আমোদ-প্রমোদ
চিন্তা ভাবনা দূর করবার জন্য নানাপ্রকার আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা ছিল, যেমন নাচ গান, ঢাক-ঢোল বাজান, বাঁশী বাজান, গল্পগুজব, হেঁয়ালি, শিকার, মাছধরা, আর হাঁড়িপান। হেঁয়ালি কথায়ও আমোদ হয় বটে, তবে সেটা লোকের শিক্ষার জন্য, বেশীর ভাগ কাজের সঙ্গে সঙ্গে ইহা বলা হয়।
(১) নাচ-গান
সাঁওতালদের ভিতরে অনেকরকম নাচ প্রচলিত আছে, এবং তার সঙ্গে গানও আছে। নাচ-গানের সঙ্গে ঢাক-ঢোল ও বাঁশী প্রভৃতি বাজানো হয়। এদের নাচ-গানের নাম এরূপ : –’লাগ্রে’, ‘ডং’, ‘গুলাউরি’, ‘ডাহার’, ‘বাহা’ ‘রিনজা’, ‘ঝিকা’, ‘হুম্তি’, ‘টাইনি’, ‘গুণজার’, ‘সহরায়’, ‘লতয়’ আর ‘ডুঙ্গার’ (১)। গান ছাড়া নাচ, – ‘পাকদন’ নাচ, ‘ডম নাচ’, আর লাউরিয়া নাচ। আর নাচ ছাড়া গান—বন-সঙ্গীত, বিবাহ-সঙ্গীত, গল্প-সঙ্গীত, চাষ-সঙ্গীত, আর মৃত্যু-সঙ্গীত। শোভার জন্য পৰ্ব্ব-পার্ব্বণ এবং শিকারের সময় গান ছাড়াও শাক বাজান হয়। সকল গানের সঙ্গে বেহালা থাকে। ফাফা বাঁশ থেকে বাঁশী তৈরি হয়; এ বাঁশের নাম দু-লঙ্গা বাঁশ; মহিষের শিং কিংবা হরিণের শিং থেকে ‘শাকোরা’ বানান হয়; বেহালা কাঠ দ্বারা তৈরি হয়; এতে তাঁতের হতো একটা করে দিয়ে ঘোড়ার চুল দিয়ে বাধে। তারপর রজনি গাছের আঠা দিয়ে লাগিয়ে দেয়, তাতেই সুর বেজে উঠে। লোহা দিয়ে খোল ক’রে নাগরা তৈরি করে, আর মহিষের চামড়া দিয়ে মুখ বন্ধ করে। মাটি দিয়ে ও ছাগলের চামড়া দিয়ে অনেক সময় নাগরা তৈরি হয়। লাগ্রে, গুলাউরি ও হুমতি নাচ সৰ্ব্বদাই হ’য়ে থাকে। ‘বাহা’ নাচ কেবল বাহা পরবের সময় হয়; ‘সহ রায়’, ‘মাটোয়ার’ আর ‘গুণজার’নাচ কার্ত্তিক মাসে সহরায় পরবের সময় হয়; ‘রিন্জ। আর ‘ডিনসার’ নাচ কারাম পরবের সময় হয়; ‘ডন’ নাচ বিবাহ আর ‘ছাতিখারের সময় হয়। ‘ডাহার’ নাচ যুবতী মেয়েরা গ্রীষ্মের দিনে নাচে; ‘ঝিকা’ নাচ ‘ছাতিখারের’ সময় হয়; ‘ডমনাচ’ বিবাহের সময়। ‘পাকডন’ আর লাউরিয়া নাচ সহ রায়-পরবে পুরুষেরা নাচে; ‘লবয়’ নাচ আশ্বিনমাসে দারাই-পরবের সময় হয়; আর ‘ডুনগের’ নাচ শিকারের সময় হয়। চাষের গান ধান রুইবার সময় গাওয়া হয়। কিন্তু এতে নাচ নাই। হেঁয়ালি গান গরমের দিনে সন্ধ্যার সময় ব’সে গাওয়া হয় ব’সে; আর ছেলে-মেয়েরা বন-সঙ্গীত ঝোপের ভিতর গেয়ে থাকে। শ্রাদ্ধের সময় মৃত্যু-সঙ্গীত গাওয়া হয়; একে শোক-সঙ্গীতও বলে।
[(১) লাগ্রে —Common dance of all.
ডং-Marriage-dance.
ডাহার — Sequel to the Lage dance.
সহরায়—Harvest festival dance.
বাহা —Flower festival dance.
ডুঙ্গার—Dance during hunt by men only.
টাইনি —Walking stick dance.
পাকদন—The sword & shield dance.]
‘পাকডন’, ‘ডাহার’ ও ‘লাউড়িয়া’ নাচ ছাড়া আর সকল নাচেই স্ত্রী—পুরুষ একত্র হ’য়ে নাচে। নাচের সময় মেয়েরা হাতে হাতে ধরে, আর ছেলেরা তাদের সামনে মুখোমুখী হ’য়ে নাচে। কোন কোন বালক নাগরা বাজাতে বাজাতে সঙ্গে সঙ্গে নাচে; কেহ কেহ ঢোল কিংবা বাঁশী বাজাবার সময়ও নেচে থাকে; আবার কোন কোন ছেলে কেবল নাচে আর মেয়েদের সঙ্গে গানও করে। ছেলেমেয়েরা একত্র নাচগান ক’রে খুব খুসী হয়; দিনের বেলা কাজকর্ম্ম করে এবং রাত্রে মিলেমিশে নাচগান করে ভ্রান্তি অপনোদন করে বিমল আনন্দ উপভোগ করে। বুড়োবুড়ীরা ছেলেমেয়েদের নাচগানে কোন আপত্তি করে না, বরং দেখে দেখে চলে যায়; পরে যখন তারা ঘুমিয়ে পড়ে তখন বলে, “এখন ছেড়ে দাও, নতুবা কাল কাজের সময় ঘুমিয়ে পড়বে”; ছেলেমেয়েরা তখন বলে থাকে, “এখনও ছাড়ব না, যে পর্য্যন্ত ক্লান্ত না হব সে পর্য্যন্ত চলবে”। নাচের সময় জগমাঁঝিও থাকে না; শেষ পর্যন্ত কেবল ছেলেমেয়েরাই থাকে। মোরগের ডাক পর্যন্ত নাচে, পরে অল্প একটু ঘুম যায়। বুড়োবুড়ীরা বেশী নাচ-গান করে না; তবে সমরে সময়ে এক ঘণ্টার জন্য করে থাকে। কিন্তু এরা ছাতিয়ার পরবে, বাহাপরবে, আর কারাম পরবের সময় নেচে থাকে; যারা ‘ঝিকা’ নাচ জানে তারা সেই নাচই নাচে এবং সঙ্গে সঙ্গে গান গায়।
(২) হাঁড়ি-পান
“হাঁড়ি” (পচাই মদ) সাঁওতালদের ‘আসল’ আমোদের জিনিষ। যখন তারা অর্দ্ধেক মাতাল হয় তখন তারা হাজার রকম কথা বলে থাকে। যেমন, রাজ-মহাজন সম্বন্ধীয়, নাচ সম্বন্ধীয়, গানসম্বন্ধীয়, ইত্যাদি, খুব হাসাহাসি করে, আমোদ প্রমোদ করে এবং বেশ ‘ধুত’ মনে করে। তারপর মদে টং হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে; তখন স্ফূর্ত্তির চূড়ান্ত হয়। বুড়ীগুলিও বেশ মদ খায়। প্রাচীনকালে বুড়ীরা বেশী মদ খেত না এবং ছেলেমেয়েরা একেবারেই খেত না। আজকাল লজ্জাসরম ছেড়ে সকলেই মদ খায়। আগে খোরাতে করে মদ খেত, বাটীতে কেহ খেত না। আজকাল বাটীকে বাটী মদ খেয়ে শেষ করে তবু তৃপ্তি হয় না। আগে শুঁড়িরা হাঁড়ি’মদ খেত না কেবল ‘লাউরিয়। -মদ খেত। আজকাল অনেক সাঁওতাল-শুঁড়ি হাঁড়িমদ খেয়ে খেয়ে সৰ্ব্বস্বান্ত হয়েছে। পয়সা না থাকলে ঘর থেকে ধান চাল নিয়ে আসে; বাড়ীতে তখন কিছু খাবারও থাকে না; আবার বাড়ী এসে ভাত তৈরি না পেলে পরিবারকে গালিগালাজ করে এবং উত্তম-মধ্যম মারপিটও করে। স্ত্রী বেচারী আর ভাত কোথায় পাবে? ধান চাল না থাকলে ধার করে ও মদ খায়; তারপর মাঘমাসে শুঁড়ি এসে জোরজুলুম করে ঘরের তৈজসপত্র গাড়ীতে বয়ে নিয়ে যায় এসব লোকের পরিবারও ছেলেপেলেরা খাওয়। পরায় বিশেষ কষ্টে দিনপাত করে, জঙ্গল থেকে শাকপাতা তুলে এনে খায়। আগে লোকে চার, ছয় অথবা বড়জোর আট খোরা মদ খেত; তাতে শক্তির বিশেষ অপচয় হত না সকলেই বেশ জোয়ান ছিল। আজকাল ‘ মদ খেতে খেতে পূর্ণবয়স্ক হ’বার পূর্ব্বেই বিয়ে করে বেটে হয়ে যায়; এরূপ চাল চলনে কি আর শক্তি থাকে?
(৩) “গল্প-গুজব ও হেঁয়ালি”
সাঁওতালেরা খোসগল্প ক’রে ও হেঁয়ালি কথা ব’লে অত্যন্ত আনন্দবোধ করে। সন্ধ্যাবেলা বুড়োরা এসব শিখিয়ে থাকে। গিন্নী ও বৌরা সন্ধ্যাবেলা ভাতব্যঞ্জন রান্নার কাজ করে। আর বুড়োবুড়ীতে দুজনে ছেলেদের নিয়ে গল্পগুজব ক’রে আমোদ প্রমোদ করে। যে গল্পগুজব বেশী জানে গ্রামের সব ছেলেপেলে তার কাছে এসে হাজির হয়। গ্রীষ্মের দিনে ছেলেরা উঠানে একচালার নীচে শুয়ে রাত কাটায়। এতে ছেলেদের বেশ শিক্ষা হয়। অনেকে এত গল্প জানে যে তাদের গল্প কিছুতেই ফুরায় না, খাওয়া দাওয়া নাচগান সব ভুলে যায়, কেবল গল্পের আমোদে মোহিত হয়। ছেলেরা ও মেয়েরা উভয়েই হেঁয়ালি শিখে এবং দিনরাত সে সব নিয়ে পরস্পর জিজ্ঞাসাবাদ করে। ছেলেরা বেশীর ভাগ গল্পগুজব শিখে; মেয়েরা শিখলেও বুড়ী না হওয়া পর্যন্ত সাহস ক’রে লোকের সামনে খোসগল্প করতে পারে না। শিয়ালসম্বন্ধেই বেশী কাহিনী প্রচলিত; রাজরাজ রাদের সম্বন্ধেও অনেক গল্প আছে। আর হেঁয়ালি আছে হাজার রকমের। হেঁয়ালি আরম্ভ হইবার সময় প্রশ্ন হয় “এ কি বল দেখি?” তারপর তার উত্তর হয়।
(৪) ছদ্মবেশী-বহুরূপী
সাঁওতালের ভিতর একপ্রকার আমোদ আছে, তার নাম ছদ্মবেশী অথবা বহুরূপী নাচ। কেবল রসিক পুরুষেরাই এ নাচ নাচতে পারে। ইহা দেখ লে সকলেই হেসে থাকে। এইরূপ নাচে মানুষের নানারকম দোষ প্রদর্শিত হয়। যেমন দাম্পত্য-কলহ,—বরকন্যার শ্বশুরগৃহে গমন, বিধবার কান্না, পাদ প্রদর্শন, নাচ, ভাতভক্ষণ, কাজকর্ম্ম, বুড়োবুড়ী ইত্যাদি। মেয়েলোকের সাজ পরে, মেয়েদের মত কাপড় পরে মেয়েলি সুরে কথা কয়। আর লোকের হাসতে হাসতে পেট ফাঁটে।
(৫) মাছ ধরা
মাছধরাও একটা আমোদবিশেষ। পুকুরে, ডোবায়, ও গাঁড়ায় মাছধরা হয়। যে গ্রামের সীমায় মাছধরবার জায়গা আছে সেই গ্রামের মাঁঝিকে খবর দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট দিনে দুপুরবেলা সকলে চারদিক ঘিরে মাছ ধরে। বাধাবিপত্তি সামনে পড়লে “ঠাকুরের” পূজা দেয়; তারপর জাল দিয়ে মাছ ধরে; অনেকে হাত দিয়েও মাছ ধরে। খুব সোরগোল হয় এবং বেশ আমেদি হয়। মাছধরা শেষ হ’লে জালপিছে ছোট ছোট মাছ “তোলানি” করা হয়, আর বড় মাছ কেটে ভাগ করা হয়; তারপর জালপিছে বড়মাছের অর্দ্ধেক ‘তোলানি’ উঠায়; পরে গ্রামের সকলকেই মাছের ভাগ দেয়। তিনভাগ করা হয়; একভাগ পুকুরের কিংবা ডোবার মালিককে দেওয়া হয়; আর দুভাগ গ্রামের লোক ভাগ করে নেয়। গাঁড়ার মাছ হ’লে সীমানার মাঁঝি একভাগ পায়; আর দোসীমানায় হ’লে দুদিকের মাঁঝির সমান সমান একভাগ অর্দ্ধেক ক’রে পার; আর অবশিষ্ট দুভাগ দুগ্রামের পাঁচজনে ভাগাভাগি করে নেয়।
(৬) শিকার
সাঁওতালদের মধ্যে সব চেয়ে শ্রেঃ আমোদ শিকার। অতি প্রাচীনকাল থেকে শিকার চলে এসেছে; যতরকম আপদবিপদ হৌক না কেন, সাঁওতালেরা শিকারে যেতে কখনও দ্বিধা করে না; যদি কেহ যেতে আপত্তি করে তবে তাকে লোকে মেয়েমানুষ বলে ঠাট্টা করে। প্রাচীন সাঁওতালেরা খুব সাহসী ছিল; তারা বাঘভাল্লুকের সহিত লড়াই করত; কখনও বাঘভাল্লুকেরা জিতত কখনও সাঁওতালেরা জিত্ত।
দেশময় শিকার
প্রাচীনকালে শিকারের সংবাদ পাঠাবার জন্য সজনে গাছের ডালা গ্রাম হ’তে গ্রামান্তরে পাঠান হ’ত। গ্রামে গ্রামে যেরূপ নায়ক কিংবা কুডাম-নায়ক থাকে তেমন প্রত্যেক শিকারে একজন ডিহরি (Superintendent of annual hunt সাম্বাত্সরিক শিকারের অধ্যক্ষ) থাকে। প্রত্যেক দেশের জন্য একজন ‘ডিহরি’ নিযুক্ত হয়; ইনিই সমস্ত গ্রামে গ্রামে ডাল পাঠিয়ে শিকারের সংবাদ জানান; তখন দেশের লোকে জিজ্ঞাসা করে, “কিসের খবর, বাবা?” তারপর বনের নাম করা হয় এবং বলা হয় যে অমুক বনে, অমুক দিন, অমুক জায়গায় এসে সকলে বৈঠক করবে। বিশ্রামের জায়গাও ঠিক করা হয়। গৃহে ফিরে এলে সকলে জল্পনা করে, “ওহে অমুক দিন অমুক জঙ্গলে অথবা পাহাড়ে শিকারে যেতে হবে।” তারপর গ্রামের সকলে মিলে অস্ত্রশস্ত্র একত্র করে, তীরধনুক জুড়ে, খাঁড়া ধাঁর দেয়, লাঠিতে “বল্লম” জুড়ে, আর তরবারি ঘসে ঘসে “জ্বল জ্বল” করে নেয়। মেয়েরা মৌলফল দিয়ে খাবার জিনিষ তৈরি করে এবং ধান ভেনে চাল ক’রে দেয়। মাঁঝি পাঁচ পাই চাল এবং একপাতা মৌল দেয়; পাঁচজনে মিলে তাই খায়; গরীব-গরবা না থাকলে এতেই চলে যায়। নায়ক শিকারের নামে পাঁচটা মুরগী উৎসর্গ করে।
যাত্রা
নির্দ্ধারিত দিনে গ্রামের দু একজন অতি প্রত্যুষে সমতল ভূমিতে এসে সকলকে ডেকে একত্রিত করে। তারা ঢাক-ঢোল, নাগরা, শাকোয়া প্রভৃতি নিয়ে আসে। যে পর্য্যন্ত গ্রামের সকলে উপস্থিত না হয় সে পর্যন্ত “ডুবু ডুবু” করে নাগরা পিটান হয়, “শরং শরং” করে বাঁশী বাজান হয়, “তুতু তুতু” করে শাকোয়া বাজান হয়। আর বেশ মিষ্টি স্বরে বনগীত গেয়ে থাকে। তারপর সকলে একত্রিত হ’লে চীৎকার করে বলা হয় এবং সকলে সভাস্থলে চলে যায়। সেখানে সকলে দুপুর বেলা ভাত খায়। এক একজন ক’রে দেশের সব লোক সেখানে সমবেত হয়; “ডিহরি” ভোর থেকেই সেখানে উপস্থিত থাকে।
“ডিহরি”
দেশের লোক সব উপস্থিত হ’লে ‘ডিহরি’ ভালমন্দ গণবার জন্য খড়ি পাতে। যে দিকে খারাপ দেখতে পায় সে দিকের লোকদের তলব দিয়ে জিজ্ঞাসা করে “অমুকদিগের কোন্ কোন্ লোক এসেছ?” তখন একে একে সকলে গ্রামের নাম বলে; সেই গ্রামের লোকেরা তেল দিয়ে ঠাকুরের পূজা করে। যদি এরূপ বুঝা যায় যে কোন গ্রামের লোককে বাঘে খাবে, তবে তাদের সাবধান ক’রে বলা হয়—”খুব সাবধান হয়ে চল, নতুবা ফিরে যাও।” তারা জবাব দেয়, “না বাবা, আমরা বেশ ঠিক আছি।” তারপর “ডিহরি” যাদের বাঘে খাবে তাদের বেছে বাহির করে। উহাদের নামে এক একটা মুরগী উৎসর্গ ক’রে মন্ত্র পড়ে, “ওগো ঠাকুর, তোমায় প্রণাম; তুমি চারদিক ব্যাপে আছ, তুমি আর্ত্তের রক্ষা কর।“
পরে ‘ডিহরি’ পাঁচটা মুরগী উৎসর্গ ক’রে পূজা দেয়,—একটা মুরগী ‘ডিহরি’-দেবতার উদ্দেশ্যে, আর চারটা বনদেবীর নামে উৎসর্গিত হয়। তারপর পাটিপেতে রক্ত ও চাল মিশায় এবং সে চালও বনদেবতার নামে উৎসর্গ করা হয়। তারপর মুরগীর মাংস দিয়ে সুরুয়া পোলাও রান্না হয়। যে গ্রামের মুরগী সেই গ্রামের লোকের ‘সুরুয়ার’ অংশ পায়। তারপর যেখানে যেখানে বিপদের সম্ভাবনা, সে সব জায়গায় মুরগী বধ করে পূজা দেওয়া হয়; তারপর খাওয়া দাওয়া করে।
জঙ্গলে প্রবেশ
পূজা শেষ করে খাওয়া দাওয়া করে ডিহরিকে চালক করে সকলে একসঙ্গে জঙ্গলের ভিতর প্রবেশ করে। অনেকে নাগরা না বাজায়ে আস্তে আস্তে এসে জঙ্গলের প্রান্তভাগে লুকিয়ে থাকে; আর কেহ কেহ ধীরে ধীরে শিকার করতে করতে জঙ্গলের শেষ পর্যন্ত চলে যায়। দেশের লোক শ্ৰেণী ভাগ হ’য়ে দুইদিক দিয়ে জঙ্গলে প্রবেশ ক’রে শিকার কর’তে সুরু করে; সঙ্গে একটা বড় নাগরা রাখে। ডুবু ডুবু করে নাগরা বাজান হয়, আর শিকারীরা সাবধানে চারদিকে নজর রেখে চলে। খরগোস, ময়ূর কিংবা অন্য কোন পাখী কিংবা কোন বড় জন্তু শিকার করলে দেশের লোক মাংস কেটে ভাগ করে নেয়।
যদি কেহ কোন হরিণ শরবিদ্ধ করে তবে সে একা সেই হরিণের পাঞ্জা অনুসরণ করতে থাকে; যে পর্য্যন্ত হরিণ না পড়ে সে পৰ্য্যস্ত তার অনুসরণ করে। হরিণ পড়ে গেলে সকলে তার ঘাড় ও গলা কেটে ফিরে আসে। যদি কেহ এক্লা কোন জন্তু বাণবিদ্ধ করে এবং সেটাকে অন্য কোন শিকারী মেরে ফেলে তবে শেষোক্ত শিকারী ঘাড়ের অর্দ্ধেকটা পায়, আর প্রথমোক্ত শিকারী মাংস পায়। দেশের লোকেও মাংসের ভাগ পেয়ে থাকে।
বাঘ কিংবা ভাল্লুক মানুষ দেখ, বামাত্র গর্জন করে ওঠে। কাকে ও বাঘে কামড়ালে তার নিকটস্থ লোক তিনবার ভেরী বাজায়ে সকলকে সংবাদ দেয়; পরে দেশের লোক দক্ষিণ দিকে নজর রাখে ও বলে “এদিকে যাওয়া নিষেধ”। আহত লোকটার ক্ষতে ঔষধ লাগান হয় এবং পরে সকলে মিলে শিকারে বাহির হয়। সময় সময় ভল্লুক পেলে তীর না ছুড়ে লাঠি-ঠেঙ্গা দিয়ে তাকে নিপাত করে; কখনও ভল্লুক মরে যায়, কখনও ছুটে ছুটে জনতার মধ্যে প্রবেশ করে দৌড়িয়ে যায়। অনেক সময় ভল্লুক মারতে লাঠি ভেঙ্গে যায়। বাঘে কোন লোককে ধরলে তার আত্মীয়-স্বজন প্রাণপণে তার জন্য লড়াই করে। হয় লোকটাকে ছাড়িয়ে আনে অথবা তার জন্য সকলে প্রাণবিসর্জ্জন দেয়। আজকাল লোক ভীরু হয়েছে, বাঘের ডাক শুনামাত্র দৌড়িয়ে পালায়।
বিশ্রাম ও নিদ্রা
সন্ধ্যাবেলা সকলে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসে। সকলে সমবেত হয়ে নিজ নিজ গ্রামের লোক মিলে মৌলের লাড্ডু সংগ্রহ ক’রে একত্র করে, এবং সকলে ভাগ করে খায়। এ বিষয়ে একটা গল্প আছে। কথায় বলে, পুরাকালে একটি গরীবলোক অন্য কিছু খাবার না পেয়ে একটা ডুমুরের লাড্ডু, সঙ্গে এনেছিল। বিশ্রাম স্থলে সকলে তা দেখে ওকে বলেছিল, “কি এনেছ! এবার যা এনেছ তাই খাও।” বেচারা ঐ খেয়েই সেদিন রইল। দ্বিতীয় দিনে সে একটা নীল গাই (হরিণ) তীর দিয়ে শিকার করে; গ্রামের নামে ডাক্ না ছেড়ে সে ডুমুরের নামে ডাক ছাড়ল; হরিণ পড়ে গেল। গ্রামের লোক এসে বল্ল, “এ আমাদের হরিণ, অমুকে মেরেছে।” দেশের লোক গরীব লোকটাকে জিজ্ঞাসা করলে “তুমি এরকম ডাক কেন দিলে?” তখন সে অত্যন্ত দুঃখ করে দেশের লোকদের বলে, “গতকল্য সন্ধ্যাবেলা লাড্ডু, ভাগ করে খেয়েছে, আমাকে দেয় নাই।” এ কথা শুনে দেশের লোক উহাদিগকে বিশেষ ভর্ৎসনা করল এবং তাদিগকে তার গোলাম করলে। তারপর দেশের লোককে জরিমানা দিয়ে নিস্তার পেল। সেদিন থেকে সাঁওতালেরা আর এরূপ করে না।
শিকার-বৈঠক
লাড্ডু খেয়ে ভাত তরকারী খায়। ডেরার আলোতে সমস্ত বন আলোকিত হয়। এত লোক সমাগম হয়—কেহ রান্না করে ভাত খায়, কেহ বা খরগোস কিংবা ময়ূরের মাংস পুড়ে ঝোল রান্না করে খায়। হরিণের মাংস ‘আনাম’ থাকে। সান্ধ্য ভোজন শেষ হ’লে ডিহরি সকলকে বৈঠকে ডাকায়। প্রত্যেক গ্রামের পাঁচ ছয়জন করে বৈঠকে হাজির হয়; কেহ বাঁশী বাজায়, কেহ বনগীত গায়, আর কেহ নেচে গেয়ে বেশ স্ফূর্ত্তি করে, কেহ বা ঘুমিয়ে পড়ে। ডিহরির গ্রামের ছোকরারা আড্ডামহলে বাড়ী বাড়ী ঘুরে প্রত্যেক গৃহস্থের কাছ থেকে একবাটি করে চাল আদায় করে; এরা নানারকম হাসিঠাট্ট। করে বেড়ায় এবং সকলে হেসে কুটপাট হয়।
ডিহরি শিকার বৈঠকে মাঁঝি এবং দেশের সমস্ত লোক তার রায়ত যেখানে বৈঠক সেখানে এসে সকলে সম্মিলিত হয়ে চন্দ্রমণ্ডলের মত চারিদিক ঘিরে বসে। দেশের যারা প্রধান তারাও সেখানে বসে। পরে ডিহরি সকলকে জিজ্ঞাসা করে, “ওহে দেশবাসী বন্ধুগণ, তোমাদের মধ্যে কোন দুঃখ-সুখ ঝগড়াবিবাদ থাকলে বল? তোমরা সকলে কুশলে আছ ত?” দেশবাসী সকলে তখন উত্তর করে, “ আপনাদের আশীর্ব্বাদে আমাদের সকলের মঙ্গল।” ডিহরি বলে “ঠাকুরের আশীর্বাদে তোমাদের সকলের মঙ্গল হোক!“
তারপর ডিহরির নিকট সকলে একে একে নালিশ উপস্থিত করে। একজন বলে “অমুক গ্রামের সাথে আমাদের খরগোস নিয়ে বিবাদ হয়েছে।” ডিহরি জিজ্ঞাসা করে, “কি রকম?” সে বলে আমি লাঠি দিয়ে মেরেছিলাম।” আর একজনে বলে “আমার কুকুরে তাড়া করে ধরেছিল।” ডিহরি দুজনকে জিজ্ঞাসা করে, “আচ্ছা তোমাদের সাক্ষী-প্রমাণ আছে?” এরা জবাব দেয়, “হাঁ, অমুক অমুক গ্রামে, আমাদের সাক্ষী আছে।” তারপর ডিহরি সাক্ষ্য নেয়; দুপক্ষের লোকদিগকে ডেকে জিজ্ঞাসা করে। পরে বিচারে প্রমাণ যার হয় সেই পায়। দেশের লোক বিচারে ডিহরির সাহায্য করে, কিন্তু হুকুমটা ডিহরি দেয়। যদি সাক্ষ্য প্রমাণ না থাকে অথব। যদি সাক্ষীবা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়, তবে ডিহরি পর দিবস ভোরে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে দুজন থেকে দুটি তীর চেয়ে নেয়। তীর দুটাতে সিন্দুর লাগিয়ে ও লোটার জল দিয়ে দাঁড় করা’য়ে বলে, “এ বাবা ব্যোমদেব, আপনার দোহাইতে আমরা বিচার করি; আমরা ঠিক পাই না; তুমি ঠাকুরবাবা আকাশ জুড়ে আছ, আমরা মর্ত্যে বসে বিচার করি। আমাদের এর বিচার না হলে দেশবাসী সকলেই ক্ষুণ্ণ হবে; এ দুজনের ভিতর কে ঠিক বলছে আমাদের বলে দেও।” পরে ডিহরি আর দেশের লোক সে দুজনকে বলে, “এখন তোমরা সূর্য্যদেবকে প্রণাম করে তীর দুটি উঠাও; আমাদের কোন দায়িত্ব নাই; একটা একটা করে উঠাও, আমাদের ভয় ক’রো না, কিন্তু ঠাকুরকে ভয় কর।” পরে যে তীর উঠায় সে উত্তরে বলে থাকে, “শুন ঠাকুর, আমি যদি ‘বেধর্ম্ম’ করে থাকি তবে যেন শিকারে এ বনের বাঘ আমাকে খেয়ে ফেলে; আর বেধর্ম্ম না করে থাকূলে আমি যেন মঙ্গলমত বাড়ী ফিরে যেতে পারি।” দ্বিতীয় ব্যক্তিও সাহস থাকূলে এরূপ করে থাকে, অন্যথা হটে যায়। তারপর ডিহরি লোটার জল তীরের আগায় ঢেলে দেয়; ঢেলে করযোড় করে বলে, “ওগো ঠাকুর, তুমি এদের দুজনের ভালমন্দ বিচার কর।” তারপর শিকারের মধ্যে একদিন এরূপ শপথকারী দুজনে একজায়গায় আছে এমন সময় হঠাৎ মধ্যজঙ্গল থেকে একটা বাঘ গর্জন করতে করতে এসে হাজির হ’ল; আর যে ধর্মমত বলে—ছিল তার সামনে এসে পেছন পায়ে দাড়ায়ে অভিবাদন করে; তারপর তাকে ছেড়ে দিয়ে বেধর্মীকে ধরে শেষ করে। এরূপ দৃষ্টান্ত নাকি অনেক দেখা গিয়েছে। যদি বাঘের হাত থেকে নিষ্কৃতি পায়, তবে অন্য কোন জানোয়ারের হাতে মারা যায়।
ডিহরি শিকার বৈঠকে ব’সে, এরূপ শিকার সম্বন্ধীয়, যত বিবাদ মীমাংসা করে দেয়; সাক্ষী না পেলে পরদিন ভোরে দুজনকে ডেকে পূর্ব্বোক্ত প্রকারে পরীক্ষা করা হয়। জন্তু সম্বন্ধীয় বিচার শেষ করে ডিহরি সকলকে ডেকে বলে “ওহে দেশবাসী যদি আর কোনও বিবাদ থাকে তবে বল।” তখন একে একে নিজেদের দুঃখের কথা উত্থাপন করে। কেহ বলে “গ্রামের মাঁঝিও পাঁচজনা আমাকে খামাকা জরিমানা করেছে”; অথবা “পরগণা ও মাঁঝি মিলে আমার জমি কেড়ে নিয়েছে”; অথবা “জামাই-বৌ নিয়ে অন্যায় বিচার করেছে”; অথবা “আমাকে মিছামিছি ‘ডান’ বলে”; অথবা “বিনা কারণে খামাকা আমাকে সমাজে বন্ধ করেছে”; অথবা “গ্রামের সকলে আমাকে দেখলে দুয়ার বন্ধ করে”; ইত্যাদি হাজার রকমের নালিশ হয়। এ কারণে শিকার-বৈঠক এদের “হাইকোর্ট”। সেখানে মাঁঝি, পরগণা অথবা দেশমাঁঝি কেহই আমল পায় না; দেশের লোক ছোট বড় সকলকেই বিচার করে; আর এই সকল প্রধানেরা ঘুষ খেয়ে অথবা লোভে পড়ে অবিচার ক’রে থাকূলে তার প্রতিবিধান হয়। অনেক ঘুষখোর লোক ভয়ে কিংবা লজ্জায় সেখানে উপস্থিত হয় না। সে যদি হাজির না থাকে তবে অন্য দিন ডেকে তাকে হাজির করা হয়; আর যদি সে না মানে তবে দেশের লোক তার বাড়ীতে ছুটে এসে তার অন্যায় বিচারের প্রমাণ পেলে তাকে জরিমানা করে। শিকার-বৈঠকে খুব ন্যায্য বিচার হয়; কিছুতেই অবিচার হ’তে পারে না। গ্রামে মাঁঝি কিংবা পরগণা অনেক সময়ে গালিগালাজ ক’রে লোককে ধমকায়, কিন্তু এসব পোড়া জঙ্গলবিচারে কেহ কাহাকে ধমকায়ে চুপ করাতে পারে না; সকলে ভীরু কুকুরের লেজের মত ঘুরে বেড়ায়; সেজন্য এসব বিচারে গরীবের খুব “ভরসা” থাকে।
দ্বিতীয় দিন
বিচার করতে, করতে ডুঙ্গার নাচ নাচতে, নাচতে বনগীত গাইতে গাইতে, আর বাঁশী বাজাতে বাজাতে রাত ভোর হয়। পরে সকলে প্রাতরাশ বাশি ভাত কিংবা অন্য কিছু খায়। ডিহ্রি অবশিষ্ট মুরগীগুলি উৎসর্গ করে; অনন্ত কোন জঙ্গলে শিকার শেষ করে ফিরে আসে। মধ্যাহ্নে কিংবা অপরাহ্নে শিকার শেষ করে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে; শিকার করতে করতে আপন আপন বাড়ীর দিকে চলে যায়।
পুরাকালে এককালীন পাঁচদিন পর্য্যন্ত শিকার চলত; এখন তা হয় না। আগে যেসব গ্রামের মধ্য দিয়ে শিকারীসঙ্ঘ চলত সেসব গ্রামের মেয়েরা এসে তাদের পা ধোয়াইয়া দিত; শিকারীরা তাদিগকে চম্পাফুল উপহার দিত এবং তারা প্রণাম করত। এ ছাড়া গ্রামের লোক খাদ্যদ্রব্য ও পানীয় জল জোগাড় করত। এখন এ নিয়ম লোপ পেয়েছে।
গৃহে প্রত্যাবর্তন
শিকারীরা গৃহে ফিরে এসে হাত পা ধোয় এবং পরস্পরকে প্রণাম করে বলে যে তারা যমের হাত থেকে বেঁচে এসেছে। এজন্য এরূপ বলে থাকে, “মেয়েদের বিপত্তি সন্তান প্রসবের সময়, আর পুরুষদের বিপদ শিকার স্থলে।” এ বিপদ কাটাতে পারলে এরা অনেকদিন বাঁচে। তারপর সকলে বসে ভাত খায়। পরে শিকারলব্ধ মাংস সকলে ভাগ করে নেয়। কতক মাংস রেধে পূর্ব্ব পুরুষদের নামেও উৎসর্গ করা হয়।