সৃষ্টিতত্ত্ব (আদিম কাল থেকে মানুষের বিবরণ)

সৃষ্টিতত্ত্ব (আদিম কাল থেকে মানুষের বিবরণ)

যেদিকে সূর্য্য উদয় হয়, সেদিকেই মানুষের জন্ম হয়েছিল। সৰ্ব্ব-প্রথমে কেবল জল ছিল। কিছুদিন পরে পরমেশ্বর কাঁকড়া, হাঙ্গর, কুমীর, রাঘব-বোয়াল, বড় ‘ইচা’ মাছ, কেঁচো, কচ্ছপ প্রভৃতি জলচর জন্তু সৃষ্টি করেন। তারপর “ঠাকুর” (ঈশ্বর) বললেন, “এখন আর কি সৃজন করিব? এবার মানুষ সৃজন করিব।” এই ব’লে তিনি মাটির দুটি মূর্ত্তি সৃষ্টি করলেন; সেগুলিতে তিনি প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে উদ্যত হ’লে আকাশ থেকে একটি দিব্য ঘোটক নেমে এসে উহাদিগকে পদদলিত করে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে চলে গেল। সেজন্য ঠাকুর অত্যন্ত দুঃখিত হলেন। তারপর ঠাকুর বললেন, “এবার মাটির তৈরি করব না, এবার পাখী তৈরি করব।” এই বলে তিনি “হাঁস-হাঁসিল” নামক দুটি পার্থী নিজের বক্ষঃস্থল উন্মোচন করে সৃষ্টি করলেন এবং তাদের হাতে বসালেন; তাহাতে তাহাদের অতি সুন্দর দেখাল। তারপর তিনি ফুঁ দিয়ে তা’দের জীবন দিলেন; এরাও আকাশে উড়ে গেল এবং উড়ে উড়ে আকাশে বেড়াতে লাগল; ঠাকুরের হাতে এসে বসল। কোথায়ও বসবার স্থান না পেয়ে এরা তারপর দিব্য ঘোটক জলপান করবার জন্যে অতি সুন্দর সূক্ষ্ম সূতায় নেমে এল, জলপান করবার সময় মুখের ফেণা ফেলে গেল; জলেতে সেই ফেণা ভাসতে লাগল; সেই হতে জলেতে ফেণার সৃষ্টি।

তারপর ঠাকুর পাখী দুটিকে বললেন, “এবার তোমরা ফেণার উপরে গিয়ে বস;” তারাও ফেণার উপরে গিয়ে বসল এবং ‘গোটা’ সমুদ্রে ভেসে বেড়াতে লাগলো; ফেণা একখানা জাহাজের মত এদের নিয়ে এদিক সেদিক ঘুরতে আরম্ভ করল। আরপর তারা ঠাকুরকে বলল, “আমরা বেড়িয়ে বেড়াচ্ছি। খেতে ত পাচ্ছিনা।”

তারপর ঠাকুর কুমীরকে তলপ দিলেন; কুমীর হাজির হয়ে ঠাকুরকে বলল, “আমাকে কেন ডেকেছেন ঠাকুর?” তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “মাটি তুলতে পার?” কুমীর বলল, “আপনি হুকুম করলে পারি;” এই বলে জলে নেমে মাটি তুলতে লাগল, কিন্তু সব মাটি গ’লে গেল।

তারপর ঠাকুর ‘ইচা’ মাছকে ডাকালেন; ‘ইচা’ মাছ হাজির হয়ে ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করলে, ঠাকুর, আমাকে কেন ডেকেছেন?” ঠাকুর জিজ্ঞাসা করলেন, “মাটি তুলতে পারবে?” ইচামাছ উত্তর করলে “আপনি বললে তুলতে পারি;” এই বলে জলে নেমে গিয়ে মাটি তুলতে লাগল, কিন্তু সব মাটি গ’লে গেল।

তারপর ঠাকুর রাঘব-বোয়ালকে তলব দিলেন; সে এসে হাজির হয়ে ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করলে, “ঠাকুর, আমাকে কেন ডেকেছেন?” তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “মাটি তুলতে পার?” রাঘব-বোয়াল জবাব দিল, “আপনি বললে তুলতে পারি।“ জলে নেমে মাটি কামড়িয়ে কতক মুখে ও কতক পিঠে আনছিল, কিন্তু সব মাটি গ’লে গেল। (সেই সময় হইতে বোয়াল মাছের পিঠে আঁস নাই।)

তারপর ঠাকুর পাথর-কাঁকড়াকে তলব দিলেন; সে এসে হাজির হ’য়ে জিজ্ঞাসা করলে, “ঠাকুর আমাকে কেন ডেকেছেন?” ঠাকুর জিজ্ঞাসা করলেন, “মাটি তুলতে পারবে?” কাঁকড়া উত্তর করল, “আপনি বললে তুলতে পারি; এই বলে জলে নেমে মাটি কামড়ে আনছিল, কিন্তু সমস্ত মাটি গ’লে গেল।

তারপর ঠাকুর কেঁচোকে ডাকল; কেঁচো হাজির হয়ে জিজ্ঞাসা করলে, ‘ঠাকুর, আমাকে কেন ডেকেছেন?” ঠাকুর বললেন “মাটি তুলতে পারবে?” কেঁচো বললে “আপনি বললে তুলতে পারি, কিন্তু কচ্ছপের জলের উপর দাঁড়িয়ে থাকা চাই।”

তারপর ঠাকুর কচ্ছপকে ডাকালেন, কচ্ছপ এসে হাজির হ’য়ে জিজ্ঞাসা করলে, ‘ঠাকুর আমাকে কেন ডেকেছেন?” ঠাকুর বললেন, “দেখ, কেউই মাটি তুলতে পারেনি; কেঁচো মাটি তুলতে স্বীকার হয়েছে যদি তুমি জলের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে পার।” কচ্ছপ বললে, “আপনি হুকুম দিলে থাকতে পারি।” কচ্ছপ জলের উপর স্থির হয়ে দাঁড়াল; ঠাকুর তার চারি পায়ে চারি কোণে শিকল দিয়ে বাঁধলেন, এবং কচ্ছপ একেবারে স্থির হ’য়ে জলের উপর দাঁড়াল। আর কেঁচো মাটি তুলতে নেমে গিয়ে মাটির লাগাল পেল। সে কচ্ছপের উপর লেজ রেখে দিল এবং মুখ দিয়ে নীচে মাটি খেতে লাগল আর উপরে কচ্ছপের পিঠে মাটি বে’র করে দিতে লাগল, মাটিগুলি সরের মত বসে গেল; এই রকম ভাবে তুলতে তুলতে গোটা পৃথিবী ভরে গেল, তারপর সে থামল।

তারপর ঠাকুর মই দিয়ে মাটি সমান করে দিলেন; সমান করতে করতে যে ভাগ উঁচু রহল, তাই পৰ্ব্বত হ’ল। মাটি উঠান ও সমান হ’লে পর জলের উপরে ভাসমান ফেণা উহাতে “লটকে” গেল; আর এই ফেণাতে ঠাকুর বেনার বীজ বুনে বেনাগাছই প্রথম সৃষ্টি করলেন। বেনা গাছের পর তিনি দুৰ্ব্বাঘাস জন্মালেন, দুর্ব্বাঘাসের পর কড়মগাছ, তারপর শালগাছ, আসনগাছ, বক্র মউলগাছ, আর যতরকম গাছ সব সৃষ্টি করলেন। পৃথিবী শক্ত হয়ে উঠল; যেখানে যেখানে জল ছিল সেখানে চাপা দিলেন, আর যেখানে জল ভেদ করে উঠছিল, সেখানে পাথর চাপা দিয়ে বন্ধ করলেন।

তারপর বেনাঝোপে পাখী দুটি বাসা নিয়ে দুটি ডিম প্রসব করল; মাদীটি ডিমে তা দিতে লাগল; আর নরটি খাবার খুঁজে আনে। এই ভাবে দুটি ডিম হ’তে দুটি বাচ্চা হ’ল; ওমা! দুটি মানুষ জন্মাল, একটি ছেলে একটি মেয়ে! তখন পাখী দুটি গান ধরল;—-

হায়, হায়, জালাপুরীতে, (সমুদ্রে)
হায়, হায়, এই মানুষ দুটি
হায়, হায়, জন্মেছে!
হায়, হায়, এই দুটিকে,
হায়, হায়, কোথায় রাখব।
হায়, হায়, দাও ব’লে দাও,
হায়, হায়, ঠাকুর বলে দাও,
হায়, হায়, এই যে জন্মেছে,
হায়, হায়, এ দুটি মানুষ,
হায়, হায়, কোথায় রাখব।

তারপর তারা ঠাকুরকে মিনতি করে বললে, “কি করে আমরা এই মানব শিশু দুটিকে প্রতিপালন করব?” ঠাকুর তাদের তুলো দিয়ে বললেন, “তোমরা যে যে জিনিষ খাও, তাহার রস নিংড়ে তুলাতে ভিজিয়ে এদের মুখে চুষতে দিও।” এই প্রকারে চুষে খেতে খেতে শিশুদুটি বড় হয়ে হাঁটতে শিখল। তাদের বয়সবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পাখী—দুটিরও ভাবনা বাড়তে লাগল—”বড় হ’লে এদের কোথায় রাখব?”

তারপর তারা আবার ঠাকুরের কাছে কাকুতি মিনতি করায় ঠাকুর বললেন, “এদের বাসস্থান ঠিক করতে উড়ে চলে চাও।” তারা যেদিকে সূর্য্য অস্ত যায় সেদিকে উড়ে চলে গেল এবং “হিহিড়ি পিপড়ি” নামক একটি স্থান পেল। ফিরে এসে তারা ঠাকুরকে খবর দিল; ঠাকুরও বললেন, “সেদিকেই নিয়ে যাও।” তারপর তারা পিঠে করে ব’য়ে এদের সেখানে নিয়ে রেখে দিলে। “হাঁস-হাঁসিল” কোথায় গেল প্রাচীন সাঁওতালেরা এ বিষয়ে কিছু বলে যায় নাই। সেজন্য আমরাও জানি না।

এই দুটি আদি মানুষের নাম “হারাম” বুড়ো আর “আয়ও” বুড়ী; ইহাদিগকে কেহ কেহ “পিলচু-হারাম” আর “পিলচু বুড়ী” ও বলে থাকে। হিহিড়ি পিপড়িতে এরা “সুমতুবুক” ঘাসের দানা ও সামঘাসের শিষ খেয়ে খেয়ে বাড়তে লাগল। তাদের কোন আচ্ছাদন না থাকায় উলঙ্গ হয়ে থাকৃত; তবুও তাদের কোন লজ্জা ছিল না, আর তারা বেশ শান্তিতে ছিল।

মানুষের প্রথম পাপে পতন বিষয়

একদিন লিটা (সয়তান) এসে এদের বললে, “ওহে নাতি, কোথায় গেলে, কেমন আছ? আমি তোমাদের ঠাকুর দাদা, তোমাদের দেখতে এসেছি। দেখছি, তোমরা ভালই আছ, কিন্তু তোমরা একটি বড় আমোদ ভোগ করতে পারছ না; তোমরা ‘হাঁড়ি’ (মদ) তৈয়ার করে খাও, সে ভারি মিষ্টি।” এই বলে তাদের বাখর তৈরি করতে শিখিয়ে দিল। তারপর তিন জনেই বনে চলে গেল। লিটা তাদের মুল দেখিয়ে দিল, আর তারা মূল খুঁড়ে নিয়ে এল। মূল আনার পর লিটা পিলচু-বুড়ীকে বল্‌ল, “তুমি আমাদের জন্য চাল ভিজিাও।” সে চাল ভিজাল; চাল ভিজায়ে গুঁড়ি কুটল; তারপর মূলগুলিকে পিষে রস নিংড়ে গুঁড়ির সঙ্গে মিশাল; মিশিয়ে গুলি করল; গুলি ক’রে খড় দিয়ে ঝুড়িতে ভরে রেখে দিল। ভোর হলে পর যে সময়ে তারা গুলি করেছিল ঠিক সেই সময়ে তারা গুলিগুলো খুলল; খড়গুলি ফেলে দিল; আর কূলোতে মেলে শুকাতে দিল; মেলাতে শুকিয়ে গেল; তারপর ঘরের ভিতর রেখে দিল। তারপর ঘাসের দানা ও শীর্ষ একত্র করে কুটল ও চাল সিদ্ধ করে ভাত রান্না করল; ভাত ঠাণ্ডা করল; ঠাণ্ডা করে সেই বাখরের সঙ্গে মিশিয়ে দিল; তারপর সেগুলো জমা করে পাতা দিয়ে বেঁধে রাখল। পাঁচদিন পরে সেগুলো সিদ্ধ হল। সন্ধ্যার সময় জল ঢেলে দিল। তারপর লিটা বললো “এবার তোমরা তোমাদের প্রধান ঠাকুরের নামে কিছু উৎসর্গ করে পান করে ফেল; আমি আবার কাল আসব।”

পরে তারা দুজনে তিনটি পাতার বাটি বানাল; তিনটি বাটিতে মদ পূর্ণ করে এক বাটি তাদের দেবতার নামে উৎসর্গ করল, আর দু’বাটি তারা নিজেরা পান করে ফেলল। পান করতে করতে দুইজনে আমোদ—আহ্লাদ করতে লাগল; এই রকম ঠাট্টা তামাসা ও আমোদ প্রমোদ করতে করতে হাঁড়ি (মদ) পান করে সব শেষ করল, ও খুব মাতাল হ’য়ে পড়ল। রাত্রি হ’ল আর দু’জনে এক সঙ্গে ঘুমাল। রাত্রি প্রভাত হলে পর লিটা এসে এদের ডেকে বলল, “ওহে নাতিরা, জেগেছ কি? এখন বেরিয়ে এস।” তারা জেগে নিজেদের উলঙ্গ দেখে অত্যন্ত লজ্জিত হ’য়ে উত্তর করল, “ওগো, ঠাকুর দা, কি ক’রে আমরা বে’র হ’তে পারি? আমাদের বড় লজ্জা বোধ হচ্ছে; এখনও আমরা উলঙ্গ; কালরাত্রে হাঁড়ি খেয়ে মাতাল হ’য়ে কি কুকাজই করেছি!”

[বাইবেলের লিখিত আদম ও ইভের গল্প মনে করুন; এই ভাবে মানুষ প্রথম পাপ করতে শুরু করে। ]

তারপর লিটা তাদের বলল “কিছু ভেবো না” এবং মুচকি মুচকি হেসে চলে গেল। পিলচু-হারাম ও পিলচু বুড়ী বটগাছের পাতা দিয়ে নিজেদের শরীর ঢেকে লজ্জা নিবারণ করল। এদের আবার ছেলেপিলে হ’ল—সাতটি ছেলে সাতটি মেয়ে। বড় ছেলের নাম হ’ল “সান্দ্রা”; তার ছোটটির নাম হ’ল “সান্ধম”; তার ছোটটির নাম “চারে”; তারপরটির নাম “মানে”; আর সকলের ছোটটির নাম হ’ল “আচারে ডেলহু”; বড় মেয়ের নাম হ’ল “ছিতা”, তারপরটির “কাপু”; তারপর “হিসি” আর একটির নাম “ডিমনি”। অবশিষ্ট কয়জনের নাম আমরা ভুলে গেছি।

ক্রমে তারা একত্রে বাস করে যোগ্য হল। হারামবুড়ো ছেলেদের—নিয়ে একদিকে শিকার করতে চলে যায়। আর বুড়ী মেয়েদের নিয়ে শাকপাতা তুলতে অন্য দিকে যায়; সন্ধ্যার পর সকলে ঘরে ফিরে একত্রিত হয়। একদিন ছেলেরা একা “খানদেরার” বনেতে শিকার করতে যায়, আর মেয়েরা একেলা “সুড়ুকু” বনে শাক পাতা তুলতে যায়; তুলতে তুলতে মেয়েরা ক্লান্ত হ’য়ে চাপাকিয়া বটগাছের নীচে বেরিয়ে পড়ল এবং গাছের “ব”তে ঝুলে ঝুলে খেলতে লাগল, আর তাহারা নাচতে আরম্ভ করল। তারপর গান ধরল :—-

পিপ্‌ড়ে পিপ্‌ড়ে যেমন পাল্‌কে পাল হয়, মাগো,
চাপাকিয়া-বটের নীচে ডালেতে পাল্‌কে পাল, আমরা গো।

যুবকেরা শিকার করতে করতে ক্লান্ত হয়ে একটা “বরবিন্দি হরিণ” সঙ্গে নিয়ে আসছিল; যুবতীদের গান শুনে বললে “ওরে, শুনরে শুন, কারা গান গাইছে!” আর হরিণটিকে ছেড়ে দিল, তারা মেয়েদের নিকট এসে তাদের সঙ্গে খেলতে লাগল। খেলতে খেলতে খুব আমোদ সুরু করল; বড়ছেলে বড়মেয়েকে আর ছোট ছেলে ছোট মেয়েকে বেছে নিল। আর সকলেও সেরূপ বেছে নিল। তারপর, বড়ছেলে ও বড়মেয়ে হরিণ দেখতে চলে গেল; তখন বাকী কয়জনে গান ধরল :—

বটগাছের নীচেতে হরিণ শিশু,
মাগো, দেখ, ‘বয়বিন্দ’ হরিণ শিশু।

তারপর নিজেরা নিজেরা জোড়া হ’য়ে গেল। এইসব দেখে বুড়োবুড়ী বললে, “এরা নিজে নিজে আসক্ত হয়ে পড়েছে, এদের এখন বিয়ে দেওয়া যাক।” একখানা ঘর তৈরি করে তারমধ্যে সাতটি কামরা করলে; কামরাতে হাঁড়ি (মদ) রেখে দিল; ছেলেমেয়েরা সকলেই হাঁড়ি পান করল; পান করার পর হারাম-বুড়ী সতিকামরার এক এক কামরায় তাদের এক এক জোড়া রেখে দিল – বড়ছেলে বড়মেয়ের সঙ্গে, ছোট ছেলে ছোটমেয়ের সঙ্গে, এই রকম সকলকে; এইভাবে তাদের বিবাহ হ’য়ে গেল।

তারপর এদের ছেলেপিলে হ’ল। এই রকমে বংশবৃদ্ধি হ’তে লাগল। তাতে হারামবুড়ী বলল, “যখন কেউ ছিলনা, তখন আমরা জুটি কেবল জুড়ী হয়েছিলাম; তারপর সাত ছেলে সাত মেয়ের জন্ম দিয়ে বংশবৃদ্ধি করলাম; এদের ভাইবোনে বিয়ে দিয়েছি; এবার এদের সম্প্রদায় করে ভাগ করে দিব যেন ভাইবোনে আর বিবাহ না হয়।” তারপর তাদের জাতিভাগ করে দিল; বড় ছেলের বংশের নাম হল “হাসড।”; তারপরটির বংশের নাম হ’ল “মুরমু”,; তারপর “কিসকু,” তারপর “হেম ব্রম” তারপর “মারণ ডি,” তারপর “সরেন” তারপর “টুডু।” তারা দুজনে এদের বললে “তোমরা দেখবে বিবাহের সময় যেন এক বংশে বিবাহ না হয়; এক বংশের মেয়ে হ’লে ছেলে অন্যবংশের হবে। এইভাবে তারা রইল; এই ভাবে থাকতে থাকতে তাদের বংশ বেড়ে গেল।

খোজকামান দেশ; মানুষের পতন ও বিনাশ

পরে তারা খোজকামান দেশে চলে গেল। সেখানে গিয়ে মানুষ মহিষ মহিষীর ন্যায় অত্যন্ত বদ হয়ে উঠল এবং কেউ কেউকে চিনতে চাইল না। এই সব দেখে ঠাকুর অত্যন্ত ক্রুব্ধ হয়ে ঠিক করলেন যে, যদি মানুষ তাঁর কাছে না ফিরে আসে, তবে তাদের বিপদ নিশ্চিত। তারপর ঠাকুর এদের খোঁজ নিয়ে বললেন, “এস মানব, এখনও আমার নিকট ফিরে এস;” কিন্তু মানব তাঁর কথায় কর্ণপাত করল না। তখন ঠাকুর পিলচু-হারাম ও পিলচু-বুড়ীকে (কেহ ফেহ বলেন ইহারা “হিহিড়ি পিপড়িতে মারা গেছিল”) অথবা এক জোড়া পুণ্যাত্মা বুড়োবুড়ীকে ডেকে এনে বললেন, “মানব আমার কথা শুনলে না। সেজন্য আমি তাদের মেরে নিঃশেষ করব। তোমরা দুজনে হারাতা পর্ব্বতের গুহায় গিয়ে প্রবেশ কর, সেখানে বাঁচবে।”

হারাতা পর্বত

এই দুইজন ঠাকুরের কথা শুনল ও পর্বতের গুহায় প্রবেশ করল। তাদের প্রবেশ করবার পর ঠাকুর সাতদিন সাতরাত্রি আকাশ হ’তে অগ্নিবৃষ্টি (কোন কোন গুরু বলেন স্বর্গের জল) বর্ষণ করে জগতের সমস্ত মানুষ ও জীবজন্তুকে বিনষ্ট করলেন; কেবল যে দুজন হারাতা পর্বতের গুহায় প্রবেশ করেছিল; তারাই কেবল অবশিষ্ট বেঁচে রইল। এবিষয়ে এরূপ গান আছে :—

সাত দিন সাতরাত্রি হ’ল অগ্নিবৃষ্টি,
সাত দিন সাতরাত্রি অবিশ্রান্ত বৃষ্টি;
কোথায় ছিলে তখন তুমি হে মানুষ,
কোথায় নিয়েছিলে আশ্রয় হে মানুষ (দুটি)।
আছে আছে হারাতা পাহাড়,
আছে আছে পৰ্ব্বত কন্দর;
তথায় ছিনু মোরা দু’জনা,
তথা নিলুম আশ্ৰয় দু’জনা।

তারপর বৃষ্টি থেমে গেল; বৃষ্টি থাম্‌লে লোকদুটি পর্ব্বতের গুহা হতে বের হয়ে দেখল যে একটা মহিষী মৃত পড়ে আছে; আরও দেখলে যে সেরকম একটি গাভীও কারকে গাছের গুড়ির নীচে পড়ে আছে, গাভীটির একপাশ পুড়ে গিয়ে চাম উঠে গিয়েছিল, আর এক পাশ ভাল ছিল। গান আছে :—

জ্বলন্ত আগুনে গাভীপাশ গিয়াছে পুড়ে।
ভস্মের মাঝেতে মহিষী মৃত রয়েছে পড়ে।

আরও নানাপ্রকার জন্তু দেখিতে পাইল। গুহা হতে বের হবার পর ঠাকুর তাদের কাপড় দিলেন। হারাতা পাহাড়ের নিকট তারা ঘর তৈরি করল। সেখানে তাদের অনেক সন্তান-সন্তুতি হ’ল ও বংশ অনেক বেড়ে গেল।

হারাতা পাহাড় হইতে তারা সাসাংবেদ নামক এক প্রকাণ্ড প্রান্তরে চলে গেল; তথায় তারা অনেক দিন বাস করল, এবং সেখানে তাদের জাতিভাগ হল। আদি ‘পারিসে’র মত এই দুজন হারামবুড়োবুড়ী তাদের জাতি ভাগ করে দিল; যথা, হাসডা, মুরমু, কিসকু, হেমব্রম, মারণ দি, সরেণ, আর টুডু। এই সাত সম্প্রদায় ছাড়া আরও পাঁচটি সম্প্রদায় হ’ল; যথা, বাসকে, বো, পাউরিয়া, চোড়ে, আর এক বংশ লোপ পেয়েছে; তাদের নাম ছিল “বেড়েয়া”। গান আছে :—

হিহিড়ি পিপড়িতে জন্মেছিলুম মোরা,
খোজকামানে মোদের খোঁজ নিছিলেন খোদা, (ঠাকুর)
হারাতা পাহাড়ে বেড়েছিলুম মোরা,
সাসাংবেদে হয়েছিল মোদের জাতভাগ।

জারপি দেশ

সাসাংবেদে জাতিভাগ হয়ে আদি পুরুষেরা জারপি নামক দেশে এল। সেখানে থাকতে থাকতে, কে জানে কেন, তারা সেখানে না টিকতে পেরে সেখান থেকে বনে বনে ঘুরতে ঘুরতে একটা উঁচু পাহাড়ের নিকট এসে পৌঁছল। পথ হাটতে হাটতে ও পার হবার পথ খুঁজতে খুঁজতে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল; পথ না পেয়ে তারা বলল, “এই পর্ব্বতের দেবতা নিশ্চয়ই আমদের পথ বন্ধ করেছেন। এস আমরা ইহাকে কিছু মানত করি, যেন ইনি আমাদের রাস্তা ছেড়ে দেন।” তারা স্বীকার হয়ে এরকম মানত করল, “হে পৰ্ব্বতদেব! আমাদের রাস্তা ছেড়ে দেও, আমাদের দেশ খুঁজে পেলে তোমাকে পূজা দিব।” দেখ! কিছুক্ষণ পরে সকালবেলা তারা পার হবার রাস্তা পেল এবং দেখতে পেল যে ভোর হওয়া মাত্র সূর্য্যদেব উঠে পড়েছেন; নতুবা পথ খুঁজতে খুঁজতে সূর্য্যদেবও অনেক বিলম্বে উঠছিলেন। এই বহির্দ্বারকে সাঁওতালেরা “সিংদুয়ার” বলে থাকে। এবিষয়ে গান আছে :—

জারপি দেশ থেকে
সিংদুয়ার, বাই দুয়ার দিয়ে
দেশের লোক বের হয়ে এসেছে।

আয়রে কায়েন্দে, চায়চম্পা

তাদের পার হতে কতদিন যে গেছিল তা বলা যায় না। বাইদুয়ার দিয়ে বের হয়ে তারা ‘আয়রে’ দেশ পেল; সেখানে থাকতে থাকতে “কায়েন্দে” দেশে উঠে আসতে লাগল। “কায়েন্দে” দেশ হইতে কে জানে কেন তারা ‘চায়’ দেশে এল; সেখানে তারা অনেকদিন রইল, এবং তাদের সংখ্যাও বেড়ে গেল। সেখানে টিকতে না পেরে সেখান থেকে সাতনদীর দেশ চম্পাদেশে পালিয়ে গেল; তাহার দুটি দুয়ার ছিল,—একটির নাম “চায়দুয়ার”, অপরটির নাম “চম্পাদুয়ার”।

চম্পাদেশে বসতি

চম্পাদেশে তারা অনেক গড় নির্মাণ করলে, যেন কোনও প্রকারে কোন শত্রু তাদেয় পরাজয় না করতে পারে; একটির নাম হ’ল “খায়রি” গড়—একটি হেমব্রম বংশের গড়; একটির নাম “কোয়েন্দা” গড়—এটি কিসকুবংশের; একটির নাম “চম্পা” গড়—এটি মুরমুবংশের; একটির নাম “বাদোসি” গড়—এটি মারণদি বংশের; আর একটির নাম “সিম” গড়—এটি টুডুবংশের গড় আরও ছিল, তাদের নাম ভুলে গেছি।

চম্পাদেশে তারা অনেক কাল ছিল। আর সেখানে তারাই প্রধান ছিল। সে সময়ে তারা কারও পায়ের তলায় ছিলনা। কিসকুবংশ রাজবংশ ছিল। মুরমুবংশ প্রথম হইতেই পুরোহিত ছিল, সেজন্য তাদের মুরমুঠাকুর বলা হয়। সরেণ বংশ ক্ষত্রিয়; লড়াইর জন্য তারা সিপাহি ছিল। হেমব্রমবংশ কুমার, মারণদিবংশ ধনী মহাজন; আর টুডুবংশ ঢাকঢোল বাজাত ও মিস্ত্রীর মত লোহার যতরকম কাজ করত। বাসকে বংশ বণিক, ক্রয়বিক্রয় করত, আর অবশিষ্ট লোক কি করত তা ঠিক জানা যায় নাই।

গ্রামের জাহের দেবী

চম্পাদেশে বাস করবার সময় তারা প্রধান পৰ্ব্বতকে (মারাংবুরু) ”মোঁরে”কে, “ তুরুই”কে, আর জাহেরদেবীকে গ্রামের প্রান্তভাগে রাস্তার মোড়ে স্থাপিত করে পূজা করতে থাকে। সূর্য্যদেবকেও পাঁচবৎসর পর পর সূর্যোদয়ের সময় পূজা দিতে লাগল।

রামরাজা

প্রাচীর সাঁওতালেরা বলে যে এরূপ প্রবাদ আছে যে, পুরাকালে রামরাজার সময় যত সাঁওতাল রাবণরাজাকে পরাজিত করতে রাম রাজার সঙ্গে যুদ্ধে গিয়ে তাঁর সাহায্য করেছিল। এজন্য সে সময় হইতে অনেক দিন পর্যন্ত হিন্দুদের সহিত ইহাদের কোন যুদ্ধবিগ্রহ ছিল না। হিন্দুরা ময়দানে সমতলভূমিতে থাকত, আর সাঁওতালেরা বনে ও পাহাড়ে থাকত। কিন্তু হিন্দুদের সহিত এদের অনেক যুদ্ধ হয়। হিন্দুদের সহিত আজ পর্যন্ত এদের সদ্ভাব নাই। এরা জঙ্গল কেটে যে সব দেশ পরিষ্কার করত, হিন্দুরা সে সব দেশ কেড়ে নিত। তবুও যদি সাহেবেরা হিন্দুদের সাহায্য না করত তবে এরা তাদের গঙ্গাপারে তাড়িয়ে দিত; ইংরেজেরা হুলের সময় হিন্দুদের সাহায্য না করলে সাঁওতালেরা গঙ্গানদীকে সীমানা স্থির করে নিত। পুরাকালে গঙ্গানদীর এপার ওপার উহাদের দখলে ছিল। গান আছে :—

গঙ্গানদী পরিপূর্ণ,
সরানদী ভরপুর;
ওহে মিরু, ফিরে যাও।
কি দেখে ফিরে যাব,
বন্ধুই আমার প্রাণ,
বন্ধুই আমার বল।
ভগিনি, আমার গোঁসাই হে,
গঙ্গানদী ভরপুর,
ভগিনি, আমার গোঁসাই হে,
সরানদী ভরপূর।
ভগিনি, আমার গোঁসাই হে,
সুতার জাল বুনবো মোরা,
সাওতালী কথা
ভগিনি, আমার গোঁসাই হে,
রাণকি (বড়) জাল বুনবো মোরা,
ভগিনি, আমার গোঁসাই হে,
(বড়) “গলদা” চিংড়ি পড়বে জালে,
ভগিনি, আমার গোঁসাই হে,
তরুণ মাগুড় পড়বে জালে।

চম্পাদেশে হিন্দুরা এদের পরাজিত করে চম্পাগড় দখল করেছিল, কিন্তু উহারা পুনরায় যুদ্ধ ক’রে জিতিয়া দুর্গ অধিকার করে। সে সময়ে দুজন হিন্দুভ্রাতা তাদের ভগ্নীর সহিত এরূপ আলাপ করেছিল;

দাদারে ইনদানসিং মানদান সিং
দাদারে ছুটালং চম্পাকা গড়।
বহিন গো, না কান্দ না খিজ,
বহিন গো হাতেকা শাঁখা বিচং,
বহিন গো কাণেকা সোণা বিচং,
বহিন গো, তব হোনা লিব চম্পাকা গড়।

সাঁওতালেরা নিজেরা নিজেরাও কাটাকাটি করে মরছিল। গান আছে,

উঠ, উঠ, উঠ, বন্ধু হে,
হুসিয়ার, হুসিয়ার বন্ধু হে;
কোয়েন্দাবাসী কাটাকাটি ক’রে মরছে।
উঠ, উঠ, উঠ, বন্ধু হে,
হুসিয়ার হুসিয়ার, বন্ধু হে,
বাদালবাসী কাটাকাটি ক’রে মরছে
কিসের লাগি কাটাকাটি করে মরছ, বন্ধু হে,
কিসের লাগি মারামারি করছ, বন্ধু হে,
কিসের লাগি বিবাদ ক’রে মরছ, বন্ধু হে,
সীমার লাগি কাটাকাটি করছি, বন্ধু হে,
সীমার লাগি মারামারি করছি, বন্ধু হে,
সীমার লাগি বিবাদ করছি, বন্ধু হে!

“থারয়ার” জাত

চম্পাদেশে সাঁওতাল, মুণ্ডা, বনমানুষ, কুড়মী প্রভৃতি জাতি ‘খারয়ার’ নামে অভিহিত হইত। বনমানুষদিগকে জানি না কেন—হয়ত বানর খাওয়ার জন্য—জাতিচ্যুত করা হয়। মুণ্ডারাও সেখানে পৃথক হয়ে পড়ে, আর “কুড়মী”রা হিন্দুদের সহিত মিশতে আরম্ভ করে। কতক ‘খারয়ার হিন্দু’ সিংহবংশীদের সঙ্গে বিবাহসম্বন্ধ স্থাপন করে তাদের বশীভূত হ’য়ে—”সিংহ” উপাধি ধারণ করে। এখন পর্য্যন্তও প্রাচীনদেশে সিংহবংশীয়েরাই রাজা আছে। বনমানুষের মধ্যেও কেহ কেহ “সিংহ” হয়েছে। এদের মধ্যেও কেহ কেহ পুরাণ দেশে রাজা আছে।

মান্দসিং

পুরাকালে এরূপ প্রবাদ আছে যে একজন সিংহবংশীয়-যুবকের সহিত কিসকুবংশীয়া একটি মেয়ের অবৈধ প্রণয় হয়। মেয়েটি একটি জারজ সন্তান প্রসব করে বনে ফেলে আসে। ধনী মারণদিবংশীয়েরা এই শিশুটিকে কুড়িয়ে নিয়ে আসে। এদের আশ্রয়ে ছেলেটি পূর্ণযৌবন লাভ ক’রে “মান্দসিং” নাম ধারণ করে। এই যুবক বড় হ’য়ে ঝড়ের মত একজন অতি পরাক্রান্ত পুরুষ হয়েছিলেন, বুদ্ধিতে কিংবা যুদ্ধ—বিদ্যায় কেহই ইহার সমকক্ষ ছিল না। ইনি কিসকুবংশের দেওয়ান নিযুক্ত হন। একদিন তিনি রাজাকে বললেন, “আমাকে বিয়ের জন্যে একটি মেয়ে খুজে দিন।” রাজা পাঁচজনকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, কিন্তু জারজ বলে কেহই ইহাকে মেয়ে দিতে রাজী হল না। ইহা শুনে মান্দসিং অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হ’য়ে বললেন, “তোমরা যদি মেয়ে না দেও, তবে জোরপূর্ব্বক আমি সমস্ত যুবতীদের কপালে সিঁদুর দিয়ে তাদের ইজ্জত নষ্ট করব।” দেশের লোক এই কথা শুনে অত্যন্ত ভীত হয়ে বলল, “এস, আমরা পালিয়ে যাই।” দেশের অধিকাংশ লোক পালিয়ে যায়, কেবল কয়েকজনমাত্র কর্তৃত্বের লোভে রয়ে গেল।

মুসলমান ও সাঁওতাল

কেহ কেহ বলেন, এরূপ প্রবাদ আছে যে, এই মান্দসিং অথবা অন্য কোন সিং মুসলমানদের বন্ধু ছিল! সাঁওতালদের পূর্বপুরুষদের সহিত মুসলমানদের এরূপ ঘোরতর যুদ্ধ হয় যে, কথায় বলে, অনর্গল তীরবর্ষণে সূৰ্য্যদেব ঢাকা পড়েছিলেন। তারার সূর্য্যদেবের প্রকাশে আলো হওয়ায় মুসলমানেরা ক্রোধান্বিত হ’য়ে বলেছিল, “দেখ, আমাদের চেয়ে কে এক বড় বীর আসছে, এস আমরা একে কেটে ফেলি।” তারা উহাকে ধরবার জন্য একে অন্তের কাঁধে উঠতে লাগল; কিন্তু সূৰ্য্যদেব এদের পদদলিত করায় এরা দুম-দাম করে পড়ে যায়। সে সময় থেকে মুসলমানদের মাথায় চুল নাই; কেবল দাড়ীতে চুল থাকে। সকল জাতি অপেক্ষা মুসলমানদের উপরে সাঁওতালদের বেশী রাগ ও ঘৃণা।

তোড়ে, পাখরি, বাহা, বান্দেলা / বিচার মীমাংসা

চম্পাদেশ হইতে সাঁওতালেরা তোড়ে-পাখরি-বাহা বান্দেলা দেশে পালিয়ে যায়। সেখানে তারা অনেকদিন থাকে। তখন কি কারণে জানি না, হিন্দুরা ও অনেকে সমতল ভূমিতে এসে প্রবেশ করে। তারপর দেশের লোক একত্র হয়ে শালগাছে, আসনগাছে, মহুলগাছের নীচে পদ্মপাতায় আসন করে এবং “কেরে” ঝরণার জল পান করতে করতে বার বৎসর কি বারদিন বিচার ক’রে ঠিক করলে যে “আজ থেকে নার্ত্তার (অশৌচ-সংস্কার) দিন, নামাকরণের দিন, বিবাহের দিন, মৃত্যুর দিন, আমরা আমাদের সব মালী-মোকদ্দমা বিচার মীমাংসা করব।” এইখানে প্রাচীন সাঁওতালেরা তাদের পুরাতন রীতিনীতি পরিবর্তন ক’রে ফেলে। পুরাকালে সাঁওতালেরা শবকে কখনও দাহ করত না, অথবা গঙ্গায় নিয়ে যেত না; ইহাকে পুঁতিয়া কবর দিত। বিবাহের সময় মেয়েদের সিঁদুর দেওয়ার প্রথা ছিল না। এসকল আচার রীতিনীতি ইহারা হিন্দুদের নিকট শিখেছে। সেখান থেকে তারা উঠে “তোড়ে-পাখরি-বাহা-বান্দেসর” ভিতর দিয়ে পিড়ির উপরে অথবা পদ্মপাতায় বসে ভাসতে ভাসতে পুরুষেরা “ইচা” গাছের মূলে, আর মেয়েরা মহুল গাছের মূলে এসে হাজির হয়। তারা দেখে যে তাদের পায়ের আলতাও মুছে নাই, অথবা পদ্মপাতাও ভিজে নাই; সেজন্য তারা বলতে লাগল যে, “আমরা ভাল বিচারই করেছি; আমাদের আচার বিচার যুগোপযোগী হয়েছে; এখন থেকে ইহাই প্রচলিত হউক।”

জোনাজশপুর মাঠ

তারপর কে জানে কেন, সেখান হইতে তারা পালিয়ে যায়,— কেহ কেহ বলে মুসলমানদের ভয়ে। যেতে যেতে তারা “বারি বাড়োবা” বন দেখতে পায়; কিন্তু কেহ অগ্রসর হইতে সম্মত হয় না; তখন তারা বলল, “আমাদের কেহ অগ্রগামী হবে না, এখন আমরা সারি সারি হয়ে চলে গিয়ে বন পার হই।” বন থেকে বের হয়ে তারা জোনাজশপুর মাঠে একত্রিত হয়ে পরস্পরকে জিজ্ঞাসাবাদ করল, “আমরা সকলে বের হয়ে এসেছি কিনা?” এখানে কিছুদিন থেকে কোনও কারণে সেখান থেকে ও পালিয়ে যায় এবং খাসপাল বেলাংজাতে এসে হাজির হয়।

থাসপাল বেলাংজা, শির, শিখাও, নাগপুর

এখানে থাকতে থাকতে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যার যেদিকে ইচ্ছা সেদিকে চলে যায়; কতক ‘শির’ দেশে গেল; কতক ‘শিখাও’ দেশে এবং কতক ‘নাগপুর’ দেশে চলে গেল। এই সময়ে এরা হিন্দুদের অনেক নীচে পড়ে যায়। যে সকল খারোয়ার কিংবা বনমানুষ হিন্দুদের সঙ্গে বিবাহ-সূত্রে আবদ্ধ হয়—কেবল তাদেরই এখন রাজ্য আছে। এদের ‘খারোয়ার’ নাম কেন লুপ্ত হয় কেহ জানে না। অনেকে বলে, এরা শিখারের পরপারে সাত দেশেতে অনেক দিন অতিবাহিত করায় এদের নাম সাঁওতাল হয়েছে।

এরা শিখার রাজার সমস্ত বন জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে এবং তাহার অধীনে এদের অনেকে গ্রামের মণ্ডল নিযুক্ত হয়। কিন্তু সেখান থেকেও হিন্দুরা তাদের তাড়িয়ে দেয় ও তাদের ঘরবাড়ী কেড়ে নেয়। শিখার রাজার কাছে এরা ছাতাপরব শিখেছে (a Hindu festival observed on the last day of Bhadra)।

টুণ্ডি-সাঁওতাল পরগণা

শিখার হইতে অনেক সাঁওতাল টুণ্ডিতে যায়—কোথায় থাকবে কোন ঠাঁই মিলল না। প্রাচীনেরা এদের নিষেধ করে বলেছিল, “অজয় নদী পার হয়ো না, যদি কেহ পার হও, তবে তার গর্ভের ছেলেটিকে পর্য্যন্ত চিটি কেটে দাগ করে দিবে, কেননা সেটাও ভণ্ড মুসলমানদের রাজ্য।” কিন্তু এরা প্রাচীনদের কথা না শুনে পেটের জ্বালায় এসে পড়ে। তারপর ক্রমে ক্রমে সাঁওতাল পরগণায় এসেছে। এখানে রেশম পোকার মত এরা আস্তে আস্তে এসেছে, এখনও আছে; হয়ত আর কোন দিন এখান থেকেও চলে যাবে। কতক সাঁওতাল রাজমহল পার হ’য়ে গঙ্গার ওপাশে চলে গেছে; জানি না কেন ভগবান এদের এমন শাস্তি করেছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *