সংঘর্ষ

সংঘর্ষ

শিক্ষকতা ছেড়ে ডিরোজিও সাহিত্য ও সাংবাদিকতার সাধনায় আত্মনিয়োগ করলেন। আধুনিক মুদ্রণযন্ত্রের যুগে সামাজিক আন্দোলনের ও জনমত গঠনের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হল সংবাদপত্র। ডিরোজিও তা জানতেন, তাই পত্রিকার ভিতর দিয়ে তাঁর মতামত ও আদর্শ প্রচারের জন্য প্রস্তুত হলেন। মানিকতলার শ্রীকৃষ্ণ সিংহর বাগানবাড়িতে তারপরেও অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনের বা অনুরূপ কোনো আলোচনাসভার বৈঠক বসত কি না জানা যায় না। অন্তত তার কোনো সঠিক সংবাদ পাওয়া যায়নি। পরিবেশ যেরকম উত্তপ্ত হয়েছিল তখন, তাতে মানিকতলায় ডিরোজিয়ানদের বিতর্কসভা বসলে ক্ষিপ্ত জনতা হয়তো—বা চড়াও হত সেখানে। জনতাকে লেলিয়ে দেবার মতো প্রভাবশালী গোঁড়া হিন্দু সমাজনেতারও অভাব ছিল না।

পত্রিকা কেবল ডিরোজিও নিজে প্রকাশ করেননি, তাঁর প্রিয় ছাত্রদেরও সেই কাজে উৎসাহিত করেছিলেন। ছাত্রদের মধ্যে অগ্রগণ্য কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বয়স তখন (১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে) আঠারো বছর, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের বয়স সতেরো বছর, রামগোপাল ঘোষের বয়স ষোলো বছর এবং ডিরোজিওর নিজের বয়স বাইশ বছর। অ্যাকাডেমিক সভায় তিনি ছাত্রদের বিদ্যাবুদ্ধি নয় শুধু, বাগ্মিতাবিকাশেও সাহায্য করেছেন। সভায় কৃষ্ণমোহন ছিলেন ‘the readiest and most effective speaker, unaffected in manner, calm and unimpassioned though sometimes bursting forth into vehemence’, এবং যে রামগোপাল ঘোষ তাঁর বাগ্মিতার জন্য ‘ডেমস্থেনিস’ আখ্যা পেয়েছিলেন, ‘this debating club was to him what the Oxford club had been to many and English orator.’ গুরুগম্ভীর জটিল বিষয়ের বিতর্কে ষোলো—সতেরো—আঠারো বছরের তরুণদের এই প্রতিভার বিকাশ সত্যিই বিস্ময়কর। ডিবেটিং ক্লাবের বাগ্মিতার বদলে এবারে স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তেজোদীপ্ত তারুণ্যের কঠিন পরীক্ষার সময়।

সিংহাসনচ্যুত গুরুর কাছে শিষ্যবৃন্দ সমবেত হলেন সংকটকালে উপদেশ ও উৎসাহের জন্য। বিদ্বৎসভার সংকীর্ণ আবেষ্টনীর মধ্যে বাকযুদ্ধ করলে আর চলবে না। তরবারির চেয়েও শতগুণ শক্তিশালী লেখনী ধারণ করে প্রকাশ্য জনসমাজে অন্ধ গোঁড়ামি ও অজ্ঞানতার বিরুদ্ধে নির্ভয়ে নিরন্তর সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হবে।

আঠারো বছরের যুবক কৃষ্ণমোহনের সম্পাদনায় প্রকাশিত হল ইংরেজি The Enquier পত্রিকা ১৮৩১ খ্রিস্টাদের মে মাসে, অর্থাৎ ডিরোজিও কলেজ ছাড়ার মাসখানেকের মধ্যে। জুন মাসের গোড়াতে সতেরো বছরের তরুণ দক্ষিণারঞ্জনের সম্পাদনায় প্রকাশিত হল বাংলার সাপ্তাহিকপত্র ‘জ্ঞানান্বেষণ’। ডিরোজিও নিজে তাঁর সমস্ত সম্বল উজাড় করে The East Indian নামে একখানি ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশ করলেন, ৯ নম্বর কসাইতলা থেকে (১১ বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট)। পত্রিকার নামকরণ থেকে বোঝা যায়, কেবল এ দেশের হিন্দুসমাজের সংস্কারের জন্য নয়, নিজের নির্যাতিত ও অবহেলিত ফিরিঙ্গি—সমাজের আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামের জন্যও তিনি সচেষ্ট হয়েছিলেন।

‘দি এনকোয়ারার’ পত্রিকার উদ্দেশ্য ঘোষণা করে প্রথম সংখ্যায় কৃষ্ণমোহন লেখেন : “Having thus launched our bark under the denomination of Enquirer, we set sail in quest of truth and happiness.” দক্ষিণারঞ্জনের বাংলা ‘জ্ঞানান্বেষণ’ পত্রিকার আদর্শ প্রচারিত হল এই সংস্কৃত শ্লোকটিতে :

এহি জ্ঞান মনুষ্যানামজ্ঞান তিমিরংহর।

দয়া সত্যঞ্চ সংস্থাপ্য শঠতামপি সংহর।।

মানুষের অজ্ঞানতার তিমির হরণ করে, দয়া ও সত্যকে সংস্থাপন করে, শঠতাকে সংহার করে জ্ঞানের বিকাশের পথ প্রশস্ত করাই পত্রিকার আদর্শ। বছর দুই পরে ‘জ্ঞানান্বেষণ’ ইংরেজি—বাংলা দ্বিভাষী পত্রিকায় পরিণত হয়। কৃষ্ণমোহন ও দক্ষিণারঞ্জন প্রধানত হিন্দুসমাজ নিয়ে এবং ডিরোজিও নিজে ফিরিঙ্গি—সমাজ নিয়ে সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। ডিরোজিওর ফিরিঙ্গি চরিতকার এডওয়ার্ডস বলেছেন যে ‘ইস্ট ইন্ডিয়ান’ পত্রিকা হল ‘the first newspaper that was the recognised organ of Eurasians and which advocated their claims… with an eloquence and a power of argument of which East Indians may well be proud.’

ডিরোজিও মধ্যে—মধ্যে কৃষ্ণমোহন ও দক্ষিণাকে উপদেশ পরামর্শ দিতেন, ‘এনকোয়ারার’ পত্রিকায় তাঁর পক্ষে লেখাও সম্ভব, কিন্তু নিজে ফিরিঙ্গি বলে মনে হয়, তিনি দূরে সরে থাকাই পছন্দ করতেন। হয়তো তিনি ভাবতেন, ফিরিঙ্গি হয়ে হিন্দুসমাজের সংস্কারক হবার চেষ্টা করলে খ্রিস্টান পাদরিদের মতো তাঁকেও উপহাসের পাত্র হতে হবে। তাই বোধহয় দু’জন হিন্দু ব্রাহ্মণ যুবককে হিন্দুসমাজের সংস্কার—সংগ্রামে সামনে এগিয়ে দিয়ে ডিরোজিও নিজে ফিরিঙ্গি—সমাজের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।

সারা জুলাই মাস ধরে (১৮৩১) কলেজের তরুণদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের ঝড় বয়ে চলল। বিক্ষোভ ক্রমেই যেন বাড়ছিল মনে হয়। ১৬ জুলাই ‘সংবাদ প্রভাকর’ লেখেন, ”অপর শ্রীযুত মেম্বর মহাশয়দিগের প্রতি আমারদিগের নিবেদন এইমত আজ্ঞা তাবৎ ক্লাস মেস্টর এবং পণ্ডিতমহাশয়দের প্রতি দেন যে হিন্দু কলেজের ছাত্ররা ফিরিঙ্গির মতো পরিচ্ছদ না করিতে পায় যথা—ফিরিঙ্গির জুতা পায় সবচুল মাথায় খালি আঙ্গরাখা গায় মালা নাই গলায় মেচরের গুণে সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় হয় এবং দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করে” ইত্যাদি। অভিযোগের ভাষা দেখে বোঝা যায়, বিরক্তি ও ব্যঙ্গবিদ্রূপের মাত্রা কোথায় পৌঁছেছিল। ১৪ মে তারিখের ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় উদ্ধৃত ‘সংবাদ প্রভাকর’ একটি চিঠিতে এই বিচিত্র ঘটনাটির উল্লেখ দেখা যায়।

কলকাতার একজন গৃহস্থ ভদ্রলোক নিজের পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে ‘৺জগদম্বার দর্শনে’ কালীঘাটে এসে এক দোকানে বাসা করেন। অতঃপর গঙ্গাস্নান করে পূজার নৈবেদ্যাদি নিয়ে ‘জগদীশ্বরীর সন্নিধানে’ উপস্থিত হয়ে ‘তাবতের সহিত অষ্টাঙ্গে প্রণাম’ করেন, কিন্তু ‘উক্ত গৃহস্থের সুসন্তানটি’ প্রণাম করেন না। তার পরিবর্তে ‘ব্রহ্মাদি দেবতার দুরারাধ্যা যিনি তাঁহাকে ওই ব্যলীক বালক কেবল বাক্যের দ্বারা সম্মান রাখিল’ অর্থাৎ দেবী কালীকে সম্বোধন করে বলল, গুড মর্নিং ম্যাডাম। ‘ইহা শ্রবণে অনেকেই শ্রবণে হস্ত দিয়া’ পলায়ন করলেন। তারপর তার পিতা তাকে প্রহার করার জন্য উদ্যত হলে জনৈক ভদ্রলোক বাধা দিয়ে বললেন, ক্ষান্ত হন, এখানে রাগ প্রকাশ করা উচিত নয়। তাতে সেই বেল্লিক বালকের পিতা আক্ষেপ করে ছেলেকে বললেন, ‘ওরে, আমি কী ঝকমারি করে যে তোকে হিন্দু কলেজে দিয়েছিলাম, যে তোর জন্যে আমার জাত—মান সব গেল।’ ভদ্রলোকের দিকে ফিরে তিনি বললেন, ‘জানেন মশায়, এই কুলাঙ্গারের জন্যে আমি সমাজে মুখ দেখাতে পারি না, ধর্মসভায় যেতে পারি না।’ তাঁর এই খেদোক্তি শুনে ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, শুনেছি কলকাতার অনেক বাঙালি বড়োমানুষ হিন্দু কলেজের ম্যানেজার, তাহলে কেন ছেলেদের এরকম কুশিক্ষা হয়? এই কথার উত্তরে ছেলের পিতা বললেন, আর মশায়, বাঙালি বড়োমানুষের গুণের কথা বলবেন না। ঘরের টাকা দিয়ে তাঁরা দেশের ছেলেদের পরকাল টনটনে করছেন।

ধর্মসভার মুখপত্র ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ ২ মে, ১৮৩১ ইংরেজি—বিদ্যার সঙ্গে নাস্তিকতার সম্পর্ক বিষয়ে যে প্রবন্ধ লেখেন তা—ও এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। হিন্দু কলেজের ও ডিরোজিওর ছাত্ররা ইংরেজি শিক্ষার ফলে কেন যে নাস্তিক হয়ে উঠছেন, চন্দ্রিকার কাছে তা বোধগম্য নয়। ইংরেজি শিখলেই যে নাস্তিক হতে হবে, চন্দ্রিকা তা মনে করেন না। তাঁরা বলেন, আগে যেসব দেওয়ান—মুচ্ছুদ্দি ছিলেন, তাঁরা ইংরেজি শিখে, ‘সাহেব লোকের অভিপ্রায় মত কর্ম সুসম্পন্নপূর্বক বহু ধনোপার্জন’ করেছিলেন এবং ইংরেজরা তুষ্ট হয়ে তাঁদের নানা প্রকারের মর্যাদা প্রদান করতে কুণ্ঠিত হননি। অবশ্য এ কথা ঠিক যে, মুচ্ছুদিরা ভালো ইংরেজি জানতেন না। কথিত আছে, ঢেঁকির বিবরণ দিতে গিয়ে কোনো মুচ্ছুদ্দি সাহেবের কাছে বলেছিলেন, ‘টুমেন ধাপুড় ধুপুড়, ওয়ান মেন সেঁকে দেয়।’ কিন্তু তাতে কী? এই ইংরেজি শিখেই তাঁরা যথেষ্ট ক্ষমতাশালী লোক হয়েছিলেন এবং কাজকর্মও বেশ উত্তমরূপে নির্বাহ করতে পারতেন। এঁদের পরবর্তীকালে যাঁরা দেওয়ান—মুচ্ছুদ্দি হলেন—যেমন হরিমোহন ঠাকুর, নীলমণি দত্ত, তারিণীচরণ মিত্র, গঙ্গাধর আচার্য, নীলমণি দে প্রভৃতি তাঁরা অনেকেই ইংরেজি—বিদ্যায় ‘বিলক্ষণ পারগ’ হয়েছিলেন, কিন্তু তার জন্য তাঁরা নিজেদের ধর্মকর্ম বিসর্জন দেননি। তারপর যাঁরা মুচ্ছুদ্দি ও জমিদার হন, তাঁদের মধ্যে উমানন্দন ঠাকুর, রাধাকান্ত দেব, রামকমল সেন, হরচন্দ্র লাহিড়ী, রসময় দত্ত, শিবচন্দ্র দাস, রামপ্রসাদ দাস প্রভৃতি ইংরেজি—বিদ্যায় যেরকম পারদর্শী হয়েছিলেন তা ‘বাঙ্গালি ও ইংরাজ’ সকলেই জানেন। অথচ এঁরা কেউ ‘আপন ধর্ম কর্ম অমান্য করেন নাই এবং নিষ্কর্মান্বিত কখন নহেন।’ এঁরা কেউ দেওয়ান, কেউ গ্রন্থকর্তা, কেউ সেরেস্তাদার, কেউ—বা খাজাঞ্চির বিশ্বস্ত কর্মে নিযুক্ত থেকে বহু অর্থ উপার্জন করেছেন।

সামাজিক ইতিহাসের এইটুকু প্রস্তাবনাকারে বিশ্লেষণ করে চন্দ্রিকা লিখেছেন : ”এক্ষণে যাঁহারা ভালো ইংরাজি শিক্ষা করিয়াছে তাহারদিগের বিদ্যার কি এই ফল হইল কেবল নাস্তিকতা করিবেক, ভালো যদি ওই নাস্তিকের মধ্যে উক্ত ব্যক্তিদিগের মত কেহ তা পদপ্রাপ্ত হইতে পারিত তথাচ বুঝিতাম যে নাস্তিকতা করাতে সাহেব লোক তুষ্ট আছেন এই নিমিত্ত করে, তাহা কোন মতেই নহে কেননা কর্মকর্তা সাহেব লোক বেলিক নাস্তিককে কখন উচ্চ পদে বা বিশ্বস্ত কর্মে নিযুক্ত করেন না ইহা নিশ্চয় আছে।’ চন্দ্রিকার ন্যায়—অন্যায় বিচারের মানদণ্ড অত্যন্ত নিরেট। ইংরেজি শিখে নাস্তিক হলে ইংরেজরা খুশি হয়ে যদি ভালো চাকরি দিতেন এবং বহু টাকা উপার্জন করা যেত, তাহলেও বরং নাস্তিকতা অনেকটা সার্থক হত। কিন্তু তা যখন সম্ভব নয় তখন নাস্তিক হয়ে লাভ কী? আগেকার লোক অল্প ইংরেজি—বিদ্যার জোরে ধর্মকর্ম করে, দেওয়ানি, সেরেস্তাদারি প্রভৃতি বড়ো বড়ো চাকরি করেছেন, আর আজকালকার যুবকরা তাঁদের চেয়ে অনেক ভালো ইংরেজি শিখে কেউ পাঠশালার টিচার, কেউ—বা ষোলোটাকা মাইনের কেরানি হচ্ছেন, আর কেউ—কেউ অভিমান করে ঘরে বসে বিদ্যালয়ে প্রাইজ—পাওয়া পুস্তকগুলি নাড়াচাড়া করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছেন। অতঃপর চন্দ্রিকা দুঃখ করে বলেছেন যে, যতদিন পিত্রালয়ে আহারের সংস্থান আছে, ততদিন চিন্তা নেই, কিন্তু পরে যে এঁরা কী করবেন তা ঈশ্বরই জানেন! যিশুখ্রিস্ট ভজনে মজে গিয়ে প্রথমে এ দেশের হতভাগ্য অনুন্নত জাতির যে অবস্থা হয়েছিল, এই ইংরেজি কেতাদুরস্ত নাস্তিকদেরও পরে সে অবস্থা হবে। এ দেশের অশিক্ষিত লোকরা মনে করেছিল, পাদরিদের প্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে, যে খ্রিস্টান হলে একটি সুন্দরী বিবি, একখানি বাড়ি আর এক লক্ষ টাকা পাওয়া যাবে। কিন্তু খ্রিস্টান হবার পরে তাঁদের ভাগ্যে জুটেছে বাগানের মালি, দারোয়ান ও খিদমতগারের চাকরি। আমাদের হিন্দু কলেজের বাহাদুর, হিন্দু নাস্তিকদের অদৃষ্টেও তার চেয়ে লোভনীয় কিছু জুটবে বলে মনে হয় না। এই হল চন্দ্রিকার সমালোচনার সুর।

পত্রপত্রিকার এইসব সমালোচনা থেকে বোঝা যায়, হিন্দু কলেজের ছাত্রদের বিরুদ্ধে ধর্মসভার বিষোদ্গার ডিরোজিওর পদচ্যুতির পরেও পূর্ণমাত্রায় চলছিল। দুর্মর সমালোচনার ঘন—ঘন কামান—গর্জনে বিচলিত হয়ে উঠেছিলেন তরুণের দল। জুলাই মাসের শেষে (১৮৩১) কৃষ্ণমোহন তাঁর ‘এনকোয়ারার’—এ লিখলেন—

কৃষ্ণমোহনের জবাবের তাৎপর্য এই : আমাদের উপর উৎপীড়ন এখনও পূর্ণমাত্রায় চলেছে। গোঁড়ার দল এখনও ক্ষিপ্ত হয়ে কটূক্তির কামান দাগছেন। গুড়ুমসভার গরম ক্রমেই অসহ্য ও মারমুখী হয়ে উঠেছে। সভার পোষকরা জানেন না তাঁদের এই প্রতিক্রিয়ার ফলাফল কী। ধর্মোন্মাদরা দাবি করছেন যে, আমাদের জাতিচ্যুত ও সমাজচ্যুত করবেন। আমরা উদারপন্থীরা এর জবাব দেব আমাদের ধৈর্য ও সহ্যগুণ দেখিয়ে—গুড়ুমসভার দাপট বাড়ে তো বাড়ুক, তাঁরা ক্রোধে টগবগ করতে—করতে ঔদ্ধত্যের চূড়ায় উঠুন। তাঁদের বিক্ষোভ—বিতৃষ্ণা দাবানলের মতো প্রজ্বলিত হয়ে উঠুক। আমরা উদার। আমরা তাতে ভয় পাব না, নির্ভীক রোমানের মতো আমাদের কাজ করে যাব এবং তার জন্য যত নির্যাতনই সহ্য করতে হোক, তা—ও করব। সমাজচ্যুতির বিষাণ ধর্মধ্বজীরা যদি বাজাতে চান তো বাজান, ঘরে—ঘরে তা বেজে উঠুক। কয়েকশত বিদ্রোহী তরুণ ঘর ও পরিবারের নিরাপদ আশ্রয় থেকে উন্মুক্ত পথের উপর অসহায়ের মতো নিক্ষিপ্ত হোক। তারা সকলে একতাবদ্ধ হয়ে একটা প্রচণ্ড দল গড়ে তুলবে, আমাদের উদ্দেশ্যও তখন সফল হবে।

‘এনকোয়ারার’ পত্রিকায় কৃষ্ণমোহন তখন এইরকম আবেগপূর্ণ ভাষায় তরুণদের উৎসাহিত করছিলেন। পত্রিকার পৃষ্ঠায় তাঁর কলম দিয়ে অনর্গল বিদ্রোহের অগ্নিবর্ষণ হচ্ছিল। রেভারেন্ড লালবিহারী দে লিখেছেন—

Week after week he put in the columns of the Enquirer the orthodox Hindus into the pillory. He thus became, amongst the band of reformers, the most uncompromising denouncer of the national superstition. His house became the resort of those young men who had perceived the absurdity of the national religion, and were breaking through the fetters of caste.

বিদ্রোহী তরুণদের নেতা হয়ে উঠেছিলেন কৃষ্ণমোহন। ডিরোজিওর পদচ্যুতি গোঁড়া হিন্দুসমাজের প্রতি তরুণদের আরও বেশি বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছিল। ধর্মসভার বিরূপ সমালোচনা তাতে ইন্ধনও জোগাচ্ছিল অনবরত। কৃষ্ণমোহনের গৃহে তরুণদের সভা বসত, নানা বিষয়ে আলাপ—আলোচনা হত এবং সংগ্রামের কৌশল ও পথ ঠিক করা হত অবস্থা বুঝে। শিক্ষকের অপমানের আঘাত শিক্ষক নিজে ভুলে যাবার চেষ্টা করলেও, তাঁর ছাত্ররা তা কিছুতেই ভুলতে পারছিলেন না। কারণ তাঁদেরই অভিভাবক, পিতা—পিতামহ ও আত্মীয়স্বজনরা হিন্দুসমাজের কর্ণধার হয়ে সকলের প্রিয় শিক্ষক ডিরোজিওকে অপমানিত করে পদচ্যুত করেছেন, এবং শুধু তা—ই নয়, তাঁর নির্মল চরিত্রে মিথ্যা অভিযোগের কলঙ্ক লেপন করেছেন। কৃষ্ণমোহনের গৃহে মিলিত হয়ে তরুণরা এই অন্যায়ের প্রতিকার সম্বন্ধে চিন্তা করতেন, এবং ‘জ্ঞানান্বেষণ’ ও ‘এনকোয়ারার’ পত্রিকায় সেই চিন্তার ও আলোচনার ফলাফল প্রতি সপ্তাহে প্রকাশ করতেন।

এমন সময় হঠাৎ একদিন একটি নাটকীয় ঘটনা ঘটে গেল। ঘটনার স্থান হল কৃষ্ণমোহনের বাড়ি এবং পাত্রদল হলেন তাঁর তরুণ বন্ধুবান্ধব। কৃষ্ণমোহনের পৈতৃক বাড়ি ছিল মধ্য কলকাতার গুরুপ্রসাদ চৌধুরী লেনে। তাঁর বাড়ির উত্তরে ভৈরবচন্দ্র ও শম্ভুচন্দ্র চক্রবর্তী নামে দু’জন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ বাস করতেন। ২৩ আগস্ট, ১৮৩১। কৃষ্ণমোহন কোনো কাজে সেদিন বাইরে বেরিয়েছিলেন। তাঁর অনুপস্থিতিকালে বন্ধুবান্ধবরা দল বেঁধে তাঁর বাড়িতে এসে বৈঠকখানায় বসে হিন্দুদের গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে গরম—গরম কথাবার্তা বলতে বলতে খুব উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। সেই উত্তেজনার বশে মেছুয়াবাজারের এক মুসলমানের দোকান থেকে রুটি ও গোমাংস নিয়ে এসে বাড়িতেই ভক্ষণ করতে আরম্ভ করেন। ব্যাপারটা তাতেই শেষ হয় না। ভক্ষণান্তে গোমাংসের হাড়গুলি উল্লাসধ্বনি দিতে—দিতে পাশের চক্রবর্তীদের বাড়ির ভিতরে নিক্ষেপ করা হয়। গোহাড়—গোহাড় ধ্বনি শুনে চক্রবর্তীরা হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে আসেন এবং ছেলেদের কীর্তি দেখে স্বভবত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। বালখিল্যদের এই ঔদ্ধত্য তাঁদের অসহ্য মনে হয়। ব্রাহ্মণপ্রধান পাড়ায় দারুণ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। ক্রোধোন্মত্ত প্রতিবেশীরা কৃষ্ণমোহনের বন্ধুদের প্রহার করতে উদ্যত হন। অশ্রাব্য কটুবাক্য অভিসম্পাত তরুণদের উপর বর্ষিত হতে থাকে। প্রহারের ভয়ে তাঁরা বাড়ি ছেড়ে দৌড় দেন। কৃষ্ণমোহনের অগ্রজ ভুবনমোহন বাড়িতে ফেরামাত্র প্রতিবেশীরা সমস্বরে দাবি করেন যে, তাঁর ছোটোভাইটিকে কিছুতেই আর বাড়িতে স্থান দেওয়া চলবে না। আসামাত্রই বিদায় করতে হবে।

তা—ই করা হল। কৃষ্ণমোহন বাড়ি ফিরে আদ্যোপান্ত বিবরণ শুনে বিস্মিত ও দুঃখিত হলেন। সকলকে বুঝিয়েসুঝিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু তাতে কোনো ফল হল না। পিতৃস্থানীয় প্রতিবেশীরা উত্তেজিত হয়ে তাকে অবিলম্বে বাড়ি ও পাড়া ছেড়ে চলে যেতে আদেশ করলেন। আদেশ তাঁকে শিরোধার্য করতে হল। কৃষ্ণমোহন পৈতৃক গৃহ ছেড়ে চলে গেলেন।

গৃহত্যাগ করেও তিনি নিশ্চিত হতে পারলেন না। শোনা যায়, এই সময় তাঁকে রাস্তাঘাটে প্রহার করা, এমনকী গোপনে হত্যা করারও চক্রান্ত করা হয়েছিল। রাজনীতির যুগের আগেও দেখা যায়, ধর্মনীতির যুগে সমাজের বড়ো বড়ো দলপতিরা ভাড়াটে গুন্ডা পোষণ করতেন। বিধবাবিবাহ আন্দোলনের সময়, আরও প্রায় পঁচিশ বছর পরে বিদ্যাসাগরকে এইভাবে লাঞ্ছিত করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। রামমোহনকেও এরকম অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়নি তা মনে হয় না। কৃষ্ণমোহন ও তাঁর বন্ধুবান্ধবদের উপর আক্রোশের উপশম হল না সহজে। বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার পর কলকাতা শহরে হিন্দু পল্লিতে আশ্রয় পাওয়া তাঁর পক্ষে কঠিন হয়ে উঠল। বন্ধু দক্ষিণারঞ্জন সাহস করে নিজের বাড়িতে তাঁকে আশ্রয় দিলেন। কিন্তু মাসখানেকের বেশি সেখানে থাকাও সম্ভব হল না। দক্ষিণার আত্মীয়স্বজন এবং সেই পাড়ার লোকজন সকলে ক্রমে তাঁদের আপত্তি জানাতে লাগলেন। অবশেষে ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৮৩১ কৃষ্ণমোহন বন্ধুর বাড়ি ছেড়ে চৌরঙ্গি অঞ্চলে এক সাহেবের গৃহে অতিথিরূপে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলেন। শহরের কোনো হিন্দু পল্লিতে কেউ তাঁকে আশ্রয় দিতে সাহস করলেন না।

তরুণদের এই আচরণ অবশ্যই সমর্থনযোগ্য নয়। নিছক কিশোরসুলভ চাপল্যের বশেই তাঁরা এই অন্যায় কাজ করেছিলেন। পাখির নতুন ঠোঁট উঠলে বা ডানা গজালে যেমন সে ঘন—ঘন যত্রতত্র ঠোকরাতে এবং যেখানে খুশি উড়তে চেষ্টা করে, ডিরোজিওর তরুণ ছাত্ররাও কতকটা তা—ই করেছিলেন। নতুন প্রগতিবাদ, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সংস্কারমুক্তির আস্বাদ পেয়ে, প্রথম যৌবনের উদ্দামতায় তাঁরা নিঃসন্দেহে বেশ কিছুটা বেহিসেবি স্বেচ্ছাচারিতায় গা ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। তার জন্য কটুবাক্য ও কঠোরসমালোচনা দুয়েরই স্বাভাবিক গতি সর্বনাশের দিকে। কোনো সমালোচনাই উপযোগিতা ও উপকারিতার শোভন সীমানার মধ্যে গণ্ডিবদ্ধ থাকে না। সমালোচনার ইতিহাসে এটা চিরকালের একটা বড়ো কলঙ্ক।

ডিরোজিয়ানদের সমালোচনার ক্ষেত্রেও রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ এই কলঙ্ক থেকে মুক্ত হতে পারেননি। তা হতে হলে বিরোধীদের প্রতি যে মমত্ববোধ থাকা উচিত তা তাঁদের ছিল না। প্রবীণ ও নবীন দুই দলই পরস্পরের প্রতি অন্ধ বিদ্বেষভাব পোষণ করতেন। সেইজন্য কোনো পক্ষের সমালোচনাই সংগত ও শালীন হত না।

গোহাড় নিক্ষেপের ঘটনার পর স্বভাবতই ডিরোজিওকেন্দ্রিক বিক্ষোভের তরঙ্গ আরও বেশি উত্তাল হয়ে ওঠে। এর কোনো ঘটনাই ডিরোজিওর উসকানিপ্রসূত নয়, কিন্তু তবু তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব ঘটনাচক্রে তাঁকেই তখন বহন করতে হচ্ছিল। ডিরোজিও তাঁর ছাত্রদের কখনো এ কথা বলেননি যে, অবাধ ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারিতাকে প্রশ্রয় দিতে হবে, অথবা সামাজিক প্রগতিচেতনা এত উগ্র হবে যে, সাধারণ বিধিনিষেধ ও বাছবিচার করা চলবে না। তাই মনে হয়, হিন্দু কলেজ ছাড়ার পর তাঁর ছাত্ররা অত্যধিক উত্তেজনার বশে ঘটনাস্রোত যেদিকে প্রবাহিত করছিলেন তা তাঁর মনঃপূত ছিল না। তরুণদের অসংযত উচ্ছলতায় ডিরোজিও হয়তো কিছুটা বেদনা ও অস্বস্তিও বোধ করছিলেন। কিন্তু সামাজিক ঘটনার এগিয়ে চলার একটা নিজস্ব গতি ও ছন্দ থাকে এবং সবসময় তা নায়কের খেয়ালখুশি অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত হয় না। ১৮৩১—এর এপ্রিলের পর থেকে ঘটনাস্রোত নিজস্ব গতিতেই ডিরোজিওর আয়ত্তের বাইরে চলে গিয়েছিল। তার প্রধান নায়ক হলেও পরে তিনি তার হাল ধরতে পারেননি। কিন্তু তা না পারলেও তরুণরা তাঁর সান্নিধ্য ও সহানুভূতি থেকে বঞ্চিতও হয়নি। চারদিকের আবর্তের মধ্যে তিনিই ছিলেন তাদের প্রেরণার উৎস। হাল ধরার মতো তার বয়স হয়নি, হাতও শক্ত হয়নি।

নিরাশ্রয় হয়েও কৃষ্ণমোহন নিরুৎসাহ হননি। গৃহত্যাগ করার সময় তাঁর মানসিক অবস্থা কী হয়েছিল তা তিনি নিজেই লিখে গেছেন এই ভাষায় : ‘We left the home where we passed our infant days; we left our mother who nourished us in our childhood; we left our brother with whom we associated in our earliest days : we left our sisters with whom we sympathised since they were born.’ বিচ্ছেদের এই বেদনার সঙ্গে সামাজিক নির্যাতনও তাঁকে অনেক সহ্য করতে হয়েছে। তাঁর তরুণ বন্ধুবান্ধবরা তার খানিকটা অংশ গ্রহণ করলেও শিক্ষক ডিরোজিওকে অপমান ও বেদনার কথা মনে করে সমস্ত নির্যাতনই তরুণদের কাছে উপেক্ষণীয় মনে হয়েছে। নির্যাতন যখন সীমা ছাড়িয়ে গেছে, তখন তাঁদের মুখপত্র ‘এনকোয়ারার’—এর পৃষ্ঠায় তাঁরা জবাব দিয়েছেন এই ভাষায় :

Persecution in high for we have deserted the shrine of Hinduism. The bigots are violent because we obey not the calls of superstition. Our conscience is satisfied, we are right; we must persevere in our career. If opposition is violent and insurmountable, let us rather aspire to martyrdom than desert a single inch of the ground we have possessed. Conspiracies are daily formed to hurt us in every possible way. Circulars stuffed with falsehoods have been issued to dafame our character : and all cruelties which the rage of malice and the heat of fanaticism can invent, have been planned to be exercised upon us. But we will stand persecution. A people can never be reformed without noise and confusion.

‘আমরা হিন্দুধর্মের পবিত্র দেবালয় পরিত্যাগ করেছি বলে আমাদের উপর নিষ্ঠুর নির্যাতন করা হচ্ছে। কুসংস্কার আমরা বর্জন করেছি বলে অতিধার্মিকরা আমাদের উপর খড়্গহস্ত হয়েছেন। আমরা যা করছি তা ন্যায়সংগত বলেই আমাদের বিবেকবুদ্ধিসম্মত। ধৈর্য ধরে আমরা তা করব প্রতিজ্ঞা করেছি। বিরোধীরা যদি ক্রোধে আত্মহারা ও মারমুখী হয়ে ওঠেন, আমরা মৃত্যুও বরণ করতে রাজি আছি। কিন্তু আমাদের সংগ্রামলব্ধ স্বাধীনতা একতিলও আমরা ছাড়তে ইচ্ছুক নই। আমরা জানি, প্রতিদিন আমাদের আঘাত করার জন্য বিরোধীরা নানা রকমের চক্রান্ত করছেন। আমাদের স্বভাবচরিত্র সম্বন্ধেও মিথ্যা কলঙ্ক রটাচ্ছেন তাঁরা প্রচারপত্র বিলি করে। বিদ্বেষ ও ধর্মান্ধতাপ্রসূত যত রকমের নির্দয় অপকৌশল আছে, সব তাঁরা একে—একে আমাদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সর্বপ্রকারের অত্যাচার আমরা সহ্য করতে প্রস্তুত। আমরা জানি, একটা জাতিকে সংস্কারমুক্ত ও উন্নতচিত্ত করতে হলে বাইরে খানিকটা কোলাহল ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবেই।’

ডিরোজিও একদিন তাঁর তরুণ প্রতিভাবান ছাত্রদের ভবিষ্যৎ জীবনের কথা মনে করে কাব্য রচনা করেছিলেন। কবি—কল্পনায় তরুণদের আহ্বান করে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি দেখছি, সদ্যফোটা ফুলের মতো পাপড়ি মেলে তোমাদের প্রতিভার মুকুল ফুটে উঠেছে, মনের কপাট খুলে যাচ্ছে একে—একে এবং যে মোহের বন্ধনে তোমাদের প্রচণ্ড ধীশক্তি আজ শৃঙ্খলিত তা—ও ক্রমে ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। পাখির ছানার মতো তোমাদের ডানা—ঝাপটানি শুনছি আমি, আর কান পেতে আছি কবে নীড়ের বন্ধন ছেড়ে, মুক্ত ডানায় ভর দিয়ে উধাও হবে তোমরা অনন্ত আকাশের সীমানা—সন্ধানে।’

বাংলার তরুণদের এই শক্তিপরীক্ষা শুরু হল ১৮৩১—এর আগস্ট—সেপ্টেম্বর থেকে। ডিরোজিও মনে মনে বুঝলেন, সামাজিক প্রগতি ও কল্যাণকামনায় উদ্বুদ্ধ এই তরুণের দল ভুল করবে অনেক, পদে—পদে অন্যায়ও করবে এবং সংযম ও শৃঙ্খলার বাঁধও ভাঙবে বারবার। তাদের দীক্ষাগুরু হলেও, এই দুর্বার অভিযান প্রতিরোধ বা সংযত করার সাধ্য তাঁর নেই। সংগ্রামের জয়—পরাজয় ও ফলাফল সবই অনিশ্চিত, কিন্তু সংগ্রামের সৈনিক যারা, প্রেরণা তাদের অফুরন্ত। মানুষের কল্যাণ, সমাজের উন্নতি, দেশের অগ্রগতি, ব্যক্তির মুক্তি, অজ্ঞানের জ্ঞান, অন্ধের দৃষ্টি, পঙ্গুর চলচ্ছক্তি, বোবার বাকশক্তি—এইরকম শতমুখ থেকে উৎসারিত তাদের প্রেরণা। এ যেন ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’। তাই এ সংগ্রামের হয়তো—বা শুরু আছে, গতি আছে, কিন্তু শেষ নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *