বিবাহ-বিষয়ক
(১) ঘটক
যদি কেহ নিজের ছেলের জন্য পাত্রীর সন্ধান করা আবশ্যক মনে করে তবে সে ঘটকের আশ্রয় নিয়া থাকে; সে বলে “ওহে, কোথায়ও পাত্রী খুঁজে দেও;” ঘটক উত্তরে জিজ্ঞাসা করে, “কি রকম পাত্রী?” তখন ছেলের বাপ বলিয়া থাকে, “এরকম কি সে রকম;” ঘটক বলে, “স্মরণ করে দেখছি, আচ্ছা দেখি উহারা রাজী হয় কিনা।” ছেলের বাপ তখন বলে, “আচ্ছা, তাহা হইলে খোঁজ করে অমুক দিন আমাকে এসে খবর দিবে।”
তারপর ঘটক কুটুম্বের বাড়ী এসে জিজ্ঞাসা করে “তোমাদের কুটুম্ব এনে দিব? রাজী আছ? কি বলছ?” তখন তাহারা বলে, “কি রকম কুটুম্ব? আমাদের যে ভয় লাগাচ্ছ?” ঘটক তখন বলে “কোন ভয় নাই, ভাল কুটুম্ব।” তারপর ঘটক কথাটা ভেঙ্গে দিয়ে জিজ্ঞাসা করে, “তোমাদের মেয়ের অন্য কোথাও সম্বন্ধ স্থির করেছ কি?” তাহারা জবাব দেয়, “না। এখনও কোন কথা হয় নাই।” তখন ঘটক বলে, “তবে কুটুম এনে দিব?” তাহারা জিজ্ঞাসা করে, “আনবে ত, কিন্তু কোন গোত্রের?” ঘটক বলে, “অমুক গোত্রের।” তারপর আবার জিজ্ঞাসা করা হয়, “কোন্ গ্রামের?” সে বলে, “ অমুক গ্রামের;” আবার প্রশ্ন হয়, “সে কে?” তখন সে উত্তর দেয় ‘অমুকে।” তখন তাহারা বলে, “আচ্ছা তবে, যদি তাহারা আমাদিগের উপর খুসী হয়।” ঘটক বলে, “আচ্ছা অমুক দিন আমি তাহাদিগকে নিয়ে আসব, তোমরা ঘরে থাকিও।” তখন তাহারা জবাব দেয়, “আচ্ছা, প্রথমে বাইরে বাইরেই হউক, নতুবা যদি পাছে লজ্জা পেতে হয়, যদি আমরা পরস্পর রাজী না হই।”
তারপর ঘটক পাত্রের পিতার নিকট হাজির হ’য়ে বলে, “কুটুম্ব বলেছে ভাল, তুমি নিম্নে এস কিন্তু এবারটা বাইরে বাইরেই কথা হইবে। আমাদের যাওয়ার দিন অমুক দিন ঠিক করিয়া আসিয়াছি।’
(২) সার সাগুণ (a good omen —শুভাশুভ)
শুভ, অশুভ চিহ্ন
নির্দ্ধারিত দিনে ঘটক এসে ছেলের বাপ মা ও গ্রামের দুইজন মাতব্বর নিয়ে অতি প্রত্যুষে রওনা দেয়। পথে যাইতে যাইতে নিজেদের গ্রামের সীমায় অথবা পাত্রীর গ্রামের সীমায় যদি আগুন, কুড়োল, কাহারও মস্তকে জ্বালানী কাঠ, সাপ কিম্বা শিয়াল তাহাদের পাশ কেটে যায়, তবে সেটা অশুভ চিহ্ন ব’লে গণ্য হয়, এবং সেজন্য তাহারা ঘরে ফিরে যায়। কিন্তু যদি তাহাদের নিজের গ্রাম্যপ্রান্তে কিংবা পাত্রীর গ্রাম প্রান্তে পূর্ণ কুম্ভ, গাভী, নূতন ভাণ্ড, বলদ, অথবা কোন বাঘের পদচিহ্ন দেখা যায়, তবে সেটা বিশেষ শুভ—জনক হয়, এবং তখন তাহারা পাত্রীর গ্রামের জগমাঁঝির নিকট এসে উপস্থিত হয়। [আজকাল এসব কেবল মিছামিছি; কেননা পাত্রের সিতা পূর্ব্বেই নিজের গ্রামের মাঁঝিকে বলিয়া থাকে যে “অমুক দিন ভোরে আমরা পাত্রী দেখতে যাব, সেই সময় তুমি গ্রামের লোকদের সাবধান করে দিবে যেন সে সময় কেহ আমাদের বিঘ্ন না জন্মায়।” আর পাত্রীর গ্রামের মাঁঝিকেও ঘটক এই প্রকার কথা বলিয়া থাকে যেন তাহাদের গ্রামের কেহ কোন বাধা না জন্মায়।]
ঘটক জগমাঁঝিকে বলে, “পাত্রা দেখতে এসেছি, এবার জিনিষটি (মেয়েটি) আমাদের দেখিয়ে দেও।” তখন জগমাঁঝি পাত্রীর পিতার নিকট গিয়ে খবর দেয়, “ওহে, কুটুম এসেছে।” তাহারা বলে, “বেশত, ভালই।” তখন জগমাঁঝি মেয়েটিকে বলে “এস ত তোমরা দু একজন আমাদের বাড়ী, আমাদের কুটুম এসেছে, তাহাদের জলটল দিবার লোক নাই, এস তোমরা দিবে।” তখন মেয়ের পিতামাতা উহাকে বলে, “যাও মা, ওর সঙ্গে চলে যাও।” তখন মেয়েরা তিনজন যায় এবং যাইবার সময় সমবেত সকল লোকদের প্রণাম করতে করতে যায়। পাত্রী তিনজনের মধ্যে থাকে, পাছে সে লজ্জা পায়। তখন ঘটক পাত্রের পিতামাতার কাণে কাণে ফিস ফিস করে বলে, “মাঝের মেয়েটির উপর নজর রাখ।” প্রণাম করবার পরও মেয়ে তিনটি খানিকক্ষণ পৰ্য্যন্ত দাঁড়িয়ে চলে যায়। ইহারা চলে গেলে জগমাঁঝি এসে ঘটককে জিজ্ঞাসা করে “কিহে, পছন্দ হল কি?” তখন কুটুম্বেরা বলে, “হাঁ, আমাদের পক্ষেত ভালই, আমরাত রাজী, উহারা এখন রাজী হয় কিনা।”
তারপর জগমাঁঝি পাত্রীর পিতামাতার বাড়ী আসে। তাহারা উহাকে জিজ্ঞাসা করে, “কিহে জগমাঁঝি, কুটুমরা কি বলাবলি করছে খুসী হয়েছে কিনা?” জগমাঁঝি তখন বলে, “হাঁ, কুটুমরা ভালই বলছে, তাহারা খুসী হয়েছে।” তারপর পাত্রীর পিতা জগমাঁঝিকে বলে, “কুটুমদের নিয়ে এস, তাহারা জলটল খেয়ে যাবে।” জগমাঁঝি নিজের বাড়ী এসে ঘটকদের বলে, “ওহে ঘটক বাবা, কুটুম মিলেছে, এস জলটল খেয়ে যাবে।” তখন পাত্র পক্ষের লোকেরা বলে “নাহে, এই ভাল, এখন জল খাবার দরকার নাই, পরেত ঢের খাবই।’ যদি পাত্রীর পিতা হাঁড়ি তৈয়ার করে থাকে তবে সে জগমাঁঝিকে বিশেষ ভাবে অনুরোধ করে, “এস, বেশীক্ষণ বসতে হ’বেনা, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই হয়ে যাবে।” তখন এপক্ষ বুঝে নেয় যে হাঁড়ি তৈয়ার আছে, সেজন্য সকলেই সেখানে যায়। জগমাঁঝি ইহাদিগকে সঙ্গে নিয়ে যায়। মেয়েরা সেখানে হাজির থাকে, কুটুম্বরা আসিবামাত্র তাহারা খাটিয়া, মাচি (চেয়ার), পিঁড়ি প্রভৃতি বসবার আসন পেতে দেয়; তাহারা জল দিয়ে আবার তাদের প্রণাম করে। তারপর পাত্রীর পিতাও তাহাদের প্রণাম করে এবং পরস্পর সুখ-দুঃখের কথা আলোচনা করে। তারপর মেয়েরা কুটুমদের পা ধোয়াইয়া বাড়ীর ভিতরে নিয়ে যায়। সেখানে সকলকে হাঁড়ি মদ G ভাত খেতে দেওয়া হয়। খাওয়া দাওয়া শেষ হলে তাহারা বিদায় নেয়। অনেকে প্রথমবার পাত্রীর পিতামাতার ঘরে প্রবেশ করে না। একেবারে জগমাঁঝির বাড়ী হইতেই ফিরে চলে যায়।
বাড়ীতে এসে পাত্রের পিতা ঘটককে বলে, “এতদিন পরে আবার আসিবে।” নির্দ্দিষ্ট দিনে ঘটক এলে তাহাকে হাঁড়ি দেওয়া হয় ও বলা হয়, ‘যাও কুটুমদের নিয়ে এস, এবার তাদের পালা।” তখন ঘটক পাত্রীর বাড়ীতে চলে আসে এবং তাদের বলে “এস, তোমাদের খোঁজ হয়েছে, কখন যাবে?” পাত্রীর পিতা বলে, “এস, আমরা একে ওকে ডেকে আনি;” এই ব’লে মাঁঝিকে, পারাণিককে ও জগমাঁঝিকে ডেকে আনে, এবং হাঁড়ি তৈয়ার থাকিলে পান করে এবং কথাবার্তা বলে। পাত্রের পিতা বলে, “আমাদের কুটুমরা আমাদের খোঁজ করেছে, আমরা কবে যাব ব’লে ঘটককে দিন ধার্য্য ক’রে দেই।” তাহারা পঞ্চম দিন ধার্য্য করে। ঘটক ফিরে আসে এবং পাত্রের পিতাকে খবর দেয়, “অমুক দিন কুটুমরা আসবে।” পাত্রের পিতা দুই এক হাঁড়ি মদ তৈয়ার করে।
নিৰ্দ্দিষ্ট দিন উপস্থিত হ’লে অতি প্রত্যূষে পাত্রী পক্ষের লোক, পাত্রীর পিতামাতা আর গ্রামের দুই একজন মাতব্বর পাত্র দেখতে আসে। ঘটক তাদের নিয়ে আসে। স্বগ্রামের প্রান্তভাগে কিংবা পাত্রের গ্রামের প্রান্তভাগে যদি আগুণ, কুড়োল, কাহারও মাথায় কাঠ, সাপ অথবা শৃগাল তাদের সামনে পাশ কেটে যায় তবে সেটা অশুভ লক্ষণ মনে করে বাড়ী ফিরে যায়, আর সম্বন্ধও ভেঙ্গে যায়। কিন্তু যদি নিজের গ্রামের সীমায় পূর্ণ কলস, গাই, নূতন ভাণ্ড, বলদ, অথবা বাঘের পদচিহ্ন দেখিতে পাওয়া যায় তবে সেটা শুভ লক্ষণ মনে করে এবং তাহারা পাত্রের গ্রামে জগমাঁঝির গৃহে এসে হাজির হয়। ঘটক জগমাঁঝিকে বলে, “ওহে কুটুমেরা পাত্র দেখতে এসেছে, আর বেশী দেরী করো না।” জগমাঁঝি এসে পাত্রের পিতামাতাকে বলে, “কুটুমেরা এসেছে, ছেলেকে নিয়ে যাই।” পাত্রের পিতা পাত্রকে আর দুই একজন ছেলের সঙ্গে পাঠাইয়া দেয়, জগমাঁঝি তাহাদিগকে নিয়ে যায়। ছেলেরা এসে কুটুমদের প্রণাম করে। পাত্র ছেলেদের মাঝে থাকে; ঘটক মেয়ের পিতার কাণে কাণে বলে দেয় যে উহাদের মধ্যে মধ্যবর্ত্তী ছেলেটিকে ভাল করে দেখে নাও।” তাহারা পাত্র দেখে পছন্দ না করলে ঘটককে একান্তে ডেকে বলে, “পাত্রের বয়স বেশী, মেয়ে খুসী হ’বে না” অথবা অন্য কোন ওজর দিয়ে মানে মানে গোপনে চলে আসে; আর যদি পছন্দ হয় তবে ঘটককে সেরূপ বলে। ঘটক জগমাঁঝিকে জানায়, জগমাঁঝি পাত্রের পিতাকে জানায়। এরূপ শুনিলে পাত্রের পিতা জগমাঁঝিকে বলে, কুটুমদের নিয়ে এস, জলটল খেয়ে যাবে।” তাহারা আসে এবং পরস্পর অভিবাদন করে এবং ছেলেও কন্যার পিতাকে প্রণাম করে। সেই বাড়ীর মেয়েরা কুটুমদের পা ধোয়াইয়া দেয় এবং তাহাদিগকে ঘরের ভিতর নিয়ে যায়। প্রথমে হাঁড়ি পান করে, পরে ভাত খেতে দেওয়া হয়; তাহারা ঘরে ফিরে যায়; সব ঠিকঠাক হয়ে রইল।
(৩) ঘবাড়ী-প্রদর্শন
কুটুম্বদের অভ্যর্থনা
পাত্রীপক্ষের লোক পাত্রের অবস্থা জানবার জন্য তার ঘরবাড়ী দেখতে আসে। তখন পাত্রীর খুড়ো, জেঠা, মামা, মামী কিংবা মাসী, গ্রামের মাঁঝি, পারাণিক আর গ্রামের পাঁচজনের মধ্যে দুই একজন তাদের সঙ্গে আসে। ঘটক তাদিগকে একছার পাত্রের পিতামাতার বাড়ীতে নিয়ে যায়। সেখানে খাটিয়া, মাচি, পিঁড়ি প্রভৃতি বসবার জন্য পেতে দেওয়া হয়; তাহারা সকলেই বসে। পরে ঘটিতে বাটিতে জল আনা হয়, আর তাহাদের প্রণাম করা হয়। পরে পিঁড়ি, জল ও বাটিতে তেল আনে, পিঁড়ির উপর কুটুমদের পা রেখে পা ধুইয়ে দেয়; তারপর তৈল মাখিয়ে দেয়। পা ধোয়ার পর জগমাঁঝি ঘরে প্রবেশ ক’রে একমুঠো দাতন কাঠি ও একভাঁড় তেল এনে কুটুমদের বলে, “এস আমরা ঘাটে স্নান করতে যাই। তাদের জলের ঘাটের দিকে নিয়ে যায়। তারা দাঁতন করে তেল মেখে স্নান করে চলে আসে এবং আবার খাটিয়াতে উপবেশন করে। তখন বাড়ীর লোকে ভিতরে পাটি নিয়ে যায় এবং বলে “কুটুমদের জল এনে দাও।” কুটুমেরা হাত ধুয়ে বাড়ীর ভিতরে গিয়ে পাটিতে বসে।
পরে জগমাঁঝি বলে “ওহে মদ নিয়ে এস।” মদ আনা হয়। প্রথমে মাঁঝি পারাণিক প্রভৃতিকে তারপর অন্যান্য সকলকে চার চার পাত্র করে মদ দেওয়া হয়। পরে জগমাঁঝি বলে “ওহে বাটিতে করে মদ এনে কুটুমদের দেও।” আবার সকলকে মদ বিতরণ করা হয়। তারপর মাঁঝি বলে, “ওহে জগমাঁঝি, একটি মেয়েকে ডাক, পাত্রগুলি কুড়িয়ে নিয়ে যাক্।” মেয়েরা এসে সব কুড়িয়ে ফেলে দেয়। তারপর একটি বাটি ও একঘটি জল আনে; সকলে বাটিতে হাত ধুইয়া ফেলে।
চিড়ামুড়ি
তারপর জগমাঁঝি বলে, “পাতা নিয়ে এস” পাতা এনে প্রথমে মাঁঝির সামনে পরে অন্যান্য লোকের সামনে পেতে দেওয়া হয়। পাতা দেওয়া হ’লে পর জগমাঁঝি বলে “ওহে একটি ছেলেকে পাঠিয়ে দেও, আমাদের চিড়ামুড়ি দিয়ে যাক্। সে প্রথমে মাঁঝিকে পারাণিককে এবং পরে আর সকলকে পরিবেশন করে। তারপর জগমাঁঝি কুটুমদের বলে “এস চিড়ামুড়ি ভিজান যাউক।” তাহারা চিড়ামুড়ি ভিজায় এবং তখন জগমাঁঝি বলে “ওহে গুড আন।” গুড় এনে প্রথমে মাঁঝি পারাণিককে তারপর অন্যান্য সকলকে দেওয়া হয়। পরে জগমাঁঝি বলে “ওহে কুটুমরা, এই দেখ আমরা মানুষকে শুকনো করেছি। নতুবা পূর্ব্বযোগে যেরকম বস্ত—ধনীরা ধানভূষ শুকাত, আর আমরা কুটুমদের শুকাচ্ছি; এতে তোমাদের মনে দুঃখ হবে।” কুটুম্বেরা
তখন জবাব দেয় “যারা মনে দুঃখ করত তারা সকলে চলে গেছে (মরে গেছে)। * খাওয়া শেষ হ’লে জগমাঁঝি বলে “আমরাত খেয়ে উঠান উজাড় করেছি, আরও মুড়িচিড়া নিয়ে এস। আবার মুড়িচিড়া এনে পরিবেশন করা হয়। পরে জগমাঁঝি বলে “ওহে ভিতর থেকে কুটুমদের জল এনে দাও।” তখন একবাটি করে আবার মদ দেওয়া হয়। এইভাবে খাওয়া দাওয়া শেষ হয়।
পরে জগমাঁঝি ডেকে বলে, “ওগো, বড় বউমা, (সে না থাকিলে অন্য কোন মেয়েকে ডাকা হয়) এদিকে এস, পাতাগুলি ফেলে দাও, আর ঘটীতে জল এনে বাটিতে ঢেলে দাও, আমরা হাতমুখ ধুইব।” হাতমুখ ধোওয়া হ’লে পর আবার দুই দুই পাত্র মদ দেওয়া হয়। তারপর ভিতর হইতে বাইরে গোশালায় এসে খাটিয়াদিতে বসে; জগমাঁঝি ডেকে বলে, “ওগো বড় বৌমা, এখন হুঁকা ও তামাক নিয়ে এস। সে নিয়ে আসে; কুটুমদের তামাক দেওয়া হয়।
তারপর জগমাঁঝি বাড়ীর ভিতর গিয়ে পাত্রের পিতাকে বলে “ওহে কুটুমদের কি দিয়ে ভাত খাওয়াইব?” সে বলে, “যাও, বড় ছেলেকে ডেকে দাও।” বড় ছেলে এসে জিজ্ঞাসা করে “বাবা, কেন ডেকেছ?” পিতা বলে, “ওহে যাও বড় খাসিটি নিয়ে এস।” সে গিয়ে খাসিটি নিয়ে আসে।
পরে জগমাঁঝি বলে, “ওহে, ঘটিতে জল নিয়ে এস।” জল আসিলে খাসির মাথায় জল ঢালা হয় এবং তাহাকে কাটা হয়।
ভাত খাওয়ার জন্য আবার কুটুমদের বসান হয়। ভাত তরকারী দেওয়া হ’লে পর জগমাঁঝি বলে, “দেখ বন্ধুগণ, আমরা আমাদের কুটুমদের শুকনো করছি; পূর্ব্ব পুরুষেরা ধান ও তুষ শুকনো করতো, সেজন্য মনে দুঃখ করো না।” তখন কুটুমেরা বলে, “মনে দুঃখ করিবার কোন কারণ নাই; দুঃখ করিবার লোক সব চলে গেছে।” ভাত খাবার পর হাত ধুয়ে চূণ ও তামাক খাওয়া হয়। বিদায় হবার পূর্ব্বে আবার বাড়ীর ভিতরে নিয়ে মদ দেওয়া হয়। মদ পান করে বিদায়ের জন্য বাইরে চলে আসে। তারপর তারা পংক্তিতে পংক্তিতে দাঁড়ায়— পরস্পরে অভিবাদনের জন্য। এরূপে বিদায় নিয়ে তারা চলে যায়। (হিন্দু বিবাহের অনুকরণ)।
(8) ঘট-প্রদীপ – (Betrothal)
কনের ঘট প্রদীপ
ঘটক আসা যাওয়া করে; পরে ঘটপ্রদীপের দিন ধার্য্য হয়। প্রথমে কনের ঘটপ্রদীপ হয়। নির্দ্দিষ্ট তারিখে ঘটকমহাশয় বরের পিতা, খুড়ো, জেঠা, মামা ও পিসা, মাঁঝি, জগমাঁঝি, পারাণিক ও গ্রামের পাঁচজনের দুই একজন নিয়ে কনের বাড়ীতে আসে। কন্যাপক্ষের জগমাঁঝি রাস্তার মোড়ে জলপা নিয়ে কুটুমদের অভ্যর্থনা করে এবং কনের বাড়ীতে নিয়ে যায়। সেখানে খাটিয়া, মাচি, পিড়ি প্রভৃতি এনে তাহাদের বসতে দেওয়া হয়; তাহারা সেখানে বসে।
পরে পাত্রীর পিতামাতা বাড়ীর ভিতর হইতে এসে জল দিয়ে কুটুমদের প্রণাম করে। তারপর তাহাদের পা ধোয়াইয়ে স্নানের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। স্নানের পরে মদ পান করে ও চিড়ামুড়ি খায়। খাবার পর বাইরে এসে গোশালায় বিশ্রাম করে।
পরে (যেমন পাত্রের বাড়ীতে হয়েছিল) তাহারা একটি খাসি আনে। খাসির মাথায় জল ঢেলে দেয়; তখন জগমাঁঝি বলে “ওহে শাকটা কেটে ফেল।” তখন কুটুমেরা খাসিটাকে কেটে ফেলে। তারপর জগমাঁঝি ডেকে বলে, “ওহে বড়বাবু, এদিকে এসে খাসিটাকে বানিয়ে ফেল।” সে এসে খাসিটাকে কেটে বানায়। তারপর ভাত তরকারী রান্না হয়। তখন কুটুমের। বলে, “ওহে জগমাঁঝি, আমাদের তাড়াতাড়ি বিদায় কর।”
তারপর জগমাঁঝি বলে, “ওহে বড়বাবু এবার পাটী পেতে দেও।” পাটী পাতা হ’লে জগমাঁঝি কুটুমদের বলে “ভাইসকল, এবার খাটিয়া হতে নেমে পাটীতে বসে পড়।” তখন সকলে পাটীতে বসে। জগমাঁঝি বলে “এবার হাঁড়ি (মদ) নিয়ে এস. প্রত্যেকে দুই দুই পাত্ৰ মদ পান করে।
পরে জগমাঁঝি ডেকে বলে, “ওহে এখন কনের হাতে জল পাঠিয়ে দেও।” বাটীতে করে হাঁড়ি আনা হয়। কনে প্রথমে মাঁঝিকে এক বাটী মদ ও এক ঘটি জল দিয়ে প্রণাম করে, তারপর পারাণিককে এক বাটী হাঁড়ি ও এক ঘটি জল দিয়ে হাঁড়ি ও জল দিয়ে প্রণাম করে; পরে বরের পিতাকে সে হাঁড়ি পান করে বাটী রেখে দেয় আর বৌকে হাতে ধ’রে কোলে বসায় এবং গলায় একগাছা হাসুলি পরায়ে মুখে চুমা খায়। পাত্রীপক্ষের লোকেরা তখন গান ধরে :–
ওগো মাগো দিয়ে যাও এক ঘটি জল,
বাবা শ্বশুর বউকে নেও পায়ের তল।
পাত্রী যখন পাত্রের পিতাকে জল দেয় তখন এই গান গাওয়া হয়। আর শ্বশুর যখন বৌকে কোলে করে বসে তখন এই গান গাওয়া হয় :—
দেখে নেও অমুক রীতি,
চিনে নেও অমুক রীতি,
মনে লাগেত বস পায়ের উপরে।
তারপর পাত্রী শ্বশুরের কোল থেকে নেমে তাহাকে প্রণাম করে; এবং আর একবার হাঁড়ি বিতরণ করা হয়। সকলকেই আবার জল ও হাঁড়ি দেওয়া হয়। তখন গান হয় :—
কে কে তুম্বা গাড়ুর জল আসছে,
কে কে তুম্বা গাড়ুর জল নিচ্ছে;
কে কে শুভ স্থির করছে,
তুম্বা গাড়ুর জলে?
ফলনা লোকে আসছে তুম্বা গাড়ুর জল,
ফলনা লোকে নিচ্ছে তুম্বা গাড়ুর জল।
ফলনা লোকের শুভ স্থির করছে,
তুম্বা গাড়ুর জলে।
গানে “ফল্না” কথার পরিবর্তে কনে বরের বংশের নাম উল্লেখ করে। এক বংশে বিবাহ হয় না : ভিন্ন ভিন্ন বংশে বিবাহ হয়।
পান করা শেষ হ’লে জগমাঁঝিকে সকলে বলে, “ওহে, ভিতরে গিয়ে দেখে এস, ভাত রান্না হয়েছে কি না?” সে ভিতরে গিয়ে দেখে যে রান্না হয়েছে; তখন কনের বাপ বড় বৌকে ডেকে বলে “ও বড় বৌমা, ঘটিতে বাটিতে জল নিয়ে এস।” বৌ জল নিয়ে আসে ও ঘটির জল হাত ধোয়ার জন্য বাটিতে ঢেলে দেয়। তখন জগমাঁঝি ডেকে বলে, “ওহে বড়বাবু, পাতা, বাটি, ভাত তরকারী নিয়ে এস।” ভাত-তরকারী এনে প্রথমে মাঁঝিকে, পারামাণিককে, তারপর অপর সকলকে পরিবেশন করে। তখন জগমাঁঝি কুটুম্বদের সম্বোধন করে বলে “পুরাকালে প্রাচীনেরা ধান তুষ শুকাইত, আর এমন আমরা তোমাদের শুকাইতেছি (কষ্ট দিচ্ছি), সেজন্য তোমাদের বিশেষ দুঃখ হতেছে।” তারা জবাব দেয়, “হাঁ, বাবা “খাব” ত বলি, কিন্তু কতগুলো জিনিষ একত্র করলে খাওয়া হতে পারে! কাঠই বল, জলই বল, পাতাই বল সব একত্র ক’রে রান্না বান্না করলে তবে আমাদের খাওয়া হয়।”
আহারের পর সকলে হাত ধুয়ে উঠানে এলে তামাক খায়। জগমাঁঝি তখন বলে “ওহে কুটুমদের কখন বিদায় করবে? সকলে বলে, “ভিতরে গিয়ে দেখ জায়গা আছে কিনা?” সে গিয়ে দেখে জায়গা আছে। তখন সকলে ঘরের ভিতর প্রবেশ করে পাটীতে বসে।
বেয়াইর সম্ভাষণ
জগমাঁঝি বলে, “হাঁড়ি নিয়ে এস।” হাঁড়ি এনে সকলকে দেওয়া হয়। পরে বরের পিতা ও কনের পিতা এক জায়গায় বসে এবং তাদের জন্য আর একবার হাঁড়ি আনা হয়। তখন দুজনে বলে, “এস বেয়াই, এস আমরা এই হাঁড়িটা খেয়ে ফেলি।” তখন দুজনে বলে, “এস কুটুমদের প্রণাম করি।” তারা কুটুমদের প্রণাম করে। তখন বেয়াই দুজন পরস্পর হাত ধরে তিন তিনবার হাত আনা নেওয়া করে। করে। পরে দুজনেই মাথার দিকে হাত তুলে দেয়, পরে তিন তিন বার কাঁকে কাঁকে কোলাকুলি করে; কোলাকুলি করে আবার তিন তিন বার হাত আনা নেওয়া করে; এবং পুনরায় হাত মাথায় দিকে উপরে তুলে দিয়ে বলে, “সাহেব” (used by fathers-in-law when saluting each other)। তখন গান ধরে,
মঞ্জুরা মঞ্জুরা মঞ্জুরাময় হে,
কেমন মঞ্জুরা মোদের আমোদ;
দুজনে সম্বন্ধ করে স্থাপন,
দুজনে করব মোরা আমোদ।
কনের বাপ তখন বলে, “ওহে বেয়াই, আজ থেকে এ বাড়ী তোমাদের “হ’ল।” বরের বাপও তখন বলে “বেয়াই, আমার বাড়ীও আজ থেকে তোমার।” পরে বেয়াই দুজন পরস্পর বলাবলি করে, “ওহে, তুমি যে ভাবে গ্রামে গ্রামে বেড়িয়ে বেড়াতে, কিংবা শিকারে যেতে, কিংবা মাঠে, ময়দানে, বনে জঙ্গলে চোয়ান জল কিংবা ঝরণার জল খেতে, আজ থেকে সে সব ছেড়ে দাও; আর আমার এখানে কুঁড়ের ছায়া, পাখীর বাসা, তুম্বার জল আছে, কষ্ট হইলেও এখানে আসবে, ডানবায় যেয়োনা, যখনই হউক এদিকে এলে আমার এখানে পায়ের ধূলি দিয়ে কিছু জলটল খেয়ে যাবে; ছেলেদের একবার দেখে যাবে।” এই প্রকারে গল্প গুজব করতে করতে তারা হাঁড়িপান শেষ করে।
পর কুটুমরা বলে, “ওহে জগমাঁঝি, এখন আমাদের বিদায় দেও।” তখন তারা সকলে বাইরে উঠানে আসে। সেখানে কনেপক্ষের লোক একদিকে, আর বরপক্ষের লোক আর একদিকে মুখোমুখী দাঁড়ায়ে পরস্পর অভিবাদন করে। পরে বিদায় হয়ে ঘরে ফিরে যাওয়ার সময় জগমাঁঝি বলে, “ওহে বন্ধুগণ! দেখ তোমরা যে পাহাড়ের “শাক” (খাসি) তুলেছিলে সেটাও তোমাদের খাঁড়া ভূলে ফেলে যাচ্ছ যে!” তখন খাসির এক এক টুকরা করে সকলকে দেওয়া হয়; তারা নিয়ে চলে যায়।
এই ভাবে কন্যার পিতা ও বরের পিতার ঘরে গিয়ে বরকে একটা হাসলি কিংবা অন্য কিছু পরিয়ে দেয়।
(৫) পণ
ঘটক যাওয়া আসা করে। বরের পিতা ঘটককে বলে, “যাও হে কুটুমদের বুঝে এস!” ঘটক যায় এবং ফিরে এসে বলে “হাঁ কুটুমরা রাজী হয়েছে!” তখন বরের বাপ গ্রামের মাঁঝি, পারাণিক, জগমাঁঝি ও গ্রামের আরও দুই তিনজন মাতব্বর ডেকে তাদের হাঁড়ি খাওয়ায়। গ্রামের মাঁঝি জিজ্ঞেস্ করে “এ হাঁড়ি কিসের?” “ও গো, মাঁঝি, এটা ঘটকের হাঁড়ি, এবার পণ দিতে হবে।” হাঁড়ি পান করা হয়।
“গিরা” বান্ধা (Santhali mode of intimating date of marriage)
পরে তারা গিরা বান্ধে পাঁচদিন কি সাতদিন পৰ্য্যস্ত। (Five or seven knots are tied on a string to indicate that the marriage would take place 5 or 7 days after. Each string is loosed each night; when all have been loosed the time for marriage h’s come.) ঘটক গিরা নিয়ে কনের বাড়ীতে যায়। সেখানে তাদের অমত হইলে গিরা বাড়িয়ে দেয়; তাদের কথাই গ্রাহ্য হয়;
আইও বরের সঙ্গে
পরে নির্দ্দিষ্ট দিন উপস্থিত হ’লে বরের পিতা, মাঁঝি, পারাণিক, জগমাঁঝি, পেয়াদাকে ডেকে বলে, “পণ দিবার তারিখ উপস্থিত, এস বরযাত্রী হ’য়ে যাবে।” তারা ব’লে, “গ্রামের ছোট বড় সকলকে ডেকে আনি।” পেয়াদা তাদের ডাকৃতে চলে যায়। তারা এসে বরের পিতাকে জিজ্ঞেস করে “ওগো বাবা, তেল-হলুদে কুলাবে কিনা?” সে বলে “কুলাবে।” তারপর নায়ক ও নায়কের স্ত্রীকে, একলাইনে পাটিতে বসিয়ে আইওরা তেল হলুদ মাখায়। তাদের পর মাঁঝি ও তার স্ত্রী, পারাণিক ও তার স্ত্রী, জগমাঁঝি ও তার স্ত্রী, পেয়াদা ও তার স্ত্রী প্রভৃতিকে স্বামী স্ত্রীকে একত্রে তেল হলুদ মাখান হয়। এর পর বরের বাপকে ও গ্রামের ছোট বড় সকলকেই তেল মাখানো হয়। তখন জগমাঁঝি বলে, “এবার বরকে আন, তেল মাখাব”; বরের মা বলে, “আইও কোথায়!” বরের বড় বোন না থাকিলে বড় বৌ কিংবা ছোট বোন আইও হ’তে পারে। আরও বলে “বরের অনুগামী হবে কে?” তারা তখন বলে “কাকার ছেলে আছে, সে বরের চেয়ে ছোট, তাকে বরের সঙ্গী করব।” নিজের জ্ঞাতির ছেলে না থাকলে ভাই সম্পর্কিত অন্য লোকের ছেলেও সঙ্গী হতে পারে।
তারপর একটা ঘটিতে জল এনে বড় বৌকে বলা হয় “বরের চারিদিকে ঘোর।” তখন আইওরা একটা পাটি হাতে নেয় এবং বড় বৌ আগে আগে এদের সহিত যায় ও বরের চারিদিকে ঘটির জল ঢেলে ঢেলে ঘুরতে থাকে। তিনবার ঘোর! শেষ হ’লে আইওরা পাটি পেতে দেয় এবং বর, কোলবর (সঙ্গী } আর আইও সকলে সেখানে বসে। পরে জগমাঁঝি বলে “বরের মাকে আসতে বল।” সে আসে; পাত্রে তেল হলুদ থাকে; জগমাঁঝি বলে, “বরের মাকে বরের মুখে তেল হলুদ মাখাতে বল।” তারপর জগমাঁঝি আইওদের বলে, “এবার তোমরা বরকে তেল মাখাও।” তারা তেল মাখায়; তখন ঘটক বলে, “এখন সকলে প্ৰস্তুত হও, বেলা বাড়ছে চলে এস।”
শান্তিজল
সকলে ঘটককে জিজ্ঞেস করে “বড় রাস্তা কি ছোট রাস্তা দিয়ে আমা—দের নিয়ে যাবে?” ঘটক জবাব দেয় “বড় রাস্তায় যাব।” পরে তারা দুটি টাকা আর পিতলের হাসলি সঙ্গে নেয়, এবং নাগরা রামসিংঙ্গা কিংবা ঢাক বাজাতে বাজাতে চলে যায়। তারা কনের গ্রামে উপস্থিত হ’লে রাস্তার মোড়ে দাঁড়ায় এবং ঘটক পাত্রীর বাড়ী আগে চলে গিয়ে বলে, “এই যে আমরা এসেছি, শান্তিজল নিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা কর এবং আমরা কোথায় বাসা করব দেখিয়ে দেও।” পাত্রীর পিতা জগমাঁঝিকে ব’লে “যাও খোঁজ নিয়ে এস, গ্রামে কোন বড় ঘর মিলে কিনা; “জগমাঁঝি খোঁজ নিয়ে বাড়ী ঠিক করে। তারপর একটা পাতার উপরে ঘটির জল রেখে বরযাত্রীদের নিকটে যেয়ে বলে, “এস তোমাদের আড্ডায় নিয়ে যাই।” তারা সকলে আড্ডায় আসে। সেখানে বরপক্ষ জগমাঁঝি ও পেয়াদেেক বলে, “ওহে, জ্বালানী কাঠ, দুটা ভাতের হাঁড়ি একটা পাতিল আর একটা হাতা খুঁজে নিয়ে এস; জল কোথায়? দেখিয়ে দেও, রাত্রে কোথায় পাব? আর ভাত ঢালবার জন্যে একটা বড় গামলা নিয়ে আসবে।” তারা সব নিয়ে আসে।
পরে বরযাত্রীরা ক্লান্তি দূর করবার জন্যে হাঁড়ি পান করে। তার। জগমাঁঝিকেও হাঁড়ি খাওয়ায়, নিজেরাও খায়। তখন জগমাঁঝি বলে, “এখন তোমরা ভাত রান্না কর; আমাদের যখন সব ঠিক হবে তখন তোমাদের ডেকে পাঠাব।”
পাত্রীর ঘরে হাঁড়ী প্রস্তুত হ’লে পর বরযাত্রীদের ডাকা হয়। তারা এসে পরস্পর অভিবাদন করে। তারপর উঠানে তারা ও গ্রামের লোকেরা বসে। তখন জগমাঁঝি সে বলে “এখন হাঁড়ি নিয়ে এস।” কুটুমদের জন্য জল ও তামাক আনে। হাঁড়ি আনা হয় এবং সকলে হাঁড়ি পান করে। তখন জগমাঁঝি বলে “ও গো কনের বাপ. কতটাকা পণ খাবে, বরপক্ষকে কি বলব?” বরপক্ষের ও কন্যাপক্ষের মুখোমুখী কোন কথা হয় না। কন্যাপক্ষের জগমাঁঝি দুটি পাত্র নিয়ে আসে। এক পাত্রে পাঁচগণ্ডা কড়ি পূরে দেয়। আর একটি পাত্রে তিন পাক সুতা ভ’রে দেয়—এক পাক স্থতা আধাআধি সাদা ও লাল, আর দুই পাক বেশীর ভাগ সাদা, কিন্তু তাহাতেও এক ভাগ লাল সূতা থাকে .
তারপর জগমাঁঝি ঘটককে ডেকে এনে বলে, “ওহে ঘটকমহাশয় এটি দেখ।” সে পাত্রছটি পরপক্ষের নিকট নিয়ে যায়; বরপক্ষেরা কোন সুতায় হাত দেয় না কিন্তু একটি কড়ি তলে নিয়ে পাত্রদুটি ঘটককে ফিরিয়ে দেয় এবং বলে “যাও কনের বাপের কাছে নিয়ে যাস।” সে নিয়ে এলে তারা দেখে যে একটি কড়ি কম; তখন তারা আর একটি কড়ি পাত্রে দিয়ে ঘটককে বলে, “যাও বরের পিতার নিকট ফের নিয়ে যাও।” তারাও আবার আর একটি কড়ি রেখে ফিরিয়ে দেয়। এই রকমে তারা তিনবার কি পাঁচবার পাত্র আনা নেওয়া করে। পরে আর কিছু নেয় না, মুখে কথাবার্তা চলে। যদি কনের বাপ তিন টাকা পণ নেয় তবে বরের পিত! দুটি কড়ি রাখে, আর পাঁচ টাকা পণ হ’লে—তিনটা কড়ি রাখে, আর সাতটাকা পণ হ’লে সাতট! কড়ি রাখে। তিনটাকা পণ হ’লে বরপক্ষের কেহ কিছু ফিরে পায় না। পাঁচটাকা পণ হ’লে বর একটা গাই—একটা বাটি, ও ধুতিচাদর পায়, আর বরপক্ষের গ্রামের পাঁচজন একটা খাসি, এক হাঁড়ি মদ, আর পাঁচপাই চাল, নুন ও হলুদ পায়। একেই বলে “পণং তোরায়োনি” (পণ-তোলানি)। পাত্রীর পিতা ৭ টাকা পণ খাইলে, তাকে একটা ধেনুগাই, একটা বাটি, একখান থালা, আর জামাইর ধুতিচাদর দিতে হয়। আর বরপক্ষের লোকেরা পণ-তোলানি পায়—একটা খাসি, এক হাঁড়ি মদ, আর সাত পাই (দেড়সের) চাল।
তারপর বরপক্ষ কনের গলায় হাসলি পড়িয়ে দেয়। আর সে হাঁড়ি বিতরণ করে এরপর তারা পণের দুইটাকা জগমাঁঝির হাতে দেয়। জগমাঁঝি টাকা হাতে নিয়ে সকলকে অভিবাদন করে। এ টাকাকেই “পানজা-তেন” বলে। জগমাঁঝি এ টাকা কনের বাপকে দেয়। তারপর বরযাত্রীরা আড্ডায় চলে যায়। কিছুক্ষণ পরে আবার ভোজে তাদের ডাকা হয়। ঘটপ্রদীপের সময় যেরূপ হয় এখনও সেরূপ হয়ে থাকে। ভোজনের পর শোবার জন্যে আবার আড্ডাতে চলে আসে। পরদিন ভোরে তাদের আবার ডেকে হাঁড়ি দেওয়া হয়; কনের মা ঘটকের কাছে পাঁচ পাইল। চিড়ামুড়ি বেন্ধে দেয়। উঠানে এসে পরষ্পর প্রাণামাদি ক’রে বরপক্ষ বিদায় হয়। তারা সকলে একেবারে ঘরে চলে আসে।
(৬) বিবাহ
ঘটক যাওয়া আসা করে। এইবার দুইপক্ষ বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হইবে। পণ দিবার পর সে বৎসর যে কোন সময়ে বিবাহ হ’তে পারে; কিংবা কখনও কখনও দুই এক বৎসর পরেও হয়ে থাকে।
বিবাহ দিতে সমর্থ বোধ করলে বরের পিতা ঘটককে ডেকে বলে, “ওহে, কুটুমদের কাছ থেকে গিরা নিয়ে এস।“ ঘটক কনের বাড়ীতে গাঁয়ে বলে, “এসো গিরা বান্ধি।” তখন পাত্রীর পিতা গ্রামের মাঁঝি, পারাণিক, জগমাঁঝি প্রভৃতি সকলকে ডেকে হাঁড়ি দেয়। হাঁড়ি পানের সময় মাঁঝি জিজ্ঞেস করে “এ কিসের হাঁড়ি?” কনের বাপ বলে, “ঘটক এসেছে, কতদিনের গিরা বেন্ধে দিব।” তারা দিনক্ষণ গণে নয়টি গিরা বান্ধে। পরে কনের মার বারহাত লম্বা রঙ্গীন সাড়ীর জন্য কনের—ঠাকুরমার জন্য আটহাত লম্বা সাড়ীর জন্য, আর কনের দিদিমার জন্যে সাতহাত লম্বা একখানা সাড়ীর জন্যে সূতার চিহ্ন পাকিয়ে দেয়। ঘটক গিরা ও পাকান সূতা নিয়ে বরের পিতাকে দেয়।
বরের পিতা গিরা ও সূতা পেয়ে গ্রামের মাঁঝি ও পারাণিককে ডাকায় এবং বলে, “দেখ গিরাত পাঠিয়েছে, আমরা কি বলব?” ওরা দুইজনে বলে, “বেশত, আমরাও বেন্ধে ফিরিয়ে দেই!” তখন হাঁড়ি পান করে ও পাঁচটা গিরা বান্ধে—একটা কনের পিতার জন্য, একটা বরপক্ষের গ্রামের মাঁঝির জন্যে, একটা পারাণিকের জন্যে, একটা জগমাঁঝির জন্যে, আর একটা বরের পিতার কুটুম্বদের জন্য;-এই সব নিমন্ত্রণ-চিঠি। কনের পিতার গিরাটি ঘটকের হাতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
বরের ঘরে আয়োজন মণ্ডপ
পরে তিন দিন থাকতে বরের পিতা মাঁঝি ও পারাণিককে ডেকে বলে, “ওহে দেখ, দিনও ঘনিয়ে এল, এস আমরা একটা মণ্ডপ তৈরি করি।” তারা বলে, “বেশত।” তখন বরের পিতা বলে, “ওহে, আমাকে পাঁচটি ছেলে ও পাঁচটি মেয়ে জোগাড় করে দেও।” পরে জগমাঁঝি পেয়াদা পাঠিয়ে গ্রামের যুবকদের ডেকে এনে বলে, “ওহে, এখানে একটা মণ্ডপ তৈরি কর।” পরে পুরোহিতকে ডেকে আনা হয়। সে এলে মাঁঝি বরের পিতাকে বলে, “তিনটা মুরগী পুরোহিতকে দেও—একটা লালচে, আর দুটি সাদা, আর তিন পাই চাল, একপাত্র হাঁড়ি ও পূজার সরঞ্জামাদি ওকে দেও।” ‘নায়ক (পুরোহিত) এসব গ্রাম্যপ্রান্তে নিয়ে জাহেরে দেবীকে মণ্ডপের নামে পূজা দেয়। তখন সে এইরূপ মন্ত্র পাঠ করে, “ওগো, জাহের দেবী, এই নেও, অমুক মাঁঝির মণ্ডপের নামে এই মুরগী প্রভৃতি জিনিষ তোমায় উৎসর্গ করছি; এগুলি খুসী হয়ে গ্রহণ কর। এতে খুসী হ’য়ে অভয় দেও যেন আমারা অমুক গ্রামে বরযাত্রী হয়ে যেতে পারি – রাস্তায়, বনে, জঙ্গলে যেন ভয়ত্রাসের কোন কারণ না থাকে, যেন হোঁচট্ না খাইয়ে পড়ি, কেহ যেন আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ না করে। আর ‘ওগো মা ঠাকুরাণ, ডাইনে বায়ে সব বাধা সরিয়ে দাও; তবে আমরা যাব, হাঁড়ি পান করব। দেখো যেন পেটকামড়ানি কিংবা মাথাবেদনা না হয়। ওগো ঠাকুরাণ, অভয় দেও কুটুম্বদের সহিত বিবাদ হবে না, ঝগড়া হবে না, বাদ হবে না, বিতণ্ডা হবে না, নাশ হবে না বিনাশ হবে না।” এই মন্ত্রপাঠের সময় লালচে মুরগীটি জাহের দেবীকে উৎসর্গ করা হয়। এর পর ‘ঘোরে’ দেবতাকে এরূপ মন্ত্রপাঠ করে একটি সাদা মুরগী উৎসর্গ করে; সৰ্ব্বশেষে “পৰ্ব্বত” দেবতাকে এইরূপ মন্ত্রপাঠ করে অবশিষ্ট সাদা মুরগীটি উৎসর্গ করে। নায়ক আর দুচারজন লোক সঙ্গে নিয়ে মুরগীর “সুরুয়া” পোলাও রান্না করে খায়, হাঁড়িও পান করে; পরে ঘরে চলে আসে।
পরে মণ্ডপের নিকট এসে জগমাঁঝি যুবকদের জিজ্ঞেস করে ‘মণ্ডপ শেষ হয়েছে কি?” ওরা বলে “হাঁ, শেষ করেছি।” জগমাঁঝি তখন বলে, “মণ্ডপের মাঝখানে একটা গর্ত খনন কর, মৌলগাছ পুত।” পরে জিজ্ঞেস করে “গর্ভ শেষ হয়েছে কি?” “তারা বলে, “হাঁ। শেষ হয়েছে।” আবার জগমাঁঝি বলে “ভিতরটা খুলে দেও।” খোলার পর জগমাঁঝি বরের পিতাকে বলে, ‘ তিন টুকরা কাঁচা হলুদ, আর পাঁচটা ফুটা কড়ি, আর তিন গাছ দুর্ব্বাঘাস নিয়ে এস, হলুদ পিষে উহার সঙ্গে তিনটি আতপ চাল মিশিয়ে দেও।” একত্র করে একসঙ্গে একটা পুটলি বেন্ধে গর্ভের ভিতরে পূরে রেখে দেয়; একটি মৌলগাছ পুতে দেয় ও খড়ের দড়ি দিয়ে গাছটির চারিদিক জড়িয়ে দেয়।
পরে জগমাঁঝি আইওকে ডেকে বলে “এসগো, মাটি দিয়ে এ জায়গা পরিষ্কার করে দেও, গুড়ি দিয়ে লেপ দিয়ে সাদা করে দেও। আর “গিরু” ঘসে মণ্ডপের খুটিগুলি নানাপ্রকারে চিত্রিত কর; আর সামনের দিকে বরকন্যা একে দেও।” আইও এসব করে দেয়।
পরে জগমাঁঝি যুবকদের বলে “এত শেষ হ’ল, এখন খেয়ে দেয়ে একটু সুস্থ হও।” এই বলে জগমাঁঝি বরের গৃহে প্রবেশ করে তেল আর দাঁতন কাটি এনে দিয়ে তাদের বলে, “যাও স্নান করে এস।” তারা দাঁতন করে তেল মেখে স্নান করে ঘরে এসে বসে। তখন জগমাঁঝি এ বিয়ের বাড়ি থেকে একপাত্র মদ এনে তাদের খেতে দেয়। তারা হাঁড়ি পান করে। তারপর এক ‘ডাবা’ ভাত ও এক পাতিল তরকারী আনে, পাতা ও জলের ঘটিও আনে; ঘটি এগিয়ে দিয়ে বলে, “জল ঢেলে হাত ধোও;” তারা হাত ধোয়। পরে জগমাঁঝি বলে “ওরে একজন ভাত দে, আর একজন তরকারী দে।” তারা ভাত খেলে পর জগমাঁঝি কতক সূতা দিয়ে তাদের বলে, “এখন দড়ি পাকাও; কয়েকজন দড়ি পাকাও, আর করেকজন আমপাতা এনে দড়িতে গিটে দেও এবং মণ্ডপের চারি কোণে দড়ি বেঁধে দেও।” তারা দড়ি বাঁধে। জগমাঁঝি আবার বলে, গ্রামের তিন জায়গায় দড়ি লাগাও; একটি দড়ি মাঁঝির ঘরের পাশে, আর দুটি রাস্তায়।” রাস্তার দুই মাথায় দড়ি বাঁধা হয়। এইভাবে শেষ হয়।
মণ্ডপের তেল-হলুদ
পরে বরের পিতা জগমাঁঝিকে বলে “গ্রামের মাঁঝি, পারাণিক আর সকল বুড়ো মেয়েদের তেল হলুদ মাখার জন্য নিয়ে এস।” পরে স্বয়ং গিয়ে তাদের সকলকে ডেকে নিয়ে আসে; তার। এসে প্রথমে প্রত্যেকে দুই দুই পাত্র হাঁড়ি খায়; পরে জগমাঁঝি আইওকে ডেকে এনে বলে এদের তেল-হলুদ মাখাও।“ সে এসে সকলকেই তেল হলুদ মাখায়। একেই “মণ্ডপের তেল হলুদ” বলে। সকলের শেষে বরের পিতামাতাকে ও বরকে তেল হলুদ মাখান হয়। তারপর কোলে বরকে ও আইওকে তেল মাখান হয়। তথন দুই দুই পাত্র হাঁড়ি পান করে যে যার ঘরে চলে যায়। কিন্তু সেদিন হইতে বিৰাহ শেষ না হওয়া পর্যন্ত গ্রামের ছেলেমেয়েরা দিবারাত্রি নাচগান ক’রে থাকে।
তিনদিন পরে বরযাত্রীদের রওনা হ’বার তারিখ উপস্থিত হয়। তখন অতি প্রত্যুষে বরের পিতা এক পাত্র “জান” হাঁড়ি ঢেলে মাঁঝি পারাণিক, ও জগমাঁঝি প্রভৃতিকে ডেকে দেয়। হাঁড়ি পান করতে করতে মাঁঝি জিজ্ঞেস করে, “ওহে এটা কিসের হাঁড়ি, এতে ত কোন ‘সার’ পাচ্ছিনা।” ‘সার’ কথাটা উপমাসূচক, যেমন “কথার কাঁথা।” মোট কথা কোন তাদের ডাকা হয়েছে। তখন বরের পিতা বলে, “বিবাহের দিন উপস্থিত, এস তোমরা বরযাত্রী হয়ে আমাদের সঙ্গে যাবে।” মাঁঝি জগমাঁঝিকে বলে “গ্রামের সকলকে খবর দাও।” সে পেয়াদাকে দিয়ে সকলকে ডেকে আনে। তখন সকলেই হাঁড়ি পান করে। পরে বরের পিতা জগমাঁঝিকে বলে, “ওহে, আমাকে পাঁচজন ছোকরা খুঁজে দেও” তারা এলে বরের পিতা বলে, “বরযাত্রীদের খোরাকির জন্য চাল, তরকারী, লবণ, আর পাঁচ হাঁড়ি মদ বের ক’রে নেও; এসব সূৰ্য্য উঠতে উঠতেই আগে আগে নিয়ে যাবে; এর সহিত একটা ছাগল, একপাত্র মদ তিনপাই চাল, (পাঁচটাকা পণ হ’লে পাঁচপাই) তিন টুকরা হলুদ, তামাক, লবণ, আর একটা ভাড়ে তেল নিয়ে যাবে।” শেষের জিনিষগুলিকে “চাড়ি” অথবা দেবতার সামগ্রী বলা হয়।
অগ্রগামীদল
ভাত খাবার পরে যুবকেরা এই সব জিনিষ নিয়ে আগে আগে নিয়ে কন্যার গ্রামে আসে। তাদের একজন বিবাহবাড়ী চলে যায়। সেখানেও বরের গ্রামের মত একটা মণ্ডপ তৈরি করা হয় ও অন্যান্য কাজ করা হয়। সেই লোকটি এসে বলে, যহাশয়, আমরা “আগুয়ানের” দল এসে হাজির হয়েছি। পরে কনের বাপ জাগমাঁঝিকে ডেকে বলে, “এদের বাসস্থান দেখিয়ে দেও।” তখন তাদের জগমাঁঝি যেখানে সাজান হয়েছে সেখানে নিয়ে যায়; আর বরযাত্রীদের জন্য ঘর হাঁড়ি, পাতিল, ডাবর, হাতা, কাঠ, পাতা, ঠোঙা প্রভৃতি দেওয়া হয়। তারপর জগমাঁঝি বিবাহ—বাড়ীতে ফিরে আসে।
পাত্রের ঘরে জলবিবাহ
বরের পিতা ও গ্রামবাসী আগুয়ানদের পাঠিয়ে স্ত্রী-পুরুষ মিলে জল-বিবাহ করতে চলে যায়। বরের মা একটা ডালা নিয়ে যায়; এতে আতপ ধান, আতপ চাল, দুৰ্ব্বাঘাস, একটা মুরগীর ডিম, তেল-সিন্দুর, ও একগাছা সুতা থাকে। বরের কাকীমা তরোয়াল ধরে, ও তার পিসীমা একটা তীর—ধনুক হাতে নেয়। দুই জন আইও সূতার বিড়ার উপরে দুটি কলসী কনের কাপড়ে ঢেকে মাখায় রাখে; এদিগকে “শুভ কলসী” বলে। বরের ভগ্নীপতি বামন সেজে কোদাল নিয়ে যায়, আর জগমাঁঝি স্বয়ং হাঁড়ি আর ঠোঙা নিয়ে যায়; অন্যান্য সকলে কেবল দর্শকমাত্র। ডাবরধারিণী, তরোয়ালধারিণী, ও তীর-ধনুকধারিণী নাচতে নাচতে ঘাটে চলে আসে। ঘাটে এসে তিনপাক নেচে নেচে ঘুরে। সেখানে বামন জলের পাশে একটা ছোট গর্ত খনন করে; এবং গর্ভেতে জল এনে ভরে দেয়। তখন জগমাঁঝি তিন কোনে তিনটি তাঁর পুতে দেয়। পাঁচপাক সুতা তাতে জড়িয়ে দেয়; আর একটি মুরগী ডিম তীরের নিকট বসিয়ে দেয়; আর প্রত্যেক তীরের নিকট কড়ি রেখে দেয়; তারপরে তীরগুলিতে সিন্দুর মেখে দেয়। এরপর প্রধান পর্বতদেবতাকে একপাত্র মদ, মৃত মাঁঝিকে একপাত্র, ও আর একপাত্র মদ বৃদ্ধ সর্দারের নামে উৎসর্গ করা হয়। অবশিষ্ট মদ সকলে মিলে পান করে।
পরে বরের মা, কাকী ও পিসী তিনবার নেচে নেচে ঘুরে এবং তাদের পেছনে পেছনে আইও দুইজনও ঘুরে; আর তাদের পেছনে পেছনে আরও পাঁচজন লোক ঘুরে। তারপর ধনুকধারিণী জলে তীর ছাড়ে, আর তরোয়ালধারিণী জল দুইজন জল কাটে, আর আইও তুলে। পরে তারা ঘরে ফিরে সকলে মণ্ডপের নিকট উপস্থিত হয়। পরে জগমাঁঝি বামন-যুবককে বলে, “সেখানে ঘাটে যেমন খুঁড়েছিলে এখানেও তেমনি উঠানে খুঁড়।” সে খুঁড়ে একটা গর্ভ করে; জগমাঁঝি এর তিন কোণে তিনটি তীর পুতিয়া দেয়, আর তীরগুলিতে পাঁচপাক সূতা জড়িয়ে দেয়, এবং বলে “ওগো, আইও মেয়েরা তোমাদের শুভকলসী দুটি এখানে রাখ।” তারপর কলসী দুটি সেখানে রাখে।
পরে জগমাঁঝি বলে, “এসগো, তিনজন আইও এস, মন্দিরের খুঁটী ধর।” বরকে সেখানে নিয়ে আসে; তখন জগমাঁঝি আইওদের বাম হাতের কনিষ্ঠা অঙ্গুলী মৌগাছের খুঁটীতে বেঁধে দেয় এবং তাদের ডান হাতে একটা ধান দিয়ে না ভেঙ্গে চাল বের করতে দেয়; তারা চাল বের করে; জগমাঁঝি তখন তাদের অঙ্গুলী খুলে দেয়। পরে স্থতা ডান কাণে ও ডান পায়ের কনিষ্ঠা অঙ্গুলিতে জড়িয়ে পাক দিতে থাকে। সে একজন যুবককে বলে, “তিনটা আমপাত নিয়ে এস।” সে এনে দেয়; আরও বলে, “তিনগোছা দুৰ্ব্বাঘাস, তিনটা গোটা আতপ চাল (যেন ভাঙ্গা না হয়) নিয়ে এস, আর হলুদ জলের একটু ছিটা দেও। আইওরা যে চাল করেছিল সেই চাল তিনটি আর দুৰ্ব্বাঘাস যুবকটি এনে দেয়। পরে সেই চাল ও দুৰ্ব্বাঘাস আমের পাতায় জড়িয়ে উহা বরের দক্ষিণ হাতে পাকান সুতা দিয়ে বেঁধে দেয়।
বরের ক্ষৌরকর্ম
তারপর বামন যুবক জগমাঁঝিকে বলে, “এখন জামাইকে কামাও।” তাকে কামান হয়। নাপিত দুই পাই চিড়া, দুই পাই চাল, লবণ ও তামাকে পেয়ে থাকে। তারপর তাকে মণ্ডপের জলের দিকে নেওয়া হয়। দুটা লাঙ্গলের জোয়াল ও একখানা তরোয়াল ও আনা হয়; জোয়ালের উপর বরকে বসান হয়, আর তার সামনে তার পিতা মাথার উপরে তরোয়াল তুলে দাঁড়িয়ে থাকে। জগমাঁঝি ঘটিতে করে শুভকলসীর জল তরোয়ালে ঢেলে দেয় এবং সেই জল পিতার পেছন দিকে বসান বরের মাথায় ঝরে পড়ে। পরে তরোয়াল ভুলে নেয় এবং শুভকলসীর জলে জামাইকে স্নান করান হয়।
তারপর বরযাত্রীরা প্রস্থানের উদ্যোগ করে; বরের ঘরে ভাত খায় ও হাঁড়ী পান করে। আইওরা তেল হলুদ মাখিয়া জামাইকে মালা ও হাসলি পড়িয়ে দেয় এবং চোখে কাজল দেয়। তখন গান হয়,
কতদূরে কতদূরে শ্বশুরঘর,
কতদূরে কতদূরে শ্বশুরঘর,
এখানেও গাঙনদী ওখানেও গাঙনদী,
তার মাঝে গো বাছা তোমার শ্বশুরঘর।
অবশিষ্ট তেল ও হলুদ ঘটকের জিম্বায় দেওয়া হয়। তখন জগমাঁঝি ঘরের পিতামাতাকে বলে, “দেওত কনের সাড়ী, তার মার রঙীন সাড়ী, তার ঠাকুমা ও দিদিমার সাড়ী, পাকান পাগড়ী, তেল সিন্দুর, নিমপাতা এরণ্ড পাতা ও কয়টি তুষ বের করে দেও।” তারা এসব বের করে ডালাতে সাজিয়ে দেয়। ঘটকের জিম্বায় দিয়ে বলে, “এই যে এগুলি তোমরা দেখে নেও।”
তারপর বামন-যুবক পাঁচটা শালপাতা, এক পুরিয়া সিন্দুর ও একমুষ্টি আতপ চাল চায়। সেগুলি দিয়ে একটা পুঁটলি বাঁধে। পরে বামন—যুবক বরের মাথায় একটা পাগড়ী বেঁধে দেয়। তখন সকলে মিলে বরযাত্রী বের হয়। বরের মা এক ঘটি জল ও একপাত্র গুড় নেয়, আর বরের বাপ টাকা বেঁধে নেয়। সকলে মাঁঝির বাড়ীতে আসে। সেখানে বরের মা ছেলেকে কোলে ক’রে পাটিতে এসে গুড় খাওয়ায়; এবং মুখ ধোয়াইয়া কিছু জলও খাওয়ায়; তখন বর মুখে একটা টাকা রেখে দেয়, আর তার মা তাকে মাই খাওয়ায়; মা হাত পাতে ও ছেলে উদ্গার করে টাকাটা ফেলে দেয়। একেই (Breast) “নুনু” টাকা বলে, আর এটা মার প্রাপ্য। তারপর বর, মাঁঝি, কোলবর, আইও প্রভৃতি সকলের উদ্দেশ্যে প্রণাম করে।
কনের গ্রামের দিকে স্বমনোদ্যোগ
মাঁঝির নামে একপাত্র হাঁড়ি ও উৎসর্গ করে। আইওরা জামাইকে কোলে ক’রে রাস্তার মোড় পর্যন্ত দিয়ে যায়। সেখান থেকে তারা ফিরে আসে আর ঘটক তাদের নিয়ে কনের ঘরের দিকে রওনা হয়। আজকাল ঢাকঢোল, রামসিঞা, ভেরী, চৌদাল, হাওই, বন্দুক প্রভৃতি ধনীলোকেরা সঙ্গে নিয়ে যায়; কিন্তু পূর্ব্বে এসব ছিলনা, এবং বাজনা বাজাতে ডোমদেরও নিযুক্ত করা হ’ত না।
কনের গ্রামে বরযাত্রী
বরযাত্রীরা কনের গ্রামে এসে হাজির হয়। রাস্তার মোড়ে তারা অপেক্ষা করে; ঘটক গিয়ে কনের বাড়ীতে খবর দিয়ে বলে, “ওহে আমরা এসেছি, যদি কিছু বাকী থাকে শেষ করে ফেল।” তারা জবাব দেয় “আমরা সব শেষ করেছি।” তখন জগমাঁঝি পেয়াদা পাঠিয়ে গ্রামের লোকদের খবর দেয়। তারা সকলে এসে তেল হলুদ মাখে ও হাঁড়ি পান করে। সধবা মেয়েরা সিন্দুর পরে; কুমারী, স্বামীকর্তৃ ক পরিত্যক্তা মেয়েরা ও বিধবারা সিন্দুর পরে না।
পরে জগমাঁঝি পেয়াদার কাঁধে এক কলসী জল নেয় ও নিজে ও পাতা দিয়ে ঢেকে এক ঘটি জল নিয়ে বরযাত্রীদের কাছে আসে। তারা সেখানে নাচতে থাকে; জগম; ঝিকে দেখে ক্ষান্ত হয়। জগমাঁঝি ও পেয়াদা বলে, “ভাই সব, জল খেয়ে নেও।” জগমাঁঝি জলের ঘটি এগিয়ে দেয়, আর তারা দুহাতে ধরে নেয়। তারপর প্রণামাদি ক’রে বরযাত্রীরা জলপান করে।
বরের শান্তিজল
তারপর কনের মা একঘটি জল ও মাথায় এক পাই গুড় নিয়ে কন্যাযাত্রী, আইও, ও গ্রামের মেয়েদের নিয়ে রাস্তার মোড়ে জামাইকে শান্তিজল দিতে আসে। বরযাত্রীদের কাছে এসে ঘটককে বলে, “জামাইকে দেও, গুড়জল খাওয়াব।” তখন বরযাত্রী ও কন্যাযাত্রী প্রণামাদি ক’রে একত্রিত হ’য়ে নাচতে আরম্ভ করে। ঘটক কনের মাকে ব’লে, “এই যে জামাই;” জামাই শাশুড়ীকে ও আর দুই একটি মেয়েকে প্রণাম করে। অন্যান্য মেয়েরা ও আইওরা জামাইকে দেখে অত্যন্ত গালিগালাজ করে গান ধরে।
আজ কথায় আজ আওরে, কাল কথায় কলি আওরে,
কত বড় সদাগরের বেটা আদা রাতে বিদায় দিলে করে।
তোর মায়ী কুকুর সঙ্গে তাল
তোর মায়ী বিড়াল সঙ্গে সুতালং,
ছিও, ছিও, নকটিও,
আমার বিচি না ছুইওরে
আগে বল্ত কচি কচি ছেলে,
এখন দেখি বড় বড় দাত,
ছাগলের মত বিশ্রী কপাল।
মায়ের, প্রেম. ওগো বাছা,
বাপের সোহাগ, ওগো বাছা,
ডুমুরের মত পেকে গেছ, ওগো বাছা।
বরের বাপ মা বলে “আমার ছেলে
জয়নগরে তেলের বেপারী,
আর নুনের বেপারী,
তেল না নিয়ে তেলের বেপার,
নুন না নিয়ে নুনের বেপার।”
গুড় খাওয়ান
তারপর কনের মা বরের উরূ ধোয়াইয়ে মুখ ধোয়ায় ও গুড় খাওয়ায়। গুড় খাওয়ার পর আবার জল খাওয়ান হয়। এইরূপে বামন ও কোল—বরকেও গুড় খাওয়ান হয়।
তারপর আইওরা বরকে ও তাহার সঙ্গীকে কোলে করে গ্রামের প্রথম বাড়ীর উঠানে নিয়ে আসে। জগমাঁঝি একঘটি জল নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে আসে; বরযাত্রী ও কন্যাযাত্রী পেছনে পেছনে নাচতে নাচতে আসে। আইওরা সেই উঠানে বরকে ও তার সঙ্গীকে নামিয়ে গুড় জল খাওয়ায়। ঘরে ঘরে এইরূপ গুড় জল খাওয়ান হয়। তারপর জগমাঁঝি গ্রামের বাইরে বরযাত্রীদের তাদের আড্ডায় নিয়ে যায় এবং সেখানে বলে, “এই তোমাদের বাসা, এখন তোমরা সুবিধা করে নেও” সেখানে বরযাত্রীরা তাদের নিজে—দের ভাত খায় ও হাঁড়ি পান করে।
পরে জগমাঁঝি কনের বাড়ীতে এসে বলে, “ওগো জামাইকে স্নান করাতে এস।” তারা এক বাটি তেল, একবাটি হলুদ, এক কলসী জল, একটা পার্টি, একখানা পিড়ি, আর বরের জন্য একখানা ধুতি ও চাদর বের করে এবং জগমাঁঝি বাঞ্ছনা বাজাতে বাজাতে বরযাত্রীদের আড্ডায় তাদের নিয়ে যায়। সেখানে জগমাঁঝি বলে, “বরকে দেও।” বর দাঁড়ালে ঘটক তার হাত ধরে মেয়েদের নিকট নিয়ে আসে। তার পাটি পেতে বরকে বসায় এবং কনের তিন ভগিনী তেল মাখিয়ে খুব রগড়ায় (প্রায় চাম উঠে যায়), আর মাথা চিরুণী দিয়ে আঁচরিয়ে দেয়। এইভাবে শেষ হয়।
কি করে ফুল ছাড়বে অর্থাৎ শুদ্ধ হবে
পরে পাটি তুলে পিড়ি আনে এবং জামাইকে পিড়িতে বসায় এবং এক কলসী জল দিয়ে তাকে স্নান করায়। স্নান হ’লে জগমাঁঝি বলে “জামাই, ভিজে কাপড় কি করে ছাড়বে?” তখন জগমাঁঝি ধুতি আর চাদর এনে মেয়েদের দেয় এবং তারা জামাইকে দেয়। জামাই ভিজে কাপড় ছেড়ে সেই ধুতি ও চাদর পরে। তখন আইওরা বলে “ফুলত ফেলে দিলে, এখন কি সিদ্ধ করব?” তখন বরযাত্রীরা এক পাত্র হাঁড়ি দান করে। সেই হাঁড়ি মাথায় নিয়ে জগমাঁঝি ঘরে চলে আসে; সেখান থেকে যে যার ঘরে চলে যায়।
সিন্দুরদান
তারপর মাঁঝি জগমাঁঝি ও পেয়াদাকে ডেকে বলে, “গ্রামের ছোট—বড় সকলকে খবর দেও, আমরা সকলে মিলে সিন্দুরদান দেখব।”
সকলে একত্রিত হ’লে ঘটককে বলা হয়, “তোমারাও সেজে এস, সিন্দুরদান দেখবে।” তারা আসে। তখন গ্রামের পাঁচজন জগমাঁঝি ও পেয়াদাকে বলে, পাঁচটা আম—পল্লব নিয়ে এস।” তারা নিয়ে আসে। বরযাত্রীরা কনের উঠানে নাচতে থাকে।
জামাই ও কনের ছোট ভাই
পরে কনেপক্ষ বলে “বরযাত্রীদের পাচজন ভিতরে এস” তারা ঘরের ভিতরে যায় এবং হাঁড়ি পান করে। বাইরে বামন যুবক বরকে কাঁধে নিয়ে দাঁড়ায়। তখন ঘটক বলে “কনের ছোট ভাই কাপড়ের জন্যে খুব কাঁদছে।” পাঁচজনে বলে, “তাকে কাঁধে ভগ্নীপতি তাকে কাঁধে ক’রে নিয়ে এস।” কনের করে নিয়ে আসে। পরে একেও জামাইকে একত্র করা হয়; দুইজন লোক ঘটীর জলে ও আমপল্লব পাঁচটা তাদের তুলে দেয়; বরপক্ষের পাঁচজনে বলে ‘ জামাইবাবু, বৌর ভাইএর মাথায় আমপাতা দিয়ে তিনবার জল ছিটিয়ে দেও।” কন্যাপক্ষের পাঁচজনও কন্যার ভাইকে বলে, “তুমিও জামায়ের মাথায় তিনবার জল ছিটিয়ে দেও।” তার। দুইজনে জল ছিটাছিটি করে। পরে সকলে জামাইকে বলে “ওর পাগরি বেঁধে দাও।” জামাই ছেলেটির পাগড়ি বেঁধে দেয়। সকলে বলে, “ওকে চুমা খাও।” সে চুমা খায়। তখন তারা দুইজনে মুখ থেকে চিবান জল পরস্পরকে নিক্ষেপ করে। পরে পাগড়ি বাঁধা ছেলেটিকে মাটিতে নামান হয়।
তারপর সকলে বলে, “এবার কনেকে আন”; বাড়ীর ভিতরে কনেকে সাড়ীপরিয়ে একটা ডালাতে বসান হয়; জগমাঁঝি বরযাত্রীদের বলে “ওহে, বরযাত্রি এই তোমাদের কনে!” ঘরের উঠানে যেখানে বরকে কাঁধে করে রাখা হয়, কনেকেও সেখানে আনা হয়। কনেকে ধরে উপরে তোলা হয় এবং বরের সঙ্গে মুখোমুখি করে। তখন তাদের দুইজনের মধ্যে একটা কাপড় দিয়া পরদা টানিয়ে দেয়। কন্যাপক্ষের জগমাঁঝি কনেকে একঘটি জল তুলে দেয়, আর বরপক্ষ বরকে একঘটি জল তুলে দিয়ে বলে, “ওহে, বাবু, আমপল্লব দিয়ে কনের মাথার তিনবার জল ছিটিয়ে দাও।” কন্যাপক্ষও কনেকে বলে ‘মা, তুমিও আমপাতা দিয়ে জামাইর মাথায় তিনবার জল ছিটিয়ে দাও।” তারপর দুইজনে জল ছিটাছিটি করে।
তারপর বামনযুবক জামাইকে, পাঁচটি শালপাতা তুলে দেয়; উপরের পাতায় সিন্দুর মাখান থাকে। বরপক্ষ বরকে বলে, “কনের মাথা থেকে ঘোমটা সরিয়ে দেও।” বর ঘোমটা সরিয়ে ফেলে এবং কনের মাথার উপর বামহাতে সিন্দুর ধরে থাকে। তখন বরপক্ষ বলে “কিছু সিন্দুর মাটিতে ফেলে দাও;” কিছু সিন্দুর মাটিতে ফেলে দেয়। পরে তারা বলে “এখন ডানহাতের কনিষ্ঠা অঙ্গুলি দিয়ে কনের কপালে পাঁচবার সিন্দুর লাগাও; সিন্দুর লাগান হয়। তারা আবার বলে, “বামহাতে কনের গ্রীবাদেশ ধর এবং পাতার অবশিষ্ট সিন্দুর কপালে লেপে দেও।” বর সিন্দুর কপালে লেপে দেয় এবং সকলে তখন “হরিবোল” বলে। পরে বামনযুক বরকে নীচে নামায়। বরপক্ষ বরকে বলে “ডালা থেকে কনেকে কোলে করে নামাও;” কনেকে নামান হয়। তখন কনের দিদি এসে বর ও কনের কাপড় জড়িয়ে এককরে গাঁট দিয়ে দেয়।
বরণ
তারপর কনের মা ও দুই জা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে—কিছু দুৰ্ব্বাঘাস, কিছু আতপ ধান, কিছু আতপ চাল, তিনট। চালের গুড়ির ডেলা তিনটা গোবরের ডেলা, একখানা থালাতে সাজায় আর এক পাত্র হলুদ ও এক পাত্র তেলও থালাতে রাখে। থালা হাতে নিয়ে তারা বাইরে বর ও কনের নিকট আসে। কনের মাতা থালা নিয়ে তাদের তিনবার বরণ করে; আর থালার দুকা ঘাস, আতপ ধান, আতপ চাল কিছু নিয়ে আবার তাদের তিনবার বরণ করে, এবং সেই চাল, ধান ও দুৰ্ব্বাঘাস তাদের পেছন দিক হইতে ছড়িয়ে ফেলা হয়। তারপর তেল ও হলুদ মিশিয়ে জামাইর দুই গালে লেপে দেয়, আর জামাইও নিজে হাতভরে পাত্র হইতে হলুদ নিয়ে শাশুড়ীর দুইগালে লেপে দেয়। তারপর কনে, বামন, আর সঙ্গী দুইজনকে কনের মাতা : সেরূপ তেল হলুদ মাখায়, আর তারাও সেরূপ ফিরে মাথায়। কনের মা ও-জা দুইজনও এইরূপ করিয়া থাকে।
পারচাউ
বরণকারিণীদের মধ্যে দুই জনা বাড়ীর ভিতর গিয়ে একজনে একটা আগুনের মালসা আর একজনে একটা “তোক” (হামাল দিস্তা) নিয়ে বাইরে আসে। মালসার আগুন বরকনের সামনে রাখা হয়; পরে কনের মা ডানহাতে ‘তোক’ করে আগুনের মালসার উপর বরণ করে এবং বামহাতে আগুনকে প্রণাম করে। তারপর বামহাতে তোক ধরে ডান হাতে আগুন নমস্কার করে; আবার ডান হাতে তোক ধরে বামহাতে আগুন নমস্কার করে। পরে জা দুইজনে ও তোক নিয়ে সেরূপ করে। শেষটীর এই প্রকার বরণ করবার পর তোক দিয়ে আগুনের মালসাটি ভেঙ্গে দিয়ে ঘরের ভিতর পালিয়ে যায়। এই সকল ক্রিয়াকাণ্ডকে “পারচাউ” বলে।
তারপর কনের দিদি, যিনি বরকন্যাকে একত্র করে গাঁট দিয়েছেন, ঘটিতে জল এনে তাদের পা ধোয়াইয়া দেয়। বামহাতে কনেকে ধরে ঘরের ভিতর লইয়া যায় আর ডানহাতে ঘটীর জল ঢালতে ঢালতে যায়; আর বামন প্রভৃতি পেছনে পেছনে যায়। ঘরের দুয়ারে কনের ছোটবোন আটক করে; আটক না করতে পারলে দরজা বন্ধ করে দেয়; একেই বলে সিংদুয়ার; জামাই একটা পয়সা দিলেই দরজা খুলে দেয়।
ঘরের ভিতর পার্টিতে সকলে বরকন্যাসহ বসে। পরে আইওরা এসে গায় তেলহলুদ মাখায় ও হাত ধোয়াইয়া দেয়। তারপর তাদের ভাত খেতে দেওয়া হয়। কনের ছোটভাই ভাত কেড়ে খায়; জামাইও একগ্রাস খায়; পরে দুইজনে ভাগ করিয়া খায়। আহারের পর আবার হাত ধোয়ান হয় এবং বামনী বরকন্যার গাঁট খুলে দেয়। পরে বর ও তার সঙ্গীরা বের হয়ে গোয়ালে (অর্থাৎ বৈঠকখানায়) এসে বসে।
তারপর কনের বাপ ও তার বেয়াই, ঘটক ও জগমাঁঝি জলভাত খেতে বাড়ীর ভিতরে আসে। ঘর থেকে বের হয়ে বরের পিতা উপোস থাকে; হাঁড়ি আর ভাত দেওয়া হয়; খেয়ে তারা গোয়ালে আসে; বর যাত্রীরা উঠানে থাকে।
মণ্ডপের নীচে বরযাত্রী
তারপর মাঁঝি ও জগমাঁঝি ঘরে ঢুকে এবং দুই পাত্র করে সকলকে হাঁড়ি খেতে দেয়। কনের পিতামাতা বলে “এস, বরযাত্রীদের সব নিয়ে এস। আমরা মণ্ডপের নীচে গিয়ে বসি।” মণ্ডপের চারিদিকে খড় বিছিয়ে বিছানা করে এবং সকলকে ডাকে। তারা এসে দাঁড়িয়ে থাকে। তখন কন্যাপক্ষের জগমাঁঝি বরপক্ষের জগমাঁঝিকে ডেকে বলে “ওগো (অমুক) মাঁঝিসাহেব!” তিনি উত্তরে বলেন “কি সাহেব!” জগমাঁঝি বলে “ঝুড়ির মত শরীরটা নামিয়ে বস “ বরযাত্রীরা সকলে বসে। তারপর একঘটি জল ও একখোরা তামাক এনে তাদের সামনে রাখা হয়।
তারপর কন্যাপক্ষ বরপক্ষের মাঁঝিকে ডেকে বলে, (অমুক) “মাঁঝিসাহেব!” উত্তরে সে বলে “কি সাহেব!” তারা বলে “আমরা এক জায়গায় বসে এক হয়ে যাই, কেমন আপনাদের কুশলত?” বরপক্ষ বলে “আজ্ঞে, দেখুন আপনারা আমাদের খোঁজ নিয়েছেন, আমাদের তেজ পাহাড়ের মত বেড়ে গেছে; বাণের মাদুরের মত আমাদের বুক ফুলে উঠেছে; আমাদের পরমায়ু পাঁচহাত বেড়ে গেছে; আমাদের দাড়ী শিংএর মত বেড়ে গেছে; সাহেব, আপনাদের আশীর্ব্বাদে আমরা সব কুশলেই আছি।” তারপর কন্যাপক্ষও বলে, “ঠাকুরের আশীর্বাদে আমাদেরও মঙ্গল।” তখন গান করা হয়।
আইও গো যাইও নাইওর,
বাবা হে না যাইও রাজ-দরবার,
আজত গো বাবা যাওরে বরযাত।
জাওয়াই দেগো বিটি (Woman) জাওয়াই দেগো।
দুয়ারে আছে বিটি (ঝি) রাইচন্দন গোবর হো,
বেছেত দিব বিটি সোনার পিঁড়া হো,
খেতেত দিব গুয়া পান।
আইস কুটুম বইসো কুটুম,
মোদের আঙ্গিনায়!
আগুতে বৈসা লও রায়হো ফল্না রায়।
তার পিছে বৈসা লও দশ কুটুম
আনসে বহিনি এক “লোটা” পানি জো
আনসে বহিনি এক ছিলিম “তামাকু”,
হুকা তামাকের বড় ব্যবহার।
****
তারপর মাঁঝি পারাণিক হ’তে আরম্ভ করে গ্রামের সকলে ও বরপক্ষ হাঁড়ি পান করে, তখন জগমাঁঝি বলে, “দেও বাবা, এবার পণের বাকী টাকা গুলো দিয়ে দাও; এখন বাইরে এস।”
ফেল বাবা, ফেল বাবা,
তারপর গান হয়,
পুটির (পুটিমাছ) মত টাকা গো।
ফেল বাবা, ফেল বাবা,
মাছের রক্ত সোনা গো।
ছাড় বাবা, ছাড় বাবা,
পুটির মত টাকা গো।
ছাড় বাবা, ছাড় বাবা,
মাছের রক্ত সোনা গো।
কে ব’লে দিবে গো,
পুটির মত টাকা গো,
কে দিবে এ সভায়,
মাছের রক্ত সোনা গো,
ফল্না রায় বলেছে,
পুটির মত টাকা গো,
মহাজন দিবে গো।
মাছের রক্ত সোনা গো।
তারপর ঘটক জগমাঁঝির হাতে পণের বাকী এক (কি দুই, কি তিন. কি পাঁচ) টাক। দিয়ে বলে, “এই নেও, বাবা, পণের বাকী টাকা।” টাকা দিয়ে, মাঁঝি ও অন্যান্য সকলকে প্রণাম করে। তখন ঘটক কনের মার, ঠাকুমার ও দিদিমার সাড়ী বের করে দেয়। সকলে সাড়া মেপে দেখে ও বলে “বেশ হয়েছে।” তারপর কনের মা ও তার দুই দিদিমা সাড়া পরিধান করে। তারপর গান হয়।
মাতো নিলে ঝিলিমিলি সাড়ী গো
বাপতো নিলে মুঠাভরা টাকা হো।
ভায়াতে। নিলে বরদা
এক পাইলা ধান দিয়ে,
কিনলুম সিন্দুর গো,
জনমে জনমে রহি গেল।
ছিড়ে ফিরে গেল কাপড়া গো,
ভেঙ্গে চুরে গেল মুঠাভরা টাকা গো।
ছিড়ে গেল বরদা।
এক পাইল। ধান দিয়ে,
কিনলুম সিন্দুর গো,
জনমে জনমে রহি গেল।
****
খাসী
তারপর কনের বাপ মণ্ডপের খুঁটীর চারিদিকে গোবর দিয়ে লেপে দেয়। পরে একটা পাতায় চাল এনে রাখে। একপাত্র হাঁড়ি ও চারিটা ভাণ্ড আনে; খাসীটাকে সেখানে এনে চাল খেতে দেয়। তার গলায় একটা লাঠি লাগিয়ে দেয়। তখন জগমাঁঝি খাসীর গলায় দড়ী ও লাঠি ধরে গ্রামের সকলকে ডেকে বলে, “এদিকে আসুন;” তারা সকলে এসে খাসীর মাথায় জল ঢেলে দেয়। তখন জগমাঁঝি বরযাত্রীদের বলে “আসুন, আপনারা এসে শাকপাল। তুলে দিন!” তখন গান করা হয়।
খাঁড়া ধর, খাঁড়া ধর, রাউতা পাইকা,
জোড়া জোড়া খাসী রাউতা উঠালও
দেও হো রাউতা খাঁড়াকো চোট।
তখন বরপক্ষের একজন উঠে সকলের কথামত তরবারি এনে খাসী—টাকে কেটে ফেলে। জগমাঁঝি ভিতরে গিয়ে পাতায় চাল নিয়ে আসে; এবং খাসীর মাথাটা চালের উপর রাখা হয়। জগমাঁঝি আবার ঘরে ঢুকে হাঁড়ি, দুটা ভাণ্ড ও তিন চারটা খোরা বের করে নিয়ে আসে।… সকলে আবার মদ পান করে।
পরে বরযাত্রীরা কনের পিতামাতার কাছে থেকে পণের পরিবর্তে উপঢৌকন পায়, যেমন, একটা ছাগল, পাঁচপাই চাল, লবণ, হরিদ্রা, তেল আর এক হাঁড়ি মদ। ……. সকল বরযাত্রীরা এ সব জিনিষ উপভোগ করে।
তারপর খাসী কাটা হ’লে পর তার মাথা ও একসের চাল জগ—মাঁঝি বরযাত্রীদের নিকট এনে বলে, “ওগো, আপনারা তখন শাক তুলতে বলেছিলেন, এবার শাক তুলে এনেছি, নিন। বরযাত্রীরা খাসীর মাথা ও চাল দিয়ে “সুরুয়া” (পোলাও) করে খায়। একভাগ জগমাঁঝির জন্য রাখে।
পঞ্চাইতি টাকা
জগমাঁঝি এসে তার পঞ্চম ভাগ “সুরুয়া” (পোলাও) আদায় করে। সে বরযাত্রীদের বলে “আসুন এবার আমাদের পঞ্চাইতি দিন।” বরযাত্রীরা এক পাত্র হাঁড়ি শিকায় ঝুলিয়ে দেয় এবং এক লোটা হাঁড়ি ঝগমাঁঝিকে দেয়। জগমাঁঝি সেগুলি নিয়ে আগে আগে যায়; আর বরযাত্রীরা বাজনা বাজাতে বাজাতে পেছনে পেছনে যায়। তারা মাঁঝির গৃহে এসে উপস্থিত হয়; গোয়ালে খড়পেতে সকলে বসে।
পরে বরযাত্রীরা মাঁঝিকে বলে “ওহে মাঁঝিসাহেব, গ্রামের সকলকে ডাক, আম:দের একেলা হলে চলবেনা।” তখন গ্রমের সব মেয়েপুরুষ একত্রিত হয়। জগমাঁঝি বলে “মাঁঝি বাবা, এখন তুমি আমাদের পিতা—মাতা, আত্মীয়স্বজনের ভালমন্দ জিজ্ঞাসা কর।” তখন মাঁঝি আরম্ভ করে, “তবে মাঁঝিবাবা দুপরানে পরানগত, লরে দেড়কা অনেধনে, চাকর চাকরানী, মজুর মজুরানী, পিতামাতা, অজা-পিতা, কাকী-খুড়ো, ভাইপো-ভাগিনা, ভাইবোন,…… আপনাদের সব কুশলত?” মাঁঝি ও পারাণিক বরযাত্রীদের আবার জিজ্ঞাসা করে, “কি সাহেব, আপনারা এতদুর এসেছেন, আর কতদূর যাবেন?” তারা জবাব দেয়, “অমরা এ পর্য্যন্তই পা বাড়িয়েছি।” তখন মাঁঝি বলে “ বনের ভিতর যেতে যেতে কাঠ খুজিবে; এটা লাঙ্গলের ফাল হবে, এটা জোয়াল হবে, এটা ঢাকা হবে এটা বাট হবে; আর গ্রামের ভিতর গেলে পাত্র খুজবে; এটা হাড়ি হবে, এটা পাতি হবে, এটা কলসী হবে, এখন আপনারা কিরকম পাত্র চান?”
বরযাত্রীরা তখন উত্তরে বলে “আমরাত একটা ভাঙ্গ! পাত্র (অর্থাৎ একজন নষ্ট স্ত্রীলোক বিধবা অথবা তালাক দেওয়া মেয়ে) খুঁজছি।” মাঁঝি বলে “সাহেব, সেরকম পাত্রত এখানে জুটবেনা; আপনারা ‘বাণিজ—বেপার’ করেন, কিরকম পাত্র চান হীরার কি মাণিকের?” বরযাত্রীরা বলে, “আমরা ত হীরাই চাই, কিন্তু এখানে ত ‘হাটবাট উঠে গেছে, ভাল হীরা কোন হাটে মিলবে?” তখন মাঁঝি জিজ্ঞাসা করে “তিনের হাটে কি পাঁচের হাটে চাও?” বরযাত্রীরা বলে, “সাহেব,। আমরা ত হাট-বাট চিনি না; আমরা তোমাকে ধরেছি, তুমি আমাদের হাটের সব সওদা কিনে দাও।” মাঁঝি বলে, অপেক্ষা কর, মিলবে।” তারা বলে, আমরা যে উপোষ করে আছি!” মাঁঝি বলে, “হাট ত ভেঙ্গে গেছে, এখন যে আর পাবেনা, এখন দেখ পিছিয়ে পড়লে, কেন পিছিয়ে পড়লে?” বরযাত্রীরা বলে, “কি করব মাঁঝি সাহেব আসতে আসতে দেখি একটা ষাঁড় মুখ দিয়ে বাচ্চা প্রসব করছে, এই দেখতে দেরী হ’য় গেল; সেখানে থেকে কিছুদূর এসে দেখি যে কতকগুলো মৌমাছি ঘাসের নীচে লুকিয়ে রস জমা করছে; সেখান থেকে এসে আবার দেখলাম জমি পেকেছে;
ঘুঘুর লেজের মত ছোট একটা কুড়াল দিয়ে জাম পাড়লাম, তারপর কুড়ালটা একটা ছোট হরিণের মাথায় পড়ল, হরিণটা মরে গেল দেখলাম। আমরা আর কি করব? তারপর ঘাস তুলতে তুলতে এসেছি; তারপর বার বোঝা পাখী মেরেছি; এই সব করতে করতে দেরী হয়েছে। তারপর আবার দেখলাম একটা পাখী “জাতুর” নাচ? নাচতেছে, এটা দেখতেও বিলম্ব হয়ে গেল। আবার দেখলাম একটা পাথী সাতটা মাঠ জুড়ে পাহারা দিতেছে, এতেও দেরী হয়ে গেল।”
তখন কনেপক্ষ জিজ্ঞাসা করে “ভাল সাহেব, আপনারা এতদূর হাতে এসেছেন, আপনাদের কেহ কি বাণিজ-বেপার কিম্বা গোমস্তাগিরি করেন না?” তখন গান হয়,
কহত কহ, কহত ভায়া,
কহত আপনার জাত,
না জান জাতি, না জান পাতি,
না জ্ঞান আপনার জাত।
বরযাত্রীরা বলে, “তবে শুনুন সাহেব, আমরা ছাগল-গরু চড়াতে গেছিলাম, অমুক আমাদের নায়ক। অমুক আমাদের গোমস্তা ছিল।” কনেপক্ষ তখন জিজ্ঞাসা করে, “আপনারা কটা বলদ নিয়ে কারবার করেন?” বরযাত্রীরা তখন ভাবে বরেরা কত ভাই এবং বলে, “সাহেব, তিনটা বলদ নিয়ে আমাদের কারবার।” কনেপক্ষ আবার জিজ্ঞাসা করে, “আচ্ছা আপনাদের ঢেকী কটা (অর্থাৎ মেয়ে কয়টি)?” বরপক্ষ বলে, “সাহেব, এতটা ঢেকী (মেয়ে)।” কন্যাপক্ষ আবার জিজ্ঞাসা করে, “আপনারা কোন ঘাটের জল খান?” বরের বাপ বলে, “সাহেব, আমরা অমুক ঘাটের জলপান করি।” আবার প্রশ্ন হয়, “ভাল সাহেব, আপনারা, কিসের বেপার করেন?” বরপক্ষ বলে, “আমরা হীরা মাণিকের বেপার করি।” তখন কন্যাপক্ষ বলে “হাট ত এখন ভেঙ্গে গেছে; অনেক দূরে। হাট, একটু অপেক্ষা করেন।” তারা উত্তর দেয়, “আচ্ছা তবে অপেক্ষা করি।” কন্যাপক্ষ বলে, “মাঁঝিকে ধরেন, উনি আপনাদের সওদা কিনে দিবেন; আপনারা কি জিনিষ নিয়ে এসেছেন—তিল কি সরিষা?” তারা বলে “আমরা সরিষা এনেছি।” কন্যাপক্ষ বলে “আমাদের দেশে কিন্তু সরিষা ভারি সস্তা, আর হীরা খুব মহার্ঘ : তবে মাঁঝি যা করেন; তূলা ও আছে, নিক্তিও আছে, আপনাদের ইচ্ছামত মেপে দিবেন।“ তখন বরপক্ষ বলে, “আমরা মাঁঝির নিক্তিতেই ওজন করে দিব, তিনি যে হীরা দিবেন তাই নিব।” তখন গান হয়,
মাঠে বাটে “চাতানিতে” (প্রস্তরময় স্থান)
বেপারীদের ছাউনি গো,
না জানি বাবা,
কত সোণা গলছে গো।
না জানি বাবা,
কার শাঁখা দুলছে গো।
না জানি বাবা,
কে হীরামাণিক বেপার করছে গো।
কন্যাপক্ষ বলে, “আপনারাত মাঁঝিকে সওদা করতে ধরেছেন; এতে আরও কিছু টাকা লাগবে, দিবেন কি?” বরপক্ষ জিজ্ঞাসা করে, “আর কত লাগবে, সাহেব?” তারা বলে, “একসিকা চার আনা লাগবে।” বরপক্ষ বলে, “আর কি করব, লাগলে কি আর দিব না সাহেব?” জগমাঁঝি তখন বলে, “তবে দেন।” তখন জগমাঁঝির হাতে একটা টাকা পঞ্চাইতি বাবদ দেওয়া হয়। জগমাঁঝি সে টাকা হাতে নিয়ে গ্রামের সকলকে প্রণাম ক’রে বলে এই আপনাদের “মণ্ডলের টাকা”; এই বলে বরপক্ষকে প্রণাম করে। তারপর সকলে মিলে হাঁড়িপান করে।
তারপর কন্যাপক্ষের মাঁঝি বলে “এখানকার কাজ ভালরকম হয়েছেত?” বরপক্ষ বলে, “হাঁ, বেশ হয়েছে মাঁঝি সকলকে দাঁড়াতে বলে। সকলে দাঁড়িয়ে পরস্পর অভিবাদন করে; আর বরযাত্রীরা নিজেদের বাসায় চলে যায়। এদের তিনজনকে ডেকে নিয়ে নিজের বাড়ীতে যায় এবং সেখান থেকে তাদের উপযুক্তমত “সিধা” দেওয়া হয়। তারা সিধা নিয়ে বাসায় চলে আসে।
“গিড়ি চুমাউরা” বরণ
পরে কন্যাপক্ষের জগমাঁঝি বলে “এখন গ্রামের সকলকে ডাক, আমরা ‘গিড়ি চুমাউরা’ ক্রিয়া সম্পন্ন করব।” পেয়াদা গ্রামের সকলকে ডেকে একত্রিত করে। জগমাঁঝি ঠোঙ্গা করে লোটার জল হাতে করে বর—যাত্রীদের কাছে গিয়া বলে, “আসুন, গিরি চুমাউরা’ দেখবেন।” তারা সকলে হাঁড়ি সঙ্গে নিয়ে আসে। একেই বলে “ভাচি নাইলানি।” দুজনে কাঁধে করে দুটি ভাণ্ডে হাঁড়ি কনের বাড়ীতে নিয়ে আসে। বরযাত্রীরা পৌছলে ছাউনির নীচে খড় বিছিয়ে দেওয়া হয়। তারা সকলে সেখানে বসে।
পরে কনেপক্ষের জগমাঁঝি বলে, “আইওদের খোঁজ কর আর হরিদ্রা পিষ। তারা এলে বর কন্যাকে তেল মাখাবো।” আইওরা এসে বর কন্যাকে তেল মাখায়; তারপর তাদের ভাত খেতে দেওয়া হয়। তখন বর কিছুই মুখে দেয় না। জিজ্ঞাসা করলেও কিছু বলে না। তখন কনের বাপ বলে, “জামাই বাবা, এখন খাও, তোমাদের দুধ খেতে দিব।” তারপর একটা বাছুর স্বীকার করলে সে পায়। খেয়ে তারা উঠে পড়ে; আইওরা পাটি গুছায়, আর হরিদ্রা নিজেদের আঁচলে বেঁধে নেয়। তারপর চালক লোটাতে জল নিয়ে বাইরের উঠান আসে; সেখানে এসে দেখতে পায় যে মৌলগাছের খুঁটিতে কিছুই লেখা নাই।… পরে চালক পাতা দিয়ে বেশ করে লিখে দেয়। তখন জগনাঝি বলে “এখন তোমরা দুজনে বরকন্যাকে লিখিত জায়গায় চারিপাশে লোটাজল নিয়ে ঘুরপাক দেও।” তারা বর কন্যাকে সেরূপ ঘুরপাক দেয়। তারপর সকলে পাটিতে বসে। কনের মা ও তার দুই জা “কারওয়াল।” কলসী বার করে আনে এবং সঙ্গে একসের ধান কোচায় করে নিয়ে আসে। বরকন্যার সামনে ধান রেখে তার উপর কলসী রাখা হয়। কলসীর উপরে একটা ঢাকনি রাখা হয়, তেল এনে ঢাকনিতে ঢেলে দেয়। কনের মা একটা পলতা পাকিয়ে অ’লো জ্বেলে দেয়।
তারপর জগমাঁঝি কনের বাপকে বলে “এবার মদ নিয়ে এস।” তখন “ভাচি বাইসানি’ হাঁড়ি বের করা হয়। বরপক্ষের একটি আর কনে পক্ষের একটি বালক হাঁড়ি পরিবেশন করে; দুজনে দুবাটি মদ পায়। বর পক্ষের বালকটি বর পক্ষের হাঁড়ি কন্যাপক্ষকে আর কন্যাপক্ষের বালকটি কন্যা ‘ক্ষের হাঁড়ি বরপক্ষকে দিয়া থাকে—দুইপক্ষেই মাঁঝি হইতে আরম্ভ হয়।
তারপর জগমাঁঝি বাড়ীর ভিতর গিয়ে কনের মাকে বলে, “এখন ‘গিড়ি চূমাউরা’ (বরণ) কাজ আরম্ভ কর। তখন কনের মা ও তার জা-রা বের হয়ে আসে এবং গ্রামের অন্যান্য মেয়েলোক দুয়ারের নিকট থাকে; তারপর বরণ কাজ আরম্ভ হয়। প্রথমে কনের মা বরণ করে। একটা ডালাতে আতপ ধান, আতপ চাল, দুর্বাঘাস, একজোড়া বয়লা ও একটি হালি রাখে, এবং ডালাখানা বর কন্যার মাথার উপরে ঘুরায়; তারপর মুঠো ক’রে কিছু চাল, কিছু ধান, ও দুৰ্ব্বাঘাস নিয়ে দুজনকে বরণ করে, এবং তাদের পেছন দিক্ দিয়ে সেগুলি দূরে ফেলে দেয়; তার পর বরকন্যার সামনে বসে এবং বরের দুহাতে বয়লাজোড়া পড়িয়ে দেয় এবং মেয়ের গলায় হালি পড়িয়ে দেয়। তারপর
দুজনে মাকে প্রণাম করে। কনের মার জা-রা সেভাবে বরণ করে, তবে গয়নার পরিবর্তে কড়ি দিয়া থাকে। তারপর মাঁঝির স্ত্রী, পারাণিকের স্ত্রী ও গ্রামের অন্যান্য মেয়েরা বরকন্যাকে গয়না পড়িয়ে দেয় অথবা কড়ি দেয়; বর ও কড়ি দিয়া থাকে। তার পর কনের ছোটবোন বরকন্যার পা ধুইয়ে দেয় এবং পুরস্কার চায়। বর তাহাকে এক আনা পয়সা দেয়। বরকন্যা উঠে ঘরের ভিতর যায় এবং জগমাঁঝি কড়িগুলি গ’ণে কুড়িয়ে বরের পিতার নিকট জিম্মা রাখে।
তারপর কনের পিতা, মাঁঝি ও জগমাঁঝি ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে। মাঁঝি কনের পিতাকে জিজ্ঞাসা করে “ওহে হাঁড়ি কতটা আছে?” কনের পিতা বলে “বরযাত্রীদের কুলাবে।” তখন মাঁঝি জগমাঁঝিকে বলে “বরযাত্রীদের ডেকে নিয়ে এস; আর কনেকে বলে, “এস মা, এবার বাপকে জল দিবে।” আইওরা সকলে বাইরে আসে; এক লোটা জল বাইরে আনে। যাত্রীদের সামনে এসে মাঁঝির মাঁঝি সে জল দিয়ে মুখ ধোয়। বরযাত্রীদের ডাকা হয়, কনে ও সঙ্গে সঙ্গে এক হাঁড়ি মদ ও তারপর কনে ও আইওরা বর—কাছে লোটার জল রেখে যায়। তারপর জগমাঁঝি এক বাটি মদ কনেকে দেয়, কনে সে মদ মাঁঝিকে দেয়। মাঁঝি সে মদ পান করে এবং বামহাতে কনেকে ধরে কোলে বসায়, একগাছা শাঁখা পড়িয়ে দেয়, ও চুমা খায়, কন্যা কোল থেকে উঠে মাঁঝিকে ঘুরে প্রণাম করে; তারপর এরূপ জগমাঁঝি পারাণিক, বরের বাপ জেঠাকে প্রণাম করে থাকে। তারপর কনে বাড়ীর ভিতর যায় এবং বর—যাত্রীরা তাদেয় বাসায় চলে আসে।
তারপর জগমাঁঝি কনের পিতামাতাকে জিজ্ঞাসা করে “রান্না হয়েছে কিনা।” তারা বলে “হাঁ, সব তৈয়ার বরযাত্রীদের খাবার জন্য ডাক দেন।” তখন জগমাঁঝি গ্রামের পেয়াদাকে ডেকে বলে, “যাও গ্রামের গুণী-গরিব ধনী নির্ধন সকলকে ভোজে নিমন্ত্রণ করে ডেকে আন; আর আমি বরযাত্রীদের ডেকে আনছি।” সকলকে ডেকে আনা হয়; তারা ছাউনির নীচে বসে। তখন জগমাঁঝি গ্রামের ছোকরাদিগকে পরিবেশন করতে আজ্ঞা করে; তাদের কেহ ভাত দেয়, কেহ ঝোল দেয়, কেহ পাতা আনে। তারা মাঁঝি হ’তে আরম্ভ ক’রে সকলকে ভাতব্যঞ্জন পরিবেশন করে। ভোজের পর সকলে যার যার ঘরে চলে যায়। মেয়েদের এরূপ ভোজ হয় ও খেয়ে দেয়ে নিজেদের ঘরে চলে যায়। সিন্দুর দান পর্য্যন্ত বর কনের ঘরে থাকে।
“রোলা” গণনা “রোলা” rafter
তারপর হাঁড়ি পানের জন্য আবার জগমাঁঝি বরের বাপ এবং বরযাত্রীদের মধ্যে একজন কিংবা দুজন বৃদ্ধকে ডেকে নিয়ে আসে। তারা এলে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে। দুই বেয়াই একপংক্তিতে বসে এবং দুজনকে একসাথে হাঁড়ি দেওয়া হয়; তারা পরস্পরকে প্রণাম করে হাঁড়ি পান করে। তারপর আর সকলে হাঁড়ি পান করে। তখন এই গান হয়,
খুঁটি দেখ, খুঁটি দেখ, সুমুদিনি, (সম্বন্ধি)
খুঁটি দেখ শিবি বৃন্দাবন
পাঁড় দেখ, পাড় দেখ, সুমুদিনি,
পাঁচ দেখ, শিরি বৃন্দাবন।
রোলা দেখ, বোলা দেখ সুমুদিনি,
রোলা দেখ, শিরি বৃন্দাবন!
ঝাঁটি দেখ, ঝাঁটি দেখ, সুমুদিনি,
ঝাঁটি দেখ, শিরি বৃন্দাবন।
খেঁড় দেখ, খেঁড় দেখ, সুমুদিনি,
খেঁড় দেখ, শিরি বৃন্দাবন
রোলার পরে চালের নীচে
কে রয়েছে বসেগো?
বৌ রয়েছে বৈঠকে গো?
রোলার পরে চালের নীচে,
অমুকে রয়েছে বসেগো,
অমুকে করছে মালি মামলা গো
ছোট বেয়াই, বড় বেয়াই
হাসিব খেলিব,
জীবন ভর বেয়াই
যমরাজা হ’তে হরিবোল।
তারপর হাঁড়ি পান শেষ হয়, এবং বরযাত্রীরা তাদের জায়গায় চলে যায়।
তারপর বরপক্ষের মধ্যে যার ইচ্ছা হয় সে গ্রামের বালকবালিকা দের নিয়ে মণ্ডলের নীচে নৃত্য করে, ঢাকঢোল বাজায়, ও বেশ করে গান করে। বরপক্ষের বুড়োরা বরপক্ষের ছোকরাদের যাবার পূর্ব্বে বলে “বাছা, নাচবে ত নাচ কিন্তু দেখ কার গায়ে হাত দিওনা, শাস্তি হবে।“ বরপক্ষের কোন যুবক কনেপক্ষের কোন মেয়ের সঙ্গে হাসিঠাট্টা করতে পারে না, কারণ তাতে খুব সাজা হয়; পরন্তু কন্যাপক্ষের কোন যুবক বরপক্ষের কোন মেয়ের সহিত ঠাট্টা-তামাসা করলে বিশেষ কেহ গ্রাহ্য করে না।
বরকন্যার বিদায়
পরদিন সকালে বর কন্যাকে জগমাঁঝি বাইরে আনে। জগমাঁঝি বলে “আপনারা সকলে প্ৰস্তুত হ’ন, আমি বর কন্যাকে এবার বের করব।” সকলে প্রস্তুত হয়; জগমাঁঝি বলে “একটা দিস্তা নিয়ে এস।” দিস্তা আনা হয় এবং সেটা কন্যাপক্ষের কারও নিকট জিম্মা দেয়। জগমাঁঝি কন্যার মাকে বলে “ওগো লোটাতে ও বাটিতে গুড় আর জল সাজিয়ে দাও, আর একটা পাটি নিয়ে এস।” কনের মা বলে, “আমরা সকলে প্রস্তুত”—এই বলে এক পাইল। ধান কন্যার আঁচলে বেঁধে দেয়। তখন জগমাঁঝি বলে “বুড়ো মাঁঝির হাঁড়ি কোথায়?” এক পাত্র হাঁড়ি তাকে দেওয়া হয়; সে হাত বাড়িয়ে নেয় এবং বলে “আসুন সকলে বাইরে চলুন;” সকলেই বাইরে আসে। তখন কনে আঁচলে বাঁধা ধানগুলি ঘুরে ঘুরে বাড়ীর দুয়ারের দিকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে প্রণাম করে। তারপর সকলে মাঁঝির নিকট আসে। বরযাত্রীরাও তাদের সঙ্গে সেখানে আসে।
বরযাত্রীরা নাচতে সুরু করে, আর জগমাঁঝি মৃত মাঁঝির উদ্দেশ্যে। মদ উৎসর্গ করে এরূপ মন্ত্র পড়ে থাকে, “দেখ মাঁঝি বুড়ো, বরকনের বিদায় উপলক্ষে তোমায় পূজা দিতেছি! দেখবে যেন এরা বনের ভিতর যেতে যেতে হুচট্ না পড়ে। কোন বিধবা কিংবা দুঃখী স্ত্রীলোক যেন এদের কোন মন্ত্র পড়ে যাদু না করে; পথে কিংবা জঙ্গলে যেতে যেতে যেন এদের কারও পেটব্যথা কিংবা মাথাব্যাথা না হয়! বছর ঘুরতে না ঘুরতে যেন এই বরকন্যার খাটের নীচে আমরা বুড়োরা যেন আবার কোলাকুলি করতে পারি; তুমি আগে, আমরা পেছনে, ভালয় ভালয় যেন বরকন্যা ও তাদের সাথীরা গন্তব্যস্থানে পৌঁছায়।” তারপর সকলে বরপক্ষ ও কন্যাপক্ষ মিলে বরকন্যার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের বাইরে দোরাস্তা পর্যস্ত অনুসরণ করে।
গুড় খাওয়ান
দোরাস্তায় পৌঁছিলে সেখানে একখান পাটি পেতে কনের মাকে, বসান হয়। তারপর সকলে বরকে এনে শাশুড়ীর কোলে বসাইয়া দেয়। শাশুড়ী জামাইর মুখ ধোয়াইয়া দেয় ও তিনবার ক’রে গুড় খাওয়ায়। কনেকেও সেরূপ ভাবে গুড় খাওয়ায়।
তারপর কনের গ্রামের সকলে পংক্তি করে দাঁড়ায়—একদিকে পুরুষ আর অন্যদিকে মেয়েরা। তখন কনের মা বরকন্যাকে বলে “তোমরা মাঁঝি হতে আরম্ভ করে সকলকে প্রণাম কর।” তারা সকলকে প্রণাম, করে। তারপর সকলে পরস্পর প্রণাম করে; পরে গান হয়।
উঠ ধনি, চল ধনি,
আপনারি ঘরে ধনি।
চল ধনি দশ বাড়ী দূর
না জান তিতা,
না জান মিঠা,
না জান নানুয়ারে।
জানত “ফলনা” রায়ে,
জানত গাও ভাইয়া
জানত দেশভারি লোক।
তারপর গ্রামের বুড়োদের ডেকে এনে পংক্তি করে বসায়; বরযাত্রীরা ও মুখোমুখী হয়ে বসে; তারপর গল্প আরম্ভ হয়। বর ও কন্যাপক্ষের মাঁঝি দুজন নানাপ্রকার উপদেশ দেয় এবং যাতে বরকন্যা উভয়ে সুখে স্বচ্ছন্দে থাকতে পারে সেরূপ অনুরোধ করে।
তারপর জগম।ঝি কন্যার হাত ধরে বরপক্ষের মাঁঝির নিকট এনে বলে “নেন বাবা, আমি একে আপনাদের হাতে সমর্পণ করলাম।” মাঁঝি উত্তর দেয় “হাঁ বাবা, আমরা একে নিলাম।” তখন কনে নিয়ে বরযাত্রীরা ঘরের দিকে রওনা হয়। তখন জগমাঁঝি ডেকে বলে, “ওগো বরযাত্রী একটু দাড়াও, অস্ত্রগুলির কথা ভুলে গেছি।” এই বলে এক টুকরা মাংস এনে তাদের সঙ্গে দেয়। বরযাত্রীদের সঙ্গে পাঁচজন কন্যাপক্ষ আর একজন ঝি যায়। ঝি একটা পাটি সঙ্গে নিয়া যায়। বরপক্ষ চলে যায়। আর কন্যাপক্ষ বিবাহের বাড়ীতে ফিরে আসে।
শুভজল
‘চাড়ি’ ছাগলটা কাটা হয়; কাঁচা মাংস তিনভাগে বিভক্ত করে; একভাগ ও মাথা কনের বাপ পায়; আর দুভাগ গ্রামের পাঁচজন সুরুয়া পোলাও রেঁধে খায়। ‘চাড়ি’ মদও সকলে পান করে। মণ্ডপের নীচে মৌল গাছের গুটি উঠান হয়; সেখানে প্রোথিত আতপচাল, কাচা হলুদ, দুর্ব্বাঘাস, আর কড়ি বের করা হয়। খুলে দেখা হয় কিরকম আছে। হলুদে আর আতপচালে অঙ্কুর গ’জে থাকূলে বরকন্যার শুভ হয়। তারপর গ্রামের ছোড়া ছুড়ার। এক ঝুড়ি ভাত, এক হাঁড়ি ঝোল, আর এক হাঁড়ি মদ পায়। একে “শিশির” হাঁড়ি ও “শিশির” ভাত বলে থাকে। তারপর জগমাঁঝি আইওদের ও এক এক ভাগ ভাত দিয়ে তাদের পিতামাতার নিকট রেখে আসে। সকলেই আপন আপন ঘরে চলে যায়।
বরপক্ষ নিজেদের গ্রামে এসে উপস্থিত হয়; তখন ঘটক সকলকে রাস্তার মোড়ে রেখে আগে চলে আসে এবং বরের বাড়ীতে এসে বলে, “বর কন্যা এসেছে। আসুন আপনার। শুভ-জল দিয়ে তাদের গ্রহণ করুন!” বরের পিতা গ্রামের মঝি, জগমাঁঝি, পারাণিক, জগপার ণিক, পেয়াদা প্রভৃতি সকলকে ডেকে আনে। তাদের দুই বাটি ক’রে মদ দেওয়া হয়, বরের পিতা বলে, “ওগো, ম ঝিসাহেব, বরকন্যা এসেছে। আসুন আমরা জল দিয়ে আশীর্ব্বাদ ক’রে তাদের নিয়ে আসি।” তখন মাঁঝি বলে, “ওহে গ্রামের ছেলেমেয়েদের ডেকে পাঠাও।” জগমাঁঝি পেয়াদা পাঠিয়ে সকলকে ডেকে আনে। মাঁঝি বরের পিতাকে বলে, “আপনি একহাঁড়ি মদ ঢেলে রাখুন।” তারপর মাঁঝি জগমাঁঝিকে বলে, “তুমি ছেলেদিগকে দুখোরা মদ দেও।” বরের পিতা একটু মদ মাটিতে ঢেলে দিলে জগমাঁঝি ছোকরাদের হাঁড়ি দিয়া থাকে।
তারপর মাঁঝি ছেলেদের বলে “এখন খুব ক’সে কাপড় পর, আর ‘একজোড়া ঢাক খুঁজে নিয়ে এস।” মাঁঝি জগমাঁঝিকে বলে, “একটা কলসীতে জল আর একটা লোটা নিয়ে এস।” এসকল আনা হলে পর সে বলে, “আসুন, আমরা বরকন্যা ও কন্যাপক্ষ সকলকে নিয়ে আসি।” তখন ছেলেমেয়েরা সকলেই রাস্তার মোড়ে বরকন্যার নিকট চলে আসে। জগমাঁঝি লোটার জল কন্যাপক্ষকে ও কনের সহচরী-বুড়ীকে দেয়।
তারপর বরের মা, বর, কন্যা, কন্যাপক্ষ ও কনের সহচরী বুড়ীকে পা ধোয়াইয়া গুড়জল খাওয়ায়। সে সময়ে গ্রামের মেয়েরা গান গেয়ে কনেকে গালি দিয়া থাকে, যেমন কনেপক্ষ জামাইকে গালি দিয়ে গান করেছেন সেরকম—কেবল নামটা বদল হয়ে থাকে। তারপর জগমাঁঝি মেয়েদের বলে, “তোমরা বন্ধু কন্যাকে কোলে নেও।” তারা বরকন্যাকে কোলে নিয়া বাড়ী বাড়ী ঘুরে এবং বাড়ীর মেয়েরা তাদের গুড় খাওয়াইয়া থাকে। সর্ব্বশেষে বরের বাড়ীতে এসে সকলে উঠানে দাঁড়ায়; বামণী এসে বরকন্যার আঁচল বেঁধে গিট দিয়ে দেয়। তখন বরের মা একখানা আগেতে আতপ চাল, আতপ গান, দুৰ্ব্বাঘাস, তিন টুকরা চালের গুড়ী, তিন টুকরা গোবর একটা বাটিতে হলুদ, একবাটিতে তেল, একটা লোহার শাঁখা, সিন্দুর চিরুণী, সাজিয়ে এই থালা হাতে করে বরের মা উঠানে নিয়ে আসে। বরকন্যাকে তিনবার বরণ করে থাকে; তারপর থালা রেখে কিছু দুৰ্ব্বাধান, আতপ চাল ও আতপ ধান মুষ্টিতে ক’রে বরকন্যাকে আবার তিনবার বরণ করে এবং সেগুলি তাদের পিছন দিকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
তারপর বরের মা একটা বাটিতে জল ও হলুদ বেশ করে গুলে বরকন্যার গালে মাখিয়ে দেয়। কন্যা ও শাশুড়ীর গালে হলুদজল মেখে দেয়। তারপর বরের মা বৌর মাথায় তেল মেখে দেয়। চিরুণী দিয়া মাথা আঁচরিয়ে দেয়, কপালে শাশুড়ীকে তেল মাখিয়ে, চিরুণী দিয়ে চুল আঁচরিয়ে কপালে সিন্দুরের টিপ্ দেয়। তারপর বরের মা কনের বামহাতে লোহার শাঁখা পরিয়ে দেয়। তারপর গুড়ী ও গোবর তিন টুকরা তিন কোণে ছুড়ে ফেলে দেয়। তারপর বরের খুড়ী-জেঠা প্রভৃতিও এরূপ করে থাকে।
গৃহ প্রবেশ
তারপর বরের মা ঘটককে একটা “টোক” (উথলি দিস্তা) আতে বলে। ঘটক কন্যাপক্ষের কাছ থেকে একটা উথলি চেয়ে নিয়ে আসে। এটাকে “যৌতুক টোক” বলে। তারপর আইওরা ঘরথেকে একটা পাতিলে আগুন নিয়ে উঠানে আসে। তখন তিনি জা (প্রথমে বরের মা) বামহাতে টোক আগুনের উপরে বরণ করে এবং ডানহাতে প্রণাম করে। শেষের মেয়েটি টোক দিয়ে পাতিল ঢেলে দিয়ে আগুন ফেলে দেয়, এবং টোকটা ঘরের দিকে ফেলে দেয়। একেই বরকন্যার ‘গৃহপ্রবেশ’ বলে।
তেল হলুদ মাথান
তারপর বরকন্যাকে ঘরের দুয়ারে নিয়া আসে এবং সেখানে একখানা থালার উপরে তাদের পা ধোয়ান হয়। তারপর তাদের ঘরের ভিতর নিয়ে যায়; তখন বরের ছোটবোন দরজা বন্ধ করে দেয়। তখন একটা গান হয়, সেটাকে “বিজয়ার” গান বলে। তারপর কন্যা তার ননদকে একটা পয়সা দিলে সে দরজা খুলে দেয়। সকলে তখন ঘরের ভিতর প্রবেশ করে এবং পাটি পেতে বসে। আইওরা বরকন্যাকে তেলহলুদ মাথায়। তখন গান হয়;–
কাকারি লাগি, বাবা, গজমতি হাতি হো?
কাকারি লাগি, বাবা, ময়নামতি রাণী হো রে?
বাবু কুয়ার লাগি, গজমতি হাতি হো,
বাবু কুয়ার লাগি, ময়নামতি রাণী হো রে।
পুরুবে (পূর্ব্বে) যে গেলো পুতা, পছিমে যো আইলা,
কাহা পুতা পাওলে পুতা, কেঁও ঝাঁরি ফুল?
সাত সমুদ উপরে, জলপ-গঙ্গা-ঘাটে জো,
বাবা কিনাল কেঁও ঝাঁরি ফুল।
তারপর আইওরা বরকন্যা ও আর সকলকে সিন্দুরের কৌটা দেয় এবং তাহাদের হাত ধোয়াইয়া দেয়। তারপর বরকন্যাকে দুধভাত দেওয়া হয়; আর একজন ভাততরকারী এনে সকলকে পরিবেশন করে। …. খাওয়া শেষ হইলে আইওরা তাদের হাত ধোয়াইয়া দেয়। তারপর সকলে বের হয়ে আসে। বর কন্যাপক্ষের সহিত আর কন্যা তার সহচরী—বুড়ীর কাছে থাকে। তারপর গ্রামের জগমাঁঝি কন্যাপক্ষকে ডেকে এনে ভাত ও হাঁড়ি খাওয়ায়; তারপর বরপক্ষকেও ডেকে এনে তাদের ভাত ও হাঁড়ি খেতে দেয়। একে “ধুলকাড়ানি হাঁড়িভাত” বলে। তারপর সকলে ঘুমিয়ে পড়ে। ভোর হ’লে পর বরের পিতা জগমাঁঝিকে বলে, “কন্যাপক্ষেরা উঠেছে কিনা একবার খবর নিয়ে এস।” জগমাঁঝি বলে “তারা সকলেই উঠেছে।” তারপর বরের পিতা, কন্যাপক্ষ, বরকন্যা, কন্যার সহচরী বুড়ী, গ্রামের মাঁঝি ও আর দুএকজন নিয়ে গরুর পালের নিকট আসে; সেখানে বরের বাপ একটা দামরা বাছুর কন্যাপক্ষকে দেখাইয়া বলে, “বাবা, এটা তোমাদের চিনে লও।” তারপর কনের ছোট ভাই কিংবা দাদা সেই বাছুরের পিঠে হাত চাপড়িয়ে প্রণাম করে; গ্রামের মাঁঝিও আর সকলে প্রণাম করে; সকলে একত্র বসে। মাঁঝি উঠে কনেপক্ষদের বলে, “নেও বাবা, আমাদের এ বাছুরটিকে নেও।” তারপর সকলে যার যার ঘরে চলে আসে।
তারপর বরের পিতাকে জগমাঁঝি বলে “এখন দয়া করে তেল ও দাঁতন দেও, স্নান করিতে যাব।” তেল ও দাঁতন দেওয়া হয়। জগমাঁঝি কনেযাত্রীদের জলের ঘাটে নিয়ে যায়। তারা স্নান করে ফিরে আসে। জগমাঁঝি ঘরে প্রবেশ করে বলে, “আমরা এসেছি, বড় ক্ষুধা পেয়েছে, তাড়াতাড়ি কর।” সে কনেযাত্রীদের ঘরের ভিতরে নিয়ে পাটিতে বসায় এবং বলে “দেও, চার চার খোর। ক’রে হাঁড়ি দেও” সকলকেই হাঁড়ি দেওয়া হয়; সকলেই পান করে। আইওগণ হাত ধোয়াইয়া দেয়, আর খোরাগুলি ভেঙ্গে ফেলে দেয়।
চিড়া মুড়ী
তারপর বরের মা একটা ডালাতে চিড়া-মুড়ি নিয়ে আসে। বরের মা বলে, “নেও বাবা, চিড়ামুড়ি ভিজিয়ে নেও।” তারা চিড়ামুড়ি ভিজিয়ে নেয়, তখন একজন আইও গুড় ও দই এনে তাদের পাতে ঢেলে দেয়। তখন বরের পিতা মিনতি করে নানাপ্রকার কথা বলে। সকলে খেয়ে উঠে, তাদের আবার হাঁড়ি দেওয়া হয়। হাতমুখ ধুয়ে সকলে উঠে আসে।
গ্রামের ভোজ
তারপর জগমাঁঝি ঘরে প্রবেশ ক’রে বরের পিতাকে জিজ্ঞাসা করে “এখন কুটুমদের কি খাওয়াব?” সে বলে, “একটা খাসি আছে, সেটাকেই বানিয়ে নেও।” জগমাঁঝি গ্রামের একটি ছোকরাকে ডেকে এনে বলে, “বাপু তুমি গ্রামের ছোটবড় সকলকে নিমন্ত্রণ করে বলগে “আসুন আপনার কনেযাত্রীদের শাকপালা তুলে দিবেন।” মেয়ে পুরুষ সকলেই এসে বরের ঘরে একত্রিত হয়। গ্রামের সকলে কেহ সন্দেশ, কেহ মদ, কেহ বা চাল এনে থাকে।
তারপর জগমাঁঝি একটা খাসি এনে বরযাত্রীদের দেয়। খাসিটাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে তার মাথায় জল ঢেলে দেয়, তারপর সেটাকে একটা পাতায় করে চাল খেতে দেয়। তখন জগমাঁঝি কনেযাত্রীদের বলে “বাব। এবার তোমাদের শাকপালা তুলে নেও।” তারা সকলে উঠে পড়ে; তাদের মধ্যে একজন খাঁড়া ধরে খাসিটাকে ছুঁয়ে দেয়, খাড়াটাকে সেখানে রেখে দেয়। তখন গ্রামের একজন খাসিটাকে খাঁড়া দিয়ে মেরে ফেলে। কনেযাত্রীদের কেহ খাসি কাটে না, কেনন। তারা বলে “বিবাহ-বন্ধন ছিড়ে যাবে!” জগমাঁঝি খাসির মাথাটা পাতার চালের ভিতর রেখে ঘরের ভিতর চলে যায়। কাটবার সময় যে ডাণ্ডা ধরেছিল সে খড়দিয়ে রক্তপুছে ফেলে এবং ডাণ্ডাটা মাটিতে রাখে। তারপর বরের বাপ সেই জায়গায় কতকটা হাঁড়ি ফেলে দেয়। তখন সকলে হাঁড়িপান করে।
তারপর জগমাঁঝি বলে “এবার আপনারা পরস্পর অভিবাদন করুন।” প্রথমে বেয়াই দুজন পরস্পরকে প্রণাম করে, তারপর সকলে মাঁঝি হতে আরম্ভ করে গ্রামের সকলকে প্রণাম করে। ছেলেমেয়েরা নাচতে থাকে, আর মজুরেরা মজুরের কাজকাম করে।
বরণ
তারপর বরের পিতা মাঁঝিকে বলে “বাবা, এস সকালে সকালে বরণ-কাজ শেষ করে ফেলি।” পেয়াদা পাঠিয়ে গ্রামের সকলকে ডাকা হয়। তারপর আইওরা বরকন্যাকে ঘরের ভিতর নিয়ে তাদের তেলহলুদ মাখায়। তেলমাখার পর বামনী তাদের আচল এক করে বেন্ধে দেয়। তারপর তাদের ভাত খেতে দেওয়া হয়। তখন বউ খেতে চায়না, কিছু জিজ্ঞাসা করলেও উত্তর দেয়না। তখন বরের পিতা বলে “বৌমা তোমারা খাও, দুধ খাবার জন্য তোমাদের একটি বাছুর দিব।” তখন সে খায়; খাবার পর সকলে বাইরে আসে।
তারপর বামনী লোটায় জলনিয়ে সর্ব্বপ্রথমে মণ্ডপের খুটির নিকট আসে। তারসঙ্গে কনের সহচরী-বুড়াও থাকে। যেখানে লেখা হয়েছে, সেখানে তারা তিনবার করে ঘুরে। আর বামনী ঘুরবার সময় জল ঢেলে দেয়। তারপর আইও লেখার উপরে পাটি পেতে দেয়, সেখানে বর কন্যাকে বসায়। তারপর কনের ঘরে যেমন বরণ করা হয়েছিল তেমন এখানেও হয়। গ্রামের মেয়েরা বরণের সময় বরকনেকে শাঁখা, মালা, অঙ্গুরী, কিংবা কড়ি উপহার দিয়া থাকে। কনেপক্ষ বরণকালে কিছু দেয় না। তারপর গ্রামের লোকে বেশকরে মদ পান করে। তারপর তিনপাক দিয়ে বরকন্যাকে ঘরের ভিতর নিয়ে আসে। তারা সকলে আবার হাঁড়িপান করে।
ভোজ
তারপর গ্রামের সকলকে ভোজ দেওয়া হয়। কনের বাড়ীতে যেমন খাওয়া দাওয়া হয় এখানেও সেইরূপ খাওয়া দাওয়া ও কথাবার্তা হ’য়ে থাকে। খাওয়া দাওয়া করে কেহ নাচগান করে, কেহবা শুয়ে থাকে। (যারা নাচগান করবার তারা নাচগান করে, আর যারা শোবার তারা শুয়ে পড়ে)।
ভোর হয়; তখন বামনী বরকন্যার বিবাহের কাপড় সিদ্ধকরে কাঁচে। তারপর কনেপক্ষ ও কনের সহচরী বুড়ী সকলে দাঁতন করে; দাঁতন শেষ ক’রে বাসি চিড়ামুড়ি বরকন্যার সহিত খায়। তারপর বরকন্যার স্নান ও সাজি মাটিদিয়ে-চুল-মাজা দেখবার জন্য গ্রামের সব মেয়েপুরুষ একত্রিত হয়। স্নান ও মাথা কচলান আরম্ভ হয়; দুখানা পিড়ি একলাই সে পাতে; আর একটা পাত্রে সাজিমাটি ভিজায়; দুটা দাঁতকাঠি আনে; বরকন্যাকে পিড়িতে বসায়। তারা পূর্ব্বদিক মুখ করে বসে, বরের দক্ষিণদিকে কন্যা বসে। তারপর বর একটা দাঁতকাঠি চিবিয়ে কনেকে দেয়; কনে আবার দাঁতনের জন্য সেটাকে বামনীকে দেয়; কনের হাতের ভাল দাঁতন বামনী নিয়ে বরকে দেয়। বরকন্যা দুজনের দাঁতন শেষ হয়; হাতমুখ ধোওয়াও হয়। তারপর বরকন্যা পরস্পর সাজি মাটি দিয়ে নিজেদের মাথা পরিষ্কার করে; তারপরে স্নান হয়। কন্যা নিজে বরের পা ধোয়ায় ও তেল মাখায়; তারপর তাকে প্রণাম করে। তারপর সকলে পরস্পরকে অভিবাদন করে হাঁড়ি পান করে।
বর কনেকে মাঁঝির উপদেশ দান
আহারের পর মাঁঝি বরকন্যাকে নিজের কাছে বসিয়ে উপদেশ দেয়। সে বলে, “ওগো বউমা এখন এটাই তোমার ঘরবাড়ী; এখানেই তোমার ঘরসংসার (হাঁড়ি-পাতিল!; আজ থেকে সব দেখেশুনে নেও; এখন এরাই তোমার বাপমা; এরা যা চায় দিবে; এরা যে কাজ করতে বলবে সে কাজ করবে; ইনি তোমার স্বামী। রাত্রি হ’ক, আঁধার হ’ক, পেটব্যথা কিংবা মাথাধরা হ’ক বাপমাকে বলবে আর এদের অবর্তমানে স্বামীকে বলবে, “ওগো আমায় সাহায্য কর, রাত্রে কিংবা অন্ধকারে একলা কোথাও বের হওনা।”
তারপর মাঁঝি বরের বাপমাকে বলে, “দেখ, এই মেয়ে নিজে আসে নাই; আমরাই বাণিজ্য করে নিয়ে এসেছি; এ বেচারি নির্ব্বোধ (‘ আনারি “), আজ থিকে বেশ করে সাবধানে একে শিখিয়ে পড়িয়ে নিবে; তবেই ভালমত চলিতে পারিবে।”
তারপর মাঁঝি জামাইকে বলে, “তুমিও বাপু আজ থেকে যেখানেই শিকার করতে যাওনা কেন যাহা পাবে একলা সম্ভোগ করোনা; আধখানা নিজে খেলে আর আধখানা স্ত্রীর জন্যে নিয়ে আসিবে।
তুমিও বৌমা আজ থেকে তোমার স্বামী যেখানেই থাক্, আসামাত্র তাকে জল ‘ও দাঁতন দিবে; জল আনতে কিংবা পাতা কুড়াতে কোন সহচরীর সঙ্গে যাবে, কোন পুরুষের সঙ্গে হাসিঠাট্টা করোনা; ইনিই তোমার একমাত্র পুরুষ, অন্য পুরুষের দিকে তাকিও না।”
তারপর কন্যা উত্তর দেয়, বিবাহবন্ধনে জড়িত হয়েছি; করবেন। এরা দুজন আমার ইনি আমার ধর্ম্মমা, আর ইনি আমার সহধর্মী। যেখানে থেকেই এরা ক্লান্ত এবং ক্ষুধার্ত্ত হ’য়ে আসবে আমি জল এনে দিয়ে এদের শ্রম অপনোদন করব। আমি এরূপ ভাবে না চলিলে আপনারা সকলে আমায় ভর্ৎসনা করবেন।”
“হাঁ বাপ, আমরা প্রতিজ্ঞা করে আপনার। পাজনে ইহা আরও দৃঢ় বাপমা – ইনি আমার ধর্ম্মবাপ আর
তারপর মাঁঝি ঠাট্টা করে বলে “বা বৌত বেশ ভাগ; ভাত তরকারী আমাদের কেমন দেয় দেখব, আমরা খেলে বিশ্বাস করব।”
ঘটক বিদায়
তারপর বরের পিতা ঘটক ও বামনের পাওনা চুকিয়ে দেয়। ঘটক পাঁচহাত লম্বা একখানা ধুতি, এক সিকা পয়সা, ও খড়মের জন্য এক আনা পয়সা পায়। পুরোহিতও পাঁচহাত লম্বা একখানা ধুতি পায়। সকল তখন উঠানে আসে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা নেচে নেচে গান করে। তারপর কনেযাত্রীরা বিদায় হয়। তাঁরা যাবার সময় কনেকে বলে “মা ভেবোনা, আমরা পাঁচদিন পরে এসে তোমাকে নিয়ে যাব। তুমি হাঁড়ি তৈরি করে রাখবে, আর পাঁচ পাইলা চিড়া কুটে রাখবে।” তারপর সহচয়া বুড়ীও বলে, “মা, এখানে মন দিয়ে থাক, এটাই এখন তোমার ঘর, এটাই তোমার দুয়ার; রীতিমত কাজকাম ক’রে খাওয়া দাওয়া করবে, আমাদের ভুলে যেও না, এটা তোমার চিরজীবনের ঘরবাড়ী; ভেবোনা পাঁচদিন পরে আবার আমরা আসব।” তারপর কনেপক্ষ সকলকে প্রণাম করে বিদায় হয়। তারপর মণ্ডপ তোপা হয়।
ঘাটকেনা
বিকাল বেলা ৪টার সময় বৌ গ্রামের দু’একটি মেয়েকে নিয়ে জল আনতে ঘাটে যায়, অল্প কিছু সিন্দুর সঙ্গে নেয়; সেখানে ঘাটে পাঁচটি সিন্দুরের ফোটা দেয় এবং সহচরীদের সঙ্গে চলে আসে। একে ‘ঘাটকেনা’ বলে।
পাঁচদিন পরে দ্বিরাগমন
পাঁচদিন পরে ঘটক ও কন্যাপক্ষের দুই একজন লোক এসে হাজির হয়। প্রণামাদি করবার পর তাদের পা ধোয়াইয়া দেওয়া হয়। তারা ঘরে প্রবেশ করে হাঁড়ি পান করে। পরে মুরগীর ঝোল রেন্ধে ভাত খেতে দেয়। তারপর তারা ঘুমিয়ে পড়ে। ভোর হলে চিড়ামুড়ি খেতে দেয়। দুপুরবেলা ঝোল ভাত খায়; দুপুরবেলার খাওয়া শেষ হলে শাশুড়ী চিরুণী দিয়ে বৌর মাথা আচড়িয়ে দেয় এবং সিন্দুরের টিপ দেয়, বরকেও তৈয়ার করা হয়। বউ এক হাঁড়ি মদ আর পাঁচ পাইলা চিড়া সঙ্গে নেয়, চিড়া কাপড়ে বেন্ধে নেয়। তারপর সে শ্বশুর শাশুড়ীকে প্রণাম করে, ঘটক ও কনেপক্ষের দুইজনকে সকলে প্রণাম করে। বৌ মদের হাঁড়ি মাথায় নেয় এবং চিড়া কাপড়ের খুঁটে বোগলে রাখে। তারপর একছার নিজের ঘরে চলে আসে। ঘরে এসে হাজির হয়। সেখানে কনের দিদি ও ছোট বোনে সকলের পা ধুইয়ে দেয়; তারপর জামাইকে চিমটি কাটতে থাকে; জামাই পয়সা কিংবা মালা স্বীকার করলে ছেড়ে দেয়। সকলে মিলে জলকেলি করে, পরস্পর অভিবাদন করে ঘরের ভিতর এসে খাওয়া দাওয়া করে।
সমাপ্তি
দুইরাত্রি বরকন্যা সেখানে থাকে। তখন ঘটক বলে, “আমি এখন তোমাদের নিয়ে যাব।” একপাত্র হাঁড়ি ও পাঁচপাইল। চিড়া প্রস্তুত হয়। কন্যা এগুলি মাথায় ও বোগলে নিয়া চলে। প্রণামাদি করে তারা ঘটকের সহিত বরের বাড়ীর দিকে রওনা দেয়। সেখানে এসে উপস্থিত হয়। গ্রামের সকল লোক সেখানে এসে উপস্থিত হয়। এখানে মদ ও চিড়া খাওয়া হয়, সকলে খাওয়া দাওয়া করে গল্প করে। তারপর “আপনাপন” ঘরে চলে যায়। ঘরকন্যা সেখানে থেকে যায়।