সেই অজানার খোঁজে ২.৩

এর পর মাস চার সাড়ে চারের মধ্যে অবধূতের বা কোন্নগরের কারো সঙ্গেই দেখা হয় নি। তার একটা কারণ পুজোর লেখার চাপ। এটা থাকে আগস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত। তারপরেই আমার নিজস্ব রুটিনের পুজোর ছুটি শুরু হয়ে যায়। খবরের কাগজের চাকরির পুজোর ছুটি বলতে তেমন কিছুই নয়। পুজোর লেখা শেষ হলেই সমস্ত বছরের পাওনা ছুটির সঙ্গে এই ক’টা দিনের ছুটি মিলিয়ে এক দেড় মাসের জন্য সপরিবারে কোথাও না কোথাও বেরিয়ে পড়ি। মাঝে বছর দুই ছেলের কারণে বেরুনোয় ছেদ পড়েছিল। গেল বছর থেকে আবার বেরুচ্ছি। এবারে রাজস্থানের দিকে প্রোগ্রাম।

রওনা হবার দিন দুই আগে ফোনে অবধূতের সঙ্গে কথা হয়েছিল। তিনি শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেছেন, আপনার স্ত্রীকে দিন একটু, আমার স্ত্রী কথা বলবেন।

কেবল স্ত্রী নয়, মেয়ের সঙ্গেও তাঁর কথা হলো। এক দিকের বাক্যালাপ থেকেই বোঝা গেল কি নিয়ে কথা। আমরা থাকছি না বলে অবধুত গৃহিণীর আগাম কালী পুজোর নেমন্তন্ন। আমার স্ত্রী জানান দিলেন, আপনি নেমন্তন্ন না করলেও শুধু এই জন্যেই কালীপুজোর আগে আমাদের ফেরার প্রোগ্রাম—আপনার গেল বারের কালীপুজো এখনো আমাদের চোখে লেগে আছে। আমার মেয়ে আর এক ধাপ ওপরে গেল। বলল, এমন কালীপুজো জীবনে দেখি নি, এবারেও যেতে না পারলে আপনাকে দায়ী করব, আপনি দেখবেন যাতে কোনোরকম বিঘ্ন না হয়—

ও-দিক থেকে তিনি নাকি হেসে বলেছেন, বিঘ্ন হবে না।

বিঘ্ন হয় নি। সমস্ত রাজস্থান ঘুরে দিল্লি হয়ে কালীপুজোর চারদিন আগে আমরা কলকাতায় ফিরেছি। বেড়িয়ে ফেরার পর প্রতিবারের মতো এবারেও মনে হয়েছে, কলকাতাকে ভালো লাগার জন্যেই মাঝে মাঝে কলকাতা ছেড়ে দূরে চলে যাওয়া দরকার। গেলে কলকাতার টান বোঝা যায়। রাতে ফোনে অবধূতকে সেই কথা বলতে তিনি হেসে সারা। বলে উঠলেন, মশাই সর্বব্যাপারেই আপনার এ-কথা খাটে, প্রিয়কে প্রেয়সী করে তুলতে হলে তাকেও মাঝে মাঝে ছাতা দরকার—বিরহ কথাটার অর্থ কি ছাড়া না ছেড়ে পাওয়া? নিজের স্ত্রীকেই তো এ-পর্যন্ত কতবার ছাড় লাম, ফেরার পর মনে হতো চার গুণ মিষ্টি!

ফোনে রমণীর ভৎসনা প্রায় স্পষ্ট কানে এলো, তোমার কি কোনোদিন আর বয়েস হবে না!

—ওই দেখুন মশাই সত্যি কথা বলে গাল খাচ্ছি, কালীপুজোর দিন সকালেই চলে আসুন তাহলে—

সকালে হয়ে ওঠেনি। খাওয়া দাওয়ার পর একটু বিশ্রাম করে বেলা তিনটে নাগাদ রওনা হয়েছি। বিকেলের মধ্যে পৌঁছে গেলে আর হৈ-হল্লা বা বাজী পটকার মধ্যে পড়তে হবে না। দুটোকেই বড় ভয়।

…একই জিনিসের বিপরীত রূপ এত বয়েস পর্যন্ত কম দেখলাম না। কি শোকে কি উৎসবে। শোকে উৎসবের তাণ্ডব, আবার উৎসব শেষে শোকের ছবি। উৎকট রকমের নানা ছাঁদে-ছন্দে ‘বোলো হরি হরি বোল’ ধ্বনির মত্ত উল্লাস কানে এলে মৃত্যুকে ‘শ্যাম সমান’ কল্পনা করা কারো পক্ষে সম্ভব হয় কিনা জানিনা। তমিস্রনাশিনী শ্যামাপূজার পরদিন খবরের কাগজের ভাঁজ খুললেই মানুষের উল্লাসজনিত অঘটনে বলির অবধারিত বিবরণ থেকেও চোখ সরানো সম্ভব হয় না। কত সংসারের শোকের ছায়া মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে। ছেলের কারণে কলকাতার এই কালীপুজোকে বরাবর এড়িয়ে চলতে চেয়েছি। কিন্তু শেষের দু‘বছর তাকে নিয়ে আর নড়া সম্ভব হয় নি। কি উদ্বেগের মধ্য দিয়ে এই কটা দিন আমাদের কাটত ভোলার নয়। বিকেল থেকেই তার দু‘কানে মোটা করে তুলো গুঁজে রাখতাম। তা সত্ত্বেও বাজীর উৎকট শব্দে চমকে চমকে উঠত। বিসর্জনের উল্লাসের দিনে আরো কাহিল অবস্থা। মাথার যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে উঠত, সমস্ত শরীর লাল হয়ে যেত, মনে হতো দম বন্ধ হয়েই না শেষ হয়ে যায়। আর আজ অবধূতের বাড়িতে কল্যাণী মাতাজীর সেই কালপুজো দেখার আকর্ষণে আমাদের দিন কয়েক আগে বাইরে থেকে বেড়িয়ে ফেরা।

অবধূত ভারী খুশী। তিনজনকেই নজর করে দেখে মন্তব্য করলেন, সকলকেই বেশ তাজা দেখাচ্ছে আপনাদের।

কল্যাণীর খুশীর ভাব কেবল মুখের স্নিগ্ধ হাসিটুকুর মধ্যেই প্রকাশ। মেয়েকে বললেন, তোমার কথা সকাল থেকে অনেকবার মনে হয়েছে।

অতিথি অর্থাৎ ভক্ত সমাগমের দেরি আছে। কেবল কয়েকটি মহিলা এসে যোগানদারীর কাজে লেগেছেন। তাঁদের মধ্যে একজনকে দেখে শুধু আমি কেন, মনে মনে আমার স্ত্রী আর মেয়েও অবাক একটু। আমার মনে হয়ে ছিল ঠিক সেই মহিলাকেই দেখছিনা আর কা উকে দেখে ভুল করছি! কল্যাণী মায়ের শিষ্য শ্রীরামপুরের সেই অবস্থাপন্ন ভদ্রলোকের ঘরণী—মাতাজীর প্রতি স্বামীর গদ্-গদ্ ভক্তি-ভাব যিনি আদৌ সরল চোখে দেখতেন না। মাতাজীর রূপের টানটাই স্বামীর বড় আকর্ষণ ভাবতেন। মাতাজীটিও যে তাঁর সম-বয়সী, বয়েস একান্ন বাহান্ন সে-তো দেখে কারোর বোঝার উপায় নেই। এই মহিলাও যৌবনকালে বেশ রূপসী ছিলেন বোঝা যায়, কিন্তু বয়সের ছাপ গেল বারে তাঁর পরিপাটি প্রসাধনের আড়ালে থাকা দূরে থাক, বরং যেন একটু বেশিমাত্রায় প্রকট হয়ে পড়েছিল মনে আছে। গেল বারে তিনি এসেছিলেন তাঁর স্বামীরত্নটিকে তীক্ষ্ণ প্রহরায় রাখার গুরু দায়িত্ব নিয়ে। সেবারে এঁকেই ইশারায় দেখিয়ে অবধূত আমাকে বলেছিলেন, একটু রসের খোরাক পেতে চান তো ওই মহিলার ওপর নজর রাখুন—এত লোকের মধ্যে ওই মহিলাই কেবল আমার স্ত্রীটিকে বরদাস্ত করতে পারেন না, আবার তাঁর ভদ্রলোকটিকে আঁচল-ছাড়াও করতে পায়েন না।

…গেল বারের সে প্রহসন ভোলবার নয়। সারাক্ষণই তাঁর উগ্র টানধরা মেজাজ। এই মেজাজের কারণ মাতাজীর অন্য ভক্তরাও জানত এবং লজ্জা পেত। আর স্বামীটির তো বিড়ম্বনার একশেষ। তিনি একাই মাতাজীর শিষ্য, স্ত্রী নন। তাই কারো লাজ-লজ্জার ব্যাপারে তাঁর ভ্রূক্ষেপও ছিল না। মাতাঙ্গী পুজোয় বসার আগে সক্কলকে পেট পুরে রাতের খাওয়া খেয়ে নেবার নির্দেশ শুনে আহারে বসেই তিনি শ্লেষের শর নিক্ষেপ করে ছিলেন, কল্যাণীর দিকে চেয়েই সক্কলকে শুনিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, মায়ের পুজোর আগে সক্কলকে খেয়ে নিতে হবে এটা কোনো শাস্ত্রের নির্দেশ না মাতাজীর নিজের নির্দেশ।

…দোষের মধ্যে তার ভদ্রলোকটিই স্ত্রীর মুখ বন্ধ করার জন্য আগ বাড়িয়ে বলে ফেলেছিলেন, মাতাজীর নির্দেশ মানেই শাস্ত্রের নির্দেশ। শোনামাত্র মহিলা স্বামীকে দাবড়ানি দিয়ে থামিয়েছিলেন। এই নিয়ে অন্য ভক্তদের সঙ্গেও মহিলার বিতণ্ডা অস্বস্তিকর হয়ে উঠছিল। পুরুষ ভক্তদের কেন এত ভক্তির আদিখ্যেতা খুব সূক্ষ্মভাবে সে আভাস দিতেও ছাড়েন নি। হাসিমুখে শেষে কল্যাণীই তাঁকে ঠাণ্ডা করেছিলেন, বলেছিলেন, না মা, শাস্ত্রে, খেয়ে পুজোর কথাও নেই না খেয়ে পুজোর কথাও নেই—মানুষের অভিরুচিটাই সংস্কার আর নিয়মে এসে দাঁড়িয়েছে। মায়ের ছেলে-মেয়েরা উপোস করে মা-কে ভোগ খেতে দেখবে এ আমার ভালো লাগে না বলেই এখানে আগে খেয়ে নেবার ব্যবস্থা। তাঁর সেই হাসিমুখের কথাগুলো আমার কানে লেগেছিল বলেই এই মহিলাকে দেখামাত্র গেল বারের ওই প্রহসন মনে পড়ে গেল।

… আর সঙ্গে সঙ্গে সেই শেষের চমকও। …নিজস্ব পদ্ধতির সেই পুজো এবং বিচিত্র রকমের আরতি শেষ করে সকলের মাথায় ঘটের শাস্তি-জল ছিটিয়ে প্রদীপের আশিস-ছোঁয়া তপ্ত হাত শ্রীরামপুরের ওই ভদ্রমহিলার মাথায় রাখতেই তিনি তীক্ষ্ণস্বরে আর্তনাদ করে উঠেছিলেন, কি হলো! কি হলো! এ আমার কি হলো।… তার পরেই পাশের মহিলার কোলে ঢলে পড়ে অজ্ঞান। হতভম্ব বিমূঢ় সকলে…তারপরেই মাতাজীর তৎপর হাতের শুশ্রূষা—পুজোর ঘটি থেকেই জল নিয়ে তাঁর চোখে মুখে জোরে জোরে ঝাপটা দিতে তবে জ্ঞান ফেরে। ·-তার পরেও ভয়ার্ত আর্ত দৃষ্টি।…উপুড় হয়ে মাতাজীর পায়ে লুটিয়ে পড়েছিলেন। পরদিন আমাদের কাছে কল্যাণী নিজেই হাসিমুখে ওই ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, মানুষের মন সবল হতে সময় লাগে, দুর্বল সহজেই হয়। পুজোর সময় এতগুলো মানুষের তন্ময়তার প্রভাব কিছু আছেই…এই প্রভাবে মহিলার মন যত দুর্বল হয়েছে নিজের ভিতরের অপরাধ-বোধ ততো বেড়েছে, এই অবস্থায় তাঁর স্নায়ু তো স্পর্শকাতর হতেই পারে—আমি ওর মাথায় হাত রাখতে নিজের স্নায়ুর সঙ্গে নিজেই আর যুঝতে পারেন নি-এতে আমার কোনো কেরামতি নেই।

… কল্যাণী ভিতরে চলে যাবার পর অবধূতের সেই মন্তব্যও কানে লেগে আছে, যেন একবছর নয়, দু’পাঁচ দিন আগে শোনা। বলেছিলেন, আমারও ওই এক কথা, ওঁর কোনো কেরামতি নেই, কোনো ব্যাপারে আমাদের কারো কোনো কেরামতি নেই…কিন্তু আমাদের অলক্ষ্যে একেবারে কারোরই কি নেই? কেন এমন হয়…কে করে—কে ঘটায়?

একবছর বাদে এসে শ্রীরামপুরের মহিলাকে দেখে মনে হলো অলক্ষ্যের কোনো ঘটন-পটিয়সীর কোনো মাহাত্ম্যই আবার নতুন করে দেখছি।… কল্যাণী মাতাজীর পিছনে ছায়ার মতো লেগে আছেন সেই ভদ্রমহিলা, তাঁর স্বামী তখন পর্যন্ত অনুপস্থিত। তিনি রান্নায় সাহায্য করছেন, পুজোর আয়োজনে সাহায্য করছেন, ঘুরে ফিরে এসে জিজ্ঞেস করছেন, মা এটা দিয়ে কি হবে, ওটা কি করে করব…। কল্যাণীকেও একবার স্নেহের ধমকের সুরেই বলতে শুনলাম, যেমন করে হয় করো না বাপু, ভক্তি-শ্রদ্ধা থাকলে যেভাবে করো তা-ই ভালো।

গেল বছর ওঁকে আপনি-আপনি করে বলতেন। এখন তুমি।

আমি হাঁ হয়ে দেখছি। মহিলার পরনে খুব চওড়া লালপেড়ে গরদের শাড়ি, গায়ে ওই রঙেরই হাল্কা গরম কাপড়ের ব্লাউজ। এক পিঠ খোলা চুল। কপালে বড় সিঁদুর টিপ, সিঁথিতে চওড়া টকটকে সিঁদুর। প্রসাধনের ছিটেফোটাও নেই। স্নিগ্ধ সুন্দর একখানা মায়ের মুখ। কল্যাণীর পাশে যেন এমন মূর্তিই মানায়। ফিরে দেখি অবধূত মিটি-মিটি হাসছেন। চোখোচোখি হতে জিজ্ঞেস করলেন, চিনলেন?

—খুব… কিন্তু না-চেনার মতো নতুন।

বলতে বলতে আখের গুড় আর সেই মুখরোচক মশলা মেশানো সরবত হাতে সেই মহিলাই হাজির। বললেন, মা পাঠিয়ে দিলেন—চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে সরবতের গেলাস হাতে নিলাম। অবধূত বললেন, দাড়াও, এঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই—

সপ্রতিভ মুখে মহিলা বললেন, পরিচয় মায়ের মুখে শুনেছি…তাছাড়া গেল বছরেও এঁদের সকলকে দেখেছিলাম।

আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, গেল বছর আমিও আপনাকে দেখেছি মনে আছে…

সঙ্গে সঙ্গে অবধূতের সরস প্রশ্ন, ঠিক এঁকেই দেখেছিলেন বলছেন?

আমি অপ্রস্তুত। এ-টুকতেই বোঝা গেল মহিলাও বুদ্ধিমতী কম নয়। জিভ কেটে দ্রুত প্রস্থান করলেন।

মহিলার নাম শুনলাম প্রভা ঘোষ। ওঁর স্বামী বীরেশ্বর ঘোষের শ্রীরামপুরে সুতো আর রঙের মস্ত কারবার। দুটো ছেলে একটা মেয়ে। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। কিন্তু ছেলেরা দু‘জনের একজনও বাপের কাছে থাকে না এটাই দুঃখ। আর ছেলেদের অভিযোগ মা তাদের বউদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে না। আর মায়ের পাল্টা ক্ষোভ বাপের দৌলতে যে-ছেলেরা এতবড় কারবারের অংশীদার, তাদের বউদের অত দেমাক হবে কেন! মোট কথা ভদ্রলোকের গৃহ শান্তির বড় অভাব ছিল। তার ওপর নাগাড়ে অজীর্ণ রোগে ভুগছিলেন। অনেক চিকিৎসা করিয়েও তেমন ফল পান নি। লোক মুখে অবধূতে নাম শুনে এসেছিলেন। অবধূত তাঁকে বলে দিয়েছিলেন ক্রনিক অ্যামিবিয়সিস, সারতে সময় লাগবে, ধৈর্য ধরে চিকিৎসা করতে হবে। তা তিনি ধৈর্যের পরীক্ষায় উতরেছেন এবং সেরেও গেছেন। সেবারের কালীপুজোর নেমন্তন্ন রক্ষা করতে এসে মাতাজীর পুজো দেখে তিনি মুগ্ধ। ততদিনে অনেক ভক্তের সঙ্গেই তাঁর হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তার মধ্যে শ্রীরামপুরের ভক্তও জনা দুই ছিলেন যারা ঘোষমশাইয়ের বাড়ির অশান্তির কথা জানতেন। তাঁদের পরামর্শ মাতাজীকে ধরে পড়ুন, দীক্ষা নিন, সব অশান্তি দূর হয়ে যাবে। তাঁদের আবার ধারণা, বাবার সমস্ত শক্তির উৎস মাতাজী। হেসে হেসে অবধূত বলেছিলেন, কল্যাণীর সব থেকে বড় পাবলিসিটি অফিসার হলো গিয়ে হারু—ওষুধের গাছগাছড়া শেকড়বাকড় লতাপাতা যোগানের কাজ করেই যে চুল পাকালো। ব্যাটা করে আমার কাজ আর গুণকীর্তন করে বেড়ায় কেবল ওই মাতাজীর।

রোগী বা ভক্ত যে-ই আসুক হারুর সঙ্গে তার খাতির হয়েই যায়। ওর একটা মন নাকি এখনো সেই বক্কোমুনির থানেই বাস করছে। রোগী বা ভক্তদের কংকালমালী ভৈরব আর ভৈরবী মায়ের মহিমার গল্প শুনতেই হয়। দশ বছর বয়সে যে মেয়েকে জাগ্রত-শিব-তুল্য মহাভৈরব কংকালমালী নিজের কোলে বসিয়ে দীক্ষা দিয়েছিলেন, সেই মেয়ে অশেষ শক্তির আধার ছাড়া আর কি? ওই মহাভৈরবের আশীর্বাদে কালে-দিনে ভৈরবী মায়ের থেকেও অনেক বেশি শক্তির অধিকারিণী হবেন হারু সেটা বরাবরই বিশ্বাস করত। তখন অবশ্য হারু জানত না দশ বছরের সেই মেয়ে অর্থাৎ আজকের মাতাজী সেই ভৈরবী মায়েরই মেয়ে। অবধূতের সঙ্গে তাঁর বিয়ের সময় জেনেছে, আর তখনই বুঝেছে মহাভৈরব কেন ওই মেয়েকে এত স্নেহ করতেন।

বিশ্বাসপ্রবণ ধাত যাদের, হারুর মুখে বক্কোমুনির থানের সেইসব চোখে দেখা কাহিনী শুনলে তারা রোমাঞ্চিত হবেই। অবধূত বা তাদের মাতাজীর অতীত জীবনের কথা শুনতে কার না সাধ? যাক, বীরেশ্বর ঘোষ ধরে পড়তে অবধূতের কথায় কল্যাণী দেবী তাঁকে দীক্ষা দিতে রাজি হয়েছিলেন। পেটো কার্তিকের ধারণা, বাবার কথা বা অনুরোধ মাতাজী সর্বদা আদেশ হিসেবেই শিরোধার্য করেন। ঘোষমশাইকে কল্যাণী দেবী বলেছিলেন, সস্ত্রীক আসুন একদিন, তখন কথা-বার্তা হবে।

অবধূতের ধারণা, স্বামীর পুরনো অসুখ সেরে যাবার ফলে ভদ্রমহিলা একটু ভক্তি-বিশ্বাস নিয়েই এসেছিলেন হয়তো। কিন্তু যাঁর কাছ থেকে দীক্ষা নিতে হবে তাঁকে দেখেই বিগড়ে গেলেন, ভক্তি-বিশ্বাসও রসাতলে। নিজেও বড় ঘরের রূপসী আর মোটামুটি শিক্ষিতা মেয়ে ছিলেন। সেই রূপ যে অবধারিত ক্ষয়ের মুখে, চেষ্টা করেও আর ধরে রাখা যাচ্ছে না, এই খেদ মনের তলায় ছিলই। এখানে এসে যাঁকে দেখলেন তুলনামূলক বিচারে তিনি ঢের বেশি সুন্দরী তো বটেই, তার ওপর ভরা-যৌবনই বলা চলে। মোট কথা তারই সমবয়সী যে এটা তিনি কল্পনাও করতে পারলেন না। এই একজনের কাছে দীক্ষা নিতে হবে—এঁরই কাছে দীক্ষা নেবার জন্য তাঁর ঘরের লোকের এত আগ্রহ এত উন্মাদনা!

আগ্রহ আর উন্মাদনার কারণটা মহিলার কাছে জলের মতো স্পষ্ট।… দীক্ষা সম্পর্কে কোনো কথাই হলো না। দু‘চার কথার পর কাজের তাড়া দেখিয়ে মহিলা আগে ভাগে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসলেন।

তারপর দেড় দু‘মাসের মধ্যে ভদ্রলোকেরও আর দেখা নেই। তাঁরা চলে যেতেই কল্যাণী নাকি হেসে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, মাঝখান থেকে আমারও ভক্ত গেল তোমারও রোগী গেল—কেন যে দীক্ষা নেবার জন্য তুমি হুটহাট লোককে বলো—

আমিও সায় দিয়ে বললাম, সত্যিই এটা অন্যায় আপনার, দীক্ষা নেবার জন্য লোক পাঠিয়ে আপনি নিজের স্ত্রীকে এ-ভাবে উত্যক্ত করেন কেন? কার্তিক বলছিল আপনি হুকুম করলে তবেই উনি দীক্ষা দিতে রাজি হন, নইলে নয়?

মুচকি হেসে অবধূত বললেন, স্ত্রীকে উত্যক্ত করি দুই কারণে, আর আমার বিবেচনায় দুটোই সায়েন্টিফিক।…আচ্ছ। র‍্যাপ শব্দটার বাংলা কি?—মনোগত সম্পর্ক বা সম্বন্ধ বলতে পারেন।

—বেশ…প্রাকৃতিক নিয়মেই ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদের আর মেয়েদের সঙ্গে ছেলেদের এই র্যাপ বা মনোগত সম্পর্কটা ভালো হয়—এটা একটা স্বীকৃত সত্য মানেন তো?

—মানি, তবে দুজনের কেউ যদি রিপালসিভ না হয়।

অবধূত জোরেই হেসে উঠলেন।—আপনি জানেন না, মনের ছোঁয়া পেলে রিপালসিভ হলেও র্যাপ ভালো হয়। সে যাক, আমার স্ত্রীকে মুনি ঋষিরাও কেউ রিপালসিভ বলবে না।… আধ্যাত্মিক ব্যাপারেও এই র‍্যাপ কথাটা খাটে। আমার ভৈরবী মা আমার কাছে যতো কাছের, স্বয়ং আমার গুরুও ততো নন। এই সত্যটার ওপর গুরুত্ব দিয়েই দীক্ষা নেবার বেলায় আমার স্ত্রীর কাছে লোককে পাঠাই। আর, দ্বিতীয় কারণটা আরো বেশি সায়েন্টিফিক। দীক্ষা বলতে আমি বুঝি কর্মের গতানুগতিক সংস্কার থেকে যতটুকু পারা যায় মনটাকে অন্যদিকে সরানো। জপ মানেও অন্যত্র মনোনিবেশ। এখন এই বীরেশ্বর ঘোষের ব্যাপারটাই ধরুন।

বাড়িতে দেমাকের স্ত্রী নিয়ে অশান্তি, ছেলে ছেলের বউদের নিয়ে অশান্তি আর তার সঙ্গে ব্যবসায়ের চিন্তা—এই চিন্তা আর অশাস্তি থেকেই ভদ্রলোকের ক্রনিক পেটের রোগ। ঘুমের মধ্যেও এগুলো অবচেতন মন থেকে সরে না। ওষুধে আর বিশ্বাসে অনেকটাই সুস্থ হলেন তিনি, কিন্তু রোগের মূল কারণ ওই অশান্তি আর চিন্তা থেকে তাঁর মনটাকে তুলে না আনতে পারলে ফের রোগে পড়তে কতক্ষণ? · এখানকার মাতাজীর সম্পর্কে নানাজনের মুখে নানারকম বিশ্বাসের কথা শুনে আর তারপর তার কালীপুজো দেখে ভরপুর বিশ্বাস নিয়ে নিজেই তিনি মাতাজীর কাছ থেকে দীক্ষা নেবার জন্য ব্যগ্র হলেন, আর তক্ষুনি আমিও কর্মের চিরা চরিত সংস্কার থেকে তাঁর মন সরানোর খাঁটি রাস্তা পেয়ে গেলাম আর কল্যাণীকে ডেকে দীক্ষার ফতোয়া দিলাম, কিন্তু কল্যাণী গোল বাধালে এর মধ্যে আবার তাঁর স্ত্রীকে টেনে।

‘আমি উৎসুক।—দেড় মাস বাদে ভদ্রলোক আবার একাই এলেন?

—এলেন তো বটেই, একখানা ঝড়ো কাকের মতো এলেন। আগের থেকেও ডবল দুশ্চিন্তা, এখানে আমাদের মুখ দেখাবেন কি করে। আবার পেটের রোগ শুরু হতে না এসে পারলেন না অবধূত এরপর কল্যাণীর ভুল শুধরাবার ব্যবস্থা করেছেন। তাঁকে ডেকে বলেছেন, এঁর দীক্ষা নেওয়া খুব দরকার, এর স্ত্রীর এখনো দীক্ষা নেবার সময় আসে নি—তুমি এঁর ব্যবস্থা করো।

…দীক্ষা হয়েছে। দেখতে দেখতে তারপর ঘোষমশাই অন্য মানুষ। কিন্তু তাঁর স্ত্রীটি দ্বিগুণ উতলা, স্বামীর ভাবাবেগ আর জপে তন্ময়তা একটুও স্বাভাবিক বা অকৃত্রিম মনে হয় নি। নাম জপ করে না রূপ জপ করে কে জানে, সপ্তাহে দু‘দিন তিনদিন করে কোন্নগরে ছোটার ভাড়া কেন? শাসন করেও আটকানো যায় না কেন! গায়ে শান্তির বাতাস লেগেছে না মাতাজীর রূপের বাতাস?

এই প্রতিক্রিয়ার ফল গত বছর কালীপুজোর রাতে নিজের চোখেই দেখেছি। এ-বছর আবার শ্রীমতী ঘোষেরও এমন পরিবর্তন। শুনলাম সেবারে ফিট হয়ে বাড়ি ফেরার সাতদিনের মধ্যে স্বামীকে নিয়ে আবার এসেছেন। আকৃতি, তাঁকেও দীক্ষা দিতে হবে। কিন্তু কল্যাণী বেশ সরল মুখেই এবারে তাঁকে একটু বেগ দিয়েছেন। বলেছেন, আপনার দীক্ষা নেবার সময় হয়েছে কিনা সেটা আপনাদের অবধূত বলে দেবেন, তিনি যেমন বলেন আমি তেমনি করি।

ঠাট বজায় রাখার জন্য মহিলাকে আরো মাসখানেক ঘোরাতেই হয়েছে, তারপর তাঁরও দীক্ষা হয়েছে। এখন তিনি মাতাজী অন্তঃপ্রাণ। তাঁর স্বামী ছেলেদের আর বউদের নিয়ে সন্ধ্যায় আসবেন, কিন্তু মাতাজীর সাহায্যের জন্য উনি সকালেই চলে এসেছেন।’

হাতের সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে মিটি মিটি হেসে অবধূত বললেন, আমি আশ্চর্য হয়ে দেখি বুজরুকির ধাপে-ধাপে পা রেখেও যদি বিশ্বাসের দরজায় পৌঁছনো যায় তাহলে তার এমনি জোর যে সাপের বিষও আর বিষাক্ত থাকে না।…এই পরিবারের ব্যাপারটাই দেখুন, কল্যাণীর হুকুমে মহিলা এরপর যেচে ছেলে আর ছেলের বউদের কাছে যেতে লাগলেন, তাদের ভালো-মন্দের খোঁজ খবর নিতে লাগলেন। যিনি সর্বদা মেজাজে ফুটতেন তাঁর এই পরিবর্তন দেখে ছেলে বউরা অবাক। বাপের পরামর্শে শেষে একদিন ছেলের বউরাও এ-বাড়িতে এলো—এসে আটকে গেল। তারাও এখন কল্যাণীর শিষ্য। সপরিবারে দুই ছেলেই আবার বাবা-মায়ের কাছে ফিরে আসতে চাইলো। কিন্তু এবারে কল্যাণীই আপত্তি করল, না, বাবা-মাকে যতো পারো ভক্তিশ্রদ্ধা কর কিন্তু যে-যার স্বাধীনতা নিয়ে যেমন আছ তেমনি থাকো। এমন সচ্ছল এক পরিবারের সব অশান্তি যেন যাদু-মন্ত্রে উবে গেল…অথচ আমরা তো কিছুই করলাম না—তাহলে কে কি করল বলুন তো?

অবধূতের এই প্রশ্নের জবাব কোনোদিন দেবার চেষ্টা করি নি।

বিকেল গড়িয়ে চলেছে। আমরা কখনো সামনের দাওয়ায় কখনো বা পিছনের আঙিনায় পায়চারি করছিলাম। অবধূত মাঝে মাঝে. এটা-সেটা বলছেন আর একের পর এক সিগারেট টেনে চলেছেন। পেটো কার্তিকের শুনলাম সকাল থেকে ফুরসৎ নেই। সমস্ত কেনাকাটা আর ব্যবস্থাপনার দায়-দায়িত্ব তার। গত বারে জনা পঞ্চাশেকের নেমন্তন্ন ছিল, এবারে শুনলাম পঁচাত্তর আশি হবে।

শ্রীমতী প্রভা ঘোষ ছাড়া আরো সাত আট জন মহিলা তাদের মাতাজীর সাহায্যে ব্যস্ত। এদের মধ্যে বার কয়েক একটি অবিবাহিত মেয়েকে দেখলাম। সেই থেকে মুখ বুজে কাজ করে চলেছে। দুর্বো বাছছে, পিটুলি বাটছে, এটা-ওটা নিয়ে আসছে, রেখে আসছে। এখন দেখছি পিছনের দাওয়ায় উপুড় হয়ে বসে নিবিষ্ট মনে বড় করে আল্‌পনা আঁকছে। আমার হাতে একটা আঙুলের খোঁচায় ইশারা করে অবধূত সেদিকে এগোলেন। কিন্তু পাঁচ হাতের মধ্যে এসে দাঁড়ানো সত্ত্বেও মেয়েটির নিবিষ্টতায় ছেদ পড়ল না, আমাদের লক্ষ্য করল না।

—এই মেয়ে মুখ তোল!

ধড়ফড় করে মুখ তুলে তাকালো তারপর আস্তে আস্তে উঠে দাড়ালো। —তোকে দাড়াতে কে বলেছে…এঁকে চিনিস?

আঙুল তুলে আমাকে দেখালেন। মেয়েটি ডাগর দুই চোখ মেলে আমার দিকে তাকালো। বিব্রত ভাব। সামান্য মাথা নাড়ল, চেনে না।

ইশারার কারণ না বুঝে মেয়েটিকে আমি ভালো করে লক্ষ্য করছি। বেশ দীর্ঘাঙ্গী। ভালো স্বাস্থ্য। বছর তেইশ চব্বিশ হবে বয়েস। গায়ের রং ফর্সা তো নয়ই বরং একটু চাপা। আয়ত চোখ দুটো বেশ সুন্দর বলেই মুখখানা মিষ্টি দেখায়।

অবধূত আমার নাম বলে ফের জিজ্ঞেস করলেন, এবারে চিনলি?

এবারে সামান্য মাথা নাড়ল। চিনেছে।

—এঁর কতগুলো বই পড়েছিস?

মুখের বিড়ম্বনা আরো স্পষ্ট। জবাব দিতে পারল না।

—সে কি রে, কোনো বই পড়িস নি তো নাম শুনে চিনলি কি করে?… কথা বলছিস না কেন, শুধু ব্যাক-ডেটেড নয়, ইনি তোকে বোবা ভাবছেন—

এবারে মৃদু জবাব দিল, নাম শুনেছি…

—কোথায় শুনেছিস?

—এ বাড়িতেই।

অবধূত হাসছেন।—তোর মাতাজীকে বলব তোকে আর একটু স্মার্ট করে দিতে, কথা বলতে হলেই অত মিইয়ে যাস কেন? ঠিক আছে কাজ কর—

মেয়েটা যেন হাপ ফেলে বাঁচল। আমরা ফিরলাম।

এ-ভাবে আমাকে ডেকে নিয়ে কথা বললেন যখন কিছু ব্যাপার আছে। জিজ্ঞেস করলাম, মেয়েটি কে?

হেসে জবাব দিলেন, ঘটনার সাজের আর একজন। ওর নাম সুষমা, শ্রীমতী প্রভা ঘোষের খুড়তুতো বোনের মেয়ে, কল্যাণীর নতুন রিক্রুট, মাস আড়াই যাবত তার কাছে মানে এ-বাড়িতেই আছে। তার আগে প্রভা ঘোষ তাকে নিজের বাড়িতে এনে রেখেছিলেন। সে যাক, আগে বলুন কালো হলেও মেয়েটিকে দেখলেন কেমন?

হেসে ফিরে বললাম, আমার মতামত জেনে কি হবে, কারো সঙ্গে ওর বিয়ের সম্বন্ধ-টম্বন্ধ করার দায়ে পড়েছেন নাকি?

প্রশ্ন শুনে অবধূত হেসে উঠলেন। ভারী খুশি।—ঠিক ধরেছেন।… খানিক আগে আপনি বলছিলেন না, ছেলে বা মেয়ে দুজনের একজন যদি দেখতে রিপালসিভ হয় তাহলেও তাদের মধ্যে র‍্যাপ হতে পারে না—আর আমি জবাব দিয়েছিলাম, মনের ছোঁয়া পেলে রিপালসিভ হলেও র‍্যাপ্‌রট ভালো হয়—এই মেয়েকে নিয়ে এখন আমার সামনে সেই এক্সপেরিমেন্ট।

আমি বিমূঢ় একটু।—কিন্তু কালো হলেও মেয়েটি তো মোটেই রিপালসিভ নয়, লম্বা, স্বাস্থ্য আর মুখশ্রীও ভালো—

একটা হাত তুলে অবধুত আমাকে থামিয়ে দিলেন, আরে মশাই আপনি একেবারে এক তরফা ভাবছেন, মেয়েটি রিপালসিভ আমি একবারও বলেছি, ছেলেটি তে৷ রিপালসিভ হতে পারে!

আমি আবার অথৈ জলে।

এরপর মেয়েটির সমাচার শুনলাম। শ্রীমতী প্রভা ঘোষের খুড়তুতো বোনের মেয়ে সুষমা—বারো বছর বয়সের মধ্যে বাবা মা দুজনকেই হারিয়েছিল। দশ বছর বয়সে বাবা গেছে, বারো বছরে মা। জয়েন্ট ফ্যামিলির কাকা-কাকীমারা ভরসা। মা মারা যাবার পর থেকে মেয়েটা অন্যরকম হয়ে যাচ্ছিল এটা লক্ষ্য করেও কেউ খুব গা করে নি। ভেবেছিল শোক সয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ঠিক হয় নি। তার খেলাধুলো হাসি-খুশি সব গেল। মুখ বুজে স্কুলে যাতায়াত করে। কিন্তু কোনো কোনো দিন তা-ও যায় না, কাকীমারা বকাবকি করে কাকারা বিরক্ত হয় —কিন্তু সে বসে আছে তো বসেই আছে। কেন যাবে না বলে না, কারো কথার জবাব দেয় না।

পনেরো বছর বয়সে মেয়েকে ফিটের রোগে ধরল। পনেরো দিন বিশ দিন এক মাস অন্তর স্কুলে গিয়ে ফিট হয়, নয়তো বাড়িতে। কাকারা কাকীমারা মহা বিরক্ত, মেয়ের নিজেরও ভালো থাকার কোনো চেষ্টা নেই। ডাক্তার দেখানো হচ্ছে কিন্তু নিজে গরজ করে ওষুধ খাবে না, কারো সঙ্গে বেড়াবে না কথা বলবে না, হাসির কথায় হাসবে না পর্যন্ত। পারলে সারাক্ষণ নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকবে। এমনি ডাক্তারের পরামর্শে মানসিক ডাক্তার দেখানো হলো। তার চিকিৎসার ফলে ঘুম আর শুয়ে বসে থাকাই বাড়তে থাকল, তেমন ফল বিশেষ দেখা গেল না। মনের ডাক্তার বিধান দিল, তার চিকিৎসার সঙ্গে সঙ্গে সাইকো অ্যানালিসিসের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষিত কাকা কাকীমাদের কারো এই রোগটার ওপরেই বিশ্বাস নেই। এ আবার একটা রোগ নাকি ও তো ইচ্ছে করলেই ভালো থাকতে পারে—ইচ্ছে করবে না, কারো কথা শুনবে না, মর্জি আর গোঁ ধরে পড়ে থাকবে—এর আর চিকিৎসার কি আছে? সাইকো অ্যানালিসিস বলতে তারা বোঝে রোগীর সঙ্গে কথা বলে রোগ সারানো। কথা তারা দিবা-রাত্রই বলছে, কার কথা মেয়ে ‘শুনছে? মাঝখান থেকে সাইকো-অ্যানালিসিস তো হলোই না, মনের রোগের চিকিৎসাও বন্ধ হয়ে গেল। আর মেয়ের ফিট হওয়া ক্রমশঃ বাড়তে থাকল।

…স্কুলে বেশ ভালো ছাত্রী ছিল। কিন্তু বছর নষ্ট করে করে সেকেণ্ড ডিভিশনে হায়ার সেকেণ্ডারি পাশ করতেই সুষমার একুশ বছর গড়িয়ে গেল। শেষ যে বারে পাশ করতে হবে পণ করে মোটামুটি পড়াশুনা করে পরীক্ষা দিল, সে বারে পাশ তো করলই—শেষের চার পাঁচ মাসের মধ্যে ফিটও হলো না। পরীক্ষার পরেই আবার যে কে সেই। তাকে আর কলেজেও ভর্তি করানো গেল না। কে একজন পরিচিত ডাক্তার তার বড় কাকাকে বলেছিল, এ-সব রোগ অনেক সময় ফাংশানালও হয়, অর্থাৎ রোগী নিজেই নিজের রোগ সৃষ্টি করে। কিন্তু নিজেই নিজের রোগ সৃষ্টি করাটাও যে বড় রকমের মানসিক অসুখই এটা কারো মাথায় এলো না। কাকারা এবার কড়া শাসনের দিকে এগোল। কিন্তু মার-ধোর করেও তাকে কলেজে পড়তে পাঠানো গেল না। উল্টে আরো ঘন ঘন ফিট হতে লাগল। কাকারা রেগে গিয়ে বলে ফিট না হাতি, হিস্টিরিয়া-থাক পড়ে!

হিস্টিরিয়াও যে একটা রোগই তাই বা কে বলে দেয়। শেষে সকলের টনক নড়ল একদিন। বেলা গড়িয়ে যায়, মেয়ে ঘুম থেকে ওঠে না, ঘরের দরজাও খোলে না। চিৎকার চেঁচামিচি হাঁক-ডাক কিন্তু কোনো সাড়া নেই। দরজা ভাঙা হলো। সুষমা তার বিছানায় নিঃসাড়ে পড়ে আছে। মুখ দিয়ে গ্যাজলা উঠছে। পশে একটা খালি ট্যাবলেটের শিশি। ছোট টেবিলে তার লেখা একটা চিঠিও পেপার ওয়েট চাপা দেওয়া আছে। লিখেছে, আমার মৃত্যুর জন্য এই পৃথিবীর কেউ দায়ী নয়। এই জীবন আর টানতে পারছিলাম না। তাই চলে যাচ্ছি।

তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে যেতে পেটে যা ছিল পাম্প করে বার করা হলো। দেখা গেল এস্তার ঘুমের ওষুধ খেয়েছে। এত খেয়েছে যে আর দু‘তিন ঘণ্টা গেলে কিছুই করা যেত না। কিন্তু যে মেয়ে বাড়ি থেকে মোটে বেরুেতো না সে এত ঘুমের ওষুধ পেল কি করে—পেল কোথা থেকে?

পরে হাসপাতালের জেরায় সুষমা নিজেই স্বীকার করেছে মনের রোগের চিকিৎসার সময় ডাক্তারের প্রেসকপশন অনুযায়ী যে ঘুমের ওষুধ তাকে দেওয়া হতো তার বেশিরভাগ সে না খেয়ে জমাতো। তার মন বলত এগুলো একদিন কাজে লাগবে।

এরপর সুষমার কাকা কাকীমাদের উৎকণ্ঠার শেষ নেই। যোগাযোগ এমনি যে ঠিক এ-সময়েই প্রভা ঘোষ তাঁর মাতাজীকে পেয়ে জীবন সার্থক ভাবছেন। বাবা আর মাতাজীর ওপর তাঁর অখণ্ড বিশ্বাস। বাপ-মা মরা খুড়তুতো বোনের এই মেয়েটিকে তিনি স্নেহ করতেন। সুষমার রোগের খবর বরাবরই রাখতেন। কিন্তু তখন তাঁর বিশ্বাসও ছিল না, করারও কিছু।ছিল না। ঘুমের ওষুধ খেয়ে সুষমার মরার চেষ্টার কথা শুনে তিনি কলকাতায় তাদের বাড়িতে এসে হাজির। হাসপাতাল থেকে ফেরার পর মেয়ের আবার ঘন ঘন ফিট হচ্ছিল।

তাদের সঙ্গে কথা বলে প্রভা ঘোষ স্বামীকে নিয়ে সোজা কোন্নগরে চলে এলো। অহংকার গিয়ে এখন তাঁর সকলের জন্য আবেগ আর আকৃতির দিকটাই বড়। তিনি বাবা আর মাতাজীকে ধরে পড়লেন মেয়েটাকে সারিয়ে দিতেই হবে। অবধূত পরের মঙ্গলবারে শ্মশানে যাবার দিন সকালের দিকে মেয়েটিকে একবার নিয়ে আসতে বললেন। তার আগে অবশ্য‍ই রোগের আর মেয়েটির সম্পর্কে সব খুঁটিয়ে জেনে নিলেন।

যথা দিনে সুষমাকে নিয়ে তাঁরা এখানে এসে উপস্থিত। সঙ্গে ঘোষ দম্পতী ছাড়া মেয়ের এক কাকা আর কাকীমাও আছে। মাসির নির্দেশে সুষমা মাতাজী আর অবধূত দুজনকেই প্রণাম করল। অবধূত বললেন, ওরা আসার পাঁচ মিনিটের মধ্যে মেয়েটির দিকে চেয়ে একটা মজা দেখলাম। আমাকে নয়, বার বার চোখ তুলে সে কল্যাণীকে দেখছে। এই দেখার সাদা দিকটা তিনি খুব ভালো জানেন। অনেকেরই দেখামাত্র কল্যাণীকে ভালো লাগে, এই মেয়েরও লেগেছে। মেজাজী আর অহংকারী মাসির পরিবর্তন দেখেও ওর প্রতি কিছুটা বিশ্বাস হয়তো আগে থাকতেই গজিয়েছিল। তাছাড়া কল্যাণীকে প্রণাম করে উঠতেই উনি বলেছিলেন, মাতাজী তোর সব যন্ত্রন্না ম্যাজিকের মতো দূর করে দেবেন দেখিস—

যাই হোক মেয়েটিকে বেশ ভালো করেই দেখলেন অবধূত। তাঁর প্রথমেই মনে হলো দীর্ঘদিন ধরে ওর ভিতরে সত্তার হাহাকার চলেছে। ওই সত্তা নিরাশ্রয়। চোখের তারার গভীরেও কিছু একটা অনিশ্চয়তার আতঙ্ক। অসময়ে বাপ-মা চলে গেলে অনেক ছেলে মেয়ের আশ্রয়শূন্যতার অনুভূতি চাপা আবেগের দিকে গড়িয়ে সেটা পরিপুষ্ট হতে থাকে। তখন একটা কিছু আশ্রয় সে আঁকড়ে ধরতে চায়। এই মেয়ে নিজের আগোচরে রোগের আশ্রয় আঁকড়ে ধরে আছে। এটা সাধারণ মানুষ ছেড়ে সাধারণ ডাক্তারদেরও ধরা-ছোঁয়ার মতো রোগ নয়, কায়িক কোনো রোগও বলা চলে না হয়তো, কিন্তু রোগের বাড়া। এর যন্ত্রণা এমনি যে আত্মহত্যা করেও নিষ্কৃতির পথ খুঁজেছে মেয়েটি।

হাত দেখলেন। আয়ু রেখা সরল সুস্থ। সংসার জীবনযাপনের লক্ষণও কপালে আর হাতের রেখায় স্পষ্ট।

যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছে। এর চিকিৎসাও তিনি জানেন। কিন্তু এর পর ভড়ঙের দিকটা গুরু গম্ভীর করে না তুললে রোগী বা তার আত্মীয়-পরিজনেরা সে-রকম গুরুত্ব দেবে না।

—তোমার নাম কি?

মৃদু জবাব, সুষমা!

—সুষমা মানে কি?

নিরুত্তর।

জানো, না জানো না?

—লাবণ্য…

—কত দিনের মধ্যে আয়নায় নিজের মুখ দেখ না? জবাব নেই।

—যা খাও ভালো হজম হয় না, প্রায়ই অম্বল হয়ে যায় তো?

মাথা নাড়ল। তাই হয়।

—তবু টক ঝাল মুন আর ভাজাভুজিই বেশি খাও কেন?

সুষমার দু‘চোখে বিস্ময়ের ছায়া। তার থেকেও বেশি ওর কাকা আর কাকীমার চোখে।

—থেকে থেকেই জলতেষ্টা পায়, আর সবসময় কিছু না কিছু চিবুতে ইচ্ছে করে—তুমি কি চিবোও, পান না সুপুরি না মৌরি?

ওর কাকীমা বলে উঠল, এই তিনটের যা পায় তা-ই মুখে নিয়ে চিবোয় —কাঁচা পান পর্যন্ত!

গল্প থামিয়ে আমার দিকে চেয়ে অবধূত হেসে বললেন, এই ঝাপ-তালকে আপনি যেন আবার অলৌকিক ক্ষমতা ভাববেন না—সব নার্ভ-টেনশনের রোগীর বেলাতেই এ-সব লক্ষণ কম-বেশি খাটে। খাটে আমিও জানি। তবু অলৌকিক না হোক ক্ষমতা কিছু আছে সেটা মনে মনে অন্তত স্বীকার না করে উপায় নেই। হরিদ্বারে যাবার পথে আমার স্ত্রীর মুখ আর কপালে শোকের ছায়া দেখেছিলেন, মেয়ের জিভের রঙ দেখে লিভারের গোলযোগের কথা বলেছিলেন। উনি বলেন এগুলো শিক্ষা আর অভ্যাসের ব্যাপারে, চেষ্টা করলে সকলেই রপ্ত করতে পারে। কিন্তু গত এক-দেড় বছর ধরে এই চেষ্টার এত নজির দেখলাম যে মাঝে-মাঝে নিজেই বিভ্ৰান্ত হয়ে পড়ি।

কথা না বাড়িয়ে বললাম, জানি, তারপর?

তারপর অবধূত কল্যাণীকে বললেন, সুষমাকে তার পুজোর ঘরে নিয়ে যেতে। মেয়েটির কাকা-কাকীমার প্রতি তাঁর মুখ-ভাব প্রসন্ন নয়। এটুকুও তাদের সীরিয়াস করে তোলার জন্য। মন্তব্য করলেন, এবারে সময়ে ধরা পড়েছে তাই হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে বাঁচাতে পেরেছেন, ফের যদি চেষ্টা করে আট-ঘাট বেঁধেই করবে, কিছু করার সুযোগ না-ও পেতে পারেন। সুষমার কাকা-কাকীমা আঁতকেই উঠলেন। কারণ আত্মত্যার চেষ্টর খবর শুনে মানসিক চিকিৎসকও তাদের সতর্ক করে দিয়েছেন, সর্বক্ষণ চোখ রাখতে বলে দিয়েছেন।

সুষমার কাকীমা বলে উঠল, আবারও এই চেষ্টা করবেই বলছেন?

—করবেই বলছি না, করলে শক্ত ব্যাপারে হবে, আর আপনারাও ফ্যাসাদে পড়তে পারেন।

মহিলার ঘেমে ওঠার দাখিল। —প্রভাদি বলেছিলেন আপনি আর মাতাজী হাতে নিলে আর চিন্তা নেই, আপনারা দয়া করে কিছু বিহিত করুন। অবধূত প্রভা ঘোষের দিকে তাকালেন, এ-রকম কাউকে বলবে না, আমাদের নিজেদের কারো কোনো ক্ষমতা নেই।…আজ মঙ্গলবার, শ্মশানে থাকব জানোই তো,সুষমাকে নিয়ে কাল বিকেলের দিকে এসো…আজ কের রাতটা ওকে শ্রীরামপুরে তোমার কাছে রাখার সুবিধে হবে?

প্রভা ঘোষ তক্ষুনি মাথা নাড়লেন, কেন হবে না, ওকে আমি সমস্ত রাত বুকে আগলে রাখব—

—এক রাত রাখবে কি কত রাত সে আমি কাল বলব। কাকা-কাকীমার দিকে ফিরলেন, আপনারাও কাল বিকালের দিকে আসবেন, এখন কলকাতায় ফিরে যান।

তারা উঠে ভাইজির সঙ্গে দেখা করতে আর ঠাকুর প্রণাম করতে কল্যাণীর ঘরে এলো। এসে স্তব্ধ, হতবাকও।… মাতাজী মেঝেতে সুষমাকে কোলে নিয়ে বসে আছেন, দুজনেরই দৃষ্টি মায়ের পটের দিকে। সুষমার দু‘গাল বেয়ে ধারা নেমেছে।

—না, আজ অনেক বছরের মধ্যে কাকারা বা কাকীমারা বা বাড়ির কেউ এ-মেয়ের চোখে কখনো জল দেখে নি, তাকে কাঁদতে দেখে নি। আমি বোকার মতো জিজ্ঞেস করে বসলাম, এটা হলো কি করে… কল্যাণী দেবী কিছু করেছেন?

—যা ঘণ্টা, মনস্তাত্ত্বিক লেখক হয়েও এটুকু বুঝলেন না! বারো বছর বয়সের মধ্যে বাবা-মাকে খুইয়ে তেইশ বছর বয়সে কল্যাণীর কোলে বসে মেয়েটা মায়ের কোলে বসার স্বাদ পেয়েছে—কাঁদবে না!

…পরদিন বিকেলেও কল্যাণী সুষমাকে নিয়ে ঠাকুরঘরে বসেছেন। এদিকের ঘরে তার কাকা-কাকীমা শ্ৰী শ্ৰীমতী ঘোষ দম্পতীকে নিয়ে অব ধুত। না, তাঁকে শ্মশানে বসে সুষমাকে নিয়ে কোনো চিন্তাই করতে হয় নি। তিনি অবধারিত জানেন ওই সুলক্ষণা মেয়ের যন্ত্রণার কাল শেষ হয়েছে। জানেন এই মেয়ের সুখের সংসার হবে। কিন্তু সকলকে তিনি নিশ্চিন্ত করলেন অন্যভাবে। বললেন, আপনাদের এই মেয়েকে সম্পূর্ণ সুস্থ করার ভার আমি নিলাম, খুব বেশি হলে তিন-চার মাস লাগবে। আমি ওষুধ দেব আর মাতাজী দীক্ষা দেবেন…কিন্তু একটা নিৰ্দেশ আপনাদের মানতে হবে, সুষমা আপনাদের কাছে এখন আর কলকাতায় ফিরে যাবে না, ওর চেঞ্জ অফ এনভারমেন্ট দরকার —এই ক’টা মাস ও শ্রীরামপুরে প্রভার কাছে থাকবে, চিৎকসা ওর মারফতই হবে, তাছাড়া ওদের গাড়ি আছে, সপ্তাহে দু‘তিন দিনও ওকে মাতাজীর কাছে নিয়ে আসতে পারবে।

… সুষমার কাকা-কাকীমা মনে মনে হাঁপ ফেলে বাঁচলেন। চেঞ্জ অফ এনভারমেন্ট অর্থাৎ পরিবেশ বদলের জন্য সুষমাকে কিছুকাল বাইরে কোথাও নিয়ে যাওয়া আর রাখার কথা মানসিক চিকিৎসকও বলেছিলেন। কিন্তু অত সময় কারো নেই, অত গরজও না। মেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা না করলে একই ভাবে দিন গড়িয়ে যেত। মনে মনে তারা হাঁপ ফেলে বাঁচল। এর মধ্যে দৈবাৎ কোনো অঘটন ঘটলেও পুলিশ তাদের তাড়া করবে না—যে দিন-কাল! কাকাটি বিগলিত হয়ে বললেন, প্রভাদি দয়া করে যদি রাজি হন.. খরচ-পত্র যা লাগে দেব—

প্রভা ঘোষ একটু ধমকের সুরে বলে উঠলেন, এখানে এসে টাকা-পয়সায় নামও মুখে এনো না, বাবার হুকুম হয়েছে যখন প্রভাদির ঘাড়ে কটা মাথা যে রাজি হবে না!

মনে মনে ভাবছিলাম এ সেই প্রভা ঘোষ, মাত্র একটা বছর আগে তাঁর কি উগ্র রুক্ষ আর সন্দিগ্ধ মূর্তি না দেখেছিলাম।

..অবধূত তারপর সকলকে নিয়ে এইদিনও কল্যাণীর পুজোর ঘরে এলেন। এদিনও সুষমা তাঁর কোলে বসে। কাঁদছে না, চাউনি আগের দিনের তুলনায় সজাগ। কল্যাণীর কোল থেকে নেমে মাটিতে বসল। অবধূত বললেন, শোনো মেয়ে, তুমি ধরা পড়ে গেছ, তোমার সত্তা ঈশ্বরের আশ্রয় খুঁজছে, কিন্তু এত বোকা তুমি এটা জান না, সেই আশ্রয় মৃত্যুর রাস্তায় মেলে না—জীবনের রাস্তা ধরলে তবে মেলে—ওই যাঁর কোলে বসেছিলে তিনিই তোমাকে সেই আশ্রয়ের ঠিকানা বলে দেবেন—কিন্তু মাসকয়েক এখন তুমি আর কলকাতায় তোমার কাকা-কাকীমাদের কাছে থাকতে পারছ না—ওই শ্রীরামপুরের মাসির কাছে থাকবে আর তোমার এই মাতাজীর কাছে থাকবে—ভবিষ্যতে আমার এখানকার অনেক দায়-দায়িত্ব তোমাকে নিতে হবে, বুঝলে? এমনি-এমনি আমরা কারো জন্য কিছু করি না—পারবে তো?

অবধূত বললেন, আশায় আর অবিশ্বাস্য আনন্দে মেয়েটার বিভ্ৰান্ত চোখ-মুখ কি-রকম হয়ে উঠল যদি দেখতেন।

…যাবার আগে সুষমার কাকীমা অবধূতকে বললেন, আমরা তাহলে একেবারে নিশ্চন্ত হয়ে বাড়ি যাচ্ছি?

দরমার গেটটা খুলতে খুলতে অবধূত জবাব দিলেন, খুব নিশ্চিন্ত হয়ে বলতে পারছি না…মেয়েটার ভালো বিয়ে আছে দেখতে পাচ্ছি…এখন থেকেই পাত্রের খোঁজে থাকার তোড়জোড় করতে পারেন।

কাকীমাটি প্রথম থতমত খেল, তারপর হেসে উঠে উৎফুল্ল মুখে বলল, তাই নাকি! তাহলে আর আমরা কেন, আপনি নিজেই দাড়িয়ে থেকে বিয়ে দেবেন।

.. আমার আরো কিছু শোনার ছিল, শোনা হলো না। সুষমা প্রসঙ্গে শুরুতেই উনি বলেছিলেন, মনের ছোঁয়া পেলে আরছেলে বা মেয়ের একজন রিপালসিভ হলেও র‍্যাপ রট হয় এই মেয়েকে নিয়ে এখন তাঁর সামনে সেই এক্সপেরিমেন্ট।…কালো হলেও মেয়েটা মিষ্টি, তাহলে কুৎসিত ছেলেটাই হবে।…সে কে? লোকজন আসা শুরু হয়ে গেছে। বিকেলের আলোয় অনেক আগেই টান ধরেছিল। এখন সন্ধ্যা। একজন দুজন করে যারা আসছিল, অবধূতকে প্রণাম করে সোজা ভিতরে চলে যাচ্ছিল। তাই আমাদের আলাপে ছেদ পড়ে নি। কিন্তু এবারে একসঙ্গে তানেকে এসে গেল। প্রথমে বীরেশ্বর ঘোষের গাড়ি। তিনি তাঁর ছেলেরা ছেলের বউরা নাতি-নাতনিরা সকলেই হাজির। তারপর যারা এলো তারা শুনলাম সুষমার কলকাতার কাকা-কাকীমা আর তাদের ছেলে-মেয়ের দল। এখন তারাও অবধূত আর মাতাজীর ভক্ত। … গতবারের দেখা আর না দেখা একে একে আরো অনেক মুখ। কিন্তু এদের মধ্যে কুৎসিত কোনো মুখ চোখেই পড়ল না। তারপর হেড-লাইট জ্বেলে গেটের সামনে আরো দুটো ঝক ঝকে গাড়ি। একটা বিলিতি একটা দিশি। বিলিতি গাড়ি থেকে নামলেন রতনলাল সারাভগি, তাঁর স্থূলাঙ্গী স্ত্রী আর এক ছেলে। অন্য গাড়িতে দ্বিতীয় ছেলে, তার সেই মামা, আরো জনা কয়েক মেয়ে পুরুষ। তাদের সঙ্গে দুই গাড়ি থেকে নামল রাশীকৃত ফুল, ধূপের বাক্স, একের পর এক মিষ্টির হাঁড়ি আর ঝুড়ি।

দাওয়ার সিঁড়ির সামনে দাড়িয়ে চাপা গলায় অবধূত বললেন, এই পুজোর সমস্ত খরচ রতনলাল সারাওগি দিতে চেয়েছিল, আমি শুধু বলেছি কিছু করতে হবে না, একটা বিলিতি মাল শুধু নিয়ে আসবেন—আনল কিনা কে জানে।

আমি হেসে ফেলেছি।

কলকাতায় ফিরেই আমি ফোনে রতনলালের খবর জানতে চেয়েছিলাম। অবধূত হেসে বলেছিলেন, কালীপুজোয় আসছে, কেমন আছে নিজের চোখেই দেখবেন। পরে বলেছেন, বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পুরো টিম ওকে দেখে রায় দিয়েছে তার ব্যাধি নির্মূল।

—আর হাসপাতালের টাকা?

—দুই হাসপাতালের নামে পনেরো লক্ষ টাকার চেক আমার মারফৎ পাঠাতে চেয়েছিলেন, কে ও-সব দায়িত্ব নিয়ে ঝামেলা পোয়ায় মশায়, গরিবের জন্য আমি কিছু টাকা পাইয়ে দিয়ে খালাস।

সারাওগিরা সব অবধূতের পায়ে লুটিয়ে পড়ে প্রণাম করলেন। এই ভক্তির মধ্যে কোনো ফাঁক-ফাঁকি নেই। টিপ্পনীর সুরে অবধূত এক ফাঁকে বললেন, আমরা কি করে গড-ম্যান হয়ে যাই লক্ষ্য করুন।

ব্যবস্থা সব আগের বারের মতোই। পুজোর আগে সকলের খেয়ে নেবার পর্ব। আয়োজনও গত বারের মতোই। পোলাও মাছ ভাজা মাংস আর চাটনি। নিরামিষাশীদের পোলাও বেগুন ভাজা ছানার ডালনা চাটনি। বাড়তির মধ্যে এবারে শেষ পাতে সারাওগির আনা মিষ্টি। পেটো কাতিক আর তার দুই বন্ধু যোগান দিচ্ছে, কিন্তু পরিবেশনে এবার মাতাজী একা নন, সুষমাকে নিয়ে প্রভা ঘোষও নেমে গেছেন। তিনি আগেই ঘোষণা করে রেখেছেন বাকি সকলকে নিয়ে তিনি পরের ব্যাচে বসবেন। তাঁর মাতাজী আপত্তি করেন নি।

ভিতরের পরিষ্কার বড় উঠোনে সকলের পাত পড়েছে। নিরামিষাশীদের দু‘তিন হাত তফাতে। লক্ষ্য করলাম, কোটিপতি সারাওগি বা তাঁর আত্মায় পরিজনেরাও মাটিতে বসে পরম ভক্তি ভরে খাচ্ছেন। অবধূতের মেজাজ এখন রীতিমতো প্রসন্ন। খানিক আগে আধঘণ্টার জন্য তিনি আমাকে নিয়ে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করেছিলেন। সারাওগির আনা বিলিতি বোতলের আর্ধেক শেষ করে দরজা খুলেছেন৷ ছ’আনা তিনি জঠরস্থ করেছেন, আর ভয়ে ভয়ে ছ’আনা আমি। বলেছেন, আজকের দিনে তো কারণ পান বিধি মশাই, অত ঘাবড়াচ্ছেন কেন! খেতে বসেও তিনি কার্তিকের সর্দারি নিয়ে রসিকতা করেছেন। সকলকে শুনিয়েই আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন গেল বারের তুলনায় এবারে প্রভা ঘোষকে অন্য-রকম দেখছি কিনা। গত পুজোয় যারা উপস্থিত ছিল সকলেই হেসে উঠল। শ্রীমতী ঘোষের সপ্রতিভ মুখ লাল একটু। ধমকের সুরে কল্যাণী বললেন, মুখ বন্ধ করে খাও তো এখন!

অবধূতের খাওয়া থেমে গেল। অসহায় চোখে সকলের দিকে চেয়ে বললেন, আপনাদের মাতাঙ্গীর হুকুম শুনলেন মহাশয় মহাশয়ারা? মুখ বন্ধ করে খেতে হলে কেবল বাতাস ছাড়া আর কিছু খাওয়া যায় কিনা বলে দিতে পারেন? খেতে হলে গোরুকেও মুখ খুলে খাবার মুখে নিতে হয়— হাসি আর আনন্দের ছোঁয়া এখানে স্বতঃস্ফুর্ত। কল্যাণীও হাসছেন। খানিক বাদে আবার একটু অন্য ধাঁচের খুশির খোরাক পেল। সুষমা ধীর স্থির মেয়ে তার পরিবেশনও ধীরে সুস্থে। ফলে তার দিকের কারো কারো পাত খালি। তাই দেখে পেটো কার্তিক তার হাত থেকে পোলাওয়ের বালতিটা টেনে নিল, আর ব্যস্ত সমস্ত মাতব্বরের মতো বলে উঠল, দিন দিন, হয়েছে—এ-ভাবে পরিবেশন করলে খাওয়া হতে রাত দেড়টা বাজবে সর্ব কর্ম মেয়েদের দিয়ে হলে আর কথা ছিল না—

পোলাওয়ের বালতি ছেড়ে দিয়ে সুষমা অপ্রস্তুত মুখে দাঁড়িয়ে রইলো। সঙ্গে সঙ্গে ও-দিক থেকে কল্যাণীর ঈষৎ তপ্ত গলা, কি বললি তুই—কি বললি?

ঘর্মাক্ত মুখে পেটো কার্তিক দাঁড়িয়ে গেল। তারপর ঠক করে পোলাওয়ের বালতি মাটিতে নামিয়ে রেখে দুই হাতের উল্টোদিক দুই কানে ঘষে বলল, এই কান মলছি—হলো? বালতিটা আবার তুলে নিয়ে তেমনি মেজাজের সুরে সুষমাকে বলল, দয়া করে দাড়িয়ে না থেকে মাংসের বালতিটা এদিকে আনার ব্যবস্থা করুন—

খালিপাতে হাতা ভরে ভরে পোলাও দিতে লাগল।

ও-দিক থেকে আবার কল্যাণীর মন্তব্য শোনা গেল, আজ আমার সঙ্গে কার্তিকেরও অমাবস্যার উপোস তো, তাই ওর মেজাজ ভালো নেই— পরিবেশন করা মাথায় উঠল, কার্তিকের গলা দিয়ে একটা আর্তনাদের মতো বেরিয়ে এলো।-আমার উপোস! আমি তো জানি না! তারপরেই দ্রুত এগিয়ে এসে পোলাওয়ের বালতি আবার সুমার হাতে ধরিয়ে দিল।—নিন, পরিবেশন করে রাত কাবার করুন, আমার ঘাট হয়েছে—বাপরে বাপ!

সকলে সরবে হাসছে এবার। অদূরে কোটিপতি সারাওগি দম্পতীর দিকে চেয়ে মনে হলো মাটিতে বসে এমন আনন্দ আর তৃপ্তির খাওয়া তারা খুব বেশি খান নি। সে-কথা বলে তাঁদের দিকে অবধূতের মনোযোগ আকর্ষণ করতে তিনি সঙ্গে সঙ্গে আর এক রসের অবতারণা করলেন। ডেকে বললেন, সারাওগি সাহেব আপনাকে এ-ভাবে সকলের সঙ্গে খেতে বসতে দেখে আমার এই লেখক বন্ধু বলছেন, কমিউনিজম্-এ ধর্মের জায়গা নেই, কিন্তু গোঁড়া কমিউনিস্টদের কেউ আজ এখানে থাকলে বুঝত, গণসাম্যবাদের এমন ভালো প্ল্যাটফর্মও আর দ্বিতীয় নেই—এখানে এলে সকলেই সমান, কি বলেন?

রতনলাল সারাওগি হাসিমুখে জবাব দিলেন, তাই তো দেখছি।

রাত সাড়ে দশটার মধ্যে সকলের খাওয়া-দাওয়া শেষ। কিন্তু এবারের কালীপুজো রাত দেড়টায়। অনেক দেরি। বোঝা গেল সকলেই এখানে থেকে যাওয়ার লোক। সারাওগিরা পর্যন্ত ফেরার নাম করলেন না। কথায় কথায় অবধূত জানালেন, পুজোর সঙ্গে এবারে একটা আহুতি-যজ্ঞ হবে, আপনারা যে-যার ইষ্টর পথে বাধা অর্থাৎ অনিষ্ট আহুতি দেবেন।

—আপনার স্ত্রী করবেন?

—আর কে…।

আধ-ঘণ্টা গল্পগুজবের পর অবধূত আবার আমাকে নিয়ে তাঁর নিজস্ব ঘরে ঢুকলেন। বললেন, শত্রুর শেষ না হওয়া পর্যন্ত শান্তি নেই মশাই— শত্রু বলতে বিলিতির বোতলের বাকিটুকু। ধীরে সুস্থে চলল। এবারে আমিও কমে অব্যাহতি পেলাম না। আরো ঘণ্টাখানেক বাদে নিশ্চিন্ত হয়ে দরজা খুললেন।

—চলুন আয়োজন কদ্দুর দেখি।

পুজোর ঘরটা হলঘরের মতো বড়। ওটার ভিতরের দিকের দরজা বরাবর আঙিনার খানিকটা জায়গা ছেড়ে সকলকে খেতে বসানো হয়েছিল। এখন তার কারণ বোঝা গেল। দরজা বরাবর আঙিনার ওই জায়গাতে আহুতি-যজ্ঞ হবে। ইটের দুহাত প্রমাণ-চৌকো যজ্ঞ-কুণ্ডে পেটো কার্তিক বালি ফেলছে আর ছোট একটা টিনের পাত দিয়ে চার-দিক সমান করছে। কল্যাণী পাশে দাঁড়িয়ে তদারক করছেন। শেষ হতে দেখা গেল বালুর স্তরও প্রায় বিঘতখানেক পুরু হবে। সব-দিক সমান হলো কিনা ভালো করে দেখে নিয়ে কল্যাণী কুণ্ডের বাইরে মাঝামাঝি জায়গায় দুই হাঁটুর ওপর জানু-আসনে বসলেন। পরনে টকটকে লাল চওড়া পাড়ের গরদের শাড়ি, গায়ে গরদের ব্লাউজ। স্নানার্ড ছড়ানো চুল পিঠের ওপর দিয়ে মাটি ছুঁয়েছে। কুণ্ড-রচনার কারুকার্য দেখব না তাঁকে দেখব? দুই-ই দেখছি। হাতের সরু বড় একটা বেল-কাঁটা দিয়ে যজ্ঞ-কুণ্ডের পালিশ করা বালুর ওপর নানাভাবে দাগ কাটতে লাগলেন। তার পাশে পেটো কার্তিক দাঁড়িয়ে, আমরা সামনে।

অবধূত বললেন, ওই দাগ গুলোতে পঞ্চ-গুঁড়ি পড়লে কি দাড়ায় দেখুন। হাসিমুখে টিপ্পনীর সুরে কল্যাণী বললেন, বোতলে আর অবশিষ্ট কিছু নেই বুঝি, তাই এখানে অবধূত আমার মাথাটা টেনে নিয়ে কানে কানে বললেন, সুরার পরেই তো নারী… কি বলেন?

তাই দেখে কল্যাণী মুখ নামাতে গিয়েও নামালেন না, সন্দিগ্ধ চাউনি। আ-কথা কু-কথা হচ্ছে বুঝি?

সামলাতে চেষ্টা করে জবাব দিলাম, না…ভালো কথাই।

—ওঁর না-হয় পাপ-পুণ্যির পরোয়া নেই, আপনারও কি নেই?

অর্থাৎ আমি চোরের সাথী গাঁট-কাটা। হাসিমুখেই কাজে মন দিলেন। পেটো কার্তিককে তাঁর পাশে ছোট ছোট পাঁচটা মোড়ক খুলতে দেখা গেল ওতে পাঁচ রকমের রঙের গুঁড়ো-লাল, বেগনে, হলুদ, সাদা, সবুজ। এক-এক দাগে এক-এক রকমের রঙ দিতে দিতে যা দাঁড়ালো, দেখে সত্যিই শিল্পীর কাজ মনে হলে। আমার। বেদীর ওপর মস্তবড় সুন্দর একখানা অষ্টদল পদ্ম!

আমার গলা দিয়ে বেরিয়ে এলো, বাঃ!

অবধূত বাধা দিয়ে উঠলেন, অত উচ্ছ্বসিত হবেন না মশাই, ওখানকার আগুনে একখানা ভালো জিনিস উপহার দিতে হবে মনে রাখবেন — আচ্ছা, কার কি দোষ আহুতি দিচ্ছ তা প্রত্যেককে বলে-বলে দেবে তো?

স্মিত মুখে অষ্টদল পদ্মের চারদিকে চার রঙের রেখা টানতে টানতে কল্যাণী জবাব দিলেন, তোমার কি আহুতি দেব এক্ষুনি বলে দিতে পারি—সংশয়। মুখ তুলে আমার দিকে তাকালেন, আপনারও তাই…তবে দু’-জনেরটা দু‘রকমের।

অবধূত গম্ভীর।—কি বুঝলেন মশাই?

আমার নিরীহ জবাব, বুঝে কাজ কি?

বেলপাতার ডাল থেকে মনের মতো একটা ত্ৰি-পত্র বেছে নিতে নিতে কল্যাণী বললেন, মায়ের সম-দৃষ্টি, বোঝার প্রারব্ধ থাকলে তুমিও বুঝবে উনিও বুঝবেন।

অবধূতের তর্কের মুড্‌।—সম-দৃষ্টি প্রারব্ধ এ-ও তো দুর্বোধ্য শব্দ!

পেটো কার্তিক বেল-কাঠ চূড়ো করে সাজাচ্ছে আর মা-বাবার কথায় মজ। পাচ্ছে। বিশ্ব ত্রি-পত্র একটু আড়াল করে কল্যাণী আঙুলে করে তাতে কিছু আঁকলেন কি লিখলেন জানি না। হাসছেন মিটিমিটি। ত্রি-পত্রট! ‘অষ্টদল পদ্মের মাঝখানে উপুড় করে প্রথমে আমার দিকে পরে অবধূতের দিকে তাকালেন। জবাব দিলেন, কিছুই দুর্বোধ্য না। একই প্রদীপের আলোয় একজন মন দিয়ে গীতা-ভাগবত পড়ছে, আর একজন তেমনি মন দিয়ে সেই আলোতেই দলিল জাল করছে। প্রদীপের আলোটা হলো মায়ের সম-দৃষ্টি, আর যে যা করছে সেটা প্রারব্ধ।

কল্যাণীকে দেখলে চোখ জুড়োয়, কিন্তু তাঁর কথা শুনে কানও এমন জুড়োয় ধারণা ছিল না। অবধূত ঘটা করে নিজের স্ত্রীকেই দেখছেন।

আমার দিকে ফিরলেন। —কি মশাই আর সাহিত্য করবেন না ছেড়ে দেবেন?

লজ্জা পেয়ে কল্যাণী ধমকের সুরে বলে উঠলেন, তুমি ওঁকে নিয়ে এখন যাবে এখান থেকে! এই কার্তিক, তুইও যা এখন—

—চলুন সরে পড়া যাক। আড়ালে এসে অবধুত হাসি-ছোঁয়া নির্লিপ্ত সুরে জানান দিলেন, যজ্ঞ-কুণ্ড বেদীতে যোনি-চিহ্ন আঁকা হবে এখন, তারপর বেলপাতা চাপা দেওয়া হবে—তাই গলা ধাক্কা।

পুজোর পরে যজ্ঞ হবে, যজ্ঞের পরে আরতি এবং মঙ্গলানুষ্ঠান। পুজোর সময় গেলবারের মতোই আমি আর অবধূত বাইরের বারান্দায় এসে বসেছি। উনি কথা-বার্তা কম বলছেন, পর পর সিগারেট টেনে চলেছেন। ভরা খাওয়ার আগে আর পরে বোতলের জিনিস যে পরিমাণ উদরস্থ করেছেন, আর কেউ হলে ঘুমিয়ে পড়ত। থেকে থেকে আমারই ঝিমুনি আসছিল। উনি আমার তিনগুণ খেয়েছেন, কিন্তু চোখে ঘুমের লেশমাত্র আছে মনে হয় না।

একবার জিজ্ঞেস করলাম, কিছু যেন ভাবছেন মনে হচ্ছে?

বারদুই সিগারেটে টান দিয়ে ওটা সামনের উঠোনে ছুঁড়ে ফেলে জবাব দিলেন, ঠিক ভাবছি না, বার বার একটা কথা কেবল মনে আসছে—এসব কেন, ‘আমি কেন, আপনি কেন, এইরকম—

হাল্কা সুরে বললাম, শ্রীরামকৃষ্ণ তো বলে গেছেন সব ঈশ্বরকে জানার জন্য, সেটাই বিশেষ জ্ঞান আর বিজ্ঞান।…কিন্তু শুনেছি কর্মের শেষে এ-সব প্রশ্ন মনে আসে, আপনার এখনই মনে আসছে এটা ভালো কথা নয়—

আর একটা সিগারেট বার করে শলাইয়ের বাক্সে ঠুকছেন। মনে হলো এই মুহূর্তে উনি নিজের মধ্যে নেই। চোখের দৃষ্টি যেন সামনের অন্ধকারের ভিতর দিয়ে অনেক দূরের কোথাও উধাও। প্রায় মিনিটখানেক বাদে তেমনি বিমনার মতো সিগারেট ধরিয়ে বললেন, তার কিছু বাকি আছে, অন্তত সামনের বছরের গোড়ার দিক পর্যন্ত, দেখা যাক…

কি কথায় কি কথা! আমি কি বলেছি সে কি ওঁর কানে গেছে! উদ্‌গ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কিসের কিছু বাকি আছে, সামনের বছরের গোড়ার দিক পর্যন্ত কি?

আত্মস্থ হলেন আর হেসেও উঠলেন। বললেন, সামনের বছর গোড়ার দিকে আমার একটি কর্মের গাছে ফল ধরবে, সেটা বিষ ফল কি অমৃত ফল দেখা যাক। সেই টানে বাঁধা পড়ে আছি, তারপরে আর বোধহয় কল্যাণীকে আটকানো যাবে না। চলুন, ওদিকে যজ্ঞ শুরু হচ্ছে—আমার ভিতরটা কি-রকম দমে গেল। সবটাই দুর্বোধ্য লাগছে। তিনি কি অশুভ কিছু ইঙ্গিত করলেন? কোন্ ফলাফল দেখার পর কল্যাণীকে আর আটকানো যাবে না? আটকানো যাবে না মানেই বা কি?

সকলে যজ্ঞের সামনের উঠোনে জমায়েত হয়েছে। কেউ কেউ দাওয়ায় বসে। পেটো কার্তিক আমাদের জন্য দুটো চেয়ার এনে দাওরার অন্য ধারে পেতে দিল।

মৃদু-মন্ত্রপাঠের সঙ্গে সঙ্গে কল্যাণী কুণ্ডে আগুন দিলেন। বেলকাঠের ওপর ঘি ঢাললেন। আগুন বাড়তেই থাকল। আগুনের তাপে সামনের মেয়ে-পুরুষেরা সরে সরে যেতে লাগলেন। কিন্তু কল্যাণী ঠায় তাঁর আসনে বসে। আগুনের তাপে সমস্ত মুখ অগ্নি বর্ণ। মহিলা আমার কেন সকলের চোখেই এখন বোধহয় বড় বিচিত্র-রূপিণী। মন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে হোমাগ্নি ছড়াচ্ছেন, তপ্ত বাতাস সুগন্ধে ভরপুর। আমার ভয় হচ্ছে যজ্ঞের আগুনে কল্যাণীর সোনার বরণ অঙ্গ না জ্বলেই যায়। অবধূতের দিকে তাকালাম। তিনি নিরুদ্বিগ্ন, স্থির নিশ্চল।

না, আহুতি দেবার জন্য কল্যাণী সকলকে ডাকলেন না। নিজেই যজ্ঞকাষ্ঠ তুলে নিয়ে নিয়ে এক-একবার মেয়ে পুরুষদের দিকে চেয়ে নিজেই মঙ্গলাহুতি দিলেন। আর পেটো কার্তিককে ডেকে দিয়ে আহুতি দেওয়ালেন। পেটো কার্তিকের পর সুষমাকে দিয়ে। তারপর ওই দূর থেকে সোজা তাকালেন অবধূতের দিকে। উনি উঠলেন, এগিয়ে গেলেন। স্ত্রীর হাত থেকে যজ্ঞ-কাষ্ঠ হাতে নিলেন। আহুতি দিলেন। তারপরেও সেখানেই বসে রইলেন।

… অনুষ্ঠানের ব্যাপারটা এখানে বড় কিছু নয়, আমার মনে হলো এত—

গুলো মানুষের কোনো অদৃশ্য আবেগ মিলিত হয়ে অদ্ভুত নিটোলভাবে স্থির হয়ে আছে। কারো চোখে পলক পড়ছে না। সকলের দৃষ্টি ওই মহিলার আগুনের মতোই লালচে মূর্তির দিকে।

…একটা বেল-কাঁটা কল্যাণী নিজের কড়ে আঙুলের ওপর রেখে একটু জোরে টেনে নিলেন। অন্য আঙুল দিয়ে ওই আঙুলটা চেপে আহুতি বস্ত্রের ওপর ধরতে দেখলাম টপ টপ করে রক্ত পড়ছে। বেশ কয়েক ফোটা পড়ার পর একটা নারকেল তুলে সেই রক্তাক্ত আহুতি বস্ত্রে বেশ করে মুড়ে কুণ্ডের জ্বলন্ত আগুনের সামনে ঠেসে বসিয়ে দিলেন। পূর্ণাহুতি শেষে যজ্ঞকুণ্ডে গঙ্গাজল ঢেলে ধীর পায়ে তিনি আবার পুজোর ঘরের দিকে চললেন।

গেলবারের মতোই আরতি-পর্ব। কিন্তু আমার কাছে দু‘চোখ ভরে দেখার মতোই নতুন। পেটো কাতিক ঘরের আলোগুলো সব নিভিয়ে দিয়েছে। হল-ঘর আবছা অন্ধকার। দক্ষিণা কালীর সামনে দুটো প্রদীপের আলোয় কল্যাণীর মুখখানাই কেবল জ্বলজ্বল করছে। শুধু হাতের ওপর তুলোর প্রদীপ জ্বলে জ্বলে ছোট হচ্ছে, শঙ্খ-শুভ্র দুই সুঠাম বাহু মায়ের মূর্তির সামনে উঠছে নামছে ঘুরছে ফিরছে। এরপর তেমনি খালি হাতের চেটোয় কর্পূর জ্বালিয়ে কপূর-আরতি, বাঁ-হাতের ঘণ্টা বাজছে। তারপর তেমনি শূন্য হাতে চামর দোলানো আর হাতের শঙ্খমুদ্রায় শঙ্খ আরতি। শঙ্খমুদ্রা মুখে ঠেকিয়ে দীর্ঘ রবে তিনবার সত্যিকারের শঙ্খই বেজে উঠল যেন।

ভোর-ভোর। বিদায় পর্বে প্রায় সকলের চোখেই জল দেখেছি। কোটিপতি সারাওগিরা সকলেই কাঁদছেন। রতনলাল ঘন ঘন রুমালে চোখ মুছলেন। যাবার আগে আমার দুহাত ধরে বললেন, জীবন সার্থক হলো, বাবা দেওতা, মাতাজী দেবী…আপনি বাবার পেয়ারের বন্ধু, আপনিও ভাগ্যবান। চোখে জল সুষমার কাকা-কাকীমাদেরও দেখেছি।

অবধূতের অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব ভাগ্যের কথা সেটা এখন বিশ্বাস করি। কিন্তু এই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল ভাগ্যের থেকে অনেক দূরে সরে আছি। সহজ মানুষ সহজ বিশ্বাসে মাতোয়ারা হয়, অনায়াস সমর্পণে আত্মশুদ্ধি করে নিতে পারে। সেটা সাময়িক হলেও অনন্তকালের সূচ্যগ্র অংশ তো বটে। কিন্তু আমার কি দশা। স্বতঃস্ফুর্ত বিশ্বাস দূরের বস্তু, সমর্পণ কাকে বলে জানি না।

মাতাজী কল্যাণী কি ভিতর দেখতে পান? তিনি বলেছিলেন সংশয় আহুতি দেবেন। নিজের স্বামী অবধূতকেও তাই বলেছিলেন। কিন্তু কোথায় অবধূত আর কোথায় আমি!

আমাদের যাওয়া দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর। নিরিবিলিতে পেয়ে এর মধ্যে বারকয়েক অবধুতকে জিজ্ঞাসা করেছি, কাল রাতে আপনি কৰ্ম, কর্ম ফল দেখা, তারপর আর কল্যাণীকে আটকানো যাবে না—এ-সব কি বলছিলেন?

হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন। একবার বলেছেন, কাল রাতে মাল কতটা পেটে পড়েছিল সে খেয়াল আছে আপনার?

শেষে মিনতি করে বলেছি, শুধু এ-টুকু বলুন, অশুভ কিছু নয় তো? —অশুভ! জোরেই হেসে উঠেছেন।—আরে মশাই, কোনো অশুভ কল্যাণীর ত্রি-সীমানায় ঘেঁষে না, বুঝলেন? ঘেঁষলেও তার দায় এখনো তাঁর শিবঠাকুর কংকালমালী ভৈরবই নিজের হাতে তুলে নেন—এ আমার প্রত্যক্ষ করা সত্য—আপনি নিশ্চন্ত থাকুন।

…মানুষ চাঁদে যাচ্ছে, দূর-নীরিক্ষে যাবার জন্য মহাকাশ স্টেশন স্থাপন করেছে—এ-যুগ বিজ্ঞানের জয়-জয়কারের যুগ। কিন্তু পৃথিবীর কোণে কোণে অনন্তকাল ধরে আত্ম-দর্শনের এই যে সাধনা চলেছে—এ-ও বিজ্ঞান বা বিশেষ জ্ঞান নয় বলে তো মন থেকে ছেঁটে দিতে পারছি না!

এই দুই জ্ঞান থেকেই আমি অনেক দূরে পড়ে আছি। প্রথমটার জন্যে মনে কোনো খেদ নেই কিন্তু দ্বিতীয়টার জন্য এক ধরনের অগোচরের অস্থিরতা আর অসহায়-বোধ কেন?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *