ছাত্র ডিরোজিও

ছাত্র ডিরোজিও

পরিবারের চেয়ে ডিরোজিওর জীবনে বহিরাবেষ্টনের প্রত্যক্ষ প্রভাব অনেক বেশি গভীর ছিল। তাঁর জীবনের আসল বনিয়াদ গড়ে উঠেছিল বিদ্যালয়ে, পিত্রালয়ে নয়। ছ’বছর থেকে চোদ্দোবছর বয়স পর্যন্ত ডিরোজিও বিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করেছিলেন। বিদ্যালয়ের নাম ‘ধর্মতলা অ্যাকাডেমি’, শিক্ষকের নাম ডেভিড ড্রামন্ড।

ধর্মতলার চাঁদনির কাছে ছিল ড্রামন্ড সাহেবের স্কুল। তার উত্তরে ছিল গুমঘর, পশ্চিমে হসপিটাল স্ট্রিট, দক্ষিণে ধর্মতলা এবং পুবে হার্ট সাহেবের ঘোড়ার আস্তাবল। উত্তর—দক্ষিণ—পুব—পশ্চিম চারদিক থেকেই স্কুলে প্রবেশ করা যেত। মৌলালি থেকে চাঁদনির স্কুলে হেঁটে যেতে বালক ডিরোজিওর দশ—পনেরো মিনিটের বেশি সময় লাগবার কথা নয়।

সাহেব ও ফিরিঙ্গিদের স্কুলের মধ্যে ড্রামন্ড, শেরবোর্ন ও হাটম্যান, এই তিনজনের স্কুলের তখন সুনাম ছিল কলকাতায়। ধর্মতলায় ছিল ড্রামন্ডের স্কুল, উত্তর চিৎপুর অঞ্চলে আদি ব্রাহ্মসমাজের কাছে ছিল শেরবোর্নের স্কুল, আর হাটম্যানের স্কুল ছিল বৈঠকখানায়। কলকাতার প্রাচীন সম্ভ্রান্ত বাঙালি পরিবারের সন্তানেরা অনেকে এই কয়েকজন ফিরিঙ্গি গুরুর কাছে যৎকিঞ্চিৎ কালোপযোগী ইংরেজি বিদ্যা আয়ত্ত করে তদানীন্তন সমাজে অপ্রত্যাশিত বৈষয়িক প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন। ওয়ার্ড বুক ও স্পেলিং বুকের কতকগুলি নিত্যব্যবহার্য ইংরেজি শব্দ কোনোক্রমে কণ্ঠস্থ করে আমাদের পূর্বপুরুষেরা যে অর্থ ও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, আজ শত—শত ইংরেজি কেতাব পাঠ করে, বড়ো বড়ো ডিগ্রি নিয়েও আমরা কল্পনায় তার নাগাল পাই না। বাস্তবিক লেখাপড়া করে গাড়িঘোড়া চড়া সম্ভব ছিল সেকালে, একালে নয়।

আঠারো শতকের শেষ পর্বে কলকাতা শহরে সুপ্রিমকোর্ট স্থাপিত হবার পর থেকে, অর্থ রোজগারের প্রয়োজনে, ইংরেজি—শিক্ষার আগ্রহ এ দেশের লোকের মনে জাগতে থাকে। প্রধানত আদালতের বাঙালি মুহুরিরা এই আদিপর্বের ইংরেজি শিক্ষকরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তখনও বিদেশি মিশনারিরা এ কাজে আদৌ অগ্রসর হননি। সুতরাং ইংরেজি—শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রথম উদযোগীর কৃতিত্ব বাঙালিদেরই প্রাপ্য, পাদরিদের নয়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তো নয়ই। অবশ্য সেকালের ইংরেজি—শিক্ষা বলতে শব্দশিক্ষাই বোঝাত, প্রকৃত বিদ্যা আয়ত্ত করার প্রশ্নই ছিল না। কোর্টের মুহুরিদের সেরকম বিদ্যা দান করার ক্ষমতাও ছিল না। নিছক ব্যাবহারিক জীবনে সাহেবদের সঙ্গে মিলেমিশে কিছু অর্থ রোজগারের সুবিধার জন্য যেসব ইংরেজি শব্দ ভাববিনিময়ের তাগিদে জেনে রাখার প্রয়োজন হত, সেইগুলি তালিকাবদ্ধ করে কোনোরকমে কণ্ঠস্থ করতে পারলেই সেকালে ইংরেজির দিগগজ পণ্ডিত হওয়া সম্ভব হত। যিনি যত বেশি ইংরেজি শব্দ মুখস্থ করতে পারতেন, তাঁর পাণ্ডিত্যের খ্যাতি তত বেশি শহরময় ছড়িয়ে পড়ত এবং ওই বিদ্যেটুকুর জন্য দোর্দণ্ডপ্রতাপে তাঁরা সমাজে চলাফেরা করতেন। এঁরাই ইংরেজ আমলের আদিপর্বের এ দেশীয় ‘ইনটেলেকচুয়াল’।

এই সময় থেকে বিদেশি ইংরেজরা ও ফিরিঙ্গিরা ব্যক্তিগত ব্যবসায় হিসেবে নিজেদের চেষ্টায় ইংরেজি—শিক্ষার ছোট ছোট স্কুল খুলতে থাকেন কলকাতায়। শেরবোর্ন, ড্রামন্ড ও হাটম্যানের মতো মার্টিন বাউলের স্কুল ছিল আমড়াতলায়, প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী মতিলাল শীল এই স্কুলের ছাত্র ছিলেন। শেরবোর্নের ছাত্রদের মধ্যে দ্বারকানাথ ঠাকুর অন্যতম। আরাতুন পিক্রসের স্কুলও মধ্য কলকাতায় সুপরিচিত ছিল, এবং তাঁর ছাত্রদের মধ্যে কলুটোলার কানা নিতাই সেন ও খোঁড়া অদ্বৈত সেন ব্যাকরণহীন ভাঙা—ভাঙা ইংরেজি—শিক্ষার জন্য সেকালে যথেষ্ট খ্যাতি ও প্রতিপত্তি অর্জন করেছিলেন। ইংরেজি—শিক্ষার এই পর্বের রেশ থাকতেই ডিরোজিওর বিদ্যাশিক্ষা আরম্ভ হয়েছিল।

১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে ডিরোজিও যখন জন্মগ্রহণ করেন, তখন পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ দেশের রাজস্ব থেকে শিক্ষাখাতে এক কপর্দকও ব্যয় করা আবশ্যক বোধ করত না। ১৮১১ খ্রিস্টাব্দে মিন্টো একটি পত্রে এ দেশীয় প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থার ক্রমাবনতির দিকে ডিরেক্টরদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং শিক্ষার পুনরুজ্জীবনের জন্য কিছু অর্থব্যয়ের কথাও উল্লেখ করেন। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির নতুন অ্যাক্টে ডিরেক্টররা ভারতবাসীদের শিক্ষার জন্য রাজস্বের উদবৃত্ত থেকে অন্যূন বাৎসরিক এক লক্ষ টাকা ব্যয় অনুমোদন করেন। ব্যয়ের অঙ্ক দেখেই বোঝা যায়, কোম্পানি কতকটা ঢেঁকি গেলার মতো করে ভারতীয়দের শিক্ষার জন্য কিছুটা দায়িত্ব স্কন্ধে নিয়েছিলেন। ডিরোজিও যখন ১৮১৪—১৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে বিদ্যালয়ের শিক্ষা আরম্ভ করেন, কোম্পানির অধীনে আমাদের শিক্ষার তখন এই শোচনীয় হাল ছিল।

শিক্ষার জন্য কিছু অর্থব্যয় আরম্ভ হলেও, শিক্ষার উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও নীতি কী হওয়া উচিত তা তখনও স্থির হয়নি। আধুনিককালের পাশ্চাত্য বিদ্যা বিজ্ঞান—সাহিত্য—দর্শন প্রভৃতির প্রতি কোম্পানির কর্তারা তখন বিমুখই ছিলেন। তাই শিক্ষা বলতে প্রথমদিকে তাঁরা এ দেশের প্রাচীন সংস্কৃত—আরবি বিদ্যার পুনরুজ্জীবনের প্রয়াসী হয়েছিলেন। ১৮২৩—২৪ থেকে ১৮৩৫ সালে মেকলের বিখ্যাত ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষার প্রস্তাব গৃহীত হওয়া পর্যন্ত প্রায় দশ—বারো বছর ধরে প্রাচ্যবিদ ও পাশ্চাত্যবিদ এই দুই দলের মধ্যে মতামতের প্রবল সংঘর্ষ চলতে থাকে। ১৮২৩ সালে রামমোহন রায় এ দেশে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান—দর্শন—সাহিত্য শিক্ষা প্রবর্তনের পক্ষে আমহার্স্টকে একটি দীর্ঘ যুক্তিপূর্ণ পত্র দেবার পর থেকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যবিদদের মতের সংগ্রাম আরও প্রবল রূপ ধারণ করে। সংগ্রামের সূচনাকালেই ডিরোজিওর ছাত্রজীবন শেষ হয়ে যায়। বিতর্কের ঝড় শেষ হবার পর ১৮৩৫ সাল থেকে ইংরেজি—শিক্ষার নীতি যখন স্থিরভাবে গৃহীত হল, তার কয়েক বছর আগে ১৮৩১ সালের শেষে ডিরোজিওর ইহজীবন শেষ হয়ে যায়। ঝড়ের খানিকটা ঝাপটা অবশ্য হিন্দু কলেজে শিক্ষকতাকালে তাঁকে সহ্য করতে হয়েছিল। তবে ডিরোজিওর নিজের শিক্ষাদর্শ তার অনেক আগেই স্থির হয়ে গিয়েছিল, এবং হিন্দু কলেজের মতো পাশ্চাত্য ইংরেজি—শিক্ষার অন্যতম প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শিক্ষকরূপে যুক্ত হয়ে সেই আদর্শকে বাস্তবে যথাসম্ভব রূপায়িত করারও সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন।

বিচ্ছিন্ন ও ব্যক্তিগতভাবে ইংরেজরা, পাদরি সাহেব ও ফিরিঙ্গিরা ইংরেজি শিক্ষার যেসব বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন, সেগুলিকে ঠিক শিক্ষায়তন বলা যায় না। ব্যাবসাবাণিজ্য ও চাকরিবাকরির নিতান্ত প্রয়োজনে যেটুকু ইংরেজি শিখতে হত, তার বেশি এইসব বিদ্যালয়ে শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল না। অধিকাংশ শিক্ষকের তার বেশি শিক্ষা দেওয়ার যোগ্যতাও ছিল না। শেরবোর্ন, পিক্রস, হাটম্যান, ড্রামন্ড প্রভৃতি যে কয়েকজন সাহেব—ফিরিঙ্গির ইংরেজি স্কুলের কথা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁরা প্রত্যেকেই যে সুপণ্ডিত বা উচ্চশিক্ষা দেবার মতো যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন তা—ও নয়। পাণ্ডিত্যের দিক দিয়ে ডিরোজিওর শিক্ষক ড্রামন্ডের মতো ব্যক্তি কলকাতা শহরে তখন সহজলভ্য ছিল না। কলকাতায় যেমন তখন পণ্ডিত ও মৌলবাদীদের অনেক টোল—মাদ্রাসা ছিল, তেমনি সাহেব—ফিরিঙ্গিদেরও ইংরেজি—শিক্ষা দেবার পাঠশালা ছিল। কোনোদিক থেকেই হিন্দু কলেজের সঙ্গে তাদের তুলনা করা যায় না। কয়েকটি স্কুলের বিবরণ দিলে আরও পরিষ্কার বোঝা যাবে।

ফিরিঙ্গি শেরবোর্নের স্কুল ছিল উত্তর কলকাতার চিৎপুর অঞ্চলে। শোনা যায় তাঁর মা ছিলেন এ দেশের ব্রাহ্মণকন্যা। তাই বোধহয় জাতফিরিঙ্গি হলেও ব্রাহ্মণ্য প্রথানুযায়ী ছাত্রদের কাছ থেকে উৎসব—পার্বণের সময় শেরবোর্ন কড়ায়গন্ডায় গুরুদক্ষিণা আদায় করতে আদৌ কুণ্ঠিত হতেন না। দ্বারকানাথ ঠাকুরের মতো অনেক ধনীর সন্তান তাঁর বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। দোল—দুর্গোৎসবের সময় তিনি তাই বেশ মোটা রকমের ভেট পেতেন ছাত্রদের কাছ থেকে। শেরবোর্নের বৈষয়িক বুদ্ধিও যথেষ্ট প্রখর ছিল, তিনি নিজের নামে একটি বাজারও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন উত্তর কলকাতায়, বাৎসরিক ৫০০ টাকা খাজনায় কোম্পানির কাছ থেকে ৯৯ বছরের লিজ নিয়ে বাজার থেকে তিনি বেশ ভালো টাকা রোজগার করতেন।

হাটম্যান ছিলেন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি, ‘ওল্ড মিশন চার্চের’ একজন গোঁড়া সমর্থক। বিদ্যার চেয়ে ধর্মের প্রতি তাঁর আসক্তি ছিল বেশি, তাই এ দেশীয় ছাত্রদের অভিভাবকরা তাঁর বৈঠকখানার স্কুলে ছেলেদের পাঠাতে শঙ্কিত হতেন। ক্ল্যাসিকাল বিদ্যায় পারদর্শী বলে হাটম্যানের খ্যাতি থাকলেও ধর্মবাতিকের জন্য তিনি বিদ্যাচর্চায় বা শিক্ষাদানে মনোনিবেশ করতে পারতেন না। তাঁর সম্বন্ধে একটি মজার কাহিনি একবার ‘বেঙ্গল হরকরা’ পত্রে (১৬ এপ্রিল, ১৮৭৫) প্রকাশিত হয়েছিল। কাহিনিটি এই : সেদিন সন্ধ্যাবেলা মিস্টার ও মিসেস হাটম্যান তাঁদের তিনটি ছেলেমেয়ে নিয়ে গোড়ার গাড়ি করে বাড়ি ফিরছিলেন, এমন সময় রাস্তার উপর হঠাৎ একটি হাতি দেখে ঘোড়া খেপে যায়। ঘটনাটি ঘটে এসপ্ল্যানেডে। ঘোড়া ভয় পেয়ে যাত্রীসহ গাড়ি নিয়ে ড্রেনের মধ্যে লাফ দিয়ে পড়ে। হাটম্যান সপরিবারে ক্ষতবিক্ষত দেহে বাড়ি ফেরেন। ঘটনাটি এখানে উল্লেখ করা হল—হাটম্যানের জন্য নয়, হাতির জন্য। ডিরোজিওর বাল্যকালে কলকাতা শহরে এসপ্ল্যানেডের মতো জায়গায় দু’চারটে হাতিও চলেফিরে বেড়াত। তার প্রতীকী তাৎপর্য এই যে মধ্যযুগের রক্তমাংসের গজমূর্তি নবযুগের কলকাতা শহরে তখনও অচল বা অদৃশ্য হয়নি।

সিমলাতে আমহার্স্ট স্ট্রিটের পুবদিকে মেকলে নামে এক সাহেব একটি স্কুল খুলেছিলেন। সেখানে ইংরেজি বাংলা ফারসি সংস্কৃত ল্যাটিন প্রভৃতি ভাষায় শিক্ষা দেবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ফারসি সংস্কৃত ও লাটিনের জন্য সাহেব মাসিক চার টাকা বেতন এবং ইংরেজি ও বাংলার জন্য তিন টাকা বেতন ধার্য করেছিলেন। বয়সের কোনো বাধা ছিল না বলে তাঁর স্কুলে ছাত্রসংখ্যাও কম ছিল না।

এই ধরনের ছোটো বিদ্যালয় হলেও, ড্রামন্ডের ধর্মতলা অ্যাকাডেমির খানিকটা বৈশিষ্ট্য ছিল। শেরবোর্ন বা হাটম্যানের সঙ্গে ড্রামন্ডের দৈহিক বা মানসিক চেহারার যেমন কোনো সাদৃশ্য ছিল না, তেমনি তাঁর স্কুলটিও ছিল একেবারে অন্য রকমের। ড্রামন্ড ছিলেন খাঁটি বিলেতি সাহেব, জাতে স্কচম্যান। যেমন দুর্ধর্ষ ও একগুঁয়ে প্রকৃতির লোক, তেমনি বিচক্ষণ ও পণ্ডিত। দর্শন সাহিত্য বিজ্ঞান প্রায় সকল বিষয়েই তাঁর অনুরাগ ছিল। ডিরোজিওর জন্মের বছর চার পরে ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে ড্রামন্ড সাহেব স্কটল্যান্ড থেকে বাংলায় আসেন। উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীনভাবে ব্যাবসাবাণিজ্য করে কিছু অর্থ উপার্জন করা। কিন্তু অন্য কোনো বাণিজ্যে জড়িত না হয়ে তিনি অল্পদিনের মধ্যে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন। কয়েকজন বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে অর্থসাহায্য নিয়ে তিনি ‘ধর্মতলা অ্যাকাডেমি’ প্রতিষ্ঠা করেন, এবং পরে নিজে তার অন্যতম স্বত্বাধিকারী হন। তাঁর পিঠের উপর প্রকাণ্ড একটি কুঁজ ছিল বলে শহরের লোকের কাছে তিনি ‘কুঁজো স্কচম্যান’ বলে পরিচিত ছিলেন। বাইরের এই দৈহিক বিকৃতির ক্ষতিপূরণস্বরূপ মনে হয় সৃষ্টিকর্তা তাঁকে আশ্চর্যরকম উন্নত বলিষ্ঠ মনের মালিক করেছিলেন। সেইজন্য তাঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য যিনি একবার লাভ করতেন, তিনি সহজে তাঁকে ভুলতে পারতেন না।

ড্রামন্ড ছিলেন একেবারে ভিন্ন প্রকৃতির লোক, স্বাধীনচেতা ও প্রগতিপন্থী। ‘গুরুমশায়’ বা ‘শিক্ষক’ বলতে আমাদের মনে একটি যে নিরীহ প্রাণীর মূর্তি ভেসে ওঠে, ড্রামন্ডের সঙ্গে তার কোথাও কোনো মিল ছিল না। অত্যন্ত সুস্থ ও সমুন্নত মন নিয়ে তিনি সমাজে বাস করতেন। শহরের মধ্যে সুন্দর একটি বড়ো বাড়ি তিনি ভাড়া করে থাকতেন। বোঝা যেত, বৈরাগীর আত্মনিগ্রহ তাঁর কাম্য ছিল না, ভোগবিলাস ও জীবনের রসাস্বাদনের প্রতি তাঁর আসক্তি ছিল যথেষ্ট। বাড়িতে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে পানভোজন ও নাচ—গান করতে তিনি একটুও সামাজিক সংকোচ বোধ করতেন না। এই সৎসাহস (তাৎকালিক প্রথানুযায়ী) তাঁর বলিষ্ঠ জীবনদর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল বলে তা প্রকাশের পথে তাঁর শিক্ষকতার পেশা কোনো বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি। তাঁর ধারণা ছিল কতকটা এইরকম—মনের দিক থেকে মানুষমাত্রেই সম্রাট। সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রেখে, মানবিক রুচি বিকৃত না করে, আত্মতৃপ্তি ও আত্মবিকাশের জন্য যা ইচ্ছা করার স্বাধিকার প্রত্যেক ব্যক্তির আছে। ঈশ্বর যদি কেউ থাকেন তো থাকুন, যাঁদের অফুরন্ত অবসর আছে তাঁরা স্বর্গলোক কোথায় তার হদিশ করুন, কিন্তু ইহজীবনে মানুষই ঈশ্বর, মানুষই তার সর্বময় প্রভু, এবং মানবচিন্তাই ঈশ্বরচিন্তার নামান্তর। মানুষের চেয়ে বড়ো সত্য আর কিছু নেই পৃথিবীতে। ঘোর সংশয়বাদী ও যুক্তিপন্থী ড্রামন্ড এ কথা কেবল যে বন্ধুদের বা সমদর্শীদের বলতেন তা নয়, মধ্যে—মধ্যে ছাত্রদেরও শোনাতেন, এবং ছাত্রদের কর্ণেই যে কেবল তা প্রতিধ্বনিত হত তা নয়, কিঞ্চিৎ রেশ তাঁর মর্মেও পৌঁছোত।

ধর্মতলা অ্যাকাডেমির কুঁজো স্কচম্যান শিক্ষকটির এই মানসপ্রকৃতির পরিচয় অভিভাবকদের জানা থাকলেও, তাঁর শিক্ষারীতির বৈশিষ্ট্যের জন্য বিদ্যালয়ে ছাত্র পাঠাতে কেউ দ্বিধা করতেন না। এ দেশি ছাত্রদের অভিভাবকরা অনেকে অবশ্য ড্রামন্ডের কাছে ছেলে পাঠাতে ভয় করতেন। ড্রামন্ডের কাছে শিক্ষালাভ করে ছেলেরা পাছে নাস্তিক ও অতিশয় তার্কিক হয়ে উঠে সমাজে ও সংসারে বিপর্যয় ঘটায়, এই ছিল তাঁদের ভয়। তা সত্ত্বেও ড্রামন্ড ও তাঁর বিদ্যালয়ের সুনামের জন্য ছাত্রের অভাব হত না। এ দেশের সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তানেরাও অনেকে বাল্যকালে তাঁর স্কুলে লেখাপড়া শিখেছেন।

ড্রামন্ডের গৃহের নাচ—গানের মজলিশের কথা বলেছি। সেইটাই যে তাঁর গৃহের বড়ো আকর্ষণ ছিল তা নয়। তার চেয়েও বড়ো আকর্ষণ ছিল সাহিত্য—বিজ্ঞান—দর্শন আলোচনার মজলিশ। শোনা যায়, ড্রামন্ড নিজে ছিলেন দার্শনিক ডেভিড হিউমের গোঁড়া ভক্ত। দার্শনিক তত্ত্বের আলোচনাতেও তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল। তার জন্য বাড়িতে নিয়মিত বৈঠক বসত। ড্রামন্ডের এই দর্শনপ্রীতির কথা উল্লেখ করে স্যান্ডফোর্ড আর্নট তাঁর লেখা ফারসি ব্যাকরণ বন্ধুকে উপহার দিয়েছিলেন : “To David Drummond Esq, who amidst the luxuries of the East never lost his rilish for the metaphysics and the muse…”

প্রাচ্যের বিলাসিতার মধ্যে ড্রামন্ডের দর্শন ও সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ একটুও শিথিল হয়নি। ‘D.D.’ নাম দিয়ে নিয়মিত সমসাময়িক ইংরেজি পত্রিকায় কবিতা ও সাহিত্য বিষয়ে তিনি প্রবন্ধ লিখতেন। তাঁর লেখা কবিতার একটি সংকলনও প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু তখনকার দিনে তার খোঁজখবর বিশেষ কেউ রাখতেন না। সাহিত্যের সমঝদার গোষ্ঠী কলকাতার সমাজে তখনও গড়ে ওঠেনি। বিদ্যোৎসাহী ইংরেজদের মধ্যে অনেকে তাঁর সাহিত্যপ্রতিভার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। শোনা যায়, ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতা’ বিষয়ে তাঁর একটি কবিতা পাঠ করে মেটকাফ সাহেব অতিশয় প্রীত হয়ে তাঁর কাব্যগ্রন্থের জন্য পঞ্চাশ টাকা চাঁদা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

সাহিত্যচর্চা ছাড়াও সাংবাদিকতাক্ষেত্রে ড্রামন্ড একজন কৃতী সম্পাদকরূপে তৎকালে বেশ প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছিলেন। তিনি নিজে একখানি সাপ্তাহিকপত্র প্রকাশ করেছিলেন, তার নাম Weekly Examiner––A Journal of Politics, News and Literature। প্রায় বছর দুই চলার পর (১৮৩৯—৪০) পত্রিকাখানি বন্ধ হয়ে যায়। ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে এপ্রিল মাসে ৫৬ বছর বয়সে ড্রামন্ডের মৃত্যু হয়। তাঁর ছাত্র ডিরোজিওর মৃত্যুর পর প্রায় বারো বছর তিনি বেঁচে ছিলেন।

ড্রামন্ডের কোনো স্মৃতিচিহ্ন কলকাতার মতো শহরে থাকার কথা নয়। কিন্তু সার্কুলার রোডের গোরস্থানে ড্রামন্ডের সমাধি আজও দেখা যায়। ড্রামন্ডের সমাধির স্মৃতিফলকে লেখা আছে :

Beneath lie the mortal remains of

David Drummond, a Native of Scotland

and for many years a successful teacher of youth*

in this city : he departed this life on the

28th April 1843, aged 56 years.

This Monument was errected to the Memory

of the deceased by a few of his friends and

pupils who respected his character admired

his talents and esteemed his worth.

‘ধর্মতলা অ্যাকাডেমি’ অথবা ‘উইকলি এগজামিনার’ পত্রিকা কোনোটারই অস্তিত্ব নেই আজ। তাঁর কীর্তিচিহ্ন সবই ধুলোয় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কিন্তু তাঁর সমাধির উপর খোদাই—করা এমন কয়েকটি কথা আছে, যা তাঁর স্মৃতির শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বলা যেতে পারে। এই কথা ক’টি হল : ‘a successful teacher of youth’, তরুণদের সার্থক শিক্ষক।

ড্রামন্ডের নিজের জীবনে না হলেও তাঁর অন্যতম ছাত্র ডিরোজিওর জীবনে এ কথার তাৎপর্য যে কত গভীর তা সহজেই অনুমান করা যায়। এ দেশে পোর্তুগিজ ফিরিঙ্গি পরিবারে জন্মে ডিরোজিও কোথা থেকে এমন শিক্ষা পেয়েছিলেন, যার শক্তিতে বাংলার একদল তরুণকে নবযুগের জীবনদর্শনে উদ্ভ্রান্তের মতো উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলেন, এ প্রশ্ন সকলের মনে জাগবে। প্রশ্নের উত্তর হল, শিক্ষা পেয়েছিলেন তিনি তাঁর শিক্ষক ড্রামন্ডের কাছ থেকে। কবি ও দার্শনিক ড্রামন্ড তাঁর ছাত্রের মানসভূমিতে যে সাহিত্য ও দর্শনের বীজ ছড়িয়েছিলেন সযত্নে, অল্পকালের মধ্যে ডিরোজিওর জীবনে সেই বীজই সোনার ফসল ফলিয়েছিল। যুক্তিবাদী দার্শনিক ডেভিড হিউমের গোঁড়া শিষ্য ড্রামন্ড তাঁর ছাত্র ডিরোজিওকে নবযুগের ন্যায়দর্শনে দীক্ষা দিয়েছিলেন। ড্রামন্ড নিজে কখনো কোনো মতামত বা সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য মনে করতেন না, নির্মম যুক্তি ও বিচারবুদ্ধির অগ্নিপরীক্ষায় তা যাচাই না করে গুরুর জীবনাদর্শের উত্তরাধিকার বহন করে ডিরোজিও তাই এ দেশের তরুণদের শ্রেষ্ঠ কৃতী শিক্ষক হয়েছিলেন।

ড্রামন্ডের ধর্মতলা অ্যাকাডেমির সংবাদ ‘ক্যালকাটা গেজেট’, ‘গভর্নমেন্ট গেজেট’, ‘সমাচার দর্পণ’ প্রভৃতি পত্রিকায় মধ্যে—মধ্যে প্রকাশিত হত। ডিরোজিওর ছাত্রজীবনের কৃতিত্বের কথা এইসব সংবাদ থেকে কিছু—কিছু জানা যায়। একবার আট বছর বয়সে তিনি আবৃত্তিপাঠ, ভূগোল ও অন্যান্য বিষয়ে অসাধারণ মেধা প্রদর্শনের জন্য একটি স্বর্ণপদক পুরস্কার পেয়েছিলেন। এই ধরনের কৃতিত্বের জন্য আরও একবার পুরস্কার পেয়েছিলেন ন’বছর বয়সে। স্কুলের বাৎসরিক পরীক্ষাগ্রহণ ও পরিদর্শনের জন্য তখন কলকাতার স্বনামধন্য সাহেবরা এই শ্রেণির স্কুলে আমন্ত্রিত হতেন। ২০ ডিসেম্বর ১৮২২, একটি বাৎসরিক পরীক্ষায় তখনকার প্রসিদ্ধ ‘ইন্ডিয়া গেজেট’ পত্রিকার সম্পাদক জন গ্র্যান্ট উপস্থিত ছিলেন। পরীক্ষার পরে তিনি তাঁর পত্রিকায় লেখেন : ‘বিভিন্ন লেখকের রচনা থেকে ইংরেজি আবৃত্তি করে ছাত্ররা যে অদ্ভুত কলাকৌশল ও দক্ষতা প্রদর্শন করেছিল, তা বাস্তবিকই বিস্ময়কর। এর জন্য কৃতিত্ব কেবল ছাত্রদের প্রাপ্য নয়, শিক্ষকেরও প্রাপ্য। ডিরোজিও নামে একজন ছাত্র শেক্সপিয়রের শাইলক চরিত্রের এমন অপূর্ব চিত্র তার আবৃত্তির বাচনভঙ্গিতে ফুটিয়ে তুলেছিল, যা ওই বয়সের স্কুলের ছাত্রের পক্ষে অভাবনীয় বলা চলে। কলম্যানের একটি হাস্যকৌতুকের কবিতাও সে আবৃত্তি করেছিল চমৎকার হাস্যোদ্দীপক ভঙ্গিতে।’ ইন্ডিয়া গেজেট—এর সম্পাদক গ্র্যান্ট সাহেবের সঙ্গে ডিরোজিওর তখনও প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যলাভের সুযোগ ঘটেনি। ছাত্রজীবন শেষ হবার পরেই সেই সুযোগ ঘটে, এবং ডিরোজিওর সাহিত্যসাধনা ও সাংবাদিকতার প্রধান গুরু হয়ে ওঠেন গ্র্যান্ট সাহেব।

ধর্মতলা অ্যাকাডেমির আরও একটি বৈশিষ্ট্যের কথা ছাত্রদের কৃতিত্ব প্রসঙ্গে গ্র্যান্ট উল্লেখ করেন। তিনি লেখেন যে, ড্রামন্ডের স্কুলে এ দেশি ও বিদেশি ইয়োরোপীয় ছাত্ররা পাশাপাশি বসে শিক্ষালাভ করছে দেখে খুবই আনন্দ হল। এইভাবে শিক্ষা পেলে উভয় দেশের লোকের মধ্যে বিদ্বেষভাব ও উচ্চনীচভাব অচিরেই দূর হয়ে যাবে। এ কেবল ড্রামন্ডের স্কুলের বৈশিষ্ট্য ছিল না, অন্যান্য সাহেব—ফিরিঙ্গিদের স্কুলেরও ওই একই বৈশিষ্ট্য ছিল। কিন্তু তাতে গ্র্যান্টের আশা পূর্ণ হয়নি, অর্থাৎ উভয় দেশের মানুষের মধ্যে সামাজিক ভেদবৈষম্যবোধ দূর হয়নি।

শেরবোর্নের স্কুলের মতো ড্রামন্ডের স্কুলেও এ দেশের সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলেরা লেখাপড়া করত। গোপীকৃষ্ণ দেবের জামাতা হরিদাস বসু পাঁচ বছর ড্রামন্ডের স্কুলে লেখাপড়া করে যখন বিদায় নেন, তখন সেটা ‘সংবাদ’ হয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। হরিদাস বসু বলেন, ”আমি এই স্কুলে পাঁচ বৎসর থাকিয়া বিদ্যাভ্যাস করিলাম ইহাতে স্কুলের অধ্যক্ষ সাহেবদের আমার প্রতি যেমত অনুগ্রহ তাহা আমি কহিয়া কি জানাইব এবং এই সংসারে যত দান আছে বিদ্যাদানের তুল্য কোনো দান নহে এই বিদ্যা আমাকে দান করিয়াছেন অতএব আপনাদের অনুগ্রহেতে আমি কৃতবিদ্য হইয়া কর্মান্তরে প্রস্থান করি।” হরিদাসের মতো আরও অনেক ধনীর সন্তান, বেনিয়ান—মুচ্ছুদ্দিদের পুত্র ড্রামন্ডের স্কুলে বিদ্যাশিক্ষা করে কর্মান্তরে প্রস্থান করেছেন। বাংলা দেশের বালকদের সঙ্গে ডিরোজিওর বন্ধুত্ব ছাত্রজীবনেই হয়েছিল। তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে দু’চারজন অন্তত বাঙালি ছিল বলে মনে হয়। বাল্যসঙ্গীরা বা সহপাঠীরা কেউ তাঁর জীবনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছেন বলে জানা যায় না। তাঁর শিক্ষক ড্রামন্ডই তাঁর মানসক্ষেত্র কর্ষণ করে নবযুগের দার্শনিক চিন্তার বীজ বপন করেছিলেন। বাল্যে ও কৈশোরে ড্রামন্ডের মতো একজন প্রকৃত শিক্ষক ও চরিত্রশিল্পীর সান্নিধ্যে আসার সৌভাগ্য হয়েছিল বলে ডিরোজিও তাঁর স্বল্পস্থায়ী কর্মজীবনে মাত্র কয়েক বছরের চেষ্টায় এ দেশের ইতিহাসের পৃষ্ঠায় নিজের প্রতিভা ও ব্যক্তিত্বের স্বাক্ষর রেখে যেতে পেরেছেন।

বিদ্যালয়ের যিনি আদর্শ শিক্ষক, তিনি বিদ্যা দান করেন বটে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি দান করেন বিদ্যা ও জ্ঞানের প্রেরণা। প্রায় আট বছর ধর্মতলা অ্যাকাডেমিতে বিদ্যাভ্যাস করলেও এবং ড্রামন্ডের মতো বিদ্যাগতপ্রাণ শিক্ষকের সস্নেহ সংস্পর্শ পেলেও, ডিরোজিও যে সর্ববিদ্যায় যথেষ্ট পারদর্শী হয়েছিলেন তা বলা যায় না। চোদ্দো বছরের কিশোরের পক্ষে কত দূরই বা বিদ্বান হওয়া সম্ভবপর! আট বছর ছাত্রজীবনের পর মাত্র আর আট বছর কর্মজীবন। তারপরেই ডিরোজিওর জীবনের অবসান। কাজকর্মের ফাঁকে এই আট বছর তিনি যথাসাধ্য জ্ঞানবিদ্যার সাধনা করেছিলেন। শিক্ষক—জীবনেও তাঁর নিজের শিক্ষার পালা শেষ হয়নি।

……

* বাঁকা হরফ লেখকের।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *