ঝড়

ঝড়

অবশেষে ঝড় উঠল।

শনিবার, ২৩ এপ্রিল, ১৮৩১।

হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষরা জরুরি সভায় মিলিত হলেন। গভর্নর চন্দ্রকুমার ঠাকুর, সহকারী সভাপতি উইলসন, রাধাকান্ত দেব, রাধামাধব বন্দ্যোপাধ্যায়, রামকমল সেন, ডেভিড হেয়ার, রসময় দত্ত, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, শ্রীকৃষ্ণ সিংহ ও সম্পাদক লক্ষ্মীনারায়ণ মুখোপাধ্যায়।

গম্ভীর নিস্তব্ধ পরিবেশ। সভার আলোচ্য বিষয় উল্লেখ করে সম্পাদক বললেন : ‘অধ্যক্ষদের এই জরুরি সভা আহ্বান করার কারণ হল, বিদ্যালয়ে কোনো একজন শিক্ষকের অপ্রত্যাশিত আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির ফলে জনসাধারণের মধ্যে ক্রমবর্ধমান শঙ্কার সঞ্চার হচ্ছে এবং প্রতিষ্ঠানেরও অনিষ্ট হচ্ছে। এই শিক্ষকটির উপর অনেক তরুণের চরিত্রগঠনের দায়িত্ব রয়েছে, কিন্তু তাঁর বিচিত্র শিক্ষাপদ্ধতির ফলে ছাত্রদের নীতিবোধ ক্ষুণ্ণ হচ্ছে এবং তাদের নৈতিক চরিত্র ক্রমেই পরিবার ও সমাজের পক্ষে অকল্যাণ ও অশান্তির কারণ হয়ে উঠছে। এই ঘটনার কথা সকলেই জানেন, সুতরাং এখানে তা উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। শুধু এইটুকু বলা প্রয়োজন যে, এই ঘটনা সম্বন্ধে বাইরে যে আপত্তিকর ধারণার সৃষ্টি হয়েছে, তার ফলে সম্ভ্রান্ত পরিবারের প্রায় ২৫ জন ছাত্র বিদ্যালয় ত্যাগ করেছে। আরও প্রায় ১৬০ জন ছাত্র অসুখের অজুহাতে কলেজে আসা বন্ধ করেছে। তাদের মধ্যে অনেকেই কলেজ ছেড়ে দেবে মনে হয়। বিষয়টি নিয়ে কিছুকাল ধরে যথেষ্ট আলাপ—আলোচনা হয়েছে। অভিভাবকদের চিঠিপত্র ও অধ্যক্ষদের মতামত থেকে যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আমাদের অবিলম্বে গ্রহণ করা উচিত তা ক্রমান্বয়ে প্রস্তাবাকারে এই সভায় পেশ করা হবে।’

সভা শুরু হবার আগে উদ্দেশ্যটি এইভাবে ব্যক্ত করা হয়। পরিবেশ ক্রমেই আরও গম্ভীর হয়ে ওঠে। এই প্রস্তাবনার মধ্যে যে শিক্ষকের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, তিনি যে হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও তা বলাই বাহুল্য। প্রস্তাবগুলি এই—

১. ডিরোজিও যেহেতু সমস্ত অনর্থের মূল এবং জনসাধারণের আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছেন, সেইজন্য তাঁকে কলেজ থেকে অপসারিত করা সংগত এবং ছাত্রদের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ সংযোগও অবিলম্বে ছিন্ন করা আবশ্যক।

২. উচ্চশ্রেণির যেসব ছাত্রের আচার—ব্যবহার ও অভ্যাস আপত্তিকর বলে অভিযোগ এসেছে এবং যারা ভোজসভায় যোগদান করেছে, তাদের কলেজ ছাড়তে বাধ্য করা হবে।

৩. যেসব ছাত্র প্রকাশ্যে হিন্দুধর্মবিরোধী আচরণ করে এবং এ দেশের সামাজিক প্রথা অমান্য করে চলে, তাদেরও কলেজ থেকে বহিষ্কৃত করা আবশ্যক।

৪. কলেজে ভরতি হবার বয়স ১০ থেকে ১২ এবং ১৮ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত করা হবে।

৫. মৌখিক শাসনে বা তিরস্কারে যদি ভালো ফল না—পাওয়া যায় তাহলে অবাধ্য ছাত্রদের দৈহিক দণ্ডদানেরও ক্ষমতা দিতে হবে প্রধান শিক্ষককে।

৬. ছেলেদের স্বভাবচরিত্র সম্বন্ধে পূর্বে খোঁজখবর না করে কলেজে ভরতি করা হবে না।

৭. ইয়োরোপীয়দের পাওয়া গেলে ভবিষ্যতে তাঁদেরই বেশি সুযোগ দিতে হবে, অবশ্য তাঁদেরও চরিত্র ও ধর্ম সম্বন্ধে খোঁজ দিতে হবে।*

৮. বিদ্যালয়ের ছুটি হবার পর ছাত্রদের কলেজ—এলাকার মধ্যে থাকতে দেওয়া হবে না।

৯. যদি কোনো ছাত্র বাইরের কোনো সভাসমিতিতে বা বক্তৃতায় যোগদান করে তাহলে তাকে কলেজ থেকে বিতাড়িত করা হবে।

১০. কী—কী বই পাঠ্য হবে এবং কতক্ষণ তা পড়ানো হবে, তা নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। *

১১. ছাত্রদের নৈতিক চরিত্রের অবনতি হতে পারে এমন কোনো বই কলেজে কেনা, পড়ানো বা পড়তে দেওয়া হবে না।

১২. ফারসি ও বাংলা পড়ার জন্য ছাত্রদের আরও বেশি সময় দিতে হবে।

১৩. সিনিয়র ক্লাসের ছাত্রদের সংস্কৃত পড়তে হবে।

এই প্রস্তাবগুলির মধ্যে সাত নম্বর প্রস্তাবটি পরিষ্কার নয়। ‘ইয়োরোপীয়’ কী? ছাত্র না শিক্ষক? আলোচনার সময় প্রস্তাবটি পুনরায় রচনা করে ‘qualified European teachers’ বলে গৃহীত হয়েছে। ডিরোজিওর তরুণ শিষ্য হিন্দু কলেজের ছাত্রদের কীর্তিকলাপে হিন্দুসমাজে যে কী গভীর আলোড়ন হয়েছিল তা আলোচ্য প্রস্তাবগুলির ভাব ও ভাষা দেখে বোঝা যায়। ডিরোজিওকে পদচ্যুত করা নয় শুধু, নিয়মের শৃঙ্খলে ছাত্রদের আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধবারও সংকল্প করেছিলেন কলেজের অধ্যক্ষরা। শিক্ষক ডিরোজিওর সঙ্গে হিন্দুধর্মপ্রথাবিরোধী স্বাধীনচেতা সিনিয়র ছাত্রদেরও অনেককে কলেজ থেকে বহিষ্কৃত করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তৃতীয় প্রস্তাবটি কেবল এই মর্মে সংশোধন করা হয়েছিল যে, অভিভাবকদের জানিয়ে দেওয়া হবে, তাঁরা যদি মনে করেন যে, কলেজের জন্য ছাত্রদের আচরণ হিন্দুধর্মবিরোধী হয়ে উঠেছে, তাহলে যখন খুশি তাঁদের ছেলেদের তাঁরা ছাড়িয়ে নিতে পারবেন। চতুর্থ প্রস্তাব অনাবশ্যকবোধে বাতিল করা হয়েছে। দৈহিক দণ্ডদানের ও ছেলেদের নৈতিক চরিত্র অনুসন্ধানের প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। দৈহিক প্রস্তাব সম্বন্ধে অধ্যক্ষরা সিদ্ধান্ত করেন যে, কলেজের বাইরে ছেলেরা কোনো সভাসমিতিতে বা বক্তৃতায় যোগদান করবে কি না, সে বিষয়ে তাদের আত্মীয়স্বজন ও হিতাকাঙ্ক্ষীরা ভেবে দেখবেন, কলেজ—কমিটির এ বিষয়ে কোনো নির্দেশ দেওয়ার দায়িত্ব নেই।

প্রথম প্রস্তাব ডিরোজিওর পদচ্যুতি সম্বন্ধে অধ্যক্ষদের মধ্যে বেশ আলোচনা ও মতান্তর হয়েছিল বলে মনে হয়। প্রস্তাবটি উত্থাপন করার সময় বলা হয় :

Whether the Managers had any just grounds to conclude that moral and religious tenets of Mr. Derozio as far as ascertainable from the effects they have produced upon his scholars are such as to render him an improper person to be entrusted with the education of youth.

ডিরোজিওর নীতি ও ধর্ম—বিষয়ক শিক্ষাদীক্ষার ফলে ছাত্রদের যে মনোভাবের বিকাশ হয়েছে তা দেখে কলেজের অধ্যক্ষরা তাঁকে তরুণদের শিক্ষার দায়িত্বগ্রহণের একজন অযোগ্য ব্যক্তি বলে মনে করেন কি না? প্রস্তাবটি এইভাবে ঘুরিয়ে পেশ করা হয়েছিল বোধহয় আলোচনার সুবিধার জন্য।

কলেজের গভর্নর চন্দ্রকুমার ঠাকুর বলেন যেহাতে যেসব তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে, তাতে এমন সিদ্ধান্ত করা যায় না যে ডিরোজিও একজন অযোগ্য শিক্ষক।

সহকারী সভাপতি উইলসন বলেন যে, ডিরোজিওর শিক্ষার কোনো কুফলের প্রমাণ তিনি অন্তত পাননি এবং তাঁকে একজন সুযোগ্য ও ক্ষমতাশালী শিক্ষক বলেই তিনি মনে করেন।

রাধাকান্ত দেব বলেন যে, তরুণদের শিক্ষার ব্যাপারে তিনি ডিরোজিওকে একজন অত্যন্ত অযোগ্য শিক্ষক বলে মনে করেন।

রসময় দত্ত বলেন যে, এখানকার রিপোর্ট দেখার আগে তিনি ডিরোজিওর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগের কথা কিছু জানতেন না।

পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ দ্বারা সমর্থিত নয় বলে ডিরোজিওর চরিত্র ও শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ সত্য বলে স্বীকার করতে প্রসন্নকুমার ঠাকুর সম্মত হন না।

রাধামাধব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ডিরোজিও যে একজন অযোগ্য শিক্ষক, সে সম্বন্ধে তাঁর কোনো সন্দেহ নেই।

রাধাকান্ত দেবের অভিমত সমর্থন করে রামকমল সেন বলেন যে ডিরোজিও তরুণদের যোগ্য শিক্ষক নন।

শ্রীকৃষ্ণ সিংহ বলেন যে, ডিরোজিওর বিরুদ্ধে সমস্ত অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে মনে হয়, তাঁর সম্বন্ধে যোগ্যতা বিচারের কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না।

ডেভিড হেয়ার বলেন যে, ডিরোজিওর মতো সুযোগ্য শিক্ষক বর্তমানে দুর্লভ এবং তাঁর সুশিক্ষার ফলে ছাত্ররা বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছে বলে তাঁর ধারণা।

ন’জনের মধ্যে ছ’জন অধ্যক্ষ ডিরোজিওর সপক্ষে এবং তিনজন বিপক্ষে মতামত প্রকাশ করেন। যেভাবে প্রস্তাবটি উত্থাপন করা হয় তা স্বভাবতই ভোটে বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা। অতএব ডিরোজিও—বিমুখ অধ্যক্ষদের নির্দেশেই মনে হয়, প্রস্তাবটি অন্যভাবে পুনরায় পেশ করা হয়। নতুন প্রস্তাবটি এই—

Whether it was expedient in the present state of Public feeling amongst the Hindoo community of Calcutta to dismiss Mr. Derozio from the College.

নবরূপের এই প্রস্তাবটি কতটা দু’মুখো করাতের মতো, যেদিক দিয়েই চালিত হোক—না কেন, এবারে ডিরোজিওর শিরশ্ছেদ হতে বাধ্য, তাঁর নিস্তার নেই। যোগ্যতা—অযোগ্যতা, শিক্ষার সুফল—কুফল, ছাত্রদের নৈতিক উন্নতি—অবনতি ইত্যাদি তর্কসাপেক্ষ প্রশ্ন একেবারে চাপা দিয়ে সমগ্র হিন্দু—সম্প্রদায়ের আত্মাভিমানের সমস্যাটি এমন কৌশলে তুলে ধরা হল অধ্যক্ষসভার সামনে, যে তাঁরা প্রত্যেকেই উভয়সংকটে পড়ে গেলেন। সমস্যাটা দাঁড়াল এই, ব্যক্তির স্বার্থ, না সমষ্টির বা সমাজের স্বার্থ, কোনটা বড়ো?

ডিরোজিওর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ যদি সত্য না—ও হয়, তাতে কী আসে যায়? সত্য হোক আর মিথ্যা হোক, কলকাতা শহরের সমগ্র হিন্দুসমাজের বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে যখন যে, তিনিই সমস্ত অনর্থের মূল এবং তরুণ ছাত্রদের যাবতীয় অনাচার—ব্যভিচারের প্রধান উৎসাহদাতা, তখন সেই ধারণার সত্যতা বিচার না করে তার বেদিমূলে তাঁকে উৎসর্গ করাই নিরাপদ নয় কি? জনসমাজের এই অপমানিত ও ব্যথিত চিত্তের দিকে ডিরোজিওর পদচ্যুতি ‘expedient’ বা সমীচীন কি না বিচার করে দেখা অধ্যক্ষদের কর্তব্য।

রাধাকান্ত দেব, রামকমল সেন ও রাধামাধব বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে এবার গভর্নর চন্দ্রকুমার ঠাকুর যোগদান করে বললেন যে ডিরোজিওর পদচ্যুতি ‘necessary’ বা প্রয়োজনীয়। রসময় দত্ত ও প্রসন্নকুমার ঠাকুর বললেন, ‘expedient’ বা অবস্থাগতিকে আবশ্যক। উইলসন ও ডেভিড হেয়ার কেউ কোনো মত প্রকাশ করলেন না, হিন্দুসমাজের ব্যাপার বলে। সুতরাং প্রস্তাব ভোটে গৃহীত হল এই মর্মে যে, ডিরোজিওর পদচ্যুতির সিদ্ধান্ত কার্যে পরিণত করা হোক, তাঁর কর্মক্ষমতার ন্যায্য স্বীকৃতি দিয়ে—

Resolved that the measure of Mr. Derozio’s removal be carried into effect with due consideration for his merits and services.

কলেজের অধ্যক্ষরা ডিরোজিওকে সোজাসুজি পদচ্যুত করেননি। উইলসন একখানি চিঠিতে ডিরোজিওকে সভার সিদ্ধান্ত জ্ঞাপন করে তাঁকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করার জন্য অনুরোধ করেন। পদত্যাগপত্রসহ ডিরোজিও পত্রোত্তরে উইলসনকে যা লেখেন তার মর্ম এই।

‘মহাশয়, আপনার নির্দেশমতো এই চিঠির সঙ্গে পদত্যাগপত্র পাঠালাম। পত্রখানি পাঠ করলেই দেখতে পাবেন, স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করা সম্বন্ধে আপনার অনুরোধ আমি যথাযথভাবে গ্রহণ করতে পারিনি। আমার শিক্ষকতাকালে কলেজের কোনো অনিষ্ট হয়েছে বলে যদি আমি মনে করতাম, অথবা তার সপক্ষে বিশ্বাসযোগ্য কোনো প্রমাণ থাকত, তাহলে আমার দিক থেকে বিনা প্রতিবাদে পদত্যাগ করার যুক্তি অবশ্যই আমি মেনে নিতাম। কিন্তু এতখানি আত্মমর্যাদা জলাঞ্জলি দিয়ে একটা সাময়িক ঘটনাবর্তের আঘাত সহ্য করা যুক্তিযুক্ত বলে আমি মনে করি না। এ কথা আমি কী করে অস্বীকার করব যে, আপনারা আমাকে বাধ্য করছেন পদত্যাগ করতে। নির্বিবাদে পদত্যাগপত্র পাঠানো তাই কোনোমতেই সম্ভব হল না। আপনি একজন মহানুভব ব্যক্তি আমার সম্মানরক্ষার জন্য আপনি যে এই অনুরোধ করেছেন তা আমি জানি। কিন্তু সেই সান্ত্বনায় আমার অপমানের বেদনার উপশম হচ্ছে কোথায়? প্রবীণ ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা যদি পদচ্যুত করে আমাকে অপমান করাই সাব্যস্ত করেন, তাহলে আমারও সে অপমান সহ্য করার মতো শক্তি থাকা বাঞ্ছনীয় বলে আমি মনে করি।

কলেজের কয়েকজন হিন্দু কর্মাধ্যক্ষ আমার বিরুদ্ধে যে অসংযত ক্রোধ প্রকাশ করেছেন তা সহজে শান্ত হবে বলে মনে হয় না। অতএব কলেজে পুনরায় শিক্ষকের কাজ গ্রহণ করার সম্ভাবনা আপাতত দেখছি না। তা ছাড়া কর্মজীবনের স্রোতে ভাসতে ভাসতে কোথায় কোন তীরে গিয়ে জীবনতরি ভিড়বে, তার ঠিক নেই। হয়তো জীবনে আর আপনার সান্নিধ্যলাভের সুযোগ হবে না। আজ তাই এই সুযোগে আপনার কাছে আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। কলেজে কাজ করার সময় আপনার কাছ থেকে যে সহৃদয় ব্যবহার পেয়েছি তা জীবনে কখনো ভুলব না।—ইতি

এইচ.এল.ভি. ডিরোজিও

এই চিঠির সঙ্গে যে পদত্যাগপত্রটি ডিরোজিও পাঠিয়েছিলেন, তার মর্ম এই :

‘ম্যানেজিং কমিটি, হিন্দু কলেজ

ভদ্রমহোদয়গণ, গত শনিবারের জরুরি বৈঠকে আপনারা কলেজের সঙ্গে আমার সম্পর্কচ্ছেদ উচিত মনে করে যে প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন, তার জন্য আমি এই পদত্যাগপত্র পেশ করতে বাধ্য হচ্ছি।

সভার কার্যবিবরণের মধ্যে উল্লেখ করা হয়নি এরকম কয়েকটি বিষয়ের প্রতি প্রসঙ্গত এখানে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। প্রথমত, আমার বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ চেষ্টা করেও আপনারা প্রমাণ করতে পারেননি। যেসব অভিযোগ করা হয়েছে তা এখনও আমি জানি না, এবং আমাকে জানানোর প্রয়োজনও আপনারা বোধ করেননি। অভিযোগকারীদের সামনে উপস্থিত হয়ে আমার জবাব দেবার ন্যায্য অধিকার থেকেও আমাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। আমার ব্যক্তিগত চরিত্র, অভিরুচি, আদর্শ, নীতি ইত্যাদি সম্বন্ধে আলোচনা ও সমালোচনা করেছেন আপনারা, আমাকে উত্তর দেবার সুযোগ না দিয়ে। একথাও আমি জানি যে, কমিটির অধিকাংশ সভ্য আমার বিরুদ্ধে অযোগ্যতার অপবাদ স্বীকার না—করা সত্ত্বেও আপনারা আমাকে যে—কোনো অজুহাতে শিক্ষকপদ থেকে সরিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত করেছেন। অপরাধী যে, তাকে জেরা করা হল না, সে জানল না তার অপরাধ কী, অথচ তার একতরফা বিচার ও দণ্ডদান দুইই শেষ হয়ে গেল। আশা করি, এগুলি সত্য বলে স্বীকার করতে আপনারা সংকোচ বোধ করবেন না। তাহলেই আমি খুশি হব, আর কোনো মন্তব্য করব না।’

পদত্যাগপত্রের শেষে উইলসন, ডেভিড হেয়ার ও শ্রীকৃষ্ণ সিংহকে ডিরোজিও আন্তরিক সাধুবাদ জানিয়েছেন তাঁদের সৎসাহসের জন্য।

ডিরোজিওর চিঠির উত্তরে উইলসন পরে যে চিঠি লিখেছিলেন, তার মধ্যে নির্দিষ্ট অভিযোগগুলির আভাস পাওয়া যায়। উইলসন লেখেন—

‘প্রিয় ডিরোজিও,

মনে হয় আপনার কথাই ঠিক, কিন্তু তবু কলেজের হিন্দু ম্যানেজারদের সম্পর্কে অতটা রূঢ় মন্তব্য না করলেই পারতেন। বাস্তবিক তাঁদের খুব দোষ দেওয়া যায় না। সমাজের প্রতিক্রিয়ার কাছে তাঁরা খানিকটা অবস্থাগতিকে মাথা হেঁট করতে বাধ্য হয়েছেন। তদন্ত বা ন্যায়সংগত বিচার—বিবেচনা করার অবকাশ তাঁরা পাননি। আপনার ব্যক্তিগত নিন্দা ও বিরূপ সমালোচনাও সভায় তেমন কিছু করা হয়নি। কলকাতার লোকের, বিশেষ করে হিন্দুসমাজের মনে, আপনার সম্বন্ধে এমন একটা ধারণা দৃঢ়মূল হয়েছে, যা কলেজের পক্ষে সত্যি ক্ষতিকর হচ্ছে। সেই ধারণাটা সত্য কি মিথ্যা তা যাচাই করার জন্য তথ্যপ্রমাণ ঘেঁটে অথবা সাক্ষীসাবুদ ডেকে জেরা করে বিশেষ কোনো লাভ হত না। এখনও অন্তত ঘরোয়াভাবে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে বলে আমার ধারণা। কিছুদিন তা চলবে বলে মনে হয়।

আপনার বিরুদ্ধে তিনটি গুরুতর অভিযোগ করা হয়েছে। সেগুলি কী তা ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে আমি প্রশ্নাকারে জানাচ্ছি। প্রশ্নের উত্তর দিতেই হবে এমন কোনো কথা নেই, আপত্তি না থাকলে দেবেন।

আপনি কি ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন?

আপনি কি মনে করেন যে পিতা—মাতার আদেশ পালন করা অথবা তাঁদের শ্রদ্ধাভক্তি করা নৈতিক কর্তব্যের মধ্যে গণ্য নয়?

আপনার মতে ভাইবোনের বিবাহ কি সামাজিক অপরাধ নয়?

এইসব বিষয় নিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে আপনি কি স্বাধীনভাবে আলাপ—আলোচনা করেন?

আমি জানি, এসব কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করার আমার কোনো অধিকার নেই। কিন্তু তবু আপনার বিরুদ্ধে হিন্দুসমাজের অসন্তাোষের কারণ কী, এবং জনসাধারণের মধ্যে কী ধরনের গুজব রটনা হয়েছে, তারই একটু আভাস দেবার জন্য এগুলি লিখে জানালাম। এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন তা সাহস করে বলতে পারলে আমি নিজে খুবই খুশি হতাম। আপনার কোনো যুক্তিপূর্ণ জবাব পেলেও আমি তা অধ্যক্ষদের দেখিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারি।

 নিবেদন ইতি,

 এইচ. এইচ. উইলসন।’

উইলসনের চিঠির যে উত্তর দিয়েছিলেন ডিরোজিও, সেটি তাঁর জীবনের মহার্ঘ দলিলরূপে গণ্য হবার যোগ্য। চিঠিখানি দীর্ঘ, কিন্তু এই দলিলমূল্যের জন্য তা সম্পূর্ণ উদ্ধৃতির প্রয়োজন।

এইচ. এইচ. উইলসন মহাশয় সমীপেষু

প্রিয় মহাশয় গতকাল সন্ধ্যায় আপনার চিঠি পেয়ে তখনই জবাব দেব ভেবেছিলাম, কিন্তু কয়েকটি জরুরি কাজের জন্য দিতে পারিনি। সেজন্য মার্জনা করবেন। আমার ব্যাপারে আপনি এখনও এত দূর আগ্রহ প্রকাশ করছেন দেখে সত্যিই আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি। আপনার প্রশ্নগুলি আমার ব্যক্তিগত জীবন ও চরিত্রের দিক থেকে এত গুরুত্বপূর্ণ যে তার উত্তর স্বভাবতই একটু দীর্ঘ হবে। এই দীর্ঘ উত্তর আপনাকে কষ্ট করে পড়তে হবে ভেবে লজ্জাবোধ করছি। তবু আপনার মতো একজন স্বনামধন্য শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির কাছে এরকম একটি দীর্ঘ চিঠিতে অনেক গুরুবিষয় সম্বন্ধে মতামত প্রকাশের সুযোগ যে আপনি দিয়েছেন, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।

প্রথম প্রশ্নের উত্তর। কারও কাছে এমন মতামত আমি কোনোদিন প্রকাশ করিনি, যাতে আমাকে নাস্তিক মনে করা সম্ভব। তবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বা অনস্তিত্ব সম্বন্ধে মন খুলে আলোচনা করা যদি অপরাধ হয়, তাহলে অপরাধী বলে আমি নিজেকে স্বীকার করতে কুণ্ঠিত নই। এ বিষয়ে নানা মুনির নানা মত আছে। সেই মত নিয়ে ছেলেদের সঙ্গে মধ্যে—মধ্যে উন্মুক্ত মনে আলোচনা করেছি। যাঁরা আস্তিক, তাঁদের কথা বলেছি, যাঁরা নাস্তিক, তাঁদের কথাও বলেছি। যাঁরা অস্তিনাস্তি প্রশ্নই উত্থাপন করতে চান না, তাঁদের কথাও উল্লেখ করতে ভুলিনি। আমি জানি না, এরকম একটি গুরুবিষয় নিয়ে এইভাবে আলোচনা করার মধ্যে অন্যায় কোথায়! এক পক্ষের কথা অন্ধের মতো বিশ্বাস করব, অন্য পক্ষের যুক্তি শুনব না বা বিচার—বিবেচনা করব না, এইটাই কি কোনো বিষয়ে জ্ঞানলাভের সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা? কী করে তাহলে জ্ঞান পূর্ণতা লাভ করবে? আর বিশ্বাস যা—ই হোক—না কেন, তার ভিতটাই বা কি দৃঢ় হবে যদি না প্রতিপক্ষের মতামত বিশ্লেষণ করা হয় এবং তার যুক্তি খণ্ডন করার মতো ক্ষমতা থাকে?

এ দেশের একদল তরুণের শিক্ষার খানিকটা দায়িত্ব কিছুদিনের জন্য বহন করার সুযোগ পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, তাদের একদল গোঁড়া আপ্তবাক্যবাদী অন্ধবিশ্বাসী তৈরি না করে সত্যিকার সুশিক্ষিত যুক্তিবাদী মানুষ তৈরি করব। তাই সকল বিষয়ে সর্বপ্রকারের মতামত নিয়ে অবাধে আলোচনা করতে আমি তাদের উৎসাহ দিতাম। আমার বিশ্বাস, তা না করলে কোনো মানুষেরই অব্যক্ত প্রতিভা ও সুপ্ত মানসিক শক্তির পূর্ণ প্রকাশ হয় না। লর্ড বেকনের ভাষায় বলা যায় : ‘if a man will begin with certainties, he shall end in doubts’ কিন্তু তাতেও দেখলাম যে, এক সংশয় থেকে মনে আর—এক নতুন সংশয়ের উদয় হয় এবং অবশেষে সংশয়াকুল চিত্তের দোলায়মানতা আর শেষ হয় না কোনোদিন। সেইজন্য আমি ছাত্রদের দার্শনিক হিউমের রচনাবলির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি, কারণ হিউম অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ও শানিত যুক্তি দিয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্ব খণ্ডন করেছেন। কেবল তা—ই করেই আমি ক্ষান্ত হইনি। ডক্টর রিড ও স্টুয়ার্টের প্রতিযুক্তি ও উত্তর হিউম প্রসঙ্গে তাদের পড়িয়েছি। হিউমের যুক্তির এত জোরালো প্রতিবাদ আজ পর্যন্ত আর কেউ করতে পারেননি। এবং ‘This is the head and front of my offending.’ ধর্ম বিষয়ে ছাত্রদের মজ্জাগত ধ্যানধারণার মূল পর্যন্ত যদি আমার সেই শিক্ষার ফলে নড়ে গিয়ে থাকে তাহলে তার জন্য আমি কি অপরাধী? তরুণদের মনে কোনো নির্দিষ্ট বিশ্বাস সৃষ্টি করা কোনোদিন আমার উদ্দেশ্য ছিল না এবং সেটা আমার ক্ষমতার বহির্ভূত ব্যাপার। আমার এই কথা থেকে বুঝতে পারবেন, ছাত্ররা যদি কেউ নাস্তিক হয়ে থাকে তাহলে তার জন্য নিন্দাবাদ যেমন আমার প্রাপ্য, তেমনি যারা আস্তিক হয়েছে, তাদের জন্য সাধুবাদও আমি দাবি করতে পারি।

সত্যি কথা বলতে কী, মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ও মতের পরিবর্তনশীলতা সম্বন্ধে আমি নিজে এত বেশি সজাগ যে, অত্যন্ত ছোটোখাটো বিষয়েও আমি কখনো একটি নির্দিষ্ট মত প্রকাশ করি না। অনুসন্ধিৎসার অনন্ত সমুদ্রে দুর্জ্ঞেয় সত্যের দ্বীপে যাত্রা করাই জ্ঞানান্বেষণের শ্রেষ্ঠ পন্থা বলে আমার ধারণা।

আমার নিজের মনের গড়নও তা—ই। প্রশ্নহীন সংশয়হীন মন যত শীঘ্র জড়ত্বের জালে জড়িয়ে পড়ে মানসিক অপমৃত্যু বরণ করে, প্রশ্নকাতর সংশয়াতুর মন তত সহজে মানুষকে সন্দেহবাদী বা নাস্তিবাদী করে তোলে না। এটা সত্য নয়, ওটা সত্য, অথবা আমার যা বিশ্বাস, সেইটাই ধ্রুবসত্য, এমন কথা হলফ করে কোনো সত্যসন্ধানী কখনোই বলবেন না।

আপনার দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, পিতা—মাতাকে শ্রদ্ধা করা ও তাঁদের আদেশ পালন করা আমি নৈতিক কর্তব্য বলে মনে করি কি না? আপনার এই প্রশ্নে সত্যিই আমি হতবাক হয়ে গেছি। জীবনে কোনোদিন কেউ আমাকে এই ধরনের একটা অস্বাভাবিক প্রশ্ন যে করবেন তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। আমি পিতা মাতাকে শ্রদ্ধেয় মনে করব না, অথবা তাঁদের আদেশ অমান্য করা অন্যায় ভাবি না, আমার বিরুদ্ধে এত দূর হীন অপপ্রচারে যাঁরা আত্মতৃপ্তি লাভ করেন, তাঁদের কেবল ঘৃণ্য মনে করেও আমি স্বস্তি পাচ্ছি না। আপনি বয়োজ্যেষ্ঠ শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি, এ বিষয়ে আপনাকে কী বলব বুঝতে পারছি না। আমি যদি পিতৃহীন না হতাম তাহলে আমার পিতাই এই অপপ্রচারের উচিত জবাব দিতে পারতেন। এই বলে জবাব দিতেন যে, যাঁরা আমার বিরুদ্ধে এই কুৎসিত অভিযোগ করেছেন অথবা অন্য যাঁরা এদিক থেকে নিজেদের মহাত্মা বলে মনে করেন, তাঁদের কারও চেয়ে আমি কম পিতৃমাতৃভক্ত নই। হয়তো খোঁজ করলে দেখা যাবে, তাঁদের অনেকের চেয়ে পিতা—মাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য জীবনে আমি অনেক বেশি পালন করেছি। সুতরাং আমি আমার ছাত্রদের যে এরকম শিক্ষা দিতে পারি না তা বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। বরং তার বিপরীতটাই করেছি। ছাত্রদের মধ্যে যখনই এই ধরনের কোনো মনোভাবের আমি আভাস পেয়েছি, তখনই তাদের রীতিমতো ধমক দিয়ে পিতা—মাতার বাধ্য হতে বলেছি। তবে সমাজে পিতা—মাতার অনেক তথাকথিত বাধ্য সন্তানকে দেখেছি কুলাঙ্গারে পরিণত হতে, তাই মধ্যে—মধ্যে তাদের সাবধান করে দিয়েছি যে পিতা—মাতার প্রতি বাধ্যতার মুখোশ পরে অমানুষ হওয়ার চেয়ে কিছুটা অবাধ্য হয়েও মানুষ হওয়া শ্রেয়। কিন্তু পিতা—মাতার প্রতি ছেলেদের ব্যবহার সম্বন্ধে আমি যে বরাবর কতখানি সজাগ ছিলাম, তার দু’টি দৃষ্টান্ত আপনার কাছে উল্লেখ করছি।

যে দু’জন ছাত্র সম্বন্ধে বলছি, তারা কলকাতাতেই থাকে, যে—কোনো সময় তাদের ডেকেও আপনি জিজ্ঞাসা করতে পারেন। মাস দু’তিন আগে দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় নামে আমার একজন ছাত্র (সম্প্রতি তাকে নিয়ে শহরে বেশ সাড়া পড়ে গিয়েছিল) আমাকে জানায় যে, বাড়িতে পিতার নিষ্ঠুর আচরণ তার পক্ষে অসহ্য হয়ে উঠেছে। বাড়ি না ছাড়লে তার উপায় নেই। আমি যদিও ঘটনাটি সব জানতাম, তাহলেও তাকে বাড়ি ছাড়তে নিষেধ করে বুঝিয়ে বললাম, ‘অত অধৈর্য হলে চলবে না, মা—বাবার আচরণ কিছুটা অপ্রীতিকর মনে হলেও সহ্য করা উচিত। বাড়ি থেকে তাঁরা যদি তোমাকে তাড়িয়ে না দেন তাহলে নিজে তুমি বাড়ি ছেড়ে চলে যেয়ো না।’ আমার কথা শুনে দক্ষিণা বাড়িতেই রইল, কিন্তু দুঃখের বিষয়, বেশি দিন থাকতে পারল না। দু’তিন সপ্তাহ আগে আমাকে না জানিয়ে পিতৃগৃহ ছেড়ে আমারই বাড়ির কাছে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে চলে এসেছে। বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথাবার্তা পাকা হবার পর আমি জানতে পারি। আমি যখন তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আমাকে না জানিয়ে তুমি বাড়ি ছাড়লে কেন?’ তখন সে উত্তর দিল, ‘আপনি তো তাহলে কিছুতেই আমাকে বাড়ি ছাড়তে দিতেন না।’ এই গেল দক্ষিণারঞ্জনের কথা।

মহেশচন্দ্র সিংহ নামে একটি ছাত্র তার পিতা ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে অত্যন্ত রূঢ় ব্যবহার করে, খুড়ো উমাচরণ বসু ও সহোদর নন্দলাল সিংহকে সঙ্গে নিয়ে আমার বাড়িতে দেখা করতে আসে। আমি তার অশোভন আচরণের জন্য তিরস্কার করে বলি যে, অনুতপ্ত হয়ে পিতার কাছে যদি সে ক্ষমা না চায় তাহলে তার সঙ্গে আমি কোনো সম্পর্ক রাখব না। এরকম আরও অনেক দৃষ্টান্ত উল্লেখ করতে পারি, কিন্তু করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।

আপনার তৃতীয় প্রশ্ন হল, ভাইবোনের বিবাহকে সামাজিক অপরাধ বলে আমি মনে করি কি না? হ্যাঁ, নিশ্চয় আমি তা অসংগত বলে মনে করি। এরকম একটা আজগুবি বিষয় নিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে আমি আলোচনা করতে পারি, এ কথা আপনারা ভাবলেন কী করে? অবাক হয়ে ভাবি, আমার বিরুদ্ধে এরকম সব বিচিত্র অভিযোগ কোন শ্রেণির উর্বর মস্তিষ্ক থেকে আবিষ্কৃত হতে পারে? বিবিধ বিষয় নিয়ে যাঁদের সঙ্গে আমার কোনোদিন আলোচনা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে কেউ যে এরকম কুৎসিত মিথ্যা রচনা করবেন তা আমার মনে হয় না। আমার ছাত্রদের আমি বিলক্ষণ চিনি ও জানি। তাদের মধ্যে এমন মূর্খ কেউ নেই, যে ভুল বুঝে এইসব কথা রটনা করবে, অথবা এমন ধূর্তও কেউ আছে বলে আমি জানি না যে, স্বেচ্ছায় আমার মতামত বিকৃত করে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করবে। আমার তাই মনে হয়, একশ্রেণির কাপুরুষ চরিত্রহীন লোক আমার বিরুদ্ধে এই মিথ্যা অপপ্রচারে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। মিথ্যাই তাদের উপজীব্য। ধর্ম বিষয়ে কেউ স্বাধীন চিন্তা করলে তাকে সমাজের লোক নাস্তিক ও নরাধম বলতে পারে, এ কথা জানি ও বুঝি। কিন্তু অন্য যেসব প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন, সেগুলি যে এইভাবে কোনো সভ্যসমাজে কোনো সভ্য মানুষের চরিত্রকে কলঙ্কিত করার জন্য উদ্ভাবিত হতে পারে, তা আপনার চিঠিতে না জানলে আমার পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব হত না। আপনি সহৃদয় ব্যক্তি, তাই আপনাকে অনুরোধ করছি, নির্ভয়ে এইসব গুজব ভিত্তিহীন ও মিথ্যা বলে ঘোষণা করবেন। গুজব রটনাকারীদের বলবেন, ‘I am not a greater monster than most people.’

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমি শুনেছি, একদল লোক অফুরন্ত উৎসাহ নিয়ে আমার সম্বন্ধে নানা রকমের কাল্পনিক কাহিনি প্রচার করতে আরম্ভ করেছেন। কেবল আমার সম্বন্ধে নয়, আমার পরিবার সম্বন্ধেও তাঁদের কুৎসিত কল্পনা স্কন্ধকাটা প্রেতের মতো ডানা মেলতে শুরু করেছে। একটি কাহিনি হল, আমার ভগ্নীর সঙ্গে (কেউ বলেছেন আমার মেয়ের সঙ্গে, যদিও আমার কোনো মেয়ে নেই) একজন হিন্দু যুবকের নাকি শীঘ্রই বিবাহ হবে। খবর নিয়ে জেনেছি, বৃন্দাবন ঘোষাল নামে একজন দরিদ্র ব্রাহ্মণ এই গল্পটি বেশ শ্রুতিরোচক করে সর্বত্র প্রচার করে বেড়ায়। আমি শুনেছি, এই ঘোষালের পেশা হল, প্রতিদিন সকলে উঠে লোকের বাড়ি—বাড়ি ঘুরে যতসব আজগুবি খবর সংগ্রহ করা এবং ফুলিয়ে—ফাঁপিয়ে রসিয়ে—রসিয়ে সর্বত্র তা—ই পরিবেশন করা। এই ঘোষালের মতো কিছু পেশাদার গুজব—রসিক চেষ্টা করলে রাতারাতি শিবকেও যে বাঁদর বানিয়ে ফেলতে পারেন, তাতে আর আশ্চর্য কী? যা—ই হোক, এ সম্বন্ধে আর কিছু আমি বলতে চাই না, কারণ অপবাদ বা মিথ্যা গুজব খণ্ডন করার মতো নির্বুদ্ধিতা আর কিছু নেই। এসবের উৎপত্তি যেমন অস্বাভাবিক, অপমৃত্যুও তেমনি স্বাভাবিক।

আপনার প্রশ্নের উত্তর এখানেই শেষ করলাম। এখন আমি আপনাকে সবিনয়ে একটি প্রশ্ন করব। মিথ্যা জনরবের ভয়ে অথবা কুৎসা প্রচারকদের তোষণের জন্য, আমাকে কলেজ থেকে কর্মচ্যুত করা কি আপনাদের মতো বিচক্ষণ ব্যক্তিদের পক্ষে সংগত হয়েছে? এ কথা অবশ্য ঠিক যে, আপনাদের সভার কার্যবিবরণের মধ্যে আমার বিরুদ্ধে কোনো বিশেষ অভিযোগ লিপিবদ্ধ করা হয়নি। কিন্তু কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে যখন মিথ্যা জনরব রটে, তারই ভিত্তিতে যদি তাঁকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়, তাহলে সেটা মিথ্যাকেই প্রশ্রয় দেওয়া হয় না কি? কেবল জনরব শান্ত করার জন্য কলেজের অধ্যক্ষ আমাকে কর্মচ্যুত করতে বাধ্য হয়েছেন, এ কথা মেনে নিতে আমি রাজি নই। আগে থেকেই তাঁরা বদ্ধপরিকর হয়েছিলেন আমাকে তাড়াবার জন্য। অন্ধ ধর্মগোঁড়ামিই আমার প্রতি তাঁদের বিতৃষ্ণা জাগিয়ে তুলেছে। তা যদি না হত তাহলে এরকম অভিনব কৌশলে, সমস্ত সৌজন্য ও শালীনতাবোধ বিসর্জন দিয়ে, এইভাবে তাঁরা আমাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করতেন না। তাঁদের এই আচরণের কথা যাঁরাই শুনেছেন, তাঁরাই গভীর বেদনা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। প্রকাশ্যে অবিচারের প্রতিবাদ করতেও আমার প্রবৃত্তি হয় না, কারণ প্রতিবাদ করলে পরোক্ষে তাঁদের মতামতের মর্যাদা দেওয়া হয়। এটুকু মর্যাদাও তাঁদের প্রাপ্য বলে আমি মনে করি না।

সুদীর্ঘ চিঠির জন্য আপনার কাছে আবার ক্ষমতা প্রার্থনা করছি, এবং আমার জন্য যে এতসব ঝঞ্ঝাট আপনাকে সহ্য করতে হল, সেজন্য সসংকোচে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বক্তব্য শেষ করছি।

 ইতি—

 আপনার একান্ত অনুগত

 এইচ.এল.ভি. ডিরোজিও

কেবল চিঠিখানাই যে এখানে শেষ হল না তা নয়, ডিরোজিওর একাঙ্ক জীবননাট্যের শেষ দৃশ্যের পরদাও এখানে সরে গেল।’

……………

* ৮নং প্রস্তাবটি কলেজ রেকর্ডে নেই।

* ডিরোজিওর কর্মচ্যুতি সম্পর্কে সভার বিবরণ, প্রস্তাব ও চিঠিপত্র হিন্দু কলেজের প্রাচীন নথিপত্র থেকে উদ্ধার করে গ্রন্থের শেষে ‘পরিশিষ্ট’ অংশে ছাপা রয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *