“বাঁশের ঝুড়ি মাথায় করে বিবাহ” (গরীবের বিয়ে)
এটা গরীবদের বিবাহ। কনের বাড়ীতে বর যায়না; কেবল ঘটক ও বরপক্ষের পাঁচজন কনের বাড়ীতে চলে আসে। কোনও মণ্ডপ তৈরি হয় না; বরযাত্রীদের পৃথক বাসস্থানও দেওয়া হয় না। আচার ব্যবহার রীতিমত হয়ে থাকে; খাওয়া দাওয়া কিংবা হাঁড়ি পান একইরকম হয়ে থাকে। বরপক্ষ খেয়ে দেয়ে বৌকে বরের বাড়ীতে নিয়ে আসে। কন্যাপক্ষ হ’তে তিনটি ছেলে ও একজন মেয়েলোক কনের সঙ্গে আসে। ‘চাক-পুরাউনি’ কিংবা ‘চুল ছাড়ানি’ লাগে না। বরের ঘরেই সিন্দুর দান হয়; সেখানে রীতিমত নিয়ম রক্ষা হয়। বরকন্যার দ্বিরাগমন ও সাধারণতঃ হ’য়ে থাকে।
ঘরজামাই
যাদের পুত্রসন্তান নেই কিংবা অল্পসংখ্যক নিষ্কর্ম্মা পুত্র আছে তারা ‘সমত্ত’ মেয়ে থাকলে ঘরজামাই রাখবার চেষ্টা করে। কেবল গরীব কিংবা পিতৃমাতৃহীন অনাথ বালকেরাই ঘরজামাই হয়ে থাকে। ঘরজামাইদের পণ কিংবা খরচ বাবদ কোনও টাকা দিতে হয় না; সব মেয়ের দিক থেকে দেওয়া হয়। বিবাহ অন্যান্য বিবাহের মত; কিন্তু বিবাহের পূর্ব্বে কনের জন্য বরকে পাঁচবৎসর শ্বশুর বাড়ীতে মজুর খাটতে হয়; তখন কোন ভাতা পায় না, কেবল খোরাক পোষাক পেয়ে থাকে। ঘরজামাই রাখবার সময় একটা বাছুর দেখে রাখা হয়; পাঁচবৎসর না পেরুতে যদি মেয়ের সঙ্গে জামাইর বনিবনাও না হয় তবে জামাই কেবল বাছুরটি নিয়ে চলে যায়। বিবাহের সময় কনের পিতা কনেকে একটা বাছুর দিয়া থাকে। জামাই পাঁচবৎসর যে শস্যাদি অর্জ্জন করে তাহা সুদে খাটায়; পাঁচবৎসর পরে মনের মিল থাকলে স্বামীস্ত্রী সেখানে থেকে ভাতা পায়; অন্যথা দুজনে চলে আসে।
কন্যার মত পিতামাতার পুত্রসন্তান না থাকলে আর ঘরজামাই তাদের মৃত্যুপর্যন্ত দেখাশুনা ও খোরাক পোষাক দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ করলে তাদের ঘরবাড়ী, জমিজমা সব পায়; আর গোধনের অর্দ্ধেক পায়; বাকী অর্ধেক গরুবাছুর কন্যার পিতার ভাইরা অথবা জ্ঞাতিবর্গ পায়। ঘরজামাই শ্বশুর-শাশুড়ীর শ্রাদ্ধাদি কাজ ক’রে থাকে। দু তিনজন খরজামাই থাকলে সম্পত্তি ভাগ হয়ে থাকে।
“তালাকদেওয়া বিধবামেয়ের বিবাহ”
মৃতদার পুরুষদের উপর কেহ খুসী নয়; সেজন্য কোনও মেয়ে তাদের সঙ্গে বিবাহ বসতে চায়না। লোকে কথায় বলে, “রাঢ়ী পুরুষগুলি মুখভেঙচান বানরের মত;” “রাঢ়ী পুরুষগুলি ঝাঁটার মত কর্কশ; সাধ করে কে পাপ ঘাড়ে নেয়।”
“ছাড়োয়া” (separated from wife) পুরুষদের উপরও কেহ সন্তুষ্ট নয়। লোকে বলে, “ছাড়োয়া পুরুষ চাখা হাতা, কে জানে কয় দিন।”
বিধবা মেয়েদেরও দোষ দিয়ে থাকে। কথায় বলে, “রাঢ়ী মেয়ে ৰাজা ঘোড়া, হান্ হান্।” “ছাড়ই” (divorced by husband) মেয়েদেরও অশেষ দোষ; লোকে বলে, “ছাড়ই” কুড়ী (মেয়ে) ময়না পাখী, কেবল মাথার বাহার,” “ছাড়ই কুড়ী সবুজ বুলবুল, হাজার রকমে ডাকে,” “ছাড়ই কুড়ী তিঁতিরি পাখী, সকলকে ভুলিয়ে নেয়,” “ছাড়ই কুড়ী চড়কগাছ, একস্থানে ঠিক হ’য়ে থাকতে পারেনা।”
রাঢ়ী কিংবা ছাড়োয়ো পুরুষ কোন কুমারী মেয়ে বিয়ে করলে মেয়ের পিতামাতা পাঁচটাকা কিংম্বা সাতটাকা পণ পেয়ে থাকে; কিন্তু জামাই কিছু ফিরে পায় না। অবিবাহিত মেয়েদের বিয়ের মত এদেরও বিয়ে হয়।
পুরাকালে রাঢ়ী কিংবা ছাড়ই মেয়েরা অবিবাহিত কোন যুবককে রাখতে (অথবা বিয়ে করতে) পারত না; এখনও সেরূপ আইন নাই; কিন্তু কলিকালে, আইন না থাকা সত্ত্বেও দুএকজন এরূপ রেখে থাকে। রাঢ়ী মেয়েকে যে রাখে তাকে তার অর্দ্ধেক পণ দিতে হয়; আর জগমাঁঝি আটখানা মণ্ডলা পায়। মাঁঝি কিছুই পায়না। শাশুড়ীর কিংম্বা দিদিশাশুড়ীর জন্য কোন শাড়ী লাগে না; “চাড়ি,” স্নান অথবা দ্বিরাগমন পদ্ধতি কিছু নাই; এটা ঠিক বিবাহ নয়, একে সাধারণ কথায় “চার” (a system of hiring cattle for agriculture purpose) বলে। এ রকম বিবাহের নাম “সাঙ্গা”। জামাই বৌকে সিন্দুর দেয় না; একটু সিন্দুর বৌর কপালে ফুটিয়ে দেয়। এরূপ সাঙ্গা বিয়েতে কোন ভোজ দিতে হয় না; কেবল দুারিজনকে হাঁড়ি দেওয়া হয়।
যে সব কুমারী মেয়ের ছেলে হয় তাঁদিগকে “চুপি ছাড়ই” বলে থাকে। এদিকে কেহ রাখলে ‘ছাড়ই’ মেয়ের মত পণ দিতে হয়; কিন্তু এদের বিবাহ অন্যান্য কুমারী মেয়েদের মতই হয়ে থাকে।
ঘর-করণী
(‘Nir bolok’ baha a woman who instals herself in a man’s house as his wife.)
কোন গ্রামে কোন যুবক কোন যুবতির সঙ্গে প্রেমে পড়িলে যুবতী জগমাঁঝির নিকট এসে খুলে বলে। জগয়াঁঝি যুবকের সঙ্গে আলাপ করে তার বাপমাকে বলে। বাপমাও মাঁঝির নিকট দুএকদিন পরে বলে। সকলে বসে কথাবার্ত, বলে; তারা যুবক যুবতীকে বুঝিয়ে দেয়; তারা খুসী হয়ে রাজী হলে সকলে বিবাহের দিন স্থির করে নিজ নিজ ঘরে চলে যায়। গ্রামের পাঁচজন পাঁচশিকা ‘পঞ্চাতি’ পায়; বিবাহ অন্যান্য বিবাহের মত হয়ে থাকে।
কোন ছেলে কোন মেয়ের সঙ্গে একত্র বসবাস করে পরে তাকে না রাখতে চাইলে মেয়েটি জোর পূর্ব্বক তার ঘরে এসে বাসকরে। ছেলেটি রাজি হলে তাদের বিবাহ হয়; আর যদি সে রাজী না হয় তবে পাঁচজনের বিচারে তাকে মেয়েকে তিনটাকা দিতে হয়; পাচজনে ছেলে মেয়ের বাপকেও পাঁচসিকা জরিমানা করে। মেয়ে টাকা নিলে জগমাঁঝি তাকে তার বাপমার বাড়ীতে নিয়ে রেখে আসে।
ইপুতুত
(বেআইনি সিন্দুরদান)
পাঁচজনের অনুমতি ব্যতিরেকে যদি কোন যুবক জোরপূর্ব্বক কোন যুবতীর কপালে সিন্দুরের ফোটা দেয় তবে লোকে তাকে “ইপুতুত” বলে। ইহা দু প্রকার; কখনও কখনও মেয়ের সম্মতি নিয়ে সিন্দুর দেওয়া, আর কখনও তার সম্মতি ব্যতিরেকে “খামাখা” সিন্দুর দেওয়া। যদি মেয়ে ও ছেলে দুজনে রাজী হয়, কিন্তু মেয়ের বাপমা, বিবাহ দিতে অন্বীক্বত হয়, তবে ছেলেও মেয়ে দুজনে পরামর্শ করে ঠিক করে এবং ছেলে মেয়ের কপালে সিন্দুর দেয়। কোনও যুবক কোন মেয়েকে ‘খুব পছন্দ করলে, আর যদি সে সন্দেহ করে যে বাপমা বিবাহ দিতে রাজী -নাও হ’তে পারে অথবা মেয়েও রাজী না হতে পারে, তখন সে মেয়েকে কিছু না বলে হঠাৎ তাকে একদিন সিন্দুর পরিয়ে দেয়। কখনও কখনও মেয়েদের বদনাম রটাইবার জন্য অথবা তাদের পরিত্যক্তা কিংম্বা ‘ছাড়াই’ মেয়ে করবার জন্যে রাগ করে লোকেরা এরূপ করে থাকে। লোকে কথায় বলে যে কুমারী কন্যা বিবাহ করলে পরলোকে সুখ হয়; “রাঢ়া” কিংবা “ছাড়া” মেয়ে বিয়ে করলে সে সুখ হয় না। সেজন্য কখনও কখনও এরূপ হয় যে কারও প্রথমা স্ত্রী “রাঢ়ী” কিংবা “ছাড়ই” হলে সে পরলোকে স্ত্রী পাবার জন্য একজন কুমারী মেয়েকে বিবাহ করে কিংবা সিন্দুর দেয়। সে মেয়ে পরে থাকুক বা না থাকুক সেও পর—লোকের জন্য পথ পরিষ্কার করে রেখে দেয়।
কোন ছেলে কোন মেয়েকে সিন্দুর দিতে মনন করিলে সে একটা পাতায় সিন্দুর নিয়ে জলের ঘাটে কিংবা খোলা মাঠে চলে যায়, এবং হঠাৎ কোন মেয়ের কপালে সিন্দুর মাখিয়ে দেয়। সিন্দুর অভাবে মাটি কিংবা চূণও ব্যবহার হয়। পরবের সময় কিংবা কাঠপাতা আনবার সময়ও সিন্দুর দিয়ে থাকে। কোন মেয়েকে সিন্দুর দেওয়া হলে আইনতঃ সে সিন্দুর দেওয়া পুরুষটির স্ত্রী হয়; আর মেয়েটি সে পুরুষের নিকট না—থাকলে “ছাড়ই” হয়।
প্রতিহিংসা
কোনও যুবক কোনও যুবতীকে জোরপূর্বক সিন্দুর দিলে সে মেয়ের বাপভাইএর ভয়ে গ্রাম হ’তে পালিয়ে যায়। মেয়ের বাপ-ভাইয়েরা সিন্দুর দেওয়ার কথা অবগত হ’লে অত্যান্ত উত্তেজিত হয়, এবং গ্রামের লোকজন একত্র ক’রে তীর ধনুক ও খাঁড়া নিয়ে যুবকের ঘরে প্রতিহিংসা নিতে চলে আসে। প্রথমে তারা সে গ্রামের মাঁঝিকে সব কথা বলে; সে বলে, “ন্যায়মত যা ভাল মনে হয় করুন।” তারা যুবকের ঘরে ঢুকে জলের কলসী একটি একটি ক’রে ভেঙ্গে ফেলে, ভাত রাধার হাঁড়ি, চূলা প্রভৃতি সব ভেঙ্গে চুরমার করে; আর যুবককে পেলে তাকে বেন্ধে মারতে মারতে মরার মত ক’রে কেবলমাত্র জীবনটা রেখে উঠানের মাঝখানে শুইয়ে রাখে। তারপর তারা ছাগল—শিকারে চলে যায়; ছাগল পেলে খাঁড়া দিয়ে তাকে দুখণ্ড করে। আর শূকর পেলে তাকে তীরধনুক ছেড়ে মারে। তারপর তারা গাভীর পাল ধরে; ভাল ভাল তিন জোড়া গাভী কিংবা মহিষ নিয়ে তারা মাঁঝির বাড়ীতে আসে; ছাগলের টুকরা দুটিও সেখানে আনে।
বিচার ও দণ্ড
তারপর মাঁঝি গ্রামের পাঁচজনকে ডেকে পঞ্চাইতি ক’রে বিচার করে। প্রথমে কি প্রকারে ঘটনা হয়েছে তার তালাস হয়; দুএকজন লোক মেয়ের বাড়ীতে পাঠিয়ে খবর নেওয়া হয় যে মেয়ের সম্মতি কি অসম্মতিক্রমে কি জোর ক’রে তাকে সিন্দুর দেওয়া হয়েছে; একটি ছাগলও সেখান থেকে নিয়ে আসে। দুপক্ষের লোকে ছাগল দুটিকে মেরে খেয়ে ফেলে; অন্যান্য সব ‘মালটাল’ যুবকের পক্ষে মাঁঝি ও পাঁচজনে মেয়েরপক্ষের মাঁঝির নিকট জিম্বা রাখে—যে পর্যন্ত যুবকের পিতা জরিমানার টাকা না দেয়। যুবক যুবতিকে পাক কি না পাক মেয়ের বাপ ছটাক। পাবেই; আর যুবকের গ্রামের মাঁঝি যুবকের বাপের কাছ থিকে পাঁচটাকা জরিমানা আদায় করে; এ টাকাটাকে “মাথা বাঁচানো” টাকা বলে। আদিকালে কখনও কখনও সিন্দুর দেওয়ার অপরাধে যুবককে পিটিয়ে মেরে ফেলা হ’ত। মাঁঝি যুবককে বাঁচায় সে জন্য এ টাকাটা পায়; পাঁচটাকার ভিতরে দুটাকা সে গ্রামের লোকদের ভাগ করিয়া দেয়। প্রায়ই ছেলের সঙ্গে ‘ইপুতুত” মেয়ের বিবাহ হয়ে থাকে; কুমারী মেয়ের মতই তার বিবাহ হয়; এদের বিবাহ না হ’লে, মেয়েটি “ছাড়ই” বলে গণ্য হয়।
ছুটকি (দ্বিতীয় পক্ষের ভার্য্যা)
আদিকালে এক পরিবারেই লোক সন্তুষ্ট থাকিত; কারও দুই পরিবার ছিল না। আজকালও কেহ কামের উত্তেজনায় দুতিনটি স্ত্রী বিয়ে করলে লোকে তার প্রশংসা করে না; তবে এরূপ লোক খুব বিরল। কিন্তু কাহারও প্রথমপক্ষের স্ত্রীর সন্তান না হলে সে গ্রামের দুএকজনের সঙ্গে পরামর্শ করে একজন ‘ছুট্কি’বিবাহ করে। “বকি” (প্রথম পক্ষের স্ত্রী) তার বাপের বাড়ী চলে যায়। এরূপ লোকের বড়ভাই মৃত হ’লে সে প্রথমা স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও বড় বৌদিদিকে ‘সাঙ্গা’ বিয়ে করতে পারে; অনেক সময়ে ছেলে পেলেরা যেন অন্যত্র না যায়, সেজন্য এরূপ ‘সাঙ্গা’ হয়ে থাকে। এতে কোন দোষ নাই; কিন্তু ছোটভাই মরলে বড়ভাই তার স্ত্রীকে সাঙ্গা করতে পারেনা। ছোটভাইএর স্ত্রীকে বড়ভাই দেবতার মত ভক্তি করে; তার খাটিয়াও ছুইতে পারে না।
যারা দুইপরিবার গ্রহণ করে তারা পরে তার ফলভোগ করে থাকে; কেননা ছুটকি ও বট্কিতে মিল হয়না, এবং লোকে নানা কথা বলে থাকে।
“হিরম-বৈহা”
(প্রথমা ভার্য্যার পাওনা)
প্রথমা ভার্য্যার সন্তানাদি না হইলে অথবা কামোপভোগের জন্য পুরুষেরা দ্বিতীয়বার বিবাহ করে থাকে। কিন্তু “বট্কি” খুসী কিংবা রাজী না হলে সে ছুট্কিকে ঘরে ঢুকতে দেয়না, ছুট্কিকে দেখামাত্র দুয়ারে দাঁড়িয়েই তাকে মারতে সুরু করে। ইহারও নিয়ম আছে; ‘বটকি’ “হিরম বৈহা।” বাবদ পাঁচটা টাকা কিংবা একটা বাছুর পায়। এই টাকা পেলে তিনজনে পাঁচজনের সামনে একপংক্তিতে পূৰ্ব্বমুখী হ’য়ে বসে। প্রথমা স্ত্রী স্বামীর দক্ষিণ পার্শ্বে দুজনের মধ্যে বসে। তারপর স্বামী প্রথমা স্ত্রীকে সিন্দুর দেয়, আর অবশিষ্ট সিন্দুর একটা ডিম্ব ফুলে ক’রে বামহাতে ছুটকির মাথায় মাখিয়ে দেয়। বটকি তার বাপের ঘরে চলে যায়।
আপাঙ্গির (মেয়েচুরি—elopement)
যদি কোনও পুরুষ এবং কোনও মেয়ে একত্র বসবাস করবার জন্যে অন্যদেশে পালিয়ে যায় তবে তাকে ‘আপাঙ্গির’ বলে থাকে। সাধারণত: মেয়েটি সধবা কিংবা নিকট-সম্বন্ধীয় হলে (অর্থাৎ যাকে বিবাহ করা আইনতঃ অসঙ্গত) পুরুষটি সমাজে জাতিচ্যুত হবার ভয়ে তাকে বের করে নিয়ে পালিয়ে যায়।
পুরাকালে কেহ সধবা মেয়েকে বের করে নিলে সকলে তার খোঁজ নিয়ে কেটে ফেলত! অথবা কেহই তাদের কোন খোঁজ পেত না। আজ—কাল সকলে ডবল পণ আদায় করে এবং মেয়েটাকে জিম্মা রাখে; যে বের করে নেয় সে মাথা বাঁচাবার পণ স্বরূপ মাঁঝিকে পাঁচটাকা দেয়। যদি কেহ নিজের কোন আত্মীয়াকে বের করে নেয় তবে সে সমাজে বন্ধ হয়। যদি একজন আর একজনকে না ছেড়ে দেয় তবে দুজনই যাবজ্জীবন সমাজে বন্ধ থাকে; কেহই এদের সঙ্গে খাওয়া দাওয়া করেনা, কিম্বা এদের ছেলেপেলে ও ‘ঘাট’ পায়না। আর যদি ছাড়াছাড়ি হয়, তবে সমাজে উঠতে পারে, কিন্তু তাতে অনেক টাকা লাগে। যদি কেহ নিকট সম্পর্কীয় কোন মেয়েকে নিয়ে পালায়, তবে দুপক্ষের বাপমা ও আত্মীয়স্বজনের টাকা দিতে হয়। আর যদি তাহাদিগকে পরিবারের মধ্যে রাখা হয় তবে তারাও সমাজে বন্ধ হয়। গ্রামের পাঁচজনে তাদের জরিমানা করে, এবং তারা তাদের ছেলেমেয়েদের আমল দেয়না; এবং কখনও তাদের কেহ আনানেওয়া করেনা। মেয়ে ছিনিয়া নেওয়া আর মেয়ের সহিত পালিয়ে যাওয়া একই রকম অপরাধ। ভিন্ন জাতের সহিত পালিয়ে গেলে যাবজ্জীবন সমাজচ্যুত হয়, আর তাদের বাপমারও দণ্ড দিতে হয়।
“সাকাম অড়েজ” (পাতাছেড়া)
(তালাক)
পূর্ব্বে দুকারণে ‘তালাক’ হত—স্ত্রী পরপুরুষের সঙ্গে সহবাস করলে, অথবা ‘ডান’ হ’লে, কিন্তু আজকাল স্বামীস্ত্রীতে বনিবনাও না হইলেই ‘ছাড়াছাড়ি’ কিংবা তালাক হ’তে পারে। স্বামী দ্বিতীয়বার বিয়ে করলে প্রথমা স্ত্রী তালাক চাইতে পারে। স্ত্রী ডান হ’লে তাকে তালাক দিলে, অথবা তালাক না দিলেও, সে অন্যত্র সাঙ্গা করতে পারে। স্ত্রী অভিচারিণী হ’লে তাকে তালাক দেওয়া হয় পূর্ব্বেই বলা হয়েছে।
কারও স্ত্রী পাঁচজনের ঘাটে ‘ডান’ বলে সাব্যস্ত হ’লে সে গ্রামের পাঁচজনকে ডেকে এনে স্ত্রীকে ৰাপমার অথবা কেবল বাপের জিম্বা করে দেয়, এবং সন্তানাদি থাকলে তাদের নিজে রেখে দেয়। আর যদি স্তন্যপায়ী কোন শিশুসন্তান থাকে তবে তাকে বড় হবার পর নিয়ে আসে। এর কোন দণ্ড নাই; পাঁচজনে কেবল একটা ভোজ পায়। পরে কোন মেয়ের বিয়ে হ’লে সে বিয়ের সাড়ী পায়না।
আজকাল কেবল বনিবনাও না থাকা দরুণ যদি কেহ তালাক দেয়, তবে দোষী সাব্যস্ত হ’লে তাকে জরিমানা দিতে হয়। বিনাদোষে কোন স্বামী স্ত্রীকে ত্যাগ করলে পণের টাকা ফেরত পায়না, আর নিজেরও “ছাড়ান” টাকা লাগে। সন্তান পিতার কাছে থাকে; সে স্ত্রীকে একটা গাই, এক বস্তা ধান, একটা বাটী ও একখানা সাড়ী দিয়ে থাকে, আর যদি সে স্ত্রী কোন শিশু সন্তানকে লালনপালন করে বড় করে, তবে তাকে নেবার সময় মেয়েটি ১৬মণ ধান ও একখানা সাড়ী পায়। সন্তানের ব্যামোপীড়ায় কোন খরচ লেগে থাকলে তাও পেয়ে থাকে। মেয়ের দোষে যদি “ছাড়াছাড়ি” হয় তবে পুরুষ টাকা ফিরে পায়; কিন্তু মেয়ে কিছুই ফিরে পায় না। গ্রামের পাঁচজন দুপক্ষ হইতেই পাঁচসিকা পঞ্চাতি পেয়ে থাকে।
স্বামী দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহ করলে, ও প্রথমা স্ত্রী তালাক চাইলে স্বামী পণের টাকা ফিরে পায় না, আর তাকে প্রথমা স্ত্রীকে একটা গাই, এক বস্তা ধান, একখান। কাপড় ও একটা বাটি দিতে হয়।
তালাক দিবার প্রণালী এই প্রকার :—দুপক্ষের মাঁঝি ও পাঁচজন একত্রিত হয়; এক লোটা জল ছাড় করে রাখা হয়, এবং তার দুপাশে স্বামীস্ত্রীকে মুখোমুখী করে দাঁড় করান হয়। তখন বরপক্ষের মাঁঝি বলে “ওগো কন্যা, ঠাকুরের নামে ও পূর্বপুরুষদের নামে আমরা দেখতে পাই যে তোমাদের মধ্যে একদিনের জন্যও বনিবনাও হয় না; এখন আমাদের কোন দোষ নাই; তোমাদের মধ্যে মিল না থাকলে আমরা কি করব? এখন তোমরা নিজের মনে চিন্তা করে দেখ যে তোমরা ‘ছাড়াছাড়ি’ হবে কিনা।” ওগো ‘ফললা’ (স্বামী) যদি তুমি বাস্তবিক তালাক দিতে চাও তবে শিংঠাকুর, পাঁচ পর্বতঠাকুর ও পূর্ব্বপুরুষের দোহাই দিয়ে পাতা ছিড়ে ফেল, নতুবা তালাক হ’বে না।”
পরে বামপার উপরে তাদের দাঁড় করান হয়; পূর্ব্বদিকে জোড়হাত করে দাড়ায়, তিনটা শালপাত। আনা হয়; স্বামী গলবস্ত্র হ’য়ে সেই পাতা ধরে এবং উপর থিকে শিরা শিরা ছিড়ে ঠাকুরের নামে পাতা ছিড়ে ফেলে দেয়; তারপর ঘুরে জলের লোটাটাকে ডান পা দিয়ে লাথি মেরে ভেঙ্গে ফেলে; তারপর মাঁঝি থিকে আরম্ভ ক’রে সকলকে প্রণাম করে। মেয়েও সেইপ্রকার সকলকে প্রণাম করে।
পাতা ছিড়বার সময় যদি একসোজা দাঁড়িয়ে পাতা ছিড়ে, তবে লোকে বলে হয়ত সময়ে আবার মিলও হ’তে পারে; আর যদি লোটার জল নিঃশেষ হ’য়ে গড়িয়ে না পড়ে তবে লোকে বলে এখনও মায়া ছাড়তে পারে নাই, সম্ভবতঃ আবার মিল হবে।
বিটলাহা
(সমাজ চ্যুতি)
আদিম সাঁওতালেরা কেবলমাত্র দু অপরাধে লোককে সমাজচ্যুত করিত, যথা, ভিন্নজাতের সহিত কিংবা নিকটবর্তী আত্মীয়স্বজনের সহিত প্রসক্তি। কোনও ব্যক্তি এরূপ দোষ করলে তার গ্রামের মাঁঝি পার্শ্ববর্তী গ্রামের মাঁঝিদের সহিত পরামর্শ করে। তাহারা সকলে একমত হলে নিজ নিজ গ্রামের লোকদের বলে দেয়, “অমুক লোকের সহিত খাওয়া দাওয়া করিতে পারিবে না। অমুকের সহিত বিবাহ সম্বন্ধ স্থাপন করিতে পারিবে না যদি কর তবে তোমরাও এক আগুনে পুড়ে মরবে। কিন্তু কেবল এরা তাকে সমাজচ্যুত করতে পারে না; সে ক্ষমতা দেশের লোকের হাতে থাকে। দেশের লোক পোড়া জঙ্গলে প্রবেশ করে বৈঠক করে। সকল গ্রামের মাঁঝি পারাণিক, দেশমাঁঝি, ও অন্যান্য মুখ্য লোকেরা একমত না হলে, যে কথা রটিয়ে থাকে তাকে বিশেষরূপে সাজা দেয়। আর যদি তারা একমত হয় তবে এরূপ হুকুম জারি করে, “তোমরা সকলে শকরি পাতা” (দোষী লোক) ঠিক কর। তারপর দেশের যুবক গায়কের দল একত্র হয়ে গান গেয়ে সেই দোষী লোকের নাম ও দোষ ব্যক্ত করে গ্রামে গ্রামে ঢোল দিয়ে যায়। দেশের সমস্ত লোক বাঁশী বাজিয়ে ও ঢোল বাজিয়ে গ্রামের চৌমাথায় সমবেত হয়, এবং একখণ্ড পোড়াকান্ঠ ও একটা ভাঙ্গা ঝাঁটা দোষীর উঠানে পুতে দেয়। গ্রামের সকলে যে পর্য্যন্ত প্রায়শ্চিত্ত না করে সে পর্যন্ত অশুদ্ধ ও সমাজে বন্ধ থাকে, তারা দোষী লোকটাকে বিশেষ জ্বালাযন্ত্রনা দেয়। তাকে কেহ আগুন দিতে চায় না, অথবা তার পরিবারের কেহ একঘাট হইতে জল আনতে পারেনা। সে এরূপ নানা প্রকার শাস্তি ভোগ করে।
জমজাতি
(সমাজে পুনঃ-প্রবেশ)
সমাজচ্যুত কোন ব্যক্তি পুনরায় আত্মীয় স্বজনদের সহিত মিশতে চাইলে নানা প্রকার জোগাড় চেষ্টা করে। গ্রামের সকলকে ডেকে মাঁঝির কাছে তার ইচ্ছা ব্যক্ত করে; মাঁঝি পরগণাকে বলে; “পরগণা (সর্দার) দেশের আর বার জন পরগণাকে খবর দেয়। কোন নির্দিষ্ট দিনে সকলে গ্রামে সমবেত হয়; তারা বাহিরে বিশ্রাম করে; সমাজচ্যুত ব্যক্তি শূকর ও ছাগল মেরে প্রকাণ্ড এক ভোজ দেয়। তারপর সে একটা লোটাতে জল নিয়ে গ্রামের রাস্তার মোড়ে চলে আসে। সেখানে গলবস্ত্র হয়ে, লোটার জল দুহাতে তুলে জোড়হাত করে দাড়ায়; তখন তাঁহাকে নিতান্ত দুঃখী বেচারীর মত দেখায়। তারপর সকলের মুরুব্বি পুরগণা, ও মাঁঝি সকলকে বলে, “এবার একে রেহাই (মাপ) দেওয়া যাক, এ নিতান্তই দয়ার যোগ্য মনে হচ্ছে! তাকে সকলের কাছে আনা হয়; তখন সে সিংবোঙ্গাকে প্রণাম করে বলে, “এ বাবা, আমি অতি গর্হিত কাজ করেছি, আমি এবার মাপ চাই, আপনারা দয়া করুন।” তারপর প্রধান পরগণা তার হাতথেকে লোটার জল নিয়ে সিংরোঙ্গাকে প্রণাম করে বলে, “তুমি দোষ মাপ চাওয়ায় আমরা সকলে তোমার দোষ মাপ করলুম।” তারপর অল্প একটু জল দিয়ে মুখ ধুইয়ে সকলকে সে জল দেয়। “মুখ্যা মুখ্যা” যত লোক সেখানে থাকে সকলেই সে জলে সুখ ধুইয়ে থাকে।
তারপর সকলে গ্রামে প্রবেশ করে। নিজের উঠানে গিয়ে সে সকল মুখ্যার পা ধুইয়ে দেয়; তারপর সকলে পংক্তিতে পংক্তিতে খেতে বসে যায়; সে ভাতের হাঁড়ি নিয়ে আসে; জলের পাত্র ও ব্যঞ্জনাদিও নিয়ে আসে। আর প্রত্যেক ‘পরগণা’ বাবদ পাঁচ পাঁচ টাকা, আর প্রত্যেক মাঁঝিবাবদ এক এক টাকা, পাত্রে রাখে ভাণ্ডে রেখে দেয়; আর গ্রামের মাঁঝির জন্যও পাঁচ টাকা রেখে দেয়।
তারপর সকলে খাওয়া-দাওয়া করে। খাওয়া-দাওয়ার পর দেশের পরগণা ও মাঁঝিরা তাকে সমাজে গ্রহণ করে, এবং তাকে সমাজের সমস্ত অধিকার ফিরিয়ে দেয়! সেদিন থেকে সে সমাজভুক্ত হয়; সকলের সঙ্গে একত্র খাওয়া-দাওয়া এবং বিবাহসম্বন্ধাদি স্থাপন করিতে পারে। তারপর প্রণামাদি ক’রে যে যার ঘরে চলে যায়।