সর্বকালের সেরা কাহিনি

১. সর্বকালের সেরা কাহিনি

একদম শুরুতে, মানে আজ থেকে প্রায় ১৪ বিলিয়ন বা ১৪০০ কোটি বছর আগে গোটা মহাবিশ্বটা ছিল খুবই ছোট। অতি ক্ষুদ্র। এই বাক্যটা শেষ হতে যতটুকু সময় লাগে, তার চেয়েও ছোট ছিল তার সময়ের ব্যাপ্তি।

কিন্তু সেটা কত ছোট? একটা পিৎজাকে ওই সময়ের ব্যাপ্তি হিসেবে কল্পনা করো। এখন পিৎজাটাকে এক ট্রিলিয়ন ভাগে ভাগ করো। মহাবিশ্বের সবকিছু—মানে তোমার দেহ যেসব কণা দিয়ে তৈরি হয়েছে, সেগুলোসহ তোমার জানালার বাইরের গাছপালা, বাড়িঘর, তোমার বন্ধুর মোজা, পিটুনিয়া, তোমার স্কুল, আমাদের গ্রহের আকাশচুম্বী পাহাড়-পর্বত আর গভীর মহাসাগর, সৌরজগৎ, বহুদূরের গ্যালাক্সি—সব স্থান ও শক্তি এবং বিশ্বজগতের বস্তুসহ সবকিছু ওই ক্ষুদ্র বিন্দুতে ঠাসাঠাসি অবস্থায় ছিল।

সেটা ছিল প্রচণ্ড উত্তপ্ত।

এত্ত ছোট্ট একটা জায়গায় এত এত বেশি কিছু ঠাসাঠাসি থাকায় পরিস্থিতিটা ছিল খুবই উত্তপ্ত। তাই তখন মহাবিশ্বের শুধু একটা কাজ করাই বাকি ছিল। প্রসারিত হওয়া।

প্রচণ্ড দ্রুত বেগে।

বর্তমানে এ ঘটনাকে আমরা বলি বিগ ব্যাং। বাংলায় মহাবিস্ফোরণ। আর এক সেকেন্ডের অতি ক্ষুদ্র এক ভগ্নাংশ সময়ে সঠিকভাবে বলতে গেলে এক সেকেন্ডের ১০ মিলিয়ন ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ভাগের ১ ভাগ) মহাবিশ্ব অতি দ্রুতবেগে বড় হতে লাগল। ( ১ ট্রিলিয়ন হলো ১,০০০,০০০,০০০,০০০ বা ১০১২ বা এক লাখ কোটি। )

কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমাদের বিশ্বজগতের জীবনের একবারে প্রথম অবস্থার কথা কীভাবে জানা সম্ভব হলো? বর্তমানে আমরা আবিষ্কার করেছি, মাত্র চারটি মৌলিক বল নিয়ন্ত্রণ করছে গোটা মহাবিশ্বকে গ্রহকে কক্ষপথে ঘোরানো থেকে শুরু করে আমাদের দেহ গঠনকারী ছোট কণা পর্যন্ত সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে এই চারটি বল বা ফোর্স। কিন্তু মহাবিস্ফোরণের ঠিক পরমুহূর্তে এই চারটি বলের সব কটি একটামাত্র বল হিসেবে বিরাজ করছিল।

মহাবিশ্ব প্রবল বেগে প্রসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা ক্রমে ঠান্ডা ও হতে লাগল।

ক্ষণিক এই কাল বিজ্ঞানীদের কাছে প্ল্যাঙ্ক যুগ নামে পরিচিত। এই কালের নাম দেওয়া হয়েছে বিখ্যাত জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের নামানুসারে। এ সময়ের শেষ দিকে অন্য সব বল থেকে একটা বল আলাদা হয়ে গেল। সেই বলটি হলো গ্র্যাভিটি বা মহাকর্ষ। নক্ষত্রসমূহ ও গ্রহগুলোকে একত্রে ধরে রেখে ছায়াপথ বা গ্যালাক্সি গঠন করে এই মহাকর্ষ। আবার সূর্যের চারপাশে নির্দিষ্ট কক্ষপথে পৃথিবীকে আটকে রাখে এই বল। ১১ বছর বয়সী কোনো বাচ্চাকে বাস্কেটবল ডাঙ্কিং করতেও বাধা দেয় এটা। এ ছাড়া আরও অনেক কিছুই রয়েছে। মহাকর্ষ যে সব সময় টানে, তার একটা সরল প্রমাণ দেখানো যাক। তোমার হাতের বইটা বন্ধ করো। এরপর বইটাকে পার্শ্ববর্তী কোনো টেবিলের কয়েক ইঞ্চি ওপরে তুলে ধরো। বইটা ছেড়ে দাও এবার। কী ঘটল? আসলে এভাবেই কাজ করে মহাকর্ষ। (অবশ্য তোমার বইটা যদি নিচে না পড়ে যায়, তাহলে এক্ষুনি আশপাশের কোনো অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্টকে খুঁজে বের করো। সেই সঙ্গে ঘোষণা করো মহাজাগতিক জরুরি অবস্থা। )

অবশ্য আদিম মহাবিশ্বের প্রথম কয়েক মুহূর্তে সেখানে মহাকর্ষ কাজ করার জন্য কোনো গ্রহ, কিংবা কোনো বই বা ১০ বছর বয়সী কোনো বাস্কেটবল খেলোয়াড় ছিল না। মহাকর্ষ সবচেয়ে ভালো কাজ করে বড় বড় বস্তুর সঙ্গে। সে তুলনায় আদিম মহাবিশ্বে সবকিছু ছিল অকল্পনীয় রকম ক্ষুদ্র।

কিন্তু সেটা তো ছিল সূচনামাত্র।

বিশ্বজগৎ তখনো কেবল বাড়ছে।

এরপর প্রকৃতির অন্য তিনটি প্রধান বল পরস্পর থেকে আলাদা হয়ে গেল। মহাবিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ক্ষুদ্র কণাদের বা পদার্থের টুকরোদের নিয়ন্ত্রণ করা এই বলগুলোর প্রধান কাজ।

তুমি কি মঙ্গল গ্রহে বাস্কেটবল ডাঙ্ক করতে পারবে?
ধরে নেওয়া যাক, কোনো একভাবে তুমি মঙ্গল গ্রহে পৌঁছাতে পেরেছ। অবশ্য কাজটা কিন্তু মোটেও সহজ নয়। ধরা যাক, তুমি একটা স্পেসস্যুট পরে আছ। সেটা পরেও লাফ দেওয়ার জন্য যথেষ্ট সুবিধা আছে। কোনো গ্রহে বা চাঁদে মহাকর্ষের টান বা আকর্ষণ কেমন হবে, সেটা নির্ভর করে তার ভরের ওপর। পৃথিবীর সঙ্গে তুলনা করলে মঙ্গল গ্রহের ভর বেশ কম। সেখানকার মহাকর্ষের শক্তি পৃথিবীর তিন ভাগের এক ভাগ মাত্র। কাজেই মঙ্গল গ্রহে তুমি লাফ দিয়ে যথেষ্ট উঁচুতে উঠতে পারবে। কিন্তু আমি আশা করছি, তুমি কখনো মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার সুযোগ পেলে সেখানে বাস্কেটবল খেলে সময় নষ্ট করবে না। তার চেয়েও অনেক মজার মজার জিনিস দেখার ও করার আছে সেখানে।

চারটি বল পরস্পর থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার পর যা হলো, সেটাই আসলে একটা মহাবিশ্ব গঠনের জন্য দরকার। এই চারটি বল হলো মহাকর্ষ, সবল নিউক্লিয়ার বা পারমাণবিক বল, দুর্বল নিউক্লিয়ার বল এবং বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল। এ বিষয়ে পরের অধ্যায়ে আমরা আরও কথা বলব।

*

শুরুর পর ১ সেকেন্ডের ট্রিলিয়ন ভাগের ১ ভাগ সময় পেরিয়ে গেছে।

*

কিন্তু মহাবিশ্বের আকার তখনো অতিক্ষুদ্র। এত ক্ষুদ্র যে তা কল্পনাও করা যায় না। সেই সঙ্গে উত্তপ্তও বটে। এ সময় বিভিন্ন কণার ভিড় হতে শুরু করে। এ সময়ে বিন্দুতে কণা ছিল মোট দুই ধরনের। এদের একটার নাম কোয়ার্ক, আর অন্যটা লেপটন। কোয়ার্ক নাম দেওয়া হয়েছিল মার্কসের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে। কোয়ার্ক কণারা অদ্ভুতুড়ে এক জানোয়ারের মতো। তুমি কখনোই আলাদা করে কোনো কোয়ার্ককে আটকাতে পারবে না। এরা সব সময় কাছাকাছি থাকা অন্যদের সঙ্গে গলা ধরে ঝুলে থাকবে। আমি নিশ্চিত, তোমার অন্তত একটা বন্ধু অথবা ক্লাসমেট আছে, যাদের আচরণ ঠিক এ রকম। কোয়ার্ক হলো সেসব বাচ্চার মতো, যারা কখনো একা একা কোনো কাজ করতে চায় না। এমনকি রেস্টরুমেও একা একা যেতে চায় না তারা।

দুটি বা তার চেয়ে বেশি কোয়ার্ককে একধরনের বল একত্র করে রাখে। মজার ব্যাপার হলো, কোয়ার্কদের আলাদা করতে গেলে সেই বলের পরিমাণ হুট করে আরও বেড়ে যায়। যেন কোয়ার্কগুলো কোনো

পদার্থের অনেক নাম
আমাকে আগেই সতর্ক করা হয়েছে যে খুদে পাঠকদের কাছে অসংখ্য নাম ও শর্তের পরিচয় দিতে যাওয়া বোকামি। তাই মহাবিশ্বের বিভিন্ন ধরনের কোয়ার্কের কথা বিস্তারিত বলার লোভ এখানে সামলাতে হচ্ছে। শুধু এটুকু জেনে রাখো, মোট ছয় ধরনের কোয়ার্ক আছে। সেগুলো হলো আপ, ডাউন, স্ট্রেঞ্জ, চার্ম, বটম ও টপ। তবে আমার মনে হয়, তোমাদের কোয়ার্ক ও লেপটন সম্পর্কে জানা উচিত। কারণ, তুমিসহ গোটা দৃশ্যমান মহাবিশ্ব এগুলো দিয়ে তৈরি। আমি খেয়াল করে দেখেছি, ছোট বাচ্চারা বিভিন্ন ডাইনোসরের জটিল নামও মনে রাখতে পারে। তাতে তাদের কোনো সমস্যা হয় না। কিছু ডাইনোসর আছে হিংস্র আর ভয়াবহ। সেগুলোও তারা ঠিকই মনে রাখতে পারে। কিন্তু আমরা সেসব জিনিসের কথা বলছি, যেগুলো দিয়ে গোটা মহাবিশ্ব গঠিত হয়েছে! কণাগুলোও বেশ আকর্ষণীয়। আবার তেমন ভয়ংকরও নয়। আর এসব কণা ছাড়া আমরা ওই ডাইনোসরদের কখনো পেতাম না।

ধরনের খুদে অদৃশ্য রাবার ব্যান্ড দিয়ে আটকানো। তাদের যথেষ্ট পরিমাণ আলাদা করা সম্ভব হলে ওই অদৃশ্য রাবার ব্যান্ডটা ছিঁড়ে যায়। তারপর সঞ্চিত শক্তি থেকে প্রতিটির শেষ প্রান্তে তৈরি হয় নতুন একটা করে কোয়ার্ক। এভাবে জোড়া থেকে আলাদা করা প্রতিটির একটা করে নতুন বন্ধু জুটে যায়। মনে মনে একবার ভাবো, তোমার স্কুলে এ রকম অবিচ্ছেদ্য বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও যদি একই ঘটনা ঘটত এবং তারা যদি অঙ্কুরিত হয়ে দ্বিগুণ হয়ে যেত, তাহলে ব্যাপারটা কী হতো। তাহলে তোমার শিক্ষক নিঃসন্দেহে বিস্ময়ে একেবারে থ হয়ে যেতেন।

অন্যদিকে লেপটন হলো নিঃসঙ্গ, একা। কোয়ার্কদের যে বল একত্র করে, লেপটনের ওপর তার কোনো প্রভাব নেই। কাজেই লেপটন কখনো গুচ্ছকারে থাকে না। সবচেয়ে পরিচিত একটি লেপটন হলো ইলেকট্রন।

প্ৰতিপদার্থ
আমরা এইমাত্র যে কোয়ার্ক ও লেপটনের সঙ্গে পরিচিত হলাম, সেগুলো ছাড়াও মহাবিশ্বের প্রধান প্রধান সব কণার প্রতিকণা বা অ্যান্টিপার্টিকেল জোড়া রয়েছে। এদের বলা হয় অ্যান্টিম্যাটার বা প্রতিপদার্থ। প্রতিকণারা সবদিক দিয়ে তার কণার বিপরীত চরিত্রের। যেমন ইলেকট্রনের কথা ধরা যাক। লেপটন কণা পরিবারে এরাই সবচেয়ে জনপ্রিয় ও পরিচিত সদস্য। ইলেকট্রনের চার্জ নেগেটিভ বা ঋণাত্মক। কিন্তু এর প্রতিকণা পজিট্রনের চার্জ পজিটিভ বা ধনাত্মক। অবশ্য আমাদের চারপাশে প্রতিকণা তেমন দেখতে পাওয়া যায় না। কারণ, কোনো কণার কখনো প্রতিকণা তৈরি হলে, তা সঙ্গে সঙ্গে তার কণা জোড়ার দিকে ছুটে যায়। আর তাদের এই সাক্ষাতের ফল কখনো ভালো হয় না। কারণ, এই জোড়া পরস্পরকে ধ্বংস করে ফেলে। সে বিস্ফোরণে তারা রূপান্তরিত হয়ে যায় শক্তিতে। (পদার্থবিদ জর্জ গ্যামোর লেখা বই মি. টম্পর্কিন-এর তৃতীয় অধ্যায়ে এ- সংক্রান্ত গল্প পাবে।) বর্তমানে পরমাণুদের একসঙ্গে সংঘর্ষ ঘটিয়ে দানবীয় পরীক্ষায় প্রতিপদার্থ কণা তৈরি করেন বিজ্ঞানীরা। আবার মহাকাশে উচ্চশক্তির সংঘর্ষের পর আমরা এ ধরনের কণা পর্যবেক্ষণ করতে পারি। কিন্তু প্রতিপদার্থ খুব সহজে খুঁজে পাওয়া যায় বিভিন্ন বিজ্ঞান কল্পকাহিনির পাতায়। এ কণার ব্যবহার দেখা যায় স্টার ট্রেকের টেলিভিশন শো ও মুভিতে বিখ্যাত এন্টারপ্রাইজের ইঞ্জিনগুলোর জ্বালানি হিসেবে। আবার বিভিন্ন কমিকসেও এদের বারবার দেখতে পাওয়া যায়।

এসব কণা ছাড়াও মহাবিশ্ব তখন টগবগ করছিল প্রচণ্ড শক্তিতে আর এই শক্তি বিরাজ করছিল তরঙ্গরূপী প্যাকেট বা আলোকশক্তির গুচ্ছ হিসেবে। এদের বলা হয় ফোটন

এখানেই সবকিছু অদ্ভুত হয়ে ওঠে মহাবিশ্ব এতই উত্তপ্ত ছিল যে এসব ফোটন নিয়মিতভাবে পদার্থ ও প্রতিপদার্থ কণাজোড়ায় রূপান্তরিত হচ্ছিল। এরপর এসব জোড়া পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষের মুখে পড়ে আবারও রূপান্তরিত হচ্ছিল ফোটনে। কিন্তু রহস্যময় কোনো কারণে এসব রূপান্তরের এক বিলিয়নের মধ্যে মাত্র একটা পদার্থ কণা তৈরি হচ্ছিল কোনো প্রতিপদার্থ সঙ্গী ছাড়াই। এই সব নিঃসঙ্গ কিছু কণা যদি বেঁচে না যেত, তাহলে মহাবিশ্বে কোনো পদার্থই আর অবশিষ্ট থাকত না। এটা খুবই দারুণ ব্যাপারও বটে। কারণ, আমরা সবাই পদার্থ দিয়ে তৈরি।

আমরা টিকে আছি। আমরা জানি, সময় বয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মহাবিশ্ব ক্রমে প্রসারিত ও শীতল হচ্ছিল। মহাবিশ্ব আমাদের সৌরজগতের আকারের চেয়ে বড় হয়ে যাওয়ার পর দ্রুত হারে কমে যেতে থাকে এর তাপমাত্রা। তবু মহাবিশ্ব তখনো অনেক উত্তপ্ত ছিল। কিন্তু এর তাপমাত্রা তখন নেমে এসেছিল ১ ট্রিলিয়ন ডিগ্রি কেলভিনের নিচে।

তাপমাত্রা কীভাবে মাপা হয়
এ ব্যাপারে তুমি হয়তো এরই মধ্যে জেনে গেছ। কিন্তু কোনো সিস্টেমের তাপমাত্রা বর্ণনা করার বেশ কয়েকটি উপায় আছে। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ডিগ্রি ফারেনহাইট ব্যবহার করা হয়। ইউরোপে এবং বিশ্বের বাকি বেশির ভাগ দেশে ব্যবহার করা হয় ডিগ্রি সেলসিয়াস (বাংলাদেশেও সেলসিয়াস স্কেল ব্যবহার করা হয়)। কিন্তু অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্টরা ব্যবহার করেন কেলভিন একক। এটি এমন এক মানদণ্ড, যেখানে শূন্য হলো সত্যিকার অর্থে শূন্য। এর চেয়ে বেশি ঠান্ডা আর হতে পারে না। কাজেই ১ ট্রিলিয়ন ডিগ্রি ফারেনহাইট বা সেলসিয়াসের তুলনায় ১ ট্রিলিয়ন ডিগ্রি কেলভিন অনেক বেশি শীতল। এখানে অন্য স্কেল বা মানদণ্ডের বিরুদ্ধে আমি কিছু বলছি না। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ফারেনহাইট বা সেলসিয়াস একক ব্যবহার করায় কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আমরা যখন মহাবিশ্ব নিয়ে চিন্তা করব, তখন সবকিছুই হবে কেলভিন এককে।

*

মহাবিশ্ব শুরুর পর ১ সেকেন্ডের মিলিয়ন ভাগের ১ ভাগ সময় পেরিয়ে গেছে।

*

মহাবিশ্ব শুরু হয়েছিল এই বাক্যটি শেষ হতে যে সময় লাগে, তার চেয়েও অতিক্ষুদ্র একটা ভগ্নাংশ সময় থেকে। এখন তার আকার আমাদের সৌরজগতের সমান। এর পরিমাণ আড়াআড়িভাবে প্রায় তিন শ বিলিয়ন কিলোমিটার বা ১৮০ বিলিয়ন মাইল।

১ ট্রিলিয়ন ডিগ্রি কেলভিন তাপমাত্রা খুবই উত্তপ্ত, যা সূর্যের পৃষ্ঠের চেয়েও অনেক বেশি গরম। কিন্তু মহাবিস্ফোরণের একেবারে প্রথম মুহূর্তের সঙ্গে তুলনা করলে ১ ট্রিলিয়ন কেলভিন তাপমাত্রাকে অনেক ঠান্ডা বলতে হবে। এই কুসুম কুসুম গরম মহাবিশ্ব তখন আর কোয়ার্কগুলোকে ‘রান্না করা’র মতো যথেষ্ট উত্তপ্ত রইল না। কাজেই তখন নিজ নিজ সঙ্গী খুঁজে নিয়ে ভারী কণা তৈরি করতে লাগল কোয়ার্ক কণারা। কোয়ার্কদের এই সমন্বয়ের ফলে শিগগিরই প্রোটন ও নিউট্রনের মতো আমাদের পরিচিত পদার্থের রূপের দেখা মিলতে লাগল।

প্রোটন, নিউট্রন ও ইলেকট্রন কণা একত্রিত হয়ে তৈরি হয় পরমাণু।
প্রোটন, নিউট্রন ও ইলেকট্রন কণা একত্রিত হয়ে তৈরি হয় পরমাণু।

প্রোটন, নিউট্রন ও ইলেকট্রন কণা একত্রিত হয়ে তৈরি হয় পরমাণু।

মহাবিশ্বে পদার্থের সরল রেসিপি
১. কোয়ার্ক ও লেপটন দিয়ে শুরু করতে হবে।
২. কোয়ার্কদের একত্র করে প্রোটন ও নিউট্রন গঠন করতে হবে।
৩. প্রোটন, নিউট্রন ও ইলেকট্রন (ঋণাত্মক চার্জযুক্ত একধরনের লেপটন) একত্র করে তৈরি করতে হবে প্রথম অ্যাটম বা পরমাণুটি।
৪. এসব পরমাণু একত্রে মিশিয়ে তৈরি করতে হবে অণু বা মলিকিউল।
৫. বিভিন্ন ধরনের অণু জড়ো করে এবং তাদের সমন্বয়ে এরপর তৈরি করতে হবে গ্রহসহ অন্য সবকিছু।

*

মহাবিশ্ব শুরুর পর এতক্ষণে ১ সেকেন্ড সময় পেরিয়ে গেছে।

*

মহাবিশ্বের আকার তখন আড়াআড়িভাবে কয়েক আলোকবর্ষ। অর্থাৎ সূর্য থেকে তার সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী নক্ষত্রগুলোর যে পরিমাণ দূরত্ব, তার প্রায় কাছাকাছি। তাপমাত্রা কমে তখন নেমে গেছে ১ বিলিয়ন ডিগ্রিতে। এই তাপমাত্রাও আসলে প্রচণ্ড গরম। সেটা এতই উত্তপ্ত যে তা ছোট্ট ইলেকট্রন এবং তাদের বিপরীত কণা পজিট্রন ‘রান্না’র জন্য যথেষ্ট। এই দুই আলাদা কণাগুলো হুট করে উদয় হয় এবং পরস্পরকে ধ্বংস করে আবার অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু অন্য কণাদের ক্ষেত্রে যে কথাটি সত্য, ইলেকট্রনের জন্যও তা সত্য : অর্থাৎ

চারটি মৌলিক বল
নিচের মৌলিক চারটি বল মহাবিশ্বকে শাসন করছে :
১. মহাকর্ষ বা গ্র্যাভিটি। এ সম্পর্কে আমরা সবাই জানি।
২. শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বল বা সবল পারমাণবিক বল। ইংরেজিতে বলা হয় স্ট্রং ফোর্স। এই বলটি কণাগুলোকে পরমাণুর কেন্দ্রে আটকে রাখে।
৩. দুর্বল নিউক্লিয়ার বল বা দুর্বল পারমাণবিক বল। ইংরেজিতে বলা হয় উইক ফোর্স। এই বলের কারণে পরমাণু ভেঙে যায় এবং সেখান থেকে শক্তি বেরিয়ে আসে। আসলে এই বলটি দুর্বল নয়। এই বলটিও মহাকর্ষের চেয়ে শক্তিশালী। কিন্তু এটি সবল বলের মতো অত শক্তিশালী নয়।
৪. বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল বা ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফোর্স। এই বল ঋণাত্মক চার্জবাহী ইলেকট্রনগুলোকে পরমাণুর কেন্দ্রের ধনাত্মক চার্জবাহী প্রোটনের সঙ্গে আটকে রাখে। আবার এই বল একগুচ্ছ পরমাণুকে আটকে রেখে অণু গঠন করে।

সরলভাবে বললে : মহাকর্ষ বড় ধরনের বস্তুগুলোকে আটকে রাখে। অন্যদিকে অন্য তিনটি বল ক্ষুদ্র জগতের ভেতর কাজ করে। যেমন পরমাণু।

১ বিলিয়নের মধ্যে মাত্র একটা ইলেকট্রন কণা বেঁচে যাচ্ছিল।

কিন্তু ধ্বংস হয়ে গেল বাকি সব কটি।

মহাবিশ্বের তাপমাত্রা এরপর নেমে গেল মাত্র এক শ মিলিয়ন কেলভিনে। কিন্তু তারপরও সেটা ছিল সূর্যপৃষ্ঠের চেয়েও অনেক

অনেক গরম।

পরস্পরের সঙ্গে ফিউজ হতে লাগল বড় কণাগুলো। অর্থাৎ কণাগুলো পরস্পর পারমাণবিকভাবে জোড়া লেগে একত্র হতে লাগল। বর্তমানে আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্ব যেসব পরমাণু দিয়ে গঠিত, তার মৌলিক উপাদানগুলো একত্র হলো এভাবে। অর্থাৎ নক্ষত্র, গ্রহ, তোমার জানালার বাইরের গাছপালা বা বাড়িঘর, তোমার বন্ধুর মোজা, আমার গোঁফ—যেসব পরমাণু দিয়ে গঠিত, তার মৌলিক উপাদানের কথা বলছি। প্রোটনগুলো অন্য সব প্রোটন ও নিউট্রনের সঙ্গে জোড়া লাগতে শুরু করল। এভাবে একসময় গঠিত হলো পরমাণুর কেন্দ্র। একেই বলা হয় পরমাণুর নিউক্লিয়াস।

*

মহাবিশ্ব শুরুর পর এতক্ষণে দুই মিনিট পেরিয়ে গেছে।

*

সাধারণত প্রোটন ও নিউক্লিয়াসের প্রতি আকর্ষিত হবে মহাবিশ্বজুড়ে ঘুরে বেড়ানো ইলেকট্রনগুলো। ইলেকট্রনের চার্জ ঋণাত্মক বা নেগেটিভ। অন্যদিকে প্রোটন ও নিউক্লিওয়ের চার্জ ধনাত্মক বা পজিটিভ। আর জানোই তো বিপরীত চার্জ পরস্পরকে আকর্ষণ করে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তাদের চার্জ ধনাত্মক আর ঋণাত্মক কেন? আবার তুমি এটাও জিজ্ঞেস করতে পারো, বিপরীত চার্জ পরস্পরকে আকর্ষণ করে কেন?

এর উত্তরে বলতে হয়, এটাই নিয়ম। তাদের আচরণ আসলে এ রকমই।

আমার ইচ্ছা করছে, এর চেয়ে ভালো কোনো উত্তর দিই তোমাকে। কিন্তু মহাবিশ্ব আমাদের জন্য বোধগম্য হয়ে উঠবে এ রকম কোনো বাধ্যবাধকতা তার নেই। আমি যেটা বলতে পারি, সেটা হলো, বহু বহু বছরের বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে এই দুই ধারণা গড়ে উঠেছে।

এখন হয়তো ভাবতে পারো, পরস্পর আকর্ষণ করলে, তারা একে অপরের সঙ্গে লেগে যাবে বা সংযুক্ত হবে। কিন্তু কয়েক হাজার বছর ধরে মহাবিশ্ব এতই উত্তপ্ত ছিল যে তারা এভাবে একত্র হয়ে উঠতে পারেনি। ইলেকট্রন মুক্তভাবে চলাফেরা করেছে, সামনে-পেছনে বা এদিক-ওদিক ছুড়ে দিয়েছে ফোটনকে। মুক্ত ইলেকট্রন আসলে ফোটনকে নিয়ে এরকম খেলতে পছন্দ করে।

তবে মহাবিশ্বের তাপমাত্রা ৩ হাজার কেলভিনের নিচে নেমে আসার পর এই অবস্থার সমাপ্তি হয়। তিন হাজার কেলভিন মানে আমাদের সূর্যপৃষ্ঠের প্রায় অর্ধেক তাপমাত্রা। ফলে মুক্ত ইলেকট্রনগুলো ওই সব ধনাত্মক চার্জবাহী প্রোটনের সঙ্গে একত্র হতে থাকে। তারা একত্র হওয়ার পর মহাবিশ্ব পাড়ি দিতে শুরু করল সব ফোটন। এই অক্ষত ফোটন বা আলোকে বিজ্ঞানীরা এখন শনাক্ত করতে পারেন। এ বিষয়ে তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা আরও কথা বলব।

চার্জ কী?
প্রতিটি মানুষের বিভিন্ন রকম গুণ বা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আমাদের কেউ হয়তো দয়ালু বা দানশীল। আর কেউ হয়তো মোটেও বন্ধুসুলভ নয়। এসব ধর্ম তাদের সম্পর্কে আমাদের বুঝতে সহায়তা করে। চার্জ বা আধানও হলো বস্তু বা পদার্থের অন্যতম মৌলিক ধর্ম। কিছু কণার পজিটিভ বা ধনাত্মক চার্জ থাকে। যেমন প্রোটন। আবার কিছু কণার চার্জ হয় ঋণাত্মক বা নেগেটিভ। এ ছাড়া কিছু কণার কোনো চার্জই থাকে না। যেমন নিউট্রন। দুটি কণার একই ধরনের চার্জ থাকলে, পরস্পরকে বিকর্ষণ করে বা দূরে সরে যায় তারা। কিন্তু দুটি কণার বিপরীতধর্মী চার্জ থাকলে, তারা পরস্পরকে আকর্ষণ করে। যেমন প্রোটন ও ইলেকট্রন।

*

মহাবিশ্ব শুরুর পর এতক্ষণে ৩৮০ হাজার বছর পেরিয়ে গেছে।

*

এ সময় মহাবিশ্ব এমনভাবে প্রসারিত হচ্ছিল, যেন সেটা এক কখনো না ফাটা বেলুন। মহাবিশ্ব যতই বড় হচ্ছিল, ততই শীতল হচ্ছিল। সময় কাজ শুরু করে মহাকর্ষ। প্রথম কয়েক হাজার বছরে কণাগুলো সব জায়গায় দৌড়াদৌড়ি বা ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছিল কিন্ডারগার্টেনের বাচ্চাদের খেলার মাঠে ছেড়ে দিলে যে অবস্থা দাঁড়ায়, এসব কণার অবস্থাও ছিল সে রকম। এ সময় মহাকর্ষ এসব কণাকে একত্রে টানতে শুরু করে মহাজাগতিক বিভিন্ন শহরে। মহাবিশ্বের এই শহরগুলোকে বলা হয় গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ।

এভাবে প্রায় এক শ বিলিয়ন গ্যালাক্সি গঠিত হলো।

প্রতিটি গ্যালাক্সিতে নক্ষত্র বা তারার সংখ্যা ছিল কয়েক শ বিলিয়ন। এসব নক্ষত্রের কাজকারবার ছিল অনেকটা রান্নাঘরের প্রেশার কুকারের মতো। এরা অতিক্ষুদ্র কণাগুলোকে একত্র করে বড় থেকে আরও বড় মৌল গঠন করতে বাধ্য করছিল। বড় নক্ষত্রগুলো উৎপাদন করছিল অনেক বেশি তাপ ও চাপ। সে কারণে সেখানে গঠিত হতে পেরেছিল লোহার মতো ভারী মৌল। দানবীয় এসব নক্ষত্রের ভেতরে তৈরি হওয়া মৌলগুলো সেখানেই থেকে গেলে তা আসলে অনর্থক হতো। কিন্তু এই নক্ষত্রগুলো ছিল অস্থিতিশীল। তাই তারা একসময় বিস্ফোরিত হয়ে তাদের ভেতরের মৌলগুলোকে ছায়াপথের চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেয়।

টেলিস্কোপে তোলা আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রের ছবি। এই গ্যালাক্সিকে বাংলায় বলা হয় আকাশগঙ্গা ছায়াপথ। এতে হাজার হাজার নক্ষত্র দেখা যাচ্ছে।
টেলিস্কোপে তোলা আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রের ছবি। এই গ্যালাক্সিকে বাংলায় বলা হয় আকাশগঙ্গা ছায়াপথ। এতে হাজার হাজার নক্ষত্র দেখা যাচ্ছে।

মহাবিশ্বের সূচনা হওয়ার ৯ বিলিয়ন বছর পর, মহাবিশ্বের গড়পড়তা একটা অংশে একটা গড়পড়তা ছায়াপথে জন্ম নেয় একটা গড়পড়তা সাধারণ নক্ষত্র। সেটা ছিল আমাদের সূর্য।

কিন্তু সেটা গঠিত হলো কীভাবে? কণা আর ভারী মৌল দিয়ে ঠাসাঠাসি বিপুল পরিমাণ গ্যাসীয় মেঘ মহাকর্ষের টানে ধীরে ধীরে পুঞ্জীভূত হতে থাকে। ওই সব কণা ও ভারী মৌলের মধ্যে ছিল অতিরিক্ত প্রোটন ও নিউট্রন। সেগুলো একে অপরকে কেন্দ্র করে ঘুরতে শুরু করলে, মহাকর্ষ তাদেরকে পরস্পরের আরও কাছে আসতে বাধ্য করে। এভাবে তারা পরস্পরের সংঘর্ষের মুখে পড়ে এবং জোড়া লেগে একত্র হয়।

মৌল কী?
মহাবিশ্বের সর্বমোট জানা মৌলের সংখ্যা ১১৮। এদের প্রতিটি মাত্র এক ধরনের পরমাণু থেকে তৈরি হয়েছে। প্রতিটি মৌলের মধ্যে প্ৰধান পার্থক্য হলো তাদের কেন্দ্রে থাকা প্রোটনসংখ্যায়। হাইড্রোজেনের কেন্দ্রে প্রোটনসংখ্যা মাত্র একটি। এটিই মহাবিশ্বের সবচেয়ে সাধারণ মৌল। একটা হাইড্রোজেন পরমাণুতে আরও একটা প্রোটন যোগ করা হলে তুমি শেষ পর্যন্ত নতুন একটা মৌল পাবে। নতুন সেই মৌলটিকে বলা হবে হিলিয়াম।

একবার সূর্য জন্ম নেওয়ার পরও এই গ্যাসীয় মেঘের ভেতর অবশিষ্ট ছিল প্রচুর পরিমাণে মহাজাগতিক উপাদান। এই গ্যাসীয় মেঘ থেকে বেশ কয়েকটি গ্রহ ও উল্কা নামের হাজার হাজার মহাকাশীয় পাথর তৈরি হওয়ার মতো যথেষ্ট পদার্থ ছিল। আরও ছিল কোটি কোটি ধূমকেতু তৈরি হওয়ার মতো যথেষ্ট পদার্থ। এগুলো তৈরি হওয়ার পরও আরও পদার্থ অবশিষ্ট ছিল সেখানে। অন্য সব মহাজাগতিক বস্তুর দিকে সজোরে ছুটে গিয়েছিল এই পথভ্রষ্ট আবর্জনা।

এর ফলে যে সংঘর্ষ হলো, তা খুবই শক্তিশালী ছিল। এ সংঘর্ষের কারণে গলে গেল পাথুরে গ্রহগুলোর পৃষ্ঠতল।

সৌরজগতের চারপাশে এসব আবর্জনার পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে এসব প্রভাবও কমে গেল। তাতে গ্রহদের পৃষ্ঠতলও শীতল হতে শুরু করে। পৃথিবী এমন জায়গায় গড়ে ওঠে, যাকে সূর্যের চারপাশে আমরা গোল্ডিলকস জোন বলি। তোমার হয়তো মনে আছে, গোল্ডিলকস কখনো খুব বেশি গরম বা খুব বেশি ঠান্ডা পরিজ খেতে পছন্দ করত না। একইভাবে পৃথিবীও সৌরজগতের এমন এক জায়গায় অবস্থিত, যাকে বলা হয় সূর্য থেকে একেবারে যথার্থ দূরত্ব। পৃথিবী যদি সূর্যের খুব কাছে হতো, তাহলে সাগর-মহাসাগরের সব পানি বাষ্পীভূত হয়ে উবে যেত। আবার সূর্য থেকে বেশি দূরে থাকলেও জমে বরফ হয়ে যেত সাগর-মহাসাগরের সব পানি।

পৃথিবীর ৭০০ কিলোমিটার ওপর থেকে তোলা ছবি। ভূপৃষ্ঠ দেখেই বোঝা যাচ্ছে আমাদের পৃথিবীকে কেন নীলচে গ্রহ বলা হয়।
পৃথিবীর ৭০০ কিলোমিটার ওপর থেকে তোলা ছবি। ভূপৃষ্ঠ দেখেই বোঝা যাচ্ছে আমাদের পৃথিবীকে কেন নীলচে গ্রহ বলা হয়।

সেটি ঘটলে পৃথিবীতে আমাদের চেনাজানা জীবনের উদ্ভব কখনো হতো না।

তাহলে এই বইটি পড়ার জন্য তুমিও কখনো এখানে থাকতে না।

মহাবিশ্ব শুরুর পর এতক্ষণে ৯ বিলিয়ন বছর পেরিয়ে গেছে।

এ সময় আমাদের তরুণ ও উত্তপ্ত গ্রহের পাথরগুলোর ভেতরে আটকে পড়া পানি বাষ্পীভূত হয়ে আকাশে ওঠে গেল। তা ছাড়া ক্রমেই শীতল হচ্ছিল পৃথিবী। ফলে ঘনীভূত হয়ে উঠল এই পানি। তারপর বৃষ্টি হয়ে নিচে নেমে এল। এভাবেই একসময় গড়ে উঠল সাগর-মহাসাগর। এই মহাসাগরেই কোনো এক কারণে সরল অণুগুলো একত্র হয়ে প্রাণে রূপ নিল। সেই কারণটা আমাদের কাছে এখনো অজানা।

মানুষ বায়ুজীবী প্রাণী। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেনসমৃদ্ধ বাতাস দরকার। কিন্তু আদিম মহাসাগরে আধিপত্য বিস্তার করেছিল অবায়ুজীবী ব্যাকটেরিয়া। এই আণুবীক্ষণিক গঠনের প্রাণের বেঁচে থাকার জন্য কোনো অক্সিজেনের দরকার হয়নি। সৌভাগ্য যে এসব অবায়ুজীবী ব্যাকটেরিয়া অক্সিজেন নিঃসরণ করেছিল। বাতাসে মানুষের বেঁচে থাকার উপযোগী উপাদানের জোগান দিয়েছিল আসলে এরাই। অক্সিজেনসমৃদ্ধ এই নতুন বায়ুমণ্ডল আরও জটিল থেকে জটিলতর প্রাণের উদ্ভবের সুযোগ করে দিল।

কিন্তু জীবন নিতান্তই পলকা। মাঝে মাঝে মহাকাশ থেকে আমাদের গ্রহে আছড়ে পড়ত বড় ধরনের ধূমকেতু ও গ্রহাণু। তাতে নিমেষেই বড় ধরনের ওলট-পালট হয়ে যেত।

৬৫ মিলিয়ন বছর আগে, ১০ ট্রিলিয়ন টন ওজনের একটা গ্রহাণু আঘাত হেনেছিল পৃথিবীতে। সেই জায়গাটি মেক্সিকোর ইউকাটান উপদ্বীপে অবস্থিত। মহাকাশ থেকে আসা ওই পাথরটা ভূপৃষ্ঠে যে খাদের সৃষ্টি করেছিল, তা প্রায় ১১০ মাইল প্রশস্ত এবং ১২ মাইল গভীর। এই গ্রহাণুর আঘাতের ফলে ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রচুর ধুলো ও ধ্বংসাবশেষ বায়ুমণ্ডলে মিশে গেল। এতে স্রেফ বিলুপ্ত হয়ে গেল পৃথিবীর বেশির ভাগ প্রাণী। এর মধ্যে রয়েছে বিখ্যাত বিশালদেহী ডাইনোসর।

বিলুপ্তি। মানে জীবজন্তু বা প্রাণের কোনো রূপের অস্তিত্বের চরম সমাপ্তি। এই বিপর্যয় আমাদের স্তন্যপায়ী আদিপুরুষকে সমৃদ্ধ করেছিল। তখন আর তাদের টি-রেক্সের সকালের নাশতা হতে হলো না। এই স্তন্যপায়ী দলের মধ্যে বড় মস্তিষ্কধারী একটা দলকে বলা হয় প্রাইমেট। তাদের থেকেই একসময় হোমো সেপিয়েন্স নামের প্রজাতির উদ্ভব হয়। তারা নতুন কৌশল উদ্ভাবন ও বিজ্ঞানের যন্ত্রপাতি বানাতে যথেষ্ট চৌকস। আবার মহাবিশ্বের জন্ম ও বিবর্তন সম্পর্কেও আবিষ্কার করতে পেরেছে তারা।

এই প্রাণীটিই হলাম আমরা।

*

মহাবিস্ফোরণের আগে কী ঘটেছিল?

*

এ ব্যাপারে অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্টদের কোনো ধারণা নেই। কিংবা এই প্রশ্নের জন্য আমাদের সবচেয়ে সৃজনশীল উত্তরে পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের ভিত্তি খুবই সামান্য বা একেবারেই কোনো ভিত্তি নেই। অন্য কথায়, আমরা সেগুলোকে কখনো প্রমাণ করতে পারব না। এর প্রতিক্রিয়ায় অনেকে জোর দিয়ে বলেন, কিছু একটা অবশ্যই শুরু করেছিল। সেটা এমন কোনো শক্তি, যা অন্য সবকিছুর চেয়ে বৃহত্তর। সেই উৎস থেকেই সবকিছু এসেছে। এসব মানুষের ধারণায় এই কিছু একটা হলো অবশ্যই ঈশ্বর।

কিন্তু মহাবিশ্ব যদি চিরন্তন হয়? অর্থাৎ এমন কোনো অবস্থা, যা আমরা এখনো শনাক্ত করতে পারিনি, যেমন হতে পারে মাল্টিভার্স, যা ক্রমান্বয়ে নতুন নতুন মহাবিশ্ব তৈরি করে, তাহলে?

কিংবা মহাবিশ্ব যদি একেবারে শূন্য থেকে হুট করে উদয় হয়ে থাকে, তাহলে?

কিংবা আমরা যেসব বিষয় জানি ও ভালোবাসি, সেগুলো যদি কোনো সুপারইন্টেলিজেন্ট এলিয়েন প্রজাতির তৈরি করা কোনো কম্পিউটার গেম হয়, তাহলে?

এসব প্রশ্ন সাধারণত কাউকে সন্তুষ্ট করতে পারে না। অবশ্য এসব প্রশ্ন আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে অজ্ঞতা বা অজানা হলো গবেষক বিজ্ঞানীদের মনের একটা প্রাকৃতিক অবস্থা। স্মার্ট তরুণেরা প্রায়ই ‘আমি জানি না’ এই কথাটি বলতে অপছন্দ করে। কিন্তু বিজ্ঞানীদের অবশ্যই সব সময়ই বলতে হয়, আমরা কী কী জানি না। যারা বিশ্বাস করে যে তারা সবকিছু জানে, তারা আসলে মহাবিশ্বের জানা ও অজানার মাঝখানের সীমানা খোঁজে না, কিংবা সেখানে হোঁচটও খায় না।

পরের অধ্যায়গুলোতে আমি তোমাদের সেই জায়গাতেই নিয়ে যাওয়ার আশা করছি। আমরা নিশ্চিতভাবে জানি যে মহাবিশ্বের একটা সূচনা ছিল। এটাও জানি, মহাবিশ্ব পরিবর্তন হতে শুরু করেছিল এবং ধীরে ধীরে তা বিবর্তিত হয়েছে।

আমরা আরও জানি, তোমার দেহের প্রতিটি পরমাণুর জন্মরহস্যের ইতিহাস ধরে মহাবিস্ফোরণ পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব। এসব পরমাণুর জন্ম বিশাল বিশাল সব নক্ষত্রের চুল্লিতে। পাঁচ বিলিয়ন বা পাঁচ হাজার কোটি বছর আগে ছায়াপথগুলোর ভেতরে এসব নক্ষত্রের যাত্রা শুরু হয়েছিল।

আমরা হলাম নক্ষত্রের জীবন্ত ধূলিকণা।

মহাবিশ্ব আমাদের নিজেকে আবিষ্কার করার ক্ষমতা দিয়েছে। আর সেই আবিষ্কার আমরা সবে শুরু করলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *