শিক্ষক সুনীতি
বৃত্তিতে ছিলেন শিক্ষক। অধ্যাপনা জীবন শুরু বিদ্যাসাগর কলেজে কিছুকাল ইংরেজির অধ্যাপকরূপে। প্রথমে স্নাতক স্তরে ইংরেজি পড়ান, পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে পড়ান। কলকাতায় খয়রা অধ্যাপক হয়ে প্রথম পর্যায়ে ছাত্ররূপে পান শ্রীসুকুমার সেনকে। জমি ভাল হলে সুনীতিকুমারের অধ্যাপনা কী পরিমাণ ফলপ্রসূ হতে পারে অধ্যাপক সুকুমার সেন তার জ্বলন্ত উদাহরণ। বেদ, অবেস্তা, ব্যাকরণ, সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃত, গ্রিক, ল্যাটিন এ সবেতেই নিষ্ণাত সুনীতিকুমারের নিতান্ত স্নেহভাজন যোগ্যতম শিষ্য সুকুমার। এর সঙ্গে তাঁর আমরণ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল; শিক্ষাগুরু হিসেবে সুনীতিকুমার গর্বিত ছিলেন এই কৃতী ছাত্রকে নিয়ে। সুনীতিকুমারের মৃত্যুর পরে সাহিত্য অকাদেমি আয়োজিত স্মৃতিসভায় শ্রীসুকুমার সেন একটি অমূল্য উক্তি করেন। তাঁর ভাষণের প্রথম বাক্যই ছিল: ‘উচ্চতা নানা রকমের হয়, অট্টালিকাও উচ্চ, মহীরূহও উচ্চ। একটি নিষ্প্রাণ, অন্যটি জীবনরসে সমৃদ্ধ। সুনীতিবাবুর ছিল সেই বনস্পতির উচ্চতা।’ এই ভাবে সুনীতিকুমারকে শ্রদ্ধা নিবেদন থেকে বোঝা যায় তাঁর গুরু-ঋণের স্বীকৃতি আর সুনীতিকুমারের একটি অসাধারণ সর্বাঙ্গীণ মূল্যায়ন।
শ্রীসুকুমার সেনের পরেও যাঁরা সুনীতিকুমারের কাছে পাঠ নিয়েছেন তাঁরা তাঁর অধ্যাপনার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ না করে পারেননি। সকল ছাত্রছাত্রীকে তিনি ‘আপনি’ সম্বোধন করতেন, কাউকে প্রণাম করতে দিতেন না। এ দুটিই প্রতীকী, অধ্যাপক ছাত্রদের মনে হীনমন্যতার ভাব প্রবেশ করুক তা চাইতেন না। নিজেকে মনে করতেন খানিকটা অগ্রসর ছাত্র মাত্র। তর্কে ছাত্রের অধিকার ছিল। পড়াতে আসতেন নিয়মিত এবং পড়িয়ে যে আনন্দ পাচ্ছেন সেটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হত ওঁর পড়ানোর প্রাণবন্ত উচ্চারণে। প্রথম কয়েক বছর আমন্ত্রিত হয়ে বাইরে গেলে ফিরে এসে বাড়তি ক্লাস নিয়ে ক্ষতিপূরণ করে দিতেন; পরে আমন্ত্রণ এত ঘন ঘন আসত যে সেটা পারতেন না, তবে চেষ্টা করতেন। এত অসাধারণ তাঁর অধ্যাপনা যে ছাত্ররা— অন্তত বুদ্ধিমান ছাত্ররা— মন্ত্রমুগ্ধবৎ শুনত, প্রহর গুনত তাঁর ক্লাসের জন্যে। পড়াতেন বাংলা, সংস্কৃত, ইংরেজি, পালি ও প্রাকৃত বিভাগে ভাষাতত্ত্ব, এ ছাড়াও প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ইংরেজি। কিছু দিন তারাপোরেওয়ালার কাছে ঝালিয়ে নিয়ে পরে পড়াতেন অবেস্তাও। গ্রিক ল্যাটিন কেলটিকও। কোনওটিই খুব জনপ্রিয় বিষয় ছিল না, ফলে ছাত্র সংখ্যা বেশি ছিল না কখনওই। কিন্তু বিদ্যোৎসাহী ছাত্র তাঁর কাছে যা পেত অন্য কারও কাছে সে ভাবে বা ততটা পেত না।
অধিকাংশ পণ্ডিতের উচ্চতাই অট্টালিকার উচ্চতা, দেখলে বিস্ময় হয়, কখনও বা সম্ভ্রম, কিন্তু প্রেরণা দেয় না। সুনীতিকুমারের এক দিকে যেমন ছিল জ্ঞানপ্রাচুর্য অন্য দিকে তেমনই ছিল প্রাণপ্রাচুর্য। আর কী আশ্চর্য পরিধি তাঁর জ্ঞানের: ভাষাই কি শুধু, না ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ধ্বনিবিজ্ঞান বা ধ্বনিতত্ত্ব? সংস্কৃতই কি শুধু, না পালি প্রাকৃত বাংলা, ওড়িয়া, হিন্দি, মাগধী শৌরসেনী, অবহট্ট বা ব্রজবুলি? খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতক থেকে খ্রিস্টীয় বিংশ শতক পর্যন্ত কি অনায়াস সঞ্চরণ— যুগ থেকে যুগান্তরের বিবর্তনে। প্রয়োজনে অতি সহজেই এসেছে গ্রিক, ল্যাটিন, খোটানি, আরামীয়, অবেস্তীয় পারসিক বা আরবি। এই অনায়াস সঞ্চরণই শিহরণ জাগাত ছাত্রের জিজ্ঞাসার মর্মমূলে: কত জানবার আছে, একজন মানুষ কত জানতে পারে। এবং সহজেই ছাত্রছাত্রীরা একটি বোধে উত্তীর্ণ হতেন: এ সব বাহুল্য নয়, পাণ্ডিত্যপ্রকাশ নয়, এ সব জ্ঞাতব্য ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ভাষারই সঙ্গে। ভাষা তো যন্ত্র বলেনা, ভাষা তো কোনও মানবগোষ্ঠী পরামর্শ করে কোনও বিশেষ স্থানে বা কালে সৃষ্টি করেনি। জীবন্ত মানুষের বাস্তব পরিবেশের চাপে, প্রয়োজনে উদ্ভুত হয়েছে ভাষা। যেহেতু এ প্রয়োজন যুগে যুগে পরিবর্তিত হয়েছে তাই ভাষারও বিবর্তন ঘটেছে। ইন্দো-ইউরোপীয় থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত ‘গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে’— এই চরণটি বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন ভাষান্তরে কী ভাবে বিবর্তিত হয়েছিল বানানে ও উচ্চারণে এ তিনি আনুপূর্বিক বলে যেতেন। বলা বাহুল্য, এ উদাহরণ সৃষ্টির পিছনে বহু পরিশ্রম ছিল। শুধু কালে নয়, স্থানের পরিবর্তনে ভাষার বিবর্তনও তিনি অত্যন্ত মনোজ্ঞরূপে বলতেন বাংলাদেশেরই নানা আঞ্চলিক বৈচিত্র্যে। সুনীতিকুমার শুষ্ক তত্ত্বকে বোঝাতেন অজস্র পরিচিত অর্ধপরিচিত এবং অপরিচিত উদাহরণ দিয়ে। ক্রমে ক্রমে অর্ধপরিচিত হয়ে উঠত পরিচিত এবং অপরিচিত হত অর্ধপরিচিত। একটা কারণ ছিল, তিনি জানতেন শ্রোতারা সে সব জানে না। কিন্তু সে জন্যে কিছু মাত্র তাচ্ছিল্য ছিল না তাঁর বাগভঙ্গিতে, যেন একটু প্রণিধান করলেই ছাত্ররা সবই বুঝবে। তাঁর এই প্রত্যয় প্রতিফলিত হত অকৃপণ ভাবে জ্ঞানভাণ্ডার উজাড় করে দেওয়ার মধ্যে, এবং সত্যিই উৎসাহী ছাত্রের বিশ্বাস জন্মাত কতকটা পরিশ্রম করলে তাঁরা অন্তত ওঁর মূল বিবক্ষিতটি মোটামুটি ধরতে পারবেন। পারতেনও। এবং এখানে অধ্যাপক হিসেবে তাঁর চূড়ান্ত সার্থকতা। মৃতবিদ্যার জড় পিণ্ড বিকর্ষণ করে ছাত্রকে, জীবিত বিদ্যার স্পন্দন আকর্ষণ করে, প্রলুব্ধ করে জ্ঞানলাভে, প্রবৃত্ত করে নবতর সাধনায়। অধ্যাপকরূপে তাঁর আলস্য ছিল না। নিত্য নতুন জ্ঞান সংগ্রহ করছিলেন বলে রোজ নতুন জ্ঞান পরিবেশন করতে পারতেন যা খুব কম অধ্যাপকের সাধ্য ছিল। আর ছিল অনুপুঙ্খ সম্বন্ধে কঠোর সতর্কতা, বারবার নিজের বক্তব্যকে উদাহরণকে নিজে যাচাই করে নিতেন স্থূণানিখাতন্যায়ে, যাতে কোনও মতেই কোনও ভুল তথ্য না বলেন। ভাসাভাসা জ্ঞান ছিল তাঁর ঘোর অপছন্দ; কোনও বিষয় জানতে চাইলে আকর গ্রন্থ ছাড়া অন্য কিছুতেই ভরসা পেতেন না, প্রায়ই একাধিক আকর গ্রন্থের আশ্রয় নিতেন। ইতিহাস, ভূগোল, দেবকল্পনা, সমাজ, নৃতত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্ব সবই আনুষঙ্গিক ভাবে এসে পড়ত এবং অসামান্য সমৃদ্ধ করে তুলত তাঁর দেওয়া তত্ত্ব ও তথ্যকে।
তাঁর ছাত্রছাত্রী কি শুধু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আশুতোষ বিল্ডিংএ? সেখানে আর ক’জনকে পড়িয়েছেন তিনি? তার শতগুণ জিজ্ঞাসু নিত্য ভিড় করত সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়ি থেকে শুরু করে ‘সুধর্মা’ পর্যন্ত; বিদ্যাসাগর কলেজের দিন থেকে মৃত্যুর ক’দিন আগে পর্যন্ত। কাউকে বিমুখ করতেন না, যে এক গণ্ডুষ জলের প্রার্থী হয়ে আসত তাকে কলসি ভরে দিতেন এবং আরও দূরে নদীর সন্ধান দিতেন। এ ব্যাপারে তাঁর ক্লান্তি ছিল না, কার্পণ্য ছিল না। তাঁর সান্নিধ্যে যাঁরাই এসেছেন সকলেরই এক অভিজ্ঞতা, সামান্য জানতে চেয়ে কত বেশি জেনে গেলাম। এটা হত, কারণ সুনীতিকুমারের নিজের ছিল: ‘ভূমৈব সুখং নাল্পে সুখমস্তি। ভূমাত্বেব বিজিজ্ঞাতিসত্যঃ।’ এই ভূমারই সন্ধান দিতে চাইতেন ছাত্রছাত্রীদেরও। যার অঞ্জলিতে যতটা ধরে ততটা সে পেয়েছে, উপচে পড়েছে তাঁর দান। অধ্যাপনা তাঁর শেষ হয়নি। বরং পরিসর বেড়েই চলল, পরিণতি হল ‘জাতীয় অধ্যাপক: মানবিকী বিদ্যা’। এই-ই তাঁর যথার্থ সারস্বত পরিচয়; কোনও একটি বিষয়ের সঙ্গে শুধু তাঁকে যোগ করলে তাঁর ক্ষেত্রে অব্যাপ্তি দোষ ঘটে। মানবিকী বিদ্যাই ছিল তাঁর বিষয়; পারিভাষিক অর্থে শুধু নয়, ব্যুৎপত্তিগত অর্থেও; কারণ তাঁর অধ্যয়ন অধ্যাপনার মূল মন্ত্র ছিল; ‘আমি মানব, মানবের কিছুই আমার পক্ষে অবান্তর নয়। ওই মানবকেন্দ্রিকতা থেকে ভাষাচর্চা এসেছিল বলেই সে চর্চা এত সজীব এবং এত সঞ্জীবনী ছিল। যে দেশে গেছেন সেখানকার ইতিহাস শিল্প সংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিতে দেখেছেন স্থানীয় মানুষকে এবং তার পটভূমিতে দেখেছেন তার ভাষাকে।