জাগতিক বাধা ও অবাধ বিদ্যাভ্যাস

জাগতিক বাধা ও অবাধ বিদ্যাভ্যাস

মাঝে মাঝেই বলতেন, ‘আমাকে আপনারা ভুলতে পারবেন না, আমাকে অমর করে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ’। জিজ্ঞাসু চোখে তাকালে বলতেন, ‘কেন, সেই যে শেষের কবিতা-য় অমিত শিলং যাওয়ার সময়ে অন্য বই নিলে না, পড়তে লাগল সুনীতি চাটুজ্জের বাংলা ভাষার শব্দতত্ত্ব, লেখকের সঙ্গে মতান্তর ঘটবে এই একান্ত আশা নিয়ে।’ বলে হাসতেন। যেন এ ছাড়া অমরতার জন্য দাবি তাঁর ছিল না! অন্য একটি কথাও ছিল, সব দাবির স্বীকৃতি বিধৃত রইল ওঁর প্রিয় কবির একটা পরিহসিত উক্তির মধ্যে, এটাও ওঁকে তৃপ্তি দিত।

অমরতার দাবি? জন্মেছিলেন কেরানির সন্তান হয়ে নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরে।` বাল্যের পোলিও যদি বা সারল, খুঁত রেখে গেল দৃষ্টিশক্তিতে, এর জের চলল সারাজীবন। একমাত্র এবং শেষ অস্ত্রোপচারও ওই চোখেই। আর্থিক অবস্থা খারাপ ছিল বলে সব ভাইয়েরা মোতিলাল শীলের অবৈতনিক বিদ্যালয়ে পড়তেন। অভাবের দরুন মাতৃশ্রাদ্ধ অতি দরিদ্র ভাবে সম্পন্ন হয়েছিল। আহার যৎপরোনাস্তি সাধারণ, বেশবাসও তথৈবচ, ছাতা জুতোর বাহুল্য সে অবস্থায় অকল্পনীয়। উত্তরাধিকার সূত্রে জ্যেষ্ঠের পরিত্যক্ত বস্ত্র দিয়ে কনিষ্ঠের লজ্জানিবারণ হত। নিতান্ত দুর্দিনে কেরোসিনের খুচরো ব্যবসা করে সংসারের অভাব মোচনের ব্যর্থ চেষ্টা— এর কোনও স্মৃতিই তিনি ভোলেননি, অসংকোচে বহুজনকে বারবার বলেছেন।

বলতে পেরেছেন তার কারণ এ দারিদ্র্য ছিল তাঁর বহিরঙ্গ, অন্তরে ছিল অপর্যাপ্ত ঐশ্বর্যের সম্ভার। বিদ্যায় বুদ্ধিতে সহপাঠীদের সকলের উপরে ছিল তাঁর স্থান। ক্লাসে বয়ঃকনিষ্ঠ এই বালকটি আপন মেধায় সহজেই সকল শিক্ষকের স্নেহভাজন হয়েছিলেন। পাঠশালায় ক’ মাস দাগা বুলোনোর পরে প্রথমে ক্যালকাটা অ্যাকাডেমি ও পরে মোতিলাল শীলের ফ্রি স্কুলে পড়াশোনার সূত্রপাত। স্কুলে পড়ার সময়ে কয়েকটি বিষয়ে স্থায়ী তাৎপর্যপূর্ণ অভিজ্ঞতা তাঁর ঘটে। গোড়াতেই বিবেকানন্দের রচনা ও চিন্তার সঙ্গে পরিচয়; বিবেকানন্দের রচনার স্বাদেশিক আত্মনির্ভরতা ও ওজস্বিতা এই কিশোরকে অভিভূত করে। কিছু পরে স্কুল থেকে ফেরবার সময়ে ওয়াই এম সি এ-র সংস্পর্শে এসে নানা বিষয়ের বইয়ের সঙ্গে পরিচয়; সেই সঙ্গে ব্যায়ামের সুযোগ ও কিছু উদারচেতা আদর্শবাদী খ্রিস্টান নেতার সান্নিধ্যে এসে অন্য এক ধরনের জীবনবোধের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটল।` এতে তাঁর মানসিক দিগন্ত কতকটা প্রসারিত হল। তৃতীয় অভিজ্ঞতা হল স্কুলের পর হেদুয়ার গড়ানে ঘাসের ওপর শুয়ে আকাশের দিকে চেয়ে শান্তিনিকেতন থেকে আসা গৌরমোহন গুপ্ত-র আবৃত্তিতে চিত্রা, মানসী, প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের স্বাদ গ্রহণ। তাঁর সামনে নতুন একটা জগৎ খুলে গেল, এ সব কবিতার অনুরণন রইল সারাজীবন। শেষ যে অভিজ্ঞতাটি এই কিশোরের অন্তর্লোককে স্থায়ী ভাবে প্রভাবিত ও সমৃদ্ধ করেছিল তা হল, অবনীন্দ্রনাথের চিত্রপ্রদর্শনী। তখন অবনীন্দ্রনাথের ছবিতে সম্পূর্ণ ভারতীয় এক শৈলীর আবিষ্কারে এবং ভারতীয় পৌরাণিক বিষয়বস্তুর স্বাধীন ও রসোত্তীর্ণ চিত্রায়ণে দেশের চিত্রজগতে যুগান্তর এসেছে। চিত্ররসতৃষ্ণার্ত এই তরুণটি মুগ্ধ নেত্রে বারে বারে ছবিগুলি দেখতেন ও অন্তরস্থ করতেন। এই নতুন অভিজ্ঞতার সূত্রে তিনি নিজেও সারাজীবনই মাঝে মাঝে ছবি এঁকেছেন, ঋজু স্পষ্ট অভ্রান্ত রেখায় আঁকা সে সব ছবিতে আছে যথেষ্ট প্রাণের ঐশ্বর্য, গতিবেগের প্রাচুর্য। পরে শিশির ভাদুড়ির নাটকে গ্রিক চরিত্রের পরিধেয় বেশ ঠিক কেমনটি হবে সে সম্বন্ধে সুনীতিকুমার ছবি এঁকে নির্দেশ দিয়েছেন। নিখুঁত ছিল সেই নির্দেশ, কারণ তখন তিনি গ্রিক সাহিত্য পড়ছেন এবং প্রণিধান করে আহরণ করেছেন গ্রিক বেশভূষার অনুপুঙ্খ। কৈশোরেই দেশ সম্বন্ধে গর্ববোধ, কর্মনিষ্ঠা ও আত্মসংস্কৃতির নির্দেশ পান বিবেকানন্দের বাণীতে; উদার সংস্কারমুক্ত প্রীতিনিষ্ঠ জীবনদর্শন লাভ করেন ওয়াই এম সি এ-র সংস্পর্শে এসে; অন্তরের গভীরতম আবেগের উন্মোচন ঘটে রবীন্দ্রকাব্যের ধারায় অবগাহন করে; দৃশ্যজগতের রসোত্তীর্ণ মহিমা তাঁর সামনে রূপায়িত হয় অবনীন্দ্রনাথের চিত্রকলার প্রভাবে। কৈশোরে লব্ধ এ ক’টি ঐশ্বর্যের উত্তরোত্তর বিকাশ ঘটতে থাকে পরবর্তী জীবনে— মনন, সংস্কারমোচন, সাহিত্যরস ও রূপোপলব্ধিতে।

১৯০৭ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় ষষ্ঠ স্থান অধিকার করে বৃত্তিভোগী ছাত্ররূপে স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হন। এখানে অধ্যাপকদের মাধ্যমে পাশ্চাত্য সাহিত্য ও চিন্তাধারার সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয় ঘটে। আবার এই সময়েই স্বাধীন ভাবে বিকাশ ঘটে তাঁর চিত্তের। গ্রিক, ল্যাটিন, ফরাসি, জার্মান, হিন্দি, ওড়িয়া, অসমিয়া ও তামিল ভাষাগুলি সম্বন্ধে প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করেন প্রধানত নিজেরই অদম্য অধ্যবসায়ে। সাহেব অধ্যাপকরা সাহায্য করেছিলেন পাশ্চাত্য সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর পরিচয় গভীরতর করতে। ততদিনে বইয়ের দোকানে অহরহ হানা দেওয়ার অভ্যাস জন্মে গিয়েছিল। ভাষা ও শব্দের ব্যুৎপত্তি সম্বন্ধে কৌতূহল ছিল আজন্মকাল, এই বারে সুযোগ মিলল তা নিয়ে চর্চা করবার। গভীর নিষ্ঠায় এ পাঠ চলল, নিরবচ্ছিন্ন ভাবে। এ সময়ে সংসারে অভাব, ছোট ছোট ভাইবোনেরা মাতৃহীন সংসারে মানুষ হচ্ছে, নানা রকম অসুবিধে, বৃদ্ধ পিতামহ পিতামহী, একা পিতার উপার্জনে আর কুলোয় না। বৃত্তির কিছু অংশ সংসারের অভাব মোচনে দিতে হয়, সামান্যই হাতে থাকে। তা সত্ত্বেও ৬৪ নং সুকিয়া স্ট্রিটের খোলার চালের বাড়ির বাসিন্দা এই ক্ষীণদৃষ্টি কিশোরের অন্তর গভীর বিদ্যোৎসাহে মথিত হত বলে তিনি এত বিচিত্র বিষয়ে এমন ব্যাপক ও গভীর ভাবে মনঃসংযোগ করতে পেরেছিলেন। বৈচিত্র্য কি কম? অভিনয় দেখেন সোৎসাহে; ছবি দেখেন দেশের বিদেশের— প্রদর্শনীতে ও অ্যালবামে; পৃথিবীর সমস্ত দেশের সাহিত্য পড়েন গভীর আগ্রহে— বিশেষত মহাকাব্যে তাঁর অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা; এরই সঙ্গে চলছে ইতিহাসচর্চা, যে ইতিহাসের সীমা দেশ-কালকে ছাড়িয়ে যায়। এবং ভাষাতত্ত্বের দুরূহ দিকটার চর্চা চলছে আপন মনে, একক চেষ্টায়। অত্যন্ত দুরূহ পরিশ্রমের ফলেই এতগুলি ক্ষেত্রে এত স্বচ্ছন্দ ভাবে বিচরণ করা সম্ভব হয়েছিল। যে বিষয় তাঁকে আকর্ষণ করত তাতে তাঁর যে অভিনিবেশ এবং তপস্যা তা যাঁরা তাঁকে নতুন ভাষা আয়ত্ত করতে দেখেছেন তাঁরাই জানেন। সবচেয়ে বড় কথা, কোথাও মাঝপথে থামার ধাত তাঁর ছিল না। ইহাসনে শুষ্যতু মে শরীরম্’— এই রকম সংকল্প নিয়ে শুরু হত সাধনা এবং চলত মাস বছর ছাপিয়ে। ক্লান্তি আসত না, কারণ এ সাধনার স্তরে স্তরে লগ্ন ছিল আনন্দ। এবং সে আনন্দের উৎস ছিল একটি বোধে: ভাষাই হোক, সাহিত্যই হোক, চিত্রই হোক, ভাস্কর্য স্থাপত্য বা সংগীতই হোক, সব কিছুর মধ্যে দিয়ে যার সাধনা চলত সে হল মানুষ। মানবিক কোনও কিছুই তাঁর জগতে অবান্তর ছিল না। মানুষকে দেখতে চাইতেন তার ভাষার ব্যবহারে, সাহিত্য শিল্পসৃষ্টিতে, তার চিন্তামননের ঐশ্বর্যে। এই মানুষকেন্দ্রিকতাই তাঁর বহু আপাতশুষ্ক ও কঠিন সাধনায় রসের জোগান দিত। হয়তো তা আইরিশ সাহিত্য বা ইন্দোনেশিয়ার শিলালিপি বা ভাষাতত্ত্বের গাণিতিক ব্যাখ্যা কিংবা মিশরের ইতিহাসের কোনও নতুন তথ্য নিয়ে দুরূহ চেষ্টার প্রহরে জিজ্ঞেস করেছি— ‘কেন পড়ছেন এটা?’। সর্বদাই একটি স্মিতহাস্যমণ্ডিত উত্তর পেয়েছি, ‘স্বান্তঃ সুখায়’। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে ভেবেছি, কেমন সে অন্তর, জ্ঞানের জগতে যা আবির্ভূত হয়েছে গরুড়ের মতো সর্বগ্রাসী ক্ষুধা নিয়ে? অল্পে তার সুখ নেই

সৌভাগ্যের বিষয়, কলেজে ছাত্রাবস্থায় কয়েকজন বিদ্বান অধ্যাপকের সংস্পর্শে এসেছিলন— আর্কহার্ট, স্টিভন, স্ক্রিমজর, টমোরি ও ক্যামেরনের কাছে পাঠ নিতেন। এ ছাড়াও পরে অধ্যাপনায় এলেন ওয়ান ও ঈভলীন এভান্স। এঁদের মধ্যে আর্কহার্ট ও স্টিভন বিশেষ প্রতিষ্ঠা লাভ করেন বহুমুখী পাণ্ডিত্যের জন্য। অন্যেরাও নিজের নিজের বিষয়ে কৃতবিদ্য ছিলেন। অধ্যাপক অধরচন্দ্র মুখোপাধ্যায় (ইতিহাস), বরুণচন্দ্র দত্ত (রসায়ন), মন্মথনাথ বসু (বাংলা) এবং নন্দলাল বিদ্যাবিনোদ ও বিহারীলাল বন্দ্যোপাধ্যায় (সংস্কৃত) পাঠ দিতেন। সসম্মানে ফার্স্ট আর্টস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সুনীতিকুমার বিএ পড়বার জন্যে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন সাম্মানিক ইংরেজি নিয়ে। বিএ পড়বার সময়ে বিশ্রুত ও বিদগ্ধ অধ্যাপকদের সান্নিধ্যে তাঁর চিন্তার ও জ্ঞানের পরিধি পাঠ্যতালিকার পরিধি ছাপিয়ে বহুদূর বিস্তৃত হয়। প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপকদের মধ্যে পান এইচ এম পার্সিভাল, বিনয়েন্দ্রনাথ সেন, মনোমোহন ঘোষ এবং প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষকে। এই সময়ে গ্রিক ভাষা ও সাহিত্য একান্ত নিষ্ঠার সঙ্গে চর্চা করেন, ল্যাটিন ভাষা ও সাহিত্যও গভীর ভাবে পাঠ করেন। ভাষাতত্ত্বে আগ্রহ থাকার ফলে গ্রিক-ল্যাটিন আবার হিন্দি-ওড়িয়ার মতো যে সব নতুন নতুন চর্চায় প্রবেশ করেন সেগুলি তাঁর দৃষ্টিতে ক্রমে পরস্পর অন্বিত এক বোধ স্পষ্ট করে গেলে। মূলত ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলির সঙ্গে বিশেষ পরিচয় এই পর্বে। কলেজের মুখ্য পাঠ্য ইংরেজিকে কেন্দ্রে রেখে এই সব প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলিকে উৎসরূপে বিচার করেন। সঙ্গে সঙ্গে চলে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের গভীরে প্রবেশ। তামিল চর্চা ও সে-সাহিত্যে উৎসাহের উদ্রেকও এই সময়েই ঘটে। ছবি আঁকতেন মনের খেয়ালে; তামিল পুরাকাহিনির একটি ছবি এই সময়কার। গ্রিক সাহিত্যের উপাদান অবলম্বনে কয়েকটি রেখাচিত্রও আঁকেন তখন। নাটকের অভিনয় দেখতে বরাবরই উৎসাহ ছিল। এই সময়ে ও পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ পড়ার সময়ে থিয়েটারে অভিনয় না করলেও শৌখিন নাট্যাচর্চার সঙ্গে সহযোগিতা ছিল। শিশিরকুমার ভাদুড়ির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বও এই থিয়েটার-প্রীতির সূত্র ধরেই।

১৯১১ সালে ইংরেজি অনার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান নিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে ওই বিষয় নিয়েই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ ক্লাসে ভর্তি হন। এ বার আর শুধু ইংরেজি নয়, নানা ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে যে আগ্রাসী ক্ষুধা তাঁর জেগেছে তার যতগুলি পারা যায় সব ক’টির চর্চাতেই আত্মনিবেশ করেন। তাই প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ইংরেজি, জার্মানিক এবং ভাষাতত্ত্ব (যা ইংরেজির ‘বি গ্রুপ’ নামে পরিচিত) নিয়ে পড়েন। লাইব্রেরিতে দীর্ঘকাল কাটত, আর নিয়মিত যাতায়াত ছিল বইয়ের দোকানগুলিতে। বহু দুর্লভ গ্রন্থ এই সময়ে পুরনো বইয়ের দোকান থেকে সংগ্রহ করেন। এম এ-তেও প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে উত্তীর্ণ হন ১৯১৩ সালে। গভর্নমেন্ট সংস্কৃত অ্যাসোসিয়েশন থেকে বেদের ‘আদ্য’ এবং ‘মধ্য পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হন, মধ্য পরীক্ষা দিয়েছিলেন ১৯১৮ সালে। এই সময়েই বেদকে বুঝতে চেষ্টা করেন ভাষাতত্ত্বের দৃষ্টিতে। আদ্য মধ্যের দাবি ছাড়িয়ে, নিজের তাগিদে নিরুক্ত-পাণিনি – পতঞ্জলির সঙ্গে এসে যুক্ত হল দুটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি: পাশ্চাত্য ভাষাতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ এবং ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে। তখনকার কালে এ দেশে খুব কম বেদজ্ঞ পণ্ডিতেরই বেদচর্চার পরিধি এত বিস্তৃত ছিল। এই সময়ে অ্যান এসে অন হিটরিক্যাল অ্যান্ড কম্পারেটিভ গ্রামার অব্ দি বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ বিষয়ের অন্তর্গত ‘দি সাউন্ডস অব্ মডার্ন বেঙ্গলি’ নামে গবেষণাপত্র প্রস্তুত করে ‘প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ’ বৃত্তি ও ‘কম্পারেটিভ ফিললজি উইথ স্পেশাল রেফারেন্স টু দি বেঙ্গলি ডায়ালেক্টস’ প্রসঙ্গে গবেষণার ফলস্বরূপ ‘জুবিলি’ গবেষণা পুরস্কার পান।

এম এ পাশ করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্যাসাগর কলেজে ইংরেজির অধ্যাপকরূপে যোগ দেন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে সহকারী অধ্যাপক রূপেও কাজ করেন ১৯১৪ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত। ১৯১৪ সালে কমলা দেবীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানান মন্ত্রাক্রান্তা ছন্দে স্বরচিত একটি শ্লোকে।o কমলা দেবীর শিক্ষাদীক্ষা তখন সাধারণ গৃহস্থকন্যার অনুপাতেই ছিল; সুনীতিকুমার তাঁকে সহধর্মিণীর মর্যাদা দিয়েছিলেন তাঁর নিজের লেখাপড়া গবেষণার বিষয়বস্তু মুখে মুখে বলে তাঁর উৎসাহ উদ্রিক্ত করে। কাজটা সাধারণ ছিল না, সহজও ছিল না, কিন্তু এ কাজে তিনি ছিলেন অক্লান্ত কর্মী। ছয় সন্তানের জননী কমলা দেবীর কিন্তু সংসার ছাড়াও কিছু কিছু শখ ছিল এবং সেগুলিতে সম্পূর্ণ প্রশ্রয় দিতেন স্বামী। পরবর্তী কালে কমলা নিজের বাড়িতে হরিণ ময়ূর পুষেছিলেন।

সংসারে তখনও অভাব, কাজেই অধ্যাপনার কাজ পাওয়াতে বিশেষ সুবিধে হয়। অধ্যাপনা কালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রখ্যাত পণ্ডিতদের সাহচর্য তাঁর সারস্বত চর্চার নানা দিককে উদ্দীপিত করে; নতুন নতুন দিকে প্রধাবিত হতে থাকে তাঁর অন্বেষণা ও আগ্রহ। ক্ষীণ দৃষ্টি, বই কেনার সামর্থ্য সীমিত; তৎসত্ত্বেও নানা দিক থেকে নানা বিষয়ের গ্রন্থ সংগ্রহ করে অতৃপ্ত আগ্রহে পড়ে চলেছেন। সে সময়কার খাতাগুলি দেখলে বোঝা যায়, যা পড়েছেন তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নানা দিক সম্বন্ধে সচেতন থেকেই পড়েছেন এবং পরীক্ষার পাঠ্যগ্রন্থ যেমন করে ছাত্ররা পড়ে তেমন অধ্যবসায় নিয়েই পড়েছেন। অথচ অন্য দিকে জীবনকে কোথাও ফাঁকি দেনি। সংসারের দায়িত্ব বেড়েছে— ইন্টারমিডিয়েট, বিএ পরীক্ষার পরীক্ষকের কাজ নিতে বাধ্য হয়েছেন আর্থিক সাশ্রয়ের কথা ভেবে।

১৯১৯ সালে সরকার তাঁকে ভাষাতত্ত্ব অধ্যয়নের বৃত্তি দিয়ে ইউরোপে পাঠাবার জন্যে মনোনীত করেন; মেয়াদ তিন বছরের, যদিও তিনি কিছুদিন বেশিই থাকেন। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র দু’ বছরে ডি লিট উপাধি অর্জন করেন। এই সময়ে ডানিয়েল জোনস প্রমুখ শ্রুতকীর্তি পণ্ডিতের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে পাঠ নেওয়ার সৌভাগ্য হয়। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাতত্ত্বে এফ ডাবলিউ টমাস, প্রাকৃত ও ইন্দো-ইউরোপীয়তে এল ডি বার্নেট, পারসিক ভাষার স্যর ই ডেনিসন রস, প্রাচীন আইরিশে অধ্যাপক রবিন ফ্লাওয়ার— এঁরা ছিলেন তাঁর শিক্ষক, প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানীয়। প্রাচীন ইংরেজি ও গথিক পড়েন অধ্যাপক চেম্বার্স ও গ্র্যটানের কাছে। আবশ্যিক ছিল না, তবু ফোনেটিকসে ডিপ্লোমা নেন। এই দু’বছরের ফসল বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও বিবর্তন নিয়ে ডি লিট-এর থিসিস দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অব দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গওয়েজ; এটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২৬ সালে দু’ খণ্ডে প্রকাশ করেন— পৃষ্ঠা সংখ্যা ১১৭৯।

মন ভরেনি, সোজা গেলেন প্যারিসে। দু’বছর একটানা কাজের পর প্যারিসে এক বছরের ছুটি। কেমন সে ছুটি? মনপ্রাণ দিয়ে ইউরোপীয় সভ্যতার কেন্দ্র আর উৎসস্থান প্যারিসের প্রবহমান জীবনের মধ্যে থেকে তার আধিমানসিক আর আধ্যাত্মিক সংস্কৃতির সঙ্গে একটু অন্তরঙ্গ পরিচয় করতে হবে, নিজের মন আর আত্মার প্রসারের জন্য, চিত্তের স্বাস্থ্যের জন্য— বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিটা মুখ্য নয়— আনুষঙ্গিক গৌণ ব্যাপার। ওই গৌণ শিক্ষার পাঠ্যসূচি ছিল: ইন্দো-আর্য, স্লাভ ও ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাতত্ত্ব, অস্ট্রো-এশীয় ভাষাতত্ত্ব, সদীয়, প্রাচীন খোটানী ভাষা, গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষার ইতিহাস। যে সব অধ্যাপকের সান্নিধ্যে আসতে পেরেছিলেন বলে সারা জীবন গর্ব করতেন তাঁরা হলেন অধ্যাপক ব্যল ব্লখ, আঁতোয়া মেইয়ে, জঁ শিলুস্কি ও পোল পেলিও। এঁদের কৃতিত্ব ও চিন্তাধারার পার্থক্য ছিল এবং তরুণ ভারতীয় ছাত্রটির তাতে বিশেষ লাভ হয়। বিষয়গুলির জটিলতা ও ভাষাশিক্ষার মধ্যে অন্তর্নিহিত ঐক্যের সূত্রটি তখন বিশেষ ভাবে তাঁর উপলব্ধিতে আসে। লন্ডনে থাকবার সময়ে ছুটিতে বেরিয়ে পড়তেন সারা ইংল্যান্ডে। স্কটল্যান্ড দেখেন ভাল করে। প্যারিসে এবং তার পরে বেড়ান ইটালি, গ্রিস ও জার্মানি। গ্রিসের সঙ্গে পরিচয় সুদূর কৈশোরের দিনে ওয়াই এম সি এ-র লাইব্রেরির বইতে, সে পরিচয় স্পষ্টতর হয় কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সময়ে। ক্রমশই অদম্য হয়ে ওঠে সে দেশ দেখার প্রেরণা যেখানে মহৎ সাহিত্য, শিল্প, সামাজিক রাজনীতিক দার্শনিক চিন্তার এমন দীপ্ত বিকাশ ঘটেছিল। তাই একটা গাধা ভাড়া করে প্রায়ই যৎসামান্য খেয়ে, যত্রতত্র শুয়ে প্রায় মাসখানেক গ্রিস চষে বেড়িয়েছিলেন। এ তো দেশ ভ্রমণ নয়, তাঁর ‘পূর্বজনমের প্রথমা প্রিয়ার’ অভিসারে যাত্রা; তাই পথের কষ্ট গায়ে লাগেনি। প্রগাঢ় তৃপ্তি ও গভীর জ্ঞানে পূর্ণ চিত্ত নিয়ে ফিরলেন গ্রিস থেকে। বলতেন গ্রিক সাহিত্য পাঠ ও গ্রিস দর্শন না করলে জীবনের অনেকটা বাকি থেকে যায়; বলতেন গ্রিক সাহিত্য প্রাণে নির্মল বাতাস বইয়ে দিয়ে যায়, সে যেন ইজিয়ান সাগরবেলার স্নিগ্ধ সতেজ বাতাস।’ ইটালি তাঁকে মুগ্ধ করেছিল ইউরোপীয় রেনেশাঁস শিল্পের ও সমাজনীতির পীঠস্থান রূপে। আর প্যারিস? পৃথিবীর সমাজতত্ত্বের বড় এক পরীক্ষা ঘটে এখানে, যা উন্মুক্ত করে দেয় তৎকালীন মননের দিগন্ত, প্রেরণা জোগায় শিল্প ও সাহিত্যের। ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত পাশ্চাত্য জগতের তাৎপর্যপূর্ণ নানা পরীক্ষানিরীক্ষার চিহ্ন ও প্রমাণ প্যারিসের, রাজপথে, গলিতে, তার চল্লিশটি মিউজিয়ামে। ফরাসি সভ্যতার প্রতি প্রীতি তাঁর পূর্ব হতেই ছিল। গাঢ়তর হল প্রায় এক বছর সেখানে বিহরণ করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *