মত পরিবর্তনে সাহসী

মত পরিবর্তনে সাহসী

সুনীতিকুমারের চরিত্রগত সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য বোধহয় তাঁর বিবর্তনের ক্ষমতা। স্বভাবে একটা দার্ঢ্য ছিল যখন যা সিদ্ধান্ত করতেন বা যে প্রত্যয়ে এসে পৌঁছতেন দৃঢ় ভাবে তা ধরে থাকতেন, প্রয়োজন হলে তার জন্যে সংগ্রামেও পশ্চাৎপদ হতেন না। এ দৃঢ়তা কলকাতা দেখেছিল ছিয়াশি বছরের বৃদ্ধের মধ্যে রামায়ণ বিতর্ক-সভায় (১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৬)। সেখানে যুক্তি দিয়ে তিনি যা যা বলেছিলেন কিছু পণ্ডিত তার বিরোধিতা করেন; এবং দু’চার দিন আগে থেকেই তাঁর কাছে অত্যন্ত কদর্য এবং ভয়াবহ চিঠি আসতে থাকে সনাতনপন্থীদের কাছ থেকে। মনে আঘাত পেলেও মতে আঘাত লাগেনি। লাগত, যদি প্রতিকূলতা আসত যুক্তিগ্রাহ্য আপত্তি নিয়ে; তা হলে তিনি মত পরিবর্তন করতে দ্বিধা করতেন না। একদা তাঁর মনে হয়েছিল সারা ভারতের সব ভাষার জন্যে একটিমাত্র লিপি প্ৰবৰ্তিত হওয়া প্রয়োজন এবং সেটি কোনও ভারতীয় লিপি হলে অনর্থ বাধতে পারে, তাই সেটি রোমান লিপি হওয়াই বাঞ্ছনীয়। দৃঢ়স্বরে এ মত ঘোষণা করলেন। কিন্তু কিছুকাল পরে ধীরে ধীরে দেখতে পেলেন আঞ্চলিক লিপিতে প্রায় হাজার বছর ধরে বিভিন্ন শাস্ত্র কাব্য সাহিত্য ধর্মদর্শন ও ভাষ্য লিপিবদ্ধ হয়ে এসেছে, ভারতের উত্তর পূর্ব দক্ষিণ পশ্চিমে। ভাষাই যখন পৃথক, লিপিসাম্যে কাজ বেশি দূর এগোবে না। তখন অনায়াসে পূর্বমত পরিহার করে বললেন, আঞ্চলিক লিপিই বজায় থাকুক। তেমনি ভাষা। পণ্ডিত নেহরুর সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করলেন হিন্দি সর্বভারতীয় ভাষারূপে গৃহীত হওয়ার দাবি রাখে। আরম্ভ হল হিন্দির সপক্ষে প্রচার— উচ্চকণ্ঠে সকল সভাসমিতিতে বলতে লাগলেন হিন্দিকে সর্বভারতীয় ভাষার সম্মান দেওয়াই হল ভারতের সংহতি সাধনের একটি প্রকৃষ্ট উপায়। পরে বুঝতে পারলেন সমগ্র দক্ষিণ ভারতের মানুষ এতে যৎপরোনাস্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে, আর্যাবর্তের হিন্দি তাদের সংস্কৃতি থেকে বহু দূরে। জোর করে এ ভাষা চাপিয়ে দিলে তাদের আনুগত্যই সংশয়িত হবে, সংহতি সৃষ্টি তো দূরের কথা। তখন আবার প্রত্যাহার করলেন হিন্দির সপক্ষের যুক্তি; ভারতবর্ষের বৃহৎ ভূখণ্ড দাক্ষিণাত্য, যাঁদের দীর্ঘকালের নিরবচ্ছিন্ন সংস্কৃতির ইতিহাস রয়েছে, হিন্দিকে ওপর থেকে কৃত্রিম ভাবে তাঁদের উপরে চাপিয়ে দিলে তাঁদের দূরে সরিয়ে নেওয়া হবে। আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার চলতে লাগল।

এত সযত্ন এবং এত নিপুণ প্রস্তুতি নিয়ে ভারতবর্ষের এই মানুষটি উপস্থিত হতেন ভিন্ন দেশের মানুষের দ্বারে। সংস্কৃতি বিভেদ ঘটায় না, মানুষের মৌল একত্বকে উজ্জ্বলতর করে তোলে; তাই নিরবধি সন্ধান চলত আপাতবিচ্ছিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে নিহিত ঐক্যের। কিন্তু, পার্থক্যকে, বৈচিত্র্যকেও তিনি সসম্ভ্রমে স্বীকার করতে জানতেন, ফলে সত্যকার পরিশীলিত চিত্তের নির্ণায়ক যে গুণ— যা আছে, তা যেমন ভাবে যেখানে যার মধ্যে আছে তাকে তেমনি ভাবেই স্বীকার করা— এ তিনি সম্পূর্ণ ভাবে আয়ত্ত করেছিলেন। মানুষ সম্বন্ধে গভীর এক সম্ভ্রমবোধ তাঁকে নিবৃত্ত করত কোনও সংস্কৃতিকে বা কোনও ব্যক্তিকে তুচ্ছ মনে করা থেকে। যা মহৎ তাকে যেমন শ্রদ্ধার বেদীপীঠে আসন দিতে পারতেন তেমনি যা তুচ্ছ তাকেও তার সত্তার প্রকাশরূপে মেনে নিতে পারতেন। এ বড় সহজ সাধনা নয়। তাঁর পরিচিত সকলেই প্রায় দেখেছেন তাঁর মধ্যে মানুষের প্রতি অবজ্ঞার অভাব। কিন্তু ঘৃণা যে তাঁর ছিল না তা নয়। যুক্তিবহির্ভূত সংস্কার সম্বন্ধে প্রগাঢ় ঘৃণা ছিল, ধর্মের নামে কিছু মানুষকে নীচ মনে করাকে বা সংস্কারাচ্ছন্ন অনমনীয়তাকে তিনি ঘৃণা করতেন; ঘৃণা করতেন অহমিকাকে, জাত নিয়ে, ধন বা এমনকী বংশ নিয়েও আত্মম্ভরিতা সম্বন্ধে তাঁর সহিষ্ণুতা ছিল না; বিরূপ হয়ে উঠতেন সংকীর্ণতা ভেদবুদ্ধির কুৎসিত চেহারা দেখে। যাঁরা তাঁকে জানতেন তাঁরা সকলেই জানেন কোনও দিন একটিও দম্ভের বাক্য তাঁর কাছে কেউ শোনেনি। দিগন্তবিস্তৃত জ্ঞানের পরিধি ছিল বলেই হয়তো, কী জানতেন না, সে নিয়ে তীব্র ভাবে নিত্য সচেতন ছিলেন, এই সচেতনতাই তাঁকে দিয়েছিল সেই বিস্ময়কর আন্তরিক বিনয়, যার সৌন্দর্য অভিভূত করত সকলকে। এর মধ্যে একবিন্দু অভিনয় ছিল না, কারণ সমস্ত জ্ঞান আহরণ করতে পারেননি এই তীক্ষ্ণ বোধই তাঁকে রক্ষা করেছিল অহমিকা থেকে। মনে হয় সব বিদ্যাই মানুষকে বিনয় দেয় না, অমন অগাধ অপরিণাম বিদ্যাই শুধু যথার্থ বিনয় দিতে পারে। অনায়াসে নিজেকে নিয়ে যে পরিহাস করতে পারতেন এরও পিছনে সেই অপরিপূর্ণতার বোধ ও তার থেকে সঞ্জাত বিনয়। কতবার বলেছেন, ইউরোপের যে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডর ঝাঁট দিলে দশটা সুনীতি চাটুজ্জে পাওয়া যাবে। কথাটা একেবারেই সত্যি নয়, কিন্তু আশ্চর্য এই যে কথাটা তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। আদর্শকে এত উচ্চে স্থাপনা করেছিলেন বলেই এই প্রাজ্ঞ অতৃপ্তি তাঁকে এক অনিন্দ্যসুন্দর মহিমা দিয়েছিল।

সুনীতিকুমার জন্মেছিলেন ঊনবিংশ শতকের শেষ দশকের শুরুতেই; মনেপ্রাণে অনেকাংশেই ঊনবিংশ শতকেরই সৃষ্টি তিনি। ফরাসি বিপ্লবের পরে যে মানবকেন্দ্রিকতা ইউরোপে ব্যাপ্ত হয়ে পড়ে সুনীতিকুমার তার দ্বারা গভীর ভাবে প্রভাবিত। সঙ্গে সঙ্গে অষ্টাদশ শতকের ইউরোপের যুক্তিনিষ্ঠাও তাঁর মধ্যে গভীর সাড়া জাগায়। সুনীতিকুমার বিশ্বাস করতেন ভারতবর্ষে চিন্তা ও মননের ঐতিহ্যে যা কিছু স্থায়ী ও মূল্যবান তা যুক্তিনির্ভর; যা কিছু অশুভ, পরিহার্য এবং সংস্কৃতির অগ্রগতির পরিপন্থী তা যুক্তিকে অগ্রাহ্য করে কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দেয়। যুক্তির জগতে ভারতবর্ষ দিয়েছে অনেক, এবং তিনি বলতেন সেই ঐতিহ্য উদ্ঘাটন করে তার অনুসরণ করাই আমাদের পক্ষে মঙ্গলের, চিন্তাজগতে অগ্রগতির একমাত্র পথ। যুক্তিবাদকে নিজের চিন্তা, মনন ও প্রত্যয়ে শীর্ষস্থান দিয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত। যুক্তিবাদ ও মানবকেন্দ্রিকতায় তাঁর সমকালীন কিছু চিন্তাশীল পণ্ডিতও তাঁর পাশে ছিলেন। বন্ধু সুশীলকুমার দে৬, রাধাকৃষ্ণন, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা প্রমুখ চিন্তাবিদ কেউই অতিলৌকিক বা পারলৌকিক কোনও কিছুতে বিশ্বাস করতে পারেননি। এতে এঁরা সকলেই মনের দিকে কতকটা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন কিন্তু তৎসত্ত্বেও যা বিশ্বাস করতে পারেন না সে বিশ্বাস বা সংস্কারকে আমরণ সাহসের সঙ্গে পরিহার করেছিলেন। সুনীতিকুমার বিশেষ ভাবেই নিঃসঙ্গ ছিলেন কারণ তাঁর সারস্বত সাধনা এক বৃহৎ পরিসরে পরিব্যাপ্ত ছিল এবং তা ছিল অন্তর্লোকের গভীরে। মত মানুষেরই জন্যে, মানুষ মতের দাসত্ব করবে এ কল্পনা তাঁকে পীড়া দিত। তাই মিথ্যে আত্মসম্মানের মোহ ত্যাগ করে তিনি নিজের মত বা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে জানতেন।

১৯২৬ সালের দাঙ্গার সময়ে তিনি প্রবল হিন্দু মহাসভাপন্থী। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় কিছু হিন্দু মরেছে শুনে লাঠি হাতে রাস্তায় বেরোলেন, সে দিনের বিশ্বাসমতে যবন-নিধনের জন্যে। এর মূল ইতিহাস আরও পিছনে: বিবেকানন্দের শিক্ষায় আত্মপ্রত্যয়, বীরত্বের সাধনা, শৈশব থেকে অভ্যস্ত ডন বৈঠক, ইত্যাদিতে সুগঠিত স্বাস্থ্য। হিন্দু বাঙালি ক্লীবের মতো পড়ে মার খাবে এ তখন তাঁর অসহ্য বোধ হয়েছিল। এরই কাছাকাছি সময়ে তিনি লিখলেন, ‘হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিতদের বর্ণাশ্রম সমাজে কী স্থান’। অর্থাৎ তখন হিন্দুমহাসভার সাম্প্রদায়িক নীতি তিনি আত্মস্থ করেছেন; ভারতবর্ষ হিন্দুপ্রধান দেশ, হিন্দুই এখানে প্রথম ও প্রধান নাগরিক এ বিশ্বাস করেন। হিন্দুরাজ্যে হিন্দু ন্যায়বিচারই চলবে, অহিন্দু নাগরিক তার অধীনে থাকবে, তবে কষ্টে থাকবে না এ কথাও মেনে নিয়েছেন। পরে ধীরে ধীরে সাম্প্রদায়িকতার নগ্ন মূর্তি যতই উদ্ঘাটিত হতে লাগল, হিন্দু নাগরিকতারও নখদত্ত বিকাশ দেখলেন। ইসলাম সম্বন্ধে পড়াশোনা করে সম্ভ্রমের সঙ্গে প্রতিবেশী সম্প্রদায় সম্বন্ধে বিদ্বেষ উৎপাটন করলেন। নিজেকে মুক্ত করলেন হিন্দু গোঁড়ামি থেকে

হিন্দুর কলঙ্কমোচনের জন্যে সুনীতিকুমার এক সময়ে হিন্দুসমাজের প্রত্যন্তবাসী তপশিলি সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষদের পদবি-পরিবর্তনে উদ্যোগী হন। প্রশ্ন করলে বলতেন, যাতে ওরা সবচেয়ে বেশি আত্মসম্মানবোধ করে সেই জন্যেই ব্রাহ্মণ উপাধি দিচ্ছি। এই তথাকথিত নিম্নবর্গের মানুষদের ব্রাহ্মণ পদবি দেওয়া সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে, যাতে তারা দাস, নাথ, লাই এবং হাড়ি-বাগদি-ডোমের জন্মলব্ধ পদবি নিয়েই সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে, এই কথা বললে— কথাটা ওঁর মনে ধরে; বললেন, ‘তাইতো, সেই রকমটিই হওয়া উচিত। শ্রাদ্ধে যার গোত্রপরিচয় জানা যায় না তাকে তো আমরা মানবগোত্র বলি, এরাও থাক সেই মানব গোত্রভুক্ত হয়ে।’ এই প্রসঙ্গে মাঝে মাঝে বলতেন, ‘দৈবায়ত্তং কুলে জন্ম, মদায়ত্তং তু পৌরুষম।’ এক দিকে কৌলীন্য ও ব্রাহ্মণ্যে বিস্তর ফাঁক ও ফাঁকি সম্বন্ধে অবহিত হচ্ছিলেন বলেই ও ব্যাপারে কোনও কৃত্রিম শ্রদ্ধা রক্ষা করা আর সম্ভব হচ্ছিল না, অন্য দিকে আত্মসমীক্ষা চলছিল। তথাকথিত নীচ শ্রেণির মানুষের নীচতা যে স্বার্থসন্ধী ব্রাহ্মণ্যসমাজের দ্বারা আরোপিত এ সম্বন্ধেও অবহিত হচ্ছিলেন বলেই মানুষকে নিজের পরিচয়ে দাঁড়াতে সাহস দিতেন। সমস্ত জাতিভেদ প্রথাটাই যে কত মেকি এবং কী পরিমাণ বিষাক্ত, সে নিয়ে ক্রমেই তাঁর চেতনার প্রসার ঘটছিল। মাঝে মাঝে মহাভারতের শান্তিপর্বের ভীষ্মের কথাটি বলতেন, ‘গুহ্যং ব্রহ্ম যদিদং তে ব্রবীমি, ন মানুষাচ্ছ্রেষ্ঠতরং হি কিঞ্চিৎ’। এর পিছনে দীর্ঘ বিবর্তনের ইতিহাস আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *