৩
কালীকিংকর অবধূতের পৈতৃক নাম প্রবোধচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ডাক নাম চাঁদু। বাবা কোনো বেসরকারি কলেজের অধ্যাপক। পাঁচ বছর বয়সে মা মারা যান। বাবা আবার বিয়ে করেছেন। যিনি এসেছেন তিনি একজন স্কুলের শিক্ষিকা। বিমাতা বলে তিনি নিষ্ঠুর বা নির্দয় ছিলেন না। কিন্তু তাঁর বাড়ির আচরণ-শাসন-অনুশাসন সব স্কুল মাস্টারের মতো ছিল। সব-কিছু নিক্তির ওজনে বিচার বিবেচনা করতেন। চাঁদুর ভালো লাগত না। মা না থাকার দরুন হোক বা যে কারণে হোক ছেলেবেলা থেকে সে জেদী আর একং য়ে। পড়তে ইচ্ছে না করলে পড়বে না, খেতে ইচ্ছে না করলে খাবে না। সব থেকে গোল পাকাতো স্কুলে যাওয়া নিয়ে। রোজই বায়না ধরত স্কুল যাবে না।
স্কুল মাস্টার নতুন মা এসব বরদাস্ত করার মানুষ নয়। নিজে চেষ্টা করে না পারলে গায়ে হাত তুলতেন না, খোদ জায়গায় অর্থাৎ বাবার কাছে ধরে নিয়ে যেতেন। বাবার ধৈর্য খুব বেশি নয়। কলেজের চাকরি ছাড়া দু’দুটো টিউশনি করতে হয়, নিজের হাট-বাজার করতে হয়। তখনকার বে-সরকারি কলেজের মাস্টারদের কিই বা মাইনে। বাবা প্রথমে ভালো কথা বলে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ছেলের মতি ফেরাতে চেষ্টা করতেন। তাতে কাজ হতো না। ফলে অবধারিত মার-ধোর। তাতেও কাজ না হলে আরো মার বা অন্য শাস্তি। নতুন মায়েরও রাগ হতো। বলতেন, এইটুকু ছেলের এমন ঠ্যাটামো আর দেখিনি।
কিন্তু চাঁদু কি করবে, যা ভালো লাগে না তা কিছুতেই ভালো লাগে না। কত বই ইচ্ছে করে ছিড়ে ফেলে বাবার কাছে মার খেয়েছে ঠিক নেই। স্কুলের ক’টা ঘণ্টা বন্দী থেকে তার হাঁপ ধরে যায়, মনে হয় এমন দম-বন্ধ করা শিকল আর দুটি নেই। কিছু ওপরের ক্লাসে ওঠার পর স্কুল পালানোর বিদ্যে রপ্ত হলো। কিন্তু সে সময়ে স্কুল পালানো অত সহজ ছিল না। ধরা পড়তে হতো। তাই খেয়ে দেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে মাঝে মাঝে স্কুলে আসতই না। সমস্ত দিন টো-টো করে বেড়াতে মন্দ লাগত না। মানুষ আর মানুষের মিছিল দেখত। কিন্তু স্কুলে না গেলে কামাইয়ের চিঠি আনতে হয়। এই নিয়েই ধরা পড়ত। বাবার হাতে তখন বেদম মার সংসারে আরো তিনটে ভাই বোন এসেছে। তারা কিন্তু অন্যরকম। বাবার থেকে মা-কে বেশি ভয় করে। তারা কথা শোনে, কেউ অবাধ্য নয়।
তাদের খেলার সময় খেলা, পড়ার সময় পড়া, স্কুলের সময় স্কুল। তাদের নিয়ে মায়ের খুব গর্ব। তেমনি চিন্তা চাঁদুকে নিয়ে। ওটা অমানুষ হলে সকলে তো তাকেই দুষবে। বলবে সৎমা নিজের ছেলেকে তো দেখবেই, পরের ছেলে বয়ে গেলে তার কি। তার এই ন্যায্য দুশ্চিন্তার ফলে বাবার ক্রোধ এবং প্রহার। ম্যাট্রিক ক্লাসে পড়ার সময়ও চাঁদু বাবার হাতে কম মার খায়নি।
সকলকে অবাক করে সে ম্যাট্রিক আর আই. এ. ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেছে। বাবার খুব আপত্তি সত্ত্বেও সংস্কৃত অনার্স নিয়ে বি. এ. ক্লাসে ভর্তি হয়েছে। কেবল বাবা আর মায়ের কাছে ছাড়া এখন আর সে কারো কাছে চাঁদু নয়। প্রবোধচন্দ্র। মাটি এখনো তার মতি-গতি ফিরেছে বলে একটুও ভাবেন না। ভাববেন কি করে, যখন যা খুশি তাই তো করে বেড়াচ্ছে। বাপের শাসনের আতা ডিঙোবার পর কাউকে আর পরোয়াই করে না। যে-দিন ইচ্ছে কলেজে গেল, যে-দিন ইচ্ছে গেল না। রাতে খাবার সময় বাড়ি থাকে না, ভাত ঢাকা দিয়ে রাখতে হয়। বাপ তিনবার জিগ্যেস করলে একবার জবাব দেয়, দক্ষিণেশ্বরে গেছল, বা ময়দানে বসেছিল। এই কৈফিয়ত কারো কাছেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।
কিশোর বয়স থেকেই তার নিজস্ব জগতের খবর কেউ রাখত না। ওই বয়সের সেই জগৎ অনেকটাই শূন্য। নিজেকে বড় অসহায় মনে হতো। এই পৃথিবীতে নিজেকে বড় একলা মনে হতো। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানারকম কল্পনা দিয়ে শূন্য জগৎ কিছুটা ভরে তুলতে চেষ্টা করত। নানা-রকম উদ্ভট কল্পনাও তার মাথায় আসত৷ স্কুলে উঁচু ক্লাসে পড়ার সময় থেকেই রাতে প্রায়ই ভালো ঘুম হতো না। রাত তার কাছে বিভীষিকা হয়ে উঠেছিল। এরপর একটা উপায় বার করল। আলো নিভিয়ে চোখ বুজে আর ঘুমোতে চেষ্টা করত না। বিছানায় গা হাত-পা ছেড়ে চোখ বুজে মনে মনে শিবঠাকুরের কৈলাসে চলে যেত। নন্দী-ভৃঙ্গী দোর আগলে বসে আছে। কল্পনার পাখায় ভর করে তাদের এড়িয়ে কোনো-না-কোনোভাবে ভিতরে ঢুকতই। ঢুকে কি শিবঠাকুরের খোঁজ করত? মোটেই না। মা গৌরীর খোঁজে এ-দিক সে-দিক ঘুরত। বেশির ভাগ রাতেই হ্রদের ধারে পেত তাকে। চার দিকের ফুলের গন্ধে প্রবোধচন্দ্রের ফুসফুস ভরে উঠত। হ্রদের বুকে পূর্ণিমার চাঁদ খলখল করে হাসছে। দু‘জোড়া রাজহাঁস মনের আনন্দে ভেসে চলেছে। হ্রদের কোনো এক ধারে বসে আছে মা গৌরী। প্রবোধচন্দ্রকে দেখে তার হাসি-হাসি মুখ, সদয় চোখ। প্রবোধচন্দ্র সটান গিয়ে তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। মা হেসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।
ব্যস, চোখ খুলেই দেখে সকাল। ঘুমের এমন মোক্ষম দাওয়াই আর বুঝি হয় না। পাছে নিত্য ব্যবহারে দাওয়াইর ফল কমে যায়, তাই তিন চারদিন ঘুম না হলে এক রাতে চোখ বুজে সে কৈলাস রওনা হয়। বি. এ. পড়ার সময়ও কৈলাস পাড়ি দিয়েছে।
বাবা অনেক সময় মন্তব্য করেন, এ-ছেলের কিছু হবে না। বলেন, এর দুর্ভোগ আছে। আর মুখে না বললেও মা-তো জেনেই বসে আছেন, কিছু হবে না তো বটেই, উল্টে এ-ছেলে নিয়ে তাঁদের দুর্ভোগ আছে।…দুর্ভোগ বলতে টাকা-পয়সার অভাব ছাড়া আর কি। তা এমন তন্ত্র-মন্ত্র বা দ্রব্যগুণ কি নেই নাকি যার জোরে ইচ্ছে করা মাত্র হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ টাকা এসে যাবে? কল্পনার জোর থাকলেই আছে। সেই কল্পনার পাখায় ভয় করে কতবার প্রবোধচন্দ্র লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়ে এসেছে। তারপর কি-কি ভাবে অত টাকা খরচ করবে সেই হিসেব মেলাতে গিয়ে হিমসিম।
—বি. এ. পরীক্ষার ফল তেমন ভালো হলো না। মোটামুটি অনার্স পেয়ে পাশ করল। এম. এ-তে ভর্তি হলো। পড়ার খরচ অবশ্য বাবাই চালিয়ে আসছে। কিন্তু আই. এ. পাশ করার পর থেকেই প্রবোধচন্দ্র টিউশনি করা শুরু করেছিল। কেউ জানত না। পরে ভাইয়েরা জেনে বাবা-মাকে বলে দিয়েছে। বাবা খুব কিছু বলেননি। মা রাগ করেছেন। —আমাদের কাছে গোপন কেন, আমরা তোর টিউশনির টাকা কেড়ে নেব?
টিউশনি করে টাকা উপার্জন করার ব্যাপারে খুব যে ঝোঁক ছিল তা নয়। নিজের হাত খরচের জন্য বাবার কাছে হাত পাততে পারে না। তার থেকেও বড় কারণ, হঠাৎ-হঠাৎ মনে হতো, কিছু টাকা এক সময় তার দরকার হবে। কোন্ সময় কেন দরকার হবে জানে না। কেবল মনে হতো দরকার হবে—কিন্তু হলে তাকে টাকা দেবার মতো মানুষ কে আছে? এই কারণেই টিউশনি। রোজগারের টাকা খরচ প্রায় হতই না। জমত। অথচ জমানোর প্রতিও তার খুব একটা আগ্রহ ছিল না।
জীবনের ধারা বাঁক নিই এই এম. এ. পড়ার সময়। কিছুই ভালো লাগে না। ভিতরটা যেন কোথাও উধাও হবার জন্য উন্মুখ। কিন্তু কোথায়, তার কোনো হদিস নেই।
বয়েস তখন একুশ। পর পর তিনদিন বাড়ি থেকে নিখোঁজ সে। চতুর্থ দিন বাড়ি ফিরতেই বাবার অগ্নিমূর্তি। চীৎকার করে উঠলেন, ফিরে আসার দরকার কি ছিল? কোথায় ছিলি তিন দিন প্রবোধচন্দ্রের জবাব, তারাপীঠে।
বাবা বিমূঢ় প্রথম।—তারাপীঠে! সেখানে তোর কি? নিরুত্তর।
—বলে যাসনি কেন?
মা ইন্ধন জোগালেন, আমি বিশ্বাস করি না ও তারাপীঠ গেছল—তুমি খোঁজ নাও।
বাবা আবার ক্ষিপ্ত।—এইরকম স্বাধীন ভাবিস তুই নিজেকে, কেমন? তোকে দেখে তোর ছোট ভাই দুটো কি শিখছে? নিজের সর্বনাশ করছিস সেই সঙ্গে ওদেরও সর্বনাশ করছিস? আমি এই লাস্ট ওয়ার্নিং দিলাম, এমন স্বাধীনতার পাখা আমি বাড়তে দেব না― দেব না!
পরদিনই আবার ঘর ছেড়েছে। সকলের অগোচরে। সঙ্গে ছোট্ট সুটকেশ। দু‘চারটে জামা-কাপড়। নিজের আড়াই বছরের টিউশনির রোজগার শ’পাঁচেক টাকা। পৈতেয় পাওয়া সোনার বোতাম আর দুটো সোনার আঙটি। হাতের ঘড়ি। এই সম্বল।
প্রথমে পুরী গেছে। জনাদুই সাধকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। তাঁরা ত্রাণ আর পরমার্থ লাভের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু পাঁচ মাস না যেতে প্রবোধচন্দ্র দু‘জনার কাছ থেকেই পালিয়েছে। তার কেবল মনে হয়েছে আলোর হদিস নেই, সে কেবল অন্ধকারের মধ্যে সেঁধিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু ঘরের বদলে ভবঘুরের নেশায় পেয়ে বসেছে তাকে। কাশী-হরিদ্বার-ঋষিকেশ-লছমনঝোলা-উত্তরকাশী-কেদারন্দ্রী এসব কিছুই বাকি থাকেনি। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরেছে। হিমালয়ের গুহা-কন্দরে বিচরণ করেছে। হ্যাঁ, কোনো না কোনো যোগীপুরুষের সন্ধান পেয়েছে। কিছুকাল লেগে থাকার পর আবার একই দশা। তখন যেন প্রাণ নিয়ে পালানোর তাড়া।
…কামাক্ষ্যায় এক তান্ত্রিকের আশ্রয়ে এক বছর ছিল। ভেবেছিল আশ্রয় মিলল। কিন্তু শেষে দেখল ভৈরব-গুরুর যোগ-সাধনা ব্যভিচার মুক্ত নয়। আবার পথ সম্বল। বিহার আর মধ্যপ্রদেশেরও অনেক জায়গায় ঘুরেছে।
ফল শূন্য।
লাভের মধ্যে এই চার বছরে সে রিক্ত, কপর্দকশূন্য। কারো অনুগ্রহ হলে আহার জোটে, না হলে জোটে না। ঘুরে ফিরে আবার সে এই বাংলায় ফিরে এলো। কলকাতায় নয়, এলো রামপুরহাটে। বয়স তখন পঁচিশ। কিন্তু মনের বয়েস যেন একশ পঁচিশ। ইচ্ছে, সেই তারাপীঠেই বামাক্ষেপার পঞ্চমুণ্ডির আসনে মৃত্যু পণ করে বসবে। জীবিত কাউকে পেল না। অমর লোকের ওই সাধক যদি পথের হদিস দেয়। বাড়ি ছেড়ে তিন দিনের জন্য এই তারাপীঠে এসেছিল বলেই বাবা বরাবরকার জন্য তাকে বাইরের পথ দেখিয়ে দিয়েছিল। অনেক জায়গায় ঘুরিয়ে সেই তারাপীঠই আবার তাকে টানছে। গত চার বছরে কম করে এক কুড়ি যোগীর সংশ্রবে এসেছে। এদের কেউ তান্ত্রিক কেউ বা ভিন্ন পথের। তন্ত্রের ওপরেই প্রবোধচন্দ্রের বেশি টান কেন নিজেও জানে না। এ সম্পর্কে যেটুকু ধারণা তার সবটাই ভাসা-ভাসা। এই সাধনার লক্ষ্য মোটামুটি জানা আছে। বৈদিক সাধনার তুলনায় তন্ত্রসাধনা অনেক বেশি রহস্যময় বলে মনে হয়। তাছাড়া বৈদিক সাধনার মধ্যে অপ্রকাশ কিছু নেই, গোপন কিছু নেই। তন্ত্রসাধনার সবটুকুই গোপন, গুহ। রহস্যময় মনে হওয়ার এও হয়তো একটা কারণ। কিন্তু এই মার্গের খাঁটি সাধক বা সিদ্ধপুরুষ কি নেই কোথাও? যারা হাত বাড়িয়ে তার হাত ধরতে চাইলো, তাদের কাছে ধরা দিতে পারা গেল না কেন? কামাচার-ব্যভিচার কোনো সাধনার অঙ্গ হতে পারে এই চিন্তা কিছুতেই মনে ঠাঁই পায় না। আশার থেকে অনেক বেশি হতাশা নিয়েই তারাপীঠ লক্ষ্য করে রামপুরহাটে এসেছে।
কিন্তু আসলে তার জন্য অন্য কিছু নির্দিষ্ট বলেই রামপুরহাট আসা।
এখানে খবর পেল বছর তিন চার হলো বক্রেশ্বরের মহাশ্মশানের গায়ে একজন বিরাট তন্ত্রসাধক ডেরা করে আছেন। এর বহু আগে থেকেই বক্রেশ্বরের ওই মহাশ্মশান তাঁর সাধন ক্ষেত্র ছিল নাকি। কিন্তু তখন এক নাগাড়ে তিনি চার ছ’মাসের বেশি থাকতেন না। কোথায় চলে যেতেন কেউ জানে না। অনেকের ধারণা তিনি এখানেই থাকতেন কিন্তু অদৃশ্যভাবে থাকতেন। মোট কথা বছরে চার ছ’মাস করে প্রতি বছরই তাঁকে বক্রেশ্বরে দেখা যেত। কারো সঙ্গেই তিনি বড় একটা বাক্যালাপ করতেন না, কারো দিকে চোখ মেলে তাকাতেনও না বড়। কিন্তু যাকে ডাকতেন বা যার দিকে তাকাতেন, সকলেই বুঝতো সে বাবার কৃপা পেল। এ-রকম কৃপা এই রামপুরহাটেও কেউ কেউ পেয়েছে। যেমন এখানকার এক পুলিশ অফিসারের নাম সকলেই জানে। মোহিনী ভটচায়। খুব জাঁদরেল লোক ছিলেন এক সময়। কিন্তু তাঁকে কেউ ভালো মানুষ বলে ভাবত না। মদ্যপ অত্যাচারী বলেই জানত। শুধু তিনি কেন, তাঁর ভাই ভাইপোও পুলিশে চাকরি করে। কেউ কম যায় না। এই মোহিনী ভট চাকে যম-রোগে ধরেছিল। লিভার ক্যানসার। শিবের অসাধ্য রোগ। শুনে অনেকে খুশি হয়েছিল। হবে না কেন, মিত্রর থেকে তাঁর শত্রুই তো বেশি।
…মোহিনী ভটচায, পাগলের মতো হয়ে গেছলেন। সবই কৃতকর্মের অপরাধের ফল ভেবেছেন তিনিও। তারাপীঠ তো রামপুরহাটের গায়েই। স্টেশন থেকে আড়াই তিন মাইল পথ। মোহিনী ভট্টচার্য, তারা মায়ের সামনের চাতালে এসে হত্যা দিলেন। মায়ের সামনেই এই পাপ-দেহ যাক।
তিন দিন বাদে ভোরের দিকে এক অদ্ভূত স্বপ্ন দেখলেন তিনি। কোনো মেয়েছেলের গলা যেন ধমকাচ্ছে তাকে। এখানে পড়ে থাকলে তো মরবি, বাঁচতে চাস তো বক্কোমুনির থানে কংকালমালীর কাছে যা না! তার ঝাঁটা না খেলে এই রোগ পালায়?
…ঘুম ভাঙার পরেও সেই রমণী-কণ্ঠ যেন কানে লেগে আছে৷ বক্কোমুনির থান মানে বক্রেশ্বরের মহাশ্মশান। আর সেখানকার ওই ভৈরবের নাম কংকালমালী। কংকাল যার গলায় মালা সে কংকালমালী। এককথায় রুদ্র, শিব। কিন্তু সেই ভৈরবের কংকালমালী নাম বটে, তার অঙ্গে কংকালের কোনো চিহ্নও নেই নাকি।
কংকালমালী ভৈরবের নাম মোহিনী ভট্টচাযের শোনা ছিল অবশ্য। কৃপা হলে অনেকের আধি-ব্যাধি সারিয়েছেন এমন খবরও কানে এসেছে। কিন্তু কণামাত্র বিশ্বাস নেই বলেই তাঁর কথা মনে হয়নি। না ভোর-রাতের এই আদেশ তিনি নিজের অবচেতন মনের ক্রিয়ার ফল ভাবতে পারলেন না। গাড়িতে কত আর পথ বক্রেশ্বর। পুলিশের চাকরি, গাড়ি পেতেও অসুবিধে নেই।
ডেরায় ভৈরব কংকালমালী নেই। কেউ বলতে পারল না তিনি কোথায়। অথচ এক ঘণ্টা আগেও অনেকে দেখেছে নাকি৷ মোহিনী ভট্টচার্য, তাঁকে মন্দিরে আর উষ্ণ প্রস্রবণগুলির দিকে খোঁজাখুঁজি করলেন। কোথাও তাঁর হদিস পেলেন না।
শ্রান্ত ক্লান্ত মোহিনী ভট্টচার্য, সন্ধ্যার দিকে একলা পাপহরার প্রবাহ ধরে এগিয়ে চললেন। এই পাপহরার ধারেই শ্মশান৷ অনেক দূরে একটা নিভু নিভু চুল্লি লক্ষ্য করে এগিয়ে চললেন তিনি। নিজের ইচ্ছেয় নয়, পা দুটো আপনা থেকে সেই দিকে চলল। জায়গায় জায়গায় শেয়ালের শব নিয়ে কাড়াকাড়ি চোখে পড়ছে। কিন্তু মোহিনী ভট্টচাযের তখন আর ভয়-ডর বলে কিছু নেই।
চুল্লির অদূরে কে একজন বসে। মাঝে মাঝে জোরে বাতাস দিচ্ছে, বাতাসে চুল্লির আগুন এক-একবার বাড়ছে। সেই আগুনে তাঁকে দেখা যাচ্ছে। কাছে এগোলেন। আরো ভালো করে তাঁকে দেখলেন। সম্পূর্ণ নগ্ন। মাথার জটাজ ট চুল-দাড়ি বুক-পিঠের নিচে নেমে এসেছে। গায়ের রং কালোর দিক-ঘেঁষা লালচে মনে হলো।
কেউ বলে না দিলেও ভট্টচার্য, যেন জানেন ইনিই কংকালমালী ভৈরব! হাত জোড় করে দাড়িয়ে রইলেন।
অনেকক্ষণ বাদে ভৈরব ভাঁটার মতো চোখ তুলে তাকালেন তাঁর দিকে। তারপর কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ একটা আধপোড়া চেলা কাঠ নিয়ে তাড়া করলেন তাঁকে। মোহিনী ভট্চাযের প্রথম অনুভূতি পালানোর তারপর মনে হলো মৃত্যুর খাঁড়া তো এমনিতেই মাথার ওপর ঝুলছে—পালাতে যাবেন কেন! হাত জোড় করে দাড়িয়েই রইলেন।
ভৈরব হুংকার দিয়ে উঠলেন, শালা মরনেকা লিয়ে আয়া—নিকালো হিয়াসে।
ভট্টচার্য, হাত জোড় করে দাড়িয়েই রইলেন। ক্রুদ্ধ ভৈরব হাতের জ্বলন্ত চেলাকাঠ নিয়েই হন হন করে একদিকে চললেন।
মোহিনী ভট্টচার্য, কলের মতোই তাঁকে অনুসরণ করলেন।
অনেকটা পথ পেরিয়ে ভৈরব একটা ভাঙাচোরা চালাঘরের সামনে মাটির দাওয়ায় বসলেন। জোরে হাওয়া দিলে ভেঙে পড়বে এমনি ঘরের দশা! অন্ধকার। চেলা-কাঠের আগুনে যেটুকু দেখা যায়।
চোখের ইশারায় ভট্টচার্য কে সামনে বসতে বললেন।
ভট্টচাৰ্য বসলেন।
ভৈরবের সঙ্গে তিন দিন সেই চালাঘরে কাটিয়েছেন তিনি। না চালাঘরেও নয়, ওই দাওয়ায়। ভৈরব ঘরের মধ্যে রাত কাটিয়েছেন নয়তো শ্মশানে। গাঁয়ের লোক ভৈরবকে ফলমূল দিয়ে যায়। তিনি পা দিয়ে সেগুলো ওঁর দিকে ঠেলে দেন। এ-ছাড়া এই তিন দিনে আর কোনো আহার ছিল না। তিন দিনের মধ্যে ভৈরবকে তিনি কিছুই মুখে তুলতে দেখেন নি।
… তৃতীয় রাতে ঝোলা থেকে কিছু শেকড়-বাকড় বার করে তাঁর হাতে দিয়েছেন। রোজ একটু একটু করে জল দিয়ে ছেঁচে তারপর বেটে খেতে বলেছেন। তখনই স্পষ্ট বাংলা কথা শুনেছেন তাঁর মুখে। বলেছেন, শাল। তুই অনেক পাপ করেছিস, তারই দুর্ভোগে পড়েছিস— এমনিতে তোর বিশেষ কিছুই হয়নি, এরপর সমঝে না চললে হাড়ে-মাংসে পচন ধরে মরবি। যা ভাগ—
দিন সাতেকের মধ্যেই সুস্থ সবল মানুষ নোহিনী ভট্টচার্য! দেহে কোনো ব্যাধির চিহ্নমাত্র নেই। সেই থেকে ভদ্রলোক একেবারে বদলে গেছেন। এখনো কাজে বহাল আছেন এই পযন্ত। জপ-তপ সম্বল করে ভারী আনন্দে আছেন। আরো আশ্চর্য, শুধু তিনিই নন, পুলিশের চাকুরে তাঁর ভাই-ভাইপোরা পর্যন্ত একেবারে বদলে গেছে। কংকালমালী ভৈরব তাঁদের কাছে জাগ্ৰত শিব।
কিন্তু এই শিবের নাগাল পাওয়া ভাব। মোহিনী ভট্চায়, সম্পূর্ণ সুস্থ হবার খবর শুধু রানপুরহাটে কেন— অনেক জায়গার লোকই জেনেছে। ব্যাধি নিরাময়ের আশায় আগেও লোক যেত তাঁর কাছে। এরপর ছোটাছুটির ধুম পড়ে গেল। কিন্তু কোথায় কংকালমালী ভৈরববাবা? তিনি হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন। পরের বছরখানেক তাঁর আর কোনো পাত্তাই নেই।
তারপর শ্মশানের সেই ডেরায় হঠাৎই আবার তার দেখা মিলল। তখন আবার কাতারে কাতারে মানুষের ভিড়। ব্যাধিগ্রস্তদের আবেদন নিবেদন। মেজাজ হলে ভৈরব ওষুধ দেন। না হলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেন। কিন্তু তাড়ালেই কি লোক সরে যায়। ফলে ভৈরবই আবার অদৃশ্য হন। এই করেই কয়েকটা বছর চলেছিল। বছরের মধ্যে মাস কয়েক ভৈরব-বাবা বক্কোমুনির এই শ্মশানের ডেরায় থাকেন। বাকি সময় তিনি কোথায় থাকেন কেউ জানে না। এখানে থাকেন যখন, একটি লোক সপ্তাহের বেশির ভাগ দিনই ভৈরবের ওখানেই পড়ে থাকেন। তিনি রামপুরহাটের মোহিনী ভট্টচাৰ্য।
বছর চারেক হলো বাবার চালচলনের ব্যতিক্রম দেখছে সকলে। কংকালমালী ভৈরব এখানেই আছেন। আর যান না কোথাও। তাঁর শ্মশানের সেই ডেরা একবার তাঁর অনুপস্থিতিতে সম্পূর্ণ ভেঙে আরো অনেক বড় আর মজবুত করে ঘর তুলে দিয়েছেন মোহিনী ভট্টচার্য। দরকারও হয়ে পড়েছিল। কারণ, তারও তিন বছর আগে অর্থাৎ সাত বছর আগে ভৈরববাবার ডেরায় একজন বাসিন্দার আবির্ভাব দেখেছে সকলে। তিনি এক ভৈরবী। বয়েস বেশি নয়, অপূর্ব রূপসী। সেবারে বাবা এক বছরের জন্য নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন। ফিরলেন যখন, সঙ্গে এই ভৈরবী। ভৈরববাব। কোথা থেকে এই ভৈরবী সংগ্রহ করেছেন, সঠিক কেউ জানে না। কিন্তু ভৈরবীকে নিয়ে কিছু কানাঘুষো শোনা যায়। তিনি নাকি বীরভূমেরই বড় কোনো ঘরের ঘরণী। অত্যাচারী লম্পট স্বামীর সঙ্গে বনিবনা ছিল না বলে কলকাতায় বাস করতেন। তবে সবই শোনা কথা। এই ভৈরবীকে আগে চাক্ষুষ কেউ কখনো দেখেনি। আর এই কানাঘুষোও একটুও সরব হয়ে ওঠেনি ভয়ে। কারণ, যে ভৈরবীকে নিয়ে কথা, তাঁর ভৈরব স্বয়ং কংকালমালী—যিনি জাগ্রত শিব। কানাঘুষোয় বেশি কান দিয়ে কে তাঁর রোষের মুখোমুখি হতে চায়?
ভৈরবীর আবির্ভাবের পরে ও গোড়াব বছর তিনেক কংকালমালী ভৈরব নিয়মিত সাত আট মাস করে অদৃশ্যই থাকতেন। ভৈরবী মায়ের দেখা শুনোর ভার তখন সম্পূর্ণই মোহিনী ভট্চাযের। তিনি তাঁকে মাতৃজ্ঞানে পূজা করেন।—কিন্তু গত চার বছরে কংকালমালী ভৈরব আর ঠাঁই বদল করেননি। বক্কোমুনির থানে অর্থাৎ শ্মশানেই ভৈরবীকে নিয়ে আছেন।
রামপুরহাটে থাকাকালীন প্রবোধচন্দ্র এ-সব সমাচার শুনেছিল তারাপীঠের এক বৃদ্ধ ভক্তর মুখে। তখন রামপুরহাট থেকে রোজই তিন মাইল পথ পায়ে হেঁটে একবার করে তারাপীঠে আসত। তখনই এই বৃদ্ধের সঙ্গে আলাপ। পরের জীবনের কালীকিংকর অবধূতের বিশ্বাস এ-ও এক সাজানো ঘটনা। নইলে ওই বৃদ্ধের সঙ্গে তাঁর এমন অন্তরঙ্গ যোগাযোগের আর কোনো তাৎপর্য নেই।
বৃদ্ধটিকে প্রবোধচন্দ্রের ভারী ভালো লেগেছিল। সে বামাক্ষ্যাপার পঞ্চমুণ্ডির আসনে ধ্যানস্থের মতো বসেছিল। ফোঁস ফোঁস দীর্ঘনিশ্বাস কান আসতে দেখে পাশে ওই বৃদ্ধ বসে। পর পর তিন চারদিন একই ব্যাপার। কথায় কথায় আলাপ। বৃদ্ধের বড় দুঃখ তারা-মা কতজনকে ভরিয়ে দিল, কিন্তু তাঁর প্রতি কৃপা আর হলো না। কোন্ কৃপার প্রত্যাশী তিনি? — কিছু না। কেবল মা আছেন, এই বদ্ধ বিশ্বাসটুকুই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান, এটুকুরই প্রত্যক্ষ প্রমাণ তিনি দেখতে চান। ভদ্রলোক রেলের ভালো চাকরি করতেন। প্রৌঢ় বয়সে বউ মারা যায়। সংসার বলতে তিন ছেলে। রিটায়ার করার পর কলকাতায় বাড়ি করেছিলেন। ছেলেরা তখন সংসারী। রিটায়ার করার পরে মনে হয়েছিল তাঁদের সংসারে তিনি অবাঞ্ছিত। মনে হওয়া মাত্র সব ছেড়েছুড়ে পনেরো বছর ধরে তারাপীঠে পড়ে আছেন। পেনসনের টাকা ক’টি সম্বল। তা-ও সব নয়, পেনসনের তিন ভাগের একভাগ ছেলেরা মাসে মাসে পাঠায়। সেই রকমই নির্দেশ ছিল তাঁর। দিবিব চলে যায়।… কিন্তু না দয়া করছেন না।
ভদ্রলোককে এত ভালো লেগেছিল যে প্রবোধচন্দ্র নিজের হতাশার কথাও তাঁকে বলেছিল। শুনে আন্তরিক পরামর্শই দিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, বাবা তুমি একবার বক্কোমুনির থানে গিয়ে কংকালমালী ভৈরবের শরণ নাও না—হয়তো যাকে খুঁজছ তাঁর মধ্যেই পেয়ে যাবে।
যতটুকু জানেন, কংকালমালী ভৈরবের সমাচার তিনি বলেছেন। প্রবোধচন্দ্রের খুব আগ্রহ হয়েছিল, কিন্তু সেখানেও এক ভৈরবীর অবস্থান শুনে হতাশ হয়েছিল। বলেছিল, ভৈরবী-টৈরবী নিয়ে যাঁরা সাধনা করছেন তাঁদের সংশ্রবে আর যেতে চাই না।
—কেন গো। তিনি অবাক।—আ-হা, সাক্ষাৎ মা জগদ্ধাত্রী তিনি—আমি নিজে গিয়ে একবার বাবাকে আর ভৈরবীকে দেখে এসেছি। ভৈরবী মা তো কেবল মাত্র লোককে ওষুধ দেওয়া ছাড়া আর কোনো ক্রিয়া-কলাপ করেন না—ভৈরব নিজের সাধন নিয়ে থাকেন, নিজে আর কাউকে ওষুধ দেন না—ওই ভৈরবী মা দেন।
শুনে আবার কৌতূহল হয়েছিল।—তাঁর ওষুধে লোকের অসুখ সারে?
—নিশ্চয়ই সাবে। নইলে মঙ্গলবারে ওষুধের জন্য হাজারের ওপর লোকের লাইন পড়বে কেন?
—ভৈরবী মায়ের বয়েস কত হবে?
—এঁদের বয়েস তো ঠিক ধরা যায় না। মনে হয় তেত্রিশ-চৌত্রিশ হবে।
—আর কংকালমালী ভৈরবের?
সেটা বলা অসাধ্য। কেউ বলে দেড়শ পৌনে দু‘শ বছর, আবার কেউ বলে পঁচাত্তর-আশী। আমি কেবল দেখেছি বেশ শক্ত মজবুত দেহ।
—ভৈরবী মা অপূর্ব রূপসী আর বয়েস মাত্র তেত্রিশ-চৌত্রিশ শুনে প্রবোধচন্দ্রের আবার দ্বিধা। ভৈরবীদের সম্পর্কে তাঁর ধারণা কখনো ভালো ছিল না। তার মধ্যে নিজেরও কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে।…হ্যাঁ, কামাখ্যা থেকে তাকে পালিয়েই আসতে হয়েছিল। সেখানে এক ভৈরবের করুণা পাবে আশা হয়েছিল। কিন্তু পাঠ শুরু হয়েছিল তাঁর ভৈরবীর কাছে। তার থেকে কম করে বিশ বছরের বড়। আরো বেশি হতে পারে। ভৈরবীদের বয়েস সত্যিই আঁচ করা শক্ত।…সেই ভৈরবী প্রথমেই তাকে কানাচারের পাঠ দিতে এগিয়েছিলেন। তাকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে আর নিজে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে তার কোলে বসে হর-পার্বতীর এই রূপ ধ্যান করতে বলেছিলেন। প্রবোধচন্দ্র সেখান থেকে সেই রাতেই পালিয়েছিলেন। বক্রেশ্বর যাবে কি যাবে না স্থির করতে দুই একটা দিন কেটে গেল। একবার ভাবল, রামপুরহাটে মোহিনী ভট্টচার্যের সঙ্গে আগে গিয়ে দেখা করলে কি হয়? তার থেকে আগে নিজের চোখে গিয়ে একবার দেখে আসাই ভালো মনে হলো। এই ভৈরবী মাতাজী এত লোককে ওষুধ দেন, সে-ও কেন যেন এক বাড়তি আকর্ষণের মতো মনে হলো তার।
এক মঙ্গলবারের ভোরেই বক্রেশ্বরে এলো।… তারাপীঠের বৃদ্ধ খুব অত্যুক্তি করেননি। সেই সকাল থেকেই ওষুধের আশায় কাতারে কাতারে লোক লাইন করে দাড়িয়ে আছে। স্থানীয় লোকের মুখে শুনল সুপুর-রামপুর-ইলামবাজার-বোলপুর-সাঁইথিয়া-রামপুরহাট-নলহাটি-সিউড়ী থেকে তো বটেই, ওষুধের আশায় মুর্শিদাবাদ-সাঁওতাল পরগনা-বর্ধমান এমন কি কলকাতা থেকেও লোক আসার বিরাম নেই। বক্কো বাবার থানে ভৈরবী মায়ের ওষুধের কথা ব্যাধিগ্রস্ত মানুষের কানে কোনো না কোনো ভাবে পোঁছেই যায়।
সকাল থেকে প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত ঠায় দাঁড়িয়ে প্রবোধচন্দ্র ভৈরবী মায়ের ওষুধ দেওয়া দেখল। আর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সেখানে শৃঙ্খলার তদারক করছেন যে প্রৌঢ় ভদ্রলোক, তিনিই কংকালমালী ভৈরবের অশেষ কৃপাপ্রাপ্ত মোহিনী ভট্চায্। অন্যরা তাঁরই ভাই-ভাইপো অথবা তাদের লোক। ভৈরবী মা উঁচু বাঁধানো দাওয়ার আসনে বসে। তাঁর দু‘হাতের মধ্যে কাগজ কলম নিয়ে বসে আর একটি লোক। পিছনে একটা লাল বঙ্গলের ওপর নানা আকারের ডালার মধ্যে ছোট বড় কাগজের মোড়ক। সেখানেও আর একটি লোক বসে। ভৈরবী মায়ের দাওয়ার দশ গজ তফাতে ছোট্ট একটা কাঠের গেট। সেটা সরিয়ে একজন করে লোক মায়ের সামনে আসছে। তার হয়ে গেলে সে আর এক দিক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, লাইনের পরের লোক আসছে। বিশ গজ ফারাক থাকার দরুন কারো ব্যাধির কথা অপরে শুনতে পাচ্ছে না।.. হ্যাঁ, অনির্বচনীয় রূপই বটে মাতাজীর। কিন্তু বড় স্থির, স্নিগ্ধ। অন্য ভৈরবীদের মতোই পরনে রক্তাম্বর বেশবাশ —এটুকুই শুধু মেলে, আর কিছু মেলে না।…কি মেলে না প্রবোধচন্দ্র সব ঠাওর করতে পারল না, কেবল মনে হলো রূপ তো নয়ই, কোনো কিছুই মেলে না।
ভৈরবী মা পারত পক্ষে কারো সঙ্গে কথা বলছেন না। যে আসছে স্থির চোখে শুধু তাকে দেখছেন, তার নিবেদন শুনছেন। শোনা হলে একটু ঘুরে পিছনের লোক তাঁর ইশারায় ডালা সামনে এগিয়ে দিচ্ছে। তিনি ওষুধ তুলে আলতো করে প্রার্থীর অঞ্জলিবদ্ধ হাতে ফেলে দিচ্ছেন। ওষুধ কি ভাবে খেতে হবে খুব সম্ভব মোড়কের গায়ে বা ভিতরে লেখা থাকে। ওষুধ পেলে প্রার্থী যুক্ত হাতে প্রণাম করে সামনের কাঠের বাক্সে একটি সিকি ফেলে চলে যায়। সমস্ত ওষুধেরই এই এক প্রণামীমূল্য। সকলেই জানে এটুকু শুধু ওষুধ সংগ্রহের খরচ। অর্থাৎ বিনা মূল্যেরই ওষুধ। মায়ের পা ছুঁয়ে প্রণাম করার রীতি নেই। দু‘পা ঢেকে মা যোগাসনে বসে থাকেন। ওষুধ পেলে হাত জোড় করে প্রণাম করে চলে যেতে হয়। সকলেই ওষুধ পায় বা সকলেরই ওষুধ মজুত থাকে এমন নয়। যে পায় না বা যার ওষুধ মজুত থাকে না, নিবেদন শোনার পর মা আঙুলের ইশারায় ও-দিকে কাগজ কলম নিয়ে বসা লোকটিকে দেখিয়ে দেন। সেই লোক দু‘চার কথায় কিছু লিখে রেখে তাকে এক বা দু‘সপ্তাহ পরে আসতে বলে দেয়।
ভোর সাতটা থেকে বিকেল প্রায় পাঁচটা পর্যন্ত একদিকে ঠায় দাঁড়িয়ে লোকের এই ওষুধ নেওয়ার পর্ব দেখে গেল প্রবোধচন্দ্র। এর মধ্যে লেখার লোক আর ওষুধের ডালা এগিয়ে দেবার লোক বদল হয়েছে, একমাত্র মোহিনী ভট্টচার্য, ছাড়া অন্য সব তদারকি লোকদেরও পালা করে এক-দেড় ঘণ্টার জন্য অনুপস্থিত থাকতে দেখা গেছে। শুধু মোহিনী ভট্টচার্য, একভাবেই তাঁর কাজ করে গেছেন, আর আসন ছেড়ে একবারও নড়েননি কেবল ভৈরবী না।
…আর অনতিদূরে এই একটি ছেলে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ঠায় দাড়িয়ে কেবল দেখে গেছে—
—এটুকু লক্ষ্য করেছেন ভৈরবী মা-ও। চোখ তুলে দুই একবার সোজা তাকিয়েছেন তার দিকে। প্রবোধচন্দ্রের তখন মাথা নিচু।
তখনও যারা আসছিল মোহিনী ভট্টচার্য, তাদের হাতের ইশারায় চলে যেতে বললেন। অর্থাৎ আর হবে না, ভৈরবী মা তাঁর আসন ছেড়ে উঠে পড়েছেন। পয়সার কাঠের বাক্স, ওষুধের ডালা তিনিই দাওয়া থেকে ঘরে রেখে এলেন। অন্য সকলে বাইরে দাওয়ার ওপর দাড়িয়ে। ভৈরবী মা দাঁড়িয়ে দুই এক মিনিট ভট্টচার্যের সঙ্গে কথা বললেন। প্রথমে দোর গোড়ায় পরে ভৈরবী মা-কে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে সকলকে নিয়ে অদূরে দাঁড়ানো একটা মোটরে উঠলেন তিনি। যাবার সময় একটু দাড়িয়ে গিয়ে প্রবোধচন্দ্রকে ভালো করে লক্ষ্য করলেন। ঘুরে দেখলেন ভৈরবী মা-ও এই ছেলেটির দিকেই তাকিয়ে আছেন। কিছু না বলে তিনি চলে গেলেন। বিকেলের আলোয় টান ধরেছে। দাওয়ায় ভৈরবী মা দাঁড়িয়ে। গজ পনেরো তফাতে প্রবোধচন্দ্র। তার মাথা নিচু।
একবার মুখ তুলতে চোখাচোখি হলো। মনে হলো ভৈরবী মা মাথা নেড়ে তাকে কাছে আসতে ইশারা করলেন।
মাথা নিচু করে প্রবোধচন্দ্র পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো। দাওয়ার তিন হাতের মধ্যে দাঁড়ালো।
—তোমার কি ?
প্রবোধচন্দ্র মাথা নাড়ল। কিছু না।
—কিছু না তো সকাল থেকে দাঁড়িয়ে আছ কেন?
নিরুত্তর।
—কিছু বলবে?
মুখ না তুলে মাথা নাড়ল। কিছু বলার নেই।
ভৈরবী মা স্থির চোখে দেখছেন। —তাহলে না খেয়ে সেই সকাল থেকে দাঁড়িয়ে আছ কেন? কি চাই?
—ভৈরব বাবার দর্শন। তাঁর কৃপা।
আবার নিরীক্ষণ করছেন। তিনি কাউকে দর্শন দেন না, কারো সঙ্গে কথা বলেন না।
প্রবোধচন্দ্র নির্বাক।
ভিতর থেকে বিরক্ত গম্ভীর গলা শোনা গেল।—বাইরে কে দাঁড়িয়ে—কার সঙ্গে কথা বলছ?
—একটি ছেলের সঙ্গে।
—কি চায়?
—আপনার দর্শন আর কৃপা।
এবারে হুঙ্কার। —চলে যেতে বলো।
প্রবোধচন্দ্র ভয়ে ভয়ে ভৈরবী মায়ের দিকে তাকালো।
তিনি স্থির চোখে তাকেই দেখছেন। একটা হাত তুলে তাকে অপেক্ষা করতে ইশারা করে ভিতরে চলে গেলেন। একটু পরেই ফিরলেন। এক হাতের চেটোয় শালপাতা, অন্য হাতে মাটির গেলাস।
—ধরো।
প্রবোধচন্দ্র মুখ তুলল। শালপাতায় খানিকটা মেওয়াগোছের কিছু। গেলাসে দুধ।
ক্ষুধা তৃষ্ণায় গলা-বুক শুকিয়ে ঝামা হয়ে আছে খেয়াল ছিল না। দেখে তাড়াতাড়ি দু‘হাত বাড়ালো। ভৈরবী নায়ের হাত থেকে আগে শালপাতা নিল। শুকনো গলা বুক, তাড়াতাড়ি খেতে গিয়ে বিষম খেল।
—আগে খানিকটা দুধ খেয়ে গলা ভিজিয়ে নাও।
প্রবোধচন্দ্র তাই করল। খাওয়া শেষ হতে নাটির গেলাস আর শালপাতা হাতে দাঁড়িয়েই রইলো।
ভৈরবী না তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখছেন। গলা খাটো করে বললেন, কাল সকাল ছ’টার আগে এসো, দর্শন পাবে। কৃপা কতটা পাবে তিনি জানেন।
একটু এগিয়ে গিয়ে হাতের শালপাতা আর মাটির গেলাস ফেলে প্রবোধচন্দ্র একবার ফিরে তাকালো।
ভৈরবী না সেখানেই দাঁড়িয়ে আছেন। চেয়ে আছেন।
রাতটা প্রবোধচন্দ্র মন্দিরের চাতালে শুয়ে বসে কাটিয়ে দিল। ঘুম প্রায় হলোই না। আধো ঘুমের মধ্যে কতবার ভৈরবী মায়ের মুখখানা দেখল ঠিক নেই। আধো ঘুমের মধ্যেই এক-একবার মনে হলো সে যেন বিশেষ কোনো আনন্দের উৎসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সেই উৎসের মধ্যেও ভৈরবী মায়ের মুখের ছায়া দুলছে। আর সম্পূর্ণ জাগ্রত অবস্থায়ও থেকে থেকে মনে হয়েছে সে এই জীবনের কিছু একটা সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে।
রাত চারটেয় মন্দিরের চাতাল ছেড়ে নেমে এসেছে। ছোট সুটকেশটা সেখানেই একজনের জিম্মায় রেখেছিল। একপ্রস্থ জামা-কাপড় বার করে ভোর সাড়ে চারটের মধ্যে স্নানাদি সেরে ফেলল। তারপর অধীর প্রতীক্ষা। শ্মশানের কাছাকাছিই ঘোরাঘুরি করতে লাগল। কংকালমালীর ডেরার সামনে এসে দাড়ালো যখন, সকাল তখন সোয়া পাঁচটা হবে। ফাল্গুনের শেষ সেটা। ভোরের আলো তখনো খুব ভালো করে জাগেনি। তবে ফাঁকা শ্মশানে ভোর একটু তাড়াতাড়িই হয়।
ডেরার কাছাকাছি এসে থমকে দাঁড়ালো। সদ্য স্নান সেরে ভৈরবী মা দাওয়ার তারে ভেজা বসন শুকুতে দিচ্ছেন। আছড় গায়ে শুকনো রক্তাম্বর জড়ানো। দু‘হাত তুলে তারে ভেজা কাপড় মেলে দিতে গিয়ে বুকের বসন অনেকটা স্খলিত।
কাপড় মেলে ভৈরবী মা থনকে দাঁড়ালেন। পঁচিশ-ত্রিশ গজ দূরে গত সন্ধ্যার সেই ছেলেটি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে।
দেখলেন একটু। তারপর ভিতরে চলে গেলেন। মিনিট তিন-চারের মধ্যে আবার বেরুলেন। রক্তাম্বর বেশ-বাস সুবিন্যস্ত। মাথা নেড়ে ডাকলেন।
প্রবোধচন্দ্র পায়ে পায়ে দাওয়ার সামনে এসে দাড়ালো। অপলক চোখে ভৈরবী মা তার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করলেন। যাকে দেখছেন তার চোখ নিজের পায়ের দিকে।
মাটির দেয়ালের পেরেকে টাঙানো দুটো কুশাসন নামিয়ে দাওয়ার নেঝেতে মুখোমুখি পাতলেন।—ভিতরে এসে বোসো, তুমি একটু আগে এসে গেছ, বাবা মাঝ-রাত থেকেই শ্মশানে, এখনো ফেরেননি।
প্রবোধচন্দ্র দাওয়ায় উঠে আসনে বসল। হাত দুই তফাতে তিনিও আসনস্থ হলেন। প্রবোধচন্দ্রের মনে হয় মহিলার চাউনি স্নিগ্ধ, কিন্তু বড় বেশি স্থির আর অপলক।
—কাল রাতে তুমি ঘুমোওনি?
স্নানাদি সেরে পরিচ্ছন্ন হয়ে এসেছে, তবু আঁচ করলেন কি করে জানে না।—তেমন ভালো না…।
—এখানে কোথায় থাকো?
—এখানে থাকি না।
—কাল কোথা থেকে এখানে এসেছিলে?
—তারাপীঠ থেকে!
—তারাপীঠে থাকে!?
—না।
—তাহলে?
—কোথাও থাকি না, যেখানে ঠাঁই মেলে থেকে যাই। একবারও মুখ না তুলে জবাব দিয়ে যাচ্ছে!
ভৈরবী মায়ের দু‘চোখ তার মুখের ওপর তেমনি স্থির, অপলক। তোমার নাম কি?
বললো।
—তোমার বাবা মা ঘর বাড়ি নেই?
—বাবা মা আছেন, কলকাতায় তাঁদের ঘর বাড়িও আছে।
—তাঁদের সঙ্গে তোমার কোনো সম্পর্ক নেই?
—না।
—তুমি কতদিন তাঁদের কাছ ছাড়া?
—চার বছর।
—তোমার বয়স কত এখন?
—পঁচিশ।
—মায়ের অনুমতি নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিলে?
—না।.. নিজের মা নয়।
আবার থমকে চেয়ে রইলেন। মার দিকে সে একবারও মুখ তোলেনি।—পড়াশুনো কত দূর করেছ?
—এম. এ. পড়ছিলাম। পরীক্ষা দেওয়া হয়নি।
পরের প্রশ্ন করতে সময় নিলেন একটু। সেই ফাঁকে দেখে নিচ্ছেন। —চার বছর তুমি কোথায় কোথায় ঘুরেছ?
—ভারতবর্ষের প্রায় সব সাধন-ভজনের জায়গায়।
—গুরু পাওনি?
—পেয়েছি…টিকে থাকতে পারিনি…নিজেকে সমর্পণ করার মতো কাউকে পাইনি।
—তন্ত্র সাধনার গুরু খুঁজছ?
—হ্যাঁ।
—কেন?
প্রবোধচন্দ্র বাঁধা বুলি কিছু বলতে পারত। কিন্তু সে চেষ্টা করল না। মুখ না তুলেও তার মনে হচ্ছিল ভৈরবী মা তার ভেতর-বার সবই দেখতে পাচ্ছেন। সত্যি জবাবই দিল। —জানি না।
—কিন্তু এখানে এসে তোমার কি সুবিধে হবে, ভৈরব বাবা কাউকে সাধন দেন না, কৃপাও করেন না।
—আপনি কৃপা করলে হতে পারে।
ভুরুতে ভাঁজ পড়ল একটু। — আমি বললেও হবে না, তাছাড়া তিনি যা করেন না, আমি তাঁকে তা বলতে যাব কেন?
—সে-কথা বলছি না… আপনার কৃপাই চাইছি।
ধমকালেন।— আমার কাছ থেকে সাধন নেবে? ঘাড় গোঁজ করেই সামান্য মাথা নেড়ে সায় দিল।
—কিন্তু আমার তুমি কতটুকু জানো?
অকপটে মনের কথাই বললো প্রবোধচন্দ্র। —আপনাকে আমার ভালো লেগেছে…।
—কি ভালো লেগেছে?
সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এত লোককে ওষুধ দেওয়া। উপকার না পেলে এত লোক আসত না।…এই সাধনটুকু পাওয়া আমার কোনো কিছু থেকে কম মনে হলো না।
অন্তত মিনিটখানেক আর সাড়াশব্দ নেই। ভৈরবী মায়ের দু‘চোখ এই ছেলের মধ্যে কি দেখছে তিনিই জানেন।
—মুখ তোলো।
প্রবোধচন্দ্র চেষ্টা করে দু‘চোখ তাঁর মুখের ওপর তুললো।
—তুমি আমার কাছ থেকে সাধন নেবে কি করে, তন্ত্র সাধনে দৃষ্টির সাধনা বড় জিনিস—তুমি তো আমার দিকে মুখ তুলে তাকাতেও পারছ না? দ্বিধান্বিত জবাব, আপনি কৃপা করলে পারব।
—আমি কৃপা করলে পারবে মানে? এখন পারছ না কেন? নিরুত্তর। আবার মাথা নিচু।
—কেন পারছ না?
—ভায়…।
হতবাক একটু।—কিসের ভয়, কেন ভয়?
দ্বিধান্বিত জবাব।—কামাখ্যায় আমার সাধনের ভার সেখানকার ভৈরব-বাবা ভৈরবী-মাকে দিয়েছিলেন। তাঁর আচরণে আমাকে সেখান থেকে পালিয়ে আসতে হয়েছে।
হতভম্ব একটু।—কেন, তাঁর মেজাজ খুব কড়া?
—না—
—তাহলে?
নিরুত্তর।
—কথার জবাব একবারে দেবে, তাহলে তোমাকে পালিয়ে আসতে হয়েছে কেন?
প্রবোধচন্দ্র মরিয়া হয়েই বলে ফেলল, ও-সব হর-গৌবীর আসন-টাসন আমার বিচ্ছিরি রকম নোঙরা মনে হয়েছিল তাই।
ভৈরবী-মা হতভম্ব প্রথম। তারপর বিড়ম্বনা আর হাসি চাপার তাড়নায় সমস্ত মুখ লাল। গালে হাত রাখার মতো করে এক হাতে মুখ চাপা দিয়ে জিগ্যেস করলেন, সেই ভৈরবী-মায়ের বয়েস কতো?
—চল্লিশ-বিয়াল্লিশ হতে পারে।
মুখ তোলো। এবারে নিজের মুখ সদয়।
প্রবোধচন্দ্র মাথা তুলল। এই মূর্তি অনির্বচনীয় মনে হলো তার। —সত্যিকারের কোনো সাধনেই নোঙরামির জায়গা নেই, তুমি ভুল লোকের কাছে গেছলে।…সে ভৈরবী নয়, পিশাচী। ভয়ে মুখ তুলতে চাও না কেন—আমাকে দেখেও তোমার সে-রকম মনে হয়?
প্রবোধচন্দ্র অপরাধী মুখে একটু জোরেই মাথা নাড়ল। মনে হয় না। উনি উঠে গেলেন। মিনিট তিন-চারের মধ্যে মাটির ছোট মালসার মতো পাত্রে বড় দুটো সাদা বাতাসা, দুটো নারকেলের নাড়ু, আর কিছু ভেজানো মুগের ডাল নিয়ে ফিরলেন। অন্য হাতে মাটির জলের গেলাস। সামনে রেখে বললেন, খাও।
প্রবোধচন্দ্র তক্ষুণি খেতে লাগল। গতকাল সকাল থেকে তার পেটে অন্ন পড়েনি।
খাওয়া শুরু করেই সচকিত। কঙ্কালমালী ভৈরব-বাবা আসছেন। পরনে সামান্য কৌপিন, হাতে লম্বা চিমটে! দূর থেকে তাকে দেখেই বিরক্ত রুষ্ট মুখ।
দাওয়ায় এসে দাড়াতেই ভৈরবী-মা আসন ছেড়ে উপুড় হয়ে সাষ্টাঙ্গে শুয়ে তাঁর পায়ে মাথা রেখে প্রণাম করলেন, এ ছোড়া আবার কে?
প্রবোধচন্দ্রের বিড়ম্বনার একশেষ, এক হাত এঁটো, প্রণাম করারও উপায় নেই। ভৈরবী-মা জবাব দিলেন, কালকের সেই ছেলেটি… আপনার দর্শন আর কৃপার আশায় কাল সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত দাড়িয়েছিল। যে-ভাবে তাকালেন ভৈরব-বাবা, প্রবোধচন্দ্রের মনে হলো হাতের চিমটে দিয়েই মেরে বসবেন। তার বদলে গলা দিয়ে চাপা হুংকার বেরুলো।
—দূর হ—দূর হ!
ঘরে ঢুকে গেলেন। ভৈরবী-মায়ের সদয় মুখ। —তুমি খাও বাবা।
খাওয়া শেষ হতে ভৈরবী-মা জিগ্যেস করলেন, দুপুরে খাবে কোথায়?
—ঠিক নেই।
—খাবার টাকা-পয়সা আছে?
তাড়াতাড়ি জবাব দিল, সে-জন্য আপনি ব্যস্ত হবেন না, ব্যবস্থা হয়ে যাবে। মাটির পাত্র আর গেলাস হাতে উঠে দাড়ালো।
—ব্যবস্থা এখানেই হবে। সাড়ে বারোটা-একটার মধ্যে এসে বাবার প্রসাদ নিয়ো।
প্রবোধচন্দ্র দাওয়া থেকে নামল। একটু ইতস্ততঃ করে বলল, আমার খাওয়াটা বড় কথা নয়, অনেক দিনই না খেয়ে কাটে…আমার আরজি আপনি মনে রাখবেন?
চেয়ে আছেন। আরো সদয় মুখ। বললেন, আমি নিজে তো তোমার আরজি মঞ্জুর করার মালিক নই দেখি চেষ্টা করে—দুপুরে এসো কিন্তু, আমি অপেক্ষা করব।
প্রবোধচন্দ্র মাথা নেড়ে জানালো, আসবে। একটু দূরে মাটির পাত্র মাটির গেলাস ফেলে বড় বড় পায়ে শ্মশান থেকে বেরিয়ে এলো। • আরজি মঞ্জুর করার মালিক, কংকালমালী-বাবা। তাঁর মেজাজও স্বচক্ষেই দেখল। তবু প্রবোধচন্দ্রের বুকের ওপর থেকে যেন একটা পাথর সরে যাচ্ছে। মন বলছে সে ঠিক জায়গায় এসেছে। এখানে আশ্রয় মিলবে। মিলবেই।
বেলা সাড়ে বারোটা থেকে একটার মধ্যে আসার কথা। কিন্তু বারোটার মধ্যেই এসে হাজির। ক্ষুধা তৃষ্ণার তাড়নায় আদৌ নয়। ভৈরবী-মায়ের আকর্ষণে। নিজের মা-কে মনেও পড়ে না। কিন্তু সমস্তক্ষণ এক মা-পাওয়ার আনন্দে ভিতরটা ভরপুর। মা নেই সে-দুঃখ কোনোদিনও ছিল না। কিন্তু এই মা-কে না পেলে যেন সর্বনাশ।
জুতো জোড়া খুলে নিঃশব্দে দাওয়ায় উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের ভিতর থেকে একটা রুষ্ট-গম্ভীর ঝাপটা কানে এসে লাগল। কংকালমালী-ভৈরবের গলা।
—ও-সব ঝামেলা আমার ভালো লাগে না, দূর হয়ে যেতে বলো! তন্ত্রের সাধনায় ও খুব কিছু এগোবে না।
যেটুকু এগোয়, তাছাড়া ওষুধ শেখার ব্যাপারেই ওর বেশি আগ্রহ দেখলাম, আপনাকে বিরক্ত না করে ওর ভার আমিই নেব।
আবার হুংকার।কেন, তোমার এত গরজ কিসের?
—ছেলেটির লক্ষণ বেশ ভালো। আমি খুব ভালো করে দেখে নিয়েছি। —তা বলে যত লোকের লক্ষণ ভালো সকলকে তুমি এখানে ডেকে আনবে? আমাকে তুমি এখান থেকে তাড়াতে চাও?
—সকলের কথা বলিনি। সকলের তৃষ্ণা আর এই ছেলের তৃষ্ণা এক নয়—আমি শুধু একে নেব।
—হুঃ! স্পষ্ট অসন্তোষ।
—তাছাড়া আপনার ওষুধে লোকের কত উপকার হচ্ছে। এত বড় একটা জিনিস আমার পরেই শেষ হয়ে যাবে? আমি কি এই নিয়ে এখানে চিরদিন আটকে থাকব?
—হুঃ! এবারের হু-টা তেমন জোরালো নয়।
প্রবোধচন্দ্র রাইরে স্থাণুর মতো দাড়িয়ে।
—ও-মা, তুমি এসে গেছ! একটা গামছা টেনে নিতে গিয়ে দরমার কাছে এসে ভৈরবী-মা তাকে দেখেছেন। তাঁর মুখে চাপা হাসি। আরো একটু এগিয়ে এসে খাটো গলায় বললেন, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের ভিতরের কথা শুনছিলে বুঝি?
প্রবোধচন্দ্র মাথা নাড়ল। শুনছিল।
—ঠিক আছে, ভিতরে এসো। এবারে সহজ স্বাভাবিক গলা। —বাবাকে প্রণাম করে তাঁর আশীর্বাদ চাও। ..বাবা রাগ করে পা ছুঁড়লে সেটা ও কিন্তু আশীর্বাদ ভেবো। এসো—
ভিতরে ঢুকল। বাবার পরনে এখন কৌপিনটুকুও নেই। সম্পূর্ণ নগ্ন। ঘরের দিকে চেয়ে মনে হলো এক্ষুণি তাঁর আহার শেষ হলো। মায়ের হাত থেকে গামছা নেবার জন্য হাত বাড়ালেন। কিন্তু ওটা না দিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে মা যত্ন করে তাঁর মুখ মুছিয়ে দিলেন। পিছনের দেয়ালে ঠেস দিয়ে দু‘পা ছড়িয়ে চাটাইয়ের ওপর আধশোয়া হলেন তিনি।
প্রবোধচন্দ্র এগিয়ে গিয়ে ভয়ে ভয়ে তাঁর পায়ে কপাল ঠেকিয়ে প্রণাম করল। বাবার এখনো রুষ্ট মুখই, কিন্তু মায়ের ওই-রকম বলার দরুনই বোধহয় পা ছুড়লেন না। প্রণাম সেরে উঠতে বললেন, যা শালা, খুব বেঁচে গেলি।
বাইরে দাওয়ায় বসে তার আহার সমাধা হলো। সামনে মা বসে। আহারের আয়োজন যৎসামান্য। মোটা চালের ভাত, কড়াইয়ের ডাল, আর একটু তরকারি। প্রবোধচন্দ্রের ধারণা ছিল, ভৈরব-ভৈরবীদের কারণ আর মাংস ভিন্ন আর কিছু রোচে না। কিন্তু এই খেয়ে তার মনে হলো তৃপ্তিভরে এমন পরমামৃত কোনো কালে খায়নি।
মা বললেন, তোমার দু‘বেলার খাওয়ার ব্যবস্থা এখন থেকে এখানেই হবে—আর অসুবিধে না হলে রাতে এই দাওয়াতেই শুয়ে থাকতে পারো—সঙ্গে রাতে শোবার ব্যবস্থা আছে?
মুখের দিকে চেয়ে প্রবোধচন্দ্র অল্প হেসে নিঃসংকোচে জবাব দিল, আমার শোবার ব্যবস্থার দরকার হয় না—মাথা গোঁজার একটু ঠাঁই পেলেই হলো। … বাবার মেজাজ যেমনই দেখি না কেন, আমি ঠিক জানতাম আপনার আশ্রয় পেয়েই গেছি।
মায়ের জবাবে একটা ইংরেজী শব্দও বেরুলো। অত সিওর হয়ে কাজ নেই, কয়েকটা দিন আগে দেখি তোমাকে।
প্রবোধচন্দ্রর সব থেকে আশ্চর্য লাগে ভৈরবী মায়ের পরিশ্রম করার ক্ষমতা দেখে। রাতে দু’আড়াই ঘণ্টার বেশি ঘুমোন না। ভৈরব-বাবার সেবা তাঁর সব থেকে বড় কর্তব্য। কিন্তু বাবার সেবার চাহিদা এত কম যে মা-কে সেজন্য বেশি সময় দিতে হয় না। সকাল থেকে রাতের বেশিরভাগ সময় কাটে ওষুধ সংগ্রহ আর ওষুধ তৈরির কাজে। বনে জঙ্গলে আর নানা জায়গায় ঘুরে শেকড় বাকড় অনুপানাদি আর দ্রব্য আনার জন্য তিন চারজন লোক আছে। মা প্রত্যেকটা জিনিস যাচাই করে দেখে নেন। সন্দেহ হলে ভৈরব-বাবাকে দেখিয়ে নিয়ে নিশ্চিন্ত হন। প্রবোধচন্দ্রকে এক-একটা জিনিস বার বার দেখিয়ে নাম-গুণ ইত্যাদি মনে রাখতে বলেন। এক-একটা জিনিস কত রকমের ব্যাধিতে লাগে লিখে রাখতে বলেন। ওষুধ সালশা বা চূর্ণ ইত্যাদি বানাবার সঙ্গে তাঁর শিক্ষা দেওয়া চলতে থাকে। দিন তিনেক বাদে রামপুরহাটের মোহিনী ভট্টচার্য, এলেন। ভৈরব বাবার ঘরে এক মা ছাড়া তাঁরই কেবল অবাধ যাতায়াত। ঘণ্টাখানেক বাদে ওই ঘর থেকে বেরিয়ে এসে প্রবোধচন্দ্রের সামনে দাওয়ায় বসলেন। সস্নেহে তিনি বললেন, মায়ের আশ্রয় পেয়েছ তোমার বড় ভাগ্য বাবা — জেনে রেখো ভৈরব-বাবার সমস্ত শক্তির আধার এখন মা…মা তোমার প্রশংসা করলেন।
প্রবোধচন্দ্র হেসে বলল, আর বাবা?
—বাবার কথা ছেড়ে দাও, তিনি স্বয়ং রুদ্র, কিন্তু অন্তরে সদা প্রসন্ন। এই মানুষটিকেও প্রবোধচন্দ্রের বড় ভালো লাগল।… ইনিই নাকি একদিন স্বেচ্ছাচারী ভোগী অত্যাচারী মানুষ ছিলেন। বাবার মহিমা প্রবোধচন্দ্র মনে মনে স্বীকার করে বইকি। কিন্তু বাবার মনোভাব বাইরে অন্তত তার প্রতি একটুও প্রসন্ন নয়। এখনো বেশিরভাগ রাতই শ্মশানে কাটান। আসতে যেতে বলেন, শালা কোথা থেকে এসে জুটেছে!
মা বেরিয়ে এসে ভট্ট্চায মশাইয়ের হাতে একটা লম্বা লিস্ট ধরিয়ে দিলেন।
প্রবোধচন্দ্র দেখলেন সাদা কাগজে মুক্তোর মতো হাতের লেখা। এ-গুলোও ওষুধেরই নানা উপকরণ। বললেন, রামপুরহাটে সব-কিছু পাবেন না বাবা আপনাকে কলকাতায় লোক পাঠাতে হবে।
—আজই পাঠাবো… মায়ের যখন দরকার, সবই এসে যাবে।
ভৈরবী মায়ের উদ্দেশে মাটিতে মাথা রেখে প্রণাম করে ভট্টচার্য, মশাই বললেন, মঙ্গলবার ঠিক সময়ে ওদের নিয়ে এসে যাব মা। মা মাথা নাড়তে তিনি গাড়িতে গিয়ে উঠলেন। পুলিশের জিপ গাড়ি।
মঙ্গলবারে আসবেন কারণ সেদিন ওষুধ দেবার আর নেবার দিন।
অদ্ভুত ভালো লাগছে প্রবোধচন্দ্রের। বুকের তলায় এমন শাস্তি আর যেন অনুভব করেনি। কাজ না থাকলে নিজের মনেই এদিক-ওদিক বেড়ায়। এমন শান্ত নীরবতারও একটা বিশেষ রূপ আছে। পথের দু‘দিকে বড় বড় গাছ। অর্জুন-অশ্বত্থ-পাকুড়-কাঁঠাল-তেঁতুলগাছগুলোও যেন পরম আত্মীয়ের মতো তাকে গ্রহণ করেছে।
… আবার মঙ্গলবারের সেই ওষুধ দেবার দিন। বেশ ভোরেই মোহিনী ভট্টচার্য, জিপে তাঁর লোকজন নিয়ে এসে গেলেন। ও-দিকে লাইনে লোক দাঁড়ানো আরও আগে থেকে শুরু হয়ে গেছে। আরো আধ-ঘণ্টার মধ্যে স্নান সেরে মা তাঁর উঁচু দাওয়ার সামনে বসলেন। তাঁর নির্দেশে প্রবোধচন্দ্রও স্নান সেরে প্রস্তুত। অন্য লোকের বদলে এবারে ওষুধের ডালাগুলোর সামনে তার আসন। সে-ই ডালা এগিয়ে দেবে। কে কি রোগ বা কার কি অসুবিধের কথা বলে না তাও মন দিয়ে শুনতে বলেছেন।
মোহিনী ভট্ট্চায, ছোট কাঠের গেটের দড়ি খুলে দিতে ওষুধ প্রার্থীরা একে একে আসতে লাগল। একসঙ্গে দু‘জনের আসার রীতি নেই। তবে কেউ অশক্ত বা অথর্ব হলে তার সঙ্গের চলনদার রোগী নিয়ে আসতে পারে। প্রবোধচন্দ্র রোগীর নিবেদন শোনার থেকে মায়ের মুখই বেশি লক্ষ্য করছে। মনে হলো, মা-ও নিবেদন শোনার থেকে স্থির চোখে দেখে নিয়ে রোগীর হাল বেশি বুঝতে পারছেন।
আজও বিকেল পর্যন্ত এই পর্ব চলল। এইদিন মা আর মোহিনী ভট্চায়, ছাড়া আর একজন সারাক্ষণের মধ্যে জায়গা ছেড়ে নড়ল না বা উঠল না। সে প্রবোধচন্দ্র। মা-ও তাকে একবারের জন্য উঠতে বললেন না, এটুকুও যেন তাঁর করুণাই মনে হলো। এই দিনে বাবার খাওয়া-দাওয়া বা সেবার ব্যবস্থা কি হয় প্রবোধচন্দ্র জানে না।
অবশ্য পরে জেনেছে। বাবা এমনিতেই সপ্তাহে দু‘দিন বা বড় জোর তিন দিনের বেশি মুখে অন্ন তোলেন না। এক মঙ্গলবারের ছাড়া রান্না রোজই হয় বটে। কিন্তু বেশির ভাগ দিন তিনি হাত দিয়ে অন্ন-ব্যঞ্জন স্পর্শ করে দেন শুধু। যে-দিন ইচ্ছে হয় দুই এক গরাস মুখে তোলেন। রাতের আহার বহুকাল ধরেই ত্যাগ। মঙ্গলবারে মা-কে রান্নার কোনো আয়োজনই করতে হয় না।
এখানে প্রবোধচন্দ্রের রাতের খাওয়া কোনোদিন দু‘খানা রুটি একটু গুড় আর দুধ। কোনোদিন বা ফল আর দুধ। মোহিনী ভট্ট্চাযের ব্যবস্থায় দুধ একজন রোজই দিয়ে যায়। এ ছাড়া ভক্তদের কাছ থেকে যে-দিন যেরকম জোটে।
শুক্রবার সন্ধ্যায় ভৈরবী-মা তাকে বললেন, কাল শনিবার রাতে তোর দীক্ষা হবে।
মা খুব সহজে তাকে আরো আপনার করে নিয়েছেন। তুমি ছেড়ে তুই করে বলেন। দীক্ষা হবে শুনে প্রবোধচন্দ্রের সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত।
—রাতে কখন দীক্ষা দেবেন মা?
—বাবা থাকতে আমি দীক্ষা দিতে যাব কেন! তিনিই দেবেন—
প্রবোধচন্দ্র স্তব্ধ একটু। কথা ক’টা যেন শিরশির করে কানের ভিতর দিয়ে দেহের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে লাগল।
—আমাকে কি করতে হবে?
—দু‘হাত তুলে নাচতে হবে। মা হেসে ফেললেন, কি আবার করতে হবে, স্নান সেরে লাল চেলি পরে তাঁর কাছে গিয়ে সামনে বসতে হবে।
—লাল চেলি কই!
—ভচাৰ্য, মশাইকে দিয়ে আনিয়ে রেখেছি।
রাত আর পরের দিনটা অধীর প্রতীক্ষায় কাটল। রাত বারোটাও এগিয়ে এলে। একসময়। স্নান সেরে রক্তাম্বর পরে প্রস্তুত হতে মা তাকে বাবার ঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন।
ভৈরব-বাবা দেওয়ালে ঠেস দিয়ে আধ-শোয়ার মতো কম্বলের ওপর বসে। সম্পূর্ণ নগ্ন। এই রাতের আঁধারে তাঁর মুখখানা আদৌ তুষ্ট মনে হলো না প্রবোধচন্দ্রের। চাউনি দেখে মনে হলো যেন আঙ্কেল দেবার অপেক্ষায় আছেন।
প্রবোধচন্দ্র তাঁর সামনে পাতা আসনে বসল। ভৈরব-বাবা সোজা হলেন। তার দিকে স্থির চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। প্রবোধচন্দ্রের সর্বাঙ্গে অদ্ভূত শিহরন। মনে হলো ওই চোখের ভিতর থেকে বিদ্যুৎ তরঙ্গের মতো একটু কিছুর ধাক্কায় এ-রকম হচ্ছে।
চিমটেটা তুলে নিয়ে ভৈরব-বাবা তার দু’কাঁধে একটু জোরেই দু‘টো ঘা বসিয়ে দিলেন। তারপর আবার চোখের দিকে তেননি খানিক চেয়ে থেকে জলদ গম্ভীর গলায় হাঁক দিলের, কালীকিংকর।
কিছু না বুঝে প্রবোধচন্দ্র এ-দিক ও-দিক তাকালো। ভৈরবী-মা বললেন, আগের নাম ভুলে যাও — এখন থেকে বাবার দেওয়া কালীকিংকর নামেই তোমার পরিচয়। বলতে বলতে একটা ধ্যাবড়া কৌটো খুলে বাবার সামনে ধরলেন। ওতে রক্তবর্ণ সিঁদুর।
বুড়ো আঙুলটা সেই সিঁদুরে ডুবিয়ে ভৈরব-বাবা নাকের ওপর থেকে কপালের শেষ পর্যন্ত সোজা একটা সিদুরের দাগ তুলে দিলেন। যা শালা, এবার লুটে পুটে খাগে যা!
ভৈরবী-মা বললেন, বাবাকে প্রণাম করে উঠে এসো।
সে উপুড় হয়ে বাবার ছড়ানো দু‘পায়ে কপাল মাথা ঘষে মায়ের সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এলো।
মা জিগ্যেস করলেন, বাবা কি আশীর্বাদ করলেন বুঝতে পারছ? মাথা নাড়ল, বুঝতে পারেনি।
মা বুঝিয়ে দিলেন।—জগৎ আনন্দময়। নিরানন্দের মধ্যেও আনন্দ ছড়িয়ে আছে। তুমি সেই আনন্দ লুটে নাও।
মায়ের দিকে চেয়ে আছে। চোখের পাতা পড়ছে না। আস্তে আস্তে হাঁটু গেড়ে বসল। মায়ের দু‘পায়ে মাথা রাখল। দু‘হাতে পা দু‘খানি জড়িয়ে ধরে মাথা রেখে পড়ে থাকল।
জীবনে কি কখনো কেঁদেছে? মনে পড়ে না। তার চোখের জলে মায়ের দু‘পা ভেসে যাচ্ছে। কেঁদে এত আনন্দ তা-ও কি কখনো কেউ অনুভব করেছে?
—কালীকিংকর ওঠে।
***
প্রবোধচন্দ্রের অস্তিত্ব ঘুচে গেছে। সেই খোলসেই যাঁর আবির্ভাব তিনি অন্য একজন। তিনি কালীকিংকর। কালীকিংকর অবধূত।
এই নতুন জীবনে মায়ের বাধা অনেক সময় আশ্চর্য রকমের স্পষ্ট এবং গম্ভীর। অমান্য করার জো নেই। যেমন অবধূতের সংকল্প, চুল দাড়ি রাখবেন, আর কাটবেন না, কামাবেন না। মায়ের স্পষ্ট আদেশ, চুল দাড়ি রাখতে হবে না। ওসব কেটে আগের থেকেও পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে।
মোহিনী ভট্টচার্য, একদিন দরজি এনে কালীকিংকরের মাপ নিতে এলো। ভৈরবী-মা সামনে বসে। অধৃত বুঝলেন, তাঁর নির্দেশেই দরজি আনা হয়েছে। মাপ নেওয়া হতে দু‘জোড়া কাপড়ের কথাও মা বলে দিলেন। সেই জামা, কাপড় আসতে কালীকিংকর অবাক। তার ধারণা রক্তাম্বর ধুতি আর জামা আসছে। তার বদলে বেশ মিহি জমিনের ধুতি আর ভালো কাপড়ের পাঞ্জাবি? মা-কে বলেই ফেলল, এসব আর পরব কেন? মা-ও অবাক একটু।—তাহলে কি পরবি?
—আমার তো রক্তাম্বর পরার কথা।
—এমন কথা কে বলেছে?
কালীকিংকর চুপ। কেউ বলেনি। নিজেই ভেবেছিলেন।
ম! ফতোয়া দিলেন, রক্তাম্বর ধুতি চাদর এক প্রস্থ থাকলেই হবে, কাজে কর্মে পরবি—সব-সময় পরবার দরকার নেই।
এ-ব্যবস্থা কালীকিংকরের খুব মনঃপূত হয়নি। ভৈরবী-মা যেন অনেকটা গৃহস্থ বাড়ির ছেলের মতোই রাখতে চান। কিন্তু তাঁর নির্দেশ অমান্য করা চলে না।
মানুষের আদি-ব্যাধি নিরাময় করার বিদ্যে মা তাঁকে যত যত্ন করে শেখান, অন্যান্য বিষয়ে সাধন দেবার ব্যাপারে তাঁর অত আগ্রহ নেই। তন্ত্র সাধনার অনেক নিগূঢ় ক্রিয়া-কলাপ জপ-তপ আছে কালীকিংকর জানেন। কিন্তু তিন-মাস যাবৎ ভৈরবী-মা কেবল তাঁকে মনঃসংযোগ আর দৃষ্টি-সঞ্চালনের বিদ্যেয় রপ্ত করে তুলছেন। বলেন, মানুষের সেবা করতে হলে এ দুটোই সব থেকে বেশি দরকার। মনের স্থির সংযোগ হলে নিজের অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কেটে যায়। আর দৃষ্টি সঞ্চালন আয়ত্তে এলে মানুষের ভিতরের অদেখা স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল পর্যন্ত ঘুরে আসা যায়। ভৈরবী-মায়ের হাব-ভাব আর শিক্ষা দেখে কালীকিংকরের মনে হয়, নিজের মনঃসংযোগ এবং মানুষের আধি-ব্যাধির সেবা, আর মুখ দেখে লক্ষণ জানা বা চেনাই তাঁর কাছে তন্ত্রসার।
মাস আড়াই তিনের মাথায় এক সকালে এখানকার বাঁধা-ধরা ছকে বেশ একটু বৈচিত্র্যের রঙ ধরতে দেখলেন কালীকিংকর। তিনি দাওয়ার সিঁড়িতে বসে দুটো লোবের আনা শিকড়-বাকড় লতা-পাতা দেখছিলেন। ভৈরবী মা সেগুলো গুছিয়ে রাখতে রাখতে তাঁর পরীক্ষা নিচ্ছিলেন। কোন্টা কি, কোন্ কাজে লাগে ইত্যাদি। লোক দুটো নতুন সাধুকে মায়ের এই জেরার মুখে পড়তে দেখে মজা পাচ্ছিল।
দশ হাতের মধ্যে একটা জিপ এসে দাঁড়ালো। মোহিনী ভট্চাযের চেনা জিপ। এই জিপে মেয়েছেলে আসতে দেখেও দু‘চোখ অনভ্যস্ত নয় কালীকিংকরের। ভটচার্য মশায়ের আর তাঁর ভাইয়ের স্ত্রীরা মাঝে মাঝে আসেন। কিন্তু এই সকালে জিপ থেকে নামল যে মেয়েটি তার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ হবে না, চোখের ওপর এমন শাসন-ক্ষমতা কারো আছে কিনা কালীকিংকর জানেন না। তাঁর অন্তত নেই।
বছর ষোল সতেরোর মধ্যে হবে বয়েস। বেশ লম্বা। সুডোল স্বাস্থ্য। দুধে আলতা গায়ের রং। আয়ত টানা চোখ। টিকলো নাক। সকালে স্নান করে এসেছে, আধা-কোঁকড়া চুল পিঠের ওপর ছড়ানো—সেই চুলের গোছা কোমর ছাড়িয়ে হাঁটুর দিকে নেমেছে।
জিপ থেকে নেমে হাসি-হাসি মুখে অতি পরিচিতের মতো দাওয়ার দিকে এগুলো। ভ্যাবাচাকা খেয়ে কালীকিংকর দাওয়ার সিঁড়িতে বসেই ছিলেন, শশব্যস্তে উঠে সিড়ি ছেড়ে সরে দাঁড়ালেন। এগিয়ে আসতে আসতে মেয়েটি তাঁর মুখখানা একদফা দৃষ্টিবাণে বিদ্ধ করে নিল। দাওয়ায় উঠতে কালীকিংকরও ঘুরে তাকালেন। ভৈরবী-মায়ের আর লোক দুটোরও হাসিহাসি মুখ।
দু‘হাত কোমরে তুলে মেয়েটি ভ্রুভঙ্গি করে দাওয়ার শিকড়-বাকড় লতা পাতাগুলো দেখল। তারপর ভৈরবী-নায়ের দিকে চেয়ে বলল, তোমাদের জ্বালায় এ জায়গা থেকে ডাক্তার বদ্যিরা সব পালাবে দেখছি—
ঘরের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর ঘরের বাসিন্দা অর্থাৎ কংকালমালী ভৈরবের উদ্দেশে একটু গলা চড়িয়ে যা বলল, শুনে কালীকিংকরের কান খাড়া, শিরদাড়া সোজা।
—কই গো শিবঠাকুর, ঠিক-ঠাক মতো আছ? ভিতরে ঢুকব?
সঙ্গে সঙ্গে ভিতর থেকে ভৈরবের দরাজ গলার শব্দ, আমি ঠিক-ঠাক মতোই আছি, তোর অশুবিধে হলে একটু দাড়া, আমি বাঘ-ছালটা কোমরে জড়িয়ে নিই।
—জড়াও বাপু, আমার ক্ষমতা থাকলে তোমাদের হিমালয়ের মাথায় বসিয়ে রাখতাম, লোকালয়ে আসতে দিতাম না।
ঘরে হা-হা হাসির শব্দ।
কালীকিংকর দেখছেন, ভৈরবী-মায়ের ঠোঁটে হাসির আভাস। আর লোক দুটোর মুখে হাসি ধরে না।
ঘরের ভিতর থেকে ভৈরব বাবার হাঁক শোনা গেল, আ যা মেরে চোঁদরী কা চাঁদ—দু‘চোখ ভরে দেখি তোকে—
মেয়েটি হাসি মুখে ভিতরে চলে গেল। একটা থলে হাতে মোহিনী ভট্টচার্য দাওয়ায় উঠে এসেছেন। কালীকিংকরকে বললেন, জিপে দইয়ের হাঁড়ি আর মিষ্টির হাঁড়ি আছে, নামিয়ে আনো তো বাবা—এই থলেতে মাংস আছে মা-বাবার কাছেই নিয়ে যাই?
ভৈরবী-মা জিগ্যেস করলেন, এত-সব কেন?
— কল্যাণী মায়ের হুকুম, বলল, শিঠাকুরকে আজ এ-সব ঘুষ দিতে হবে। তাঁরা দু‘জনে হাসি মুখে দরজার দিকে এগোলেন। কালীকিংকর এ-টুকু শুধু বুঝলেন মেয়েটির নাম কল্যাণী। চটপট দই আর মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে এলেন। ভিতরে না ঢুকে ও-দুটো হাতে করে তিনি দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে ভিতরের দৃশ্য দেখতে লাগলেন।
জানু-আসনে বসে কল্যাণী ভৈরব বাবার পায়ে উপুড় হয়ে কপাল ঠেবিয়ে পড়েই আছে। কংকালমালীর গোঁপ-দাড়ি বোঝাই মুখে খুশি উপছে উঠছে। তিনি তার পিঠে হাত বোলাচ্ছেন। ওই মেয়ের পা ছেড়ে ওঠার নাম নেই, যেন মনের সুখে আদর খাচ্ছে।
দাবড়ানির সুরে ভৈরব বাবা বলে উঠলেন, ওঠ, ওঠ —খুব হয়েছে— আড়াই মাস না দেখে দু‘চোখ অন্ধ হতে বসেছে—আর শালী এতদিন বাদে এসে খুব ভক্তি দেখাচ্ছে।
পা থেকে মাথা না তুলেই ঝাঁঝের গলায় মেয়ে জবাব দিল, তোমার ভৈরবীর হুকুম শুনে মুখ বুজে ছিলে কেন?… পরীক্ষার আগে আর আসতে হবে না আদেশ শুনেও তো ভেজা বেড়ালখানার মতো মুখ করে বসেছিলে।
—আচ্ছা, আমারই দোষ, ওঠ।
উঠল। তাঁর মুখোমুখি মাটিতেই বসল। ভৈরবী-মা আর মোহিনী ভট্টচার্যের হৃষ্ট মুখ।
ভৈরব-বাবার দু‘চোখ তার মুখ থেকে কোমর পর্যন্ত ওঠা-নামা করল একবার।—তা পরীক্ষা দিয়ে দিগগজ হয়ে এলি?
—হলাম কি হলাম না তুমি জানো। পাশ করলে আমার ক্রেডিট, ফেল করলে তোমার দোষ।
—কেন, ফেল করলে আমার দোষ কেন?
ফেল করলে লোককে বলব, তোমাদের ভৈরব-বাবা আমার মন কেড়ে নিয়ে বসেছিল, পড়াশুনায় মন দিতে পারি নি। শিবঠাকুরকে না দেখে পার্বতী কি তার বাপের বাড়িতে খুব সুখে ছিল, তাকে ম্যাট্রিক, পরীক্ষা দিতে হলে মজা টের পেত!
ভৈরব বাবার অট্টহাসি।—তোকে ফেল করায় কোন্ শালার বাপের সাদ্ধি! তুই সবেতে পাশ করেই বসে আছিস।
কালীকিংকর স্থান কাল ভুলে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখ দিয়ে দেখবেন না কান দিয়ে শুনবেন! চোখ-কান দুই-ই এমন আড়াআড়ি কাড়াকাড়ি করেও ভরাট হয়!
ভৈরব-বাবার চোখ হঠাৎই দরজার দিকে। ঝুঁকে চিমটেটা তুলে নিয়ে ছোঁড়ার ভঙ্গিতে মাথার ওপর তুলে হুংকার ছাড়লেন, এই ও শালা! ওখানে দাঁড়িয়ে তুই হাঁ করে আমার পার্বতীর রূপ গিলছিস—এত সাহস তোর! এ-দিকে চোখ দিলে তোকে আমি বাপের নাম ভুলিয়ে ছাড়ব না! ভাগো হিয়াসে!
দৈয়ের হাঁড়ি আর মিষ্টির হাড়ি মাটিতে নামিয়ে রেখে কালীকিংকর উঠে দাড়ালেন। এই মেয়ের সামনে এ-রকম ধমক খেয়ে তার জিভেও কোন সরস্বতী ভর করল কে জানে। হাত জোড় করে সবিনয়ে বললেন, বাপের নাম আমি এঁকে দেখার অনেক আগেই ভুলেছি বাবা—
দাওয়ার মাঝামাঝি জায়গায় এসে দাঁড়ালেন। তাঁর দিকে চেয়ে শিকড়-বাকড় যোগাড়ের লোক দুটো হাসছে। ভিতরের কথা-বার্তা স্পষ্ট শোনা যায়।
ভৈরব বাবার হুংকার শোনা গেল। তাঁর পার্বতীকেই শাসাচ্ছে। —শালা সেয়ানা কত দেখলি? খবদ্দার এর কথায় ভুলবি না—ও-শালা আমার বুক ঝাঁঝরা করে দেবার মতলবেই এখানে এসে জুটেছে!
রসালো জবাবও শোনা গেল। কল্যাণী বলছে, অত দুশ্চিন্তায় থেকে কাজ কি, তোমার কপালের আগুনে ভস্ম করেই ফ্যালো না!
লোক দুটো শব্দ না করে হাসছে। ওদের একজনের নাম হারু। কালীকিংকরের সঙ্গে তারই বেশি ভাব। সে-ও অনেক গাছ-গাছড়া শেকড়-বাকড় চেনায় তাঁকে। ইশারায় তাঁকে ডেকে দাওয়া থেকে নামলেন। তারপর জিগ্যেস করলেন, এতদিনের মধ্যে দেখিনি, এই মেয়েটি কে?
হারু জানালো, এই দিদিমণির সঠিক পরিচয় সে জানে না। তবে এ-টুকু জানে, ভট্টচার্য মশাইয়ের কোনো আত্মীয়ের মেয়ে। ছেলেবেলা থেকেই বাপ-মা হারা। ভট্টচার্য, মশাই তাকে নিজের ছেলে-মেয়ের থেকেও বেশি স্নেহে মানুষ করছেন। তার কারণ, ভৈরব-বাবা এই মেয়েকে দারুণ স্নেহ করেন। দশ বছর বয়সে বাবা তাকে নিজের কোলে বসিয়ে দীক্ষা দিয়ে—ছেন। তাদের ধারণা, এই মেয়ে অশেষ শক্তির আধার। কালে দিনে বাবার আশীর্বাদে ভৈরবী-মায়ের থেকেও অনেক বেশি শক্তির অধিকারিণী, হবে।
সময়টা যেন একটা বিভ্রমের মধ্যে কাটতে লাগল কালীকিংকরের। না, কল্যাণী নামে ওই মেয়ে দুপুরের খাওয়ার আগে একবারও ঘর থেকে বেরোয়নি। অথচ, কালীকিংকর যেন সারাক্ষণ তার মুখ দেখছেন, হাসি দেখছেন আর কথা শুনছেন।
দুপুরে দাওয়ায় খাওয়ার তিনখানা আসন পাতা হলো। একখানা কালীকিংকরের। মুখোমুখি দুটো কল্যাণী আর মোহিনী ভচাযের। এত খাবার এসেছে, তাঁরাও প্রসাদ পেয়ে যাবেন বোঝা গেল।
খেতে বসে আরো যেন অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেলেন কালীকিংকর। ওই মেয়ে মাঝে মাঝে সোজা তাকিয়ে তাকে দেখছে। সামনে ভৈরবী-মা, পাশে ভট্টচার্য, মশাই, কিন্তু এ-জন্যে যেন কোনো দ্বিধার কারণ নেই। খেতে খেতে হঠাৎ মুখ তুলে তাকাচ্ছে। নিঃসংকোচে দেখে নিয়ে আবার খাচ্ছে।
কল্যাণী একবার মুখ তুলে ভৈরবী-মায়ের দিকে তাকালো। ভৈরবী-মাকে সামনা-সামনি সকলেই মা বলে। গম্ভীর মুখে মন্তব্য করল, মা, তোমার এই শিষ্যের কিস্স্থ হবে না, এখনো টনটনে জ্ঞান।
হাসি চোপ ভৈরবী-মা জিগ্যেস করলেন, কি টনটনে জ্ঞান?
জবাব না দিয়ে গম্ভীর মুখে কল্যাণী আবার বলল, বাবার সেই শুকদেব ব্যাসদেব আর অপ্সরাদের গল্পটা ওঁকে শুনিয়ে সেই মতো তালিম দাও। হাব-ভাব আর কথা শুনলে কে বলবে এই মেয়ে সবে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছে। বয়েস ষোল সাড়ে ষোলর বেশি হবে না। কালীকিংকর আড়চোখে লক্ষ্য করলেন, ভৈরবী-মা গালে হাত দিয়ে হাসি চাপতে চেষ্টা করছেন। আর, হাসি চাপার চেষ্টায় মোহিনী ভট্চাযের খাওয়ার দিকে আরো বেশি মনোযোগ। গোঁ-য়ের দিক থেকে বিচার করলে কালীকিংকরকে কেউ সাদা-মাটা মানুষ বলবে না। এই বয়সের একটা মেয়ের—তা সে যত রূপসীই হোক তির্যক উপহাসের পাত্র হয়ে মাথা গোঁজ করে বসে খেয়ে যাবার পাত্র নয়। মুখ তুলে সোজা তাকালেন।
—মায়ের এই শিষ্য বলতে কে—আমি?
—আপনি ছাড়া মায়ের আর দ্বিতীয় শিষ্য নেই।
আপনি করে বলতে গিয়েও মুখে আটকালো কালীকিংকরের। বললেন, মায়ের শিক্ষার ত্রুটি তুমি বেশ ধরে ফেলেছ—আমার টনটনে জ্ঞান বিদ্ধ করার মতে| মুনি-ঋষি-অপ্সরাদের গল্পটা বলে তুমিই আমাকে একটু এগোতে সাহায্য করো।
পিঠ টান করে মেয়ে সোজা হয়ে বসল একটু। দু‘চোখ তাঁর মুখের ওপর আটকে থাকল কয়েক পলক। এই বয়সের মেয়ের এই দৃষ্টি সঞ্চালন বিদ্যেটা ভৈরব-বাবার কাছ থেকে পাওয়া কিনা কালীকিংকর জানেন না। কিন্তু এ-টুকুতেই যেন বেশ পর্যুদস্ত হয়ে পড়লেন তিনি। সেটা অস্বীকার করার তাড়নায় সোজা চোখে চোখ রেখে চেয়ে রইলেন।
মেয়ের বসার ভঙ্গি আবার শিথিল হলো একটু। আলতো সুরে বলল, গল্পটা এমন কিছু নয়, তবে আপনাদের মতো ভাবী যোগী-পুরুষদের শিক্ষার বিষয়।…ব্যাসদেব তাঁর ছেলে শুকদেবের খোঁজে বেরিয়েছিলেন। দূর থেকে দেখলেন, রূপসী অপ্সরারা এক সরোবরে স্নান করছে। ছেলে তাদের সামনে দিয়ে চলে গেল। তার ভ্রূক্ষেপও করল না। কিন্তু একটু বাদেই বৃদ্ধ বেদব্যাস সেখান দিয়ে যেতেই অপ্সরারা ত্রস্ত—যে যার বসন সামলাতে ব্যস্তসমস্ত। বেদব্যাস অবাক হয়ে তাদের জিগ্যেস করলেন, এই একটু আগে যৌবনে ঝলমল আমার ধ্রুবক ছেলে এখান দিয়ে চলে গেল, তোমরা এতটুকু চঞ্চল হলে না, ভ্রূক্ষেপ করলে না—অথচ আমার মতো বৃদ্ধকে দেখে তোমাদের এত লজ্জা—কি ব্যাপার?
… অপ্সরারা করজোড়ে নিবেদন করল, ভগবান শুকদেব তো শিশু, তাঁর নারী-পুরুষ জ্ঞান লোপ হয়ে গেছে…কিন্তু আপনার, এই জ্ঞানটুকু এখনো যে টনটনে প্রভু—তাই আমাদেরও লজ্জা।
কতটুকু আহত করা গেল নির্লিপ্ত চোখে একবার দেখে নিল। তারপর আহারে মন দিল। একটু ধমকের সুরে ভৈরবী-মা বললেন, বাবার আস্কারা পেয়ে তুই দিনে দিনে বড় বাচাল হয়ে যাচ্ছিস কল্যাণী। ওর কথায় কান না দিয়ে তুমি খাও তো বাবা—
শেষেরটুকু কালীকিংকরের উদ্দেশে!
বিকেলের দিকে মোহিনী ভট্টচাষের সঙ্গে জিপে উঠে চলে গেল। আর কালীকিংকরের মনে হলো তার চার দিকে সত্যিই শ্মশান। শোভা কিছু নেই। এ-রকম মনে হওয়া মাত্র কাল্পনিক কশাঘাতে নিজেকে সংযত করতে চাইলো। মনে মনে সন্ত্রস্ত একটু। পাছে ভৈরবী-মা তাঁর মুখের দিকে চেয়ে ভেতর দেখে ফেলেন। আরো ভয়, ঘরে সেঁধিয়ে থাকলেও ভৈরব-বাবা সত্যিই যদি সর্বদ্রষ্টা হন, আর ওখানে বসেই তাঁর দিকে চোখ চালান, তাহলে রক্ষা নেই। বার বার নিজের পক্ষে জোরালো রায় দিলেন, তিনি দোষ কিছু করেননি, পাপ তাঁর মনের কোণেও উকিঝুকি দেয়নি।… ভালো লাগার মতো একটা মেয়ে এসেছিল। ভৈরবী-মায়ের ভালো লেগেছিল।…কংকালমালী মহাভৈরব-বাবারও খুব ভালো লেগেছিল৷ সেটা যেমন দোষের নয়, তাঁরও একটু ভালো লাগা কক্ষণো দোষের নয়।
পরের মঙ্গলবারে ওষুধ দেবার দিনে ভটচায,-মশাই আর অন্য সকলের সঙ্গে কল্যাণীকেও জিপ থেকে নামতে দেখে কালীকিংকর নিজের মনের ওপর কড়া প্রহরী বসিয়ে দিলেন। দেখলেন ওই মনের গায়ে যেন এক ঝলক দক্ষিণের বাতাস লাগল। স্নায়ু টান করে কড়া হাতে তিনি ওই মনের চারদিকের জানালা দরজা বন্ধ করে দিতে চাইলেন।…সুন্দরী রমণী যুগে যুগে কত মহাতপার চিত্ত-বিভ্রম ঘটিয়েছে, ধ্যান ভঙ্গ করেছে। তাঁর সামনেও এ এক পরীক্ষা বৈ আর কিছু নয়। খুব সামান্য, সাধারণ পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারলে বক্কোমুনির এই শ্মশানেই তাঁর গতি হোক। দেহের সঙ্গে সব কিছু ছাই হয়ে যাক।
রোগীদের প্রথম ক’ঘণ্টার ভিড়ের সময় এই মেয়েও সাহায্য করে গেল। তাঁর দু‘হাতের মধ্যে একই কম্বলে বসে তাঁর সঙ্গে ওষুধের ডালা এগিয়ে দিতে লাগল। ফলে কালীকিংকরকে এই দিনে বার বার জায়গা ছেড়ে উঠতে হলো না। ওষুধ না পেলে যে লোকটি কলম দিয়ে লিখে রাখছে সে, আর ওষুধের তাগিদে যারা আসছে তাদেরও অনেকে এই মেয়েকে চেনে দেখা গেল। ভৈরবী-মায়ের পিছনে ওই মেয়েকে দেখে অনেক রোগীর মুখে হাসি। ভৈরবী-মায়ের জয়ধ্বনির সঙ্গে তারা কেউ কেউ কল্যাণীমায়েরও জয়ধ্বনি করছে। আর এদিকে এই মেয়ে মাঝে মাঝে চাপা গলায় বলছে, আবার আমাকে নিয়ে টানাটানি কেন, ওষুধ খেয়ে যমের টানাটানি বন্ধ করতে পারো কিনা দেখো।
বেলা একটা দেড়টার সময় অনেকের মতো সে-ও উঠে ভিতরের ঘরে চলে গেল। তফাৎ, অন্যের বেলায় বদলি কেউ এসে দায়িত্ব নিয়েছে। কল্যাণীর বদলি কে আসবে। ঘণ্টা দেড় দুই বাদে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বসল। একটু বাদে ভৈরবী-মায়ের হাতে একটা ডালা এগিয়ে দেবার ফাঁকে চাপা গলায় জিগ্যেস করল, কি হলো, যতক্ষণ এই উৎসব চলবে তোমার এই শিষ্যেরও নিরম্বু উপোস নাকি!
কল্যাণীর হাত থেকে এবার ওষুধের ডালা নিয়ে ভৈরবী-মা একবার কালীকিংকরের দিকে তাকালেন। তারপর নিজের কাজে মন দিলেন।
বিকেলের শেষ রোগী বিদেয় করে ভটচায, মশাই গেটে দড়ি বেঁধে দিলেন। ভদ্রলোকের বয়েস হয়েছে। তিনি স্পষ্টই শ্রান্ত। শ্রান্তির লেশমাত্র নেই ভৈরবী-মায়ের মুখে। কালীকিংকরের ধারণা তাঁর নিজের মুখেও নেই।
সকলেই দাওয়ায় দাড়িয়ে এখন। মোহিনী ভটচায, এগিয়ে আসতে কল্যাণী শূন্যে ঝাপটা মেরে বসল একটা।—মাঝে খাওয়া-দাওয়া আর একটু বিশ্রামের ব্যবস্থা না থাকলে পরের মঙ্গলবার থেকে মেসোমশাইকে আর আমি এখানে আসতে দিচ্ছি না।
ভৈরবী-মা জবাব দিলেন, খেতে না চাইলে আমি কি করব?
—তুমি হুকুম করে দেখেছ—এখানে তোমার হুকুম অমান্য করার কারো সাধ্যি আছে?
মা হেসে জবাব দিলেন, আর কারো না থাক, ভৈরব-বাবার জোরে সেটুকু তোর আছে।
ধমকের সুরে মোহিনী ভট্টাচার্য, বললেন, এই মেয়ে, আমার হয়ে তোকে উমেদারি করতে বলেছি? এই একটা দিন আমার কোথা দিয়ে কেটে যায় টেরই পাই না।
—পুণ্যির হাওয়ায় ভেসে কেটে যায়।…আর এই যোগী ব্রহ্মচারীও ভৈরববাবার কাছ থেকে ক্ষুধা-তৃষ্ণা নিবারণী মন্ত্র নিয়েছেন নাকি—পুণ্যি তোড়ে মুখ শুকিয়ে যে আমসি একেবারে!
ভৈরবী-মায়ের মুখে সস্নেহ হাসি।—সবার পিছনে লাগিস কেন, তোর খাওয়া হয়েছে না হয়নি?
—আমার খাওয়া হবে না কোন দুঃখে, শিবঠাকুরের ঘরে ঢুকে দুধ কলা আম সন্দেশ চেটেপুটে খেয়েছি, তারপর শিবঠাকুরের গলা জড়িয়ে ধরে এক ঘণ্টা ফিসফিস গুজগুজ করে বিশ্রাম নিয়ে আবার এসেছি।
—এই শালী, মিথ্যেবাদী। ঘরের ভিতর থেকে ভৈরব-বাবার হুংকার। — তুই একবারও আমার গলা জড়িয়ে ধরিসনি!
কল্যাণী হাসি মুখে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।—ধরিনি! এইরকম মহাভৈরব তুমি! হাত দিয়ে গলা জড়ানো বুঝতে পারো, আর সমস্ত মন-প্রাণ দিয়ে গলা জড়ানো বুঝতে পারো না?
ঘরে কংকালমালীর অট্টহাসি।
স্থান-কাল ভুলে এই মেয়েকেই দেখছেন কালীকিংকর। ষোল সতেরো বছরের মেয়ের ভিতরে ঐশ্বর্যের যেন শেষ নেই। এর সবটুকুই কি কংকাল — মালী ভৈরবের কৃপা—তাঁর বিভূতি?
মোহিনী ভট্টচার্য প্রতি মঙ্গলবার ছাড়াও সপ্তাহে মাঝে একদিন করে আসেন। ভৈরবী-মা অথবা ভৈরব-বাবার প্রয়োজন বুঝে নিতেই আসা। কিন্তু এই দিনেও এখন আর তিনি একলা আসেন না। সঙ্গে কল্যাণী থাকেই। আর এই দিনে তাদের সঙ্গে ভালো মাছ বা মাংসও আসেই। অন্য খাবার দাবারও থাকে। কল্যাণী এখানে সমস্ত দিন থাকে আর খেয়ে যায় বলেই নয়। আগেও সপ্তাহের এই ফাঁকা দিনে ভটচায মশাইয়ের সঙ্গে কিছু না কিছু খাবার আসত। কিন্তু ইদানীং আরো বেশি আসছে। ভৈরবী-মা বলেন, এত কেন!
ভটচায, মশাই ওই মেয়েকে দেখিয়ে দেন। এত না হলে ওর মন ওঠে না।
মাঝের এই দিনে এসে কল্যাণী বেশিরভাগ সময় ভৈরব-বাবার ঘরেই কাটায়। আবার এক-একবার দাওয়ায় এসে ভৈরবী-মায়ের পাশে বসে তাঁকে একটু আধটু সাহায্য করে। ওষুধের জিনিস-পত্র হাতে হাতে গোছগাছ করে দেয়। মা-কে কিছু বলতে হয় না—এ-কাজে যেন অনেকদিন ধরেই অভ্যস্ত।
ভৈরবী-মায়ের শিষ্যকে যাচাইও করে একটু আধটু। নতুন কোনো শিকড় লতা বা ধাতুগুণের জিনিস দেখলে সেটা তুলে ধরে জিগ্যেস করে, এটা কি বলুন তো?
জানা থাকলে কালীকিংকর জবাব দেন।
—কি কি কাজে লাগে?
কি জিনিস চেনা থাকলে এই জবাবও জানাই থাকে।
ভেরি গুড।
জানা না থাকলে কালীকিংকর চুপচাপ মায়ের দিকে তাকান। মা বলেন, কি জিনিস আর কি কাজে লাগে এবার ওকে জিগ্যেস করো।
মেয়ে কোনোদিন হেসে ফেলে। কোনোদিন বা আত্মরক্ষার পথ দেখে। আমি বলতে যাব কেন, আমি কি তোমার কাছে এসবের পাঠ নিচ্ছি! চটপট উঠে বাবার ঘরে চলে যায়।
খেতে বসেও এক-একদিন কম মজা করে না। কল্যাণী আর মোহিনী ভট চাযের আসন পাশাপাশি। মুখোমুখি আসনটা কালীকিংকরের। ভৈরবী-মা পরিবেশন করেন।
খেতে খেতে সেদিন হাত গুটিয়ে কল্যাণী কালীকিংকরের পাতের দিকে চেয়ে রইলো। তারপর বলল, তপস্বী আর তপস্বিনীদের শুনেছিলাম সকলের ওপর সমদৃষ্টি।
মেসোমশাইয়ের অর্থাৎ মোহিনী ভট চাষের স্বাভাবিক প্রশ্ন। কেন, কি হলো?
একটা আঙুল তুলে কালীকিংকরের পাত দেখিয়ে দিল।—ভালো ভালো মাংসের পীসগুলো সব ওই পাতে—তুমি আমি হাড় চিবুচ্ছি।
ভট চায মশাই হেসে উঠলেন। কালীকিংকরের খাওয়া আপনি থেমে গেল। বকুনির সুরে ভৈরবী-মা বললেন, খাওয়ার সময়েও তুই পিছনে লাগতে ছাড়বি না—বেচারার খাওয়া থামিয়ে দিলি।
আহা, বেচারা ভালো করে খান।
কথা-বার্তা শুনে আর হাব-ভাব দেখে কে বলবে এই মেয়ে তাঁর থেকে বয়সে ন’বছরের ছোট। কালীকিংকর এতটা হজম করতে রাজি নন। গম্ভীর মুখে ভৈরবী মা-কে বললেন, মা আমি যদি একবারটি আসন ছেড়ে উঠি আবার বসতে পাব তো?
না বুঝে ভৈরবী-মা জিগ্যেস করলেন, কেন?
—আপনি সত্যি ভুল করেছেন দেখছি, ওর পাতে বেশির ভাগই হাড় পড়েছে, হাত ধুয়ে এসে আমি নিজে একটু মাংস বেছে দিই, বাচ্চা মেয়ের নজর লাগলে নিজে তাকে কিছু দিতে হয় শুনেছি।
—কোথায় শুনেছেন? আর এখানে বাচ্চা মেয়ে কে? কল্যাণীর সোজা মুক্তি চ্যালেঞ্জ। —নজর কে কার দিকে দেয় আমি জানি না?
মোহিনী ভটচায, খাচ্ছেন আর মিটিমিটি হাসছেন। শেষের কথা শুনে ভৈরবী মা-ও হেসে ফেললেন। —বিতণ্ডা থামিয়ে যে-যার খেয়ে ওঠতো এখন। কালীকিংকরের দিকে চেয়ে বললেন, ও হাড় বেশি পছন্দ করে তাই ওর পাতে হাড় বেশি।
কল্যাণীও হেসে ফেলল। তারপরেই গলা চড়িয়ে হাঁক দিল, ও শিবঠাকুর, শুনছ? জেগে আছ না ঘুমোচ্ছ?
ঘরের ভিতর থেকে গম্ভীর জবাব এলো, জেগে আছি। ও-ছোড়ার পাখা গজিয়েছে, হাড় চিবুতে হলে আগে পাখ্ না ছেঁটে দিতে হবে।
সময়ে কল্যাণীর পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। কালীকিংকর শুনলেন ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেছে। কিন্তু আর নাকি পড়ার ইচ্ছে নেই। মেসোর ইচ্ছে এবারে কলেজে পড়ুক। সেই ইচ্ছে কল্যাণী ভৈরব-বাবাকে দিয়ে বরবাদ করিয়েছে। তাঁর কথার ওপর কার কথা? কিন্তু কালীকিংকরের এটা পছন্দ হয়নি। দুপুরে ভৈরব-মায়ের সঙ্গে বসে ওষুধ বানাচ্ছিলেন।
দু‘হাত ফারাকে বসে কল্যাণীও কি ঝাড়-বাছ করছিল। নিজের কাজের দিকে চোখ রেখেই কালীকিংকর বললেন, ফার্স্ট ডিভিশনে ম্যাট্রিক পাশ করে আর না পড়ার কোনো মানে হয় না—আপনাদের জোর করা উচিত ছিল।
মন্তব্য ভৈরবী-মায়ের উদ্দেশে। কিন্তু ফোঁস যার করার সে করেই উঠল।
—আমাকে বিদ্যেধরী বানিয়ে আপনার কি সুবিধে হবে?
—আমার আর কি সুবিধে হবে, তোমার নিজেরই সুবিধে হবে। —কি সুবিধে, চাকরি করতে বেরুবো?
—না বেরুলেও বেরুনোর যোগ্যতা থাকা ভালো। না পড়ে কি করবে? —এম-এ পড়তে পড়তে আপনি পড়া ছাড়লেন কেন? আপনিই বা না পড়ে কি করছেন?
রাগ না করে কালীকিংকর বুদ্ধিমানের মতো হাসলেন। —নিজেকে আমি মায়ের হাতে ছেড়ে দিয়েছি, কি করছি না করছি মা জানেন।
—নিজেকে আমি বাবার হাতে ছেড়ে দিয়েছি, কি করছি না করছি বাবা জানেন।
মায়ের হাত চলছে, কিন্তু নিঃশব্দে, হাসছেন। কালীকিংকর টিপ্পনীর সুরে বললেন, তুমিও তাহলে আমার মতোই ভেরেণ্ডা ভাজবে।
—আপনার মতো কেন, আমি তো কোনো মেয়ের আঁচলের তলায় বসে নেই—বাবার কাছে ক্রিয়া-কলাপ শিখে হাড় চিবুনোর বিদ্যেটাই ভালো করে রপ্ত করব!
কালীকিংকর অনেক দিন নিজেকে সমঝেছেন, এমন কি নিজের ওপর চাবুক চালিয়েছেন। এই মেয়েকে সকলেরই ভালো লাগে। যাঁদের সঙ্গে আসে তাঁদের ভালো লাগে। যাদের জন্য আসে অর্থাৎ রোগীদেরও ভালো লাগে। ভৈরবী-মায়ের ভালো লাগে। আর ভৈরব-বাবার তো চোখের মণি। ওপরওয়ালার কারিগরি বলে যদি কিছু থেকে থাকে, তাহলে ভালো লাগার মতো মেয়ে করেই তাকে পাঠানো হয়েছে। কালীকিংকরেও শুধু ভালো লাগলে সেটা দোষের ভাবতেন না। কিন্তু ভালো লাগা এক আর সমস্ত চিত্ত সংগোপনে তার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকা আর এক। নিজের কাছে এই আকর্ষণ যত স্পষ্ট হয়ে উঠছে, কালীকিংকরের ততো অস্বস্তি। কল্যাণী মঙ্গলবারে তো আসেই, আর মাঝের একদিন বলতে শনিবারেই বেশি আসে। কালীকিংকরের মনে হয় সপ্তাহের এই দুটো দিনই যেন বড় বেশি দেরিতে আসে। আর দিন দুটো ফুরোয় ও বেশি তাড়াতাড়ি। কিন্তু কোনো শনিবারে না এলে মনে হয় এমন বর্ণশূন্য দিন জীবনে আর যেন কখনও আসেনি। ভট্টচার্য, মশাইকে জিগ্যেসও করতে পারেন না কেন এলো না। তখন ভৈরবী-মায়ের ওপরই রাগ হয়, কেন উতলা হন না, কেন জিগ্যেস করেন না এলো না কেন।
এলো না তাতে তোর কি? তোর কি? তোর কি? নিজের ভিতর থেকেই এই গর্জন শুনতে পান কালীকিংকর। আক্রোশে নিজেকেই ফালা ফালা করে দিতে চান।—তোর কি আশা? তোর কেন এত দুরাশা : …তুই না খোঁজার জগতের পথ পাড়ি দিতে চেয়েছিলি? এই পথের কেউ দোসর হতে পারে? তোর এই খোঁজার জগতে এখন কে ঘুর ঘুর করছে? শেষে কিনা একটা মেয়ে? তার থেকে তুই মরে যা! মরে যা, মরে যা, মরে যা!
ক্ষিপ্ত হয়েই নিজেকে শাসন করতে চেষ্টা করেন। তখন তাঁর হাব-ভাব আচরণ দেখে ভৈরবী-মাও এক-এক সময় চুপচাপ চেয়ে থাকেন। একটা দুটো করে একে একে চারটে বছর কেটে গেল। তাঁর বয়েস ঊনত্রিশ। কল্যাণীর কুড়ি। ভৈরবী-মা একদিন কথায় কথায় বলেছিলেন, বাবা নাকি কুড়িতে বিয়ে দিতে বলেছিলেন ওই মেয়ের।—সেই কুড়ি। কালীকিংকর এমন নির্ভুল হিসেব রাখতে গেছেন কেন? কল্যাণীর কুড়ি বছর বয়সটা একটা যন্ত্রণার মতো এগিয়ে আসছে তো আসছেই। তবু হিসেব ভুলতে পারেন না কেন? এই মেয়ে এখন আরো নিটোল আরো স্থির যৌবনা! চাল-চলন স্বভাবের অস্থিরতা আগের থেকে কমেছে মনে হয়। কমেছে কারণ, সে যেন তার কদর জানে। জানে দুনিয়া তার বশ।
..খুব মিথ্যে জানে কি? এই মেয়েকে দেখিয়ে মোহিনী ভটচায, যার দিকে আঙুল নাড়বেন সে-ই বর্তে যাবে, পরম সমাদরে নিয়ে গিয়ে ঘরে তুলবে।
কিন্তু সংগোপনে এ কি যন্ত্রণা পুষছেন কালীকিংকর? বাসনার কোন অতলে নিঃশব্দে ডুবতে চলেছেন তিনি? একটি মেয়ের এমন ক্রীতদাস হয়ে বেঁচে আছেন তিনি? এই মৃত্যু থেকে তাঁর যে সত্যিকারের মৃত্যু ভালো ছিল!
আর না। এবারে তিনি এই মৃত্যুর গহ্বর থেকে নিজেকে টেনে তুলবেন। তুলবেনই। বুদ্ধিনাশের এই জালে নিজেকে আর জড়াবেন না। ভৈরবী-মায়ের সঙ্গে কাজে বসে সেই দুপুরেই প্রস্তাব পেশ করলেন।—মা, চার বছর আপনার আশ্রয়ে কাটিয়ে দিলাম, এবার কিন্তু আমাকে ছেড়ে দিতে হবে…
ভৈরবী-মায়ের হাতের কাজ থেমে গেল। তিনি চেয়ে রইলেন। শিক্ষা-দীক্ষা সব শেষ হয়েছে ভাবছিস?
—শুরু হয়েছে কিনা তাই জানি না মা, আপনার কাছে থেকে লোকের উপকার করার শিক্ষা কিছু পেয়েছি হয়তো কিন্তু ভিতর থেকে এক পাও এগোইনি…।
পা বাড়ালেই ভেতর থেকে এগুনো হবে?
—আপনি আশীর্বাদ করলে হবে।
—কাপুরুষকে আশীর্বাদ করব কি করে? অনেক দিন ধরেই তোকে অন্যা রকম দেখছি…পালানোর পথ কি কোনো পথ? কোথা থেকে কোথায় পালাতে চাস তুই?
ভৈরবী-মায়ের মুখে এ কি কথা! তিনি কি তাঁর ভিতরের কাটা-ছেঁড়া সব দেখতে পাচ্ছেন? তাঁকে বাসনার সমুদ্রে ডুবতে দেখছেন?
একটু চুপ করে থেকে আদেশের সুরে ভৈরবী-মা বললেন, অঘ্রান মাস পর্যন্ত অপেক্ষা কর্, সব ঠিক হয়ে যাবে।
…এটা ভাজ শেষ। মাঝে আশ্বিন কার্তিক। অস্ত্রানে কল্যাণীর বিয়ে তাহলে।…ভৈরবী-মা তাঁর ভিতর দেখেছেন। তাই এই অমোঘ আদেশ।
দাঁড়িয়ে থেকে কল্যাণীর বিয়ে দেখে এই ক্রীতদাসত্বের মায়া থেকে উত্তীর্ণ হতে হবে।
…তাই হোক। তিনি বলেছেন সব ঠিক হয়ে যাবে, এ-টুকুই সান্ত্বনা।
***
বিয়ে জানে বলেই হয়তো কল্যাণী শনিবারে আসা ছেড়েছে। সাহায্যের দরকার হয় তাই শুধু মঙ্গলবারে ওষুধ দেবার দিনে আসে। সে কংকাল-মালী ভৈরবের বড় আদরের শিষ্যা। … বাবার কৃপায় তারও কি ভিতর দেখার চোখ হয়েছে? নইলে মুখের দিকে ভালো করে না তাকিয়েও মনে হয় কেন, রমণীর চোখে মুখে কৌতুক উপছে উঠছে। কালীকিংকর ‘পারতপক্ষে তার দিকে তাকান না। কথা তো বলেনই না। তবু রোগী দেখা ওষুধ দেওয়ার পর্ব শেষ হতে কৌতুকে ডগমগ মুখের দিকে কালীকিংকরের চোখ পড়েই।
—তোমাদের অবধূতের কি এখন বাক্-সংযমের ব্রত চলেছে নাকি গো মা? কোনোদিকে না তাকিয়ে কালীকিংকর দাওয়া থেকে নেমে চলে এসেছেন। নিজের হাত থাকলে অগ্রহায়ণ মাসটাকে কালীকিংকর টেনে হিঁচড়ে এগিয়ে নিয়ে আসতেন। তাড়াতাড়ি আসুক। তাড়াতাড়ি চলে যাক। মা বলেছেন, তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে।
…সেই দিনটা জন্মাষ্টমী, কালীকিংকরের খেয়াল থাকার কথা নয়। ছিলও না। জিপ থামতে দেখল মোহিনী ভট্টচাযের সঙ্গে কল্যাণী নামছে। ভট্টচার্যের হাতে দুটো মিষ্টির হাঁড়ি। আর কল্যাণীর হাতে বড়সড় একটা ফুলের ডালা। ফুল ছাড়া তাতে একটা চূড়ার মতো দেখা যাচ্ছে—সঙ্গে আরো কি।
ঘরের সামনে এসে গলা চড়ালো। শিবঠাকুর ঠিক-ঠাক আছ? আসব? আয়, তুই হঠাৎ কোন্ টানে?
ভিতরে ঢুকল। বাইরে দাঁড়িয়ে কালীকিংকর জবাব শুনলেন।—আজ জন্মাষ্টমী, ইচ্ছে হলো তোমাকে একটু সাজাবো — তাই হা-হা হাসি। জন্মাষ্টমীতে তুই ভৈরবকে সাজাবি! এই মতি হলো তোর। … ফুলের সঙ্গে এসব কি মুকুট, চূড়া, বাঁশী!
—আমার হাতে পড়ে তুমি আজ মুরলীধর হবে।
—আর রাধিকা?
—আমি ছাড়া কে আবার তোমার রাধিকা হতে যাবে, যেমন কপাল। —ঠিক আছে, সাজা। তারপর তোকে আমার কোলে বসে আমার সঙ্গে বাঁশি ধরতে হবে যা ডবকাখানা হয়েছিস—রাধিকাওএমন ছিল না। মোটা গলা আর সুরেলা গলার সরব হাসি। কালীকিংকরের দাওয়া থেকে নেমে দূরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করছে। তাঁর বিষাক্ত মনে এমন সহজ রসিকতারও বিষ-ক্রিয়া। কিন্তু পা দুটো মেঝের সঙ্গে আটকে আছে। দাওয়ার ও-মাথায় দাঁড়িয়ে ভৈরবী-মা নিচু গলায় ভটাচার্য, মশাইয়ের সঙ্গে কি কথা বলছেন! বেশ কিছুক্ষণ বাদে ভৈরব-বাবার হাঁক শুনে কালীকিংকর সচকিত।—অবধূত! এই শালা ভূত—
এস্তে ঘরে এসে দাড়ালেন। বাবাকে ফুল-সাজে সাজানো হয়েছে। ফুলের মালা, ফুলের বালা, ফুলের বাজুবন্ধ। মাথায় শিখি-চূড়া। হাতে বাঁশী।—দ্যাখ, ভালো করে দ্যাখ,—রাধিকা বলল, হিংসেয় জ্বলে পুড়ে যাবে— ডেকে দেখাও!…ঠিক বলেছে, জ্বলছিস—হা-হা-হা—এই শালা! আমার দিকে না তাকিয়ে তুই আমার রাধিকার রূপ গিলছিস? চোখ দুটো গেলে দেব না তোর। দূর হ, দূর হ!
কালীকিংকর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। সকলেই কি পরীক্ষার জালে কষে বাঁধছে তাঁকে? তাঁকে উত্তীর্ণ হতে হবে—হতেই তো হবে! দাওয়া থেকে নেমে এলেন। লক্ষ্যহারার মতো শ্মশানের ভিতরের দিকে এগিয়ে চললেন। এটা ভাদ্রর শেষ।… অগ্রহায়ণের যে আরো অনেক দেরি! সেই অভ্রান মাস এলো। কালীকিংকর আরো স্থির আরো সংযত। বিয়ের দিন কবে জানা নেই। জানার আগ্রহও নেই। যে দিনেই হোক, তিনি গিয়ে দাঁড়ানোর জন্য প্রস্তুত।
কিন্তু ভৈরবী-মা হঠাৎই এক বেখাপ্পা আদেশ করে বসলেন। বললেন, আজ বিকেলের দিকে ভটচায, বাবার জিপ, এসে তোকে নিয়ে যাবে — তোর সঙ্গে কথা আছে, তৈরি থাকিস।
তাঁর সঙ্গে ভটচায মশাইয়ের কি কথা থাকতে পারে কালীকিংকর ভেবে পেলেন না। হয়তো লোক-বল কম, সাহায্য দরকার।
জিপ এলো। তিনি উঠলেন। ফেরার সময়েও জিপ পাবেন আশা করা যায়। নইলে রামপুরহাট থেকে বাসে ফেরা আয়াসসাধ্য ব্যাপার। না কালীকিংকরের মনে এখন কোনো দুশ্চিন্তার ঠাঁই নেই।
ড্রাইভার বাড়ি দেখিয়ে দিয়ে জিপ নিয়ে চলে গেল। কড়া নাড়তে দরজা খুলে সামনে দাঁড়িয়ে কল্যাণী।
খুব অমায়িক গলা করে বলল, অবধূতজীর আসতে পথে কোনো কষ্ট হয়নি তো?
—না।…এ-মাসেই তোমার বিয়ে শুনলাম… কংগ্র্যাচুলেশন্স।
—শুনলেন! চাউনি বিস্ফারিত প্রায়।—এ মাসেই আমার বিয়ে আপনি শুনলেন?
চাপা হাসিতে ঝকমক করছে সমস্ত মুখ। কালীকিংকর হঠাৎ জবাব দিতে পারলেন না।
—ঠিকই শুনেছেন— থ্যাংক ইউ। ও মেসোমশাই ইচ্ছে করে আসতে দেরি করছ কেন?
দ্রুত ঘর ছেড়ে চলে গেল। হঠাৎ এমন মজার ব্যাপারটা কি হলো কালীকিংকর বুঝলেন না।
মোহিনী ভটচায, এসে পরম আদরের অতিথির মতোই ব্যবহার করলেন তাঁর সঙ্গে। জলখাবারের আয়োজন ভোজের আয়োজনের মতোই। জিপ পাঠিয়ে হঠাৎ বাড়িতে ডেকে আনা হলো কেন কালীকিংকর তার কোনো হদিস পেলেন না। আপ্যায়নের পর ভটচায, গৃহিণী উঠে যেতে আর ধৈর্য থাকল না।—মা বলছিলেন, কি দরকারি কথা আছে…
— হ্যাঁ এইবার বলি। আজ পাঁচ তারিখ। সামনের চৌদ্দ তারিখে বিয়ের দিন ঠিক করলাম, অবশ্য ভৈরব-বাবাকে একবার জিগ্যেস করে নিতে হবে। …মা বলছিলেন, কল্যাণীর ব্যাপারটা তোমাকে খোলাখুলি সব জানাতে, জানাবার ভারও তিনি আমাকেই দিয়েছেন, তাই তোমাকে ডেকে আনা।
কালীকিংকর বিমূঢ় হঠাৎ। —কল্যাণীর ব্যাপার আমাকে জানাতে বলেছেন…! আমাকে কেন?
মোহিনী ভটচায, মিটিমিটি হাসছেন। বিয়েটা হতে যাচ্ছে তোমার সঙ্গে, আর জানাতে যাব অন্য লোককে ডেকে এনে?
দীর্ঘ চার বছর ধরে বিশাল একটা অনুভূতির বন্যাকে বুঝি কাঁচা মাটির বাঁধ দিয়ে ঠেকিয়ে রাখার জন্য যুঝছিলেন কালীকিংকর অবধূত। কটা মাত্র কথায় সেই বাঁধ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। সেই তোড়ে নিজেরই হাবুডুবু দশা।
মনের সেই অবস্থাতেই মোহিনী ভটচায যা বলে গেলেন, তিনি বোবার মতো বসে শুনলেন!
…কল্যাণীর বাবার নাম পরমেশ চক্রবর্তী, মায়ের নাম মহামায়া। মহামায়াই এখন কংকালমালী ভৈরবের ডেরার ভৈরবী-মা। কল্যাণী তাঁর একমাত্র সন্তান। রামপুরহাটেই পরমেশ চক্রবর্তীর বাপের মস্ত অবস্থা ছিল। জমিজমা আর প্রাসাদের মতো বাড়ি ছিল। কলকাতায় বাড়ি ছিল। অল্প বয়সে অগাধ বিত্তের অধিকারী হয়ে পরমেশের মাথা ঘুরে গিয়েছিল। আগেও তাঁর স্বভাবচরিত্র ভালো ছিল না। তাঁর চরিত্র শোধরানোর জন্য বাপ মা অনেক বাছাই করে রূপসী মেয়ে মহামায়াকে ঘরে এনেছিলেন। তাঁকে পেয়ে পরমেশ বিকৃতির পথে আরো বেশি এগিয়েছেন। তাঁর ভোগের লালসা অত্যাচার ব্যভিচার বেড়েই চলেছিল। কিন্তু মহামায়ার ভিতরেও আগুন কম ছিল না। শ্বশুর শাশুড়ীর মৃত্যুর পরেই একমাত্র মেয়েকে নিয়ে তিনি কলকাতার বাড়িতে চলে এসেছেন। এমন বাপের চোখের সামনে তিনি মেয়েকে রাখতে রাজি নন।
…নিজের এই চরিত্র পরমেশের। তার ওপর সন্দেহ রোগ। রামপুরহাটে থাকতে স্ত্রীকে ঘর-বন্দী রেখেছিলেন। চাকর-বাকরকে পর্যন্ত অন্দরমহলে ঢুকতে দিতেন না। স্ত্রীর এমন বিদ্রোহ তিনি বরদাস্ত করেন কি করে? রামপুরহাট থেকে কলকাতা আর কত দূরে। মাতাল হয়ে আসতেন, অত্যাচার আর উৎপীড়নও দিনে দিনে ক্রমশঃ বেড়েই চলেছিল। স্ত্রীর প্রতি সন্দেহের কীট তাঁর মাথায় প্রথম ঢোকে রামপুরহাটে প্রায় সমবয়সী নিজের খুড়তুতো ভাইকে নিয়ে। এই দেওরটিকে মহামায়া পছন্দ করতেন। সেই দেওরও তখন কলকাতাবাসী। নিজে সেধে এসে মহামায়ার দেখা শুনোর দায়িত্ব নিয়েছেন। এমন দরদের একটাই অর্থ জানেন পরমেশ চক্রবর্তী। আর নিজের স্ত্রীর কলকাতায় এসে থাকার কারণও তাঁর কাছে জলের মতো স্পষ্ট।
…ক্রমে তাঁর দিকে চেয়ে নিজের মৃত্যুর ছায়া আর সর্বনাশের ছায়া দেখতে লাগলেন মহামায়া। মানুষটা সেই যে কলকাতায় এসে বসেছেন আর নড়েন না। বাড়িতে যাদের নিয়ে ভোগের আসর বসে, অন্তঃপুরের দিকে তাদের হাঙরেব দৃষ্টি। বিদ্রোহের আগুন নিয়ে আবার স্বামীর মুখোমুখি দাড়িয়েছেন। পরমেশের চোখে মুখে ক্রূর বিকৃত হাসি। বলেছেন, ভয় করছে? স্বামীকে বাতিল করে কেবল একজনের আনন্দের খোরাক যোগাচ্ছ—সেই একের জায়গায় পাঁচ জন হলে অত ভয়ের কি আছে? ওই অ্যালসেসিয়ানগুলোকে এবার একদিনে ছেড়ে দেব ভাবছি, ক্ষুধা-তৃষ্ণায় বেচারারা পাগল-পাগল করছে।
মহামায়ার মনে হলো সেই রকমই কিছু করতে পারে। রমণীর দেহ ছিঁড়ে খেতে দেখার উল্লাস দু‘চোখ দিয়ে যেন গলগল করে উপছে উঠছে।… আর, শেষে এই লোকের হাতে তাঁর মৃত্যু অবধারিত।
পরদিন মেয়েকে আয়ার সঙ্গে স্কুলে পাঠালেন না। তাকে প্রস্তুত করে নিজে নিয়ে যাবার জন্য তৈরি হলেন। পরমেশ জিগ্যেস করলেন, তুমি কোথায় যাচ্ছ?
মহামায়া জবাব দিলেন, হেডমিসট্রেস দেখা করতে বলেছেন, মেয়ের সম্পর্কে কিছু বলবেন হয়তো…।
স্ত্রীর শান্ত মেজাজ দেখে পরমেশ হাসলেন। সেই বিকৃত হাসি।—ফেরার সময় একবার শিবুর সঙ্গে দেখা করে আসবে না—কবে আবার সুযোগ হয় ঠিক কি…।
শিবু সেই খুড়তুতো দেওর। সন্দেহের কীট-দংশনে এখন সমস্ত মস্তিষ্ক ঝাঁঝরা। মহামায়া মেয়ে নিয়ে চলে গেলেন। পরমেশের চোখে এটা নতুন কিছু নয়। মেয়েকে নিয়ে অনেক দিনই তাঁকে স্কুলে যেতে দেখেছেন।
—মহামায়া নিজেও আর ফেরেননি। মেয়েও না।
কবে কিভাবে বক্রেশ্বর শ্মশানের কংকালমালী ভৈরব বাবার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ মোহিনী ভটচায, জানেন না! বাবার তলব পেয়ে একদিন ছুটে গিয়ে দেখেন, ঘরে একটি মহিলা আর সাত আট বছরের মেয়ে বসে। মেয়েটিকে তাঁর হাতে তুলে দিয়ে বাবা হুকুম করলেন, এই মেয়ে তোমার কাছে গচ্ছিত থাকল, নিজের ছেলে মেয়ের থেকেও বেশি যত্নে একে প্রতিপালন করবে। কেউ জিগ্যেস করলে আত্মীয় পরিচয় দেবে। মেয়েটিকে নয়, ওই মহিলাকে কি মোহিনী ভটচায, কখনো কোথাও দেখেছেন? ঠাওর করতে পারলেন না। এরকম এক তাজ্জব দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হলো বলেই আরো অবাক। কর-জোড়ে জিগ্যেস করলেন, ইনি কে বাবা?
সঙ্গে সঙ্গে হুংকার।—তোর তা দিয়ে কি দরকার রে শালা! আমার ভৈরবী—কেন, চোখে ধরেছে?
কল্যাণীকে নিয়ে মোহিনী ভটচায, প্রস্থান করে বেঁচেছেন।
***
রামপুরহাটে ভৈরবীকে নিয়ে একটা চাপা কানা-ঘুষো একটু একটু করে বেড়েছে। বছর ঘুরতে কিছু কানে গেছে পরমেশ চক্রবর্তীরও। তিনি এই শ্মশানে এসেছেন, দূর থেকে স্ব-চক্ষে ভৈরব কে দেখেছেন। হ্যাঁ, তখন তো তাঁর ভৈরবীরই বেশ।…দিন কতকের মধ্যে রামপুরহাটের বাড়িতে সাতটি নতুন মুখ দেখা গেছে।
রাতে মদের নেশায় পরমেশ চক্রবর্তীর নীরব সংকল্প নিজেদের অগোচরেই হয়তো কিছুটা সরব হয়েছিল। একে পুলিশের চাকরি মোহিনী ভট্টচার্যের তায় কংকালমালী ভৈরবের এমন ভক্ত—তাঁরও কানে আসা খুবই স্বাভাবিক।… বাবার থানে বড় রকমের কিছু হামলা ঘটতে যাচ্ছে, রক্তাক্ত কাণ্ড কিছু হতে যাচ্ছে।
জিপ ছুটিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ভৈরব বাবার কাছে এসেছেন তিনি। পুলিশের বড় চাকরিতে বহাল, বাবার হুকুম হলে সক্কলকে অ্যারেস্ট করে থানায় পুরতে অসুবিধে নেই।
ভৈরব বাবা নির্বিকার।-কিচ্ছু করতে হবে না, সময় হয়েছে, শালা নিজেই মরবে।
তবু সকলের অজান্তে বাড়িটাকে বেশ কড়া প্রহরায় রেখেছিলেন মোহিনী ভটচায, ঠিক তিন দিন পরের যা সমাচার, পুলিশের চোখে ঘটনার দিকে থেকে তা অভিনব কিছু নয়। তবু কণ্টকিত শুধু মোহিনী ভটচায্। বাবার নিরুদ্বেগ ভবিষ্যদ্বাণী মনে পড়েছে।
…সকালে রক্তাক্ত মৃত অবস্থায় পরমেশ চক্রবর্তীকে তাঁর শোবার ঘরে পাওয়া গেছে। ঘরের সিন্দুক হাঁ-করা খোলা। সাতজন নতুন মুখের মধ্যে দু‘জন উধাও। পুলিশের জেরায় বাকি পাঁচজন কবুল করেছে, আগের দিন সকালে পরমেশ চক্রবর্তী সাত জনকে দেবার জন্য ব্যাঙ্ক থেকে একুশ হাজার টাকা তুলে ওই সিন্দুকে রেখেছিলেন। লোক দুটোর সঙ্গে সেই টাকাও উধাও।
…পরের এই তেরো বছরের সমাচার সংক্ষিপ্ত। নিজের মেয়ের মতোই কল্যাণীকে বড় করেছেন মোহিনী ভটচায্। অবশ্য বাবার কুপাই এই মেয়ের সব থেকে বড় সম্পদ। বাবার নির্দেশে পরমেশ চক্রবর্তীর রামপুরহাটের বাড়ি-ঘর, জমিজমা আর কলকাতার বাড়ি বেচে নগদ টাকা সব কল্যাণীর নামে ব্যাঙ্কে জমা ছিল। সুদে আসলে সে টাকা ছ’লক্ষর ওপর দাঁড়িয়েছে। সে সাবালিকা হতে সব এখন তার হেপাজতে।)
সেই দিনে ওই টাকার অঙ্ক শুনে কালীকিংকরের মাথাটা ঝিম-ঝিম করে উঠেছিল। ভটচায, মশাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জিপে ওঠার পরেও ভেবেছিল, বাবার ডেরায় ফিরে না গিয়ে একেবারে সটকান দেবে কিনা। ছ’লাখ টাকার ওপরে মালিক-বাপরে বাপ! রূপের ডালি এত বড়লোক মেয়ের জন্য এঁরা তাঁকে বাছাই করে নিলেন কেন কালীকিংকর ভেবে পেলেন না। কিন্তু পালানোর চিন্তা বেশিক্ষণ মাথায় ঠাঁই পেল না।
আজ চার বছর ধরে যে-মেয়ে তাঁর মন জুড়ে বসে আছে, সেই মনের সঙ্গে ওই মেয়ের কোনো টাকার যোগ ছিল না। ওই মেয়েকেই কেবল তাঁর মস্ত ঐশ্বর্য বলে মনে হয়েছিল। টাকার লোভের ছিটেফোঁটাও ছিল না, এখনো নেই।—এমাসেই বিয়ে বলে অভিনন্দন জানানোর জবাবে কল্যাণীর সেই মুখ, সেই বিস্ফারিত চাউনি, আর সেই কথাগুলো চোখ কান জুড়ে বসল। বলেছিল, শুনলেন। এ মাসেই আমার বিয়ে আপনি শুনলেন।
…তার মানে কার সঙ্গে বিয়ে এ কেবল অবধূতই জানতেন না। আর সকলেরই জানা ছিল।
বিয়ে হয়ে গেল। ভটচায, মশাইয়ের বাড়িতেই হিন্দু মতে বিয়ে। আবার সেই বাড়িতেই বউ-ভাত, ফুলশয্যা। এ-বিয়েতে তেমন আড়ম্বর বা জাঁকজমক কিছুই হলো না।
ফুলশয্যার রাতে কল্যাণীকে নিরিবিলিতে পাওয়ার পরেও নিজের এই ভাগ্য কালীকিংকর যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তখনো ভাবছেন এমন ঘটনার বুনোট সম্ভব হলো কি করে? কে ঘটালো?
বলেই ফেললেন, ব্যাপারখানা কি রকম হলো?
নব-বধূর মুখের হাসিতে চাউনিতে বা কথায় লজ্জাটজ্জার লেশমাত্র নেই।
—কেন, এ-রকমই হবে তুমি জানতে না?
—আমি একটা ভবঘুরে বাউণ্ডুলে, শ্মশানে ভৈরবী মায়ের কাছে পড়ে থাকি—আমার জন্য রাজত্বযুদ্ধ রাজকন্যা সেজে বসে আছে কি করে জানব।—তুমি জানতে?
—চার বছর আগে প্রথম যেদিন তোমাকে দেখলাম সে-দিনই জানতাম —কি করে—কি করে? কালীকিংকর ব্যগ্র উন্মুখ।
—সে-দিনই দই-মিষ্টির হাঁড়ি হাতে তোমাকে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শিবঠাকুর হুংকার ছাড়লেন মনে নেই? বললেন, তুমি তাঁর বুক ঝাঁঝরা করে দেবার মতলবেই এখানে এসে জুটেছ—আমি তক্ষুণি বুঝে নিয়েছি, ব্যাপারখানা এই দাঁড়াবে।…এর অনেক পরে অবশ্য শুনেছি, মায়ের সঙ্গে তোমার প্রথম সকালের ইন্টারভিউতে তুমি ফার্স্টক্লাস নম্বর পেয়ে গেছলে।
—কিন্তু আমার তো তুমি কিছুই জানতে না—মায়ের মতলব বুঝে তুমি খুব ধাক্কা খাওনি?
—কি বুদ্ধি তোমার—বললাম না, প্রথম দিন শিবঠাকুরের ওই কথা শুনেই যা বোঝার আমি বুঝে নিয়েছি! মায়ের মনে যা-ই থাক, তাঁর ভৈরব-বাবার মত না হলে কারো এক পা এগোবার সাধ্য ছিল নাকি! … আর তিনি মত দিলে আমি ধাক্কা খেতে যাব কেন—আমার ভালো—মন্দ তাঁর থেকে বেশি কে জানে—কে বোঝে?
পরদিন সকালে জিপে করে দু‘জনে এলেন কংকালমাসী ভৈরব আর ভৈরবী-মা-কে প্রণাম করতে। ভটচায মশাই দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার আয়োজনও সেখানেই করেছেন।…বউ নিয়ে ঘরে ঢুকতেই ভৈরব বাবার বজ্র হুংকার।—শালা বেইমান। শালা নেমকহারাম! তো বেটীকে আমি সাবধান করে দিয়েছিলাম না, এ-শালা আমার বুক ঝাঁঝরা করে দেবার মতলবেই এখানে এসেছে।
তাঁর পায়ের কাছে কল্যাণী জানু-আসনে বসল। আঁচলের গ্রন্থিতে টান পড়তে কালীকিংকর পিছনে এসে দাঁড়ালেন। মুখখানা যতটা সম্ভব বেজার করে কল্যাণী ভৈরব-বাবার দিকে তাকালো।…বুকে একটু হাত বুলিযে দেব?
—তাতে আর কতটুকু জুড়োবে— তুইও এমন নেমকহারাম — অ্যা? আমাকে ছেড়ে ওই শালাতে মজে গেলি?
—অবলাকে তুমি রক্ষা করলে না, কি করব?
আস্তে আস্তে তাঁর দু‘পায়ের ওপর মাথা রাখল। পায়ের ওপর নিজের কপাল মু” আর দু‘গাল বুলোতে লাগল। এই প্রণাম দেখে কালীকিংকরের বুকের তলায় অদ্ভুত এক আবেগের ঢেউ। কংকালমালী ভৈরব হাসছেন মিটিমিটি। জটাজ ট চুল-দাড়ি বোঝাই রুক্ষ মূর্তি ভৈরব বাবার এমন কোমল মুখ কালীকিংকর আর দেখেননি।
প্রণাম করে উঠতে ভৈরবী মায়ের দিকে বাবা হাত বাড়ালেন। সিদুরের পাত্র হাতে তিনি প্রস্তুত। বাবা মোটা মোটা তিনটে আঙুল সিঁদুরে ডুবিয়ে কল্যাণীর কপালে আর মাথায় লেপে দিলেন।
সে উঠে সরে বসতে কালীকিংকর হাঁটু মুড়ে বসে বাবার পায়ে মাথা রাখলেন। দশ সেকেণ্ড না যেতে বাবা দাবড়ানি দিয়ে উঠলেন, খুব ভক্তি দেখিয়েছিস শালা—এবারে ওঠ।
উঠতে বাবা তাঁর কপালে সিঁদুর দিয়ে একটা ত্রিশূল মতো কিছু একে দিলেন মনে হলো। পরে আয়নায় দেখেছেন ত্রিশূলই। ভৈরব কটমট করে খানিক সোজা তাঁর দিকে চেয়ে থেকে কল্যাণীর দিকে ফিরলেন।-এ শালা তোকে খুব ভোগাতে আর জ্বালাতে চেষ্টা করবে— তুই কিছু পরোয়া করিস না, যত চেষ্টা করবে শালা নিজে ততো ভুগবে আর জ্বলবে! কল্যাণী আলতো করে বলল, জ্বালাতে আর ভোগাতে চেষ্টা যাতে না করে তুমি তাই করে দাও— দু‘জনেরই বাঁচোয়া।
ভৈরব-বাবা খেঁকিয়ে উঠলেন, আমি কি ঈশ্বর যে যা বলবি তাই করে দেব—ও-শালার খেলা না খেলে কারো পার আছে? ঝামেলায় পড়লে ওই শালাকেই ডাকবি—দেখবি এই শালারও নাকে আপনা থেকেই দড়ি পড়ে গেছে।
ও-শালা মানে ঈশ্বর, আর এ-শালা মানে কালীকিংকর।
বিয়ের দশদিন যেতেই ভৈরবী-মা জামাইকে তাড়া দিতে শুরু করলেন, আর বসে থাকিস না— দেখে-শুনে একটু জমি কিনে দু‘খানা ঘর তুলে নে —ভট চাঘ, মশাইয়ের ওখানে আর কতদিন পড়ে থাকবি?
—কিন্তু ভটচায মশাই যে ছাড়তে চান না, বলেন হবে‘খন, যাক কিছু দিন।
—তিনি অন্য আশায় বলেন, শিগগীরই নিজের ভুল বুঝবেন।… ভৈরব—বাবা কোন্নগরে গঙ্গার কাছাকাছি নিরিবিলিতে একটু জমি নিয়ে ঘর তুলতে বলেছেন তোদের।
ভট্টচার্য, মশাইয়ের কি আশা বা কি ভুল আর মাথায় থাকল না কালীকিংকরের। জিগ্যেস করলেন, হুগলীর কোন্নগর? সেখানে কেন?
—জায়গাটা খুব পছন্দ, প্রথম জীবনে ভৈরব-বাবা সেখানকার শ্মশানেই কাজ করেছিলেন।
কল্যাণীকে বলতে সে-ও সায় দিল, হ্যাঁ, শিবঠাকুর মুখ ফুটে বলেছেন যখন, সেখানেই জমি দ্যাখো।
—কিন্তু এত তাড়ার কি আছে! আচ্ছা, এ-দিকে ভটচায মশাই আমাদের ছাড়তে চান না, ও-দিকে মা বলেছেন, উনি অন্য আশায় আছেন, শিগগীরই নিজের ভুল বুঝবেন…কি ব্যাপার বলো তো?
—ব্যাপার আর কি, মেসোমশাই ভাবছেন আমাদের বাড়ি ঘর না হওয়া পর্যন্ত মা আর তাঁর ভৈরব-বাবাকে আটকে রাখা যাবে—কিন্তু তা তো আর যাবে না, ওঁরা খুব শিগগীরই চলে যাবেন।
আকাশ থেকে পড়লেন কালীকিংকরও।—ওঁরা চলে যাবেন মানে—কোথায় যাবেন?
—তা কি করে জানব! তাছাড়া কত জায়গায় যাবেন ঠিক আছে!
—আর ফিরবেন না?
—মনে হয় না। আমার বিয়ের জন্যেই এতদিন এখানে আটকে ছিলেন, এখন যে কোনো দিন দেখব তাঁরা চলে গেলেন।
এ-খবর শুনে কালীকিংকর যত না অবাক, তার থেকে বেশি অবাক কল্যাণীর দিকে চেয়ে। না, ওই মুখে এতটুকু বিষাদের চিহ্নমাত্র নেই। আর ফিরবেন না জেনেও এমন নির্লিপ্ত থাকতে পারে কি করে? মায়ের প্রতি না হোক, ভৈরব-বাবার প্রতি তার আকর্ষণ তো নিজের চোখেই দেখা। জিগ্যেস না করে পারলেন না, তোমার মন খারাপ হচ্ছে না—কষ্ট হচ্ছে না? তেমন সাদাসিধে জবাব, মন খারাপের কি আছে, আর কষ্টই বা হবে কেন —সেই দশ বছর বয়সে দীক্ষা নেবার পর থেকে শিবঠাকুর কি এক মুহূর্ত আমার কাছ ছাড়া নাকি!
সত্যি দিন-কতকের মধ্যে ভৈরবী-মা আর কংকালমালী ভৈরব বক্কোমুনির থান ছেড়ে চলে গেলেন। কোথায় গেলেন কেউ জানল না।
কল্যাণী তেমনি নির্লিপ্ত, সহজ। বুকের ভেতরটা খাঁ-খাঁ করতে লাগল কেবল মোহিনী ভটচার্যের। আর কালীকিংকর অবধূতের। কল্যাণী তাঁর মনের অবস্থা আঁচ করে হেসেই মন্তব্য করল, তোমার সত্যিকারের অবধূত হতে ঢের দেরি।
জীবনের আর এক অধ্যায় শুরু হলো কালীকিংকর অবধূতের। এই অধ্যায়ে তাঁর সব থেকে বড় প্রতিদ্বন্দ্বিনী নিজের স্ত্রী কল্যাণী।
কোন্নগরে জমি কেনা হয়েছে। কালীকিংকর আর ভট্টচার্য মশাইয়ের তৎপরতায় তিন ঘরের এক-তলা দালান উঠতেও সময় লাগেনি। তিনি আর তাঁর গৃহিণী এসে তাঁদের সংসার পেতে দিয়ে গেছেন।…তারপর দিনে দিনে নিজের স্ত্রীটিকেই আবিষ্কারে ঝোঁক নেশা এমন কি অসহিষ্ণুতা ও কালীকিংকরের। তাঁর সহজ নির্লিপ্ততার আবরণ তিনি ভাঙতে চেয়েছেন। এর সবটুকুই একেবারে সহজাত এ তিনি কিছুতেই ভাবতে পারেন না, বা ভারতে চান না।
এত টাকা যার দখলে তার মন যাচাই করার চেষ্টা অস্বাভাবিক নয় খুব। —এত টাকা তোমার, স্বামীকে খাইয়ে পরিয়ে রাখছ, আমি তো তোমার ক্রীতদাস।
দু‘চোখে সহজ কৌতুক উপছে উঠতে দেখেছেন। —ক্রীত নয় তবে দাস বলতে পারো।
—কি রকম?
—তুমি তো আমার কাছে আসো নি, শিব-ঠাকুরের ইচ্ছে বুঝে আমি নিজে সেধে তোমার কাছে গেছি—তাই ক্রীত আর কি করে হবে। আর, শুধু দাস তুমি নিজে হতে পারো যদি সেই রকম ভাবো—এর সঙ্গে টাকার কোনো সম্পর্ক নেই।
—নিজেকে আমি তোমার দাস ভাবি?
—মাঝে মাঝে এই রকমই মনে হয়, বেশি মনে হয় যখন বীরত্ব ফলাতে চেষ্টা করো। আসলে নিজেই তুমি সহজ হতে পারছ না।
নিজেকে জাহির করার তাড়নায় আর সেই সঙ্গে এক অমোঘ আকর্ষণে আকণ্ঠ ভোগের মধ্যে ডুবতে চেয়েছেন। সেই ভোগ অনেক সময় প্রায় নির্দয় নিষ্ঠুর হয়ে উঠতে চেয়েছে। কারণ, ভোগের দোসরের তখনো কোনো প্রতিবাদের আভাস মাত্র নেই। সর্বংসহার মতো অচঞ্চল, চোখে কৌতুক, ঠোঁটে হাসি। প্রত্যাখ্যানের অসহিষ্ণুতা নেই। আবার দিনের পর দিন এই ভোগ-পর্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েও দেখেছেন। তখনো কোনো আহ্বান নেই।
…এক এক সময় মনে হতো, সত্যি তিনি এক রমণীর দাস হয়ে পড়ছেন। এই রমণী তাঁর স্নায়ু সত্তা সব গ্রাস করে বসে আছে। বন্ধনের এই শেকল তাঁকে ছিড়তে হবে। জীবনটাকে তিনি এই মোহনায় টেনে এনেছেন এমন পরিণতির জন্য নয়। তখনই বিচ্ছিন্ন হতে চেয়েছেন। প্রথমে তিন-চার দিন, তারপর এক সপ্তাহ, তারপর এক দেড় তিন চার মাসের জন্যও উধাও হয়েছেন।…আবার এক বিচিত্র তৃষ্ণা তাঁকে ঘরের দিকে টেনেছে। তৃষ্ণাই শুধু নয়, সেই সঙ্গে একটা শূন্যতাবোধও। প্রতিবারই আশা করেছেন, ফিরে এসে স্ত্রীর দুশ্চিন্তাকাতর ম্লান মুখ দেখবেন। কিন্তু তার বিপরীত। হাসিমুখের টিপ্পনী শুনতে হয়েছে, অবধূতজীর ধৈর্য ফুরোলো? মনের এই অবস্থায় একটা ভাঙচুরের নেশায় পেয়ে বসত কালীকিংকরকে। রক্তমাংসের এই রমণীর দেহই ভেঙে-চুরে রহস্য উন্মোচনের লক্ষ্য। তখনো প্রত্যাখ্যান নেই, বিরক্তি নেই। টানা বিরতির পরে আহ্বানও নেই। শেষে হাল ছেড়ে জিগ্যেস না করে পারেননি, আচ্ছা এতদিন আমি ছিলাম না—তোমার ভাবনা হয়নি?
দু‘চোখে কৌতুক উপছে উঠতে দেখেছেন। জবাবটুকুও তেমনি সরস।— ভাবনা না হলে তুমি ফিরে এলে কি করে—ভাবনার টান পড়তেই তো এসে হাজির হলে।
একটু বাদে আবার বলেছে, আচ্ছা, আমার শিবঠাকুরের কাছে চার বছর থেকেও তুমি সহজ হতে পারো না কেন—উনি বলেছিলেন, তুমি আমাকে অনেক ভোগাতে আর জ্বালাতে চেষ্টা করবে, আর ঠিক তাই করতে গিয়ে নিজেই ভুগছ জ্বলছ—সুখে থাকতে তোমাকে এমন ভূতে কিলোয় কেন? বছরের পর বছর কেটে যায়। কিন্তু কালীকিংকরের খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। আপনা থেকেই কি করে ভক্ত জুটছে—জোটে—জানেন না। নিজের কাজ অনুশীলন, তন্ময়তা নিয়ে বেশ কিছুদিন হয়তো বিভোর হয়ে রইলেন। তারপরেই ভিতর থেকে আবার একদিন ছোটার তাড়া। পালানোর তাড়া। কেউ আষ্টে-পৃষ্ঠে বাঁধছে মনে হলেই বন্ধন ছেঁড়ার তাগিদ। পরে অবশ্য ভেবে দেখেছেন এটা নতুন কিছু নয়। ছেলেবেলা থেকেই তাঁর এই স্বভাব। এখন বন্ধনের রকমফের হয়েছে শুধু। এখন স্ত্রীই বন্ধন। সোনার শিকল হলেও শিকলই। মনের একটা দিক এই শিকলে বাঁধা পড়ে আছে মনে হলেই বেরিয়ে পড়েন। এই করে দেশের অনেক জায়গায় আবার অনেক বার করে ঘোরা হয়ে গেল। অর্থের জন্য স্ত্রীর মুখাপেক্ষী হতে হয় না। অর্থের যোগানদার আপনা থেকেই এগিয়ে আসে। কিন্তু তখনো তাঁর মনে হয়নি, ঘটনার আসর সাজানো আছে বলেই, আর সেই আসরে কিছু ভূমিকা আছে বলেই তাঁর টান পড়ে। তিনি ঠাঁই-নাড়া হন। কিন্তু নিজে ভাবেন, বন্ধন-দশা ঘোচানোর তাগিদেই তিনি বেরিয়ে পড়েন।
—শেকল ছিঁড়ে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বেরিয়ে পড়ার শেষ প্রহসন সাত বছর আগের। তখন নানা দিকে তাঁর অনেক ভক্ত, অনেক কদর। কিন্তু ঘরে স্ত্রী যেমন বন্ধন, এ-সবও যেন তেমনিই বন্ধন। কেবলই মনে হতো সব-কিছু ছেড়ে, সব-কিছু থেকে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি যদি কেউ-না কিছু-না বা কারো না গোছের একজন হতে পারতেন, তাহলে নিজেকে পেতেন। কংকালমালী ভৈরব বাবা হয়তো এই পাওয়াই পেয়েছেন, সত্যিকারের সাধন-পথের যাত্রীদেরও হয়তো এই পাওয়াটুকুই লক্ষ্য।
… কারো প্রতি বিন্দুমাত্র অভিমান বা অভিযোগ না রেখেই সেবারে অনির্দিষ্ট কালের জন্য ঘর ছেড়েছিলেন। তিনি কেউ-না হবেন, কিছু না হবেন, কারো-না হবেন।…বিহারে দ্বারভাঙ্গা জেলার কাকুরঘাটির মহাশ্মশানে এক অজানা অবধূত হিসেবে টানা তিন বছর কাটিয়েছিলেন। …তারপর এক ঘটনার ধাক্কায় আবার ছিটকে বেরিয়ে পড়েছেন। ঘরে ফিরে এসেছেন। মনে হয়, তাঁর চোখ খুলেছে! তখনই মনে হয়েছে সেখানকার সাজানো ঘটনায় তাঁর একটা বড় ভূমিকা ছিল বলেই টান পড়েছিল। তারপর থেকেই তাঁর জিজ্ঞাসা, এমন সব ঘটনা কেন ঘটে, কে ঘটায়, কে সাজায়?
…এরপর থেকে স্ত্রীকেও আর তিনি শেকল ভাবেন না। বরং শক্তি ভাবতে চেষ্টা করেন। চার বছরের মধ্যে আর ঘর-ছাড়ার টান অনুভব করেননি।