দোষ ও দণ্ড
(দণ্ডবিধি আইন)
(১) পঞ্চাতি বিচার
সাওতালদের মধ্যে তিনরকম পঞ্চাতি বিচার প্রচলিত : —-গ্ৰাম্য পঞ্চাতি অথবা মাঁঝির বৈঠক, বাহির অথবা পরগণা বৈঠক, আর শিকার অথবা শিকার বৈঠক। গ্রাম্য বৈঠকে মাঁঝি মুখ্যা, বাহির বৈঠকে পরগণা মুখ্যা, আর শিকার বৈঠকে ডিছুরি মুখ্যা। মাঁঝির বৈঠকে গ্রামের পাঁচজন তাহার বিচারে সাহায্য করে; পরগণার বৈঠকে পরগণার নিম্নস্থ মাঁঝিরা এবং প্রতিবেশী পাঁচজন বিচারে সাহায্য করে। শিকার বৈঠকে দেশসুদ্ধ লোক ডিছুরির সাহায্য করে। মাঁঝি এক গ্রামের মাথা; পরগণা কতকগুলি গ্রামের মাথা; আর দেশের লোক বন-বৈঠকে সমস্ত দেশের উপর কর্তৃত্ব করে এদের মধ্যে দেশমাঁঝি আছে; তারা পরগণাদের সাহায্যকারী। মাঁঝির বিচার থেকে পরগণার নিকট আপিল হয়; পরগণার বিচার হ’তে বন-বৈঠকে দেশের লোকের নিকট আপিল হয়। এদের বিচার থেকে আর আপিল নাই।
পরগণার প্রাপ্য এরূপ :-নিজের এলাকার ভিতরে প্রত্যেক গ্রাম থেকে একটাকা আর আধসের ঘি পায়, আর বৎসরান্তে ২০ গণ্ডা জন্দ্ৰাও পেয়ে থাকে। দেশমাঁঝির প্রাপ্য : গ্রাম পিছে আট আনা ও একপোয়া ঘি, আর বৎসরান্তে দশ গণ্ডা জন্দ্রা। মাঁঝিরা গরগণার টাকা আদায় করলে পরগণা তাদের ভোজ দিয়ে খাওয়ায়। দেশমাঁঝিরা ও এরূপ করে থাকে। কিন্তু আজকাল অনেক অনেক মাঁঝি পরগণার টাকা নিয়মমত চুকাইয়া দেয় না; পরগণারাও আর ভোজ দেয় না। যে দিন থেকে সাহেবেরা এদেশে রাজা হয়েছে সেদিন থেকে ইহা লোপ পেয়েছে। এদের আসার পর থেকে কি মাঁঝি কি পরগণা লোভী হয়ে পড়েছে। যে কেহ বেশী টাকা দিতে পারে সেই বিচার পায়, আর হাকিমের নিকট তার বেশী প্রতিপত্তি হয়; আর নিঃস্ব গরীবকে কেহ ‘পোছেনা’, খামাখা গালাগালি করে তাড়িয়ে দেয় এবং তাদের মোকদ্দমা ডিসমিস্ করে।
দেশের লোকেরা আর ধর্ম্ম মানে না; গ্রামের মাঁঝির নিকটও বলে না, পরগণার নিকট নালিশ করে না, অথবা দেশবাসীর নিকট গিয়ে কাঁদে না। বুড়োবুড়ীদের ভিতর বিবাদ লাগলে তারা লজ্জাসরমের মাথা খেয়ে একছার হাকিমের কাছে গিয়ে হাজির হয়, আর সুচতুর উকিলবাবুরা বেশ করে টাকা খায়। নিজেরা হাজতও ভোগ করে আর তুষের আগুনের মত রাগে জ্বলতে থাকে। পূর্ব্বপুরুষদের বিচার অবহেলা করায় এরূপ ফল হয়েছে! “বেশ, গুরুতর অপরাধ হাকিমের নিকট নেও, কিন্তু প্রাচীনকাল থেকে পূর্ব্বপুরুষেরা যেসব বিচার নিষ্পত্তি করত সেগুলি নিয়ে কেন হাকিমের নিকট যাও।”
(২) সাক্ষী-বিষয়ক
অতি পুরাতনকাল থেকে সাঁওতাল যুবক সত্যনিষ্ঠার জন্য প্রসিদ্ধ; কখনও মিথ্যাকথা বলতে জানিত না। নিজের আত্মীয়সম্পর্কেই হউক কিংবা শত্রুসম্বন্ধেই হউক এরা নিছক সত্য কথা বলত। ইংরেজদের আগমনের পর সত্যকথা বলার দুএকজনের ফাঁসিও হয়েছে! এসব অপরাধের সাক্ষী ছিল না; মিথ্যা কথা বললে এরা খালাস পেত। এদের বৈঠকে সাক্ষী এক একজন করে ডাকা হত না; একবারে সব সাক্ষী সামনা সামনি বলত কিন্তু তবুও মিথ্যা বল্ত না। আজকাল হিন্দুদের নিকট শঠতা শিখে ওদের মত দুএক বাটি মদের জন্য নিজেদের মান ও প্রাণ বিক্রী করে থাকে; আর হাকিমেরা এদের ভাষা না জানায় সত্য—মিথ্যা ধরতে পারে না। কেবল খলপ্রক্বতি বাবুদের কথায় ভুলে যায়। এরা এখন ন্যায় বিচার পায় না। হাকিমের সোজা হলককে কেহ ভয় করে না; প্রাচীন সাঁওতালদের শপথের মত দিব্যি দেওয়া হয় না, যেন প্রাণের ভয়ে সশঙ্কিত হয়, মিথ্যা বলাত দূরের কথা। দুএকজন হাকিম হিন্দুদের নিকট হ’তে সাঁওতালী ভাষায় ছোট ছোট হলক তরজমা করে নিয়েছে, কিন্তু সেসব পড়লে এদের কেবল হাসি পায়; কারণ যে হলক পড়ে তাকে কোন কিছুতে বাঁধে না। সে হলপ এইরূপ—”ধৰ্ম্ম ধৰ্ম্ম বলবে; মিথ্যা কথা বললে বাঘ ও অপদেবতায় খাইবে!” সাক্ষীও একথাগুলি আওড়ায় “ধর্ম্ম ধৰ্ম্ম বলবে, মিথ্যা কথা বললে বাঘ ও অপদেবতায় খাইবে!” এতে সাক্ষী কেন ভয় পাবে?
(৩) দোষ কত প্রকার?
গুরুতর অপরাধের মধ্যে এই সব :—নরবলি, অসতর্ক খুন, স্ত্রী-ভাগানি, জোর করে জাত নেওয়া, আর জোর করে সিন্দুর দান; এসকলের দণ্ড ছিল প্রাণদণ্ড। নরবলি-পূজক ছেলেমেয়ে চুরি করে নিয়ে অথবা রাস্তাঘাট থিকে মানুষ ধরে নিয়ে দেবতার কাছে উৎসর্গ করত; ঠিক সে সময়ে ধরা পড়লে বিনাবিচারে এদের প্রাণদণ্ড হত (if kidnapping), আর এদণ্ডের কোন আপিল ছিল না। শিকারের সময় যদি কেহ অসতর্কতা নিবন্ধন অন্য কাকেও শরবিদ্ধ করে মারত তবে পাঁচজনে বিচার করে তার প্রাণদণ্ডের আদেশ দিত। তীর নিক্ষেপ করার সময় যেখানে শরবিদ্ধ লোকটি দাড়ান ছিল ঠিক সেই খানে অপরাধীকে দাঁড় করাত, আর যেখান থিকে অপরাধীকে তীর ছুঁড়েছিল, ঠিক সেখানে মৃতব্যক্তির একজন ওয়ারিশকে দাঁড় করাত। সেখান থিকে এক বাণে যদি অপরাধীর মৃত্যু হত ভাল, নচেৎ সে সেযাত্রা রক্ষা পেত। যদি কোন বাণ কোন প্রাণীকে বিদ্ধ ক’রে কারও মৃত্যু ঘটায়, তবে সেই রকম ভাবে অপরাধীকে জানোয়ার যতদূরে ছিল ততখানি দূরে রেখে তাঁর ছোড়া হত, সেই তীরে যদি তার মৃত্যু হত ভাল, নচেৎ রক্ষা পেত।
যদি কেহ স্ত্রী ভাগাইয়া নেয় তবে যেখানে তাকে পাওয়া যেত সেখানেই বন্যপশুর মত তাকে বধ করত। আজকাল মৃত্যুব্যবস্থা নাই, মাথা বাঁচাতে দোষীকে পাঁচটাকা জরিমানা দিতে হয় মাত্র।
জোর ক’রে জাত নষ্ট করলেও সেইরূপ প্রাণদণ্ড হত; কিন্তু আজকাল মাথা বাঁচান পাঁচটাকা লাগে। আর তা ছাড়া সামৰ্থ্যমত জরিমানাও দিতে হয়। অনেকে কুড়িটাকা পর্যন্তও জরিমানা দিয়ে থাকে। কেহ জোর করে কোন মেয়ের কপালে সিন্দুর লাগালে তার দক্ষিণ হস্ত কেটে ফেলা হত, আর “টাকুর” সাহায্যে তার এক চোখ উড়িয়ে নেওয়া হত (টাকু — spinning axle of a spinning wheel), আর তাকে বেশ জরিমানাও দিতে হত। আজকাল হাত ও চোখ বাঁচাতে এদের পাঁচটাকা লাগে; মারও খায়, জরিমানাও দেয়, খামাখা খামাখা কখনও খুন হত না।
আদিকালে ডানদের “বেয়ারু” করে গ্রাম থেকে বহিষ্কৃত করে দিত; আবার কখনও কখনও এদের মেরেও ফেলা হত। এখনও এদের বের করে দেওয়া হয়; কখনও মেরেও ফেলা হয়। কিন্তু ইহা ন্যায়সঙ্গত নয়; যেহেতু প্রাচীন সাঁওতালেরা এরূপ করত না। রাগের বশে কাকেও মারলে সে যদি মরে যেত তবে তাকে প্রাচীনেরা খুন বলত না, এবং সেজন্য দোষীর প্রাণদণ্ড ব্যবস্থা ছিল না।
আত্মীয় কুটুম্বের মধ্যে অথব। অন্য কোন জাতের সঙ্গে “লটঘটি” (adultery—ব্যাভিচার) ঘটলে, পাপ প্রণয় জন্মালে তাদের সমাজচ্যুত করা হত। এখনও এনিয়ম প্রচলিত আছে, তবে আজকাল অনেকটা এ নিয়মের ব্যতিক্রম হয়ে থাকে। অনেকে “খাতিরজমা” এরূপ করে থাকে। কিন্তু সমাজ তাকে কিছু বলে না।
প্রাচীনকালে সাঁওতালদের ভিতর চুরি ছিল না; কিন্তু আজকাল এরা এটা হিন্দুদের কাছ থেকে শিখে নিয়েছে। সেকালে একপ্রকার চুরির প্রমাণ পাওয়া যায়—ভেড়াছাগল চুরি করে খাওয়া। এগুলি হারিয়ে কোথাও গেলে গ্রামসুদ্ধ লোক ধরে মেরে খেয়ে ফেলতে; মাঁঝি দুভাগ নিত। এসব প্রমাণিত হলে প্রত্যেককে পাঁচসিকা করে জরিমানা দিতে হত। আজকাল এসবের বিচার হাকিমের পরিষ্কার এজলাসে হয়ে থাকে।
এদের মধ্যে গর্ভপাত অপরাধ ছিল না। আত্মীয়তার মধ্যে ক্বচিৎ এরূপ হ’ত; প্ৰমাণিত হ’লে ডাক্তার ও প্রসূতি দুজনেরই দশটাকা করে জরিমানা হত। এখন হাকিমের নিকট এসব বিচার হয়। মিছেমিছি কারও অপবাদ করলে অপবাদ ঘুগবার জন্যে পাঁচটাকা, পাঁচজনকে পাঁচসিকা দিতে হয়। কেবল মাতালেরাই লোকের শুধুশুছু গালাগালি ক’রে মানহানি দোষ করে। সেকালে এদের খুব মার দেওয়া হত, আর দশ টাকা করে জরিমানা করা হত। আজকাল কখনও কখনও এসব মামলা হাকিমের নিকট রুজু হয়।
যদি কেহ কারও ক্ষতি করে তবে সেজন্য তাকে তার দাম অথবা মূল্য দিতে হয় এবং জরিমানাও দিতে হয়। মারপিট করলে দুজনের দোষ হ’লে দুজনেরই জরিমানা হয়, অন্যথা একজনের। বলদ কিংবা গাই চুরি করলে অপরাধীকে ধরে তার প্রতিবিধান করা হয়; আর যদি কেহ লাঙ্গল চাষ করতে করতে করতে অথবা মারতে মারতে মেরে ফেলত তবে তারও শোধ দিতে হয়। কেহ মিথ্যা নালিশ কিংবা মিথ্যা দাবী উত্থাপন করলে তার উল্টো সাজা হয়। খামাখা “চুগাল” (পরনিন্দা) করে যারা বেড়ায় তাদেরও জরিমানা করে জব্দ করা হয়। যদি কোন যুবতী মেয়ে পীঠস্থানের গাছে চরে দোষ করে, অথবা অন্য কোন পরিবারের ভিতর ঢুকে দোষ করে তবে তাকে পূজা দিতে হয়।
সীমানা ভঙ্গ নিয়ে বিবাদ হ’লে পরগণা ও মাঁঝি মিলে তার বিচার করে; আর জোর করে জমি কেড়ে নিয়ে গেলে গ্রামের মাঁঝি ও পাঁচজনে তার মীমাংসা করে; দোষীর জরিমানা হয়। এ দুরকম বিবাদ এদের মধ্যে পূর্ব্বে ছিল না; আজকাল হিন্দুদের নিকট শিক্ষার ফলে ইহা দেশময় ছেয়ে পড়েছে। আজকাল হিন্দুরা গ্রামকে গ্রাম কেড়ে নেয়, সীমানাও অতিক্রম করে। জমিও বেদখল করে চুরি করে। লোকে কথায় বলে, “হিন্দুলোক সূচের মত প্রবেশ করে আর লাঙ্গলের ফালের মত ছিদ্র করে।” সাঁওতালেরা এখন জমি কাড়াকাড়ি নিয়ে বেশ মামলা করতে শিখেছে। এসব যেখানে হয় সেখানে আর শান্তি থাকে না। হাকিমের নিকট মিথ্যা সাক্ষীর ফলে জমিজমা এখন শেষ হয়েছে। আর হাকিমেরা এদের কথা না বুঝায় এদের বড় মুস্কিল হয়েছে। হয়ত একদিন না একদিন আবার এদেশ হ’তে এরা পালিয়ে যাবে। হিন্দুদের মধ্যে এদের বাস করতে না হলেই এদের মঙ্গল।