সেই অজানার খোঁজে ১.১

দু’রাতের জার্নিতে পথে এরকম একজন সহযাত্রী জুটে যাবে, স্ত্রী মেয়ে বা আমি কেউ আশা করিনি। আমার আর মেয়ের ভিতরটা একটু বিরূপ হয়ে উঠেছিল। স্ত্রীর মুখ দেখে মন বোঝা শক্ত। উনি সব পরিবেশেই ঠাণ্ডা, চুপচাপ।

ময়দানে মস্ত একটা রাজনৈতিক সমাবেশ ছিল সেদিন। বিকেলে মিটিং, দুপুর থেকে মিছিলে মিছিলে বহু রাস্তার সমস্ত যানবাহন বিকল। কম করে তিন সাড়ে-তিন ঘণ্টার জ্যাম। সে-সময়ের কলকাতার এটা নৈমিত্তিক চিত্র। অফিস থেকে দু‘ভাই পর পর আমাকে ফোনে বলে দিয়েছিল অনেক আগেই হাওড়া স্টেশনে রওনা হতে হবে। ওই মিটিং ভাঙলে কলকাতার কত রাস্তা কত ঘণ্টার জন্য আটকে যাবে ঠিক নেই। এ-রকম তিক্ত অভিজ্ঞতা আমার আগেও হয়েছে। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় রওনা হয়ে রাত সাড়ে সাতটার ট্রেন ফেল করেছি। যাক, এবারে আমরা যাব হরিদ্বার। গত দেড় মাস ধরে আমাদের মন এত বিষণ্ণ যে কলকাতার বাড়ি-ঘর হাওয়া-বাতাসে দম বন্ধ হয়ে আসছিল। হঠাৎই এই যাত্রা স্থির। রেল দপ্তরের এক চেনাজানা অফিসারের কল্যাণে রিজারভেশনও পেয়ে গেলাম। হরিদ্বারে গিয়ে কোথায় উঠব কোথায় থাকব তা-ও ঠিক করার ফুরসৎ মেলেনি। সেখানে গেলে সাধারণত কংখলের রামকৃষ্ণ মিশনে আশ্রয় পেয়ে থাকি। সেখানকার বড় মহারাজ স্নেহ করেন। প্রত্যেক বার সুব্যবস্থাই হয়। কিন্তু তার জন্য অনেক আগে থাকতে চিঠি লিখে জানিয়ে রাখতে হয়। নইলে ভালো ঘর ছেড়ে ঠাঁই মেলাই শক্ত। বিশেষ করে যাত্রীর মৌসুমে। এটা মৌসুম ঠিক নয়। কিন্তু মৌসুমের কাছাকাছি সময়। আর সপ্তাহ তিনেক বাদে পুজোর ভ্রমণ বিলাসীদের হাওয়া বদলানোর হিড়িক পড়ে যাবে। মনে মনে ঠিক করেছি কংখলের আশ্রমে জায়গা পাই তো ভালো, না পেলেও খুব দুর্ভাবনার কিছু নেই। হরিদ্বারে হোটেল আর ধরমশালার ছড়াছড়ি। কোথাও জায়গা পেয়েই যাব।

ডুন এক্সপ্রেস সাড়ে ন’টা নাগাদ ছাড়ে, হয়তো বা আরো মিনিট দশ-পনেরো আগে। হালের টাইম-টেবল প্রায়ই একটু-আধটু বদলাচ্ছে। যা-ই হোক মিটিং ভাঙার জ্যামের ভয়ে আমরা বিকেল সাড়ে ছ’টার মধ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছি। তখন আমাদের মনের অবস্থা শুধু আমরাই জানি। মোটরে ওঠার আগে বাড়ির সকলের চোখেই জল। স্ত্রী আর মেয়ের চোখেও।…দু‘বছর আগে পর্যন্ত ছুটি-ছাটার সঙ্গে কিছু বাড়তি ছুটি যোগ করে ফি বছরেই কোথাও না কোথাও বেরিয়ে পড়েছি। বেরুতাম একজনকে উপলক্ষ করে, তাকে আনন্দে রাখার জন্য। তখন সংখ্যায় আমরা চারজন। এবারে সেই একজন কম।

পথে ভিড় যেটুকু পেয়েছি, সেটা এমন কিছু নয়। সোয়া সাতটার মধ্যে আমরা হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে গেছি। ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করতে আমার কোনদিনই ভালো লাগে না। আমাদের তিন জনের সঙ্গে তিনটে সুটকেস, একটা বড় টিফিন ক্যারিয়ার আর একটা কুজোর সাইজের জলের জাগ। আমরা প্লাটফর্মে সুটকেসের ওপর বসে অপেক্ষা করছি। ট্রেনের আনাগোনা, লোকজনের ছোটা-ছুটি দেখতে দেখতে সময় বেশ কেটে যায়। ট্রেন ঠিক কটায় ছাড়বে খোঁজ নিয়েছি। ন’টা পঁয়ত্রিশে! দু‘ঘণ্টা দশ-বারো মিনিট বাকি।

মিনিট পঁচিশ বাদে হস্ত-দন্ত হয়ে দুটি ছেলে এদিকে এলো। আমার চোখে ছেলে, দু‘জনেরই বয়েস আটাশ-তিরিশের মধ্যে। দু‘জনেরই পরনে চোঙা না হোক পা-চাপা প্যান্ট, একজনের গায়ে টেরিকটের চকচকে বুশ-শার্ট, অন্য জনের এমনি শার্ট, টেরিকটের। পায়ে ছুঁচলো চকচকে শু৷ মাথায় পরিপাটি করে আঁচড়ানো ঘাড়ে-নামা চুলের মতোই চকচকে। কিন্তু তার দু‘হাত আর শ্যামবর্ণ মুখের দিকে তাকালে চোখে ধাক্কা লাগে। বাঁ-হাতের দুটো আঙুল আধখানা করে নেই, দু‘হাতেই অনেকটা জায়গা জুড়ে পোড়া দাগ। বাঁ-চোখের পাশ ঘেঁষেও গালে-মুখে কপালে ওই রকম পুরনো পোড়া দাগ। চোখটা বরাত জোরে বেঁচে গেছে। কালোর ওপর তার মুখখানা মিষ্টি, কিন্তু ওই অঘটনের পাকা দাগে সেটুকু চোখে পড়ার নয়।

প্ল্যাটফর্মে ভিড় দেখেই তার মেজাজ অপ্রসন্ন। কোমরে হাত দিয়ে চারদিকে একবার দেখে নিয়ে সঙ্গীকে বিরক্তির সুরে বলে উঠল, এ শালার ভিড়ের মধ্যে কোথায় এনে বসাব! খুব কষ্ট হবে যে…

মিটিং-এর দরুন হয়তো অনেক যাত্রীই আমার মতো আগে এসে বসে আছে। অন্য ট্রেনের যাত্রীর ভিড়ও থাকা সম্ভব। কিছু জিগ্যেস করার ব্যাপারে ছেলেটার আমাকেই পছন্দ হলো।—আচ্ছা দাদা, ডুন এক্সপ্রেস ঠিক ক’টায় ছাড়বে বলতে পারেন?

যে-ভগ্নিপতির দল কারো খুব কষ্ট হবার মতো প্ল্যাটফর্মের ভিড় বাড়িয়েছে আমিও তাদের একজন। তার ওপর বাপ ছেড়ে জ্যাঠার বয়সীকে দাদা সম্বোধন। অন্য দিকে তাকিয়ে জবাব দিলাম, ন’টা পঁয়ত্রিশ।

নিজের হাতঘড়ি দেখল। এখনো পৌনে দু‘ঘণ্টার কাছাকাছি দেরি। আবার প্রশ্ন, ট্রেনটা কখন ইন করবে জানেন দাদা?

ঘুরে তাকালাম তার দিকে।

সেটা এক ড্রাইভার ছাড়া আর কেউ ঠিক-ঠিক জানে না-তার সঙ্গে তো আমার দেখা হয়নি ভাইটি।

—লে হালুয়া—আপনার অমন ত্যারছা করে জবাব দেবার কি হল—মশায়—জানেন না বললেই হত! সঙ্গীর দিকে ফিরল, তুই ছুট্টে চলে যা, ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করাই ভালো, এখানে ভিড়ের গরমে বেজায় কষ্ট হবে—আমি দেখি দুই একটা ডাব-টাব পাই কিনা।

দু‘জনে ব্যস্ত পায়ে চলল। সঙ্গীটি সত্যিই ছুটল।

মেয়ে আমার ওপরে ঝাঁঝিয়ে উঠল, এ-সব লোকের সঙ্গে তুমি ও-ভাবে কথা বলো কেন বাবা যা বলে গেল শুনতে খুব ভালো লাগল? মেয়ের মা-ও এক-নজর আমার দিকে তাকিয়ে নীরবে তাকেই সমর্থন—করল।

আমি বললাম, বেচারার মেজাজ অমন খারাপ কেন বুঝলি না, সদ্য বিয়ে করা বউ নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছে, প্ল্যাটফর্মের ভিড়ে বউয়ের কত কষ্ট হবে ভেবেই মেজাজের ঠিক নেই—এখন ডাব না পেলে এই মেজাজ আরো তিরিক্ষি হবে।

মেয়ে হেসে ফেলল। স্ত্রী অন্য দিকে মুখ ঘোরালেন।

বরাত একটু ভালোই। প্ল্যাটফর্মে গাড়ি এলো এক ঘণ্টা দশ মিনিট আগে। তা সত্ত্বেও লোকের ছোটাছুটি। কুলি কোচ নম্বর জেনে নিয়ে তার হিসেব মতো জায়গায় আমাদের বসিয়েছিল। ঠিক সামনেই সেই কোচ। চারটে করে বার্থের কুপেতে আমরা তিন বার্থ রিজারভ করেছি। একটা নিচের আর ওপরের দুটো বার্থ পেয়েছি। দ্বিতীয় নিচের বার্থের প্যাসেঞ্জারকে ওপরে পাঠানোর চেষ্টা সম্ভব কিনা আঁচ করার জন্য গাড়ির গায়ে আটকানো চার্টে তার নামটা পড়ে নিলাম। আর তার পরেই সম্ভাবনাটা বাতিল করলাম।

নিচের বার্থের প্যাসেঞ্জারের নাম কালীকিঙ্কর অবধূত।

…এত বয়েস পর্যন্ত অবধূত নামে একজনকেই চিনতাম, জানতাম। তিনি তন্ত্র সাধক কত বড় ধারণা নেই, কিন্তু নামী লেখক যে তাতে সন্দেহ নেই। সহযাত্রীর নামখানা গাল-ভরা, ফার্স্ট ক্লাসের যাত্রী এই অবধূত কোন্ পর্যায়ের তা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই। কেবল এটুকু ধরে নিলাম মেয়ের জন্য নিচের বার্থ পাওয়ার কোনো আশা নেই, কারণ কোনো অবধূতকে আমি অনুরোধই করতে পারব না। তাছাড়া কুপের একমাত্র বাইরের সহযাত্রী হিসেবে অবধূত-টবধূত প্রত্যাশিত তো নয়ই—বাঞ্ছিত‍ নয়।

কুলি বিদায় করে মেয়েকে বললাম, নিচের ওই বার্থ যার, তিনি কালীকিঙ্কর অবধূত…তোকে ওপরের বাথে ই উঠতে হবে।

স্ত্রী মন্তব্য করলেন, তাতে কিচ্ছু অসুবিধে হবে না, সিড়ি লাগানো আছে, তুমিও ইচ্ছে করলে নিচের বার্থে থাকতে পারো।

আমি বললাম, তোমার সামনের বার্থ অবধূতের শুনেই ঘাবড়ে গেলে নাকি?

স্ত্রী বিরক্ত।—এত বয়সেও মেয়েটার সামনে মুখের লাগাম নেই। সাতাত্তর সালের সেপ্টেম্বর সেটা। এই মাসেই সাতান্ন ছাড়িয়ে আটান্নয় পা দিয়েছি। স্ত্রীর তিপ্পান্ন। মেয়ের একুশ বাইশ। মায়ের কথা শুনে মেয়ে হাসছে। ওদের দু‘জনের মুখেই হাসি দেখলে এই বেরুনো সার্থক। নিচের একটা বার্থ ই আপাতত ঠিক-ঠাক করে বসা হল। ওপরের ব্যবস্থা পরেও হতে পারবে। তার পরেই যে-দৃশ্য আর নাটকের মুখোমুখি আমরা, তিনজনেই ভেবাচাকা।

ব্যস্তসমস্তভাবে বার্থে এসে ঢুকল আঙুল-কাটা এক-গাল পোড়া সেই মূর্তি প্ল্যাটফর্মে লোকের ভিড় দেখে যার মেজাজ বিগড়েছিল। তার বগলে একটা চকচকে ছোট হোল্ড-অল্। সামনের বার্থে আমাদের, বিশেষ করে আমাকে দেখে তার ব্যস্ত মুখে যে ছায়া পড়ল, মনে হল নিঃশব্দে সে নিজেকে আর এক-দফা ভগ্নিপতির সম্মান দিল।

ফার্স্ট” ক্লাসের বার্থ একটু বেশি চওড়া। দেখা গেল হোল্ড-অলের পুরু তোষক ঠিক সেই মাপের তৈরি। অনুমান ওই বার্থের যাত্রী কালীকিঙ্কর অবহৃত সর্বদাই ফার্স্ট ক্লাসে যাতায়াত করে অভ্যস্ত। তোষক-চাদর-গায়ের চাদর ইত্যাদি দেখে আরো অনুমান ভদ্রলোক শৌখিন মানুষ। সদ্য বিয়ে করা বউয়ের জন্য নয়, প্ল্যাটফর্মের ভিড়ে উনি কষ্ট পাবেন বলেই এই ছেলের উতলা বিরক্ত মুখে দেখেছিলাম। এই মূর্তি অবধূতঙ্গীর চেলা-ফেলা হবে। তাই যদি হয় তো যেমন চেলা তেননি শুরু হওয়ারই সম্ভাবনা। কিন্তু এরপর অপ্রত্যাশিত কিছু দেখাবই ভাগ্য আমাদের। করিডোরের জানলা বরাবর এক দঙ্গল মেয়ে-পুরুষ দাঁড়িয়ে। সেদিকে ফিরে চেলাটি হাঁক দিল সব রেডি, বাবাকে নিয়ে আসুন!

চেলা যে তাতে আর সন্দেহ থাকল না।

করিডোরের জানলা দিয়ে বাবার দর্শন পেলাম না। আধ মিনিটের মধ্যে কুপের দরজার সামনে তাঁর আবির্ভাব। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের তিনজোড়া চোখে লালের ধাক্কা। বাবার পরনে টকটকে লাল চেলির থান। কপালে লাল সিঁদুর টানা, গায়ে তেমনি লাল কনুই-হাতা ফতুয়া, গলায় বড়স একটা রুদ্রাক্ষের মালা, পায়ে চপ্পল, দুটো আঙটি পরা দু‘আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট। হাসি-হাসি মুখ। চওড়া বুকের ছাতি। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। পরিষ্কার শেভ করা মুখখানা কমনীয় বলা যেতে পারে। বয়েস পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে।

লাল বসন থেকে লালের জেল্লা ঠিকরোচ্ছে। আমাদের তিনজনকে দেখে দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে গেলেন। তাঁর পিছনে আর দু‘পাশে গিজগিজ করছে লোক। হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটার চারভাগের তিনভাগ জ্বলতে বাকি। ঘুরে ওটা একজনের হাতে দিয়ে বললেন, ফেলে দাও।

এটুকু যে কুপের দুটি মহিলার সম্মানে কারোরই বুঝতে বাকি থাকল না। এ-দিকের চেলাটির আর এক দফা বিরক্তির কারণ হলাম আমরা। সে বলে উঠল, বাবার ওটার ফেলার কি দরকার ছিল, দু‘দিনে তো একশ’বার সিগারেট খেতে হবে, তখন উঠে উঠে বাইরে গিয়ে খাবেন নাকি! ভিতরে এসে বসুন! আমার মুখের ওপর তার আড়চোখের একটা ঝাপটা এসে লাগল। ভাবখানা, বাবার মুখের সিগারেট ফেলে দিতে হয় এমন মেয়েছেলে নিয়ে ট্রেনে ওঠা কেন।

বাবা ভিতরে এলেন। চেলার কথায় কান দিলেন বলে মনে হল না। নিজের বার্থের শয্যা-রচনা দেখলেন। আমাদের বার্থ আর ওপরের খালি বাৰ্থ দুটো দেখলেন। নিচের যে বার্থে আমরা বসা তাতে দু‘ভাঁজ করে একটা সুজনি আর একটা ছোট্ট বালিশ পাতা। আমার স্ত্রী বাতাসে ফোলানো বালিশে শুতে পারেন না। আমাদের ওপরের দুই বার্থের সুজনি আর রবারের বালিশ এখনও পর্যন্ত যার-যার সুটকেশে।

অবধূতের পিছনের ভক্ত সংখ্যা ঠাওর করা গেল না। তাঁর পিছনে দু‘জন মাত্র ঢুকতে পেরেছে। তিনি আসন নিলে ভেতরে বড়জোর আর চার পাঁচজনের জায়গা হতে পারে। কিন্তু তিনি দাঁড়িয়ে থাকার দরুন পিছনের কেউ এগোতে পারছে না। ভিতরের চেলা তাড়া দিল, কি হল বাবা, বলুন!

কিন্তু বাবার দু‘চোখ স্ত্রী আর মেয়েকে ছেড়ে এবারে আমার মুখের ওপর। —ওপরের ওই দুটো বার্থ আপনাদের?

জবাবে মাথা নাড়লাম। আমাদেরই।

হরিদ্বারে যাচ্ছেন!

বলতে যাচ্ছিলাম, সেই রকমই ইচ্ছে। না বলে আবারও মাথাই নাড়লাম।

হরিদ্বারই যাচ্ছি।

বাবার সঠিক অনুমানের ফলে চেলা আর পিছনের ভদ্রলোক দু‘জনের হাসি-হাসি মুখ। অর্থাৎ তাদের বাবাটি সর্বজ্ঞ, অনুমানের কোনো ব্যাপার নেই। আমার বিবেচনায় কেরামতিও কিছুই নেই। বেনারস বা লক্ষ্ণৌ যাবার পক্ষে ডুন এক্সপ্রেস আদৌ ভালো গাড়ি নয়। আর হাওড়া থেকে সোজা হরিদ্বার বা দেরাদুন এই একটা গাড়িই যায়। তাছাড়া দেরাদুন অর্থাৎ এই শীতের জায়গায় যেতে হলে সঙ্গে কিছু বাড়তি সরঞ্জাম থাকার কথা। অতএব হরিদ্বার।

কিন্তু চেলার প্রতি বাবার পরের নির্দেশ শুনে আমি তো বটেই, স্ত্রী আর মেয়েও সচকিত একটু। তিনি বললেন, আমার বিছানা ওপরে পেতে দে, মায়েদের পক্ষে ওপরে উঠতে-নামতে অসুবিধে হবে।

গাড়ির চার্টে সহযাত্রীর নাম অবধূত দেখেই এই সুবিধেটুকুর আশা মন থেকে ছেঁটে দিয়েছিলাম। দেখছি মেঘ না চাইতে জল। তবু বলতে যাচ্ছিলাম, দরকার নেই, অসুবিধে হবে না। কিন্তু বলার সুযোগ পেলাম না। তার আগেই ওই চেলাটির মুখে প্রতিবাদের ঝাপটা।—আপনার কি-যে কখন মাথায় ঢোকে বুঝি না বাবা, ওই বাচ্চা মেয়ের অসুবিধে হবে আর আপনার খুব সুবিধে হবে—এই সরু সিঁড়ি বেয়ে ওঠা-নামা করতে গিয়ে পড়ে হাড়গোড় ভাঙন আর কি—এখন বসে পড়ুন তো! বাবার মুখে রাগ-বিরাগের অভিব্যক্তি নেই। বক বক না করে যা বললাম চটপট করে ফ্যাল না—নইলে তো পরে আমাকেই বিছান। টানাটানি করতে হবে।

চেলা থমকালো। রুষ্ট চাউনি আমার মুখের ওপর। নির্বাক রোযের সাদা তাৎপর্য, ভ্যালা লোক জুটেছেন মশাই আপনি একখানা! কিন্তু সকলকেই একটু সচকিত করে মেয়ে বলে উঠল, আমার কোনো অসুবিধে হবে না, সরানোর দরকার নেই!

মেয়ের বলার ধরনটা আদৌ মোলায়েম নয়। একুশ বাইশ বছরের মেয়েকে বাচ্চা মেয়ে বলার দরুন হতে পারে, অথবা ইদানীং এই গোছের গড়ম্যানদের প্রতি তার বিশ্বাস বা ভক্তি-শ্রদ্ধা একেবারে শূন্য বলেও হতে পারে। চেলাটির অপ্রসন্ন চাউনি এবার মেয়ের দিকে—বাবার মুখের ওপর এমন ঝাপটা মারা কথা বরদাস্ত করার ইচ্ছে নেই, আবার মেয়েছেলেকে বলেই বা কি।

কিন্তু এর পরেও অবধূতটির বেশ প্রসন্ন সপ্রতিভ মুখ। বললেন, অসুবিধে না হলেও সামনের এই বার্থে তোমার বদলে একটা রক্তাম্বর-পরা লোককে দেখতে তোমার মায়েরই কি ভালো লাগবে মা? তা ছাড়া ট্রেনে উঠে যদি দেখতে তোমার মা আর তুমি এই দুটো পাশাপাশি বার্থ পেয়েছ—তাহলে তোমারও ভালো লাগত না? চেলার দিকে তাকালেন, কিরে, কথা শুনবি না দাঁড়িয়েই থাকবি?

সঙ্গে সঙ্গে করিডোর থেকে একজন ভক্তর অসহিষ্ণু গলা।—এই পেটো কার্তিক, বাবা যা বলছেন চটপট করে দে না—অবাধ্য হওয়াটা তোর রোগে দাড়িয়েছে— না?

অবধূত মানুষটির বিবেচনা-বোধ প্রখর বলতে হবে। আর কথা বলার ধরনও সরস। ও দিকে পেটো কার্তিক অভিহিত চেলাটি এক হ্যাঁচকা টানে বালিশশুদ্ধ পাতা বিছান। ওপরের বার্থে ফেলার মধ্যেই তার মেজাজ বুঝিয়ে দিল। শিকল ধরে ঝুলে নিজেও উঠে গেল। হাতের ঝাপটায় চাদর টান করে তার ওপর বালিশ পেতে ঝাঁঝালো গলায় জিগ্যেস করল, জিনিস-পত্রগুলোও কি ওপরে আসবেন না তাঁরা নিচেই থাকবেন? বাবার মুখে বাৎসল্যের হাসি—রাতে যা লাগবে ওপরে তোল, আর সব নিচের বার্থের তলায় থাক আপনাদের অসুবিধে হবে না তো? শেষেরটুকু আমার উদ্দেশে। বললাম, অসুবিধে হবে কেন…আপনি মিছিমিছি নিজের অসুবিধে করলেন।

ট্রেন ছাড়তে দেরি আছে, আমি তাহলে নিচেই বসি খানিক? ভদ্রলোক অমায়িকও বটে।

—হ্যাঁ, বসুন।

বসলেন। সেই ফাঁকে তাঁর আরো কিছু ভক্ত ভিতরে ঢুকে পড়েছে। নিজের দু‘পাশে আরো জনা চারেককে বসালেন তিনি। জনা-কতক দাড়িয়ে রইলো। দরজার বাইরেও অনেকে, ভিতর খালি হলে তাদের ঢুকতে পাওয়ার আশা। সৌজন্যের খাতিরে আমি একটু সরে বসে একজনের বসার জায়গা করে দিলাম। অবধূত ডাইনে বাঁয়ের দু‘জন ভদ্রলোক আর মহিলার সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। অসুখ আর ওষুধের প্রসঙ্গ কানে এলো। আমি ফিরে আসা পর্যন্ত ওই ওষুধই চলুক, মায়ের ইচ্ছে হলে ফিরে এসে দেখব ওতেই বউমা ভালো হয়ে গেছেন—আর তুই পান জর্দা খাওয়া একটু কমা তো, অত খেলে ভালো লোকেরই অম্বল হবে—

আমাদের সামনে এক সারি লোক দাঁড়িয়ে। তাই কার প্রতি কি নির্দেশ ঠিক ঠাওর করা যাচ্ছে না। ও-দিকে পেটো কার্তিক নেমে এসে একে ঠেলে একে থাক্কা দিয়ে তার কাজ সারতে লাগল। তার সেই বন্ধ মাথার ওপর দিয়ে আর কাউকে বা ঠেলে সরিয়ে ফলের ডালা, ডাব, সুটকেশ একটা বেতের ঝুড়ি ইত্যাদি ভিতরে পাঠাতে লাগল। সেগুলো পায়ের ফাঁক দিয়ে বার্থের নিচে ঠেলে পেটো কার্তিক খিটখিটে গলায় বলে উঠল, আগে হাত পাখাটা দে―ভক্তির ঠেলায় যে বাবার দম বন্ধ হয়ে গেল—আপনারা একসঙ্গে এত লোক ঢুকে পড়লেন কেন—বাদের দর্শন হয়েছে বাইরে যান তো!

আধ ডজন মাথার ওপর দিয়ে পাখা এলো। পাশের মহিলার হাতে এটা দিয়ে পেটো কার্তিক হুকুম করল, বাতাস করুন।

মাথার ওপর পাখা চললেও সত্যি গরম হচ্ছিল। ঠেলে-ঠলে একটু জায়গা করে বাবার পায়ে মাথা ঠেকিয়ে তিন-চারজন বেরিয়ে গেল।

সঙ্গে সঙ্গে পেটো কার্তিকের হুমকি, দাঁড়ান কেউ ঢুকবেন না, ভিতরের লোক বেরিয়ে গেলে একে একে আসুন আর বেরিয়ে যান—এই নীলু, বাবার রাবারের চপ্পল দে—এখন পর্যন্ত জুতো জোড়া পর্যন্ত বদলানো গেল না।

পেটো কার্তিকের দাপটে সত্যিই কেউ আর হুড়োহুড়ি করে ঢুকতে চেষ্টা করছে না। সে এরই মধ্যে জায়গা করে নিয়ে মেঝেতে বাবার পায়ের কাছে বসে গেছে। বাবা নিচু গলায় তাঁর ওপাশের বসা লোকটাকে কিছু বলছেন বা নির্দেশ দিচ্ছেন৷ হাতে হাতে জুতোর বাক্স এলো একটা। নিজের হাতে পেটে! কার্তিক বাবার পায়ের শৌখিন স্যাণ্ডেল জোড়া খুলে নিজের পকেটের রুমাল বার করে তাঁর পায়ের তলা পর্যন্ত মুছে দিল। আমি বড় চোখ করে দেখলাম এরই মধ্যে বাবার পায়ের কাছে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট, একটা কুড়ি টাকার নোট, আর দুটো দশ টাকার নোট পড়েছে। পেটো কার্তিক রুমালটা কপালে ঠেকিয়ে নিজের কোলের ওপর রাখল। জুতোর বাক্স থেকে রাবারের চপ্পল বার করে বাবার পায়ে পরিয়ে দিয়ে স্যাণ্ডেল জোড়া সেই জুতোর বাক্সয় রেখে বার্থের নিচে ঠেলে দিল। অবধূতের সেদিকে চোখ নেই সামনের দাঁড়ানো ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলার সঙ্গে হেসে কথা বলছেন।—আমার কি ক্ষমতা, ও-বেটি আঙুল না নাড়লে কিছু করার সাধ্য আছে—তাঁর করুণা হয়েছে তাই তোমাদের মেয়ের মাথার ব্যামো সেরেছে।

নোট ক’টা এখন পেটো কার্তিকের এক হাতের দু’ আঙুলের ফাঁকে ভাঁজ করা। বাসের কণ্ডাক্টাররা নোট ভাজ করে যে-ভাবে আঙুলের ফাঁকে রাখে। গম্ভীর মুখে ফতোয়া দিল, যার করুণাই হোক, বাবার দেওয়া মাদুলি-ধোয়া জল রোজ মেয়েকে খাওয়াবেন।

মহিলা সঙ্গে সঙ্গে সায় দিলেন, খাওয়াচ্ছি বাবা, রোজ খাওয়াচ্ছি। তাঁরাও একে একে বাবার পারে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম সারলেন। এবারে তাঁর পারে দু‘খানা পঞ্চাশ টাকার নোট পড়ল। উঠে দাঁড়ানোর ফাঁবে নোট দুটো ভাঁজ হয়ে পেটো কার্তিকের আঙুলের ফাঁকে।

এর পরের শৌখিন বাবুটি কাছে এসে হাত জোড় করে জিগ্যেস করল—আপনি দেরাদুন থেকে কবে ফিরছেন বাবা?

—আমি জানি না, মা জানে। কেন, মামলার তারিখ কবে?

—বারো দিন পরে বাবা।

—না, তার মধ্যে আমার ফেরার আশা কম— আর ফিরলেই বা কি, তোরা শালারা ভাইয়ে ভাইয়ে মামলা করে মরবি, আর আমি সে-জন্য মায়ের কাছে একজনের জন্য কাঁদতে যাব? বলেছি না, ভাইকে ধরে নিয়ে আয় একদিন আমার কাছে, দেখি মিটমাট হয় কিনা—

—সে এলো না বাবা…

তার বড় দোষ, সে তোকে বিশ্বাস করবে কেন?

—-আপনি একটু দয়া রাখবেন বাবা। বলেই হাঁটু গেড়ে বসে বাবার পায়ে আর রাবারের চপ্পলে কপাল ঘষল। উঠে দাঁড়াতে দেখলাম বাবার পায়ে এবারে একখানা একশ টাকার নোট। সেটাও পেটো কার্তিকের আঙুলের ভাঁজে আশ্রয় নিল।

এবারে যে লোকটির পালা তার পরনের জামা-কাপড় আধময়লা। রোগা শুকনো মুখ। সামনে এসে দাঁড়াতেই বাবার নির্দেশ, দেখি জামাটা তোল তো—

লোকটি তক্ষুণি জামা তুলল। আমরা পিছনে তাই বাবার দ্রষ্টব্য কি বুঝতে পারছি না। প্রসন্ন গলা শুনলাম, বাঃ, দুটোই তো বেশ সাফ হয়ে গেছে দেখছি, পুরো অজ্ঞান করে অপারেশন করা হল?

—না, ওই জায়গায় ইঞ্জেকশন দিয়ে।… সবই আপনার অসীম করুণা বাবা…

—না-ও ঠেলা, আমি আবার কি করলাম, ডাক্তার বায়পসি করে বলল, ক্যানসার গ্রোথ নয়, সীস্ট-অপারেশন করে দিল, ফুরিয়ে গেল—তুই তো ভয়ে হেদিয়ে গেছলি।

গম্ভীর মুখে পেটো কার্তিকের মন্তব্য, বাবার কাছে এসে পড়েছে যখন, ক্যানসার হলেই বা ভয়ের কি ছিল।

কিন্তু লোকটার বোধহয় বদ্ধ ধারণা, বাবার কৃপাতেই ক্যানসার সীস্ট হয়ে, গেছে। পায়ে কপাল ঠেকিয়ে আর ওঠেই না। উঠতে দেখা গেল বাবার পায়ে একটা দশ টাকার নোট।

এই প্রথমবার পায়ের দিকে চেয়ে নোট দেখলেন অবধূত। তারপর চেলাকে বললেন, ফলের ডালাটা বার কর তো—

চেলা হাত বাড়িয়ে ডালা টেনে আনল। বড় ডালা ফলে বোঝাই। অবধূত নিজের হাতে মস্ত এক থোকা আঙুর তুললেন। —ধর…

—এত কেন বাবা…

ধর না। আঙুর নিতে বড় বড় দুটো আপেল তুলে তার হাতে দিলেন। —এখন নিশ্চিন্ত হয়ে ভালো করে একটু খাওয়া দাওয়া কর তো। আর রাত করিস না, বাড়ি যা।

চলে গেল। আমার মনে হল অসময়ের ওই আঙুব আর বড় দুটো আপেলের দাম তিরিশ টাকার কম হবে না। কিন্তু পেটো কার্তিকের মুখ খানা দেখার মতো। অমন আঙুরের থোকাটা দিয়ে দেওয়া বরদাস্ত হওয়া কঠিন যেন। মেয়ের দিকে চোখ পড়তে ভ্রূকুটি করতে হল। সে পেটো কার্তিকের মুখ দেখে নিজের মুখ রুমাল চাপা দিয়ে হাসছে। চোখে পড়লে এই পেটো কার্তিক এটা বরদাস্ত করবে না।

বয়স্ক আর বয়স্কাদের সঙ্গে অল্পবয়সী ছেলে-মেয়েরাও দর্শম প্রণাম সেরে যাচ্ছে। প্রণামী পড়ছে। কিন্তু ফলের ঝুড়িও খালি হয়ে যাচ্ছে। অবধূত উদার হাতে যাকে যা ইচ্ছে দিয়ে দিচ্ছেন। অতবড় ফলের ডালা একেবারে খালি হয়ে গেল। তখনো তিন চার জনের দর্শন প্রণাম বা আবেদন জানানো থাকি। পেটো কার্তিক থমথমে মুখে খালি ডালাটা জোরে ধাক্কা মেরে বার্থের নিচে পাঠিয়ে দিল। আমি প্রমাদ গুনছি। হাসি চাপার চেষ্টায় মেয়ের মুখ লাল। দেড় মাস বাদে ওর মুখে আগের স্বাভাবিক হাসি দেখছি, তাই ভালো লাগছে। কিন্তু পেটো কার্তিকের চোখে পড়লে বিপদ। মেয়ের হাসি দেখে তার মায়ের ঠোঁটের ফাঁকেও হাসির আভাস। একটি মেয়ের দর্শন প্রণাম শেষ হতে অবধূত জিগ্যেস করলেন, ফল সব ফুরিয়ে গেল বুঝি…?

গনগনে মুখে চেলাটি বলে উঠল, আমার কেনা ডাব দুটো আছে—বার করব?

—তোর যেমন কথা, হাওড়া স্টেশন থেকে বালীগঞ্জ পর্যন্ত ডাব বয়ে নিয়ে যাবে! থলেতে খেজুরের প্যাকেট আছে দেখ, বার করে দে—

চেলার মুখ দেখে আমারই হাসি পাচ্ছে, মেয়ের দোষ দেব কি। এবারে বার্থের নিচে থেকে থলে টেনে বার করে একটা প্যাকেট বাবার হাতে দিল।

এরপরেই বাকি যারা ছিল ব্যস্ত। কারণ গাড়ি ছাড়ার সময় হল। প্রণাম করে প্রণামী রেখে তাড়াতাড়ি নেমে যেতে লাগল। হাতপাখা রেখে শেষের মহিলাও ব্যস্ত মুখে প্রণাম সারলেন। অবধূত চেলাকে বললেন, তুইও নেমে যা, তোর বার্থও দেখে রাখিস নি তো?

—হুঃ, ছাড়ক গাড়ি, আপনাকে না খাইয়ে আমি গেলাম আর কি কোচ নম্বর জানা আছে, নীলুর কণ্ডাক্টর গার্ডকে বলেও যাবার কথা। নেমেই যা না, এর পর তো দেড় দু‘ঘণ্টার আগে ট্রেন থামবে না—রাত হয়ে গেলে এদের অসুবিধে হবে না!

চেলার তেমনি ঝাঁঝালো উত্তর, দেরি হয়ে গেলে আমি ওই করিডোরে বসে থাকব—আপনাকে না খাইয়ে আমি নড়ব কি করে-আপনার খাওয়া না হলে আমার খাওয়া আসবে কোত্থেকে? আপনি নিচে থাকলে নিজের ইচ্ছে মতো খেতে-শুতে পারতেন এখন তো আপনাকে এঁদের ঘড়ি ধরে খেতে শুতে হবে।

—তুই থাম্ তো, উঠে বোস।

উঠে গুরুর পাশে বসল। ভাঁজ করা নোটগুলো এখনো আঙুলের ফাঁকে গোঁজা। পোড়া দাগের মুখ একটু শ্রান্তই লাগছে।

গাড়ি নড়ল। প্ল্যাটফর্মের মানুষদের মুখগুলো একটু একটু করে সরতে লাগল। মিনিট দুই লাগল প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে যেতে। এতক্ষণের হট্টগোলের শেষ।

গুরু সম্পর্কে কৌতূহল নেই। শিষ্যর চরিত্রখানা সেই থেকে বেশ লাগছে।

আধুনিক চেলা গুরুকেও মুখ ঝামটা দিয়ে কথা বলে দেখছি। পেটো কার্তিক উঠে দাঁড়ালো। নোটের গোছা নিজের প্যান্টের পকেটে গুঁজল। ওপরের বার্থ থেকে বড়সড় ভি. আই. পি. অ্যাটাচি কেসটা নামিয়ে নিচের বার্থে রাখল। সেটা খুলতে প্রথমেই যে জিনিসটার দিকে চোখ গেল সেটা একটা চ্যাপটা স্কচ, হুইস্কির বোতল। মুখ খোলা হয়নি। তার পাশে আট দশ প্যাকেট কিং সাইজের সিগারেট।

একটা প্যাকেট, লাইটার আর অ্যাশট্রে বার করে গুরুর সামনে রেখে অ্যাটাচি কেস আবার ওপরের বার্থে তুলে দিল। সিগারেটের প্যাকেটের ওপর নাম দেখলাম রথম্যান। সিগারেটের নেশা না থাকলেও খুব দামী ফরেন জিনিস ওটা, জানি। তন্ত্র-সাধক অবধূতটি বিলাসী এবং সুরসিক বলতে হবে। সফরে বেরুলে সঙ্গে স্কচ হুইস্কি মজুত থাকে। বোতলটা যে আমরাও দেখলাম সে-জন্য তাঁর মুখে সংকোচের লেশমাত্র নেই। সিগারেটের প্যাকেটটা টেনে নিয়ে আমার দিকে তাকালেন। মুখে সামান্য দ্বিধার হাসি, বললেন, এই এক বদ নেশা আমার, মায়েদের কি খুব অসুবিধে হবে?

পেটো কার্তিক আবার বসে পকেট থেকে নোটের গোছা বার করে গোনা শুরু করেছিল—তার এক-এক আঙুলের ফাঁকে এ-এক অঙ্কের নোট — একশ পঞ্চাশ কুড়ি দশ পাঁচ। পাঁচের নিচে নেই। জবাবটা মায়েদের দিক থেকেই আশা করে সে মা-মেয়ের দিকে তাকালো। মেয়ে একটা বাংলা বার্ষিক সংকলন বার করে বসেছে। আমি জবাব দিচ্ছি না দেখে স্ত্রী বিব্রত মুখে আমার দিকে তাকালেন। পেটো কার্তিকের ভুরুর মাঝে বিরক্তির ভাঁজ পড়ল। বললাম, এ-টুকুতে অসুবিধে হলে আমাকে তো গোটা কুপ রিজার্ভ করে যাতায়াত করতে হয়, অসুবিধে হবে না, আপনি খান। প্যাকেট খুলে অবধূত আগে আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন।—চলে তো। কখনো-সখনো শখ করে চলে, এত দামী সিগারেট নষ্ট না করাই ভালো। মিটি মিটি হাসি। হাসলে সপ্রতিভ আধ-ফর্সা মুখখানা বেশ সুন্দরই · দেখায়।—এ-সব দামী জিনিস সংগ্রহ করার ব্যাপারে আমার কোনো ·

কেরামতি নেই মশাই, জুটে যায়—না জুটলে সিগারেট ছেড়ে বিড়িতেও অসুবিধে হয় না। ধরুন —

একটা তুলে নিতে নিতে দেখলাম সিগারেট খাওয়ার ধাক্কায় ভদ্রলোকের আঙুল দুটো হলদে হয়ে গেছে। আমার সিগারেট নেওয়াটা মেয়ের পছন্দ হল না বুঝলাম। কারণও আছে। কিন্তু নিজে সেধে নিচের বার্থ ছেড়ে দিলেন, ভদ্রলোককে সদাশয় বলতেই হবে। শখে এক-আধটা চলে বলার পর একটা না নেওয়া অভব্যতা।…এরপর গাড়িতে হুইস্কির বোতল খোলা হতে দেখলে অবশ্য বরদাস্ত করা শক্ত হবে। কিন্তু সিগারেট ধরাবার ব্যাপারেই যা বিনয় দেখলাম, মনে হয় না ওরকম পরিস্থিতিতে পড়তে হবে।

নিজে লাইটার জ্বেলে আমার সিগারেটের মুখে ধরালেন। তারপর পিছনে ঠেস দিয়ে দু‘পা বার্থে তুলে টান করে দিলেন। চেলা আধ-হাতটাক সরে বসল। টাকা গোনা থামিয়ে আমার দিকেই চেয়ে আছে। মনে হল তার বিবেচনায় গুরু যা করলেন সেটা আমারই করা উচিত ছিল। অর্থাৎ তাঁর সিগারেট আমারই ধরিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। চোখোচোখি হতেই গম্ভীর মুখে জানান দিল, অল্ ওভার দি ওয়ারলড, বাবার বাঙালী ভক্ত আছে— বাবার ভালো জিনিসের কখনো অভাব হয় না। তারা বাবার জন্য এনে ধন্য হয়, সেবা করতে পেরে ধন্য হয়।

আমি আলতো করে বলে বসলাম, বাবাও ধন্য হন না?

এমন দুঃসাহসের কথা পেটো বোধহয় আর শোনেনি। পোড়া দাগের মুখে রক্তকণার ছোটাছুটি শুরু হল। কিন্তু যাঁকে নিয়ে কথা তিনি জোরেই হেসে উঠলেন। চেলার দিকে চেয়ে বললেন, কেমন জব্দ, আর হড়বড় করবি? আমার দিকে তাকালেন, ঠিকই বলেছেন আপনি, শুধু ধন্য কেন, এত ঋণের বোঝা কাঁধে চাপছে শেষে নরকেও ঠাঁই হলে হয়।

এই বিনয় অবশ্য কানে একটু নতুন ঠেকল। ক্রুদ্ধ চেলাটি নোটের গোছা আবার নিজের প্যান্টের পকেটে চালান করল। টাকার জিম্মাদার সে-ই বাঝা গেল। অবধূত পিছনে ঠেস দিয়ে বসে সিগারেট টানছেন, আর মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকাচ্ছেন। এক-আধবার স্ত্রী আর মেয়ের দিকেও। প্রণামী কত জুটেছে সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন বটে।

মুখুজ্জে মশাইয়ের দেরি হয়ে যাচ্ছে না তো…আমি ওপরে উঠে যাব? মুখুজ্জে মশাই শুনে আমি থমকে তাকালাম। আমার স্ত্রী আর মেয়েও। তিনি বললেন, ওঠার আগে গাড়ির গায়ের চার্টে আমার নামের ওপর এ মুখার্জী অ্যাণ্ড, ফ্যামিলি দেখেছিলাম… ভুল করলাম না তো?

স্বস্তি। বললাম, ভুল করেননি। আমরা দশটা সাড়ে দশটার আগে খাই না, শুতে শুতে এগারোটা সাড়ে এগারোটা।

তিনি নিশ্চিন্ত হয়ে আর একটু আরাম করে ঠেস দিলেন। ওই সিগারেট থেকে আর একটা সিগারেট ধরালেন। আগের টুকরোটা হাত থেকে নিয়ে চেলা জানলা দিয়ে ফেলে দিল। এটুকু হাত পিছনে নিয়ে গুরু নিজেই করতে পারতেন। আরো দৃষ্টিকটু লাগল সিগারেট ফেলে চেলাটি রক্ত-বর্ণ চেলির ওপর দিয়েই গুরুর পা-টিপতে লেগে গেল।

গুরু নির্লিপ্ত। সেবায় এমনি অভ্যস্ত যে খেয়াল করছেন কিনা সন্দেহ। সিগারেট টানার ফাঁকে মাঝে মাঝে স্থির চোখে আমাকে দেখছেন। দুই একবার স্ত্রীকে আর মেয়েকেও। এই সিগারেটটা শেষ হতে সোজা হয়ে বসলেন। নিজেই সিগারেটের শেষটুকু জানলা দিয়ে ফেলে পা টেনে নিয়ে সোজা আসন-পিঁড়ি হয়ে বসে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। সামনে একটু ঝুঁকে মুখের কিছু যেন একটু ভালো করে দেখে নেওয়ার দরকার হল। আবার সোজা হলেন। দু‘চোখ অপলক, একটু বেশি মাত্রায় তীক্ষ্ণ। ট্রেনে ওঠার পর থেকেই ভদ্রলোকের একটা বৈশিষ্ট্য আমার নজরে এসেছিল। না-ফর্সা না-কালো কমনীয় মুখের ওই দুটো চোখ। চাউনি স্বচ্ছ আবার গভীরও। কিন্তু ওই চোখ দেখে মনে হল, এক্কারে আই কি একেই বলে? সত্যিই আমার ভেতর দেখতে পাচ্ছেন?

স্ত্রী আর মেয়েও নিঃশব্দে তাকেই লক্ষ্য করছিল। শুধু আমি কেন, এ-রকম গড়ম্যান ওরাও কম দেখেনি। আমি নিস্পৃহ মুখে জিগ্যেস করলাম, বি দেখছেন?

চাউনি আবার সহজ। মুখেও সুন্দর হাসি।—মুখুজ্জে মশাই গায়ক লেখক না আর্টিস্ট?

আবার থমকাতে হল একটু। গড় ম্যানদের দাপটের অস্তিত্ব অতি দুঃখের ভিতর দিয়েই আমাদের মন থেকে মুছে গেছে। এ-রকম হুট-হাট কথা বা অবাক হবার মতো কিছু ক্রিয়াকলাপ স্বচক্ষে দেখা আছে। নির্লিপ্ত জবাব দিলাম, জার্নালিস্ট…।

কোন্ কাগজের?

বললাম।

কি-রকম জার্নালিস্ট?

সানডে ম্যাগাজিন এডিটর।

তার মানে সাহিত্য বিভাগের। আবার সামনে ঝুঁকলেন একটু। কপাল নিরীক্ষণ করছেন মনে হল। মাথা নাড়লেন।—-নাঃ, মিলছে না, আরো একটু বেশি কিছু হবার কথা।

মেয়ে বার্ষিক সংখ্যা খুলে কোনো লেখার চার লাইনও পড়েছে কিনা সন্দেহ। এবারে পেটো কার্তিককেই একটু জব্দ করার সুযোগ পেল। তাকে একবার দেখে নিয়ে গম্ভীর মুখে জবাব দিল, আমার বাবার অল্ ওভার দি ওয়ারলড, বাঙালী আর হিন্দুস্থানী ভক্ত পাঠক আছে, বাবার উপন্যাস পড়ে তারা ধন্য হয়, চিঠি লিখেও ধন্য হয়।

দু‘চোখ পেটো কার্তিকের মুখের ওপর তুলে বক্তব্য শেষ করল। ছেলেটাকে এই প্রথম হকচকিয়ে যেতে দেখলাম। একবার আমার দিকে আর একবার মেয়ের দিকে তাকাতে লাগল। আমি মেয়েকে ছোট করে ধমক লাগাতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু অবধূতের উচ্ছ্বাসে ফুরসৎ পেলাম না।—তাই বলো, তাই বলো! ভাবছিলাম কপালে স্পষ্ট দেখছি উনি আর্টের কোনো লাইনে বড় কিছু, তবু এমন ভুল হল কি করে!…বাবার কি নাম বলো তো মা? আমি বললাম, ছেড়ে দিন না, বাপকে মেয়েরা সব সময়েই বড় দেখে। হাতের ঢাউস সংকলনের এক জায়গা খুলে মেয়ে সেটা অবধূতের দিকে এগিয়ে দিল। ওই স্পেশ্যাল নাম্বারে আমার লেখা থাকবে সেটা অবশ্য কাকতালীয় কিছু নয়। তাঁর নাম পড়া হতেই চেলাটি ম্যাগাজিনটা হাত থেকে টেনে নিল। তার পরেই তার চোখ মুখ উদ্ভাসিত।—কি আশ্চর্য! এনার অনেক গল্পের সিনেমা তো আমি তিন চারবার করে দেখেছি— অ্যা? এক লাফে আমার কাছে এগিয়ে এলো। পায়ের ধুলো দিন সার, না জেনে খুব অপরাধ করেছি।

পা গুটিয়ে নিয়ে বললাম, জায়গায় গিয়ে বোসো, আমার সম্পর্কে তোমার ধারণা খুব মিথ্যে নয়, আমি লোকটা তেমন সাদাসিধে নই।

অবধূত চোখ বড় বড় করে ফেললেন, কি ব্যাপার রেকিছু গোল বাঁধিয়ে বসে আছিস বুঝি? তোকে নিয়ে আর আমি বেরুবো না। আমার দিকে ফিরলেন, কি করেছে?

হেসে জবাব দিলাম, কিছু না, প্ল্যাটফর্মে আনার কথা-বার্তা ওর একটু ত্যারছা মনে হয়েছিল। কিন্তু আপনার প্রতি ওর ভক্তিতে একটুও খাদ নেই।

উনি চেলাকে বললেন, বসে নিজের নাক-কান মল এখন, তোর স্বভাব আর বদলাবে না। পরে আমাকে আবার একটু ভালো করে দেখে নিলেন। —তা আমার মুশকিল কি জানেন, সাহিত্য জগৎ ছেড়ে আমি কোনো জগতেরই কিছু খবরর রাখি না, রোজ খবরের কাগজে চোখ বোলানোরও ফুরসত মেলে না। যাক, একজন গুণী লোকের সঙ্গে যোগাযোগ হল এটুকুই আনন্দ।

ভদ্রলোকের কথা-বার্তার ধরন বেশ। ভক্তদের সঙ্গে যখন কথা কইছিলেন তখনো খুব একটা সব-জান্তাভাব দেখিনি। অলৌকিক জ্ঞান বুদ্ধির জলুস দেখাতে না এলে আমার বিরক্তির কারণ নেই। নিজে থেকে নিচের বার্থ ছেড়ে দিলেন সে-জন্যও আমার মনে মনে একটু কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। আবার একটা সিগারেট ধরালেন। আমাকেই দেখছেন। —মুখুজ্জে মশাইয়ের জন্ম বোধহয় সেপ্টেম্বরে…মানে ভাদ্র মাসে?

অনুমান সত্যি। কিন্তু এই পাণ্ডিত্যের প্রতি আমার উৎসাহ বা কৌতূহল নেই। ফিরে জিগ্যেস করলাম, কি করে বুঝলেন?

—ভাদ্র মাসের জাতকের লক্ষণ দেখেছি আমারও ভাদ্রয় জন্ম। —তাহলে আমার সঙ্গে আপনার কিছু মিল আছে বলছেন?

—না চেহারার মিলের কথা বলছি না। লক্ষণের মিলটা আপনাকে ঠিক বোঝাতে পারব না।

বোঝার আগ্রহও নেই। তবু একটু খুশি করার জন্য বললাম, ভাদ্র মাসেই জন্ম, সেভেনথ, সেপ্টেম্বর নাইনটিন টোয়েন্টি।

হাসতে লাগলেন।—আমার থেকে তাহলে তিন বছর চারদিন পিছিয়ে আছেন…আমার ফোর্থ সেপ্টেম্বর নাইনটিন সেভেনটিন।

এবারে আমি অবাক একটু। চেহারা-পত্রে পঞ্চাশের নিচেই মনে হয়। অবিশ্বাসের সুরে বললাম, আপনার বয়েস ষাট বলতে চান?

খুশির হাসিতে মুখখানা ভরাট। জবাব দিলেন, বয়েস ভাড়াতে হলে মাত্র ষাট বলব কেন, উত্তর কাশীতে একবার এক যোগীর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, তার বয়েস খুব বেশি হলে পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ—তার ভক্তরা আমাকে বলল, বাবার বয়েস নব্বই। শুনে আমি পালিয়ে বাঁচি।

শুনতে মন্দ লাগল না। লক্ষ্য করছি আমিও। ভদ্রলোক সরস বচন-পটু বটেই। কিন্তু ভক্তরা আরো বেশি অভিভূত হয় বোধহয় তাঁর চোখের আকর্ষণে। চেয়ে থাকেন যখন, মনে হয় চোখও কথা বলে। এত স্বচ্ছ অথচ গভীর চাউনি আমি কমই দেখেছি।

সিগারেট ফেলে ঘড়ি দেখলেন।—দশটা পঁচিশ— খাওয়ার পাট সেরে ফেলা যাক, কি বলেন?

—হ্যাঁ…

মেয়ের বোধহয় খিদে পেয়েছে। বলার আগেই উঠে খবরের কাগজ পেতে টিফিন ক্যারিয়ার রাখল। স্ত্রী তার সুটকেশ খুলে প্লাস্টিকের বড় ডিশ আর গেলাস বার করে একটু ধুয়ে নিলেন। তিনি জানালার ধারে, তাই ওঠার দরকার হল না।

ও-দিকে অবধূতের সঙ্গে দেখলাম পরিপাটি-ব্যবস্থা। পেটো কার্তিক একটা বড়-সড় প্লাস্টিকের সেট পাতল। বেশ বড় দুটো ডিনার ডিশ আর কাচের গেলাস সাজালো। বড় একটা চামচ বার করল। ডিশের কোণে একটু মুন আর দুটো কাঁচা লঙ্কা রাখল। তারপর পেট-মোটা বেঁটে একটা টিফিন ক্যারিয়ার প্লাস্টিকের শিটের ওপর রাখল।

অবধূত করিডোরের জানলায় গিয়ে মুখে-হাতে জল দিয়ে এসে বসলেন! পেটো কাৰ্তিক প্ৰায় বড় ডিশ জোড়া দুটো মোটা মোটা পরোটা তার ডিশে রেখে পরের বাটি খুলল। আর তার পরেই আমি আর মেয়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। মস্ত বাটিটা ভরতি পেল্লায় সাইজের পাকা পোনার খণ্ড। এক এক খণ্ডের ওজন দেড়শ গ্রামের কাছাকাছি হতে পারে। চামচে করে তার দু‘খানা দ্বিতীয় ডিশে রাখা হল।

এ-দিকে আমাদের প্লাস্টিকের ডিশে লুচি আর আলুর দম। স্ত্রীর ডিশে পটলের তরকারি। আর আলুর দম ছাড়া বাটিতে মেয়ের জন্য একটা ডিমের কারি।

আধখানা লুচি আর আলুর দম মুখে তুলে দেখি অবধূত হাত গুটিয়ে চুপচাপ স্ত্রীর দিকে চেয়ে আছেন। গভীর চাউনিও একটু যেন বিষণ্ণ মনে হল। স্ত্রী-ও হয়তো খেয়াল না করেই তাকালেন তাঁর দিকে।

দু-হাত জোড় করে অবধূত বললেন, মা-গো ছেলের একটা অনুরোধ রাখবেন?

আমার স্ত্রী হকচকিয়ে গিয়ে চেয়ে রইলেন।

—আপনার খুব হাই ডায়বেটিস দেখতে পাচ্ছি, তাই আলুর দমের বদলে পটলের তরকারি…এক টুকরো মাছ এখান থেকে দিতে অনুমতি পেলে আপনার এই ছেলে খুব তৃপ্তি করে খেতে পারবে।

যে-ভাবে মা-গো দিয়ে শুরু করলেন আর যে-ভাবে নিজে তৃপ্তি করে খেতে পারবেন বলে শেষ করলেন—আপত্তির কথা মুখে আনাও মুশকিল। স্ত্রী অসহায় চোখে আমার দিকে তাকালেন।

কিন্তু অনুমতি যেন পেয়েই গেছেন। অবধূত নিজে উঠে চামচশুদ্ধ মোটা বাটিটা হাতে নিয়ে নেমে এলেন। চামচে করে একটা মাছ তুলে ডিশে রাখতেই স্ত্রী আঁতকে উঠলেন, এত বড় মাছ খাব কি করে…

—ছেলের মুখ চেয়ে ঠিক খেতে পারবেন, আপনার হাই প্রোটিন ঠিক মতো পড়ছে না। দ্বিতীয় বারে একটু গ্রেভি তুলে দিলেন। তারপর তেমনি বড় আর একখণ্ড মাছ মেয়ের ডিশে দিয়ে বললেন, মাছ খাও, ডিম সরিয়ে রাখো, তোমার লিভারের গণ্ডগোল আছে, জিভের এক পাশ কালচে দেখলাম—ডিম খাওয়া উচিত নয়—ওটা শেষ হলে আর একটা দেব।

মেয়ে হাঁ করে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে রইলো একটু, তারপর হেসে ফেলে বলল, একখানা পরোটা দেবেন না? চমংকার গাওয়া ঘিয়ের গন্ধ পাচ্ছি আনন্দে ছেলেমানুষের মতো হেসে উঠলেন।—এই তো চাই—কার্তিক শীগগির পরোটা দে!

বাটি নিয়ে এবার আমার দিকে তাকাতেই তাড়াতাড়ি দু‘হাতে নিজের ডিশ ঢাকলাম।—আর না, আর না, এবারে আপনি খান!

—দেখুন মশাই, মায়েদের নিয়ে আমার ভাবনা ছিল, না সরালে হাতের ওপরেই বাটি উপুড় করে দেব—খাওয়ার থেকে খাইয়ে কি কম আনন্দ নাকি! হাত সরান বলছি—

আমার ডিশেও তেমনি পরিপুষ্ট একটা খণ্ড পড়ল। বললাম, আপনাদের আর কি থাকল, ওই দেখুন কার্তিকের মুখ শুকিয়ে গেছে!

কার্তিক তক্ষুণি জোরালো প্রতিবাদ করল, কক্ষণো না! লোক পেলে বাবা এই-রকম মিলে নিশে খান বলে সব সময় বেশি যোগাড় থাকে—এই শেষের বাটিতে আরো তিন চার পিস মাছ আছে।

ভদ্রলোক হেসে বললেন, তাছাড়া আপনাদের আলুর দমের ভাগ একটু পাব না —খাসা চেহারা দেখছি।

আমার স্ত্রী তখনো খাওয়া শুরু করেননি। ব্যস্ত হয়ে এদিক ওদিক তাকালেন। অবধূত এক হাতে নিজের পরোটার ডিশটা তুলে সামনে ধরলেন, এতেই দিন—

চারটে আলুর দম দিতেই তিনি ডিশ সরালেন। লাগলে আর থাকলে পরে চেয়ে নেব। ডিশ জায়গায় রেখে মাছের বাটি নিয়ে আবার মেয়ের দিকে এগোতে সে বলল, আমি আর না, এই একটা মাছ খেলেই পেট প্রায় ভরে যাবে—

প্রায় ভরলে তো চলবে না, ডিম তুমি খাবে না বললাম না — ওটা কার্তিকের জন্য সরিয়ে রাখো, মাঝে সাজে এক আধটা পোচ খেতে পারো হাত সরাও, আমার খিদে পেয়ে গেছে।

মেয়ে হাসি মুখে আরো এক টুকরো মাছ নিল।

ভেরি গুড। এবারে নিজের জায়গায় আয়েস করে বসলেন। কার্তিক, আর দেরি করিস না, তুইও খেয়ে নে।

কার্তিক অম্লানবদনে আর একটা ডিশ বার করে বসে গেল।

খাওয়া চলল। ভিতরে ভিতরে এবার আমার একটু অবাক হবার পালা।

আমি ভুক্তভোগী বলেই এ-সব লোকের ক্ষমতা সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই। স্ত্রী বা মেয়েরও নেই। এই ভদ্রলোককে ভালো লেগেছে কারণ, তান্ত্রিক অবধূত হলেও তাঁর মন জয় করার রীতি আলাদা। তাতে ভড়ং-চড়ং কম। কপাল দেখে বা লক্ষণ দেখে ভাদ্র মাসে জন্ম বলে দিলেন তাও আমার কাছে কোনো শক্তির নজির নয়!… কিন্তু স্ত্রীর ডিশে পটলের তরকারি দেখেই খুব হাই ডায়েবেটিস আঁচ করে ফেললেন। তাও না হয় হল, মেয়ের লিভার খারাপ কিনা জানি না, শরীর ভালো যাচ্ছে না বলে ইদানীং তাকে ডাক্তার দেখানো হয়েছে—সেই ডাক্তারও ওকে পারলে ডিম না খেতেই বলেছে, আর খেলে পোচ ছাড়া অন্য কিছু খেতে বারণ করেছে।

অবধূত খাইয়ে আনন্দ পান সে-তো দেখলামই। নিজেও বেশ ভোজন রসিক। আরো একটু আলুর দম চেয়ে নিয়ে ওই-রকম চার পিস মাছ আর তিনখানা ঢাউস পরোটা পরিতৃপ্তির সঙ্গে খেয়ে উঠলেন। পেটো কার্তিক ও খুব পিছনে থাকল না। সে খেল চারখানা পরোটা, আমার স্ত্রীর দেওয়া আলুর দম ডিমের কারি, আর দু‘পিস ওই দেড়শ গ্রাম ওয়ালা মাছ ততক্ষণে সে আরো অন্তরঙ্গ অমায়িক হয়ে উঠেছে! আমাদের খাওয়া হতে প্রায় হুকুমের সুরেই বলল, ডিশ-টিশ টিফিন ক্যারিয়ারের বাটি যেমন আছে থাক, খাওয়া হলে আমিই ধুয়ে নিয়ে আসছি—হরিদ্বার পর্যন্ত আপনাদের আর কুটোটি নাড়তে দিচ্ছি না—সার আমাকে যতো বাজে লোক ভেবেছেন, অতটা নই—বাবা সাক্ষি।

খাওয়ার পর অবধূত আবার সিগারেট ধরিয়েছেন। পলকা গম্ভীর মুখে সায় দিলেন, তা বটে। খুব ঠাণ্ডা ছেলে, অন্যের মাথা উড়িয়ে দেবার জন্য বোমা বানাতে গিয়ে হাত-মুখের ওই দশা—আজকালকার ছেলেরা বোমাকে পেটো বলে, তাই এর নাম পেটো কার্তিক।

স্ত্রী আর মেয়েরও পেটো কার্তিকের মুখ নতুন করে নিরীক্ষণ করার পালা। সে হতাশ গলায় বলে উঠল, যাও একটু মন পাওয়ার চেষ্টায় ছিলাম, বাবা দিলেন পাংচারড করে।… আচ্ছা মা, হাত আর মুখের যে দশাই হোক, ওই করতে গিয়েই বাবার আশ্রয় তো পেয়ে গেলাম, আমার বরাত খারাপ কে বলবে—-বাবা আমাকে নিজের কাছে রেখে শুধু প্রাণে বাঁচালেন না—পুলিসের হাত থেকেও বাঁচালেন।

যুক্তিব কথাই। পেটো কার্তিককে সত্যিই এখন খারাপ লাগছে না।

খাওয়া হতে দুই টিফিন ক্যারিয়ার ডিশগুলো আর সাবান নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে গেল। কারণ গাড়ির গতি একটু শিথিল হয়েছে। ওর নামার স্টেশন আসছে।

পাঁচ সাত মিনিটের মধ্যেই ফিরে এলো। ট্রেন তখন সবে থেমেছে। অবধূত তাকে সাবধান করলেন, রাতে আর খবরদার নাববি না বলে দিলাম, সকালের আগে আমার খবর নেবার দরকার নেই। তোর কোচ নম্বর কত?

জবাব দিয়ে পেটো কার্তিক আমাকে বলল, বাবাকে একটু দেখবেন সার তাহলে—

—তোমার বাবা সকলকে দেখেন আর আমি তাঁকে দেখব?

অবধূত তাড়া দিলেন, সর্দারি না করে তুই নাম এখন!

চলে গেল। অতি আপনার জনকে একলা রেখে যাওয়ার দুশ্চিন্তা মুখে।

আমার মনে পড়ল, হাওড়া স্টেশনের প্রণামীর টাকা সব ওর পকেটে। মনে হয়, অবধূতের ট্রেজারারও পেটো কার্তিকই হবে। তাই হয়তো এ নিয়ে কেউ কিছু উল্লেখ করল না।

ট্রেন ছাড়লে শোয়ার তোড়জোড় হবে। অবধূত নতুন সিগারেট ধরিয়েছেন। খাওয়ার পরে আমাকেও সিগারেট সেধেছিলেন। নিইনি। তোয়ালে আর সাবানের কেস নিয়ে স্ত্রী উঠলেন। শোবার আগে তাঁর বেশ করে হাত-মুখ না ধুলে চলে না। মেয়েও তাঁর পিছনে গেল।

অবধূত জিগ্যেস করলেন, আপনার স্ত্রীর ব্লাড সুগার কতো? —তিনশ’র ওপরে। খাবার আগে দুবেলা ইনসুলিন নিতে হয়।

—নিজে নেন?

— হ্যাঁ।

—আজ আমাদের জন্যেই বাদ পড়ল…

—কোথাও বেরুলে এরকম বাদ পড়ে।

—ওঁর ব্লাড সুগার কি হিরিডিটরি?

—না।

—মেয়ের তো বিয়ে হয়নি… আপনাদের কাছেই থাকে না হস্টেল-টস্টেলে থেকে পড়ে?

—আমাদের কাছেই থাকে।… কেন?

—আপনার স্ত্রীকে বড় নিঃসঙ্গ মনে হল, তাই। সিগারেট মুখে তুলে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন।

ওরা বাথরুম থেকে ফিরে আসতে আমি গেলাম। ততক্ষণে গাড়ি আবার নড়েছে। মনে হল, ডায়বেটিসের চিকিৎসা ভালো জানা আছে কিনা জিগ্যেস করলে ভদ্রলোক খুশি হতেন। কিন্তু আমি আর ও-দিক মাড়াতে রাজি নই। আমার স্ত্রীকেও রাজি করানো যেত না।

আমি ফিরে আসার পর অবধূত উঠলেন। বেরুলেন।

মেয়ে মন্তব্য করল, ভদ্রলোক সিগারেট খান বটে—থামা নেই, দরজা বন্ধ করার পরেও খাবেন না তো?

—কি করে বলব…কেমন দেখলি অবধূতকে?

সাফ জবাব, অবধূতগিরির বুজরুকি বাদ দিলে বেশ ভালো। স্ত্রী বিরক্ত।—তোর ও-ভাবে বলার দরকার কি?

মেয়ে বলল, তবে তোমার ভাদ্রয় জন্ম, শিল্প বা সাহিত্য করো, মায়ের ডায়বেটিস, আমার ডিম খাওয়া বারণ—বেশ জল ভাতের মতো বলে গেলেন—এ-সব কি ওঁদের অকালট সায়েন্সের মধ্যে পড়ে?

স্ত্রী বাধা দিলেন, থাম না, এসে যাবেন…।

—এলেই বা, মাছ খাইয়ে মাথা কিনে ফেলেছেন নাকি যে ইচ্ছে মতো কথা বলতে পারব না! হেসে ফেলল, যা-ই বলো, খাসা মাছ কিন্তু, আর পরোটাও খাঁটি গাওয়া ঘিয়ের বাবা—একটাই তল করতে পারছিলাম না।

এবারে স্ত্রীর ধমক।—তুই থামবি?

ফু” দিয়ে আমাব আর মেয়ের রবারের বালিশ ফোলানোর মধ্যে অবধূত এসে গেলেন। নিচের বার্থেও সুজনি পাতা হয়ে গেছে। আমার ওপরের বাৰ্থ বাকি। সেটা নিজেই পাতলাম।

না-কে একটু জব্দ করার জন্যেই হয়তো মেয়ে খুব নিরীহ মুখে অবধূতকে বলল, আপনি কি রাতেও সিগারেট খাবেন নাকি?

ওর মা কেন, আমিও একটু বিব্রত বোধ করলাম। ভদ্রলোক তাড়াতাড়ি বললেন, না মা না, রাতে আর না —ইস্, তোমার অসুবিধে হচ্ছিল আমাকে বললে না কেন!

মেয়ে হাসি মুখেই মাথা নাড়ল।—জানলা দরজা সব খোলা ছিল, আমার একটুও অসুবিধে হচ্ছিল না—আপনাকে জিগ্যেস করলাম বলে মায়ের মুখ দেখুন—তোমাকে বললাম না, মানুষ হিসেবে উনি দারুণ ভালো? প্রসন্ন মুখে হাসছেন ভদ্রলোক। মেয়ের দিকেই চেয়ে আছেন। বললেন, আর অবধূত হিসেবে দারুণ ভাঁওতাবাজ, এই তো?

মেয়ে এবারে নিজের কলে নিজে পড়ল। মুখ লাল করে আত্মরক্ষার চেষ্টা।

তেমনি হাসছেন।—আমি যেমনই হই, মেয়ে তুমি কত ভালো এ কিন্তু নিজেও জানো না। আচ্ছা গুড নাইট।

উনি ওঁর জায়গায় উঠে গেলেন। আমি প্রথমে দরজা পরে মেয়ের দিকের জানলাও বন্ধ করলাম। স্ত্রীর মাথার জানলা খোলা থাকলো, ওটা বন্ধ করতে গেলে বাধা দেবেন জানা কথাই।

…এক সময় ঘুম ভেঙে গেল। ওপরের সামনের বার্থে অবধূত নিশ্চল পাথরের মূর্তির মতো বসে আছেন। মেরুদণ্ড সোজা। দুচোখ বোজা। ঘড়ি দেখলাম। রাত সাড়ে তিনটে।

এরপর আবার ঘুম ভাঙলো সকাল সাড়ে পাঁচটায়৷ অবধূত তেমনি বসে আছেন। তবে এখন চোখ বোজা নয়। চোখোচোখি হতে হেসে একটু মাথা নাড়লেন। নিচের দিকে চেয়ে দেখলাম, স্ত্রী-ও বসে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে বসে আছেন। মেয়ে ও-পাশ ফিরে ঘুমোচ্ছে। আমার কেমন মনে হল সেই রাত থেকে সিগারেট খেতে না পেয়ে ভদ্রলোকের কষ্ট হচ্ছে। নিচে নেমে এলাম। ফিসফিস গলায় স্ত্রীকে বলতে তিনিও মাথা নেড়ে সায় দিলেন। আমি দাঁড়িয়ে অবধূতকে বললাম, আপনি নেমে এসে বসুন, এতক্ষণ সিগারেট খেতে না পেয়ে আপনার অবস্থা বুঝতে পারছি।

তিনি হাসলেন, হাতের কাছে থাকলে খেয়ে যাই—আবার না খেলেও কষ্ট-টষ্ট খুব কিছু হয় না…ব্যস্ত হবেন না, ওঁরা উঠুন—

স্ত্রী উঠে বসেই আছেন, উনিই নিচে নেমে বসতে বললেন আপনাকে। খুশি মুগ্ধে নেমে এলেন। কাঁধে তোয়ালে, এক হাতে সোপ কেস্, টুথ-ব্রাশে পেস্ট লাগানো, অন্য হাতে সিগারেটের প্যাকেট, লাইটার। আমাকে বললেন দরজাটা খুলুন, এ-পাট সেরে আসি।

আধ-ঘণ্টা বাদে ফিরলেন।…আমি রাত সাড়ে তিনটে থেকে ওঁকে বসা দেখেছি, তারও কত আগে থেকে বসেছিলেন জানি না। কিন্তু তরতাজা মুখ! হাতের তোয়ালে ছকে ঝুলিয়ে টুথ-ব্রাশ আর সাবান ওপরের বার্থের ভি. আই. পি. ব্যাগে রাখতে রাখতে বললেন, পর পর তিনটে সিগারেট খেয়ে এলাম, মা-মণির ঘুম ভাঙার আগে আর খাচ্ছি না।

আর ঠিক তক্ষুণি মা-মণি আড়মোড়া ভেঙে এ-দিক ফিরল। একবার চোখও তাকিয়েছে। আবার বুজতে গিয়েও বুজল না। সামনের লোকের বসনের লালের ধাক্কায় ঘুম একটু চটে গেল বোধহয়। উঠে বসল। মেঝের স্যাণ্ডেলে পা গলাতে গলাতে বলল, আপনারা গল্প করুন, আমি বাবার জায়গায় গিয়ে শুই—এখনো অনেকক্ষণ ঘুমোবো।

সামনের সিঁড়ি দিয়ে প্রায় চোখ বুজেই ওপরের বার্থে উঠে গেল। এর রাজসিক ঘুম। ইচ্ছে করলে বেলা ন’টা সাড়ে ন’টা পর্যন্ত ঘুমোতে পারে। তবে গত দেড় মাস ধরে ঘুমনো থেকে ছটফটই করত। আশা করছি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে ওর অন্তত উপকার হবে।

অবধূত আমাদের মুখোমুখি বসলেন। বললেন, গাড়ি ঘণ্টাখানেকের মতো লেট যাচ্ছে, ছ’টা ক’মিনিটে গয়া পৌঁছনোর কথা, সাতটা বেজে যাবে— গয়ার আগে ব্রেকফাস্টের আশা নেই।

ভদ্রলোক ব্রেকফাস্টের ব্যাপারটা নিজের ঘাড়ে তুলে নেবেন মনে হতে বললাম, ব্রেকফাস্ট অন মি, আগে থাকতেই বলে রাখছি।

হাসছেন মিটিমিটি।—কেন, মাছের জবাবে আলুরদম তো হয়ে গেছে।

দুধের বদলে ঘোল।

ঘোল কি দুধের থেকে খারাপ জিনিস নাকি মশাই! অবস্থা বিশেষে দুধ বিষ, ঘোল অমৃত। …তা আমার আপত্তি করার কোনো কারণ নেই, এই জীবনটা পরের ওপর দিয়েই দিব্বি চালিয়ে যাচ্ছি।

হাসতে গিয়ে আমার স্ত্রীর দিকে চোখ পড়তে একটু থমকালেন। উনি আমার দিকে পিঠ রেখে জানলা দিয়ে দূরের দিকে চেয়ে আছেন। অপলক চোখে খানিক তাকে দেখার কারণ কি ঘটল বুঝলাম না। সকালের তাজা হাসি মুখখানা একটু যেন বিষণ্ণ হয়ে উঠল। কালও একবার এই ব্যাপার লক্ষ্য করেছিলাম। উঠলেন। নিজের ওপরের স্বার্থ থেকে ভি. আই. পি. ব্যাগটা নামিয়ে আবার বসলেন। পাশে লাইটার আছে, সিগারেট নেই।

অর্থাৎ ফুরিয়েছে। ওটা খুলে আর একটা ডবল প্যাকেট বার করলেন। কিন্তু সেই ফাঁকে এমন কিছু চোখে পড়ল যে ভিতরে ভিতরে বেশ অবাক আমি। কাল রাতে বিলিতি হুইস্কির বোতলটা পুরো ভরতি দেখেছিলাম। আজ এই সকালে দেখছি বোতলের জিনিস অনেকটা নেমে এসেছে। বোতলটা শোয়ানো অবশ্য, কিন্তু তবু বেশ বোঝা যায়। যেটুকু কম সেটুকুর সদগতি রাতের মধ্যেই হয়েছে সন্দেহ নেই।

ব্যাগ বন্ধ করলেন। ওটা পাশেই পড়ে থাকল। প্যাকেট খোলার ফাঁকে স্ত্রীকেই লক্ষ্য করছেন। একটা সিগারেট বার করলেন। বারকয়েক সেটা প্যাকেটে ঠুকে স্ত্রীকেই জিগ্যেস করলেন, মায়ের কি রাতে প্রায় ঘুম হয় না নাকি?

স্ত্রী জানলার দিক থেকে মুখ ফেরালেন। অস্ফুট জবাব দিলেন, হয় আমি জানি হয় না। একদিন দু‘দিন নয় প্রায় চৌদ্দ বছর যাবতই হয় না। কিন্তু এ-প্রসঙ্গ অবাঞ্ছিত আমার কাছে।

সিগারেটটা হাতে করেই কিছুটা সরে গিয়ে স্ত্রীর মুখোমুখি বসলেন তিনি। বেশ গম্ভীর। —মা, ছেলেকে যে হাতখানা একটু দেখাতে হবে। বিব্রত মুখে স্ত্রী আমার দিকে তাকালেন।

আমি ঘর-পোড়া গোরু। এসবে কোনদিনই বিশ্বাস ছিল না—এখন তো বিরক্তিকর। কিন্তু তাহলেও ভিতরে মানুষটা আমি খুব সবল নই। স্ত্রীর স্বাস্থ্য প্রসঙ্গে উতলা হবার মতোই কিছু বলে বসার সম্ভাবনা। কারণ তাঁর দেহের স্বাস্থ্য মনের স্বাস্থ্যের খবর আমি জানি। আপত্তির সুরেই বললাম, থাক না—আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছু জানার কৌতূহল নেই দু‘চোখ আমার মুখের ওপর ফেরালেন। এ সেই চোখ। স্বচ্ছ অথচ গভীর ব্যঞ্জনাময়। এই দৃষ্টির প্রভাব তুচ্ছ করার মতো নয়। বললেন, আপনার মনের ভাব বুঝতে পারছি। আমি গায়ে পড়ে কারো ভবিষ্যৎ বলতে যাই না। নিজের শিক্ষার জন্যেই একবারটি মায়ের হাতখানা দেখতে চাইছি… একবারটি দেখান মা।

অগত্যা স্ত্রী আস্তে আস্তে বাঁ-হাত বাড়িয়ে দিলেন। ঝুঁকে বেশ নিবিষ্ট চোখে দেখলেন খানিক।—ডান হাতও একটু দেখি…

দেখলেন। তারপর সরে এসে আমার মুখোমুখি বসলেন। গম্ভীর ঠিক নয়, আরো বিষণ্ণ মনে হল।—আপনাকেও একটু বিরক্ত করব, ডান হাতটা একটু দেখান।

বিরক্ত নয়, আমার রেগে যাওয়ারই কথা। কিন্তু এই মুখের দিকে চেয়ে হাত কেন যেন আপনিই উঠে এলো। কম করে মিনিটখানেক দেখলেন উনি। তারপর পিছনে গা ছেড়ে দিয়ে বড় নিঃশ্বাস ফেললেন একটা। হাতের সিগারেটটা ধরালেন। স্ত্রী এখন উতলা মুখে তার দিকেই চেয়ে আছেন। সিগারেটে পর পর দু‘তিনটে টান দিয়ে বিষণ্ন গম্ভীর চোখে অবধূত আমার দিকে তাকালেন। ভারী গলায় বললেন, আপনাদের একমাত্র ছেলেটি বুঝি অনেককাল ভুগে কিছুদিন আগে চলে গেল…?

গায়ে কাঁটা-কাঁটা দিয়ে উঠল আমার। স্ত্রীও স্তব্ধ। অবধূত এই দুঃখের অতীত দেখার জন্য হাত দেখতে চেয়েছেন এ কে ভাবতে পারে! আমি বিস্মিত বিমূঢ় চোখে তাঁর দিকে চেয়ে আছি।…হ্যাঁ, হাত দেখার আগেও এঁকে বিষণ্ন মুখে চেয়ে থাকতে দেখেছি।

—আপনি হাত দেখে এটা বুঝে ফেললেন?

—হাত আমি খুব কমই দেখি।… দরকার হয় না। কাল রাতেও মায়ের ভিতরে আমি শোকের ছায়া দেখেছিলাম। আজও দেখলাম। শির হবার জন্য আজ হাত দেখতে চাইলাম।…কত বছর বয়েস হয়েছিল?

—আঠারো।

—অনেক দিনের পুরনো অসুখ?

—হ্যাঁ, মাসকুলার ডিসট্রফি… চৌদ্দ বছর ভুগে দেড় মাস আগে চলে গেল।

এবারে শান্ত মুখেই স্ত্রী জিগ্যেস করলেন, আপনার হাতে এলে আপনি কিছু করতে পারতেন?

—কিচ্ছু পারতাম না মা, কেউ পারত না।

নিজের অগোচরে একটু রুক্ষ স্বরে বলে উঠলাম, না পারলেও আপনারা পারার আশ্বাস দেন কেন? অভয় দ্যান কেন? সতেরো রকমের ক্রিয়াকলাপ করান কেন?

যে-ভাবে চেয়ে রইলেন, আমি নিজেই অপ্রস্তুত একটু। চাউনির মতো গলার স্বরও ঠাণ্ডা।—আপনি অনেকের কাছেই গেছলেন?

—আমার কোনদিনই এ-সবে খুব বিশ্বাস ছিল না…এ রোগের চিকিৎসা নেই শোনার পর স্ত্রীর ইচ্ছেয় যেতে হয়েছে। চুপচাপ বসে তো আর দেখতে পারি না। প্রচার আছে, ভারতবর্ষের এ-রকম প্রায় সব গড়ম্যানের কাছে ছেলে নিয়ে আমরা গেছি।

সিগারেট এরপর হাতেই পুড়তে থাকল। বিমনা মুখে ভদ্রলোক বাইরের দিকে চেয়ে রইলেন। সিগারেটের আগুন আঙুল ছুঁই-ছুই হতে ওটা ফেলে দিলেন। নিজের মনেই বার দুই বললেন, গড-ম্যান…গড-ম্যান আমার দিকে তাকালেন।—গড়ের হদিস কেউ কখনো পেয়েছে কিনা জানি না, কিন্তু এ-টুকু মনে হয়, পেলে তার আর গড-ম্যান হবার সাধ থাকে না।—আপনার বিচারে ভুল খুব নেই, তবু একটু আছে। মানুষ দুঃখ কষ্ট ভয় কারো না কারো কাছে জমা দিয়ে নিষ্কৃতি পেতে চায়। কিছু কাজ পেলে আমাদের গড-ম্যান তারাই বানায়। তাদের বিশ্বাসের পুঁজি বাড়তে থাকে।

—যেটুকু কাজ পায় তা হয়তো আপনাদের কাছে না এলেও পেতে পারত।

—নিশ্চয়ই পেতে পারত, কিন্তু সব-সময় নয়। আমাকেই ধরুন। আমি ওষুধে বিশ্বাস করি, কিছু ওষুধ নিজেও জানি।…আপনাদের মেডিক্যাল সায়েন্সের ওষুধের কথা বলছি না, ও ছাড়াও পৃথিবীতে কত রকমের ওষুধ আছে তা কে বলতে পারে? সে-রকম ওষুধ জানা থাকলে লোকের কাজ হয়।

—কিন্তু তার জন্যে কারো অবধূত কারো মহারাজ হয়ে বসার দরকার কি? ওষুধ দিলেই তো হয়? হাসলাম।

—আপনার খুব রাগ আমাদের ওপর। …কিন্তু আমাদের কাছে লোক এলে তবে তো ওষুধ! আসবে কেন? আসে ভয়ে, ভয় জমা দিতে। কিছু পেয়ে হোক বা অপরকে দেখে হোক, তার ভিতরে বিশ্বাসের প্রবণতা আসে।…এই বিশ্বাস কি জিনিস আপনি জানেন? আপদে-বিপদে এর মতো ক্যাটালিটিক এজেন্ট খুব কম আছে। সব ছেড়ে শুধু এই বিশ্বাসের জোরেই কত লোককে কত রকমের বিপদ কাটিয়ে উঠতে দেখেছি শুনলে আপনি অবাক হবেন। মাঝখান থেকে নাম হয়ে যায় আমাদের। আর পতনও হয় শুধু আমাদেরই। কারণ সেই অহঙ্কারে আমরাও ওদের দেওয়া গড-ম্যানের নামাবলীটা আঁকড়ে থাকি।

অবধূত সিগারেট ধরালেন।

আমি চেয়ে আছি। এমন সহজ যুক্তির কথা কম শুনেছি বটে। এই গোছের লোকের সঙ্গে এমন সদয় অথচ অন্তরঙ্গ আলাপের সুযোগও কম পেয়েছি। লোকটি যে দস্তুর মতো শিক্ষিত তাতেও ভুল নেই। নইলে ক্যাটালিটিক এজেন্টের উপমা দিতেন না। কিন্তু আমি সত্যিই অভিভূত হয়েছি ছেলের প্রসঙ্গের পর থেকে।

—কি দেখছেন?

বললাম, আপনার কিছু ক্ষমতা আছে।

এবারে চোখে কৌতুকের আভাস।—কি রকম?

—কাল আমার কপাল দেখে জন্ম মাস আর পেশা বলে দিলেন, স্ত্রীর হাই ডায়বেটিস বললেন আর তাঁর ভিতরে শোকের ছায়া দেখলেন, মেয়ের জিভ দেখে লিভারের কথা বললেন, আর আজ আমাদের এত বড় শোকের ব্যাপারটাও আপনি স্পষ্ট দেখতে পেলেন।

হেসে উঠলেন। —একটু-আধটু আছে অস্বীকার করছি না—কিন্তু জেনে রাখুন, এই ক্ষমতার একটুও ঐশ্বরিক নয়—এ-ও একটা সায়েন্স—এই সায়েন্স ফলো করলে আপনিও এই ক্ষমতার অধিকারী হতে পারেন— লোকের কাছে আমরা অবশ্য এটাকে ঐশ্বরিক ক্ষমতা বলেই ক্যাশ করে থাকি।

বড় ভালো লাগল। হাওড়া স্টেশনে গাড়িতে বসে ভক্ত সমাবেশে দেখে এই মানুষ যে এমন নিরহঙ্কার একবারও ভাবতে পেরেছি!

স্টেশন প্রায় এসেই গেছে খেয়াল করিনি। গাড়ির গতি খুব শ্লথ। অবধূত বললেন, এবারে গলা ভেজানোর তোড়জোড় করা যাক—আপনি ব্যস্ত হবেন না, ট্রেন থামলেই কার্তিকের শ্রীমুখ দেখা যাবে।

—বাবা আমারও চা নিও। ওপরের বার্থ থেকে মেয়ের গলা। গলার স্বর থমথমে। চেয়ে দেখি সে শেকলের কাছে কাত হয়ে অবধূতকেই দেখছে।

চোখ লাল-লাল।

অবধূত বললেন, যাক, ঠিক সময়ে তোমার ঘুম ভেঙেছে। চট-পট নেমে মুখ-হাত ধুয়ে এসো।

আমার মনে হল মেয়ে জেগেই ছিল। চুপ-চাপ নেমে এলো। তারপর অবধূতকে অপ্রস্তুত করে তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করল।

—এ কি গো মা! সকালে উঠেই প্রণাম কেন?

ভার-ভার গলায় মেয়ে জবাব দিল, আপনার কার্তিকের থেকেও আমি বেশি অপরাধ করেছিলাম—তাই।

তোয়ালে সোপ-কেস আর পেস্ট লাগানো টুথ-ব্রাশ হাতে করে বেরিয়ে গেল।

অবধূতের বিড়ম্বিত মুখ আরো কমনীয় দেখালো।—কি কাণ্ড, মেয়ে তো ওপরে শুয়ে আমাদের কথা সব শুনেছে!

বললাম, শোনার মতো কথা, শুনে ভালোই করেছে।

ট্রেন থামার এক মিনিটের মধ্যে পেটো কার্তিক হাজির। মেঝেতে সোজা শুয়ে পড়ে বাবার পায়ে মাথা রেখে প্রণাম সারল। তারপর উঠে আমার দিকে ফিরে বলল, আজ আর বঞ্চিত করবেন না সার, পায়ের ধুলো নিতে দিন। তারপর হাত ঠেলে সরিয়ে আমার স্ত্রীকেও একটা প্রণাম ঠুকে উঠল।

ব্রেকফাস্টের মেনু ব্রেড-বাটার, ডবল ডিমের পোচ, ছ’পট চা আর কলা পেলে কলা। আর ছোট এক পট চা চিনি ছাড়া।

স্ত্রী মেয়ের দিকে চেয়ে এক আঙুল দেখিয়ে ইশারা করতে ও বলল, মা সিঙ্গল পোচ খাবে বলছে, আমার কিন্তু ডবলই চাই।

পেটো কার্তিক গজ গজ করে উঠল, এখন কলার খোঁজ-ডালা ভরতি ফল কাল সব দাতব্য করে বসলেন!

আমরা হাসছি। অবধূত বললেন, তুই কিছুই সরিয়ে রাখিসনি বলতে চাস?

—বাদাম আখরোট কিসমিস আছে, বিস্কুট আছে, মেওয়ার সন্দেশ আছে, চানাচুর আছে।

অবধূত টিপ্পনীর সুরে বললেন, ডিম টোস্ট কলা আর ওইসব দিয়েই কষ্ট করে ব্রেক-ফাস্টটা সেরে ফ্যাল কি আর করবি?

এই ছেলেটাকেও আজ আমার ভালো লাগছে। বোমা-বাজ ছেলেটাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে ভদ্রলোক ভালো ছাড়া মন্দ কি করেছেন। চা-পর্ব শেষ হবার বেশ আগে ট্রেন ছাড়ল। পেটে। কার্তিক জোর করেই দিদিকে কলা মিষ্টি খাওয়ালো, একটা মাত্র মিষ্টি খেলে মায়ের ক্ষতি হবে কিনা জিগ্যেস করল—হবে শুনে তাঁর ডিশে অনেকটা চানাচুর ঢেলে দিল। চায়ের সঙ্গে খান, বেশ ভালো চানাচুর।

এই অন্তরঙ্গ খুশির হাওয়া আমরা ভুলতে বসেছিলাম।

খাওয়া শেষে ট্রে-তে জিনিসপত্র গোছ-গাছ করে একদিকে সরিয়ে রেখে পেটো কার্তিক বলল, দিদি আপনার কালকের সেই বইখানা দেবেন, সারের গল্পটা পড়ে ফেলি—

বলার ধরনটা আমাকে একটু অনুগ্রহ করার মতো। দিদি বই বার করে দিল।

অবধূতকে জিগ্যেস করলাম, আপনি আপাততঃ তাহলে দেরাদুনেই থাকছেন কিছুদিন?

—দিন পনেরোর বেশি নয়, তার মধ্যে দিন দুই মুসৌরিতেও কাটানোর ইচ্ছে আছে।

—আমার আবার চেঞ্জ, যাচ্ছি এক ভক্তর টানা-হেঁচড়ায়।

বইয়ের দিকে চোখ, পেটো কার্তিকের গম্ভীর মন্তব্য।—ভক্ত টাকার আণ্ডিল, কিন্তু হাড় কেপ্পন, আমার সেকেণ্ড ক্লাসে যাবার ভাড়া পাঠিয়েছে …ফাঁক পেলে আমি ঠিক শুনিয়ে দেব।

অবধূত হাসি চেপে ধমকে উঠলেন, যেটুক জোটে তাতেই খুশি থাকতে পারিস না কেন?

তেমনি গম্ভীর উত্তর। —পারলে আর চেলাগিরি করব কেন, বাবাই হয়ে বসতাম।

মেয়ে তো বটেই আমার স্ত্রী-সুদ্ধ হেসে ফেললেন। গুরু-শিষ্যের এমন সদালাপও কম শোনা যায়।

অবধূত জিগ্যেস করলেন, আপনি হরিদ্বারে কতদিন থাকবেন?

—ভালো লাগলে ওই-রকমই—দিন পনেরো।

দু‘চার দিনের জন্য দেরাদুনে চলে আসুন না—ভালোই লাগবে।

—আগে গেছি। ওখানে যাবার মতো গরম জামা-কাপড় সঙ্গে আনিনি, আমার আবার অল্পেতে ঠাণ্ডা লাগার ধাত · হরিদ্বারেই নিরিবিলিতে দিন কতক কাটিয়ে আসব, তাছাড়া এখন বেড়ানোর মন খুব নেই।

—হরিদ্বারে থাকছেন কোথায়, কংখল রামকৃষ্ণ মিশনে?

—সে রকমই ইচ্ছে।

—ইচ্ছে মানে···লিখে জায়গা বুক করেননি?

—এবারে হঠাৎ বেরিয়ে পড়লাম, সেটা করা হয়নি।

—তাহলে তো মুশকিল, জায়গা পাবেন মনে হয় না। হাতের সিগারেট জানলা দিয়ে ফেলে দিয়ে হেসে বললেন, না মশাই আমি কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করছি না—এই সময় থেকেই সেখানে যাত্রীর ভিড় হতে থাকে—মহারাজদের সঙ্গে জানাশোনা আছে?

—তা আছে, কিন্তু ঘর খালি না থাকলে আর জায়গা দেবেন কোথা থেকে…তখন ভালো কোনো ধরমশালায় ওঠার চেষ্টা করব।

—কেন, মনের এই অবস্থা নিয়ে আপনি একজন গুণী মানুষ যাচ্ছেন— তাঁদের নিজেদের কারো ঘর ছেড়ে দেওয়া উচিত।

হেসে জবাব দিলাম, সেই উচিত কাজটি তাঁরা করতে যাচ্ছেন বুঝলে আমি আগেই পালাব।

অবধূত বললেন, দেখুন পান কিনা, না পেলেও কিছু অসুবিধে হবে না, ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

বই থেকে মুখ না তুলে পেটো কার্তিক মন্তব্য করল, মুখ দিয়ে যখন একবার বেরিয়েছে কংখলে ঘর পাবেন না—পাবেন না।

এবারে সত্যিই ধমকের সুরে অবধূত বললেন, তোর চোখ কোন্ দিকে আর কান কোন্ দিকে।

নিরুত্তর। নির্লিপ্ত।

ট্রেন মোগলসরাই পৌঁছতেও প্রায় ঘণ্টাখানেক লেট। গাড়ি থামতেই দু‘রকমের ব্যাজ আর তকমা-পরা লোকের তৎপর আনাগোনা শুরু হয়ে গেল। বেনারসে লাঞ্চ। অর্ডার নেবে। ট্রেন এক ঘণ্টার ওপর লেট হয়ে এক-দিক থেকে ভালোই হল। ঠিক সময়ে অর্থাৎ সাড়ে বারোটা নাগাদ লাঞ্চ পাব। একটা লোক আমাদের কেবিনে মুখ বাড়াতে তাকে ডাকলাম। সকলের লাঞ্চও ‘অন্ মি‘ই করতে চাই। এবং সেটা খুশি মনেই।

কিন্তু আমাকে অবাক করে অবধূত তাকে বলে দিলেন, দরকার নেই, যাও।

চলে গেল। আমি বললাম, সে কি, বেনারসে লাঞ্চ হবে না?

—হবে আশা করা যায়…সেখানে গিয়ে দেখা যাক না কি জোটে। —কিন্তু বেনারসে আধ-ঘণ্টা স্টপ, তখন অর্ডার দিয়ে কিছু পাওয়া যাবে? মুচকি হাসলেন। মেয়ের দিকে চেয়ে বললেন, তোমার বাবার বোধহয় বেজায় খিদে পেয়ে গেছে, বেনারসে কিছু না জুটলে বিপদেই পড়ে যাব দেখছি…।

বইয়ের দিকে চোখ, পেটো কার্তিকের ঠোঁটেও হাসি ঝুলছে।

অবধূত তেমনি হেসেই আবার বললেন, সকালের ব্রেকফাস্ট তো আপনার ওপর দিয়ে হয়ে গেছে, এরপর কাল হরিদ্বার পর্যন্ত যা কিছু সব আমাদের অদৃষ্টের ওপর দিয়েই হয়ে যাবে—আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।

বুঝলাম বেনারসে কারো কাছ থেকে খাবার আসবে। তবু অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। প্রথমত, এতে ঠিক অভ্যস্ত নই। দ্বিতীয়ত কলকাতা বা হাওড়া থেকে না হয় নিজে টিফিন ক্যারিয়ার বোঝাই করে খাবার এনেছিলেন। কিন্তু এখানে আবার তিনজন বাড়তি লোকের খাবার কে জোগাবে?

ট্রেন ছাড়লে মোগলসরাই থেকে বেনারস সামান্যই পথ। · মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। তার আগেই পেটো কার্তিকের আমার গল্প পড়া শেষ। মেয়েকে বই ফেরত দিতে দিতে বলেছে, ফার্স্ট ক্লাস আর একবার সারের পায়ের ধুলো নিতে ইচ্ছে করছে।

আর অবধূত হেসে মন্তব্য করেছেন, কার্তিককে কিন্তু হেলা ফেলা করবেন না—দস্তুর মতো বি. এ. ফেল। তাঁর এই কথার মধ্যেই বেনারস এসে গেল। পেটো কার্তিকও চটপট উঠে পড়ল।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে তিনজন বয়স্কা মহিলা আর তিনজন বয়স্ক ভদ্রলোককে নিয়ে ফিরল। দেখলেই মনে হয় সকলেই অবস্থাপন্ন এঁরা। মহিলাদের বেশ-বাসের আড়ম্বর তেমন নেই, হাতে এক গাদা করে চুড়িবালা-আঙটি, গলায় মোটা হার, কানে হীরের দুল, দু‘জনের নাকে হীরের ঝকঝকে নাক-ফুল। ভদ্রলোকদের পরনে পাট-ভাঙা ধুতি আর সিল্কের পাঞ্জাবি, ঝকঝকে সোনার বোতাম, কব্জিতে সোনার ব্যাণ্ডের ঘড়ি। আর প্রত্যেকের আঙুলে একটা করে হীরের আঙটি। মহিলাদের তিনজনেরই হাতে একটা করে প্যাকেট।

তাঁদের দেখে অবধূত হাসি মুখে উঠে দাড়ালেন। ভদ্রলোকদের একজন জিগ্যেস করলেন, বাবার ট্রেনে কোনোরকম অসুবিধে হচ্ছে না?

—কিচ্ছু না। তোমাদের মতো আপনারজনেরা থাকতে অসুবিধা করে কার সাধ্যতা ভালো আছ তো সব? মায়েরা ভালো? ছেলে-মেয়েদের আনোনি বুঝি—

সামনে মহিলারা। একজন বললেন, ওদের সকলেরই স্কুল কলেজ আপনার ফেরার সময় দর্শন করবে।

হাতের প্যাকেট পায়ের কাছে রেখে তিনিই প্রথম মাথা রেখে প্রণাম করলেন। উঠতে দেখা গেল, পায়ের কাছে দু‘ভাঁজ করে একশ টাকার নোট—একাধিক তো বটেই।

একে একে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় মহিলাও প্যাকেট পায়ের কাছে রেখে ওই ভাবে প্রণাম করলেন। তাঁরাও ভাঁজ করা নোট রেখেছেন।

প্রণাম শেষ হতে অবধূত হাত দেখিয়ে তাঁর দিকের বার্থে বসতে বললেন। তাঁরা বসতে ভদ্রলোক তিনজন একে একে পায়ে কপাল ছুঁয়ে প্রণাম করে উঠলেন। সামনের জন পিছনের জনকে বললেন, বাবার খাবার নিয়ে ওরা দরজায় দাঁড়িয়ে আছে, আনতে বলে।

তিনি ও-দিক ফিরতে আমরা সরে গিয়ে বাকি দু‘জনের বসার জায়গা করে দিলাম। অবধূত হাসি মুখে মহিলাদের মাঝখানে বসে তাঁদের বললেন, বোসে৷—এবারে আমি মস্ত এক গুণীজনের সঙ্গে সফর করছি— ইনি সাহিত্যিক ওমুক…এঁরা তাঁর স্ত্রী আর মেয়ে। মহিলাদের জিগ্যেস করলেন, এঁর লেখা তোমরা পড়েছ?

বয়েস যার একটু কম তিনি হেসে জানান দিলেন, আমি অনেক বই পড়েছি, অনেক গল্পের সিনেমাও দেখেছি বড় নিঃশ্বাস ফেলে অবধূত বললেন, আমিই হতভাগা দেখছি—

যিনি বেরিয়ে গেছলেন তিনি একটা টিফিন-ক্যারিয়ার হাতে ফিরলেন, তার পিছনে দু‘জন লোকের হাতে বড়সড় দুটো করে ঝকঝকে কাঁসার পরাতের মতো, তার ওপর এনামেলের থালার ঢাকনা। জায়গা করার জন্য তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে পেটো কার্তিক প্যাকেটগুলো আর তিন গোছা নোট তুলে নিল। লোক দুটো কাঁসার দু‘জোড়া ঢাকা পরাত মেঝেতে রাখল, এগুলোর পাশে ভদ্রলোকের হাতের টিফিন-ক্যারিয়ার।

অবধূত বললেন, এত কি এনেছ—অ্যা?

সামনের ভদ্রলোক হাত জোড় করে বললেন, মাছ আর গরম ভাত — আর কিছু না। একটু মাংস আনার ইচ্ছে ছিল, তা কার্তিকবাবু চিঠিতে জানালেন—মাংস আনার দরকার নেই, আর কলকাতায় পাকা পোনাই খেতে হয়—

বাবার জন্য অন্য মাছের ব্যবস্থা করাই ভালো।

অবধূত হাঁ করে কার্তিকের দিকে চেয়ে রইলেন একটু। আমার দিকে চেয়ে’ বললেন, ওর কর্তামো দেখুন।

হাত জোড় করে ভদ্রলোক হাসি মুখে কার্তিকের সহায় হলেন, এটা কার্তিকবাবুর সঙ্গে আমাদের ব্যাপার, উনি কেবল আমাদের অনুরোধ রক্ষা করেছেন।

বেশ করেছে। নে এ-সব কোথায় রাখবি এখন দ্যাখ, বাসনগুলো চটপট খালি করে দে একজন মহিলা বাধা দিলেন, ট্রেনে আবার বাসন খালি করবে কি করে, সব নষ্ট হয়ে যাবে—সঙ্গেই যাক, আপনার ফেরার সময় আমরা নিয়ে নেবার ব্যবস্থা করব।

এরপর খানিক ঘরোয়া প্রসঙ্গ আর ব্যবসার প্রসঙ্গে কথা হতে হতে গাড়ি ছাড়ার সময় হয়ে গেল। আর একবার পায়ের ধুলো নিয়ে ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলারা নেমে গেলেন। ট্রেন ছাড়ল।

এবারের ব্যাপারটা কিন্তু হাওড়া স্টেশনের মতো খারাপ লাগল ন!। এই মানুষটিকে নিয়ে আমার আগ্রহ বাড়ছে। অনেক লোক যার কাছে আসে তাঁর ওপর ঈশ্বরের বিশেষ দান কিছু থাকেই—শ্রীরামকৃষ্ণ এই গোছের কি-যেন বলেছিলেন। এই মুহূর্তে কথাটা মনে পড়ল কেন জানি না।

পেটো কার্তিক গম্ভীর মুখে বসে পকেট থেকে তিন থাক নোট বার করে গুনছে। অবধূত তার দিকে চেয়ে মিটি মিটি হাসছেন আর সিগারেট টানছেন। এক-এক থাকে পাঁচখানা করে একশ টাকার নোট আর একটা এক টাকার। সব মিলিয়ে পনেরশ’ তিন টাকা। পেটো কার্তিক সবগুলো একসঙ্গে ভাঁজ করে এবারে নিজের প্যান্টের বাঁদিকের পকেটে গুজল। তারপর প্যাকেটগুলো খুলল। প্রত্যেক প্যাকেটে চকচকে টকটকে লাল সিল্কের চেলি আর কোয়ারটার হাত সিল্কের ফতুয়া। সেগুলো আবার প্যাকেটে রেখে পেটো কার্তিক বড় করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। বলল, আমি যে, একটা লোক বাবার সঙ্গে থাকি এ কারোর চোখেই পড়ে না।

আমরা হেসে উঠলাম। আলতো করে বাবা বললেন, টাকা-কড়ি তো সব আগের ভাগে তুই-ই হাতিয়ে নিস —হু, আমি চিনির বলদ।

অবধূত ছদ্ম কোপে চোখ রাঙালেন, এই হারামজাদা, ওই টাকা থেকে তুই বিড়ি, সিগারেট, চপ, কাটলেট খাস না?

লজ্জা পেয়ে পেটো কার্তিক চার আঙুল জিভ কাটলো। তারপর টিফিনক্যারিয়ারের গায়ে হাত রেখে বলল, ভাত গরম আছে, আর দেরি করে কি হবে?

এক-একটা পরাতের ঢাকনা খুলতে আমাদের চক্ষু স্থির। প্রথমটাতে একগাদা বড় বড় মাছের ফ্রাই। তার নিচেরটাতে চিতল মাছের পেটির কালিয়া। ছ’পিস আছে, এক-এক পিসের ওজন আড়াইশ’র কম হবে না। তার পরের পরাতে আধ-হাতেরও বড় এক-একটা পাবদা মাছ—সর্ষের ঝাল। সে-ও আট ন’পিস হবে। ওটার নিচের পরাতে তোপসে মাছের পাতলা ঝোল—এও দেখার মতো সাইজ, গোটা বারো চোদ্দ হবে। দেখেই আমার মাথা ঝিমঝিম করছে। ওই সাইজের দুটো ফ্রাই আর একখণ্ড করে চেতল মাছের পেটি খেলে পেট টাই হবার কথা।

অবধূত হাসছেন, এ-সব মাছ আনার জন্য তুই চিঠি লিখে জানিয়ে দিয়েছিলি?

হৃষ্টবদন পেটো কার্তিক জবাব দিল, তা কেন, আপনি যাচ্ছেন জেনে ওঁরাই আমাকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, বেনারস স্টেশনে আপনার দুপুরের খাবার নিয়ে আসবেন বাবা কি-কি আনলে পছন্দ করবেন। আমি শুধু লিখে দিয়েছিলাম, পাক৷ পোনা আর মাংস বাদে অন্য সব মাছই বাবা ভালো খাবেন—মাংস আর পোলাউ তো লক্ষ্ণৌয়ের পার্টি নিয়ে আসবেন। আমার মেয়ে হঠাৎ খিল-খিল করে হেসে উঠল। হাসি থামতেই চায় না। তারপর অবধূতের দিকে চেয়ে বলল, এরপর আপনার কবে কোথায় যাবার প্রোগ্রাম হয় আমাদের আগে থাকতে জানাবেন তো! অবধুত হেসে সায় দিলেন, জানাবেন।

আমি বললাম, তা তো হল, দু‘জনের জন্য ওঁরা এই খাবার এনেছেন?

পেটো কাৰ্তিক জবাব দিল, তা না, পথে কারো না কারো সঙ্গে বাবার আলাপ হয়ে যায়ই, আর বাবা না দিয়ে থুয়ে খান না, এ সব ভক্তরাই জানেন।

সকলে গলা পর্যন্ত খেয়েও সবই বেশি হল। আমার পরের কথায় আর কেউ না হোক স্ত্রী অসন্তুষ্ট হলেন। বলেছিলাম, যা রইলো তার কিছু রাতে কাজে লাগতে পারে—আমার স্ত্রী মাংস খান না।

অবধূত ব্যস্ত হয়ে পরিষ্কার মতো টিফিন-ক্যারিয়ারে সরিয়ে রাখতে বললেন। আমার দিকে চেয়ে স্ত্রী রাগ করেই জিগ্যেস করলেন, এরপর রাতে আর দরকার হবে?

মেয়ে জানান দিল, আমার অন্তত দরকার হবে না।

অবধূত বললেন, রাতের কথা রাতে—তোমার মা এক-এক পিসের বেশি কিছুই খাননি, তোপসে মাছ পাতেই নেননি।

মেয়ে ছেলেমানুষের মতো জিগ্যেস করে বসল, আচ্ছা আপনি কি রোজই এ-রকম খান?

জবাব দিল পেটো কার্তিক। — সপ্তাহের মধ্যে অনেক রাত বাবার খাওয়াই হয় না। শনি মঙ্গলবার তো কোনো না কোনো শ্মশানে কাটান, অন্যবারেও এক-একদিন ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকেন, তখন মা-ও ডেকে বিরক্ত করেন না—তাছাড়া ঘরে বাবা শাক-ভাত ডাল-ভাত সমান আনন্দ করে খান—তখন আমার আবার বেজায় কষ্ট।

মুখের সিগারেট নামিয়ে অবধূত বললেন, এই, তোকে কি আমার পাবলিসিটি অফিসার রেখেছি?

…এরপর ভক্ত আর ভক্তি দেখলাম লক্ষ্ণৌ স্টেশনে, আর দেখলাম পরদিন সকালে হরিদ্বারে পৌঁছেও। হরিদ্বারের ভক্তদের মধ্যে যে প্রৌঢ়টি বিশিষ্ট, তাঁর নাম পুরুষোত্তম ত্রিপাঠী। ইউ. পি-রই মানুষ। অনেক ফলমূল আর মিষ্টি নিয়ে এসেছে। আর এসে পর্যন্ত দু‘হাত জোড় করেই ছিলেন। অবধূত তাঁকে ডেকে বন্ধু বলে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ভদ্রলোক পরিষ্কার বাংলা বলতে পারেন। তাঁকে জিগ্যেস করলেন, তোমার সঙ্গে গাড়ি আছে তো?

—জি মহারাজ।

—স্ত্রী আর মেয়ে নিয়ে ইনি দিন পনেরো হরিদ্বারে থাকবেন। কংখলে শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রমে ওঠার কথা, তুমি এদের সঙ্গে করে কংখলে নিয়ে যাও —সেখানে ঘর না পেলে তোমার বাড়িতে নিয়ে তুলবে— আমার ঘর দুটো ছেড়ে দেবেপারি তো আমিও একবার দেরাদুন থেকে নেমে এসে দেখে যাব’খন।

তাঁর ঘর ছেড়ে দেওয়া আর নিজে এসে দেখে যাওয়ার কথা শুনেই হয়তো আমাকে মস্ত কেউ ধরে নিলেন। হাত জোড় করে মিনতির সুরে বললেন, উনি কংখল যাবেন কেন—আমার গরীবথানায় নিয়ে তোলার অনুমতি দিন।

আমি তাড়াতাড়ি বললাম, আপনারা ব্যস্ত হবেন না, আগে কংখলেই যাই, ঘর না পেলে কোনো ধরমশালা বা হোটেলে উঠব।

অবধূত বললেন, এঁরই দু‘দুটো হোটেল আছে এখানে—কিন্তু মা ডায়বেটিক রোগী, হোটেলে অসুবিধে হবে আপনার অসুবিধে বুঝতে পারছি, আপনি না-হয় খাওয়া দাওয়ার বাবদ কিছু মূল্য ধরে দেবেন—

কাতর মুখে পুরুষোত্তম ত্রিপাঠী বললেন, মহারাজ, কৃপা করে এ-রকম বলবেন না, আপনার দৌলতে আমার ভাগ্য—এই মহান মেহমানকে একটু সেবা করার আদেশ করুন।

মুচকি হেসে অবধূত জবাব দিলেন, তোমার এই ভাগ্যটা আমার হাতে নেই—দেখো কি হয়। আর দেরি কোরো না, এঁরা খুব ক্লান্ত।

ঝকঝকে অ্যামবাসাডারের দরজা খুলে হাত জোড় করে পুরুষোত্তম ত্রিপাঠী জিগ্যেস করলেন, কংখলেই যেতে হবে?

আমিও হাত জোড় করে জবাব দিলাম, আপনার এত ব্যস্ত হবার মতো আমি কেউ নই…এখানে এলে বরাবর কংখলেই উঠি… জায়গা পেলে সেখানেই থাকব।

—জায়গা পেলে কেন, ঘর বুক করা নেই? —তা নেই, হঠাৎ চলে এসেছি।

শুনেই দুহাত কপালে ঠেকালো। — জয় মহারাজ! চলুন তাহলে— মহারাজেরই জয় বটে। কংখলের আশ্রমে অতিথি উপছে পড়ছে। সব ঘর ভরতি। তিন চারটে ফ্যামিলি ওয়েটিং লিস্ট-এ থেকে একদিন দু‘দিনের জন্যে হোটেলে আছে। আগে জানিয়ে আসিনি বলে এখানকার বড় মহারাজ দুঃখ করলেন! আর কোথায় উঠব তা-ও তাঁকে জানাতে বললেন।

আবার পুরুষোত্তম ত্রিপাঠীর গাড়িতে। ভদ্রলোক বেজায় উৎফুল্ল। তিনি সামনে, ড্রাইভারের পাশে। পিছনে আমরা। ঘুরে আমার দিকে চেয়ে বললেন, আমি একটু নির্বোধ আছি।

—কেন?

মহারাজ যখন বললেন, কংখলে জায়গা না পেলে আমার বাড়িতে তাঁর ঘর দুটো ছেড়ে দিতে তখনই বোঝা উচিত ছিল, কংখলে আপনি জায়গা পাবেন না।

আড় চোখে মেয়ে আর স্ত্রীর দিকে তাকালাম। ভদ্রলোকের দিকে চেয়ে বিশ্বাসের রূপ দেখছে তারাও।—এমন বিশ্বাস মানুষের কি করে হয়? কি পেলে হয়? এই ভারতের তো আমি অনেকটাই দেখেছি। মানুষ দেখেছি। হিংসা-বিদ্বেষ-আক্রোশ দেখেছি। ত্যাগ-উদারতা-উদাসীনতাও কম দেখিনি। এর মধ্যে হঠাৎ-হঠাৎ মনে হয়, এক-একজনের এমন কিছু সম্পদ আছে যা আমার নেই। সেটা অর্থ বা প্রতিপত্তি নয়। যা নেই তা এই আপোস শূন্য বিশ্বাস। যে বিশ্বাসকে অনেক সময় আমার অন্ধ আর অহেতুক মনে হয়। কিন্তু সার ফলটুকু কি? এরা ঠকছে না আমি ঠকছি?

হঠাৎ একটু যাচাই করার লোভ মাথায় চাপল। বললাম, আমার স্ত্রী ডায়বেটিক পেশেন্ট, তাঁর খাওয়া দাওয়ার একটু আলাদা ব্যবস্থা করতে হবে—আপনি হোটেলে যেমন চার্জ করেন তেমনি চার্জ করতে হবে… নইলে আপনার ওখানে থাকা আমার পক্ষে সুবিধে হবে না—অবধূতজীও তাঁ আপনাকেও মূল্য নিতে বলেছেন।

অম্লান বদনে জবাব দিলেন, নেব, মহারাজার আদেশ অমান্য করব নাকিন্তু কত মূল্য তিনি বলেননি, আপনি এক টাকা দেবেন।

একে আর কিভাবে যাচাই করব আমি? তবু বললাম, আপনি একটা বড় ভুল করছেন, অবধূতজীর সঙ্গে প্রথম আলাপ হাওড়া স্টেশন থেকে গাড়ি ছাড়ার পরে—তার আগে কেউ কাউকে চোখেও দেখিনি!

সাদা-সাপটা জবাব, আপনাকে দেখার জন্য মহারাজ দেরাদুন থেকে নেমে আসতে পারেন বলেছেন… আপনাকে নিজের ঘর ছেড়ে দিতে বলেছেন—আপনি কি লোক বা কতদিনের আলাপ আমার আর জানার দরকার নেই—আপনার সঙ্গে তাঁর কত জন্ম-জন্মান্তরের আলাপ আপনি জানছেন কি করে?

—ঈশ্বর, তুমি কি কোথাও আছ? যদি থাকো তো বলব, তুমি আমার অনেক নিয়েছ, কিন্তু দিয়েছও অনেক। শুধু এই বিশ্বাসটুকু দিলে না কেন? বিশ্বাসের এমন সহজ জোর থেকে আমাকে বঞ্চিত করলে কেন? হর-কি-পিয়ারীর কাছাকাছি সুন্দর বাড়ি পুরুষোত্তম ত্রিপাঠীর। ঝকঝকে তকতকে বাড়ি। শ্বেতপাথরের মেঝে। অবধূত বছরে দু‘বছরে একবার হরিদ্বারে আসেন। তাঁর জন্য নির্দিষ্ট এই দুটো বিশাল ঘর শুধু তখনই ব্যবহার করা হয়। এই প্রথম ব্যতিক্রম। ঘর দুটো আমি দখল করেছি। অ্যাটাচড়, বাথ। আরামের সমস্ত উপকরণ মজুত।

চারদিক দেখে নিয়ে স্ত্রী একটা খাটে বসলেন। বললেন, আমার বড় অদ্ভুত লাগছে।

জিগ্যেস করলাম, কেন?

জবাব দিলেন, কি জানি।… কেবল মনে হচ্ছে, দুদিন যাঁকে ট্রেনে দেখলাম, তাঁর কিছুই জানা হল না।

মেয়ে সায় দিল। সত্যি মা, কত তো দেখলাম, কিন্তু এ-রকম মানুষ তো কোথাও দেখিনি।…বাবা তুমি এঁকে নিয়ে কিছু লিখবে?

হেসে বললাম, কি জানি যে লিখব? কেবল তাঁর কল্যাণে তোফা খেলামদেলাম আরামে এলাম—আর এখনও তাঁর জন্যেই রাজসিক অভ্যর্থনা।

কিন্তু জানি, এ-টুকুই আমার মনের কথা নয়।

পুরুষোত্তম ত্রিপাঠীর আদরে যত্নে আমরা ব্যতিব্যস্ত। দশ পা রাস্তায় হাঁটার উপায় নেই। তাঁর গাড়ি সর্বদাই আমাদের জন্য মজুত। খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে তিনি শুধু বুঝে নিয়েছেন, রান্নায় আলু আর মিষ্টি চলবে না। হরিদ্বারে কোথাও আমিয চলে না। নিরামিষ আহারের এত আয়োজন যে, খেয়ে উঠতে পারি না, ফেলতেও পারি না।

পুরুষোত্তম ত্রিপাঠী নিজেই নিজের গল্প করেছেন। নিজের গল্পের মধ্যে অবধূতজীর মাহাত্ম্যের কথাই সব। তাঁকে প্রথম দেখেছিলেন হর-কি-পিয়ারীর ঘাটে, ব্রহ্মকুণ্ডুর পাশে। ত্রিপাঠীর তখন ভিকিরি দশা। বছর একুশ-বাইশ বয়েস। ধরমশালায় কোনোদিন খাওয়া জোটে কোনোদিন জোটে না। নিজের বাপ-মা নেই। দিল্লিতে কিছু আত্মীয়-স্বজন আছে, হাইস্কুল পাশ করার পরে কাজ জোটাতে পারেনি বলে আর আশ্রয়ও মেলেনি। ঘুরতে ঘুরতে ভবঘুরের মতো চলে এসেছিলেন হরিদ্বারে। হরির দরজায় এসে যদি কিছু হয়।

…হবার মতো আশার ছিটে ফোটাও দেখেন না। ভিক্ষে করতে পারেন না। আত্মহত্যা করে যন্ত্রণা শেষ করার মতো মনের জোরও পান না। এই সংকল্প নিয়ে মনসা পাহাড়ে গিয়ে উঠলেন একদিন। মনে হল কে যেন তাঁকে ঠেলে নামিয়ে দিল।

…নেমে আসতে হর-কি-পিয়ারীর ঘাটে মহারাজের সঙ্গে দেখা। তিনি নয়, মহারাজই তাকে কখন দেখেছেন কতক্ষণ দেখেছেন জানে না। কাছে ডাকলেন। তারপর এমন চেয়ে রইলেন মনে হল ভিতরশুদ্ধ, ফালা ফালা করে দেখছেন। চাপা ধমকের সুরে বলেছেন, হরির দরজায় এসে মাথায় বদ মতলব নিয়ে ঘুরছ কেন — পবিত্র স্থানকে কলংকিত করার জন্য এখানে এসেছ?

…মহারাজের সঙ্গে তখন দ্বিতীয় কেউ নেই। তিনি একা। পুরুষোত্তম ত্রিপাঠী তিন দিন তাঁর সঙ্গে তাঁর কাছেই কাটালেন। তারপর মহারাজ যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে তাঁকে বললেন তুমি এখানে ছোট করে একটা হোটেল খোলো, লোক ঠকিও না।

ত্রিপাঠী বিমূঢ়। এক পয়সার সম্বল নেই, তিনি হোটেল খুলবেন কি! মহারাজ নগদ পাঁচশ টাকা তাঁর হাতে দিলেন। বললেন, এই দিয়ে শুরু করো, আমি আবার এসে দেখব তুমি কতটা কি করলে।

পঁয়ত্রিশ বছর আগে হরিদ্বারের এই চেহারা ছিল না। ছোট বড় ধরমশালা ছিল বটে, কিন্তু হোটেল নাম মাত্র। যাত্রীর মৌসুমে লোকের থাকার জায়গা খাওয়ার জায়গা মেলে না। একটি মাত্র রান্নার লোক আর একটা চাকর রেখে ছাপরা ঘরে হোটেল শুরু করেছিলেন। শুধু খাওয়ার ব্যবস্থা। নিজেই হাট-বাজার করতেন। লোকের খাওয়ার সময় সামনে দাঁড়িয়ে তদারক করতেন। মহারাজের কৃপায় সেই থেকে আজ তাঁর এই অবস্থা—দুটো বড় হোটেলের মালিক তিনি, এই বাড়ি, গাড়ি।

এ যাত্রায় কালীকিংকর অবধূতের সঙ্গে আবার দেখা হবে ভাবিনি। ত্রিপাঠীর কাছ থেকে আমি তাঁর ঠিকানা চেয়েছিলাম। শুনলাম তিনি কলকাতায় থাকেন না। কোন্নগরে থাকেন। স্টেশন থেকে এক মাইলের কিছু বেশি হবে পথ। শ্মশানের কাছাকাছি। স্টেশনে নেমে সাইকেল রিকশঅলাকে অবধূতজীর বাড়ি বললেই সে নিয়ে যাবে।

…কিন্তু শুরু থেকে আমাদের এবারের সম্পূর্ণ যাত্রাটাই যেন আর কারো নিয়ন্ত্রণের ছকে বাঁধা ছিল। তেরো দিনের মাথায় অবধূত সত্যিই পেটো কার্তিককে নিয়ে হরিদ্বারে হাজির! আসছেন সে খবর অবশ্য আগের দিনই পেয়ে গেছলাম। সকলে মিলে তাঁকে স্টেশনে আনতেও গেছলাম। ত্রিপাঠীর মুখ দেখে মনে হয়েছিল এমন আনন্দের দিন তাঁর জীবনে বেশি আসেনি। আমার প্রতি দারুণ কৃতজ্ঞ। কারণ কোন্নগর থেকে তিনি চিঠিতে জানিয়ে ছিলেন, এ যাত্রায় তাঁর হরিদ্বারে থাকা হবে না। ত্রিপাঠীর বদ্ধ ধারণা, আমার জন্যই তাঁর এমন সৌভাগ্য।

অবধূতকে বলেছিলাম, আপনি সত্যি আসবেন ভাবিনি।

তিনি হেসে জবাব দিয়েছেন, স্বার্থ ছাড়া কেউ এক পা নড়ে! দেরাদুনে তিনটি বাঙালী পরিবার আমার ভক্ত। সেখানকার গিন্নিরা আর ছেলে

মেয়েরাও দেখলাম আপনার লেখার ভক্ত-তা আমি ভাবলাম আপনাদের মতো গুণীজনদের সঙ্গে দহরম-মহরম আছে দেখলে আমার প্রেস্টিজ বাড়বে, খাতির কদরও বাড়বে—সেই লোভেই চলে এলাম।

হেসে বলেছি, সাহিত্যিক না হলেও আপনি বাক্-পটু আমার থেকে ঢের বেশি।

…এই মানুষের প্রতি আমি ট্রেনেই আকৃষ্ট হয়েছিলাম। সেই আকর্ষণ হরিদ্বারের দু‘দিনে আর ফিরতি ট্রেনে একসঙ্গে আসার দু‘দিনে কত যে বেড়েছে আমিই জানি। ত্রিপাঠীর এখানে যা প্রভাব, অবধূত মুখের কথা আসাতে তিমি একই কুপেতে ফেরার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আমাদের টিকিট করাই ছিল, কেবল অবধূতের বার্থ অদল-বদল করে নেওয়া।

হরিদ্বারে বা ট্রেনে আমাদের কোনোরকম আধ্যাত্মিক বা তন্ত্রমন্ত্রের আলোচনা হয়নি। তার থেকে রসের কথা ঢের বেশি হয়েছে। রাতের নিরিবিলিতে দু‘জনে ত্রিপাঠীর ওখানে বোতল নিয়েও বসেছিলাম। আমারও একটু আধটু চলে দেখে উনি মহা খুশি। তখনই কথায় কথায় বলেছিলেন, এর মতো জিনিস আছে মশাই—বছর চারেক আগে বিহারের কাকুরঘাটি মহাশ্মশানে আমি টানা প্রায় তিন বছর কাটিয়েছি—সেখানে বেশিরভাগ দিন আমার রাতের খাওয়া ছিল মুড়ি তেলেভাজা আর ওখানকার শস্তা দিশী মদ-আহা কি দিনই গেছে।

আমি থমকেছি।—শ্মশানে টানা তিন বছর কাটিয়েছেন তা-ও বিহারের শ্মশানে—কেন, কোনো তন্ত্র-সাধনাব ব্যাপারে?

হাসতে লাগলেন।স্রেফ পালিয়েছিলাম মশাই, বন্ধন কাটানোর ঝোঁকে —এ আবার আমার অনেক কালের ঝোঁক, কেউ বেঁধে ফেলছে মনে হলেই পালানোর তাগিদ, কিন্তু হেরে গেছি।

কিসের বন্ধন? কোথা থেকে কোথায় পালানোর তাগিদ?

হাসছিলেন আর গ্লাসে চুমুক দেবার ফাঁকে ফাঁকে আমাকে দেখছিলেন। ধীরে সুস্থে জবাব দিলেন, রমণীর বাহু বন্ধন থেকে। আমার অদৃষ্টে এই শেকল যে কি শেকল তা যদি জানতেন—সেটা ছেঁড়ার তাগিদে মাঝে মাঝে আমার মাথায় ভূত চাপত—পালাতাম। সেই প্রথম আমার ভিতরের লেখক মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। কৌতূহল তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু অ-প্রসঙ্গ আর বিস্তারের দিকে গড়ায়নি। প্রস্তুতি হিসেবে বলেছিলাম, ফিরে গিয়ে ফাঁক পেলে আমি কিন্তু আপনার কোন্নগরের ডেরায় গিয়ে হাজির হব।

—নিশ্চয়ই আসবেন। আমিও যাব। আমরা মিউচুয়াল অ্যাডমিরেশন সোসাইটি গড়ে তুলব, আপনার কি হবে জানি না, আমার পশার বাড়বে।

পরের কথায় গলায় একটু রহস্যের ছোয়া পেলাম। বললেন, আসবেন… আপনার ভালোই লাগবে হয়তো অনেকের লাগে।

হরিদ্বারে আর ফেরার সময় ট্রেনেও অবধূতের কিছু কথা আমার মনে দাগ কেটেছে।—আমার চোখে এই জগতের সব-কিছুই বড় আশ্চর্য লাগে। জন্ম-মৃত্যু-সৃষ্টি-ধ্বংস সবই যেন কেউ সাজিয়ে সাজিয়ে যাচ্ছে। মানুষ থেকে শুরু করে সমস্ত প্রাণীর এমন বায়োলজিকাল পারফেকশন কি করে হয়—কে করে? একটা ফুলের বাইরে এক-রকম রঙ ভিতরে এক রকম, পাপড়ির গোড়ায় এক রঙ, মাথার দিকে অন্য রকম—এমন নিখুঁত বর্ণ বিন্যাস কি করে হয় —কে করে? আপনারা লেখেন, ঘটনা কতটা দেখেন আপনারাই জানেন। আমি শুধু ঘটনা দেখে বেড়াই, যা দেখি তা কোনো বইয়ে পাই না, কোনো চিন্তায় আসে না। যেখানে যাই, দেখি কিছু না কিছু ঘটনার আসর সাজানো—পরে মনে হয়েছে আমি নিজের ইচ্ছেয় আসিনি, কিছু ঘটবে বলেই আমার টান পড়েছে—আমার কিছু ভূমিকা আছে বলেই আমাকে সেখানে গিয়ে হাজির হতে হয়েছে—এমন কেন হয়, কি করে হয় বলতে পারেন? এই দেখুন না, ক’দিন আগেও আপনি আমাকে চিনতেন না, আমিও আপনার অস্তিত্ব জানতাম না, আমার এই বেশভূষা আর হাওড়া স্টেশনে ভক্তদের সঙ্গে আমাকে দেখে আপনারা বিরূপই হয়েছিলেন, পরেও আপনার আলাপের কোনো আগ্রহ ছিল না, উল্টে বিরক্ত হচ্ছিলেনঅথচ এই ক’টা দিনের মধ্যে দেখুন পরস্পরকে আমরা আত্মীয় ভাবছি—এ-ই বা কি করে হয়, কেন হয়?

আমি জবাব দিয়েছি, এর সবটাই আপনার গুণে হয়েছে।

—তা নয়, আপনাকে দেখেই যদি আমার ভালো না লাগত এমন হত না, আপনার স্ত্রীর দিকে চেয়ে যদি শোকের ছায়া চোখে না পড়ত তাহলেও এমন হত না—সব-কিছুর পিছনে অবধারিত কিছু কার্য কারণ সম্পর্ক থাকে —মানুষ দেখে দেখে আমার এটুকুই অভিজ্ঞতা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *