ধর্ম ও সেবা

“ধরম ও সেওয়া” (ধৰ্ম্ম ও সেবা)

(১) ঠাকুর (ঈশ্বর)

আদিকালে সাঁওতালদের দেবদেবতা কিছু ছিল না; পালিয়ে আসতে আতে এসব এরা পেয়েছে। পথে সিংদুয়ারে “সিংবোঙ্গার” অর্থাৎ সূর্যদেবের লাগাল পেয়েছে। প্রাচীনেরা কেবল এক ঈশ্বরকেই বিশ্বাস করত। উপদেবতা পেয়ে ক্রমে ক্রমে তারা ঠাকুরকে ভুলেছে; এখন কেবল নামটি মাত্র অবশিষ্ট আছে। আজকাল অনেকে নামও ভুলে গেছে, কেবল বুড়োদের কথায় ও মুরুব্বিদের কৃপায় নামটা মাঝে মাঝে স্মরণ করে। আজকাল অনেকে বলে থাকে, “সূর্য্যদেবই আমাদের ঠাকুর, কেননা সৃষ্টি ও ধর্ম্মের অভ্যুদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সূর্য্যদেব আমাদের দৃষ্টি গোচর হয়েছেন।” কিন্তু প্রাচীনেরা কিংবা তাদের গুরুরা এখনও বলে থাকে, “না, ইহা ঠিক নয়; পরমেশ্বর একজন নিশ্চয়ই আছেন; চৰ্ম্মচক্ষে তাঁকে দেখা যায় না, কিন্তু তিনি সব দেখতে পান। পৃথিবী, ব্যোম, মানব, প্রাণী, পাখী, পিপীলিকা, সাপ, বিছা, মাছ, কাঁকড়া, বৃক্ষাদি, ধানচাল, বজরা, জন্দ্রা, যাবতীয় পদার্থ তিনি নিজে সৃষ্টি করেছেন, সব শাসন করছেন এবং ছোটবড় সকলকে পালন করছেন। তিনি স্বয়ং একেবারে সৃষ্টিকর্তা ও সংহার-কর্ত্তা। উপদেবতার কিংবা মানুষের খেয়ালে সৃষ্টিও হয় নাই, সংহারও হবে না। পরমেশ্বর সব মাপ জোফ করে সৃষ্টি করেছেন; সৃষ্টির শেষ না হওয়া পর্যন্ত কারও বিনাশ হতে পারে না। এখানে আমরা যেইভাবে থাকি, স্বর্গে গিয়েও আমরা সেইভাবে ঠাকুরের কাছে ভালমন্দ পাব।”

সূর্য্যদেবতা সাঁওতালদের প্রধান উপাস্যদেবতা, তাঁহার কৃপায় ভোর হয়, সন্ধ্যা হয়, রৌদ্র হয়, বৃষ্টি হয়; এজন্য তাঁর নামে ধর্ম্মের দোহাইও দেওয়া হয়। ইনি পুরুষ, চাঁদ এর স্ত্রী; আর আকাশের তারা এদের পুত্রকন্যা। প্রাচীনেরা বলাবলি করে, “এ দুজনের অনেক সন্তানসন্ততি ছিল। পুত্র সন্তান পিতার কাছে, আর মেয়েরা মার কাছে থাকে। সূর্য্যদেবের ও দিবসের তারার কিরণে পৃথিবীতে উত্তাপের সৃষ্টি হয়।“ চাঁদ দেবী সূর্য্যদেবকে বলেন “ছেলেগুলোকে খাইতেছ, আবার মর্ত্যবাসীদের পুড়িয়ে মার।” বুড়ো সূর্য্যঠাকুর আবার বলেন, “তুমি মেয়েগুলোকে মেরে ফেল; নচেৎ মানুষ ‘আসান’ (শান্তি) না পেলে আমি ওদের খেয়ে ফেল্‌ব।”

পরে চাঁদদেবী (মেয়ের জাত ফরফন্দী বেশ জানে) মেয়েগুলিকে সব ডোলের ভিতর লুকিয়ে রেখে বুড়োর নিকট এসে বলে, “আমি সব খেয়ে শেষ করেছি, তা’না হ’লে রৌদ্র ও বৃষ্টি হবে কেন? তুমিও ছেলেগুলিকে খেয়ে নাচ, তবেই মানুষ হেসে খেলে বাঁচবে।” এরূপে বুড়ী বুড়োকে মিথ্যা ব’লে প্রবোধ দেয়। বোকা বুড়ো মেয়েলোকের কথায় বিশ্বাস করে নিজেদের ছেলেদের খেয়ে শেষ করে। রাত্রি হ’লে আর বেশ দেখা গেল যে মেয়েরা সব বেঁচে আছে! তখন সূৰ্য্যদেব চটে তরোয়ার হাতে করে বুড়ীকে তেড়ে মারতে যায়; মেরে শেষ করত কিন্তু বুড়ী তখন তার ছোট মেয়েকে দিয়ে তাঁকে শান্ত করে।

এখন পর্য্যন্ত সূর্য্যদেব তেড়ে চলেছেন; ফরফন্দী সব টের পেয়ে মাস মাস কেটে ফেল্‌ছে; কেবল বুড়োর প্রাণ ঠাণ্ডা থাকলে দুএকদিনের জন্য চন্দ্রমাদেবী একটু ‘আসান’ পান। যে দুটি তারা বুড়োকে দেওয়া হয়, তার একটির নাম প্রভাত-তারা, আর একটির নাম সন্ধ্যা তারা। আজকাল অনেকেই ভুল করে যেমন সূর্যদেবকে পরমেশ্বর বলে, তেমন অন্যান্য উপদেবতাকে ঠাকুর বলে উপাসনা করে। বোঙ্গা (উপদেবতা) পূজার সময় এরূপ নিবেদন করা হয়—”বাবা ঠাকুর, গোঁসাই ঠাকুর, তোমাকে প্রণাম।“ উপদেবতায় বিশ্বাস থাকে পূজা কর, কিন্তু তাই বলে এঁরা ঠাকুর নয়, কেবল উপদেবতা মাত্ৰ।

(২) উপদেবতা (বোঙ্গা)

উপদেবতার মধ্যে সূর্য্যদেব প্রধান; তাঁরপর “জমছিম বোঙ্গা”, “মারাং বুরু” (পৰ্ব্বতদেব, আসল নাম ‘লিটা’ অথবা শয়তান), তার পর “জাহেরএরা” (আসল নাম রামশালগী অর্থাৎ পীঠস্থানের দেবতা, “মোরে” (অর্থাৎ পঞ্চদেবতা), “গোঁসাই বৌ”, “পরগণা বুড়ো”, “মাঁঝিবুড়ো”, “গৃহদেবতা”, তাঁরপর “পারিবারিক দেবতা।” এসব ছাড়াও ওঝাদের পৃথক উপদেবতা আছে। আর অনেকে ধনী হবার উদ্দেশ্যে নানাপ্রকার ধনী উপদেবতার পূজা দেয়। সীমাবোঙ্গা, সুতবোঙ্গা, ঝরণাবোঙ্গা, বৃক্ষকাণ্ডমূলকদেবতা, বনদেবতা ইত্যাদি আরও অনেক উপদেবতা আছে।

পারিবারিক দেবতা নানারকমের; বংশভেদে ভিন্ন ভিন্ন দেবতার পূজা হয়; আর গৃহদেবতা তেমনি ভিন্ন ভিন্ন রকমের। এক বংশের ভিতর অনেক সময়ে মিল হয় না কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন বংশের মধ্যে অনেক সময়ে বেশ মিল দেখা যায়। পারিবারিক দেবতা কিংবা গৃহদেবতার নাম বাইরে কেহ অন্যলোকের নিকট প্রকাশ করে না, এমন কি স্ত্রীলোকেরা ও এবিষয়ে কাকেও বলে বেড়ায় না। বাড়ীর বুড়ো ব’লে যায়। সাঁওতালদিগের

মরবার সময় বড়ছেলের কাণে কাণে নাম মধ্যে গুরুস্থানীয় প্রাচীনেরা সকলেই আদি যুগ হ’তে পারিবারিক ও গৃহদেবতার নাম জানে। হালদারবংশের কয়েক পারিবারিক দেবতার নাম “ধারাসোড়ে” অথবা “ধারাসঁড়ি।”, আর “কাটকম-কুদ্র।”। আর গৃহদেবতার নাম “বাসপাহার” অথবা “দেওমালি”। কিসকুবংশের পারিবারিক দেবতার নাম “চম্পাদানাগড়”, আর গৃহদেবতার নাম “সোঁস” ইত্যাদি। “জমাহমবোঙ্গা” পরিবার ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়। কোন পরিবারে “পানহার”, কোনখানে “আনহার”, কোনখানে “বযডাঙ্গে”, “সেঁওখালি”, “বারাংবাবা”, “বাড়া-আহাংকো” ইত্যাদি।

ওঝাদের দেবতার নাম “সিংবাহনি” “মারাংবুরু” “কামরু-গুরু” “সিধা-গুরু” “গাণ্ডো-গুরু” “লভর-গুরু” “বুয়াংগুরু” “ভিতুগুরু” ইত্যাদি, আর যে গুরুর নিকট ওঝা শিক্ষা করে থাকে। ধনীবনদেবতাও ভিন্ন ভিন্ন, একজনের নাম “কালচাওরা”। কথায় বলে ধনীউপদেবতা অন্য লোক থিকে চুরি করে এনে ধনীলোককে দিয়ে থাকে। কখনও কখনও ধনীদেবতারাও ঝগড়া করে থাকে এরূপ প্রবাদ আছে। আর এদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে শক্তিমান তাঁর ধনী উপাসকেরাও অনেক সম্পত্তির মালিক হয়। এরূপ প্রবাদও আছে যে ধনী উপদেবতারদের অনেক সময়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। একদিন একধানের ‘খাড়াই” (thrashing foor) থেকে এক ধনী বোঙ্গা “ভারে” করে ধান বয়ে নিতেছিল, ঠিক সেসময়ে ধনী গৃহস্থ এসে পড়ে, এবং চোর মনে করে তাঁকে লাঠা দিয়ে তাড়া করে; ইনি উঠান পার হয়ে পালিয়ে যান। তারপর ঘরের ভিতর প্রবেশ করে, চারিদিকে পালিয়ে বেড়ায়, আর ঘরের যত হাঁড়ি পাতিল ভেঙ্গে শেষ করে। সে লোকটিও ডাকাডাকি করে উত্তম-মধ্যম গালাগালি করে, এবং বলে, “এই কি তোমাদের চোরভূত আমার বাড়ীতে এসে হাজির হয়েছে।” সেই সময় থেকে এই লোকটি কোথাও গেলে বোঙ্গা ভয়ে বাড়ীর ভিতর ঢুকে পালিয়ে বেড়ায়; সেজন্য ধনী গৃহস্থেরা একে বলে থাকে, “ওগো আমার বাড়ীতে আর এসো না; তোমার ভয়ে বোঙ্গা আমার সব ভেঙ্গে চুরে দেয়।”

“জমছিম” বোঙ্গা প্রথম থেকে ছিল না; সূর্য্যদেবের উৎসবের সময় এর পূজা দেওয়া হত। পূর্ব্বপুরুষদের কথায় এর পূজা হ’য়ে থাকে। একদিন উৎসবান্তে সকলে যখন ঘরের দিকে রওনা হয় তখন হঠাৎ “খাড়া” হারিয়ে যায়; রাস্তায় এটা ধরা পড়ে এবং একজনে খাড়া আতে ফিরে যায়। এই লোকটি “জমছিম” বোঙ্গাকে দেখতে পায়; ইনি ছড়ান যত ধান চাল কুড়িয়ে খায়। খেতে খেতে বোঙ্গ। বলে, “এবার না তে নাচতে সব ভোজ নষ্ট করেছি।” তারপর লোকটাকে দেখতে পেয়ে সে অদৃশ্য হ’য়ে যায়। লোকটি খাড়া ফিরিয়ে আনে কিন্তু বোঙ্গা দেখার কথা কাকেও বলে না। এরপর লোকটি ব্যারামে প’ড়ে মরণাপন্ন কাতর হয়, তখন ওঝারা খড়ি পেতে গণে জিজ্ঞাসা করে, “কিহে বোঙ্গাটোঙ্গা দেখেছ?” তখন লোকটির সেদিনকার কথা মনে পড়ে এবং বলে, “হুঁ। ঠিক, সত্যসত্যই আমি হারাণে। খাঁড়া আনতে গিয়ে এক বোঙ্গা দেখেছিলাম; তাঁকে বলতে শুনেছি, ‘এখন নাচতে নাচতে ভোজ ভেঙ্গেছি’।” এজন্য এই বোঙ্গার নাম “আহাং” রাখা হয়। ওঝারা বললে “এই বোঙ্গাকে তোমরা সকলে ‘জমাছিম’ বোঙ্গা বলে পূজা করবে।” সেদিন থেকে সাঁওতালেরা এর পূজা করে থাকে।

(২) সেওয়া আর পরব (পুজা পার্ব্বণ)

‘এরো ছিম’−(A festival observed after seed-sowing has begun; fowls are sacrificed and milk is offered to the village the village deities)–অর্থাৎ বাইন-পরব, বছরের প্রথম পরব। আষাঢ়মাসে বাইনের সময় চারা তৈরি করবার উদ্দেশ্যে সকলে মিলে মুরগী উৎসর্গ করে খাওয়া দাওয়া করে। প্রত্যেক পরিবারের এক একটি ক’রে মুরগী লাগে। নায়ক গ্রামের পীঠস্থানে পূজা দেয়। মারাংবুরু, জাহের-এরা, মোড়ে, গোঁসাই-এরা, পরগণা, আর বুড়ো মাঁঝি-এদের নামে এক একটি করে মুরগী উৎসর্গ করা হয়। চারি সীমা—দেবতার উদ্দেশ্যেও একটা মুরগী পূজা দেওয়া হয়। অবশিষ্ট মুরগীগুলি সীমার চারদিকে উৎসর্গ করা হয়। অথবা বেশী হ’লে ‘জব’ করে ফেলে। সকলে একসঙ্গে পূজা দেয় না। ভিন্ন ভিন্ন পূজা হয়। এরূপ মন্ত্র পড়া হয় :—”বাপু ঠাকুর, তোমাকে প্রণাম—ইত্যাদি”।

নায়কের ভোজন শেষ হ’লে গ্রামের ছেলেবুড়ো মুরগীর সুরুয়া পোলাও রান্না করে একত্রে ভোজন করে। জাহের-এরাও মোড়ে দেবতার মুরগী দুটি নায়কে একলা খায়। দুদিন তিনদিন ধরে ঘরে ঘরে এরূপ পূজা হয়ে থাকে। পারিবারিক বোঙ্গা, গৃহবোঙ্গা, প্রাচীনবোঙ্গা আর মারাংবুরুর নামেও পূজা দেওয়া হয়।

‘হাড়িয়ার ছিম’—ধান রোয়া শেষ হ’লে শ্রাবণমাসে ভাল ফসলের জন্য চাষীরা দেবতার উদ্দেশ্যে মুরগী উৎসর্গ করে পূজা দেয়—একে “হাড়িয়ারছিম” পরব বলে (ছিম—মুরগী, fowl) —A festival observed after the paddy has been planted. Fowls a1e sacrificed to all the tribal village deities and prayer offered for a good harvest)। এ সময় কেবল গ্রামের দেবতার নামেই পূজা হয়; মন্ত্র একপ্রকার।

“ইড়ি গুদলি নওয়া” (নূতন ইড়ি ও গুনদলি–offering the first fruits of iri & gundali crops) — ভাদ্রমাসে এ পরব হয়। এ সময় নায়ক স্নান করে যেখানে উচু জমিতে প্রথম পাকা শস্য দেখে সেদিকে চলে যায়। আর একদিকে দাঁড়ায়ে যতটা পারে ততটা শস্য এনে “জাহেরে” (গ্রাম্য প্রান্তে) গোবর ছিটিয়ে “জাহের এরা” প্রভৃতি দেবতার নামে পূজা দেয়। মন্ত্ৰ প’ড়ে দুধ ঢেলে উৎসর্গ করে। আবার মন্ত্র প’ড়ে গ্রামে ফিরে এসে মাঁঝির “খানে”ও সেরূপ মন্ত্ৰ প’ড়ে পূজা দেয়। যাহা অবশিষ্ট থাকে তাহা নায়ক নিয়ে আসে।

“জানখাড়”-(worship accompanied with sacrifice when the ripening of the low land rice is acknowle—dged and the first fruits offered to the deities) – অগ্রহায়ণ মাসে এ পূজা হয়। এ পূজায় একটা শূকর কিংবা ভেড়া বলি দেওয়া হয়। একে “জানখাড়”-বলি বলে। কুডাম নায়ক জাহের সম্বন্ধীয়—পরগণায় এনে একে বলি দেয়। পূজার সামগ্রী সকলই কুডামনায়ক জোগাড় করে। সুরুয়া, লোগা ও রান্না করবার চালও সে এনে থাকে। পূজা শেষে কেবল পুরুষের! খায়; মন্ত্র পড়া হয় এবং গ্রামের নায়ক নূতন ইড়ি গুন্দশির মত নূতন ধান উৎসর্গ করে। গ্রামের প্রত্যেক ঘরে ঘরে এরূপ নূতন ধানের পূজা হয়।

সহরায়—সহরায় পরব (Harvest festival observed after the full harvest has been gathered) সাঁওতালদের প্রধান পরব। পৌষমাসে ধান কাটা শেষ হলে এপরব হয়। নুতন ফসল পেয়ে সকলেই দেবদেবতার পূজা দেয় এবং আত্মীয়স্বজনকে নিমন্ত্রণ করে সমাদর করে খাওয়ায়। ছোটবড়, রাঢ়ী-দুঃখী সকলেই এপরবে যোগদান করে।

মাঁঝি গ্রামের লোক ডেকে একত্রিত ক’রে বৈঠক করে এবং সহরায় পরবের দিন নির্দ্দিষ্ট করে। পরে মাঁঝি পাইককে আদেশ করে “যাও গটহাড়ি তুলো গে। আর ঘরে ঘরে বল সকলেই হাঁড়ি পাতুক। অমুক দিন অমুক সময়ে সকলে ‘সহরায়’ স্নান করব এরপর ঘরে ঘরে হাঁড়ি রাখা হয়, আর সকলেই আপন আপন আত্মীয়দের নিমন্ত্রণ করে। নির্দ্ধারিত দিনে ভাই, বোন, মেয়ে, ভাগিনা, ভাগিনী, ভাইপো, ভাইঝি সকলে মিলে সমবেত হয়। স্নানের পূর্ব্বদিন সন্ধ্যাবেলা পাইক তিনটা মুরগী ধরে নায়কের নিকট নিয়ে আসে—হটো সাদা আর একটা বাদামী রংয়ের। নায়ক এগুলি বেন্ধে রাখে আর নিজে সেরাত্রি খুব নিষ্ঠা নিয়মে থাকে—মাটিতে পাটি পেতে শুয়ে থাকে। পেয়াদা বাড়ী বাড়ী ঘুরে এক একটা মুরগী এবং সেই সঙ্গে এক পাই করে চাল, লবণ, ও হলুদ সংগ্রহ করে। স্নানের সময় নায়কের স্ত্রী চালের গুড়ি করে নায়ককে দেয়। প্রাতরাশের সময় নায়ক পূজা দিতে জলের ধারে চলে যায়। পাইক সকলকে ডেকে নায়কের সঙ্গে সীমানার দিকে চলে যায়। গ্রামের দুএকজন লোকও তাদের সঙ্গে যায়।

নায়ক জল থেকে স্নান করে উঠে গোবর দিয়ে উত্তর দক্ষিণ দিকে আঁকে। খোঁড়াতে খোঁড়াতে এক একটা করে চতুষ্কোণ খোঁড়া গ্রাম থেকে তোলা চাল রাখে; তাতে সিন্দুরের টিপ দেয়; প্রত্যেক লাইনে তিন তিনটা করে সিন্দুরের টিপ দেয়। তারপর পূর্ব্বদিগের বাদামী রংঙের মুরগীটাকে জলের ছিটা দেয়, এবং এর মাথায়, ডানায় সিন্দুর লাগায়। তারপর তোলা চালের উপর মুরগীটি চরিয়ে বেড়ায় এবং নায়ক মন্ত্র পড়ে, “ওগো, জাহেরএরা, ওগো ঠাকুর, তোমাকে প্ৰণাম; আজ আমরা সকলে ‘সহরায়ের’ নামে এখানে এসেছি; তোমরা খুসী হ’য়ে আমাদের সুখস্বচ্ছন্দ বৃদ্ধি কর; আমাদের আজ বুড়ো, ছেলেমেয়েদের মঙ্গল হৌক। পুরাকালে প্রাচীনেরা যেরূপ কাপড়চোপড়ে ধনেধান্যে সমৃদ্ধশালী ছিল, আমাদেরও সেরূপ হৌক; বাবাঠাকুর তোমাকে প্রণাম। আমাদের যত কিছু আরাম ব্যারাম, পীড়া, দুঃখজ্বালা সব তোমরা নিবৃত্তি কর; আমাদের আত্মীয় কুটুম্ব, চাকর-বাকর, ভাগা-ভাগিনী, নাতি-নাতনী, সকলের মঙ্গল হোক; আমাদের মধ্যে যেন ঝগড়া-বিবাদ, নাশ বিনাশ, মনো—মালিন্যের সৃষ্টি না হয়; আমরা যেন নেচে-গেয়ে সুখে-স্বচ্ছন্দে থাকি; ওগো গোঁসাই, বাবাঠাকুর তোমাকে প্রণাম!”

তারপর বাদামী রংঙের মুরগীটিকে উৎসর্গ করা হয়। এরূপ আরও অনেক মুরগী উৎসর্গিত হয়। তারপর সুরুয়া-পোলাও রান্না করে গ্রামের সকলে ভোজন করে। তারপর “গটছাড়ি” (তোলামদ) সকলে পান করে। তারপর গ্রামের গুণী-গরিব সকলেই সকলের কুশলাদি জিজ্ঞাসা করে—”কেমন আছেন? কারও ত অসুখ-বিসুখ নেই?” কারও অসুখ থাকলে বলা হয়। গ্রামের সকলেই বলে থাকে “মাঁঝি বাবা, আপনার আশীর্বাদে আমরা সকলেই ভাল আছি।” মাঁঝিও বলে, “ঠাকুরের আশীর্ব্বাদে আমাদের সকলেরই মঙ্গল হবে। এই ‘সহরায়-পরবে’ আমাদের বড় বোন এসে হাজির হয়েছেন; পাঁচ—দিন পাঁচ রাত্রি ভাই-বোন মিলে নেচে গেয়ে স্ফূর্ত্তি কর; নিয়াই-ঝগড়া করো না; ‘লোভ-লালচ’ করো না; লোভ-লালচ থাকলে খুব হুসিয়ার হ’য়ে ‘ঝান্টি-ঝিঙ্গা’ তুলে ফেলবে; দেখে তুলবে যেন কোন কাঁটা না থাকে; আর যে সব ফুল গাছ সাবধানে সুতা দিয়ে তোলা হয়েছে সে সব গাছের ফুল তুলে পাপের ভাগী হয়ো না।” সকলে মিলে তখন জবাব দেয় “বার বাণ্ডিল সূতা দিয়ে আমাদের কাণ বন্ধ করব, যেন ছোট বড় কারও কথা চোখেও দেখ তে না পাই, আর কাণেও শুতে না পাই।” তারপর সকলে মিলে গান ধরে :—

“কো নাহি সিরিজিলা,
ব্যোম্‌ পিথিমা হো।
কো নাহি সিরিজিলা,
গাইয়া জো ইয়োরে;
কো নাহি সিরিজিলা।
গাইয়া জো।

ঠাকুরাহি সিরিজিলা
বোমা পিথিমা হো,
ঠাকুরাহি সিরিজিলা,
গাইয়া জো ইয়োরে,
ঠাকুরাহি সিরিজিলা,
গাইয়া জো।

টিরমুচি সিরিজিলা
কানুরে গোয়ালা,
পুরুবাহি ডাহারালি
গাইয়া জো ইয়ারে
পুরুবাহি ডাহারালি
গাইয়া জো

কাহা বাবু হারালিও
ডাণ্ডা কা বাঁশীহো,
কাহা বাবু হারালিও,
গাইয়া জো ইয়োরে।
কাহা বাবু হারালিও
গাইয়া জো।

বাটেহি হারালম
ডাণ্ডা কা বাঁশীহো।
গটেহি হারালাম
গাইয়া জো ইয়োরে।
গটেহি হারালম্
গাইয়া জো।

তারপর রাখালবালকেরা চীৎকার ক’রে বলে, “ওহে, তোমরা সকলে গাই নিয়ে এস; খাঁদ পেতে ঠিক করে নেও।” তখন যে যার গাই নিয়ে খাঁদের নিকট আসে। তখন নায়ক রাখালদের পাচন-নড়ী চেয়ে নিয়ে খাঁদের নিকট রাখে। এবং প্রত্যেকখান নড়ীতে সিন্দুর দিয়ে দেয়। তারপর গাইগুলিকে খাঁদের নিকট আনা হয়।

যে গাই সেখানে রক্ষিত ভিমে পা দেয় অথবা তার গন্ধ সুঙ্গে, সে গাইটিকে ধরে তার পা ধোয়ান হয় এবং তার শিঙ্গে তেল মেখে সিন্দুর দেওয়া হয়। এই গাইএর রাখালকে সকলে মিলে ঘাড়ে তুলে মাঁঝির নিকট নিয়ে আসে। রাখালবালক মাঁঝিকে নত হ’য়ে প্ৰণাম করে, এবং তারপর অন্যান্য বুড়োদেরও প্রণাম করে।

তারপর ঢাক বাজাতে বাজাতে সকলে ঘরে ফিরে চলে আসে। তখন নায়ক গৃহে প্রবেশ করে সকলকে হাঁড়ি খেতে দেয়। সেখান থেকে সকলে মাঁঝির বাড়ীতে আসে; ইনিও সকলকে হাঁড়ি পান করায়। মাঁঝি জগমাঁঝি ও জগপারাণিককে বলে, “এই পরবের সময় গ্রামের ছেলেমেয়ে সব তোমাদের দুজনের জিম্বায় থাকৰে; পরবও তোমাদের জিম্বায়। রাস্তাঘাট শূন্য রাখলে কারও জরিমানা হবে না।” তারপর সকলে যার যার বাড়ীতে চলে যায়। নিজেদের বাড়ীতে ভাতও খায় আর হাঁড়িও পান করে।

সন্ধ্যা হয়; বুড়োবুড়ীরা ঘুমাতে যায়। আর রাখালবালকেরা গাই নিয়ে বাড়ী বাড়ী টহল দেয়। প্রথমে মাঁঝির বাড়ীতে আসে; গোয়ালঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে ঢাক বাজিয়ে গান ধরে।

গাইনী চলিল সিরিবিন্দাবন হো,
মহিষিণী চড়ায় গঙ্গাপারাজো ইয়োরে।
মহিষিণী চড়ায় গঙ্গাপারাজো,
গাইনী আসে বেল্ ডুবতে।
মহিষিণী আসে আঠা রাত জো ইয়ারে,
মহিষিণী আসে আধারাত জো।
কোন সিংঙে দিব তেল সিন্দুর,
কোন পিঠে দিব দুবিধান জো ইয়োরে
কোন পিঠে দিব ছবিধান জো।

এরকম গৃহে গৃহে এসে গান করে, ঢাক বাজায়, আর বেশ করে বাঁশী বাজায়, আর সারা রাস্তা লজ্জাসরম ছেড়ে চেঁচিয়ে বেড়ায়। গৃহস্থেরা এসব শুনেও শুনে না।

তারপর মেয়েরাও গাই নিয়ে ঘুরে আসে। তারাও সর্ব্বপ্রথমে মাঁঝির বাড়ীতে আসে। আতপ চাল, আতপ ধান, দুর্ব্বাঘাস, ও প্রদীপে তেল নিয়ে যায়। সকলে মিলে মন্ত্র পড়ে এবং মন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে মেয়েরা আতপ চাল ও দুৰ্ব্বাঘাস গোয়ালঘর ও গাইর দিকে রেখে গান গায়।

হাতে নিলা আতপ চাল
গোছে নিলা পাকাল পান,
চলি গেল অমুকী দেবী,
গাইয়ে চুমবাইয়ে
একা চুমবাই চুমবাই লাগলে,
দুই চুমবাই বাড়ারে,
পড়ি গেলা সেরা বলদ,
একে কালে গো।
কাই বলদ কান্দ হে,
কাই বলদ খিজ হে।
দেবরে পুতা রি,
রিল মালারে সান।
ধীরে চালাও ধীরে চালাও,
বাবুরে বরদ।
কহিছে তো কামবে সিন্দুর।

গ্রামের যুবতীরাও ঘরে ঘরে এই প্রকার গান গেয়ে বেড়ায়। যাদের মহিষ আছে তারাও এরূপ ঘুরে ঘুরে গান করে বেড়ায়। এরূপে বাড়ী বাড়ী ঘুরে এসে ছেলেমেয়েরা গ্রামের রাস্তায় সমবেত হয়। সেখানে তারা গান করে, ঢাকঢোল বাজায়, বাশী বাজায়, এবং করতাল বাজায়ে নাচগান করে খুব আমোদপ্রমোদ করে।

অতি প্রত্যুষে মোরগের ডাকের সঙ্গে সঙ্গে ছেলেরা আর একবার গাই নিয়ে ঘুরতে যায়; পেছনে পেছনে মেয়েরাও যায়। ছেলেরা গান গায়।

কুকড়া মা ডাকি গেল,
পাওয়া মা পার্টি গেল।
উঠ পুটা পাছড়া খোলায়রে,
উঠ পুটা পাছড়া খেলায়।
না বাবা উঠায়,
না বাবা জাগায়,
রাত তো পোহাল গোয়ালেরে,
রাত তো পোহাল গোয়ালে।
হাতে নিলা ছড়ি,
পায়ে নিলা খড়ম্,
চলি গেলা অমুক রায়;
পাছড়া খোলায়।

মেয়েরা ঘুরে ঘুরে এরূপ গান গেয়ে বেড়ায়। তারপর রাখালবালকেরা গাই ছেড়ে দেয় এবং মেয়েরাও নাচ-গান শেষ করে নিজ নিজ কাজে লেগে যায়। ছেলেরা মাঁঝির উঠানে এসে “ডান্টা” নাচ নেচে গান করে,–

চলরে চোলিয়া পুলিয়া
মাছ ধরতে যাব,
মাছের কাটা লাগিল,
দোলা ছানদাই যাবে গো।

কে বলে বুড়া মরল,
কে বলে বুড়া আছে,
ঝার কোলে বাশিয়া,
রাঙ্গা মাটি মাখিয়া।

বুড়া কুরমুরে গো (কোথায় গো)
বুরা কুরমুরে।

স্ত্রীলোকেরা সংসারের কাজকর্ম করে; ঘরদুয়ার গোবর দিয়ে লেপ দেয়; আর বালকেরা নাচ-গান শেষ করে ঢাক-ঢোল নিয়ে বাড়ী বাড়ী “গাদোল” করে ঘুরে বেড়ায়। (গাদোল = young men and boys go about with drums and other musical instruments and pay a visit to each house in the village; some of the party go as Fakirs, some with straw monkeys, some as pedlars for the sake of amusement, They get rice and keep it with Jagamanjhi).

একবার এদিক থেকে আর একবার ওদিক থেকে বাঁশের ঝাঁটি নিয়ে গভেতের বাড়ী হাজির হ’য়ে সকলে বাইরের ফটক বন্ধ করে দেয়। গভেত এক হাঁড়ি মদ দিলে পর দরজা খুলে দেয়। পরে গ্রামের শেষ প্রান্তে এসে নানারকম নাচের পুতুল তৈরি করে; সেগুলি মাঁঝির বাড়ীতে নিয়ে আসে। সেখানে পুতুল নাচায় এবং মাঁঝি তাদের চাল দান করে। এরকম সকল বাড়ী বাড়ী গিয়ে ভিক্ষা মাগে। ভিক্ষা শেষ করে ভিক্ষালব্ধ সমস্ত চাল জগমাঁঝির নিকট জিম্মা দেয়। তারপর সকল ছেলেরা মিলে তীর, কুড়াল চুরি প্রভৃতি নিয়ে স্নান করতে যায়। স্নান করে আসে।

তারপর ঘরে ঘরে মুরগী ও শূকরের মাংস দিয়ে বোঙ্গার পূজা করে। বোঙ্গাপূজা শেষ করে ভাত ঝোল রান্না করে। প্রাচীনেরা পূজার মাংস ভিন্ন ভিন্ন ক’রে রান্না করত। ভাতের সঙ্গে এই মাংস মিশিয়ে ঠাকুরকে উৎসর্গ ক’রে মন্ত্র পড়ে এবং তারপর সকলে ভোজন করে। এরূপ গান হয় :—

থোরা থোরা মুরগী শুকর
বহু বহু কুটুম,
ভাত কিম্বা ঝোল,
আমি, বাবা, না পারি বাটতে।

বুড়োবুড়ীরা হাঁড়ি পান করে বাড়ী বাড়ী গান গেয়ে ঘুরে বেড়ায়; ছেলেমেয়েরাও রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে নাচ-গান করে।

দ্বিতীয় দিন ভোর হয়। তখন মাঁঝির বাড়ীতে সকলকে একত্রিত করবার জন্য ঢাক বাজান হয়। গ্রামের মুখ্যারা সকলে এসে হাজির হয়। মাঁঝি সকলকে জিজ্ঞাসা করে, তারা উত্তর দেয় “হাঁ, মাঁঝিবাবা, আমরা সকলেই ভাল আছি, ভাল থাকৃতে মন্দ বলব কেন?” মাঁঝি হাঁড়ি দেয় এবং সকলেই তা পান করে। তখন মাঁঝি জিজ্ঞাসা করে, “এখন তোমরা গরু খুঁটা দিবে কিনা?” তারা বলে, “আপনি হুকুম করলেই গরু খুঁটা দিতে পারি (বাঁধতে পারি)।” তখন মাঁঝি জগমাঁঝিকে ও জগপারাণিককে ডেকে হুকুম দেয়। জগমাঁঝি ছেলেদের ডেকে বলে দেয় “সব খুঁটা গেড়ে ফেল।” “কেমন হে, গুণী-গরিব সব ভাল ত?”

খুঁটা গাড়ার আসল জায়গা মাঁঝির, পারাণিকের, জগমাঁঝির, জগপারাণিকের, আর গর্ভেতের বাড়ী। এই পাঁচজনের দুয়ারে জগমাঁঝি নিজে থেকে খুঁটা গাড়ায়। জগমাঁঝির হুকুমমতে গ্রামের ছেলেরা এই পাঁচ দুয়ারে খুঁটা পুতে এবং তার সঙ্গে বলদ বাঁধিবার জন্য দড়ি লাগায়। জগমাঁঝি এদের হাঁড়ি পান করতে দেয়; হাঁড়ি পান করে যার যার ঘরে চলে যায়।

বিকালবেলা রাখালেরা গরু নিয়ে আসে; এসে নিজেদের বাড়ীতেই রাখে। গোয়ালঘরে তেলমাখান হয়; তারপর গৃহের একজন স্ত্রীলোক— ধনী কি নির্ধন, রাখাল বালককে গোয়ালঘরের দুয়ারে স্নান করায় ও তেল মাখার। তারপর ঘরে এনে পিঠা ও মুড়ি খেতে দেয়। ঘরে ঘরে এরূপ করা হয়।

তারপর জগমাঁঝি গ্রামের ছেলেদের বলে, “ওহে, মাঁঝির ঘর থেকে আরম্ভ করে সব গরু জাগাও, এবং তাদের গলায় ধানের গোছা দেও।” ঘরে ঘরে গাই জাগান হয়; এবং একজন সাথে থেকে ধানের গোছা গলায় লাগিয়ে দেয়। তারপর দেশের কুটুম্বদের জন্য প্রত্যেক ঘর হ’তে এক মোড়া করে হাঁড়ি তোলা হয়। তারপর বলদ বের করে এনে খুঁটা করা হয়। সর্ব্বপ্রথমে মাঁঝির বাড়ীতে গাই বান্ধা হয়। ষাঁড়-গুলিকে দড়ি দিয়ে বেঁধে উশকাইয়া দেওয়া হয়, যেন একটা আর একটাকে আক্রমণ করে। তারপর ঢাকঢোল বাজায়, বাঁশী বাজায়, এবং সমস্ত রাস্তায় রাস্তায় এরূপ খেলা দেখা হয়। তারপর সকলে এসে মাঁঝির বাড়ীতে উপস্থিত হয়। সেখানে দেশের সমস্ত লোক জমাট হয়। সকলেই আপন আপন ষাঁড় ছেড়ে দেয়।

তারপর মাঁঝির বাড়ীতে দেশের কুটুমদের জন্য খাট, মোড়া, মাচি পেতে দেওয়া হয়। তারপর মাঁঝি গ্রামের ছেলেদের বলে, “দেশের কুটুমদের হাঁড়ি দেও; দুই মোড়া করে হাঁড়ি ও তার সঙ্গে মুড়ি এবং চিড়া একমুঠা করে সকলকে দেও।“ সকলকে সেরূপ দেওয়া হয়। তারপর গান হয় :—

ডুডু ডুডু শোনাইতে
আইস হো সঙ্গভাইয়া,
বইস হো সোণার পালংকে
কিছুই নাহি কলা হো,
সঙ্গভায়া মোহিতে মরি।
একর ছিলিম তামাকুর—
খাইলে হো সঙ্গভায়া,
বড়রে বেওহারে,
একর ঘটি পানি জো পিলো হো,
সঙ্গভাই বড়রে সুলাং (‘শান্তি)।

দেশের লোকে উত্তর দেয়,

বাটির বাটি মন্দা জেন;
খাইলা জো সঙ্গভায়া।
দোনো দোনো মালিকের ঝোরে;
কিছুই নাহি কামকাজ করালো হো;
সঙ্গভাইয়া মোহিতে মরি!

তারপর গ্রামের ও দেশের যুবকেরা মাঁঝির দুয়ারে ও গ্রামের রাস্তায় রাস্তায় ঢাল-তরোয়ার নিয়ে নেচে বেড়ায় এবং সকলেই সে নাচ দেখে থাকে। নাচ শেষ করে দেশের কুটুমরা নিজ নিজ বাড়ীতে চলে যায়। আর গ্রামের যুবকযুবতীরা একরাত্রি রাস্তায় নেচেগেয়ে বেড়ায়। ভোরবেলা মাঁঝি এক হাঁড়ি মদ এনে ছেলেদের দেয়। পারাণিকের বাড়ীতেও এইরূপ নাচগান করে এক হাঁড়ি মদ পায়। ছেলে-মেয়েরা সেই দুই হাঁড়ি মদ মাঁঝির দুয়ারে এসে ঢেলে পান করে। আর একরাত্রি নেচে নেচে ভোর করে। ভোর হ’লে জগমাঁঝি ও জগপারাণিক ছেলেদের দিয়ে খুঁটিগুলিকে উঠিয়ে ফেলে। সে সময় ছেলেরা নানারকম রং তামাসা করে বাড়ী বাড়ী হ’তে একটা করে ডিম ও চাল আদায় করে। একজন মরার মত ভান করে; আর সকলে তাকে বাড়ী বাড়ী নিয়া ঝেড়ে থাকে; একটা একটা ডিম ও একমুষ্টি চাল পায়; তারপর মরা হঠাৎ বেঁচে উঠে। প্রত্যেক বাড়ী বাড়ী এরূপ করা হয়।

এই সব শেষ করে যুবকযুবতী, বুড়োবুড়ী সকলে মিলে বাড়ী বাড়ী ঘুরে নাচগান করে আমোদপ্রমোদ করে বেড়ায় উঠানে প্রবেশ করে তারা এরূপ গান গেয়ে থাকে :—

যোগী তো মাঙ্গায়,
বছরে বছর,
ছণ্ডা তো মাঙ্গায়, (ছণ্ডা—ছোকরা)
আজকার দিন ওরে,
ছণ্ডা তো মাঙ্গায়,
আজকার দিন
বহুত না মাঙ্গায়ে,
থোরা না মাঙ্গায়,
মাঙ্গায় তো এক কুলা ধান,
আর এক বাটি মদ।

এই রকম ক’রে বাড়ী বাড়ী থেকে ধান, চাল, ডাল, লবণ ও মদ পেয়ে থাকে। নাচের সময় যুবকযুবতীরা পরস্পর নিন্দাবাদ ক’রে থাকে। যুবকেরা যুবতীদের হাতভাঙ্গা ব’লে গালি দেয়, আর যুবতীরা যুবকদের পা-গোদা বলে নিন্দা করে। এপ্রকার নিন্দাসূচক গানও হ’য়ে থাকে। বাড়ী বাড়ী হ’তে ‘তোলা’ উঠিয়ে রাত্রে জগমাঁঝির বাড়ীতে সব জিম্বা রাখে। সকলের শেষে যে বাড়ীতে গান করে তারা এক হাঁড়ি মদ, পাচগণ্ড। পিঠা, আর পাঁচপাইল। চিড়ামুড়ী দিয়ে থাকে। সকলেই এ হাঁড়ি পান করে, একে “শিশির হাঁড়ি” বলে। নাচগান শেষ ক’রে যুবকযুবতীরা জগমাঁঝির ঘরে এসে ঘুম যায়। পরদিন প্রত্যূষে মেয়েরা জগমাঁঝির দুয়ারে গোবরজল ছিটিয়ে দেয়, জল তুলে আনে এবং ছেলেরা ধানের গোছা এনে একত্রিত করে। জগমাঁঝি যুবকযুবতীদের প্রাতরাশ খেতে দেয়; খাওয়া দাওয়া শেষ করে যে যার ঘরে চলে যায়!

সাকরাত—পৌষমাসের শেষ দিন সংক্রান্তি (বাস্তুপূজা)। এর দুদিন পূর্ব্বে গ্রামের প্রান্তদেশে রাস্তায় সকলে মিলে ব’সে পরামর্শ করে। “কাল আমরা সকলে মাছ ও কাঁকড়া ধরে সাকরাত পরব করব।“ তারপর দিন সকলে মাছ ও কাঁকড়া ধরে। সাকরাত দিন ভোরে বাড়ী বাড়ী একটা মুরগী মারে। ঝোলভাত খেয়ে সকলে স্নান করতে চলে যায়—ভাত, মাছ, কাঁকড়া ও মাংসের ঝোল ইত্যাদি খায়। বেলা উঠলে সকলে মিলে শিকারে চলে যায়। নিকটস্থ বনে শিকার করে। শাকসব্জী স্নানের সময় তুলে নিয়ে আসে। মেয়েরা চিড়া ও পিঠা তৈরি করে নিয়ে আসে। এই সব দিয়ে পূর্ব্বপুরুষদের তর্পণ করে ও প্রধান দেবতার নামে কিছু মদ উৎসর্গ করা হয়। সকলে পিঠা ও চিড়া ভক্ষণ করে। ভোজনের পর জগমাঁঝি তীরধনুকের “চানমারির” জোগাড় করে। সে একটা কায়রা কিংবা এরণ্ডগাছ কেটে নিয়ে আসে। গ্রাম্যরাস্তার মোড়ে ময়দানে একে পুতে তারপর সর্বপ্রথম নায়ককে তীর ছুড়তে বলা হয়। যে পর্য্যন্ত তীর না লাগে সে পর্য্যন্ত সকলেই তীর নিক্ষেপ করে। যদি কেহ তীর মেরে সফলকাম হয় তবে জগমাঁঝি এসে খাঁড়া দিয়ে চানমারির খুঁটী কেটে ফেলে। আর লক্ষ্যভেদকারীকে জগমাঁঝি কাঁধে করে সকলের নিকট নিয়ে আসে। মাঁঝি হ’তে আরম্ভ করে সকলে একে প্রণাম করে।

তারপর যুবকেরা নাচগান করে আমোদ করে। তারপর সকলে বাড়ী ফিরে আসে। জগমাঁঝি চানমারির খুঁটী কেটে কোন জন্তুর মত কাঁধে করে নিয়ে আসে। মাঁঝির বাড়ীতে সকলেই প্রবেশ করে। লোকে এই চানমারির খুঁটীকে “মাঁঝি-ডুণ্ডে” বলে। মাঁঝি সকলকে চিড়া, মুড়ি ও মদ খেতে দেয়। তারপর মাঁঝি বলে, “আপনারা সকলে আমার প্রজা। সয়তানকে বিনাশ করে আমাকে আপনারা বাঁচান অথবা আমাকে মেরে ফেলুন।” সেখান থিকে মদপান করে সকলে পারাণিকের বাড়ীতে আসে। সেখানেও চিড়ামুড়ী ও মদ খায়। এখান থেকে একজোট হ’য়ে “মরজিমত” এবাড়ী সেবাড়ী ঘুরে ঘুরে মদ খায়। যুবকযুবতীরা মিলে মাঁঝির বাড়ীতে “লাগরে” নাচ নাচে। নাচ শেষ করে যার যার বাড়ী ঘুমোতে চলে যায়।

মাঘমুরগী—মাঘমাসে খড় কাটবার নাম করে এই মুরগী উৎসর্গ করা হয়। বাড়ী বাড়ী মুরগী মেরে মদ সহ দেবতার নামে উৎসর্গ করে সকলে আমোদ প্রমোদ করে।

বাহা—(Flower festival) বাহা সাঁওতালদের দ্বিতীয় বড় পরব। ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমার ভাঙ্গাচান্দে এ পরব হয়ে থাকে। এ পরব বৎসরান্তে মাত্র একবার হয়। এই সময়ে ‘সারজম’ ও অন্যান্য গাছে ফুল হয় এবং মৌলগাছে ফল হয়। ‘বাহা’ একটা ধৰ্ম্ম-পরব; ‘সহরায়ের’ মত এতে কোন ব্যভিচার হয় না।

নির্দ্দিষ্ট দিনে গ্রামের যুবকেরা স্নানের সময় জাহেরে (অর্থাৎ গ্রাম্য—দেবতার পীঠস্থানে) কতকগুলি চালা তৈরী করে; একটি জাহের দেবীর জন্য, কতকগুলি পঞ্চদেবতা ও প্রধান দেবতার জন্য, আর একটি গোঁসাই ঠাকুরের জন্য। নায়ক সব ঠাকুরের “থানে” গোবরলেপ দিয়ে

স্নান করে চলে যায়। স্নান করে নায়ক ও যুবকেরা নায়কের গৃহে

চলে আসে। নায়ক তাদের মদ ও ভাত খেতে দেয়। খাওয়া দাওয়ার পর সকলে মিলে শিকারে বের হয়। নায়ক কুলা, ঝুড়ি, তীর ধনুক, খাড়া, ঝাটা, ঠাকুরের বয়লা, গলার মালা, শঙ্খ, ঘণ্ট। এই সকল জল থেকে ধুয়ে নিয়ে আসে। তারপর অস্ত্রশস্ত্রগুলিকে তেলমসল্লা মাখিয়ে দেয় এবং একটা নূতন মেটে হাড়িতে এবং এক বাণ্ডিল সুতায় তেল মাখান হয়। যুবকেরা যখন শিকার থেকে ফিরে আসে, তখন সন্ধ্যা হয়।

তারপর পেয়াদা তিনটি মুরগী এনে নায়ককে দেয়; এদের নায়কের মূরগী বলে। সন্ধ্যার সময় নায়কের গৃহে ঢাক বাজান হয় ও শঙ্খধ্বনি করা হয়। ইহা শুনে দেবতাদের আত্মা নেমে এসে যাঁর যাঁর থানে প্রতিষ্ঠিত হ’ন এবং গ্রামের লোকেও সব হাজির হয়। নায়ক দেবতাদের ধরবার জন্য বাইরে আসে। তিনজনের ভিতরে দেবতার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। একজন কেঁপে কেঁপে জাহের ঠাকুরাণী হয়ে আসেন, একজন পঞ্চদেবতা ও আর একজন প্রধান দেবতা। জাহের ঠাকুরাণী আস্তে আস্তে এসে মালা ও বালা পরিধান করে; ঝুড়িটা মাথায় নেয়, আর ঝাটাটাকে ধরে; পঞ্চদেবতা তীরধনুক ধরে; আর প্রধান দেবতা ‘কাপি’ (ঘোড়া) ঘাড়ে করে। এই রূপে সকলে জাহেরের দিকে চলে আসে; গ্রামের যুবকেরা পেছনে পেছনে অনুসরণ করে। জাহেরে উপস্থিত হ’য়ে জাহের ঠাকুরাণী আপনার আসনে প্রতিষ্ঠিত হন; অনন্ত দুজনেও আসন গ্রহণ করেন। তারপর সকলে বাড়ী ফিরে আসে।

পরে নায়ক জোর হাত করে সকল দেবতার কাছে প্রার্থনা করে। সকলে মিলে একটা পাটিতে বসে; বসে সকলে “আমাদের মঙ্গল কর” বলে একমুষ্টি চাল উৎসর্গ করে। তারপর মন্ত্র পড়া হয়; নায়ক ঠাকুরদের জিজ্ঞাসা করে, “ওগো, বৃষ্টিজল ও আগুন জল দেখাতে পার। তখন দেবতারা উত্তর করে, “এই মাত্র দেখতে পাবে, উত্তরদিকে চেয়ে থাক।”

তারপর নায়ক দেবতাদের সকলের পা ধোয়াইয়া দেয়। তারপর শঙ্খঘণ্টা, ঢাকঢোল বাজান হয়। নায়ক ভূত ছাড়িয়ে নেয় এবং সকলকে ভাত ও মদ খেতে দেয়। স্ত্রীপুরুষ সকলই একবাটি মদ ও ভাত খায়। গায়কেরা বেশীরভাগ পৃথক ভাত ও মদ পায়, তাদের আর বাড়ীতে খেতে হয় না। তারপর গায়কেরা নেচে নেচে গাইতে আরম্ভ করে।

এইরূপ নেচে গেয়ে রাত্রি ভোর হয়; খুব সুন্দর সুন্দর গান গাওয়া হয়। বাহার সময় লজ্জা সরমের কিছু নাই কেবল সুন্দর সুন্দর গান হয়। নায়ক স্ত্রীপুরুষ ন্যায়ধর্ম্মানুসারে সে রাত্রি মাটিতে ঘুমায়। এই প্রকারে দুতিনদিন সকলে মিলে উৎসব করে।

“আবগে বোঙ্গা”—এ পূজা বছর বছর হ’ত, কখনও অগ্রহায়ণ মাসে কখনও আষাঢ় মাসে। এখন আর এ পূজা হয় না। “আবগে বোঙ্গা” পূজায় সাঁওতালেরা কখনও মোরগ, কখনও শূকর, আর কখনও ভেড়া উৎসর্গ করত। “মারাং বুরু” সকলের দেবতা কিন্তু ‘আবগে বোঙ্গা’ প্রত্যেকের নিজস্ব। জ্বর জ্বালায়, দুঃখ-দুদিনে গৃহস্থমাত্রেই এ দেবতার পূজা দিয়ে থাকে। লোকে কথায় বলে “ডাইনি মাগী ‘আবগে বোঙ্গাকে’ হাত করতে পারলে পরিবারের লোক বাঁচান কষ্ট হয়; লোক মরে যায়।” সেজন্যে কায়কষ্টে সকলেই এদেবতার পূজা দিয়ে সন্তুষ্ট করে। বিপদের সময় এ দেবতার সম্মান করলে লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেঁচে যায়। এ পূজার সময় ভাইবোন ও নিকট আত্মীয়সম্পর্ক স্বজনকে নিয়ে সকলে খাওয়া দাওয়া করে। এতে মেয়েদের নিমন্ত্রণ হয় না। এপুজা মাঠে হয়, মন্ত্রাদি অন্যান্য পূজার মত।

সীমাবোঙ্গা—এর পূজাও বছর বছর হয়ে থাকে। এবড় শক্ত দেবতা। পূজায় কোন ত্রুটি হ’লে মারা পড়ে; মুহূর্তের মধ্যে সাপ, বাঘ জন্মায়, রোগ দেখা দেয়; এজন্য সাঁওতালেরা বিশেষ ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি এই দেবতার সেবা করে। রোপণের সময় আর কর্তনের সময় বছরে দুবার করে এদেবতার নামে মুরগী উৎসর্গ কর। হয়। এই পূজায় কোনরকম খাঙ্গ কিংবা সিন্দুরের প্রয়োজন হয় না। বিশেষ কোন ন্যায়াচারও নাই। মন্ত্রেও মাত্র দুএকটি কথাবলে থাকে, “ওগো, সীমা দেবতা, আমাদের ফসল ভাল হোক।” স্ত্রীলোক ছাড়া, সকলেই খাওয়া দাওয়া করে। কথায় বলে—পরিবারের সকলেই নিমন্ত্রণ খেলে, কিংবা বাড়ী থেকে বের হলে সীমাবোঙ্গা ঘরে ঢুকে ছেলেপেলেদের কবর তৈরি করে।

আজকালও বৎসর বৎসর আসল পরব ও বোঙ্গার পূজা ঘরে ঘরে হয়। অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তিতে “সাহারমুণ্ডা” নামক পরবে পিঠা পায়েস করে খায়, কিন্তু কোন পূজা নাই।

সাঁওতালেরা দিনে দিনে হিন্দুদের কাছ থেকে অনেক পরব গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে গ্রামের সকলেই একটা পরব করে থাকে, তার নাম “করম”। এই পরবে প্রস্ফূটিত কার্মুক ফুল, আতপ চাল, দুৰ্ব্বাঘাস, ও তেলসিন্দুর দিরে পূজা দেওয়া হয়; আর দুহাত কাপড় দিয়ে কমলাগাছের ডাল ঢেকে দেওয়া হয়। এরা হিন্দুদের কাছ থেকে আর একটি পরব গ্রহণ করেছে; সে কেবল যারা মানত করে তারাই পূজা করে; অন্যেরা এসে দেখে কিন্তু পূজা দেয় না। এই সকল লোকে দুর্গাপূজার সময় দুর্গাপূজা, কালীপূজার সময় কালীপূজা, ও মনসাপুজার সময় মনসাপূজা করে থাকে। ছাতাপরবে ছাতাপূজা, ও পাটাপরবে মহাদেবের পূজা, আর যাত্রাপরবে বংশীঠাকুরের পূজা হয়। আজকাল এদের ভিতর ঠাকুরপূজা নিয়ে বেশ গোলমাল বেঁধেছে। সাহেবদের মাত্র একদেবতা; এক ঠাকুরকে উপাসনা করলেই সকলের মঙ্গল হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *