সীমানা ছাড়াতে ছাড়াতে

সীমানা ছাড়াতে ছাড়াতে

১৯৬২ সালে ডাবলিনে যান ও সেখানে মাইলস ডিলন নামে পণ্ডিত-প্রবরের সঙ্গে সারস্বত সখ্যের সূত্রপাত হয়। কেলটিক ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চায় সুনীতিকুমার এঁর কাছে নানা সাহায্য পেয়েছিলেন। ওই বছরই যুক্তরাষ্ট্র, হাওয়াই, জাপান ও ফিলিপিনসে যান। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলির বিচ্ছিন্নতা তাদের সংস্কৃতিকে কীভাবে রূপায়িত করে ও বহু বিভিন্ন মহাদেশীয় সংস্কৃতির তরঙ্গ কেমন করে এই সব দ্বীপে আছড়ে পড়ে তাদের প্রভাবিত করে সে নিয়ে চিন্তার সূত্রপাত এই ভ্রমণেই। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনলজি, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও স্থায়ী আন্তর্জাতিক ভাষাতত্ত্ব সমিতির সভায় যোগ দেন, একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন এবং সর্ব সদস্যের সভায় সভাপতিত্ব করেন। দেশে ফিরে তৃতীয়বার সর্বসম্মতিক্রমে বিধান পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৬৩-র জানুয়ারিতে ভারত সরকারের ‘পদ্মবিভূষণ’ সম্মানে ভূষিত হন। এর পর আন্নামালাই বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা: বিষয় ছিল ‘ড্রাভিডিয়ান’; ১৯৬৫ সালে এটি পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন আন্নামালাই বিশ্ববিদ্যালয়। এ সবের সঙ্গেই চলে দেশের মধ্যে নানা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংযোগ। কাঁচড়াপাড়ায় বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনে যোগ দেন ওই ১৯৬৩ সালেই। কলকাতায় তামিলচর্চার সংস্থা ভারতী তামিল সংঘম-এর সভাপতি হয়েছিলেন সুনীতিকুমার। মে মাসে হায়দ্রাবাদে ভাষাতত্ত্ব সভায় যোগ দেন। নেপালরাজের আমন্ত্রণে কাঠমাণ্ডুতে, ‘নেপাল ও ভারত’ নামে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। অক্টোবরে মরাঠাওয়াডা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঔরঙ্গাবাদ) আমন্ত্রিত হয়ে ‘রবীন্দ্রনাথ’ বিষয়ে একটি বক্তৃতা দেন; ওই বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৬৫ সালে এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন।

পরের জানুয়ারিতে দিল্লিতে আন্তর্জাতিক প্রাচ্যবিদ্যা সম্মেলনে যোগ দেন আয়োজক সমিতির সভ্যরূপে। মে-জুনে রাশিয়ায় তারাস শেভচেঙ্কোর সার্ধশতবার্ষিকী উপলক্ষে কিয়েভ, কানিয়েভ, শেভচেঙ্কোভা ও মরিন্টসিতে যান এবং লিথুয়ানিয়ায় ভিলনিউ ও ল্যাটভিয়ার রিগাতেও যান। মস্কোতে এশীয় ও আফ্রিকীয় সাহিত্যিক সম্মেলনে যোগ দেন জুন মাসে। এর আগে তাঁর অনুপস্থিতিতেই ভারত সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপকের (মানবিকী বিদ্যা) পদ দিয়ে সম্মানিত করেন। কমনওয়েলথের ভারতীয় প্রতিনিধিরূপে জামাইকা যান লন্ডন হয়ে। ফেরবার পথে পোর্তো প্র্যাস (হাইতি) যান আফ্রিকান ‘ভুদু’ ধর্ম সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করার জন্যে।

১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে অর্ধশতাব্দীর জীবনসঙ্গিনী কমলা দেবীর মৃত্যু হয়। ছোট একটি পুস্তিকা রচনা করেন তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে। সেই মাসের শেষ দিকে কটকে সর্বভারতীয় বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। ফেব্রুয়ারি মাসে বিধান পরিষদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন জাতীয় অধ্যাপকের দায়িত্ব গ্রহণ করবার জন্যে। মার্চ-এপ্রিলে গেলেন ইম্ফল, মণিপুর-পুরাণ রচয়িতা আতম্বাপু শর্মার স্মারক বক্তৃতা দিতে। এই ধরনের রচনা ও উৎসাহের মধ্যে দেশের উপেক্ষিত ও অজ্ঞাত সংস্কৃতি সম্বন্ধে সুনীতিকুমারের স্বতঃস্ফূর্ত কৌতূহল, আগ্রহ ও শ্রদ্ধা সূচিত হয়। যেমন এর পরেই তিনি যান গ্যাংটকে (সিকিম), চো-গিয়ালের অভিষেক উপলক্ষে। উপলক্ষ যাই হোক, প্রকৃত উদ্দেশ্য স্থানীয় সংস্কৃতির স্বরূপ সম্বন্ধে সরেজমিনে অভিজ্ঞতা অর্জন। এ উদ্দেশ্য সারাজীবন তাঁকে তাড়না করে ফিরেছে, পৃথিবীর সর্বপ্রান্তে এমনকী স্বগৃহের উপান্ত প্রদেশেও নিয়ে গেছে।

ভারতবর্ষের মধ্যে প্রথম দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ই সুনীতিকুমারকে সাম্মানিক ডি লিট উপাধিতে ভূষিত করে ১৯৬৪-রই ডিসেম্বর মাসে। এই সময়েই ভারত সরকার প্রতিষ্ঠিত রুশ-বিদ্যাচর্চার সংস্থা স্থাপিত হয় এবং সুনীতিকুমার তার সভাপতি হন। এ সংস্থা রুশ-ভারত যুগ্ম প্রচেষ্টায় গঠিত।

১৯৬৬-এর ফেব্রুয়ারিতে মহীশূরে ভারত সরকার প্রতিষ্ঠিত চিন-বিদ্যা-কেন্দ্র পরিদর্শন করেন সুনীতিকুমার। পরে তিব্বতি শরণার্থী কেন্দ্রটিও দেখে আসেন। কুর্গে বক্তৃতা দেন। ভারতের যে সব দেশের সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রক সাংস্কৃতিক বিনিময় কর্মসূচি স্থাপন করেন সেগুলি পরিদর্শন করতে পাঠান সুনীতিকুমারকে; এগুলি ছিল কায়রো, আদ্দিস আবাবা, আথেন্স, বুখারেস্ট, প্যারিস, লন্ডন, প্রাগ, পূর্ব বার্লিন, মস্কো, রিগা, ডিলনিউস ও এরেভান। তেহরানে অনুষ্ঠিত বিশ্ব-ইরানবিদের সম্মেলনে সুনীতিকুমার দীর্ঘ এক প্রবন্ধ পাঠ করেন। এই যাত্রাতেই ইস্পাহান, শিরাজ, পার্সিপোলিস ও নকশ-ই-রুস্তম দেখে আসেন। এ অঞ্চলে দূর অতীতের যেমন আম্মামীনিয় সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ ও কীর্তিস্তম্ভের গৌরব এখনও বিদ্যমান, অন্য প্রান্তে সুনীতিকুমারের অতিপ্রিয় গ্রন্থ শাহনামা-র স্মৃতিপুত নগরীগুলিও এখানে আছে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে আমন্ত্রণ সোভিয়েট ইউনিয়নে, এ বার শোথা রুশ-থাবেলির অষ্টম শতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রবন্ধ পাঠের জন্যে আহ্বান। রুশ-থাবেলি জর্জিয়ার জাতীয় কবি, এঁর মহাকাব্য বেফখিস ট্-কাওসনি (ব্যাঘ্রচর্মে মানুষ) গ্রন্থটির পুনর্মুদ্রণ তখন আসন্ন। আর্মেনিয়া গেলেন ফেরবার পথে ও সেখানকার কিছু বিদ্বজ্জনের সঙ্গে আলাপ করলেন। এর পূর্বেই আর্মেনিয়া সম্বন্ধে তাঁর প্রাক-প্রস্তুতি ছিল, বই পড়ে। তাঁর লেখা আর্মেনিয়ান হীরো— লেজেন্ডস অ্যান্ড দি এপিক অব ডেভিড অব সাসুন; এ বার ডেভিড সাসুন-এর দেশে গিয়ে সে-সংস্কৃতিটিকে প্রণিধান সহকারে দেখে এলেন। অক্টোবরে সিমলার ইনস্টিটিউটে বক্তৃতা করেন ইন্দো-ইউরোপীয় সংস্কৃতি ও ভাষাতত্ত্ব সম্বন্ধে— প্রধানত ইরান বাল্ট্ ও আর্যদের সম্বন্ধে। ওই বছরের শেষে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি দেয়।

১৯৬৭-র মে মাসে ভারত-চেকোস্লোভাকিয়ার মৈত্রীবন্ধন দৃঢ়তর করবার জন্যে চেকোস্লোভাকিয়া তাঁকে একটি স্বর্ণপদক দেয়। ওই বছর অগাস্টে মিশিগানে সপ্তবিংশতিতম আন্তর্জাতিক প্রাচ্যবিদ্যা সম্মেলনে যোগদান করেন। পরের মাসে বুখারেস্টে আন্তর্জাতিক ভাষাতত্ত্ব সম্মেলনে যোগ দেন। এই বারে ফেরবার পথে আথেন্স, আঙ্কারা, ইস্তাম্বুল ও তেহরান ভ্রমণ করে আসেন। এই সব দেশের স্থানীয় সংস্কৃতির নানা দিকে যাঁরা চর্চা করেছেন তেমন বেশ কয়েকজন মনীষীর সঙ্গে তাঁর সখ্য হয়। পরেও পত্রবিনিময় চলে। অক্টোবরে সিমলায় ‘ভাষা ও সমাজ’ সম্বন্ধে বক্তৃতা দেন। ১৯৬৮-র জানুয়ারিতে মাদ্রাজে তামিলবিদ্যার এক সম্মেলনে প্রবন্ধ পাঠ করেন, বিষয়: ‘তামিল ও দ্রাবিড় ভাষাতত্ত্ব ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে কিছু চিন্তা’। পরের মাসে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডি লিট উপাধি দেন। ফেব্রুয়ারি মাসে সাহিত্য অকাদেমির সহকারী সভাপতি নির্বাচিত হন।

এপ্রিলে বিশ্বভারতীতে বিশ্ব-সাহিত্য ও রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে ‘নৃপেন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় স্মারক’ বক্তৃতা দেন। দীর্ঘকাল ধরে রবীন্দ্র-সাহিত্য অধ্যয়ন করেছিলেন এবং ধীরে ধীরে বিশ্বসাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের স্থান ও দান সম্বন্ধে তাঁর একটি বোধ গড়ে ওঠে। তিন বছর আগে মরাঠাওয়াডায় প্রদত্ত বক্তৃতামালারই পূর্ণতর, পরিণততর সংস্করণ বিশ্বভারতীর এই বক্তৃতা। কৈশোরেই রবীন্দ্রসাহিত্য প্রীতির উন্মেষ হয়, তাঁর যুক্তি চিন্তায় এবং বোধে ও বোধিতে রবীন্দ্রনাথ ক্রমে ভারতীয় সাহিত্যের সীমা ছাড়িয়ে বিশ্বসাহিত্যের পটভূমিতে উত্তীর্ণ হন। বিশ্বসাহিত্যের আদিপর্বের সমস্ত সাহিত্যগ্রন্থ তিনি বিশেষ যত্ন করে পাঠ করেন; পরবর্তী পর্বের সকল তাৎপর্যপূর্ণ সাহিত্যগ্রন্থও। ফলে এই গুরুত্বপূর্ণ মূল্যায়নে তাঁর এক ধরনের অধিকার জন্মেছিল।’

১৯৬৮-র মে মাসে প্রকাশিত হয় বাল্টস অ্যান্ড আরিয়ান্স ইন দেয়ার ইন্দো-ইউরোপীয়ান ব্যাকগ্রাউন্ড গ্রন্থটি। বাল্টিক সভ্যতা ও ভারতীয় আর্য সভ্যতার আদিমতম পশ্চৎপট যে ইন্দো-ইউরোপীয় সংস্কৃতি, সেইখানে এ দুইয়ের ভাষাগত, চিন্তাগত, প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংস্কৃতিক যে মিল ও সংযোগের ক্ষেত্র তার স্বরূপ উন্মোচন এবং কিছু দূর পর্যন্ত তার বিবর্তন অনুধাবন করেছেন এ গ্রন্থে। এ কাজ তৎকালে পৃথিবীতে যে ক’জন করতে পারতেন সুনীতিকুমার যে তাঁদের মধ্যে বিশিষ্ট ভাবে অধিকারী তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বইটি ছোট কিন্তু তথ্যে পূর্ণ এবং কত বিভিন্ন উৎস থেকে যে সে সব তথ্যের সংকলন এবং নির্ভরযোগ্য ভাবে সেগুলির প্রতিষ্ঠাপন তা দেখলে সত্যিই বিস্ময়বোধ হয়।

এই বছর অগাস্টে সুনীতিকুমারের নিজের অধ্যয়ন ও অধ্যাপনাক্ষেত্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সমাবর্তন উৎসবের বক্তৃতা দিতে আমন্ত্রণ জানায়। অক্টোবরে হায়দ্রাবাদে ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডি লিট উপাধি দেয়। ১৯৬৯-এর জানুয়ারিতে লন্ডনের আন্তর্জাতিক ধ্বনিবিজ্ঞান সংস্থার সভাপতি নির্বাচিত হন। আন্তর্জাতিক ভাষাতত্ত্বের ক্ষেত্রে যাঁর প্রথম ও প্রধান চর্চা, তাঁর জীবনে এই সম্মান একটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। আন্তর্জাতিক ভাষাতত্ত্বের জগতে এটি একটি শীর্ষস্থানীয় স্বীকৃতি। ফেব্রুয়ারি মাসে এশিয়াটিক সোসাইটি সুনীতিকুমারকে ‘রবীন্দ্র ফলক’ দিয়ে সম্মানিত করে। ওই মাসেই দিল্লিতে য়ুনেস্কোর সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত মধ্য এশিয়া সম্বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করেন। মার্চে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডি লিট উপাধি দেয়। মে-জুন মাসে মাদুরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রীষ্মকালীন পাঠচক্রে ‘ভারতবর্ষে ভাষাতত্ত্ব’ সম্বন্ধে চারটি বক্তৃতা করেন। কবি তিরুবাল্লুবরের জন্মের দ্বিসহস্রবর্ষপূর্তি উপলক্ষে মীনাক্ষীমন্দিরে সুনীতিকুমার কবি সম্বন্ধে বক্তৃতা দেন।

১৯৬৯-এর জুনে প্রকাশিত হয় সুনীতিকুমারের আর একটি গ্রন্থ, ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইথিওপিয়া: ফ্রম দ্য সেভস্থ সেঞ্চুরি বি সি। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দী থেকেই ইথিওপিয়া ইতিহাসে অবতীর্ণ, সেই সময় থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত ভারতবর্ষের সঙ্গে তার নানাবিধ সংযোগের বিবরণ এ গ্রন্থে। বাণিজ্যে যার সূত্রপাত, তা পারস্পরিক আদানপ্রদানের দ্বারা ক্রমেই কেমন ভাবে উভয় সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে তার বিবর্তন দেখাবার জন্যে নানা উৎস থেকে উপাদান সংগ্রহ করে একটি পরিণতির ইতিহাস রচিত হয়েছে এ গ্রন্থে। ওই বছরে ডিসেম্বর মাসে সাহিত্য অকাদেমির পক্ষ থেকে অনুষ্ঠিত গুরু নানকের পঞ্চশতাব্দীপূর্তি উপলক্ষে যে সভা আয়োজিত হয় তার সভাপতিত্ব করেন সুনীতিকুমার। পরে কলকাতায় তিন দিনব্যাপী যে সভা চলে ওই উপলক্ষে সেখানেও সভাপতিরূপে উপস্থিত থাকেন। পরের বৎসর জানুয়ারি মাসে ওই বিষয়ে মাদ্রাজে একটি আলোচনাসভার আয়োজন হয়, সেটিরও উদ্বোধন করেন। এই বছরে দ্বিতীয়বার এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি নির্বাচিত হন। এই দু’বারই সুনীতিকুমারের প্রেরণায় ও সাহায্যে সোসাইটি অনেক তাৎপর্যপূর্ণ সভা, প্রকাশনা, আলোচনা ও অন্যান্য কাজ নিষ্পন্ন করে।

১৯৭১ সালে তাঁর বহু সাধের ও সাধনার একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়: ওয়লর্ড লিটারেচার অ্যান্ড টেগোর। এটি ১৯৬৮ সালে বিশ্বভারতীতে প্রদত্ত ‘নৃপেন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় স্মারকবক্তৃতা’। রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে তাঁর প্রায় সারাজীবনের চিন্তা এতে একটি সামগ্রিক রূপ পায় বিশ্বসাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে। ১৯৬৬-তে তেহরান-এ ভারততত্ত্ব সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যা বলেন তাকে একটি গ্রন্থে সংহত রূপ দিয়ে প্রকাশ করেন ১৯৭২ সালে ইরানিয়ানিজম। ছাত্রাবস্থায় যে অবেস্তা পাঠ শুরু হয় তারই সঙ্গে ধীরে ধীরে সংযুক্ত হয় ইরানীয় সভ্যতা সংস্কৃতি সম্বন্ধে তাঁর চিন্তা; ছোট একটি গ্রন্থের পরিসরে চিন্তাপ্রসূত বহু তত্ত্ব এ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। এর পরেই জয়দেবকে নিয়ে ছোট একটি পরিচিতি-পুস্তক রচনা করেন সাহিত্য অকাদেমির জন্যে; প্রকাশকাল ১৯৭৩। সুনীতিকুমার একেবারেই কবি জয়দেবের ভক্ত ছিলেন না, তবু কী পরিশ্রম করে জয়দেব সম্বন্ধে যাবতীয় জ্ঞাতব্য তথ্য সংকলন করেছেন, এবং ধ্বনি সম্পদের জন্যে যেটুকু সম্মান তাঁর প্রাপ্য তা তুলে ধরেছেন এ গ্রন্থে। এ দিকে কোনও সময়েই নিজের বিষয় ভাষাতত্ত্ব থেকেও সরে যাননি বরং এ বিষয়ে দৃষ্টির প্রসার ঘটছিল। এবং ১৯৭৪-এ প্রকাশ করলেন ইন্ডিয়া: আ পলিপ্লট নেশন, অ্যান্ড ইটস লিঙ্গুইস্টিক প্রব্লেমস ভিজাভি ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশন। বহুভাষাভাষী ভারতীয়দের ভাষাগত সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় সংহতির সমস্যা সম্বন্ধে এতে আলোচনা করেছেন। ১৯৭৬-এ বন্ধু অমিয় চক্রবর্তীর কন্যা শেমন্তীর বিবাহ উপলক্ষে সংক্ষিপ্ত হিন্দু বিবাহ পদ্ধতির সঙ্গে উপনয়ন পদ্ধতির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি হিসেবে সম্পূর্ণ একটি গ্রন্থ রচনা: আ শর্টেন্ড আর্য-হিন্দু-বৈদিক ওয়েডিং অ্যান্ড ইনিশিয়েশান রিচুয়াল। উপনয়ন ও বিবাহ সম্পর্কে বৈদিক মন্ত্রগুলি তিনি তাঁর রুচি অনুসারে এতে সাজিয়ে দিলেন। লক্ষণীয়, ১৯৭৭-এ শ্রাদ্ধ সম্বন্ধে অনুরূপ একটি গ্রন্থ লেখার কথা ভেবেও লিখতে পারলেন না। বললেন, ‘যুক্তিতে মানতে পারছি না।’ অর্থাৎ যেখানে আত্মা, পরলোক, জন্মান্তর, কর্মবাদ, স্বর্গ, নরক, ইত্যাদি এসে পড়ে সেখানে তাঁর অযৌবনসিদ্ধ যুক্তিনিষ্ঠা এ সবের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়িয়ে লেখনীকে স্তব্ধ করে দেয়। সাতাশি বছরের বৃদ্ধের পক্ষে ওই কারণে এ সম্বন্ধে না-লেখাটা বিশেষ গৌরবের। এ সবের ফাঁকে ফাঁকে কিছু কিছু প্রবন্ধ রচনাও চলছিল। বিশেষ উল্লেখযোগ্য ১৯৭৫-এ দিল্লিতে আন্তর্জাতিক রামায়ণ সম্মেলন থেকে ফিরে রামায়ণ বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ তথ্যপূর্ণ গ্রন্থরচনার সংকল্প করেন। এ প্রসঙ্গে ১৯৭৬-এর ১৩ ফেব্রুয়ারি ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে যে বিতর্কসভা হয় সেখানে তাঁর জ্ঞানের দৃঢ়তা, তথ্যসম্ভার ও যুক্তি পরম্পরা সমস্ত শ্রোতাকে মুগ্ধ করে। এ নিয়ে লিখবার সময় পেলেন না।

চোখের ছানিতে কষ্ট পাচ্ছিলেন শেষ দিকে ক-বছর ধরেই। এর মধ্যে ডেঙ্গুজ্বর স্বাস্থ্যের উপরে একটা বড় রকমের আঘাত হানল। চোখে অস্ত্রোপচারের জন্যে মনে মনে প্রস্তুতই শুধু ছিলেন না, দৃষ্টি ফিরে পেলে কী কী করবেন, লিখবেন তার পরিকল্পনাও চলছিল; এমনই তীব্র ছিল তাঁর জীবনমুখিনতা। ১৯৭৭-এর ১৭ মে নার্সিংহোম গেলেন; ১৮ মে অস্ত্রোপচার সার্থক ভাবেই হল। চোখ বাঁধা অবস্থাতেই বলেন প্যারিসে তৃতীয় বিশ্ব সংস্কৃত সম্মেলনে প্রাচীন গ্রিক, প্রাচীন হিব্রু ও প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্য পৃথিবীকে যে কী মননসম্পদ দিয়েছে তার উপরে প্রবন্ধ মুখে মুখে বলবেন। ছাত্রী তার অনুলিপি প্রস্তুত করলে তিনি সেটি প্যারিসে পাঠাবেন। অর্থাৎ জীবন থেকে এক চুলও সরে যাননি। বরং শেষ পর্যন্ত সমস্ত কর্মশক্তিকে পরিশ্রমে ও প্রয়াসে সমুজ্জ্বল করে তুলতে উৎসাহী ছিলেন।

সময় হল না। সময় হল না আরব্ধ জীবনকথাটিও শেষ করবার। ২৪ তারিখে বাড়ি ফিরলেন সুস্থ দেহেই। ২৬ তারিখে কাজও করলেন, মুখে মুখে দুটি চিঠির উত্তর শ্রুতিলিপির মতো বলে গেলেন একান্ত সচিবকে। পরম আগ্রহে প্রতীক্ষা করছিলেন চশমা পাবার, অর্থাৎ নতুন উদ্যমে কাজ করবার।

২৯ মে দুপুরে শরীর খারাপ হল, বেলা চারটেয় চলে গেলেন। দীর্ঘ রোগ ভোগ যে তাঁকে করতে হয়নি, এই একটি মাত্র সান্ত্বনা। কিন্তু সাতাশি বছর বয়সে যিনি দেহে মনে সজীব, সক্রিয় তাঁর এই প্রয়াণকে অকাল প্রয়াণ বলেই মনে হয়। এর আকস্মিকতা তাঁরই শেষ দিকের উপলব্ধিকে প্রমাণ করল: বিশ্বনিয়ন্তা নেই, মঙ্গলময় বিশ্ববিধান নেই। কিন্তু কতটুকু নিতে পারে মৃত্যু এই মৃত্যুঞ্জয় প্রাণ থেকে? কত বাকি রইল যা তাঁর দেশবাসীর চিরদিনের প্রেরণাস্থল হয়ে রইল সারস্বতসাধনায় যা উত্তরপুরুষকে উদ্দীপিত করবে সুচিরকাল ধরে। অসামান্য প্রতিভাবলে পৃথিবীর বিদ্বৎসমাজে তাঁর একটা স্থায়ী আসন ছিল; তাই বিদেশি পণ্ডিতেরা এ দেশে এলেই তাঁর সন্ধান করে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতেন। এশিয়াটিক সোসাইটি বা ভারতীয় জাদুঘরে সুনীতিকুমার তাঁদের অনেকেরই বক্তৃতার ব্যবস্থা করতেন। যেমন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকালে মুখ্যত সেখানকার ছাত্র-অধ্যাপক এবং গৌণত সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সুধীবৃন্দ সুনীতিকুমারের কল্যাণে তাঁর পরিচিত বহু বিদেশী পণ্ডিতের বক্তৃতা শুনতে পেয়েছেন— ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট অথবা সাধারণ বক্তৃতাকক্ষে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকেও পণ্ডিতরা কখনও কখনও তাঁর টানে কলকাতায় এসে অনুরূপ ভাবে বক্তৃতা দিয়েছেন, যেমন তিনিও পণ্ডিত-বন্ধুদের আমন্ত্রণে অসংখ্যবার দেশে ও বিদেশে বহু বিচিত্র বিষয়ে বক্তৃতা করেছেন। মানবিকী বিদ্যাচর্চায় এই ধরনের পারস্পরিক আদানপ্রদান, সারস্বত ক্ষেত্রে নিমন্ত্রণ-প্রতিনিমন্ত্রণ যে কী পরিমাণ স্বাস্থ্যকর হয়ে উঠেছিল তা তৎকালের ওই ভাবে শিক্ষিত মনীষীদের কাজ দেখলেই বোঝা যায়। আর বোঝা যায় এঁদের তিরোধানের পর ওই ভাবের আদানপ্রদান কত সংকুচিত হয়ে পড়েছে তা দেখেও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *