মানবিক সম্পর্ক

মানবিক সম্পর্ক

সুনীতিকুমারের সমসাময়িক কালের বিভিন্ন ভাষায় পণ্ডিতদের সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতা, বিদ্যাক্ষেত্রের কল্যাণমিত্রদের সঙ্গে সারস্বত সংযোগ তাঁকেও উৎসাহ দিত। কিন্তু বেশি করে উদ্দীপিত করত তাঁর বিদ্যাসহচরদের। মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু বা গিরীন্দ্রশেখর বসু বিজ্ঞানের কৃতী ছাত্র; এঁদের সঙ্গে সুনীতিকুমারের গভীর সখ্য ছিল। জীবন, জগৎ, সমাজ, সমকালীন জাতীয় সংগ্রাম, ইত্যাদি ক্ষেত্রে এঁরা নানা আলাপ করতেন। যেমন সুনীতিকুমার আইনস্টাইন, সিগমুন্ড ফ্রয়েডের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে তাঁনের মনস্বিতার স্পর্শ পেতে উৎসুক ছিলেন। নিজের গবেষণা ক্ষেত্র ভাষাতত্ত্ব ছাড়াও অনেক বিস্তৃত ছিল তাঁর চর্চার ক্ষেত্র— শিল্পচিন্তা, দর্শন, নৃতত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্ব, ইতিহাস, সাহিত্য, সংগীত, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, ধর্ম, লোকাচার এ সবেই তাঁর নিত্যজাগ্রৎ কৌতূহল ছিল। ফলে, এই সব ক্ষেত্রের মনীষীদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সংযোগ ছিল— দেশে এবং সারা পৃথিবীতে। মানসিক সান্নিধ্যে এবং বিদ্যাচর্চার সাযুজ্যে এঁরা এবং সুনীতিকুমার পরস্পরকে সমৃদ্ধ করতেন।

প্রথম যৌবনেই ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে যাতায়াত করতেন। তখন ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল শিশিরকুমার ভাদুড়ির সঙ্গে। বিদ্বান বুদ্ধিমান ও মার্জিতরুচি এই তরুণ অভিনেতার সঙ্গে দীর্ঘকাল বন্ধুত্ব ছিল তাঁর। চন্দ্রগুপ্ত নাটকে গ্রিক বেশবাস সুনীতিকুমারই পরিকল্পনা করেন। তেমনই পৌরাণিক ও মোগল পোশাকের আদলও নির্দেশ করেন। নাটকে সহজাত আগ্রহ ছিল বলে প্রায়ই দেখতে যেতেন, দেখাতে নিয়ে যেতেন অন্য বন্ধুদের। শিশিরকুমারের নটপ্রতিভা মুগ্ধ ও অভিভূত করে সুনীতিকুমারকে। যেমন ‘মান্ডে ক্লাবে’ গিয়ে মিত্রতা হয় সুকুমার রায়ের সঙ্গে এবং সুকুমার রায়ের মৃত্যু পর্যন্ত এ সংযোগ অক্ষুণ্ণ ছিল, কারণ ওই তরুণের প্রতিভা, মনের সৌকুমার্য, শুচিতা, আদর্শবাদিতা ও তাঁর সৃষ্টিপ্রতিভা সুনীতিকুমারকে গভীর ভাবে আকর্ষণ করেছিল। কালিদাস নাগ ছিলেন প্যারিসে তাঁর পথপ্রদর্শক ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু, এঁর পরিশীলিত রুচি, বিদ্যাবত্তা ও বিদ্যানুরাগ সাড়া পেয়েছিল সুনীতিকুমারের মনে; সম্পর্ক অটুট ছিল কালিদাস নাগের মৃত্যু পর্যন্ত। সহকর্মী পণ্ডিত প্রবোধচন্দ্র বাগচি ও তারাপোরেওয়ালার গুণমুগ্ধ ছিলেন; বিশেষ সখ্য ছিল সর্বেপল্লী রাধাকৃষ্ণনের সঙ্গে— যোগসূত্র গুণগ্রাহিতা। মানসিক গঠনে কিছু দূর পর্যন্ত মিল ছিল এ দুজনের, বিদ্যানুরাগ ও বহুমুখী আগ্রহ ছিল সেই মিলের ভিত্তি। সুশীলকুমার দে-র সঙ্গে পরিচয় লন্ডনে; দু’জনেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি এম এ; দু’জনেই আলাদা আলাদা বছরে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন ও পরে বিষয়ান্তরে চর্চায় প্রবৃত্ত হন। সুনীতিকুমার নিজের প্রতিভায় পিএইচ ডি না করে সরাসরি ডি লিট পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি পান। উদারহৃদয় বন্ধু সুশীলকুমার দে-কে অনুরূপ নিয়মপিঞ্জর থেকে উদ্ধার করেন অনেককে বলে বিশেষ ব্যবস্থা করিয়ে। এঁদের বন্ধুত্বের মিলনক্ষেত্র ছিল বহুধাবিস্তীর্ণ— ইংরেজি, বাংলা, সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃতি দীর্ঘকাল সজীব সম্পর্ক ছিল উভয়ের ক্ষেত্রে। শ্রীগোপাল হালদার প্রাতিষ্ঠানিক ভাবেই সুনীতিকুমারের গবেষণার ছাত্র ছিলেন; কিন্তু গবেষণা সূত্রপাতের অনতিকাল পরেই শ্রীগোপাল হালদার কারারুদ্ধ হন। সুনীতিকুমার এই ভিন্ন রাজনীতিবিশ্বাসী সৎ শিষ্যটির কারাবাসের দুঃখ বহুল পরিমাণে লাঘব করেছিলেন, স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে বিশেষ ব্যবস্থা করিয়ে জেলে ওঁর সঙ্গে দেখা করে, আলোচনা করে, বই পাঠিয়ে, এমনকী বিশেষ বক্তৃতা উপলক্ষে সাময়িক মুক্তিতে সে সভায় যোগ দেওয়ার অনুমতি আদায় করে।

সুকুমার রায়ের সঙ্গে যে ‘মান্ডে ক্লাবে’ তাঁর আলাপ হয়, সেখানেই পরিচয় প্রশান্তচন্দ্ৰ মহলানবীশের সঙ্গেও। বৈজ্ঞানিক প্রশান্তচন্দ্রের বুদ্ধির বহুধাবিকীর্ণ দীপ্তি, সাহিত্যে রুচি এবং রবীন্দ্রানুরাগ দু’জনের ঘনিষ্ঠতার সেতু হয়ে ওঠে। এ সংযোগও দীর্ঘকাল অব্যাহত ছিল। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের মনস্বীরা অনেক সময়ে সুনীতিকুমারের প্রতিভায় আকৃষ্ট হয়ে তাঁর কাছে এসেছেন এবং এমনও বহুবার ঘটেছে প্রতিভার সামান্যতম সম্ভাবনা দেখে তিনি নিজেই তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। শুধু প্রতিভাই নয়, অন্যবিধ গুণও মগ্ধ করত, এই গুণগ্রাহী মানুষটিকে। তাঁর একান্ত সচিবের লেখা থেকে সেটা স্পষ্ট। শিশিরকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের কর্মনিষ্ঠা ও অতন্ত্র মনোযোগ সুনীতিকুমারের কীসে মঙ্গল হয় তার দিকে: এটি তাঁকে এত মুগ্ধ করেছিল যে একখানা বই উৎসর্গ করেন তাঁকে। তাঁর সাহিত্যসচিব অনিল কাঞ্জিলাল মশায় বিদ্যা বুদ্ধি এবং অধ্যয়নের পরিধিতে ও রুচিতে এবং একনিষ্ঠ সারস্বত পরিচর্যায় সুনীতিকুমারের খুব কাছে আসতে পেরেছিলেন এবং এ জন্যে সুনীতিকুমারের পরিতুষ্টিও যেমন পেয়েছেন, দীর্ঘকালের সান্নিধ্যও তেমনি পেয়েছেন।

যে-মানুষটির সান্নিধ্যে সুনীতিকুমার নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতেন তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রথম পরিচয় কবির কবিতা পাঠে আগ্রহ। এ আগ্রহ সঞ্চার করেন, আগেই বলেছি, সহপাঠী গোরা। গোরা অর্থাৎ গৌরগোবিন্দ গুপ্ত ব্রহ্মচর্য আশ্রম থেকে এসে মোতি শীলের ইস্কুলে সুনীতিকুমারের সহপাঠী হন। ইনি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের বংশধর এবং ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের ছাত্র ও অনুগামী। গোরার কাছেই সুনীতিকুমার রবীন্দ্রনাথের কবিতা শোনেন। যে-মন এক দিন বিশ্বের সমস্ত ধ্রুপদী সাহিত্যে নিষ্ণাত হল, সে-মননের অন্তর্নিহিত কষ্টিপাথরে পাকা ছাপ পড়েছিল তখনই। এবং তখন যার সূত্রপাত তার অনুশীলন চলল সারাজীবন; অনুধাবন এবং মনের মধ্যে বাজতে লাগল বিচিত্র তার অনুরণন। চিত্রা, মানসী-তে যার শুরু এবং মন্ত্রমুগ্ধের মতো ভারতীয় রোমান্টিক রচনার সেই প্রথম গুঞ্জন অপরিণত কিশোরকে যে নতুন এক জগতের সন্ধান দিয়েছিল তা নিয়ে গভীর নিষ্ঠার চর্চা চলেছিল সমগ্র জীবন ভরে। নানা কর্মকাণ্ডের টানে তাঁকে শান্তিনিকেতনে বারবার যেতে হয়েছে, আরও বেশি করে যেতে হয়েছে শুধু কবির টানে। যেতেন সেখানকার কাজে, উৎসবে ও নানা দায়িত্ব নিয়ে। কবির প্রয়াণের পরও তিনি কবির সম্মানের জন্যে এই সব আনুষ্ঠানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাপারে সাগ্রহে যোগ দিয়েছেন। কবির প্রতি এ তাঁর শ্রদ্ধার্ঘ্য; শান্তিনিকেতনও যে কবির এক সৃষ্টি; একে অনাদর করার কথা ভাবতেই পারতেন না তাই। ১৯২৭ সালে সেই যে তিন মাস কবির সঙ্গে গেলেন জাভা, সুমাত্রা, বালি, মালয় ও শ্যামদেশ, সেখানে দিনপঞ্জিতে সঞ্চয় করে রেখেছেন দৈনন্দিন প্রাপ্তি, বোধের ও বোধির। এর পর থেকে কবির সঙ্গে যে-সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তা তাঁকে ফিরে ফিরে নিয়ে গেছে কবির সান্নিধ্যে ও শান্তিনিকেতনে। কবিও গুণগ্রাহী ছিলেন; শুধু যে বাংলা ভাষা পরিচয় (১৯৩৮) বইটি সুনীতিকুমারকে উৎসর্গ করে তাঁর সমাদর ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন তা নয়, জাভাযাত্রীর পত্রে অকুণ্ঠ প্রশংসায় সংবর্ধিত করেছেন সুনীতিকুমারকে। লিখেছেন:

সকলপ্রকার রচনাই স্বাভাবিক শক্তির অপেক্ষা করে। চিঠি-রচনাও তাই। আমাদের দলের মধ্যে আছেন সুনীতি। আমি তাঁকে নিছক পণ্ডিত বলেই জানতুম। অর্থাৎ, আস্ত জিনিসকে টুকরো করা ও টুকরো জিনিসকে জোড়া দেওয়ার কাজেই তিনি হাত পাকিয়েছেন বলে আমার বিশ্বাস ছিল। কিন্তু এ বারে দেখলুম, বিশ্ব বলতে যে ছবির স্রোতকে বোঝায়, যা ভিড় করে ছোটে এবং এক মুহূর্ত স্থির থাকে না, তাকে তিনি তালভঙ্গ না করে মনের মধ্যে দ্রুত এবং সম্পূর্ণ ধরতে পারেন আর কাগজে-কলমে সেটা দ্রুত এবং সম্পূর্ণ তুলে নিতে পারেন। এই শক্তির মূলে আছে বিশ্বব্যাপারের প্রতি তাঁর মনের সজীব আগ্রহ। তাঁর নিজের কাছে তুচ্ছ বলে কিছুই নেই, তাই তাঁর কলমে তুচ্ছও এমন একটি স্থান পায় যাতে তাকে উপেক্ষা করা যায় না। সাধারণত, এ কথা বলা চলে যে শব্দতত্ত্বের মধ্যে যারা তলিয়ে গেছে শব্দচিত্র তাদের এলাকার সম্পূর্ণ বাইরে, কেননা চিত্রটা একেবারে উপরের তলায়। কিন্তু, সুনীতির মনে সুগভীর তত্ত্ব ভাসমান চিত্রকে ডুবিয়ে মারেনি এই বড় অপূর্ব। সুনীতির নিরন্ধ্র চিঠিগুলি তোমরা যথাসময়ে পড়তে পাবে— দেখবে এগুলো একেবারে বাদশাই চিঠি। এতে চিঠির ইম্পিরিয়ালিজম; বর্ণনাসাম্রাজ্য সর্বগ্রাহী, ছোট বড় কিছুই তার থেকে বাদ পড়েনি। সুনীতিকে উপাধি দেওয়া উচিত— লিপিবাচস্পতি কিংবা লিপিসার্বভৌম কিংবা লিপিচক্রবর্তী।

সুনীতিকুমারের মনটা শিল্পী মনই ছিল; নিজেই বলতেন, ছোটবেলায় চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ না হয়ে গেলে তিনি শিল্পীই হতেন। শিল্পী না হলেও শিল্পীর মৌলিক ক্ষমতাটি ছিল; সব কিছু খুঁটিয়ে দেখা, মনে রাখা, তা থেকে আনন্দ লাভ করা। কবির সঙ্গে যাঁর ঘনিষ্ঠ সংযোগ ঘটল তিনি শুধু ভাষাবাচস্পতি নন, তিনি রসবোদ্ধা ও মানবপ্রেমিক। কাজেই জাভা সুমাত্রা মালয় বালিদ্বীপে তিনি খুঁজেছেন মানুষকে তার এই দূরপ্রাচ্যের পরিবেশে, পেয়েছেন নতুন এক পরিচয়। ওখানে শ্রাদ্ধে পৌরোহিত্য করাটা যতটা ওদের উপকার করা, ততটাই নিজেরও জ্ঞান বৃদ্ধি করা। বস্তুত, করিব সঙ্গে সুনীতিকুমারের এইখানেই গভীর মিল: উভয়েরই অন্বিষ্ট মানুষ, বিভিন্ন স্থানে, কালে, বিচিত্র বেশে, বিশ্বাস, আচরণে ও সৃষ্টিতে। এক জন শেষ বয়সে কবিতা লিখলেন ‘কেন’, অন্যজন সে কবিতা মন্ত্র বোধে আবৃত্তি করতে লাগলেন শেষ ক-বছর। যখন পড়েন, ‘আমি ব্রাত্য আমি মন্ত্রহীন’ তখন ঈষৎ থেমে অস্ফুটে বলেন ‘আমিও’। সেই মানসসুন্দরী, খেয়া, নৈবেদ্য পর্যায়ের স্থির চিত্তলোভন বিশ্বাস কবি যে ভাবে বর্জন করছিলেন সেই ভাবেই নিরঞ্জন সত্যের হিমতুষার ধারার কঠিন অবগাহনের দ্বারা এক ধরনের শুচিতালাভ সুনীতিকুমারকে টানছিল দুর্বার আকর্ষণে। তাঁর কাছে গেলে পড়তে বলতেন রবীন্দ্রনাথের শেষ পর্যায়ের নিরলংকার কিন্তু হিরককঠিন উপলব্ধির কবিতাগুলি, নিজেও উপাংশু আবৃত্তি করতেন। চারিদিকে তাকিয়ে যখন বহু দীর্ঘকালের লালিত লোভনীয় বিশ্বাসগুলি আর রাখতে পারছিলেন না, তখন ফিরে ফিরে আসতেন জীবনের উৎসজলে স্নান করতে; পড়তেন বেদ, গ্রিক মহাকাব্য, গ্রিক নাটক, রবীন্দ্রনাথের কবিতা এবং শরীর-মনের ক্লান্তি জুড়িয়ে নিতেন রবীন্দ্রসংগীতে। রবীন্দ্রনাথের মতোই, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেই আপাতরঞ্জন মোহ থেকে ধীরে ধীরে তাঁর উত্তরণ ঘটল কঠিন সাধনায় এবং শেষে রবীন্দ্রনাথের মতোই বলবার শক্তি অর্জন করেছিলেন: ‘কঠিনেরে ভালবাসিলাম’। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিয়তচলিষ্ণু মনের দীক্ষাদাতাও বটে, পান্থজনের সখাও বটে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *