সেই অজানার খোঁজে ২.৭

মাস আড়াই বাদে সকালের দিকে একদিন সুবীর চ্যাটার্জী কোন্নগরে এসে হাজির। মা-কে দেখে আর মায়ের মুখে দাদার অজস্র প্রশংসা শুনে তার একটু কৌতূহল হয় নি এমন নয়। মায়ের এতদিনের হাঁপানির রোগ প্রায় সেরে এসেছে। তাঁর মুখের রং ফিরেছে। সুবীর চ্যাটার্জীর কাছে এটাই একটু আশ্চর্য ব্যাপার। কিন্তু তাঁর কোন্নগরে আসার কারণ আদৌ এই নয়। …দেখা হলেই নমিতা দেবী এই ছেলেকে কোন্নগরে যাবার তাগিদ ছ্যান। ধারণা শুধু নয়, তাঁর বিশ্বাস চাঁদুর এখন অনেক ক্ষমতা, অনেক শক্তি . হাজার হোক পেটের সন্তান, তাঁর আশা দাদার সাহচর্যে এসে এই ছেলের মনে যদি কিছু পরিবর্তন আসে।

সুবীর চ্যাটার্জীর কোন্নগরে আসা দাদার ক্ষমতা আর শক্তির কথা শুনে শুনে। লেখা-পড়া জানা মানুষ, এই জীবনের প্রতি ঘেন্না সময় সময় কি তারও ধরে না? অদৃষ্ট বলে কিছু আছেই, নইলে তার এই দশা হলো কি করে? ওই অদৃষ্ট ফেরানোর ক্ষমতা যে তাঁর নেই, দেখতেই পাচ্ছে।… কারো যদি থাকে একবার দেখে আসতে ক্ষতি কি? দেখতেই এসেছিলো। এই দেখতে আসা থেকেই ঘটনার সাজে রং-বদল শুরু।

অবধূতের ঘরে তখন বেশ কয়েকজন লোক। বাঁশের গেটের সামনে তিন-তিনখানা চকচকে গাড়ি দাঁড়িয়ে। লোকগুলোকে দেখেও রীতিমতো অবস্থাপন্ন মনে হলো সুবীর চ্যাটার্জীর। কিন্তু দাদার সামনে বশংবদের মতো বসে আছে। ভাইকে দেখে অবধূত খুশিই হলেন। ডাকলেন, আয়, কলকাতা থেকে কোন্নগরে আসতে ভোর তিন মাস লেগে গেল? মা বলেছিলেন তুই রাউরকেল্লা থেকে ফিরলেই এখানে পাঠিয়ে দেবেন। তাঁকে নিয়ে ভিতরে এলেন। —কই গো, কে এলো দ্যাখো— কল্যাণী ভিতরের দাওয়ায় ছোট পিঁড়ি পেতে বসে চাল বাছ ছিলেন। প্রায় শুকনো চুল পিঠের ওপর ছড়ানো। পরনে চওড়া লালপেড়ে মিহি শাড়ি, গায়ে লাল রঙের ব্লাউজ। মাথায় সিঁদুর টিপ সিঁথিতে জ্বলজ্বলে সিঁদুর রেখা। মুখ ফিরিয়ে তাকালেন।

প্রথম দেখার এই মুহূর্তটুকু শুভ ছিল কি? সুবীর চ্যাটার্জী স্থান-কাল ভুলে চেয়ে রইলো।…দাদার ঘরে এমন এক দিব্যাঙ্গনার অবস্থান যেন পৃথিবীর বহু আশ্চর্য ব্যাপারের সেরা কিছু। তার চোখে পলক পড়ে না। দৃষ্টির এমন বিমূঢ় তন্ময়তার ধাক্কায় কল্যাণীর সুন্দর দুই ভুরুর মাঝে একটু ভাঁজ পড়ো-পড়ো হলো। এক হাতে আঁচলটা চুলের ওপর দিয়ে পিঠ বেড়িয়ে মাথায় তুললেন।…অবধূত সকৌতুকে লক্ষ্য করছেন। এই ভাইয়ের চরিত্রের আদ্যোপান্ত তিনি জানেন। কিন্তু নিজের ক্ষেত্রে সেটা মনে রাখার ব্যাপার মনে হলো না একবারও। কল্যাণীকে দেখে কেউ অবাক হলে এমনকি অভিভূত হলেও মজাই পান। আর কত শক্ত ঘাঁটি সেটা অনুভব করতে পারেন বলেই স্ত্রীকে নিয়ে মনে কোনোরকম দুশ্চিন্তা কখনো রেখাপাতও করে না।

—কি রে একেবারে হাঁ হয়ে গেলি যে।…প্রথম দেখে একটা প্রণামও করলি না! শেষের খোঁচাটুকু ইচ্ছে করেই দিলেন, নইলে হাওড়া স্টেশনে ষোল বছর বাদে যোগাযোগ সত্ত্বেও সেদিন প্রণাম এই ভাই তাঁকে করে নি বা আজও করে নি এটা মনে আছে।

সুবীরের বিমূঢ় দৃষ্টি এবারে তাঁর দিকে ঘুরল। এ কে? তোমার বউ নাকি?

—কেন, তোর সন্দেহ হচ্ছে? · আমার বউ হলে তোর কে হয়?

কল্যাণী চালসুদ্ধ কুলোটা নিয়ে আস্তে আস্তে উঠলেন। ঈষৎ গম্ভীর। ঘরের দিকে এগোলেন। বাধা পড়ল, অবধূত বললেন, কি হলো, আমার ছোট ভাই সুবু বুঝতে পারছ না?

—বুঝেছি। সোজা ছোট ভাইয়ের দিকেই তাকালেন। আয়ত দু‘চোখে চোখ পড়তে সুধীর আবার বিহ্বল। আঙুল তুলে সামনের ঘরটা দেখিয়ে কল্যাণী বললেন, ‘আপনি ও-ঘরে গিয়ে বসুন, আমি আসছি। স্বামীর দিকে তাকালেন, তোমার ঘরে কত লোক, দেরি হবে?

—তা আরো আধ-ঘণ্টা খানেক তো বটেই, তুমি ওকে চা-টা দাও, আমি যত তাড়াতাড়ি পারি আসছি।

চলে গেলেন। কল্যাণী পুজোর ঘরে ঢুকতে গিয়েও আবার ঘুরে দাড়ালেন। সোজা আবার চোখে চোখ। বিহ্বল, স্থান-কাল বিস্তৃত এখনো। কল্যাণীর ঠোঁটের ফাঁকে ঈষৎ হাসির আঁচড় পড়ল কি পড়ল না। ভিতরে ঢুকে গেলেন। অবধূত এই ভাইয়ের স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে তাঁকে কিছুই বলেননি। কিন্তু মানুষটাকে দেখে তিনি খুশি হতে পারেন নি।

মিনিট কুড়ির মধ্যে ট্রে-তে পেয়ালা চায়ের পট আর ডিশে জল-খাবার সাজিয়ে নিজেই নিয়ে এলেন। সুবীর চ্যাটার্জী বসেনি। বসতে পারে নি। ঘরে পায়চারি করেছে, আর এক-একবার দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। এবারে ব্যস্ত হয়ে একটা চেয়ার টেনে বসলো।

টেবিলে জল-খাবার রাখতে রাখতে কল্যাণী জিজ্ঞেস করলেন, মা কেমন আছেন?

—ভালো। চোখ ফেরানো সম্ভব হচ্ছে না। হেসে আত্মস্থ বা সহজ হবার চেষ্টা। —দাদার হাত যশ আছে, এতদিনের পুরনো অসুখ অনেকটাই সেরে গেছে।

—দেখবেন, ওষুধ যেন বন্ধ না হয়। দেওরটি যে তার মায়ের কাছে থাকেও না, কল্যাণীর এ-খবরও জানা নেই। এম. এ. পাশ, ভালো চাকরিটা অদৃষ্টের দোষে গেছে—কেবল এটুকুই শুনেছিলেন।

সুবীর চ্যাটার্জী খেতে শুরু করেছে। ভালো খাওয়াই তেমন জোটে না, মুখ-রোচক জল-খাবার কাকে বলে তা প্রায় ভুলতে বসেছে। কিন্তু এরই মধ্যে চোখের জরিপের কাজ শুরু হয়ে গেছে। ফাঁকে ফাঁকে সহজ এবং অন্তরঙ্গ হবার চেষ্টা। মুখে কৃত্রিম হাসি।—তোমাকে দেখে আমার তাক্‌ লেগে গেছে, দাদার ঘরে এমন একটি বউ আছে জানলে আমি ঢের আগেই আসতাম।

তুমি বলাটা কানে লাগল। যদিও দু‘দিক থেকেই তাই বলাটা স্বাভাবিক কল্যাণী আলতো চোখে তাকালেন।-এমন বলতে?

হাসি। চায়ের কাপে চুমুক দেবার ফাঁকে দু‘চোখ আবার বুক হয়ে মুখের ওপর —এমন বলতে কি তুমি জানো না—আয়নায় নিজেকে দেখো না?

নিলপ্ত জবাব। —আমার আয়না তো আপনার দাদা ..।

…সুঠাম স্বাস্থ্য নিটোল যৌবন অনন্যরূপা হলেও ছেলেমানুষ তো বটেই, কিন্তু কথাবার্তা হাব-ভাব চাউনি বেশ পাকা মনে হলো সুধীরের আর সেই জন্যেই আরো ভালো লাগছে। কি মনে হতে প্রশ্নটা মনে এসেই গেল, আচ্ছা দাদা তো চিকিৎসা করে জানি, কিন্তু সে কি তন্ত্র-সাধক? কল্যাণী লক্ষ্য করেছেন, অতবড় দাদাও এই লোকের কাছে সে-রকম সম্মানের পাত্র নয়—চিকিৎসা করেন না বলে ‘করে’ বলা হলো, আর তিনি বা উনির বদলে ‘সে’। জবাব দিলেন, লোকে তো তাই বলে।

—লোকে বলে মানে—তুমি জানো না?

—আমাদের জানা-জানিটা কেবল আমাদের মধ্যেই।

কেন?

হ্যাঁ, বেশ পাকা, আর সেই কারণে আরো লোভনীয়—এই জন্যে যে আমি জানতাম তান্ত্রিকদের সাধারণত ভৈরবী থাকে…তুমি দাদার বউ না আসলে ভৈরবী?

ফিরে আলতো প্রশ্ন।—কোটা হলে আপনার পছন্দ হয়?

নাঃ, এই মেয়ের কথাবার্তা রূপের থেকে কম কিছু নয়। শোনার জন্য কান দুটোও মাতোয়ারা হতে চায়। জোরে হেসে আরো সহজ আরো অন্তরঙ্গ হবার চেষ্টা।—আমার পছন্দ অনুযায়ী তো কিছু হয় নি, জবাবটাই দাও না?

—মা অগ্নিসাক্ষী রেখে আর সাতপাক ঘুরিয়ে সম্প্রদান করেছেন, তার নাম বিয়ে কিনা আপনার দাদাকেই জিজ্ঞেস করবেন। একটু রসিকতাও করে বললেন, আমাকে ভৈরবী হিসেবে গ্রহণ করেছেন কি বউ হিসেবে তিনিই জানেন।

—ও…বিয়েই তাহলে। কতদিন আগে তোমাদের বিয়ে হয়েছে?

—বছর আষ্টেক।

এবারে সত্যিই অবাক।—আট বছর! তাহলে এখন তোমার বয়েস কত?

—কত মনে হয়?

—বড়জোর কুড়ি…

কল্যাণীর বিনীত চাউনি।—আর একটু কমানো যায় না?

সুবীর চ্যাটার্জীর দু‘চোখ তাঁর মুখের ওপর থমকে রইলো খানিক। তারপর গলার স্বরে উষ্মাই ঝরল।—-দাদা তান্ত্রিক হোক বা যা-ই হোক পাষণ্ডের কাজ করেছে বলতে হবে— আট বছর আগে সে তোমার মতো একটি না-বালিকাকে বিয়ে করে ঘরে এনেছে! আর তোমার মা সেই বিয়ে দিয়ে নিজের মেয়ের এমন সর্বনাশ করলেন?

কল্যাণীর দু‘চোখ বড় বড়। সর্বনাশ বলতে? সর্বনাশ নয়! দাদার বয়েস কত এখন জানো?

… কল্যাণীর মুখ দেখে মনে হবে দাদার বয়েস আঁচ করতে চেষ্টা করছেন। না পেরে বললেন, তান্ত্রিকদের বয়েস আন্দাজ করা শক্ত শুনেছি কত, সাতচল্লিশ আটচল্লিশ? অত না হোক আটত্রিশ তো হবেই—আমার থেকেও কম করে—

থমকাতে হলো আবার।—আমার সঙ্গে তুমি কি সেই থেকে ঠাট্টা করে যাচ্ছ?

কল্যাণী থতমত খেলেন যেন। ছি, ছি, আপনি কি ঠাট্টার পাত্র।

অবধূত ঘরে ঢুকলেন।—কি রে চা-টা খাওয়া হয়েছে? স্ত্রীর দিকে চোখ পড়তেই ভ্রু কোঁচকালেন একটু। এই মুখ তিনি খুব ভালোই চেনেন। হাসি চাপার চেষ্টায় মুখে রক্ত উঠছে। জিজ্ঞেস করলেন, কি কথা হচ্ছিল? —উনি বলছিলেন তুমি একটি পাষণ্ড, আট বছর আগে একটি নাবালিকাকে বিয়ে করে এনে তার সর্বনাশ করেছ।

ছদ্ম-বিরক্তি আর গাম্ভীর্যে অবধূতের মুখখানা ভরাট। স্ত্রীকেই বললেন, এ-সব আলোচনার মধ্যে তোমাকে থাকতে বারণ করেছি না? এখনো যদি কেউ চাইল্ড ম্যারেজ রেস্ট্রেন্ট অ্যাক্টে ফেলে কোর্টে কেস ঠুকে দেয় —পার পাবো? যাক, সুবু এলো, মাছ মাংস তো কিছু ঘরে নেই বোধহয় —বাজারে যেতে হবে না?

কল্যাণী জবাব দিলেন, ওঁর আর খাওয়ার মেজাজ আছে কিনা কে জানে —বাজারে যেতে হলে এক্ষুনি চলে যাও, এরপর কখন রান্না হবে কখন খাওয়া হবে—একটা রিক্সা ধরতে পারো কিনা দ্যাখো—

অবধূত লাল জামার পকেটে হাত দিয়ে টাকা বার করলেন। ছ’খানা একশ টাকার নোট। একটা নোট আবার পকেটে রেখে বাকি ক’টা কল্যাণীর দিকে বাড়িয়ে দিলেন, এগুলো রাখো—

ভাইকে বললেন, যাবি নাকি আমার সঙ্গে?

দাদার রোজগার কত, ভাইয়ের পক্ষে তা-ও আঁচ করা শক্ত হলো। —তুমিই যাও, আমি বসে এর সঙ্গে একটু গল্প করি।

সঙ্গে সঙ্গে কল্যাণী বলে উঠলেন, আমার এখন গল্প করার সময় নেই, সব কাজ পড়ে আছে—তার থেকে সঙ্গে গিয়ে পছন্দ মতো বাজার করে আসুন—মেঘলা দিন আছে, মাথাও ঠাণ্ডা হবে।

দু’ভাই বেরুলেন। বেশ খানিকটা হাঁটলে তবে রিক্সা পাওয়া যেতে পারে। সুবীর চ্যাটার্জী একটু ধাঁধার মধ্যে পড়েছে। মানুষটা আর যা-ই হোক বোকা নয়।…যত রূপসীই হোক, ওই বয়সের মেয়ের কথাবার্তা অমন পাকাপোক্ত আর সরস ইঙ্গিতবহ হয় কি করে ভেবে পাচ্ছে না। ভাবার ধৈর্য কম। ঝপ করে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা দাদা, ওর বয়েস ঠিক-ঠিক কত বলো তো?

—ওর মানে কার?

—তোমার বউয়ের?

—বয়েস যা-ই হোক, আমার বউকে তোর বউদি বলতে অসুবিধে হচ্ছে?

— হচ্ছে। পুরনো দিন আর নেই, বয়সে ছোট বা সমান-সমান হলেও আজকাল যে যার নাম ধরেই ডাকে—

—ও…তাই ডাকিস।

—বয়েস কত বললে না?

—যদি বলি প্রায় আঠাশ … বিশ্বাস হবে?

—একবারে না।

—তাহলে তোর যা খুশি তাই ভেবে নে, আরো বছর দশেক বাদে যদি একই রকম দেখিস তখন হয়তো বিশ্বাস হবে।

রিক্সায় যেতে যেতে অবধূত ভাইয়ের মুখ চোখ কপাল ভালো করে লক্ষ্য করেছেন। ভাগ্যের ছিটে ফোঁটাও ‘দেখছেন না। বুদ্ধিভ্রংশ মানুষ যেমন এক বগ্‌ গা ছোটে, এও তেমনি দ্রুত অধোপথে ধেয়ে চলেছে। ভাই না হয়ে আর কেউ হলে বিরক্তই হতেন।…মা বলেছিলেন, এই ভাইয়ের যদি মতি ফেরাতে পারিস এই পৃথিবীতে আমি আর কিছু চাই না। অনেক দুঃখে কোনো মা নিজের ছেলের সম্পর্কে এ-রকম বলে। জিজ্ঞেস করলেন, বাইরে যদি চাকরি বাকরি ঠিক করতে পারি যাবি তো?

—বাইরে মানে কত বাইরে?

—এই ধর ইউ. পি-তে?

—নাঃ, অত দূরে পোষাবে না।

—চাকরির ইন্টারভিউ দিতে তো রাউরকেল্লা ছুটেছিলি?

—তখন মাথায় একটা ঝোঁক চেপেছিল, পরে মনে হয়েছে হয় নি ভালোই হয়েছে।

অবধূত ব্যাপারটা অন্য ভাবে বিবেচনা করলেন।…ষোল বছর বাদে দেখা হওয়ার যোগ ছিল, এর সঙ্গে মায়ের সঙ্গে। তাই ভাই ছুটেছিল রাউর কেল্লা ইন্টারভিউ দিতে আর তিনি পুরী যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে বেরিয়েছিলেন। দেখা হওয়ার যোগটাই শুধু কার্য কারণ সম্পর্ক। এই যোগের ওপর দুজনের কারোরই কোনো হাত ছিল না। অবধূতের কেন যেন মনে হলো এই যোগটা শুভ নয়।

…এক দিনের জায়গায় বিনা অনুরোধে সুবীর চ্যাটার্জী তিন দিন থেকে গেল। খাওয়া-দাওয়া ব্যবস্থা ভালো। আরো ভালো দাদার মদের বোতল। আলমারিতে ওই বোতল দেখেই দুচোখ চকচক করে উঠেছিল। আর অবধূত ভেবেছেন, সময়ে কাচের আলমারি থেকে বোতল ক’টা সরিয়ে রাখা উচিত ছিল। অনুমতি দিতে হয় নি, সন্ধ্যা পার হতেই বোতল নামিয়ে বসতে দেখেছেন। চাকরি যাবার পর থেকে এত ভালো জিনিস সুবীর চ্যাটার্জী আর চোখেও দেখে নি। গেলাস এনে কাঁচাই শুরু করেছে। অবধূত কল্যাণীকে ডেকে বলেছেন একটা জলের জাগ আর কিছু খাবার এনে দাও, লিভার পচে মরবে দেখছি।

—হাতের কাছে একটা গেলাসই পেলাম, আর একটা গেলাসও আনতে বলে।…তোমারও চলবে তো? ভাইয়ের সদয় মুখ।

—নাঃ তোর সঙ্গে চলবে না। অবধূতের ঠাণ্ডা জবাব এবং প্রস্থান। …সব থেকে ভালো দাদার এই বউ। দেখলে চোখ ফেরানো যায় না। দেখার তৃষ্ণা আরো বাড়ে। এটা ওটা চাওয়ার হলে বার বার তাকে ঘরে আনার চেষ্টা। প্রথম সন্ধ্যায় জলের জাগ রেখে যাবার খানিক বাদে ডিশে গরম মাংসের বড়া দেখে দারুণ খুশি।—বাঃ, দাদাকে তো দারুণ রসেবশে রেখেছ দেখছি—এ জিনিস (হাতের গেলাস দেখিয়ে ) তোমারও চলে?

—এখন পর্যন্ত চলে না।

—তন্ত্র পথে সুরা তো সাধনার অঙ্গ, তাহলে আমার সঙ্গেই হাতেখড়ি হোক না?

—হাতে খড়ির সাধ থাকলে আপনার সঙ্গে কেন, তান্ত্রিকের সঙ্গেই হবে। তিন দিনে দাদার কাজ-কর্মের ধারা যতটা সম্ভব লক্ষ্য করেছে। তাঁর চিকিৎসার দিকটা মানতে রাজি কিন্তু আর যে কারণে লোকের আনাগোনা দেখছে তার সবটাই ভাঁওতাবাজী মনে হয়েছে। এই ভাঁওতাবাজীর জোরেই হয়তো এমন বউ ঘরে আনা সম্ভব হয়েছে। ভাগ্য বটে লোকটার। হিংসেয় বুকের ভিতরটা চিনচিন করে জ্বলে। লুব্ধ দুচোখ বার বার অন্দর মহলে চক্কর দেয়। বেশিক্ষণ না দেখলে কোনো দরকারের অছিলায় সামনে এসে দাড়াতেই হয়।

—এক কাপ চা হবে?

কল্যাণী উল্টো-মুখে বসে কুটনো কুটছেন। হবে, ঘরে গিয়ে বসুন, হারুকে দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

—হারু কে?

—কাজের লোক। সংক্ষিপ্ত জবাব।

ওদিক ফিরে বসা বলেই লুব্ধ চোখের অবাধ্য হতে আরো সুবিধে। কিন্তু তারও তো মেয়াদ আছে।—তুমি নিজেই নিয়ে এসো না, সেই থেকে মুখ বুজে বসে আছি.. এত কি কাজ, কারো তো আর অফিসের তাড়া নেই! কল্যাণী আস্তে আস্তে ঘুরে তাকিয়েছেন।— আচ্ছা, নিয়ে আসছি…

চায়ের পেয়ালা হাতে মিনিট দশেক বাদে ঘরে ঢুকেছেন। খুশি মুখে সেটা নিতে গিয়ে আঙুলে আঙুল ঠেকেছে।

—থ্যাংক ইউ. বসো…

বাধ্য মেয়ের মতো কল্যাণী বসেছেন।

পেয়ালায় চুমুক দিয়েই উচ্ছ্বাস। —বাঃ, ওয়াণ্ডার ফুল। সকালের থেকেও ভালো হয়েছে।

—সকালে পাশে আপনার দাদা ছিলেন তো, তাই অত ভালো লাগেনি।

হেসে উঠতে গিয়ে বিষম খেতে হয়েছে, পেয়ালার চা-ও একটু চলকে পড়েছে।—-দেওরের সঙ্গে এ-রকম করেই কথা বলা দরকার, বুঝলে? …আচ্ছা, কাল এসেই আমি দিব্বি ‘তুমি’ চালিয়ে দিলাম, কিন্তু তুমি সেই থেকে আমাকে আপনি-আপনি করে পর করে রাখছ কেন?

নিরীহ গোছের আয়ত দুচোখ সোজা মুখের ওপর। —আপনার বিবেচনায় আমি তো একেবারে ছেলেমানুষ।

চেহারায় না হোক, হাব-ভাব কথাবার্তায় অন্তত ছেলেমানুষ ভাবা যাচ্ছে না। ইঙ্গিতটা রমণীর মতোই সুপরিণত সুডৌল লাগছে। সরল গোছের হাসি-ছোয়া চাউনির গভীরেও সরস কিছু চিকচিক করে উঠছে। সুবীর চ্যাটার্জীর শরবিদ্ধ দশা। হঠাৎই কিছু মনে পড়ল যেন।—ভালো কথা, দাদাকে কাল তোমার বয়েস জিজ্ঞেস করেছিলাম, বলল, প্রায় আঠাশ, আমার তো বিশ্বাসই হয় না —সত্যি নাকি?

—বললেন বুঝি? উঠে দাড়ালেন, সত্যি কিনা আপনি তাই নিয়ে গবেষণা করুন, আমি হাতের কাজ সারি।

—শোনো শোনো! সম্ভব হলে হাত ধরে আটকানোর তাগিদ। — গবেষণা করতে হলে তোমাকেও তো সামনে বসে থাকতে হয়—

দু‘পা গিয়েও আস্তে আস্তে ঘুরে দাড়ালেন। ঠোঁটে হাসি, চোখেও, কিন্তু কথাগুলো তির্যক-গম্ভীর। —-বড় ভাইয়ের বউয়ের বয়েস দিয়ে কি হবে? আশীর্বাদ করি লক্ষ্মণের মতো পায়ের দিকে চেয়ে থাকার মতি হোক। সুবীর চ্যাটার্জী আরো শরাহত। আরো পরিতুষ্ট। তিন রাত বাদে চলে যাবার পর অবধূত ঘুরে ফিরে বার কয়েক কল্যাণীর নির্লিপ্ত মুখখানা লক্ষ্য করেছেন আর মিটিমিটি হেসেছেন। শেষে জিজ্ঞেস করেছেন, কি-রকম বুঝলে? ভায়ার তোমাকে খুব মনে ধরেছে?

কল্যাণী তেমনি জবাব দিলেন, মনে হয়।

অবধূত তখন এই ভাই সম্বন্ধে যা জানতেন সবই বললেন। বিমাতার।

আকৃতির কথাও জানালেন, বলেছিলেন এই ভাইয়ের যদি মতি ফেরাতে পারিস এই পৃথিবীতে আমি আর কিছুই চাই না। একটু থেমে তাঁকেই জিজ্ঞেস করলেন, কি করা যায় বলো তো?

—কিছু করার আছে মনে হয় না, মাথা একটু বেশিই বিগড়ে গেছে, সহজেই বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারেন—যাবার আগে বলে গেছেন কয়েক দিন আনন্দে কাটানোর মতো তাঁর একটা জায়গা হলো।

—তার মানে আবার আসবে?

—মানে তো তাই দাঁড়ায়।

অবধূত সকৌতুকে নিরীক্ষণ করলেন একটু।—তুমি যেন একটু ঘাবড়েছ মনে হয়?

—ছঃ! এক শব্দে নস্যাৎ করে দিয়ে চলে গেলেন।

স্ত্রীর এমন জোরের উৎসের হদিস আজও পান নি। কতবার তো তাঁকে একলা ফেলে রেখে এ-দিক ও-দিকে চলে গেছেন, অনেক সময় নিজেই একটু-আধটু উতলা হয়েছেন, দিনকাল ভালো নয়… রূপের তৃষ্ণায় মানুষ যত পাগল হয় ততো বোধহয় আর কিছুতে নয়। কিন্তু ফিরে এসে মনে হয়েছে তিনি নিরর্থক ভেবেছেন। তিনি থাকুন বা না থাকুন স্ত্রীটি যে সর্বদাই এক নিরাপদ বেষ্টনীর মধ্যে বসে আছেন।

বিমাতা নমিতা দেবীও একবার কোন্নগরে এলেন। অবধূতই নিজে কলকাতা গিয়ে তাঁকে নিয়ে এসেছেন। চাঁদুর বউ দেখে তিনি আনন্দে আটখানা। বউয়ের বয়স নিয়ে তিনিও ধাঁধাঁয় পড়েছিলেন। কল্যাণী সানন্দে তাঁর সেবা-যত্ন করেছেন। এখানে দিন-কয়েক থেকে তাঁর আশা বেড়েছে আর বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়েছে, এই শক্তিমান তান্ত্রিক ছেলে মন করলে তাঁর নিজের ওই অপদার্থ ছেলের মতি ফেরাতে পারে। অবধূতের হাত ধরে আবার তাঁকে সেই একই অনুরোধ করেছেন।

…কিন্তু এই মা-ই যখন শুনলেন সুবু এখানে এসে তিন রাত থেকে গেছে, তাঁর ভিতরে অস্বাচ্ছন্দ্যের একটা ত্রস্ত আঁচড় পড়েছে। তক্ষুনি মনে হয়েছে ওই ছেলের তিনদিন থেকে যাওয়ার মতো আকর্ষণ এখানে আছে। মুখ কালো করে বলেছেন, পেটের ছেলে, কি আর বলব অত প্রশ্রয় দিবি না, কিছু যদি করতে পারিস আসা-যাওয়া করুক—এখানে থাকার দরকার কি!

অৰ্ধত হেসে বলেছেন, ছোট ভাই থাকতে চাইলে না বলব কি করে, বাড়ি তো আমার খুব ছোট কিছু নয়, থাকলে অসুবিধের কি আছে। অসুবিধে কি সেটা নমিতা দেবী আর মুখ ফুটে বলতে পারেন নি।

এক এক করে আরো চারটে বছর পার হয়েছে। বৈমাত্রেয় ছোট ভাই সুবু মূর্তিমান উপদ্রবের মতোই হয়ে উঠেছে। প্রতি মাসেই একবার করে আসে। দুদিন তিনদিন পাঁচদিনও থেকে যায়। দিনে দুপুরেও মদের বোতল নামিয়ে বসে। আলমারিতে চাবি লাগানো থাকলে সোজা এসে দাদার কাছে চেয়ে নেয়। অবধুত একবার কাচের আলমারি থেকে বোতল সরিয়ে স্টিলের আলমারিতে রাখতে চেয়েছিলেন। কল্যাণী আপত্তি করেছেন, সরাবে কেন, ভাইকে মুখের ওপর বলে দাও এখানে এ-সব চলবে না। —আমার চলে যখন ওকে ও-কথা বলি কি করে?

—তাহলে ওগুলো ওখানেই থাকবে।

ভাইকে কবিরাজি চিকিৎসা শেখাবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, বছর চারেক মন ঢেলে শিখলে ঠিক দাড়িয়ে যাবি, চাকরির ধান্দায় কারো কাছে ঘুরতে হবে না। অত লেখাপড়া শিখেছিস পারবি না কেন? প্রস্তাব সরাসরি নাকচ। ভাইয়ের সাদা-সাপটা জবাব, ‘অত লেখা-পড়া শিখেছি বলেই পারব না। কবিরাজি শিখে শেষে আমি কবিরাজ হয়ে বসব তুমি এটা ভাবলে কি করে? তাছাড়া টিউশানিগুলো গেলে চার বছর আমার চলবে কি করে?

—চলার ব্যবস্থা আমি করতে পারতাম, কিন্তু তোর আঁতে লাগছে যখন সে আলোচনায় গিয়ে আর লাভ কি..

একবার দেখা গেল ভাইয়ের অন্য ব্যাপারে বরং আগ্রহ একটু বেশি। জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা দাদা, তান্ত্রিকরা সত্যি খুব শক্তিশালী হয়?

—সত্যিকারের তান্ত্রিক মানেই শক্তিশালী।

—তুমি সত্যিকারের তান্ত্রিক নও?

—আমি তন্ত্রের ত-ও জানি না।

—সে-রকম শক্তিশালী তান্ত্রিক তুমি দেখেছ?

—দেখেছি।

—আমাকে দেখাতে পারো?

—তোর ভাগ্যে থাকলে দেখবি, ইচ্ছে করলেই তাঁদের দেখা মেলে না। একটু চুপ করে থেকে আবার জিজ্ঞেস করেছে, আচ্ছা সম্মোহন, বশীকরণ এ-সব ব্যাপারগুলো কি?

নিজের অগোচরে চোখ তার মুখের ওপর একটু তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছিল।— আমি জানি না।

—এ-সব তন্ত্রসাধনার মধ্যে পড়ে না?

—কোনো সাধকই এ-সব নিচুস্তরের জিনিস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে না।… কেন, তোর এ-সব শেখার ইচ্ছে হয়েছে?

হাসতে লাগল।—তুমি তন্ত্রের কিছু জানো না বলছ কিন্তু তোমারই যা দাপট দেখছি, ও-সব ছোট-খাট ব্যাপারগুলো জানলে তো আরো ঢের বেশি মওকা পেতে।

কল্যাণীর কাছ থেকেও কিছু জ্ঞান-লাভের বাসনা হয়েছিল। যেমন বীরাচার সাধনার ব্যাপারখানা কি, তান্ত্রিকেরা ভৈরবী নিয়ে উপসনা করে কেন, এদের সঙ্গে যারা বৈষ্ণবী নিয়ে উপাসনা করে তাদের তফাৎ কি। কল্যাণীর স্পষ্ট জবাবে উৎসাহ জল। —ও-সব জানতে হলে আপনার দাদার কাছে যান, আমি ভাত ডাল শুক্তো মাছ মাংস পোলাও পর্যন্ত জানি…। অবধূত বিরক্ত হন, আবর কল্যাণীর মুখের দিকে চেয়ে বেশ মজাও পান। প্রশ্রয় পেয়ে পেয়ে এ ভাই ক্রমে স্নায়ুর ওপর চেপে বসছে এটুকু প্রকাশ করতেও আপত্তি। নির্লিপ্ত, নিস্পৃহ।…ওই ভাই জেনেছে দাদা শনি মঙ্গলবারে শ্মশানে কাটায়। যখন আসে এবং থাকে শনি বা মঙ্গলবার একটা পড়েই। এমনি এক শনিবারে অবধূত নিজেই প্রস্তাব করেছিলেন, আজ আর শ্মশানে না গেলাম, থাক কল্যাণী প্রায় ঝলসে উঠলেন, কেন যাবে না? ওর সাধ্য কি কি করবে?

আরো মাস তিনেক বাদে সকালে শ্মশান থেকে ফিরে দেখেন স্ত্রীটি খুব গম্ভীর। আগের বিকেলে ভাই এসেছে। অবধূত নিজে থেকে কিছু বললেন না। কল্যাণীও দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ হবার আগে পর্যন্ত নির্বাক। দুপুরে ঘরে এসেই বললেন, দ্যাখো, তোমাকে একটা কথা না বললেই নয়, তোমার ভাইকে এখনো যদি ভালো মতো সমঝে না দাও মুশকিলে পড়বে, দিনে-দিনে সে মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

অবধূত উদ্‌গ্রীব, কেন কাল রাতে সে কিছু করেছে নাকি? তুমি ভয় পেয়েছে।

কল্যাণী ফুঁসেই উঠলেন, কি? ভয়? আমি? ওকে?…হ্যাঁ, ভয় আমি পাচ্ছি সেটা ওর জন্যেও তোমার ভাই বলে— বুঝলে? সময় থাকতে ওকে দূরে সরতে বলো!

না, কল্যাণীর এই মূর্তি অবধূত বিয়ের বারো বছরের মধ্যে দেখেন নি। পরে জেরা করেও তাঁর মুখ থেকে আর কোনো কথা বার করতে পারলেন না।

…এরপর কে তাঁকে যন্ত্রণা দিল, কার ইঙ্গিতে এমন এক অস্বাভাবিক পদক্ষেপ, নিজেই জানেন না। কল্যাণীর এমন শক্তির উৎস যে তাঁকেই বার বার মনে পড়তে লাগল। গুরু কংকালমালী ভৈরবকে। একটা আশ্চর্য রকম আকর্ষণ বোধ করতে লাগলেন তিনি। জীবনে এই গোছের অনুভূতিগুলোই বোধহয় অলৌকিক ব্যাপার, যার কোনো ব্যাখ্যা নেই যুক্তি নেই।

তক্ষুনি ঠিক করলেন কালই তিনি বক্রেশ্বর যাবেন, মহা-ভৈরব গুরুর থানে যাবেন। সঙ্গে সঙ্গেই আবার মনে হলো, তিনি গেলে কি হবে? সুবু শোধরাবে কি করে? ভাবতে লাগলেন।

সন্ধ্যার পর ভাই মদ নিয়ে বসেছে। কল্যাণীর আজও আতিথেয়তায় ত্রুটি নেই। ভাজা ভুজি নিজে রেখে গেছেন কি হারুকে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন জানেন না। দাদাকে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভাই দরাজ অভ্যর্থনা জানালো। এসো, চলবে নাকি?

অবধূত এগিয়ে এসে বসলেন। এই প্রথম বললেন, চলতে পারে—তুই তো এরই মধ্যে ছ’আনা ফাঁক করে এনেছিস দেখছি…

শব্দ করে হাসল একটু, তারপর জোর হাঁক দিল, কল্যাণী | দাদার জন্য একটা গেলাস—!

অবধূত বললেন, বউদিকে তুই নাম ধরে ডাকা শুরু করে দিয়েছিস? —হোয়াট নট্‌? সি ইজ থ্রি, ইয়ারস্ ইয়ংগার দ্যান মি, আই অ্যাম থার্টি ফাইভ সি ইজ থারটি ট্যু···দ্যো স্টিল্ লুস্‌ টুয়েন্টি—উই ওয়ান্ট টু বি গুড ফ্রেণ্ডস—আমি তাকে আমার নাম ধরে ডাকার পারমিশান দিয়ে দিয়েছি। দরাজ হাসি। ইউ আর এ লাকি ওল্‌ড ম্যান দাদা, ইউ আর দি ট্রেজারার অফ এ জেম অফ এ ওয়াইফ।

গেলাস হাতে কল্যাণী দরজার কাছে দাড়িয়ে শেষটুকু শুনলেন। ভিতরে এসে গেলাস টেবিলে রেখে চলে যাচ্ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে দেওরের জোরালো বাধা, ও-কি চলে যাচ্ছে কেন? সামনেই দাদা বসে আজ আর লজ্জা কি? কল্যাণী ঘুরে দাড়ালেন।

—প্লীজ, একটু বসে যাও।

চলে গেলেন। অবধূত দেখছেন। ভাইয়ের দুচোখে মত্ত বাসনা গলগল করে ঠিকরে বেরুচ্ছে।

নিঃশব্দে নিজের গেলাস তুলে নিলেন তিনি। কল্যাণী এলো না সেই খেদেই যেন প্রয় আধ-গেলাস তরল পদার্থ এক চুমুকে জঠরে চালান করে বড় মাপের আর একটা ঢেলে নিল। এরও আধা-আধি শেষ হতে অবধূত বললেন কাল ভোরে আমি এক জায়গায় যাচ্ছি, তুইও যাবি?

—হেল! এ জায়গা ছেড়ে আমি আর কোথাও যেতে চাই না…বাট হোয়্যার?

—বক্রেশ্বরে।

—সেটা আবার কোথায়—সেখানে কি?

—তুই একবার একজন শক্তিমান তান্ত্রিকের খোঁজ করছিলি-সেখানে তিনি।

এ-কথায় সুবুকে নড়েচড়ে বসতে দেখলেন। মনোযোগ দেবার জন্য নিজের মাথাটা বার দুই জোরে ঝাঁকিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, সেখানে তিনি আছেন?

—আছেন।

—খুব শক্তিমান?

—খুব।

—যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন?

—ইচ্ছে করলে পারেন।

—লোক ভালো?

—দয়ার অবতার।

—যাব, নিশ্চয়ই যাব—-কিন্তু তোমার সামনে আমি তাঁকে কিছু বলতে পারব না! আমার সঙ্গে দেখা করিয়ে দিয়ে তুমি সরে যাবে।

— তাই যাব।

আবার সংশয়। —কিন্তু তিনি যে শক্তিমান তার প্রমাণ তুমি নিজে পেয়েছ?

—পেয়েছি।

—কি প্রমাণ?

—কল্যাণীকে সেখানেই প্রথম দেখেছিলাম। মনে-প্রাণে তাঁকে চেয়েছিলাম। তাঁর দয়াতেই পেয়েছি।

ভাইয়ের চোখে আবার লোভের ফোয়ারা দেখলেন অবধূত।

পরদিন সকালের গাড়িতে দুজনে রামপুরহাট এলেন। সেখান থেকে সোজা বক্রেশ্বরে। যশোদাকান্তকে ধরে অবধূত যা বলার বলে রাখলেন। আর ভাইকে আগেই জানিয়েছেন রাতের আগে তান্ত্রিক বাবার দেখা মেলে না। হোটেল-ঘরে বসে সন্ধ্যার মুখে দুজনে মিলে খানিকটা মদও খেয়েছেন। ভাই একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, তান্ত্রিক বাবার কাছে মদ খেয়েও যাওয়া চলে?

—সব চলে।

রাতের খাওয়া সারা হতে বললেন, চল্ এবারে।

অনেকটা পথ গিয়ে ভাই থমকে দাড়ালো। অনেকদূরে একটা চিতা জ্বলছে। এ কোথায় নিয়ে এলে আমাকে?

—শ্মশানে। কোনো ভয় নেই, চল্।

সুবু দাদার গা ঘেঁষে এগোতে লাগল। তার গলাটা কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে।

যশোদাকান্ত ঘরের প্রদীপ জ্বেলে ধুপ ধুনো দিয়ে অপেক্ষা করছিল। অবধূতের আদেশ পেয়ে চলে গেল।

ভাইকে নিয়ে কংকালমালী ভৈরবের ঘরে ঢুকলেন। কংকালমালী ভৈরবের ছবির মূর্তি দেখেই সুবু সভয়ে থমকে দাড়ালো। পাশের ভৈরবীর ছবি অবশ্য সুন্দর মিষ্টি। কিন্তু তাঁদের মাথার ওপর মা-কালীর ছবিখানা আবার ভয়াবহ মনে হলো তার। যেন সদ্য টাটকা রক্ত খাওয়া মুখ। অবধূত প্রণাম সেরে ভৈরবগুরুকে দেখিয়ে বললে, ইনিই সেই শক্তিমান মহাতান্ত্রিক।

—কিন্তু এ তো ছবি!

—তাহলেও জাগ্রত! রাতে তুই ওই পার্টিটা পেতে এ-ঘরে থাকবি। যা চাস একমনে প্রার্থনা করবি।

—কিন্তু দেখে তো মনে হয় ইনি প্রচণ্ড রাগী!

—প্রচণ্ড। আবার তুষ্ট হলে তেমনি দয়ালু।

ভাইয়ের কণ্ঠতালু শুকিয়ে আসছে।—আমরা দুজনেই এ-ঘরে থাকি না দাদা—

—না। কঠিন গলায় অবধূত বললেন, তাতে কোনো ফল হবে না, বরং ক্ষতি হবে।

এ কি করছেন, কেন করছেন অবধূত নিজেও জানেন না। যা মনে হচ্ছে করে চলেছেন, বলে চলেছেন।

তিনি বাইরে শুয়ে। সুবু ভিতরে। ওর ছটফটানি বাইরে অনুভব করতে পারছেন। এক-একবার গলা পাচ্ছেন, দাদা ঘুমোলে…?

—কথা নয়, একমনে প্রার্থনা কর।

স্তব্ধ পরিবেশ। থেকে থেকে শেয়াল ডেকে উঠছে।

দাদা ঘুমোলে?

অবধূত আর সাড়া ছ্যান নি।

রাত একটা। এই শ্মশানের রাত একটার চেহারা অন্যরকম। আর ছটফটানি টের পাচ্ছেন না। ডাকছেও না। অবধূত উঠে বসে ঝুঁকে দেখলেন। ঘুমিয়ে পড়েছে।

তিনিও বাইরের পাটিতে গা এলিয়ে দিলেন। কিন্তু চোখে ঘুম নেই। তাঁর ধারণা কিছু ঘটবে বলেই কেউ তাঁকে এখানে টেনে এনেছে।

ঘটল। রাত মাত্র দুটো তখন।

ঘরের মধ্যে আচমকা একটা আর্তনাদ শুনে ছিটকে উঠে বসলেন!

—দাদা! বাঁচাও বাঁচাও! মেরে ফেলল— বাঁচাও!

অবধূত উঠে দাড়ালেন। দেখলেন সুবু টলতে টলতে বেরিয়ে আসছে। তাঁকে দেখে দুহাতে আঁকড়ে ধরল। —-দাদা বাঁচাও, ওই তান্ত্রিক আমাকে ত্রিশূল হাতে তাড়া করে কালীর মুখের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, থামলেই ত্রিশূল দিয়ে বুকে পিঠে খোঁচা দিয়ে আবার নিয়ে যাচ্ছে!

অবধুত তাকে ধরে জোরে জোরে ধাক্কা দিয়ে বললেন, কি পাগলের মতো বকছিস তুই?

শুবুর ভয়ার্ত মুখ, কাগজের মতো সাদা, ঘাড় ফিরিয়ে একবার ঘরের দিকে চেয়েই সন্ত্রাসে বলে উঠল, আমি আর এক মুহূর্তও এখানে থাকব না—ও তান্ত্রিক না পিশাচ!

বজ্র-কঠিন গলায় অবধূত বললেন, ফের ও-কথা বলবি তো তোর জিভ আমি টেনে ছিঁড়ব।

সুবু সভয়ে এবার দাদার দিকে তাকালো। একটা হাত সাঁড়াশির মতো চেপে ধরে অবধূত আবার তাকে ঘরে নিয়ে এলেন। একটা আঙুল সোজা তুলে গুরুর ফটো দেখালেন।—ওই মহাতান্ত্রিক কংকালমালী ভৈরব—দশ বছর বয়সে কল্যাণীকে নিজের কোলে বসিয়ে দীক্ষা দিয়েছেন —নিজের প্রাণের থেকে তাকে বেশি ভালোবাসেন তাকে নিয়ে তোর মনের কুচিন্তা এখানে জমা দিয়ে যা, নইলে কেউ তোকে রক্ষা করতে পারবে না!

আবার তাকে বাইরে টেনে এনে বসিয়ে দিলেন। থর থর করে কাঁপছে। ঘামছে। কুঁজো থেকে জল এনে চোখে মুখে ঠাণ্ডা জলের ঝাপটা দিলেন। বললেন, এখন সবে রাত দুটো, কোথাও যাওয়া যাবে না—সকাল হোক। আশ্চর্য, এরপর অবধূতই ঘুমিয়ে পড়লেন। শান্তির ঘুম। ভোরে জেগে দেখেন শুধু পাশে নেই। কোথাও নেই।

..এই পর্যন্ত বলে অবধূত খানিক ঝিম মেরে বসেছিলেন। তখনো মধ্য রাত। থেকে থেকে শেয়াল ডাকছে। কংকালমালী মহাভৈরবের দাওয়ায় আমি আর উনি মুখোমুখি বসে। মুখ তুলতেই আমার উদ্‌গ্রীব প্রশ্ন, তারপর?

ভারী গলায় জবাব দিলেন, অলৌকিক বিশ্বাস করি না বলি, কিন্তু তারপর যা ঘটে তার কোনো ব্যাখ্যা আমি নিজের ভিতর থেকে আজও পাই নি।…শুনে আপনি হয়তো বলবেন, এ-ও তো সাইকোলজিকাল বা অটোসাজেশনের ব্যাপার—কিন্তু আমার প্রশ্ন ঠিক মুহূর্তটিতে এমন ব্যাপার কেন ঘটে, কে ঘটায়? তাছাড়া নিছক সাইকোলজিকাল বা ইমোশনাল ক্রাইসিস হলে কল্যাণী তার ওপর এমন নির্ভর করতে পারে কি করে?

এত জোর পায় কোথায়?

অধীর আগ্রহে তাগিদ দিয়েছি, তারপর সুবুর কি হলো আপনি আগে বলুন—

শোনার পর আমারও মুখে কথা সরে নি।

…টানা ছমাসের মধ্যে সুবুর আর দেখা পান নি অবধূত। ভেবেছিলেন তার রোগ সে‘র গেছে। … সকাল থেকেই আকাশের অবস্থা ভালো ছিল না সেদিন। আকাশ কালিবর্ণ। তারই মধ্যে অবধূতকে কলকাতা রওনা হতে হয়েছিল। এক ভক্তর কঠিন অসুখ, তারা এসে হাতে-পায়ে ধরে নিয়ে গেছে। এও ঘটনার সাজ ছাড়া আর কি।.. দুপুর না গড়াতে, আকাশটা মাথার ওপর ভেঙে পড়ার পাঁচ সাত মিনিট আগে শুধু এসে হাজির। এসে এ-ঘর ও-ঘর খোঁজ করে দাদাকে পেল না। কল্যাণীকে জিজ্ঞেস করল, অবধূতজী কোথায়?

দাদা নয়, অবধূতজী। গলার স্বরে ব্যঙ্গ। কুটিল গম্ভীর চাউনি। এতদিন বাদে দেখে দুচোখে পিচ্ছিল লোভ।

—কলকাতায়।

—কখন ফিরবে?

—জানি না, কেন?

—তার সঙ্গে আমার একটু বোঝাপড়া ছিল, এর মধ্যে আমিও কিছুদিন দুই একজন তান্ত্রিকের সঙ্গে ঘোরাফেরা করলাম… বুঝলে?

কল্যাণী ঠাণ্ডা জবাব দিলেন, আমার বুঝে কি লাভ!

প্রবল বৃষ্টি নামতে দেখে ঘর-দোর সামলাতে চলে গেলেন। শুধু বৃষ্টি নয়, ঝড়ও। অনেকক্ষণ বাদে ঝড় থামল, কিন্তু বৃষ্টির তোড় বাড়তেই থাকল। ডুবিয়ে ভাসিয়ে সব একাকার না হওয়া পর্যন্ত এ বৃষ্টি থামবে না—সেই বৃষ্টিতেও আকাশের এক-দিকে লাল আভা। তাতে পৃথিবী ডোবানোর সংকেত বুঝি। .. সন্ধ্যের আগেই সুবু মদ নিয়ে বসেছে। কল্যাণী নিজে ঘরে না এসে হারুকে দিয়ে এটা-ওটা পাঠিয়ে দিয়েছেন। রাত আটটা বাজল। ন’টাও বেজে গেল। চারিদিক জলে ভাসছে। অবধূতের এর মধ্যে ফেরার কোনো প্রশ্নই নেই।

রাত দশটা নাগাদ কল্যাণী দোর গোড়ায় দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার খাবারটা এখানে দিয়ে যাব?

সুবু ঘোলাটে চোখে তাকালো। কল্যাণীর হঠাৎ মনে হলো সে যেন তার খাবারটাই সামনে দেখেছে। কথাও কানে এলো, সেই থেকে ঘরে আসছ না কেন, ভয় পাচ্ছ?

কল্যাণী ধীর পায়ে ঘরে এসে দাঁড়ালেন।—ভয় কাকে পাব?

সুবু চেয়ার ঠেলে উঠে দাড়ালেন।— তুমি কাউকেই ভয় করো না—না?

—না—না।

চোখের পলকে এগিয়ে দরজা দুটো বন্ধ করে ছিটকিনি তুলে দিল। বৃষ্টি আর বজ্রপাতের শব্দে সেই শব্দও ঢেকে গেল। এত মদ খাওয়া সত্ত্বেও সুবু একটুও টলছে না। বলল, খুব ভালো কথা, এমন বীরাঙ্গনাই আমার পছন্দ, দাদা আমাকে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে মানসিক বিকৃতি ঘটিয়ে আর ভয় পাইয়ে হত্যা করার মতলবে ছিল, আমি তার চরম শোধ নেব না?

আজ তোমাকে কে রক্ষা করে দেখি—

বলতে বলতে ক্ষিপ্ত আক্রোশে দু‘হাতে জাপটে ধরে বুকে টেনে নিতে গেল। কল্যাণী একটু বাধা দেবার চেষ্টা করতেই ঠাস করে গালে প্রচণ্ড একটা চড় বসিয়ে দিল। দাঁতে দাঁত ঘষে আবার তাকে বুকে টেনে নিয়ে বলল, আজ খুন করে পেতে হলেও তোমাকে আমি পাব।

পরের মুহূর্তে যেন একটা ইলেকট্রিক শক খেয়ে তিন হাত দূরে ছিটকে দাঁড়ালো। দুই চোখে দিশাহারা আতঙ্ক, গলায় আর্তনাদ।—এ কি! এ কি এ-কি! বাঁচাও বাঁচাও! মেরে ফেলল — খেয়ে ফেলল — বাঁচাও! উন্মাদের মতো ছুটে গিয়ে দরজার ছিটকিনি খুলল! সেই অন্ধকার, দুর্যো গের ঘনঘটার মধ্যে ছুটে বেরিয়ে গেল।

কল্যাণী নির্বাক দাঁড়িয়ে চার-দিক দেখছেন। ওই লোকের এমন ত্রাস আর আতংক দেখে কিছু ঘটে গেল অনুভব করেছেন, কি ঘটল তাই বোঝার চেষ্টা। ফর্সা গালে পাঁচ আঙুলের দাগ দগদগে লাল হয়ে আছে।

অবধূত ফিরলেন পরদিন বিকেলের দিকে। গত দিনের দুর্যোগে ট্রেন চলাচল পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কল্যাণী তক্ষুনি কিছু বললেন না। একটু জিরিয়ে মুখ-হাত ধুয়ে জল-টল খাবার পর কল্যাণী জিজ্ঞেস করলেন, কলকাতার রোগী কেমন?

অবধূত জবাব দিলেন, বয়সটাই রোগ, কিছু করার আছে মনে হয় না।… তুমি আমার জন্য ভাবছিলে তো?

এই ঝড় জলে রওনা হতে পারবে না বুঝেছিলাম।…তাছাড়া ভাবার সময়ও খুব পাই নি, তোমার ভাই এসেছিল… তার মুখ দেখেই মনে হয়েছিল মতলব ভালো না অবধূত হাঁ হয়ে চেয়ে রইলেন। কল্যাণী এরপর ঠাণ্ডা মুখে সবই বললেন। একটি কথাও গোপন করলেন না।

অবধূত স্তম্ভিতের মতো বসে। অনেকক্ষণ বাদে জিজ্ঞেস করলেন ‘ও দরজা বন্ধ করে এই কাণ্ড করার সময়েও তোমার ভয় করল না?

—একটুও না। সন্ধ্যার দিকে একটু অশাস্তি হচ্ছিল।…মাকে খানিক ডেকে শিবঠাকুরের দিকে মন দিলাম। মনে হলো ঠিক আমার চোখের সামনে সেই রকম দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে ফিক ফিক করে হাসছেন। ব্যাস, আমার সব অস্বস্তি অশান্তির শেষ।…কিন্তু ভীষণ কিছু দেখেই তোমার ভাই উন্মাদের মতো ঝড়-জলের মধ্যে ছুটে বেরিয়ে গেছে।

মাসখানেক পরে। সকাল তখন ন’টা হবে। অবধূত বাইরের বারান্দায় বসে কাগজ পড়ছিলেন। বছর আট সাড়ে আর্টের একটি ছেলের হাত ধরে এক মহিলা বাঁশের ছোট গেট সরিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে এলো। অবধুত খেয়াল করেন নি কিন্তু কল্যাণী তখুনি কি বলার জন্য বাইরে এসেছেন, দেখে অস্ফুট স্বরে বললেন, কেউ এলো…

অবধূত মুখ তুলে দেখলেন সিঁড়ির কাছে ছেলের হাত ধরে দ্বিধান্বিত মুখে মহিলা দাঁড়িয়ে। কালোর ওপর ভারী সুন্দর মুখশ্রী। কিন্তু ছেলেটার দিকে তাকিয়েই অবধূত থমকালেন। মনে হলো বাচ্চা বয়সের শুধু এসে সামনে দাড়িয়েছে।

ডাকলেন, এসো, তোমার নাম কি বকুল তো?

মহিলা ভ্যাবাচাকা খেয়ে চেয়ে রইল একটু। তারপর মাথা নাড়ল, অর্থাৎ তাই।

—এসো।

ঈষৎ বিস্ময়ে কল্যাণীও দেখছে তাঁকে। এই নাম কখনো শোনে নি। তাঁর থেকে দুই এক বছরের ছোট অর্থাৎ বছর একত্রিশ বত্রিশ হবে বয়েস। কপালে ছোট সিঁদুর টিপ, সিঁথিতেও সূক্ষ্ম সিঁদুরের আঁচড়। উঠে এসে উপুড় হয়ে প্রথমে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে অবধূতকে প্রণাম করল, পরে কল্যাণীকেও।

দ্বিধান্বিত গলায় বকুল জিজ্ঞেস করল, সুবীর চট্টোপাধ্যায় আপনার ছোট ভাই?

—হ্যাঁ… কেন? বোস—

বসল না। উদগত আবেগ সংযত করে বলল, তিনি খুব অসুস্থ, হাসপাতালে আছেন, অবস্থা খারাপ, কাল থেকে অক্সিজেন চলছে, ফিরে গিয়ে দেখতে পাব কি না জানি না…তবু আপনাদের এক্ষুনি একবার যেতে হবে, তিনি পাগলের মতো আপনাদের খুঁজছেন।

কল্যাণী নির্বাক। অবধূত স্তব্ধ। —জিজ্ঞেস করলেন তার কি হয়েছে? শুনলেন কি হয়েছে।… মাসখানেক হলো হঠাৎ মাথার গণ্ডগোল। ঘুমের মধ্যে এমন কি জেগে থেকেও ভয়ঙ্কর ভয় পেয়ে আর্তনাদ করতে থাকে, পাগলের মতো পালাতে চেষ্টা করে। কি দেখে বকুল জেনেছে।…একজন তান্ত্রিক ভৈরব বিকট মূর্তিতে তাকে ত্রিশূল নিয়ে তাড়া করে, ত্রিশূলের খোঁচা মেরে মেরে রক্তে-ভেজা জীবন্ত কালীর মুখের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। মাথার গণ্ডগোল ভেবে ডাক্তার দেখানো হয়েছে, কিন্তু রোগ বাড়ছেই। ভয়ে ত্রাসে উন্মাদের মতো ছোটে। রাত দশটার পরে এ-রকম বেশি হয়।—সেদিন ঘুমের মধ্যেও এমনি ভয় পেয়ে আর্তনাদ করে ওঠে আর পালাতে গিয়ে দাওয়া থেকে পড়ে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত। হাসপাতালের ডাক্তার বলল, ব্রেন-কংকাশন। অপারেশনের পর থেকেই দিনে দিনে অবস্থা খারাপ হচ্ছে। জ্ঞান হলে বকুলকে চিনতে পারে, চিৎকার করে বকাবকি করে কেন এখনো কোন্নগর থেকে দাদাকে আর বউদিকে ধরে নিয়ে আসছে না! অজ্ঞান অবস্থায়ও তাদের ডাকে। গতকাল যা গেছে থাকতে না পেরে বকুল তার মায়ের কাছে লোক পাঠিয়ে দাদার কোন্নগাংড়ির হদিস জেনেছে। আজ এসেছে।

এসে বড় নিঃশ্বাস ফেলে অবধূত জিজ্ঞেস করেছেন, মা ওর খবর কিছু পেয়েছেন?

—না আমি অসুখের কথা কিছু বলি নি।

—তুমি একটু অপেক্ষা করো, আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে নিচ্ছি। কল্যাণীকে বললেন, কিছু টাকা বার করো।

প্রস্তুত হয়ে দেখেন কল্যাণীও যাবার জন্য তৈরি। —তুমিও আসছ তাহলে?

—এ-সময়ও আমি যাব না, বলো কি!

দেড়গুণ ভাড়া গুনে সোজা ট্যাক্সিতে এলেন। হাসপাতাল। সাধারণ কেবিনে সুবুর প্রায়-নিশ্চল দেহ পড়ে আছে। মাথায় ব্যাণ্ডেজ। অক্সিজেন চলছে। ড্রিপ নার্স জানালো যে কোনো মুহূর্তে কিছু হয়ে যেতে পারে ব্লাডপ্রেসার একেবারে নেমে গেছে।

প্রায় আধ-ঘণ্টা বাদে সুর বড় বড় করে তাকালো হঠাৎ। দাদাকে দেখন।

স্পষ্ট টনটনে গলায় বলল, এসেছ!… বউদি এলো না?

কল্যাণী সামনে এসে দাঁড়ালেন।

দৃষ্টি ঠিক চলছে না, তবু তন্ময় হয়ে দেখার চেষ্টা।—আমাকে দয়া করো, আমার মাথায় তোমার হাত রাখো।

কল্যাণী আরো এগিয়ে গেলেন। মাথায় হাত রাখলেন। হাত রেখে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে রইলেন।

—আ-আঃ, শান্তি…শান্তি। বিকেল চারটে নাগাদ সব শেষ।
 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *