ডিরোজিয়ান

ডিরোজিয়ান

মানবসমাজের ইতিহাসে প্রবীণ—নবীনের দ্বন্দ্ব চিরদিন ছিল, এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। শ্রেণিগত দ্বন্দ্ব, জাতিবর্ণগত দ্বন্দ্ব, সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব, এসব দ্বন্দ্বের যে একদিন অবসান হবে অন্তত তা কল্পনা করতে বাধা নেই। মানুষের শুভবুদ্ধি জাগ্রত হলে এই সমস্ত দ্বন্দ্বের মূল পর্যন্ত সহজে উপড়ে ফেলা যাবে। কিন্তু যতদিন মানুষ থাকবে, সমাজ থাকবে, এবং মানুষ ও সমাজ উভয়েরই অগ্রগতি ইতিহাসের বিধান অনুযায়ী প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না, ততদিন উভয়েরই অগ্রগতি ইতিহাসের বিধান অনুযায়ী প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না, ততদিন পুরুষানুক্রমে নবীন—প্রবীণের বিরোধও বর্তমান থাকবে। মানুষ ও প্রকৃতির সংগ্রাম এবং নবীন—প্রবীণের সংঘর্ষ—এই দুটি ক্ষেত্র থেকে সমাজের গতিশক্তি সঞ্চারিত হবে চিরদিন।

উনিশ শতকে বাংলা দেশে পাশ্চাত্য আদর্শ—সংঘাতের ফলে সমাজের যে জাগরণের চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছিল, স্বভাবতই তার প্রতিভূ হয়ে উঠেছিলেন নবীন তরুণের দল। এই তরুণদেরই তখন অনেকে বলতেন ‘ইয়াং বেঙ্গল’, কেউ কেউ বলতেন ‘ইয়াং ক্যালকাটা’। রামমোহনের যুগের উপান্তে, উনিশ শতকের দ্বিতীয় পর্বে এই তরুণদলের বিকাশ হয়। এঁরা সকলে হিন্দু কলেজের ছাত্র ছিলেন এবং সেখানে ইংরেজি শিক্ষালাভ করে নবযুগের পাশ্চাত্য ভাবধারার সংস্পর্শে এসেছিলেন, শিক্ষকদের মধ্যে যিনি ছাত্রদের এই নবযুগমন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিলেন তিনি বাঙালি নন, একজন ফিরিঙ্গি, বয়সে প্রায় ছাত্রদেরই মতো তরুণ, নাম হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। হিন্দু কলেজের তরুণ ছাত্রগোষ্ঠীর দীক্ষাগুরু ডিরোজিও ছিলেন বলে তাঁদের ‘ডিরোজিয়ান’ও বলা হত। ‘ইয়াং বেঙ্গল’ নামে বাংলার যে তরুণদল ইতিহাসে সুখ্যাত ও কুখ্যাত, তাঁরা ‘ডিরোজিয়ান’।

এই তরুণদের মধ্যে প্রায় সকলেই অসাধারণ প্রতিভাবান ছিলেন, যদিও একদিকে বা একভাবে সকলের প্রতিভার সমান বিকাশ হয়নি। কিন্তু প্রতিভাও মানুষের আসল পরিচয় নয়, পোশাকি পরিচয় মাত্র। মানুষের আদত পরিচয় ‘চরিত্র’। চরিত্রগুণে তরুণ ডিরোজিয়ানরা তখনকার বাঙালি—সমাজে নিঃসন্দেহে অদ্বিতীয় ছিলেন। সততা নিষ্ঠা সৎসাহস দৃঢ়তা প্রভৃতি গুণের এমন আশ্চর্য সমন্বয় হয়েছিল তাঁদের চরিত্রে যা সাধারণ চরিত্রে সর্বযুগেই দুর্লভ। সামাজিক খ্যাতি প্রতিষ্ঠা ও কীর্তির দিক থেকে সকলের পক্ষে সমস্তরে অধিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব হয়নি, হতেও পারে না। কর্মক্ষেত্রের ভিন্নতার জন্য প্রত্যেকের প্রতিভা ও চরিত্রবলের প্রয়োগে পার্থক্য ঘটেছে, এবং সেই পার্থক্যের জন্য তাঁদের লোকখ্যাতিরও তারতম্য ঘটেছে। রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় বা রামগোপাল ঘোষ যে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন, হরচন্দ্র ঘোষ বা রামতনু লাহিড়ী বা অন্যেরা তা করতে পারেননি। কিন্তু তা সত্ত্বেও লোকচিত্তে এই তরুণদলের সকলের চারিত্রিক প্রতিষ্ঠা আজও সমানভাবে স্বীকৃত। মানুষ কৃষ্ণমোহন, রামগোপাল এবং মানুষ রামতনু বা হরচন্দ্রর মধ্যে তিলমাত্র প্রভেদ নেই। এমনকী যাঁরা উল্কার মতো হঠাৎ প্রজ্বলিত হয়ে নিভে গিয়েছিলেন, যেমন মহেশচন্দ্র ঘোষ, কি মাধব মল্লিক, তাঁরাও এই স্বীকৃতি দাবি করতে পারেন।

অথচ এই তরুণেরা কত লাঞ্ছনা, অপমান ও অত্যাচারই না সহ্য করেছেন প্রতিপক্ষদের কাছ থেকে। প্রতিপক্ষদের মধ্যে প্রবীণেরাই প্রধান ছিলেন, কিন্তু সকলেই যে প্রবীণ ছিলেন তা নয়। গতানুগতিকতার গোলামি করে, চিরাভ্যস্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে যাদের দিন কেটে যায়, এবং সমাজের প্রবীণদের উপদেশের ওপর যাদের আস্থা অটল, সেই সাধারণ লোকও তরুণদের বিপক্ষে পক্বকেশ, প্রবীণদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। প্রতিপক্ষ দলের বিপুল শক্তি—অর্থের শক্তি, অন্ধ গোঁড়ামির শক্তি, এবং সকলের উপরে একচক্ষু ঐতিহ্যের শক্তি। এই প্রচণ্ড সংহত শক্তির বিরুদ্ধে একদল তরুণের সংগ্রাম নবযুগের বাংলার ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় অধ্যায় রচনা করেছে।

যদিও এই তরুণদলের প্রায় প্রত্যেকেই হিন্দুসমাজের উচ্চশ্রেণিভুক্ত ছিলেন, তাহলেও যেহেতু তাঁদের আদর্শগত সংগ্রামে কোনোরকম পারিবারিক সমর্থনলাভের আশা ছিল না, সেই কারণে তাঁদের অর্থবল ছিল না, লোকবল তো ছিলই না। একমাত্র সম্বল ছিল ওই ‘আদর্শ’। বাস্তব—ভিত্তিহীন নিরবয়ব আদর্শও চুপিসারে সমাজে প্রবেশ করে যে কত দূর পর্যন্ত তাকে তোলপাড় করতে পারে, ইতিহাসে সেরকম দৃষ্টান্তের অভাব নেই। বাংলা দেশের সমাজকেও সেইভাবে তোলপাড় করেছিলেন ‘ইয়াং বেঙ্গল’ দল, এবং কেবল ‘আইডিয়া’ বা আদর্শের জোরে। তাঁরা অনেক ভুল করেছিলেন, সামান্য ভুল নয়, বাছা—বাছা সেরা ভুল। এক—একটি ভুল ‘ওজনে’ অনেক ভারী। তরুণের ধর্ম হল ভুল করা, ইতিহাসের ধর্ম হল তরুণদের সেই ভুল স্বাভাবিক বলে স্বীকার করা। ভুলের ভগ্নস্তূপের উপর নির্ভুলের ইমারত গড়ে তোলা যায়, বিশেষ করে মানবসমাজের ইতিহাসে অন্যের ভুলের ভিতর থেকে দু—চারটে শুদ্ধ সত্য আত্মপ্রকাশ করে। ইয়াং বেঙ্গলের ভুলের ভিতর থেকেও এইরকম কয়েকটি শুদ্ধ সত্য পরবর্তীকালে বাংলার সমাজজীবনে আত্মপ্রকাশ করেছিল। ‘ভুল’ আর ‘মিথ্যা’ এক নয়। তরুণদল ভুল করেছিলেন, কিন্তু জীবনে কখনো একদিনের জন্যও মিথ্যার আশ্রয় নেননি, মিথ্যা আচরণও করেননি। সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্য যে—সমস্ত চলার পথ তাঁরা বেছে নিয়েছিলেন, তার মধ্যে কোন পথ যে চোরাবালি তা তাঁরা প্রথমে বুঝতে পারেননি। পরে ধীরে—ধীরে বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু সেই ভুল পথটা ইতিহাসের কাছে ক্ষমার্হ। তাই ভুলের পরাজয়ের কোনো গ্লানি তাঁদের স্পর্শ করতে পারেনি। যেসব সত্য সমাজে ও জীবনে প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁরা সংগ্রাম করেছিলেন, সেইসব সত্যের জয়ের মধ্যেই তাঁদের আদর্শের জয় ও সংগ্রামের জয় ঘোষিত হবে। আজও হয়নি, ভবিষ্যতে হবে।

ইয়াং বেঙ্গলের দীক্ষাগুরু ছিলেন বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, বয়সে তরুণ এবং জাতিতে পোর্তুগিজ ফিরিঙ্গি। শিক্ষকের নাম হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। বিদ্যালয়ের নাম ‘হিন্দু কলেজ’।

নবযুগের বাংলার সামাজিক আদর্শের ভিত গড়ার জন্য, ভারতীয় হলেও, একজন ফিরিঙ্গি জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ফিরিঙ্গিরা আজও আমাদের কাছে ভিন্ন সমাজের লোক। তাই বাংলার সমাজের সঙ্গে ভিন্ন সমাজের মানুষ ডিরোজিওর এই ঐতিহাসিক সংযোগ তাঁর জীবনকে আরও বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

প্রবীণ—নবীনের বিরোধ আদিকাল থেকে চলে আসছে মানবসমাজে। যুগ থেকে যুগান্তরে যাত্রার সন্ধিক্ষণে এই বিরোধ তীব্র জটিল রূপ ধারণ করেছে বারংবার। সুস্থির সমাজ সচকিত হয়ে উঠেছে সেই সংঘাতে, নবচৈতন্যের কম্পন লেগেছে তার দেহ মনে। এইরকম হৃৎকম্পের সঞ্চার করেছিলেন ডিরোজিয়ানরা বাংলার সমাজে। লোকচৈতন্যের মূল পর্যন্ত তাঁরা সজোরে নাড়া দিয়েছিলেন নির্ভয়ে। কিন্তু বহুকালের ঘুমপাড়ানিতে এ দেশের মগ্নচৈতন্য মানুষ সেই ঝাঁকুনির ফলে কতখানি চৈতন্যলাভ করেছিল তা ঠিক বলা যায় না। তবে সমাজতরির ভরাডুবির আশঙ্কায় স্থিতস্বার্থ প্রাজ্ঞ ও প্রবীণেরা সেদিন যে ত্রাস ও শোরগোলের সৃষ্টি করেছিলেন তা সত্যিই অভাবনীয়। তাঁদের কলরব শুনে মনে হয়েছিল, সমাজে এমন একদল হঠকারী কালাপাহাড়ের আবির্ভাব হয়েছে, যাদের কাণ্ডজ্ঞানহীন নৈতিক উৎপাতে দেশের ঐতিহ্যবন্ধন একেবারে ছিন্ন হয়ে যাবে এবং নীতিবোধ ধর্মবোধ আস্থা ভক্তি ইত্যাদির অস্তিত্ব পর্যন্ত থাকবে না। কিন্তু নবযুগের কালাপাহাড়ের দল প্রবীণদের এই ভয়াবহ ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে সত্যাসত্য নির্ণয়ের সংগ্রামে দৃঢ়পদে অগ্রসর হয়েছিলেন।

আজকের বিশ শতকের বহুমুখী অগ্রগামী সমাজে প্রবীণ—নবীনের নীতি—বিরোধের ফলে পুনরায় প্রচণ্ড আবর্ত সৃষ্টি হয়েছে। কারণ সতত—সচল সমাজের বুকে আজকে জেগেছে ঝঞ্ঝামদমত্ত বলাকার অস্থিরতা, অনবরুদ্ধ বেগের আবেগ। তার পথ চলার মন্ত্র হয়েছে ‘হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে’। স্থাবর—জঙ্গমের বৈপরীত্য নববিজ্ঞানের যুগে আজ দ্রুত বিলীয়মান। শতবর্ষ আগে বাংলার সমাজে কেন, কোনো সমাজেই এই সামগ্রিক সচলতা ছিল না। স্থিতি—গতির বৈপরীত্য তখন ছিল সাদা—কালোর মতো সুতীব্র ও সুস্পষ্ট। কুম্ভকর্ণর অচৈতন্য নিদ্রায় অভিভূত ছিল সমাজ। সামান্য মৃদু আঘাতে তার অসাড় দেহে চৈতন্যোদয় হত না। ক্রমাগত আঘাতের পর আরও জোরে আঘাত করে ডিরোজিয়ানরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন বাংলার সমাজকে সটান ও স্বনির্ভর করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। প্রবীণ—নবীনের দ্বন্দ্বও বেশ তীব্র হয়েছিল সেদিন। একদিকে সংরক্ষণের সংশয়—ভয়জড়িত আর্তনাদ, অন্যদিকে ভাঙনের নিঃশঙ্ক কোলাহল, এই দুয়ের এক বিচিত্র ঐকতান রচিত হয়েছিল ইয়াং বেঙ্গলের যুগে। ডিরোজিও ছিলেন এই ঐকতানের প্রধান উদ্গাতা।

নব্যবঙ্গের ফিরিঙ্গি শিক্ষাগুরু ডিরোজিও তাঁর ছাত্রদের প্রায় সমবয়স্ক ছিলেন, বেশি হলে দু’চার বছরের বড়ো। অথচ তাঁর ব্যক্তিত্বের জাদুস্পর্শে বাংলার তারুণ্যের এই দীপ্ত প্রকাশ কেমন করে সম্ভব হয়েছিল তা ভাবলে সত্যিই অবাক হতে হয়।

একটি পোর্তুগিজ ফিরিঙ্গি পরিবারে ডিরোজিও জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১০ এপ্রিল (অথবা ১৮ এপ্রিল) ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে। ধর্মতলায় মৌলালির দরগার কয়েক গজ দক্ষিণে সার্কুলার রোডের উপর একটি বাড়িতে তাঁর জন্ম হয়। বছরখানেক ভাগলপুরে ছাড়া তাঁর বাইশ বছর জীবনের বাকি দিনগুলি এই বাড়িতেই কেটে যায়। এই বাড়িতে তাঁর ছাত্রদের সভা—বৈঠক বসে। অবশেষে এই বাড়িতে ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে (২৬ ডিসেম্বর, সোমবার) তাঁর মৃত্যু হয়, বাইশ বছর বয়সে।

বাড়ি থেকে কয়েকশত গজ দক্ষিণে পার্ক স্ট্রিটের প্রাচীন গোরস্থানে ডিরোজিওর সমাধি। জন্মস্থান থেকে দক্ষিণে গোরস্থান যত দূর, প্রায় তত দূর উত্তর—পশ্চিমে ডিরোজিওর জীবনের প্রধান কর্মস্থান গোলদিঘির হিন্দু কলেজ। এই এক অথবা দুই বর্গমাইল ক্ষেত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তাঁর জীবনের বাইশ বছর। মধ্যে ভাগলপুরের প্রাকৃতিক পরিবেশে অবস্থানের ফলে তাঁর কাব্যপ্রতিভার যে প্রাথমিক উন্মেষ হয়েছিল, অল্পকাল হলেও তা স্মরণীয়।

কলকাতা শহরে পোর্তুগিজ—সমাজে ডি’রোজারিও পরিবারের বেশ প্রতিষ্ঠা ছিল মনে হয়। ডিরোজিওর পিতা ‘জে স্কট অ্যান্ড কোং’ নামে কলকাতার এক বিখ্যাত সদাগরি হৌসে উচ্চপদস্থ চাকুরে ছিলেন। তিনি সম্পন্ন মধ্যবিত্ত ছিলেন, কারণ কলকাতার গৃহসম্পত্তি তিনি নিজের অর্থেই করেছিলেন, উত্তরাধিকারসূত্রে পাননি। পোর্তুগিজরা তখন এ দেশের ফিরিঙ্গি সমাজে সংখ্যালঘু হলেও, বাণিজ্যিক ও আর্থিক প্রতিপত্তির দিক দিয়ে অনেক গণ্যমান্য ছিলেন। ডি’রোজারিও পরিবার তাঁদের অন্যতম।

ডিরোজিওর পিতা দুই বিবাহ করেছিলেন, ডিরোজিও তাঁর প্রথম স্ত্রী—র সন্তান। তাঁর আরও দুটি ভাই ও দুটি বোন ছিল। বড়োভাই ফ্র্যাঙ্ক নৈষ্কর্মের সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে, শেষ পর্যন্ত কলকাতার ফিরিঙ্গি—সমাজে অপদার্থ কুলাঙ্গারের কুখ্যাতি কুড়িয়ে বেরিয়েছেন। ছোটোভাই ক্লডিয়াস টম—ডিক—হ্যারির মতো সাধারণ গড্ডলপ্রবাহে ভেসে গেছেন, কোনো পরিচয় কোথাও রেখে যাননি। সোফিয়া নামে একটি বোন প্রথম যৌবনে সতেরো বছর বয়সে মারা যায়। কেবল আমেলিয়া নামে একটি বোন পিতার সংসারে ডিরোজিওর জীবনে সদাসঙ্গী ছিল। বোনটির সুমিষ্টতা ও চরিত্রের মাধুর্য ডিরোজিওর সঙ্গে তাঁর প্রীতিবন্ধন গাঢ় করে তুলেছিল। এই দু’টি ভাইবোন ছাড়া ডিরোজিওর এক মাসিমা ছিলেন, ভাগলপুরের এক ধনিক নীলকর সাহেবকে বিবাহ করে সেখানেই তিনি বসবাস করতেন। মাসিমার কাছে ভাগলপুরে যাওয়া ছাড়া কলকাতা শহরের বাইরে ডিরোজিওর বিশেষ গতিবিধি ছিল না। অবশ্য মাসিমার স্নেহের চেয়ে ভাগলপুর অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশই তাঁকে আকর্ষণ করত বেশি। তাঁর প্রথম জীবনের কাব্যপ্রেরণার প্রধান উৎস ছিল এই পরিবেশ। ‘জঙ্গিরার ফকির’ কাব্যের উপাদান এখান থেকেই তিনি আহরণ করেছিলেন।

ডি’রোজারিও পরিবার সম্বন্ধে এর বেশি আর কিছু জানা যায় না। বাংলার সঙ্গে পোর্তুগিজদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক যতটা ঘনিষ্ঠ ছিল, সাংস্কৃতিক সম্পর্ক তা ছিল না। তা ছাড়া তাঁদের দাপট—দৌরাত্ম্যের যুগ তার প্রায় একশো বছর আগে—সতেরো শতকেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। ডিরোজিওর কালে বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে পোর্তুগিজদের বিশেষ কোনো সংস্রব ছিল বলে মনে হয় না। তাঁদের বৈদেশিক স্বাতন্ত্র্যও তখন প্রায় লোপ পেয়ে গিয়েছিল। যাঁরা এ দেশের স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছিলেন তাঁরা বংশানুক্রমিক সান্নিধ্যের ফলে দেশটাকে মাতৃভূমি জ্ঞান করতে খানিকটা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। এ ছাড়া শিক্ষা—সংস্কৃতিক্ষেত্রে পোর্তুগিজ ফিরিঙ্গিদের বিশিষ্ট কোনো দান ছিল না। ভিভিয়ান ডিরোজিও প্রসঙ্গে এইজন্যই মনে হয়, এরকম একটি সাধারণ ফিরিঙ্গি পরিবারে জন্মে এবং তাঁর সম্পূর্ণ স্বভাববিরোধী প্রতিকূল পরিবেষ্টনে প্রতিপালিত হয়ে কী করে তিনি বাংলার তরুণসমাজের শিক্ষাগুরু ও জীবনাদর্শের গুরু হতে পেরেছিলেন, এবং কোথা থেকেই বা তার প্রেরণা পেয়েছিলেন? এ প্রশ্ন মনে জাগা স্বাভাবিক। হঠাৎ একটি ফিরিঙ্গি পরিবার থেকে এরকম চরিত্রের অভ্যুদয় হল কেমন করে, তার কার্যকারণ সম্পর্ক সন্ধান করা দায় হয়ে ওঠে। তা হলেও, যেহেতু ডিরোজিও নবযুগের বাংলার সমাজের বিস্ময়বিশেষ, তাই তাঁর স্বল্পস্থায়ী জীবনের একটা ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *