মৃত্যু ও শ্রাদ্ধ
(১) মৃত্যু
পরিবারের কেহ মারা গেলে মেয়েরা খুব কান্নাকাটি করে; হায় হায় করে চীৎকার করে, বুক চাপড়ায়, মৃতব্যক্তির গুণকীর্তন করে দুঃখপ্রকাশ কপাল ঠুকে, এবং নানাপ্রকারে করে। বাপ-মা মরলে কিংবা কর্তাও মরলে নানাসুরে তাহার গুণ কীৰ্ত্তন করে কেঁদে থাকে। গুণ কীর্তন করতে করতে গানের সুরে শোক প্রকাশ করে।
(২) দাহ
মৃত্যু হইলে শবদাহের ব্যবস্থা হয়। মাঁঝি, পারাণিক পরামর্শ করে পেয়াদাকে আদেশ করে, “সব লোক ডেকে আন, অমুক বাড়ীতে থেকে শবদাহ করতে কাঠের যোগাড় দেখ।” তারপর সকলে কুড়াল নিয়ে মৃতব্যক্তির গৃহে আসে। বাড়ীর মেয়েরা হলুদ পিষে, গুয়ামৌরি আর ধান ভাজে। পুরুষেরা একটা মুরগী ধরে, গোয়ালে আগুন লাগায় এবং চালের খড় খুলে। এসব জিনিষ একটা ভাঙ্গা কুলাতে সাজায়। তারপর যে ঘরে লোকটি মারা পড়েছে, সেই ঘরের খাটের উপরে নানাজিনিষ রেখে সাজায়;–যেমন, কাপড়, বাটি, টাকা পয়সা, খাঁড়া, তরোয়ার, তীরধনুক, লাঠি, বাঁশী, আর যত জিনিষপত্র। সাজান শেষ হ’লে চারজন লোক ঘরে প্রবেশ করে, এবং খাটিয়ার চারশুঁটি ধরে তাকে বের করে আনে। উঠানে বের ক’রে গ্রামের রাস্তার মোড়ে দোরাস্তায় কাঁধে করে আনে। সেখানে বাড়ীর মেয়েরা তেল ও হলুদ মাখায়, আর শবের কপালে একটা সিন্দুরের টিপ দেয়।
তারপর মেয়েরা বাড়ী ফিরে আসে এবং পুরুষেরা শব শ্মশানে নিয়ে যায়। নিজের কোন বাঁধ থাকূলে সেখানেই দাহ হয়, অন্যথা গাড়ায় দাহ হয়। সেখানে বাঁশ কেটে মাচান করা হয় -উত্তর দক্ষিণ দিক্ করে। চারটা খুটি পুতে যেন কোনরকমে শব পড়ে না যায়। তারপর মৃতের ওয়ারিশ হাত পা ও চোখ ধোয়াইয়া দেয় এবং মুখেও একটু জল দেয়। তারপর যারা শব বয়ে আনে তারা তিনবার মাচানের চারিদিকে ঘুরে এবং পরে মাচানের উপর শব স্থাপন করে। শবের মাথা দক্ষিণ দিকে রাখে। তারপর তার শরীর থিকে কাপড়, মালা, ডোরা খুলে নেওয়া হয়।
গ্রামের লোক সব চারদিক ঘিরে দাড়ায়। যদি কোনও স্ত্রী গর্ভবতী থাকে তবে সে দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। মৃতের ওয়ারিশ তার কাপড়ের সুতা দিয়ে সুড়া গাছের ডালে বেন্ধে আগুন লাগার, এবং সেই আগুন শবের মুখে নিক্ষেপ করে। একে ‘মুখাগ্নি করা’ বলে। জ্ঞাতিবর্গ সকলেই এক একখানা করে কাঠ নিয়ে আসে, গ্রামের লোকেরা সেরূপ কাঠ এনে থাকে। তারপর সকলে মিলে বলে “আমরা সকলেই এক একখানা ক’রে কাঠ দিলাম, আর বিলম্ব ক’রো না, বাতাসের মত চলে যাও।” এর পর চারদিকে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। তখন সকলে দূরে সরে যায়; তারপর দাহকায্য শেষ হ’লে জল দিয়ে আগুন নিবিয়ে দেয়। ওয়ারিশ মৃতব্যক্তির একখানা হাঁড় জলে ধুয়ে, এবং হলুদজলে এবং দুধে ফেলে নিয়ে আসে। সন্ধ্যাবেলা সকলে ঘরে ফিরে আসে। সকলে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “কিছু ভেব না। ইনি ত চলে গেলেন, সুখেই গেলেন, আমাদেরও একদিন এরূপ যেতে হবে।”
(৩) শ্রাদ্ধক্রিয়া
শ্রাদ্ধ মৃতব্যক্তির শেষ ক্রিয়।। এদের জন্যই শ্রাদ্ধক্রিয়ার প্রতিষ্ঠান। হাঁড়ি এবং ভোজের যত জিনিষ এনে একত্রিত করা হয়। নির্দ্দিষ্ট দিনে গ্রামের সমস্ত লোক ও আত্মীয় স্বজন এসে উপস্থিত হয়, সকলে কামিয়ে স্নান করে। দেবতা ও পূর্ব্বপুরুষদের নামে ভাত উৎসর্গ ক’রে পূজা দেওয়া হয়।
বাড়ীর উঠানে সাজনা গাছের ডাল পুতে, গোবর লেপে দেয়, পাতা পেতে চাল রাখে, এবং তারপরে মন্ত্র পড়া হয়। মৃতব্যক্তি সম্বন্ধে নানাপ্রকার কথাবার্তা হয় এবং দেবতাদের উদ্বোধন করা হয় তার আত্মার সুখশান্তির জন্য। শ্রাদ্ধের সময় গাই, ছাগল, শূকর, মুরগী বা কিছু উৎসর্গ করা হয়। এরূপ প্রবাদ আছে যে, সব পরলোকে মৃত ব্যক্তির নিকট চলে যায়।
পরলোক—স্বর্গ
প্রাচীনেরা বলে থাকে যে ঠাকুর আমাদের জন্য পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীতে আয়ুঃ শেষ হলে লোক স্বর্গে চলে যায়! সেখানে আমাদের দোষগুণ বিচার হয়। যিনি পুণ্য করেন তিনি ভাল ‘ঠাঁই’ পান; আর যে পাপ করে সে নরকে স্থান পায়। পুণ্যবান ব্যক্তির উপরে উপদেবতা কিংবা পর্বতদেবতাদের কোন প্রতিপত্তি থাকে না। এদের প্রতিপত্তি কেবল পাপী লোকের উপর।
লোকে কথায় বলে “মর্ত্তে যা যা খেতে ইচ্ছা হয়, স্বর্গে গেলেও সেইরূপ খেতে ইচ্ছা করে; কিন্তু সে সব খেতে চেরে খেতে পায়না এবং সে জন্য অত্যন্ত কষ্ট অনুভব করে। মর্ত্তে যারা মাংস বেশী পছন্দ করে, তারা পরলোকে গিয়ে সৰ্ব্বক্ষণ মাংস মাথায় করে ব’য়ে বেড়ায়; বেশ পচে যায় তবুও খেতে পায় না। ইহলোকে যদি কেহ ঋণ পরিশোধ না করে তবে তাহা পরলোকে জমতে থাকে, এবং ঋণীর পিঠের চাম ছাড়িয়ে সেখানে নুন লাগিয়ে দেয়।
প্রাচীনদের কথা এখানে শেষ হল।