চারদিনের দিন ঘুম থেকে উঠেই অবধূত ঘোষণা করলেন, পার্বতী আজ সকালের গাড়িতেই ছেলে নিয়ে আসছে— চলুন স্টেশনে যাই। আজ আসার সম্ভাবনা আমিও জানি। তবু বললাম, আজ না এসে কালও তো আসতে পার?
—না, আজই সে আসবে।… পার্বতীকে বলে দিয়েছিলাম ছেলে-পেলে তারকেশ্বরে পুজো দেবার জন্য সেইদিনই কলকাতা রওনা হতে, আমি এখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করব। অবহৃত হাসতে লাগলেন, আমার নয়, পার্বতীর ভাবার কথা আমার মুখ দিয়ে সে বাবা তারকনাথেরই হুকুম শুনেছে। চলুন দেখাই যাক।
এসেছে। গেলবারে পার্বতীর সঙ্গে ছিল একজন পরিচারক আর পরি চারিকা। এবারে তারা ছাড়াও পার্বতীর হাতে ধরা বছর পাঁচেকের একটি ফুটফুটে ছেলে : তারই হারানো ছেলে রাহুল। তাদের সঙ্গে আর যে দুজন সুশ্রী মেয়ে পুরুষ, দেখেই বুঝলাম, তারা লাজবন্ত। আর অনন্তরাম। তাদের সঙ্গে আট থেকে দশ বছরের মধ্যে দুটি ছেলে আর একটি মেয়ে।
অনন্তরাম-লাভবটার সেই পালিত তিন ছেলে-মেয়ে। দেখামাত্র আমারও মনে হলে। তারা সত্যিকারের বাবা-মা হতে পেরেছে।
দূর থেকে রক্তাম্বর বেশে অবধূতকে দেখামাত্র পার্বতী ছেলের হাত ধরে ছুটে এলো। তারপর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মেই অবধূতের পায়ের ওপর আছড়ে পড়ল। হাসছে, কঁাঁদছে, পায়ে চুমু খাচ্ছে। স্টেশনের মানুষেরা হাঁ হয়ে দেখছে।
আর অবাক বিস্ময়ে তার দিকে চেয়ে আছে লাজবন্তী আর অনন্তরামও। স্টেশনে ভিড় জমে যাচ্ছে দেখে অবধূত সেখানে আর একটি কথাও বললেন না। সকলকে নিয়ে যে-বাড়িতে আমরা আছি সেখানে এলেন!
পার্বতীর ছেলে রাহুল তাঁর কোলে।
এক ঘণ্টার মধ্যে আমরা সকলে আবার তারকেশ্বরের মন্দিরে। এত সকালে লোকের ভিড় খুব বেশি না হলেও একেবারে কমও নয়। কিন্তু এই সকালে আমার মনে হলো দেবতার পুজো শুধু কয়েকজনের। পার্বতীর আর লাজবন্তীর। আর তাদের চার ছেলেমেয়েদেরও হয়তো। সকলেই তারা দুধকুণ্ডে স্নান করেছে। তারপর পার্বতী ভিজে কাপড়ে সেই আগের বারের মতো দণ্ডি কেটে-কেটে উঠে আসছে! তার পিছনে রাহুল মা যা করছে সে-ও তাই করছে। তার পিছনে দণ্ডি কেটে আসছে লাজবন্তী। তারপর তার দুই ছেলে আর মেয়ে। সকলের পিছনে অনন্তরাম। দণ্ডি কেটে মন্দির প্রদক্ষিণের এমন উৎসব বেশি দেখা যায় কিনা জানি না। দু‘চোখ ভরে দেখছি। দণ্ডি কাটতে কাটতেই পার্বতী কেঁদে ভাসাচ্ছে। কিন্তু মানুষের কান্না এত সুন্দর এত আনন্দের হতে পারে তা-ও কি জানতাম?—ঠাকুর দেবতা জানি না। বিশ্বাস কাকে বলে তাও অন্তর থেকে জানি না। দু‘চোখ ভরে কেবল দেখেই যাচ্ছি। একটা আনন্দের ডেলা থেকে থেকে গলার কাছে ঠেকছে।
অনাড়ম্বর ঘটার মধ্যেই প্রদক্ষিণ আর পুজো শেষ হলো।… পার্বতীর কৃতজ্ঞ ঘন দক্ষিণে মন্দিরের পাণ্ডা আর পুজারীর দল সকলে খুশি। খুশির জোয়ার মন্দির এলাকার সমস্ত ভিখিরির মুখেও। কাচ্চা বাচ্চা ছোট বড় মেয়ে পুরুষ প্রতিটি ভিখিরির হাতে একটা করে দশ টাকার নোট আনা সম্ভব নয়, ভিখিরির সংখ্যা শ আড়াই তিনের কম হবে না।
কিন্তু ফেরার সময় লাজবন্তী আর অনন্তরাম নড়ে না। কাউকে দেখতে পাওয়ার আশায় তারা চারদিকে তাকাচ্ছে। আগেও তাদের অনুসন্ধিস্থ চোখ এ-দিক ও-দিকে ঘুরতে দেখেছি। চুল ছাটা দাড়ি গোঁফ কামানো সিস্কেক রক্তাম্বর বেশ-বাশ পরা অবধূতকে দেখে তারা কৌপিন-ধারী ভস্মমাথা নগ্নদেহ জটাজট বোঝাই শ্মশানঘাটের সাধুকে চিনবে কি করে? ঘরে ফিরে জানার পরেও চেনা কঠিন। বিশ্বাস করাও। লাজবন্তী বা অনন্তরাম শুধু নয়, প্রচণ্ড বিস্ময়ে স্তব্ধ পার্বতীও। অবধুত হেসে ডান হাত উল্টে অনন্তরাম আর লাজবন্তীর দিকে বাড়িয়ে দিয়েছেন।-ভোল বদলালেও বেনারসীলালের চুরির দাগ এই হাত থেকে কোনো দিন মিলাবে না — নিজের হাতে শুশ্রূষা করেছ—এই দাগটা মনে করতে পারছ?
ভাবাবেগের পরের প্রতিক্রিয়া পাঠকের অনুমান সাপেক্ষ।
পরিবেশ আবার সহজ খুশিতে ভরে উঠতে পার্বতী বলে উঠল, কমলাগঙ্গার শশ্মশানঘাটে আপনিই তাহলে আমাদের বিয়ে দিয়েছিলেন।… আজ চার বছর ধরে আমি নানা তীর্থস্থানে ঘুরে ঘুরে আপনাকে কত খুঁজেছি —বছরের মধ্যে প্রায় ছ’মাস করে আমার আপনার খোঁজে কেটেছে— কিন্তু আপনি দয়া করে চিঠি দিয়ে আমাকে তারকেশ্বরে আসতে বললে আমি তো সামনা-সামনি দেখেও আপনাকে চিনতে পারতাম না।
শুনে অবধূত বেশ অবাক।—চার বছর ধরে নানা তীর্থে ঘুরে আমাকে খুঁজেছ—কেন?
সকলেই শুনলাম কেন।… পার্বতীর সন্তান হওয়ার এক বছরের মধ্যে খুনের দায়ে বেনারসীলালের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়ে যায়। যে দাইয়ের হাতে রাহুল হয়েছে সেই পুনিয়ার মা খুব মানসিক চাপে ভুগছিল। সে-ই পার্বতীর পরিচারিকা জানকীবাঈকে সব ঘটনা বলেছে। ওই ঘটনার পরদিনই সে শ্মশানে গেছল। সেখানে তখন সাধুও নেই, পার্বতীর ছেলে ও নেই। তাই তার বিশ্বাস সাধু মরেনি— ছেলেও তার কাছেই।… এরপর অনেক চেষ্টা করে পার্বতী জেলে বেনারসীলালের সঙ্গে দেখা করেছে। ছেলে বেঁচে আছে কিনা তাও সে জানে না, কিন্তু ঘটনার কথা অস্বীকার করেনি।
…সেই থেকে পার্বতী কমলাগঙ্গা ঘাটের সাধুকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। আর মনে প্রাণে বিশ্বাস করেছে তার ছেলে বেঁচে আছে—কোনো একদিন তাকে পাবেই।… মহারাজের চিঠি পেয়ে তাই একটুও অবিশ্বাস করেনি। এতদিনে ঈশ্বরের দয়া হয়েছে ভেবে ছুটে এসেছে। এসে ছেলে পেয়েছে।
কলকাতায় নিজের বাড়িতে নয়, পেটো কার্তিক আর অবধূতের সঙ্গে কোনগরের বাড়ি এসেছি। ভদ্রলোকের সঙ্গ ছাড়তে ইচ্ছে করছিল না। পরে মনে হয়েছে, সত্যিই কি নিজের ইচ্ছেয় এসেছি—না কি, অবধূত যে বলেন, কে ঘটায় কে সাজায়—এই আসার পিছনেও তেমন কারো হাত ছিল?—তা না হলে যে-চিত্রটা সম্পূর্ণ হয়েছে ভাবছিলাম, না এলে সেটা যে কত অসম্পূর্ণ থেকে যেত তা কি আমার কল্পনার মধ্যে ছিল?
অবধূত বোতল গেলাস বার করে বসেছিলেন। হেসে বলছেন, ড্রিংক মানুষের সং-সত্তা টেনে বার করে, এই রাতটা পার্বতী তার ছেলে, আর লাজবন্তী অনন্তরাম আর তাদের ছেলে-মেয়ে অ্যাণ্ড কোম্পানীর জন্য সৎসত্তা দিয়ে শুভেচ্ছা কামনার রাত—কি বলেন?
আমি সানন্দে সায় দিয়েছি, নিশ্চয়ই!
কল্যাণী দেবী মাঝে মাঝে এসে মুখরোচক এটা-সেটা সরবরাহ করে যাচ্ছেন। পেটো কার্তিক বাবার সেবার অছিলায় পা টিপছে — আসলে তার দু‘কান আর মন আমাদের কথাবার্তা গিলছে।
অবধূত প্রস্তাব করলেন, ওরা এত করে বলল, সকলে মিলে একবার কাঁকুড়ঘাটি যাওয়া যাক—কি বলেন?
আমি বললাম, অবিলম্বে প্রোগ্রাম করে ফেলুন—আমি এক পায়ে দাঁড়িয়ে।…কিন্তু বিহারের মাঝপথের স্টেশনে পোলাও-মাংস কালিয়া যোগান দেবার মতো আপনার ভক্ত আছে তো?
পেটো কার্তিকের মন্তব্য, ওরা তো নিরামিষ ভক্ত, তিন ঘণ্টার নোটিস পেলেও ও-সবের ব্যবস্থা আমিই করে নিয়ে যেতে পারব।
তারকেশ্বরে পার্বতী আর লাজবন্তীর গ্রুপকে নিরানিষ খেতে দেখেছে পেটো কার্তিক। তাই অরুচি।
একটা থালায় মাংসের বড়া নিয়ে এলেন কল্যাণী দেবী। আমি বলে উঠলাম, বা-বা—ভোজনটাও এক অপূর্ব সাধনার অঙ্গ আগে জানতাম না।
কল্যাণী হাসিমুখে জবাব দিলেন, এটা ওঁর আর পেটো কার্তিকের সাধনার অঙ্গ-সকলের নয়।
থালা রেখে চলে যাচ্ছিলেন, বাধা দিলাম— আচ্ছা, এই যে এতবড় একটা ব্যাপার ঘটে গেল—এ-সম্পর্কে আপনি কিছু আলোকপাত করুন।
সহজ জবাব, এ-রকম ঘটনা ঘটবে এ-তো পাঁচ বছর আগেই জানা ছিল।…এতে কার কি বাহাদুরি?
কারো নয়?
—কেউ কেউ ভাবতে পারেন তাঁর বাহাদুরি আছে। কিন্তু যিনি ঘটালেন আর ঘটনার শেষ করলেন তিনি হাসছেন।
—কে ঘটালেন? ঈশ্বর?
—আর কে? আর কার ক্ষমতা? চলে গেলেন।
আমি বিশ্বাস করি বা না করি, বিশ্বাসের ভারী একটা সুন্দর রূপ অনেক দেখেছি।…কালও পার্বতীর মুখে দেখলাম। লাজবন্তী আর অনন্তরামের মুখে দেখলাম।—পেটো কার্তিকের মুখেও বিশ্বাসের এক কমনীয় রূপ দেখেছি। কিন্তু কল্যাণী দেবীর সংশয়শূন্য এই সহজ বিশ্বাসের বোধ করি তুলনা নেই। তার এই রূপের দিকে তাকালে মনে হবে, এ-বিশ্বাস ভিন্ন জগতে আর কোনো সত্যের অস্তিত্ব নেই।
—যে-কথাগুলো বলে গেলেন তাতে স্বামীর প্রতি ঠেস ছিল। কিন্তু অবধূতের দিকে চেয়েও বিশ্বাসের আর এক রূপ আমি একাধিকবার দেখেছি। এই মুহূর্তে হরিদ্বার থেকে ফেরার পথে ট্রেনে তাঁর সেই গভীর কথাগুলো আমার হুবহু মনে পড়ল। বলেছিলেন, ‘আমার চোখে এই জগতের সব-কিছুই বড় আশ্চর্য লাগে। জন্ম মৃত্যু সৃষ্টি ধ্বংস সবই যেন কেউ সাজিয়ে সাজিয়ে যাচ্ছে। মানুষ থেকে শুরু করে সমস্ত প্রাণীর এমন বায়োলজিকাল পারফেকশন কি করে হয়-কে করে? একটা ফুলের বাইরে এক-রকম রঙ ভিতরে এক-রকম, পাপড়ির গোড়ায় এক রঙ, মাথার দিকে অন্য-রকম—এমন নিখুঁত বর্ণ বিন্যাস কি করে হয়—কে করে? .. বলেছিলেন, ‘আপনারা লেখেন, কতটা দেখেন আপনারাই জানেন। আমি শুধু ঘটনা দেখে বেড়াই, যা দেখি তা কোনো বইয়ে পাই না, কোনো চিন্তায় আসে না। যেখানে যাই, দেখি কিছু না কিছু ঘটনার আসর সাজানো—
পরে মনে হয়েছে আমি নিজের ইচ্ছেয় আসিনি, কিছু ঘটবে বলেই আসার টান পড়েছে—আমার কিছু ভূমিকা আছে বলেই আমায় সেখানে গিয়ে হাজির হতে হয়েছে—এমন কেন হয়, কি করে হয় বলতে পারেন? আমি বিশ্বাস করি বা না করি, বিশ্বাসের এই কথাগুলো আমার মনে খোদাই হয়ে বসে গেছে।
—হঠাৎ মনে হলো, শান্তিই যদি এই জীবনের পরম প্রাপ্তি, আমি তার কতটুকু পেয়েছি? এই শান্তির পথ বিশ্বাসের পথ। এই পথ-যাত্রীদের তো কম দেখলাম না। সকলেই শান্ত, প্রসন্ন, কমনীয়। অন্তত আমার তা-ই মনে হয়।
বলে ফেললাম, আমাকে একটু পথ দেখান—
—তার মানে? কি পথ?
—বিশ্বাসের পথ, শান্তির পথ।
অবধূত চুপচাপ মুখের দিকে চেয়ে রইলেন একটু। বললেন, শান্তি জিনিসটা যার-যার মনের কাঠামোর ওপর নির্ভর করে।…কিন্তু কোন্ বিশ্বাসের কথা বলছেন?
—আপনাদের যা বিশ্বাস। ঈশ্বরে বিশ্বাস।
আবার খানিক চেয়ে রইলেন। তারপর হাসতে লাগলেন। বললেন, শুনুন, আমার স্ত্রীকে দেখে আমার বিচার করবেন না। আমার মতো টানাপোড়েনের মধ্যে দুনিয়ায় কতজন আছে জানি না।… অনেকে চোখ বুজে বিশ্বাস করে ঈশ্বর আছে। অনেকে চোখ বুজে অবিশ্বাস করে, ঈশ্বর নেই। ঈশ্বর আছে কি নেই —এই সন্ধান কত জনে করে?
অবধূতের দু‘চোখ মনে হলো কোথায় কোন্ দূরে উধাও। গলার স্বরগভীর। বললেন, আমি করি। করছি।… ঘটনার সাজ দেখে দেখে প্রশ্ন করি, কে ঘটায়? কেন ঘটে? কে সাজায়? কে করে? জবাব পাই না। আমি খোঁজ করছি। খুঁজে যাচ্ছি। ঈশ্বর আছে কি নেই আমি আজও জানি না।
আমি নির্বাক বিমূঢ় চোখে চেয়ে আছি।