বিশ্ব গোলাকার কেন

৮. বিশ্ব গোলাকার কেন

হ্যামবার্গারে প্রতিবার কামড় দিতে গেলে আমার মনে ভেসে ওঠে শনি গ্রহের কথা। অবশ্য বলা বাহুল্য, এই খাবারের সঙ্গে গ্রহসংক্রান্ত কোনো বিষয়ের সম্পর্ক নেই। কিন্তু বার্গারের আকৃতি এবং বিশেষ করে তার ওপরের বানটি মহাজাগতিক। এটাই আমাকে মনে করিয়ে দেয় যে গোলক নামের নিখুঁত গোল বলের আকৃতি কতটা ভালোবাসে আমাদের মহাবিশ্ব। আবার এসব বৃত্তাকার বস্তুগুলো ঘোরার সময় কীভাবে বদলে যায়, সেটাও মনে পড়ে আমার।

যেমন শনি গ্রহ। এই জাম্বো গ্রহটি পৃথিবীর চেয়েও দ্রুতবেগে ঘোরে। পৃথিবীতে তোমার দিন ২৪ ঘণ্টা লম্বা। কারণ, আমাদের গ্রহটা এক পাক ঘুরে একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে আসতে ২৪ ঘণ্টা সময় লাগে। সেই বিন্দুটি হতে পারে, তুমি এ মুহূর্তে যেখানে বসে বা দাঁড়িয়ে আছ সেটিই। পৃথিবী তার বিষুবরেখা বা নিরক্ষীয় অঞ্চলে যেকোনো কিছু ঘণ্টায় ১০০০ মাইল বেগে বহন করতে পারে। বিষুবরেখা হলো গ্রহটির মধ্যরেখা। এটি শুনতে বেশ দ্রুতগতির বলে মনে হয়। কারণ, একটা বিমান সাধারণত ঘণ্টায় প্রায় ৫৫০ মাইল বেগে ছোটে। তবে এই দুই গতির কোনোটার সঙ্গেই শনি গ্রহের গতির তুলনা চলে না। আমার দ্বিতীয় প্রিয় এই গ্রহটি এক দিন বা এক পাক ঘূর্ণন সম্পূর্ণ করে মাত্র সাড়ে ১০ ঘণ্টায়। আবার পৃথিবীর চেয়ে শনি গ্রহ অনেক অনেক বড়। কাজেই সঠিক সময়ে এই ঘূর্ণন সম্পূর্ণ করতে শনি গ্রহের বিষুবরেখাকে ছুটতে হয় ঘণ্টায় ২২ হাজার মাইল বেগে।

আমার দ্বিতীয় প্রিয় গ্রহ শনিকে দেখো! শনির এক দিনের দৈর্ঘ্য মাত্র সাড়ে ১০ ঘণ্টা।
আমার দ্বিতীয় প্রিয় গ্রহ শনিকে দেখো! শনির এক দিনের দৈর্ঘ্য মাত্র সাড়ে ১০ ঘণ্টা।

আমাদের গ্রহটি অত জোরে ঘুরলে তোমাকে স্কুলে থাকতে হতো মাত্র ২০ মিনিট। কিন্তু এখুনি খুশি হয়ো না। তাতে ঝামেলাও আছে। কারণ, তখন গরমের ছুটিও হয়ে যেত অনেক ছোট।

যেসব বস্তু দ্রুতবেগে ঘোরে, সেগুলো চ্যাপ্টা হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। যেমন পৃথিবী পুরোপুরি গোলকীয় নয়। আমাদের পৃথিবী উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত বিস্তৃত একটা কাল্পনিক রেখার চারপাশে ঘোরে। এই কাল্পনিক রেখা বরাবর এক মেরু থেকে আরেক মেরু পর্যন্ত দূরত্ব গ্রহটির বিষুবরেখা বরাবর এক পাশ থেকে আরেক পাশ পর্যন্ত দূরত্বের চেয়ে ছোট। অন্য কথায়, মেরুর দিকে পৃথিবী কিছুটা চ্যাপ্টা। আর এই পার্থক্যটা হলো প্রায় ২৬ মাইলের।

সান্তার কেন ইকুয়েডরে ছুটি কাটানো উচিত
পৃথিবী যদি বর্তমানের চেয়ে আর মাত্র ১৬ গুণ বেশি জোরে ঘুরত, তাহলে সেন্ট্রিফিউগাল ফোর্স বা কেন্দ্র থেকে বাইরে দিকের বল বিষুবরেখার সবকিছুকে ওজনহীন করে ফেলত। (সেন্ট্রিফিউগাল ফোর্স বা কেন্দ্রবিমুখী বল হলো নাগরদোলায় যে বলটি রাইডারকে বাইরের দিকে ঠেলে দেয় বা একটা বালতিতে পানি নিয়ে বৃত্তকারের ঘোরাতে থাকলে যে বলের কারণে পানি বালতিতে থেকে যায়)। এমনকি পৃথিবীর বর্তমানের আবর্তন বেগের কারণে সান্তা ক্লজের ওজন উত্তর মেরুর চেয়ে বিষুবরেখায় এক পাউন্ড কম হবে। কারণ, উত্তর মেরুতে কেন্দ্রবিমুখী বলের কোনো প্রভাব নেই। ছুটি কাটানোর সময় সবাই একটু বেশি ভালো থাকতে চায়। কাজেই তুমি যদি অসময়ে সান্তা ক্লজকে খুঁজে বের করতে চাও, তাহলে সেখান থেকেই শুরু করা ভালো।
টুকরো তথ্য
চ্যাপ্টা গোলককে বলা হয় অবলেট স্পেরোয়েড বা দুই প্রান্ত চাপা গোলকীয়। পৃথিবী এ রকম দুই প্রান্ত চাপা গোলক। শনি গ্রহও তা-ই।

কোনো বস্তু যত জোরে ঘোরে, সেটি ততই চ্যাপ্টা হতে থাকে। এই ব্যাপারটাই আমাকে হ্যামবার্গারের কাছে ফিরিয়ে আনে। শনি গ্রহ যেহেতু ঘণ্টায় ২২ হাজার মাইল বেগে ঘোরে, তাই গ্রহটির মাঝখানের চেয়ে এর মেরু থেকে মেরুতে পুরোপুরি ১০ শতাংশ চ্যাপ্টা। এই পার্থক্যটা শৌখিন টেলিস্কোপেও ধরা পড়ে। শনি গ্রহ অনেক দূর থেকে একটা নিখুঁত গোলক বলে মনে হয়, যার কেন্দ্রটা বেশ প্রশস্ত ও শীর্ষ বানরুটির মতো চ্যাপ্টা। তাই শনি গ্রহ আসলে অনেকটাই বার্গারের মতো। মহাবিশ্ব গোলক পছন্দ করে। স্ফটিক ও ভাঙা পাথর ছাড়াও মহাবিশ্বের বেশির ভাগই বস্তুর কোণগুলো তীক্ষ্ণ। কিছু কিছু বস্তুর আকৃতি আবার অদ্ভুত। তবু মহাবিশ্বের গোলাকার বস্তুর তালিকা

আসলে গুনে শেষ করা যাবে না। সাধারণ সাবানের ফেনা থেকে শুরু করে গ্যালাক্সি আর এর বাইরের বস্তুও গোলাকার।

অন্যান্য আকৃতির চেয়ে মহাবিশ্বের গোলাকার বস্তুর প্রতি পক্ষপাতিত্ব করার পেছনে রয়েছে কিছু ভৌত আইন। যেমন সারফেস টেনশন বা পৃষ্ঠটান। এই বলটি কোনো বস্তুর পৃষ্ঠতলের উপাদানগুলোকে একত্রে টেনে ধরে। সাবানের ফেনা বা বুদের কথা ধরা যাক। সাবানের বুদ্বুদ সাবান আর পানি দিয়ে তৈরি। এর মাঝখানে আটকে থাকে একটা বাতাসের পকেট। সাবানের বুদ যে তরল দিয়ে তৈরি হয় তার পৃষ্ঠটান বাতাসকে চেপে ধরে চারদিক থেকে। এই বুদ্বুদ গঠিত হয় খুব অল্প সময়ের মধ্যে। সর্বনিম্ন সম্ভাব্য পৃষ্ঠ আয়তনে এটি ওই বাতাসকে আটকে ফেলে। ফলে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ শক্তিশালী বুদ্বুদ গঠিত হয়। কারণ, সাবানময় আবরণটি তার প্রয়োজনের চেয়ে আর পাতলা হয়ে বিস্তৃত হতে পারে না। আর একটা আবদ্ধ জায়গার জন্য সর্বনিম্ন পৃষ্ঠ আয়তনের আকৃতি হয়ে ওঠে নিখুঁত এক গোলক।

আসলে সুপার মার্কেটের সব ধরনের বাক্স আর খাবারের প্যাকেট যদি গোলকীয় হতো, তাহলে প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়ালের পেছনে বছরে কয়েক বিলিয়ন ডলার ব্যয় কমানো যেত। চেরিয়োসের সুপার-জাম্বো বক্সগুলোর উপাদান একটা গোলকীয় কার্টনে খুব সহজে আঁটানো সম্ভব। সে জন্য এই কার্টনের ব্যাসার্ধ হতে হবে সাড়ে চার ইঞ্চি। কিন্তু খাবারের প্যাকেট তাক থেকে পড়ে গড়াতে থাকবে, আর তার পিছু পিছু দৌড়াতে হবে—এমনটি আসলে কেউই চায় না।

কোনো আবর্তনশীল স্পেস স্টেশনে সবকিছুই ওজনহীন থাকে। কারণ, মহাকর্ষের অভাব (মহাকর্ষ শূন্য নয়)। সেখানে তুমি যদি সামান্য গলিত বা কোনো তরল ধাতু বের করে দাও, তাহলে সেগুলো ছোট পুঁথির মতো ভেসে বেড়াবে। সেগুলো ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার পর শক্ত হতে শুরু করে এবং পৃষ্ঠটানের কারণে পরম নিখুঁত গোলকে পরিণত হয়।

*

গ্রহ ও নক্ষত্রদের মতো বড় ধরনের মহাজাগতিক বস্তুর জন্য পৃষ্ঠটানের গুরুত্ব কম। এসব বস্তুকে গোলকে পরিণত করে শক্তি ও মহাকর্ষ। মহাকর্ষ শুধু গাছ থেকে আপেলই টেনে নামায় না, কিংবা শুধু স্থানকে বাঁকিয়ে দেয় না, এই বল পদার্থকে চুপসে দেওয়ার চেষ্টা করে সব দিকে। পদার্থকে এভাবে সংকুচিত করে ছোট থেকে আরও ছোট স্থানে চুপসে দেয়। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় সব সময় মহাকর্ষ জয়ী হয় না। কঠিন বস্তুর রাসায়নিক বন্ধন বেশ শক্তিশালী। হিমালয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পর্বতশ্রেণি। আমাদের ভূপৃষ্ঠের শক্তিশালী পাথরের কারণে এই পর্বতশ্রেণি মহাকর্ষের বিরুদ্ধে বেড়ে উঠেছে।

হিমালয় পৃথিবীর বৃহত্তম পর্বতশ্রেণি। এটি এর চেয়ে লম্বা হতে পারবে না। কারণ, মহাকর্ষ তাকে নিচের দিকে টেনে রাখে।
হিমালয় পৃথিবীর বৃহত্তম পর্বতশ্রেণি। এটি এর চেয়ে লম্বা হতে পারবে না। কারণ, মহাকর্ষ তাকে নিচের দিকে টেনে রাখে।
আমাদের পৃথিবীতে উঁচু চূড়া এবং নিচু উপত্যকা আছে সত্যি, কিন্তু মহাকাশ থেকে দেখলে আমাদের গ্রহটাকে একটা নিখুঁত সমতল গোলক বলে মনে হয়।
আমাদের পৃথিবীতে উঁচু চূড়া এবং নিচু উপত্যকা আছে সত্যি, কিন্তু মহাকাশ থেকে দেখলে আমাদের গ্রহটাকে একটা নিখুঁত সমতল গোলক বলে মনে হয়।

পৃথিবীর শক্তিশালী পাহাড়-পর্বত নিয়ে উত্তেজিত হওয়ার আগে তোমার জানা দরকার যে অন্যান্য গ্রহের সঙ্গে তুলনা করলে পৃথিবীপৃষ্ঠকে প্রায় সমতলই বলা চলে। অতিক্ষুদ্র মানুষ হিমালয়ে হাইকিং করে। আমাদের কাছে পাহাড়-পর্বতগুলো আসলে দানবাকৃতির বলে মনে হয়। আমার মতো যারা শহুরে বালক, তাদের কাছে বড় একটা পাহাড়কেও অনেক বিশাল বলে মনে হবে। তুমি হয়তো ভাবতে পারো, এই বড় বড় পাহাড়-পর্বতের কারণে অনেক দূর থেকে দেখলে পৃথিবীকেও স্ফীত দেখা যাওয়ার কথা। একটা মহাজাগতিক বস্তু হিসেবে পৃথিবী লক্ষণীয়ভাবে মসৃণ। তোমার কাছে যদি একটা সুপারডুপার, জাম্বো সাইজের আঙুল থাকে এবং তুমি যদি পৃথিবীর (মহাসাগরসহ সবকিছুর) উপরিভাগজুড়ে আঙুলটা টেনে নিয়ে যাও, তাহলে পৃথিবীকে মনে হবে পুল গেমের বোর্ডের মতো মসৃণ। গ্লোবগুলোতে পৃথিবীর পর্বতশ্রেণিকে যে রকম উঁচু দেখানো হয়, বাস্তবে তা আসলে অতিরঞ্জিত। পৃথিবীর পর্বত ও উপত্যকা থাকা সত্ত্বেও এবং এক মেরু থেকে আরেক মেরুতে কিছুটা চ্যাপ্টা হলেও মহাকাশ থেকে পৃথিবীকে নিখুঁত গোলক বলে মনে হয়।

সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহের পর্বতের সঙ্গে তুলনা করলে পৃথিবীর পর্বতমালাগুলোকে পুঁচকে বলা যায়। সৌরজগতের সবচেয়ে উঁচু পর্বত আছে মঙ্গল গ্রহে। তার নাম অলিম্পাস মনস। এর উচ্চতা ৬৫ হাজার ফুট এবং ৩০০ মাইল এলাকাজুড়ে এর ভিত্তি বিস্তৃত। অলিম্পাস মনসের কাছে আলাস্কার মাউন্ট ম্যাককিনলিকে একটা ইঁদুরের গর্তের মতো মনে হবে। এমনকি মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতাও এর অর্ধেকেরও কম।

কেমন অন্যায্য, তাই না? তাহলে মার্শিয়ান বা মঙ্গলবাসীরা কত ভাগ্যবান? মহাজাগতিক পর্বত তৈরির রেসিপি খুব সরল। সেটা হলো : কোনো বস্তুর পৃষ্ঠে মহাকর্ষ যত দুর্বল হবে, তার পাহাড়- পর্বতগুলো হবে তত উঁচু। পৃথিবীতে একটা পর্বতের ওজনে তার নিচের পাথরের স্তর ভেঙে যাওয়ার আগপর্যন্ত পর্বতটা যতটা উঁচু হওয়া সম্ভব, মাউন্ট এভারেস্ট ঠিক ততটাই উঁচু হতে পেরেছে। এর চেয়ে বেশি উঁচু হলে মহাকর্ষ তাকে টেনে নিচে নামিয়ে আনত।

অন্যদিকে মঙ্গল গ্রহের মহাকর্ষ পৃথিবীর চেয়ে অনেক কম। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া ৭০ পাউন্ডের কোনো শিক্ষার্থীর ওজন মঙ্গল গ্রহে গিয়ে হবে মাত্র ২৬ পাউন্ড। কারণ, সেখানে মহাকর্ষের পরিমাণ কম। তাই পাহাড়-পর্বতও অনেক উঁচু হতে পারে ওই গ্রহে। সে কারণেই মঙ্গলে অলিম্পাস মনসের উচ্চতা এত বেশি।

*

মেঘমুক্ত স্বচ্ছ রাতের আকাশ খচিত থাকে তারায় তারায়। তারা বা নক্ষত্ররা আসলে আকারে অনেক বড়, ভারী গ্যাসের পিণ্ড। এদের গঠনও প্রায় নিখুঁত গোলক। সে জন্য ধন্যবাদ মহাকর্ষকে। কিন্তু কোনো নক্ষত্র যদি আরেকটা অতি শক্তিশালী মহাকর্ষধারী বস্তুর কাছাকাছি চলে আসে, তাহলে অন্য বস্তুটা নক্ষত্রটার কিছু পদার্থ ছিনিয়ে নিতে শুরু করে। বাইনারি স্টার বা যুগল নক্ষত্রদের ক্ষেত্রে এটা সাধারণ একটা ঘটনা। এই নক্ষত্র জোড়া পরস্পরের সঙ্গে মহাকর্ষের মাধ্যমে আবদ্ধ থাকে। বিশেষ করে এদের একটা বিশালাকৃতির মৃতপ্রায় নক্ষত্র হলে এভাবে আটকে থাকে সেগুলো। এই মৃতপ্রায় নক্ষত্রটিকে বলা হয় রেড জায়ান্ট বা লাল দানব। এই জোড়ার আরেকটি নক্ষত্র লাল দানব নক্ষত্র থেকে পদার্থ শুষে নিতে থাকে। এতে মৃতপ্রায় নক্ষত্রটির আকার বিকৃত হয়ে যায়। এর একদিক এমনভাবে প্রলম্বিত বা টান খেয়ে লম্বা হয়ে যায় যে তাকে দেখতে মনে হয় অনেকটা হার্সির কিসের মতো। (হার্সির কিস একধরনের মিল্ক চকলেট।)

শিল্পীর কল্পনায় একটা বাইনারি সিস্টেমে ঘূর্ণমান নিউট্রন স্টার তার মৃতপ্রায় প্রতিবেশীর কাছ থেকে পদার্থ শুষে নিচ্ছে। মৃতপ্রায় প্রতিবেশীটি হলো উজ্জ্বল লাল দানব।
শিল্পীর কল্পনায় একটা বাইনারি সিস্টেমে ঘূর্ণমান নিউট্রন স্টার তার মৃতপ্রায় প্রতিবেশীর কাছ থেকে পদার্থ শুষে নিচ্ছে। মৃতপ্রায় প্রতিবেশীটি হলো উজ্জ্বল লাল দানব।

*

এখন আমরা একটু অদ্ভুত হয়ে যাব।

কল্পনা করা যাক, একটা চ্যাপস্টিকের টিউবে প্রায় এক শ মিলিয়ন হাতি ভরা হয়েছে। এই ঘনত্বে পৌঁছাতে চাইলে, তোমাকে অবশ্যই কিছু কঠিন কাজ করতে হবে। পরমাণুর ভেতরের কেন্দ্রে প্রোটন, নিউট্রন থাকে ঠাসাঠাসি অবস্থায়। ওই কেন্দ্রের চারপাশের কক্ষপথে ঘুরপাক খায় ইলেকট্রন। ঘূর্ণনরত ইলেকট্রন আর পরমাণুর ঠাসাঠাসি কেন্দ্রের মাঝখানে থাকে খালি জায়গা। অতগুলো হাতি পিষে একটা লিপ বামের পাত্রে আঁটাতে চাইলে তোমাকে অবশ্যই সব কটি পরমাণুর কেন্দ্র আর ইলেকট্রনের মাঝখানের এই ফাঁকা জায়গা সংকুচিত করতে হবে। সেটা করতে গেলে প্রায় ঋণাত্মক চার্জের সব ইলেকট্রন ধনাত্মক চার্জের প্রোটনের ওপর ভেঙে পড়বে। আর চার্জ নিরপেক্ষ নিউট্রনের একটা বল তৈরি হবে।

পরমাণুর কেন্দ্রে ঠাসাঠাসি অবস্থায় থাকে প্রোটন ও নিউট্রন। অন্যদিকে এই কেন্দ্রের চারপাশে ঘুরপাক খায় ইলেকট্রন।
পরমাণুর কেন্দ্রে ঠাসাঠাসি অবস্থায় থাকে প্রোটন ও নিউট্রন। অন্যদিকে এই কেন্দ্রের চারপাশে ঘুরপাক খায় ইলেকট্রন।

এবার পালসারের সঙ্গে পরিচিত হও। এটা আমার আরেকটা প্রিয় মহাজাগতিক বস্তু। হাতি নয়, বরং গ্যাসীয় মেঘ থেকে গঠিত হয় পালসার। মহাকাশের এই বস্তুটা ওই লিপ বামের মতোই ঘন এবং এর পৃষ্ঠতলের মহাকর্ষও অনেক শক্তিশালী। কোনো পালসারের ওপর যদি একটা পর্বত গড়ে উঠত, তাহলে সেটার উচ্চতা কোনোভাবেই এ বইটার একটা পাতার চেয়ে বেশি হতে পারত না। কিন্তু মহাকর্ষের কারণে ওই খুদে পর্বতে উঠতেও পৃথিবীর যেকোনো পর্বতে ওঠার চেয়ে তোমার অনেক শক্তির দরকার হতো। পৃথিবীর সঙ্গে তুলনা করলে, এটা একজন পর্বতারোহীর তিন হাজার মাইল উচ্চতার খাড়া শৃঙ্গে ওঠার শামিল।

ভেলা নামের এই পালসারটি একটি নিউট্রন স্টার। হেলিকপ্টারের ব্লেডের চেয়েও এটি দ্রুতগতিতে ঘুরছে।
ভেলা নামের এই পালসারটি একটি নিউট্রন স্টার। হেলিকপ্টারের ব্লেডের চেয়েও এটি দ্রুতগতিতে ঘুরছে।

আমরা আশা করি, পালসারগুলো হবে মহাবিশ্বের সবচেয়ে নিখুঁত আকৃতির গোলক।

*

ক্লাস্টার বা গুচ্ছের মধ্যে সংগঠিত থাকে গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ। আর এসব ক্লাস্টারের আকৃতিও বিভিন্ন রকম হয়। কিছু ক্লাস্টারকে মনে হয় জরাজীর্ণ। অন্য কিছু আঁশের মধ্যে প্রসারিত হয়ে পাতলা হয়ে থাকে। আবার কিছু ক্লাস্টারের গঠন বিশাল চাদরের মতো। কিন্তু কোমা ক্লাস্টার গ্যালাক্সি চমৎকার এক গোলক তৈরি করে। এই ক্লাস্টারের কথা আমরা ডার্ক ম্যাটার অধ্যায়ে আগেই বলেছি।

কোমা ক্লাস্টারকে শিথিল বা রিল্যাক্সড সিস্টেমও বলা হয়। দয়া করে এমন কোনো দৃশ্য ভেবে বোসো না, যেখানে একদল গ্যালাক্সি পেছনে আয়েশ করে হেলান দিয়ে মধুর জ্যাজ সংগীত শুনছে। এখানে আমি রিল্যাক্সিং শব্দটা উল্লেখ করেছি, সেটা অন্য রকম। এর মানে অনেক রকম হতে পারে। যেমন এর ভেতরের গ্যালাক্সিগুলোর গতিবেগ ও দিক গবেষণা করে একটা সিস্টেমের ভর অনুমান করা যায়। সে জন্য সব কটি ভারী বস্তু দেখতে হয় না। এই গ্যালাক্সিগুলো নিয়ে গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা অনুমান করতে পারেন কী পরিমাণ অদৃশ্য বা ডার্ক ম্যাটার ওই সিস্টেমে লুকিয়ে আছে এবং সেই ছায়াপথগুলোর চলাফেরা কীভাবে পরিবর্তিত হয়।

এসব কারণে ডার্ক ম্যাটার অনুসন্ধানের জন্য চমৎকার একটা হাতিয়ার হয়ে উঠেছে রিল্যাক্সড সিস্টেম। এবার আরও জোরালো একটা বিবৃতি দেওয়ার অনুমতি চাই: যদি রিল্যাক্সড সিস্টেম না থাকত, তাহলে আমরা বুঝতে পারতাম না যে মহাবিশ্বের আনাচকানাচে সব জায়গায় ডার্ক ম্যাটার ওত পেতে আছে।

*

সবকিছুর মধ্যে সবচেয়ে বড় আর সবচেয়ে নিখুঁত গোলক হলো, পর্যবেক্ষণকৃত মহাবিশ্ব কিংবা মহাবিশ্বের যে অংশটি আমাদের টেলিস্কোপের মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই।

মহাকাশের যেদিকেই তাকানো হোক না কেন, সেদিকেই দেখা যায় যে গ্যালাক্সিগুলো আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আমাদের কাছ থেকে যে গ্যালাক্সির দূরত্ব যত বেশি, সেটি সরে যাচ্ছে আরও দ্রুতবেগে। আমাদের কাছ থেকে সব দিকেই একটা দূরত্ব আছে, যেখানে বস্তুগুলো আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে প্রায় আলোর কাছাকাছি গতিতে। এই দূরত্বে এবং তার থেকেও দূরের নক্ষত্রের মতো যেসব বস্তু থেকে আলো নিঃসৃত হয়, তা আমাদের কাছে আসার আগেই তাদের শক্তি হারিয়ে ফেলে। প্রসারণশীল মহাবিশ্ব পার হয়ে এই আলো প্রসারিত ও নিষ্প্রভ হয়ে যায়। আর এসব বস্তু থেকে যদি আলো আমাদের কাছে পৌঁছাতে না পারে, তাহলে ওই সব বস্তু আসলে পর্যবেক্ষণ করাও সম্ভব নয়। এই সীমাবদ্ধতার বিস্তৃতি মহাকাশের সব দিকে। কাজেই এরা একটা গোলক গঠন করে।

এই গোলকীয় কিনারার বাইরের মহাবিশ্ব আমাদের কাছে এখনো অদৃশ্য ও অজানা। তবে এই সীমানার ওপারে কী আছে—তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতে কিন্তু তোমার কোনো বাধা নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *