মতবিরোধ

মতবিরোধ

কৃষ্ণমোহন ও দক্ষিণারঞ্জনের দল বাইরের সমাজে যখন প্রবল বিতণ্ডার ঝড় তুলেছিলেন, তখন ডিরোজিও যে কেবল শান্ত বা উদ্বিগ্ন হয়ে দূর থেকে তা দেখছিলেন তা নয়। ‘ইস্ট ইন্ডিয়ান’ পত্রিকায় হতভাগ্য ফিরিঙ্গি—সমাজের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের জন্য তিনিও প্রস্তুত হচ্ছিলেন। ছাত্রদের তুলনায় যৌবনসুলভ উদ্দামতা তাঁরও কিছু কম ছিল না। কৃষ্ণমোহনের ‘এনকোয়ারার’ পত্রিকার মতো ‘ইস্ট ইন্ডিয়ান’ পত্রিকায় তিনিও তরবারির মতো লেখনী চালনা করতে আরম্ভ করেছিলেন। ধৈর্য ও সংযম, গুরু বা শিষ্যবৃন্দের কারও বিশেষ ছিল না। উভয়েই সমান একরোখা ও চরমপন্থী ছিলেন।

ব্রাহ্মণের বাড়ি গোমাংস নিক্ষেপ করে কৃষ্ণমোহনের বন্ধুর দল যখন চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিলেন, সেই সময় ডিরোজিও ‘ইস্ট ইন্ডিয়ান’ পত্রিকায় ‘জনবুল’ পত্রিকার সম্পাদক সম্বন্ধে কোনো বিষয়ে ‘অসংযত ও অশোভন’ মন্তব্য করে, হিন্দুসমাজে না হলেও, ইয়োরোপীয় ও ফিরিঙ্গি—সমাজে বেশ তোলপাড় তুলেছিলেন। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে। ঘটনাটি ‘জনবুল’ পত্রিকার সম্পাদক ক্যাপ্টেন ম্যাকনাগটেন (Captain Macnagten) নিজের ভাষায় এইভাবে বর্ণনা করেছেন :

I accordingly went to his house (ডিরোজিওর) the following morning, accompanied by a friend, and was shown into an office room where two persons were sitting. I did not know Mr. Derozio by sight, and therefore said that I desired to see the Editor of the East Indian. After some hesitation one of them replied ‘I am the Editor.’ ‘Then’ said I ‘this not (producting note) is your writing I presume?’ He took it from me, looked at it, fumbled with it a little, and then with increased hesitation said that he had written it. Upon that I took it out of his hand, refolded it, returned it to my pocket, and then said, ‘Now, Sir, for the gross insolence of that note, I have come here to inflict upon you a personal chastisement’, and then taking him by the collar, I gave him two blows with a light stick, which blows, though intended for his shoulders, fell upon his arm that had been raised toward them. Them were not of a nature to do him any sort of bodily injury, for I had no desire to do that, nor would the object I had in view have been attained by such effect. He neither said anything nor offered the slightest resistance while this was going on; but on the contrary grew as pale as he could, and perceptibly trembled

–Indian Gazette, 26 September, 1831.

‘বুল’ সম্পাদক লিখেছেন : ‘পরদিন সকালে একজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে আমি ডিরোজিওর বাড়ি গিয়েছিলাম। বাড়ি যাবার পর আমাকে একটি অফিসঘরে নিয়ে যাওয়া হল। দেখলাম, সেখানে দুই ভদ্রলোক বসে আছেন। আমি ডিরোজিওকে এর আগে কোনোদিন চোখে দেখিনি। সেইজন্য ঘরে ঢুকে বললাম, ‘ইস্ট ইন্ডিয়ান’—এর সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করতে চাই। একটু ইতস্তত করে একজন বললেন, আমিই সম্পাদক। তারপর আমি বললাম, তাহলে এই লেখাটি (লেখাটি দেখিয়ে) আপনারই আশা করি? আমার হাত থেকে তিনি লেখাটি নিলেন, কিছুক্ষণ চেয়ে দেখলেন, আমতা—আমতা করে জড়ানো সুরে বললেন, হ্যাঁ, আমারই লেখা। লেখাটি তাঁর হাত থেকে নিয়ে ভাঁজ করে পকেটে রেখে বললাম, এই লেখাতে আপনি যে সীমাহীন ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছেন তা ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে শাস্তি দিয়ে সংশোধন করার জন্য আমি এসেছি। এই কথা বলে, ডিরোজিওর জামার কলার ধরে একটি হালকা বেত দিয়ে দু’ঘা মারলাম। ইচ্ছে ছিল কাঁধের উপর মারার, কিন্তু হাত তুলে ঠেকাতে যাবার ফলে তাঁর হাতেই বেতের বাড়ি লেগেছিল। সত্যি—সত্যি বেত মেরে তাঁকে আঘাত দেবার ইচ্ছা আমার ছিল না, তাতে আমার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হত। এই ঘটনার সময় ডিরোজিও কোনোরকম বাধা দেবার চেষ্টা করেননি। তাঁর চোখ—মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল, এবং ভয়ে তিনি কাঁপছিলেন।’

‘ইস্ট ইন্ডিয়ান’ ডিরোজিওকে বেত্রাঘাত করেছিলেন অবিমিশ্র ‘জনবুল’ ম্যাকনাগটেন।

কারণ খাস—ইংরেজ ক্যাপ্টেনের আত্মসম্মানে নাকি বেহুঁশের মতো আঘাত করেছিলেন ফিরিঙ্গি ডিরোজিও। ঘটনাটি নিয়ে ইয়োরোপীয় ও ফিরিঙ্গি মহলে কয়েকদিন বিপুল উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল। ডিরোজিওর তরুণ বাঙালি ছাত্ররাও নিশ্চয় খানিকটা উত্তেজিত হয়েছিল।

মধ্যে—মধ্যে তরুণদলের সংস্কার প্রচেষ্টা সমর্থন করে ডিরোজিও ‘ইস্ট ইন্ডিয়ান’ পত্রিকায় প্রবন্ধাদিও লিখতেন মনে হয়। অর্থাৎ কেবল ফিরিঙ্গি—সমাজের দিকে নয়, হিন্দুসমাজের দিকেও তাঁর সজাগ দৃষ্টি ছিল। কৃষ্ণমোহনের দল হিন্দুদের কুসংস্কার ও গোঁড়ামির যে কঠোর সমালোচনা করতেন, একমাত্র ডিরোজিও তার ন্যায্যতা ও যৌক্তিকতা বিচার করে আন্তরিক সাধুবাদ জানাতেন পত্রিকা মারফত। হিন্দু মডারেটরা, অর্থাৎ মধ্যবয়স্ক ব্রাহ্মরা নীতিগতভাবে পৌত্তলিকতা বর্জন করেও স্বগৃহে ও পরিবারে ঠিক পৌত্তলিকের মতোই আচরণ করতেন। তরুণ প্রগতিপন্থীদের কাছে স্বভাবতই এ আচরণ বিসদৃশ ঠেকত। মডারেটদের অগ্রগণ্য, ব্রাহ্মদের, অন্যতম নেতা ‘রিফর্মার’ পত্রিকার সম্পাদক প্রসন্নকুমার ঠাকুরকে এই আচরণের অপরাধে তরুণরা একবার ‘এনকোয়ারার’ পত্রিকায় তীব্র সমালোচনা করেন। ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ প্রথমে দুর্গোৎসবের বিবরণ প্রসঙ্গে যাঁরা প্রতিমাপূজাবিরোধী অথচ দুর্গাপূজা করছেন, তাঁদের নামের তালিকা প্রচার করেন। কিছু টিপ্পনীও ছিল তার সঙ্গে। দুই নৌকায় পা দিয়ে এইভাবে যাঁরা এগিয়ে চলতে চান, কথার সঙ্গে কাজের এবং নীতির সঙ্গে আচার—ব্যবহারের সংগতি রক্ষা করার প্রয়োজন বোধ করেন না, তরুণের দল তাঁদের নির্মমভাবে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করেন। প্রসঙ্গটি নিয়ে ডিরোজিও তাঁর ‘ইস্ট ইন্ডিয়ান’ পত্রিকাতেও আলোচনা করেন এবং তরুণদের সমালোচনা যুক্তিসংগত বলে সমর্থন করে প্রসন্নকুমারের দুর্বল দু’মুখো মনোভাব নিন্দনীয় বলে প্রচার করেন। ‘ইন্ডিয়া গেজেট’—এর সংবাদে প্রকাশ

The East Indian then took up the subject, and in allusion to Baboo Prasanna Kumar’s connection with the Reformer, a paper in which the Hindoo Gods and Goddesses are treated with little honor, maintained the inconsistency of his engaging in this festival. Some friend of the Baboo’s then came forward and addressed a letter to the India Gazette, in which be endeavoured to exculpate him, by asserting that he was bound to perform the worship of the Goddess in as much as he had trust property in his hands which had been devoted to the subject. To this a rejoinder was given in the East Indian, denying the fact,

––Indian Gazette, 1 November, 1831.

প্রসন্নকুমারের বন্ধুর যে চিঠির কথা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘The East Indian and Baboo Prusunnu Coomar Tagore’ নামে সেই চিঠিখানি ১৮৩১, ১৯ অক্টোবর তারিখের ‘ইন্ডিয়া গেজেট’—এ প্রকাশিত হয়। প্রসন্নকুমার তাঁর ‘রিফর্মার’ পত্রিকায় পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে লেখেন অথচ নিজে প্রতিমাপূজা করেন বলে ডিরোজিও ও কৃষ্ণমোহনের দলের অভিযোগের উত্তরে বন্ধুটি লেখেন :

He has attacked idolatory because he hates it from the bottom of his heart. I know he hates it as much as Mr. Derozio, the Editor of East Indian, or Baboo Krishnamohan Banerjee, the Editor of the Enquirer, can do.

কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রসন্নকুমার কেন দুর্গাপূজা করেন, সে সম্বন্ধে বন্ধুটি লিখেছেন, তিনি সমর্থন করেন বলে যে পূজা করেন তা নয়, পৈতৃক সম্পত্তি রক্ষার জন্য করতে বাধ্য হন। এই কথা বলে তিনি প্রশ্ন করেছেন :

May I ask Mr. Derozio if he never saw a rank Deist going to the Temple of Christ, and worshipping at his alter without a grain of belief in the Bible? I think he should constantly expose their conduct as being more within the bounds of his vocation, than trouble himself about what Hindoos do––a subject on which not with standing his pretensions he has often betrayed great ignorance.

ডিরোজিওর সবচেয়ে বড়ো দুর্বলতা যেখানে, সমালোচক ঠিক সেখানেই আঘাত করেছেন। অর্থাৎ ডিরোজিওর যে ফিরিঙ্গি এবং হিন্দুদের সম্বন্ধে কোনো সমালোচনা করার অধিকার নেই, এই কথাই তাঁকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইয়োরোপীয় ডিয়িস্টরা বাইবেলের অলৌকিকতায় বিশ্বাস না করেও গির্জায় উপাসনা করতে যান কি না, সে বিষয়ে আলোচনা করার অধিকার ডিরোজিওর আছে, কিন্তু হিন্দুরা পূজা করবেন কি করবেন না, অথবা করলে কী পদ্ধতিতে করবেন, সেসব বিষয় তাঁর আলোচনাভুক্ত নয়, যেহেতু তিনি হিন্দুসমাজ, হিন্দুধর্ম ইত্যাদি সম্বন্ধে কিছুই জানেন না।

অবশ্য ডিরোজিও তাঁর দুর্বলতা সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন। তাই তাঁর তরুণ হিন্দু ছাত্রদের সংস্কার—আন্দোলন পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ানো তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। উপদেষ্টা ও উৎসাহদাতা হয়েই তাঁকে কাজ করতে হয়েছে। তবু মধ্যে—মধ্যে তরুণদের কর্ণধারহীন অসহায় অভিযানের কথা ভেবে, এবং বয়সে নিজেও একজন তরুণ হয়ে, তিনি তাঁদের আদর্শ ও উদ্দেশ্যের নৈতিক সমর্থনে দু’চার কথা প্রকাশ্যে না বলে স্থির থাকতে পারেননি। যখনই বলেছেন, তখনই গোঁড়া হিন্দুরা তো বটেই, ‘মডারেট’ বা উদার সংস্কারপন্থীরাও তাঁর জাতিগত অধিকার সম্বন্ধে তাঁকে সাবধান করে দিয়েছেন। প্রকাশ্যে হিন্দুসমাজ সম্পর্কে কোনো কথা বলার অধিকার বা সুযোগ ছিল না তাঁর। এই অধিকারের গণ্ডি লঙ্ঘন করেই তাঁকে মধ্যে—মধ্যে তরুণদের পক্ষ অবলম্বন করতে হয়েছে, কারণ বাংলার তরুণরা তখন তাঁরই কাছ থেকে পথ চলার প্রেরণা প্রত্যাশা করেছেন সবচেয়ে বেশি।

ডিরোজিওর কর্মচ্যুতি ও তাঁর অনুগত তরুণদের প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণার পর, কলকাতার সাহেবসমাজে তাঁর প্রভাব ও সমাদর বেশ খানিকটা কমে গিয়েছিল মনে হয়। উনিশ শতকের তিরিশে পর্যন্ত ইংরেজরা এ দেশের সামাজিক প্রথা ও আচার—ব্যবহার সম্বন্ধে কোনো বিরূপ মন্তব্য করতে সাহস করতেন না। সমাজ ও ধর্ম বিষয়ে হস্তক্ষেপ করাও তাঁদের শাসননীতিসম্মত ছিল না। তাই ডিরোজিও ও হিন্দু কলেজের ছাত্রদের নিয়ে হিন্দুসমাজ যে বিক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিল, তাতে তাঁরা আলোচনা—সমালোচনার ও মতামত প্রকাশের ব্যাপারে অত্যধিক সাবধান ও খানিকটা ভীতও হয়ে উঠেছিলেন। ডিরোজিয়ানদের মতামত সমর্থন করা তাঁদের পক্ষে স্বাভাবিক হলেও তা তাঁরা অকুণ্ঠচিত্তে করেননি বা করতে পারেননি। ‘ইন্ডিয়া গেজেট’, ‘বেঙ্গল হরকরা’, ‘ক্যালকাটা গেজেট’ প্রভৃতি পত্রপত্রিকায় ডিরোজিও ও তাঁর তরুণ শিষ্যবৃন্দের কার্যকলাপের সমালোচনার ভঙ্গি ও সুর দেখলেই তা বোঝা যায়।

১৮৩১—এর সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কয়েক মাস ধরে ‘ইন্ডিয়া গেজেট’, ‘বেঙ্গল হরকরা’, প্রসন্নকুমারের ‘রিফর্মার’, ডিরোজিওর ‘ইস্ট ইন্ডিয়ান’ ও কৃষ্ণমোহনের ‘এনকোয়ারার’—এই পাঁচখানি ইংরেজি পত্রিকায়, ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ ও ‘সংবাদ প্রভাকর’, ‘সমাচার দর্পণ’ ও ‘জ্ঞানান্বেষণ’—এই চারখানি বাংলা পত্রিকায় এই সময়কার সামাজিক আন্দোলনের ধারা ও গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে নানা রকমের আলোচনা ও বাদ—প্রতিবাদ চলতে থাকে। এই আলোচনার ধারা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনটি প্রধান মতামতের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল তখন—ক. বামপন্থী, খ. উদারপন্থী ও গ. রক্ষণশীল। এই মতামতের বিভিন্ন ধারার সঙ্গে পত্রিকাগুলি এইভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল।

ক. বামপন্থী, খ. উদারপন্থী ও গ. রক্ষণশীল

বামপন্থীরাই এর মধ্যে বয়সে সবচেয়ে তরুণ ছিলেন। প্রভাকর—সম্পাদক কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তর বয়স তখন আঠারো—উনিশ, এবং ডিরোজিয়ানদের হিন্দুধর্মবিদ্বেষের উগ্রতার আবর্তে পড়ে তিনি তাঁদের নির্মম ব্যঙ্গবিদ্রুপ ও সমালোচনা করেছেন। কিন্তু তিনি ঠিক ‘ধর্মসভা’ বা চন্দ্রিকার অন্ধ—সমর্থক ছিলেন না। সমালোচনা তাঁর ব্যঙ্গপ্রীতির আকর্ষণে মধ্যে—মধ্যে শালীনতার সীমা অতিক্রম করলেও, চন্দ্রিকার ঠিক প্রতিধ্বনি তিনি করেননি। তবু মতামতের শ্রেণিবিভাগ করতে হলে এই সময়ের প্রভাকরকে রক্ষণশীল দলের সঙ্গী ছাড়া কিছু বলা যায় না। ‘সমাচার দর্পণ’ শ্রীরামপুরের মিশনারিদের পত্রিকা, তরুণ ডিরোজিয়ানদের হিন্দুধর্ম বিরোধিতায় তাঁদের উল্লসিত হবার কথা। তাই তাঁরা হয়েছিলেনও। এই কারণে তরুণ সংস্কারকদের খানিকটা তাঁরা সমর্থন না করে পারেননি। কিন্তু নাস্তিকতা বা ধর্মভাবের অভাব তখন হিন্দু কলেজের তরুণ ছাত্রদের মধ্যে যেরকম প্রবল ছিল, তাতে মিশনারিদের প্রীত হবার কথা নয়। কোনো মিশনারির দল তা হননি, কেরি—মার্শম্যানের দলও না, ডাফের দলও না। ‘সমাচার দর্পণ’—এর সমর্থন বা উল্লাস সত্ত্বেও তাই তাকে ‘উদারপন্থী’ ছাড়া কোনো আখ্যা দেওয়া যায় না।

সত্যকার মধ্যপন্থী বা উদার মতাবলম্বী ছিলেন ‘রিফর্মার’ এবং তার বড়ো সমর্থক ছিলেন ‘ইন্ডিয়া গেজেট’ ও ‘হরকরা’র ইংরেজ সম্পাদকেরা। ‘গেজেট’ ও ‘হরকরা’ এই সময় উঠে—পড়ে লেগেছিলেন তরুণদের সংযত করার জন্য। ধারাবাহিক সম্পাদকীয় প্রবন্ধে তরুণদের কার্যকলাপ, রীতিনীতি, মতামত ইত্যাদি সমালোচনা করে তাঁরা কেবল তাঁদের গরম না হয়ে নরম হতে উপদেশ দিতেন। অবশ্য কোনো বিদ্বেষভাব নিয়ে ‘destructive’ সমালোচনা তাঁরা বিশেষ করতেন না, সাধারণত সহানুভূতি প্রকাশ করে ‘constructive’ সমালোচনাই করতেন। যেমন ‘ইন্ডিয়া গেজেট’ সম্পাদকীয় প্রবন্ধে লিখেছেন :

Here as well as elsewhere there is a conflict going on between light and darkness, truth and error, and it is because we cannot fully approve of the temper and proceedings of those who have our best wishes that we now advert the subject, in the hopes of leading them to a more correct appreciation of the circumstance in which they are placed, and to the adoption of better adapted means for the promotion of their object.

––India Gazette, Editorial, 21October, 1831.

তারপর যুক্তির জাল বিস্তার করে তরুণদের দেখানো হয়েছে, তাঁদের ভুলভ্রান্তি কোথায় ‘ইন্ডিয়া গেজেট’—এর যুক্তি এই : রামমোহনের অনুগামী ব্রহ্ম—সভাপন্থীরা হলেন হিন্দুসমাজের মডারেট গোষ্ঠী, আর ডিরোজিওর অবাধ চিন্তার অনুগামীরা হলেন ‘ultraleft’ বা ‘র‍্যাডিক্যাল পার্টি’। দুই দলই সমাজের সংস্কার, উন্নতি ও কল্যাণ কামনা করেন এবং চিরকালের শাস্ত্রবচনের চেয়ে যুক্তি ও বুদ্ধির উপরেই নির্ভর করতে চান। উভয় দলই পৌত্তলিকতা যুক্তিহীন ও অর্থহীন কুসংস্কার বলে বর্জন করতে চান, জাতিভেদ অমানবিক সামাজিক প্রথা বলে মানতে চান না এবং যে—কোনো বিষয়ে ধর্মান্ধতাকে ঘৃণা করেন। কিন্তু মডারেটরা ধীরেসুস্থে সংসারের পথ এগুতে চান। তাঁরা মনে করেন, একটা সুপ্রাচীন সমাজের রীতিনীতি, আচার—অনুষ্ঠান ধ্যানধারণা হঠাৎ ইচ্ছা করলেই বদলে ফেলা যায় না। তা ছাড়া, সমাজের জনমতকে উপেক্ষা করে বা আঘাত দিয়েও কোনো প্রথা বা সংস্কার বা অনুষ্ঠান উচ্ছেদ করার চেষ্টা করলে বিপরীত ফল ফলতে পারে। তাতে সংস্কার—প্রচেষ্টা ব্যর্থ করার সম্ভাবনাই বেশি। মডারেটদের এই উগ্রতা ও অস্থিরতা এত প্রবল যে, সহযোগী বা ‘fellowtraveller’ মডারেটদের ব্যক্তিগতভাবে নাম ধরে—ধরে সমালোচনা করে ক্রমেই তাঁরা তাঁদের দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন। সকল দলের সংস্কারকামীদের ‘united front’ প্রয়োজন গোঁড়া রক্ষণশীলদের বিরুদ্ধে। বামপন্থীদের এই ঐক্য ও পারস্পরিক সহনশীলতা না থাকলে তাঁদের কোনো দলেরই উদ্দেশ্য সফল হবার সম্ভাবনা নেই। বিশেষ করে তরুণ প্রগতিপন্থীরা যদি তাঁদের লেখায় ও আচরণে আরও সংযম ও ধৈর্য প্রকাশ করতে না পারেন তাহলে সংস্কারসাধনের সমস্ত উদ্যম তাঁদের ব্যর্থ হবে। ‘ইন্ডিয়া গেজেট’—এর এই যুক্তি সমর্থন করে ‘বেঙ্গল হরকরা’ লেখেন :

We agree with our contemporary of the India Gazette that some of the Hindoo Reformers in their abhorrence of, superstitions have been in some instances carried away by the violence of their feeling into foolish extravagances and very idle bravadoes

‘রিফর্মার’ পত্রিকাতেও তাঁদের কর্মনীতি ব্যাখ্যা করে তরুণ বামপন্থীদের অসহিষ্ণুতা ও উগ্রতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে থাকেন। তরুণরা মডারেটদের বলতেন ‘half-liberals’ এবং মডারেটরা তরুণদের বলতেন ‘ultra-radicals’, কিন্তু সাধারণের কাছে তাঁরা শুধু মডারেট ও ‘র‍্যাডিক্যাল’ বলে পরিচিত ছিলেন। উভয় দলের বাদপ্রতিবাদ সম্বন্ধে ‘হরকরা’ লেখেন :

The merits of the two sects have excited some rather angry and irritating discussions, which while they can do no good to either party may seriously injure the cause which both equally profess to have at heart, and only adopt different means for the attainment of the same end.

—India Gazette, 26 October, 1831.

‘ইন্ডিয়া গেজেট’, ‘হরকরা’, ‘রিফর্মার’ প্রভৃতি বিজ্ঞ পরামর্শদাতাদের উপদেশ—নির্দেশ তরুণরা যে ঘাড় হেঁট করে মেনে নিতেন তা নয়। তাঁদের মন্থরগতি নরমনীতির সমালোচনা করে, প্রত্যেকটির যুক্তি খণ্ডন করে, তাঁরা জবাব দিতেন! ‘এনকোয়ারার’ পত্রিকায় প্রকাশিত তরুণ র‍্যাডিক্যালদের একটি দীর্ঘ জবাব ২৮ অক্টোবর (১৮৩১) ‘ইন্ডিয়া গেজেট’—এ মুদ্রিত হয়। তরুণরা লেখেন যে, বয়স্ক ও প্রবীণ প্রাজ্ঞদের যুক্তি দিয়ে বা বুঝিয়ে তাঁরা দলভুক্ত করতে পারবেন বলে আশা করেন না। ‘ইন্ডিয়া গেজেট’ ও ‘হরকরা’ মনে করেন যে, মডারেটদের কটু সমালোচনা করে তরুণরা ক্রমে তাঁদের রক্ষণশীলদের দলে ঠেলে দিচ্ছেন—এ অভিযোগ ভিত্তিহীন। বরং তরুণদের নীতি ও কার্যকলাপের কঠোর সমালোচনা করে এবং রক্ষণশীলদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে নানা রকমের কুৎসা রটিয়ে মডারেটরাই তাঁদের সংস্কার—আন্দোলন কোণঠাসা করার চেষ্টা করছেন।

রক্ষণশীল ও মডারেটদের বিত্ত বা প্রতিপত্তির কোনো অভাব নেই, ইচ্ছা করলে তাঁরা সহায়সম্বলহীন তরুণদের সব দিক দিয়ে পিষে মেরে ফেলে দিতে পারেন। কুৎসা রটানোর সুবিধা তাঁদের অনেক, এবং তাঁদের পত্রিকার প্রচার বেশি বলে হিন্দুসমাজের বৃহৎ অংশের কাছে তরুণদের বিরুদ্ধে তাঁদের বক্তব্য পৌঁছে দিতে কোনো অসুবিধা হয় না। সুতরাং মডারেটদের তরুণরা বিচ্ছিন্ন করছেন না, বরং তরুণদের তাঁরাই উচ্ছন্ন করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছেন। তা ছাড়া মডারেটদের মন্থরগতি সংস্কারনীতির মূলেই এমন গলদ রয়েছে যে, তাঁদের উপর কোনোদিক থেকেই ভরসা করা যায় না। তাঁরা কখনো ডাইনে, কখনো বাঁয়ে চলেন, যখন যেদিকে সুবিধা। নীতি বা আদর্শ বলে বিশেষ কিছু তাঁদের নেই। কথা ও কাজের সঙ্গে তাঁদের কোনো সামঞ্জস্য নেই। সম্পত্তি, টাকাকড়ি, জাতি প্রভৃতি এত রকমের স্বার্থের সঙ্গে তাঁরা জড়িত যে সামাজিক সংস্কারকর্মে নির্ভয়ে আত্মনিয়োগ করা তাঁদের পক্ষে অসম্ভব। যুগের হাওয়া বদলেছে বলে প্রগতির কথা তাঁরা মুখে আওড়ান, কেবল তার মানটুকু সমাজের কাছ থেকে বিনা মাশুলে আদায় করার জন্য। কিন্তু যখন প্রত্যক্ষ পরীক্ষার সামনে এসে দাঁড়াতে হয়, তখনই ভয়ে তাঁদের বুক কাঁপতে থাকে, চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে যায়, কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হয়ে আসে এবং স্বার্থের কালো হাওয়া নীতির ক্ষীণ দীপশিখাটিকে ফুৎকারে নিভিয়ে দেয়। এই তো হিন্দুসমাজের স্থির—ধীর মডারেটদের অবস্থা। এহেন মডারেটদের সঙ্গে হাত মেলাবার চেষ্টা করে লাভ কী? এরকম ডাইনে—বাঁয়ে দোলায়মান সহযাত্রী কি পথ চলতে সাহায্য করে, না বাধারই সৃষ্টি করে বেশি? তরুণ র‍্যাডিক্যালরা তাই লিখেছেন, ‘We disregard all that they say or do, and are engaged in measuring our success with the rising generation.’ ‘ইন্ডিয়া গেজেট’ পত্রিকার সম্পাদককে লক্ষ্য করে ‘এনকোয়ারার’ লিখলেন, “We hope he will not forget that our object is to influence our younger friends with a liberal example, and that we never entertained the elder members of the orthodox community.” প্রসঙ্গত গো—হাড় নিক্ষেপের ঘটনাটিও উল্লেখ করা হয়েছে। ‘ইন্ডিয়া গেজেট’ এই ঘটনাটির কথা বারংবার উত্থাপন করে তরুণদের অপছন্দ করার চেষ্টা করেন বলে ‘এনকোয়ারার’ লিখেছেন :

Our contemporary has adverted to the throwing of the meat in the house of an orthodox Hindoo––a circumstance which the perpetrators confessed was wrong and which no generous mind would after our confession of repentance, and assurance of strict conduct––think of referring to. It is true that the feelings of the bigots have been improperly wounded; we have perceived our guilt and have corrected ourself, is it then consistent with one that ‘wishes us will’––may, whose ‘warmest wishes’ we have the happiness to be entitled to––to rake up faults which we have confessed ourselves guilty of, and which perhaps the most implacable foe would have the generosity to excuse?

‘কিছুদিন আগে একজন গোঁড়া—হিন্দুর বাড়িতে গোহাড় নিক্ষেপের ঘটনাটি ‘ইন্ডিয়া গেজেট’ সম্পাদক পুনরুল্লেখ করেছেন তরুণদের লোকচক্ষে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য। কিন্তু তরুণরা যখন কাজটি অত্যন্ত অন্যায় হয়েছে বলে স্বীকার করেছেন, অনুতাপ করেছেন এবং ভবিষ্যতে আর এরকম অন্যায় আচরণের পুনরাবৃত্তি হবে না বলে আশ্বাস দিয়েছেন, তখন আমাদের সহযোগীর উচিত হয়নি তরুণদের গায়ে কাদা ছেটাবার জন্য বিষয়টি পুনরায় উল্লেখ করা। অন্যায়ভাবে আমরা গোঁড়াদের আঘাত দিয়েছি এ কথা ঠিক। কিন্তু আমরা আমাদের ভুল স্বীকার করে নিজেদের যে সংশোধন করেছি, সে কথাও ঠিক। অতএব তা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার অর্থ হল কুৎসিত মনোবৃত্তির পরিচয় দেওয়া। গেজেট কথায়—কথায় আমাদের হিতাকাঙ্ক্ষী বলে পরিচয় দেন, শুভেচ্ছাও জ্ঞাপন করেন, তাই তাঁদের এ কথা বলা প্রয়োজন। শত্রুরাও শুনেছি দোষ স্বীকার করলে ক্ষমা করেন, কিন্তু সহযোগী গেজেট আমাদের মিত্র হয়েও এটুকু উদারতা দেখাতে পারেননি।’

মতামতের এই সংঘাত ১৮৩১ সালের আগস্ট—সেপ্টেম্বর থেকে ১৮৩২ সাল পর্যন্ত চলতে থাকে, তারপর তার তীব্রতা ধীরে—ধীরে কমে যায়। কিন্তু ১৮৩২ সালের সঙ্গে আপাতত আমাদের সম্পর্ক নেই, কারণ ডিরোজিও তার কয়েকদিন আগেই সংগ্রামক্ষেত্র থেকে তো বটেই, ইহলোক থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। ১৮৩২ সালে ও তারপরে সংগ্রামের সমস্ত দায়িত্ব বহন করে এবং তার প্রচণ্ড ঝড়ঝাপটা সহ্য করে এগিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর তরুণ মন্ত্রশিষ্যরা। ১৮৩১ সালই ডিরোজিওর জীবনের শেষ বৎসর। ২৫ এপ্রিল তাঁর পদচ্যুতির পর থেকে মে, জুন, জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর পর্যন্ত—রক্ষণশীল, মডারেট ও তরুণ র‍্যাডিক্যাল, দলের পত্রপত্রিকায় মতামতের ঘাতপ্রতিঘাত ক্রমেই তীব্রতর হতে থাকে। এর মধ্যে ডিরোজিও নিজে একবার John Bull—এর গায়ে খোঁচা দিয়ে তাঁর শিঙের গুঁতো সহ্য করেন। তাঁর তরুণ ছাত্রদলও রক্ষণশীল ও মডারেট উভয়গোষ্ঠীর নির্মম বিদ্রুপবাণে জর্জরিত হতে থাকেন। মতামতের এই ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে ১৮৩১ সাল, এবং ডিরোজিওর জীবন, ক্রমে শেষ হয়ে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *