশ্রামের জন্য একটা বড় অশ্বত্থ গাছ পছন্দ হলো। কিন্তু খিদে পেয়েছে। একটা দোকান থেকে কিছু মুড়ি আর গুড় কিনে আর ঝোলার কমণ্ডুলুতে খাবার জল নিয়ে গাছতলায় বসলেন। যাতায়াতের পথে লোকজনেরা সাধুকে দেখছে, কিন্তু লক্ষ্য করার কোনো কারণ নেই। হামেশাই এ-রকম সাধু দেখে অভ্যস্ত তারা।

সন্ধ্যার পর আবার গুটি-গুটি এগোতে লাগলেন। ভিখিরি গোছের একটা লোককে জিগ্যেস করলেন, শ্মশান কোন্ দিকে, কত দূরে। সে জানান দিল সোজা গেলে অধিক্রোশ দূরে, কমলাগঙ্গার ধারে।

গ্রামের মাঝামাঝি জায়গা দিয়ে উত্তরমুখি কমলাগঙ্গা বয়ে চলেছে। কমলাগঙ্গার উৎস নেপাল পর্বতমালা। দূরে পারাপারের রেলব্রিজ। জয়নগর পেরিয়ে আরো এগোলে নেপাল-বর্ডার। গঙ্গার দক্ষিণদিকে মস্ত এলাকা জুড়ে শ্মশান। পাঁচ ছ’বিঘে হবে। এদিকে লোকালয় বা জন-বসতি নেই। খানিক দূরে চালাঘরে খুব গরিব মানুষদের সংসার। শ্মশানে বড় বড় অনেক বট অশ্বত্থ আর দেবদারু গাছের সারি। এ-ছাড়া বেল আর অন্য কিছু ছোট গাছও আছে। এই নির্জন শ্মশান ভারী পছন্দ হলো অবধূতের। এমাথা ওমাথা একবার ঘুরে দেখলেন। পরে জেনেছেন, এখানকার লোকের কাছে এই শ্মশান মহাশ্মশান। তারা একে মুদ্দাঘাট বলে। কিন্তু ঘাট বলতে বা বোঝায় সে-রকম কিছু নেই। তবে যে জায়গায় বেশি দাহ হয় সে-জায়গার চেহারা একটু অন্যরকম। দিনমানেও এই শ্মশানে লোক যাতায়াত কম, রাতে যারা শবদাহ করতে আসে তারা দল বেঁধেই আসে।

এই নিথর নির্জন মুদ্দাঘাট সাধারণ লোকের কাছে গা-ছমছম করা ভয়ের জায়গা হওয়াই স্বাভাবিক।

রাত বোধহয় বেশি নয়। হাত ঘড়ি কলকাতাতেই বিসর্জন দিয়ে এসেছেন অবধূত। কিন্তু মনে হয় অনেক রাত। একটা জোড়া বট আর অশ্বত্থ গাছ এক হয়ে বিশাল শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে দাঁড়িয়ে আছে। এই গাছটাই পছন্দ হলো অবধূতের। আর কিছু না হোক, কোথাও গেলে অবধূতের সঙ্গে ছোট টর্চ একটা থাকেই। খোলায় আছে। ঝোলায় অনেক কিছুই আছে। হঠাৎ দরকার হতে পারে এমন কিছু সাধারণ রোগের ওষুধ-বিষ্ণুধও। ক্ষুধা, তৃষ্ণা তো আর একটুও ত্যাগ হয়ে যায়নি। এ-জন্যে খুব নিরাসক্তভাবে লোক টানতেই হবে। লোক টানার এগুলোই বড় সম্বল। মুশকিল আসান হলে লোকের বিশ্বাস সহজে গজায়। … টর্চের জন্য ঝোলায় হাত ঢুকিয়েও সেটা আর বার করলেন না। শীতের মাঝামাঝি সময় এটা। কার্তিকের শুরু। এখানে বেশ কনকনে ঠাণ্ডা। শীত জয় করার অভ্যাস তারাপীঠে থাকার সময় থেকেই। ভৈরবী মায়ের গায়ে ভরা শীতেও কখনো গরম জামা বা ভারী আচ্ছাদন দেখেননি। আর বাবা তো শীত-গ্রীষ্মে নির্বিকার। ভৈরবী মা বলেছিলেন, এটা অভ্যাসের ব্যাপার বাবা, একটু একটু করে অভ্যাস করলে সকলেই পারে। অবধূত অভ্যাস করেছিলেন। তাই ঠাণ্ডার ভয়ে কাতর নন তিনি। মাথায় যা এসেছে রাতের মধ্যেই সেটুকু সম্পন্ন করবেন। এই বেশ-বাসও ছাড়ার তাগিদ। টর্চ বার করলেন না কারণ, চারদিকে জ্যোৎস্নার বান ডেকেছে। তাছাড়া অন্ধকারে সাধারণ লোকের তুলনায় তাঁর অনেক বেশি চোখ চলে বইকি। এ-দিক— ও-দিকে সন্ধানী দৃষ্টি মেলে তাকালেন। খানিকটা দূরে একটা নিভু নিভু চুল্লির কাছে কিছু চোখে পড়ল। এগিয়ে গেলেন। যা ভেবেছিলেন, তাই। মড়ার বড়সড় ফেলে-দেওয়া চাটাই একটা। চাটাই আর চুল্লি থেকে একটা আধা-জ্বলা চেলা-কাঠ নিয়ে গাছতলায় ফিরলেন।

গাছতলায় চাটাই পেতে তার ওপর ঝোলা থেকে বড় একটা লাল কম্বলের আসন বার করে ওটার ওপর বিছিয়ে গদি করলেন। আসন প্রস্তুত।

এরপর সম্পূর্ণ নগ্ন, উলঙ্গ তিনি। ঝোলা থেকে একটা চওড়া কৌপিন বার করে পড়লেন। মলিন লাল-বসন ঝোলায় পুরে আবার সেই প্রায়-নিভু চুল্লির কাছে চললেন। চুল্লি থেকে তপ্ত ছাই তুলে তুলে কপালে বাহুতে বুকে আর দু‘পায়ে মেখে ফিরে এসে আসনে বসলেন। চিমটেটা পাশে রেখে ত্রিশূল মাটিতে পুঁতে দিলেন।…একটা মড়ার মাথার খুলি পেলে ভালো হতো। কাল দিনেরবেলায় খোঁজ করবেন।

দূরের এক গাছতলায় দাঁড়িয়ে কেউ তাঁকে লক্ষ্য করছে এটা অনুমান করার কোনো কারণ নেই। হঠাৎই মনে হলো একটা লোক এ-দিকে এগিয়ে আসছে। এলো। সামনে এসে দাঁড়ালো। বেশ মজবুত কাঠামোর একটা মানুষ। মিস-কালো গায়ের রং। চওড়া জুলফি চিবুকের কাছে নেমে এসেছে। পুরুষ্টু গোঁপ। গোল চোখ। পরনে খাটো ধুতি। ঊর্ধ্ব অঙ্গে একটা ছেঁড়া-খোঁড়া গরম কম্বল জড়ানো। হাতে লম্বা একটা নিভানো মশাল। মুখে জ্বলন্ত বিড়ি। বয়েস চল্লিশের ও-ধারে।

কম্বল সরাতে দেখা গেল গায়ে ঠাঁটু সমান একটা ছেঁড়া গৰম কোর্তা। পকেট থেকে দেশলাই বার করল। তেলে ভেজানো মশালটা জ্বেলে তাঁর দিকে বাড়িয়ে দেখতে লাগল। মশালের উষ্ণ তাপ খুব আরামের মনে হলো অবধূতের।

—তুম্ কওন? লোকটা জিগ্যেস করল।

গুরুগম্ভীর গলায় অবধূত পাল্টা প্রশ্ন করলেন, তুম্ কওন?

এর পরে—এর পরে কেন, অবধূতের এই শ্মশানে তিন বছর অবস্থান কালে সকলের সঙ্গে সব কথাবার্তাই দেশোয়ালি হিন্দীতে। কিন্তু এই লেখকের হিন্দীর বিদ্যে এতই সীমিত যে এরপর থেকে সব কথাবার্তার ভাবই বাংলায় বিস্তার করছি।

লোকটা দাপটের সঙ্গে জবাব দিল, আমার নাম কাল্লু কাল্লু কি চীজ, এ মুলুকের সকলেই জানে, দূর থেকে তোমাকে আমি কৌপিন পরে ছাই মেখে সাধু বনতে দেখলাম—কোথায় কি করে এসে ভোল বদলাচ্ছ? ঠাণ্ডা মুখে অবধূত বললেন, আমার ভোল নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না, যাও এখন এখান থেকে!

এই শ্মশানের লাগোয়া কাল্লুর ডেরা এবং সংসার। এখানে তাঁর একচ্ছত্র দাপট। গাঁয়ের মানুষদের বেশির ভাগই গরিব। তাদের বিপদে কার শস্তায় কাঠ যোগান দেয়। অবস্থাপন্ন ঘরের শব এলে টাকার জন্য জো জুলুম করে। টাকার বিনিময়ে সে আর তার সাগরেদরা সাহায্য করে মোট কথা কারু সর্দারকে কেউ খুব তুচ্ছ করে না। তার মধ্যে একট উটকো লোক এখানে এসে সাধু সেজে এমন আস্পর্ধার কথা বললে সে বরদাস্ত করে কি করে। তাছাড়া এখানকার মানুষদের মতিগতি জানে। শ্মশানে চাই-মাখা সাধু বসে আছে দেখলে পাঁচ দশ পয়সা বা বড়লোক হলে সিকি আধুলি টাকা ফেলে পুণ্যি করে যাবে। এ-যেন তারই ভাগে থাবা বসানো। তার মেজাজ আরো উগ্র, কারণ পেটে হাড়িয়া পড়েছে। হাতের মশাল তাঁর দিকে বাড়িয়ে হুমকি দিল, এক্ষুণি এখান থেকে ভেগে পড়বে তো পড়ো—নইলে কাল্লু সর্দার এই শ্মশানেই তোমার সৎকার করবে জলদি ভাগো!

এ-সব লোককে বশ করার মতো কিছু ক্ষমতা এত কালে অবধূতের হয়েছে বইকি। মশালের আলো দাড়ি-গোঁপ জটাজ ট ছাওয়া মুখের ওপর পড়তে আরও সুবিধে হলো। দু‘চোখের অগ্নি দৃষ্টি লোকটার মুখের ওপর বিদ্ধ হয়ে রইল। না, সম্মোহন বা বশীকরণ বিদ্যে বলে কিছু যদি থেকেও থাকে অবধূত তা জানেন না। কিন্তু এই দৃষ্টির আঘাতে অনেক জোরালে। মানুষকেও বিভ্রান্ত হতে দেখেছেন। এই লোকটাও একটু থমকেছে বটে, তবু ফিরে চেয়ে থেকে দাপটের সঙ্গেই যুঝছে। হাত বাড়িয়ে আস্তে আস্তে ত্রিশূলটা তুলে নিলেন অবধূত। দাপট যারা দেখায় তারা দাপটের কাছেই নত হয়। সজোরে যেন ছুড়েই মারলেন ওটা—কাল্লু একলাফে তিন পা পিছিয়ে গেল। কিন্তু না… ত্রিশূল ছোড়া হয়নি, সামনেই মাটিতে গেঁথে দেওয়া হয়েছে।

শ্মশান কাঁপিয়ে হেসে উঠলেন অবধূত! এই হাসিতে লোকটার শিরদাড়ায় হিমস্রোত নামার কথা কিছুটা। তাই হলো বটে। বিস্ফারিত চোখে দেখছে তাকে। চেয়ে আছেন অবধূতও। হাসিটা এবারে তাঁর চোখে আর দাড়ি-গোঁপে নিঃশব্দে এঁটে বসতে লাগল। খুব কোমল গলায় বললেন, তুই তো ভালো লোকরে কাল্লু, তোর এই মেজাজ কেন—খুব হাড়িয়া টোনছিল বুঝি—সেরকম লোকের পাল্লায় পড়লে তো জানে মববি!

কালু চেয়েই আছে। লোকটার সাহস দেখছে, তাই ক্ষনতা যাচাইয়ের চোখ।

ভয় নেই, এ-দিকে আয়-নশালটা ত্রিশূলের পাশে পুঁতে দে।

পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো। এখনো অবিশ্বাস আবার সংশয়ও। জোরে ঘাঁই দিতে মশালের অপেক্ষাকৃত সরু দিকটা মাটিতে বসে গেল। কংকালমালী ভৈরবের ডেরায় চার বছরে প্রচণ্ড শীত বা প্রচণ্ড তাপে দেহ অকাতর রাখার অভ্যাস অনেকটা রপ্ত হয়েছিল। কিন্তু অনেক কালের অনভ্যস্ততার ফলে নদীর ধারের ঠাণ্ডা বাতাস গায়ে বিঁধছিল। সেই অভ্যাসের মধ্যে ফিরে যাওয়া আর সেই সঙ্গে নিজেকে সংস্কার মুক্ত করার তাগিদেই অবধূত বস্ত্র ত্যাগ করেছিলেন।… মশালের এই তাপটুকু ভালো লাগছে।

—বোস্।

কাল্লু সর্দার সামনে বসল।

অবধূত আবার স্থির অপলক চোখে খানিক চেয়ে রইলেন। মায়ের এই শিক্ষাটুকু ব্যর্থ তো হয়ইনি, অভ্যাসে অভ্যাসে উল্টে অনেক ধারালো হয়েছে। উপলব্ধি স্বচ্ছ হয়েছে। স্নায়ুব ষষ্ঠ অনুভূতিও প্রখর।

—দাপট দেখিয়ে বেড়াস, ভিতরে তো তুই এক নম্বরের ভীতু রে—দেখি হাত দুটো বাড়া তো—

সঠিক না বুঝে দু‘হাত উল্টো করে বাড়ালো। এখনো সংশয় ঘোচেনি।

—হাত সোজা কর্ বুদ্ধ কোথাকারের।

বুদ্ধ শুনে চনমন করে উঠল একটু। তবু হাত সোজা করল।

অবধূত দেখলেন খানিক।—তিনটে ছেলে আর একটা মেয়ে তোর? এবারে বিমূঢ় একটু। মাথা নাড়ল। তাই।

—বউটা তো দেখছি রোগে ভুগে আধ-মরা— নিজে নেশা-ভাঙ খেয়ে পড়ে থাকিস—বউ ছেলে-মেয়েকে দেখিস না? এবারে ধমকের সুর।

কালু সর্দার বিলক্ষণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। তারপর দু‘চোখ বিস্ফারিত! উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে দু‘হাতে দুই পা আঁকড়ে ধরল।—হাঁ বাবা, আমি বহুত্, পাপী—আমার বহুর বেমার সারছে না—তুমি কৃপা করে তাকে আরাম করে দাও বাবা— আমার গোস্তাকি মাফ করে দাও—এই আমি কান মলছি—

—ঠিক আছে, আমাকে দেখে তুই ক্ষেপে গেছলি কেন সত্যি করে বল্? উঠে বসল। নেশা ছুটে গেছে। জোয়ান লোকটা এখন ভয়ে কাঁপছে! হাত জোড় করে জানান দিল, লাল জামা-কাপড় খুলে ফেলে কৌপিন পরে আর ছাই মেখে তাঁকে সাধু বনে যেতে দেখে সে ভণ্ড ভেবেছিল—লোকে এসে না বুঝে পয়সা দেবে, তাতে তার ক্ষতি হবে ভেবে তার মেজাজ বিগড়ে গেছল।

অবধূত হাসলেন।—ঠিক আছে যা, তোর রোজগার আগের থেকে ঢের বাড়বে—কিন্তু তুই দেখবি আমাকে যেন কেউ বেশি বিরক্ত না করে।

হাত জোড় করেই আছে কাল্লু সর্দার, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, সে জরুর দেখবে।

কাল্লু সর্দারের রোজগার ঢের বাড়বে এটা অবধূতের কোনো দৈববাণী নয় লোক-চরিত্র সম্বন্ধে তার যেটুকু জ্ঞান তাই থেকেই বলেছেন। বাসনা-ত্যাগ লক্ষ্য, মানুষের সেবা-ত্যাগ নয়। উপকার পেলে লোকে আসবেই। এই কালুই এরপর প্রচারের কাজ করবে। শ্মশানের সাধুকে তারা টাকা পয়সা দিয়ে যাবে জানা কথাই। তাঁর তো কেবল জীবন ধারণ নিয়ে কথা, টাকাপয়সার লোভ নেই। নির্লিপ্তভাবে মানুষের উপকার করার ইচ্ছে নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু কারো মায়ায় জড়ানোর ইচ্ছে আদৌ নেই। তাই প্রথম চেলা কাল্লু সর্দারকে এ-ভাবে হুঁশিয়ার করা।

—তোর বহুকে কাল নিয়ে আসিস, দেখব কি করা যায়।

আশ্বাস পেয়ে কালু সর্দারের মুখে কথা সরে না। জোড়-হাত করেই রইলো।

অবধূত চার-দিকে তাকালেন। এদিকে-ওদিকে বড় বড় কালো পাথর পরে আছে। ষষ্ঠ স্নায়ু আবার প্রথর। তাঁর যে-জীবন তাতে মানুষের বিশ্বাস আসল পুঁজি। এই বিশ্বাস সংস্কারাবদ্ধ তা-ও জানেন। কিন্তু নিরাপদে এখানে কিছু-কাল কাটাতে হলে খুব নিরাসক্তভাবে এই পুঁজিও ভাঙানো দরকার। বললেন, শোন, এখানে কোথাও শ্মশান-কালীমাতাজী নিজেকে গোপন করে রেখেছেন। তাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যেই এখানে আসা। তুই আর নিজেকে পাপী বলে পাপ বাড়াবি না তোর অনেক পুণ্যি, তোর এখন অনেক কাজ, আজ যা, কাল বলব।

জোড়-হাত করে যেন করুণা ভিক্ষা করল কালু সর্দার। মহারাজের সেবার কি ব্যবস্থা হবে?

ক্ষুধা তৃষ্ণা আর তেমন নেই অবধূতের। কিন্তু মশালের আলো কমে আসতে বেশ শীত-শীত করছে।—তোর ঘরে হাড়িয়া আছে?

কাল্লু বিগলিত।—জি মহারাজ!

আবার একটু ভাবলেন। —গাঁজা?

কাল্লু সর্দার ছুটল। গাঁজা এলো, নতুন কল্কে এলো। সঙ্গে তিন-চারজন সাঙ্গ-পাঙ্গ। যে সাধুকে দেখে সর্দারের বুকের তলায় আনন্দের কাঁপুনি আবার ভয়ও, সে-যে পয়-নম্বর গোছের একজন তাতে আর সন্দেহ কি? পাঁচ-সাত দিনের মধ্যে কাঁকুড়ঘাটি শ্মশানের সাধুর আবির্ভাব রাষ্ট্র হয়ে গেল। নিচু শ্রেণীর, নিম্নমধ্যবিত্ত আর মধ্যবিত্তদের আনাগোনা শুরু হয়ে গেল।…সাধুর আশ্চর্য ক্ষমতা, শ্মশানের মাটি খুঁড়ে শ্মশানকালীকে উদ্ধার করে প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই শ্মশানকালী সুন্দর মসৃণ একখণ্ড কালো পাথর। অদ্ভূত তেল-সি দুরে তাকে মায়ের আকারে এনে পুজো শুরু করেছেন। মা যে জাগ্রত তাতে আর সন্দেহ কি, সাধুকে মায়ের সঙ্গে কথা বলতে কাল্লু সর্দার শুনেছে, তার সাকরেদরা শুনেছে। বাবার শীত তাপ জ্ঞান নেই, ক্ষুধা-তৃষ্ণা বোধ নেই। মায়ের ওষুধে কাল্লু সর্দারের অমন বেমারি বউটাকে প্রায় সারিয়ে তুলেছে। এ-সব কথা বাতাসে তিনগুণ হয়ে ছড়ায়।

নিজেকে ছাড়িয়ে যাবার জন্য, বন্ধনমুক্ত হবার জন্য পাহাড়ের গুহা-গহ্বরে আশ্রয় খোঁজেননি অবধূত। পরিচিতের বেষ্টনী ছেড়ে তিনি অপরিচিতের বেষ্টনীতে এসেছেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে সংযোগ বেশি কাম্য। এদের মধ্যে থেকে নিজের অনুশীলন যতটা এগোয়। নিবৃত্তির পথ যতটুকু প্রশস্ত হয়। নিজের ভিতরটাকে যদি পদ্মপত্রের মতো করে তুলতে পারেন—এরা যত-খুশি তার ওপর দিয়ে জলের মতো গড়িয়ে যাক—কোনো রকম দাগ পড়তে না দেওয়াই তাঁর নিবৃত্তি সাধনা।

নিজেকে পরীক্ষার মধ্য নিয়ে যাওয়ার জন্যেই সেবার ধারা একটু বদলেছেন অবধূত। কেউ আবেদন নিবেদন বিস্তার করতে বসলে রেগে যাবার ভান করেন। যারা আসে, কাল্লু সর্দার বুঝিয়ে দেয়, বাবাকে কিছু বলার দরকার নেই। বাবা অন্তর্যামী। কৃপা হলে বাবা নিজেই ব্যবস্থা করে দেবেন। সেই কৃপা যদি চাও, বাবার কাছে এসে চুপচাপ বসে থাকো। বাবা শুধোলে বলবে। না শুধোলে আগ বাড়িয়ে কিছু বলতেও যেও না।

… বক্রেশ্বরে মানুষের সেবার ব্যাপারে ভৈরবী-মায়ের যা ছিল সব থেকে বড় পুঁজি—সেই মনঃসংযোগ আর দৃষ্টি সঞ্চালন বিদ্যের ওপরেই সব থেকে বেশি নির্ভর করতে চাইলেন অবধূত। মা বলতেন, মনের স্থির সংযোগ হলে নিজের অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কেটে যায়, দৃষ্টি সঞ্চালন আয়ত্তে এলে মানুষের ভিতরের অদেখা স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল পর্যন্ত ঘুরে আসা যায়। মুখ দেখে লক্ষণ জানা আর চেনাটাই এখন তন্ত্রসার অবধূতের কাছেও।

প্রতিদিন এই মহড়াই চলেছে। কোন্ রোগের কি লক্ষণ, দেহে বা মুখে তার প্রকোপ আর চাপ মোটামুটি তাঁর আয়ত্তের মধ্যেই। তবু চট করে কাউকে বিধান দিয়ে বসেন না, ধৈর্য পরীক্ষার অছিলায় সময় নেন। তাঁর তীব্র তীক্ষ্ণ সেই দৃষ্টি সকলে সহ্যও করতে পারে না, ভিতরের যন্ত্রণা বা ব্যাকুলতা তাতে আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তখন নিশ্চিন্ত জোরের সঙ্গেই মুশকিল আসানের পথ বাৎলে দেন।—এই রোগ পুষলি কি করে? আরো এতদিন ভোগান্তি আছে তোর—মায়ের কৃপায় সেরে যাবে—এই এই করগে যা।

অন্যত্র যা, এখানেও তাই। রোগ আর ব্যাধিগ্রস্ত লোকেরই ভিড় বেশি। ফলে অবধূতের সুবিধেও বেশি। দেখতে দেখতে ধন্বন্তরী হয়ে উঠলেন গাঁয়ের মানুষদের কাছে। কিন্তু এখানে সাধুর আচরণ দেশের মানুষদের কাছে যেমন, তেমন নয়। এখানে নিজের চার ধারে এক নির্লিপ্ত কঠিন সাধারণ রচনা করে সকলের কাছ থেকেই বিচ্ছিন্ন তিনি। ভক্তরা ফলমূল দুধ চিড়ে গুড় ছাতু দই সিকি আধুলি টাকা রেখে যায়। অবধূত ফিরেও তাকান না। আঙুলের ইশারায় সে-সব কাল্লু সর্দার তুলে নিয়ে যায়। তার দিন ফিরছে বটে। সেই সঙ্গে বাবার প্রতি ভক্তিশ্রদ্ধা তুঙ্গে। বাবার আহার নাম মাত্ৰ। তা-ও প্রায় একাহারী। রাতে মদ গাঁজা সামান্য ভাজাভুজি ছাড়া আর কিছু রোচে না। কোনো অমাবস্যার রাতে বাবার একটু মাংস খাবার সাধ হলে কাল্লু সর্দার আনন্দে নৃত্য করে। বাবার কল্যাণে সর্বদা তার ঘরে তো কত কি মজুত এখন, বাবাকে মনের সাধে খাওয়াতে পারলে সে বর্তে যায়। কিন্তু তার কি জো আছে। একবার মাথা নাড়লে দ্বিতীয়বার অনুরোধ করার হিম্মত নেই। এমন তাকাবেন যে আত্মারাম ত্রাসে থরো থরো। কেবল অরুচি নেই মদে। গাঁজায়। এ-দুটি রোজ রাতেই চলে। টাকার আমদানি বেশি হলে কাল্লু সর্দার দিশি জিনিস না এনে গঞ্জের বড় দোকান থেকে ভালো মদ কিনে নিয়ে আসে। বাবার খাওয়া হলে সে-ও প্রসাদ পায়। নেশা বেশি হয়ে গেলে আর ঘরে ফেরারও শক্তি থাকে না—বাবার পায়ের কাছে সটান শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

কিন্তু সকলেই তা বলে রোগের তাড়নায় সাধুর কাছে আসে না। অভাবের তাড়নায় বা ভাগ্য ফেরানোর তাগিদে যারা তার কাছে আসে অবধূত তাদের মুখ দেখলেই বুঝতে পারেন। কিন্তু এ-ছাড়াও মানুষের সমস্যার শেষ নেই, সংকটেরও শেষ নেই। মুখের লক্ষণ দেখে এই সমস্যা বা সংকট আঁচ করার পরীক্ষার মধ্যেও অবধূত নিজেকে ফেলেছেন। ফেলছেন। পর পর পরীক্ষায় তিনি আশ্চর্যভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন। এর মধ্যে একটাই নিজের ক্রেডিট ভাবেন। এক জোড়া মেয়ে-পুরুষ আসছে দশ-বারো মাইল দূর থেকে। স্বামী-স্ত্রী। অনন্তরাম আর লাজবন্তী। ছেলেটির বছর বত্রিশ-তেত্রিশ বয়েস, আর মেয়েটির সাতাশ আটাশ! বর্ধিষ্ণু চাষী পরিবার, নিজেদের টাট্ট-ঘোড়ার গাড়িতে আসে। নিজে যেচে সমস্যা বা সংকট জানানোর রীতি নেই। সাধুর কৃপা হলে তিনি দেখবেন, বুঝবেন, দরকার হলে প্রশ্ন করবেন। এই দম্পতী একে একে তিন দিন এলো। দু‘দিন একঘণ্টা ধরে চুপচাপ বসে থেকে চলে গেছে। … অবধূত তাদের দেখেছেন, বুঝতে চেষ্টা করেছেন। না, দু‘জনের কারো কোনো ব্যাধির হদিস পান নি, আর্থিক অনটনেরও না। দু‘দিনই পাঁচ টাকা করে প্রণামী রেখে গেছে। যেখানে পাঁচ-দশ পয়সা বা সিকি আধুলিই বেশি পড়ে সেখানে পাঁচ টাকা অনেক। মেয়েটির বেশ মিষ্টিমুখ, লক্ষ্মীশ্রী, অথচ ভিতরে কোনো অপূর্ণ বাসনায় কাতর বোঝা যায়।…কে? কি প্রত্যাশা?

তৃতীয় দিনে একটু সতর্ক হয়েই সাধু তাদের দিকে মনোনিবেশ করলেন। ঝকঝকে ছ’চোখ তুলে লাজবন্তীর দিকে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি প্রসারিত করলেন। তারপর গলার স্বর খুব নরম করে বললেন, মায়ি, তোমার ভিতরে মায়ের স্নেহ, এই স্নেহ দিয়ে অন্যের ছেলে-মেয়েদের কাছে টেনে নেওয়া যায় না, নিজের ছেলে-মেয়ে ভাবা যায় না?

অনুমানে ভুল হয় নি। লাজবন্তী সাধুর পায়ে লুটিয়ে পড়ল। বাবার আশীর্বাদে তার নিজের কি কোনো সন্তান হতে পারে না?

অবধূত স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। এর পরে আর সমস্যা কিছু নেই।— বাঁ-হাতখানা দেখাও তো?

দেখলেন। মাথা নাড়লেন। তুমি অপরের ছেলে-মেয়ের মা হবে। তাইতেই তোমার মাতৃস্নেহ সার্থক হবে। গরিব ছেলে-মেয়েদের কাছে টেনে নাও—আনন্দ পাবে।

লাজবন্তীর এগারো বছরের বিবাহিত জীবনে সন্তান আসে নি। সাধুর কথায় অখণ্ড বিশ্বাস, আর আসবেও না। তাঁর বিধান শিরোধার্য করে সেই আনন্দের পথেই পা ফেলেছে। অতি দুস্থ, অনাথ তিনটি বাচ্চা ছেলেমেয়েকে নিজের কাছে এনে সন্তান স্নেহে প্রতিপালন করছে। তাদের জন্য আবার বাবার আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে এসেছে। সাধুর ছেলেমানুষের মতো আনন্দ দেখে সকলে অবাক। ওই শিশুদের আশীর্বাদ করার জন্য বাবা নিজের আসন ছেড়ে উঠেছেন। বলেছেন, তুই সত্যিকারের মা হয়েছিস বে বেটি, তোর ঘরে গেলেও পুণ্য, চল্, তোর ঘরে গিয়ে তোর ছেলেদের আশীর্বাদ করব।

সকলকে হতবাক করে সত্যি সাধু তাদের টাট্টু ঘোড়ারগাড়িতে চেপে লাজবন্তীর ডেরায় এসেছেন। বাচ্চাগুলোকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে মঙ্গল কামনা করেছেন। সাধুৰ এই কৃপা পেয়ে লাজবন্তী আর অনন্তরাম জন্ম সার্থক ভেবেছে। সকলে তাদেরও ধন্য ধন্য করেছে। বছর ঘুরতে সাধুর নাম অনেক দূরে দূরেও ছড়িয়ে পড়েছে।

মোটামুটি অবস্থাপন্ন যারা, দুবারোগ্য ব্যাধির প্রকোপে না পড়লে তারা সাধারণত ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়। চট করে দৈবের পিছনে বা সাধুর পিছনে ছোটে না। এরা এলে বুঝে নিতে হয় এদের প্রত্যাশা অন্য কিছু। রোগাক্রান্ত হলে তো মুখ দেখেই অবধূত অনেকটা বুঝতে পারেন। দু‘বছরের মাথায় এ-পর্যায়ের একজনের যাতায়াত শুরু হতেই কালু সর্দার বাবাকে সাবধান করেছে। লোকটির নাম শান্তাপ্রসাদ। বছর পঁয়তাল্লিশ বয়েস। এক-কালে বড় অবস্থার মানুষ ছিল। ব্যবসায় নেমে তার অনেকটাই খুইয়েছে। জমিজমার অনেক বন্ধকে চলে গেছে। অনেক টাকা ঋণ। কিন্তু এখনো ঠাট বজায় রেখেই চলে ভদ্রলোক। শান্তাপ্রসাদ রাতের দিকে নির্জনে আসে সাধুর কাছে। পায়ের কাছে একটা করে বিলিতি মদের বোতল রাখে। এই জিনিসটি পেলে সাধু সব থেকে খুশি হন সে বুঝে নিয়েছে। নিজের কোনো আর্জি পেশ করে না। এসে প্রণাম করে চুপচাপ বসে থাকে আবার এক সময় প্রণাম করে চলে যায়।

কাল্লু সর্দার তার আনা মদের ভাগ অর্থাৎ প্রসাদ অপছন্দ করে না। কিন্তু মানুষটার ওপর সন্দিগ্ধ। বাবার ভালো-মন্দের থেকে তো আর মদ বেশি নয়। তাই বাবাকে সতর্ক করেছে, শাহাপ্রসাদ যদি তার শত্রুকে ঘায়েল করার মতলব নিয়ে এসে থাকে তাহলে বাবার তাকে পাত্তা না দেওয়াই ভালো। কারণ সেই শত্রু বড় ভীষণ শত্রু। এই শত্রুর নাম রতনলাল।

সমস্ত কাকুড়ঘাটিতে তার মতো বড় অবস্থার মানুষ আর একজনও নেই। রতনলাল দৌলতরামের ছেলে। আসলে বাপের নাম ছিল রামলাল। তার এত দৌলত আছে বলেই লোকের মুখে মুখে সে দৌলতরাম হয়ে গেছল! রতনলালের বাবা দৌলতরাম আর শান্তাপ্রসাদের বাবা সরপ্রসাদ খুব বন্ধু ছিল। সরপ্রসাদ ছিল বেপরোয়া দিলদরিয়া গোছের মানুষ। তার অনেক রকমের আধুনিক ব্যবসার প্ল্যান মাথায় গজাতো। বড়লোক হতে গিয়ে বন্ধু দৌলতরামের কাছে অনেক টাকা ঋণ করেছিল। শেষে অর্ধেকের বেশি জমিজমা বন্ধক দিয়ে আবার নতুন ব্যবসায় নেমেছে। তাতেও মার খেয়ে হঠাৎ হার্টফেল করে মরেছে। ফলে শান্তাপ্রসাদের ঋণ এখন গলা পর্যন্ত। সুদে আসলে এই ঋণ বাড়ছেই। কিন্তু বেঁচে থাকতে দৌলতরাম বন্ধুর ছেলেকে সেজন্য কোনোদিন বিপাকে ফেলেনি। বরং নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে বাপের ঋণ শোধ করার পরামর্শ দিয়েছে।

শান্তাপ্রসাদ বিপাকে পড়েছে দু‘বছর আগে দৌলতরাম মারা যেতে। কর্তৃত্ব এখন তার একমাত্র ছেলে রতনলালের হাতে। এই ছেলেকে দৌলতরাম কোনোদিন বিশ্বাস করত না। ছেলেবেলা থেকেই সে মন্দ রাস্তায় হাঁটা শুরু করেছে। বাপ অনেক চেষ্টা করেও তাকে বশে আনতে পারেনি। চরিত্র শোধরানোর জন্য দৌলতরাম অল্প বয়সে ছেলের বিয়ে দিয়েছিল। একটা মেয়ের জন্ম দিয়ে সেই বউটা অকালে মরেছে। ছেলের চরিত্র শোধরাবে না! ধরে নিয়েই দৌলতরাম আর বিয়ের তাগিদ দেয়নি। ছেলেও বিয়ে না করে ফুর্তির রাস্তাই বেছে নিয়েছে। বিরাট ধনীর একমাত্র চরিত্রহীন বদমেজাজ। ছেলে হলে যা হয় রতনলাল তাই। দৌলতরানের একমাত্র সম্বল তার নাতন। পার্বতী—বুড়োর চোখের মণি।

দোর্দণ্ডপ্রতাপ রতনলাল কিছুটা টিট তার এই বাপের কাছে। ছেলের তুলনায় বাপের বুদ্ধি অনেক বেশি ক্ষুরধার। নত হলে এই ছেলে তাকেই ছোবল মারবে জানে। তার ওপর সর্বদাই ছড়ি উঁচিয়ে চলত। কাজের সুবাদে আট দশটি যোয়ান লোক তাকে ঘিরে থাকত। এক কথায় পাহারা দিত। কোতোয়ালির সঙ্গেও দৌলতরামের বন্ধু সম্পর্ক। যত বেপরোয়াই হোক, এই বাপের সঙ্গে রতনলাল এঁটে উঠতে পারত না। খুব তাছাড়া আসল জিনিস অর্থাৎ দৌলতরামের সমস্ত দৌলতের চাবির নাগাল না পাওয়া পর্যন্ত কোমর বেঁধে লাগার সুযোগ বা সাহসও নেই। বাপ মুখে তো সর্বদাই হুমকি দিচ্ছে ত্যাজ্যপুত্র করবে, কাজেও কখন তা করে বসে ঠিক নেই। তাই বুদ্ধিমানের মতো রগচটা বাপকে না ঘাঁটাতেই চেষ্টা করে। তাঁর হুকুম-মতো ব্যবসা, আর কারবার দেখে। সপ্তাহের মধ্যে চার পাঁচদিন তাকে দ্বারভাঙায় গিয়ে থাকতে হয়। সেখানে দৌলরামের সারের ব্যবসা, আর মস্ত স্টেশনারি দোকান। অনেক বিশ্বস্ত লোকজন কাজে বহাল আছে—কিন্তু ছেলেকে সেখানেও দৌলতরাম তাদের মনিবের জায়গায় বসায়নি। মনির দৌলতরাম নিজে, ছেলে সব থেকে বেশি মাইনের কর্মচারী মাত্র। কিন্তু অন্য বিশ্বস্ত কর্মচারীরাও কি তা বলে নিজেদের ভবিষ্যৎ বোঝে না? ভবিষ্যতে এই ছেলেই যে সব-কিছুর সর্বেসর্বা হবে কে না জানে। তাই তলায় তলায় এরা প্রায় সকলেই রতনলালের অনুগত।

দৌলতরাম কাঁকুড়ঘাটির মস্ত গোডাউন আর তেজারতি অর্থাৎ সুদের কারবারটি সম্পূর্ণ নিজের হাতে রেখেছিল। সারের ব্যবসা আর স্টেশনারি দোকান ছাড়াও এই সুদের কারবার থেকেই তার ঘরে লক্ষ্মী অচলা। …দৌলতরাম মারা যাবার পর থেকেই শান্তাপ্রসাদের মাথার ওপর খাঁড়া ঝুলছে। শান্তাপ্রসাদকে রতনলাল কোনোদিনই দু‘চক্ষে দেখতে পারত না। লেখাপড়া জানা মানুষ হিসেবে বাপ তাকে স্নেহ করত বলে তার ওপর আরো রাগ। ধারদেনা শোধ করার জন্য সে এখন প্যাঁচ কষছে—হুমকির পর হুমকি দিচ্ছে। রতনলালের সমস্ত কর্মের দোসর বেনারসীলাল। এই বেনারসীলাল রতনলালের সব থেকে বড় হাতিয়ার।

বেনারসীলালকে ভয় করে না গাঁয়ে হেন লোক নেই। সকলের ধারণা, বেনারসীলাল করতে পারে না এমন কুকাও নেই। বয়সে বেনারসীলাল রতনলালের থেকে কম করে দশ বারো বছরের ছোট। কিন্তু আসল বয়েস সত্ত্বেও দু‘জনে হরিহর আত্মা। তার প্রধান কারণ মাত্র আঠেরো বছর বয়সে দামাল ছেলে বেনারসীলাল অব্যর্থ মৃত্যু থেকে রতনলালকে বাঁচিয়ে ছিল।… বর্ষায় এক-একবার কমলা গঙ্গা ভীষণ রূপ ধরে। সেই ভয়ংকর সময়ে একটা বড় নৌকাডুবি হয়েছিল। রতনলাল সাঁতার পর্যন্ত জানে, জানা সত্ত্বেও সেই অঘটনে অনেক লোক মরেছে। অবধারিত মৃত্যুযোগ ছিল রতনলালেরও। কিন্তু একজন সাগরেদের সাহায্যে বেনারসীলালই তাকে বাঁচিয়েছিল। বাঁচাতে গিয়ে বেনারসীলাল মরতেই বসেছিল।… এই ঋণ রতনলালের বাবা দৌলতরামও অস্বীকার করতে পারেনি। নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের ওই ছেলেকে নিজের বাড়িতে ঠাঁই দিয়েছিল। তার লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়েছিল। তেমন সুমতি থাকলে এই ছেলে কালে দিনে দৌলতরানের ডান হাত হয়ে বসতে পারত। তার বদলে বেনারসীলাল তার মহাশ্রদ্ধার দাদার অর্থাৎ রতনলালের ডান হাত হয়ে বসতে পারাটাই অনেক বেশি কাম্য ভেবেছিল।… পড়াশুনোয় মোটামুটি ভালে৷ ছিল, কিন্তু নিজের চরিত্রগুণে আর সঙ্গদোষে বেশি এগোতে পারে নি। দু‘বছর না তিন বছর দৌলতরাম তাকে ডাক্তারি পড়িয়েছিল। সমস্ত খরচের দায় তার। কিন্তু ততদিনে সে স্ব-মূর্তি ধরেছে। ডাক্তারি পড়া ছেড়ে রতনলালের যোগ্য সাগরেদ হয়ে বসেছে। রতনলাল আর বেনারসীলাল—এই দুই লালের দাপটে গাঁয়ের মানুষ দারুণ তটস্থ। শুধু গাঁয়ের মানুষ কেন, দ্বারভাঙার সারের ব্যবসা আর স্টেশনারি দোকানের কাজের লোকেরাও।

সেখান থেকে বাপের চোখে ধুলো দিয়ে ফিমাসে রতনলাল যদি নিজের বরাদ্দ ছাড়াও মোটা টাকা টেনে নেয়, কার হিম্মত আছে সেটা খোদ মালিককে জানিয়ে দেবে? উল্টে দুই লালের হুকুম মতো তাদের দু‘নম্বরি হিসেবের খাতা তৈরি রাখতে হয়। সকলে জানে, রতনলালের অর্থ-বল আর বেনারসীলালের গুণ্ডা-বল—এই দুই বলের রাজ-যোগে তারা একেবারে অজেয়।

কাল্লু সর্দার অবশ্য এত কথা তার বাবা মহারাজকে গুছিয়ে বলতে পারেনি। কিন্তু অবধূত যতটুকু বোঝার বুঝে নিয়েছেন। চেলার মতে রতনলাল মানুষটা ক্ষেপে না গেলে অত ভয়ংকর নয়, কিন্তু বেনারসীলাল যাকে বলে কালকেউটে। তাই শান্তাপ্রসাদ যদি ওই শত্রুদের ঘায়েল করার মতলবে বাবার কাছে ভিড়ে থাকে, বাবার তাহলে তাকে বর্জন করাই ভালো— কারণ, ওই দুই লাল রুষ্ট হলে আগুন জ্বলতে সময় লাগে না। তাদের অসাধ্য কর্ম নেই।

…ডাক্তার না হয়েও বেনারসীলাল গায়ের গরীব মানুষদের কাছে ডাক্তার হয়ে বসেছে। মেজাজের মাথায় চিকিৎসা করে, ওষুধ দেয়, শুঁই চালিয়ে নিজের হাত পাকায়। বড় বড় ফোঁড়াও ফালা ফালা করে কেটে দেয়। তার হাতে পড়ে অনেক গরীব লোক মারা পড়েছে। অনেকে ক্ষত-ঘা বিষিয়ে মরেছে। কিন্তু কার সাহস আছে মুখে রা কাটে। তাছাড়া কেন কি হয় গরিব মানুষেরা বোঝেই বা কতটুকু? রোগ সারলে তারা বরং দু‘হাত তুলে বেনারসীলালের সুখ্যাতি করে। কিন্তু কাল্লু সর্দারের মতো অনেকেই আবার জানে, নিজের বউকেই এই ফুটিয়ে মেরেছে বেনারসীলাল। ওষুধের বদলে ইচ্ছে করে বিষ দিয়েছে। এই শ্মশানেই এই বউয়ের দাহ হয়েছে। কাল্লু সর্দার কাঠ যুগিয়ে রতনলালের কাছ থেকে মোটা বকশিশ পেয়েছে। বেনারসীলালের বিপদে আর শোকে রতনলাল তো পাশে থাকবেই। ছিলও।

..কিন্তু কাল্লু সর্দার হলপ করে বলতে পারে বিষে নীল বর্ণ হয়ে গেছল বউটার সব্ব-অঙ্গ। মরার সময়েও চোখ চেয়ে মরেছে। রার পরেও নাকি নেই চোখে ভয় ঠিকরে বেরুচ্ছিল।

কিন্তু শান্তাপ্রসাদকে কেন যেন অবধূতের আদৌ খারাপ লাগত না। লোকটা ভিতরে ভিতরে বিষণ্ন, দুশ্চিন্তায় কাতর। হতাশায় ডুবতে থাকলে মানুষ যেমন কাউকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়, এই লোকও আর কোনো পথ না পেয়ে তাকে আঁকড়ে ধরে আছে মনে হয়। তাছাড়া অবধূত অনেক কিছু ছাড়তে পেরেছেন—কিন্তু মদের নেশা তাঁর বেড়েই চলেছে। শান্তাপ্রসাদ বোতল নিয়ে এলে সেদিন খুব আনন্দে মুখ বদলানো হয়।

নেশায় চুর হয়ে থাকেন।

এমনি মৌজের মাথায় একরাতে শাহাপ্রসাদকে সাফ বলে দিলেন, যতই সরাব খাওয়াও আমার দ্বারা কারো দুশমনি করা সম্ভব হবে না—তোমার মতলবও হাঁসিল হবে না— এই মতলব নিয়ে এসে থাকলে কেটে পড়ো। হাত জোড় কবে শান্তাপ্রসাদ বলল, আমি কারো দুশমনি করতে চাই না বাবা, তুমি কেবল একটি ছেলেকে আর একটি মেয়েকে রক্ষা করো।… আমি তোমাকে কয়েক দিন লক্ষ্য করার পর রাতে স্বপ্ন দেখেছি, তুমিই তাদের রক্ষা করেছ, তাদের মিলিয়ে দিয়েছ-তার পর থেকেই তুমি ওদের কৃপা করতে আমি সেই আশায় আছি।

সেই তূরীয় অবস্থায় অরসূত মন দিয়েই তার আর্জি শুনেছেন। কারণ, এরকম আবেদন অপ্রত্যাশিত।

ছেলেটি শান্তাপ্রসাদের ভাইপো রুদ্রপ্রসাদ। নিজের দুটো মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে—তার ছেলে বলতে এই ভাইপো। রুদ্রপ্রসাদ এম. এ. পাশ, দ্বারভাঙার এক সরকারি অফিসে ভালো চাকরি পেয়েছে। কালে দিনে অনেক উন্নতি হবে।…মেয়েটি হলো রতনলালের মেয়ে পার্বতী। তার বয়েস এখন কুড়ি পেরিয়েছে। এবারেই বি এ পাশ করেছে। ওই মেয়ের ষোলো বছর বয়সে দাদু দৌলতরাম তার বিয়ে দিতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পার্বতী বেঁকে বসেছিল বিয়ে করবে না। দৌলতরাম তাঁর সমস্ত বিষয়সম্পত্তি ব্যবসার চৌদ্দ আনা এই নাতনীর নামে উইল করে রেখেছিল। ছেলের মতিগতি জানত বলেই তাকে ব্যবসা আর বিষয়সম্পত্তির দু’ মানার বেশি দেয়নি। উইলে স্পষ্ট নির্দেশ, পার্বতীর বিয়ের পর মেয়েজামাইকে ব্যবসা আর বিষয়সম্পত্তির চৌদ্দ আনা ভাগ বুঝিয়ে দিতে হবে। ষোলো বছর বয়সে পার্বতী বিয়ে করতে রাজি হয়নি বলেই দৌলতরামের এই কড়া নির্দেশ। উইল রেজিস্ট্রি হয়ে আছে। শান্তাপ্রসাদ সেই উইলের একজন সাক্ষী। অতএব রতনলাল চেষ্টা করেও সেই উইল নাকচ করতে বা কোনোরকম কারচুপি করতে পারছে না। তার মেয়ের বিয়ে দেবারও কিছুমাত্র আগ্রহ নেই কারণ বিয়ে দিলেই ব্যবসা আর বিষয়সম্পত্তির চৌদ্দ আনা হাত ছাড়া।

কিন্তু ষোলো বছরের মেয়ে পার্বতী কেন অবাধ্য হয়ে বিয়েতে আপত্তি করেছিল দৌলতরাম তলিয়ে ভাবেনি। আর রতনলালের তো তা নিয়ে মাথা ঘামানোর ফুরসত নেই।… ভাইপো রুদ্রপ্রসাদের সঙ্গে পার্বতীর ছেলেবেলা থেকেই ভাবসাব। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সেটা প্রগাঢ় প্রণয়ের দিকে গড়িয়েছে। কিন্তু বাপের চরিত্র জানতো বলেই পার্বতী সেটা কখনো প্রকাশ করেনি। তার আশা ছিল, বছর কয়েক সময় পেলে সে বি. এ. পাশ করবে আর তার মধ্যে রুদ্রপ্রসাদও পাশ-টাশ করে দাড়িয়ে যাবে। তখন আর এ বিয়েতে বাধা থাকবে না, ব্যাপার বুঝলে দাদুর রাগও পড়ে যাবে। দাদু সহায় থাকলে বাবা বড় রকমের বাধা কিছু দিতে পারবে না।

..কিন্তু সকলেরই ভাগ্য মন্দ। দাদু দৌলতরাম চোখ বুজে বসল। এখন বিয়েতে বাধা নেই। কিন্তু সব থেকে বড় বাধা রতনলাল আর তার সহচর বেনারসীলাল। এদের প্রণয়ের ব্যাপারটা তারা জানতে পারলেই বিপদের সম্ভাবনা। এমন কি ভাইপো রুদ্রপ্রসাদের প্রাণসংশয় হতে পারে। শান্তাপ্রসাদের বেশি দুর্ভাবনা বেনারসীলালকে নিয়ে। এই শয়তান রতনলালের অন্ধ বিশ্বাসের মানুষ। কিন্তু পার্বতী তার মতলবের আভাস পেয়েছে অনেক আগে! বয়সে সে পার্বতীর থেকে তেরো-চৌদ্দ বছরের বড়। বাবার অন্তরঙ্গ সহচর হিসেবে আগে তার আচরণ ছিল এক-রকম। অনেকটা কাকার মতো। এখন তার হাব-ভাব বদলাচ্ছে। নানাভাবে সে পার্বতীর মন পাবার চেষ্টা করছে। কারণ, দাদুর উইলের ব্যাপারটা খুব বেশি রাষ্ট্র হয়নি, রতনলাল যথাসাধ্য সেটা গোপন রাখতে চেষ্টা করছে—কিন্তু তা বলে বেনারসীলালের তো আর জানতে বাকি নেই। সাক্ষীদের বাদ দিলে সে সবার আগে জানে। তার মতলব বুঝেও পার্বতীকে চুপচাপ সহ্য করে যেতে হচ্ছে। হৃাতার ভাবও বজায় রাখতে হচ্ছে। কারণ, এতটুকু বিদ্রোহের আভাস পেলে সেই শয়তান কোনদিক থেকে বজ্রাঘাত হানবে ঠিক নেই।

পার্বতী আর রুদ্রপ্রসাদ এত বড় বাধা সত্ত্বেও এখন বিয়ে করতে চায়। যে-কোনোভাবে একবার বিয়েটা হয়ে গেলে পরের ব্যবস্থা পরে। বিয়ের পরে তারা রতনলালের সঙ্গে ব্যবসা আর বিষয়সম্পত্তি নিয়ে আপোস মীমাংসায় আসতে চাইলেও সে বাধ্য হয়ে রাজি হবে। শান্তাপ্রসাদের আবেদন সাধুজীকে এই বিয়েটা ঘটিয়ে দিতে হবে। এখানে এই শ্মশানকালীর সামনে তন্ত্রমতে সাধুজীকে নিচু শ্রেণীর মধ্যে তিন-চারটে বিয়ে দিতে দেখেছে। নিচু শ্রেণীর বিয়ে হতে পারলে উঁচুশ্রেণীরই বা হতে পারবে না কেন? আর সাধুজী ছাড়া গতি নেই কারণ, কাঁকুড়ঘাটিতে এমন কারো বুকের পাটা নেই যে রতনলাল আর বেনারসীলালকে উপেক্ষা করে এমন বিয়ে দিতে রাজি হবে। তাই সাধুজীই ভরসা।

…শান্তাপ্রসাদের প্ল্যান ছকাই আছে। সপ্তাহের মধ্যে চার দিন রতনলাল বেনারসীলালকে নিয়ে দ্বারভাঙায় থাকে। পার্বতী ছেলেবেলা থেকে জানকীবাঈয়ের কাছে মানুষ। সে তার দাসীও বটে আবার মায়ের মতোও বটে। সে-ও চায়, যে-কোনোভাবে রুদ্রপ্রসাদের সঙ্গে পার্বতীর বিয়েটা হয়ে যাক। সাধুজী রাজি হলে রতনলাল আর বেনারসীলালের অনুপস্থিতিতে সংগোপনে এই বিয়ে হয়ে যেতে পারে। যতদিন দরকার এই বিয়ে গোপন রাখার দায়িত্ব শান্তাপ্রসাদ রুদ্রপ্রসাদ আর পার্বতীর। বাবা দয়া করে বিয়েটা দিয়ে দিন।

..কাঁকুড়ঘাটির মহাশ্মশানে বসে মদের নেশায় তিনিও তক্ষুণি রাজি হয়ে গেছলেন! কেবলমাত্র মদের নেশায় বললে ঠিক হবে না। এমন দুটি ছেলেমেয়ের মিলন কাম্য মনে হয়েছিল তাঁর। নিজের আপদ বিপদ ভয় ডরের বালাই কোনোদিনই বিশেষ ছিল না।

দশ দিনের মধ্যে মহাশ্মশান কালীর সামনে সেই বিয়ে তিনি দিয়েছেন। বিয়ের সাক্ষী সপরিবারে কাল্লু সর্দার আর তার জনাকতক অনুচর। শান্তাপ্রসাদ আর তার স্ত্রী। আর রুদ্রপ্রসাদের খুব বিশ্বস্ত একজন ফটোগ্রাফার বন্ধু। সাধু আগেই বলে দিয়েছিলেন, মালাবদল আর শুভদৃষ্টির সময় যেন বর-কনের ফোটো তুলে রাখা হয়—ভবিষ্যতে দরকার হতে পারে।

…বিয়ের কনে পার্বতী কৌপীন-পরা জটাজুটধারী সাধুর দিকে ভালো করে তাকাতেও পারেনি।

আর সাধুও আকণ্ঠ মদ গিলে শুভ কাজ সম্পন্ন করেছেন।

বিয়ের তিন মাসের মধ্যে সাধুর মাথাতেই যেন বজ্রাঘাত।…তাঁর বিশ্বাস, মুখ দেখে তিনি আয়ুর লক্ষণও বুঝতে পারেন। অন্তত সমূহ ফাঁড়া-টাড়া থাকলে তাঁর মনে ছায়া পড়ে। কিন্তু বিয়ে দেবার সময় মদের নেশায় এই ছেলে অর্থাৎ রুদ্রপ্রসাদের দিকে কোনো বিচারের চোখ নিয়ে তাকাননি। বিয়ে দেবার উদ্দীপনাই তাঁর বড় হয়ে উঠেছিল। আর হয়তো বা কেউ কোনোরকম গণ-অঘটনের বলি হলে তার আভাস তিনি পান না। সেইরকম অঘটনই ঘটেছে তিন মাসের মধ্যে। রুদ্রপ্রসাদের কর্মস্থল দ্বারভাঙায়। সে বাসে যাতায়াত করত। সেই যাতায়াতের পথে প্রহরাশূন্য লেভেল-ক্রসিং পড়ে একটা! এ-রকম লেভেল-ক্রসিং-এর সংখ্যা ভারতে কম নয়। অঘটন না ঘটা পর্যন্ত কারো টনক নড়ে না। ফেরার সময় আবছা অন্ধকারে বাস-ভর্তি যাত্রী অঘটনের বলি হয়েছে। ছুট্‌ন্ত ট্রেনএঞ্জিনের সঙ্গে সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই তিরিশ-পঁয়ত্রিশটি প্রাণ গেছে। তাদের মধ্যে রুদ্রপ্রসাদ একজন।

—শাস্তা প্রসাদ সাধুর কাছে এসে মাথায় হাত দিয়ে বসেছে। না, তখনো পর্যন্ত পার্বতীর বিয়ের খবর রতনলাল বা বেনারসীলাল জানে না। মেয়ের উন্মাদ দশা দেখে তারা প্রণয়ের ব্যাপারটাই শুধু বুঝেছে। তাদের চোখে ধুলো দিয়ে এমন একটা ব্যাপার চলছিল, ফলে এতবড় একটা অঘটনের দরুন তারা অখুশি হয়নি। কিন্তু তাদেরও টনক নড়েছে আরো দু‘তিন মাস যেতে। পার্বতী অন্তঃসত্ত্বা। আর তখনো পাগলের মতোই অবস্থা তার।

রতনলাল আর বেনারসীলালের নিষ্ঠুর জেরার মুখে পড়ে জানকীবাঈ সত্যি কথা প্রকাশ করেছে। তিন মাস আগে শ্মশানের সাধুজী নিজে পার্বতীর সঙ্গে রুদ্রপ্রসাদের বিয়ে দিয়েছেন— সে-কথা বলেছে। আর, মালিকের অনুপস্থিতিতে রুদ্রপ্রসাদ ফি সপ্তাহে এখানে এসে দুই এক রাত থাকত তা-ও কবুল করেছে।

রতনলাল আর বেনারসীলাল দুজনেরই মাথায় খুন চেপেছিল। তবু রতনলালের মাথা আগে ঠাণ্ডা হয়েছে। দুজনেই শান্তাপ্রসাদের বাড়ি এসে শাসিয়ে গেছে, এ বিয়ে কোনো বিয়েই নয়—যদি প্রাণের মায়া থাকে তো সে যেন এ-নিয়ে টু-শব্দও না করে। ধনে-প্রাণে বধ হবার ইচ্ছে যদি না থাকে, তাকে মুখ সেলাই করে থাকতে হবে। পার্বতীর সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পরে তখন কর্তব্য বিবেচনা করা যাবে। আর বেনারসীলাল হুমকি দিয়েছে, ওই সাধুকে কাঁকুড়ঘাটির মহাশ্মশানেই দেহ রাখার ব্যবস্থা সে করবে—তবে তার নাম বেনারসীলাল।

…না তখনো অবধূত নিজের এই জীবনটার জন্য খুব উতলা বোধ করেননি। পার্বতীর দুরবস্থার কথা ভেবেই তাঁর ভিতরটা দুমড়ে ভেঙেছে।

দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন শান্তাপ্রসাদ মাঝে মাঝে আসে। সাধু তাকে আশ্বাস দেয় সব ঠিক হয়ে যাবে কিছু ভেবো না। কেন আশ্বাস দেন, কি করে দেন নিজেও জানেন না। মনে হয়, তাই বলেন। শান্তাপ্রসাদের খবর, প্রতিবেশীদের কাউকে কিছু জানতে বুঝতে না দিয়ে অর্ধ-উন্মাদ মেয়েকে রতনলাল আর এক খামারবাড়িতে নিয়ে রেখেছে। জানকীবাঈয়ের জবাব হয়নি কারণ সে পালিয়ে গেলে মুখ খুলবে। তার থেকে বহাল রেখে সর্বদা তাকে ত্রাসের মধ্যে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। মুখ খুললেই মৃত্যু অনিবার্য এটাই তাকে বোঝানো হয়েছে।

… রতনলাল আর বেনারসীলালের মতলব পরে বোঝা গেছে। তারা পার্বতীর সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার অপেক্ষায় ছিল। রতনলাল আশা করছিল, পার্বতীর যা দশা তাতে পেটের সন্তান বাঁচবে না। আর বাঁচলেও এই সন্তানকে বেশিক্ষণ সে পৃথিবীর আলোর মুখ দেখতে দেবে না। কারণ, এই সন্তানই রতনলালের এখন সব থেকে বড় দুশমন। তাকে বাঁচতে দিলে বা বাড়তে দিলে এত ধন দৌলত সব-কিছুর চৌদ্দ আনার অধিকার এই সন্তানের আর তার মায়ের। ভবিষ্যতের এই কাঁটা রতনলাল জিইয়ে রাখবে এমন নির্বোধ সে নয়। বিশেষ করে যাকে সে শত্রু ভাবে এই সন্তান সেই শান্তাপ্রসাদের ভাইপোর ছেলে। তাকে বিয়ে করাটাই নিজের মেয়ের চরম বিশ্বাসঘাতকতা ভাবে সে।

…কিন্তু এই দুনিয়ায় ঘটনার সাজ বড় অদ্ভূত। কে ঘটায় কে সাজায় অবধূত জানেন না। সেইসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই কারো বুদ্ধির চমক দেখা দেয়, কাৰো বা মতিভ্রম হয়, বুদ্ধিনাশ হয়। এমন কি চরম মুহূর্তে বিচিত্র খেয়াল চাপে মাথায়। এইসব কিছুর সমাবেশ সেই এক ভীষণ দুর্যোগের রাতে।

—রাত বারোটার পরে, পার্বতীর সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে। মৃত নয়, জীবিত। খামার বাড়িতে উপস্থিত ছিল জানকীবাঈ। কিন্তু সে তখন অঘোর ঘুমে। তার ঘুমের ব্যবস্থা সময় বুঝে বেনারসীলাল করে রেখেছিল। সন্তান ভূমিষ্ঠ করানোর দায়িত্ব পুনিয়ার মা নামে এক দাইয়ের। তার পাকা হাত পাকা মাথা, কিন্তু তেমনি লোভী আর বেপরোয়া মেয়েছেলে। টাকা পেলে কোনো কাজই অসাধ্য ভাবে না।

জীবিত সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে দুটো আঙুলের চাপে তার শ্বাসরুদ্ধ করতে কতক্ষণ? আবো সুবিধে সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পরে পার্বতী এমনিতেই বেহুঁশ। তবু বেনারসীলালের নির্দেশে তাকে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই শিশুর গলায় হাত দিতে গিয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে আর ঘুমন্ত মায়ের মুখের দিকে চেয়ে কেন যেন পুনিয়ার মায়ের হাত বার বার কেঁপে উঠতে লাগল। মৃত সন্তান প্রসব হলে তাকে কমলা গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেওয়ার রীতি। দোরগোড়ায় গাড়িও প্রস্তুত।

•কিন্তু পুনিয়াব মায়ের হাত বার বারই কাঁপছে। শ্মশানের সেই মহাযোগী ভীষণ সাধুর কথা পুনিয়ার মা-ও জানকীবাঈয়ের মুখে শুনেছে। নিজেও তাঁকে দেখেছে। শ্মশানকালীর সামনে সেই সাধুই নাকি মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। জানকীবাঈয়ের আশা, স্বামী মরলেও সাধুর কৃপায় এই সন্তান নিয়ে পার্বতী আবার ভালো দিনের মুখ দেখবে। পুনিয়ার মায়ের বার বার মনে হতে লাগল, পাপ হাতে এই শিশুর অঙ্গ স্পর্শ করলে শ্মশানের সাধুর কোপে তার সর্বনাশ অবধারিত।

আর ঠিক সেই সময়েই এক বিচিত্র খেয়াল ভর করল বেনারসীলালের মাথায়।…কমলাগঙ্গায় যখন এই শিশুকে ভাসিয়ে দিতে যেতেই হবে, তাকে আর মারার দরকার কি? একে হাড়ে হাড়ে ঠোকাঠুকি লাগার মতো শীত, তার ওপর বৃষ্টি। কমলাগঙ্গায় যাবার পথেই ওই শিশু আপনি মরবে। তার পরেই আবার এক খেয়ালের চমক মাথায়। কমলাগঙ্গাতেই যদি যাবে তাহলে শ্মশানে নয় কেন? একই সঙ্গে সেখানকার সেই সাধুর মাথাতেই বা চরম দিন ঘনাবে না কেন? এমন মঙ্কা আর কি জীবনে আসবে?

বেনারসীলাল পুনিয়ার মা-কে হুকুম করল, মারার দরকার নেই। যেমন আছে তুলে নিয়ে শ্মশানঘাটে আসতে হবে। নিজে প্রস্তুত হয়ে চারজন সাগরেদকে সঙ্গে নিয়ে রতনলালের পুরনো মোটরগাড়িতে উঠল। মোটরগাড়ি এ তল্লাটে একমাত্র রতনলালেরই আছে। এই সময় সেটা সমস্তক্ষণই বেনারসীলালের হেপাজতে।

এই দুর্যোগের রাতে অবধূতের চোখে ঘুম নেই কেন জানেন না। তিনি তাঁর ছাপরা ঘরে বসেই আছেন। প্রথম শীতেই কাল্লু তার জন্য ঘর তুলে দিয়েছিল। তারপর থেকে প্রতি বছরই বর্ষা আর শীত আসার আগে এই ঘর সংস্কার করে দেয়—বাবার যাতে কষ্ট না হয়। দুর্যোগের রাত বলেই অবধূতের নেশার মাত্রা বেশি চড়েছিল। কিন্তু এই গভীর রাতেও তাঁর চোখে ঘুম নেই।

…না, নেশার দরুন হোক বা যে-কারণে হোক, কোনো গাড়ি-টাড়ির শব্দ তাঁর কানে আসেনি। হয়তো বা ঝিমুনি এসেছিল। হঠাৎ বিস্ফারিত চোখে দেখেন ছোরা আর লাঠি হাতে চার-পাচজন গুণ্ডাগোছের লোক তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। অন্য রকমের একটা ছুরি হাতে যে-লোকটা দাঁড়িয়ে সে-ই যে একদা ডাক্তারি পড়া বেনারসীলাল তা-ও জানেন না। চোখের ইশারায় লোকগুলো সাধুকে চেপে ধরল, আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যে বেনারসীলাল তাঁর হাত উল্টে কমুইয়ের তলার দিকের শিরার ওপর ছুরিটা আমূল বসিয়ে দিয়ে সজোরে টেনে আনলো। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল।

ব্যাপারটা ঘটতে বোধহয় এক মিনিটও লাগল না। সঙ্গের মেয়েটাকে হুকুম করল, ওটাকে এই ব্যাটার সামনে শুইয়ে দাও এবার—দশ মিনিটের মধ্যেই ঠাণ্ডায় জমে মরবে।

সঙ্গীদের উদ্দেশে বলল, হাতের বড় শিরা কেটে দিয়েছি—ব্লিডিং হয়ে হয়ে রাতের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। সকালে যারা এসে দেখবে তারা ধরে নেবে, তান্ত্রিক ক্রিয়া করার জন্য এই ব্যাটা কারো সদ্যজাত শিশু চুরি করে এনেছে। কিন্তু সেই ক্রিয়া করতে গিয়ে ব্যাটা নিজেও মরেছে, শিশুও মরেছে। বেনারসীলালের সঙ্গে টক্কর দেবে এমন সাধু এখনো মায়ের পেটে।

…এ ক্ষেত্রেও আবার ঘটনার সাজ। বেনারসীলাল নিজেও দেদার মদ গিলে এসেছিল, কিন্তু তা বলে তার আত্মপ্রত্যয়ের অভাব ছিল না। সেই দুর্যোগের রাতে সে ওই শিশুকে আর সাধুকে তাদের নিশ্চিত পরিণামের দিকে ঠেলে দিতে পারার বিশ্বাস নিয়েই ফিরে গেছে। আর সাধু যদি দৈবাৎ নাও মরে তাহলে রুদ্ধ জনতার মারেই মরবে। কারণ তান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য শিশু চুরি করে আনাটা কেউ বরদাস্ত করবে না। নেশার ঝোঁকে সে-যে নিজের পরিচয় জাহির করে গেল এ খেয়াল তার বা অন্য কারো নেই।

অবধূত প্রথমে এতই হতচকিত যে তিনিও চোখের সামনে অবধারিত মৃত্যুই দেখেছেন। কিন্তু আত্মস্থ হতে খুব সময় লাগেনি। ঘরের কোণে চেলা-কাঠের আগুন জ্বলছে এখনো। কিন্তু তার আলো স্পষ্ট নয় খুব ক্ষিপ্র হাতে অবধূত ঝোলা থেকে টর্চ বার করলেন। হাতের ক্ষত কনুইয়ের তলা পর্যন্ত গভীর। কিন্তু বেনারসীলাল যা ভেবেছে তা নয়। শিরা কাটেনি। ছুরি পিছলে এসেছে। কেবল গভীর ক্ষত দিয়েই গলগল করে রক্ত বেরুচ্ছে।

সেই রক্তাক্ত হাতে শিশুটাকে টেনে এনে কম্বল চাপা দিলেন। আধা-জ্বলা চেলা-কাঠগুলো সামনে এনে যথাসাধ্য তাপের মধ্যে রাখতে চেষ্টা করলেন। তারপর নিজের শুশ্রূষায় মন দিলেন। বড় রকমের কাটা-ছেঁড়ার ওষুধ তাঁর কাছে মজুত থাকেই। ওষুধ লাগিয়ে একটা কৌপিন দিয়ে খুব শক্ত করে ব্যাণ্ডেজ বাঁধা শেষ হতে দেখলেন রক্ত চুইয়ে ব্যাণ্ডেজ ভিজে যাচ্ছে!

আপাতত আর কিছু করার নেই।

ঝোলা থেকে সেই পুরনো লাল চেলি আর ফতুয়া বার করে পরলেন। লোকের দেওয়া দু‘তিনটে ছোট বড় মোটা কম্বল পড়ে আছে। একটা তুলে নিজের গায়ে জড়ালেন, অন্যটাতে শিশুটিকে মুড়ে বুকে তুলে নিলেন। বৃষ্টি নেই, কিন্তু জোর বাতাস দিচ্ছে। রাস্তায় বেরুলে এই শীতের কামড় থেকে শিশুটাকে বাঁচানো যাবে কিনা কে জানে। তিনি শুধু চেষ্টাই করতে পারেন।

শীত আর দুর্যোগের একটাই সুবিধে। পথে মানুষ ছেড়ে কুকুর বেড়ালও নেই। একবারও না থেমে একটুও না বসে প্রায় তিন ঘণ্টা হেঁটে ছ’ ক্রোশের ওপর পথ পেরিয়ে এলেন। এখানেই অনন্তরাম আর লাজবন্তীর বাড়ি।—ঘটনা কে সাজায়? নইলে তিন বছরের মধ্যে অবধূত কোনোদিন শ্মশান ছেড়ে নড়েননি, তার মধ্যে এসেছিলেন কেবল এই অনন্তরাম আর লাজবন্তীর বাড়ি—তাদের পালিত ছেলেমেয়ে তিনটেকে আশীর্বাদ করতে! না এলে আজ নিশুতি রাতে তাদের এই ডেরার হদিস পেতেন কি করে? সে-দিন কার খেলা কে খেলেছিল?

রাত তখন সাড়ে চারটে প্রায়, কিন্তু ভোর হতে অনেক দেরি। এই শীতে ছ’টার আগে আলে৷ জাগে না। ঠুকঠুক করে দরজায় ঘা দিতে লাগলেন। কোনোরকম হৈ-চৈ কাম্য নয়।

অনন্তরাম দরজা খুলে আঁতকে চেঁচিয়েই উঠল, কে? এই রাতে কে তুমি? অন্ধকারে আপাদ মস্তক কম্বলে মুড়ি দেওয়৷ সাধুজীকে তার এখানে কল্পনা করারও কথা নয়। গলা শুনে লাজবন্তী হারিকেন হাতে আলুথালু অবস্থায় ছুটে এসেছে।

—চুপ! চেঁচাস না, আমি কমলাগঙ্গার মুদ্দাঘাটের সাধু— আমাকে ভিতরে নিয়ে চল।

অনন্তরাম আর লাজবন্তীর দেহের রক্ত চলাচল থেমে যাবার উপক্রম।

হারিকেন মুখের ওপর তুলে দেখে সত্যিই সেই সাধু। তাকে ভিতরে এনে দরজা বন্ধ করে দিল।

ঘরে এসে কম্বলের আড়াল থেকে বুকের শিশুকে লাজবন্তীর দিকে বাড়িয়ে দিলেন।—নে ধর, এটাকে যদি বাঁচাতে পারিস তাহলে তোর মাতৃত্বের জোর বুঝব।

অনন্ত:মি আর লাজবন্তী ভয়ে বিস্ময়ে দিশেহারা। হাড়কাঁপানো শীতের ভোর রাতে বারো মাইলের ওপর পথ ভেঙে শ্মশানঘাটের সাধু এই শিশুকে বুকে করে তাদের ডেরায় এসে উপস্থিত হয়েছেন—এ চোখে দেখেও বিশ্বাস করে কি করে!

—নে ধর—ঘাবড়াস না—তোদের হাত দিয়ে যদি এর বাঁচা কপালে থাকে তো বাঁচবে।

কলের পুতুলের মতো লাজবন্তী কম্বলে মোড়া শিশুটিকে নিল। অসাড় নীলবর্ণ মুখ। বেঁচে আছে কি নেই বোঝা যাচ্ছে না। তাড়াতাড়ি আলোর কাছে এনে কম্বল তুলল। বেঁচেই আছে মনে হয়। বলে উঠল, ইস্ এখনো যে এর গায়ের ময়লা পরিষ্কার করা হয়নি—এ কতক্ষণ আগে জন্মেছে— একে আপনি পেলেন কি করে?

—জন্মেছে চার-পাঁচ ঘণ্টার বেশি নয় বোধহয়। শীতের রাতে মরার জন্য একে ঠাণ্ডায় শ্মশানে কারা ফেলে গেল। সাক্ষী লোপ করার জন্য আমাকে তারা হাতের শিরা কেটে দিয়ে শেষ করে গেছে ভেবেছে যাক, আমার জন্য না ভেবে আগে এটাকে বাঁচানো যায় কিনা দ্যাখ।

এরপর লাজবন্তী শিশুটির আর অনন্তরাম সাধুজীর শুশ্রূষায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তার হাতের ক্ষত দেখে অনন্তরাম শিউরে উঠেছে। তক্ষুণি কোনো ডাক্তার ধরে আনার জন্য ছুটে বেরুতে চেয়েছিল। অবধূত বাধা দিয়েছেন, কিছু দরকার নেই, আমাদের মরা কপালে থাকলে ওদের এই বুদ্ধি হতো না, দুজনকে একসঙ্গে খতম করেই চলে যেত।

ডেটল তুলে। গরমজলে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে আবার ওষুধ লাগিয়ে এবারে অনন্তরামের সাহায্যে ভালো করে ব্যাণ্ডেজ বাঁধা হলো। লাজবন্তী এর মধ্যে পরম যত্নে শিশুটিকে জীবনের ভাপে ফিরিয়ে এনেছে। চুকচুক করে সলতের দুধ চুষে খাচ্ছে। দু‘চোখ বোজা। সুন্দর একটি জীবনের কুঁড়ি।

অবধূত গভীর মনোযোগে ছেলেটাকে দেখলেন খানিক। বাবার এই দৃষ্টি সংযোগ দেখে অনন্তরাম আর লাজবন্তী নিস্পন্দের মতো বসে। বড় নিশ্বাস ফেলে অবধূত বললেন, ঠিক বুঝতে পারছি না, আরো ভালো করে দেখতে হবে-তোমরা আমার ব্যবস্থা কি করতে পারো?

তারা বুঝল না। হাত জোড় করে লাজবন্তী বলল, আপনি হুকুম করুন বাবা—

—আমি তান্ত্রিক। আমার শ্মশানের কাজ যেটুকু নির্দিষ্ট ছিল শেষ হয়েছে। দুই একদিনের মধ্যেই আমি চলে যাব..কিন্তু এই একটা দিন আমাকে তোমরা রাখতে পারবে? কেউ চিনবে না জানবে না—পারবে? ..এই শিশুর জন্যেই বলছি। শ্মশান থেকে একে আমি তোমাদের এখানে নিয়ে এসেছি, জানাজানি হলে একে আর বাঁচানো সম্ভব হবে না।

অনন্তরামের মুখে কথা সরে না। লাজবন্তী জোর দিয়ে বলল, পারব— আপনি আমাদের শোবার ঘরের পিছনের ঘরে থাকবেন… আমি সে-দিকে কাউকে আসতে বা যেতে দেব না…অন্দরমহলেই কেউ আসবে না সেই ব্যবস্থা করব। কিন্তু এই শিশুর কি পরিচয় দেব বাবা—এ কে আপনি জানেন?

—বোধহয় জানি। কিন্তু এ কে জানলে শিশুর অমঙ্গল, তাই তোমাদেরও। …দাড়াও, আমাকে ভাবতে হবে, আমার ঘর ঠিক করে এই শিশুকেও সেখানে রাখো-এর কথাও এক্ষুণি কারো না জানা ভালো।

লাজবন্তী এই দিন বাইরের কোনো লোককে অন্দরের দিকে ঘেঁষতেই দিল না। নিরিবিলি ঘরে বসে অবধূত অনেকক্ষণ ধরে আবার ওই শিশুকে দেখলেন। হাত উল্টে অনেকক্ষণ চোখের সামনে ধরে রাখলেন। তাঁর মনে হলো, কেন মনে হলো জানেন না, পাঁচ বছর না গেলে এই শিশুর জীবন অনিশ্চিত। হাত দেখে মনে হলো পাঁচ বছর পর থেকে আয়ু রেখা স্পষ্ট। কিন্তু রেখা-টেখা কিছু নয়, তাঁর মন বলছে, শিশুর মুখ বলছে, পাঁচ বছর পর্যন্ত এর জীবন বিপন্ন। কেন বলছে তিনি আজও জানেন না। … দেখা হয়ে গেছে। এরপর কর্তব্যও স্থির। তিন বছর আগে কলকাতা থেকে বেরিয়ে পড়ার সময় ঝোলায় যে টাকা ছিল তা তেমনি পড়ে আছে। তার থেকে কিছু টাকা অনন্তরামের হাতে দিয়ে একটা ফাঁপা সোনার লকেট নিয়ে আসতে বললেন। ছোট্ট একটা কাগজে শিশুর আনুমানিক জন্মসময়, তারিখ আর কার ছেলে লিখলেন। লকেট আসতে কাগজের টুকরো ভাজ করে তার মধ্যে পুরে অনন্তরামকে আবার পাঠালেন স্যাকরার দোকান থেকে লকেট সীল করে আনতে।

পরের নির্দেশ, লাল সুতোয় বাঁধা ওই লকেট ঠিক পাঁচ বছর বয়সে শিশুর গলায় পরিয়ে দিতে হবে। এরপর ঝোলা থেকে একটা পাঁচ টাকার নোট বার করলেন। দু’ভাঁজ করে নোটটাকে ঠিক মাঝামাঝি দু‘খানা করে ছিড়লেন। এক-ভাগ লাজবন্তীর হাতে দিয়ে বললেন, এটা খুব সাবধানে আর খুব যত্ন করে রাখতে হবে। এই নোটের বাকি আধখানা কেউ এনে তোমাদের দেখালে নম্বর আর জোড় মিলিয়ে দেখে তোমরা তার হাতে ছেলে দিয়ে দেবে। জানবে এ ছেলের ওপর তারই অধিকার।

পাঁচ বছরের মধ্যে কত কি ঘটে যেতে পারে, তিনি নিজেও ইহজগতে না থাকতে পারেন, পাঁচ টাকার নোটের আধখানা হারিয়ে যেতে পারে — কত কি হতে পারে—কিন্তু সেই দিন সেই মুহূর্ত অবধূতের যা মাথায় এলো তিনি তাই করলেন। কেন করলেন, কে করালো আজও কি জানেন? অবধূত সেই শিশুর নাম রাখলেন, রাহুল।

রাতের অন্ধকারে তিনি আবার বেরিয়ে পড়লেন। সাধু তাদের ছেড়ে চললেন বুঝে লাজবন্তী অঝোরে কেঁদেছে। অনন্তরামের চোখেও জল। অবধূত আশ্বাস দিয়েছেন তাদের মঙ্গল হবে, আবার দেখাও হবে। আরও বলেছেন, ওই পাঁচ টাকার নোটের আধখানা দেখিয়ে যদি কেউ ছেলে নিতে আসে, তোমরাও তাদের সঙ্গে চলে এসো—আশা করছি তখন আবার দেখা হবে।

***

অনন্তরাম রাতের অন্ধকারে তার টাট, ঘোড়ারগাড়িতে তাঁকে দ্বারভাঙা পৌঁছে দিয়েছে।

…ঘরে ফেরার পর অবধূত আর কখনো কিছু ছাড়ার তাগিদ বা শেকল ছেঁড়ার তাগিদ অনুভব করেননি। এখন তাঁর কেবল মনে হয়, অমন একটা সাজানো ঘটনা ঘটবে আর তাতে তাঁর বিশেষ একটা ভূমিকা থাকবে বলেই তিনি এ-ভাবে ওই মন নিয়ে বেরিয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। ফিরে এসে সেখানকার ঘটনার কথা কেবল কল্যাণীকে বলেছেন। ফিরে আসার পর মনে হয়েছে এতবড় ব্যাপারটা দ্বিতীয় একজন কারো জানা থাকা দরকার—তাই বলেছেন। পাঁচ টাকার নোটের বাকি আধখানা স্ত্রীর হাতে দিয়ে খুব যত্ন করে রাখতে বলেছেন। সেইসঙ্গে কবে পাঁচ বছর পূর্ণ হবে তা-ও লিখে রেখেছিল।

…না, এই পাঁচ বছরে তিনি পার্বতী, তার ছেলে বা লাজবন্তীদের কারো খবর নেননি। অনেক সময়েই কৌতূহল হয়েছে, তবু না। কেবল মনে হয়েছে, সব ঠিক আছে। পাঁচ বছর পর্যন্ত পার্বতীর ছেলের কি বিপদ আর পাঁচ বছর পরেই বা সে-বিপদ কি করে কেটে যাবে সে-সম্পর্কেও তাঁর কোনো ধারণা ছিল না। এখন অবশ্য বুঝতে পারছেন, বিপদ কি করে কেটেছে। বেনারসীলান খুনের দায়ে জেলে। আর, মাত্র দু‘মাস আগে পার্বতার বাবা রতনলাল মারা গেছে। তাই পার্বতীর ছেলে বিপদমুক্ত।… পাঁচ বছর কবে শেষ হবে কল্যাণী তার দুদিন আগে তাঁকে জানিয়েছেন। কিন্তু দিনের হিসেব অবধূতের বরাবরই মনে ছিল। কাঁকুড়ঘাটিতে পার্বতীকে চিঠি লিখেছেন। লিখেছেন, তিনি বাবা তারকনাথের দীন সেবক। পাঁচ বছর আগে বাবা তারকনাথ পার্বতীর সদ্যজাত শিশুকে রক্ষা করেছেন। সেবকের ধারণা, পার্বতীর সেই সন্তান এখন বিপদমুক্ত। ছেলের হদিস পেতে হলে পার্বতী যেন পত্র-পাঠ পশ্চিম বাংলার তীর্থক্ষেত্র তারকেশ্বরে চলে আসে। এখানে এলে বাবা তারকনাথের এই দীন সেবকই তাকে খুঁজে নেবে। …নাটকের পরিসমাপ্তির জন্য কেন অবধূত তারকেশ্বর বেছে নিলেন? জানেন না। কেবল এ-টুকু মনে হয়েছিল এই মিলনের জন্য একটা ধৰ্মস্থানের পরিবেশ হলে ভালো হয়। মনে ডাক দিল, তারকেশ্বর। বাস্, তারকেশ্বর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *