শ্রদ্ধাবনত
সুনীতিকুমার নিজে এত বড় পণ্ডিত ছিলেন বলেই বোধহয় পূর্বতন ও সমকালীনদের মধ্যে যাঁরা তাঁর শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছেন তাঁদের প্রায় সকলেরই বিষয়ে তিনি প্রবন্ধে ঋণস্বীকার করেছেন। এই ঋণস্বীকারেরই একটি রূপ পাই তাঁর ‘হেডপণ্ডিতমশায়’ প্রবন্ধে— স্নেহশীল অথচ কঠোর নিয়মনিষ্ঠ হেডপণ্ডিতমশায়, যিনি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এই মেধাবী ছাত্রটিকে এন্ট্রান্স পরীক্ষার পূর্বে বিনা পারিশ্রমিকে বিশেষ পাঠ দিয়েছেন তাঁর প্রতি উচ্ছ্বসিত কৃতজ্ঞতা নিবেদন করছেন সুনীতিকুমার। ইউরোপে গ্রিয়ার্সনের আনুকূল্যে ভারত সরকারের দেওয়া দু’বছরের বৃত্তিতে সরাসরি ডি লিট করতে পেরেছেন এ কথা বারে বারে বলেছেন। বাল্যে মোতিশীল অবৈতনিক বিদ্যালয়ে না পড়তে পারলে তাঁর লেখাপড়াই হত না। এ প্রসঙ্গে বারংবার ওই স্কুল কর্তৃপক্ষের উদ্দেশে কৃতজ্ঞ শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। প্রতিষ্ঠিত জীবনে প্রয়োজনীয় কাজ ফেলে রেখে পুরনো স্কুলের পারিতোষিক বিবরণী সভায় সভাপতিত্ব করতে যান এবং তখন প্রকাশ্য সভায় অকুণ্ঠ ভাবে বাল্যের সেই অপরিশোধ্য ঋণ স্বীকার করেন। মামাবাড়ির নিতান্ত সাধারণ ‘মানি কাকা’র স্মৃতি কখনও ভোলেননি; ভোলেননি তার একটি কারণ বিশেষ ভাবে মনে রাখবার মতো কোনও গুণই ছিল না এই নেপথ্যচারী নিরীহ, নিরভিমান, সেবাব্রতী মানুষটির। স্বতন্ত্র একটি প্রবন্ধে তিনি ‘মানি-কাকা’কে অমর করে গেছেন। কারণ, এই ধরনের মানুষ বস্তুত পাদপ্রদীপের আলো পায় না, কিন্তু এরাই বাসুকির ফণার মতো সংসারটাকে মাথার ওপরে ধারণ করে থাকে বলে সংসার মসৃণ গতিতে চলে। তাঁর বাল্যস্মৃতিতে এমনি অনেক আপাততুচ্ছ মানুষের কথা পাই। পাই সহপাঠী কিশোর গোরার কথা, যে তাঁর সামনে রবীন্দ্রসাহিত্যের দ্বারমোচন করে।
আবার প্রতিষ্ঠিত মনীষী বা অন্য ভাবে কৃতী পুরুষদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা নিবেদন করে তিনি আনৃণ্য অর্জন করেছেন। এঁদের মধ্যে যেমন ব্যাস-বাল্মীকি-হোমারের প্রতি তাঁর লেখায় প্রণতি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ভাবে পাওয়া যায় তেমনই পাই সোক্রাতেস-আলেকজান্ডার-শিবাজী- মহাবীর-নানক-গুরু গোবিন্দ সিং-তানসেন-নামদেব-চৈতন্য-বুদ্ধ-অতীশ দীপঙ্কর-মহাবীরের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি। ঈসকিলাস, গ্যেটে, অলবিরুনী ও রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ ও রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী সম্বন্ধে বিভিন্ন প্রবন্ধে ঋণ ও শ্রদ্ধা স্বীকার করেছেন। যেমন করেছেন উদারচেতা দারা শিকোহ অথবা দরাপ খাঁ গাজী সম্বন্ধে, যাঁর উদারতা তাঁকে সংস্কৃত শ্লোকে ভারতবর্ষের নানা ঐতিহ্যের দিক বিবৃত করতে প্রবৃত্ত করেছিল। জন বীমস, উইলিয়াম জোনস, গ্রিয়ার্সন, এডওয়ার্ড ডেনিসন রস, ঝ্যুল ব্লখ, ডেভিড জোনস, মনোমোহন ঘোষ এঁদের উদ্দেশে নিবেদিত প্রবন্ধগুলিতে আছে গুরুতর্পণ; আর ভূদেব মুখোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্ৰ, মধুসূদন, ঈশ্বর গুপ্ত সম্বন্ধে প্রবন্ধগুলিতে পাই সশ্রদ্ধ মূল্যায়ন। সমকালীন বহু মনস্বী ও কৃতী ব্যক্তি সম্বন্ধে তিনি নিবন্ধ রচনা করেন যাঁদের প্রতিভার ক্ষেত্র ছিল বিভিন্ন প্রকারের। যেমন গান্ধী, সুভাষচন্দ্র, অ্যালবার্ট শোয়াইত্জার, রাধাকৃষ্ণন, পূরণচাঁদ নাহার, হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, শিশির ভাদুড়ি, প্রিয়রঞ্জন সেন, প্রবোধচন্দ্র বাগচী, প্রবোধচন্দ্র সেন, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজশেখর বসু, গুরুসদয় দত্ত, গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, অক্ষয়চন্দ্র সরকার, বটুকনাথ ভট্টাচার্য, বটকৃষ্ণ ঘোষ, হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, সতীশচন্দ্র রায়, খান আবদুল গফফর খান, রবীন্দ্রনাথ মৈত্র, সজনীকান্ত দাস, জগদানন্দ রায়, সিগমুন্ড ফ্রয়েড, প্রভৃতি। এঁদের মধ্যে কেউ সংগীতে কেউ চিত্রশিল্পে, কেউ ধ্যানে কেউ বা জ্ঞানে, কেউ সাহিত্যে কেউ বিজ্ঞানে, কেউ সমাজ সেবায়, কেউ মনস্বিতায়, কেউ দর্শনে, পালি-প্রাকৃত-চীনা সংস্কৃতিতে, কেউ বৈদিক সংস্কৃতিতে, কেউ বা জৈন সংস্কৃতিতে আপন বৈশিষ্ট্যের চিহ্ন রেখে গেছেন। সুনীতিকুমারের সর্বধর প্রতিভা সকলকে সানন্দে অভিবাদন জানিয়েছে মণ্ডনধর্মী রচনায়, খণ্ডনধর্মী সমালোচনায় নয়। তিনি বলতেন যা অকিঞ্চিৎকর, তা মহাকালের ধোপে টিকবে না; কিন্তু যার মধ্যে যেটুকু স্থায়ী পদার্থ আছে তার উপর আলোকপাত করে তাকে সমকালীন মানুষের কাছে পরিচিত করার একটা দায়িত্ব থাকে। এমনিভাবেই আবিষ্কার করেন মণিপুরপুরাণ রচয়িতা আতোম্বাপু শর্মাকে, এবং তাঁকে বাঙালির সামনে আনেন প্রবন্ধের মধ্যে। তাঁর এই ধরনের গুণগ্রাহী প্রবন্ধের সংখ্যা অনেক।
শ্রদ্ধাষ্পদদের মধ্যে আছেন শিখগুরুরা। শিখ ধর্ম সম্বন্ধে সুনীতিকুমারের বিশেষ আগ্রহের হেতু সম্ভবত শিখদের অসাম্প্রদায়িকতা, উচ্চনীচরহিত সমাজবিন্যাস, ধর্মের কেন্দ্রে একটি গ্রন্থ— গ্রন্থসাহেব-এর সম্মানিত আসন এবং তাঁদের চমৎকার ধর্মসংগীত। যে-সামাজিক রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে শিখধর্মের অভ্যুত্থান তা-ই যেন প্ররোচিত করেছিল বীরত্বের সমাদরে; এর পৌরুষ ও স্বাদেশিকতার দিকটিও তাঁকে বিশেষ ভাবে আকর্ষণ করত, এ কথা তিনি বারে বারে বলেছেন। গুরু নানকের জন্মতিথি রাসপূর্ণিমা তাঁরও জন্মতিথি, এ কথা প্রায়ই তিনি সানন্দে বলতেন।
বিভিন্ন বিষয়ে সুনীতিকুমারের গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনার সংখ্যা যেমন বিস্ময়কর, তেমনই বিস্ময়কর তাঁর রচনার বিষয়বৈচিত্র্য। এই স্বল্প পরিসরে সমগ্র পরিচয় দেওয়া সম্ভব নয়; সামান্য কিছু উল্লেখ করা যায় মাত্র। ব্যাকরণ, বানান, পরিভাষা থেকে আসেন ভাষাতত্ত্ব ও ভাষাবিজ্ঞানের নানা বিচিত্র অংশ সম্বন্ধে আলোচনায়। ব্যাকরণ শুধু বাংলার? হিন্দি, মৈথিলি আবধি এবং প্রসঙ্গত আরও অন্যান্য ভাষারও। তেমনই ভাষাতত্ত্বে তাঁর মুখ্য চর্চাকেন্দ্র বাংলা হলেও ভারতের সব কটি ভাষা ও সাহিত্য সম্বন্ধেই তিনি শুধু আগ্রহীই ছিলেন না, সেগুলি সম্বন্ধে যথেষ্ট অধ্যয়ন করে জ্ঞান অর্জন করেছেন। ভাষা, সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য, লোকাচার, ধর্মচিন্তা, জীবনধারা জানতে তিনি বারংবার পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পরিক্রমা করেছেন জ্ঞান ও মননের জগতে তাঁর আনাগোনা ছিল ভারতবর্ষে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা, গুজরাত থেকে আসাম; তাঁর চর্চায় স্থান পেয়েছে দ্রাবিড়, ওড়িশা, নেপাল, মণিপুর, রাজস্থান, পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্র— এ সব অঞ্চলের সম্বন্ধে তাঁর আগ্রহ ও জ্ঞান দুই-ই তাঁকে জাতীয় অধ্যাপকের মর্যাদায় স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। এ ছাড়াও তিনি বিশেষ প্রণিধান করে জ্ঞান আহরণ করেছেন ভারতের আদিবাসী কোল, সাঁওতাল, মুণ্ডা, অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় সভ্যতা সম্বন্ধে। কিরাতজনকৃতি-তে শুধু আসাম মণিপুর নয়, সম্পূর্ণ উত্তর-পূর্ব ভারতে দূরপ্রাচ্য থেকে যে মোঙ্গোলীয় সভ্যতার অনুপ্রবেশ ঘটেছিল তার গতি, প্রকৃতি, সাংস্কৃতিক দান সম্বন্ধে সম্যক বিস্তৃত আলোচনা তিনিই প্রথমবার করলেন। এবং করলেন কিরাতজনকে উপযুক্ত মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখে। মনে রাখতে হবে, সুনীতিকুমার তাঁর গবেষণা শুরু করেন ইন্দো-আর্য ভাষাগোষ্ঠী অবলম্বন করে। এ কাজ যাঁরা করেন তাঁরা সচরাচর ওই ভাষাগোষ্ঠীর বাইরের ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে কতকটা অবজ্ঞার ভাব পোষণ করেন। এ কথা ঠিক যে, পৃথিবীর সংস্কৃতি ভাণ্ডারে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষী জাতিগুলির দান পরিমাণে এবং গুণগত ভাবে অত্যন্ত সমৃদ্ধ— সাহিত্যে, শিল্পে, ভাস্কর্যে, স্থাপত্যে, সংগীতে, চিত্রকলায়, দর্শনে, ধর্মচিন্তায় এঁদের কীর্তি সুদীর্ঘকাল পৃথিবীর মানুষের কাছে বিশেষ সমাদৃত। সেই পরিবেশে যাঁর মন গড়ে উঠেছিল তাঁর পক্ষে কিরাতজনের কৃতি সম্বন্ধে আগ্রহী হওয়াই এক বিস্ময়কর ব্যাপার।
দুটি ব্যাপারে তাঁর এ আগ্রহ পুষ্টি লাভ করে। প্রথমত ওই সময়টা নৃতত্ত্বের নানা দিকের চর্চায় নানা গোষ্ঠীর মানুষের কৃতি উদ্ঘাটিত হচ্ছিল, পুরাকীর্তিও দেখা দিচ্ছিল প্রত্নতাত্ত্বিকের গবেষণায়, ফলে গোষ্ঠী-নিরপেক্ষ ভাবে মানুষের কীর্তি ধীরে ধীরে সম্মানের দাবি করছিল। এবং এ বিষয়ে ভারতবর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টিকে উপযুক্ত মর্যাদা দেওয়ার কৃতিত্ব সুনীতিকুমারেরই। দ্বিতীয়ত, তাঁর বিশ্বপর্যটন তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল পৃথিবীর বহু অপরিচিত প্রান্তে, তথাকথিত আর্যগোষ্ঠীর সীমানার বাইরে। বাইরে ক্ষীণদৃষ্টি এ মানুষটির অন্তশ্চক্ষু এতই তীক্ষ্ণ ছিল যে তিনি সেই সব ‘ব্রাত্য’ জাতির সান্নিধ্যে এসে ‘আর্যামি’র সংকীর্ণতা আর রাখতে পারেননি। তাদের জীবনবোধ, জীবনধারা দুই সম্বন্ধেই তাঁর একান্ত আগ্রহ এক নতুন জগতে তাঁকে দাঁড় করিয়ে গেল যেখান থেকে শেখবার বোঝবার অনেক কিছু আছে। অস্ট্রিক, দ্রাবিড় ও আর্যদের তুলনায় তিব্বতি গোষ্ঠীর এই কিরাতজনের দান ভারতীয় সংস্কৃতিতে অপেক্ষাকৃত স্বল্পভার; তবু দীর্ঘকালের সাযুজ্য আর্য ও কিরাতদের বাধ্য করেছিল কিছু দেওয়া নেওয়ায়। এ গ্রন্থে তারই পরিচয়।
মানবিক কোনও কিছুই তাঁর সাধনার বাইরে নয়। তাঁর চোখে ভারতীয় সংস্কৃতি শুধু আর্য নয়, বহু বিভিন্ন উপাদানে গঠিত; তার কোনওটিই উপেক্ষা করা যায় না। শ্রদ্ধার দৃষ্টি একমাত্র যথার্থ দৃষ্টি— এ বোধ তাঁকে অনুপ্রেরিত করত এ ধরনের আলোচনায়। এই দৃষ্টিতে তাঁর নিজের দেশের ও বিদেশের সমস্ত সভ্যতা সংস্কৃতিকে তিনি সম্মানের চোখে দেখতে শিখেছিলেন, কোনওটিকেই তাচ্ছিল্য বা অবজ্ঞা করতে পারতেন না। দূর প্রাচ্য পরিভ্রমণ করেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে; শ্যাম, বালি, জাভা, সুমাত্রা ও ইন্দোনেশিয়া সম্বন্ধে প্রচুর পড়াশোনা করে যাত্রা করেছিলেন। এ তাঁর স্বভাবসিদ্ধ গুণ; বোম্বাই গেলেও যেমন বলিভিয়া গেলেও তেমনি; পূর্বাহ্নে, যথোপযুক্ত পড়াশোনা করে, মানসিক প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করে আরব, তুর্কি ও ইরানীয় সভ্যতার বিশিষ্ট চরিত্র ও মানবসভ্যতায় তাদের বিশেষ দানগুলি জেনে নিয়ে নূতনতর তত্ত্ব আহরণ করে দৃষ্টিভঙ্গির পরিমার্জনা করেন। ইরানিয়ানিজম গ্রন্থে ইরান সম্বন্ধে তাঁর বক্তব্য বিধৃত আছে। চিন জাপানেও একাধিকবার যান সে সভ্যতাকে কতক জেনে, কতক আরও জানবার জন্যে। আফ্রিকা, যেখানে কম ভারতীয়ই সশ্রদ্ধ ভাবে যায়, সেখানে তিনি গভীর আগ্রহে তাঁদের জীবনযাত্রা ধর্ম সংস্কৃতি ও শিল্প সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করে আসেন; ত্রিপোলি, ঘানা, য়োরুবা, ইথিওপিয়া, প্রভৃতি অঞ্চলগুলি সম্বন্ধে প্রবন্ধ রচনা করেন। পুরো মহাদেশকে যে-চোখে দেখেন তা ধরা পড়ে তাঁর অ্যাফ্রিকানিজম: দি আফ্রিকান পার্সোনালিটি বইতে। শ্বেতাঙ্গসুলভ অবজ্ঞার দৃষ্টিতেই ঔপনিবেশিক মানুষ আফ্রিকাকে দেখতে অভ্যস্ত ছিল; সুনীতিকুমারের শিক্ষাদীক্ষাও এই আবহাওয়াতেই; কিন্তু তাঁর দৃষ্টিতে কোথাও আফ্রিকার মানুষ ঊনমানবরূপে দেখা দেয়নি— এ বইতে এই জিনিসটি বিশেষ ভাবে মুগ্ধ করে। তিনি বিশিষ্ট এক সভ্যতার ধারক হিসেবেই তাঁদের দেখেছেন এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে চিত্রিত করেছেন। মোঙ্গোলিয়াও তাঁর দৃষ্টিতে ধরা দিয়েছে তার আপন সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য নিয়ে। নানা উপলক্ষে বারবার ইউরোপে গেছেন সুনীতিকুমার। প্রথমে ছাত্ররূপে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স, পর্যটকরূপে গ্রিস ও ইটালি। পরে বারবার নানা উপলক্ষে আমন্ত্রিত হয়েছেন সভায় সম্মেলনে যোগ দিতে, প্রবন্ধ পাঠ করতে, সভাপতিত্ব করতে। এক দিকে যেমন ইউরোপের প্রাচীন সংস্কৃতি কেন্দ্রগুলি সম্বন্ধে তাঁর কৌতূহল তাঁকে বারবার নিয়ে গেছে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, পোল্যান্ড, চেকোশ্লোভাকিয়া ও সুইডেনে, অন্য দিকে তেমনি অপেক্ষাকৃত স্বল্প পরিচিত আর্মেনিয়া, জর্জিয়া, লাটভিয়া, তবিলিসি ও রোমানিয়া সম্বন্ধে অনুসন্ধিৎসা তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে এই সব দেশে। ঈগরের প্রাচীন গাথার আকর্ষণে গেছেন রুশ দেশে প্রাচীন কবিকে কেন্দ্র করে যে উৎসব তাতে যোগ দিতে। আমেরিকায় গেছেন অধ্যাপনা করতে ফিলাডেলফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯৫১-৫২ সালে)। প্রচুর ঘুরেছেন সে বারে এবং পরেও। কিন্তু তাঁর নিজস্ব আকর্ষণ মুখ্যত দক্ষিণ আমেরিকার মায়া, আজতেক ও ইউকাটান সভ্যতায়; এর জন্যে দক্ষিণ আমেরিকায় তিনি ব্যাপক ভাবে ঘুরে ওই লুপ্ত সভ্যতাগুলির ধ্বংসাবশেষ দেখেন। ওই সব ধর্মের মূল দেবকাহিনিগুলি আগেই পড়া ছিল। এ বারে তাদের রেখে-যাওয়া কীর্তিস্তম্ভ ও প্রত্নবশেষগুলির সঙ্গে সেগুলিকে মিলিয়ে বুঝতে চেষ্টা করেন। ফিরে এসে এ সব নিয়ে প্রবন্ধ লেখেন।
সুনীতিকুমারের ভাষাতত্ত্ব চর্চা তাঁকে প্রধানত নিয়ে গিয়েছিল প্রাচীন সাংস্কৃতিক পীঠস্থানগুলিতে। উপলক্ষ ছিল: তারাস শেভচেঙ্কোর সার্ধশতাব্দী পূর্তি অথবা শোথা রুশতাভেলির গ্রন্থরচনার অষ্টম শতক পূর্তি। এই সব উপলক্ষে রুশ দেশের প্রাচীন অতীত মূর্ত হয়ে উঠত। তেমনই অন্যান্য দেশের ওই ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তাঁর কাছে দূর অতীত স্পষ্ট হয়ে উঠত। পৃথিবীর সকল দেশের প্রাচীনতম মহাকাব্যে তাঁর বিশেষ অধিকার ছিল, উৎসাহ ছিল; সেই সব মহাকাব্যে দেশগুলির প্রথমতম উচ্চারণ নিহিত আছে; তাদেরপ্রথম আশা আকাঙ্ক্ষা স্বপ্নসাধনা ওই আদি মহাকাব্যে একটি চিরন্তন রূপ পেয়েছে। পরবর্তী কালের রচনায় তেমনটি আর হয়নি। ভাষার জন্যে, ভাষাতত্ত্বের জন্যে তো বটেই, আবার সে সব দেশের সংস্কৃতির আদিপর্বের বিশুদ্ধতম যে রূপটি মহাকাব্যগুলির মধ্যে রয়ে গেছে— সে কারণেও সুনীতিকুমারের কাছে সংস্কৃতি ও মহাকাব্যের অঙ্গাঙ্গী যোগটা স্পষ্ট ছিল। এবং এ সবের কেন্দ্রে ছিল মানুষ। ভাষা যে বলেছে সেই মানুষ, স্বপ্ন যে দেখেছে সেই মানুষ, যে স্বপ্নকে মহাকাব্যে রূপ দিয়েছে সেই মানুষ। সব কিছু অন্বেষণার কেন্দ্রে এই মানুষই তাঁর গবেষণার, জিজ্ঞাসার বস্তু। এই জিজ্ঞাসা তাঁকে অতীতে নিবদ্ধ থাকতে দেয়নি, অতীত থেকে বর্তমানে অনবরত সঞ্চরণ করিয়েছে, তাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়েছে পৃথিবীর প্রত্যন্ত প্রদেশে, টেনে নিয়ে গেছে মেক্সিকো থেকে মণিপুর, মস্কো থেকে ম্যানহাটান।
যা কিছু দেখেছেন তা নিয়ে ভেবেছেন। জ্ঞানভাণ্ডারে তাঁর সঞ্চয় এত বিপুল পরিমাণে ছিল যে একটা অভিজ্ঞতার সমান্তরাল বা সংশ্লিষ্ট বহু বিভিন্ন অভিজ্ঞতা অন্তর্নিহিত যোগসূত্রে গ্রথিত হয়ে সংহত রূপ পরিগ্রহ করেছে। এই বার সেগুলি গ্রন্থ বা প্রবন্ধের রূপ পেয়েছে। সুনীতিকুমারের ভাষায় ইংরেজিতে বা কোনও কোনও ক্ষেত্রে বাংলায়ও উনিশ শতকীয় বাক্যগঠন বৈশিষ্ট্য দেখা দিত। যদিও পরবর্তী কালে চলতি বাংলায় লিখতে গিয়ে তিনি উনিশ শতকীয় আড়ষ্টতা ত্যাগ করেন। চলতি বাংলায় তাঁর লেখাগুলিতে এখনও তাঁর কণ্ঠস্বর শুনতে পাওয়া যায়— যেমন জীবন-কথা, পথ-চলতি, বৈদেশিকী, পশ্চিমের যাত্রী, রবীন্দ্র সংগমে দ্বীপময় ভারত ও শ্যামদেশ। এ বাংলা তাঁর শৈশবের শেখা বাংলা, বাড়িতে-বলা বাংলা; এ বাংলা শুধু পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট বাগ্ধারা-সমন্বিত নয়, এর উপমা, রূপক, অনুকারী অব্যয়, বাক্যবিন্যাস সবই উত্তর কলকাতার আড্ডার বাংলা যার সঙ্গে শুদ্ধ লিখিত বাংলার বহু যোজন ব্যবধান। এই রচনাগুলি তাই ব্যক্তির বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল, এর সঙ্গে মিল রাজশেখর বসুর বাংলার এবং উত্তর কলকাতার শিক্ষিত ব্যক্তির চলিত আড্ডার বাংলার। বেশ বুঝতে পারা যায় স্কুলে কলেজে, ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে, শনিবারের চিঠি-র দফতরে এই বাংলার জীবন্ত অভিব্যক্তি বহু বৎসর ধরে ক্রমে ক্রমে তাঁর ব্যক্তিত্বের গভীরে কোন রসায়নে এক বিশেষ রূপ পরিগ্রহ করে। এই ‘কলকাত্তাই’ বাংলায় নানা গ্রন্থ রচনা করে তিনি একে সাহিত্যে যেন একটি স্থায়ী আসন দিয়ে গেলেন।
বাংলায় না লিখলেও তাঁর চলত। ইংরেজিতে লিখেই তিনি ও-ডি-বি-এল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই যশস্বী হয়েছিলেন। ইংরেজিতে যা তিনি লিখেছিলেন তার সুবাদেই বৃহৎ পৃথিবীর বিদ্বজ্জন তাঁকে চিনেছিল। তবু তিনি বাংলায় লিখেছিলেন বিস্তর এবং এর মধ্যে মনে হয় তাঁর দেশসেবার প্রেরণা ছিল। তিনি যা জেনেছেন ভেবেছেন তা তিনি দেশবাসীকে উপহার দিতে চেয়েছিলেন তার মাতৃভাষায়।
যদিও তাঁর শতকরা নব্বই ভাগ লেখার বিষয়ই তথ্যে ও আলোচনায় গম্ভীর, তথাপি সুনীতিকুমারের লেখায় একটি বিশেষ সদগুণ হল তাঁর রসবোধ। নানা অভিজ্ঞতার মধ্যে কিছু কিছু হাসির ব্যাপার এলে উনি তৎক্ষণাৎ সেটিকে হাস্যরসে রঞ্জিত করে পরিবেশন করতেন, আলাপে ও রচনায়। আরও উপভোগ্য হত এই কারণে যে তিনি নিজেকে নিয়ে হাসতে জানতেন। পাণ্ডিত্যের ভার তাঁকে কখনওই গুরুগম্ভীর করে তোলেনি। বহু প্রত্যক্ষদর্শীর কাছে নানা বিষয় নিয়ে পরিহাস করতে জানতেন। ইংরেজিতে দুটি প্রবন্ধ আছে, ‘কলকাতার ছাত্রজীবন’ও ‘কলকাতার হোস্টেল জীবন’ নিয়ে। তার মধ্যে তথ্য সবই আছে, তবে অনেকটাই আছে হাস্যরসে সিক্ত, তাই আরও উপভোগ্য। সংস্কৃত অলংকার শাস্ত্রে বলে হাস্যরসের বর্ণ শুভ্র। হাসির উপাখ্যান বলার পর ওঁর প্রাণখোলা হাসি দেখে এ কথার সত্যতা বোঝা যেত। নানা হাসির গল্পের সঞ্চয় ছিল তাঁর। একটা বলতেন, যুদ্ধক্ষেত্রে তরুণ সৈনিকের মৃত্যুর পর সেনাপতি খোঁজ করলেন সদ্যবিধবার কাছে কে গিয়ে যথাসম্ভব কোমল ভাবে খবরটা দিতে পারবে। একজন রাজি হল। সে মৃত সৈনিকের পাড়ায় উচ্চৈঃস্বরে খোঁজ করতে লাগল, ‘Does Peter Walter’s widow live here? মৃতের স্ত্রী বেরিয়ে এসে বলল, আমি তাঁর স্ত্রী’। ‘O, I tell you, you are no longer his wife, you are now his widow, for, he died on Monday.’ এমনি নানা গল্প বলতেন। সাধারণত সুনীতিকুমারের পরিহাসগুলি নির্মল হাস্যরসে ভরা, তাতে ব্যঙ্গ বিদ্রূপের পরিবর্তে থাকত বুদ্ধিদীপ্ত শাণিত উক্তি অথবা থাকত ঘটনাগত হাস্যরস কিংবা অস্থানে মূর্খতার বা দাম্ভিকতার অপপ্রকাশ