সেই অজানার খোঁজে ২.৪

পৌষ মাস। দু‘দিন হলো চেপে শীত নেমেছে। সন্ধ্যার পর কি কাজ নিয়ে বসেছিলাম। মনে হচ্ছিল গায়ে লেপ জড়িয়ে বসতে পারলে ভালো হতো। ও-ঘর থেকে হঠাৎ মেয়ের উৎফুল্ল গলা কানে এলো, ও মা, কার্তিকদা যে, খিচুড়ির গন্ধে গন্ধে কোন্নগর থেকে একেবারে কলকাতায়!

কড়া শীতের অজুহাতে রাতের মেনু খিচুড়ি ডিম ভাজা আর ঝাল আলুর দম।

বুঝলাম পেটো কার্তিক এসেছে, কাজ আর এগোবে না। … নিজের ইচ্ছেয় যদি এসে থাকে তো রাগ বা অভিমান করে এসেছে। আর অবধূত যদি পাঠিয়ে থাকেন তাহলে কিছু খবর আছে।

খিচুড়ির নামে কার্তিকের রসনা খুব সিক্ত মনে হলো না। তারও নিরাসক্ত গলা কানে এলো, আজ খিচুড়ি বুঝি, বেশ…সার কোথায়?

—সার একটা দরকারি কাজ নিয়ে বসেছেন, এসেছ যখন তাড়া কি, এক কাপ চা খেয়ে গরম হয়ে নাও—

ওর আসার কারণ না জানা পর্যন্ত আমারই আর কাজে মন বসবে না। উঠে এলাম। কাতিক তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে পায়ের ধুলো নিল। বাধা দিয়ে লাভ নেই। এ-বেলা ও-বেলা দেখা হলেও পায়ের ধুলো নিতে ছাড়বে না। সোজা হতে মুখখানা একটু শুকনো মনে হলো।—কি খবর, রাত করে এই ঠাণ্ডার মধ্যে যে?

—কিছু ভালো লাগছিল না সার, থেকে থেকে আপনার কথা মনে হতে এসে গেলাম…

তক্ষুনি বুঝলাম কিছু ঘটেছে এবং ওর মেজাজপত্র খুব ভালো নয়। জিজ্ঞেস করলাম, জানিয়ে এসেছ না, না জানিয়ে আমাকে আবার ফোন করতে হবে?

পেটো কার্তিক থমকে তাকালো। রাগ বা অভিমান নয়, জবাবের সুর বিষণ্ণ। বলল, জানালেই বা কি না জানালেই বা কি, আমার ওপর নোটিস তো হয়েই গেছে, আমাকে তাড়াবার জন্য দুজনেই এখন এক-কাট্টা… আমার মেয়াদ তো সামনের মাঘ মাস পর্যন্ত।

আমি কেন, মেয়ে চায়ের কথা বলতে যাচ্ছিল সে-ও হতভম্বের মতো দাড়িয়ে গেল। রাগ বা মান অভিমানের থেকেও গভীরতর ব্যাপার কিছু।

—বোসো, কি ব্যাপার খুলে বলো তো, কে তাড়াচ্ছে… তোমার বাবা আর মাতাজী?

—তাঁরা ছাড়া পৃথিবীতে আর কাউকে আমি কেয়ার করি? এই রাইট আর কার? মোড়ায় বসল।

ওর রাগের কথাও এমন যে হাসি এসে যায়।—ওঁরা তোমাকে তাড়াতে চান?

চট করে বুঝছি না বলেই যেন অসহিষ্ণু।—চান মানে—আর চাওয়া-চাওয়ি নেই ( হাত তুলে নিজের গলা জবাই দেখালো )—ফাইন্যাল সেন্টেন্স হয়েই গেছে, দিন-ক্ষণ এলেই আমাকে গলা পেতে দিতে হবে।

এবারে আমি সতর্ক একটু। অবধূত বা তাঁর স্ত্রী কল্যাণী যদি কোনে, কারণে বিরূপ হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, না জেনে না বুঝে আমার প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক হবে না। একটু বিরক্তির সুরে বললাম, ধানাইপানাই না করে কি হয়েছে সোজাসুজি বলো দেখি?

ওর মুখোমুখি খাটের ওপর বসলাম। পেটো কার্তিক একটু থমকে গিয়ে মেয়ের দিকে তাকালো। সাদা অর্থ ধরে নিয়ে মেয়ে বলল, আমি চা করে নিয়ে আসি —

পেটো কার্তিক ঈষৎ আবেগের গলায় বাধা দিয়ে উঠল, না দিদি আপনি যাবেন না, আপনিও থাকুন, আপনিও তো মেয়েই, একটা মেয়ের হয়ে বিচার বিবেচনা করুন। আমার দিকে ফিরল, আর আপনি তো মস্ত লেখক সার, গল্প উপন্যাসে উদার হয়ে কত ছেলে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন ঠিক নেই —আপনিই বলুন আমি কি একটা বিয়ে করার মতো ছেলে? কোনো মেয়ে নিজের ভিতরের ইচ্ছেয় আমাকে বিয়ে করতে চাইতে পারে? আমার এই পোড়া দাগের মুখের দিকে এই জখম আঙুলগুলোর দিকে ভালো করে দেখে নিয়ে বলুন।

আমি হাঁ খানিক। মেয়ের চোখ বড় বড়। আত্মস্থ হয়ে তাড়াতাড়ি দরজার কাছে এগিয়ে চেঁচিয়ে বলল, মা কার্তিকদা এসেছে, খিচুড়ির ভাগ রেখো, আর আমাদের জন্যে তিন পেয়ালা চা পাঠাও! প্রায় ছুটে ফিরে এসে ধুপ করে আমার পাশে বসল।—তোমার বিয়ে? এই মাঘে?

সমবেদনার বদলে মেয়ের এত আগ্রহ দেখে কার্তিকের আরো আহত মুখ। ইতিমধ্যে আমি সজাগ একটু। চকিতে কিছু মনে পড়েছে। … কালীপুজোর বিকেলে অবধূত বলেছিলেন, ছেলে বা মেয়ে দুজনের একজন দেখতে কুৎসিত হলেও মনের ছোয়া পেলে তাদের মধ্যে র‍্যাপর ভালো হয়। বলেছিলেন, এই মেয়েকে নিয়ে এখন আমার সামনে সেই পরীক্ষা। মেয়ের রং চাপা কিন্তু কুৎসিত আদৌ নয়। অতএব কুৎসিত বলতে ছেলে। মনে আছে সেই কালীপুজোর রাতে যারা উপস্থিত ছিল তাদের সকলকেই এই কারণেই আমি লক্ষ্য করেছিলাম। কিন্তু তেমন কুৎসিত মুখ একটিও দেখিনি।

…না পেটো কার্তিকের কথা আমার মনেই আসে নি। না আসার কারণ কুৎসিত সে মোটেই নয় বা ছিল না। তবু দেখলে গোড়ায় গোড়ায় ধাক্কা লাগত। সকলেরই লাগবে। বোমাবাজীর অঘটনের ফলে বাঁ চোখের পাশ ঘেঁষে গালে মুখে কপালে পুরনো পোড়া দাগ, বাঁ হাতের দুটো আঙুল আধখানা করে নেই, দু‘হাতেরই অনেকটা জায়গা জুড়ে পোড়া দাগ। কিন্তু দেখে দেখে এমন সয়ে গেছে যে আর ধাক্কা লাগে না বলেই চোখও পীড়িত হয় না।

রাগত মুখে পেটো কার্তিক মেয়েকে বলছে, দেখে মনে হচ্ছে পারলে এক্ষুনি নেমন্তন্ন খেতে ছোটেন। সরোষে অন্য দিকে মুখ ফেরালো। আমি বললাম, দেখছিস তো ওর মেজাজ খারাপ, রাগাচ্ছিস কেন? গলার স্বর মোলায়েম করে আলতো সুরে জিজ্ঞেস করলাম, সুষমার সঙ্গে বিয়ে? এমন করে ঘুরে তাকালো আমার দিকে যার সাদা অর্থ, এটট্যু ক্ৰটে!! মুখেও তাই বলল, আপনিও এই যড়যন্ত্রের মধ্যে… আর আমি কিনা মন হাল্কা করতে আপনার কাছেই এলাম!

মেয়েও বলে উঠল, অ্যা বাবা তুমি জানতে আর আমাদের কিছুই বলো নি? পেটো কার্তিক চুপচাপ মোড়া ছেড়ে উঠে দাড়ালো। গলা দিয়ে ক্ষুব্ধ একটা শব্দ বেরুলো, চলি—

মেয়ে তার একটা হাত ধরে ফেলল, এই কার্তিকদা বোসো বলছি!

আমিও বললাম, বোসো —আমি সত্যিই কিছু জানতাম না, কিন্তু সেই কালীপুজোর দিন সুষমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে তোমার বাবা এমন একটু ইঙ্গিত করেছিলেন যে আমার বোঝা উচিত ছিল। এখন তুমি বিয়ের কথা বলতেই সে-কথা আমার মনে পড়ে গেল, আর তাইতে মনে হলো মেয়েটি সুষমাই হবে।

কার্তিক আবার গোজ হয়ে মোড়ায় বসতে স্ত্রী নিজেই চায়ের ট্রে হাতে ঘরে ঢুকলেন। সঙ্গে সঙ্গে মেয়ে লাফিয়ে বলে উঠল, মা, কার্তিকদার বিয়ে —সুষমার সঙ্গে!

থতমত খাবার ফলে পেয়ালার চা ট্রেতে পড়ল একটু। ওমনি কার্তিক বলে উঠল, দেখলেন? সত্যি যা দেখলেন? শুনে মাসিমার হাত থেকে চায়ের ট্রে পড়ে যাবার দাখিল!

স্ত্রী সামাল দিতে চেষ্টা করলেন।—না না ওর চেঁচানির চোটে আমি ধড়ফড় করে উঠেছিলাম—খুব ভালো কথা তো, কবে ঠিক হলো—কোন্ মাসে বিয়ে?

এই মাঘেই! আবার উঠে দাড়িয়ে কার্তিক ঠাস করে জবাবটা দিল। হাত বাড়িয়ে ট্রে থেকে একটা পেয়ালা তুলে নিয়ে আবার বসল।—আমি চেষ্টা করব এমন আঙুল কাটা গাল-কপাল পোড়া অলক্ষুণের বিয়ে দেখতে বাবা যেন কাউকে না ডাকেন!

—ওমা কার্তিক দেখি রেগে আছে! স্ত্রী সাত পাঁচ না ভেবেই বলে বসলেন, তা আপত্তি থাকলে তোমার বাবাকে বলো নি কেন?

কাতিক খেঁকিয়ে উঠল, আমার বলার কোনো দাম আছে? আমি হুকুমের দাস না? আচ্ছা, আপনিই বলুন মাসিমা, এই মূর্তিকে কোনো মেয়ে মন থেকে বিয়ে করতে চাইতে পারে?

মাসিমা কি বলবেন ভেবে পেলেন না। চোখের ইশারায় তাঁকে নিরস্ত করে আমি বললাম, সুষমা তো বাচ্চা মেয়ে নয়, না চাইলে সে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে কেন?

—রাজি হচ্ছে বাবা আর মাতাজীর কথায়, তাঁরা তার চোখে দেব-দেবী! —এত দিন তোমার চোখেও তো তাঁরা তাই ছিলেন।

রাগত মুখে কার্তিক শূন্য ট্রে-তে ঠক করে পেয়ালাটা রাখল।

মেয়ে বলল, তুমি সরাসরি সুষমার সঙ্গেই কথা বলে নিলে না কেন কাতিকদা?

—বলতে আর বোঝাতে বাকি রেখেছি?

—অ্যা? সুষমা কি বলে? আমরাও উৎসুক।

—কি আবার বলবে? একবার ব্রেন ওয়াশিং হয়ে গেলে নিজস্ব আর কিছু বলার থাকে!

মেয়ে আরো উৎসুক, তার আরো জুলুম, তবু কি বলল শুনি না?

—বলল, বাবা মায়ের দয়ায় সে আমার ভিতরের সুন্দর চেহারাখানা দেখতে পেয়েছে—কোনো মানে হয়!

আমারা হাসি চাপতে চেষ্টা করছি। কিন্তু মেয়ে ফুলে ফুলে হাসছে। শেষে হাসি সামলে বলে উঠল, ঠিক বলেছে কার্তিকদা, আর একটুও না ভেবে ঝুলে পড়!

কার্তিকের মুখ দেখে মনে হবে এই সংকটে সে সব থেকে বড় ভুলটা করেছে আমার এখানে এসে। স্ত্রী ওদিকের ব্যবস্থা দেখার অছিলায় সরে গেলেন। একটু বাদে আমি বললাম, একটা গল্প শুনবে কার্তিক? ও বোকার মতো আমার দিকে তাকালো।

—রবি ঠাকুরের নাম শুনেছ?

—বি. এ. ফেল, নামটাও শুনব না!

—তাঁর লেখা। শোনো, সৌরসেন নামে স্বর্গের এক গন্ধর্ব ছিল, সবার সেরা মৃদঙ্গ বাজিয়ে। বাজনার তালে তালে উর্বশী নাচত, আর দেব-দেবীরা বাহবা দিত। একদিন প্রেয়সী মধুশ্রীর কারণে সৌরসেনের মন উতলা ছিল, তার বাজনার তাল কেটে গেল, উর্বশীর নাচে বাধা পড়ল, দেব-দেবীরা রেগে গেল, তাদের অভিশাপে কুৎসিত বিকলাঙ্গ হয়ে সৌরসেন গান্ধার রাজার ছেলে অরুণেশ্বর হয়ে জন্মালো। মধুশ্রী শোকে অধীর হয়ে মর্ত্যলোকে আসতে চাইলে৷। ইন্দ্রের দয়ায় সে মদ্ররাজার ঘরে মেয়ে হয়ে জন্মালো। মর্ত্যে কালে দিনে বিকলাঙ্গ গান্ধার রাজ অরুণেশ্বর মদ্ররাজ কন্যা কমলিকার ছবি দেখে মোহিত। সে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালো। কিন্তু রাজাকে রাজ্যের লোকই চেনে না, সে থাকে সকলের চোখের আড়ালে। অথচ মস্ত রাজা আর কলাবিশারদ হিসেবে তার নাম ডাক! মদ্ররাজ খুশি হয়েই মেয়ে কমলিকার সঙ্গে তার বিয়ে দিতে রাজি হন। রাজার প্রতিনিধি হিসেবে কমলিকাকে বিয়ে করতে গেল তার বীণা, যে বীণা তিনি নিজের কোলে রেখে বাজান।

কমলিকা স্বামীর ঘরে এসে খুব খুশি। কিন্তু রাজ স্বামীকে কখনো চোখে দেখে না। রাতের অন্ধকার ঘরে তাদের মিলন হয়। রাজা বীণা বাজায় সেই বাজনা শুনে রানী কমলিকার বুক মন ভরে ওঠে। কবেকার কোন্ হারানো নাচ মনে আসে, রাজা বাজায় রানী নাচে। দুজনে দুজনের ভালোবাসায় বিভোর। কিন্তু রানীর মনে একটা বিষম দুঃখ। এমন প্রিয় রাজস্বামীকে সে চোখে দেখতে পায় না, দিনের পর দিন তার দু‘চোখ বঞ্চিত। রোজ তাগিদ দেয় জুলুম করে, তার রাজাকে সে দেখবেই। রাজা নানাভাবে তাকে বোঝায়, ভোলায়। একদিন রানী বায়না ধরল, এই রাত পোহালে তোমাকে দেখবই।

…দেখল। দেখে শিউরে উঠল। কি কুৎসিত, কি কদাকার। দু‘হাতে মুখ ঢেকে ছুটে বনে পালিয়ে গেল সে। এই নিষ্ঠুর প্রবঞ্চনা তার অসহ্য। বনের নির্জনে রাজার মৃগয়া ঘরে সে আশ্রয় নিল।

কিন্তু রোজ রাতে রাজার বীণা বাজে। সেই বাজনা দিনে দিনে বনের ঘরের কাছে আসে। বাজনার ওই আকুতি মূর্ছ না শুনে কমলিকা পাগল হয়ে ওঠে। ছুটে যেতে চায়! কিন্তু চোখ বাধা দেয়। ওই কুৎসিতকে সে দেখবে কি করে?

কিন্তু ওই বাজনার আকুল ডাক শুনে শুনে কমলিকা একদিন আর সহা করতে পারল না। প্রদীপ হাতে উঠে দাড়ালো। নিজের মনে বলল, আমি যাব, এখন আর আমার চোখ দুটোকে আমি ভর করি না। কমলিকা বেরিয়ে এলো। জন্ম জন্মান্তরের সেই নাচ আর সুরের মূর্ছ না তার বুকের তলায় বাজছে। কমলিকা রাজার কাছে এলো। বাজনা থামল। প্রদীপের আলো তুলে কমলিকা রাজার মুখ দেখল। বলে উঠল, প্রভু আমার, প্রিয় আমার, এ কি সুন্দর রূপ তোমার!

মেয়ের আদ্যোপান্ত জানা, সে সকৌতুকে দ্বিতীয় শ্রোতার মুখখানা দেখছিল। পেটো কার্তিক স্থান-কাল ভুলে হাঁ করে আমার দিকে চেয়ে আছে। বিস্ময়-বিস্ফারিত প্রশ্ন, বিকলাঙ্গ রাজার চেহারা আবার ভালো হয়ে গেল?

জবাবে একটু নিজস্ব ব্যঞ্জনা মেশালাম। বললাম, এ কি ম্যাজিক নাকি যেতক্ষুনি ভালো হয়ে যাবে! আসলে কমলিকার পূর্ব স্মৃতি সব মনে পড়ে গেছে, সেই চোখ দিয়ে রাজার ভিতরের আসল চেহারাখানা দেখছে।

যথা সময়ে বেশ আনন্দ করেই খিচুড়ি ভোজনে বসা হলো। পেটো কার্তিকের মেজাজ এখন দস্তুর মতো ভালো। মেয়ের ঠাট্টা ঠিসারায় রাগ করছে না।

শোবার ঘরে ফোন বেজে উঠল। স্ত্রী বললেন উঠতে হবে না, তোমার হলে বলে দিচ্ছি খেতে বসেছ। কিন্তু কি মনে হতে আমিই উঠলাম৷ যা মনে হয়েছিল তাই। ও-দিক থেকে চেনা পুষ্ট গলা।—-কার্তিক আপনার ওখানে? —হ্যাঁ। যে মন-মেজাজ নিয়ে এসেছিল, এখন ঠাণ্ডা হয়ে যেতে বসেছে। অবধূতের প্রশ্ন, কি মন-মেজাজ নিয়ে গেছল?

সংক্ষেপে বললাম।

—খেতে বসলেও আপনি গিয়ে ওর কানটা আচ্ছা করে মলে দিন, কাপুরুষ কোথাকার, এতদিন ছোঁক ছোঁক করে বেড়াচ্ছিল, যেই ঠিক হয়েছে এখন ঘাবড়েছে। ও ধরে নিয়েছিল এক-তরফ। ভালোবাসার নৌকায় ভেসে বেড়াবে।

—বলেন কি ?

—ঠিকই বলি। ব্যাপারটা প্রথমে ওর মাতাজীর চোখে ধরা পড়েছে। … মেয়েটা আড়াই মাস ধরে আছে এখানে, দেখা গেল কাতিক সহজে আর বাড়ি ছেড়ে বেরোয় না, তার আগে সুষমা যখন শ্রীরামপুরে মাসির বাড়িতে ছিল আর চিকিৎসা চলছিল, কোনো কাজে কল্যাণী ওকে শ্রীরামপুরে পাঠালে কি খুশি। প্রভা ঘোষকে বলেছে, পারলে বাবা আর মাতাজীর কাছে ওকে একদিন অন্তত নিয়ে যাবেন, আপনি না পারেন আমি এসে নিয়ে যাব। দুই একবার এনেছে, পৌছে দিয়েছে। আমাকে জিজ্ঞেস করতে সাহস পায় নি, ওর মাতাজীকে বলেছে, বাবাকে তাগিদ দিয়ে ওকে তাড়াতাড়ি সারিয়ে তুলুন মা, মা-বাপ মরা দুঃখী মেয়ে, এ-রকম দেখলে খুব খারাপ লাগে। কল্যাণী কি ঠাট্টা করতে রাগ করে বলেছে, ছেলে-বেলায় বাপ-মা দুই-ই খোয়ানো কি ব্যাপার জানলে বুঝতেন। …এখানে এনে রাখার পর আমাদের আড়ালে ও-ই সুষমার গার্জেনগিরি করত, যখন যা দরকার না চাইতে এনে দিয়েছে, ইদানীং আবার মান-অভিমান হম্বি-তম্বিও করত। ব্যাপার বুঝে কল্যাণীই আমাকে বলেছে, দুটোই তো আমাদের এখন, দ্যাখো যদি হয়ে যায় তো হয়ে যাক। কার্তিকের মন আগেই বোঝা গেছল, মেয়েটার মন বুঝে তবে আমি এগিয়েছি। দায়িত্ব নেবার ভয়ে হারামজাদার এখন স্নায়ুর ধকল চলেছে। —আপনি ফোন করেছেন ‘ওকে বলব?

—এক্ষুনি বলবেন না। আগে ওকে বলুন, ওর বিয়ে করতে খুব আপত্তি থাকলে আমাকে বলে আপনি এখনো এ বিয়ে নাকচ করে দিতে পারেন, দেখুন ও কি বলে।

ফোন ছেড়ে বিরক্ত মুখ করে আবার খেতে বসলাম। নিজের মনেই বললাম, পাবলিশার তাগিদ দেবার আর সময় পায় না—

স্ত্রীর অনুযোগ, খাবার ফেলে সাত-তাড়াতাড়ি উঠে যাবার কি দরকার ছিল। খেতে খেতে একটু বাদে বললাম, কার্তিকের মন-মেজাজ ঠাণ্ডা হয়েছে তো না হয় নি?

কার্তিক বলে উঠল, আবার মনে করিয়ে দিয়ে দিলেন সার খাওয়াটা মাটি করে—

শোনো কার্তিক, মুখে তোমাকে যা-ই বলি, মনে মনে আমি সেই থেকেই ব্যাপারটা ভাবছি…বিয়ে তো একটা ছেলেখেলা ব্যাপার নয়, অন্যের ইচ্ছেয় বা অনুরোধে বিয়ের ঢেঁকি গেলা যায় না, তোমার বাবা চট্‌ করে আমার কথা উড়িয়ে দেন না…আমি গিয়ে তাঁকে বুঝিয়ে বললে হয়তো আর পীড়াপীড়ি করবেন না।

পেটো কার্তিকের শুকনো মুখ। ঢোঁক গিলে জবাব দিল, কিছু লাভ হবে না, ওঁরা দুজনে মিলে ঠিক করেই ফেলেছেন—

—কিন্তু তোমার এত আপত্তি সেটা তো তিনি বোঝেন নি, বিয়ে হয়ে গেলে আর তো সেটা ফেরনো যাবে না—একবার চেষ্টা করে দেখতে অসুবিধে কি, কাল তোমার সঙ্গেই চলে যাব ভাবছি।

পেটোর মুখের দিকে চেয়ে হাসি চাপা দায়। বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, থাকগে সার, আমার অদৃষ্টে যা আছে তাই হবে—তাই বাবা মায়ের আশীর্বাদ বলে মাথা পেতে নেব।

মেয়ে জোর দিয়ে বলে উঠল, এটাই খুব ভালো কথা।

আমার কথা তার বিরক্তির কারণ হচ্ছে বুঝতে পারছি। দুই এক গরাস জঠরে চালান করে এবারে ধীরে-সুস্থে বললাম, একটু আগে ওই ফোন অবধূত করেছিলেন, তিনি বললেন, এক্ষুনি তোমার কান ধরে আচ্ছা করে মলে দিতে…এই বিয়েতে কেন তাঁরা এগিয়েছেন তা-ও বলেছেন।

পেটো কার্তিকের ছ’চোখ বিস্ফারিত খানিক। তারপর হড়বড় করে বলল, মাসিমা আর খিচুড়ি খেয়ে কাজ নেই, উঠি আমি, এক্ষুনি কোন্নগর রওনা হব—

স্ত্রীর ভেবাচাকা খাওয়া মুখ।—কি হলো, এ-সব বলে ছেলেটার তুমি খাওয়া নষ্ট করছ কেন?

বললাম ওর পাতে ডবল খিচুড়ি দাও। এই বিয়ে কেন হচ্ছে সেটা শুনেই এ-রকম বলছি, কার্তিকবাবু একতরফা প্রেমে হাবু-ডুবু খাচ্ছিল, সেটা ধরতে আর বুঝতে পেরেই ওর বাবা আর মাতাজী এই ব্যবস্থা করেছেন, এখন দায়িত্ব ঘাড়ে চাপছে বলে ঘাবড়াচ্ছে!

পেটো কার্তিক লজ্জায় অধোবদন। মেয়ে কোনো রকমে হাসি সামলে দাবড়ানি দিয়ে উঠল, কার্তিকদা খেতে শুরু করো বলছি নইলে মা-কে বলব তোমাকে খাইয়ে দিতে-সুষমার প্রেমে পড়ে তোমার হাবুডুবু খাওয়ার রাইট আছে আবার এখন ঘাবড়ে যাওয়ার রাইটও আছে!

বলতে বলতে নিজেই হেসে অস্থির।

খাওয়া-দাওয়া চুকে যাবার পর কার্তিক এক ফাঁকে বলল, আপনার সঙ্গে নিরিবিলিতে কয়েকটা কথা ছিল সার…

ওকে নিয়ে লেখার ঘরে এসে বসলাম। —বলো…

একটু ইতস্তত করে পেটো কার্তিক বলল, আমি একটু নার্ভাস হয়েছি সত্যি কথা, কিন্তু আরো বেশি নার্ভাস হয়েছি অন্য কারণে বাবা আর মাতাজীর মতি-গতি ঠিক বুঝতে পারছি না—

এরপর যেটুকু জানান দিল তাতে আমারও একটু চিন্তার কারণ ঘটল।… বিয়ের পর ওদের কোন্নগরে বাবার বাড়িতে থাকতে দেওয়া হবে না, দুরে শহরে ওদের জন্য বাড়ি দেখা হচ্ছে। মাতাজী ওদের জন্য একটু জমিও দেখতে বলেছেন, নিজের খরচায় দোতলা একটা বাড়িও তুলে দেবেন, দোতলায় ওরা থাকবে, এক-তলায় ভাড়াটে বসবে—তাতে বাড়ি রক্ষার খরচ চলে যাবে।…শহরেই একটা দোকানঘর দেখা হচ্ছে, সেখানে কার্তিককে কবিরাজি দোকান দিয়ে বসানো হবে, যে বুড়ো কবিরাজ এখন বাড়িতে ওষুধ বানায় সে আর তার ছেলে কবিরাজ হিসেবে দোকানে বসবে—দোকানের আট আনার মালিক হবে কার্তিক, ছ’আনার মালিক হবে বুড়ো কবিরাজ আর ছেলে, বাকি ছ’আনার মালিক হবে যোগানদার হারু। কার্তিকের ধারণা, বাবা নিজের কবিরাজি চিকিৎসা আস্তে আস্তে তুলে দেবেন। ওকে বলেছেন, আমি থাকতে থাকতে তোদের দোকান যাতে মোটামুটি দাড়িয়ে যায় সে-ব্যবস্থা আমিই করে যাব।

এই শোনা পর্যন্ত কার্তিকের ত্রাস। বাবা আর মাতাজী একটা কিছু মতলব আঁটছেন.. হয়তো এখান থেকে তাঁরা অন্য কোথাও চলে যাবেন। খানিক চুপ করে থেকে বললাম, তাঁরা এখানে না থাকলে তাঁদের বাড়িই তো তোমাদের হাতে—তাহলে আর তোমাদের জন্য আলাদা বাড়ি হচ্ছে কেন?

পেটো জবাব দিল, মা অনেক বছর আগেই বলেছিলেন, ও-বাড়ি থাকবে না। ওপার শুকিয়ে গঙ্গা এ-পারে সরে আসছে, বর্ষায় বড় বান এলে এখন উঠোন ছাড়িয়ে দাওয়ার কাছাকাছি জল উঠে আসে ফি বছর বানের জলের হামলা বাড়ছে—চারদিক কেমন নোনা ধরে গেছে দেখেন নি? গঙ্গার কি কাজ হবে বলে এ-দিকটা বোধহয় রিকুইজিশনেও চলে যাবে। খানিক চুপ করে থেকে কার্তিক আরো একটা ভয়ের আভাস দিল।— আরো একটা কথা আপনাকে বলছি সার, আপনি যেন কক্ষনো বাবাকে বলবেন না, তাহলে তিনি আর আমার মুখ দেখবেন না।… বাবার বোধহয় সামনেই কোনো বিপদ ওঁত পেতে আছে। আপনাকে একদিন বলেছিলাম না খুব উতলা হয়ে দু‘বার বাবাকে শ্মশানে ছোটাছুটি করতে দেখেছি, একবার এই রতনলাল সারাওগিকে অপারেশনের হুকুম দেবার আগে। আর একবার এর চারগুণ বেশি উতলা দেখেছিলাম সেই সাতাত্তর সালের গোড়ায়—যে-বছর আপনাদের সঙ্গে পুজোর সময় আমরা হরিদ্বার হয়ে দেরাদুন যাই। খুব স্পষ্ট করে সব জানি না, কারণ বাবার কোন্ আত্মীয়-স্বজনরা আসত তখন, বাড়িতে ছেলে-পুলে হবে এমন একটি মেয়েছেলেও মাঝে মাঝে এসে থাকত—তখন আমি কাছেই অক্ষয়বাবুর বাড়িতে থাকতাম। যতদূর জানি, সেই এক আত্মীয়কে বাবা জেলে পাঠিয়েছিলেন, তার বোধহয় খালাস পেতে খুব বেশি দেরি নেই, সামনের বছর গোড়ার দিকে হয়তো ছাড়া পাবে—সেই লোক বলে গেছল জেল থেকে ফিরে তার প্রথম কাজ হবে বাবাকে খুন করা।

চমকে উঠলাম। গায়ে কাঁটা-কাঁটা দিয়ে উঠছে।

কার্তিক বলল, বাবার সত্যি ক্ষতি করতে পারে এমন লোক জন্মেছে বলে আমি মনে করি না, কিন্তু বলুন তো সার, ভয় হয় না? কোথায় বাবার পাশে থাকব, দরকার হলে তাঁর জন্য এই ছাইয়ের প্রাণ দেব, না বিয়ে দিয়ে তিনি আমাকে বাড়ি থেকেই সরিয়ে দিচ্ছেন!

…সমস্তটা রাত ভালো ঘুম হলো না। থেকে থেকে এ-বারের কালীপুজোর রাতটা মনে পড়ছে। না, মদের নেশায় অবধূত কোনো বাজে কথা বলার লোক নন। তাঁর সে-দিনের প্রতিটি কথা আমার কানে বাজছে। আমার প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, বার বার একটা কথা কেবল মনে আসছে—এ-সব কেন, আমি কেন, আপনি কেন, এইরকম—

…আমি রসিকতা করেছিলাম, শুনেছি কর্মের শেষে এ-সব প্রশ্ন মনে আসে, আপনার এখনই মনে আসছে এটা ভালো কথা নয়।

—বিমনার মতো তিনি জবাব দিয়েছিলেন, তার কিছু বাকি আছে, অন্তত সামনের বছরের গোড়ার দিক পর্যন্ত, দেখা যাক—আমি উদ্‌গ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করেছি, কিসের কিছু বাকি আছে — সামনের বছরের গোড়ার দিক পর্যন্ত কি?

আত্মস্থ হয়ে হেসে উঠে বলেছিলেন, সামনের বছর গোড়ার দিকে আমার একটি কর্মের গাছে ফল ধরবে, সেটা বিষ ফল কি অমৃত-ফল দেখা যাক। সেই টানে বাঁধা পড়ে আছি, তারপর আর বোধহয় কল্যাণীকে আটকানো যাবে না।

…পরদিন ও-কথার অর্থ কি জিজ্ঞেস করতে হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন, বলেছেন, কাল রাতে মাল কতটা পেটে পড়েছে সে-খেয়াল আছে আপনার?

…পেটো কার্তিকও সেই সামনের বছরের গোড়ার দিকের কথাই বলল, সে-সময় জেল থেকে খালাস পেয়ে কার নাকি প্রথম কাজ হবে তার বাবাকে খুন করা।

…অবধূত এমন কি কর্ম করেছিলেন, যে কর্মের গাছে বিষ ফল ধরবে কি অমৃত-ফল তিনি জানেন না? জানা হয়ে গেলে পরে কল্যাণীকে আর আটকানো যাবে না মানেই বা কি?

বিনিদ্র রাতে হঠাৎ কেন যেন অবধূতর ভক্ত হরিদ্বারের পুরুষোত্তম ত্রিপাঠীর কমনীয় মুখখানা মনে পড়ে গেল। নিঃস্ব অবস্থা থেকে মানবিক দয়ায় অবধূত যাঁকে বহু লক্ষপতির জীবনে ফিরিয়েছেন। আমার জন্য তাঁকে অতিমাত্রায় ব্যস্ত দেখে, আর মাত্র খাওয়া থাকা বাবদ এক-টাকা মূল্য ধরে দেবার কথা বলতে আমি জোর দিয়েই আমার সম্পর্কে তাঁর ধারণা বদলাতে চেষ্টা করেছিলাম। বলেছিলাম, আপনি একটা বড় ভুল করছেন, অবধূতজীর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হাওড়া স্টেশন থেকে গাড়ি ছাড়ার পরে—তার আগে কেউ কাউকে চোখেও দেখিনি।

…ভক্ত পুরুষোত্তম ত্রিপাঠীর সাদা-সাপটা জবাব, আপনাকে দেখার জন্য মহারাজ দেরাদুন থেকে নেমে আসতে পারেন বলেছেন… আপনাকে এখানে তাঁর নিজের ঘর ছেড়ে দিতে বলেছেন—আপনি কি লোক বা কতদিনের আলাপ আমার আর জানার দরকার নেই—আপনার সঙ্গে তাঁর কত জন্ম-জন্মান্তরের সম্পর্ক আপনি জানছেন কি করে?

এই লোকের মনে পড়তে বিনিদ্র শয্যায় আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।…. সঙ্গে মাত্র দু‘বছরের আলাপ আমার। কিন্তু তাঁর বিপদের বা তাঁকে হারানোর ভয়ে আমার চোখে ঘুম নেই। মাত্র দু‘বছরের আলাপে এ-রকম কি হওয়া সম্ভব? জন্ম-জন্মান্তরের আত্মিক বন্ধন হলে বরং এটা স্বাভাবিক ভাবা যায়।

পেটো কার্তিকের বিয়েতে ঘটা দেখালেন বটে কালীকিংকর অবধূত। কোন্নগরে নয়, কলকাতায় সাতদিনের জন্য মস্ত একটা বাড়ি ভাড়া করে বিয়ে। নইলে বাইরের অভ্যাগতদের আসা এবং থাকার অসুবিধে। যে বাড়িতে বিয়ে সেই বাড়িতেই বউ-ভাত। আর দূর দূরান্তরের অতিথিদের সেই বাড়িতেই থাকা আমাকে আগেই হেসে বলেছিলেন, কার্তিকের বরাবরই খুব দুঃখ ছিল ওকে কেউ কিছু দেয় না, সবই বাবাকে দেয়, এবারে তোর পাওয়ার বরাতখানা দেখিয়ে দিচ্ছি।

…বেনারসের সেই মস্ত বড়লোক পার্টির তিন ভক্ত সস্ত্রীক এসেছেন। স্টেশনে মাছ নিয়ে এসে যাঁরা মাছ খাইয়ে একদিনেই অরুচি ধরিয়ে দিয়েছিলেন, লক্ষ্ণৌয়ের পোলাউ-মাংসের পার্টি এসেছেন। হরিদ্বারের তিন-তিনটে হোটেলের মালিক পুরুষোত্তম ত্রিপাঠীর সঙ্গে আবার দেখা হলো। বাবার চিঠি পেয়ে তিনিও সপরিবারে বিয়েতে এসেছেন। দেরাদুন বা মুসৌরী আর অন্যান্য জায়গার ভক্তদের আমি চিনি না, তারাও সকলেই এসেছেন এবং অবধূত তাঁদের সঙ্গেও আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। অবাক হয়ে দেখলাম ফিরে পাওয়া সন্তানকে আর অবধূতের দেওয়া তিন পালিত ছেলে-মেয়েকে নিয়ে দ্বারভাঙার কাঁকুরঘাটির পার্বতী লাজবন্তী আর অনন্তরামও নেমন্তন্ন রক্ষা করতে এসেছে।

মোট নিমন্ত্রিতের সংখ্যা এক হাজারের কম নয়।

আমাদের তো বিয়ের আগের দিন থেকে বউ-ভাতের পরদিন পর্যন্ত নেমন্তন্ন। আমাকে অবধূত আগে থাকতেই বলে রেখেছিলেন, কলকাতার সব ব্যবস্থা-পত্রের কর্মকর্তা কিন্তু আপনি, সরে থাকলে চলবে না। সরে থাকি নি। এত ভক্ত সমাগম দেখে আমার একবারও মনে হয় নি পেটো কার্তিককে কেবল পাওয়ানোর উদ্দেশ্য নিয়েই অবধূত তাঁর ভক্তদের এখানে ডেকেছেন বা সমবেত করেছেন। কেন যেন একটা কাল্পনিক দৃশ্য মনে আসতে বার বার আমার চোখের কোণ শিরশির করে উঠেছে। মানব-পুত্র যীশুর ‘দি লাস্ট সাপার’। নিজের দিন শেষ বুঝে ক্রুশ-বিদ্ধ হবার আগে ভক্ত সমাবেশে যীশুর শেষ আহার—নিজে হাতে ভক্তদের তিনি সযত্নে সেবা করছেন, পরিচর্যা করছেন, খাওয়াচ্ছেন। …লিওনারডো দ্য ভিন্‌চির আঁকা ‘দি লাস্ট সাপার’-এর সেই বিশাল তৈল-চিত্রের প্রতিলিপি কলকাতার কোনো এক রাজপ্রাসাদে আমি দেখেছিলাম। ভক্তদের প্রতি অবধূতের আদর যত্ন আর অনাবিল স্নেহের আচরণ দেখে ভিতরটা বার বার ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছিল। মনে হচ্ছিল সকলের এই শেষ মিলন।

—বাবারে বাবা, কোনো বিয়েতে এমন পাওয়া আর জীবনে দেখি নি, তার বাবার দৌলতে পাওয়ার ভাগ্য বটে কার্তিকদা!

উচ্ছ্বাস আমার মেয়ের।

শুনলাম আসল হীরের সেট দিয়েছেন রতনলাল সারাওগি আর তাঁর দুই ছেলে দিয়েছেন আসল মুক্তোর সেট। কাঁকুরগাছির পার্বতী প্রসাদ দিয়েছে দামী জড়োয়ার সেট। বেনারসের পার্টি দিয়েছেন প্রত্যেকে একখানা করে দামী বেনারসী শাড়ির সঙ্গে বেশ ভারী ওজনের একটা করে গয়না। হরিদ্বারের পুরুষোত্তম ত্রিপাঠীর দেওয়া হারের ওজন কম করে নাকি পাঁচ ভরি হবে। সব মিলিয়ে পাওয়ার আর শেষ নেই। সব মিলিয়ে সোনার গয়না পেয়েছে ষাট ভরির ওপর। খুব দামী মাঝারি আর সাধারণ মিলিয়ে শাড়ির সংখ্যা একশো সাতানব্বই। নগদ পেয়েছে তেরো হাজার ন’শ। এ-ছাড়া আর যা-সব পেয়েছে একটা ঘরে ধরে না। ডাইনিং টেবিল ডিনার সেট পর্যন্ত।

—কার্তিককে খুব খুশি দেখলি?

একটু ভেবে মেয়ে মাথা নাড়ল।—তা কিন্তু দেখলাম না বাবা। বিয়ের পরদিন একফাকে আমাকে বলেছিল, আমার কিছু ভালো লাগছে না দিদি, বাবার কথা সারকে যা বলে এসেছিলাম সার যেন তা না ভোলেন, আপনি সর্বদা তাঁকে বাবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে বলবেন। … কি বলেছিল বলো তো বাবা?

জবাব এড়িয়ে গেছি।

পেটো কার্তিকের বিয়ে হলো মাঘের একেবারে শেষের দিকে, অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির গোড়ার দিক এটা। নতুন বছরের শুরুই বলা যেতে পারে। পেটো কার্তিকের নতুন ঘর সংসার দেখার উপলক্ষ্যে কিছু দিনের মধ্যে কোন্নগরে গেছি এবং যতটা সম্ভব অবধূতের সঙ্গেই কাটিয়েছি। কিন্তু তাঁর কথাবার্তা বা আচরণে কোনোরকম দুশ্চিন্ততার ছায়াও আমার চোখে পড়ে নি।

অবন্ধুতের সব তড়িঘড়ি কাজ। কার্তিক তার ছিম-ছাম ছোট ভাড়াটে বাড়ি দেখালো, নতুন দোকান দেখালো। কবিরাজী দোকান আগেই দেখা ছিল, সরঞ্জাম সব তো অবধূতের বাড়িতেই ছিল। কেবল তুলে নিয়ে সাজানো। বুড়ো বাপ তার ছেলেকে নিয়ে দোকানে বসা শুরু করেছেন। রাত পর্যন্ত হারুও দোকানেই থাকে। পেটোর জন্য তিন কাঠা জমিও কেনা হয়েছে। বাড়ি তোলার টাকাও নাকি মাতাজী ওর আর সুষমার নামে ব্যাঙ্কে জমা করে দিয়েছেন।

কিন্তু আনন্দ বা উৎসাহের বদলে পেটো কার্তিকের উতলা মুখ। আমাকে বলেছে, সব বড় বেশি তাড়াতাড়ি হয়ে যাচ্ছে, আমার কিছু ভালো লাগছে না সরি।

সুষমা বলল, ও খুব ঘাবড়ে যাচ্ছে, আপনি ওকে একটু বুঝিয়ে বলে যান তো, বাবা মা আমাদের বিপদে ফেলার মতো কিছু একটা করবেন এ কখনো হয় নাকি!

কার্তিককে বোঝার কি আমার নিজেরই একটু ভাবনা ধরে গেছে। অবধূতের কাছে এসে তাঁকে জেরা করতে ছাড়ি নি, আপনাদের ব্যাপারখানা কি, সব ছেড়েছুড়ে বিবাগী হবার মতলবে আছেন নাকি?

—কি ছাড়লাম? অবাক-অবাক মুখ।

—আপনি আর রোগীর চিকিৎসা করবেন না?

—কেন করব না, প্রেসকপশন করে ওষুধের জন্য কার্তিকের দোকানে পাঠাবো, আর দোকানের কবিরাজও ইণ্ডিপেণ্ডেন্ট প্র্যাকটিসের সুযোগ পাবেন, ওদের দুজনারই পসার বাড়বে— আমার ব্যবসা বুদ্ধি কম ভাবেন নাকি! হাসতে লাগলেন, কার্তিকের বিয়েখানা কেমন দিলাম দেখলেন না?

—দেখলাম। ভাবলাম জিজ্ঞেস করে বসি, লাস্ট সাপার নয় তো? বললাম না। তার বদলে জিজ্ঞেস করলাম, এখন যেমন আছেন তেমনি চলবে, না কোনো প্রোগ্রাম আছে?

হেসে জবাব দিলেন, আমার কোনোদিনই কোনো প্রোগ্রাম ছিল না। … ঘটনার সাজে ডাক পড়লে সাড়া দিতে হবে নয়তো যেমন আছি তেমনি থাকব।

—শিগগির কোনো ঘটনার সাজে ডাক পড়বে আশা করছেন?

মিটিমিটি হাসতে লাগলেন। এমন সমর কল্যাণী এদিকে আসতে গম্ভীর। যেন লক্ষ্য করেন নি এই ভাবে আমার দিকে চেয়ে জবাব দিলেন, আর আমি কিছু আশাও করব না, কোনো কর্তৃত্বও নিজের হাতে রাখব না, এখন থেকে আমি সর্বদা আমার স্ত্রীর অনুগত হয়ে চলব ঠিক করেছি। কল্যাণী ভ্রূ-ভঙ্গি করে প্রসঙ্গ বুঝতে চেষ্টা করলেন, তারপর মন্তব্য করলেন, বরাবরই অনুগত হয়ে চলেছে, বাকি আছে বুড়ো বয়সে।

অবধূত আমাকেই সালিশ মানলেন, বিবেচনা করে দেখুন। আরে, যৌবন ধর্মে পাঁচ-দিকে ছোটাছুটি করতে পারি, পাঁচ জনের অনুগত হতে পারি —কিন্তু বুড়ো বয়সে তো কেবল তুমিই ভরসা!

কল্যাণীও হাসি মুখে আমাকেই বললেন, এটা নালিশ বুঝলেন তো? সমস্ত জীবন ছেড়ে দিয়ে এখন একটু রাশ টানার দিকে চলেছি বলে ঠেস দেওয়া হচ্ছে।…আচ্ছা আপনিই বলুন, সব কিছুতেই একটা রিটায়ার মেণ্টের সময় থাকা উচিত নয়…আপনিও কি লেখার থেকে কোনোদিন রিটায়ার করবেন না?

অবধূতের গম্ভীর মন্তব্য, রবীন্দ্রনাথ রিটায়ার করেন নি।

কল্যাণীর মুখে আরো সপ্রতিভ হাসি। —বলে ঠকলে। সে ভাবে চিন্তা করলে ত্রৈলঙ্গস্বামী শ্রীরামকৃষ্ণ বামাক্ষ্যাপা বিবেকানন্দ কেউ রিটায়ার করেন নি—খুব ভালো কথা, তুমিও এদের রাস্তাই ধরো!

স্বীকার না করে পার নেই, মহিলাকে দেখলে ভালো লাগে, চুপ করে থাকলে ভালো লাগে, কথা বললেও ভালো লাগে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *