সামাজিক পরিবেশ

সামাজিক পরিবেশ

ডিরোজিও যখন জন্মগ্রহণ করেন, তখন আঠারো শতকের কলকাতার নাগরিক সমাজের মন্দগতি রূপান্তর সবেমাত্র শুরু হয়েছে। ক্লাইভ—হলওয়েল—ভ্যান্সিটার্ট—হেস্টিংস—কর্নওয়ালিসের যুগ অস্তাচলে গেছে, এবং তার সঙ্গে কালা—জমিদার গোবিন্দরাম মিত্র, মুনশি মহারাজা নবকৃষ্ণ, গোকুল ঘোষাল, অক্রুর দত্ত, রামদুলাল দে সরকার, মদন দত্ত, বারাণসী ঘোষ, হৃদয়রাম ব্যানার্জি প্রভৃতি বেনিয়ান—মুচ্ছুদ্দি ব্যবসায়ীদের প্রতাপ—প্রতিপত্তির স্বর্ণযুগও কিছুটা নিষ্প্রভ হয়ে এসেছে। মনে হয়, সমগ্র আঠারো শতকটা যেন কলকাতার মতো উদীয়মান মহানগরের আকাশে বিলীয়মান সামন্তযুগের বর্ণচ্ছটা ছড়িয়ে দিয়েছিল। তারই গোধূলিতে সমাজের রঙ্গমঞ্চে দৌরাত্ম্য করেছিলেন, ব্রিটিশের কলের পুতুল সেজে, সেকালের বাঙালি মুনশি—মহারাজ, দালাল—গোমস্তা, ইজারাদার—বেনিয়ানের দল। উনিশ শতকের গোড়া থেকে তাঁদের গতিবিধি মন্থর হয়ে এল, অনেকে মঞ্চ থেকে প্রস্থানও করলেন। বংশানুক্রমে তাঁদের পুত্র—পৌত্ররা এলেন, সঞ্চিত পৈতৃক বিত্তের অপচয় করে এক বিচিত্র শহুরে বাবুসমাজ গড়ে তুললেন তাঁরা। ডিরোজিও যখন মৌলালি অঞ্চলে জন্মালেন, তখন প্রধানত উত্তর কলকাতার দু’এক পুরুষের ধনিক পরিবারের বংশলোচনরা বাবুরূপ বীজ থেকে কচি—কচি চারাগাছে অঙ্কুরিত হয়ে উঠছেন। ডিরোজিও তাঁর যৌবনকালের মধ্যে এইসব চারাগাছকে বাবুবৃক্ষে পরিণত হতে দেখেছেন।

১৮০৯ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত ডিরোজিও স্কুলপূর্ব বাল্যকাল, এবং ১৮১৫ থেকে ১৮২৩ সাল পর্যন্ত তাঁর শিক্ষাকাল। ১৮২৬ সালে সতেরো বছর বয়সে তিনি হিন্দু কলেজের শিক্ষক নিযুক্ত হন, মধ্যে দু—এক বছর অন্য কাজ করেন। ১৮২৬ থেকে ১৮৩১ সালে মৃত্যু পর্যন্ত কয়েক বছরের সামাজিক অবস্থা হিন্দু কলেজে তাঁর কর্মজীবন প্রসঙ্গে স্বভাবতঃই আলোচিত হবে। তাঁর ব্যক্তিচরিত্রের গঠনকাল হিসেবে প্রথম ষোলো বছরের সামাজিক পরিবেশই প্রথম আলোচ্য। বাল্যকাল ও কৈশোরের পরিবেশ যে—কোনো মানুষের চরিত্র রূপায়ণে প্রত্যক্ষ প্রভাব বিস্তার করে বেশি, ডিরোজিওর জীবনেও করেছিল। যৌবনে যখন সেই পরিবেশের সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয় হয়, তখন ব্যক্তি ও সমাজের সংঘাতের ভিতর দিয়ে সচেতন ব্যক্তি চেষ্টা করে সমাজের রূপ বদলাতে। ডিরোজিও নবযৌবনকালে তা—ই করেছিলেন। তখন তিনিও ছিলেন স্রষ্টা ও নির্মাতা, সমাজই কেবল সর্বশক্তিমান ছিল না। কিন্তু জীবনের প্রথম পনেরো—ষোলো বছর মানুষের জীবনের নিয়ন্তা থাকে পরিবার ও সমাজ। পরিবার যেহেতু সমাজের প্রতিচ্ছবি, তাই নিয়ন্তা কেবল সমাজকে বললেও অত্যুক্তি হয় না। কী সেই সমাজ, যা বালক ও কিশোর ডিরোজিওর চরিত্রকে বিদ্রোহের বিস্ফোরক পদার্থ দিয়ে গড়ে তুলেছিল?

কলকাতা শহরের অর্ধগ্রাম্য রাস্তায় তখন হাতি চলেফিরে বেড়াচ্ছিল, কারণ সমাজে তখনও হাতির প্রভুরা ছিলেন। মধ্যযুগের স্থূলতা, মন্থরতা ও অচলতার প্রতাপ তখনও অখণ্ড না থাকলেও, একেবারে লোপ পেয়ে যায়নি। ধীরে হলেও তার প্রতিপত্তি খর্বিত হচ্ছিল নিশ্চয়। ডিরোজিও জন্মেছিলেন, গোড়াতেই বলেছি, বাবুসমাজের অঙ্কুরোদগমকালে। বাবুরা ছিলেন গতায়ু সমাজের ভুক্তাবশেষ, নবকলেবরে সুসজ্জিত হয়ে সমাজপ্রাঙ্গণে কিছুকালের জন্য তাঁদের সশব্দ সমাগম হয়েছিল ইতিহাসের গতিপথের প্রতিবন্ধকরূপে। ফিরিঙ্গি সমাজে জন্মেও এবং ড্রামন্ডের স্কুলে শিক্ষা পেয়েও, ডিরোজিও তদানীন্তন বাবুবৃক্ষের সুপরিপক্ব ফল হয়ে পথের ধুলোয় ঝরে পড়তে পারতেন। কিন্তু জীর্ণপত্রের মতো ঝরে না পড়ে তিনি প্রচণ্ড ঝড় তুলেছিলেন সমাজে। কারণ ঝড়ের প্রত্যাশা সমাজমানসে তখন সঞ্চারিত হয়েছিল।

সামন্তযুগের সবচেয়ে কুৎসিত প্রথা গোলামির প্রাদুর্ভাব তখন পর্যন্ত কলকাতা শহরে যা ছিল তা বিস্ময়কর। সুপ্রিমকোর্টের একটি মামলার রায় প্রসঙ্গে কলকাতায় দাসগোলামের বাণিজ্য সম্বন্ধে ১৭৮৫ সালে উইলিয়াম জোন্স বলেন : ‘এখানকার গোলামদের দুরবস্থার কথা যা আমি জানি তা এত মর্মান্তিক যে বলতে সংকোচ হয়। প্রতিদিন গোলামদের উপর যেসব নিষ্ঠুর অত্যাচারের কাহিনি আমার কানে পৌঁছোয় তা শোনাও মহাপাপ বলে আমি মনে করি। এই জনবহুল কলকাতা শহরে শুনেছি এমন পুরুষ বা স্ত্রীলোক খুব কমই আছেন যাঁর ঘরে অন্তত একটি ছেলে বা মেয়ে ক্রীতদাস নেই। খোঁজ করলে, দেখা যাবে হয়তো নিদারুণ অন্নাভাবের জন্য গোলামটি এই অভিশপ্ত জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছে। এ দেশে দারিদ্র্যই দাসত্বের অন্যতম কারণ। সম্প্রতি কলকাতা শহর গোলাম কেনাবেচার একটা বড়ো আড়ত হয়ে উঠেছে। অনেকেই জানেন গঙ্গার উপর দিয়ে নৌকা—বোঝাই গোলাম দূর গ্রামাঞ্চল থেকে কলকাতার বাজারে নিয়ে আসা হয় বিক্রি করার জন্য। এইসব গোলাম ছেলেমেয়েদের অধিকাংশকেই তাদের বাপ—মায়ের কাছ থেকে চুরি করে আনা হয়। আবার দুর্ভিক্ষ অন্নকষ্টের সময় অনেক বাপ—মা—ও ছেলেমেয়েদের পণ্যের মতো গোলাম হিসেবে অন্যের কাছে বিক্রি করে দেন।’

উইলিয়াম জোন্স এই মন্তব্য করেছিলেন আঠারো শতকের শেষে। বাংলার বাইরে গোলাম রপ্তানি বন্ধ করার জন্য ১৭৯৩ সালে কোম্পানির ডিরেক্টররা একটি আদেশ জারি করেন। তা সত্ত্বেও উনিশ শতকের প্রায় মধ্যভাগ পর্যন্ত এ দেশে গোলাম কেনাবেচা নির্বিবাদে চলতে থাকে। বিধিনিষেধের বহু ছিদ্রপথে মধ্যযুগের এই অভিশপ্ত প্রথা দীর্ঘকাল আত্মগোপন করে থাকার সুযোগ পায়। উনিশ শতকের দ্বিতীয় তৃতীয় চতুর্থ দশক পর্যন্ত ‘ক্যালকাটা গেজেট’, ‘সমাচার দর্পণ’ প্রভৃতি পত্রিকায় কলকাতা শহরের গোলামদের সম্বন্ধে নানা রকমের খবর প্রকাশিত হয়। শহরের নতুন মনিবদের অত্যাচারের কাহিনি, অত্যাচারের ভয়ে ভৃত্য ও গোলামদের পলায়নের সংবাদ, পণ্যদ্রব্যের মতো গোলাম বেচাকেনার বিজ্ঞপ্তি, অসহায় ও দরিদ্র ব্যক্তির সামান্য মূল্যে পুত্রকন্যা বিক্রয়, অথবা ধর্মীয় অনুশাসনের দায়ে পুত্রকন্যাকে নৈবেদ্যের মতো উপঢৌকন, এসব প্রায় নিত্যসংবাদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিরোজিও তাঁর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এই গোলামি প্রথার বিষাক্ত পরিবেশের মধ্যে জীবন কাটিয়েছেন। ১৮২৭ সালে আঠারো বছর বয়সে ক্রীতদাসদের বন্দি জীবনের গভীর মর্মবেদনা তিনি কাব্যে প্রকাশ করেছিলেন এবং মুক্তির করুণ কাকুতি তাঁর কবিতার অক্ষরে অক্ষরে ঝংকৃত হয়ে উঠেছিল। কবি ক্যাম্পবেলের অবিস্মরণীয় উক্তি : ‘And as the Slave departs, the Man returns’ উদ্ধৃত করে তিনি লেখেন :

 How felt he when he first was told

 A slave he ceased to be;

 How proudly beat his heart, when first

 He knew that he was free!

 The noblest feelings of the soul

 To glow at once began;

 He knelt no more; his thoughts were raised;

 He felt himself a man.

 He looked above––the breath of Heaven

 Around him freshly blew;

 He smiled exultingly to see

 The wild birds as they flew.

 He looked upon the running stream

 That ’neath him rolled away;

 Then thought on winds, and birds, and floods,

 And cried, “I’m free as they.”

 Oh Freedom! there is something dear

 E’en in thy very name,

 That lights the altar of the soul

 With everlasting flame.

 Success attend the patriot sword,

 That is unsheathed for thee!

 And glory to the breast that bleeds,

 Bleeds nobly to be free!

 Blest be the generous hand that breaks

 The chain a tyrant gave

 And feeling for degraded man

 Gives freedom to the slave.

কবিতার ভাব—অনুভাবগুলির মধ্যে ডিরোজিওর হৃদয়ের প্রত্যেকটি তন্ত্রীর অনুরণন শোনা যায়। কবি ডিরোজিও বলেছেন, গোলাম যখন জানতে পারল যে সে তার দাসত্বের নির্বাসনদণ্ড থেকে মুক্ত, তখন তার অন্তরাত্মা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠল। যখন সে স্বাধীন জীবনের স্বাদ পেল, তখন মুক্ত মানুষের উন্নত চিন্তাভাবনাগুলিও তার মনের অনন্ত আকাশে যেন তারার মতো ঝিকমিক করতে লাগল; কারও কাছে আর সে নতজানু হবে না, মাথা হেঁট করবে না, মাথা উঁচু করে উচ্চচিন্তা করবে নির্ভীক বীরের মতো। এই কথা ভাবতে—ভাবতে একবার সে আকাশের দিকে মুখ তুলে চেয়ে দেখল, মুক্ত হাওয়া হাত বুলিয়ে গেল তার মাথায়। আনন্দে আত্মহারা হয়ে মুক্ত বিহঙ্গের ডানা—ঝাপটানি সে দেখতে লাগল। বহমান নদীর দিকে চেয়ে রইল একদৃষ্টিতে। ভাবতে লাগল—এই আকাশ, এই বাতাস, এই পাখি, এই নদী, এদের মতো আমিও স্বাধীন, আমিও মুক্ত। মুক্তি ও স্বাধীনতা কথার মধ্যে না—জানি কী ঐন্দ্রজালিক মোহ আছে! তার নাম করলেই যেন আত্মার বেদিমূলে আলোর প্রদীপ জ্বলে ওঠে, অনির্বাণ তার দীপশিখা। ‘স্বাধীনতা’ নামের মাহাত্ম্য এমন যে, দেশপ্রেমিক তার পবিত্র নামে সংকল্প করে তরবারি কোষমুক্ত করেন, তাঁর পরাজয় হয় না। যে বক্ষ থেকে রক্ত ঝরে পড়ে, আত্মোৎসর্গের গৌরবে সেই বক্ষই টানটান হয়ে ফুলে ওঠে। যে হাত অত্যাচারীর শৃঙ্খল ছিন্ন করে পরাধীন লাঞ্ছিত মানুষকে আত্মমর্যাদা দান করতে পারে, সে হাত ধন্য!

‘ক্রীতদাসের মুক্তি’ কবিতার মধ্যে ডিরোজিওর জীবনের সমগ্র আদর্শটি এমন পরিপূর্ণরূপে মূর্ত হয়ে উঠেছে, যা আর কোথাও হয়নি। বর্বর দাসত্বের অনাদৃত কুৎসিত রূপ তিনি আশৈশব স্বচক্ষে দেখেছেন কলকাতা শহরে। কেবল দারিদ্র্যের জন্যই যে মানুষ দাসখত লিখে দিয়েছে তা নয়, ধর্মান্ধতার জন্যও যে কীভাবে এ দেশের মানুষ অবলীলাক্রমে আত্মবিক্রয় করেছে ও করতে পারে তা—ও তিনি প্রত্যহ দেখেছেন। সর্বপ্রকার দাসত্বের বিরুদ্ধে তাঁর মনপ্রাণ তাই কিশোর বয়সে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে, এবং সকল রকমের ব্যক্তিক ও সামাজিক বন্ধন থেকে তিনি মানুষের অবাধ মুক্তির স্বপ্ন দেখেছেন। তাঁর স্বল্পায়ু কর্মজীবনে এই স্বপ্নকেই তিনি বাস্তবে রূপ দেবার জন্য ব্যাকুল হয়েছিলেন।

ডিরোজিওর বাল্য ও কৈশোর জীবনের পরিবেশ—পরিচয় শেষ হল না এখানে। তার বৈচিত্র্য ও বৈরূপ্যের আরও নানা দিক আছে। তার বিবরণ না দিলে তাঁর চরিত্র গঠনের চিত্রশালার ধারণা পরিষ্কার হবে না। প্রথমেই ন্যায়বিচারের ধারণার কথা মনে পড়ে। লঘু অপরাধে গুরুদণ্ড এবং গুরু অপরাধে লঘুদণ্ড দেওয়া তখনকার ইংরেজ বিচারকদের কাছে সুবিচার বলে গণ্য হত। এই বিচারবোধ ও দণ্ডনীতি যে তাঁদের ব্যক্তিগত ইচ্ছাপ্রসূত ছিল না, সামাজিক প্রথাধীন ছিল, তা বলাই বাহুল্য। আঠারো শতকে তো বটেই, উনিশ শতকের প্রথম পর্ব পর্যন্ত সেকালের পত্রিকায় কলকাতার সুপ্রিমকোর্টের বিচারের যেসব খবর ছাপা হত তা পাঠ করলে আজকের যে—কোনো লোক ভয়ে শিউরে উঠবেন। দু’একটি দৃষ্টান্ত ‘ক্যালকাটা গেজেট’ পত্রিকা থেকে উদ্ধৃত করে দিচ্ছি।

১৮০৬ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে আদালতের সংবাদে দেখা যায় মুর, জেমস, রায়ান নামে সাহেবদের নরহত্যার অপরাধে এক বছর কারাদণ্ড ও কুড়ি টাকা জরিমানা করা হয়। কাউকে আবার একই অপরাধের জন্য এক সপ্তাহ জেল ও একটানা জরিমানা করা হয়। চুরির অপরাধে কানাই মিস্ত্রির হাত পুড়িয়ে ফেলার আদেশ দেওয়া হয়। জালিয়াতি ও প্রতারণার অপরাধে প্রাণদণ্ডও দেওয়া হয় অনেক অপরাধীকে। একসময় ইংরেজরা চাবুক মেরে অপরাধীর প্রকাশ্যে পথের উপর লোকসমক্ষে ফাঁসি দিতেন। তাতেও যথেষ্ট দণ্ড দেওয়া হয় না মনে করে তাঁরা ঠিক করেন যে, অতঃপর বেত্রাঘাত করে অপরাধীকে কামানের মুখে বসিয়ে সোজা উড়িয়ে দেওয়া হবে। এই বিচারবোধ ইংরেজরা ইংলন্ড থেকেই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন, এ দেশের কাজির বিচার অথবা দণ্ডনায়কের বিচার থেকে গ্রহণ করেননি। অর্থাৎ মধ্যযুগের নীতিবোধ ও আইনকানুনের জঙ্গল থেকে এ দেশের লোকের মতো ইংরেজরাও তখনও পর্যন্ত পরিত্রাণ পাননি। বিচারের এই বিসদৃশ বিশৃঙ্খলাকে ট্রেভেলিয়ান ‘illogical chaos of law’ বলে অভিহিত করেছেন। ন্যায়বিচারের এই অর্ধ—বর্বর প্রহসন ডিরোজিও বাল্যকাল থেকে দেখেছেন কলকাতা শহরে। এ—ও যে মধ্যযুগের মানসিক জাড্যের ভস্মাবশেষ ছাড়া আর কিছুই নয় তা—ও তিনি উপলব্ধি করেছেন ধীরে—ধীরে।

কেবল বিচারকদের নয়, ইংরেজ পুলিশের অবস্থাও তখন খুব শোচনীয় ছিল। এ দেশের জাদুমন্ত্র তুকতাক নলচালা বাটিচালা ইত্যাদি আধিভৌতিক কৌশলের সাহায্য নিয়ে চোর—জুয়াচোর সন্ধান করতে ইংরেজ পুলিশরা আদৌ দ্বিধা করতেন না। আঠারো শতকের শেষে টমাস মট নামে এক সাহেব কলকাতার পুলিশ—সুপার ছিলেন। চোর—ডাকাত ধরার জাদুকরি কৌশলের জন্য তিনি ‘জাদুকর মট’ বলে খ্যাত হয়েছিলেন এবং তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গ সেপাইদের শহরের লোক ‘Motte’s conjurors’ বলত। উনিশ শতকের প্রথম পর্ব পর্যন্ত অন্তত কলকাতার পুলিশের মধ্যে জাদুকর মটের শিষ্য—প্রশিষ্যের অভাব ছিল না। শ্রীমতী ফ্যানি পার্কস ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দেও কলকাতার পুলিশকে চালপড়ার সাহায্যে চোর ধরতে দেখেছেন। চৌরঙ্গিতে তাঁর নিজের বাড়িতেই এই পদ্ধতিতে চোর ধরার একটি বিবরণ তিনি লিপিবদ্ধ করে গেছেন। চালপড়া ও নলচালার সাহায্যে কলকাতার ইংরেজ পুলিশদের চোর ধরার দৃশ্য উপভোগ করার সুযোগ বাল্যকাল থেকে ডিরোজিও যথেষ্ট পেয়েছিলেন। এ দেশের মনোভূমিতে মধ্যযুগের নানাপ্রকার ভূতপ্রেত—দৈত্যের তাণ্ডবনৃত্য দেখে তিনি বিমূঢ় হয়ে গেছেন। ইংরেজদেরও স্কন্ধে চেপে সেই দৈত্যরা দৌরাত্ম্য করছে দেখে তিনি আরও অবাক হয়েছেন নিশ্চয়। তার উপর হিউমপন্থী গুরু ডেভিড ড্রামন্ডের শিক্ষায় মানুষের মনের এই শ্মশানদৃশ্য তাঁর কাছে যে কী বীভৎস ও ভয়াবহ মনে হয়েছে তা ভাবা যায় না।

কলকাতা শহরে তখন বিপুলকায় মেদবহুল রাজা—মহারাজা বেনিয়ান—ইজারাদারদের জীবনযাত্রা ছিল সর্বক্ষেত্রে ইংরেজ মহাপ্রভুদের অনুগামী। গৃহের আসবাবপত্তরে, দাস—দাসীর সমাবেশে, ভোজসভায় নৃত্য—গীত সমারোহে, উৎস পার্বণের কৃত্রিম বিলাসে, এ দেশীয় সমাজের নব্যপ্রধানেরা বিদেশি শাসকদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লোকচক্ষে সামাজিক মর্যাদালাভের জন্য তখন অত্যধিক লালায়িত হয়েছিলেন।

সমগ্র আঠারো শতক ধরে বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে প্রবল বিপর্যয়ের ঝড় বয়ে গিয়েছিল, তার প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া বাঙালির সামাজিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে স্বভাবতই প্রকট হয়ে উঠেছিল। শাস্ত্রকার ও স্মৃতিকারেরা যত বেশি কঠোর নিয়মের লৌহশৃঙ্খলে পদস্খলিত নীতিভ্রষ্ট সমাজকে বাঁধতে চাইছিলেন, ততই যেন ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’র মতো সমাজের স্খলন—পতন—চ্যুতি ও অধোগতি ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। কৌলীন্যপ্রথা বহুবিবাহ বাল্যবিবাহ পৌত্তলিকতা প্রভৃতি যাবতীয় কুসংস্কার ও কুপ্রথা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল সমাজে। সহমরণ ও সতীদাহের মতো বীভৎস প্রথাও উনিশ শতকের প্রথম পর্ব পর্যন্ত বাংলার সমাজে যেভাবে প্রসারলাভ করেছিল, তা থেকে অজ্ঞান ও অযৌক্তিকতার গাঢ় অন্ধকার যে দেশবাসীর মন ও বুদ্ধিকে কতখানি আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল তা খানিকটা অনুমান করা যায়। ডিরোজিও যখন এই নতুন মহানগরে জন্মগ্রহণ করেন, তখন এই ঘোর অমাবস্যার অন্ধকারে আমাদের যুক্তি ও বুদ্ধি নিমজ্জিত হয়েছিল। ভেলার মতো কেবল ভেসে বেড়াচ্ছিল ধর্মোন্মত্ত বিকলচিত্ত, বুদ্ধিদীপ্ত যুক্তির ও দৃষ্টির কোনো কান্ডারি ছিল না তাতে।

কৃষ্ণপক্ষের রাতের মতো বাংলা দেশের জীবনে গোটা আঠারো শতকটাই পর্বে—পর্বে যেন অন্ধকারের প্রহর অতিক্রম করে চলেছিল। সেই অন্ধকারে কেবল ধ্বনিত হচ্ছিল অর্থলোলুপদের শোরগোল, বিদেশি ও স্বদেশি উভয় দলের। তার মধ্যে শিক্ষার বাসনা ছিল না, জ্ঞানবিদ্যা ও সংস্কৃতচর্চার প্রতি অনুরাগ তো দূরের কথা বরং বিরাগই ছিল এবং দেশীয় মহান ঐতিহ্য যা—কিছু তা যে বিস্মৃতির কোন অতল তিমিরে তলিয়ে গিয়েছিল, তার ঠিক নেই। বিদেশি রাইটার, জুনিয়র—সিনিয়র মার্চেন্ট, ফ্যাকটর, এজেণ্ট থেকে কৌন্সিলের সদস্য, প্রেসিডেন্ট, গভর্নর পর্যন্ত সকলেই ছিলেন টাকার ধান্দায় উন্মত্ত, দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য। তাঁদের এ দেশি প্রতিবিম্বরা, অর্থাৎ নতুন বাঙালি (এবং অবাঙালিও) ধনাঢ্যরা বিদেশি প্রভুদের পদাঙ্ক অনুসরণ করার প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হচ্ছিলেন পদে—পদে। এইসব নব্য বাঙালি রাজা—মহারাজা—মুনশি দেওয়ান—বেনিয়ানদের তাৎকালিক বিকৃত সাংস্কৃতিক আচরণের একটি হলওয়েল বর্ণিত ‘জেন্টুদের দুর্গোৎসব’। শিক্ষা—সংস্কৃতিক্ষেত্রে আঠারো শতকের একমাত্র ক্ষীণ আলোকরশ্মি হল ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত বাংলা ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’, কিন্তু এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠার ভিতর দিয়ে তখন যে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানানুসন্ধিৎসা প্রকাশ পেয়েছিল তা সীমাবদ্ধ ছিল কলকাতা শহরের মাত্র ত্রিশজন ইয়োরোপীয়ের মধ্যে। এই ত্রিশজনের মধ্যে সকলে যে প্রাচ্যবিদ উইলিয়াম জোন্সের মতো বিদ্যানুরাগী ছিলেন তা নয়, সামাজিক প্রতিপত্তি ও প্রভুত্বের জোরেও অনেকে এই বিদ্বৎগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। বাঙালি ও ভারতীয়ের জীবনের সঙ্গে তার কোনো সংস্রব ছিল না, অন্তত আঠারো শতকে। সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতাদের কক্ষেই এই আলোকরশ্মি আবদ্ধ হয়ে ছিল। কিন্তু অন্ধকার রাত্রির পর আলোকোজ্জ্বল দিন আসে যেমন, ঠিক তেমনি সহজ নিয়মে না হলেও, কতকটা অনুরূপ ঐতিহাসিক প্রবর্তনের ছন্দে সামাজিক অন্ধকার যুগের পর নতুন আলোর ও আশার সম্ভাবনা নিয়ে নবযুগের অভ্যুদয় হয়। আঠারো শতকের পর উনিশ শতকের প্রথম পর্ব থেকেই একটা পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল নতুন সম্ভাবনা নিয়ে।

১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে ডিরোজিও যখন জন্মগ্রহণ করেন, রামমোহন রায় তখনও বাংলার নতুন রাজধানী কলকাতা শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করার সিদ্ধান্ত করেননি। বালক ডিরোজিও যখন ড্রামন্ডের স্কুলে ভরতি হন, সেই সময় ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি রামমোহন কলকাতায় এসে বসবাস করতে আরম্ভ করেন। আট—নয় বছর ডিরোজিও যখন ড্রামন্ডের স্কুলে লেখাপড়া শিখেছিলেন, রামমোহন তখন ধীরে—ধীরে নবযুগের আদর্শ সংগ্রামে অবতীর্ণ হচ্ছিলেন। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে ডিরোজিওর যখন বর্ণপরিচয় হচ্ছে ধর্মতলা অ্যাকাডেমিতে, রামমোহন তখন কলকাতায় ‘আত্মীয় সভা’ স্থাপন করে এবং অনুবাদ ও ভাষ্যসহ ‘বেদান্ত গ্রন্থ’ প্রকাশ করে সমাজে প্রথম কলগুঞ্জনের সৃষ্টি করছেন।

১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে ডিরোজিও যখন ন’বছরের ছাত্র, রামমোহন তখন সহমরণ বিষয়ে তাঁর ‘প্রবর্তক ও নিবর্তকের’ সংবাদ লিখে প্রকাশ করেন।

১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে চোদ্দোবছর বয়সে ডিরোজিও বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করেন। তখন তাঁর পূর্ণ কৈশোর, এবং নব্যবাবুদের কলকাতা শহরে তাঁর সামনে পাতাল—বিস্তৃত পিচ্ছিল পতনের পথ। আরও একটি দুর্গম পথ বহু বাধা অপসারণ করে রামমোহন তখন নির্মাণ করেছিলেন বটে, কিন্তু তা যেমন চড়াইবহুল, তেমনি কণ্টকাকীর্ণ ও বিপদসংকুল। এর যে—কোনো একটি পথ ধরে ফিরিঙ্গি—সন্তান ডিরোজিওকে তখন যাত্রা করতে হবে।

যে সমাজে ডিরোজিওর বাল্যকাল, কৈশোর ও যৌবনের প্রথম পর্ব কেটেছিল, তার রূপ ও প্রকৃতি ছিল এইরকম।* এই ধরনের সমাজে সচেতন ব্যক্তিত্বের বিকাশ হয় দুই প্রকারের—হ্যাঁ—ব্যক্তিত্ব, না—ব্যক্তিত্ব। সমাজের প্রচলিত প্রথা ও সংস্কার মাথা হেঁট করে মেনে চলতে রাজি না, শাস্ত্রমত বলে গৃহীত বিধিনিষেধ আচরণীয় বলে স্বীকার করতে সম্মত না, বুদ্ধি ও যুক্তির অগম্য যা তা সত্য বলে শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছুক না, কোনো শাসন—অনুশাসনকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও বিচারবুদ্ধির চেয়ে বড়ো সত্য বলে গ্রহণ করতে বাধ্য না—সামাজিক পরিবেষ্টনের একটা সীমিত স্তরে তখন এইরকম ‘না—না’ আর ‘না’—র বিস্ফোরক বারুদ দিয়ে ঠাসা। সমাজের এই স্তরে অগণিত ‘না’—এর বারুদের মধ্যে আবাল্য প্রতিপালিত হয়ে ডিরোজিওর মনপ্রাণ প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহে চারদিক বিদীর্ণ করে যেন ফেটে পড়তে চেয়েছিল।

………

১. বিনয় ঘোষ : ‘কালপেঁচার রম্যরচনা’ গ্রন্থের ‘কলকাতা কালচার’ দ্রষ্টব্য।

২. “Thirty Gentlemen attended this meeting. (১৫ জানুয়ারি, ১৭৮৪, বৃহস্পতিবার এশিয়াটিক সোসাইটি স্থাপনের উদ্দেশ্যে আহূত প্রথম সভা) and they represented the elite of the European Community in Calcutta at the time.” (Centenary) Review of the Asiatic Society of Bengal, 1784-1883–Part 1, History of the Society, by Rajendralal Mitra)

* বিনয় ঘোষ : বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা : ১৮০০—১৯০০

বিনয় ঘোষ : বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ (পরিবর্তিত দ্বিতীয় সংস্করণ) সামাজিক পরিবেশের বিস্তারিত পরিচয় এই গ্রন্থগুলিতে পাওয়া যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *