গ্রামে বসতি

গ্রামে বসতি

(১) গ্রামের সন্ধান ও শুভাশুভ লক্ষণ

সাঁওতাল যুবক কখনও একলা সংসার করে না। সকলে মিলে গ্রাম খুঁজে “জমকাল” হ’য়ে তথায় বাস করে। তিন চারজন সাঁওতাল একজন মুখ্যার সহিত বনের দিকে চলে যায়; বনে প্রবেশ করে পাখী উড়তে দেখলে বলে, “এমনি করে আমাদের গ্রামও একদিন “উজাড়’ হয়ে যাবে!” কিন্তু পাখীগুলিকে নীড়ে স্থির হ’য়ে বসা দেখলে, অথবা বাঘ কিংবা বাঘের পাঞ্জা দেখলে বলে, “একদিন আমরা একজায়গায় ‘পাড়া গাড়ব’ (বাস করব)।” এরূপে সন্ধান করতে করতে একটা জায়গা বেছে নেয়—যেখানে মাটি উঁচু থাকে, যেখানে ঘরবাড়ী সুন্দরমত তৈরি হ’তে পারে, আর যেখানে ক্ষেতখোলা করা যায়, এবং যেখানে সহজে জল পাওয়া যায়। এরূপ জায়গা পেলে তারা খুব খুসী হ’য়ে বাড়ীতে ফিরে আসে।

তারপর একদিন সকলে মিশে “সারসাগুণের” জন্য অর্থাৎ গ্রাম উৎসর্গ করবার জন্য চলে যায়। সাদা, আর একটি কালো মোরগ, অল্প কিছু আতপ চাল, তেল-সিন্দুর, আর একটা নূতন বাটিতে কিছু জল নিয়ে যায়। যেখানে মুখ্যার বাড়ী হ’বে সেখানে সন্ধ্যাবেলা সিন্দুর দিয়ে গোটা পাঁচেক টিকা (চিনে) দেয়; সিন্দুরের টিকার ভিতরে আতপ চাল রাখে এবং চারিদিকে বাটির জল ছিটিয়ে দেয়; এর কাছে মোরগ—গুলি বেঁধে রাখে যেন চাল না খেতে পারে; তারপর নিবেদন করে বলে “হে আকাশের দেবতা, তুমি মাদুরের মত সব জুড়ে আছ চারদিক। চার পৃথিবী তুমি ব্যাপ্ত হ’য়ে আছ; আর আমরা এই ধরিত্রীর পাঁচছয় জন তোমার নামে এই জায়গা উৎসর্গ করলাম; দুধ কি দুধ, জল কি জল, আমাদের দেখিয়ে দেও।” তারপর যে যার ঘরে চলে আসে।

দ্বিতীয় দিন খুব ভোরে এসে আবার জায়গা দেখে। কোন মোটা মোরগের পালক ঝ’রে পড়ে থাকলে বলে, “বুড়োদের ভিতর দুএকজন মরবে”; আর ছোট মোরগের ডানা পড়লে বলে থাকে, “ছেলেপেলেদের কেহ মারা যাবে।” আর যদি কোন মোরগের ডানা না পড়ে তবে সেটা খুব শুভ লক্ষণ, কেহই মারা যাবে না। আর যদি মোরগগুলির চারিদিকে ময়লা পড়ে থাকে তবে বলা হয়, “গরীব-গরবা সকলেই ভাল থাকবে।” আর একদিকে ময়লা পুঁজি হয়ে থাকলে বলে, “কেবল মাঁঝি বড়লোক হবে”; দুদিকে থাকলে বলে, “মাঁঝি আর পারাণিক বড়লোক হবে;” তিনদিকে থাকলে বলে, “আর একজন রায়তও বড়লোক হবে।” যেদিকে পিপীলিকা চাল নিয়ে যায় সেদিক থেকে দেবতার উত্থান হবে। বাটির জল শুকিয়ে গেলে বলে, “ দুএক বছর জলের টানাটানি হবে—অবৃষ্টি হবে”; আর জল না শুকালে বলে, “জলের টানাটানি হবে না।” যদি মোরগগুলি অদৃশ্য হয়ে যায়, চাল না থাকে এবং বাটির জলও শুকিয়ে যায়, তবে তারা বলে, “এই জায়গা মারাত্মক, আমাদের মঙ্গল হবে না, এখানে গ্রাম বসাব না।” কিন্তু মোরগ, চাল ও বাটির জল ঠিকমত থাকলে এরা চারদিকে গর্ভ খনন করে; তিনদিকের মাটি উঠায়, এবং সেই মাটি দিয়ে গৰ্ত্ত পূর্ণ করে। দুদিকের মাটি ভরাট হ’য়ে কিছু বাকী থাকলে বলে, “আমাদের কিছু পুঁজিপাটা থাকবে, আর যদি কিছু বাকী না থাকে তবে বলে, “এখানে শূন্য”। তারপর মোরগগুলি ছিঁড়ে একটা মাটিতে আর একটা মাঁঝির নামে উৎসর্গ করে। এইরূপে “সারসাগুণ” ক্রিয়া শেষ হয়।

(২) বসতি

তারপর একদিন এসে প্রথমে মুখ্যার একখানা কুড়েঘর তৈরি করে; ইনি গ্রামের মাঁঝি কিংবা মুখ্যা হ’য়ে প্রথমে গাছ কাটে। আজকাল বন খুঁজে রাজাকে জানাতে হয়; কিন্তু পুরাকালে রাজা সৃষ্টি হবার পূর্ব্বে এরূপ ব্যবস্থা ছিল না। তারপর মুখ্যা সকলকে নিয়ে জামি ভাগ করে; প্রত্যেকেই এক এক খানা কুঁড়ে তৈরি করে, আর গরুবাছুরের জন্য একটা খোয়াড়। তারপর বুড়োরা গ্রামে ফিরে এসে পরামর্শ করে, “কবে আমরা উঠে যাব?” দিন ঠিক করে একদিন ছেলেপিলে নিয়ে তারা নূতন গ্রামে চলে আসে। ফাল্গুন ও চৈত্র মাস নূতন গ্রামে অসিবার প্রশস্ত কাল। সকলে মিলে জমিজায়গা পরিষ্কার করে, এবং সেখানে যে বাঁশ পায় তাতে ঘরের ‘সাজ’ হয় এবং কিছু অবশিষ্ট থাকে। কাঠ ও গুছিয়ে রেখে ঘর তৈয়ার করে। মাঝে মাঝে রাস্তা খুলে এবং রাস্তার মোড়ে জাঁহের দেবীর ঠানও নির্দেশ ক’রে রেখে দেয়।

(৩) মাঁঝির সাহায্যকারী

সকলে মিলে মাঁঝির কাছে আসে; সে সকলকে মদ খেতে দেয়। তারপর বুদ্ধির তারতম্য বিচার করে গ্রামের সাহায্যের জন্য বাছনি করা হয়, এবং তাদের নামকরণ হয়, “আপনি আমাদের পারাণিক, আপনি পেয়াদা”; বেশী লোক থাকলে জগমাঁঝি ও জগপারাণিক ও নির্বাচন করা হয়; আর যিনি ঠাকুরকে রক্ত দিতে চলে যায় তাঁকে কুত্তাম-নায়ক করা হয়। পরে সকলে হাঁড়ি পান করে ও খাওয়া দাওয়া করে; তারপর যার যার ঘরে চলে যায়।

মাঁঝি পাঁচজনের ‘মাথা’। সকলকেই তার অধীনে থেকে চলতে হয়। ইনি সবকাজেই আছেন-হাকাহাকিতে, শাসনসংরক্ষণে, জন্মসংস্কারে, বিবাহাদিতে, শিকার-বিষয়ে, পরব-পার্বণে, সেবা-ভক্তিতে, রান্না-বান্নায়, হাঁড়ি-কাউরায় (মদ-টদে), পূজা পাইলে, ঝগড়া-ঝাটিতে, দুর্ভিক্ষে অনাবৃষ্টিতে, রাজদ্বারে, মহাজনদ্বারে, দোষগুণে, চুরি-টুরিতে, আরাম-ব্যারামে, বেশ্যা-বৃত্তি-সম্পর্কে. মারপিটে, খুন-খারাবিতে, দুঃখসুখে, আপদ-বিপদে, রোগশোকে, মরণ-মৃত্যুতে, দাহাদি কাৰ্য্যে, শ্রাদ্ধাদিতে : সকল টাতেই মাঁঝির দায়িত্ব।

পারাণিক—ইনি দেওয়ানের মত মাঁঝির প্রধান সাহায্যকারী। মাঁঝির অনুপস্থিতিতে পারাণিক গ্রামের সব কাজ চালায়। মাঁঝি অন্যত্র চলে গেলে এবং তার কোন পুত্র কিংবা ভাইপো না থাকলে পারাণিকই মাঁঝি হয়; অথবা মাঁঝি নিঃসন্তান মারা গেলে, অথবা গ্রামে তার কোন ভাইপো না থাকলে পারাণিক মাঁঝির পদ পায়।

জগমাঁঝি—ইনি যুবক-যুবতীদের সর্দ্দার; একে দেখতে হয় যেন গ্রামে কোন লজ্জার কাজ না হয়; যদি কোন ঘটনা হয় এবং দোষী ধরা না পড়ে তবে গ্রামের পাঁচজনকে মাঁঝির গোয়ালঘরের খুঁটিতে দড়ি দিয়ে বেঁধে মারপিট করে এবং জরিমানাও করে থাকে। কিন্তু জগমাঁঝি কোন যুবক-যুবতীর দোষ টের পেলে তাদের ধরে গ্রামের পাঁচজনের কাছে জিম্মা করে দেয়। বৈঠকে যুবক যুবতীকে রাখতে স্বীকার করলে কেবল যুবকের পিতারই জরিমানা দিতে হয়; কিন্তু যুবক রাখতে স্বীকার না পেলে জগমাঁঝি তাকে পাঁচজনের সামনে মারপিট করে, এবং বাপকেও গুরুতর জরিমানা করে। কেহ কেহ ছেলের জন্য এরূপ জরিমানা দিতে দিতে উৎসন্ন হয়ে যায়।

কার্তিকমাসে ‘সহরায়’ পরবের সময় (Harvest festival) সাঁওতাল যুবক-যুবতী জগমাঁঝির ঘরে এসে পাঁচদিন থাকে; সেখানেই খাওয়া-দাওয়া করে শুয়ে থাকে; যদি কিছু হয় তবে সেজন্য জগমাঁঝি দায়ী থাকে।

জন্মসংস্কারে, ছাতিয়ার কালে, বিবাহসম্পর্কে যত কাজ সবটাতে জগমাঁঝি অগ্রগণ্য। কোন পৰ্ব্বত দেখতে হ’লে ইনি সকলের চালক হন। গ্রামের সকলের চেয়ে জগমাঁঝি বেশী হাঁড়ি পায়। পুরাকালে জগমাঁঝি গ্রামের যুবক-যুবতীদের বেশ কড়া শাসনে রাখত, কিন্তু আজকাল অনেকটা ‘ঢিল-সিল’ হয়েছে। গ্রামের যুবতীরা বেশী করে মদ বিতরণ করে গ্রামের লোককে যাদু করে, যেন জগমাঁঝিকে জানাইলে ও প্রকাশ না হয়, অথবা জানলেও যেন শান্তি না হয়। যুবকেরা দোষ করলে জগমাঁঝির সঙ্গে বন্ধুতা করে এবং নিজেদের যত দোষ খুলে বলে; তখন জগমাঁঝি এদের বলে থাকে, “বুঝেসুঝে ‘চলহে, এর পর খোরাক-পোষাক দিতে হ’বে, না হয় মার খাবে।”

জগ-পারাণিক—ইনি জগমাঁঝির সহকারী; জগমাঁঝির অনুপস্থিতিতে জগ-পারাণিক তার কাজ চালায়।

গতেত (কোতোয়াল)–এ মাঁঝির হুকুমে গ্রামের সকলকে বৈঠকে ডেকে আনে; পূজা, পার্ব্বণে গ্রামে মুরগী সংগ্রহ করে এবং মুটেমজুর এনে তার তত্ত্বাবধান করে। গভেতকে বড়মাঁঝিও বলা হয়; যেহেতু গ্রামের সকলের উপরে?লিশের মত তার হুকুম চলে। প্রাচীনেরা কথায় বলে থাকে, “প্রধান পৰ্ব্বতদেবতা ঠাকুরের পেয়াদা ছিলেন।” গভেত খুব সাহসী, ও লোভী হ’লে অতি লোভী হ’য়ে পড়ে; সময়ে সময়ে মাঁঝিগিরি কেড়ে নিয়ে “পরগণা” হয়ে পড়ে; তখন সে ন্যায়বিচারের ধার ধারে না, ঘুষ খেয়ে বিচার করে। গ্রামের পারাণিক মাঁঝি হ’লে গভেত পারাণিকের কাজ পায়।

নায়ক (পুরোহিত)—নায়কের একমাত্র কাজ পাঁচজনের পূজাপার্বণ করা অর্থাৎ পুরোহিতগিরি।

কুডাম-নায়ক–ইনি যতবার ঠাকুরের পূজা করে ততবার ‘পরগণা’ কিংবা ‘সীমাদেবতার’ উদ্দেশ্যে মানুষের রক্ত উৎসর্গ করেন। জাহের দেবীর নামে বছর বছর শূকর বলি দেওয়া হয়; এবং সে সময় সীমাদেবতার নামে মনুষ্যরক্তও উৎসর্গ করা হয়। শিকারের সময়ও এরূপ গ্রামে পূজা দেওয়া হয়, সকলের মঙ্গলের জন্য, যেন ভালয় ভালয় সকলে ঘরে ফিরে আসতে পারে। তখন এরূপ মন্ত্র পড়া হয়;—“পরগণা ঠাকুর, তোমাকে প্রণাম; শিকার উপলক্ষে তোমাকে এই মনুষ্য-রক্ত উৎসর্গ করলাম, দেখ যেন এখানে সেখানে চাকরবাকর, কুকুর-বিড়াল প্রভৃতি সকলে রক্ষা পায়; আর কাটাসাটা সব ঢেকে রাখ; ভাঙ্গা কুলো ও তুলা পিঠে নিয়ে চলেছি; ঠাকুর প্রসন্ন হও।”

(৪) জরিপ-বিষয়ক—জমি মাপ

নূতন গ্রামে এসে সব ঠিকঠাক হ’লে একদিন সকলে মিলে জমিজমা ভাগ করে। জমি “রেক” (মপি) করা হয়—এক “রেক” এক লাঙ্গলের জন্য। এই সব জমির সাবেকমত খাজানা ধার্য্য করা হয়; আর সেই সময়ে মাঁঝি, পারাণিক, জগমাঁঝি, জগ-পারাণিক, গভেত (পাইক), নায়ক, কুডাম-নায়ক এরা সকলে নিষ্কর জমি পায়। মাঁঝি চারভাগ, পারাণিক তিনভাগ, জগমাঁঝি দুভাগ, আর সকলে এক এক ভাগ পেয়ে থাকে। এরা এসব জমি বিনা খাজনায় ভোগ করে। পুরাকালে মাঁঝিরা কেবল আধরেক পরিমাণ জমি নিত; আজকাল অনেক অনেক মাঁঝি বেশী বেশী জমি ভোগ করে।

নূতন গ্রামে এসে কেহ কেহ বাড়ীর নিকট সাজনা ও অশ্বত্থ গাছ রোপণ করে; সাজনা গাছের ডাটা খায় আর অশ্বত্থ গাছের ছায়ায় বিশ্রাম করে। কথায় বলে, অশ্বত্থ গাছ পরলোকেরও কাজ করে। চাষাবাদের জন্য অন্যান্য লোকও নূতন গ্রামে এসে বাস করে। প্রাচীনেরা এদের কিছু কিছু জমি, ক্ষেত, ও গাড়া ভাগ করে দেয়। আর মাঁঝি চাষের জন্য পতিত জমি দেখিয়ে দেয়। এরূপে গ্রামে লোক জমে, কাজকাম করে, খায় দায়, হাঁড়িপান করে; নাচগান করে, এবং নানারকম আমোদপ্রমোদে দিন কাটায়।

(৫) ধনী ও নির্ধন (“গুণী ও গরীব”)

এক গ্রামে সকলেরই সমানভাবে ভাল অবস্থায় চলে না; কেহ কেহ গরুবাছুর ও রাখাল রাখে, কুলীমজুর খাটায়, নিজেরাও বেশ খাটেপিটে, বুদ্ধিশুদ্ধিও বেশ রাখে, আবার কৃপণও হয়; এরূপ লোকেরাই ধনী হ’য়ে থাকে। আবার কেহ কেহ প্রথম থেকেই গরুবাছুর রাখে না, একেলা একেলা কাটায়, রোগ-শোকে ভোগে। তারা নির্ব্বোধ, বোকা ও কুঁড়ে; আর তাদের মেয়েরা সকলকে গালি-গালাজ করে বেড়ায়; আবার নিজেরা নিজেরা মদ খেয়ে সব নষ্ট করে, এবং নানারকম দোষের জন্য জরিমানা দিয়ে থাকে; এরূপ লোক কি করে ধনী হ’তে পারে? অনেকে বাপের দেবা সমান সমান বেটে নেয়, তবুও দাঁড়াতে পারে না, দেনার ভিতরে ডুবে থাকে। মহাজনেরা অত্যধিক সুদ আদায় করে, এবং অধর্ম্ম ক’রে ভুল হিসাব রাখে। একবার সাউ-মহাজনদের হাতে পড়লে তিনচার পুরুষের দেনা শোধ হয় না। গাইবাছুর, ছাগল-ভেড়া, মহিষ, দা-কুড়াল, আর ধান চাল খামাখা জোর করে নিয়ে যায়; আর না দিলে তাদের ধরে মারপিট করে।

সাঁওতালদেশে অনেকে সামর্থ থাকতেও উচ্ছন্ন যায়, কেবল নিজেদের দোষে। যাদের হালগরু নাই তারা সহজেই চার টাকায় হালগরু ভাড়া আনতে পারে, অথবা “হাল-বুটারিয়া” (বদল-খাটনি) খেটেও চাষ করতে পারে। ‘হালবুটারিয়ার’ নিয়ম এই : ছদিন একজন ধনীর জমি চাষ করে দেয় ও ভোরে খেতে পায়; পরিবর্তে একদিন তার হাল নিয়ে নিজের জমি চাষ করে। যাদের অনেক ছেলেপেলে তারা বলদ ভাড়া করে চাষ করতে পারে। এর নিয়ম এই :—ধনী চাষার ঘরে একটি ছেলে চাকর লাগায়, এবং তার মাহিনাবাবদ দুটা বলদ পায়। এক রাজা ছাড়া আর কাকেও ন্যায়মত খাজনা দিতে হয় না। রেকপিছে ছ’সাত টাকা খাজনা লাগে; আর এক রেক জমিতে যে শস্য উৎপাদন হয় তা সাতভাগ হ’য়ে একভাগ রাজা নেয়, আর ছয়ভাগ চাষা নেয়। যারা বেশী খাটে তারা কিছু বেশীও পায়। একে “খার্ত্তি” বলে, এর নিয়ম এই :—কোনও নূতন গ্রামে বসতি হ’লে চার-পাঁচ বছর পরে জমির রেক মাপ হয়; তখন সকল প্রজা জমি পায় এবং রাজাকে খাজনা দেয়; প্রথমে রেকপিছে পাঁচসিকা খাজনা লাগে; পাঁচ বৎসর জমি ভোগ করলে পর, রেকপিছে বেশী খাজনা ও আদায় করা হয়। নুতন জমি না পাওয়া পর্যন্ত এরূপ ভাবেই চলে! নূতন কোন প্রজা এলে সাঁওতালেরা নিজেদের জমি হ’তে এক চতুর্থাংশ ভাগ করে দেয় এবং সে পরিমাণে খাজনাও ভাগ করে দেয়। তারপর নূতন ও পুরাতন রায়তেরা মিলে নূতন জমি আবাদ করে। একেই বলে “খার্ত্তি”। “খার্ত্তি” জমির জন্য খাজানা বুদ্ধি হয় না। সাবেক খাজনাতেই চলে। কিন্তু অনেকে কুঁড়ে থাকায় “খার্ত্তি” খাটে না, এবং রাজা খাজনা বৃদ্ধি করলে ভার বোধ করে। খাৰ্ত্তি-খাটনি চাষা কিন্তু সেরূপ মনে করে না।

কুঁড়ে লোকেরা বেশী খেটে কামকাজ করে না, চাষাবাদও মন দিয়ে করে না। এসব লোকদের কিছু পুজি থাকলে খেয়ে শেষ করে; এরা কেন উচ্ছন্ন যাবে না? এক প্রকার গরীব লোক আছে তারা কখনও উচ্ছন্ন যায় না; কেননা নিজেদের বিশেষ দরকারি কাজ থাকা সত্ত্বেও ধনীর বাড়ীতে গিয়ে ধানজমি চাষ করে; এতে তাদের কিছু রোজগারও হয় এবং তাদের উপর ধনীদের মায়াও হয়। এদের ছেলেপেলেরা রাখালের কাজ করে, কাঠ জল আনে এবং “হকে”র অতিরিক্ত মাহিনা পায়। চাষের দিনে এদের ছেলেপেলেরা বেশী করে ধান কুড়াতে পারে। যাদের হাতপা চলে না অথবা সাহায্য করবার কোন লোক থাকে না তারাই এরূপে প্রতিপালিত হয়। অনাথাদের কোন ওয়ারিশ সম্পত্তি না থাকলে গ্রামের মাঁঝি কিংবা পারাণিক তাদের প্রতিপালন করে। তখন এরা বেশ সুখে থাকে যেহেতু অনাথা বলে কেহই এদের মন্দ বলতে পারে না। বড় হ’লে পর এদের বিবাহ দেওয়া হয়।

পুরাকালে ভিক্ষুক ছিল না, কিন্তু আজকাল হিন্দুদের কাছে শিখে কেহ কেহ গ্রামে হেটে হেটে ভিক্ষা করে। বিনা দরকারে ভিক্ষা মাগলে কেহ তাদের প্রশংসা করে না; কেননা ইচ্ছা থাকলে আন্নায়াসে গ্রামে কাজ ক’রে জীবিকা নির্ব্বাহ করতে পারে। খঞ্জ—খোঁড়া, অন্ধ-কাণ। প্রভৃতি লোকের দুয়ারে থেকে চৌকি দেয় এবং সেখানেই ফেনভাত খেতে পায়।

অনেকের গরুবাছুর কামলা মজুর থাকে, এবং ইচ্ছা করিলেই বেশ ধনী হ’তে পারে; কিন্তু লোকের ভয়ে ধনী হয় না। ভরণপোষণের উপযোগী অর্জ্জন করে। কথায় বলে, অনেক মেয়েলোক ধনীদের হিংসা ক’রে বলে থাকে, “এরা বেশ স্বচ্ছলভাবে খায় দায়, আমাদের কিছু নাই!” এরূপে অনেকে চোখ লাগায়; ধনীলোক ব্যারামে পড়ে গরীব হয়, অথবা মারা যায়। এরকম মেয়েরা অনেক সময়ে ধনীদের ঘরে ভূত স্থাপন করে এবং তাতেও ধনীরা মারা পড়ে।

(৬) “ মিলেমিশে কাজ কৰ্ম্ম”

সাঁওতালেরা স্ত্রী কি পুরুষ, একসাথে মিলেমিশে কাজ করতে বিশেষ আনন্দ বোধ করে। পুরুষেরা যখন জঙ্গলে কিংবা পাহাড়ে লাঙ্গল, জোয়াল, রুয়া, খুঁটী, পাইড় প্রভৃতি কাতে যায় তখন তারা দলে দলে একসঙ্গে চলে যায়। জঙ্গলে একলা প্রবেশ করা বিশেষ ভীতিপ্রদ; বিশেষ সঙ্ঘবদ্ধ হ’লে কাজও ততটা শক্ত-বোধ হয় না। রাজা কিংবা মহাজনের কাছে যাবার সময়ও পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করে; আর চাষের দিনে একসাথে একজায়গাই “খাড়াই” (“খোলা”) তৈরি করে; রাত্রে একলা কাজ করতে হয় না, এবং কাজও খুব হালকা হয়ে পড়ে। রাখালবালকেরাও তিন চারজন ক’রে একত্রে মাঠে গরু—চরিয়ে থাকে; পালা করে ছাগল-ভেড়া রাখে এবং বিপদে আপদে পরস্পরকে সাহায্য করে। মেয়েরাও জল আনতে, শাক তুলতে কাঠ আনতে হাটে বাজারে বেচাকিনি করতে যায়, যাবার সময় দলে দলে একসাথে চলে যায়।

(৭) খোস্-গল্প (“আজারা”)

যখন কোন কাজ-কৰ্ম্ম না থাকে তখন সাঁওতালেরা গল্প-গুজব করে কাটায়। পুরুষ ছেলেরা চূর্ণ, তামাক প্রভৃতি মেগে মেগে ঘুরে বেড়ায়, তামাক খায়, ভালমন্দ বিষয় নিয়ে গল্প করে সন্ধ্যাবেলা সকলে মাঁঝির নিকট এসে সম্মিলিত হ’য়ে নানারকম কথাবার্তা বলে, হাসি—ঠাট্টা করে, এবং মন “আসানের” জন্য হাজার রকম প্রাণ খুলে খোস—গল্প করে। মেয়েরা প্রায়ই আগুন চেতে গিয়ে গল্প জুড়ে দেয়; কিন্তু অধিকাংশ সময় এরা জলের ঘাটে গল্প জুড়ে দেয়। সেখানে পরস্পরেষ সুখদুঃখ ও অন্যান্য নানারকম কথাবার্তা হয়। কিন্তু কতকগুলি মেয়ে আছে তারা বেটাছেলেদের মত পরনিন্দা ছাড়া অন্য কথা বলে না; নানারকম “চুকলি” কথা কয় এবং সময়ে সময়ে এর জন্য বেশ “কাউমাউ” (হাঙ্গামা) হয়।

(৮) সম্পর্ক

সাঁওতালদের ভিতরে দুরকম সম্পর্ক দেখা যায়, জন্মসম্পর্ক আর বিবাহ-সম্পর্ক। রক্তসম্পর্ক না থাকলেও গ্রামে একপ্রকার গ্রাম্যসম্পর্ক পাতান হয়। কেহ কেহ জন্মসম্পর্কের মত, আর কেহ কেহ বিবাহ—সম্পর্কের মত এসব সম্পর্ক স্থাপন করে। গ্রামের সম্পর্ক কেবল “বেওহার” (ব্যবহার) ও মানসম্ভ্রমের জন্য; সকলেই সম্পর্কমত ডাকাখুজি করে।

(৯) বেওহার ও মানসম্ভ্রম

আগে গ্রামের লোক ভোরে ঘুম থিকে উঠেই বাপ-মাকে প্রণাম

করত; গ্রামে ভোরে কারও সঙ্গে দেখা হ’লেও প্রণাম করত; আর পরিবারের কারও সঙ্গে দেখা হলেও প্রণাম করত; এরাও ফিরে প্রণাম করত। পরব-পার্বনের সময়ও গ্রামের ছেলেমেয়েরা মাঁঝির ও তাহার স্ত্রীর পায়ে প’ড়ে প্রণাম করত। পরিবারের মধ্যে বুড়োবুড়ীকে, ছেলে ও ছেলের বৌ, ছোট কি বড়, সকলেই দিবসে একবার চুমো খাইত। ছেলেমেয়েরা সকলেই বুড়োবুড়ীকে বিশেষ ভক্তি করত। এদের মধ্যে যারা লেখাপড়া শিখত তারাও এটা স্মরণ রাখত। বুড়ো পুরুষ কি স্ত্রীলোকের সঙ্গে এরা কখনও হাসিঠাট্টা করত না, এমন কি, তাদের সামনে চৌকিতেও বসত না। ছেলেমেয়েরা হাঁড়ি পান করত না; ছেলেরা গরুর মাংসও খেত না। মেয়েরা পুরুষের কথা খুব মানত, এবং তাদের সামনে চুলও খুলত না। গ্রামের সকলেই মাঁঝি আর পারাণিককে বিশেষ ভক্তি করত; আর এরাও পাচজনের কথা অমান্য করত না।

আজকাল কলিযুগ, সব তিরোহিত হয়েছে। মেয়েরা পুরুষদের সম্মান করে না; ছেলেরা বুড়ো বাপকেও মানে না; মেয়েরা মাকে বেশ করে ঠকায়, প্রণামও করে না; পশুর মত শোয়াবসা করে। ছেলেমেয়েরা খুব করে মদ খায়; বুড়োলোক সামনে এলেও উঠে দাঁড়ায় না; বাপ-মা কিংবা অন্য কোন মুরুব্বি লোক ভৎসনা করলে মুখে মুখে জবাব দেয়, অথবা রাগ করে চলে যায়; নানারকম ভাবে ফুসলিয়ে তাদের ঘরে ফেরে আনা হয়। বৰ্ত্তমান যুগে মেয়েরা আর ছেলেরাই রাজা হয়েছে। অবশ্য কতক কতক লোক ভালই আছে, কিন্তু অধিকাংশই খারাপ। মাঁঝিও ঘুষ নিয়ে বিচার করে, আর পাঁচজনের কথা গ্রাহ্য করে না। বৈবাহিকেরাও আজকাল ঝগড়া বিবাদ করে থাকে, আগে এরূপ ঝগড়া-বিবাদ ছিল না, পরন্তু পরস্পরকে মান্য ক’রে চলত। প্রাচীনেরা বলত “ফুলের মত ভাত, মাছের ঝোল, আগুনের মত মদ, আর বেয়াইর মত কুটুম্ব তুমি কোথায় পাবে?”

(১০) হিত-পিরীত (স্নেহভালবাসা)

গ্রামের মধ্যে সকলেই সম্পর্কান্বিত বটে, কিন্তু তবু তাদের ভিতর সদ্ভাব থাকে না; অনেকের ভিতর মিল থাকে, ভাবও থাকে, কিন্তু ঠিক “পিরীত” কেবল দুএকজনের সঙ্গে হ’য়ে থাকে; আর আসল হৃয়তা (বন্ধুত্ব) কেবল দুজনের মধ্যে হয়, তাহাকে ‘সতাসং’ বলে। এটা কিছু স্বতন্ত্ররকমের; আপদে বিপদে দোস্তেরা পরস্পরের জন্য প্রাণপৰ্যন্ত বিসর্জ্জন দিতে পারে। যাদের ভিতর এরূপ পিরীত কি ভালবাসা জন্মে তারা দুঃখমুখের কথা বলাবলি করে এবং দরকার মত পরস্পরকে সাহায্যও ক’রে থাকে। গ্রামে বুড়োদের ভিতর এরূপ “হিত-পিরীত” হয়; কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে শৈশবই হিতপিরীতের প্রশস্ত কাল।

রাখাল বালকেরা মাঠে একত্র কাজ করে, সেজন্য এদের মধ্যে প্রায়ই ভালবাসা জন্মে। সঙ্গীদের ভিতর যাদের সঙ্গে মনের মিল হয় তাহাদের মধ্যেও ভালবাসা হয়; তারা সর্ব্বদা একসঙ্গে থাকে, একসঙ্গে বাঁশী বাজায়, পাখী খরগোস ও ময়ুর শিকার করে, গান গায়, পর্যায়ক্রমে ছাগল ভেড়া রাখে, বিপদে পরস্পরকে সাহায্য করে, এক পাতায় ভাত খায়, এবং পাখী মারলে ভাগ করে খায়। খরগোস শিকার করলেও ভাগ করে নেয়। শৈশব কালে ‘পিরীত হ’লে বৃদ্ধবয়সেও তা কেহ ভুলে না, যাবজ্জীবন বন্ধু থেকে যায়। বাপের সঙ্গে অন্য জায়গায় চলে গেলেও অনেকদিন পরে দেখা হ’লে খুব খুসী, হয় এবং পরস্পর চুম্বন করে।

ছোট মেয়েরাও এরূপ পিরীত করে, এবং যাবজ্জীবন তা বজায় থাকে। মেয়েরা কারাম গাছের ডাল পুতে.’সই’ পাতায়; দুটি মেয়ের মধ্যে খুব ভাব হ’লে “কারাম” পরবের সময় কারামডালের দুটি পাতা ছিড়ে দুজনে মাথায় পরে, আর গ্রামের পাঁচজনকে প্রণাম করে; পরে পাঁচজনে মিলে মদ খেয়ে আমোদ-প্রমোদ করে; এরা দুজন নামধরে ডাকাডাকি করে না, ‘কারামকুল’ বলে পরস্পরকে সম্বোধন করে।

ছেলে ও মেয়ে বিবাহ না হ’লে পিরীত করে না। আগের মত হৃদ্যতা আজকাল দেখা যায় না; মানুষের হৃদয় ক্রমশঃই খারাপ হইতেছে। বেশীর ভাগ লোকেই নিজের সুখের জন্য লালায়িত; অন্যপরের যাহোক গ্রাহ্য করে না।

(১১) সাট (একজোট্‌)

সাঁওতালেরা স্বকীয় গ্রামের মর্য্যাদাকে নিজেদের মর্য্যাদা বলে, আর গ্রামের অমর্য্যাকে নিজেদের অমর্য্যাদাকে বলে মনে করে; এজন্য অন্য কোন গ্রামের লোকের সহিত নিজের গ্রামের কারও বিবাদ লাগলে গ্রামসুদ্ধ লোক তার পক্ষে দাঁড়ায়। নিজেদের গ্রামের কোন লজ্জাজনক কথা শুনলে মাঁঝির নিকট এসে নালিশ করে। মাঁঝি তাকে ডেকে বলে, “তুমি আমাদের গ্রামের বদনাম রটিয়েছ, তার প্রমাণ দাও, অন্যথা তোমাকে রেহাই দিব না”; প্রমাণ না দিতে পারিলে তাকে জরিমানা করে দণ্ড দেওয়া হয়। যে সব গ্রামের বেশী “নামডাক” (সমৃদ্ধিপন্ন) তার লোকেরা অন্য কোন ছোট গ্রামের লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে নিজেদের পাহাড়ের মত উচু মনে করে, এবং নিজের গ্রামের সম্মানের বড়াই ক’রে থাকে। একজোটে থাকবার এরূপ ফল

(১২) “বড়াই” (দৰ্প)

বুদ্ধিমান লোক কখনও ‘বড়াই’ করে না; মুর্খরাই কেবল ভেকের মত আত্মম্ভরিতায় ফু’লে থাকে; এরূপ লোককে সকলেই ঘৃণা করে। গরীব লোক হঠাৎ ধনী হ’লে অথবা কোন উচ্চপদ লাভ করলে অহঙ্কারী হ’য়ে থাকে। লোকে কথায় বলে’ “মুটে-মজুর যদি মাঁঝির পরিবার হয়, আর কৃষক বালক যদি ‘পরগণা’ হয় তবে তাদের বড়াই বার খানা গাড়ীতেও ধরে না।” এসব দেখে আনতে হয়। পেয়াদা যদি দেশের মধ্যে ছএকবার মাঁঝির পদ প্রাপ্ত হয় তবে সে প্রায়ই ফোঁড়ার মত ফুলে উঠে, আর অনেকে ঘুষ খেয়ে শেষ করে; আর এদের স্ত্রীরাও গরীব-দুঃখীদের গালাগালি ঠাট্টা বিদ্রূপ করে থাকে। সাওতাল যুবতী সুন্দরী হ’লে সকলেই ‘পারিজাত’ পুষ্পের মত তাকে প্রশংসা করে; আর পেঁচার মত বিশ্ৰী হ’লে মুচকি মুচকি হেসে চলে যায়।

(১৩) ঠাট্টা বিদ্রূপ

সাঁওতালেরা ঠাট্টা বিদ্রূপ সহ্য করতে পারে না,—অত্যন্ত দুঃখিত হয় এবং বিশেষ রাগান্বিতও হয়। তারা বরং নিন্দা ভৎসনা সহ্য করে, তবুও ঠাট্টাকে বড় অসোয়াস্তি মনে করে পুরুষেরা বড় ঠাট্টা টিটকারিতে যায় না। কিন্তু মেয়েরা লোকের মনে কষ্ট দিবার জন্য খুব কড়াকড়া (“চোকা-চাকলা”) কথা বলে থাকে; এরা এত বাড়াবাড়ি ক’রে লোকের ধিক্কার জন্মায়। মেয়েদের ঠাট্টায় অনেকসময়ে বিবাদের সুত্রপাত হয়। আর এতে ভাই ভাই পৃথক হয় এবং স্বামী-স্ত্রীও ছাড়াছাড়ি হয়।

(১৪) রাগ

হিন্দু, মুসলমানদের মত সাঁওতালেরা হঠাৎ রেগে উঠে না; কিন্তু মনে অত্যন্ত কষ্ট পেলে সময় সময় রেগে থাকে। পুরুষেরা রেগে উঠলে মারধর করে, আর মেয়েরা রাগলে ঠোট ফুলিয়ে ফুলিয়ে বক্ বক্ করে। সে সময়ে কেহ কিছু জিজ্ঞাসা করলে “ফেউ ফেউ” করে গালাগালি করে, অথবা কেহ কিছু বললে লজ্জাবতী গাছের মত চ’টে উঠে। কি বুড়ো কি জোয়ান সকলেই এরূপ করে থাকে। পুরুষের রাগ শীঘ্র নরম হয়, কিন্তু রাগ একবার উঠলে অনেক খোসামোদ করে শান্ত করাতে হয়।

(১৫) কর্কশ কথা

কোন সাঁওতাল রেগে উঠলে রাগ সামলাইতে পারে না, সেসময়ে কেহ কিছু বলিলে তাকে “চরচট” দুকথা শুনিয়ে দেয়। কিন্তু মেয়েদের রাগ উঠলে ভাল কথায়ও তাদের রাগ পড়ে না। পুরুষদের কড়া কথা বাঁশের তীরের আগার মত ফিরে যায়, কিন্তু মেয়েদের কর্কশ কথাগুলি তীরের মত বিদ্ধ করে।

(১৬) সন্দেহ

আগে বেশ বাঁধাবাঁধি নিয়ম ছিল; লোকের ধর্ম্মভয়ও বেশী ছিল। সেজন্য সাঁওতালেরা পরস্ত্রীর মুখের দিকে তাকাত না। কেহ পরস্ত্রী ভুলিয়ে বের ক’রে নিলে তার স্বামীকে মামা বলে সম্বোধন করে যেন সে কোন সন্দেহ না করতে পারে। কিন্তু আজকাল কড়া নিয়মও নাই; আর মামা বলাও ছেড়ে দিয়েছে; বেশ করে পরস্পরের নিন্দা চর্চ্চা করে, খাতির প্রণয়ও, তেমন নাই; পুরুষ স্ত্রী পরস্পরকে সন্দেহের চক্ষে দেখে; আর পারিবারের মধ্যে সুখশান্তি নাই। আজকাল লোকে মিছামিছি সন্দেহ করে বিশেষতঃ মেয়েরা। কোন যুবক কোন বিবাহিতা কিংবা কুমারী যুবতীর পানে দৃষ্টি করলে তার পরিবারবর্গ একজোট হ’য়ে বিবাদের সৃষ্টি করে এবং কখনও কখনও সেজন্য মারামারিও হ’য়ে থাকে; মেয়েমানুষে “খিজলাই”লে (ঠাট্টা করলে) অনেক পুরুষ রাগ করে দ্বিতীয়বার ছুটকী বিয়ে করে।

(১৭) হিংসা

আদিম কাল থেকে সাঁওতালদের ভিতরে হিংসাহিংসি চলে এসেছে, আজকাল সেটা আরও বেড়ে গেছে। পুরুষেরা বিশেষ হিংসা করে না; তবে অনেক সময়ে যৌবনে যদি কোন যুবতী কোন যুবকের সঙ্গে বিবাহে অসন্মত হয়ে অন্য কোন যুবককে বিবাহ করে তবে তার হিংসার উদ্রেক হয়। মেয়েরাই বেশীর ভাগ হিংসা করে থাকে; নিজেদের হ’তে অন্যকে ধনী দেখলেই হিংসা করে; যারা সন্দেহ করে তাদেরও হিংসা করে; নিজেদের থেকে বেশী সুন্দরীদেরও হিংসা করে; যে সকল পুরুষ বিবাহ করে না তাদেরও হিংসা করে; আর হিংসার থেকে “ডান”বিদ্যা শিখে পুরুষদের খায়; পুরুষদের না খেতে পারলে তাদের যুবতী ভার্যাদেব খায়। আর ‘জা-দের’ ভিতর যে ঈর্ষা হয় তা কুষ্ঠরোগের মত সকলকে নষ্ট করে। আজকাল অর্দ্ধেক মাইল-মোকদ্দমা হিংসায় উৎপত্তি হয়, কেননা মেয়েরা যে কেবল হিংসা করে তা নয়, মনে মনে অন্যকে শাপে, আর নিজেদের স্বামী আত্মীয় স্বজনকে কড়া কথা ব’লে আগুনের মত জ্বালায়। এজন্য সমস্ত গ্ৰাম ছারখার হয়।

(১৮) ক্রোধ ও শত্রুতা

সাঁওতাল যুবক বেশী ক্রোধী হয় না; রাগলে ফিস্ ফিস করে কিন্তু রাগ বেশীক্ষণ থাকে না। ক্রোধী লোকের রাগ বাইরে প্রকাশ পায় না; বরং মুখে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে তবুও অন্তরের রাগ দেখায় না। অধিকাংশ স্ত্রীলোক ক্রোধী, তপ্ত কড়ার মত তাদের মনে মনে ক্রোধের আগুন জ্বলে, আর শত্রুর সর্ব্বনাশ করতে পারলে অত্যন্ত আনন্দবোধ করে এবং প্রাণটাকে পাতলা মনে করে। এরা সাপের মত অন্ধকারে কামড়ায়, বিষ না লাগা পৰ্য্যন্ত কি হবে তা বুঝা যায় না।

(১৯) কেনা-বেচা (খরিদ-বিক্রী)

পুরাকালে টাকাও ছিল না, এবং কথায় বলে, ক্রয় বিক্রয়ও ছিল না। প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি হয় অর্জ্জন করত না হয় তৈরি করত। ভাতের জন্য ধান, বজরা, জন্দ্রা, ইড়ি, গুগুলি, লায়ো, এবা, জান্‌হে প্রভৃতি ছিল; আর ব্যঞ্জনের জন্য অরহর, শাকপাতা, শূকর, ছাগল, খরগোস, ময়ূর, হরিণ আর পাখী প্রভৃতি ছিল। লোণা মাটি থেকে লবণ তৈয়ার করত। মাটি চেঁচে তুলে এনে হাঁড়িতে গুলে জলে ছেকে নিত; জ্বাল দিয়ে ফুটাত, তার পর জল শুকালে নুন অবশিষ্ট থাকৃত। অনেক সময়ে বেশী পরিষ্কার করবার জন্য কাপড়ে ছেকে নেয়, পরে বেশ সুস্বাদু নুন হয়। শীতের দিনে সকলে নুন তৈরি করে। নানাপ্রকার বনজ ফল থেকে তেল তৈরি হত; কাপড়ও ঘরেই বোনা হত। টুডু জাতি লোহার অস্ত্র শস্ত্র (দা কুড়াল প্রভৃতি) বানাত; আর ঝুড়ি, কুলা মাটির ভাড়ও নিজেরা তৈরি করত। প্রাচীনকালে সোণা ছিল কি না তা কেহ বলতে পারে না, তবে প্রাচীনদেশে সোণাকে ‘সমানম্’ বলা হ’ত পরে বাস্কে জাতি (বণিকজাতি) বিনিময় প্রথায় • কেনাবেচার কারবার আরম্ভ করে; পরে টাকা পয়সার উদ্ভব হ’লে টাকা পয়সাতে কেনাবেচা আরম্ভ হয়। আদিমকালে বিনিময় প্রথা পাঁচজনের মধ্যেই প্রচলিত ছিল; কেহ বা ছাগল দিয়ে মহিষ আন্ত, কেহ বা শূকর দিয়ে ছাগল আন্‌ত ইত্যাদি। আজকাল লোকগুলি “কুঁড়ে কুঁড়েনী” হয়েছে, তেলও পিষে বের করে না, মুনও তৈরি করে না, কাপড়-লতাও বুনে না, সব কিনে চালায়। এজন্য সাঁওতালেরা এখন গরীব হ’য়ে পড়েছে এবং ক্রমে ক্রমে মহাজনের ঋণেও ডুবছে।

(20) ঋণ-ধার

প্রাচীনকালে কেহ মহাজনের নিকট ধারকর্জ করত না; আর মহাজনও কেহ ছিল না। সর্বপ্রথম শিখার দেশে সাউ মহাজনেরা এদের ধরে। সেখানে এদের প্রথম মহাজন নান্দুয়ারে থাকৃত। সে সময় থেকে আজ পৰ্য্যন্ত সাঁওতালেরা তাদের হাতে পড়েছে এবং তারা শকুনের মত এদের ছিঁড়ে খেতেছে। শোধ করতে করতে সব ফুরিয়ে যায় তবুও ঋণ শেষ হয় না; কথায় বলে, “একবার ঘরে “পাই” (মাপবার যন্ত্র) ঢুকলে আর বের হয় না।” হিন্দু সাউএরা পুরান বাঘ, শুক্‌নো হাড়ও চিবিয়ে খায়,—সত্য সত্যই এদের জ্বালায় সাঁওতালেরা শিখার দেশ থেকে পালিয়ে এসেছে। আগে এতটা অন্যায় ভাবে সুদ আদায় করত না; ধান কিংবা টাকার এক চৌথ নিত; কিন্তু দিনে দিনে অন্যায় অত্যাচার বেড়ে চলেছে। তিন চার টাকা ঋণের জন্য খামাখা লাঙ্গলের জোয়াল টানাটানি করে নিয়ে আসে, আর নিষেধ করলে মারপিট করতে ছুটে আসে; তবে এদেরও দোষ আছে; ‘বেবুজের’ মত সাউদের হাতে পড়ে, আর পরিশোধ করবার নামটিও লয় না, ফলে সুদের বোঝা ভারি হয়ে উঠে; পরে মহাজন এসে “ঝাটলাট” সব নিয়ে যায়। তবে আজকাল অনেকে বজ্জাতি করে মহাজনের ন্যায্য পাওনাও ঠকাইয়া থাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *